৩. আলোচনা সভা

০৩.

মরগ্যান রাত আটটায় একটা আলোচনা সভা ডেকেছিলো লু স্ট্রাইগারের জুয়ার আড্ডায়। কিন্তু ব্লেক পৌঁছে গেলো নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই–সাতটা পঁয়তাল্লিশে। অবশ্য তেমন কিছু নয়। নেহাত তার ঘড়িটা বেয়াড়া সময় দিচ্ছিলো বলেই।

ব্লেক বার–এর লোকজনের ভিড় ঠেলে এগিয়ে চললো। ঘরের বন্ধু আবহাওয়া সিগারেটের ধোঁয়ায় ভারী হয়ে উঠেছে। অনেক পরিশ্রমের পর সে স্ট্রাইগারকে দেখতে পেলো। লালমুখো, মোটা লোকটা জুয়ার বোর্ডের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে।

ব্লেক প্রশ্ন করলো, কেউ ভেতরে গেছে নাকি, লু?

উহু। দরজা খোলাই আছে। স্বচ্ছন্দে যেতে পারো।

আচ্ছা, আমাকে একটা স্কচ খাওয়াও দেখি।

ব্লেক স্ট্রাইগারের এগিয়ে দেওয়া গেলাসটাকে দু চুমুকে শেষ করে নামিয়ে রাখলো। কোণার একটা টেবিলের দিকে আনমনাভাবে এগিয়ে টুপিটাকে পেছন দিকে ঠেলে বসে পড়লো। টাইয়ের নটটাকে সামান্য আলগা করে গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে।

একমুহূর্তের জন্যও অস্বাচ্ছন্দ্য আর ভাবপ্রবণতা ব্লেকের মন থেকে নিষ্কৃতি পায় নি। বিশেষ করে ফ্র্যাঙ্কের ঐ রেস্তোরাঁ লুঠের ব্যাপারটাই তাকে ভাবিয়ে তুলেছে–জিনির চিন্তা তো আছেই।

ব্লেকের জীবনটা অন্য তিনজনের মতো অতোটা জটিল ছিলোনা, বরং প্রচুর সুখ–সুবিধে ছিলো। ব্লেকের বাবা ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনীয়ার। তার ইচ্ছে ছিলো একমাত্র ছেলেকে ভালোভাবে মানুষ করবেন। ডাক্তার করবেন। কিন্তু এতো সুখে থেকেও পড়াশোনার ব্যাপারটা ব্লেকের কাছে বড় একঘেয়ে মনে হলো। তাই মেডিকেল কলেজে বছর দুয়েক কাটানোর পরই সে পড়াশোনায় পূর্ণচ্ছেদ টেনে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হলো। অনেক কষ্টে ব্লেক একটা চাকরী জোগাড় করলো কমিশনে গাড়ি কেনা–বেচার কাজ, এবং একই সঙ্গে সে আবিষ্কার করলো নারী সঙ্গ তার কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সুতরাং অনিবার্যভাবেই আয়ের চেয়ে বিভিন্ন পথে ব্যয়ের পরিমাণই বেশী হতে লাগলো। অবশেষে একদিন সে বুঝতে পারলো পর্বতপ্রমাণ ঋণের বোঝায় তার শিরদাঁড়া নুয়ে পড়েছে। তখনই কোম্পানির সিন্দুকে ব্লেক হাত লাগালো। সিন্দুক থেকে চার হাজার ডলার সরিয়ে সে চম্পট দিলো। সে ধরা পড়ল, তার জেল হল। ব্লেকের বয়স তখন মাত্র বাইশ। পরেও যে ব্লেক আর জেল খাটেনি, তা নয়। তাকে আরো দুবার যথাক্রমে তিন চার বছরের জন্যে জেলে যেতে হয়েছে। ক্রমে ক্রমে ব্লেকের মনে জেল সম্বন্ধে এক অদ্ভুত ঘৃণা এবং আতঙ্ক গড়ে উঠেছে।

শেষ বার যখন সে চার বছরের শাস্তি ভোগ করছে, তার দেখা হয় মরগ্যানের সঙ্গে–ঐ জেলেই। তখন মরগ্যান তার পনেরো বছর সশ্রম কারাদণ্ডের শেষ বছরটি কোনরকমে কাটাচ্ছে। কিন্তু পনেরো বছর জেলের কথা শুনেই ব্লেক কেঁপে উঠেছে।

একই সঙ্গে ওরা জেল থেকে ছাড়া পেলো৷ ছাড়া পাওয়ার পর মিলে মিশে দল বাঁধার প্রস্তাবটা মরগ্যানই রাখলো ব্লেকের কাছে। ব্লেক রাজী হলো।

ব্লেকের রাজী হওয়ার অন্যতম কারণ গোলমেলে লাইনে মরগ্যানের খ্যাতি। জেলে থাকতে অনেকের মুখেই শুনেছে। আজ হোক কাল হোক মরগ্যান একটা মোটা দাও মারবেই। এবং তারপরই সে একজন কেউকেটা হয়ে বসবে। সুতরাং মরগ্যানের প্রস্তাবে রাজী হতে দ্বিধা কি?

পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনের দিকে পেছনে তাকিয়ে রেকের সামনে ধরা পড়েছে শুধু হতাশা আর। ব্যর্থতার ইতিহাস। ভবিষ্যতের বিবর্ণ রূপও তার অজানা ছিলো না। তাই জীবনের প্রথম এবং শেষ জুয়ায় সে বাজি ধরেছে। ভবিষ্যতের রং বদলের চরম চেষ্টা না করে সে হার মানতে রাজী নয়। তার মনে হয়েছিল মরগ্যানই তাকে নিয়ে যাবে ঐশ্বর্যের রাজপথে। যে পথে কানাগলির আকারহীন বীভৎস স্মৃতিদের প্রবেশের অধিকার নেই।

ব্লেক একা একা বসে স্বপ্নের জাল বুনে চললো। ভাবতে লাগলো দু–লক্ষ ডলারের কথা। অতো টাকা নিয়ে কি করবে সে? দেশে দেশে ঘুরে বেড়াবে? ব্লেকের মন স্বপ্নের পাখায় উড়ে চললো। ওর চোখের সামনে রঙীন পর্দায় ভেসে উঠলো দেশ–বিদেশের সুন্দরী তরুণীদের ছবি, যাদের সুখ সঙ্গের জন্য সে পাগল। বেশ কিছুদিন খোঁজ করার পর সে যাবে মন্টি কার্লোয়। সেখানে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে আরো কিছু টাকা হাতাতে হবে। তারপর…

এমন সময় সমস্ত স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে জিনি গর্ডন উপস্থিত হলো তার সামনে। ও এগিয়ে গেলো। উদ্ধত চিবুক, চোখের ভাষায় তাচ্ছিল্য, বারের অন্যান্য মধু–পিয়াসীর দল জিনিকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি, চোখ টেপাটেপি করতে লাগলো। লু–স্ট্রাইগার তার জুয়ার আড্ডায় নারী সংক্রান্ত কোনোরকম আঠালো ব্যাপার পছন্দ করে না। নইলে বার–এ ঢোকার পর জিনির কি অবস্থা হতো বলা মুশকিল।

ব্লেক ভাবলো একটা জিনিষ বটে। জিনির শরীরে তার চোখ জোড়া আটকানো। গোপন আলোচনার জন্য লু–স্ট্রাইগারের কয়েকটা বিশেষ ঘর আছে। সেগুলো সে মোটাটাকায় খদ্দেরদের ভাড়া দেয়। বার থেকে বেরিয়ে দু–তিন ধাপ সিঁড়ি নামলেই ঘরগুলো পড়ে। ব্লেক লক্ষ্য করলো জিনি সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত।

আঁটো সাঁটো কালো নাইলনের স্ন্যাক্স জিনির পরনে, আর শ্যাওলা সবুজ শাট–গলার কাছটা সামান্য ভোলা।

কিন্তু মেয়েটাকে বশ করা বড় কঠিন। ব্লেক আপন মনেই বললো। কোথায় থাকে, কি করে, কে জানে। তবে ওর সঙ্গলাভের পুরো ইচ্ছে। এখন একটু আধটু মিষ্টি কথা বলে ওকে হাত করে রাখা দরকার। পরে এই ট্রাক ঝামেলা মিটে গেলে জিনিকে নিয়ে একটু ফুর্তি করা যাবে। মেয়েটার মধ্যে প্রাণ আছে। আনন্দ আছে–আর চেহারা তো আছেই।

ব্লেক চেয়ার ছেড়ে উঠলো। লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ির দিকে গিয়ে ঘরগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে জিনিকে সে ধরে ফেলল।

এই যে জিনি–আমরা দুজনেই তাহলে প্রথমে পৌঁছলাম, কি বলল? –ব্লেকের চোখ খেলে বেড়ানো জিনির আঁটো সাঁটো স্ল্যাক্সের ওপর, ওফ; এটা পরে তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে।

ব্লেকের আপাদমস্তক নিস্পৃহ মনের সবুজ চোখ জিনি দেখে। তাই নাকি? বলে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো, আলোটা জ্বালিয়ে দিলো।

আলো জ্বেলে গোল টেবিলটার কাছে নিয়ে চেয়ারে বসে হাতব্যাগটা খুললো। চিরুনি আর আয়না বের করে অবাধ্য একমাথা তাম্রাভ চুলকে আয়ত্তে আনতে চাইলো।

ব্লেকও একটা চেয়ার নিয়ে মুখোমুখি বসলো। প্রশংসাভরা চোখে সে জিনির তরঙ্গায়িত যৌবনের দিকে চেয়ে রইলো।

 ব্লেক হেসে বলল; শুনেছো তো, আজ রাতেই আমরা ছোট কাজটা সারছি। ভয় পেলে নাকি?

জিনি আয়না চিরুনি ব্যাগে ঢুকিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট বের করলো।

 ও নিস্পৃহ স্বরে বললো ভয়, এতে ভয় পাওয়ার কি আছে?

ব্লেক বললো, তা অবশ্য ঠিক–অন্ততঃ তোমার বেলায়। তুমি ভয় পেয়েছে বললেও আমি বিশ্বাস করতে পারবো না।

টেবিলের ওপর ঝুঁকে ব্লেক লাইটার জ্বালিয়ে ধরলো জিনির ঠোঁটের সামনে।

নীরবতায় কয়েক মুহূর্ত কাটলো। জিনি তারপর মাথা নামিয়ে লাইটারের আগুনে সিগারেটের অগ্রভাগ স্পর্শ করে পলকের জন্য হাসলো।

ব্লেক তীক্ষ্ণ স্বরে বললো, হঠাৎ হাসবার কি হলো?

জিনির চোখজোড়া জ্বলন্ত লাইটারের ওপর এসে থামলো। ব্লেকও তাকালো। এবং সে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলো, তার হাত থরথর করে কাঁপছে। ব্লেক লাইটার নিভিয়ে কষ্টকৃত হাসি হেসে বলল ঠিকই ধরেছে, জিনি, আমি ভয় পাচ্ছি, কিন্তু কেন জানো? আজ রাতের ছোট কাজটায় কোনো গোলমাল বাঁধিয়ে আসল কাজটাকে আমরা না কাচিয়ে ফেলি। তার ওপর এই রেস্তোরাঁটা লুঠের মতলব আমার ঠিক পছন্দসইনয়। ফ্র্যাঙ্ককে আমি বহুবার বারণ করেছি। বলেছি, এর চেয়ে ডুকাসের ঐ পেট্রল–পাটা কায়দা করা আমাদের অনেক সহজ এবং নিরাপদ ছিলো–কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাছাড়া ভেবে দ্যাখো, এই রেস্তোরাঁর ব্যাপারটায় কোনো খদ্দের হঠাই হয়তো অতিমাত্রায় সাহসী হয়ে উঠতে পারে–তখন? বুঝতেই পারছো, সে ক্ষেত্রে আমাদের গুলি চালানো ছাড়া উপায় থাকবে না। আর সেই গুলিতে যদি কেউ মারা যায়, তাহলে আসল কাজে হাত দেবার আগেই পুলিশ আমাদের পেছনে লাগবে।

জিনি ব্লেকের চোখে চোখ রেখে নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো। তাহলে কেউ যাতে না সাহস দেখাতে যায়, সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে।

কাজ করার চেয়ে মুখে বলা অনৈক সোজা।

জিনি ভুরু কুঁচকে বললো, তাই নাকি? ঠ্যাংগার বারিতে ক্ষ্যাপা কুকুরও পোষ মানে, তেমনি রিভলবারের সামনে বীরত্ব দেখালে তার ফল ভাল হয় না, সেটা বেশ ভালো করে প্রত্যেককে সমঝে দিতে হবে। তাহলে আর গোলমালের ভয় থাকবে না।

সংশয়ে ব্লেকের ভুরু কুঁচকে উঠলো, তোমাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না, জিনি। …আচ্ছা, এর আগে কি তুমি কখনো কোনো দলের হয়ে কাজ করেছ?

জিনি সংক্ষিপ্ত জবাব দিলো, তাহলে আমাকে বোঝবার চেষ্টা কোরো না।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব্লেক বলল, ঠিক আছে, তুমি যদি নিজেকে পর্দার আড়ালেই রাখতে চাও, রাখো–আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভাল, আজ রাতের সবচেয়ে কঠিন কাজটা পড়েছে তোমার ওপরেই। অর্থাৎ রেস্তোরাঁর খদ্দেরদের মানিব্যাগগুলো তোমাকেই যোগাড় করতে হবে। সেই সময়ে কেউ হয়তো বাঁধা দিতে পারে। সুতরাং সাবধানে থেকো।

মনে মনে ব্লেক জিনিকে তার অস্বস্তির অংশীদার করতে চাইলো। কিন্তু জিনির জবাব শুনে অবাক হলো।

জিনি নির্বিকার অভিব্যক্তিহীন মুখে বললো, আমার রিভলবারের সামনে সে চেষ্টা কেউ করবে বলে মনে হয় না।

জিপো এবং কিটসন এমন সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো।

কিটসন ভীষণ অবাক হলো জিনির সঙ্গে ব্লেককে দেখে, তার মনের চাপা ক্রোধ প্রতিফলিত হলো তার রক্তিম মুখমণ্ডলে।

ব্লেক ঠাট্টার সুরে বললো, এই যে, জামাইবাবু এসে গেছেন দেখছি। এ ব্যথা কিযে ব্যথা, বোঝে কি আন জনে….।

সশব্দে হেসে উঠলোজিপো। তার কালো চোখের তারা খুশিতে নেচে উঠলো। ব্লেকের রসালো টিপ্পনীতে সে দোষের কিছু দেখলো না। কিন্তু কিটসন উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠলো, থামো তোমার ঐ ছাগল–মার্কা রসিকতা পকেটে পুরে রাখো।

চটছো কেন, আলেক্স? ফ্র্যাঙ্কই তো বললো তুমি আর জিনি…..নব বিবাহিত স্বামী–স্ত্রী সাজতে যাচ্ছো। ক্যারাভানে চড়ে মধু চন্দ্রিমা কাটাতে যাচ্ছে।

কিটসন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, আমি তোমাকে থামতে বলছি, এড!

ব্লেক হালকাসুরে বললো, আরে, এতে আপত্তি কিসের? কেন, তুমি কি জিনির সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা কাটাতে রাজি নও? এমনিতে ট্রাক লুঠের ব্যাপারে তোমার ভূমিকা তেমন গুরুত্বপূর্ণনা। তার ওপর জিনির মতো একটা চামর যন্তরকে পাশে বসিয়ে গাড়ি চালানোর চেয়ে মজা আর কি হতে পারে? অবশ্য সে সময়টুকু তোমাকে কাজে লাগাতে হবে। মানে….

কিটসন ব্লেকের মুখোমুখি এসে বিদ্যুৎ চমকের মতো তার ডান হাত ঝলসে উঠলো। আধমণ হাতুড়ীর মতো সপাটে ব্লেকের চোয়ালে এসে পড়লো।

প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে গোটা ঘরটা যেন কেঁপে উঠলো। ব্লেক চেয়ার সুষ্ঠু মেঝেতে উলটে পড়লো। কয়েক মুহূর্ত পড়ে থাকার পর সে ঘোলাটে দৃষ্টিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে তাকালো।

কিটসনের বিশাল শরীর রাগে কাঁপছে। –ওঠশালা ভেডুয়ার বাচ্চা! তোর সবকটা দাঁতই আজ উপড়ে নেবো।

জিপো ভয় পেয়ে বলল, এই আলেক্স–শোনো! কিন্তু কিটসনের এক ঝটকায় সে ছিটকে হুমড়ি খেয়ে দেওয়ালে পড়লো। ঘৃণাভরে ব্লেক মাথা ঝাঁকাল বহুদিন ধরে শুধু এই রকম সুযোগের অপেক্ষাই করছিলাম। শালা, এবার তোর বক্সিং করার শখ চিরকালের জন্য ঘুচিয়ে দেবো।

ব্লেক দাঁড়াতেই মরগ্যান ঘরে এসে ঢুকলো।

জিপো রুদ্ধশ্বাসে বললো, ওদের থামাও, ফ্র্যাঙ্ক, ওরা এক্ষুনি একটা মারপিট বাধাবে।

দ্রুতপায়ে মরগ্যান এসে দুজনের মাঝখানে দাঁড়ালো। ব্লেকের দিকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তোমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

নম্রস্বরে তিরস্কার করলো মরগ্যান। তার সরীসৃপ কালো চোখ ধক ধক করে জ্বলছে।

ইতস্ততঃ করলো ব্লেক, তারপর কাঁধ ঝাঁকালো। কোটটাকে টেনেটুনে ঠিক করলো, তারপর একটা চেয়ার হ্যাঁচকা টেনে নিয়ে তাতে বসলো। মাথা নীচু করে টেবিলের দিকে চোখ রেখে গালে হাত বোলাতে লাগলো সে।

এবার ফিরলো মরগ্যান কিটসনের দিকে, দলের মধ্যে গোলমাল করাবার চেষ্টা কোরো না, আলেক্স; তাহলে নিজেই গোলমালে পড়বে। এই শেষ, আর দ্বিতীয় দিন তোমাকে আমি সাবধান করবো না। নাও–বোসো।

জিনি এবং ব্লেকের থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লো কিটসন।

অস্বস্তির ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি জিপো। জিনির পাশে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ আমতা আমতা করলো, তোমার পাশে বসলে কোনো আপত্তি আছে?

উঁহু, স্বচ্ছন্দে বসতে পারো জিনি মাথা নাড়লো।

জিপো বিব্রত হয়ে হাসলো। বসলো জিনির পাশে।

মরগ্যান ঘরে পায়চারি করতে লাগলো। ঠোঁটের কোণায় জ্বলন্ত সিগারেট, মাথার টুপি চোখের ওপর টেনে নামানো।

তাহলে শোনো–মরগ্যান বলতে শুরু করলো, আজ রাত বারোটা বেজে দশ মিনিটের সময় আমরা সেই রেস্তোরাঁটা লুঠ করছি; অর্থাৎ যখন কাফে থাকবে ভিড়ে জমজমাট–এবং হঠাৎ এসে পড়ে আমাদের কাজ পণ্ড করে দেবে সে সম্ভাবনাও কম। গাড়ির দায়িত্ব থাকবে কিটসনের ওপর। মরগ্যান থামলো, এক পলক দেখলো কিটসনকে, তুমি তো জানো রেস্তোরাঁটা কোথায়! সুতরাং পালাবার পথ খুঁজে নিতে তোমার কোনোরকম অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। গাড়ির ইঞ্জিন চালু রেখে আমাদের জন্যে রাস্তায় অপেক্ষা করবে। যদি শেষ পর্যন্ত কাজটা পণ্ড হয়ে যায় তাহলে তোমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়ি ছোটাতে হবে–আর কোনো গাড়ি যদি আমাদের অনুসরণ করে, তবে তাকে ঝেড়ে ফেলার ভার আমি তোমার ওপরেই ছেড়ে দিলাম, কি বলল? ;

কিটসন গুম হয়ে বসেছিল। মরগ্যানের কথায় শুধু মাথা হেলালো।

মরগ্যান পায়চারি করতে করতে বললো, জিনি–তুমি, এড এবং আমি–এই তিনজন রেস্তোরাঁয় ঢুকবো। লু আমাকে একটা মেশিনগান ধার দেবেবলেছে। তাছাড়াও তোমার এবং এডের হাতে রিভলবার থাকবে। তুমি আমার পেছন পেছন ভেতরে ঢুকবে। আমরা ঢুকলেই এড দরজার পর্দা ফেলে দেবে–খোলা রিভলবার হাতে দরজাটা পাহারা দেবে। আমি সোজা গিয়ে দাঁড়াবো বার–এর ওপর–যাতে মেশিনগান দিয়ে গোটা ঘরটাকেই কজা করতে পারি। আশা করি মেশিনগান দেখে কেউ আর চেঁচামেচি করবে না। যাক, এইভাবে লোকগুলোকে চুপ করানোর পর শুরু হবে তোমার কাজ। অর্থাৎ, প্রত্যেকের মানিব্যাগগুলো তোমাকে সংগ্রহ করতে হবে। ক্যাশ টাকা ছাড়া আর কিছু আমরা চাই না। কিন্তু এড, সেই সময় যদি কেউ কাফেতে চোকার চেষ্টা করে, তবে তাকে বাধা দেওয়ার দায়িত্ব তোমার। ঠিকমতো যদি আমরা সব কাজ করতে পারি। তাহলে পাঁচ মিনিটের বেশী সময় লাগবে না। অবশ্য সেটা নির্ভর করছে তোমার ওপর। মরগ্যান জিনির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, কাজটা করার সময় তোমাকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ মানিব্যাগ তোলার সময় হয়তো কোনো মাতাল আচমকা তোমার রিভলবার কেড়ে নেবার চেষ্টা করতে পারে। আর একান্ত প্রয়োজন না পড়লে আমরা বন্দুক ব্যবহার করবো না।

জিপো আশ্বত বোধ করলো এ কাজে তার কোনো ভূমিকা নেই ভেবে।

কিটসন মনে মনে ধন্যবাদ দিলে তাকে গাড়ির দায়িত্ব দেওয়ার জন্য। ওঃ, কাফেতে সটান ঢুকে চল্লিশ–পঞ্চাশজন লোককে সামাল দেওয়া নেহাত চাট্টিখানি কথা নয়। তার নিজের অতোখানি সাহস আছে কিনা সে বিষয়ে কিটসনের যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

তখনো ব্লেক ভেতরে ভেতরে কিটসনের ওপর রাগে জ্বলেছে। কিন্তু মরগ্যানের কথায় তার মন থেকে কিটসনের চিন্তা একেবারে উবে গেলো। একটা অদ্ভুত শীতল অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে তার পাকস্থলিটা যেন কুঁকড়ে যেতে চাইলো।

ব্লেক বললো, ঠিক আছে, তুমি যদি এ ভাবেই কাজটা করবে বলে ঠিক করে থাকো তবে আর আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু আমার যেন মনে হচ্ছে, ওর চেয়ে একটা সহজ কাজ নিলেই ভালো করতাম–এ কাজটা আমার মোটেই পছন্দসই নয়।

পায়চারি থামিয়ে মরগ্যান দাঁড়িয়ে বলল, আমি তা জানি এড। কিন্তু এ কাজটা পছন্দ করার পেছনে আমার কতগুলো কারণ আছে। প্রথমতঃ বড় কাজের আগে এটা আমাদের পরীক্ষা। এই কাজ থেকেই বুঝতে পারবো, আসল কাজের সময় তোমরা মাথা ঠাণ্ডা রেখে এগোতে পারবে কিনা। সেই কারণেই এই কাফে লুঠের পরিকল্পনাটা আমার মাথায় এসেছে–এটা তোমারও পরীক্ষা, জিনি। প্রথম থেকেই তুমি বড় বেশীকথা বলছে। এখন আমি দেখতে চাই তোমার কথার মধ্যে সত্যের পরিমাণ কতটুকু। সেই জন্যেই এ কাজে সবচেয়ে কঠিন কাজটাই আমি তোমার জন্য রেখেছি।

জিনি স্থির চোখে মরগ্যানের দিকে তাকিয়ে, নিশ্চিন্ত থাকো, ফ্র্যাঙ্ক। কাজটাকে তুমি যতটা কঠিন ভাবছো ততোটা কঠিন নয়। আমি ঠিক পারবো।

মরগ্যান হেসে বলল, সময় এলেই বোঝা যাবে। ঠিক আছে, এবার বাকিটা শুনে নাও। কিটসন, তুমি জিপোর গাড়িটা নিয়ে ঠিক বারোটা দশ মিনিটে কাফের সামনে হাজির থাকবে। তোমার ঘড়িটা ঠিক আছে তো? কটা বাজে দেখো তো?

কিটসন হাতঘড়ি দেখে, আটটা কুড়ি।

মরগ্যান নিজের ঘড়ি দেখে, আর আমার ঘড়িতে আটটা বেজে তেইশ মিনিট। লু-র কাছ থেকে তুমি মেশিনগানটা নেবে। সেটা গাড়ির সীটে রাখবে। তারপর তুমি কাফেতে একাই যাবে। আমি আর এড হেঁটে যাবে। কাফেতে ঢোকার সময় আমি পেছনের সীট থেকে মেশিনগানটা তুলে নেবো। তারপর জিনির দিকে ফিরে, তুমি ম্যাডাম স্ট্রীট ধরে আসবে। কাফের কাছে ঠিক বারোটা দশেই পৌঁছবে–যেন দেরি না হয়। তোমার কাছে ঘড়ি আছে তো?

জিনি সম্মতি জানালো।

ঠিক আছে। …তাহলে আলেক্স, যাবার সময় লু–র কাছে থেকে তুমি মেশিনগানটা নিয়ে যাও। জিপো, তুমি ওর সঙ্গে যাও। দেখো তোমার সাধের পক্ষীরাজ আবার বিগড়ে না যায়। বারোটা বেজে দশ মিনিটে আবার আমাদের দেখা হবে কেমন!

কিটসন চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে অস্বস্তিভরে মরগ্যানের দিকে তাকালো, তারপর জিনিকে দেখলল। হঠাৎ দরজার দিকে এগিয়ে চললো। জিপো তাকে অনুসরণ করলো।

ওরা চলে যেতেই মরগ্যান জিনিকে প্রশ্ন করলো। তুমি ঠিক আছ তো?

 জিনি ভুরু উচিয়ে, কেন, ঠিক না থাকার কোনো কারণ ঘটেছে না–কি?

মরগ্যান তীক্ষ্ণস্বরে বললো, দেখো, আমার সামনে বেশী বড় বড় কথা বোলো না। এ ধরনের কাজ আমি বহু করেছি কিন্তু তবুও আমি যে একেবারে ভয় পাইনা নয়। আমাকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করোনা জিনি। আমি জানতে চেয়েছি–তুমি ঠিক আছে কিনা? এখনো ভেবে দেখো, কাজটা তুমি পারবে কি না?

মরগ্যানের দিকে জিনি হাত বাড়িয়ে ধরলো। ওর সরু আঙ্গুলের ফাঁকে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। নিথর, নিষ্কম্প।

জিনি শান্তস্বরে বললো, আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে, ভয় পেয়েছি? বলেই চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে মরগ্যানের দিকে চোখ রেখে বললো, বাবোটা দশে আমাদের দেখা হবে, তারপর দরজার দিকে চলল, বাইরে বেরিয়ে নিঃশব্দে জিনি দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলো।

ব্লেক ঠোঁট বেঁকিয়ে বললো, মেয়েটার সাহসের প্রশংসা করতে হয়।

মরগ্যান মৃদুস্বরে, কে জানে। অনেক সাহসী লোককেই বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে আমি ভেঙে পড়তে দেখেছি। আসল কাজের সময়েই আমরা জিনির সত্যিকারের পরিচয় পাবো। আচ্ছা তাহলে এবার ওঠা যাক।

মরগ্যান এবং ব্রেক রাত ঠিক বারোটা বেজে পাঁচ মিনিটে ম্যাডাম স্ট্রীটের মোড়ে এসেউপস্থিত হলো! রাস্তা পার হয়ে একটা অন্ধকার দোকান ঘরের সামনে ওরা দাঁড়ালো। চোখের শ্বাপদ দৃষ্টি প্যালেস অফ নাইট কাফের দিকে।

জানলার ফাঁক দিয়ে উজ্জ্বল আলোর রেখা ভেসে আসছে। কাঁচের দরজার ওপরে অবস্থিত বার–এর একাংশ ওদের নজরে পড়লো।

মরগ্যান সিগারেটের টুকরোটা রাস্তায় ছুঁড়ে দিলো, ঐ সেই কাফে!

ব্লেক সচেতন হয়ে বললো, আমি বাজি রেখে বলতে পারি, এ কাজের হাত থেকে রেহাই পেয়ে জিপো মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দিচ্ছে।

মরগ্যান বললো, এবং জিপোকে এ কাজে বাদ দিতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। কিন্তু বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে, ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে সে সহজ হতে চাইলো, কিটসন গাড়ি নিয়ে হাজির হওয়া মাত্রই আমরা রাস্তা পার হয়ে কাফেতে ঢুকছি।

হুঁ, বলতে বলতেই ব্লেক প্যান্টের পেছন পকেটে হাত দিয়ে ৩৮ রিভলবারের শীতল স্পর্শ অনুভব করলো। এমন সময় সে লক্ষ্য করলো, জিনি ধীরে ধীরে কাফের দিকে যাচ্ছে। ওর পরণে সেই কালো স্ন্যাক্স এবং শ্যাওলা সবুজ শার্ট। কিন্তু ওর তামাটে চুল একটা সবুজ স্কার্ফের আবরণে ঢাকা। রাস্তার স্বল্প আলোয় ওর সৌন্দর্যকে অনেকাংশে ম্লান করে দিয়েছে ওই সবুজ স্কার্ফ, ব্লেক লক্ষ্য করলো।

ব্লেক বললো, ঐ যে জিনি এসে গেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জিপোর ঝরঝরে লিংকনটা কাফের দরজার সামনে এসে থামলো।

চলো এবার যাওয়া যাক। মরগ্যান ব্লেকের আস্তিন ধরে টান মারলো। তারপর দ্রুত লম্বা পা ফেলে রাস্তা পার হতে লাগলো।

একেবারে নির্জন কাফের সামনে রাস্তাটা। ওদের কানে এলো কাফের জুকবক্স থেকে ওয়া সঙ্গীতের হালকা সুর।

লিংকনের পাশে গিয়ে থামলোমরগ্যান। চারপাশ দেখে হাত বাড়িয়ে পেছনের সীট থেকে তুলে নিলো মেশিনগানটা।

আলেক্স, প্রস্তুত থাকো উপযুক্ত সময়ের জন্যে, গাড়ির চালকের আসনে বসে–থাকা কিটসনের দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো ছুঁড়ে মারলো মরগ্যান, পালাবার সময় এক সেকেণ্ড সময়ও আমি নষ্ট করতে চাই না।

সম্মত্তি জানালো কিটসন, ওর হাত আঁকড়ে রইলো স্টিয়ারিং হুইলটা।

ইতিমধ্যে ব্লেক রুমাল দিয়ে মুখের নিম্নাংশ ঢেকে ফেলেছে।

তখন জিনি মুখ ঢাকার পর্যায় সেরে কাফের দরজার কাছে চুপটি করে দাঁড়িয়ে।

মুখোশ ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন অনুভব করলো না মরগ্যান। এ লাইনে থেকে তার যৎসামান্য অভিজ্ঞতা হয়েছে, কাফের কোনো খদ্দেরই পুলিশের কাছে চেহারার সঠিক বর্ণনা দিতে পারবে না। কারণ আতঙ্কে চিন্তাক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে লোপ পাবে।

এসো, ভেতরে ঢোকা যাক–মরগ্যান বললো। তারপর এগিয়ে জিনির কাছে, তুমি দরজাটা খুলেই পাশে সরে দাঁড়াবে।

নিষ্পলক চোখে মেয়েটা তারই চোখে তাকিয়ে।

মরগ্যান বললো, মেয়েটার নার্ভের প্রশংসা করতে হয়। একটা কচি মেয়ের ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করা কখনই সম্ভব নয়! অথচ;….

মরগ্যান মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকলো ভেতরে।

জিনি মরগ্যানকে অনুসরণ করতেই ব্লেক এগিয়ে গেলো দরজার কাছে। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো সে। পর্দা টেনে দিলো কাঁচের ওপর।

 দুজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে ছিলো বার কাউন্টারে। বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকতেই তারা ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে দেখলো। প্রথমে নজর পড়লো মরগ্যানের দিকে। তারপর মেশিনগানটার দিকে। এই দৃশ্যে তাদের চোখজোড়া বেরিয়ে আসতে চাইলো। মুখের রং ফ্যাকাশে ভাব। তখনই দেখতে পেলো মুখ ঢাকা জিনিকে।

চিৎকার করে উঠলো মরগ্যান, সাবধান! পথ ছেড়ে দাঁড়ান আপনারা! তার হাতের মেশিনগান আদেশের ভঙ্গীতে আন্দোলিত হলো।

নিমেষে ঘরের কলগুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে গেলো। মরগ্যানের তীক্ষ্ণস্বর রেশমী কাপড়ে ছুরির ঝলকের মতো কেটে বসলো সেই জমাট নিস্তব্ধতার ওপর।

বুড়ো লোকদুটো পেছোতে গিয়ে একজন আরেকজনের ঘাড়ের ওপর উলটে পড়লো।

 মরগ্যান বার কাউন্টারে এক হাতের ভর নিয়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠলো। পরমুহূর্তেই তাকে দেখা গেলো পা ফাঁক করে, দু হাতে মেশিনগান আঁকড়ে কাউন্টারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে।

মরগ্যান এলোপাথাড়ি লাথি চালিয়ে কাউন্টারের ওপর সাজানো বোতলগুলো চারিদিকে ছিটকে ফেললো। কাঁচ ভাঙার শব্দের সঙ্গে ভেসে এলো কোনো তরুণীর ভয়ার্ত চিৎকার। কাফের চেয়ারে বসে থাকা প্রতিটি লোক চমকে উঠে দাঁড়ালো। পরস্পরের চাপা গুঞ্জন শুরু হলো।

 মরগ্যান গর্জে উঠল। খবরদার; সেই সঙ্গে নেচে উঠলো তার হাতের মেশিনগান, কেউ নড়বেন না। চুপচাপ বসে পড়ুন। আপনারা চুপ থাকলে আমার মেশিনগানও চুপ থাকবে। সাবধান, কারো একটু বেচাল দেখলেই একেবারে সীসের বস্তা করে ছাড়বো।

ব্লেকের বুকে হৃদপিণ্ডের আকুল দাপাদাপি যেন দামামা বাজাতে লাগলো। ঘামের বন্যায় তার দৃষ্টি হলো অবরুদ্ধ। ব্লেক নিশ্বাস নেবার চেষ্টায় এক হ্যাঁচকায় রুমালটা খুলে ফেললো। বুক ভরে শাস নিলো। চারদিকে তাকিয়ে রিভলবারটা আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। ব্লেক মনে মনে প্রার্থনা করছে, যেন কোনো বিপদের মুখোমুখি ওদের পড়তে না হয়।

ভাঙা গলায় একটা বুড়ী চিৎকার করে উঠলো। দুজন লোক উঠবার চেষ্টা করতেই তাদের সঙ্গীসাথীরা হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো। ঘরের সকলে যেন নিথর পাথর মূর্তিতে পরিণত হয়েছে।

মরগ্যান গলার স্বর উঁচু পর্দায় তুলে বললো, ভালো করে শুনুন, আমাদের ক্যাশ টাকা চাই। অতএব চটপট আপনাদের মানিব্যাগগুলো বের করে টেবিলে রাখুন। চটপট তাড়াতাড়ি করুন।

বেশীর ভাগ লোকই তাদের পেছন পকেট হাতড়াতে লাগলো। আর জিনিও প্রস্তুত হলো ওর দায়িত্ব পালনের জন্য। মরগ্যানের দেওয়া ক্যাম্বিসের থলেটা স্ল্যাক্সের পকেট থেকে বের করলো। তারপর বাঁ হাতে থলেটা ঝুলিয়ে ডান হাতে ৩৮ নাচিয়ে টেবিলের সারির মধ্য দিয়ে এগিয়ে। চললো। প্রত্যেক টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে থাকা মানিব্যাগগুলো তুলে নিতে থাকলো। এবং পর্যায়ক্রমে সেগুলোকে বাঁ হাতের থলেতে ঢুকিয়ে রাখতে লাগলো।

নিশ্চলভাবে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ব্লেক ওকে লক্ষ্য করতে লাগলো। ধীরে অথচ অত্যন্ত সাবধানে জিনি এগিয়ে চললো। যেন ভঙ্গুর বরফের চাদরে পা রেখে ও হেঁটে চলেছে। কিন্তু ওর চলার মধ্যে দ্বিধার ছায়া নেই। জিনি যান্ত্রিকভাবে কাজ করে চললো।

আবার হিংস্রভাবে মরগ্যান চিৎকার করলো, চটপট করুন। মানিব্যাগ বের করতে ফালতু সময় নষ্ট করবেন না। বলা যায় না, আমার আঙুলের চাপে মেশিনগান থেকে হয়তো… কিন্তু তা আমি। চাই না। সুতরাং মানিব্যাগগুলো চটপট মেয়েটার হাতে তুলে দিন।

ব্লেক এতক্ষণে কিছুটা স্বস্তি পেলো। সে ভাবললামরগ্যান আর জিনিই বলতে গেলে কাজটা হাসিল করলো। ওঃ, ওদের সাহস আছে বটে।

মরগ্যানের স্বরের কাঠিন্য ও মৃত্যু শীতলতা সারা ঘরে ছড়িয়ে দিলো হিমের আতঙ্ক। তার দাঁড়াবার দৃপ্তভঙ্গী, সেই সঙ্গে শক্ত মুঠোয় ধরা কালো চকচকে মেশিনগানটা যেন শিয়রে দাঁড়ানো মৃত্যুদূতের প্রতিমূর্তি।

হঠাৎই ওর যান্ত্রিক পরিক্রমার মধ্যে জিনি একটা টেবিলের সামনে থমকে দাঁড়ালো। একজন সুন্দরী তরুণী টেবিলে বসেছিল। পরনে দামী লোমের কোট। তার পাশে বসে স্থূলকায় চেহারার একটি লোক। চোয়ালের রেখা কঠিন, চোখের দৃষ্টি জ্বর। টেবিলের ওপর কোনো মানিব্যাগের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

লোকটার সঙ্গে জিনির চোখাচোখি হলো। লোকটার ধূসর চোখ জ্বল জ্বল করে উঠলো।

নরম সুরে জিনি বললো, ব্যাগটা চটপট বের করে দিন, স্যার, শুধু শুধু সময় নষ্ট করবেন না।

লোকটা নির্বিকারভাবে বললো, দুঃখিত। আমার কাছে কোনো ব্যাগ নেই। তাছাড়া তোমার মতো একটা বাজারে মাগীকে দেবার জন্যে আমি সঙ্গে টাকা নিয়ে ঘুরি না।

ঘামতে শুরু করলো ব্রেক। সে যেন বিপদের গন্ধ পাচ্ছে। মরগ্যান একইভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে মেশিনগান। মরগ্যান তখন তীক্ষ্ণভাবে জিনিকে লক্ষ্য করছে। ঠোঁট সরে গিয়ে তার দাঁতের সারি আংশিক উম্মুক্ত–সারা মুখে নেকড়ের হিংস্রতার ছাপ।

জিনির স্বর উঁচু পর্দায়–ব্যাগটা বের করে দাও!

লোকটা জিনির দিকে চোখ রেখে বললো, শালা, কুত্তীর বাচ্চা! আমার কাছে কোনো ব্যাগ নেই।

ফ্যাকাশে হয়ে গেলোলোকটার সঙ্গিনীর মুখ। আতঙ্কে তার চোখজোড়া বুজে এলো। সে মোটা লোকটার গায়ে ধীরে ধীরে ঢলে পড়লো। কিন্তু লোকটা অধৈর্যভাবে মেয়েটিকে ঠেলে সরিয়ে দিলো।

জিনি এবার রিভলবার উঁচিয়ে ধরলো। চটপট ব্যাগটা বের করে ফ্যাল, মোটা, নইলে একেবারে ঝাঁঝরা করে দেবো।

লোকটা জিনির কর্কশ ধমকানিতে এতটুকুও চমকালো না। কঠিন মুখে দাঁতে দাঁত ঘষে বললো। আমার কাছে–কোনোব্যাগ–নেই! বেরো এখান থেকে।

মেশিনগানের নলটা মরগ্যান লোকটার দিকে ঘোরালো কিন্তু লোকটা এবং মরগ্যানের, মাঝখানে জিনি দাঁড়িয়ে আছে। মরগ্যান যে এ অবস্থায় গুলি চালাতে পারবে না তা লোকটা বেশ বুঝতে পারলো।

সুতরাং এই অবস্থা সামলানোর দায়িত্ব জিনির পুরোপুরি তাই মরগ্যান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের লক্ষ্য করলো। সে জানতো, এটাই চরম পরীক্ষা। এই স্নায়বিক চাপের মুহূর্তে ও কি ভেঙ্গে পরবে?  কিছুক্ষণের মধ্যেই জিনি লোকটার দিকে চেয়ে হাসলো; সে হাসির ঝলকানি রুমালের আড়ালে পলকের জন্য আবির্ভূত হয়েই মিলিয়ে গেলো। তার ক্ষণস্থায়ী রেশ পরমুহূর্তেই সাপের ছোবলের মত ওর পিস্তলসুদ্ধ হাত আছড়ে পড়লো লোকটার মুখে। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেলো যে লোকটা বাধা দেবার সুযোগই পেলো না। ৩৮ এর নলটা আড়াআড়িভাবে আঘাত করলে তার নাকে এবং গালে। গাল ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোলো। একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে লোকটা মুখে দু হাত চাপা দিয়ে পেছন দিকে হেলে পড়লো।

 জিনি টেবিলে ঝুঁকে রিভলবার ঘুরিয়ে দ্বিতীয়বার আঘাত হানলো, এবার ৩৮ এর নলটা লোকটার ব্রহ্মতালুতে, লোকটা আচমকা হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে পড়লো।

বিকট স্বরে চিৎকার করে উঠলো পাশের মেয়েটি এবং সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো।

সাবধান নিজের জায়গা থেকে কেউ নড়তে চেষ্টা করলে আমি কাউকেই রেহাই দেবো না। সকলে মরগ্যানের দিকে ফিরে তাকালো। সারা ঘরময় আতঙ্কের আবহাওয়া, এমন কি ব্লেক পর্যন্ত মরগ্যানের হাড় কাঁপানো চিৎকারে শিউরে উঠলো।

জিনি হমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা লোকটার কাছে গিয়ে কলার ধরে টেনে তুলে ভেতরের পকেট থেকে লোকটার মানিব্যাগটা বের করে আনলো। ব্যাগটা থলেতে ভরে তাকে সজোরে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেললো।

ওতেই যথেষ্ট কাজ হলো কোন যাদুমন্ত্রবলে একের পর এক মানিব্যাগ টেবিলে এসে গেলো। জিনি চটপট সেগুলো থলেতে ভরতে লাগলো।

ব্লেক সাফল্যের উল্লাসে দরজার দিকে আর নজর রাখেনি। তাই দরজা খুলে একজন দোহারা চেহারার বলিষ্ঠ লোক হঠাৎই তার সামনে উপস্থিত হলো।

সে নির্বোধের মত শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। বিশাল চেহারার আগন্তুকের নজরে পড়লো ব্লেকের হাতে আলগা মুঠোয় ধরা রিভলবারটার দিকে। বিদ্যুৎগতিতে আগন্তুকের বলিষ্ঠ হাত কাটারির মতো ব্লেকের কব্জির ওপর নেমে এলো। সঙ্গে সঙ্গে রিভলবারটা মেঝেতে ছিটকে পড়ল, গড়াতে গড়াতে গিয়ে থামলো বার কাউন্টারের সামনে। হতভম্ব ব্লেক তখন একইভাবে দাঁড়িয়ে।

লোকটা ঘুষি তুলতেই মরগ্যান তার দিকে দাঁড়িয়ে বলল, খবরদার মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াও, নইলে….. ।

মরগ্যানের দিকে লোকটা তাকাতেই তার হাতে মেশিনগানটা দেখে সমস্ত সাহসকর্পূরের মতো উবে গেলো। সে মাথার ওপর হাত তুললো।

একজন বলিষ্ঠ বেঁটে–খাটো লোকের কাছ থেকে জিনি মানিব্যাগটা নিচ্ছিলো। লোকটা মরগ্যানকে মেশিনগানটা অন্য দিকে ফেরাতে দেখেই জিনির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। জিনিব্যাগটা থলেতে ভরতে যাচ্ছিলো, এমন সময় বেটে লোকটার দুটো হাত মরিয়া হয়ে রিভলবারটা কেড়ে নিতে চাইলো। ধস্তাধস্তি শুরু হলো।

৩৮ এর বাঁট জিনি শক্ত হাতে ধরে, লোকটার ভয়ার্ত চোখের দিকে দেখলো। তারপর ধস্তা ধস্তির মধ্যেই ট্রিগার টিপলো। বিকট শব্দে কাফের সমস্ত দরজা জানলা থর থর করে কেঁপে উঠলো। লোকটা তড়িৎগতিতে সরে গেলে গুলিটা তার জামার আস্তিন ছিঁড়ে, হাত ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। চামড়া কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। জিনি রিভলবার নাচিয়ে দু পা পিছিয়ে এলো। লোকটা তখন বাঁ হাতে তার আহত ডান হাতটা চেপে ধরেছে।

মরগ্যান কর্কশস্বরে, জলদি করো, জিনি, আমাদের আর সময় নেই।

জিনি শান্তভাবে নির্বিকার মুখে কাজ করে চললো। চলাফেরার মধ্যে কোন ব্যস্ততা নেই। কাফের প্রতিটি লোক ফ্যাকাসে, বিবর্ণ মুখে নিশ্চলভাবে যার যার জায়গায় বসে। নিঃশব্দে ওরা জিনির কার্যকলাপ দেখছে।

বাইরে অপেক্ষারত কিটসন গুলির আওয়াজে চমকে উঠলো। তবে কি…? অসাধারণ সংযম এবং প্রচেষ্টায় সে স্থির হয়ে বসে রইলো। দু হাতের থাবা আঁকড়ে ধরেছে স্টিয়ারিং হুইলটাকে। ঘামে মুখ চকচক করছে। উৎকণ্ঠায় উত্তাল হৃদপিণ্ড ধক ধক….।

হঠাৎ কিটসনের কানে এলে দৌড়ে আসা ভারী পায়ের শব্দ। একটু পরেই লিংকনের পেছনের। দরজা খুলে গেলো। দুদ্দাড় করে কারা যেন গাড়িতে ঢুকে পড়লো। একটা উত্তপ্ত ঘামে ভেজা দেহ কিটসনের শরীরে এসে আঘাত করতেই সে পাশ ফিরে দেখলো ব্লেক তার পাশে সামনের সীটে বসে। যান্ত্রিকভাবে কিটসনের হাত এগিয়ে গেলোগীয়ারের দিকে। গাড়িটা এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে সচল হলো।

পিছনের সীট থেকে মরগ্যান বলল, শীগগির আলেক্স! যতো জোরে পারো গাড়ি ছোটাও।

কিটসন দাঁতে দাঁত চেপে তীরবেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিলো। কিটসন গাড়িটা বাঁ দিকে ঘোরালো। সরু একটা গলি পার হয়েই বড় রাস্তায় পড়লো।

সহজাত দক্ষতার সঙ্গে সেবড় রাস্তা নিমেষে পেরিয়ে আর একটা গলিতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলো। গাড়ির গতি এবার সামান্য কমিয়ে হেডলাইটের সংকেত দিয়ে সে একের পর এক চৌরাস্তা পার হয়ে চললো।

পেছনের জানলা দিয়ে মরগ্যান দেখতে লাগলো কেউ তাদের অনুসরণ করছে কিনা। এই ভাবে আধ মাইলটাক যাওয়ার পর সে বললো। যাক বাঁচা গেছে। কেউ আমাদের অনুসরণ করছে না। চলল। জিপোর ওখানেই যাওয়া যাক।

সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে ব্লেক বললো। মেশিনগানটা না থাকলে আজ ভীষণ বিপদে পড়তে হত। আর যখন ঐ হারামজাদাটা জিনির হাত থেকে রিভলবারটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো, তখন…।

কিটসন কাঁপা গলায় বললো, কি হয়েছিলো? গুলির শব্দ পেলাম, কেউ কি আহত হয়েছে?

উহু। একটা লোক জিনির রিভলবার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলো–এমন সময় ধস্তাধস্তিতে রিভলবার থেকে গুলি বেরিয়ে আসে। অবশ্য তাতে তেমন একটা কেউ আহত হয়নি, তবে লোকটা ভীষণ ভয় পেয়েছিলো, আর একটা লোক আচমকা এসে আমার হাত থেকে বন্দুকটা ছিটকে ফেলে দিলো। তারপর তাকে সামলাতে অনেক ঝক্কি পোয়াতে হয়েছে।

মরগ্যানের ঠিক পাশেই জিনি বসেছিলো। মরগ্যান অনুভব করলো ওর শরীর কাঁপছে। মরগ্যান রাস্তার আলোয় দেখলো জিনির মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য।

মরগ্যান ওর হাঁটুর ওপর হাত রাখলো, তোমার কাজে আমি খুশী হয়েছি, জিনি। সত্যিই তোমার সাহস আছে। বিশেষ করে ঐ মোটা লোকটাকে যেভাবেশায়েস্তা করলে…ও, আমি তো ভাবতেই পারিনি…

দয়া করে চুপকরো, ফ্র্যাঙ্ক মরগ্যানকে অবাক করে মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। সামনের সীটে বসা ব্লেক বা কিটসন কিছুই টের পেলো না। মরগ্যান জিনিকে একা থাকতে দিয়ে সরে বসলো।

কিটসন জিপোর কারখানার কাছাকাছি এসে খুব সন্তর্পণে গাড়ি চালাতে লাগলো। মুখ না ফিরিয়েই বললো, মোট কত টাকা হালে?

মন্দ নয়। কম করে গোটা পঞ্চাশেক মানিব্যাগ তো হবেই। তাছাড়া কাফের ক্যাশ বাক্সও প্রায় ঠাসা ছিলো। মরগ্যান একটা সিগারেট ধরালো।

তখনো মরগ্যান, ব্লেকের হাঁপানোর শব্দ বেশ শুনতে পাচ্ছে। তার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ জন্মেছে যে ব্লেক সংশয়ের মুহূর্তে আচমকা ভেঙ্গে পড়তে পারে। এতদিন ব্লেকের সাহস ও দৃঢ়তা সম্পর্কে গভীর আস্থা ছিলো। কিন্তু আজ যেভাবে নির্জীবের মতো সে ঐ লোকটার মোকাবিলা করলো তাতে ভরসা রাখা যায় না। এখন থেকে ব্লেকের ওপরেও তাকে কড়া নজর রাখতে হবে।

এমন কি কিটসনও আজ মুহূর্তের জন্য তার বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলো। কথা ছিলো গাড়িতে উঠলেই সে তীরবেগে গাড়ি ছুটিয়ে দেবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। কানের কাছে চিৎকার না করলে কিটসন অতো জোরে গাড়ি চালাতে পারতো না। অর্থাৎ কাফে থেকে কেউ বেরিয়ে গাড়িটা দেখলে পুলিশের কাছে গাড়িটার বর্ণনা দিতো।

না, বড় কাজের আগে প্রত্যেককে ঠিক মতো প্রস্তুত করতে হবে। তবে জিনির আজকের কার্যকলাপ মরগ্যানকে ভীষণ খুশী করেছে। জিনির মূল্যই এখন তার কাছে সবচেয়ে বেশী।

মরগ্যান দেখলো জিনি এখন কান্না থামিয়ে সোজা হয়ে বসেছে। কাঠ–খোদাই অভিব্যক্তিহীন মুখ। ও বাইরের দিকে তাকিয়ে।

মরগ্যান সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললো, নাও, ধরো।

 নিঃশব্দে জিনি সিগারেটটা নিলো। মরগ্যান সিগারেট ধরাতেই গাড়িটা উঁচু নীচু কঁচা রাস্তায় পড়লো। আর বেশী দূরে নেই জিপোর কারখানা।

কারখানা বলতে একটা বড় টিনের একচালা। তার পাশে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরী একটা ছোট্ট ঘর–জিপোর বাসস্থান।

লিংকনের হেডলাইটের আলো কারখানার দরজায় পড়তেই জিপো বেরিয়ে এলো। তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলতে গিয়ে বার কয়েক হোঁচট খেলো জিপো। অবশেষে গাড়ি ঢোকাবার জন্য দরজার পাল্লা দুটো হাট করে খুললো। তাকে দেখে মনে হলো যে সে যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে।

কারখানার ভেতরে কিটসন গাড়িটাকে ঢুকিয়ে দিলো, ওরা নেমে পড়লো। জিপো দরজা বন্ধ করে ওদের কাছে এসে বললো, কি ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো?

মরগ্যান বললো, হ্যাঁ, কিছু ভেবো না। এখন বোতল আর গ্লাস বের করা দেখি। আলেক্স, তুমি চটপট এই নাম্বার প্লেট দুটো পালটে ফেলল। আর রেডিয়েটরের জলটা পালটে ঠাণ্ডা জল ভরে দাও। বলা যায় না কখন পুলিশ এসে হানা দেয়। কি হলো জিপো দাঁড়িয়ে কেন?

ঝটপট গ্লাস নিয়ে এসো। ব্লেক অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরানোনার চেষ্টা করছিলো, মরগ্যান ডাকলো, এড, তুমি কিটসনকে একটু সাহায্য করো।

জিনির কাছে গিয়ে মরগ্যান হেসে, কেমন আছ, এখন?

জিনির মুখভাব কঠিন, গায়ের চামরা ঈষৎ নীলাভ, মুখমণ্ডল পাণ্ডুর, বিরক্তিভরে বললো, আমার জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না।

এ কাজটার মতো আসল কাজটায় যদি উতরাতে পারো তবেই বুঝবো!

ওঃ, তখন থেকে খালি একই কথা, আমি কি কচি খুকি নাকি! বলে টেবিলের কাছে গিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে যন্ত্রপাতিগুলো নাড়াচাড়া করে চললো।

জিপো এক বোতল হুইস্কি আর পাঁচটা গ্লাস নিয়ে হাজির হলো। মরগ্যান গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে জিনির কাছে বাড়িয়ে ধরলো। নাও, খেয়ে নাও। ধকল তো কিছু কম গেলো না।

গ্লাসে একটা চুমুক দিতেই জিনির মুখের বিবর্ণ ভাবটা কেটে আগের সতেজ লাবণ্য ভাব ফিরে এলো।

কাজটা যতোটা সহজ ভেবেছিলাম, ততোটা নয়! আরেকটু হলেই আমার হয়েছিলো!

মরগ্যান বলে উঠলো, কিন্তু তা যখন হয়নি, তখন আর ও নিয়ে ভাবছো কেন? তাছাড়া, সবার চেয়ে তোমার কাজই ভালো হয়েছে। যাক, এবার দেখা যাক, কি রকম আমদানি হলো।

থলেটা টেবিলের ওপর উপুড় করে দিলো মরগ্যান। জিনি তাকে সাহায্য করতে লাগলো। জিপো, কিটসন আর ব্লেক গাড়িটাকে নিয়ে পড়েছে।

জিনি একটা কালো রঙের ছক কাটা মানিব্যাগ নিয়ে বললো, এই ব্যাগটা সেই মোটা লোকটার যাকে রিভলবার দিয়ে মেরেছিলাম!

ব্যাগটা খুলে দেখো ব্যাটা কিসের মায়ায় অমন রুখে দাঁড়িয়েছিল। জিনি ব্যাগ থেকে দশ দশটা একশো ডলারের নোট বের করলো।

হু–লোকটাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। হাজার ডলারের মায়ায় যে কোনো লোকই তোমাকে বাধা দিতো।

তিনজনে গাড়ির ব্যবস্থা করে এসে চুপচাপ মরগ্যান ও জিনির কার্যকলাপ টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো। সমস্ত টাকা পিকৃত হওয়ার পর মরগ্যান একটা বাক্সের ওপর আয়েস করে বসে লুঠের টাকা গুনতে শুরু করলো।

গোনা শেষ হলে মরগ্যান বললো, দু হাজার ন–শো পঁচাত্তর ডলার। যা তাহলে আমাদের মূলধন যোগাড় হয়ে গেলো। এবার আমরা স্বচ্ছন্দে এগোতে পারি।

জিপো গোল গোল চোখ করে, ফ্র্যাঙ্ক, সত্যিই কি জিনি একটা লোককে মেরেছে?

মরগ্যান নোটগুলো গুছাতে গুছাতে বললো, হ্যাঁ প্রয়োজন ছিলো তাই মেরেছে। লোকটাকে যেভাবে ও শায়েস্তা করেছে, দেখার মতো। তুমি আমিও বোধ হয় পারতাম না। গম্ভীর মুখে জিনি গাড়ির দিকে পা বাড়ালো। ওরা চারজনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।

মরগ্যান শান্তস্বরে বললো ওকে দিয়ে কাজ হবে। আর তোমরাও যদি ওর মতো কাজ দেখাতে পারো, তাহলে আর চিন্তা নেই। ধরে নাও, দশ লাখ ডলার আমরা পেয়ে গেছি।

মরগ্যান কথা শেষ করে সরাসরি ব্লেকের দিকে তাকালো। কিন্তু ব্লেক সেই চাউনির মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলো। তারপর সিগারেট বের করে দেশলাইয়ের খোঁজে হাতাড়াতে লাগলো। মরগ্যানের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি সে অনুভব করলো।

আমার কথা শুনতে পেয়েছো, এড? কোনরকমে আগুন ধরিয়ে ব্লেক বলল, নিশ্চয়ই।

জিপোর চোখ এড়ালো না পরিস্থিতির ইঙ্গিত। সে প্রশ্ন করলো, কি ব্যাপার, ফ্র্যাঙ্ক? কোনো, গোলমাল হয়েছে নাকি?

তেমন কিছু নয়। …

একটা লোক হঠাৎই এডের হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নিয়েছিল। আমরা অল্পের জন্য সে যাত্রায় রেহাই পেয়েছি। নইলে কি যে হতো বলা যায় না।

থমথমে মুখে ব্লেক, লোকটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তারও একই অবস্থা হতো।

হু–তবে লক্ষ্য রেখো, যেন ভবিষ্যতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে! মরগ্যান কিটসনের দিকে ফিরে, আর তুমি? তোমার গাড়ি চালানো আজ একেবারে যাচ্ছেতাই হয়েছে। আরো জোরে গাড়ি ছোটানো উচিত ছিলো।

কিটসন জানে, মরগ্যান খুব একটা মিথ্যে বলছে না। কাফের থেকে ভেসে আসা বন্দুকের শব্দটাই সবকিছু ওলট পালট করে দিয়েছিলো। সে ভেবেছিলো, কাফের কোনো লোককে বুঝি ওরা খুন করেছে। আর এই খুনের দায়ে জড়াবার আশঙ্কাটাই তাকে স্থবির করে দিয়েছে।

জিনি…।

আস্তে আস্তে জিনি মরগ্যানের ডাকে ওদের কাছে ফিরে এলো।

মরগ্যান বললো, শোনো, এইবার আমরা বড় কাজের প্রস্তুতি নেবো। তুমি আর কিটসন কাল মার্লোয় যাবে ক্যারাভানটা কিনে আনতে। কি মাপের কিনতে হবে সেটা জিপোই তোমাদের বলে দেবে। এবার টেবিলে কালো সিগারেটের ধোঁয়ার আড়ালে মরগ্যানের চোখ ঝাপসা দেখাচ্ছে।

ক্যারাভানের দামটা যত কম হয় ততই ভালো। কারণ এই তিনহাজার ডলারের প্রতিটি সেন্ট আমাদের কাছে এক–এক ফোঁটা রক্তের চেয়েও দামী। মরগ্যান এবার কিটসনের দিকে ক্যারাভান কিনতে গিয়ে তোমাকে কি বলতে হবে মনে আছে তো? বলবে যে তুমি আর জিনি সম্প্রতি বিয়ে করেছে; মধুচন্দ্রিমা কাটানোর জন্যে একটা ক্যারাভান তোমাদের দরকার। এতে সন্দেহের কিছুই থাকবে না; কারণ আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিয়ের পর ক্যারাভান কিনছে। তবে একটা বিষয়ে লক্ষ্য রেখো, যে লোকটা তোমাদের ক্যারাভান বেচবে, সে যেন তোমাদের সনাক্ত করতে না পারে।

সন্দেহের চোখে কিটসন তাকালো ব্লেকের দিকে। কিন্তু ঠাট্টা করার মতো মেজাজ ব্লেকের ছিলো না। কারণ কাফে লুঠের ব্যাপারটায় সে কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। তাই বিরক্তি নিয়ে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

ওঃ–এই ভাবটা মুখ থেকে তাড়াও দেখি, কিটসনকে ধমকে উঠলো মরগ্যান, তোমাকে মনেই হচ্ছে না, জিনিকে নিয়ে তুমি মধুচন্দ্রিমা কাটাতে যাচ্ছে। নাঃ, ক্যারাভান কিনতে গেলে দোকানদার তোমাদের সন্দেহ করে বসবে।

হাসলো জিপো, বললো, এক কাজ করলে কেমন হয়, ফ্র্যাঙ্ক? ধর–আলেক্সের জায়গায় আমিই না হয় গেলাম ক্যারাভান কিনতে প্রথমতঃ আমার সহজাত প্রতিভা; তাছাড়া জিনির সঙ্গে আমাকে মানাবে দারুন!

জিনি জিপোর কথায় হেসে ফেললো।

 জিনির সঙ্গে তোমার বয়েসের পার্থক্যটা বড্ড বেশী, জিপো। হেসে জবাব দিলো মরগ্যান, সুতরাং কিটসন ছাড়া আমাদের গতি নেই।

মরগ্যান টেবিলের ওপরের টাকা থেকে দু হাজার ডলার কিটসনকে গুনে দিলো।

দরাদরি করে দামটা একটু কম সম করার চেষ্টা করো। কাল সকাল এগোরোটায় আমি বুইক আর ক্যারাভ্যান টানার শেকল তোমার ওখানে পৌঁছে দেবো। জিপো, তুমি লিংকনটাকে নিয়ে। আমাকে অনুসরণ করবে। কারণ বুইকটা কিটসনের ওখানে ছেড়ে দিয়ে তোমার গাড়িতেই ফিরবো।

ঠিক আছে।

আচ্ছা এবার তাহলে ওঠা যাক। লু-কে ওর মেশিনগানটা এখনই ফেরত দিতে হবে। এড, তুমি আমার সঙ্গে চলল। জিনি ও কিটসন, তোমরা বাসে করেই রওনা দিও। কারণ আমাদের চারজনকে একসঙ্গে যতো কম দেখা যায় ততোই ভালো।

পেছনের পকেটে বাকি টাকাটা ঢুকিয়ে মরগ্যান জিনিকে বললো, তোমরা কোথায় দেখা করবে সেটা নিজেরাই ঠিক করে নিও। তবে কাল বিকেলের মধ্যেই ক্যারাভান সমেত তোমাদের এখানে ফিরে আসতে হবে। চলে এসো, এড।

জিনি মাথা থেকে সবুজ স্কার্ফটা খুলে আড়ষ্ট চুলের গোছাকে আঙুলের আলতো আঁচড়ে ঠিক করলো।

কিটসন জিনির সৌন্দর্য সম্পর্কে আবার সচেতন হয়ে উঠলো। টেবিলে হেলান দিয়ে নখ খুঁটতে লাগলো।

জিপো বললো, আর এক গ্লাস হবে নাকি?

উহু–ধন্যবাদ। জিনিঝগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে ঠোঁটে রেখে কিটসনের দিকে তাকালো।

দেশলাই বের করে কিটসন জ্বলন্ত কাঠিটা কাঁপা হাতে জিনির মুখের কাছে এগিয়ে ধরলো। আগুনের শিখাকে স্থির করতে জিনি দুহাতে আঁকড়ে ধরলো কিটসনের চঞ্চল হাত। মুখ নামিয়ে সিগারেটের অগ্রভাগ আগুনে ডুবিয়ে দিলো। কিটসনের শিরা উপশিরায় উষ্ণ রক্তের ঢেউ আছড়ে পড়লো।

আচ্ছা তাহলে চলিবলেই জিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

জিপো বললো, পরে আবার দেখা হবে; কিটসন জিনিকে অনুসরণ করলো।

রাতের উত্তপ্ত হাওয়া এসে ওদের শরীরে লাগলো। ওরা পাশাপাশি পা ফেলে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে চললো।

হঠাৎ জিনি বাসস্টপে পৌঁছে বললো, তুমি কোথায় থাকো?

লেনক্র স্ট্রীট।

 ঠিক আছে, তাহলে কাল এগারোটার সময় আমি লেন স্ট্রীটের মোড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।

যদি বল, তাহলে গাড়ি নিয়ে আমিই যাবো তোমার ওখানে–

না তার প্রয়োজন নেই।

আড়চোখে পাশে দাঁড়ানো জিনিকে কিটসন দেখতে লাগলো। একসময় বললো, সেদিন রাতে–আমি কখনোই তোমার গায়ে হাত তুলতাম না। হঠাৎ কেন যে অমন রেগে উঠলাম কে জানে। ….আমি দুঃখিত।

জিনি হেসে বললো, আমি তো ভাবছিলাম, তুমি বোধ হয় আমাকে মেরেই বসলে, খুব ভয় করছিলো আমার।

কিটসন লজ্জা পেলল, না, না–শুধু শুধু তুমি ভয় পেয়েছিলে। এমনিতেই আমার চেয়ে ছোট কারোর গায়ে আমি হাত তুলি না….তার ওপর তুমি তো মেয়ে!

 তা ঠিক, তবে পরে ভেবে দেখলাম, তোমার হাতের ঐ চড়টা খেলে আমার উপযুক্ত শিক্ষা হতো। বলতে গেলে আমিই তো সাধ করে গাল বাড়িয়েছিলাম।

কিন্তু ব্লেকের গায়ে হাত ভোলাটা কি তোমার উচিত হয়েছে?

ব্যাটা বড্ড বেশী বেড়ে উঠেছিলো, তাই একটু দাওয়াই দিলাম। তাছাড়া, ওই তো গায়ে পড়ে ঝগড়া, বাঁধালো। সেই প্রথম দিন থেকেই…

তা হোক, তবুও ওর গায়ে হাত তুলে তুমি ভালো করোনি। এখন থেকে ব্লেকের ওপর তোমাকে নজর রাখতে হবে। কারণ, সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতে ও ভুলবে না।

ব্লেককে আমি ভয় করি না।

আমারও তাই ধারণা। বছর খানেক আগে তোমার একটা লড়াই আমি দেখেছিলাম। ঐ যে লড়াইয়ে জ্যাকি ল্যাজার্ডকে একেবারে ময়দার বস্তা করে ছাড়লে–মনে পড়েছে? ওঃ। দারুণ জমেছিলো লড়াইটা।

কিটসনের বলিষ্ঠ মুখে উজ্জ্বল হাসি ফুটলো–সত্যিই দারুণ জমেছিলো সেই লড়াইটা। জ্যাকি ল্যাজার্ডকে সে যে হারাতে পেরেছিলো, তা নেহাতই ভাগ্যের জোরে। নটা রক্তাক্ত, ক্লান্ত রাউণ্ডের পর দশম রাউন্ডে ল্যাজার্ডকে কিটসন কাত করেছিলো। ভাগ্য সহায় থাকলে সে লড়াইয়ে ল্যাজার্ডও জিততে পারত।

জ্যাকি খুব ভালো লড়েছিল! তুমিও নেহাত খারাপ ছিলেনা। তা হঠাৎ বক্সিংটক্সিং ছেড়ে দিলে যে?

কিটসন একটু বিব্রত হয়ে কোনরকমে বললো, সে লড়াইটার পর হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমার চোখের ক্ষমতা ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসছে কাছের জিনিষ ভালো দেখতে পাচ্ছি না। ব্যাপার স্যাপার দেখে তো খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি বক্সিং ছেড়ে দিতে বললেন। আমার ইচ্ছে ছিলো চ্যাম্পিয়ান হওয়ার আর সম্ভাবনাও ছিলো….কিন্তু ডাক্তারের মতামতকে তো আর উপেক্ষা করা যায় না। অগত্যা…।

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে কিটসন জিনির দিকে তাকালো। বুঝতে চাইলো, বক্সিং ছাড়ার গল্পটা সন্দেহ জনক কিনা। কিন্তু জিনির ভাবলেশহীন মুখে কোন অভিব্যক্তিই নেই।

অনেকক্ষণ নীরবতার পর কিটসন বললো, তুমি হঠাৎ ফ্র্যাঙ্কের দলে ভিড়লে কেন?

তাছাড়া কার কাছেই বা যেতাম–জিনি রাস্তার দিকে তাকিয়েই বললো, ঐ যে–বাস আসছে।

বাস থামলে ওরা উঠে পড়লো। দুজনে পাশাপাশি বসলো, কিটসন দুটো টিকিট কাটলো। বাসের আর কোনো আসনই খালি নেই। কিছু কিছু কৌতূহলী লোক মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে জিনিকে দেখছে। কিটসন কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করলো।

শহরের দিকে বাস ছুটে চললো। রেল রোড স্টেশনের সামনে জিনি উঠে দাঁড়ালো। আমি এখানেই নামবো।

ওকে যাবার রাস্তা করে দিলো কিটসন। জিনির শরীরের আলতো স্পর্শে মুহূর্তের জন্য কিটসন। চঞ্চল হয়ে উঠলো। জিনি নেমে পড়লো।

বাস আবার চলতে লাগলো। কিটসন জিনিকে এক পলক দেখার আশায় জানলার কাঁচে মুখ। চেপে ধরলো–কিন্তু বৃথাই চেষ্টা।

.

০৪.

 মার্লো অভিমুখে পরদিন সকাল এগারোটায় কিটসনকে বুইক নিয়ে ছুটতে দেখা গেলো। দশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে টানা ষাট মাইলের রাস্তা মার্লো। কিটসনের হাতে বুইক যেন উড়ে চললো।

জিনি গর্ডন কিটসনের পাশেই ছিল। কিন্তু এ জিনির সঙ্গে বুঝি আগের জিনির কোনো মিলই নেই। রঙিন আঁটোসাঁটো ফ্রকটা পরে জিনিকে মনে হচ্ছে কোনো উচ্ছলা কিশোরী। ওর সুন্দর সতেজ মুখে অবাধ খুশীর রাজত্ব, যেন নববিবাহিতা কোনো বধু মধুচন্দ্রিমার আসন্ন সুখস্বপ্নে বিভোর। ওর চোখের ইশারায় উদ্দাম চঞ্চলতা, মুখের ভাব কোমল, আর সেই সঙ্গে তোতা পাখির মতো অনর্গল কথা বলছে।

কিটসন তো একবারে হতবাক ওর অভাবনীয় পরিবর্তনে। নিজেকে এক সদ্যবিবাহিত যুবকের ভূমিকায় খাপ খাওয়াতে তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তবে এখন কিটসনকে দেখলে মনে হবে, কোনো মধ্যবিত্ত, উচ্চাকাঙ্খী যুবক বিয়ের পরে স্ত্রীকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপনে যাচ্ছে। এবং ব্যাপারটা জানাজানি হবার ভয়ে সে বেশ বিব্রত।

মরগ্যান সকালবেলাই তার বুইক এবং ক্যারাভান টানার শেকল কিটসনের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে। এবং কথামতো জিপোও মরগ্যানকে অনুসরণ করে লিংকন নিয়ে যথাসময়ে হাজির হয়েছে। তারপরে, জিনি ও কিটসন যখন মরগ্যানের বুইকে চড়ে রওনা দিলো, তখন কোন অজ্ঞাত কারণে জিপো হঠাৎই ভাবপ্রবণ হয়ে পড়লো।

দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া বুইকের দিকে তাকিয়ে সে মরগ্যানকে বললো, ওদের দুটিতে ভারি সুন্দর মানিয়েছে, তাই না? আসলে জিনিকে আমরা যতোটা কঠিন ভাবি ততোটা ও নয়। ওর মতো চেহারার মেয়ে ভালোবাসা ছাড়া থাকতে পারে না… ওদের ঠিক নতুন বিয়ে করা বর–বউয়ের মতোই দেখাবে। তাই না ফ্র্যাঙ্ক!

তুমি যে দেখছি বুড়ী বিধবার মতো উল্টোপাল্টা ভাবতে শুরু করেছে, আঁ? তোমার হলো কি জিপো? হঠাৎ কি মাথা খারাপ হলো না–কি?

ঠিক আছে, আমার না হয় মাথা খারাপ হয়েছে, প্রলাপ বকছি কিন্তু বলতে পারো ফ্র্যাঙ্ক, ভালোবাসা ছাড়া এই দুনিয়ায় সুখটা কোথায়?

মরগ্যান প্রায় ধমকালো, ওঃ–হো–ওসব রাখো এখন। আমাদের অনেক কাজ সময় নষ্ট কোরো না। চলো, এডের ফ্ল্যাটে আমাকে নিয়ে চলল।

মরগ্যান ভাবলো জিপোর এ ধরণের মেয়েলি ভাব ভালো কথা নয়। আমাদের সামনে দুরুহ, দুঃসাহসিক কাজ। সুতরাং সে ক্ষেত্রে ভাবাবেগে সময় নষ্ট করা ঠিক নয়।

নদীর খুব কাছে পাথরের তৈরী বিশাল বাড়ির একটা ফ্ল্যাটে এড ব্লেক থাকে।

মরগ্যান লিফটে করে পাঁচতলায় পৌঁছলো। নির্জন বারান্দায় জুতোর মস্মস্ শব্দ তুলে মরগ্যান এগিয়ে চললো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কলিংবেলের বোতাম টিপলো।

এড ব্লেক দরজা খুললো। ব্লেকের পরনে কালো পাজামা, কালো শার্ট। তার বুকের কাছটায় সাদা সুতোয় লেখা; এ বি–এড ব্লেক। এডের মাথার চুল উস্কোখুস্কো, চোখের পাতা ভারী ও আচ্ছন্ন।

আরে, কি ব্যাপার? তোমরা এতো সকাল সকাল? কটা বাজে এখন?

মরগ্যান ব্লেককে ঠেলে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। বসবার ঘরটা ছোট হলেও আধুনিকভাবে সাজানো গোছানো। কিন্তু ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা জিন এবং হুইস্কির খালি বোতল ঘরের চেহারা পালটে দিয়েছে।

সিগারেটের ধোঁয়া ও সেন্টের গন্ধে ঘরের আবহাওয়া ভারী হয়েছে। সেটা টের পেতেই মরগ্যান নাক কোচকালো ওঃ, ঘর তো নয়, যেন বেশ্যাবাড়িতে ঢুকেছি। এটা জানলা খুলে রাখলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

তা কেন? বলে ব্লেক একটা জানলা খুলে দিলো। দেয়াল ঘড়িতে দেখলো এগারোটা কুড়ি। তোমরা দেখছি অনেক আগেই এসেছ। ……তা কিটসন কি রওনা হয়ে গেছে?

মরগ্যান শোবার ঘরের দিকে তাকিয়ে, হ্যাঁ, অনেকক্ষণ বেরিয়ে পড়েছে। শোবার ঘরে কে আছে?

ব্লেক চতুর হাসি হেসে, ওর জন্যে ভেবো না–মেয়েটা এখন ঘুমে অচেতন।

ব্লেকের জামা ধরে মরগ্যান এক হ্যাঁচকায় টেনে আনলো, শোনো এড, আমাদের সামনে এক বিরাট কাজের দায়িত্ব। তাছাড়া, কাল রাতে তুমি খুব একটা ভাল ফল দেখাতে পার নি। আসল কাজের জন্যে তোমাকে এর চেয়ে অনেক বেশী সাবধান হয়ে কাজ করতে হবে, নইলে তোমার সাহায্য আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। যদ্দিন পর্যন্ত না আমরা এই ট্রাকের ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করছি, তদ্দিন মদ খাওয়া আর মাগী চরানো ছাড়ো। সব কিছুর একটা সীমা আছে।

ঝটকা মেরে ব্লেক নিজেকে ছাড়াল। ওর মুখ কঠিন হয়ে উঠলো। –মুখ সামলে কথা বলো, ফ্র্যাঙ্ক!

তাই নাকি? যদি মিষ্টি কথায় চিড়ে না ভেজে তবে অন্য রাস্তা নিতে হবে দেখছি, …মিঃ এডওয়ার্ড ব্লেক। আমার বক্তব্য তোমার মগজে ঢুকলে ভালো, নইলে গলা ধাক্কা দিয়ে দল থেকে মেরে তাড়াবো মনে রেখো। ফ্র্যাঙ্ক মরগ্যান কারো চোখ রাঙানিকে ভয় করে না।

মরগ্যানের স্থির, উজ্জ্বল কালো চোখ ব্লেকের সমস্ত সত্তাকে বরফ করে দিলো। সে তাড়াতাড়ি বললো, ঠিক আছে। ঠিক আছে, তোমার কথা আমার মনে থাকবে।

থাকলেই ভালো।

 ব্লেক বললো, খবরের কাগজে গত রাতের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু লিখেছে নাকি?

সাধারণতঃ যা লেখে তাই। কাফের প্রত্যেকে এতো ভয় পেয়েছিলো যে পুলিশের কাছে আমাদের চেহারার কোনো সঠিক বর্ণনাই দিতে পারে নি। মনে হয় পুলিশ আমাদের খোঁজ পাবে না। এবার কাজের কথায় আসা যাক। তুমি এখন সোজা জিপোর ওখানে চলে যাও। ওকে কাজে সাহায্য করা গিয়ে। আমাকে একটু ডুকাসে যেতে হবে।

ঠিক আছে, যাচ্ছি। তবে মুখভাবে বোঝা গেল তার আজ কাজ করার মেজাজ নেই।

মরগ্যান খেঁকিয়ে উঠলো, নাও। চটপট করো। ফালতু দেরী করো না। আমি চললাম আর্নির সঙ্গে দেখা করতে। ওর কাছে একটা অটোমেটিক রাইফেল আছে। ও সেটা বেচবে। দেখি যদি পোষায় কিনে নেবো।

আমি তৈরী হয়ে এখুনি বেরিয়ে পড়ছি।

মরগ্যান চলে যেতেই ব্লেক একটা অশ্রাব্য খিস্তি দিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে বিছানার কাছে একটা জানলা খুলে দিতেই রোদের উষ্ণ ঝলক শুয়ে থাকা মেয়েটির মুখে পড়লো।

মেয়েটি বিরক্তিভরে বললো। ওঃ–হো…এড, জানালাটা বন্ধ করো। মেয়েটি বিছানায় বসে ব্লেকের দিকে তাকালো। মেয়েটির গায়ের রং বাদামী, মাথায় কালো চুলের গুচ্ছ। আয়ত চোখের তারা ঘন নীল। পরনে হলদে রাত্রিবাস। তবে ফিকে আচ্ছাদনের আড়ালে ওর সুঠাম তনুর ইঙ্গিত।

রাত্রিবাস ছেড়ে পোষাক পরতে পরতে ব্লেক বললো, চটপট লম্বা দাও, সোনা। এখুনি আমাকে কাজে বেরোতে হবে। নাও, পা দুটোকে একটু কাজে লাগাও।

কিন্তু এড, আমার ভীষণ ক্লান্তি লাগছে। তোমার কাজ থাকলে তুমি যাও না। আমি একটু না হয় ঘুমিয়েই নিলাম। কি, আপত্তি আছে?

পুরোপুরি। তোমাকে এখানে একা থাকতে দেওয়া সম্ভব নয়। এসো, জলদি উঠে পড়ো।

বিরক্তিসূচক শব্দ করে মেয়েটা টলতে টলতে মেঝেতে নেমে দাঁড়ালো। হাত টান টান করে আড়মোড়া ভেঙ্গে বাথরুমের দিকে এগোলো।

কিন্তু হঠাৎ এতো তাড়াহুড়ো কেন, এড? তোমাকে কে ডাকতে এসেছিলো?

 বৈদ্যুতিক ক্ষুর দিয়ে এখন ব্লেক, দাড়ি কামাচ্ছিল, উষ্ণস্বরে বললো, যত তাড়াতাড়ি পারো জামাকাপড় পরে কেটে, পড়ো, সোনা। কতবার বলবো। আমাকে এখুনি কাজে বেরোতে হবে।

মেয়েটি রাত্রিবাস ছেড়ে ঝাঁঝরির নীচে দাঁড়িয়ে কল খুলে দিলো।

মাঝে মাঝে ভাবি, সব জেনেশুনেও কেন যে বার বার তোমার কাছে আসি। সেই বহু প্রচলিত ছকে বাঁধা রাস্তায় তোমার নাটক শুরু। যন্ত্র সঙ্গীতের হালকা সুর, নরম আবছা আলো, কানের কাছে ফিসফিস করে কতো কথা…তারপর হঠাৎ জামাকাপড় পরে রাস্তা দেখো। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার কি ছিরি। অথচ এড, তুমিই আবার আমার স্বপ্নের রাজপুত্র! হৃদয়ের নায়ক।

বিরক্তভরে ব্লেক বললো, ছেনালী রাখো গ্লোরি। যা করছে জলদি করো। ফালতু সময় নষ্ট করো না।

ব্লেক দাড়ি কামিয়ে কফি তৈরী করতে রান্নাঘরে গেলো। তার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা মুখ শুকিয়ে কাঠ–যেন মুখে এক মুঠো তুলো গোঁজা। কাল রাতে অতো মদ না গিললেই পারতাম–কিন্তু না গিলেও উপায় ছিলো না। কারণ গত রাতের ব্যর্থতা তার আত্মবিশ্বাসকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ..নাঃ গ্লোরিকে কাল রাতে না ডাকলেই ভালো হতো। …

মরগ্যান এসব ব্যাপার স্যাপার দেখে খুব একটা খুশী হয় নি।

ব্লেক একটা কাপে কফি ঢাললো। অ্যাসপোর শিশি বের করে তিনটে ট্যাবলেট খেয়ে নিলো। সে অস্বস্তির সঙ্গে দেখলো, তার হাত কাঁপছে। ব্লেক কফির কাপে শেষ চুমুক দেবার সঙ্গে সঙ্গে গ্লোরি এলো।

পোশাক থেকে সাজসজ্জা–সবই ওর সম্পূর্ণ।

 গ্লোরি আবদারের সুরে বললো, উমম…কফি। আমার জন্য এক কাপ ঢালো, এড।

উহু–এখন আর সময় নেই। যাবার পথে কোনো রেস্তোরাঁ থেকে খেয়ে নিও। চলো যাওয়া যাক।

এক মিনিট এড। গ্লোরির স্বরের তীক্ষ্ণতায় ব্লেক ফিরে তাকালো, একটু আগে মরগ্যান এসেছিলো, তাই না? কি যেন সে বলছিলো কিসব বিরাট কাজের দায়িত্ব…ব্যাপার কি এড? খারাপ কিছু নয় তো?

ব্লেক দাঁত খিঁচিয়ে বললো, আমার ব্যাপারে নাক গলাতে এসো না, গ্লোরি। নিজের চরকায় তেল দাও। এ সম্পর্কে দ্বিতীয়বার কৌতূহল দেখালে ফল ভালো হবে না।

ব্লেকের হাত গ্লোরি আঁকড়ে ধরলো–এড, লক্ষ্মীটি–আমার কথা শোনো। মরগ্যান অত্যন্ত সাংঘাতিক চরিত্রের লোক। তার সম্বন্ধে নানা কথাই আমার কানে এসেছে। সারাটা জীবন সে পুলিশের ভয়ে ভয়েই কাটিয়েছে। মানুষ খুন ছাড়া এমন কাজ নেই যা মরগ্যান করে নি। তবে সে যেভাবে এগোচ্ছে তাতে খুনও হবে। এড আমার একটা কথা রাখো। তুমি মরগ্যানের সঙ্গ ছেড়ে দাও। নইলে নিজের বিপদ ডেকে আনবে

গত তিনমাস ধরে এই গ্লোরি ডসন ব্লেকের একমাত্র নৈশসঙ্গিনী। ও যে ব্লেকের অপছন্দ তা নয়। তাছাড়া গ্লোরিই প্রথম এবং সম্ভবতঃ শেষ। –যে মানুষ ব্লেকের মঙ্গল কামনা করে, ওর ভালো মন্দের চিন্তা করে নিছক ব্লেককে ভালোবাসে বলেই–অন্য কোনো কারণে নয়। কিন্তু তবুও এই গায়ে পড়া উপদেশ ব্লেকের একেবারেই অপছন্দ। সে খেঁকিয়ে উঠলো, যাক, আর লম্বা চওড়া উপদেশ দিতে হবে না। আমার ভালোমন্দ আমিই বুঝবো। নাও, চলো–।

ঠিক আছে। তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। অনুরোধ করা ছাড়া আর কি–ই বা আমি করতে পারি? কিন্তু আবার বলছি এড, মরগ্যান মোটেই ভাল লোকনয়। ওর দলে যোগ দিলে তুমি নিজের বিপদই ডেকে আনবে।

অধৈর্যভরে ব্লেক বলল, আচ্ছা বাবা, আচ্ছা–এবার থামো দেখি। দোহাই তোমার, এবারে চলো। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।

আজ রাতে, কি তাহলে তোমার সঙ্গে দেখা হবে না?

না। এই কটা দিন আমি ব্যস্ত থাকবে। কাজ মিটে গেলে তোমাকে ডাকবো। হয়তো সামনের সপ্তাহেই সব চুকে যাবে তার আগে নয়।

সংশয়, ও সন্দেহ ভরা চোখে মেয়েটি তাকালো, তুমি আর মরগ্যান মিলে কোনো বদ মতলব আঁটছে না তো? ওঃ, এড, ভগবানের দোহাই…।

ব্রেক গ্লোরির হাত চেপে ধরে টানতে টানতে ফ্ল্যাটের বাইরে নিয়ে গেলো। চাবি ঘুরিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে পকেটে চাবি রেখে বললো, তুমি একটু থামবে? বার বার এক কথা আমি পছন্দ করি না। ভেবো না, তুমি না হলে আমার চলবে না। এই বাজারে ঘাস ছড়ালে গরুর অভাব হয় না। কথাটা মনে রেখো…

ঠিক আছে, এড। তোমার ভালোর জন্যেই আমি তোমাকে সাবধান করতে চাইছিলাম। কিন্তু তুমি যদি অসন্তুষ্ট হও, তাহলে…।

ব্লেক ভেংচে উঠলোহা । আমি অসন্তুষ্টই হচ্ছি। এখন দয়া করে একটু থামবে?

গ্লোরি সদর দরজায় পৌঁছে বললো, তোমার জন্য আমি কিন্তু অপেক্ষা করে থাকবে। বেশিদিন দেরী করো না–লক্ষ্মীটি।

আচ্ছা, আচ্ছা–বলে দ্রুতপায়ে বাসস্টপের দিকে গেলো।

ব্লেকের জিনির কথা মনে হলো বাসে বসে। জিনি ও গ্লোরির মধ্যে বিশাল পার্থক্য তার মনে হলো। জিনির চেহারা আর সাহসের কথা ভেবে সে আবার অবাক হলো। ওকে পাশে নিয়ে পথচলার স্বপ্ন দেখলো। এই মুহূর্তে গ্লোরিকে তার ঘৃণা হলো।

ব্লেক মনে মনে কিটসনের অবস্থাটা কল্পনা করলো। জিনির পাশে একা বসেনববিবাহিত স্বামীর ভূমিকায় সে কিরকম অভিনয় করছে–সেটা দেখতে তার ভীষণ ইচ্ছে হলো। তার মানে অবশ্য এই নয় যে ঘুষি খাওয়া থ্যাবড়ামুখো ছোঁড়াটাকে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে। নিছক কৌতূহল মাত্র।

ব্লেক আনমনা ভাবেই আহত চোয়ালে হাত বোলালো। অনুভূত যন্ত্রণা তাকে মনে করিয়ে দিলো গতরাতে কিটসনের সঙ্গে তার মারামারির কথা। ব্লেকের চোখজোড়া প্রতিহিংসার জ্বালায় জ্বলে উঠলো। দৃষ্টি হলো ক্রুর। না, ঐ অপমানের কথা সে কোনদিনই ভুলবেনা। এর শোধ সে নেবেই।  যখন জিপোর কারখানার কাছে বাস থামলো, তখনও ব্লেক জিনির ভাবনায় মগ্ন। কারখানায় যাবার উঁচুনীচু কাঁচা রাস্তায় যেতে যেতে সে ভাবলো জিনির পাশে বসে কিটসন কি নিয়ে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলছে?

কিটসন জিনির সঙ্গে কথাবার্তা খুব কমই বলছিলো। ষাট মাইল রাস্তা এভাবে চুপচাপ পাড়ি দিতে হবে ভেবে সে হতাশ হলো। সাধারণতঃ মেয়েদের সামনে কিটসন একেবারেই চুপচাপ থাকে না। বরং প্রগলভতার চূড়ান্তই হয়ে যায়। কিন্তু জিনির পাশে বসে এই অভাবনীয় নিজের পরিবর্তনে নিজেই অবাক হলো। সম্ভবতঃ জিনির তেজস্ক্রিয় ব্যক্তিত্বের কাছে সে হীনমন্যতার শিকার হয়ে পড়েছে। তাই তার জিভ আড়ষ্ট। অথচ জিনিরমতোকরে আর কোনো মেয়ের সঙ্গ সে কোনদিন কামনা করেনি।

জিনি কিন্তু একনাগাড়ে বকবক করেই চলেছে। হঠাৎ হঠাৎ এক–একটা প্রশ্ন করে কিটসনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। বেশির ভাগ প্রশ্নই কিটসনের মুষ্টিযুদ্ধ অধ্যায় সংক্রান্ত। বিভিন্ন মুষ্টিযোদ্ধা সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত মতামত এবং তাদের সম্ভাবনাময় জীবনে হঠাৎইতি পড়ার কারণ–এইসব জানতে চেয়ে ও কিটসনকে বিব্রত করে তুললো। কিটসন ইতস্ততঃ করে বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার চোখজোড়া গভীর একাগ্রভাবে সামনের দিকে নিবদ্ধ।

একসময় জিনি আচমকা বলল, দু লাখ ডলার পেলে সেটা নিয়ে তুমি কি করবে ভাবছো?

কিটসনের মুখের দিকে উৎসুকভাবে চেয়ে ও পায়ের ওপর পা তুলে বসলো। জিনির সুঠাম উরু মুহূর্তের জন্য দেখা গেলো। ব্যাপারটা কিটসনের চোখ এড়ালো না। মন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় দিগভ্রান্ত বুইককে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে আবার আয়ত্তে আনলো।

এখনো তো টাকাটা পাই নি। সুতরাং এতো আগে স্বপ্ন দেখার কোনো মানেই হয় না।

জিনি একটু অবাক হলো, তার মানে আমাদের এই প্রাপ্তিযোগ সম্পর্কে তোমার এখনও সন্দেহ আছে?

ইতস্ততঃ করে সে রাস্তার দিকে নজর রেখে ধীর স্বরে বললো, যদি সত্যিই আমরা টাকাটা পাই, তবে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করবো। কারণ টমাস এবং ডাকসনের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, আমি ওদের ভালো করে চিনি। ওরা আমাদের সহজে রেহাই দেবে না।

সেটা পুরোপুরি আমাদের ওপর নির্ভর করছে, শান্ত স্বরে বললো জিনি। টমাস ও ডার্ককে যদি ঠিকমত সমঝে দেওয়া যায় যে আমরা নেহাত ছেলেখেলা করতে আসিনি, তবে ওরা আর বাধা দেবে বলে মনে হয় না। …তাছাড়া, ওদের জন্য এতোটুকু চিন্তিত নই। পরিকল্পনামাফিক কাজ হলে আর কোনো ভয় নেই। টাকা আমরা পাবোই–অন্ততঃ আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।

বললাম তো, সে ক্ষেত্রে ভাগ্য ছাড়া উপায় নেই–কিটসন একই কথার পুনরাবৃত্তি করলো, পরিকল্পনাটা যে খারাপ তা আমিবলছিনা। বিশেষ করে একটা ট্রাককে ক্যারাভ্যানের মধ্যে লুকিয়ে ফেলার বুদ্ধিটা তো অপূর্ব! কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে ট্রাকের তালাটা খুলে ফেলতে পারবো–। ধরে নেওয়া যাক, ট্রাকটা আমরা খুললাম এবং সব টাকা ভাগ করে নিলাম। তারপর? দুলাখ ডলার নেহাত চাট্টিখানি ব্যাপার নয়! অত টাকা ব্যাঙ্কে রাখা যাবেনা। কারণ পুলিশ সর্বক্ষণ তক্কেতক্কে থাকবে। সুতরাং ঐ এক বস্তা টাকা নিয়ে আমরা করবোটা কি?  

কেন? টাকাটা সেফ ডিপোজিট ভল্টে রেখে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়! তাতে পুলিশের ভয় নেই!

নেই যে তা বলি কেমন করে? গত বছর ব্যাঙ্ক লুঠের ব্যাপারটা তোমার মনে আছে? তারাও তোমার কথামতো লুঠের টাকাটা সেফ ডিপোজিট ভল্টে লুকিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু পুলিশ তো আর ঘাস খায় না! ওরা শহরের ভল্ট একে–একে খুলতে লাগলো; বরং পেয়েও গেল ব্যাঙ্ক লুঠের সমস্ত টাকা। কিটসনের আঙুল চেপে বসলো স্টিয়ারিং হুইলের ওপর চোখের দৃষ্টি স্থির।

যদি তাই হয়, তবে টাকাটা নিয়ে চলে যাবোন ইয়র্ক অথবা স্যানফ্রানসিসকোয়–অথবা আরও দূরে ছোট্ট কোনো শহরে। তখন পুলিশ আর খুঁজে পাবেনা। তাছাড়া পুলিশের অ্যামেরিকার প্রতিটি ভল্ট খুলে দেখা সম্ভব নয়।

পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা করবে ঐ দশ লক্ষ ডলার উদ্ধার করতে। সুতরাং…

ওঃ, তুমি দেখছি ভীষণ ভীতু। জিনির কথায় সহানুভূতির আভাস পেয়ে কিটসন অবাক হলো। অতোই যদি ভয় থাকে, তাহলে এ কাজের সমর্থনে ভোট দিলে কেন?

কিটসন এ আলোচনায় পূর্ণচ্ছেদ টানলো, যাকগে ওসব কথা বাদ দাও। ফ্র্যাঙ্ক আমার কথা  শুনলে হয়তো বলে বসতো, প্রলাপ বকছি। তাছাড়া মনে হয় এ কাজে আমরা সফল হবে। এবার তুমি বলো, তোমার টাকা নিয়ে তুমি কি করবে?

জিনি সীটের গায়ে হেলান দিয়ে বসলো। উইন্ডস্ক্রিনের গায়ে জিনির সুন্দর মুখমণ্ডলের প্রতিবিম্ব কিটসনকে আরো মুগ্ধ করলো।

ও–সে সব আমার অনেক আগেই ঠিক করা আছে। টাকা থাকলে মানুষ যা খুশি তাই করতে পারে। গত বছর আমার বাবা মারা গেছেন। যদি বাবার কিছু টাকা থাকতো, তাহলে বোধহয় তিনি আজ বেঁচে থাকতেন। বাবা মারা যাবার সময় আমি একটা সিনেমা হলে কাজ করতাম–অতি সাধারণ চাকরি। সুতরাং দামী ওষুধপত্রের সংস্থান করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। বাবা মারা যাওয়ার পর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, টাকার অভাবের জন্য এ পৃথিবীকে ছেড়ে যেতে আমি রাজী নই। বাবার মতো শুয়ে থেকে, নির্জীবের মতো হার স্বীকার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অনেক মাথা খাটিয়ে এই ট্রাক লোপাটের পরিকল্পনাটা আবিষ্কার করলাম।

কিটসন বিচলিত হলো জিনির এই অপ্রত্যাশিত আত্ম উন্মোচনে। এবং ট্রাক লোপাটের ব্যাপারে জিনির মন যে স্থির প্রতিজ্ঞ, তা জেনে স্বস্তি হলো। কিটসন বুঝলো, জিনি ক্রমশঃই তার ওপরে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

কিন্তু এই ট্রাক ও তার দশ লক্ষ ডলারের খবর তুমি পেলে কেমন করে?

জিনি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। কিটসন দেখলো ওর মুখে আগের সেই বরফ কঠিন নির্বিকার অভিব্যক্তি ফিরে এসেছে। কিটসন বললো, ভেবোনা আমি তোমার হাঁড়ির খবর জানতে চাইছি। এমনি কৌতূহল হলো তাই বললাম। যাকগে, কিছু মনে করো না–ভুল হলে মাপ চাইছি।

কিটসনের দিকে জিনি তাকালো। তারপর রেডিওর সুইচ অন করে নবগুলো নাড়াচাড়া করে আধুনিক যন্ত্র সঙ্গীতের সুর বাজালো। জিনি সীটে পা এলিয়ে বাজনার তালে তালে পা নাচাতে লাগলো।

ওর ইঙ্গিত বুঝে কিটসন নিজের ওপর বিরক্ত হলো। অ্যাকসিলেটরে চাপ দিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।

মিনিট কুড়ি পর ক্যারভান মর্ট–এর সামনে কিটসনের বুইক এসে থামলো। দোকানের নাম দি কোয়ালিটি কার অ্যান্ড ক্যারাভান সেন্টার। মার্লো থেকে মাইলখানেক দুরে দোকানটা বড় রাস্তার ওপরেই।

একটা সবুজ সাদা রঙের কাঠের ঘর কিটসন দেখলো–সম্ভবতঃ অফিস ঘর। তার পাশেই গ্যারেজ–পুরনো গাড়ি, লরি, ক্যারাভান সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড় করানো। ওদের গাড়ি দোকানের কাছে থামামাত্রই অফিস ঘর থেকে পড়িমড়ি করে এক অল্পবয়েসী যুবক দৌড়ে এলো। তাকে দেখেই বিরক্তি বেড়ে গেলে কিটসনের। যে ধরনের ছেলেদের সে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে, লোকটা দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই দলের। তার মুখশ্রী সাধারণের তুলনায় সুন্দর, গায়ের রঙ তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ, মাথায় কোঁকড়ানো কালো চুল, গভীর নীল চোখের তারা সজীব, প্রাণবন্ত। লোকটার পরনে সাদা গরম স্যুট। একটা ঘিয়ে রঙের শার্ট আর একটা রক্ত লাল টাই। ডান হাতের শক্ত কব্জিতে একটা দামী ওমেগা ঘড়ি সোনার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো।

উদগ্রীবভাবে লোকটা কিটসনের গাড়ির দিকে এগিয়ে এলো। একটা মোটা দাও মারার প্রত্যাশায় তার চোখেমুখে আশার আলো জ্বলজ্বল করছে।

সে চট করে এসে গাড়ির ওপাশের দরজার কাছে–যেখানে জিনি বসেছিল থমকে দাঁড়ালো। লোকটা দরজা খুলে ধরতেই জিনি নামলো। তার একগাল হাসিভরা প্রিয়জন সুলভ অভ্যর্থনার বহর দেখে আক্রোশে কিটসনের মুষ্টিবদ্ধ হতে নিসপিস করলো।

লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো, ক্যারাভান সেন্টারে এসেছেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, ম্যাডম। এখানে এসে ভালোই করেছেন। আপনাদের একটা ক্যারাভ্যান চাই, এই তো? আমাদের চেয়ে ভালো ক্যারাভান এ চত্বরে কোথাও পাবেননা। আসুন–দেখবেন আসুন

ইতিমধ্যে কিটসন গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে লোকটার গায়ে–পড়া স্বভাব দেখে অস্বস্তি বোধ করলো।

আমার নাম হ্যারি কার্টার। বুইকের চারপাশে একটা চক্কর দিয়ে কিটসনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো লোকটা হাত ঝাঁকালো।

আপনি ঠিকই ধরেছেন মিঃ কার্টার, আমরা একটা জুতসই ক্যারাভানের খোঁজ করছি–তাই না, অ্যালেক্স, জিনির স্বর কিশোরীর মতো খুশী খুশী শোনালো।

আকর্ণ বিস্তৃত হাসি হেসে হ্যারি কার্টার বললো, তাহলে বলতে হবে, আপনারা ঠিক উপযুক্ত জায়গাতেই এসেছেন। আপনাদের জীবনে এ এক স্মরণীয় অধ্যায়–এর গুরুত্ব অনেক..কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকুন। ক্যারাভান নিয়ে আপনাদের এতোটুকু অসুবিধেয় পড়তে হবেনা। যেটা পছন্দ হয় সেটাই বেছে নিন–সবরকমক্যারাভানই আমাদের দোকানে আছে। আপনাদের কিরকম চাই সেটা শুধু বলুন।

কিটসন গম্ভীরভাবে বললো, একটু কমদামের মধ্যে চাই।

দাম নিয়ে বিন্দুমাত্রও ভাববেন না, কমদামের ক্যারাভানও এখানে অনেক আছে। আসুন না। ঘুরে ফিরে দেখবেন। যেটা পছন্দ হয় বলুন, দামের জন্য ভাববেন না।

ওরা ক্যারাভানগুলোর দিকে এগিয়ে গেলো।

কিটসনের বেশ কিছু সময় লাগলো মনমতো ক্যারাভান পেতে। কারণ জিপোর নির্দেশমতো ক্যারাভানটা কম করে ষোলো ফুট লম্বা দরকার। তাতে অতিরিক্ত সাজসরঞ্জাম না থাকাই ভালো। বেশ কিছুটা ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যারাভানটাকে দেখে ওটা পরীক্ষা করার জন্যে থমকে দাঁড়ালো।

ক্যারাভানটা সাদা রঙের কিন্তু ছাদের রঙ আকাশ নীল। দু পাশে এবং সামনে পেছনে দুটো করে জানলা।

কিটসন জিনিকে বললো, এটায় কাজ চলতে পারে। জিনি মাথা দুলিয়ে বলল, মিঃ কার্টার, এটার মাপ কত?

কার্টার যেন অবাক হলো। কোনটা? এই সাদাটা? আমার মনে হয় এটা আপনাদের পক্ষে জুতসই হবে না…কার্টার কিটসনকে বললো, আপনার নামটা কিন্তু এখনো জানি না। মিঃ…

হ্যারিসন। মাপ কত ক্যারাভানটার?

সাড়ে ষোলো বাই ন–ফুট। সত্যি বলতে কি মিঃ হ্যারিস এই ক্যারাভানটা আসলে লিকার টিকার করার জন্য তৈরী–এবং সেই কারণেই বেশ শক্তপোক্ত। তাছাড়া ভেতরে সেরকম কোনো সুব্যবস্থাও নেই। বুঝতেই তো পারছেন। আপনার স্ত্রী সম্ভবতঃ এটা একেবারেই পছন্দ করবেন না তাই না মিসেস হ্যারিসন? –কার্টারের চোখজোড়া আবার গিয়ে থামলো জিনির সুগঠিত পায়ের ওপর। –অবশ্য এটার মতো অন্য ক্যারাভানও আছে–তাতে সবরকমই বন্দোবস্ত রয়েছে–দেখবেন আসুন, একেবারে এ ক্লাস জিনিস।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কিটসন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্যারাভানের চাকা দেখতে লাগলো, স্বয়ংক্রিয় ব্রেক…বুঝলো ক্যারাভানটার বইবার ক্ষমতা। তাছাড়া, জিপো বারবার বলে দিয়েছে স্বয়ংক্রিয় ব্রেকের কথা। নাঃ, এ জিনিসই তাদের চাই।

জিনি ঠাট্টার সুরে বললো, আমার স্বামীদেবতা হাতের কাজে ওস্তাদ। আমাদের আসল মতলবটা তাহলে আপনাকে খুলেই বলি, মিঃ কাটার। আমরা ঠিক করেছি, একটা ক্যারাভান কিনে সেটাকে নিজেদের মনমতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবো। একবার এর ভেতরটা দেখতে পারি?

ও নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। তবে এটা দেখা হয়ে গেলে আরো একটা ক্যারাভান আপনাদের কষ্ট করে দেখতে হবে। তাহলেই বুঝবেন আমি এ ক্লাস বলতে কি বোঝাতে চাইছি। এটা নিছকই একটা বাক্য নয় বুঝলেন?

কাটার ক্যারাভানটার দরজা খুলতেই জিনি ও কিটসন ভেতরে উঁকি মারলো।

কিটসন তার ধারণা সম্পর্কে নিশ্চিত হলো। ক্যারাভানের ভেতরটা দু একটা হালকা সেল র‍্যাক দিয়ে সাজানো। ওগুলোকে খুলে সাফকরে দেওয়া যায়। কিটসন এবার ক্যারাভানের ভেতরে ঢুকলোনাঃ, মেঝেটা ভীষণ মজবুত, তাছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও কিটসনের মাথার ওপরে প্রায় ইঞ্চি খানেক জায়গা রয়েছে।

হ্যারি কার্টারের অনুরোধে এরা দ্বিতীয় ক্যারাভানটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে জানাল প্রথমটাই ভালো।

কিটসন নীল সাদা ক্যারাভ্যানটির দিকে যেতে যেতে–মিঃ কার্টার, প্রথমটাই পছন্দ হয়েছে।  কতো দাম পড়বে ওটার?

কার্টার ক্যারাভানটার পাশে দাঁড়িয়ে ওটার ওপর চোখ বোলাতে শুরু করলো–এই ক্যারাভানটা বেশ মজবুত–মানে টেকসই, বুঝলেনমিঃহ্যারিসন। বহুবছর পর্যন্ত এটা আপনাদের কাজে আসবে। না, এটা নিয়ে আপনারা ঠকবেন না। এটার নতুন দাম হচ্ছে তিন হাজার আটশো ডলার। তবে এটা তো নতুননয়। তাই দামটানা হয় কিছু কমানো যাবে। কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছেন এর গায়ে একটা আঁচড় পর্যন্ত নেই। মানে, যারা নতুন কিনেছিল তারা পুরো ছমাসও ব্যবহার করে নি। আর আপনাদের মধুচন্দ্রিমার ব্যাপারে যখন পছন্দ হয়েছে–তখন আর বেশি বলি কি করে? নিন, মাত্র আড়াই হাজারেই ক্যারাভ্যানটা দিচ্ছি। একেবারে জলের দর মশাই।

জিনি বললো, উহু, অতো দাম তো আমরা দিতে পারবো না। তাহলে এটা আর আমরা নিতে পারলাম না, মিঃ কার্টার। চলো আলেক্স, অন্য কোথাও যাওয়া যাক।

আমি এমন কিছু দাম বলিনি, মিসেস হ্যারিসন। তাহলে আসুন, একটু কম দামের মধ্যে অন্য ক্যারাভ্যান দেখাই। ঐ তো, ওটা দেখছেন–ওটার দাম মাত্র পনেরোশো ডলার–অবশ্য এটার মতো তেমন মজবুত নয়। কিন্তু খুব সৌখীনভাবে সাজানো।

নির্বিকারভাবে কিটসন বললো, আঠারো শ পর্যন্ত উঠতে পারি। মিঃ কাটায়, তার বেশি দেওয়ার আমার ক্ষমতা নেই।

অনুকম্পার হাসি হেসে কার্টার বললো, আপনার শর্তে রাজি হতে পারলে খুশি হতাম, মিঃ হ্যারিসন। কিন্তু আমি নিরুপায়। বিশ্বাস করুন। আঠারো শ ডলারে একদম পোষায় না। জিনিসটা আপনার পছন্দ হয়েছেবলেই আপনাকে ফিরিয়ে দিতে খারাপ লাগছে–ঠিক আছে, নিন। পুরোপুরি তেইশ শ ডলারই দেবেন। আর কম বলবেন না।

ক্রমশঃ কিটসনের মেজাজ তিরিক্ষি হতে লাগলো। কার্টারের মোলায়েম ভদ্র কথাবার্তা, সুন্দর ব্যবহার, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ কিটসনকে ঈর্ষান্বিত করলো।

জিনি বললো, কিন্তু অত টাকা দিয়ে ক্যারাভান কেনার ক্ষমতা আমাদের নেই, মিঃ কার্টার। ওর সবুজ চোখ এক বিশেষ মাদকতা নিয়ে কার্টারের চোখে চাইলো। কিটসনের চোখে খেললে ক্রোধের বিদ্যুৎ। জিনির এই মোহিনী ভঙ্গিমায় যেন রয়েছে যৌন আবেদন, আর কার্টার সেটা ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো চোখ দিয়ে চাটছে। –ওটাকে দু হাজারই করুন না। বিশ্বাস করুন, ওর চেয়ে বেশি টাকা আমাদের সঙ্গেই নেই।

চিন্তিতভাবে কার্টার গোঁফে হাত বোলালো। অসীম কৌতূহলে জিনির দেহের প্রতিটি বাঁক জরীপ করলো। ইতস্ততঃ করে কাঁধ ঝাঁকালো। আপনার অনুরোধকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই, মিসেস হ্যারিসন। অন্য কেউ হলে এ প্রস্তাবে কখনই রাজী হতাম না। সত্যি বলতে কি, দু হাজারে ক্যারাভ্যান বেচলে আমার অন্ততপক্ষে একশো ডলার লোকসান যাবে কিন্তু টাকাই তো বড় কথা নয়। ঠিক আছে। এটাকে আপনাদের বিয়ের উপহার হিসেবে ধরে নিন। আপনাদের জন্য ওটার দাম আমি দু হাজারেই নামিয়ে দিলাম মিসেস হ্যারিসন। সম্পর্কটাই আসল। সেখানে, টাকা পয়সার কোনো দাম নেই।

রাগে কিটসনের ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেল। উত্তেজনায় তার হাত মুষ্টিবদ্ধ হলো।

জিনি কিটসনের উত্তেজিত স্বরকে বাধা দিয়ে–শুনুন মশায় ধন্যবাদ, আপনার সহযোগিতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। দু–হাজারে আমরা রাজি। জিনির মন কেড়ে নেওয়া, ইঙ্গিতের হাসি ব্যর্থ হলো না।

কার্টারের দৃষ্টি জিনির দিকে, এতে আর ধন্যবাদের কি আছে মিসেস হ্যারিসন। নেহাত আপনি বললেন তাই খাতির করলাম। আমার লোকদের বলে দিচ্ছি ওরা আপনাদের গাড়ির সঙ্গে ক্যারাভ্যানটাকে জুড়ে দেবে। আসুন, অফিসে বসে লেনদেনটা সারা যাক। কিটসনের দিকে ফিরে, আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন, মিঃ হ্যারিসন। দরাদরির ব্যাপারে আপনার স্ত্রীর জুড়ি নেই। আমার মতো ব্যবসাদারকেও তিনি রাজি করিয়ে ফেললেন। সত্যি, এমন স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যের কথা।

ওদের লেনদেন সম্পূর্ণ হলো। বিলটা দু–আঙুলে ধরে সে সপ্রশংস দৃষ্টিতে জিনির দিকে তাকালো। মধুচন্দ্রিমা কাটাতে কোথায় যাচ্ছেন, মিসেস হ্যারিসন? প্যারিসে?

উঁহু, আমার স্বামী মাছ ধরতে খুব ভালবাসেন। তাই ভাবছি কোন পাহাড়ী এলাকাতেই যাবো। তারপর কি হয় পরে দেখা যাবে।

 কার্টারের লোলুপ দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে কিটসন হাত বাড়িয়ে বিলটা যেন ছিনিয়ে নিলো। অথচ জিনি যেন নির্বিকার।

কিটসন জিনিকে বললো, চলো, এবার ওঠা যাক। ওদিকে আবার একগাদা কাজ পড়ে রয়েছে।

কৃপার হাসি হেসে উঠে দাঁড়ালো কার্টার। আপনাদের শুভ মধুচন্দ্রিমা কামনা করি। পরে যদি কোনদিন এই ক্যারাভ্যানটা পালটে নতুন কিছু নিতে চান, লজ্জা করবেন না–সোজা আমার কাছে, চলে আসবেন। বলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় নিয়ে জিনির সঙ্গে হাত ঝকালো কার্টার।

বিরক্ত হয়ে কিটসন পকেটে হাত ভরে রাখলো। কার্টারের সঙ্গে হাত মেলাতে তার গা রি রি করছিলো। দরজার দিকে সে এগোলো।

ততক্ষণে বুইকের সঙ্গে ক্যারাভ্যানটা লাগানো হয়ে গেছে। কার্টার জিনির সঙ্গে কথা বলতে বলতে গাড়ির দিকে এগোলো–পেছনে কিটসন।

জিনিকে গাড়িতে তুলে দেবার ভঙ্গী দেখে কার্টারের ওপর কিটসনের রাগ যেন দপকরে জ্বলে উঠলো। কার্টার তার পিঠে এক সশব্দ চাপড় মেরে আসন্ন মধুচন্দ্রিমার শুভেচ্ছা জানালো।

গাড়ি ছুটে চলতেই জিনি বললো, যাক। জিনিসটা বেশ সস্তায় পাওয়া গেছে–মরগ্যান খুশী হবে।

চাপা স্বরে কিটসন বলল, ওই হতভাগাটাকে কষে ধোলাই দেওয়া উচিত ছিলো। ব্যাটা যেভাবে তোমার দিকে তাকাচ্ছিলো…

জিনি সবুজ চোখে ঘৃণা ও বিরক্তি নিয়ে কিটসনের দিকে তাকালো।

তার মানে?

না, ঐ কার্টারের কথা বলছি। ব্যাটা যেরকম জুলজুল করে তোমাকে দেখছিলো। ইচ্ছে করছিলো ওর নাকে একখানা বসিয়ে দিই।

জিনির স্বর বরফ শীতল–কে আমার দিকে কিভাবে তাকালো, তাতে তোমার কি? আমি তোমার বিয়ে করা বউ নই, তবে মিছিমিছি উত্তেজিত হচ্ছো কেন?

কেউ যেন কিটসনের মুখে সজোরে চড় মারলো। অপমানে তার মুখ রক্তিম। শক্ত মুঠোয়। স্টিয়ারিং চেপে ধরে সে গাড়ি ছোটালো।

জিপোর কারখানায় পৌঁছনো পর্যন্ত একবারও মুখ খুলল না।

 জিপো, ব্লেক ও কিটসন সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আসল কাজের জন্য ক্যারাভ্যানটাকে তৈরী করে ফেললো।

ব্লেক ঐ এগারো দিন ধরে জিপোর কাছ থেকে নড়েনি। এমন কি জিপোর ঐ নোংরা আস্তানাতেই সে রাত কাটিয়েছে। ব্লেকের এতোটা কৰ্মাত্মা প্রাণ হওয়ার কারণ সে জানে। মরগ্যান তার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাই প্রাণপণ পরিশ্রম করে সে মরগ্যানকে দেখাতে চাইছে। তার ঐ ব্যর্থতা আকস্মিক ও সাময়িক, সেটা মরগ্যানকে বুঝিয়ে দিতে সে বদ্ধ পরিকর।

 জিপোর পাশে শুয়ে রাত কাটানো যে কি দুঃসহ ব্যাপার সেটা ব্লেক বুঝতে পেরেছে। আসলে জিপোর মতো নোংরা এবং কষ্টসহ্য করার ক্ষমতা তার একেবারেই নেই।

প্রতিদিন সকালে ঘড়ি ধরে আটটার সময় কিটসন কারখানায় আসে। আর রাত বারোটায় ফেরে। ওরা তিনজনে সারাদিন ধরে ক্যারাভ্যানটার পেছনে লেগে থাকে যাতে ওটা ট্রাকটাকে বইতে পারে।

এই ক্যারাভ্যান নিয়ে কাজ করার সময়েই ব্লেক ও কিটসন বুঝতে পারলো জিপোর কর্মদক্ষতা। ওর বুদ্ধি ও উদ্ভাবনা ক্ষমতার সাহায্য না পেলে ওরা এগোতে পারতো না।

জিপোকে ব্লেক বিশেষ পাত্তা দিতো না। কিন্তু এখন বুঝলো যন্ত্র সংক্রান্ত ব্যাপারে জিপোর কাছে তারা নিতান্তই এক–একটি গর্দভ। জিপোর সাহায্য ছাড়া এই ট্রাক লুঠের কথা ভাবাই যায় না। ব্লেকের সেই সঙ্গে ঈর্ষা এবং বিরক্তি হলো।

 কিন্তু কিটসন ভীষণ খুশী এই সরল সাদাসিধে ইটালিয়ানের কাজে। সে মনে মনে জিপোকে শ্রদ্ধা করতে লাগলো। তার মনে হলো, জীবনে এই প্রথম একটা কাজের কাজ শিখছে। তাছাড়া জিপোর একাগ্রতা ও ধৈর্য তাকে মুগ্ধ করলো।

ক্যারাভ্যানের কাজ শেষ হলো মঙ্গলবার রাতে। এবং সেই রাতেই জিপোর কারখানায় মরগ্যান এক আলোচনা চক্রের আহ্বান জানালো।

জিনি গত এগারো দিন ধরে একেবারে বেপাত্তা। ও মরগ্যানের কাছে একটা টেলিফোন নম্বর দিয়ে বলেছিলো, যদি পরিকল্পনা কোথাও কোনো পরিবর্তন হয় তবে যেন ফোন করে জানায়। কিন্তু ও কোথায় থাকে, কি করে, সে সম্বন্ধে কারোর জানা নেই–এমন কি মরগ্যানেরও না।

কাজে ব্যস্ত থাকলেও কিটসন সর্বদাই জিনির কথা ভেবেছে। নিজের অজান্তেই সে যে জিনিকে ভালবেসেছে, সেটা কিটসন আর অস্বীকার করতে চাইলো না। অবশ্য এই ভালবাসা নিতান্তই হাস্যকর ও অর্থহীন। যেমন সে জানে, ওয়েলিং কোম্পানীর ট্রাক লুঠের পরিকল্পনা তাদের টেনে নিয়ে যাবে অসাফল্য ও একরাশ বিপর্যয়ের মুখে।

কিন্তু জিনির প্রতি তার আকর্ষণ এতই উদ্দাম যে তাকে রোধ করা কিটসনের অসাধ্য। অসংখ্য বীজাণুর তো সেই অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রতিটি শিরা উপশিরায়। মিশে গেছে রক্তের সঙ্গে।

মরগ্যান ক্যারাভ্যান নিয়ে এই কদিন মাথা ঘামায় নি।

কখনো মরগ্যানের চিন্তা ধারা খাপছাড়াভাবে এগোয় না। সে জানে, ট্রাকটাকে দখলে আনার পর পালাবার ব্যাপারটাই হবে প্রধান।

অর্থাৎ পুলিশ খবর পাওয়ার আগেই অকুস্থল থেকে ক্যারাভ্যানের দূরত্ব যততই বাড়ানো যায় ততোই নিশ্চিন্ত। সুতরাং অনিবার্যভাবেই সারা শহরের ভৌগোলিক বিবরণ নিয়ে তাকে প্রাণপণ মাথা ঘামাতে হচ্ছে।

মরগ্যান রাত প্রায় আটটার সময় জিপোর কারখানায় এলো। এ কাজের সফলতা সম্পর্কে সে বর্তমানে নিশ্চিত। শুধু দু–একটা ছোটখাটো ব্যাপারে একটু চিন্তা। আর যদি দুর্ঘটনা ঘটেই যায়। তবে তাকে রোধ করার ক্ষমতা মরগ্যান কেন পৃথিবীর কারোরই নেই।

এই প্রথম বর্ষার শুরু। বৃষ্টির একঘেয়েমি আর সেইসঙ্গে নাকে ভেসে আসছে ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ। বাঁধানো রাস্তা থেকে যেন অনুভূত হচ্ছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস–মরগ্যানের এই ভিজে আবহাওয়া ভালো লাগলো।

অদূরে জিপোর কারখানার সমস্ত জানলা দরজা সযত্নে বন্ধ। ভেতরের আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে না। পুরো এলাকাটা যেন জনশূন্য এক পরিত্যক্ত স্থান।

মরগ্যান বুইকের দরজা খুলে বাইরে পা রাখলো। হেডলাইট নেভাতে যাবে, পায়ের শব্দ কানে এলো। কেউ যেন তার দিকে দৌড়ে আসছে। মরগ্যান ৩৮ এর বাঁট আঁকড়ে ধরে অনুসন্ধানী চোখে তাকালো।

মরগ্যান এবার জিনি গর্ডনকে দেখতে পেলো। ওর পরনে একটা নীল বর্ষাতি। মাথায় নীল টুপি।

মরগ্যান বললো, বহুদিন পর বৃষ্টি হলো। তোমার ঠিকানা জানা থাকলে আসার পথে তোমাকে তুলে নিতাম।

জিনি বললো, তাতে কি হয়েছে?

মরগ্যান কাছে গিয়ে ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তুমি থাকো কোথায়, জিনি?

জিনি থমকে দাঁড়িয়ে মরগ্যানের চোখে চোখ রেখে–সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।

মেয়েটার হাত আঁকড়ে ধরে মরগ্যান সামনের দিকে ওকে টেনে আমার সঙ্গে কথা বলতে সমঝে বলবে, খুকী! তোমার ব্যবহার চালচলন প্রথম থেকেই আমাদের একটু ধোঁয়া ধোঁয়া ঠেকছে। আমি এখনও জানি না, তুমি কে, তোমার আসল পরিচয় কি? কোথায় থাকো, এই ট্রাক লুঠ করার দুর্বুদ্ধি কি করে তোমার মাথায় এলো–মানে তুমি এক রহস্যময়ী। তবে তোমার উদ্দেশ্য আমার অজানা নয়। তুমি ভাবছো, যদি এই ট্রাক লুঠের ব্যাপারটা আমরা কেঁচিয়ে ফেলি তাহলে তুমি ভেস্তাল–চাল পাল্টে, টুক করে হাপিশ হয়ে যাবে। জিনি গর্ডন নামে যে কেউ ছিলো, সেটা পুলিশ ধরতেই পারবে না, প্রমাণ তো দূরের কথা।

জিনি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো–সেটা করা কি খুব অন্যায় হবে? মরগ্যানের পাশ কাটিয়ে ও এগিয়ে গেলো কারখানার দরজার দিকে। বারকয়েক টোকা মারলো।

মরগ্যান নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে। তার অভিব্যক্তিহীন কালো চোখ সংশয়ে কুটিল। কিটসন কারখানার দরজা খুলতেই সে জিনির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ওরা একইসঙ্গে কারখানায় ঢুকলো।

মরগ্যান বর্ষাতি থেকে বৃষ্টির জল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, এই যে আলেক্স, এদিকের খবর কি?

কিটসন বললো, এ দিকের কাজ সব শেষ। জিনি ওর ভিজে বর্ষাতি টেবিলের ওপর রাখলো। ওর পরনে একটা ধূসর কোট স্কার্ট–আর সবুজ ব্লাউজ। এই পোষাকে ওকে দেখে কিটসনের বুকে যেন ধাক্কা লাগলো। আশান্বিত উৎসুক চোখে সে জিনির দিকে চেয়ে রইলো।

জিনি একবার কিটসনকে দেখলো কিন্তু তেমন আমল দিলো না। বর্ষাতির পকেট থেকে ও একটা বাদামী কাগজে মোড়া প্যাকেট বের করলো। সেটা হাতে নিয়ে ক্যারাভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জিপোর কাছে গিয়ে বললো, এই যে পর্দাগুলো নিয়ে এসেছি।

মরগ্যান বললো, কি খবর, জিপো? মরগ্যানের প্রত্যুত্তরে স্বভাবসিদ্ধ একগাল হেসে জিপো তাকে অভ্যর্থনা জানালো। তার মুখমণ্ডলে আত্মপ্রসাদের ছাপ স্পষ্ট।

জিপো পর্দার প্যাকেটটা খুলতে খুলতে বললো, কাজ সব শেষ এবং কাজ দেখলে তুমি খুশীই হবে, ফ্র্যাঙ্ক। দাঁড়াও, পর্দাগুলো আগে লাগিয়ে দিই। তারপর দেখোশালার ক্যারাভ্যানের চেহারা–একেবারে যন্তর।

ব্লেক একটা ন্যাকড়ায় হাত মুছতে মুছতে ছায়ার আওতা থেকে বেরিয়ে জিনিকে দেখেই তার দৃষ্টি ওর শরীরে বাঁধা পড়লো–কিটসনের অবস্থাও তথৈবচ।

এগারো দিন বলতে গেলে ব্লেক কোনো মেয়ের মুখই দেখেনি। তাই আজ জিনিকে সামনে পেয়ে ওর মনের ইচ্ছেটা অদম্য হলো। কিটসনকে জিনির দিকে মোহগ্রস্তের মতো তাকিয়ে থাকতে। দেখে ব্লেক ভীষণ মজা পেলো। থ্যাবড়া মুখো ছোঁড়াটা ভাবছে কি? ও কি সত্যি সত্যিই জিনিকে কজা করতে পারবে? ইং, বামন হয়ে চাঁদ ধরার শখ।

ব্লেক জিনির সামনে গিয়ে, কি ব্যাপার। কোথায় ছিলে অ্যাদ্দিন? একেবারে এগোরো দিন বেপাত্তা। তা, এই লুকোচুরির কারণটা কি?

উত্তরে জিনির সহজ মিষ্টি হাসি ব্লেককে খুশী করলো।

হালকা স্বরে জিনি বললো, ছিলাম কাছাকাছিই, তবে মোটেই লুকোচুরি খেলছিলাম না।

ব্লেক সিগারেট কে এগিয়ে দিয়ে বললো, তাহলে তো মাঝে মাঝে এলেই পারতে? আমরা কাজে নতুন করে উৎসাহ পেতাম।

ব্লেক লাইটার জ্বালিয়ে জিনির সিগারেট ধরিয়ে দিলো।

আসতে আমার আপত্তি ছিলো না, তবে ঐ যে উৎসাহ–টুৎসাহ কি সব বললে, ওতে আমার একটু অনিচ্ছা আছে।

কিটসন চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো আর অস্বস্তি অনুভব করছিলো, ওদের সহজ, ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তায় তার বিরক্তি লাগলো। আর ব্লেকের কথায় জিনিকে খুশী হতে দেখে সে আরও দুঃখ পেলো।

তাহলেও অন্ততঃ একবার এসে দেখা করতে পারতে। আমি এখানে একা একা চুপচাপ দিনের পর দিন কাজ করে চলেছি…ওঃ। ভেবে দেখো দশ দশটা রাত জিপোর মতো জলহস্তীর সঙ্গে কাটাতে হয়েছে..বাপরে বাপ।

সশব্দে হেসে জিনি–ভালোই হয়েছে। অভিজ্ঞতার একটু আধটু পরিবর্তন দরকার। বলেই জিনি ক্যারাভ্যানের দিকে গেলো। মরগ্যান তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ক্যারাভ্যানটাকে দেখছে।

জিপো পর্দাগুলো লাগিয়ে গলদঘর্ম অবস্থায় বেরিয়ে, এসো, ফ্র্যাঙ্ক–ভেতরটা দেখবে এসো।

 মরগ্যান একইভাবে ক্যারাভ্যানের দিকে চেয়ে, দরজাটার কি করেছে জিপো?

জিপো হেসে কিটসনকে চেঁচিয়ে ডাকলো, আলেক্স, এদিকে এসো একবার ফ্র্যাঙ্ককে কলকজা নেড়ে দরজার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দাও।

কিটসন ক্যারাভ্যানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মরগ্যান দরজাটা বার দুয়েক নেড়ে চেড়ে দেখলো তার কাছে ওটা বেশ মজবুত বলেই মনে হলো।

সাফল্যের উত্তেজনায় জিপোর স্বর আগ্রহে ফেটে পড়ছে–কি হে। কিরকম বুঝছো?

দেখে তো মন্দ লাগছে না।

আসল কাজটা এখুনি দেখতে পাবে। আলেক্স, যন্তর চালু করো।

কিটসন একটা হাতলে চাপ দিতেই ক্যারাভ্যানের পেছনটা একটা বাক্সের ঢাকনার মতো উঠে গেলো। একই সঙ্গে মেঝের কিছু অংশ পাটাতনের মতো বেরিয়ে এলো। সেটা মাটিতে ঠেকতেই, ক্যারাভ্যান থেকে কারখানার মেঝে পর্যন্ত তৈরী হলো একটা ঢালু মজবুত রাস্তা।

জিপো হাত ঘষতে ঘষতে বললো, দেখেছো এবার আসল কায়দাটা? তুমি যেমনটি বলেছিলে ঠিক তেমনটি হয়েছে। পেছনের ঢাকনা আর ক্যারাভ্যানের মেঝে দুটোকে একসঙ্গে কাজ করাতে গিয়ে কি কম অসুবিধে ভোগ করতে হয়েছে?

মরগ্যান ঘাড় নেড়ে সমর্থন জানালো। নাঃ, তোমার সামর্থ্য আছে–সত্যিই একটা যন্তর তৈরী করেছে। তবে এই কলকজার ব্যাপারটা আরো কয়েকবার চালাও, দেখি?

কিটসনকে কম করেও বার দশেক হাতল টিপতে হলো। মরগ্যান অবশেষে ক্ষান্ত দিলো। –হুঁ, ভালোই হয়েছে কায়দাটা। সে ঢালু পাটাতন বেয়ে ক্যারাভ্যানের ভেতরে ঢুকলো।

জিপো চটপট মরগ্যানকে অনুসরণ করলো। পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে ক্যারাভ্যানের যে সব পরিবর্তন সে করেছে সেগুলো দেখালো, যেন পাড়া প্রতিবেশীকে ডেকে এনে সে নিজের বাড়ি দেখাচ্ছে।

হাইড্রোজেন আর অ্যাসিটিলিনের সিলিন্ডাউগুলো রাখবার জন্য ওপর দিকে এই কাঠের বাক্সগুলো লাগিয়েছি। যন্ত্রপাতির জন্য ঐ কাবার্ডটা। আর মালপত্র রাখবার জন্য দুধারে কাঠের টানা তাক রয়েছে। মেঝেটাকে যথাসম্ভব মজবুত করেছি। যাতে চট করে ভেঙে না যায়।

মরগ্যান বিশেষ করে নজর দিলো ক্যারাভ্যানের মেঝের দিকে। তারপর ক্যারাভ্যান থেকে নেমে, চিত হয়ে শুয়ে ওটার তলায় মরগ্যান ঢুকলো। টর্চলাইট জ্বেলে পরীক্ষা করতে লাগলো। ক্যারাভ্যানের মেঝের তলায় আড়াআড়িভাবে বন্দুদিয়ে আটকানো ইস্পাতের চওড়া পাতগুলো তার চোখ এড়ালো না।

একসময় মরগ্যান বেরিয়ে এলো ক্যারাভ্যানের নীচ থেকে। সে হাত দুটো ঝেড়ে জিপোর দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট স্বরে বললো। সাবাস জিপো! আমার কথার এতটুকু নড়চড় হয়নি দেখছি। কিন্তু ট্রাকটা ক্যারাভ্যানে ঢোকাবার পর বুইকটা কি ঠিকমতো টানতে পারবে?

কেন পারবে না। আমি বলছি না যে ওজন খুব কম হবে। তবে, যদি আমাদের পাহাড়ী রাস্তায় না উঠতে হয়, তাহলে ঐ ট্রাকসমেত ক্যারাভ্যানটাকে তোমার বুইক অতি সহজেই টেনে নিয়ে যাবে।

হু–পাহাড়ের দিকে না এগোলে আর চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে…সমস্ত কিছুই নির্ভর করছে তোমার ওপর জিপো–কত তাড়াতাড়ি তুমি তালা খুলতে পারো তার ওপর। যদি তোমার সময় খুব বেশি লাগে তাহলে হয়তো বাধ্য হয়েই পাহাড়ী এলাকায় ছুটতে হবে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু তা আমি চাইনা। কারণ পাহাড়ী এলাকার রাস্তাগুলো একেই বিপজ্জনক, তার ওপর অসম্ভব খাড়া। আমার মনে হয়, বুইকটা অতো ওজন পেছনে নিয়ে ঐ খাড়া পাহাড়ী রাস্তায় উঠতে পারবে না।

জিপো অস্বস্তিভরে বললো, কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক, তুমি বলেছিলে ট্রাকের তালা খোলার জন্য আমি অফুরন্ত সময় পাবো? না কি ট্রাকের তালা ফুসমন্তরে পাঁচ মিনিটে খুলে যাবে বলে মনে করছে?

মরগ্যান জিপোকে আশ্বাস দেবার চেষ্টা করলো। জিনি, কিটসন, ব্লেক চমকে জিপোর দিকে ফিরে তাকালো। ঠিক আছে, ঠিক আছে–এতে উত্তেজিত হচ্ছে কেন? তোমাকে আমি বলছি না যে ট্রাকটা পাঁচ মিনিটে খুলতে হবে। হয়তো দু–তিন সপ্তাহ সময় পাবে–তবে তারপরে আমাদের পাহাড়ে গিয়ে হয়তো লুকোতে হতে পারে।

কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক, তুমি বলেছিলে আমাকে একমাস সময় দেওয়া হবে তালা খোলার জন্য, আর এখন তুমি দুতিন হপ্তার কথা বলছো? ওয়েলিং কোম্পানির ট্রাকটা আমি দেখেছি। ওর তালা খোলা, নেহাত ছেলেখেলার ব্যাপার নয়। তাড়াহুড়ো করে ঐ তালা খোলা অসম্ভব।

মরগ্যান ভাবলো ট্রাক উধাও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক-শ লোক যে তাদের খোঁজে বেরিয়ে পড়বে। তার ওপর রয়েছে মিলিটারী হেলিকপ্টার–প্রতিটি রাস্তা ওরা তন্নতন্ন করে খুঁজবে। দ্রুতগামী পুলিশের দল মোটর বাইকে চড়ে প্রত্যেকটি গাড়ি পরীক্ষা করে দেখবে। যদি সত্যিই . তাদের দু লক্ষ ডলার করে পেতে হয়, তবে জিপোকে একটু তাড়াহুড়ো করতেই হবে। মরগ্যান জানে, আগে থাকতে জিপোকে এসব কথা জানালে ও ভয় পেয়ে যাবে। হয়তো একেবারে বেঁকে বসবে। তার চেয়ে বরং ট্রাকটা আগে ক্যারাভ্যানে চড়ুক তখন জিপোকে তাড়াহুড়ো করার জন্যে চাপ দেওয়া যাবে। তখন আর রাজি না হয়ে পারবে না।

মরগ্যান জিপোকে সমর্থন জানিয়ে বলল, আমারও তাই মনে হয়–তাড়াহুড়ো করে ঐ তালা খোলা যাবে না। দেখা যাক, যদি ভাগ্য সহায় থাকে, তবে হয়তো একমাস সময় পেলেও পেতে পার। কে বলতে পারে, হয়তো প্রথম চেষ্টাতেই তুমি ট্রাকের তালা খুলতে পারবে।

জিপো গম্ভীরভাবে বললো, ওদের ট্রাকটা খুব মজবুত। ওটা খুলতে গেলে কম সময়ে হবে না।

একটা সিগারেট ধরালো মরগ্যান, তাহলে আসল কাজের জন্য আমরা প্রস্তুত?

তার মুখোমুখি দাঁড়ানো তিনজনের চোয়াল কঠিন হলো–মুখে একটা বিচলিত ভাব।

জিনি ক্যারাভ্যানের গায়ে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলো। ও সতর্ক হয়ে বললো, আজ মঙ্গলবার। সুতরাং চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য আমরা তিনটে দিন হাতে পাচ্ছি.. মানে আসলে কাজটার জন্যে আমরা শুক্রবারটাই বেছে নিচ্ছি। কারো কোনো আপত্তি আছে?

কুঁকড়ে যেন কিটসনের দম বন্ধ হয়ে এলো। গত এগারোদিন ধরে এতো ব্যস্ত ছিল যে আসল কাজের কথা তার মনেই ছিলোনা। দিব্যি মনের আনন্দে প্রাণ ঢেলে পরিশ্রম করেছে–একমুহূর্তের জন্যেও তার মনে হয়নি, এ সবই আসল কাজের প্রস্তুতি।

কিটসন যেন আকাশ থেকে আছড়ে পড়লো পার্থিব জগতে। আতঙ্কে তার হাত পা পলকের জন্য স্থবির হয়ে পড়লো।

 ব্লেক অনুভব করলো তার শিরদাঁড়ায় কোনো সরীসৃপের শীতল উপস্থিতি। কিন্তু ভয়ের লেশমাত্র ছিলো না। কারণ সে জানে, কপালের জোর থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই সে মস্ত বড়লোক হয়ে উঠবে। দু লক্ষ ডলার থাকবে তার হাতের মুঠোয়। ব্লেকের উত্তেজনায় হৃৎস্পন্দন দ্রুত হলো।

জিপোর অস্বস্তি সম্পূর্ণ অন্য কারণে। ট্রাক খোলার সময় সম্পর্কিত ঐ ভাসা ভাসা ধারণাটাই তার মনের জোরকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ট্রাক লুঠ করার ব্যাপারে সে জড়িত থাকছে না। অতএব সেদিক দিয়ে নিশ্চিন্তি। কিন্তু মরগ্যান তার হাত যশ সম্পর্কে একটা বিরাট ভ্রান্ত ধারণা করবে। তা সে চায় না। বলা যায় না, হয়তো ঐ ট্রাকের তালা জিপের পক্ষে খোলাই সম্ভব হবে না। সুতরাং আগে থাকতে ভুল ধারণা করে ফ্র্যাঙ্ক তখন বিপদে পড়বে।

ব্লেক জোরালো স্বরে বললো, ঠিক আছে, শুক্রবারই ঝঞ্ঝাট মিটে যাক।

 জিনি বললো, আমি রাজি।

কিটসন আর জিপোর দিকে মরগ্যান তাকালো।

দুজনেই ইতস্ততঃ করছে। কিন্তু কিটসন যেই বুঝলো জিনি তাকে লক্ষ্য করছে, অমনি ভাঙা গলায় বললো, শুক্রবারই হোক, ক্ষতি কি?

তখন জিপোও বললো, আমার কোনো আপত্তি নেই।