৫. অফিসে এসে

অফিসে এসে বিলকে দেখতে পেলাম না। মিস অ্যাঙ্গাসের উকিল সলি লিউইসকে একটা ফোন করলাম।

আমি অ্যাকমের ওয়ালেস বলছি। আপনি কি ব্যস্ত আছেন?

না, কি ব্যাপার বলুন তো?

দয়া করে মন দিয়ে সব শুনুন, বলে ব্যাঙ্কে যা যা ঘটেছে সব বললাম।

মিঃ লিউইস সব শুনে বললেন। তাহলে আমি ধরে নিতে পারি যে টেরেন্স থরসেন আর টেরি জিগলার একই লোক।

ঠিক ধরেছেন। এবার একটা কথার জবাব দিন। টেরি জিগলার যদি মারা যায় তাহলে মিস অ্যাঙ্গাসের সেই একলক্ষ ডলারের কি গতি হবে?

সাময়িকভাবে কেউ পাবে না। পরে টেরির নিকট আত্মীয় টাকাটার মালিক হবেন।

নিকট আত্মীয় বলতে কাকে বোঝায়, মা না বোন?

এক্ষেত্রে মা।

ধন্যবাদ, আপনি একটা কাজ করবেন। মিঃ অকল্যান্ডকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন যে উপযুক্ত দাবীদারের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিন্ত না হওয়া পর্যন্ত যেন টাকাটা তিনি ব্যাঙ্কের ভল্টেই রেখে দেন।

আমি এক্ষুণি ফোন করে ওকে একথা বলছি। বলেই তিনি লাইন ছেড়ে দিলেন।

আজকের রিপোর্টটা টাইপ করা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিল এসে হাজির হল।

কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমি তো ভাবলাম তুমি মরে গেছে।

দাঁড়াও আগে একটু ড্রিঙ্ক করে নিই, তারপর সব বলছি। খাটতে খাটতে জান কয়লা করে ফেলেছি সে খবর রাখো?

ছটা চল্লিশ বাজে। অফিসের সময় অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে জেনে আমি একটা স্কচের বোতল বের করলাম। অফিসের কাজের পর দরকার হলে আমরা খাই। হুইস্কিতে বরফ দিয়ে গ্লাসটা বিলের দিকে এগিয়ে দিলাম। বিল দু-চার চুমুক দিতে বললাম, এবার বলো তো এতক্ষণ কোথায় ছিলে?

আর বল কেন? অকল্যান্ডের কামরা থেকে ঐ ছোঁড়াটা রেগেমেগে বেরিয়ে যেতে আমি ওর পিছু নিলাম। ও একটা পুরনো হন্ডা মোটর সাইকেলে এসেছিল। আমি কিছুটা তফাৎ রেখে তার পেছনে যেতে লাগলাম। একসময় ও ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায় যেতে আমি ভাবলাম ও নিশ্চয়ই সেই কালোদেরনাইটক্লাবব্ল্যাক ক্যাসেটে যাবে। কিন্তু দেখলাম ওটার পাশ কাটিয়ে ব্যাটা অয়স্টার অ্যালির সামনে এসে দাঁড়াল। আমি গাড়ি পার্ক করে এসে দেখি একটা বাড়ির সামনে ওর হস্ত দাঁড় করান। মোটর সাইকেলের নম্বর নিয়ে আমি গাড়ি রেজিস্ট্রেশান অফিসে গেলাম। সেখানে জানতে পারলাম ছেলেটার নাম গেরেন্ডা। ৩ নম্বর অয়েস্টার অ্যালিতে ১০ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টে থাকে।

গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে আবার বলতে শুরু করল, তারপর ওখান থেকে গেলাম থানায়। সেখানে জোবিগলারের সঙ্গে কথা বললাম। জো জানতে চাইল লু গেরে সম্পর্কে আমি এতকথা জানতে চাইছি কেন। আমি শুধু বললাম দরকার আছে। জো বলল, লু এখনও কোন অপরাধ করেনি কিন্তু পুলিশ ওর ওপর নজর রেখে চলেছে। কারণ ওর বাবা মাফিয়াদের হয়ে কাজ করতো। লুবয়স যখন পনেরো বছর তখন ওদের দলের লোকেরাই ওর বাবাকে খুন করে। তারপর লু ওয়াটার ফ্রন্টে ঠিকে মজুরের কাজ পায় এবং সেই টাকায় নিজের ও মায়ের পেট চালাতে শুরু করে। ওর মা বেশ কিছুদিন আগে মারা গেছে। লু ছেলেটা জাতে সিসিলিয়ান তাই ওর ওপর বিগলারের সন্দেহ। কিন্তু তাকে হাতে নাতে ধরার মত এখনও কিছু পায় নি। ওয়াটার ফ্রন্টে চলে এলাম। সেখানে আমার কয়েকটা চেনা ছোকরার কাছে গেরেন্ডার সম্পর্কে জানতে চাইলাম। ওরা ঠিক জানে না ওর রোজগারের পথটা কি। এই হল আমার আজকের কাজের রিপোর্ট ডার্ক।

তুমি অনেকদূর এগিয়েছে বিল। আমি অ্যাল বার্নির সঙ্গে কথা বলব। হয়তো কোনও খবর দিতে পারে।

আমার টেবিলের ওপর ইন্টারকমটা বেজে উঠতেই সুইচ টিপলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্নেলের সেক্রেটারী কেরীর গলা ভেসে এল।

ডার্ক, থরসেন ফাইলটা একবার নিয়ে আসুন।

 বিলকে বললাম কি ব্যাপার হঠাৎ ফাইলের খোঁজ পড়ল কেন?

ফাইলটা নিয়ে গ্লেন্ডার কামরায় গিয়ে ফাইলটা টেবিলে রেখে বললাম, একদম আপটু ডেট করা আছে।

গ্লেন্ডা বলল, কর্নেল পার্নেল আগামীকাল সকালে ফিরছেন। ফিরে এসেই উনি এটা দেখতে চাইবেন। তবে তদন্তের কাজও এখানেই শেষ। মিসেস খরসেন একটু আগে ফোন করেছিলেন। উনি বললেন, যে এ কেস নিয়ে উনি আর মাথা ঘামাতে চান না। কাজেই উনি আর টাকাপয়সা দেবেন না। অতএব থরসেন কেসের কথা ভুলে যান, ডার্ক।

তার মানে এত পরিশ্রম, এত ছোটাছুটি সব মিথ্যে হল। শুধু শুধু সময় নষ্ট?

মিসেস থরসেনের কেসটা নিয়ে আমরা যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছি। সময় নষ্ট একথা আমি বলব না।

ব্যাপারটা যখন ভালভাবে দানা পাকিয়ে উঠেছে তখনই কেসটা উনি থামিয়ে দিলেন। যাকগে এবার কি করব? পরের কাজ কি?

সেটা কর্নেল এসে ঠিক করবেন। কাল আপনি ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন।

 ফিরে এসে বিলকে খবরটা দিতেই সে হতাশ হয়ে বলল, হায় ঈশ্বর!

বাদ দাও। কর্নেল আমাদের নতুন কোন কেস দেবেন। চলো সাতটা কুড়ি বাজে আমরা খেয়ে নিই। আজ আবার লুসিনোয় যাবে নাকি?

চমৎকার! চলে যাওয়া যাক।

টেলিফোন বেজে উঠতে একটু অধৈর্য ভঙ্গিতেই রিসিভারটা তুললাম। বলতে বাধা নেই আমার প্রচণ্ড ক্ষিদেও পেয়েছিল। সেইসঙ্গে থরসেন কেসের তদন্তের অকালে পরিসমাপ্তিতে যেন দমে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি যে এই টেলিফোন কল আমার গোটা জীবনধারাকে পাল্টে দিতে যাচ্ছে।

ডার্ক ওয়ালেস বলছি। আপনি কে বলছেন?

 ওঃ ডার্ক তুমি! আমি বেটি স্টোয়েল বলছি।

বেটি স্টোয়েল সী–ভিউ হোটেলের তিন নম্বর রিসেপশনিস্ট। সুজির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। বেটি সুন্দর মেয়ে, তার একটি পুরুষবন্ধু আছে। তাকে বিয়ে করে সংসার পাতবার স্বপ্নে দিনরাত বিভোর হয়ে আছে সে।

— কিন্তু একি! রিসিভারটা ভাল করে কানে চেপে ধরে শুনলাম বেটি ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

কি হল বেটি? কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?

ওঃ ডার্ক। তোমায় কি করে খবরটা দেব বুঝতে পারছি না।

সুজির কিছু হয়েছে?

হা–ডার্ক, সুজি..সুজি আর নেই, ও মারা গেছে।

 কি বলছ তুমি? সুজি মারা গেছে?

হ্যাঁ।

 আমার নতুন জীবন গড়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। একটু চেঁচিয়েই বললাম।

কি হয়েছিল সুজির?

আমায় আর জিজ্ঞেস কোরনা ডার্ক। পুলিশ হেডকোয়ারটার্সে খোঁজ নাও। ওরাই বলে দেবে। বলেই বেটি লাইন ছেড়ে দিল।

আমি দুঃখিত ডার্ক। বেটির সঙ্গে কথাবার্তা কিছু শুনেছি; বলেই বিল বেরিয়ে গেল।

পুলিশ হেডকোয়াটার্সে জো বিগলারকে ফোন করলাম।

জো, আমি ডার্ক ওয়ালেস বলছি।

ডার্ক, দপ্তর গুছিয়ে বাড়ি যাব। এমন সময় তুমি ফোন করলে। কালকে না হয় একবার ফোন

সুজি লং কিভাবে মারা গেল জো? ওর কি হয়েছিল?

 ওর সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক?

 ও আমার বান্ধবী ছিল জো। আমরা আর কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে করতাম।

হা ভগবান, এতো তাহলে খুব দুঃখজনক ব্যাপার।

ও কিভাবে মারা গেল জো?

 মিস লং হোটেলে যাবার জন্য সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, সেই সময় একটা গাড়ি এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে একজন ওকে জিজ্ঞেস করে ওয়েস্টাবেরী ড্রাইভে যেতে হলে কোন রাস্তা ধরবে। মিস লংয়ের পাশ দিয়ে দুজন মাঝবয়সী মহিলা যাচ্ছিলেন। লোকটির কথা তাদের কানে যায়। মিস লং কিছু বলার আগেই গাড়ির ভেতর থেকে কেউ অথবা সেই লোকটি তার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে। তারপর ফুলস্পীডে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়। মিস লং দুহাতে মুখ ঢেকে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে দৌড়চ্ছিলেন। এমন সময় একটা ট্রাক এসে চাকার নীচে ওর শরীরটাকে পিষে যায়।

সুজির মারা যাবার ঘটনা শুনে আমি কথা বলার ক্ষমতা সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেললাম। বিগলার বলল, আমাদের লোকেরা তদন্ত করছে। কিন্তু সন্তোষজনক এখনও কিছু খুঁজে পায়নি। যে দুজন মহিলা সাক্ষীকে পেয়েছি তারা বিশেষ কিছুই বলতে পারেন নি। গাড়িটার রং কি বা তার ভেতরের যে লোকটি মিস লংয়ের সঙ্গে কথা বলছিল তাকে দেখতে কেমন কিছুই বলতে পারছে না। তবে তাদের একজন বলেছেন, যে গাড়ির ড্রাইভার কালো ছিল তিনি নিশ্চিত। আশেপাশের সবাইকে জেরা করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে সন্দেহজনক কেউ শিগগিরই গ্রেপ্তার হবে।

ড্রাইভারটি কালো ছিল। জো বিগলারের এই একটি কথা আমার মাথায় তোলপাড় করতে শুরু করল।

ওকে কোথায় রাখা হয়েছে জো?

বিগলার বলল, আপাততঃ মর্গে। শোন ডার্ক, ব্যাপারটা এখনকার মত ভুলে যাও, তুমি এ নিয়ে আর ভাবতে যেও না। হোটেলের স্টাফ ম্যানেজার মিস লংয়ের মৃতদেহ সনাক্ত করেছেন। আমরা ওর বাবাকে ট্রাঙ্কল করেছি। উনি প্লেনে চেপে রওনা হয়েছেন। আগামীকাল সকালে এসে মেয়েকে কবর দেবেন। আমার কথা শোন ডার্ক, তুমি মর্গে সুজিকে দেখতে যেয়ো না। অ্যাসিডে ওর মুখ ঝলসে গিয়েছিল যা দেখে তুমি সহ্য করতে পারবে না। আর ট্রাকে গোটা শরীরটা এমন থেতলে গিয়েছিল দেখা যায় না। তুমি আর ওকে শেষ দেখা দেখতে যেও না।

ধন্যবাদ জো, বলে আমি রিসিভারটা নামিয়ে রাখলাম। জো ঠিকই বলেছে। সুজির হাসিখুশি সুন্দর মুখখানাই আমার স্মৃতিতে ধরে রাখব। না, ওকে সমাধি দেবার সময় আমি যাব না।

একটা সিগারেট ধরিয়ে অসহায় ভাবে চুপচাপ বসে রইলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই এই একা অসহ্য ভাবটা আমার মনে এক অদ্ভুত জিঘাংসার জন্ম দিল, আমি মনে মনে সংকল্প করলাম, সুজির এই অকালমৃত্যুর প্রতিশোধ আমায় নিতেই হবে। সঙ্কল্পে বদ্ধপরিকর হয়ে আলো নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে লিফটে গেলাম।

অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছেচাবি দিয়ে দরজা খুলতে যেতেই চোখে পড়ল এক টুকরো কাগজ দরজার, গায়ে সেঁটে রয়েছে। তাতে লেখা–

তোমায় হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছিল

.

অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে ভাল করে স্নান করে তারপর ব্যাঙ্কের পাশবুক খুলে দেখলাম আমার অ্যাকাউন্টে বারো হাজার ডলার পড়ে আছে। সুজিকে বিয়ে করে নতুন সংসার পাতব ভেবে ঐ টাকাটা এতদিন ধরে জমিয়েছি। সুজি নেই। এখন তাই নতুন সংসার পাতার স্বপ্ন ঘুচে গেছে।

একটা স্পোর্টস সার্ট আর লিনেনের ট্রাউজার চাপিয়ে গাড়ি চালিয়ে ওয়াটার ফ্রন্টে এলাম। গাড়ি পার্ক করে বাইরে বেরিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশ পরিষ্কার, পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায় টুরিস্টরা এসে ভীড় করেছে। দূর থেকে মাছধরা ছোট ছোট মোটর বোটগুলো এসে ভিড়েছে, কৌতূহলবশতঃ তারা সেগুলো দেখছে।

রাত সাড়ে নটা। হাঁটতে হাঁটতে নেপচুন সরাইয়ে গিয়ে ঢুকলাম। এখানে টুরিস্টরা আসে না। সাধারণতঃ স্থানীয় জেলেরাই এখানে খেতে আসে। ঘরের এককোণে একটি টেবিলে বসে আছে অ্যাল বার্নি আমার ইনফর্মার, তার সামনে বীয়ারের বোতল। আমি এগিয়ে তার মুখোমুখি বসতেই সে সহানুভূতির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।

আপনার কথাই ভাবছিলাম মিঃ ওয়ালেস। এসেছেন যখন দয়া করে কিছু খেয়ে যান।

এখানকার বার দেখাশোনার ভার যার উপর সেই স্যাম আমার পাশে দাঁড়াল; সহানুভূতির সুরে বলল, একটা কনড বীফ স্যান্ডউইচ খান, মিঃ ওয়ালেস, ভাল লাগবে। সেইসঙ্গে আমার আন্তরিক সহানুভূতি গ্রহণ করুন।

আমি বার্নির দিকে তাকাতেই ও বলল, হ্যাঁ মিঃ ওয়ালেস, অ্যাসিড ছোঁড়ার খবরটা জানাজানি হয়ে গিয়েছে। এই ব্যাপারে সবাই দুঃখ পেয়েছে। এক টুকরো মাংস মুখে পুরে সে বলল, আমি কি করতে পারি?

স্যাম একটা স্যান্ডউইচ আর আধগ্লাস স্কচ এনে আমার সামনে রাখল।

 মিঃ ওয়ালেস খান, এই বলে চলে গেল।

মিঃ ওয়ালেস, আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন, বানি বলল। যারা আমার উপকার করে তাদের কখনও ভুলিনা। আপনি আমার আর স্যামের কথা ভেবে স্যান্ডউইচটা খান।

স্যান্ডউইচ আর স্কচে চুমুক দিলাম। বানি বলল, আপনার কোন কাজে লাগতে পারি?

অ্যাল, আমি বললাম, আগে আমার কিছু খবর দরকার।

খবরটা পেয়েই বুঝেছি আপনি কি ধরনের খবর চান।

লু গেরেন্ডা সম্পর্কে কিছু জানো?

গেরেন্ডা! বার্নি আড়ষ্ট হয়ে গেল। সে আমার দিকে তাকাল, মিঃ ওয়ালেস, আপনি কি বলতে চান এতে ও ব্যাটাছেলেও আছে!

ওর সম্পর্কে তুমি কতটুকু জানো?

গেরেন্ডা জো ওয়ালিনস্কির কাছে কাজ করে। বার্নি বলল, জোর একটি বড় ইয়াট আছে, ওয়ালিনস্কি বাইরে গেলে সে পাহারা দেয়, অন্যসময় ওয়ালিনস্কির গাড়ি চালায়।

তোমার কি মনে হয় হ্যাঙ্ক স্মেডলির সঙ্গে ওর যোগসাজস আছে?

থাকতে পারে, তাদের দুজনকে একসঙ্গে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। যোগসাজস থাকা বিচিত্র নয়।

জো ওয়ালিনস্কি লোকটা কে!

বার্নি চেয়ারে বসল, আপনি আমায় গভীর জলের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। ওয়ালিনস্কি সম্পর্কে কোনরকম কথা বলার ইচ্ছে আমার নেই।

বার্নির চোখেমুখে ভীতির চিহ্ন ফুটে উঠেছে। আমি চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বার্নি স্যামের দিকে ইঙ্গিত করতেই সে এক প্লেট বিশ্রী দেখতে সসেজ নিয়ে এল। বার্নির সামনে প্লেটটা রেখে আমায় বলল, মিঃ ওয়ালেস, আপনি আর কিছু নেবেন? এক কাপ কফি বা আরেকটু স্কচ। আমার কাছে সবই পাবেন।

না, স্যাম ধন্যবাদ। স্যাম এটো প্লেটগুলো নিয়ে চলে গেল।

গোটা তিনেক সসেজ একসঙ্গে মুখে পুরে বানি চোখ মুছে বলল, মিঃ ওয়ালেস আমি ওয়ালিনস্কি সম্পর্কে আপনাকে কোনও খবর দিয়েছি এটা যদি জানাজানি হয় তাহলে আমায় কেউ বাঁচাতে পারবে না। একদিন ভোরবেলা বন্দরের জলে আমার গলাকাটা লাশটা ভেসে উঠবে।

তুমি যদি কাউকে না বলল, আর আমি যদি না বলি, তবে কে জানছে? জো ওয়ালিনস্কি কে?

আরও তিনটে সসেজ মুখে পুরে বার্নি বলল, ঠিক আছে মিঃ ওয়ালেস আমি সব বলছি। আর কেউ হলে এ ব্যাপারে মুখই খুলতাম না। কিন্তু আপনার জন্য….

জো ওয়ালিনস্কি কে?

ও পূর্ব উপকূলে মাফিয়ার টাকা যোগাড় করে। প্রত্যেক মাসের এক তারিখে ইয়াটে চেপে এখানে আসে। পুরো এক সপ্তাহ এখানে থাকে। ঐ এক সপ্তাহে সে প্রোটেকশনের টাকা, ব্ল্যাকমেলিং এর টাকা, আর ক্যাসিনোগুলোর ভোলা আদায় করে। এই হল ওয়ালিনস্কি; এক কাপ বিষের মতই বিপজ্জনক আর মারাত্মক। গোটা ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকা জানে কি ঘটছে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায় যে পুলিশ কনস্টেবলরা পাহারা দেয় তারাও সব জানে, কিন্তু কিছুই বলে না। প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে রাত তিনটে নাগাদ সবাই যার যার নির্দিষ্ট তোলা নিয়ে যায়। ওয়াটার ফ্রন্টের পুলিশ কনস্টেবলরা ইচ্ছে করেই মুখ বুজে থাকে। ওয়ালিনস্কির সঙ্গে যার কারবার নেই এমন কোন ব্যাটাছেলে ঐ ইয়টের ধারে কাছেও ঘেঁষে না। একজনও নয়।

ইয়াটটার কি নাম অ্যাল?

হার্মিস, ডানদিকে মাছধরা ট্রলারগুলোর ঠিক পাশেই আছে ওটা।

 ওয়ালিনস্কির হয়ে যারা টাকা যোগাড় করে হ্যাঙ্ক স্মেডলি কি তাদের মধ্যে একজন?

আরও তিনটে সসেজ মুখে পুরে ঘাড় নেড়ে বোঝাতে চাইল যে আমার অনুমান ঠিক।

আগে কখনও বার্নিকে এত ঘাবড়াতে দেখিনি। ওকে আর ঘাঁটানো ঠিক হবে না ভেবে চেয়ার ছেড়ে উঠে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম।

আমি সত্যিই দুঃখিত মিঃ ওয়ালেস। কিন্তু আপনি মাথা গরম করে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসবেন না, এটাই আমার অনুরোধ।

আমি ঘাড় নেড়ে কাউন্টারে স্যামের কাছে গিয়ে বললাম, আমি কি দামটা দিতে পারি?

মিঃ ওয়ালেস, আমিও বানির মতই আপনার জন্যে গভীরভাবে দুঃখিত। না আপনাকে দাম দিতে হবে না। আপনার জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।

জেটির ধার দিয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম। টুরিস্টেরা রাতের ডিনার খেতে হোটেলে ফিরে আসছে। দুটো পুলিশ কনস্টেবল মাছধরা ট্রলারগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায় পাহারা দেবার দায়িত্ব এদের ওপর। এরা জো ওয়ালিনস্কির মাফিয়া চক্রের সব খবর রাখে আর এদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য মোটা টাকা দেওয়া হয়। দুটো লোকই বেজায় মোটা, দাঁড়িয়ে নিজের মনে হাতের লাঠি দোলাচ্ছে।

ছায়ার ভেতরে গা মিশিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি এসে দাঁড়ালাম হার্মিস নামে ইয়াটটির ধারে। লম্বায় তা একশো ফিট হবে। ডেকের ওপরে থাকার মত কেবিন আছে। দেখলে বোঝা যায় একটা বিলাসিতার ছাপ আছে।

একটা তালগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ইয়াটের ডেকের দিকে তাকালাম। অস্পষ্টভাবে একটা লোককে ডেকের উপর বসে থাকতে দেখলাম। তার সিগারেটের আগুন দেখতে পাচ্ছি। ইয়াটটির কোথাও আলোর চিহ্নটুকুও নেই। অনুমান করলাম ডেকের ওপরকার লোকটি লু গেরে ছাড়া কেউ নয়। একা বসে জাহাজ পাহারা দিচ্ছে।

সেখানে বেশিক্ষণ না দাঁড়িয়ে আমার গাড়ির দিকে ফিরে চললাম। ব্ল্যাক ক্যাসেটের পাশ দিয়ে যাবার সময় সেদিকে তাকালাম। নোংরা পাতলা ফিনফিনে পর্দা দিয়ে জানলাগুলো ঢাকা, তার ফাঁক দিয়ে ভেতরের আলো দেখা যাচ্ছে। নাচের তালে তালে বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। গাড়িতে উঠে সোজা বাড়ি চলে এলাম।

সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না। সুজির মিষ্টিমুখখানা আবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। আমাদের মধুর মুহূর্তগুলো ছবির মত ভাসতে লাগল আমার মস্তিষ্কের কোষের ভেতর। আমরা ভবিষ্যতকে ঘিরে যে সুন্দর স্বপ্ন দেখতাম তাও বারবার মনে পড়তে লাগল।

রাত চারটে নাগাদ দুটো ঘুমের বড়ি মুখে পুরে চোখ বুজলাম আর কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

.

পরদিন সকাল সাড়ে এগারোটায় অফিসে গিয়ে গ্লেন্ডা কেরীর কামরায় ঢুকলাম।

ডার্ক তুমি আসতে দেরী করেছে। কর্নেল তোমার খোঁজ করছিলেন। বলতে বলতে গ্লেন্ডা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার ডার্ক? তোমায় অসুস্থ দেখাচ্ছেকেন? শরীর ঠিক আছে তো?

কর্নেলের সঙ্গে এখন দেখা করা যাবে?

যাও না। ওঁর হাতে এখন কাজের চাপ কম আছে।

কর্নেল পার্নেল তার কামরায় টেবিলের ওপাশে বসেছিলেন। ষাটের ওপরে বয়স। এই প্রাক্তন সৈনিকটির চেহারা দৈত্যের মত।

খুঁদে খুঁদে দুটি নীল চোখের তীক্ষ্ণ চাউনিতে আমায় দেখতে দেখতে বললেন, সুপ্রভাত ডার্ক, বোস।

আমি চেয়ারে বসতেই কর্নেল বললেন, থরসেন ফাইলটা পড়লাম। কেসটা খুব ইন্টারেস্টিং  আর তোমরা দুজনে চমৎকার কাজ করেছে। এখন মিসেস থরসেন পিছিয়ে গেছেন তাই আমাদের ঐ প্রসঙ্গে ইতি টানাই ভাল। তোমার আর অ্যান্ডারসনের জন্য খুব ভাল একটা কাজ রেখে দিয়েছি।

শান্তভাবে বললাম, আমার জন্য না কর্নেল আমি চাকরী ছেড়ে দিচ্ছি।

ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিলাম ডার্ক। ভেবেছিলাম তুমি মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারবে। সুজির খবর শুনে সত্যিই আমি খুবই দুঃখিত। তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি ডার্ক। তোমার জায়গায় যদি আমি থাকতাম আর আমার প্রেমিকার যদি এই অবস্থা হত তাহলে ঐ বেজন্মাগুলোকে আমি উচিত শিক্ষা না দিয়ে শুধু শুধু ছেড়ে দিতাম না।

শান্তভাবে জবাব দিলাম, আমি নিজেও ঠিক তাই করব।

ঠিক। তোমায় চার সপ্তাহের ছুটি দিলাম। তুমি এইসময় ঠিক বেতন পেয়ে যাবে। তুমি ছুটি থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত অ্যান্ডারসন তোমার কাজ চালিয়ে নিতে পারবে। কেমন ঠিক আছে?

আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ কর্নেল। কিন্তু বিশ্বাস করুন সত্যিই আমি কাজ ছেড়ে দিচ্ছি। আমি এই বদমাশগুলোর বিরুদ্ধে এমন এক যুদ্ধ শুরু করেছি যা আপনি জানতেও চাইবেন না। আমি খুন হয়ে যেতে পারি নয়তো জেলেও যেতে পারি। কাজেই আপনাকে কোনভাবেই জড়ানো চলবে না। উঠে দাঁড়াতেই থরসেন ফাইলটার দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, শেষবারের মত একটা উপকার করুন কর্নেল। ফাইলটা বগলদাবা করে বললাম, এই ফাইলটা আমার চাই।

তুমি বলতে চাও, সুজির মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার সঙ্গে থরসেন কেসের সম্পর্ক আছে?

সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত কর্নেল, সব তথ্য এই ফাইলে নেই। সেগুলো আপনি জানতে চাইবেন না। ধন্যবাদ কর্নেল! আপনার কাছে চাকরীকরার কথা আমি কোনদিন ভুলবো না। আমার কাছে তা একটা বিরাট ব্যাপার। তবে এভাবে ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে আমি খুবই দুঃখিত।

কর্নেল চেয়ার ছেড়ে উঠে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই ঝামেলা থেকে যদি বেরিয়ে আসতে পারো ডার্ক তাহলে জানবে যে এখানে তোমার চাকরী চিরকাল থাকবে।

করমর্দন করতে করতে বললাম, মনে হয় না এই ঝামেলা থেকে বেঁচে বেরিয়ে আসতে পারব। আমি ওদের এমন মোক্ষম জায়গায় ঘা দেব যা ওরা কল্পনাও করতে পারবে না।

বোকার মত কিছু করে বসোনা ডার্ক।

ওদের এমন জায়গায় ঘা দেব যেখানকার ব্যথা চিরকাল থেকে যাবে। তারপর আজ হোক কাল হোক ওরা পাল্টা আঘাত হানবে। আমি আপনাকে আমার পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি আর বিলকে পাঠিয়ে দিচ্ছি যাতে নতুন কাজের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নেয়।

অফিসে ঢুকে বিলকে বললাম, বিল আমি চাকরী ছেড়ে দিচ্ছি। কর্নেল এক্ষুণি তোমায় ডাকবেন, এখন থেকে আমার কাজ তুমিই করবে।

বিল বলল, ভালই হল। আগের মতই দুজনে একসঙ্গে কাজ করতে পারব। যাক কর্নেলের কাছে যাবার আগে পদত্যাগ পত্রটা টাইপ করে ফেলি।

তার মানে?

খুব সহজ ব্যাপার, তুমি চাকরী ছেড়ে দিলে আমিও ছেড়ে দেব।

তুমি কেন খামকা চাকরীছাড়তে যাবে। গাধা কোথাকার! শোন বিল, আমি কোনরকম ঝামেলা বাড়াতে চাই না। এবার তুমি সব কাজ বুঝে নাও।

আমার সেরা বন্ধুর ভাবী বৌয়ের মুখে যখন কেউ অ্যাসিড মারে তখন আমার পক্ষে আর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব নয়। আমরা একসঙ্গে চাকরী ছেড়ে ঐ বদমাশগুলোকে একবার দেখে নেব।

না।

আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছো। যে কোন মুহূর্তে আমাদের দুজনেরই লাশ পড়ে যেতে পারে। কিন্তু তার আগে আমরা ওদের নাজেহাল করে ছাড়ব।

চেঁচিয়ে উঠলাম, না বিল। যেচে এইভাবে বিপদের মুখে পা বাড়িয়ো না।

বিলও চেঁচিয়ে উঠলো, ভগবানের দোহাই ডার্ক…। আমার সিদ্ধান্তের কথা তোমায় জানিয়ে দিয়েছি। জেনে রেখো তুমি আমায় সঙ্গে না নিলেও আমি আলাদা ভাবে ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করব।

বুঝলাম বিল সত্যিই মরিয়া হয়ে উঠেছে। হাজার বোঝালেও পদত্যাগের সিদ্ধান্ত থেকে ওকে টলানো যাবে না। আর তখনই মনে হল বিলকে সঙ্গে নিলে আমার লাভ বই লোকসান হবে না। একা ঐ শয়তানের সঙ্গে আমি পেরে উঠবো না।

বেশ, এত করে যখন বলছে তখন আমি আর তোমায় বাধা দেব না।

আমাদের দুজনের পদত্যাগপত্র দুটো নিয়ে বিল কর্নেলের সঙ্গে দেখা করতে গেল। হাসতে হাসতে ফিরে এল। তখন আমি নিজের ব্যক্তিগত জিনিষ গোছাচ্ছি।

বিল বলল, কুছ পরোয়া নেই। কর্নেল প্রথমে আমায় ছাড়তে চাননি, অনেক বুঝিয়ে তাকে রাজি করালাম। উনি বললেন যেঝামেলা মিটিয়ে ফিরে এলে আবার আমাদের চাকরীতে বহাল করবেন।

তোমার টেবিল পরিষ্কার করবে না?

আমার টেবিলে কিছু নেই পরিষ্কার করার মত। বিল বলল, আমার টেবিল পরিষ্কার থাকে। আমার খিদে পেয়েছে। বকবক না করে বাইরে গিয়ে খাওয়া যাক, খেতে খেতে কি করব ঠিক করা যাবে, কি বল?

ঠিক আছে, একবার গ্লেন্ডার কাছে যেতে হবে, ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে, তারপর লুসিনোয় খেতে যাব। সাড়ে সাতটা বাজে তবু গ্লেন্ডা বাড়ি যায় নি। কামরায় ঢুকে বললাম, গ্লেন্ডা আমরা তোমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি।

ডার্ক, বিল ভেতরে এসো, বলে গ্লেন্ডা উঠে দাঁড়াল। সুজির মৃত্যুতে আমি নিজে কতটা আঘাত পেয়েছি তা বোঝাবার ভাষা জানা নেই। তোমার জায়গায় আমি থাকলে একই সিদ্ধান্ত নিতাম, বলে দুখানা মুখ বন্ধ খাম সে আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, কর্নেল তোমাদের একমাসের আগাম দিয়েছেন।

 গ্লেন্ডা খামদুটো বিলের হাতে দিলেন, যাক সব ভালয় ভালয় মিটে গেলে আশা করছি আবার দেখা হবে।

ধন্যবাদ গ্লেন্ডা। দুজনে গ্নেন্ডার হাতে হাত মিলিয়ে বাইরে এলাম। নিচে এসে সোজা লুসিনোর ইটালিয়ান রেস্তোরাঁয়। দেখতে পেয়ে লুসিনো ছুটে এল। তারপর একটা টেবিলে বসিয়ে দিল। বসার পর লুসিনো সহানুভূতির সুরে বলল, মিঃ ওয়ালেস সব শুনেছি, আপনাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা জানা নেই। লক্ষ্য করলাম লুসিনোর চোখে জল, আবহাওয়া সহজ করতে আলতো করে একটা চাপড় মারলাম।

ধন্যবাদ, তুমি সত্যিই আমার বন্ধু।

লুসিনো বলল, মিঃ ওয়ালেস, আপনার জন্য আজ স্পেশ্যাল মেনু বানাতে দিই, দয়া করে না বলবেন না। আজ আমি আপনাদের দুজনকে আমার নিজের খরচে খাওয়াব।

আমি রাজি না হয়ে পারলাম না, তার বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল।

 বেশ তবে যা করার তাড়াতাড়ি করো। বন্ধুটির ভীষণ খিদে পেয়েছে।

লুসিনো দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে জোর গলায় তার দুজন রাঁধুনিকে স্পেশ্যাল মেনুর ফরমাশ দিল।

দুটো বড় বড় ট্রেতে কয়েক মিনিটের মধ্যে ভাজা বড় কাকড়া আর একঝুড়ি মুচমুচে রুটি ওয়েটার আমাদের সামনে এনে রাখল। সেইসঙ্গে এক বোতল ঠাণ্ডা সাদা ওয়াইন।

আমি অল্পই খেলাম। বিল গোগ্রাসে চালাচ্ছে, জানি তার পেট না ভরা পর্যন্ত কথাবার্তা শুরু করা যাবে না। বিলের প্লেট খালি হতে আমার প্লেট থেকে কয়েকটা কাঁকড়া আর রুটি ওঁর প্লেটে ঢেলে দিলাম।

প্লেট খালি হতেই বিল বলল, আর কিছু নেই।

অধৈর্যভাবেই বললাম, জানি না। এবার মন দিয়ে আমার কথা শোন। আমি কিছু টাকা জমিয়েছি। এখন আমাদের দুজনেরই টাকার দরকার হবে। তোমার হাতে জমানো কিছু টাকা কড়ি আছে?

বিল হাসল। ও নিয়ে চিন্তা নেই। আমি পঁচিশ হাজার ডলার আগেভাগেই জমিয়ে রেখেছি। আমার টাকা তোমার কাজে লাগবে। তোমার টাকা আমার কাজে লাগবে।

এবার ওয়েটার এসে কিছু স্কচ আর দুটো বড় সমুদ্রের গলদা চিংড়ি আর সেইসঙ্গে একগাদা ফ্রেঞ্চফ্রাই আমাদের প্লেটে দিয়ে গেল।

বিল তার প্লেটখানা সামনে টেনে নিয়ে বলল, বাঃ। একেই বলে ডিনার। সত্যিই ডার্ক, তোমার বন্ধুভাগ্য দেখলে হিংসে হয়।

লাইস পাই আর কফি দিয়ে আমাদের স্পেশ্যাল মেনু ডিনার শেষ হল। এবার অ্যাল বার্নির কাছ থেকে যা যা জেনেছি সব বিলকে খুলে বললাম।

বিল ভাল করে ভেবে দ্যাখো আমরা মাফিয়াদের সঙ্গে লড়তে যাচ্ছি। এর পরিণতি যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে সে সম্পর্কে তোমার ধারণা নেই। ইচ্ছে করলে এখনও পিছিয়ে যেতে পারো।

মাফিয়া তাই না?

 ঠিক তাই।

শোন ডার্ক। অ্যাসিড কেসটা নিয়ে ভাবতেই কথাটা আমার মাথায় এসেছিল। আমিও মাফিয়াদের গন্ধ পেয়েছিলাম। তাহলে চিন্তার কিছুই নেই। দুজনে মিলে ওদের শায়েস্তা করা যাবে। তুমি যদি শুধু আমায় বলে দাও কি করতে হবে।

কিন্তু পরিণামটা একবার ভেবেছো? ধরো যদি দুজনেই খুন হয়ে যাই তাহলে?

বিল একটু ভেবে বলল, তাতে কি? একবারের বেশিদুবার তোমরবনা। আমাদের প্রথম কাজ

সবসময় দুজনকে একসঙ্গে থাকতে হবে একসঙ্গে কাজ করতে হলে। তোমার জিনিসপত্তর যা আছে সব নিয়ে এক্ষুণি আমার অ্যাপার্টমেন্টে চলে এসো। চাবিটা বের করে টেবিলে রাখলাম। আমি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসছি।

তুমি এখন কোথায় যাচ্ছ?

তুমি এক্ষুণি সব নিয়ে এসো, পরে কথা হবে। ডিনারের জন্য লুসিনোকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি গাড়ি চালিয়ে সোজা হাজির হলাম থরসেনের বাড়িতে। গোটাবাড়ি অন্ধকার। শুধু জোশ স্মেডলির ঘরে আলো দেখা যাচ্ছে।

গেটের বাইরে গাড়ি রেখে হেঁটে সদর দরজায় গিয়ে তিনবার ঘণ্টা বাজাতেই দরজা খুলল। জোশ স্মেডলি ঢুলু ঢুলু চোখে আমার দিকে তাকাল।

মিঃ ওয়ালেস? দুঃখিত, মিসেস থরসেন বাড়িতে নেই, উনি অপেরায় গেছেন।

আমি একরকম জোর করেই ভেতরে ঢুকে তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, মিসেস থরসেন নয় জোশ। তোমাকেই আমার দরকার। তোমার ঘরে চলো।

ভক ভক করে জোশের মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে, তার পা টলছে। কিছুটা অনিচ্ছার সঙ্গেই সে আমায় তার ঘরে নিয়ে গেল।

টেবিলের ওপরে গ্লাস আর এক বোতল স্কচ হুইস্কি। বোতল থেকে তার গ্লাসে কিছুটা স্কচ ঢেলে বললাম, জোশ এবার কিন্তু তোমায় সত্যি কথা বলতেই হবে। তোমার ছেলে হ্যাংক কিন্তু সত্যিই বিপদে পড়েছে।

সে কাঁপা হাতে গ্লাস তুলে, আপনি ঠিকই বলেছেন মিঃ ওয়ালেস।

 তুমি কি জানো যে ও মাফিয়াদের দলে গিয়ে ভিড়েছে।

কান্নার গলায় বলল, হ্যাঁ মিঃ ওয়ালেস, কিছুদিন আগে ব্যাপারটা জানতে পেরেছি। আমি ওকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছি কিন্তু কাজ হয়নি। আমি জানি ও ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে।

পড়তে যাচ্ছে না জোশ। ইতিমধ্যে ও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। তুমি কি জানো যে অ্যাঞ্জি নিজেও মাফিয়াদের দলে ভিড়েছে।

জোশ ঘাড় নেড়ে বলল, আমিও কথাটা শুনেছি। উনি হ্যাংকদের একজন খদ্দের। সে কথাও আমি জানি।

খদ্দের মানে? ব্ল্যাকমেলের খদ্দের?

 জোশ শিউরে উঠে বলল, হ্যাঁ ঠিক তাই মিঃ ওয়ালেস, মাফিয়ারা সাংঘাতিক লোক ওদের নিয়ে কেউ ঘাঁটায় না।

মিস থরসেনকে ওরা কেন ব্ল্যাকমেল করছে?

আমি জানি না। জানতেও চাই না।

হ্যাংক জানে?

আমি বলতে পারব না। ও শুধু টাকা যোগাড় করে ওদের হাতে তুলে দেয়।

মিসেস থরসেন আমায় কেন ভাড়া করেছিলেন জানো? ওর মেয়েকে কে ব্ল্যাকমেল করছে তাকে খুঁজে বের করতে। উনি এখন আর তদন্ত চালাতে চাইছেনা। এর কারণ কি তা তুমি জানো?

গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে জোশ ভাবলেশহীন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

গলা চড়িয়ে বললাম, কারণটা কি?

জোশ একটু ইতস্ততঃকরেবলল, একটা লোকমিসেস থরসেনকে টেলিফোনে ভয় দেখাচ্ছিল। আমি এক্সটেনসান রিসিভারে ওর হুমকি শুনেছিলাম। লোকটা মিসেস থরসেনকে বলছিল যে তদন্ত না থামালে সে এই বাড়ি পুড়িয়ে দেবে।

সেই লোকটা কে?

কে আর? মাফিয়াদের লোক। ওদের সবারই গলার আওয়াজ একরকম। কানে গেলে লোকের পিলে চমকে যায়। মিসেস থরসেন উত্তরে কিছু বলেননি। রিসিভার নামিয়ে রেখেছিলেন, এর চাইতে বেশি কিছু জানি না।

কিন্তু তুমি এটা নিশ্চয়ই জানো যে ধরা পড়লে ব্ল্যাকমেলের টাকা আদায়কারী হিসেবে হ্যাংকের কম করে পনেরো বছর জেল হবে–তাই না?

পনেরো বছর?

পনেরো বছর জোশ। তার কম নয়।

আমি হ্যাংককে হুঁশিয়ার করেছিলাম কিন্তু ও হেসে উড়িয়ে দিল। আমি আর কি করতে পারি মিঃ ওয়ালেস?

মিস থরসেনকে কেন ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে তা তুমি সত্যিই জানো না?

জানলে আপনাকে ঠিকই বলতাম। আমি সত্যিই জানি না।

 টেরি থরসেন কোথায় আছে তুমি জানো? তিনবার বলার পর জোশ ঘাড় নাড়ল।

 ওর কোনও খবর আমি পাইনি, মিঃ ওয়ালেস।

আজ যাচ্ছি জোশ। কিন্তু শিগগীরই হয়তো আবার তোমার কাছে আসতে হবে। বলেই বেরিয়ে গেলাম।

.

ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায় গাড়ি চালিয়ে এলাম। এখানে পাশাপাশি অনেক স্টলে নানারকম পশরা সাজিয়ে বসেছে স্থানীয় দরিদ্র বাসিন্দারা। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে একটা স্টলের সামনে দাঁড়ালাম। স্টলের মালিকটি জাতে আরবীয় নয়তো প্যালেস্তানীয় হতে পারে। আসলে ওদের চেহারার ফারাক আমি বুঝতে পারি না। নোনা মাংস থেকে শুরু করে হরেক রকমের পুরোনো জিনিস সে বেচে টুরিস্টদের কাছে।

আমি যতদূর জানি লোকটার নাম আলি হাসান। পুরোনো জিনিস বোঝাই একটা তাকের পেছনে মেঝের ওপরে বসে সে চুরুট টানছিল। পাশেই তার ভীষণ মোটা বউ বসেছিল। যাকে দেখলেই বড় বড় গ্যাস বেলুনের কথা মনে পড়ে যায়।

মোটা আলি হাসান ঢোলা আরবী জোব্বা পরে মাথায় আরবী বিড়ে চাপিয়ে বসেছিল। মাঝে মাঝে দু একটি টুরিস্ট এসে এটা ওটা দরাদরি করছে। আমি বললাম, মিঃ হাসান, আমার নাম জো, আপনার সঙ্গে গোপনে কিছু ব্যবসায়িক কথা বলতে চাই। দয়া করে একবার বাইরে আসবেন?

হাসান বলল, ব্যবসার গন্ধ পেলে আমি একপায়ে খাড়া, চলুন। কোথায় গিয়ে বসবেন?

হাসানের ঘোট ঘোট দুটি চোখ জ্বলজ্বল করছে। মনে মনে সে নিশ্চয়ই মোটা দাও মারবার মতলব ভাজছে।

আমার গাড়িতে হাসানকে তুললাম। তার গায়ের বোঁটকা গন্ধ অসহ্য লাগায় সবকটা জানলার কাঁচ নামিয়ে দিলাম।

মিঃ হাসান, নষ্ট করার মত সময় আপনার বা আমার হাতে নেই। আমার কাছে খবর আছে আপনি ভাল বোমা বানাতে পারেন। আমার একটা বোমা দরকার। আমি আপনাকে ভাল টাকা দেব। এখন বলুন বানিয়ে দিতে পারবেন কিনা?

চুরুট টানতে টানতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ভাল বোমা বানাতে পারি এ খবর আপনাকে কে দিল?

আপনার তা দিয়ে তো দরকার নেই। আমার বোমা দরকার, যদি না দিতে পারেন তো সাফ বলুন। আমি অন্য কোথাও খোঁজ করব।

কি ধরনের বোমা দরকার?

এমন ধরনের বোমা যা ফাটলে প্রচুর ক্ষতি হবে, কিন্তু আগুন লাগবে না।

আলি হাসান জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ ওয়াটার ফ্রন্টের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ, তেমন বোমা বানিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আপনি কত দেবেন?

আপনি কত নেন?

যা ফাটলে আগুন লাগবে না অথচ প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হবে এমন একটা ছোট্ট বোমা বানাতে পুরো তিন হাজার ডলার খরচ পড়বে।

আধঘণ্টা দরাদরি করে শেষপর্যন্ত আড়াই হাজার ডলার রফা হল।

ঠিক আছে মিঃ জো। আগামীকাল রাতে এইসময় আমার স্টলে এলেই মাল পেয়ে যাবেন। কোনও চিন্তা নেই জোর আওয়াজ হবে, প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে কিন্তু আগুন লাগবেনা। এমন জিনিস চাইছেন তো? ও আমি বানিয়ে দেব। এখন কিছু আগাম দিন।

ওয়ালেট খুলে তাকে পাঁচশো ডলার দিলাম। টাকাটা সে আলখাল্লার মধ্যে গুঁজে রাখতে আমি বললাম, মিঃ হাসান বোমা বানানোয় আপনার সুনাম আছে জানি। দেখবেন সেই সুনাম যেন নষ্ট করবেন না। যদি করেন তাহলে আপনি কিন্তু বাঁচবেন না। আপনার জীবনের বাকি দিনগুলোর কিন্তু বারোটা বাজিয়ে দেব।

আপনি একদম ভাববেন না মিঃ জো, হাসান হাসল, কিন্তু বুঝতে পারলাম যে আমার কথা শুনে ওর বেশ অস্বস্তি শুরু হয়েছে। আর কিছু বললাম না, হাসান গাড়ি চালিয়ে ওর স্টলে ঢুকল।

ওর বোঁটকা গন্ধটা দূর করতে গাড়ির ভেতরকার এয়ার কন্ডিশনারটা চালিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। গাড়ি চালাতে চালাতে মনে হলো আগামীকাল ব্ল্যাক ক্যাসেটের ব্যবসা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। হ্যাঁ, প্রতিশোধের এটাই হবে প্রথম ধাপ। কিন্তু যাই করি সুজির সেই উজ্জ্বল হাসি আর আমি দেখতে পাব না।