সমুদ্রে মৃত্যুর ঘ্রাণ – ৪

০৪.

 কৌশল্যাদি ফিরে এসে বলেছিলেন, ডঃ আচারিয়া বললেন, অশোক সাঠে চার তলায় সিঙ্গল স্যুইটে ছিল। তার সঙ্গে কারো ঘনিষ্ঠতা তিনি লক্ষ্য করেননি। অশোক সাঠে, তাঁর মতে, অহঙ্কারী লোক। কারো সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলত না। তার সঙ্গেও না।– বেলা নটায় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছিল এবং পূর্বাচলের বোর্ডাররা

মুক্তি পেয়েছিলেন। ব্রেকফাস্টের পর কর্নেল দুই পুলিশ কর্তার সঙ্গে নীচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছিলেন, তখন আমি আমাদের স্যুইটের ব্যালকনিতে বসে সিগারেট টানছি। ডঃ পাণ্ডেকে দেখলুম, খালি হাতে একটা অটোরিকশাতে চেপে চলে গেলেন। তিনি যে আবার নতুন করে ট্রেনের টিকিট কাটতে স্টেশনে ছুটে গেলেন, তা স্পষ্ট। বেচারার ট্রেনভাড়াটা গচ্চা গেছে। কারণ সাড়ে নটার ট্রেন ততক্ষণে চলে গেছে। রেলস্টেশন এখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। তার ওপর স্টেশনগামী রাস্তাটা গেছে ওল্ড চন্দনপুরের ভেতর দিয়ে। সেখানে যানবাহনের প্রচণ্ড ভিড় হয়।

কৌশল্যাদি বিষণ্ণভাবে নিজের স্যুইটে ফিরে গেছেন। ডানদিকে ঝাউবন এবং সামনের বিচে রোজকার মতোই ট্যুরিস্টদের চলাফেরা দেখা যাচ্ছিল। তারপর বাঁদিকে দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপে পাগলাবাবুকে দেখতে পেলুম। চুপচাপ দাঁড়িয়ে সমুদ্রদর্শন করছিলেন তিনি। হঠাৎ করজোড়ে সম্ভবত সমুদ্রকে প্রণাম করলেন। নীচের ঘাসজমিতে বেওয়ারিশ গাধাটা নিরুপদ্রবে ঘাস খাচ্ছে।

পুলিশ অফিসাররা তাদের বাহিনী নিয়ে চলে গেলেন। কর্নেল ফিরে এসে নীচে অদৃশ্য হলেন। একটু পরে দরজায় দুবার নক করার শব্দ হল। দরজা খুলে বললুম, পুলিশ এত কাণ্ড করে কিছু ব্লু খুঁজে পেয়েছে কি না বলুন।

কর্নেল বললেন, দরজায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করতে বলছ বুঝি?

হেসে ফেললুম। না। ভেতরে ঢুকেই বলবেন। আসলে আপনি অতক্ষণ ওঁদের সঙ্গে গুজ-গুজ ফুসফুস করছিলেন। তাই আপনাকে সামনে দেখেই প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

দরজা বন্ধ করে চেয়ারে বসে কর্নেল টুপি খুলে টেবিলে রাখলেন। তারপর টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, তিনতলার ১৭ নম্বর স্যুইট এখনও বন্ধ এবং দুজন কনস্টেবল পাহারা দিচ্ছে। কাজেই পুলিশের তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। বোর্ডারদের জেরা করে মিঃ পটনায়ক কোনো ক্লু পেয়েছেন কি না, তা আমাকে কেন জানাবেন? উল্টে আমাকেই বলে গেলেন, এবার যেন নিজস্ব পদ্ধতিতে স্বাধীনভাবে তদন্ত করে ওঁদের সাহায্য করি। আশ্চর্য!

বলে কর্নেল চুরুট ধরালেন। আমি বললুম, পাগলাবাবু দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে প্রণাম করছেন দেখলুম। আপনি বলছিলেন, ওঁর ওই গান বা পদ্যটার নাকি বিশেষ কোনো গোপন অর্থ আছে। কেন একথা বলছিলেন জানতে পারি?

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, আজ সকালে ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

হ্যাঁ ব্যালকনি থেকে দেখছিলুম।

আবোল-তাবোল কথাবার্তা বলছিলেন। মাথামুণ্ডু বোঝা যায় না। আমাকে কেয়াবনের ভেতর একটা মজার জিনিস দেখাবেন বলে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, কিছু নেই। এমনি-এমনি ডেকে ব্লাফ দিলুম। বলেই চোখ নাচালেন। তার গানের মধ্যে নাকি এরকম ব্লাফ নেই। আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে তার গানের মানে। তা হলেই নাকি আমার চোখ খুলে যাবে। যাই হোক, তার নাম-ধাম পরিচয় জানতে চাইলুম। বললেন, এককাপ কফি খাওয়ালে বলবেন। কফি খাওয়ালুম। কিন্তু ওই পদ্যটা বিদঘুটে সুরে গাইতে গাইতে নাচ জুড়ে দিলেন।

হ্যাঁ। তা দেখছিলুম।

আমার কেন যেন মনে হল, এ পাগল সেয়ানা পাগল।

 এখানকার কেউ ওঁকে চেনে না শুনেছি। হঠাৎ কোত্থেকে এসে জুটেছেন।

কর্নেল বললেন, আমিও খোঁজ নিয়েছি। পাগলাবাবু প্রকৃতি-পরিবেশ সম্মেলনের আগেরদিন এখানে এসেছেন। ভদ্রলোককে রোডসাইড কাফের মালিকই পাগলাবাবু। নাম দিয়েছেন। তবে উনি ওই গাধাটা ছাড়া কাকেও উত্ত্যক্ত করেন না।

গাধাটা কার কে জানে?

নব বলছিল, গাধাটাকে কিছুদিন থেকে এখানে দেখা যাচ্ছে। কে তার মালিক কেউ জানে না। বলে কর্নেল চুরুট অ্যাশট্রেতে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। পিঠের সঙ্গে ওঁর কিটব্যাগ এঁটে বললেন, তুমি চুপচাপ ঘরে বসে না থেকে এবার বাইরে চলো!

আপনার কিটব্যাগ থেকে প্রজাপতিধরা জালের স্টিক বেরিয়ে আছে। এই রোদে প্রজাপতির পেছনে ঘুরবেন। আর আমাকে কোথাও খামোকা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সি-বিচে ঘুরতেও আমার গা ছমছম করে। যা ঢালু বিচ! মনে হয় এখনই সমুদ্র এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে টেনে নিয়ে যাবে।

সমুদ্র কিছু নেয় না। নিলেও ফিরিয়ে দেয়। অবশ্য জ্যান্ত জয়ন্ত চৌধুরিকে নিয়ে একটু পরে মৃত জয়ন্ত চৌধুরিকে ছুঁড়ে ফেরত দেবে।

তা হলে?

সি-বিচে তুমি নামবে না। আমিও না। ডানদিকে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে কিছুদূর গিয়ে আমরা পোড়ো লাইটহাউসের পেছনে নামব। ওখানে একটা জঙ্গল আছে। প্রচুর বুনো ফুল ফোটে। হ্যাঁ–ফুল যেখানে, প্রজাপতি সেখানে। তবে তোমার দৃষ্টিশক্তি থাকলে কোনো প্রেমিক-প্রেমিকাকে আবিষ্কার করতেও পারো।

কী যে বলেন! লুকিয়ে প্রণয়লীলা দেখতে বলছেন?

আহা! ইচ্ছে না হলে লাইটহাউসের চুড়ো দেখবে। চলো! বেরিয়ে পড়ি।

কিছুক্ষণ পরে বালিয়াড়ির ওপর ঝাউবনে কয়েকজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে পেরিয়ে গিয়ে ফাটল ধরা প্রাচীন লাইটহাউসটি চোখে পড়ল। তার পেছন দিকে ঘন উঁচু-নিচু গাছ আর ঝোপ-ঝাড়। ঝোপের ভেতর বড়-বড় পাথর পড়ে আছে। একটু দূরে উত্তরদিকে একটা টিলার মাথায় মন্দির দেখা গেল। লাইটহাউসটা আমার দেখা। তবে এত কাছে আসিনি। তাই টিলা বা মন্দিরটা চোখে পড়েনি। এখন দেখতে পেয়ে বললুম, বরং চলুন, মন্দির দর্শন করে আসি।

এক মিনিট! দেখি, ওই প্রজাপতিটা ধরতে পারি নাকি। ওটার নাম জগন্নাথ প্রজাপতি। ডানায় অবিকল পুরীর মন্দিরের দেবতা জগন্নাথের ছবি আছে মনে

কর্নেল কিটব্যাগ থেকে প্রজাপতিধরা জাল বের করে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলেন। আমি একটা উঁচু পাথরে উঠে লাইটহাউসটা দেখতে থাকলুম। একটু পরে দেখি, লাইটহাউসের নীচের এক বড় পাথরের আড়াল থেকে একজন শিখ ভদ্রলোক বেরুলেন। তারপর তিনি হনহন করে হেঁটে জঙ্গলের ভেতর অদৃশ্য হলেন। বললুম, কর্নেল! প্রণয়লীলা কোথায়? এইমাত্র এক শিখ ভদ্রলোক লাইটহাউসের নীচে থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকলেন।

জগন্নাথ প্রজাপতি ধরতে ব্যর্থ প্রকৃতিবিজ্ঞানী সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। শিখ ভদ্রলোক? বলে তিনি একটা পাথরে উঠে বাইনোকুলারে তাকে খুঁজতে থাকলন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, হ্যাঁ। পিচরাস্তার মোড়ে একটা অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। শিখ ভদ্রলোক সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ভদ্রলোক হয়তো লাইটহাউসে চড়তে গিয়েছিলেন। দরজা আটা দেখে ফিরে যাচ্ছেন।

অটোরিকশাতে চেপে উনি উল্টোদিকে যাচ্ছেন। হা–মোরামরাস্তায় বাঁক নিয়ে অটোরিকশা চলেছে মন্দিরের টিলার দিকে। পার্বতীর মন্দির ট্যুরিস্টদের দেখার মতো। চারশো বছরের পুরনো মন্দির। বলে কর্নেল পাথর থেকে নামলেন। বললুম, লাইটহাউসের গায়ে কি ওটা, ফলক?

হ্যাঁ। পোর্তুগিজ বণিকদের তৈরি লাইটহাউস। ফলকে রোমান অক্ষরে কী সব লেখা আছে, পড়া যায় না। সমুদ্রের নোনা হাওয়ার উপদ্রবে ক্ষয়ে গেছে।

চলুন না। দেখে আসি।

চলো! দেখি, ওটার কোথাও জগন্নাথ প্রজাপতি থাকতে পারে। তা ছাড়া শিখ ভদ্রলোক ওখানে কী করছিলেন দেখা যাবে।

ঝোপঝাড় এবং গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমরা লাইটহাউসের কাছে গেলুম। তারপর কর্নেল বললেন, লাইটহাউসের গোড়ায় কত বালি জমেছে। দেখছ? লোহার ফ্রেমে আটকানো কপাটের প্রায় অর্ধেকটা বালিতে ভরে গেছে। ঘাস গজিয়েছে প্রচুর। অ্যাঁ? এখানটা যেন কেউ খুঁড়েছিল। ভেজা বালি। ঘাস নেই।

কর্নেল হাঁটু ভাঁজ করে বসে সেই জায়গাটা খুঁড়তে শুরু করলেন। তারপর টেনে বের করলেন হাত তিনেক লম্বা নাইলনের মোটা দড়ি। বললুম, কী অদ্ভুত! শিখ ভদ্রলোকই কি এখানে দড়িটা পুঁতে রেখে গেলেন?

কর্নেল দড়িটা ঝেড়ে বালি পরিষ্কার করে গম্ভীর মুখে বললেন, জয়ন্ত! অবিকল এরকম দড়ির ফঁসে শ্রাবন্তীকে মারা হয়েছে। হা–একই দড়ি!

কিন্তু সেই দড়ি তো পুলিশের কাছে আছে।

হ্যাঁ।

তা হলে?

কর্নেল দড়িটা কিটব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে বললেন, খুনী শ্রাবন্তীকে মেরে ফেলার জন্য যে দড়ি কিনে এনেছিল, এটা তারই অংশ। দড়িটা শ্রাবন্তীকে শাওয়ারে ঝোলানোর পক্ষে বেশি লম্বা ছিল। তাছাড়া পুরো দড়িটা প্যান্টের পকেটে ঢোকানো যাচ্ছিল না বলেই এই অংশ কেটে রেখেছিল খুনী। পুলিশ পূর্বাচল হোটেল সার্চ করেনি। কিন্তু পরে যদি প্রত্যেক বোর্ডারের ঘর সার্চ করে, সেই ভয়ে বাকি দড়িটা লুকিয়ে রেখে গেল খুনী। বাইরে কোথাও ছুঁড়ে ফেললে কারো চোখে পড়তে পারে। তার চেয়ে এই জায়গাটা নিরাপদ। কারণ লাইটহাউসে নাকি সামুদ্রিক অজগর সাপের আড্ডা! সেই ভয়ে পারতপক্ষে কেউ এদিকে পা বাড়ায় না।

বললুম, তা হলে ওই শিখ ভদ্রলোকই তো খুনী!

কিন্তু পূর্বাচলে কোনো শিখ ভদ্রলোক ওঠেনি। বলে কর্নেল হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন। পিচরাস্তায় পৌঁছে তিনি বাইনোকুলারে মন্দিরের টিলাটা দেখে নিলেন। বললেন, নীচের চত্বরে কয়েকটা অটোরিকশা আর দুটো প্রাইভেটকার দাঁড়িয়ে আছে। সিঁড়িতে পুণ্যার্থীরা কেউ নামছেন কেউ উঠছেন। কিন্তু শিখ ভদ্রলোককে দেখতে পাচ্ছি না।

মন্দিরের দূরত্ব কত এখান থেকে?

 তা প্রায় দু’কিলোমিটার।

বাপস। এই খর রোদে অতদূর হাঁটতে পারব না। বালিয়াড়ি আর খোলা পাথুরে মাঠ। সারা পথে কোনো গাছ নেই যে, ছায়ায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেব।

কর্নেল শ্বাস ছেড়ে বললেন, হু। আজ মেঘ নেই। বড় চড়া রোদ। আমার টাক ঘামতে শুরু করেছে। চলো! নিউচন্দনপুরের কাছে বাঁকের মুখে শিরিসগাছটার তলায় গিয়ে দাঁড়াই। বাইনোকুলারে লক্ষ্য রাখব। শিখ ভদ্রলোককে নিয়ে অটোরিকশাটা এলেই রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে তাকে থামাব। দরকার হলে ফায়ার আর্মস বের করেও থামাব। কুইক জয়ন্ত! চলে এস।

একটু পরে শিরিসগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কর্নেল বাইনোকুলারে টিলার মন্দির দেখতে থাকলেন। আমি দরদর করে ঘামছিলুম। গাছের ছায়ায় জোরালো হাওয়া ছিল। কর্নেল টুপি খুলে বগলদাবা করেছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সামুদ্রিক হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল। প্রায় আধঘণ্টা পরে একটা অটোরিকশা ফিরে এল। তাতে শিখ ভদ্রলোক নেই। এক দম্পতি ছিলেন। বললুম, কর্নেল! শিখ ভদ্রলোক যদি প্রাইভেট কারে চেপে আসেন, আগে দেখতে পাবেন কী করে?

কর্নেল বললেন, বাইনোকুলারে টিলার নীচের চত্বর সবটাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এখনও কোনো শিখ ভদ্রলোককে দেখতে পাচ্ছি না।

আরো আধঘণ্টায় তিনটে অটোরিকশা ফিরে এল। কোনোটাতেই শিখ ভদ্রলোক ছিলেন না। আমার উত্তেজনা ততক্ষণে থিতিয়ে গেছে। বললুম, বরং আমি পূর্বাচল হোটেলে গিয়ে ও সি বা ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরকে টেলিফোনে আপনার কথা জানিয়ে দিই। ওঁরা প্লেন ড্রেসের পুলিশ নিয়ে পার্বতীর মন্দিরে হানা দেবেন।

এই সময় একটা খালি অটোরিকশা নিউচদনপুরের বসতি এলাকা থেকে বেরিয়ে আসছিল। কর্নেল হাত তুলে রিকশাটা ডাকলেন। অটোরিকশার ড্রাইভার হিন্দিতে বলল, মন্দির দর্শনে যাবেন স্যার? তাহলে কুড়ি টাকা লাগবে।

কর্নেল বললেন, আমরা যাব। ধরো, আধঘণ্টা পরে ফিরে আসব। পূর্বাচল হোটেলে নামিয়ে দেবে। কত নেবে?

সেভেনটি ফাইভ।

 বুঝলাম, সে মওকা বুঝে দর হাঁকছে। দরাদরি করে ষাট টাকার নীচে তাকে নামানো গেল না। কর্নেল অটোরিকশাতে চেপে বসলেন। আমাকেও বসতে হল। এতগুলো টাকা খরচ করে গোয়েন্দাগিরির মানে হয় না। কিন্তু কর্নেলের। মাথায় ঝোঁক চেপেছে। তিনি যেন আমার মনের কথা আঁচ করে হাসতে হাসতে বললেন, জয়ন্ত! চারশোবছরের পুরনো মন্দির। আর পার্বতীর বিগ্রহ নাকি আরও প্রাচীন। তোমাকে আমার ক্যামেরায় মন্দির আর বিগ্রহের ছবি তুলে দেব। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় একটা ফিচার লিখে অন্তত আড়াই-তিনশো টাকা পাবে। তা থেকে আমাকে যাট টাকা উসুল করে দেবে।

ওঁর কথায় আমারও হাসি এল। বললুম, ছবির দরুন আমাদের কাগজ আরও দুশো টাকা দেবে।

ব্যস! তাহলে আর কথা কী? তুমি ভাবো, আমি বুঝি ঘরের খেয়ে বনের মোষ হাঁকিয়ে বেড়াই? মোটেও না। অর্কিড, প্রজাপতি, ক্যাকটাস বা নিদেনপক্ষে পাখির ছবি সমেত একটা ইংরেজি ফিচার লিখলেই সব খরচ উসুল হয়ে যায়। তুমি তো জানো, মার্কিন মুলুকের নেচার পত্রিকায় ছবিসমেত তিন পাতা ছাপানো লেখার জন্য আমি পাই কমপক্ষে একশো ডলার।

জানি, জানি! আপনি রথ দেখেন এবং কলাও বেচেন।

কর্নেল আবার গম্ভীর হয়ে বাইনোকুলারে লক্ষ্য রাখলেন। সংকীর্ণ মোরামরাস্তা। একটা প্রাইভেট কারকে আমাদের অটোরিকশা সাইড দিল। দেখলুম, গাড়ি ভর্তি মহিলা-কাচ্চা বাচ্চা এবং দুজন মাথা ন্যাড়া প্রৌঢ় ভদ্রলোক। পার্বতীর মন্দিরে বোধ হয় মানত সেরে মাথা ন্যাড়া করে এলেন।

পনের মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলুম। টিলাটার নীচের চত্বরে কয়েকটা অটো আর দুটো প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। কিছু ফুল বিক্রেতা চিৎকার করে ওড়িয়া ভাষায় কিছু বলছে। দুটো ট্রলিতে খাবার বেচছে মিঠাইওয়ালা। ভিড়ে চোখ বুলিয়ে কর্নেল বললেন, চলো! সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে ওঠা যাক। জুতো খুলে রাখতে হবে নীচে। জুতো পাহারার লোক আছে। কিছু পয়সা তার প্রাপ্য।

জুতো জিম্মা রেখে সিঁড়িতে উঠলুম। আগে কর্নেল পেছনে আমি। সিঁড়িটা বেজায় খাড়া। নামতে লোকেদের কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু উঠতে অনেকেই হাঁপিয়ে পড়ছে। বিশ্রাম নিতে নিতে উঠছে। মাঝামাঝি গিয়ে কর্নেল বললেন, একটু রেস্ট নেওয়া যাক। চড়া রোদ বলে এই অবস্থা। তা ছাড়া বয়স–

তিনি হঠাৎ থেমে গেলেন। দেখলুম, ডঃ পরিমল হাজরা তার স্ত্রী মালবিকার একটা বাহু ধরে সাবধানে তাকে নামিয়ে আনছেন। কর্নেলকে দেখে ডঃ হাজরা একটু আড়ষ্ট হেসে বলে উঠলেন, আর বলবেন না! আমার ধর্ম টর্মে মতি নেই। কিন্তু আমার মিসেস পার্বতী দর্শন না করে জলগ্রহণ করবেন না।

মালবিকা হাজরা কর্নেলের দিকে কেন যেন রুষ্ট দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, যান কর্নেল সায়েব! গেলে পুণ্যি হবে। মানত করে থাকলে চুল-গোঁফ-দাড়ি সব কামাতে হবে কিন্তু!

কর্নেল হাসলেন। তারপর টুপি খুলে বললেন, মানত করলে এই টাকের আনাচে-কানাচে যেটুকু চুল আছে, তাতে দেবী তুষ্ট হবেন না। আর গোঁফ দাড়ির যা অবস্থা, তা দেখতেই পাচ্ছেন। সব সাদা হয়ে গেছে। বুড়োর গোঁফ দাড়ি কি দেবীর পছন্দ হবে?

মিসেস হাজরা আর কথা বললেন না। স্বামীর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নামতে শুরু করলেন। ডঃ হাজরা বললেন, ডঃ পাণ্ডে আমার মিসেসকে পার্বতীর মন্দিরের খবর দিয়ে আমাকে বিপদে ফেলেছেন।

ডঃ পাণ্ডের সঙ্গে দেখা হয়নি? ট্রেনের টিকিট পেয়েছেন উনি?

এখানে এসে দেখা হল। রাত নটা পঁয়ত্রিশের টিকিট পেয়েছেন। ডঃ পাণ্ডের সঙ্গেই তো মিসেস আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ডঃ পাণ্ড কখন বেরিয়ে এসেছেন। অগত্যা মিসেস জেদ ধরলেন আমাকে পার্বতীর মন্দিরে নিয়ে আসতে হবে।

ডঃ পাণ্ডে এসেছেন এখানে?

 হ্যাঁ। দেখলুম এখনও লাইনে আছেন। আমি তো পুজো দিতে যাইনি। ম্যান উওম্যান সেপারেট লাইন। বলে ডঃ হাজরা গম্ভীর মুখে নেমে গেলেন।

চূড়ার মন্দির প্রাঙ্গণে দুটো লাইন। পুরুষ ও মহিলা আলাদা লাইনে পুজোর উপচার শালপাতায় দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর কর্নেল যাঁকে হ্যালো ডঃ পাণ্ডে বলে সম্ভাষণ করলেন, তাঁকে দেখে আমি অবাক।

পরনে মটকার ধুতি, গলায় জড়ানো মটকার চাদর, খালি গায়ে পৈতে শোভা পাচ্ছে। পাদুটোও খালি। কপালে একপোঁচ সিঁদুর। ডঃ পাণ্ডে বিষণ্ণভাবে বললেন, বারোটা পাঁচের ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস নেই। প্যাসেঞ্জার ট্রেন। একটু পরে একটা মেলট্রেন আছে। তাতে ফার্স্ট ক্লাস আছে। কিন্তু সব বার্থ রিজার্ভড়। বসে পাটনা যাওয়া যায়। কিন্তু ওই ট্রেনে ফার্স্টক্লাসে নাকি সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রীরাও ঢুকে পড়ে। তাই রিস্ক নিলুম না, রাতের ট্রেনই ভালো।

কর্নেল বললেন, পুজো দিলেন তা হলে?

দেব না? ব্রাহ্মণ সন্তান। তাছাড়া যা ফঁড়া গেল! বলে তিনি সিঁড়ির দিকে। এগিয়ে গেলেন।

কর্নেল প্রাঙ্গণের দক্ষিণে পাঁচিলের কাছে গিয়ে নীচে উঁকি দিলেন। দেখলুম, নীচের দিকটা আরো খাড়া এবং ঝোপ জঙ্গল পাথরে ভর্তি।

বাইনোকুলারে তিন দিকটা দেখে নিয়ে কর্নেল ক্যামেরায় মন্দিরের ছবি তুললেন। কয়েকটা ছবি বিভিন্ন দৃষ্টোকোণে তুলে তিনি বললেন, চলো! নেমে যাই।

লক্ষ্য করলুম, এখানে পাণ্ডাদের উপদ্রব নেই। ছোট মন্দির। ভক্তের সংখ্যা যথেষ্ট নয় বলেই হয়তো পাণ্ডা নেই। নীচে গিয়ে দেখলুম, হাজরা দম্পতি ডঃ পাণ্ডের প্রতীক্ষা করছিলেন। দুটো অটোরিকশা ওঁদের ভাড়া করা ছিল। ডঃ পাণ্ডের অটোরিকশাকে অনুসরণ করল হাজরা দম্পতির অটোরিকশা।

কর্নেল বললেন, কোথায় শিখ ভদ্রলোক? এ তো আশ্চর্য ব্যাপার!

বললুম, দক্ষিণের মাঠ দিয়ে হয়তো কেটে পড়েছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে, দৈবাৎ সে আপনাকে দেখে ফেলেছিল।

তার অটোরিকশার নাম্বার কাদায় অস্পষ্ট ছিল। পড়তে পারিনি। এটাই সমস্যা! বলে কর্নেল আমাদের অটোরিকশাতে চেপে বসলেন।

আমিও বসলুম। অটোরিকশা স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করলে বললুম, পেছনে তিনদিক খুঁজে দেখা উচিত ছিল।

কর্নেল আস্তে বললেন, আমার বাইনোকুলার কিছু মিস করে না।

পূর্বাচল হোটেলে ফিরে দেখি, লাউঞ্জে বসে আছেন কৌশল্যাদি। আমাদের দেখতে পেয়ে উঠে এলেন তিনি। বললেন, ওপরে চলুন। কথা আছে।

দোতলায় আমাদের সুইটে ঢুকে কৌশল্যাদি বসলেন। আমি ব্যালকনির দরজা খুলে দিলুম। ঝাঁপিয়ে এল সামুদ্রিক হাওয়া। কর্নেল কিটব্যাগ, বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা রেখে আরাম করে বসে বললেন, আমার মাথায় হাওয়া দরকার। ফ্যানের সুইচ টেপো জয়ন্ত!

কৌশল্যাদি বললেন, আমি ডঃ আচারিয়াকে রেলস্টেশনে বিদায় দিতে গিয়েছিলুম। এইমাত্র ফিরেছি। ম্যানেজার মিঃ মহাপাত্র বললেন, কিছুক্ষণ আগে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পটনায়ক এসে তিনতলার ওই ডাবলবেড ১৭নং স্যুইটের সিল ভেঙে তদন্ত করে গেছেন। কনস্টেবলরা চলে গেছে। বিকেলে তিনি আবার এসে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।

কর্নেল বললেন, তাতে কী? তুমি যা বলেছ, তা-ই বলবে। শুধু ফাইল চুরির কথাটা চেপে যাবে।

আমার মনে হয়, কথাটা বলা উচিত। কারণ পুলিশ মার্ডারের কোনো মোটিভ খুঁজে না পেয়ে অকারণ আমাকে হয়রান করে ছাড়বে। সকালে আমাকে ওঁরা কিছু প্রশ্ন করেছিলেন, যা আমার পক্ষে অপমানজনক। তা ছাড়া পুলিশের যা সর্বত্র রীতি, যার-তার কাঁধে দায় চাপিয়ে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে দায়িত্ব পালন করা।

এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। ..হ্যাঁ, দিন। …বলুন মহীতোষবাবু? …আপনার ভাগনেকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে? কেন? …কী আশ্চর্য! কী নাম ওর? …অমল রায়? …আচ্ছা আচ্ছা! আমি দেখব, কী করা যায়। ..আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। …আমি দেখছি কী করা যায়। ছাড়ছি।

কর্নেল টেলিফোন রেখে বললেন, কৌশল্যা! সেই যুবকটিকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। তবে এটা মন্দের ভালো। জেরার চোটে যদি অমল এমন কিছু বলে, যা আমার থিয়োরিকে শক্ত করবে।

কৌশল্যাদি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললুম, আপনার থিয়োরিটা কী?

কর্নেল হাসলেন। পাগলাবাবুর গানের মতো। পাখি সব করে রব…ইত্যাদি।

কৌশল্যাদি তাঁর বাক্যের বাংলা অংশটুকু বুঝতে না পেরে বললেন, পাখি? সেটা কী?

কর্নেল পাগলাবাবু সম্পর্কে এবং তার বিদঘুটে সুরে গাওয়া বাংলা পদ্যটার ইংরেজি অনুবাদসহ তাকে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, তুমি পাগলাবাবুকে দেখে থাকবে?

হ্যাঁ। দেখেছি, গত পরশু বিকেলে কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর বেরিয়ে আসছিলুম। নীচের রাস্তায় পাগলাবাবু আমার সামনে দাঁড়িয়ে স্মার্ট ইংলিশে বলছিলেন, এক কাপ কফি খাওয়ালে তিনি আমাকে একটা গোপন তথ্য (সিক্রেট ইনফরমেশন) দেবেন। একটু অবাক হয়েছিলুম। যাই হোক, পাগলের হাত থেকে বাঁচতে একটা পাঁচ টাকার নোট দিলুম। তারপর পাগলাবাবু চাপা গলায় বললেন, ম্যাডাম। ভূতের হাত লম্বা হয়। জিজ্ঞেস করলুম, তার মানে? পাগলাবাবু জবাব দিলেন না। একটা রোডসাইড কাফের দিকে ছুটে গেলেন।

কর্নেল আওড়ালেন, ঘোস্টস্ হ্যাভ লং হ্যান্ডস্!

 হ্যাঁ। ঠিক এই কথাটাই বললেন।

তারপর আর দেখা হয়নি তার সঙ্গে?

না। আমি তাকে দেখলেই এড়িয়ে গেছি।

কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন, কৌশল্যা! পাগলাবাবু যে-ই হোন, তিনি সম্ভবত তোমাকে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। এবার দেখা হলে তুমি তাকে বলবে, ভূতের লম্বা হাত তোমার ঘরে ঢুকেছিল। লক্ষ্য করবে, এ কথা শুনে পাগলাবাবুর কী প্রতিক্রিয়া হয়। আসলে পাগলারা কোনো-কোনো সময় সুস্থ মানুষের মতো আচরণ করে। তাই দেখবে, কোনো পাগল রাস্তায় কখনও গাড়ি চাপা পড়ে না। পাগলরা কখনও আত্মহত্যাও করে না।

কৌশল্যাদি চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। আমি বললুম, আপনিই বলছিলেন সেয়ানা পাগল।

.