সমুদ্রে মৃত্যুর ঘ্রাণ – ৭

০৭.

কর্নেল কেন একটু হেসে উঠলেন। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চুরুট ধরালেন। আবার হাসতে হাসতে বললেন, অতিবুদ্ধির গলায় দড়ি বলে বাংলায় একটা প্রবাদবাক্য আছে।

কৌশল্যাদি বললেন, কেন একথা বলছেন?

কর্নেল কিছু বলার আগে আমি বললুম, কিন্তু একটা কথা আমার মাথায় ঢুকছে না। খুনী ফাইলচোর শিখ সাজতে গেল কেন? ইচ্ছা করলে তো সে যে কোন জায়গায় গোপনে বাকি নাইলনের দড়িটা পুড়িয়ে ফেলতে পারত! পাগড়ি, দড়ি, কৃপাণ, কুর্তা, চুত্ত পাজামা আর বালা-টালা পরে শিখ সেজেছিল কেন?

কর্নেল সোজা হয়ে বসে বললেন, আমাকে সে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল।– আমাকে মানে পুলিশকেও। আমার পাটিগণিত জয়ন্ত। তুমি আর আমি যখন ডানদিকে বালিয়াড়ির ঝাউবনের দিকে যাচ্ছিলুম তখনই সে আমাদের বিভ্রান্ত করার সুযোগটা নেয়। আমরা অন্যদিকে গেলেও সে একই সুযোগ নিত।

সুযোগ নিত মানে?

এটুকু তোমার মাথায় আসছে না? ইচ্ছে করেই সে পোড়ো লাইটহাউসের কাছে বালিতে দড়িটুকু পুঁতে রাখতে ছুটে গিয়েছিল। সে লক্ষ্য করেছিল আমরা ওদিকেই যাচ্ছি। অমনি সে হোটেলের পেছনে ঢিবির জঙ্গল থেকে শিখ সেজে রাস্তায় এসেছিল। অটোরিকশা হোটেলের নীচে সবসময় পাওয়া যায়। অটোরিকশা লাইটহাউসের কাছাকাছি রাস্তায় দাঁড় করিয়ে সে দড়িটুকু পুঁতে রাখতে গিয়েছিল এবং লক্ষ্য রেখেছিল, তোমার বা আমার চোখে যেন সে পড়ে। তাতে আমাদের কৌতূহল বা সন্দেহ জাগবেই। জেগেছিল বৈকি! তাই আমরা দেখতে গিয়েছিলুম, সে পোডড়া অজগর অধ্যুষিত লাইটহাউসের কাছে কী করছিল। সে বালি খুঁড়ে জায়গাটা আমাদের চোখে পড়ার মতো করে রেখেছিল। ওটাই তার ফাঁদ। আমরা ঠিকই ফাঁদে পড়লুম। একজন শিখকে খুনী ফাইলচোর সাব্যস্ত করে ফেললুম। অন্তত কয়েক ঘণ্টা সে আমাদের ভুল পথে ছোটাতে পেরেছিল। তাই না?

ঠিক। আপনি ঠিকই বলেছেন, অতিবুদ্ধির গলায় দড়ি।

 কর্নেল হাসলেন। পাগলাবাবুকে কৌশল্যার সাহায্য করা উচিত। অন্তত তাকে কোন মেন্টাল হসপিটালে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। উনিই তোমার ফাইল উদ্ধার করেছেন!

কৌশল্যা বলল, নিশ্চয় করব। উনি যদি আমার সঙ্গে যেতে চান–তো উনি কী করে আমার ফাইল উদ্ধার করলেন, একটু খুলে বলুন!

কর্নেল সংক্ষেপে ঘটনাটা বললেন। তারপরই টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোন ধরে কর্নেল সাড়া দিলেন। তারপর ক্রমাগত হ্যাঁ, হুঁ, ওকে, ঠিক আছে ইত্যাদি বলে গেলেন। তারপর ঘড়ি দেখে বললেন, সাড়ে সাতটা বাজে। চলো! আমরা নীচে যাই। ও সি মিঃ জেনা এবং ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পটনায়ক সদলবলে আসছেন।

কৌশল্যাদি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আবার কি জেরা শুরু হবে?

 কর্নেল বললেন, না। একটা নাটক দেখতে পাবে।

বিস্মিত কৌশল্যাদি আমার দিকে তাকালেন। আমি বললুম, চলুন তো।

কর্নেল তার কিটব্যাগ নিয়ে বেরোলেন। বললেন, নাটকের সময় তোমরা চুপ করে থাকবে। আমরা দুজনে তাকে অনুসরণ করলুম। মনে মনে বলুলম, আমি সাংবাদিক, চুপ করে থাকার গ্যারান্টি দিচ্ছি না।

লাউঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকজন অচেনা লোক বসে আছে দেখলুম। বারের সামনে অল্প ভিড়। ক্যান্টিনে কয়েকজন বোর্ডার বসে চা বা কফি খাচ্ছেন। আমরা লাউঞ্জে রিসেপশনের কাছাকাছি এবং হোটেলের দরজার সামনাসামনি বসলুম। ম্যানেজার মিঃ মহাপাত্র এসে চাপা স্বরে বললেন, সঞ্জয়ের ডিউটি শেষ। কিন্তু তাকে যেতে দিইনি।

কর্নেল বললেন, ওকে ওভার ডিউটির টাকা দেবেন। দেওয়া কর্তব্য।

মিঃ মহাপাত্র একটু হেসে বললেন, আপনি যখন বলছেন, তা-ই দেওয়া হবে। তাহলে সঞ্জয় খুশি হবে।

কিছু বুঝলুম না। কিন্তু এখন কর্নেলের হাবভাব অন্যরকম। বাঘ শিকারের ওপর ঝাঁপ দেবার আগে যেমন ঘাপটি পেতে বসে, ওঁর চেহারায় সেই ভঙ্গি।

পাঁচ মিনিটের মধ্যেই দুই পুলিশকর্তা এসে ঢুকলেন। লক্ষ্য করলুম, লনে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী এসে দাঁড়াল। মিঃ জেনা এবং মিঃ পটনায়ক লাউঞ্জে দুটো খালি আসনে বসলেন।

অস্বস্তিকর স্তব্ধতা! মনে হচ্ছিল আমরা চলেছি চূড়ান্ত বিস্ফোরণের জিরো আওয়ারে। কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। দশ… নয়… আট… সাত… ছয়… পাঁচ…

ডঃ হাজরা এবং তার স্ত্রী নেমে এলেন। কোনোদিকে না তাকিয়ে তারা ক্যান্টিনহলে ঢুকলেন। ম্যানেজার পাথরের মূর্তির মতো কাউন্টারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রিসেপশনে এক তরুণী টেলিফোন তুলে কাকে বলল, বিল। পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার! ব্যাগেজ আনতে লোক যাচ্ছে।

বুঝলুম, ডঃ বিক্রমজিৎ পাণ্ডে চেক-আউট করছেন। পৌনে আটটা বাজে। ওঁর ট্রেন রাত নটার পর।

কিছুক্ষণ পরে একজন হোটেলবয় ডঃ পাণ্ডের ব্যাগেজ নিয়ে নেমে রিসেপশনের কাছে এল। তারপর ডঃ পাণ্ডে নেমে এসে বললেন, মিঃ মহাপাত্র। পেমেন্ট করব।

ডঃ হাজরা ক্যান্টিনহল থেকে তাঁকে দেখতে পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে এলেন। বললেন, এখনই চলে যাচ্ছেন?

ডঃ পাণ্ডে বললেন, একটু সময় হাতে রেখে যাওয়াই ভালো।

অটোরিকশা বলা আছে তো?

বলা নেই। নীচে পেয়ে যাব। বলে ডঃ পাণ্ডে পার্স থেকে টাকা বের করে ম্যানেজার মিঃ মহাপাত্রের হাতে দিলেন। তারপর রিসিট নিয়ে পা বাড়ালেন। আপনার মিসেস কোথায় মিঃ হাজরা?

ওই তো ক্যান্টিনে বসে আছে। বলে ডঃ হাজরা তার স্ত্রীকে হাতের ইশারায় ডাকলেন।

মালবিকা হাজরা এসে বললেন, চলে যাচ্ছেন মিঃ পাণ্ডে? আমার খুব। খারাপ লাগছে। কয়েকটা দিনের সুন্দর স্মৃতি মনে গাঁথা থাকল। বেড়াতে ভালোই লেগেছে। শুধু ওই হতভাগা মেয়েটির কথা কাটার মত বিঁধছে।

ওঁরা পরস্পর নমস্কার করার পর ডঃ পাণ্ডে দরজার দিকে এগোচ্ছেন, হঠাৎ কর্নেল উঠে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, এক মিনিট। আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।

ডঃ পাণ্ডের কাঁধে একটা ব্যাগ। কয়েক পা সরে গিয়ে তিনি ব্যাগটা দেখিয়ে হাসলেন। এতে কোন চোরাই মাল নেই কর্নেল সরকার!

কর্নেল বললেন, চোরাই মালটা এখন আমার এই ব্যাগে শৰ্মাজি!

ডঃ পাণ্ডে চাপা গর্জে বললেন, কী? শর্মাজি মানে? কী বলতে চান আপনি?

রাহুল শর্মাকে শর্মাজি বললে অপরাধ হয় না।

মিঃ জেনা এবং মিঃ পটনায়ক এগিয়ে এলেন সঙ্গে সঙ্গে। তারপর লাউঞ্জ থেকে কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ এসে ঘিরে ধরল ডঃ পাণ্ডে-কে। আমি হতবাক। কৌশল্যাদিও তা-ই। এ কি দুঃস্বপ্ন?

ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পটনায়ক বললেন, রাহুল শর্মা। তোমাকে একটি হত্যা, চুরি এবং মিসপার্সোনিফিকেশনের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হল।

দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ ডঃ পাণ্ডে-বেশী রাহুল শর্মার দুটো হাতে হাতকড়ি এঁটে দিল। বার, লাউঞ্জ এবং ক্যান্টিন থেকে বোর্ডাররা এসে ততক্ষণে ভিড় করেছেন। কিন্তু পুলিশের লোকেরা তাদের কাছে আসতে দিল না। সত্যিই এ এক জমাটি নাটক। আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি ডঃ পাণ্ডে একজন জাল মানুষ।

কর্নেল বললেন, রাহুল শর্মা! আজই আমরা খবর নিয়েছি, পাটনায় ডঃ বিক্রমজিৎ পাণ্ডে এখানে রওনা হওয়ার আগের দিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি নার্সিংহোমে ভর্তি হন। আর সেই সুযোগে তার ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট রাহুল শর্মা তার তৈরি সেমিনার পেপার, আমন্ত্রণপত্র, এমন কি তার এক প্যাকেট নেমকার্ড চুরি করে নিজেই ডঃ পাণ্ডে সেজে এখানে চলে আসে।

আমি অবাক হয়ে শুনছিলুম। এবার সাংবাদিকতার অভ্যাসবশেই বলে উঠলুম, এই সম্মেলনে বহু বিজ্ঞানী এসেছিলেন। ডঃ বিক্রমজিৎ পাণ্ডেকে তাদের চেনার কথা। কেন তারা চুপ করে ছিলেন?

কর্নেল মুখ খোলার আগেই ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর কল্যাণ পটনায়ক সহাস্যে বললেন, আপনি একজন সাংবাদিক। ঠিক প্রশ্নই তুলেছেন। কিন্তু এর উত্তর আমরা পেয়ে গেছি। টেলিফোনে পাটনায় ডঃ পাণ্ডের সঙ্গে আজ দুপুরে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফিরে তাঁর ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের কুকীর্তি জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, সে চন্দনপুর-অন-সিতে প্রকৃতি পরিবেশ সম্মেলনে নিজেই ডঃ পাণ্ডে সেজে যোগ দিতে এসেছে। আমার মুখে কথাটা জানার পর ডঃ পাণ্ডে বললেন, তিনি এই সম্মেলনে আমন্ত্রিত বিজ্ঞানীদের তালিকা দেখে তার সহকারী এই রাহুল শর্মাকে বলেছিলেন, সরকার কী যে করছেন! অজানা-অচেনা সব ভূঁইফোড় বিজ্ঞানীদের নিয়ে এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন করছেন। এঁদের মধ্যে বাঙ্গালোরের জিনোমবিজ্ঞানী ডঃ রঘুবীর আচারিয়ার নামটা তার পরিচিত। তবে তার সঙ্গে আজও তাঁর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। হ্যাঁ, অশোক সাঠের মুখে দিল্লির আরেক জিনোমবিজ্ঞানী ডঃ কৌশল্যা বর্মনের কথা তিনি শুনেছেন। সেই মহিলাবিজ্ঞানী নাকি জিনোমতত্ত্ব ঘেঁটে একটা বৈপ্লবিক ফরমুলা তৈরি করেছেন। অশোক সাঠে এ প্রসঙ্গে তাকে বলেছিলেন, ফরমুলাটা সত্য হলে ভারতের শত্রু রাষ্ট্ররা তো বটেই, বিদেশি রাষ্ট্রও কোটি-কোটি ডলার দাম দিয়ে কিনে নেবে। জয়ন্তবাবু! তা হলেই বুঝুন, কেন এই সুযোগ ছাড়তে চায়নি রাহুল শর্মা। স্বকর্ণে এইসব কথা ডঃ পাণ্ডের মুখে শোনার পর সে তক্কে তক্কে ছিল।

কৌশল্যাদি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কর্নেল তাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। অশোক সাঠে জাল ডঃ পাণ্ডেকে দেখে নিশ্চয় অবাক হয়েছিলেন। কারণ তিনি ডাঃ পাণ্ডের এই সহকারীকে চেনেন। ঠিক এখানেই একটা গোপন চুক্তি হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। অশোক সাঠের উপস্থিতিতে কৌশল্যার সেই ফরমুলা ফাইল চুরি হলে কৌশল্যার সন্দেহ হবে অশোক সাঠেকেই। কৌশল্যা পুলিশকে তার পেছনে ছোটাতো। তাই অশোক সাঠে চলে যাবার পর চুরিটা হোক। কৌশল্যা! এবার তুমি বলো, অশোক সাঠে চলে যাবার পরদিনও তুমি তোমার ফরমুলার ফাইল আছে দেখেছিলে কি না?

কৌশল্যাদি বললেন, হ্যাঁ। ছিল আপনাকে তো বলেছি কোথায় এবং কীভাবে রাখা ছিল।

কর্নেল বললেন, অশোক সাঠে চলে যাবার আগে রাহুল শর্মাকে ওই ফাইল চুরির জন্য চরম তাগিদ দিতেই হোটেল দ্য শার্ক থেকে একজন কর্মীর হাতে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই কর্মী চিঠিটা তার নির্দেশ অনুসারে সরাসরি জাল ডঃ পাণ্ডের হাতে দিতে এসেছিল। কিন্তু রিসেপশনে খোঁজ নেবার সময় কর্মীটি বাবু দণ্ডধর দাস যিনি দাসবাবু নামে পরিচিত, তাকে ভুল করে ডঃ পাণ্ডে নামের বদলে ডঃ পণ্ডা নাম বলে। মুখ আঁটা খামে শুধু লেখা ছিল ডঃ পাণ্ডে। এখন মজার ব্যাপার হল, চারতলার ২২ নম্বর সিঙ্গল স্যুইটে আছেন সম্বলপুরের জনৈক ডাক্তার নন্দকিশোর পণ্ডা। ওড়িশায় এই পদবি সুপরিচিত। অন্যমনস্ক দাসবাবু হোটেলবয় সঞ্জয়কে হোটেল দ্য শার্কের কর্মী অনন্তের সঙ্গে ডাক্তার পণ্ডার ঘরে পাঠান। সঞ্জয় এখানে উপস্থিত আছে। যথাসময়ে সে কথা বলবে। এইবার আমি ডঃ নন্দকিশোর পণ্ডাকে অনুরোধ করছি। বাকিটুকু তিনি বলুন।

লাউঞ্জের একপ্রান্তে ভিড় থেকে একজন স্থূলকায় ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। তিনি আড়ষ্টভাবে কষ্টকর ইংরেজিতে বললেন, আমি খামে লেখা নামটা ভালো করে পড়িনি। পি এন ডি এই তিনটে হরফ চোখে পড়েছিল শুধু। কিন্তু খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠি পড়ে আমি মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলুম না। লেখা আছে : লাল ফাইল। এক লক্ষ টাকা পুরস্কার। তলায় শুধু এ এস লেখা। কিছুক্ষণ পরে আমার মনে হল এই অদ্ভুত চিঠি তাহলে অজিত সান্যালের দুষ্টুমি।

কর্নেল বললেন, কে অজিত সান্যাল সে-কথা বলুন!

 ডঃ পণ্ডা বললেন, আপনারা যাকে পাগলাবাবু বলে জানেন, তিনি আমাদের সম্বলপুরেরই আরেক ডাক্তার ছিলেন। জানি না কেন তিনি গতবছর হঠাৎ পাগল হয়ে নিখোঁজ হন। তাঁকে চন্দনপুর-অন-সিতে বেড়াতে এসে আবিষ্কার করেছিলুম। উনি আমাকে দেখেই পালিয়ে যান। তো চিঠিটা পাওয়ার পর ধরেই নিলুম পাগল ডাক্তারের কীর্তি। আজ সন্ধ্যার একটু আগে উনি নীচের রাস্তায় নাচগান করছিলেন। তখন তাঁকে চিঠিটা খামসুদ্ধ দেখিয়ে

আমি সাংবাদিক বলে এখানে পরিচিত। তাই তার কথার ওপর প্রশ্ন করলুম, আপনি চিঠিটা তা হলে রেখে দিয়েছিলেন কাছে?

হ্যাঁ। অজিত আমার বন্ধু। পাগল হয়ে আমার সঙ্গে কেন এই মজা করেছেন, জানতে ইচ্ছে করছিল। পাগলামি তো বটেই। তবু এই সুযোগে যদি তার সঙ্গে কথা বলা যায়। তাই তাঁকে চিঠিটা দেখালুম। বললুম, লাল ফাইল কী অজিত? এক লক্ষ টাকা পুরস্কার আমাকে দেবে কেন? অজিত ডাক্তার আমার হাত ধরে টেনে রাস্তার এক ধারে নিয়ে গেলেন। বাচ্চা ছেলের মতো খিলখিল করে হেসে বললেন, গাধার গলায় লাল ফাইল ছিল। গাধাটা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। ওরে বাবা! এক লক্ষ টাকা পুরস্কার? এ কি কম কথা? চলে যাও মাথায় টাক মুখে দাড়ি সান্টা ক্লজের কাছে। জানো না? সান্টা ক্লজ পুরস্কার দেয়? ওকে জিজ্ঞেস করলুম, কে তিনি? তখন অজিত ডাক্তার দুটো হাত গোল করে দুই চোখে রেখে বললেন, পাখি দেখে। প্রজাপতি পেলেই–ওরে বাবা! খ করে ধরে। আমি পালাই। অজিত ডাক্তার দৌড়ে বিচের দিকে গেলেন। তারপর আমার মনে পড়ল, যাঁর কথা অজিত বলল, তাকে তো আমি দেখেছি। এই হোটেলে তিনি আছেন। রিসেপশনের দাসবাবুকে নাম জিজ্ঞেস করলুম। উনি বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

কর্নেল বললেন, আমি তখন সবে আমার স্যুইট থেকে বেরিয়ে ডঃ হাজরার রিসার্চ পেপার নিয়ে তিনতলায় উঠছি, ডঃ পণ্ডা বললেন, আপনার সঙ্গে কথা আছে। ওঁর কথা শুনে খামসুদ্ধ চিঠিটা পকেটে রেখে দিয়ে বললুম, নীচে ক্যান্টিনে গিয়ে অপেক্ষা করুন। সব বুঝতে পারবেন। এবার হোটেল বয় সঞ্জয়, তার কথা বলুক!

 ম্যানেজার মিঃ মহাপাত্র সঞ্জয়কে ঠেলে বের করে দিলেন। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পটনায়ক ওড়িয়া ভাষায় তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হোটেল- দ্য শার্কের অনন্তের সঙ্গে তুমি ডঃ পণ্ডাকে চিঠি দিতে গিয়েছিলে?

সঞ্জয় ওড়িয়াতে জবাব দিল, হা স্যার! আমার সামনে অনন্ত ডঃ পাকৈ চিঠি দিল।

কর্নেল আমাকে অবাক করে ওড়িয়াতে তাকে বললেন, পরশু সন্ধ্যার আগে কী দেখেছিলে, সেই কথাটা এবার বলো?

সঞ্জয় ঢোক গিলে বলল, আমি চারতলার ২১ নম্বরে চা দিতে যাচ্ছিলুম। তিনতলায় ওঠার সময় দেখলুম, উনি ১৭ নম্বর সুইট থেকে বেরিয়ে একটা লালরঙের প্যাকেটের মতো জিনিস হাতে করিডর দিয়ে জোরে হেঁটে চলে গেলেন। তারপর নিজের ঘরে ঢুকলেন।

ও সি রণবীর জেনা ধমক দিলেন উনি কে? দেখিয়ে দাও!

সঞ্জয় জাল ডঃ পাণ্ডে অর্থাৎ রাহুল শর্মাকে তর্জনী তুলে দেখিয়ে দিলেন।

ওসি মিঃ জেনা হাসলেন। রাহুল শর্মা কোন দোকানে দড়ি কিনেছিল, তার খোঁজ আমরা পেয়েছি। কোন অটোরিকশাতে সে শিখের ছদ্মবেশে চেপেছিল, তাও আমরা খুঁজে বের করেছি।

কর্নেল বললেন, আমাদের বিভ্রান্ত করে ভুল পথে ছোটাতে এই রাহুল শর্মা শিখ সেজেছিল। তিনি কিটব্যাগ থেকে শিখের ছদ্মবেশ বের করে মিঃ জেনার হাতে তুলে দিলেন।

ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পটনায়ক বললেন, স্থানীয় সমুদ্রবিজ্ঞানী উমেশ ঝার সঙ্গে এই জাল ডঃ পাণ্ডে ভাব জমিয়েছিল। ডঃ ঝা ডঃ পাণ্ডেকে কখনও দেখেননি। তিনি রাহুল শর্মাকে নিজের বাড়িতে খাইয়েছিলেন। ডঃ ঝা নিরীহ গোবেচারা ভালোমানুষ। তিনি তখন জানতেন না তাঁর সঙ্গে জাল ডঃ পাণ্ডের ভাব জমাবার উদ্দেশ্য কী? বছর দুই আগে সমুদ্রবিজ্ঞানের এক শিখকর্মী তার অধীনে কাজ করতেন। বদলি হয়ে যাওয়ার সময় শিখকর্মী মহিন্দার সিংহ তার বসের অভিপ্রায় অনুসারে একপ্রস্থ শিখপোশাক তাঁকে স্মারকচিহ্ন হিসাবে উপহার দিয়ে যান। সেই পোশাক ডঃ ঝার বসার ঘরের দেয়ালে সাজানো ছিল। নেমন্তন্ন খেতে গিয়েই তা জাল ডঃ পাণ্ডের চোখে পড়েছিল। আজ সকালে এই জাল ডঃ পাণ্ডে তার বাড়ি গিয়ে কৌতুকের ছলে শিখ সাজতে চেয়েছিল। ডঃ ঝা কৌতুক ভেবেই তাকে শিখের পোশাক দেন। পাগড়ি, কুর্তা, চুত্ত পাজামা, কঙ্গন, বালা আর কৃপাণ। বাকি রইল গোঁফ-দাড়ি গোঁফ-দাড়ি শর্মা সঙ্গে নিয়েই এসেছিল, যদি কোনো প্রয়োজনে লাগে। শিখ সেজে সে ডঃ ঝাঁকে বলেছিল, পূর্বাচলে গিয়ে সে তার বন্ধু ডঃ হাজরা–বিশেষ করে ডঃ হাজরার স্ত্রী মালবিকা হাজরার সঙ্গে কৌতুক করবে। তারপর ডঃ ঝার এই স্যুভেনির সে। ফেরত দেবে।

মিঃ মহাপাত্র বললেন, ডঃ উমেশ ঝা বেলা এগারোটা নাগাদ এসে আমাকে ডঃ পাণ্ডের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি বললুম, ডঃ হাজরা সস্ত্রীক পার্বতীর মন্দিরে যাবেন বলছিলেন। হয়তো ডঃ পাণ্ডে তাদের সঙ্গেই গেছেন। শুনে ডঃ ঝা হাসতে হাসতে আমাকে ডঃ পাণ্ডের শিখ সেজে হাজরা দম্পতির সঙ্গে কৌতুক করার ব্যাপারটা বললেন। আমিও তখন এটা নিছক কৌতুক ভেবেছিলুম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, বেগতিক দেখে শিখ সেজে পালাবে বলেই শর্মা পোশাক ফেরত দেয়নি ডঃ ঝাকে।

কর্নেল বললেন, শিখ সেজে রাহুল শর্মা পার্বতীর মন্দিরে গিয়ে কোনো গোপন জায়গায় সম্ভবত উল্টোদিকে ঝোপের আড়ালে পোশাক বদলে মটকার ধুতি-চাদর পরে সাত্ত্বিক ভক্ত সেজে নিয়েছিল। তাকে নিয়ে-যাওয়া অটোরিকশার ড্রাইভার তখন তাকে চিনবে কেমন করে? যা-ই হোক, সে খালি অটোরিকশার ড্রাইভারকে তার জন্য অপেক্ষা করতে বলে কুড়ি টাকা অগ্রিমও দেয়। আপনি ঠিক ধরেছেন মিঃ মহাপাত্র। বিপদ বুঝলে শিখ সেজে পালাবে বলেই পোশাক লুকিয়ে রেখেছিল রাহুল শর্মা।

মিঃ পটনায়ক বেটন নাচিয়ে রাহুল শর্মাকে বললেন, তোমার বাঁচবার কোনো উপায় নেই। সেই অটোরিকশার ড্রাইভার একজন সাক্ষী। ডঃ উমেশ ঝা-ও তোমার কীর্তি শুনে আগুন হয়ে জ্বলছেন।

কর্নেল মুখে দুঃখ ফুটিয়ে বললেন, বেচারি কৌশল্যার ফাইলটাই পাওয়া গেল না। বেওয়ারিশ গাধাটা হয়তো সত্যি ওটা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। তা খা। আপদ গেছে। কী বলল কৌশল্যা?

কৌশল্যাদি শুধু একটু হাসলেন।

তা হলে আসামী নিয়ে আমরা এবার রওনা হই। এই নাটকের প্রধান কৃতিত্ব কিন্তু একান্তভাবে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের।

বলে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পটনায়ক, ও সি মিঃ জেনা এবং সাদা পোশাকের পুলিশের দলটি জাল ডঃ পাণ্ডে অর্থাৎ রাহুল শর্মাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

তারপরই আবার এক নাটক। পাগলাবাবু সবেগে লাউঞ্জে প্রবেশ করে চেঁচিয়ে উঠলেন, চি-ই-চি-ইং ফা-আঁ-আঁক! বাব্বা! ইয়া মোটা পাথর তুলে ছুঁড়ে মেরেছিল দস্যু সর্দার। আলিবাবা বলেই বেঁচে গেছি। কাশিম হলে অক্কা পেতুম। আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের গল্প! মাইরি বলছি, এক কাপ কফি খেতে চেয়েছিলুম। বলে কী, তুই তো গাধার সঙ্গী। গাধা কি কফি খায়? হুঁ হুঁ। ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি! আমি মাইরি তক্কে তক্কে ছিলুম। ব্যাটাছেলেকে শুনিয়ে গান গাইতুম,

পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল
মাইরি রাতি পোহাইল

পাখি ডাকছে! সব ফর্সা! তোমার কারসাজি সব ফর্দাফাঁই! তাই কি না–

কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল
মাইরি সকলি ফুটিল—

ব্যাটা খু-উ-ব জব্দ হয়েছে! চোরের ওপর বাটপাড়ি করেছিলুম। কিন্তু হায়! হায়! অমন সুন্দর রোগভোগা নিরীহ মেয়েটার গলায় ফাঁস আটকে মারলে গো! ও হো হো হো!

বলে পাগল ডাক্তার অজিত সান্যাল দুহাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।

ডঃ নন্দকিশোর পণ্ডা তার পেছনে ছুটে গেলেন। অজিতবাবু! অজিতবাবু! শুনুন!

কৌশল্যাদি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ওঁকে যেভাবে হোক আমি দিল্লি নিয়ে যাব। ওঁর চিকিৎসা করাব।

কর্নেল ডঃ হাজরাকে জিজ্ঞেস করলেন, শ্রাবন্তীর বাবা বা অন্য কেউ আসেননি?

মিসেস মালবিকা হাজরা চোখ মুছে বললেন, হতভাগিনীর বাবা তো রুগী। আর কে আছে যে ছুটে আসবে? আমিই ওর ডেডবডি বুকে করে নিয়ে যাব।

বেঁচে থাকতে মেয়েটাকে দুচোখে দেখতে পারতুম না। এখন কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে!

ডঃ হাজরা বললেন, আমি গিয়ে দেখি, কী করা যায়।

মালবিকা প্রায় গর্জে বললেন, চু-উ-প করে বসে থাকো এখানে। আমিই যাচ্ছি। এক খুনে ডাকাতের সঙ্গে একা ঘুরে বেড়াতে পেরেছি। এটুকু পারব না? দরদ উথলে উঠেছে এতক্ষণে। বলে স্থূলাঙ্গিনী ভদ্রমহিলা চটির শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলেন।

ডাঃ হাজরা বিব্রতভাবে স্ত্রীকে অনুসরণ করলেন।

আমি কৌশল্যাদিকে বললুম, মানব চরিত্র সত্যি দুয়ে কৌশল্যাদি!

কৌশল্যাদি আস্তে বললেন, প্রথমে আমার সন্দেহ হয়েছিল চুরির সঙ্গে শ্রাবন্তীর মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। মিসেস হাজরাই হয়তো প্রতিহিংসাবশে শ্রাবন্তীকে ফঁসে আটকে মেরেছেন।

কর্নেল ভারি গলায় বললেন, আমি তৃষ্ণার্ত! কৌশল্যা! জয়ন্ত! চলো! ঘরে গিয়ে কফি খাওয়া যাক।

নবকে ডেকে তিনি কফির অর্ডার দিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন। দরজা খুলে আমি ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেলুম। ব্যালকনির দরজা খোলার পর সমুদ্রের দিকে তাকালুম। রাতের সমুদ্র যেন পাগলাবাবুর মতো হাহাকার করছে। আর ভেসে আসছে ভিজে উদ্দাম হাওয়ায় ক্রমাগত মৃত্যুর নোনা ঠাণ্ডা হিম গন্ধ।…