কালো নেকড়ে – ৪

০৪.

 একটু পরেই মির্জাসাহেব এলেন। পরনে সাদা চু-পাঞ্জাবি। রহমত কফি স্ন্যাক্সের ট্রে নিয়ে এল। কফি খেতে খেতে মির্জাসাহেব বললেন, কাদের বখশের মতো ওজনদার মানুষের লাশ কোনো জানোয়ারের পক্ষে অত দূর বয়ে আনা সম্ভব নয়। আপনার এই পয়েন্টটা আমি মানতে পারছি না।

কর্নেল বললেন, ঝোপজঙ্গলের পাতায় রক্তের ছাপ আর মাটিতে বা ঘাসে ভারী কিছু টেনে আনার চিহ্ন তো স্পষ্ট। জানোয়ারটা কালো নেকড়ে হোক বা যা-ই হোক, শক্তিশালী। আপনি তো জানেন, একটা চিতাবাঘ মোষের মতো জন্তুকে টেনে গাছে তুলতে পারে।

মির্জাসাহেব একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু বাই দা দাই, পীরের মাজারে বছর দুই আগে একবার ওইরকম করে কেউ গর্ত খুঁড়েছিল। আপনাকে সে-কথা বলেছি। এলাকায় পুরনো গুজব আছে, ওখানে নাকি সোনার মোহরভরা কলসি পোঁতা আছে। কাজেই গর্ত খোঁড়া নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে রাজি নই।

বলে মির্জাসাহেব হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন, গুপ্তধনের নেশা কোনো কোনো মানুষকে পাগল করে।

আমি বললুম, গতরাতে আমি একটা অদ্ভুত চিৎকার শুনেছি।

মির্জাসাহেব বললেন, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি। কর্নেলকে বলেছি সে-কথা। আমার ধারণা, ওটা কোনো জন্তুর ডাক নয়। ইংরেজিতে নেকড়ের ডাককে হাউল বলা হয়। ডকুমেন্টারি ফিল্মে হাউল শুনেছি। জ্যোৎস্নারাতে নেকড়েরা নাকি ডাকে। কিন্তু আমার কানে ডাকটা মানুষের বলে মনে হয়েছে। কর্নেলকে বলেছি, এই এলাকায় কোথা থেকে একজন পাগলা এসে জুটেছে। সে রাতবিরেতে গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায়। সম্ভবত তারই বদমাইশি। নেকড়ের উৎপাতের কথা শুনে পাগলাটা হয়তো তামাশা করেছে! রহমতকে বলব, তাকে। দেখতে পেলে যেভাবে হোক, আমার কাছে যেন নিয়ে আসে! রহমত! ইধার আও।

রহমত বারান্দায় একটা থামের ওধার থেকে বেরিয়ে এসে কুর্নিশ ঠুকে বলল, জি ছোটেনবাবসাব!

সেই পাগলটাকে যেভাবে হোক তার কাছে ধরে নিয়ে আসার হুকুম দিলেন মির্জাসাহেব। রহমত কথাটা শুনে কাঁচুমাচু মুখে বলল, লেকিন হুজুর, উনহি এক। বুজুর্গ আউলিয়া! হাম আপনা আঁখসে দেখা, উনহি ভুখ লাগনেসে পাত্থরকা টুকরা খা লেতা!

মির্জাসাহেব রেগে গেলেন। ছোড়ো! উজবুককা তারাহ্ বাত করতা তুম। তুম উসকা শাগরিদ বন্ গেয়া মালুম!

জি হুজুর–উনহি কিসিকো বাত নেহি সমঝতা!

ঠিক হ্যায়। হাম রহিমবাবাকো বোলেগা। তুম আপনা কাম করো। ব্রেকফাস্ট ভেজ দো ইহাপর। ইয়ে ট্রে উঠাকে লে যাও।

বেজারমুখে রহমত ট্রে গুছিয়ে নিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হলো।

মির্জাসাহেব বললেন, রহমতের চেয়ে ওর বল্লমটার লাহস বেশি।

বললুম, আচ্ছা মির্জাসাহেব! কালো নেকড়ে হোক বা যে জানোয়ারই হোক, কাদের বখশকে মেরে ফেলেছি। কিন্তু এক পাগলা একা রাতবিরেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে জানোয়ারটা আক্রমণ করছে না কেন?

মির্জাসাহেব গম্ভীরমুখে বললেন, সেটাই বুঝতে পারছি না।

কর্নেল বললেন, আমি এগুলো রেখে পোশাক বদলে আসি।

বলে তিনি কিটব্যাগটা নিয়ে গেস্টরুমের দিকে চলে গেলেন। আমি বললুম, আচ্ছা মির্জাসাহেব! আপনার বাবুর্চির সঙ্গে তো আলাপ হলো না। তাকে ধন্যবাদ দিতুম। কী অপূর্ব রান্না!

মির্জাসাহেব একটু হেসে বললেন, তিনি পর্দানসিনা।

কে তিনি?

আমার দূরসম্পর্কের বোন। রহিমের মা দিলোয়ারা বেগম। রহিমের বাবা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান। লখনউতে সরকারি অফিসার ছিলেন। এদিকে আমার স্ত্রী এমিলিও মারা গেল। এই সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ ছিল না। তাই দিলোয়ারা আর ওঁর ছেলেকে নিয়ে এলুম। রহিম বি. এ. পর্যন্ত পড়েছে। ওকে আর পড়ানো গেল না। ডানপিটে ছেলে। স্পোর্টসের নেশা আছে।

কাল রহিম নাকি অনেক রাতে ফিরেছেন! পথে মোটরমাইক বিগড়ে গিয়েছিল। শাকিল মিয়াঁ বলছিলেন।

হ্যাঁ। ওকে বাগে আনা আমার পক্ষে কঠিন। দিদির পক্ষে তো সম্ভবই নয়। মির্জাসাহেব হাসতে হাসতে বললেন, কাল রাত্রে ডাক্তার জগদীশ রায়ের সঙ্গে দেখা করে রহিম গিয়েছিল স্পোর্টিং ক্লাবের একটা ফাংশনে। গান শুনছিল। বুঝুন!

রহমত আর তার মেয়ে মুন্নিজান ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রেখে গেল। ইতিমধ্যে কর্নেল এসে গেলেন। একটু পরে মুন্নিজান জলের জগ আর তিনটে গ্লাস আনল। মির্জাসাহেব তাকে বললেন, মুন্নি! তেরি আব্বা এক পাগলকো বুজুর্গ। আউলিয়া বানা দিয়া। জানতি হ্যায় তু?

রহমতকে কেটে পড়তে দেখলুম। মুন্নি ওড়নায় হাসি চাপা হিয়ে বলল, আব্বা উয়োরাজ এক কুত্তা দেকার ভাগা!

মির্জাসাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক হ্যায়! যা! আপনা কাম কর!

মুন্নিজান নাচের ভঙ্গিতে চলে গেল। কর্নেল বললেন, কুকুরকে আমি ভয় পাই। ভাগ্যিস আপনার বাড়িতে কুকুর নেই!

মির্জাসাহেব বললেন, একটা ল্যাব্রাডার রিট্রিভার ছিল। সেটা এমিলির। অসুখে ভুগে সেটা মারা যায়। তারপর একটা অ্যালসেশিয়ান এনেছিলুম। কিন্তু দিদি–মানে রহিমের মা বড্ড ধর্মভীরু। মুসলিম বাড়িতে কুকুর থাকলে নাকি ফেরেশতা অর্থাৎ দেবদূতরা ঢোকেন না। তাছাড়া কুকুর নাকি ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ প্রাণী। কে জানে কী ব্যাপার! দিদির জন্য বাধ্য হয়ে কুকুরটা আমার বন্ধু নরেশ সিংকে উপহার দিলুম।

কর্নেল বললেন, কলকাতায় আমার চেনা একজন সুরেশ সিং আছেন। আপনার বন্ধুর সঙ্গে তার কি কোনো সম্পর্ক আছে? নামের মিল দেখেই বলছি।

মির্জাসাহেব হাসতে গিয়ে হাসলেন না। হঠাৎ একটু চমকে উঠলেন যেন। বললেন, নরেশের এক ভাই ছিল মনে পড়েছে। হা সুরেশ। মনে পড়েছে। নরেশের কাছে শুনেছিলুম, সে নাকি হংকংয়ে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। দাদার সঙ্গে বনিবনা ছিল না তার। জানি না আপনি কোন সুরেশের কথা বলছেন!

হ্যাঁ। আমার জানা সুরেশ সিং একসময় হংকংয়ে ছিল। এখন কলকাতায় থাকে।

তাহলে নরেশকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

ছেড়ে দিন। এটা তেমন কোনো ইমপর্ট্যান্ট ব্যাপার নয়।

ব্রেকফাস্টের পর পাইপ ধরিয়ে মির্জাসাহেব বললেন, রহিমবাবার ওঠার সময় হয়েছে। শোনা যাক বাবাকে ডাক্তার রায় কী কথা বলেছেন। আপনারা বিশ্রাম করবেন, নাকি বেরোবেন?

কর্নেল বললেন, জয়ন্তকে একবার এরিয়াটা দেখিয়ে নিয়ে আসব।

 গাড়িটা নিতে পারেন। খুদা বখশ ড্রাইভিং করবে।

থাক। আমরা পায়ে হেঁটে ঘুরব। পীরের সমাধির ওদিকে কয়েক রকমের অর্কিড দেখে এলুম।…

কর্নেলের সঙ্গে যখন বেরোলুম, তখন আমার প্যান্টের পকেটে লাইসেন্স করা পয়েন্টে ২২ ক্যালিবারের রিভলবার। কর্নেলের নির্দেশে অস্ত্রটা সঙ্গে নিতে হয়েছিল। কিন্তু এই সতর্কতা কেন, তা বুঝতে পারছিলুম না।

দক্ষিণে সংকীর্ণ-এবড়ো-খেবড়ো পিচ-রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে বড়নবাবদের বাড়ির গেট চোখে পড়ল। এদিকটায় বনেদি ঐশ্বর্যের ছাপ আছে। পুরনো আমলের কালো পাথরের পাঁচিল মেরামত করা হয়েছে কালো পাথর দিয়েই এবং গেটটাও পরিচ্ছন্ন। যথারীতি বন্দুকধারী দারোয়ানও আছে। তার পরনে খাকি উর্দি। ভেতরে বিস্তৃত সবুজ ঘাসে ঢাকা, লন আর ফুলবাগিচার মধ্যে দোতলা বিশাল একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। আমরা ওই গেটের সামনে দিয়ে কিছুটা এগিয়েছি, গেটের দিক থেকে একটা জিপগাড়ি বেরিয়ে এল। গাড়িটা চলে যাওয়ার জন্য রাস্তা দিতে আমরা একপাশে সরে দাঁড়ালুম। কিন্তু জিপগাড়িটা এসে আমাদের কাছে থেমে গেল। গাড়ির ডানদিকে একজন রুক্ষ চেহারার লোক বন্দুক হাতে বসে ছিল। গাড়ির চালক বাঁদিকে এবং তার চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ আছে। পরনে বুশশার্ট আর ছাইরঙা প্যান্ট। তিনি ইংরেজিতে কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারাই কি ছোট মির্জাসাহেবের অতিথি?

কর্নেল একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ। আমার ধারণা, আপনি তার চাচার ছেলে মির্জা সালিম বেগ?

ভদ্রলোক বললেন, আপনার ধারণা ঠিক। যাই হোক, আপনারা একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন।

আপনি কি কালো নেকড়ের ব্যাপারে আমাদের সাধন করে দিচ্ছেন?

সালিম বেগ গম্ভীর মুখে বললেন, ও ছাড়া আপনাদের সাবধান করার কী কারণ থাকতে পারে? হায়দারভাইও সম্ভবত আপনাদের সাবধান করে দিয়েছেন?

নাহ, উনি এখনও কালো নেকড়ে সম্বন্ধে নিশ্চিত নন।

তাই বুঝি? সালিম বেগ আস্তে বললেন, হায়দারভাইয়ের সঙ্গে আমার বা আমার সঙ্গে ওঁর কথা বলা বন্ধ। তবু যেহেতু আপনারা আমাদের নবাবি খানদানের অতিথি, তাই আমার কর্তব্য আপনাদের সাবধান করা। আচ্ছা, চলি।

আপনি কি আপনার ফার্মহাউসে চললেন?

হ্যাঁ। আপনারা যেতে চাইলে সঙ্গে আসতে পারেন। তবে হায়দারভাই মেজাজি লোক। জানতে পারলে রাগ করবেন।

বরং আমাদের হোেস্টকে বলে আগামীকাল যদি যাই?

আপনাদের হোস্ট নিষেধ করবেন।

 যদি না করেন?

সালিম বেগ হাসলেন। তা হলে যাবেন। আমি ওখানে সবসময়ই থাকি। নেহাত দরকারে বাড়ি এসেছিলুম। আচ্ছা, চলি।

এক মিনিট। আপনি কি আমাদের পরিচয় জেনেছেন?

জেনেছি। দুই বাড়ির কর্তাদের মধ্যে যত বিবাদ থাক, ভৃত্যদের মধ্যে কোনো বিবাদ নেই। কাজেই আমাদের বাড়ির কথাও হায়দারভাইয়ের বাড়িতে সহজে পৌঁছে যায়। সালিম বেগ হঠাৎ চাপা গলায় বললেন, হায়দারভাই কলকাতা যাওয়ার পরই আমার কানে এসেছিল, উনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ আনতে যাচ্ছেন।

কর্নেলের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। পকেট থেকে একটা নেমকার্ড বের করে বললেন, কেউ আমাকে ডিটেকটিভ বললে আমি অপমানিত বোধ করি। এই নিন আমার নেমকার্ড। বছর তিনেক আগে রিজার্ভ ফরেস্টের বাংলোতে মির্জা হায়দারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাছাড়া আমরা দুজনেই প্রকৃতি পরিবেশ সংক্রান্ত আন্দোলনে যুক্ত আছি। আর–জয়ন্ত! তোমার নেমকার্ড দাও এঁকে!

দুটো নেমকার্ডে চোখ বুলিয়ে সালিম বেগ হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক আছে। কাল সকালে যদি আমার ফার্মহাউসে যান, আমি আপনাকে হায়দারভাইয়ের কোথায় ভুল হয়েছে, সেটা বুঝিয়ে বলব। আচ্ছা, চলি।

জিপটা চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন, লোকটা ধড়িবাজ। মেজাজ নষ্ট করে দিয়ে গেল!

বললুম, কর্নেল! এখনও কিন্তু আমি জানি না, মির্জা হায়দার আলি বেগ কেন আপনার সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন। আপনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। অথচ এখন মনে হচ্ছে, এই সালিমসাহেব ঠিক জানেন–

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, এখন ও কথা থাক।

বাঁদিকে শালবন, ডানদিকে উঁচু মাটির ওপর মাঝে মাঝে একটা করে সুন্দর বাংলা ধাঁচের বাড়ি। কিছুদূর চলার পর দুধারেই শালবন চোখে পড়ল। কর্নেল বললেন, শালবনের ভেতরে দিয়ে শর্টকার্ট করা যেত। কিন্তু বড্ড বেশি পাতা পড়ে আছে। নিঃশব্দে পা ফেলা যাবে না।

জিজ্ঞেস করলুম, আমরা যাচ্ছি কোথায়?

পীরের সমাধিতে।

আর কোনো প্রশ্ন করলুম না। শালবনের পর বাঁদিকে পাথরে বাঁধানো একফালি রাস্তা। বোঝা যাচ্ছিল রাস্তাটা খুবই পুরনো আমলে তৈরি। সেই রাস্তার দুধারে ঝোপঝাড়, বড় বড় পাথর আর উঁচু-নিচু কঁকড়া গাছ। বসন্তকালে। সবুজ চিকন পাতা আর ফুলে-ফুলে উজ্জ্বল হয়ে আছে। একটু পরে মুখ থুবড়ে পড়া পাথরের ফটক এবং একটা বিশাল বটগাছ দেখা গেল। কর্নেল বললেন, বটগাছের নিচে যে উঁচু পাথরের চত্বর দেখতে পাচ্ছ, ওটাই পীরের সমাধি।

আমার সমাধির কাছে যেতেই চোখে পড়ল, একটা আধোলঙ্গ লোক ঝুঁকে বসে কিছু করছিল। তার মাথায় লম্বা বিশৃংখল চুল, মুখে তেমনি এলোমেলো গোঁফদাড়ি। সে ঘুরে আমাদের জ্বলজ্বলে চোখে দেখতে থাকল। এতক্ষণে দেখলুম, তার হাতে একটা শাবল।

কর্নেল সকৌতুকে বললেন, পাগলাবাবা! খাজানা (গুপ্তধন) জরুর মিল যায়েগা।

অমনি সে শাবলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর একলাফে ওদিকের ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে উধাও হয়ে গেল।

কর্নেল বাইনোকুলারে তাকে দেখতে দেখতে বললেন, সেয়ানা পাগল!

বললুম, মির্জাসাহেব বলছিলেন, গুপ্তধনের লোভে লোকে এখানে খুঁড়তে আসে। অথচ আপনার ধারণা নাকি অন্যরকম।

আমার ধারণা ঠিক কি না এবার যাচাই করার সুযোগ এসেছে। বলে কর্নেল এগিয়ে গেলেন। পাগল লোকটা যেখানে গর্ত খুঁড়ছিল, সেখানে গিয়ে তিনি পিঠে-আঁটা কিটব্যাগ থেকে একটা লোহার গোঁজ, আর হাতুড়ি বের করলেন। আমি জানি, ওঁর কিটব্যাগে এ ধরনের অজস্র জিনিস থাকে। বিশেষ করে পাহাড়ি জঙ্গলে যাবার সময় এই সব জিনিস তিনি নিয়ে যান। গোঁজে চাপা শব্দে হাতুড়ির আঘাত করতে করতে কর্নেল বললেন, তুমি চারদিকে একটু লক্ষ্য রাখা জয়ন্ত!

এখানে মাটিটা নরম। কিছুটা খোঁড়ার পর কর্নেল থেমে গেলেন। উঠে দাঁড়িয়ে নাকে রুমাল চাপা দিলেন।

বললুম, কী পোঁতা আছে ওখানে?

খানিকটা মাংস। হাড়সুদ্ধ মাংস। ম্যাট থিকথিক করছে।

ভীষণ অবাক হয়ে বললুম, কী আশ্চর্য!

মাংসটা পচাতে দেওয়া হয়েছে। থিকথিকে পোকায় ভরা পচা মাংস যে জন্তুটার খাদ্য, খাওয়ার সময় কোনো মানুষ এখানে এসে পড়লে সে তাকে আক্রমণ করবে। বলে কর্নেল সরে এলেন একটু তফাতে। আপনমনে ফের বললেন, তাহলে আজ কার পালা? যারই হোক, সে সম্ভবত দুপুরেই এখানে আসবে।

কর্নেল! আমি উত্তেজিতভাবে বললুম, ব্যাপারটা খুলে বলুন।

কর্নেল আবার স্বগতোক্তি করলেন। আমি হয়তো ভুল করছি! বলে তিনি ঝুঁকে এক টুকরো মাটি তুলে আঙুলের চাপে গুঁড়ো করে গুড়োগুলো ওপর থেকে নিচে ফেলতে থাকলেন। বললেন, বাতাসের গতি পশ্চিম থেকে পূর্বে। জয়ন্ত! তুমি পূর্বদিকটা লক্ষ্য করো। ফায়ার আর্মস বের করে তৈরি হও। কোনো জন্তুকে আসতে দেখলে গুলি করবে। গুলি করার সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখবে কিন্তু। কুইক! প্রতি সেকেন্ড সময় খুব মূল্যবান।

যন্ত্রের মতো তার নির্দেশ পালন করলুম এবং আড়চোখে দেখলুম, কর্নেল কিটব্যাগ থেকে একটা টেস্টটিউব বের করলেন। তারপর লোহার গোঁজের ডগা দিয়ে পোকা সরিয়ে এক টুকরো পচা মাংস টেস্টটিউবে ভরে ছিপি এঁটে দিলেন। বললেন, হঠাৎ আমার বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল।

তারপর তিনি সেই গর্তটা ভালভাবে বুজিয়ে জুতোর চাপে সমতল করে দিলেন। একটু হেসে বললেন, জয়ন্ত! জন্তুটার আর আসার চান্স নেই। তবে সত্যি সত্যি এলে আমাকেই সামলাতে হতো। কারণ লক্ষ্য করছিলুম, তোমার দৃষ্টি একাগ্র নয়।

আমি আপনার অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপও দেখছিলুম। অবশ্য জন্তুটা এলে আমার চোখ এড়িয়ে যেত না। জন্তুটা নিশ্চয় কালো নেকড়ে?

কালো কি না জানি না। আর জন্তুটা নেকড়ে কি না তা-ও বুঝতে পারছি না। শুধু এটুকুই বুঝতে পেরেছি, এই পচা মাংসের গন্ধ সে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসে। এতে এমন কী আছে কে জানে!

কর্নেল বাইনোকুলারে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া ঝোপ ও পাথরে ঢাকা পুবদিকটা কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে নিলেন। জিজ্ঞেস করলুম, সকালে যে গর্তটা দেখেছিলেন, সেটা কোথায়?

কর্নেল আঙুল তুলে একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, ওটা পরীক্ষা করার পর বুজিয়ে দিয়েছিলুম। তলায় মাটিতে পচা মাংসের একটুখানি চিহ্ন ছিল। দুএকটা পোকাও ছিল। মির্জাসাহেবের সঙ্গে তা নিয়ে ইচ্ছে করেই আলোচনা করিনি। তাছাড়া তখনও আমার মাথায় এই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।

কিন্তু কে দুটো গর্তে মাংস পুঁতে রেখেছে?

জানতে পারলে তো সব রহস্যের সমাধান হয়ে যেত। বলে কর্নেল সমাধিচত্বরের চারদিকে ছায়াঢাকা মাটির ওপর তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকাতে তাকাতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেন। মাটির ওপর কোথাও ঘন ঘাস-গুল্ম গজিয়ে আছে। কোথাও মাটি নগ্ন হয়ে আছে। দুটো গর্তই নগ্ন মাটিতে খোঁড়া হয়েছিল।

বললুম এখানে ওই পাগলাটাকে দিয়েই গর্ত খুঁড়ে মাংস পচাতে দিয়েছিল কেউ। তারই নির্দেশে পাগলটা দ্বিতীয় গর্তটা খুঁড়ে পচা মাংস বের করে রাখতে এসেছিল। আপনি বলেছিলেন, এবার কার পালা? আপনার মতে, এখানে কারও আসার কথা ছিল।

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। আমার থিয়োরি বদলে গেছে। ওই পাগল সম্ভবত আড়াল থেকে কাকেও এখানে গর্ত খুঁড়তে দেখেছিল। গর্তে কী পোঁতা হচ্ছে তা দেখার জন্যই সে একটা শাবল যোগাড় করে চুপি চুপি এখানে এসেছিল। সেয়ানা পাগল বলাটা অবশ্য ভুল হয়নি। কিন্তু

ওঁর কথার ওপর বললুম, কিসে বুঝলেন?

এখনও পর্যন্ত পীরের এই কবরের জায়গায় কোনো মানুষ এল না কেন? আমরা এখানে প্রায় আধঘণ্টা আছি। এতক্ষণে জন্তুটার শিকার এসে পড়া উচিত ছিল।

আমরা আছি বলে হয়তো সে আসছে না।

নাহ্। এই রাস্তাটা সোজা এবং ফঁকা। আমার একটা চোখ রাস্তার দিকে ছিল। কেউ এলে আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যেত না। বলে কর্নেল পা বাড়ালেন।

তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ফায়ার আর্মস কি এখনও হাতে রাখব?

দরকার নেই। চলো, মির্জাসাহেবের বাড়িতে ফিরে যাই। একটা জরুরি কাজ সামনে এসে গেছে….

.