এগিয়ে এলো পাহারাদারদের একজন গাড়ি থেকে নামতেই, দাঁড়িয়ে পড়লো অন্যেরা, চোখ রেখে আমার দিকে।
ওখানে রাখতে চাই একটা স্যুটকেস। কি করতে হবে?
স্যার, ওটা কি সঙ্গেই আছে?
হ্যাঁ, এই যে মাটিতে নামালাম স্যুটকেস বের করে। হাতের আন্দোলনে পাহারাদারকে থামিয়ে দিলাম ওটা নেবার জন্য হাত বাড়াতে। আমি ঠিক ততোটা দুর্বলনই আমাকে দেখে যতটা মনে হচ্ছে বাতলাও কোথায় যেতে হবে।
আসুন আমার সঙ্গে। ওর পেছনে ভেতরে ঢুকলাম। চওড়া ইস্পাত মোড়া রেলিং চারদিকে। সশস্ত্র পাহারা চলেছে বাইরে লবিতেও। ঘাড়ে একটা করে অটোমেটিক রাইফেল। আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলো একটা ফ্যাকাশে মুখের সামনে পাহারার লোকটা। আভিজাত্য আছে লোকটার চেহারায়, চালিয়ে দেওয়া যায় কোন বিদেশী রাজদূত বলে। আমাকে অভিবাদন করলো উঠে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে আমি সামনে আসতেই মিঃইভশ্যাম সব ব্যবস্থা করে দেবেন ইনি আপনার। নিজের জায়গায় ফিরে গেলো পাহারাদার একটা সেলামঠুকে। আঙুল দেখিয়ে দিলাম স্যুটকেসটার দিকে।
রাখতে চাই এটা। রাজপুত্র আর একবার ঝুঁকে জানালো সে কৃতজ্ঞবোধ করবে আমার সেবা করতে পারলে। নেবেন কি স্ট্রংরুম ভাড়া? দিলাম ঘাড় এলিয়ে। আমার সঙ্গে আসুন। লিট থামলো ছ তলায়।
একটা ইস্পাত মোড়া দরজার সামনে দাঁড়ালাম বারান্দা দিয়ে হেঁটে গিয়ে। পাহারা এখানেও। পাহারার লোক দরজা খুলে দিলো সেলাম করে।
চাবিটা দাও ছেচল্লিশ নম্বরের। ইভশ্যাম যুবরাজোচিত গলায় নির্দেশ জারি করলো। চাবি বাড়িয়ে দিলো পাহারাদার। খুলে গেলো দরজা ঢুকলাম একটা ছোট ঘরে। সর্বস্তরে ইস্পাত এখানেও। একটা টেবিল দুটো আরাম কেদারা। ধূসর কার্পেট মোড়া মেঝেতে। একটা দেয়াল সিন্দুক আমাদের মুখোমুখি। মশাই এখানে তোরাত্রিবাসও করা যায়, বললাম হালকা গলায়। কাগজ পত্র দেখেন এখানে বসেই আমাদের কিছু পৃষ্ঠপোষক। ব্যবসা করলে আমরা চেষ্টা করি যতটা সম্ভব সুযোগ সুবিধে দেবার–ইভশ্যাম ঘুরলো সিন্দুকের দিকে, মনে রাখতে পারবেন কি?
কথাটা দাঁড়ায় সংযোগের অক্ষরগুলো মিলে মিতব্যয় পারবো বললাম। আপনাকে সিন্দুক খুলতে হলে। জানি, দুএকবার করেছি আগেও এ ধরনের ব্যাপার। টিপলাম বোতাম। থেমে প্রতিটি শব্দের মাঝখানে।
ফাঁক হলো দরজাটা কথার বানান করা শেষ হতেই। চাবি পড়ে আপনা আপনি সংযোগের কাজ হয়ে যায় দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। মনে করিয়ে দিলো ইভশ্যাম। ব্যবস্থা ভালোই তো মনে হচ্ছে। পাহারাদারের কাছে থাকে ভল্টের চাবি।
আমরা কাউকে চাবি বাইরে নিতে দিই না। জানিয়ে দিতে পারেন কোনো বিশেষ নির্দেশ থাকলে। পরে আপনার হয়ে অন্য কেউ আসতে পারেন, নাকি নিজেই আপনি? সিন্দুক ছুঁতে দেবেন নাকাউকে আমি সঙ্গে না থাকলে। বললাম একটু থেমে। আমাকে চিনবে তোআপনার পাহারাদার? হাসলো যুবরাজ। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আপনার ছবি উঠে গেছে সিন্দুক খোলার সঙ্গে সঙ্গে। ওটা রাখা হবে পাহারার ঘরে। মিলিয়ে চাবি দিয়ে দেবে আপনি এলে। হাসলো ইভশ্যাম, স্যার আসুন, সইটই করার আছে নীচে আরো কিছু। ভাবলাম একমুহূর্ত আমি একটা তালিকা রাখতে চাই স্যুটকেসের জিনিসপত্রের। এগোন আপনি, আমি আসছি মিনিট কয়েকের মধ্যেই। নিশ্চয়ই, জানেন কোথায় আমি বসিচলে আসুন।
লিফটে পৌঁছে দেবে আপনাকে পাহারার লোক। পকেটে ফেলে দিলাম একশো ডলারের দশখানা নোট বের করে আমি স্যুটকেস খুলে ইভশ্যাম বেরোতেই।
স্যুটকেসে রেখে দিলাম ২২ বোরের পিস্তলটা। দরকার হচ্ছেনা দুটো আগ্নেয়াস্ত্রের। লিটের দিকে এগোলাম দরজায় চাবি দিয়ে। আমি গাড়ি চালিয়ে দিলাম ফ্র্যাঙ্কলিন বুলেভার্ডে আমার ফ্ল্যাটের দিকে মিনিট বিশেক পরে।
অনেকদিন পর গুনগুনিয়ে গান ধরলাম। স্বস্তি পেলাম টাকাটা রইলো নিরাপদ জায়গায়। টাকায় হাত পড়বে না রিককার।
পেপি আর বেনোর নোংরা হাত। গাড়িটা চোখে পড়লো বুলেভার্ডের ভেতর মাইল খানেক চালাবার পর। একটা পেট্রোল পাম্পের সামনে গাড়িটাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে। এগোতেই বললাম পাম্পের ছেলেটাকে। গাড়িটা রাখতে চাই কিছুক্ষণের জন্যে।
স্যার আপনার যতক্ষণ খুশি।
ও জনি, ফিরে এসেছো তুমি। ঘটলো দ্রুত আকস্মিকতায় পরের ঘটনাগুলো ভয়ের চমক খেলে গেলো জিনির চোখে। খুলে গেলো মুখ…ওর গলা থেকে আর্তনাদ উঠলো।
পড়ে যাবার মুহূর্ত ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম মর্যাদা হয়ে…কিন্তু এখানে নেই তো জিনি…পড়ে, চললাম..নীচে…আরো নীচে…বর্তমান থেকে অতীতে…কানে বেজেছিলো আর্তনাদ একটি মেয়ের কিন্তু জিনিরনয় তা। চেষ্টা করলাম হাত তুলতে, পারলামনা–ভারী ঠেকছে লোহার মত। নেই কিছুই। চালালাম হাত শূন্যে। চেষ্টা করলাম উঠে বসলাম। যন্ত্রণা বড়…মিলিয়ে গেলো আর্তনাদ..কানে এবার শুধু নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ..মৃদু…গতি তার আর্ত মৃদু…এবারের স্পন্দনই বুঝি শেষ স্পন্দন প্রতিবারই মনে হচ্ছে।
জনি আমি চিনি এগুলো। ডেলার কণ্ঠ সমৃদ্ধ অতীতের স্মৃতিভারে। স্মৃতির রোমন্থনে ডুব দিলে মনটা আমার..ভেসে উঠলো তার দৃশ্য যে মারটা দিয়েছিলো আমাকে মিয়ামির ছোকরাটা–ডেলার তন্বী শরীরটা সেই সঙ্গে। ওঠো…লড়ে যাও উঠে।
আস্তে আস্তে চোখ খুললাম কোনো রকমে…চারিদিক আঁধারে ছেয়ে রয়েছে…কিন্তু এত আলো স্টেডিয়ামের হাতুড়ি দিয়ে কি পেটালো ছোকরা তাহলে?
গেছি কি অন্ধ হয়ে? আবার চেষ্টা করলাম উঠে বসতে জনি, জনি কথা বলো, লেগেছে কি খুব? আমার মুখে ঝুঁকে পড়েছে ডেলার মুখটা। রাতের আকাশ দেখতে পাচ্ছি ওর কানের পাশ দিয়ে, গাছের সারি ছায়া ছায়া। উল্টো দিক থেকে ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছে গাড়ির আওয়াজ চাকার মাটি কামড়ানো–অনুভব শূন্যে বিচরণের।
ঠিক আছি আমি, একা থাকতে চাই একটু হাত দিলাম মুখে। মুখ ভিজে চটচটে।
বলো তো কি হয়েছিলো? বললাম মৃদুস্বরে ওঠো, সাহায্য করতে হবে আমাকে। ওর গলায় বিপদের সঙ্কেত। ও মারা গেছে মনে হচ্ছে?
পল। জনি উঠে পড়ো, চলবে না বসে থাকলে। সাহায্য করো আমাকে। এক মিনিট ঠিক আছে। উঠতে গেলাম হাতের চেটো ঠেকিয়ে মাটিতে, শুরু হলো বুকের যন্ত্রণা। উঠলাম তবু, দাঁড়িয়ে পড়লাম। কয়েক মুহূর্ত আমাকে ধরে ফেললো ডেলা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বার আগেই, তোমার কি হলো? দাঁড়াও ঠিক হয়ে। চমকে উঠলাম ডেলার কর্কশ গলায়।
ও পড়ে আছে ওইখানে। ওর নিঃশ্বাস পড়ছে না। হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়লাম বালির ওপর। ছিড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায় বুকটা। পলের দেহটা পড়ে আছে কাত হয়ে, পাশেই দুমড়ে যাওয়া বেন্টলের মাথাটা হেলে পড়েছে হাতের ওপর। প্রায় থুতনিতে ঠেকেছে একটা পা। সেটা উপুড় হয়ে গেলো ওর দেহটা ধরে নাড়া দিতেই। থেকে গেলো সেখানেই মাথাটা যেখানে ছিলো।
মটকে গেছে ঘাড়টা। নাড়ি নেই, তুলে নিলাম হাতটা। আমার কাঁধে হাত রেখে ডেলা হাঁটু মুড়ে বসলো, কাঁপছে। বললাম, মারা গেছে। কোনো জবাব দিলোনা ডেলা, শুধু ওর হাতটা আরও ডুবিয়ে দিলো আমার শরীরের গভীরে।
থাকো এখানে পাই কিনা দেখি কাউকে। দাঁড়ালাম উঠে। ও বেঁচে নেই তুমি ঠিক বলছো? আবার চমকালাম ডেলার হীম শীতল কণ্ঠস্বরে। হ্যাঁ। কোমর ঠেকিয়ে দাঁড়ালো একটা তালগাছে ভেলা আস্তে আস্তে উঠে। হাওয়ায় উড়ছে ওর এলোমেলো চুল। ছিঁড়ে গেছে স্কার্ট। গোড়ালীতে নেমে গেছে এক পায়ের মোজা। ওর মুখে চাঁদের আলো এসে পড়েছে গাছের ফাঁক দিয়ে রক্ত শুকিয়ে গেছে নাকের পাশে।
মেলে দিয়েছে আমার দিকে উদাসীন কোটরগত চোখদুটো। অন্যখানে মন। অন্য গাড়িটা পড়ে আছেরাস্তার ওপারে একটু দেখবে ওটার ড্রাইভারের অবস্থাটা? গাড়িটা পেপির। পাত্তাই নেই ওটার কোনো। বেঁচে নেই আমরা হয়তো ভেবেছে।
কিন্তু অবস্থাটা দেখো ওই গাড়ির পায়ে পায়ে রাস্তার দিকে এগোলাম যন্ত্রণা নিয়েই। চাঁদের আলোয় স্নান করেছে সারা রাস্তা, তবুওই জায়গায় পোঁছতে আমার অনেক সময় লাগলো।
পড়ে আছে গাড়ি–থেতলানো কাত হয়ে ঝোঁপের মধ্যে। এখন ভগ্নস্তূপ প্রকাণ্ড ক্যাকার্ডটা। চোখ চালিয়ে দিলাম ভাঙ্গা জানলার ফাঁকে। স্টিয়ারিংয়ে বসে ড্রাইভার। আতঙ্ক সারা মুখে। এফোঁড়–ওফোড় করে দিয়েছে স্টিয়ারিং ওর শরীরটাকে। যেন বর্শার ফলক। তালগোলে পাকানো শরীরের উৰ্বাঙ্গ।
ব্যাগ চেপ্টে রয়েছে ক্লাচ আর ব্রেকের মধ্যে। যাক, এবার তো পেয়েছে তোমার সাধের ব্যাগ। বিশ্রাম করো এবার একটু, আমি করে আসি ফোনটা। ডেলা ঘুরে দাঁড়ালো আমার পাশে এসে, না জনি আমরা যাবো না পুলিসের ব্যাপারেও, জানানোও চলবে না সেটা কাউকে, ওযে মারা গেছে।
আরে পারযেই তো পরে জানতে সনাক্ত করবে গাড়িও। সোজাসুজি তাকালাম ডেলার চোখে। তবে আর উদ্দেশ্যটা কি চেপে যাওয়া এ ব্যাপারটা?
জানতে চেয়ো না এখন কিছু পরে বলবো তোমাকে সব। উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই তোমার এত, ঠিক আছে সব। ডেলা কথাগুলো বললো স্বাভাবিক গলায়।
গোলমাল হয়েছে তোমার মাথার অ্যাকসিডেন্টে বস তো চুপ করে। আমি খবরটা দিয়ে আসি পুলিসে। ডেলা হাত ঢুকিয়ে দিলো ব্যাগের মধ্যে আমার দিকে তাক করলো একটা অটোমেটিক, পিত্তল বের করে, আছ যেখানে থাকে সেখানে।
আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো একটা গাড়ি ঝড়ের গতিতে পেলোট্রার দিক থেকে হেডলাইট জ্বালিয়ে। নিশ্চল বসে আমরা দুজন। চাঁদের আলো পড়ে ভীতিজনক করে তুলেছে ডেলার হাতের পিস্তলটায়। কিছু কার বসোনা বোকামি করে। ডেলার গলা বরফ ঠাণ্ডা।
নামিয়ে রাখো ওটা ডেলা– কোনোরকমে বললাম কাঁপা গলায়। চেপে বসেছে জগদ্দল পাথরের মতো মাথার যন্ত্রণা। ডেলা মৃদু হাসলো ঠোঁটের ফাঁকে। পরম মুহূর্ত এসেছে আমার জীবনে। আমরা দুজনেই শুধু জানি যে পল নেই। জনি তুমি বুঝতে পারছে না তুমি জানো না এই অবস্থায় যে কত জরুরী পলের মৃত্যু সংবাদ গোপন করাটা। শোনো, আমার সঙ্গে যদি হাত না মেলাও তুমি, তাহলে আমায় সরিয়ে দিতে হবে এ পৃথিবী থেকে তোমাকে। আর কোনো রাস্তা দেখছিনা তোমার মুখ বন্ধ করার। মনে হলো লোপ পেয়েছে ডেলার শুভবুদ্ধি। কিন্তু কোনো কারণ দেখছি না ও যা বলছে তা অবিশ্বাস করার।
আর একবার শীতল স্রোত নামলো মেরুদণ্ড বেয়ে। এখন সময় নেই সব কিছু খুলে বলার তবে বলে রাখছি একটা কথা–অনেক টাকা পাবে আমার সঙ্গে কাজ করলে। ডেলা আমার দিকে মেলে দিলো তার মৃত্যুনীল চোখ। কি করার আছে? আমাকে কি করতে হবে? ভাঙা গলায় প্রশ্ন করলাম ওর চকচকে চোখে চোখ রেখে।
দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো একটা বিদ্রুপের হাসি ডেলার নিষ্করুণ ঠোঁটে। তোমার গুলো ওর গায়ে চাপিয়ে দাও ওর জামা-প্যান্ট ছাড়িয়ে দরকার এটা রটে যাওয়া যে তুমি মরে গেছে মি? আমাকে চেনে পেলোট্রার সকলে– ডেলা আমাকে থামিয়ে দিল হাতের ইশারায়। গাড়িটাতে আগুন ধরিয়ে দাও। পলকে গাড়িতে তুলে দিয়ে। নানা আঁতকে উঠলাম, পারবো না আমি তা করতে। দাঁড়াও..
তোমাকে পারতে হবে–মরতে হবে নইলে, কোনো রাস্তা নেই দ্বিতীয়। দুরত্ব কমে এলো ওর হাতের অটোমেটিকটার। স্বচ্ছ চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি, মাথায় যে আঘাত পেয়েছি। কেড়ে নেওয়া যেতো ওটা ওর হাত থেকে মদের মাত্রাটা বেশী না হলে কিন্তু এখনও গুলি করে বসবে হাত বাড়ালেই। আমি খুন করেছি ওর চোখে। নাও শুরুকরে দাওকাজ, নষ্ট হয়েছে অনেক সময়। এবার ডেলার নরম গলা। কিন্তু আমার জানা দরকার ব্যাপারটা জানবে পরে। ডেলানড়ে বসলো একটু কি, উঠবে? না? ওর ঠোঁটে আবার খেললো সেই বীভৎস হাসি।
উঠেছি–হাত বোলালাম মুখোর্ভিজে গেছে ঠাণ্ডা ঘামে। পল যেখানে পড়ে আছে সেদিকে আস্তে হেঁটে গেলাম। শুরু করলাম ছাড়াতে ওর জামাকাপড়। তেমন রক্তপাত হয় নি ঘাড় মটকে যাওয়ায়। পাল্টালাম আমার জামা কাপড়। ডেলা দাঁড়িয়ে পিস্তল উচিয়ে। ওকে জুতো পরাতে গিয়ে আবার ফ্যাসাদ বাঁধলো।
হবেনা আমার দ্বারা। ঘাসে বসে পড়লাম। হবেনা পরাতে, ফেলে দাও গাড়ির মধ্যে। লোকে ভাববে খুলে পড়েছে পা থেকে। ওকে বসিয়ে দাও স্টিয়ারিংয়ে। চললাম পলের দেহ টেনে নিয়ে। মানুষটা ছিলো দশাসই চেহারার রীতিমত কসরৎ করতে হলো। একটুও কমল না কিন্তু আমার যন্ত্রণা। ওকে ঠেলে দিলাম গাড়ির দরজা খুলে, পল গড়িয়ে গেলো। খুলে আগুন লাগিয়ে দাও লিক–এ রুমাল বেঁধে। জেল খাটানোর ব্যবস্থা করছো তুমি আমাকে। আমার ভারী হয়ে আসছে নিঃশ্বাস করো যা বলছি যন্ত্রপাতির বাক্সটা আছে হুডের ভেতর। জলদি বের করে নাও স্প্যানার। খুলে দিতেই কারবুরেটারের পাইপটা, হাতটা পুড়ে গেলো সিলিন্ডারের ঢাকনিতে। নেই বোধশক্তি, হয়ে গেছি আত্মস্থ।
বাড়ছে কমছে মাথার যন্ত্রণা। ভারী হয়ে গেছে রবারের মতো পা দুটো। রুমাল বেঁধে দিলাম লিক পাইপে। কাঠি জ্বেলে দাও। ভাঙ্গা গলা এলো ডেলার। দিলাম। আগুনের হাছুটলো মুহূর্তে গাড়ির ইঞ্জিন থেকে।
সারা গাড়িতে ছড়িয়ে পড়লো সে আগুন। কাঁপতে কাঁপতে লাফিয়ে সরে এলাম। ডেলা ছুটে এলো আমার পাশে। চলে এসো এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে কেউ দেখে ফেলার আগে…। হাঁটতে শুরু করলাম আমি ওর সঙ্গে। দুজন দ্রুতপায়ে চলেছি। নিঃশব্দ প্রাণী দুটি। মিলিয়ে গেলো গাড়ির আগুন চোখ থেকে।
ডেলা দাঁড়িয়ে পড়লো সৈকতের শ্বেতশুভ্র বালিয়াড়িতে পৌঁছে, হাঁফাচ্ছে, ওঠানামা সুস্পষ্ট উন্নত বুক দুটোয়। জনি দাঁড়াও। এবার ওর দিকে ভালো করে তাকালাম ঘুরে দাঁড়িয়ে। ওর হাতে এখনো আছে পিস্তলটা। তবে আর আমি নই সেটার লক্ষ্য। বেশী সময় নেই হাতে, কথা বলে নিই তোমার সঙ্গে। অবশ্য দরকার ছিলো খোঁজখবর নেওয়ার তোমার সম্পর্কে। কিন্তু যাক গে। ভাবিনি দেখা হবে এরকম একটা অস্বাভাবিক অবস্থায়।
ডেলা একটু থামলো, পরস্পরকে বিশ্বাস করতে হবে আমাদের এখন থেকে। থাকতে হবে একসঙ্গে। কতকালের চেনা আমরা যেন, আচ্ছা কি রকম তোমার সাহস? মানে, কতটা ঝুঁকি নিতে পারো জীবনে বড় হবার জন্য? কিন্তু, একবারও ভেবেছো কি সেটা যে আমাদের একুকর্মের জন্য কয়েদ খাটতে হবে? তোমাকে ভাবতে হবে না সে জন্য শোনো টাকা চাও তুমি? অনেক টাকা? আমরা আধাআধি কয়েক লাখ ডলার রোজগার করতে পারি নার্ভের জোর থাকলে। গেলাম শক্ত হয়ে। লাখ ডলার! মনে গাঁথা হয়ে আছে এই টাকার স্বপ্নই তো…ঠিক বলছো তো তুমি? বললাম অবিশ্বাসের স্বরে। বলছি শোনোই আগে সবটা। বসলো ডেলা, আমাকে দেখিয়ে দিলো পাশের জায়গা। ওখানে বসো–সামান্য দূরত্ব রেখে বসলাম, কোলে ফেলা ওর পিস্তলটা। আবার ওর মুখে চাঁদের আলো। ওকে সুন্দর দেখাচ্ছে এলোমলো চুল আর রক্তরেখায়িত মুখ।
ডেলা তার কথা রুদ্ধশ্বাসে বলে চললো। পল ওয়ার্দামের কাহিনী। কুখ্যাত জুয়াড়ী, তিনতিনটে, ক্যাসিনোর মালিক লোকটা, মালিক কোটিকোটি টাকার। তাই শকুনির দল ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর মৃত্যুর খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে। ম্যানেজার আছে ক্যাসিনোগুলোর আলাদা আলাদা। তৎপরতা বেড়ে যাবে ওদের কানে খবরটা পৌঁছলে। আমাদের চুষতে হবেবুড়ো আঙুল। আমাদের কাজ গুছোতে হবে পলকে বাঁচিয়ে রেখে, আমার পরিকল্পনা এটাই।
কাজটা সহজ হবে তুমি সঙ্গে থাকলে কয়েক লক্ষ ডলার মনে রেখো। নার্ভের দরকার শুধু একটু। তাই করবে আমি যা বলবো। আমরা ঠিক বেরিয়ে যাবো। হওয়া উচিৎ আমার উত্তর না এবং উঠে শুরু করে দেওয়া চলতে কিন্তু একটা কাজই হবে তাতে। মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে হবে বালিয়াড়িতে। পিঠে গুলি খেয়ে। আমার মনে পড়লো টম রোশের কথা। জনি, হঠাৎ বিপদ আছে অনেক টাকা হাতানোর। বলিনি আমি। না, পারিনি বলতেডেলা এখনো খুনের মেজাজে আছেও হাল্কা চালে কতাবার্তা বললেও, আমার মনে হলো। ভাবলাম টাকার কথা–কি করা যেতে পারে ও টাকায়? বললাম শেষে, কিন্তু কি করে চেপে রাখছে ওর মরার খবরটা? আর মনে করে কতদিনই বা চেপে রাখবো? ডেলা এলিয়ে দিলো শরীরটা মৃদু হেসে, স্পষ্ট হলো নিতম্বের রেখাঁ হাঁটু মুড়তে।
মুখ না খুললেই হলো তিন চারটে দিন। এসে যাচ্ছে টাকাটা আমাদের হাতে। সব শুনি বলে যাও সরানো আছে পর্যাপ্ত টাকা প্রতিটি ক্যাসিনোতে–যাতে কারবারের অসুবিধা না হয় ব্যাঙ্কের গোলমাল হলেও। জানো তো লিঙ্কন বীচের ক্যাসিনোটা বিশ্রামস্থল কোটিপতিদের টাকাটা রাখা আছে ওইখানেই জ্যাক রিককা লস এঞ্চেলসের ক্যাসিনো চালায়। নিক রাইসনারের দখলে লিঙ্কন বীচের ক্যাসিনো, পিট্রলেভিনস্কার হাতে প্যারিসেরটা। ডেলা আমার দিকে ঘুরলো বুক দুটো টান করে, রাইসনার জানতে পারলো পল ক্যাসিনোর উদ্বৃত্ত টাকা, জুয়োতে লাগাচ্ছে প্যারিস যাওয়ার মুখে।
সামনে একটা লোক এসে দাঁড়াল। লোকটাকে যথেষ্ট শক্তিমান মনে হলো বেঁটে হলেও। সে তুলে ফেললো আমাকে অবলীলায়। শরীরের সমস্ত ভার আমি ওর ওপর ছেড়ে দিলাম। ঠিক আছে, আমার ঘর এইতো কাছেই–স্যার ঘাবড়াবেন না আপনি। মনে হলো ডেলাও হাত ধরেছে আমার একটা। টলতে টলতে এগোলাম আমি ধীর পায়ে ওদের দুজনের সাহায্যে। চোখ বুজে ফেললাম বিছানায় শুয়ে। শুনলাম লোকটার গলা। দিদি ভালো নয়তো ওঁর অবস্থা, ডাকি ডাক্তার ডেলার গলা। কতদূরে টেলিফোনটা? হবে আধমাইলটাক? লোকটা দূরে সরে গিয়েছে আমার কাছ থেকে। ভালো করে দেখতে পাচ্ছি এখন ওর চেহারাটা শেষ সীমায় বয়স প্রৌঢ়ত্বের, অনেক জীবনযুদ্ধের স্বাক্ষর ঝাকড়া চুল আর রেখাঙ্কিত মুখে। চোখ ফেরালাম ডেলার দিকে, সে বসে আছে একটা চেয়ারে। সঙ্কল্পের দৃঢ়তায় কঠিন মুখের রেখাগুলি। ও শোকার্ত হয় নি পলের মৃত্যুতে কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবেনষ্ট হয়েছে ডেলার মানসিক স্থৈর্য এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে। একটা হুইস্কির বোতল বের করে আনলো দৌড়ে ভেতর থেকে লোকটা ওর দিকে একবার তাকিয়ে। ডেলা একচুমুকে শেষ করে দিলো গ্লাস ভর্তি পানীয় বাড়িয়ে দিতেই।
লোপাট হয়ে গেছে আমাদের গাড়িটা ডেলানামিয়ে রাখলো গ্লাস। শয়তানগুলো ডাণ্ডা বসিয়ে দিলো আমার বন্ধুর মাথায় আমাদের গাড়িটা আটকে। একটা খবর দেওয়া দরকার এখুনি লিঙ্ক বীচে–ভাইটি দেবে? ওরা এসে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে আমাদের এখান থেকে। দেখাতে হবে তত ওকে হাসপাতালে। খবর দিয়ে দিচ্ছি এখুনি সব সময় হাজির আপনাদের সেবায় হার্কনেস। হার্কনেস শোধ হবে না কখনও তোমাদের ঋণ। লীলাময়ী হাসি ফোঁটালো ডেলা তার ঠোঁটে আমরা যাচ্ছিলাম লিঙ্কন বীচে। দিদি নম্বরটা দিন খবর গিয়ে দি একটা পুলিসেও–না এখনও না।
আগে দরকার ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া, তারপর খবর দেওয়া যাবে পুলিসে। হ্যাঁ, নম্বরটা লিঙ্ক বীচ ৪৪৪৪, পারবে মনে রাখতেনা, লিখে দেবো? না, না, হবে না লিখতে চাইবে রাইসনারকে–রিককার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছেবলবে, তার আসা দরকার তাড়াতাড়ি হার্কনেস এলিয়ে বেরিয়ে গেলো কথাগুলো একবার আওড়ে। বিছানায় উঠে বসলাম লোকটা অদৃশ্য হতেই কেন বলতে গেলে ওসব? এসে হাজির হবে পুলিসের খোচড়গুলো–আমার দিকে তাকাল ডেলা, অনেক দূরে কোথাও তার চোখ দুটো–উধাও, সে ভাবছে অন্য কিছু, এই জন্যে বললাম যে–ঠিকই গাড়িটা পলের, কিন্তু ভুয়ো নম্বরটা। ওটা চুরি গেছে খোঁজ পড়লে জানবে, বুঝলে
সেই হাসি ডেলার ঠোঁটে। ঠিকই বলছে ও হয়তো কিন্তু মনে ধরলো না আমার কথাগুলো কারণ পেলোট্রাতে খবর চলে যাবে দু–এক দিনের মধ্যেই। আমি ড্রাইভারটিকে খতম করে গাড়ি নিয়ে ভেগেছি রোশ আর অ্যালিস জানবে। ছিনতাইবাজ ভাববে ওরা আমাকে, এটা পারছি না। কিছুতেই মেনে নিতে। ডেলা আমার বিছানার পাশে বসলো লঘু পায়ে এগিয়ে।
এখুনি এসে পড়বে জনি, রাইসনারদারুণ চালাক কিন্তু লোকটা খুব সাবধান, তোমার সঙ্গে কথা বলতে দেবে না ওকে। আমিই বলবো যা বলার। মাথায় চোট তোমার, কাজেই বলা বারণ কথা। সায় দিলাম মাথা হেলিয়ে। ও সন্দেহ করবে শুধু একটা ব্যাপারেই–কেন এসেছি আমি তোমার সঙ্গে। হয়তো ও যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে পলের সঙ্গে ক্যাসিনোতে ফোন করে।
পল প্যারিসের পথে উত্তরে জানাবে, আর রিককা যাত্রা করেছে লিঙ্কন বীচের দিকে। শুধু ও এইটুকু জানুক, তবে বড় জোর কিলবিল করে উঠলে মাথার পোকা কথা বলার চেষ্টা করবে। প্যারিসের লেভিনস্কীর সঙ্গে; কিন্তু লেভিনস্কীও কিছু বলতে পারবে না স্টিমার প্যারিসের ডকে না ভেড়া পর্যন্ত।
আটকে গেলো ঠোঁটে সিগারেট, বুলিয়ে নিলাম জিভ শুকনো ঠোঁটে। এক পাশবিক ইচ্ছা হলো ডেলাকে কাছে টেনে নেবার। পড়তে পেরেছে আমার মনের কথা ও বোধ হয় সরে গেলে সামান্য।
চেষ্টা করলো চোখে কাঠিন্য আনার, তাই ভাবো যা বলছি বুঝলে? তোমার কিছু জেনে রাখা দরকার পলের সম্পর্কে সে থাকতো কিভাবে। পছন্দ করতে কি কি…হোঁচট খেতে হয় বেশী এসব ছোটো খাটো ব্যাপারেই–বলে চললো ডেলা। কোথায় থাকত লস এঞ্জেলসের পল ওয়ার্দাম; টেলিফোন নম্বর তার। তার সব পরে পাওয়া গেল।
ডেলা খেলালো ঠোঁটে সেই বিচিত্র হাসি। সত্যি নয় পুরোপুরি কথাটা কিন্তু বললাম না তা আর ওকে। শুধু এটুকুই মনে হয়েছে ওকে পেতে চাই, ভাবতে পারো যা খুশী, কিন্তু পরস্পরকে জানা দরকার আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হলে। ম্লান হাসলো ডেলা, বুঝলাম। শোন তবে–পলের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা বছর দুই আগে।
আমি তখন ঘোরঘুরি করছিছবির রাজ্যে ঢোকার জন্য। আমার অবস্থা প্রায় কপর্দকহীন, আমার জীবনে দেখা দিলে পল এমন সময়। ওর কাছে আমার কোনো মূল্য ছিলো না মানুষ হিসাবে নিষ্ঠুরতা পুরোদস্তুর স্বার্থপর আর লোকটা ঔদ্ধত্যের প্রতিমূর্তি।
কিন্তু ওর টাকা ছিলো, দরাজ হাতে খরচও করতো। তা, আমি পড়ে গেলাম পলের চোখে। আর যত রকম প্রক্রিয়া জানা আছে পয়সা হাতাবার, চললাম প্রয়োগ করে। টাকা খরচ করে চললো জলের মতো আমার জন্য। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াই একসঙ্গে কিন্তু, গাঁটছড়া বাধা তো আমার ধান্দা। বাক্সে কৈলো সিগারেট বের করে ডেলা তিক্ত হেসে। ঘৃণা ওর রক্তিম ঠোঁটে, পল তার শিকার ভেবে ছিলো আমাকে–তাই সেকি হলো বিয়ের অনুষ্ঠানটাও, কারণ জীবিতা পলের স্ত্রী। কিন্তু আমার দেড় বছর কেটে গেলো ব্যাপারটা জানতেই। পল বললো ওকে ডিভোর্স করবে, অবশ্য শেষ পর্যন্ত করলোও।
ও পরিষ্কার করে নিলো গলাটা কেসে, সই হয়ে যাওয়ার কথা সামনের মাসেই ডিভোর্সের কাগজপত্র, কিন্তু দেরি হয়ে গেলো বড্ড। ওর স্ত্রী এখন টাকা পয়সা সবই পাবে, নিঃসঙ্গ হয়ে যাবো আমি আবার। ডেলার কেমন বিষয় গলা, বেশ কেটে গেলো দুটো বছর। আমি আর ফিরে যেতে চাই না আগের জীবনে, জনি এটা করছি এত ভেবেচিন্তে সেই জন্যেই, আর নিরস্ত করতে পারবে না তা থেকে কেউ আমাকে দরজার হাতল ঘোরার আওয়াজ উঠলো ডেলার কথা শেষ হবার মুহূর্তে। শুয়ে পড়লম বিছানায় সটান। চিতপাত হয়ে। ঢুকলো জুড হার্কনেস। ত্বরিতে ঘুরলো ডেলা। রাইসনারকে পেলে? হ্যাঁ আসছে। আমার কানে লাগলো ওর কথা বলার ভঙ্গি ওকে লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম চোখের কোণে। আমার দিকেই তাকিয়ে হার্কনেসও। জ্ঞান হয়নি? বোধ হয় ঘুমোচ্ছ নিঃশ্বাস অনেকটা স্বাভাবিক, জবাব দিলো ডেলা। সারা ঘর জুড়ে একটা দীর্ঘ অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ নামলো। হার্কনেস কথা বললো অনেকক্ষণ পরে, ফোন ধরেছিলেন যিনি, বললেন তার আসতে দেরী হবে ঘণ্টাখানেক।
এবার আমি শুতে যাবো আপনাদের অসুবিধা না হলে অনেক রাত তো হলো হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্বচ্ছন্দে। আর বিরক্ত করবো না ভাই, তোমাকে। ধন্যবাদ অনেক, তুমি যা করলে–ঠিক আছে।
লজ্জা দেবেননা একথা বলে বারবার। আচ্ছা, তাহলে, আর কিছু লাগছে আপনাদের? না–, রয়েছে তো সবই। তোমাকে আর উঠতে হবে না মিঃ রাইসনার এলে–
থামলো ডেলা, হার্কনেসের দিকে বাড়িয়ে ধরলো ব্যাগটা খুলে কয়েকখানা নোট বের করে, মনে যদি কিছু না করো, তাহলে, এই সামান্য দরকার নেই।
হার্কনেস ডেলাকে থামিয়ে দিলোনা, একশো আছে, তোমাকে নিতেই হবে এটা। একটা কথা আর–তোমাকে গোপন রাখতে হবে এ সবই।
বলবে জিজ্ঞাসা করলে কেউ কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার এটা কেমন? হার্কনেস টাকাটা নিলো সামান্য ইতস্তত করে, ধন্যবাদ।
আমি মুখ খুলি না আমার মাথা গলাবার নেই এমন কিছু ব্যাপারে। সে দরজাটা টেনে দিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলাম। ডেলা আঙুল তুললো পর্দাহীন–জানলাটার দিকে, ওইখান দিয়ে দেখেছিলো ও আমাদের। ওর গলা প্রায় খাদে। মনে হলো আমারও তাই। ডেলার কাছ থেকে যেটকু জেনেছিলাম রাইসনার সম্পর্কে, তাতে আমার ধারনা হয়েছিলো ওকে হলিউড মার্কা নৃশংস চরিত্রের একটা জীব বলে। কিন্তু ধারণা পাল্টাতে হলো ওকে দেখার পর। মনে হলো চল্লিশের নীচেই লম্বা ছিপছিপে চেহারার রাইসনারের বয়স। কিন্তু খড়ির মতো সাদা তার চুল, চোখে মুখে মাস্টার মশাই ছাপ। বাজ পাখীর মতো টিকালো নাক, সারা মুখে বিষণ্ণতার ছোঁয়া। রাইসনার ডেলাকে দেখেছিলো দরজায় দাঁড়িয়ে।
ডেলা তাকে অভ্যর্থনা জানালো মৃদু হেসে চোখে চোখ মিলতেই, নিক এলে। পরে হবে কথাবার্তা আগে বেরোনো যাক এখান থেকে। রাইসনার বঙ্কিম হাসি ফোঁটালো ঠোঁটের কোণে। ডেলাকেই যেন উদ্দেশ্য করলো আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে।
মিঃ রিককা? রাইসনারের নরম মেয়েলি গলা আশা করি নি যা। চোখ বোলালাম ওর সারা শরীরে ছিমছাম পোয়াক কেতাদুরস্ত।
নষ্ট হতো বোধহয় প্যারিসের অভিজাতমহলে পলের ইজ্জত আমি সঙ্গে থাকলে– ডেলা বললো ঠোঁট উল্টিয়ে, তাছাড়া এটাও হয়তো ওর অভিপ্রায় আমি জনির সঙ্গে থাকি। জানি। রাইসনার উচ্চারণ করলো অস্ফুটে, গাড়ি তুলে দিয়ে বড় রাজায়।
চোখে পড়েনি অসাধারণ কিছু তুলতেই বা গেলে কেন? লোকটা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো শহর ছেড়ে বেরোবার জন্য, যেতে চায় মিয়ামিনা কোথায় বললো। খারাপ হয়ে গেছে তার গাড়িটা নাকি। অনুনয় করতে লাগলো পৌঁছে দেবার জন্য লিঙ্কন বীচ পর্যন্ত।
বললো কিছু শহরের নাম? হ্যাঁ, পেলোটা। ঠিক আছে কি করা যায় দেখি। মনে হয় না পল চট করে ভুলতে পারবে বেন্টলে গাড়ির শোক। যা বলেছে। ডেলা খুললো সিগারেটের প্যাকেট।
গাড়ি এগিয়ে চললো দ্রুতগতিতে। কেউ কোনো কথা বললো না অনেকক্ষণ। প্রথম স্তব্ধতা ভাঙলো রাইসনারই, কমই বলেন দেখছি আপনি তোকথা, রিককা সাহেব। নিরিবিলি পছন্দ বেশ, তাই না? হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা তো বটেই। কিন্তু আপনিই যেন বক্সিং রিং থেকে নেমে এলেন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে। ডেলাই মুখ খুললো আমি কিছু বলার আগেই, একটা লোক মার খায় তুমি নিশ্চয় আশা করো না আর একজনকে ভাগতে হবে গাড়ি নিয়ে সুড়সুড়িয়ে। জনি যুঝেছে যতক্ষণ পেরেছে। তাহলে আর একটা বিশেষণ যুক্ত হলো শান্তর সঙ্গে বলবান। এবার বিদ্রুপের সুর সুস্পষ্ট রাইসনারের গলায়, তাহলে তোমার মতোনয়, মিসেস ওয়ার্দাম, হাততালি দেবে দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে। তখন কি করা উচিৎ ছিলো আমার, চেল্লানো?
ডেলা বলে উঠলো গলার শির ফুলিয়ে। একটা বন্দুক থাকে সব সময় তোমার সঙ্গে আমি তো জানতাম, তাহলে ওটা রাখার কি দরকার যদি সময়ে ব্যবহার নাই করা গেলো। এবার শক্ত হয়ে মুঠো হতে দেখলাম ডেলার হাত দুটো। রাইসনার জিতলো প্রথম পর্যায়ে। ডেলা বলে দিলে নির্বিকার মুখে, বন্দুক ছিলো না আমার সঙ্গে।
ছিলো না? এই প্রথম, তাই নয় কি? রাইসনার ডেলার দিকে তাকালো গাড়ির আয়না দিয়ে। বৃষ্টি হয় ছাতা সঙ্গে না থাকলে, তাই না? বুঝলাম রাইসনার কথাগুলি বলছে না নিজের কানে মধুবৰ্ষণ করানোর জন্য। সন্দেহ করছে ও। যদিও সে বকেছিলো আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করে, কিছু বের করতে চাইছে তবু মনে হোল। টোকা দিলাম ডেলার হাঁটুতে। ইশারায় দেখিয়ে দিলাম হাত ব্যাগটা ও ফিরতেই। ও বুঝলো ইঙ্গিতটা, পিস্তলটা বের করে দিলো ব্যাগ থেকে আসনের নীচে নামিয়ে। সেটা ফেলে দিলাম পকেটে। আচ্ছা, কেন হঠাৎ থামতে গেলে পেলোট্রায়? আচমকা রাইসনার প্রশ্ন করলো।
মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম আমরা। ধরিয়ে দিতে হোল না আমাকে আর খেই, ইতি ঘটানো দরকার ওর প্রশ্নোত্তরের আসরে, মশাই দেখুন বাদ দিন তো এইসব হেঁদোকথাবার্তা–জাম খেয়ে আছে মাথাটা শালা–পৌঁছে দিন তাড়াতাড়ি একটু ঘুমোবো। রাইসনার চুপ করে রইলো একটুক্ষণ। নিশ্চয় নিশ্চয়। সে বাড়িয়ে দিলো গাড়ির গতি, মনে করবেন না কিছু, আমার বহুকালের বকুনির অভ্যেসটা।
উঠতে লাগলো গাড়ি চড়াই। তাকালাম জানলার বাইরে। লিঙ্কন বীচ। জানালো ডেলা। রইলাম তাকিয়ে সমুদ্রের মুখে, শহর অর্ধবৃত্তের আকারে। শহরের অল্পই দেখা গেলো গাড়ির প্রচণ্ড গতির জন্য কিন্তু দেখলাম যেটুকু তাতে শহরটাকে আলাদাই মনে হলো আর পাঁচটা সৈকত শহরের থেকে। ঘড়িতে এখন রাত দুটো–স্ফটিকের সমাহার আর আলোর লাল–নীল ফোয়ারা শহরের সর্বত্র। চোখে পড়লো নিওনের প্রাচুর্যও। মনে হয় রূপকথার রাজত্ব।
বাহবা দিলাম। বাঃ জায়গাটা তো বেশ; ক্যাসিনো ওইটে হোল–যেটা দেখছো উপসাগরের শেষে হাত বাড়ালো ডেলা, তারপর বললো রাইসনারের উদ্দেশ্যে, নিক দেখাচ্ছে কিন্তু ভালোই। যেন স্বগতোক্তি করলো রাইসনার। আমরা ক্যাসিনোতে পৌঁছে গেলাম অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। পাহারা রয়েছে গেটে; কালো পোষাকের দুজন দুপাশে। হিটফলারের ঝটিকা বাহিনীর পোষাক। হাত তুললো ওরা, ভাবলেশহীন মুখে।
এগিয়ে চললো গাড়ি, দুপাশে আলোর সারি। বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়েছে আলোর কারসাজিতে, গাড়ি যেন চলেছে জলের তলা দিয়ে। এগুলো লাগিয়েছিমাসদুয়েক হলো, আলোর ব্যবস্থা করেছি সম্ভাব্য সব জায়গাতেই; যেন দেওয়ালী পোকা পয়সাওলা মানুষগুলো, রাইসার বললো, ছুটে আসে আলো দেখলেই। বেড়েছে ব্যবসাও।
নিজের মনের কথা যেন বলে চলেছে রাইসনার।
রাইসনার আবার শুরু করলো ডেলা কি একটা বলার জন্য মুখ খুলতেই; আলো দিয়েছি প্রতিটি ফুলের বাগানেও। পল তো মাঝে মধ্যে গাই–গুই করতে টাকা খরচ হচ্ছে বলে কিন্তু টাকায় টাকা পয়দা করে এখন বুঝেছে। দূরদূরান্ত থেকে কত মানুষ ছুটে আসে শুধু ফুল দেখতে। বারে ঢোকে পরে খরচাকরে মালের পেছনেও। ঘাসে ঢাকা এক ফালি জমিতে পড়লোরাভা এবার। ক্যাসিনো দাঁড়িয়ে আলোর সমারোহ নিয়ে আমাদের সামনে, স্বপ্রতিষ্ঠিত আপন মহিমায়। যেন একটা দৃশ্য আরব্যরজনীর : কেল্লা মূরীয় ভাস্কর্যের অনুকরণে, আলোর ঝরনা মিনার থেকে বিচ্ছুরিত, ঊর্ধ্বমুখী রাতের আকাশ ভেদ করে। অদুরে চলেছে নানা রংয়ের আলো জ্বলা নেভা স্বয়ংক্রীয় প্রক্রিয়ায়। রিককা সাহেব, কিছু করতে পেরেছেন এরকম লস এঞ্জেলসে? না বোধহয়। দশ হাজার খরচ করেছি এজন্য আমরা। রাইসনার গাড়ি চালিয়ে গেলোক্যাসিনো পেরিয়ে। উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় সজ্জিত অঞ্চল পার হয়ে। সেখানে অনেক মানুষের কলতান এতরাতেও। সৈকত থেকে কিছুদুরে আর একটা গেট পেরিয়ে গাড়ি দাঁড়ালো সারি সারি অনেকগুলি কুটিরের একটার সামনে। এসে গেছি। জানোই তো মিসেস ওয়ার্দাম সব ব্যবস্থা করা আছে তোমার জন্য, রাইসনার এই প্রথম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ডেলার দিকে, কি ব্যবস্থা করবো রিককা সাহেবের?
ওকে দাও, পল ব্যবহার করে যেটা, ডেলা বললো অম্লানবদনে, গাড়ি থেকে নেমে। রাইসনার প্রশ্ন করলো একমুহূর্ত থেমে। পাঠিয়ে দেবো কি ডাক্তার? দরকার নেই কোনো, ঠিক আছি আমি–ঠিক হয়ে যাবো ঠেসে ঘুম দিলেই। যেমন বোঝেন, উপেক্ষা ধ্বনিত হলো রাইসনারের। গলায়।
নিক আর দরকার নেই অপেক্ষা করার। কাজের কথা হবে সকালেই। ধন্যবাদ সাহায্য করার জন্য আমাদের। ঠোঁটের ফাঁকে হেসে রাইসনার ডেলার মুখ থেকে আমার মুখে চোখ ঘোরালো, আবার তার চোখ ফিরে গেলো ডেলার দিকেই। তাহলে চলি, দেখা হবে কাল দুপুরে কাজে বসা যাবে খাওয়া দাওয়ার পর। আস্তে চলতে আরম্ভ করলো বিরাট গাড়িটা চলতে। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম গাড়ির পেছনের আলো দুটোর দিকে গাড়িটা অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত। লম্বা নিশ্বাস নিলো ডেলা। দেখলে তো রাইসনারকে কেমন মনে হলো?
চালাক লোক। হুঁ এলো ভেতরে। শুকিয়ে গেছে গলাটা, ভিজিয়ে নি একটু। ডেলা আলো জ্বালিয়ে দিলো কুটিরে ঢুকে! বেশ বড়ই ঘরটা ব্যবহার করা যায় দিনের বসার ঘর হিসাবে, আবার ব্যবস্থাও রয়েছে রাতে শোবার। একটা রান্নাঘরও আছে, লাগোয়া কলঘর। বিলাসিতার ছাপ সর্বত্র। বন্দোবস্ত সব কিছু বোতাম টিপে সবার। ডেলা ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে। কেমন, ভালোনা ব্যবস্থা? পলের দারুণ শখ ছিলো এসব ব্যাপারে। এখানে এরকম কুটির আছে গোটা ত্রিশেক–তার নিজস্ব সজ্জা নিয়ে প্রত্যেকটিই–এটাই পছন্দ আমার কিন্তু।
ও দোলাতে লাগলো পা, একটু জলের ব্যবস্থা–হুম কি আছে ওই আলমারিতে? হুইস্কিতে সোডা ঢেলে ডেলার দিকে গ্লাস বাড়িয়ে দিলাম। ডেলা এগিয়ে এল আমার দিকে।
যাবো না, বললাম মিসমিসিয়ে, আমার হাত কাঁপছে। ভারী হয়ে আসছে নিঃশাস। একদিন আমরা মিলবো একসঙ্গে কাজ করলে, জনি–কিন্তু আজ না। যাও শুতে।
প্লিজ এখন না। ওর কাঁধে নামিয়ে দিলাম আমার হাত দুটো। ডেলা শিউরে উঠলো। ওকে আমার মুখোমুখি টেনে ঘুরিয়ে দিলাম, শুধু তোমার কথাই শুনে আসছি তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে, করছি যা বলছে। আমার কথায় চলতে হবে তোমাকে এখন থেকে। দুপাশ থেকে আমার গলায় নেমে এলো ডেলার হাত দুটো, ও কণ্ঠলগ্না হলো। আমার খুব ভালো লাগে যখন তুমি এভাবে কথা বলো জনি। ডেলা আমার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিলো।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম রাজকীয় প্রাতঃরাশ চুকিয়ে। পাশের কুটিরে নজর গেলো সিগারেট ধরিয়ে পায়চারী করতে করতে। আমার দিকেই আসছে ডেলা বেরিয়ে। ডেলা আর একবার আমার হৃদয় দোলালো আকাশ নীল হাতকাটা স্কার্ট, মাথায় নায়িকা টুপি আর রোদ্দুর চশমায়। অ্যাই জনিডেলা ছুঁড়ে দিলো তার মনোহর হাসি।
দারুণ দেখাচ্ছে কিন্তু তোমাকে। আমার মুগ্ধ দৃষ্টি। খারাপ দেখাচ্ছে না তোমাকেও কিছু। হাসিটুকু লেগে আছে ওর মুখে। ও চোখ বোলালো আমার কলারওলা গেঞ্জী আর ঢোলা প্যান্টে মাপসই হয়েছে বেশ। হয়েছে তা তো, কিন্তু কোত্থেকে জোটালে এ গুলো?
জুটিয়েছি আমিই, জোটাচ্ছি তো সব কিছু সকাল থেকেই।
ডেলা হাসি থামালো, চলো যাওয়া যাক দর্জির কাছে, তোমার জন্য অর্ডার দেবো কিছু পোষাকের–বিশ্বাস হচ্ছে না আমার তো কিছুই, কোথায় মিয়ামি যাবার ধান্দা করছিলাম। ট্রাকে চড়ে, আর…।
ওর সাদা সাদা দাঁত মেলে দিলো ডেলা আবার, সব ঠিক আছে। আরে, এসো নিকের সঙ্গে বসতে হবে আবার এদিকটা সেরে। ওর সঙ্গে ঘুরলাম ঘণ্টা খানেক ক্যাসিনোর চত্বর, দর্জির কাজ সেরে। হীরের নেকলেস থেকে অ্যাসপিরিনের বড়ি–দোকানপাট লিলিফুলে ভরা দীঘি, মৎস্যাধার বাগান, সবই করেছে ওয়াদাম–সবই। কৃত্রিম জলাশয় ওক গাছের ছায়ায়, জলে স্পেনীয় শেওলার বিস্তার। বিদ্যুৎ চালিত নৌকা ভাড়া করুন বান্ধবীকে নিয়ে যদি হারিয়ে যেতে চান। একটা ছোটখাটো চিড়িয়াখানাও আছেক্যাসিনোর পেছনে। সেখানে সারাদিন কিচিরমিচির চলছেনানা দেশের পাখীর, দেখবে এসোসিংহের গুহাটা। পশুপ্রেমিক ছিল পল। তার পশুরাজদের প্রতি অসীম দুর্বলতা ছিলো তাজ্জব বনে যাবে তুমি শুনলে, কত মানুষ শুধু এই লিঙ্কন বীচে পায়ের ধুলো দেয় ওই জানোয়ারগুলোকে দেখবার জন্যেই।
আমরা পাশাপাশি দাঁড়ালাম গুহার ওপরে রেলিংয়ে, আমার কাঁধে ঠেকানো ডেলার কাঁধ। দৃষ্টি চালিয়ে দিলাম নীচে গোটা দুয়েক পশুর বিচরণ চলেছে অলস পায়ে।
বললাম দেখার জিনিষই বটে। এদের নিজের হাতে খাওয়ায় রাইসনার। এদের জন্য সবটুকু ওর অবসর সময়ের। ফিরে দাঁড়ালো ডেলা। ফেরা যাক চলো, দেখার আছে আরো অনেক কিছু পেরিয়ে চললাম মুক্ত অঙ্গন রেস্তোরাঁ। উঁকি দিলামনীচের ঘরে, কাঁচ বসানো মেঝেতে। আমাদের দেখে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো মধ্য বয়স্ক এক মেদবহুল ইতালীয়।
লোকটার পরনে নিখুঁত প্রতিক পোষাক। জনি, লুই পরিচয় করিয়ে দি, তিনটে রেস্তোরাঁই এর এক্তিয়ারে আমাদের এখানকার। লুই ঝুঁকে অভিবাদন করলো ডেলা তার দিকে ফিরতে। লুই কেমন আছ? ডেলা ওর কুশল জানতে চাইলো মিষ্টি গলায়। ভালো ম্যাডাম।
জনি রিককা ইনি। সন্ধানী দৃষ্টি হানলো ইতালীয়টি আমার দিকে তাকিয়ে, হাত বাড়িয়ে দিলো ঝুঁকে, মিঃ রিককা আপনার কথা শুনেছি–সব খবর ভালো, আপনাদের লস এঞ্জেলসের? হ্যাঁ ভাই, কিন্তু কিছুইনা এখানকার তুলনায়। হাসলাম। কৃতজ্ঞতার ছোঁয়া নামলো লুইসের চোখে, আর ওয়াদাম সাহেব? ভালো আছেন তিনি? ডেলাকে এবারের প্রশ্ন। ভালোই প্যারিসের পথে তিনি তো এখন, ভাগ্যবান লোক তো।
ও, তা আমার এখানেই খাচ্ছেন তো আপনারা? হ্যাঁ। সম্মতি দিলো ডেলা। একটা বিশেষ পদ রাঁধবো আজ আপনাদের জন্য। গলা মেলালাম। বেশ। আচ্ছা লুই দেখা হবে পরে। এগোলো ডেলা। আমাদের কি ওখানেই চার বেলা খাওয়ার বন্দোবস্ত? বললাম, লুই বাইরে বেরোতেই। হ্যাঁ, ওইখানেই অন্য দুটোর একটাতে না হয়। অবশ্য পলের সবগুলোই। এরা না জানা পর্যন্ত ওর মৃত্যুসংবাদ আমারও। আমি অতটা ভাবিনি। ডেলা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালো আমার কথায়। আমরা হেঁটে চললাম নিঃশব্দে। মুখ তুলে তাকালাম একটা গাড়ির শব্দে। একটা কভার্টিবল বুইক এসে দাঁড়ালো ক্যাসিনোর সদরে। একখানা গাড়ি বটে–সেদিকে তাকিয়ে রইলাম বিস্ময়ের দৃষ্টিতে। গাড়ি মিশকালো রঙের। হতবাক হয়ে গেলাম গদি, চাকা আর গাড়ির আধুনিকতায়। গাড়ি কেমন? পলের ওটাও। ওটাই ব্যবহার করতে এইখানে থাকতে।
এখন ওটা জনি তোমার। আমি প্রশ্ন করলাম ভাঙা গলায়। তোমারই তো। ডেলার ঠোঁটে রহস্যের হাসি, পাথর চোখ দুটো, তোমারই, অন্ততঃ ছড়িয়ে না পড়ছে যতদিন পলের মৃত্যুর খবর। বাড়লো অস্বস্তি। উত্তেজনাও। একই কথা বলে চলেছে কেন মেয়েটা বারবার? একদম ভালো লাগছেনা আমার ওই সব শুনতে, ডেলা বলতে কি ব্যাপার। কি বলতে চাইছো? কিছুই না, এসো। ডেলা এগিয়ে গেলো গাড়ির দিকে। বসে পড়লো দরজা খুলে। আমি দাঁড়ালাম, দরজায় হেলান দিয়ে, তুমি কিছু বলতে চাইছো, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে। নিরুত্তর ডেলা। শুধু বললো অনেকক্ষণ পরে, জনি উঠে পড়, তাকিয়ে আছে সবাই। চোখ তুললাম ওর কথায়। বিলাসিনীরা আমাদের গিলছে অত্যুৎসাহী চোখে।
বসে গেলাম স্টিয়ারিংয়ে। বেড়াতে যাবো শহরের দিকে। চলো গেটের দিকে। পথ বাতলে দেব রাস্তায় পৌঁছে। হাত দিলাম স্টার্টারে। গেটের দিকে গাড়ি এগোলো, আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি আমি কিন্তু এখনও। ডেলা আমার দিকে তাকালো ভাবলেশহীন মুখে, চোখ ঢাকা গো গো র মুখোসে, বলতে চাইছি না আমি কিছুই। আপাততঃ আমাদেরই এসব, বলতে চাই শুধু এইটুকুই।
না হয় হলো তা, কিন্তু আড়াই লাখের, করছে না তো কোনো সাড়া শব্দ সেটার সম্বন্ধে? কিছুই বলছে না টাকার অঙ্কটা? কেনা যায় বলছো ও টাকায় ক্যাসিনো আর এসব? ডেলা নকল করলো আমার গলা। তবে তা বলছি না, আর এই গাড়িটা–কেনা যায় অনেক কিছু?
একবারও ভেবেছো তোমার কতদিন চলবে আড়াই লাখের অর্ধেক টাকায়? খাটাবো টাকাটা। অন্ততঃ বাঁচা যাবে ভদ্রভাবে। কি মনে হয় তোমার? খাটাবার মত কিছু থাকবে তো গাড়ি, বাড়ি আর ওয়ার্ডরোব কেনার। পোকা আছে তোমার মাথায়, বুঝলাম কুবুদ্ধি খেলছে ডেলার মাথায়। তোমার ওই টাকাটা পেলেই চলে যাবে আমি তো ভেবেছিলাম। ডানদিকের রাস্তা ধরো গেট থেকে বেরিয়ে ডেলা সেলাম নিলো পাহারাদারদের। বলেছিলে কি? পোকা আছে আমার মাথায়?
ও হেসে উঠলো, তোমাকে শুধু একটা কথাই ভাবতে বলছি–কেমন লাগবে তোমার রাইসনার যখন এখানকার মালিক হয়ে বসবে কিছুদিনের জন্য? টাকাগুলো তো পেলাম আমরা, কিন্তু অনন্তকাল চলবেনা তাতে তো, বাড়বেও না দাঁড়াও–দাঁড়াও আড়াই লক্ষ নিচ্ছি আমরা দুজনে মিলে তো–কিছুই না কি সেটাও? আর সিন্দুকেই পড়ে টাকা তো এখনও…
এ–ই লিবার্টি ইন। জো এলসনার মালিক হচ্ছে। এক ডাকে চেনে সকলে মহিলাটিকে বে স্ট্রীটের। করিয়ে দিচ্ছি আলাপ। কিন্তু মনে রেখো জনি–তুমি একজন বিত্তশালীদের দলের। এখানকার সকলে নামে চেনে রিককাকে। দেখলাম এলসনারকে মধ্যবয়সী বিশালকায়া মহিলা, দুশো পাউন্ডের কম নয় ওজনে। এগিয়ে এলো হাউহাউ করে ডেলাকে দেখে। লজ্জা পেলাম কথা বলতে লাগলো এমন ভাবে আমার সঙ্গেও। পীড়াপীড়ি চলল শ্যাম্পেনে গলা ভেজানোর জন্য। বিশেষ মেনু লিবার্টি ইনের। সঙ্গে নাচ, স্ট্রপটিজ অবশ্যই। এলস্নার ন্যাকা হাসি দিলো, সংগ্রহ করা হয় ওদের হাতে হাতে। মুখবদলও হয় সীমান্তে। ওরা আসে দুনিয়ার সমস্ত প্রান্ত থেকে। আজ সন্ধ্যায় আসুননা, দেখার জিনিষ। আমরা জুয়ার আড্ডার দিকে এগোলাম ইন থেকে বেরিয়ে। এখানে জেরী ইট্টার সঙ্গে পরিচয় হলো।
পুরোদমে খেলা চলছে পোকার। ইট্টা জানালো দিন তিনেক আগে এ খেলা শুরু হয়েছে। ইট্টা বললো দাঁতের ফাঁকে সিগারেট নাচিয়ে, আমাদের টাকায় দশ পয়সা। কয়েক হাজার পেয়ে যেতে পারি এ ব্যাপারটায় মনে হচ্ছে। পরিষ্কার বুঝলাম একটা ব্যাপার, ডেলাকে ভয় পায় ইট্টা আর এলসনার দুজনেই।
একই চিত্র অন্যত্র। ডেলা বাইরের দিকে পা বাড়ালো ডজনখানেক লোকের সঙ্গে দেখাশুনার পর।
ফেরা যাক চলো, বসতে হবে নিকের সঙ্গে। উঠে বসলাম গাড়িতে, এ গলিতে মনে হচ্ছে টাকার ছিনিমিনি চলে। চোখ বুজে থাকে নাকি পুলিসের লোক? চোখ খোলে না ওদের সেবা করা হয় বলে; আমার দিকে ডেলা হেসে ফিরলো। সাপ্তাহিক দক্ষিণা পাঁচশো। পুলিস সাহেব হেম। সে টাকাটা পায় রাইসারের কাছ থেকে। তোমারও দেখা হবে ওর সঙ্গে। হেম ভালো মানুষের পো যতক্ষণ না টাকা পাচ্ছে, দাঁড়াবে হাজতের দরজা খুলে।
নেই তো ওয়ার্দাম। চলবে কি করে এ গ্যাড়াকল। বুইক চালিয়ে দিলাম ভীড় কাটিয়ে। মনে হয়না নিকটা সামলাতে পারবে, তাকে খুজছে এলস্নার আর ইট্টা। বেঁকে বসতে পারে যে কোনো মুহর্তে। তাই পরিচয়টা করিয়ে রাখলাম তোমার সঙ্গে ওদের। ডেলা ঠোঁট ঘষতে শুরু করলো অধররঞ্জনীর কৌটো খুলে।
এর আবার কি সম্বন্ধ ওদের সঙ্গে? ডেলার ঠোঁটে খেলে গেলো বিচিত্র হাসি।
জনি অনেক অনেক–রাইসনার বসে একটা বড় টেবিলের পেছনে, সিগারেট পাতলা ঠোঁটে। ধূসর চুলের বেঁটে মানুষটাকেও দেখলাম ওর ডানদিকের একটা আরাম কেদারায়, হিংস্রতার প্রলেপ চওড়া মুখে। উঠে দাঁড়ালো ডেলাকে দেখামাত্র উদার হাসি মুখে আরে মিসেস ওয়ার্দাম যে–খুশি হয়েছি আপনার হঠাৎ আগমনে। অবাকও কম হয়নি। বিস্তৃত হলো হাসি, দেখা প্রায় বছর খানেক পরে, কি বলেন? তারপর আছেন কেমন?
আরো সুন্দর হয়েছে আপনার চেহারা। লোকটা বলে ফেললো অনেকগুলো কথা একসঙ্গে। ডেলা পেলব হাতটা বাড়িয়ে দিলো একটা চটুল হাসি হেনে। লোকটা হাতটা নিজের হাতে একটু বেশীক্ষণই রাখলো। আসুন হাত টেনে নিলো ডেলা আস্তে, পরিচয় করিয়ে দি জনি। রিককার সঙ্গে। মালিক লস এঞ্জেলস ক্যাসিনোর। ডেলা আবার আমার দিকে ফিরলো, জনি–আমাদের অকৃত্রিম হিতৈষী পুলিস ক্যাপ্টেন হেম।
হেম হাত বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে, মিলিয়ে গেছে তার মুখের হাসি। সে আমার হাতটা শক্ত করেই ধরলো, মিঃ রিককা আনন্দ হলো আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। পুলিস সাহেব ঠোঁট কাটার মতো বললো, অনেক শুনেছি আপনার কথা।
ওর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আমিও, জানালাম। রাইসনার ব্যস্ত হয়ে পড়লো এই ফাঁকে ককটেলের বন্দোবস্তে, জিম একটা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে তোমার জন্য, মিসেস ওয়ার্দাম। ডেলার হাতে মার্টিনির গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে বললো সে। খবরটা বলে দাও জিম। হেম আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিলো রাইসনারের হাত থেকে হাইবলের গ্লাসটা নিয়ে। পাওয়া গেছে আপনার গাড়িটা। পেয়েছেন? প্রতিফলন হলো বিস্ময় আর প্রশংসার যুগপৎ ডেলার চোখে। কাজের লোক আপনি, ক্যাপটেন। তুলে ধরলো ডেলার দিকে হেম তার শান্ত নীল চোখ দুটো, খুব শক্ত ছিলো না কাজটা। রিপোর্ট এসেছিলো কাল রাতেই, তারপর সব পরিষ্কার হয়ে গেলো নিক আজ সকালে ফোন করতেই। কি জানলেন?
একটা সংঘর্ষ হয় পেলোট্রার বাইরে গত রাতে দুটো গাড়িতে। ড্রাইভার মরেছে দুটোরই। আপনার গাড়ি চালাচ্ছিলো তাদের একজন–গাড়িটা ছাই হয়ে গেছে একেবারে। অনন্য মুখভার ডেলার অ্যাঁ। ক্ষেপে যাবে তো পল শুনলে।
হু। দারুণ ছিলো গাড়িটা! হেম হাত বোলালো তার ভারী চোয়ালে। আচ্ছা মিসেস ওয়ার্দাম লোকটাকে কেন বলুন তো গাড়িতে তুললেন? রাইসনার আমার দিকে এগিয়ে এলো ডেলা ওর কাহিনীর পুনরাবৃত্তি শুরু করতেই, কি খাবেন আপনি–স্কচ? বলে বসলাম বিনা দ্বিধায়, ওসব চুই না আমি। শুধু খেতে পারি একটু বিয়ার। আমার চোখে আটকে গেলো রাইসনারের কালো চোখ দুটো, স্কচই আপনার প্রাণ আমি তো শুনেছি।
যাঃ। রিককা তো স্কচে হাবুডুবো খায় ভুলে বসে আছি। থেমে গেলো বুঝি বা হৃৎস্পন্দন, আমি নজর দিচ্ছি কিছুদিন শরীরের ওপর, শুধু বিয়ার খাচ্ছি মাঝে মধ্যে। চোখ ফিরিয়ে বললাম রাইসার পড়তে পারলো কিনা জানি না আমার চোখের ভাষা। আমার দিকে একটা বিয়ারের বোতল খুলে বাড়িয়ে দিলো ভাবলেশহীন মুখে। বলে চলেছে হেম তখন, মিসেস ওয়ার্দাম লিফট দেওয়া ঠিক হয়নি উটকো লোককে–কেন যে করলেন এটা।
না, মানে মনে হয়নি কিছু জনি তো সঙ্গে ছিলো তাই। এ প্রসঙ্গে কিছু বলা দরকার আমার মনে হলো।
ধুর আমার কোনো মাথাব্যথা নেই লোকটা কে তা নিয়ে। গাড়িটার কথা আমি ভাবছি। ক্ষেপে উঠবে পলতো শুনলে, বিশেষ করে তৈরী যে গাড়ির অংশগুলো। আমি অবশ্য যোগাযোগ করেছি এ বিষয়ে বীমা কোম্পানির লোকদের সঙ্গে, ওরা রাজী হয়েছে টাকা দিতে। রাইসনার বললো মদের গ্লাসে লম্বা চুমুক মেরে।
ডেলা মিষ্টি করে বললো, ধন্যবাদ নিক। হেম ফিরলো আমার দিকে, ঠিক রাখতে হবেনথিপত্র, তা একটা বর্ণনা দিতে পারেন লোকটার চেহারার রিককা সাহেব? অবশ্য কিছু পেয়েছি ওদের কাছ থেকে পেলোট্রায়, দেখি মেলে কিনা আপনার সঙ্গে। এক বারও তো ভাবিনি এদিকটা সর্বনাশ। এরা কি সন্দেহ করছে আমাকে ফারার বলে? হতবাক রইলাম মুহূর্তের জন্য। নিঃসঙ্কোচে বলে উঠলো ডেলা–মুখ খুলতে যাবো, জানেন মজার ব্যাপার আমাদের জনির মতো লোকটা অনেকটা দেখতে–স্বাস্থ্য ওর মতোই, লম্বা, চেহারা ফর্সা গোছের।
টাই একটা সবুজ–তামাকে মিলিয়ে রং, সাদা লিনেনের স্যুট, আর একটা সাদা রেশমী জামা পরেছিলো যতদূর মনে পড়ছে। ওই ব্যাটাই হবে–হ্যাঁ হ্য, কি জানেন মিসেস, চক্কর খেয়ে পড়ে ছিলাম নিক আর আমি তো, এত মিল রিককার সঙ্গে ফারারের। গোলমেলে ঠেকছিলো ব্যাপারটা–শয়তানটাকে দেখতে অবিকল জনির মতো সাহস পেয়ে গেছে ডেলা।
কিন্তু তা মানছেনা তো জনি, ও কন্দর্পকান্তি ওর ধারণা–ডেলা খিলখিলিয়ে উঠলো। হেমও সঙ্গে। কিন্তু ভাজ থেকেই গেলো রাইসনারের কপালে। উঠে দাঁড়ালো হেম, তাহলে কাজ মিটলো আজকের মতে, চলিহাজিরা দিতে হবে না আপনাদের আর কোর্টে–একটা রিপোর্ট পাঠিয়ে দেবে করোনার সাহেবের কাছে। ফারার গাড়িটা পেঁড়িয়েছিলো গাড়ি রাখার জায়গা থেকে, আর কি বলেন ধরতে পারেন নি আপনি তাকে?
যা ভালো বোঝেন। ডেলা দেখালো ঝকঝকে দাঁতের বাহার। স্বস্তি পাচ্ছি ঝামেলা থেকে বাঁচাতে পেরে আপনাকে, মিসেস ওয়ার্দাম। ডেলার নরম হাতটা চটকালো হেম আর একবার। যদি যান কখনও আমাদের ওদিকে, দেবেন পায়ের ধুলো। দপ্তরের জেল্লা বাড়ে সুন্দরীদের পদার্পণে। হেম মাথা নোয়ালো আমার দিকে ফিরে।
রিককা সাহেব চলি–বেরিয়ে গেলো হেম। অন্যদের জন্য তবুভাবে পুলিসসাহেব, সিগারেট ধরালাম আমি। ওর পেছনেতো অনেক পয়সা যায়, ভাববেই তো
পল একসঙ্গে খাতা দেখতে বলেছে ওকে আর আমাকে। থামিয়ে দিলাম রাইসনারকে। আমার জানার দরকার নেই পল আপনাকে কি বলেছে না বলেছে। ব্যস, কিছু জানায়নি আমাকে।
মশাই দেখুন হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো ডেলা আমি উত্তেজিত ভাবে কিছু বলতে শুরু করতেই, জনি কথা বলোনা তুমি, আমি জানি কি করে করতে হয় এসব ব্যাপারের সমাধান। ডেলা উঠে দাঁড়ালো।
তুমি উদ্ধৃত্ত টাকায় হাত দিয়েছে পলের ধারণা। দেখতে এসেছি আমরা সেটা তুমি পার পাবে না এসব বুকনি দিয়ে। ভালোয় ভালোয় চাবিগুলো দিয়ে দাও। রাইসনার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মাথাটা পেছন দিকে ছুঁড়ে দিয়ে, যেন সে শুনছে খুব মজার কিছু। তা কে অন্ন মারছে, তুমি? মজার ব্যাপার সত্যি–হো—হো শোনো। রাইসনার বন্ধ করলো হাসি, এখান থেকে নড়ছি তবেই, পল যদি আমাকে তাড়ায়, তার আগে না। মস্ত ভুল করেছে যদি সেরকম কিছু ভেবে থাকো তুমি আর রিককা। এটা আমার এলাকা ভুলে যেয়োনা। অসুবিধেই হবে বাড়াবাড়ি করলে। বদলে গেছে রাইসনারের গলার স্বর।
মনে হলো রাইসনারকে মেরেই বসবে ডেলা বুঝি এবার। কিন্তু না, ও সরে গেলো দুপা, মুঠোকরা হাত দুটো, আগুন ঝরছে চোখে, আচ্ছা দেখা যাবে। ডেলা ফিরলো আমার দিকে, খেতে যাই, এসো জনি। ও আর তাকালোনা রাইসনারের দিকে। উঠেদাঁড়ালাম আস্তে আমিও রাইসনার সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিলোকাগজ কাটা ছুরিটা রেখে, বলে উঠলো ডেলা বেরোতেই, আজব চীজ মেয়েমানুষগুলো। সে আগুন দিলো সিগারেটে, তার ব্যতিক্রম নয় ম্যাডামটিও, যাক আপনি বলবেন খাতাপত্র কখন দেখতে চান, এখানেই পাবেন আমাকে সব সময়ে। রাইসনার আপনি ভুল করলেন। পল হিসেব দেখতে বলেছে ওকে। শুনেছি আমি নিজে।
শুনিনি আমি। ঠোঁটের ফাঁকে হাসলো রাইসনার, একটা সিগারেট কেস বের করলো পকেটে হাত ঢুকিয়ে, হা রিককা সাহেব ভালো কথা, এটা পড়ে ছিলো আপনার ঘরে। রেখে গেছে যে লোকটা ঘর পরিষ্কার করে। রাইসনার আমার চোখে তার সন্ধানী চোখদুটো তুলে ধরলো টেবিলে কেসটা নামিয়ে দিয়ে। কেসটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সম্পত্তি ওয়ার্দামের। ছিলো ওই প্যান্টের পকেটে। কেন গেলাম এটা পুষে রাখতে। গাফিলতি আমারই, ধন্যবাদ। রাইসনার সেটা হাত দিয়ে চাপা দিলো। কেসটার দিকে হাত বাড়াতে, আপনার কি কেসটা? মানে? এটা পলের কাছে দেখেছি আমার তো মন হয়, এতে খোদাই করা আছে তার নামও। কি হলো তাতে?
সরে পড়াই ভালো সময় থাকতে ডেলা লাইটারটা সযত্নে নামিয়ে রাখলো একটা সিগারেট ধরিয়ে ও আধশোয়া অবস্থায় সিগারেট টেনে চললো জানলার পাশে একটা ডিভানে। টেনে দেওয়া জানলার পর্দা। নরম আলোর প্রলেপ ঘরে।
টুকরো কথা ভেসে আসছে সৈকতের দিক থেকে ভিড় উপছে পড়ছে বালিয়াড়িতে, কেউ জলে নেই আমরা বিশ্রাম নিচ্ছি খাওয়ার পাট চুকিয়ে পোষাকের বাহুল্য নেই, ডেলারশরীরে রেশমী ওড়না জড়ানো। একটা চিন্তার ছাপ মুখে চোখে, কড়িকাঠের দিকে ধোয়ার বৃত্ত ছেড়ে ডেলা একমনে সিগারেট টেনে চললো।
আমি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে। নষ্ট হয়ে গেছে স্নায়বিক স্থৈর্য সম্পূর্ণ।
ডেলার দিকে চোখ। ডেলা চোখ নামিয়ে আনলো কড়িকাঠ থেকে ধীরে।
কি হলো, পাচ্ছো নাকি ভয়? প্রশ্ন করলো ভ্র তুলে। ব্যাপার ভয়ের নয়, এক ধরনের অস্বস্তি এটা। মানে, তোমাকে নিয়ে কেউ খেলছে তুমি বুঝতে পারছো অথচ। সৈকতে দৃষ্টি মেলে দিলাম জানলার দিকে এগিয়ে।
ডেলা দ্যাখো, আমাদের খেলা খেলেছি আমরা তো, কিন্তু রাইসনার তুরুপ মেরেছে। কাঁচকলা আমি তো কিছুই বুঝি না হিসেবপত্রের। পড়তে পারবে ব্যালান্স শীটটা বড় জোর। কিন্তু তাতে গ্যাড়াকল ধরতে পারবোনা উদ্ধৃত্ত টাকার। আচ্ছা, লোকটা সুবোধ বালকের মতো চাইবামাত্র চাবির গোছ এগিয়ে দেবে তুমি কি করে ভাবলে?
ডেলা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো তার সিগারেটের দিকে, কিন্তু ছাই ঝেড়ে ফেললো পরে, মেঝেয়, তাহলে? চাইছ পালিয়ে যেতে? পথ তো দেখছি না এছাড়া কোন।
ও শালা একটা বর্ণনা চাইবে হোলেনহাইমারকে ট্রাঙ্কে ডেকে, তারপর চুপসে যাবে বেলুন। ছিলোই তো ও ঝুঁকি। আমার মাথায় ওটা খেলেনি তুমি ভাবছো ন্যাকামি করলাম–খেলেছে? জানতাম ও শরণাপন্ন হবে হেলেনহাইমারের–লোকটা তো গাড়ল নয়। এগিয়ে এলাম ডেলার সামনে কিংকর্তব্য তাহলে? আমাদের কি করার থাকছে জানাজানি হলে আমি রিককানই? এতক্ষণে হয়তো–জেনেছে। ডেলাই ধরিয়ে দিলো আমার কথার শেষাংশ। ভাবছিলো ও নিয়ে ভাবনার জরুরী ব্যাপার আছে অনেক বেশী। ভালো তোমার ভাবনা, কিছু নেই আমার ভাবনার। কয়েদখানায় ভাবতে বসতে হবে হেমকে খবর দিলেই। বেচারী! জনি আমার দুঃখ হচ্ছে তোমার জন্য। ডেলা উঠে সোজা হয়ে বসলো।
কেন বুঝতে পারছেনা একটা কথা, আমরা চাপবার চেষ্টা করছি পল মারা গেছে। রাজ্য তছনছ হয় রাজ্যের রাজা মরলে। নীরব দর্শকের ভূমিকা নেবে না আদি ও অকৃত্রিম রিককা আর হেম, ইট্টা জো।
রাইসনার চুপচাপ থাকবে ক্যাসিনোর মালিকানা না পাওয়া পর্যন্ত। হেমকে ভাঙবেনা কোনো কথাই। হেম কেন, কিছু বলবে না কাউকেই। বুঝতে পারছো এখন, নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি আমি কেন?
বসলাম ডিভানের এক কোণে। কিন্তু সুবিধের নয় লোকটা। হয়তো ও মুখ খুলবে না, কিন্তু এখানে জামাই আদরে রাখবে না আমাদের নিশ্চয়ই? ডেলা নাচাতে লাগলো তার মাংসল পা।
না, তার বদলে বুলেট নিতে হতে পারে হয়তো মাথায়। সংগত কিছু আশা করা যায় না রাইসনারের মতন লোকের কাছ থেকে এর চেয়ে। কিন্তু রাইসনার অদ্বিতীয় অ্যাকসিডেন্ট ঘটাতে। কি ভয় পাচ্ছো বুঝি? পাচ্ছি কি? পাচ্ছি হয়তো, কিন্তু করলাম না মুখে প্রকাশ। হচ্ছে না ভয়ের কথা। জানো না তুমি হয়তো, কাজটা খুবই সহজ ওর কাছে। ও দেবে হেমকে কাজে লাগিয়ে। লোকটা সব কিছু করতে পারে টাকার জন্য। আমাকে বিশ্বাস করতে বোলোনা এটা অন্ততঃ। খুনের ব্যাপার চেপে যাবে। বলছি না তা। আমি বলছি অ্যাকসিডেন্টের কথা। পায়চারি শুরু করে দিলাম উঠে ঘরময়। অশান্ত হয়ে উঠছে মনটা আমার। কি চাইছো তুমি বলত? ইঙ্গিত করে যাচ্ছে শুধু তখন থেকে। ব্যাপারটা খুলেবলোত, কিছুরইঙ্গিত করছিনা। পরিষ্কার করে দিচ্ছি একটা রাজত্বের উত্তরাধিকার লাভ করার পথ। এটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে কি তোমার যে বে স্ট্রীটের আর ক্যাসিনোর পয়সা–তোমার আমারও। পারছি না, কি করে? ভয় হচ্ছে ওর চেহারায়। শোনো, তুমি এই ক্যাসিনো দিব্যি চালাতে পারবে আমি সঙ্গে থাকলে আমাদের পয়সা রোজগার হবে দু হাতে।
রাইসনারের মন পড়তে পারবো না তোমার কি ধারণা। এতো মোটা আমার মাথা? আবার অশুভ ছায়া পড়লো মনে, ও ব্যাপারটা এই তাহলে? আর এতদূর টেনে এনেছো আমাকে এর জন্য?
বলছি তাইতো– পা নামিয়ে ডেলা উঠে পড়লো কোমরের একটা ভঙ্গি করে, তোমাকে এখানে এনেছি দেখাবার জন্য পরিকল্পনা ব্যাপারটা। তুমি গিলেছে টোপ, চেয়েছিলে টাকা–তোমার চোখের সামনে টাকা।
কত নেবে নেওনা। একটু সাহস শুধু। ধরালাম সিগারেট, কাঁপছে আঙুল। জানি না উত্তেজনায় না ভয়ে, ওই সোয়া লক্ষের ব্যাপারটা তাহলে বলছে কিছুই না ওটা?
ওমা, তা কে বললো–ঠিকই আছে সেটাতো। কিন্তু এখুনি তো বেরোনো যাচ্ছেনা ওটা নিয়ে। দখল করে ক্যাসিনো, হাতে এসে যাবে উদ্ধৃত্ত টাকাও।
হাসি পেল মানসিক অস্বস্তির মধ্যেও, আর রাইসার? শিস মারবে সে কি হাত গুটিয়েনা। এগিয়ে দেবে চেয়ারের ধুলো ঝেড়ে? মাথায় গুলি ঢুকবে একটু আগে তো বললে! আমি শুধু। বলতে চাইছি একটা কথাই, তা হচ্ছে সাহস থাকলে তোমার।
অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে রাইসনারের। এবার জানা গেলো সব। আমার আন্দাজ করা উচিৎ ছিলো আগেই এরকম কিছু একটা ঘটবে কারণ ডেলার সব কথার মর্ম তো একই সারা সকাল থেকেই।
পড়ে গেছে দাবার দান, যাবে না, ফেরানো আর। ঘষে দিলাম সিগারেটটা ছাইদানে। তাকাতে পারছি না ডেলার মুখের দিকে। সরিয়ে দিতে হবে রাইসনারকে। ডেলার আশ্চর্য শান্ত গলা। বে স্ট্রীট আর ক্যাসিনো আমাদের।
আর কিছুই করার থাকবে না যখন রিককা মঞ্চে উপস্থিত হবে। ওকে আমাদের সঙ্গে হাত। মেলাতেই হবে টাকাকড়ি আর খাতপত্রের দখল নিতে পারলে আমাদেরই থাকবে লিঙ্কন বীচ। রিককা থাকতে পারে লস এঞ্জেলস নিয়ে। লেভিনস্কী তার জায়গায় থাকবে প্যারিসে।
স্বার্থকতার প্রান্তরেখায় আমাদের জীবন–আমার কাছে সরে এলা ডেলা আর একটু, নাকে আসছে চুলের সুবাস। কালো হরিণ চোখে তাকালো আমার কাঁধে হাত রেখে। জনি বলল কি করবে?
কি করবো আমি জানি। ডেলা একটা ভুল করেছে নিজের অগোচরে। বেরোনো অসম্ভব এখানে থেকে ওর ধারণা, কিন্তু নয় তা।
যাইহোক আপাতত থাকতেই তো হচ্ছে আমাদের। আমার এক উদগ্র ইচ্ছে এসব দখল নেবার–কিন্তু নিশ্চয় ওই মূল্যে নয়, তুমি বলে ছিলে না অ্যাকসিডেন্টের কথা? ওটা হবে না। অ্যাকসিডেন্টে হবে খুন। যেন অজন্তার ভাস্কর্য ডেলার মুখ।
হয় রাইসনার না হয় তুমি তোমাদের মধ্যে সেই জিতবে যে অন্যকে বাগে পাবে।
রাইসনার তোমার কোমরে চেম্বার ঠেকাবে তুমি রিককা নও জানতে পারলে। খুন হবে না তখন আর সেটা আত্মরক্ষা হবে–কি বলল? ছেলে খেলার কিছুই নেই এনিয়ে, এটা খুনই হবে। ডেলা জানলার বাইরে চোখ মেলে দিলো আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে, বলা যাবে তাই হেমকে। ~
ডেলা বললো আমার দিকে পেছন ফিরেই। বলবোউদ্ধৃত্ত টাকায় হাত দিয়েছে রাইসনার, আমরা দেখতে এসেছিলাম খাতাপত্র। রাইসার ধরাও পড়লো কাজেই করে আর কি? সম্মান বাঁচিয়েছে জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে। বিশ্বাস করবে হেম কি সেকথা! সুইসাইড পার্টি নয় নিক শালা। করবে, চাদির জুতো মারলেই করবে।
দখল নাও তুমি ক্যাসিনোর জনি। শুধু একটা ধাক্কা রাইসনারের গলায়, ব্যাপারটি কি খুব বেশী মনে হচ্ছে? বুঝি না অতসব, বলেছি খুন করবো করবো তাই। ভাবছি না সে জন্য বিনিময়ে কি পাচ্ছি। ডেলা আমার দিকে তার একটা হাত বাড়িয়ে দিলো ডিভানে বসে। জনি এসো, বোসো এখানে আমার দিকে তাকিও না ওরকম চোখে। তুমি–ভালোবাসো তুমি আমাকে, তাই না? ডেলা প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো শেষের কথাগুলো।
ভালবাসায় মারা গোলি–শোন–আমাকে মনে করতে পারো তৃতীয় শ্রেণীর মুষ্টিক, কিন্তু গিলছিএই পরিকল্পনা দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ওয়ার্দামের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে। ডুববেরাইসনারকে না সরাতে পারলে এখন দেখছে আমাকে বেছে নিলে ওকে খতম করার জন্য। দেখিয়ে দিয়ে জায়গাভাবছে কাজ উদ্ধার করবে নাকের ডগায় একটা গাড়ি ভিড়িয়ে।
থামালাম, ভুল করছে ডো তুমি–তুমি তো জানোনা খুনের মাশুল সারা জীবন তোমাকে বয়ে বেড়াতে হবে মৃতের অভিশাপ কুড়িয়ে। আমাদের বাকি জীবনটা এই লিঙ্কন বীচেই থাকতে হবে হেমের মুখ বন্ধ করতে পারলেও।
সুখ থাকবে না আমাদের মনে। নিয়ত মনে পড়বে শুধু একটা কথাই…হত্যাকারী আমরা রাইসনারের। আর, মুখ বুজে থাকবে না হেম চিরদিনের জন্য। সিগারেট বের করলাম পকেট হাতড়ে, সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ে রইলাম না নেভা পর্যন্ত জ্বলন্ত কাঠিটার দিকে, ও দিনের পর দিন টাকা চেয়েই চলবে, হয়তো একদিন চাইবে ক্যাসিনোর মালিক হতেও।
তারপর একদিন তোমার মনের মানুষ হয়ে বসবে আমার ঘাড়ে, খুনের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে…না…না আমি নেই ওসবে। এখনো খারাপ হয়নি আমার মাথা…আমি নেই খুনের ব্যাপারে। তোমার জন্যেও না, তাবৎ টাকার বিনিময়েও নয় ক্যাসিনো বা সারা লিঙ্কন বীচের। ভাবের কোনো, প্রতিফলন নেই ডেলার চোখেমুখে। পা নাচাচ্ছে বসে। ও উঠে দাঁড়ালো কিছু পরে। এগিয়ে এলো এক পা আমার দিকে। বিশ্বাস করো না তুমি ওসব, সোনা। ও হাতে হাত জড়ালো আমার, সব দিয়েছি তো আমি তোমাকে ভালবাসি বলেই। ফিরিয়ে দিতে পারিনি কালরাতে তো তোমাকে বিপদ আছে জেনেও।
ডেলা জড়িয়ে ধরলো আমার গলাটা–শোনো পাগল করেছো তুমি আমাকে। কখনো দেখা দেয় নি আমার জীবনে তোমার মতো মানুষ।
তোমায় বিশ্বাস রাখতে হবে আমার ওপর, তাই ঠিক তুমি যা বললে নিক সম্পর্কে, কিন্তু বলো কি করবো। ওর ঠোঁট চেপে ধরলো আমার ঠোঁট, কথাগুলো মৃদুস্বরে বলে।
সরাতেই হবে ওকে। নইলে ওই সরিয়ে দেবে আমাদের। কিছু পাবো না আমরা, বোধ হয় বেরোতেও পারবোনা প্রাণ নিয়ে। পারলামনাকথাবলতে। ভাসিয়ে দিলো আমার সবকথা ডেলার ঠোঁটের উষ্ণতা। ওই অবস্থায় রইলাম আমরা অনেকক্ষণ। উত্তাল আমার রক্ত। জনি–আমার বুকে আরো চেপে ধরলো ডেলা তার শরীরটা। চোখবুজে আছি আমি…অকিঞ্চিতকর মনে হচ্ছে আমার কাছে দুনিয়ার আর সব কিছুই..শুধু আমি আর ডেলা..হাত ডুবিয়ে দিলাম ওর নিতম্বের শক্ত মাংসের গভীরে। আর্তনাদ করে উঠলো একটা অস্কুট..খুলে গেলো ওর ঠোঁট। হয়েছে অনেক, শেষ হলে ভালো হয় এবার ব্যাপারটা। আমার কানে বিষ ঢেলে দিলো রাইনারের নরম গলা। স্থানকাল আছেসব কিছুরই। পাথর যেন ডেলা, তার রক্তশূন্য মড়ার মুখ। তাকালাম ঘুরে, দরজায় দাঁড়িয়ে রাইসনার। সেই হাসি ঠোঁটে, অনেক বড় দেখাচ্ছে হাতের ৪৫ অটোমেটিক পিস্তলটা।
নড়াচড়া চলবে না কোনোরকম। রাইসারের সংযত গলা, পিস্তলটা বাড়িয়ে দিলো একটা আরাম কেদারার দিকে।
বসো ফারার, মিসেস ওয়ার্দাম তুমিও ওই ডিভানটায়। ডেলা হাত ছেড়ে দিলো। মেয়েটা হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে ভয় হলো।
আসলাম আমি। কেমন একটা অস্বস্তি গলায়, কেশকষ্টহচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে। রাইসনার দরজাটা বন্ধ করে দিলো পা দিয়ে ঠেলে, এগিয়ে এলো কয়েক পা ঘরের মধ্যে। বেশ জমেছে দেখছি লীলা–তোমরা জানো বটে মজা করতে!
বুঝলাম খালি দেখে কেবিনটা। রাইসনার ঘুরলো আমার দিকে, আগুন ভয় হিংস্র চোখে, কি। করেছে ওয়ার্দামকে? নিরুত্তর আমরা। রাইসনার একটা চেয়ার টেনে বসলো কনুই দিয়ে। মারা। গেছে কিও, না দিয়েছে শেষ করে? ডেলার অবস্থা হলো দাঁতকপাটি লাগার, মাথা খারাপ হয়েছে। কি তোমার? এখন প্যারিসের পথে ও তো। বলল, নরকের।
এবার শব্দ হলো হাসির, কাঁচা কাজ করে ফেললে এরকম একটা। সন্দেহ হয়েছিলো মহাপ্রভুর প্রথম দর্শনেই কারণ লস এঞ্জেলস থেকে লিফনবীচে এতটা রাস্তা আসতে দিতে না পল, পেছনে লোকনা লাগিয়ে–পল এটা আমার চেয়ে বেশী জানেতুমি যে মুহূর্তে মুহূর্তে রূপ পালটাও নাকি জানতো–কি বলবো?
ক্ষেপে উঠলো ডেলা, তুমি কোত্থেকে পেলে এভাবে কথা বলার স্পর্ধা আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো রাইসনার ওকে, তোমরা গাড়িতে তিনজন ছিলে, তোমাদের মধ্যে একজন মরেছে রাইসনার বসলো পা মুড়ে। রিককা নয় এ লোকটা, ফারার তাহলে! ওয়ার্দাম মরেছে। কি বলল, ভেস্তে গেলো সব তাহলে? মুঠো হয়ে গেলো হাঁটুর মধ্যে ডেলার হাত দুটো, নিক একটা বুদ্ধি করি এসো আমরা এই তিনজন। আমরা ছাড়া কেউ জানে না পল যে মরেছে। অর্ধেক ভাগ দাও আমাদের দুজনকে। আমরা লেগে যাচ্ছি কাজে। আমার নখদর্পণে পলের অনেক ব্যাপারই তো। আশাকরি আমরা সাহায্য করতে পারবোফ্যাসিনোর কাজে। রাইসার একবার দেখেনিলো আমার দিকে বিস্ময়ভরা চোখে! আসছে কি করে এ লোকটা এর মধ্যে? ভাবতে যাবো কেন এরজন্য!
স্থির হাসি ঠোঁটে, পল ছিটকে বাইরে পড়ে যায় আমাদের গাড়িটা সংঘর্ষে পড়ার পর, ভেঙে যায় তার ঘাড়–তোমাদের গল্প ওটা তো। হাসছে রাইসনারও। ধরো ওকে খুন করেছে তোমরা দুজনে আমি ভাবছি? যদি চালান দেবার ব্যবস্থা করি খুনের দায়ে দুজনকেই?
হেম শালা তো তোমাদের ঝুলিয়ে দেবে দুটো বড় পাত্তি পেলেই–ইদানীং টাকার দরকার হয়ে পড়েছে বেশী ওর আবার। বরফ মেরে গেলাম আমি। শুধু কানে এলো ডেলার কথা, কিন্তু তাতে তো চাপা থাকবে না ওর মরার খবরটা। তা বটে করা যাবে আর কি। আচ্ছা, শোনো আমি চিন্তা করছি কি ভাবে ব্যাপারটা। তোমাদের কথা শুনলাম আমি আড়ি পেতে। জানলাম মেরেছে পলকে তোমরা। ফারার বন্দুক তুললোআমি ঢুকতেই। আমি গুলি করে দিলাম তার আগেই। নিভে গেলো রাইসারের হাসি, হেম জানে আমি কত দ্রুত সারতে পারি এসব ব্যাপার। বন্দুক তুললে তুমিও, আর পড়লে একই অবস্থায় প্রস্তাব দিলাম হেমকে একটা মোটা ভাগ ক্যাসিনোর।
জো আর ইট্টাকে থানায় আটকে রাখবে একটা অজুহাতে সমস্ত ব্যাপারটা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত। তার পর কাম ফতে মালের সাগর সাঁতরে উঠে আমার আগেই রিককা সাহেব। কি রকম?
ঢোকাচ্ছো কেন হেমকে এর মধ্যে? হাঁড়ি চড়িয়ে বসে থাকবে ওতো, সব সময়–ঝুঁকে বসলো রাইসনার চিন্তার ছায়া চোখে।
তাই হয়তো, কিন্তু বেরোবার একটাই রাস্তা এই ছেঁড়াঝাট থেকে। রাস্তা আছে আর একটা, ছন্দোবদ্ধ ডেলার গলা। কি? ডেলা ফিরলো আমার দিকে রাইসনারের দিকে তারপর–আদিম প্রবৃত্তি তার চোখে।
মেরে ফেললাম আমরা তোমাকে, নিরাপদ পন্থা সেটাই সবচেয়ে। আমাদের সেই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিলো তুমি ঢোকার আগেই। রাইসনারের ঠোঁটে ম্লান হাসি ফুটলো। অতলাক্তশীতল চোখ দুটো। হুঁ, শুনছিলাম, সেই জন্যেই তো ভালো মনে হচ্ছে আমার পরিকল্পনাটা। কিন্তু নিশ্চয়ই সেফটি ক্যাচ লাগানো অবস্থায় নয় বন্দুকে। কাজ হলো ওর কথায় এমন কি আমিও রাইসনারের সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে আনলাম। ডেলা রাইসনারের মুখ লক্ষ্য করে নিপুণ হাতে দ্রুত ছুঁড়ে মারলো পাশ বালিশটা। আর নিজেই রাইসনারের বন্দুক শুদ্ধ হাত চেপে ধরলো লাফিয়ে উঠে। বন্দুকের ঘোড়ায় আঙুল না বেরোয় গুলি। রাইসনারের হাতটা নেমে আসার আগেই আমি সপাটে ঘুষি চালালাম রাইসনারের চোয়ালে। নেমে গেলো ওর হাত। রাইসনার সরে গেলো দু পা ছিটকে। শক্ত করে ধরে আছে ডেলার হাত। আর একটা জমালাম দেওয়ালে মুখ থুবড়ে পড়ার মুহূর্তে। পড়ে গেলো রাইসনার।
জগ হয়ে গেলো চুরমার। গেলো টেবিলটাও। মেঝের কাপেট ভরে গেলো ফুলে আর জলে। জলে ভরে গেলো ডেলার মুখ চোখ। ওর গলা থেকে উঠলো একটা মৃদু আর্তনাদ কিন্তু হাতছাড়া করেনি বন্দুক। থরথর করেকাঁপছে। পাশাপাশিদাঁড়িয়ে আমরা, পড়ে আছে রাইসনার। কড়িকাঠের দিকে তার চোখদুটো–ওর ডান চোখটার ভিতর ঢুকে গেছে জগ থেকে কাঁচের একটা টুকরো।
ফাঁক হয়ে গেছে ঠোঁট দুটো, খিঁচিয়ে আছেদাত। চোখেমুখে যুগপৎ স্বাক্ষর ভয় আর যন্ত্রণার। ঘুষির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ডান গালটা। রাইসনারের একটা ভয়ঙ্কর চেহারা। ডেলা কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো আমার, কানে আওয়াজ পাচ্ছি ওর দ্রুত নিঃশ্বাসের।
দুজনেই অনড় আমরা, দেখছি রাইসনারকে। প্রাণ নেই ওর দেহে। যেন চলচ্চিত্র–প্রক্ষেপক যন্ত্র চলছে মাথার ভেতর মনের পটে অতীতের প্রতিবিম্ব।
উঠে দাঁড়ালো ডেলা রক্তের ছোপহাতে। আমি হতভম্ব সেদিকে তাকিয়ে। জনি, আমার চোখে ডেলা তাকালো; আমি খুন করেছি ওকে।
থাকো ঠিক জনি। কানে এলো ডেলার তীক্ষ্ণকণ্ঠ, কেউ জানে না আমি আর তুমি ছাড়া এই ব্যাপারটা। চেয়েছিলাম এই তো। মনে পড়লো রাইসনারেরকথা, সেও একই কথা বলছিলোপলের মৃত্যুতে। যা হোক ভালো জুটি। কি সব প্রার্থনা। কিন্তু পালাতে হবে তার আগে। ডেলা এক পা এগিয়ে এলো আমার দিকে, কথা বোলোনা হাঁদার মতো। এই চেয়ে ছিলাম আমরা তো সার্থকতা ছুঁয়েছে আমার পরিকল্পনা। নেই রাইসনার, ক্যাসিনোর মালিক আমরাই। বাধা দেবার আর কেউ নেই। বিজয়ের এক আশ্চর্য প্রতিচ্ছবি ডেলার কালো চোখে। আহ্বান কামোন্নত ঠোঁটে। শুধুই জয়ের আনন্দ, চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। একটা চাপা উত্তেজনা প্রচণ্ড ঝাঁকানি দিলাম ওর হাত ধরে, তুমি তো হাদা! মেরে ফেলেছি আমরা ওকে।
তাড়া করে ফিররে ওরা তো আমাদের। আমাদের রেহাই নেই এর থেকে। ওরা লাশ পাবে রাইসনারের। ডেলা হাত চাপা দিলো আমার মুখে জনি প্লিজবসো চেঁচিয়োনা তো। ঠিক হয়ে যাবে সব–রাখো একটু সাহস। আমি সব সামলে নেব…রাইসনারের লাশটা পেছন করে বসে পড়লাম। মানলাম, ঠিক আছে ঠিক হয়ে যাবে সব–কিন্তু মেরে ফেললাম লোকটাকে তো, কি করবে তার? তাকাও ওর মুখের দিকে, কি করতে হবে বুঝবে। আমি পারছি না তাকাতে, বললাম ডেলার দিকেই চোখ রেখে।
খুলে বলতে কি বলছে আর পারবো না তোমাকে নিয়ে। আচ্ছা, অনুভূতি নেই কি তোমার কোনোরকম, পারছে কি করে ওর দিকে তাকাতে? ডেলা আমার কাছে সরে এলো ডিভানের পাশ দিয়ে, হয়তো মনের জোর বেশী বলেই তোমার চেয়ে আমার। কেন?
তোমার কাছে কাজটা কি অন্যায় মনে হচ্ছে? দ্যাখো ভেবে, মারতে যাচ্ছিলোও তো আমাদের। তুমি শুধু ওকে মেরেছে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে তাও নিশ্চয় খুনের উদ্দেশ্যে নয়। থাকে কি সহানুভূতি ওর জন্য? নির্ভেজাল খুন এটা। অহর্নিশি তাড়িয়ে ফিরবে আমার মন, বিষময় করে তুলবে আমার হতভাগ্য জীবনটাকে। যেতে দাও সাতটা দিন ঠিক হয়ে যাবে সব। ভুলে যাবে সব। কিন্তু যদি সামলাতে না পারে নিজেকে, আর সাহায্য না করো যদি আমাকে। তাহলে ঝুলতে হবে ফাঁসিকাঠে দুজনকেই।
ভীতুর ডিম কোথাকার, ভাবছো না কেন একবারও এটা। ফিরে তাকালাম রাইসনারের মুখের দিকে। বীভৎস! ডেলা কাঁচের টুকরোটা বের করে নিলো রাইসনারের মুখের ওপর ঝুঁকে। হতবাক আমি আমার ঘটনাবহুল জীবনে দেখিনি এরকম ভয়ানক দৃশ্য। ঘাম ঝরলো আমার শরীর বেয়ে, বরফ যেন। ডেলা বসে গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে টুকরোটা হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর ফাঁকে। ডেলা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে কুঁচকে।
তারপর রাইসনারের ক্ষতবিক্ষত মুখের দিকে তাকালো। এরকম চেহারা হওয়া সম্ভব জন্তু জানোয়ারের টানা হেঁচড়ায়। আর সকলকে বোঝাতে হবে তাই। আমার দিকে তাকালো ডেলা চোখ তুলে। খুঁজছিলেন পালাবার রাস্তা পেয়ে গেলে এই তো–ফেলে দিয়ে এসো এক সিংহের মুখে, হিসেব সোজা।
খাওয়ার তদ্বির করতে জানোয়ারগুলোর রাইসনার যেতো খাঁচারকাছে। হতেই পারে দুর্ঘটনা। সবাই জানে এটা। জানে হেমও। এটা ধোপে টিকে যাবেআমরা ভুলের বোঝানা বাড়ালে। থামলো ডেলা। আমি কিন্তু একদৃষ্টে তাকিয়ে ওর দিকে। পরে বললাম অনেক, তোমার মাথা থেকে বেরোলো এটাও কি এখন? হ্যাঁ, তাকাও ওর মুখের দিকে, মনে হবে তোমারও তাই। মাকড়সার পায়ের অনুভূতি হলো আমার শিরা বেয়ে আবার। সৃষ্টি করতে পারব ডেলা। ওর মাথা খোলে যে কোনো অবস্থায়। ঠাণ্ডা মেরে যাওয়ার আগেই ওয়ার্দামের শরীর, ওর মাথায় খেলেছেক্যাসিনো দখলের ভাবনা, আর এখনো শুকোয়নি রাইসনারের মুখের রক্ত, বের করে ফেলেছে ও তার অপঘাত মৃত্যুর ব্যাখ্যা নির্ভুল চালই হবে সবার অলক্ষ্যে গুহায় ফেলে আসতে পারলে ওর লাশটা। জনি আছে তো সব ঠিক? ও তুলে ধরলো কালোচোখ রক্তের দাগ ওর আঙুলে। ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দরী পিশাচিনি।
ঠিক আছে কেউ না দেখে ফেললে–এতক্ষণে নিতে পারছি স্বস্তির নিঃশ্বাস। থেমে গেছে বুকে হাতুড়ির ঘা। কিন্তু কিছুই করা যাবে না অন্ধকার না নামলে। না, আচ্ছা, একবার দাঁড়াও তো উঠে। দাঁড়ালাম দেখি হাত দুটোখুটিয়ে দেখলো ডেলা। কোথাও রক্তের চিহ্ন নেই আমার শরীরে।
ঠিক আছে শোনো–বেরিয়ে পড় বাইরে ঘোরাফেরা করো সকলের সামনে। খেলে নিতে পারো একটু গলফ–ও, আরো ভালো হয় কাউকে খেলার সঙ্গী করতে পারলে। ফিরবে না মাঝরাতের আগে। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে রাইসনারের কথা সে আছে আমার সঙ্গে তা বোলো। বসেছে কাজে চলবেনা তাকে বিরক্ত করা, বেরিয়ে পড়। গল কেউ খেলতে পারে এরকম মনের অবস্থায়?
বলো তো তোমার কি হয়েছে? কিছুই ভাবতে পারছে না স্বাভাবিক ভাবে?
তোমারই হয়েছে কিছু, যদি হয়ে থাকে তো সাঁতার কাটো, গলফ যদি খেলতে না পারো তো, বেড়াও ঘুরেফিরে। যেতে পারো বারেও করো যা খুশি। এখান থেকে বেরোও মোদ্দা কথা। দর্শন দাও ওদের। একটু ভাবলো ডেলা, ঘেঁষতে দেবেনা এখানে কাউকে। জেনো এটা তোমারই কাজ। তো এতক্ষণ কি করবে তুমি? বললাম লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে। ডেলার ঠোঁটে সেই ভয়াবহ হাসি খেলে গেলো, কোথায় যাবো আমি আর–ওর কাছে এখানেই থাকবো। বসে পাহারা দেবো।
এই ন ঘন্টা ধরে! মরে যাবো না তাতে তো আর। আর ভাবতে হবে তো ভবিষ্যতের ভাবনা। আমার ভয় করবেনা ওর সঙ্গে একা থাকতে, গেছে তো মরেই। আমি তো বেরিয়ে যেতে পারলে বাঁচি এই ভুতুড়ে পরিবেশ থেকে, ডেলার কাছ থেকেও। আমি এই লাশ আগলাতে পারবো না পৃথিবীর সমস্ত টাকার বিনিময়েও। এগোলাম দরজার দিকে। জনি–কি? ফিরলাম। রাইসনারের জুতো মোজা দেখতে পাচ্ছি চোখের কোণ দিয়ে। চোখ ফিরিয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি।
বিশ্বাস থাকা দরকার আমাদের পরস্পরের মধ্যে, জনি। মনে হচ্ছে ডেলাকে মর্মরমূর্তি। পালিয়ে যেয়ো না যেন ভয় পেয়ে। একা সামলাতে পারবো না আমি তুমি পালিয়ে গেলে। আমার দরকার তোমাকে। না, যাবো না। কোনো রকমে বললাম বিকৃত গলায়। বিশ্বাস করতে পারলোনা কথাটা ডেলা বোধহয়, অনেক সময় ন ঘন্টা, কাজেই সামলানো কঠিন পালানোর প্রলোভন। শোনো, সেক্ষেত্রে হেমকে খবর পাঠোবো সঙ্গে সঙ্গে আমি কিন্তু জানিয়ে দেবো রাইসনারকে তুমি খুন করেছে। হেম বিশ্বাস করবে আমার কথা। পালাবো না বললাম তো। ডেলা উঠে আমার দিকে এগিয়ে এল।
আমাকে আদর করলো তার পুরনো কায়দায়। আজ আর আমার রোমাঞ্চ হচ্ছেনা ওর স্পর্শে। ভয় হচ্ছে কেমন।
আমাকে ভালোবাসতো তুমি এখনোনা, জনি? বাকি জীবনটা এই কাজটা মিটে গেলেই আমাদের জীবন নিশ্চিন্ত নিরবচ্ছিন্ন। আমার শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছে সব কিছু ছাপিয়ে আমার গলায় একটা রক্ত রাঙা হাতের স্পর্শ। পারলাম না, ওর হাতটা চাইলাম সরিয়ে দিতে। ডেলা বিপদজনক সাপের মত। দিলাম ঠোঁটে ঠোঁট–আজ অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে ওর উষ্ণ ঠোঁটের আত্মসমর্পণ। অস্বস্তিটুকু বাড়ালো একটা মৃতদেহের উপস্থিতি। থাকবো তোমার অপেক্ষায় আমি, আমার ঠোঁটে চেপে আছে ডেলার ভারী ঠোঁট।
শিহরণ তুলেছে আমার গালে ওর তপ্ত নিঃশ্বাস। জনি সাহস রাখো মনে ঠিক হয়ে যাবে সব। বেরিয়ে এলাম বাইরে। ক্ষিপ্ত লিঙ্ক বীচ; প্রচণ্ড গ্রীষ্ম–অপরাহ্নে। একক নরক যন্ত্রণা সামনে ঝাড়া নটি ঘণ্টা উন্মত্ত আগ্রহ মনে একটাযতদুর দু চোখ যায় ছুটে চলে যাই…ছুটে চলবো শুধু। ডেলা যে কুটির আগলে বসে আছে রাইসনারের লাশ। অনেক সেখান থেকে অনেক দূরে…দুস্তর ব্যবধান থোক কিন্তু জানি আমি…পারবনা পালাতে পাতা আছে ফাঁদ…আমার মুক্তি নেই এ থেকে।
ঘরে ঢুকে গলা পেলাম বেয়ারার না, মিস বারে নেই উনি–ওকে দেখিনি লাঞ্চের পর। হ্যাঁ, একটার সময়, না, দেখিনি–তারপর…। সিগারেট পিষে দিলাম ছাইদানে। দপদপ করছে কানের পাশে শিরাগুলো।
হ্যাঁ, নিশ্চয়–বলবো দেখা হলে। বেয়ারা ছেড়ে দিলো টেলিফোন। শুরু হয়ে গেছে রাইসনারের খোঁজ। এখুনি করা দরকার একটা কিছু–ডেলার নির্দেশ লোকজন তফাতে রাখতে হবে কুটির থেকে। শুরু হলো খোঁজাখুজি..অ্যাই শোনোহাঁক দিলাম বেয়ারাটাকে। স্যার, টেকো দাঁড়ালো পর্দা ঠেলে। ফোন করেছিলো কে?
রাইসনার সাহেবের সেক্রেটারি মিস ডোয়েরিং। ওকে ডাকছিলেন জরুরী ব্যাপারে। লোকটা হাতদিলেটাকে। স্যার, জানেননাকি উনি কোথায়? জানি আমার মানসপটে ভাসছে একটা ছবিই। ওর নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে একটা মানুষ চিৎ হয়ে পড়ে থাকা, মুখ ক্ষতবিক্ষত ঢুকে গেছে একটা কাঁচের টুকরো ডানচোখে। থেমে গেলাম গ্লাসে পানীয় ঢালতে গিয়ে। ঢালতে সাহস হচ্ছে না এ ব্যাটার সামনে। কেঁপে উঠতে পারে হাত। যান্ত্রিক গলায় বললাম ওর দিকে না তাকিয়ে, রাইসনার একটা কাজে বসেছেমিসেস ওয়ার্দামের সঙ্গে না করাই ভাল এখন বিরক্ত। আমার কথা বলার ভঙ্গিতে লোকটা পাথর হয়ে গেলো। কথাটা ওঁকে ডেকে বলে দাও।
মিসেস ডোয়েরিং না কে, স্যার বলছি। দাওয়াই বেশী পড়ে গেছে ওর গলার স্বরে বুঝলাম। সে অদৃশ্য হয়ে গেলো মুহূর্তে আবার বোতল ওল্টালো গ্লাস ভরতে গিয়ে মিঃ রিককা বারে আছেন ওর কথা কানে আসছে। বলছেন উনি রাইসনার সাহেব নাকি কি একটা জরুরী ব্যাপারে কথা বলছেন মিসেস ওয়ার্দামের সঙ্গে। এখন চলবে না বিরক্ত করা। হ্যাঁ ম্যাডাম অ্যাঁ? বললেন কতটা জরুরী জানার দরকার নেই।
আজ্ঞে, ঘাম মুছলাম রুমাল বের করে–থাক হলো তো কিছু কাজ। বাড়াবাড়ি–হলো একটু, তাহলেও এদিকে তো শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে স্কচের কাজ। পেকে এসেছে নেশাও। বোতলে ছিপি এটে দিলাম অনিচ্ছায়। ডেলার নির্দেশ দাঁড়াতে হবে জনতার মাঝে গিয়ে। বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম বাইরের খোলা জায়গায়। কমেছে রোদ। রয়েছে গাড়িটাও, গাড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম শুধু দরজা খুলে স্টিয়ারিংয়ে বসে।
নেমে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে, অজানা গন্তব্য…কিন্তু চলবে না পালানো। থমকে দাঁড়ালাম একটা বিরাট আওয়াজে। মাটি কাঁপানো, গভীর কণ্ঠনিসৃত নিনাদ, গর্জন সিংহের–পাতলাম কান…চিড়িয়াখানার পথে পা বাড়িয়েছি কখন যে জানিনা–আমাকে পেয়ে বসলো একটা বিদঘুঁটে ভাবনা ভেসে উঠলো একটা ছবি বয়ে নিয়ে চলেছি সিংহের গুহায় রাইসনারের ক্ষতবিক্ষত দেহটা। শুরু হল কাপুনি–তাকালাম পেছন ফিরে গাড়ির খোলতাই বেড়েছে সূর্যের আলোয়। তাহলে কেন আর দেরি, দাঁড়িয়ে পড়লাম। বেরিয়ে পড়তে হবে এখান থেকে…সাত ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট সময় এখনও আমার হাতে পাড়ি দিতে পারি চারশো মাইল পথ এই সময় আমি অনায়াসে…আমাকে ওরা খুঁজুক–আমার স্নায়ুগুলোকে নিস্পৃহকরে দিয়েছেসিংহের গর্জন…গভীর রাতে আঁতকে উঠলাম একটা ভয়াবহ দৃশ্যের কথা স্মরণ করে।
ফিরে চললাম গাড়ির দিকে। স্টার্টারে হাত দিলাম দরজা খুলে স্টিয়ারিংয়ে বসে। তাকালাম বাইরে না নেই কোনো প্রতিক্রিয়া। কেউ দাঁড়ালো না পথরোধ করে। বুইক এগিয়ে চললো মসৃণ গতিতে…বাড়ছে গতি–সদর রাস্তায় পৌঁছে যাবো মিনিটখানেকের মধ্যেই মুক্তি তারপর…দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেলাম গেটটার দিকে। যথারীতি মোতায়েন কোমরে হাত রেখে পাহারাদার দুজন। হর্ন–এ হাত দিলাম গাড়ির গতি কমিয়ে। নির্বিকার পাহারাদার দুটো।
বন্ধই রইলো গেটের পাল্লা। থামিয়ে দিলাম গাড়ি, কি ব্যাপার? গাড়ি চালিয়ে বেরোতে হবে নাকি বন্ধ গেটের ভেতর দিয়ে? মনেই হলো না নিজের গলা বলে, কর্কশ, কটুকণ্ঠ আমার। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো ওদের একজন, চোখদুটো সামান্য কুঁচকে বললো, মিঃ রিককা দুঃখিত, একটা নির্দেশ আছে আপনার সম্পর্কে।
কি নির্দেশ?
হাত ঘামছে স্টিয়ারিং ধরে থাকলেও শক্ত হাতে। আপনাকে ফিরে যেতে বলার নির্দেশ পাঠিয়েছেন মিসেস ওয়াম। ওরা আপনার সঙ্গে কি কথা বলবেন মানে উনি আর মিঃ রাইসনার নাকি–ওর গায়ে একটা ঘুষি জমালে কাজ হয় লোকটা যেভাবে মুখ বাড়িয়ে বুকনি দিচ্ছে…কিন্তু জুটিটা ওর..সে শালা তোহাত রেখে দাঁড়িয়ে কোমরের বস্তুটিতে…রেডি ফর অ্যাকসন! শ শালী। বাগে পেলে তোকে একবার ঠিক আছে, চেষ্টা করলাম ঠোঁটে হাসি ফোঁটাবার, আমাদের কথা হয়ে গেছে তাড়া আছে খুলে দাও গেটটা। তীক্ষ্ণ হলো সবুজ চোখদুটো লোকটার, বোধহয় আরো কথা আছে, কারণ ফোনটা এলো এইমাত্র।
হু, দেখছি–আচ্ছা–গাড়ি ঘোড়ালাম পেছিয়ে নিয়ে মনে মনে একটা গাল দিয়ে। লোকদুটো আমাকে দেখতে লাগলো পলকহীন চোখে গাড়ি যোরানো পর্যন্ত। বেরিয়ে এলাম গাড়ি লাগিয়ে গাড়ি বারান্দায়। চলছে কাঁপুনি। ডেলা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। পারছি না আর ভাবতে।
ঘুরতে হবে উদ্দেশ্যহীন–হাঁটতে শুরু করলাম সৈকতের দিকে। একটা গাড়ি এসে থামলো পাশে খানিকটা এগোতে। কে যেন বলে উঠলো বামাকণ্ঠে।
উঠে–আসুন–চলেছি আপনার রাস্তায়, তাকালাম ফিরে। মেয়েটা সোনালী চুলের, চোখে চটুল চাহনি। স্বল্পবাস অঙ্গে, শরীরের রেখাগুলি আরও তীক্ষ্ণ সাঁতার পোষাকে। বিরাটাকার টুপি মাথায়, গোলাপের পাপড়ি গোঁজা কানে। এ নারীর সঙ্গ অবশ্য বর্জনীয় প্রকৃতিস্থ অবস্থায়–কিন্তু পাশে বসে পড়লাম এখন দরজা খুলে। গাড়ি এগিয়ে চললো সৈকতের কোণ ঘেঁষে। স্টিয়ারিংয়ে চলেছে তবলার বোল। গাড়ির রেডিওর সঙ্গে তাল রেখে। লাস্যময়ীতাকালো আড়চোখে। নিয়েছি তোমাকে দেখেই, জানো তোমাদের, মানে আমার খুব পছন্দ পয়সাওলা মানুষদের। আর দারুণ তুমি তো। অচেনা বান্ধবী খিলখিলিয়ে উঠলো।
হুঁ, দেখছি আমারই দলের লোক। যাচ্ছে কোথায়? সাঁতারে? টোল পড়লো ওর গালে। হ্যাঁ, আপনি সাঁতার কাটো তুমি কি এই পোষাকেই? চোখ বুলিয়ে নিলাম ওর নিম্নাঙ্গে। কেন পছন্দ নয় তোমার? মেয়েটা বুকে আঙুল ঘষে নিলো স্টিয়ারিং থেকে হাত তুলে।
হলেই হলো তোমার–পকেট থেকে সিগারেট বের করলাম। মোহিনীউঠলো হি–হি করে। এমন কোথাও যাই চলে না, দরকারই হবে না সেখানে এগুলো–যাবে?
তোমার গাড়ি তো, আর তুমিই চালাচ্ছো। বেড়ে গেলো গাড়ির গতি। একটা জায়গা জানি আমি, যাবে সেখানে মেয়েটা বললো গলা নামিয়ে। দৃষ্টি মেলে দিলাম কাঁচের ভেতর দিয়ে।
চেয়ে ছিলাম কি আমি এই? কি জানিবোধহয় না। কিন্তু গেলাম তো ফেঁসে। জনি রিককা তুমিই তো, তাই না? ও গাড়ি ঢোকালো একটা সরু রাস্তায়। তালগাছের সারি দুপাশে। চেনো তুমি আমাকে?
হুম। তোমার কথা যে সবাই বলছে…তুমি নাকি লস এঞ্জেলসের জুয়োর রাজা। তুমি মস্তান কে যেন বললো–আমি, জানো পছন্দ করি খুব মস্তানদের। ও হেসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো স্টিয়ারিংয়ে। আচ্ছা, বলতে হয় তাহলে সুখবরই। তা, পেতে পারি কি তোমার পরিচয়টা?
জর্জিয়া হ্যারিস ব্রাউন আমি। আমাকে জানে সবাই। চেনে সকলে আমার বাবাকেও ইস্পাত সম্রাট গলওয়ে হ্যারিস ব্রাউন। মন্তানদের ভক্ত উনিও কি?
ওরদিকে তাকালাম আড়চোখে। আবার উঠলো হি হি করে। গাড়ি নেমে গেলো রাস্তা থেকে পাশের ঘাস জমিতে। পরিবেশ নির্জন ঝোঁপের, এখানেও তালের সারি। বেশ সুন্দর, না? জর্জিয়া পেছনের আসনে ছুঁড়ে দিলো টুপিটা খুলে। পা বাড়ালো বালিয়াড়ির দিকে, যাবো সাঁতারে, সঙ্গে আসবে নাকি?
আমার খেয়াল হোল গাড়ি থেকে নেমে–গড়াতে দেওয়া যায় না এটা আর বেশিদূর। থাকার কথা নয় তো এখানে আমার। থাকার কথা আমার জনারণ্যে।
এখানে মরতে এলাম কেন ওর সঙ্গে! না হয় পালাবার রাস্তা বন্ধ ক্যাসিনো থেকে। আবার শুরু করলাম গলা ছেড়ে দিয়ে, মনে হচ্ছে রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছি, দরকার ছিলো ক্যাসিনোতে ফেরার।
রাস্তায় একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হলে।
ও, সোজা রাস্তা ওটা তো। গরান ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে এসেছেন আপনি। বোধহয়?
হ্যাঁ, এগিয়ে গেলাম একটু। এবার চোখের ওপর স্পষ্ট ওর ছবির ফ্রেমটা–নির্মেঘ আকাশ ফুটে উঠেছে তুলির টানে…তালের সারি…বালুকা রাশি। বাঃ দারুন বাস্তব। ছবিটা বেশ হয়েছে তো–সৈকত–সুন্দরীর কাছে কৌতুকের মনে হলো কেন আমার কথাগুলো। ও হাসলো মিষ্টি করে, হওয়ার কথা তাই তো–হা, কিন্তু তা ফোঁটাতে পারেনা তো সবাই। সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম পকেটে হাত দিয়ে। ওর দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিলাম। ধন্যবাদ, ধূমপান আমি করি না। জ্বালালাম আমারটা, বলতে পারেন আমি কতটা দূরে চলে এসেছি ক্যাসিনো থেকে?
মাইল তিনেক। আর আপনি তো চলে ছিলেন উল্টোদিকে মেয়েটা বুরুশটা ঘষে নিলো একটুকরা কাপড়ে। বলছেন ছেড়ে এসেছি ক্যাসিনোর সৈকত?
হ্যাঁ, এসে পড়েছেন আমার এলাকায়। ওর মিষ্টি হাসি মুখে নেই। ক্ষমা করবেন, ইচ্ছাকৃত নয় অনধিকার প্রবেশের ব্যাপারটা। বলিনি আমি তা। মেয়েটা হাসলো আবার, আপনি আছেন বুঝি ক্যাসিনোতে? জোগালো না মুখে তাৎক্ষণিক উত্তর, ওকে জানাতে চাই না আমি জুয়াড়ী জনি রিককা। ক্ষতি নেই জর্জিয়া জেনেছে, কারণ এর তুলনা হয় না ওর সঙ্গে। আর কি দিন কয়েক আছি। কেশ জায়গাটা না? পাল্টালাম প্রসঙ্গ।
এদিকেই থাকেন আপনি কি?
হ্যাঁ, আমার ডেরা কাছেই, মালমসলা জোগার করছি প্রদর্শনীর জন্য আর কি। কি সেটা? বসে পড়লাম বালির ওপর, দূরত্ব রেখে ওর থেকে। ওর দিকে তাকালাম–পছন্দ হয়েছে কিনা যাচাইয়ের জন্য আমার ব্যাপারটা। অপরিবর্তিত ওর মুখভাব। একটা কোম্পানী মিয়ামির–ফেসটান। বড় কোম্পানী। শুনেছেন হয়তো নাম। স্কেচ এঁকে দেওয়া হোল আমার কাজ, সাহায্য করাও কিছু রংয়ের পরিকল্পনায় শোভা বর্ধনের জন্য শো–কেসের। বলছেন মনের মতো কাজটা? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই–মুখটাওর উজ্জ্বল হলো। গত বছর গিয়েছিলাম পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে। ছবি আঁকার ব্যাপার ছিলো কয়েকটা। পশ্চিম ভারতীয় গ্রামে রূপান্তরিত করা হলো আমাদের দোকানের একটা বিভাগকেই প্রদর্শনীটা দারুন হয়েছিলো। মনে হচ্ছে ভালোই তো কাজটা–আচ্ছা, আজ থাক–আপনাকে বিরক্ত করলাম।
না, না, মাথা নাড়লো ও। কাজ তত শেষ আমার। ও তুলে ফেলতে লাগলো বুরুশগুলো বসেছি সেই সকাল দশটায়, পেয়েছে খিদে।
বলুন দেরিই হলো একটু। সুন্দরী হাসলো। আবার সময় অসময় একা মানুষের। ও দেখতে লাগলো ছবিটা খুঁটিয়ে, ওকে দেখছি আমি কিন্তু। ওর বড় ভালো লাগছে। এই থাক আপাততঃ মেয়েটা আমার দিকে ফিরলো ছবি থেকে চোখ সরিয়ে, মিঃ রিককা সৈকত ধরে হাঁটা আপনার ফিরে যাবার সহজতম রাস্তা। উঠে দাঁড়ালাম জনি ফারার। পৌঁছে দিয়ে যাই না আপনার জিনিষগুলো।
জিনিষ তো অনেকগুলো। মনে হচ্ছে নিজে থেকেই নিচ্ছেন দ্বিপ্রহরিক নিমন্ত্রণটা, আবার গালে টোল পড়লো ভার্জিনিয়া ল্যাভেরিক, আমার নাম, যদি কিছু কাজ না থাকে আপনার হাতে –না, কাজ নেই আমার কোনো বোধ করছি বড় নিঃসঙ্গ, আর ভালও লাগছে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর হাতে তুলে নিলাম বুরুশের বাক্স হাঁটতে লাগলাম ভার্জিনিয়ার সঙ্গে।
ও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো খানিক দূরে এগিয়ে, কিন্তু আপনাকে তোবসতে হবেকুটিরের বাইরে। আমি জানেন তো, একা। ও ঠিক আছে, এই আমার আনন্দ ওর পাশে হাঁটছি। নিষ্কলুষ নয় আমার চরিত্র, তবে আমি ভীতিজনক মানুষ নই– হেসে হালকা করতে চাইলাম ব্যাপারটা। ভার্জিনিয়া হাসলো ঝকঝকে দাঁতে, বিত্তবানরা ও দোষে দুষ্ট প্রায় সবাই। দাঁড়ালাম বাংলোর সামনে। ফুলের সমারোহ চারপাশে, হালকা সবুজ রং করা ছাদটা কয়েকটা চেয়ার পাতা বাইরেইতন্তত, বেতারযন্ত্রও রয়েছে এক কোণে। ছড়িয়ে বসুন হাত পাব্যবস্থা করি পানীয়ের, খাবেন কি–স্কচ? ফাইন। আমার ইচ্ছে করলো হাতছানি দিতে।
এক মিনিট–ভার্জিনিয়া অদৃশ্য হয়ে গেলো পর্দার আড়ালে। অনেকক্ষণই নিলো সময় অবশ্য। আমি পায়চারি করে চললাম বারান্দায়, আবার শুরু হয়েছে কাপুনিটা। এলো ভার্জিনিয়া, দেরি হওয়ার কারণ বুঝলাম ওর দিকে তাকিয়ে বদল করেছে পোক। সাদা লিনেনের স্কার্ট এখন ওর গায়ে। টেবিলে নামিয়ে দিলো হাতের ট্রে।
স্যান্ডউইচের থালাও রয়েছে পানীয়ের সঙ্গে, নিন করে দিন শুরু–নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে আপনারও– গ্লাসে ঢেলে দিলাম অনেকখানি স্কচ, ফেলে দিলাম কটা বরফের টুকরোও। ভার্জিনিয়া নরম আঙুলে একটা স্যান্টউইচ তুলে নিয়ে আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিলো। মারামারি করেছেন নাকি আপনি? চমকে উঠলাম। বললাম, সামলে নিয়ে, ইয়ে আর কি তর্কাতর্কি করার ফল একজনের সঙ্গে হাত বোলালাম নাকে।
ঠিক তত কিছুনা যতটা খারাপ মনে হচ্ছে, না কি বলেন? ভার্জিনিয়া চুমুক দিলো লেবুর রসে, অস্বস্তিকর ছায়া ওর চোখে, বলে বসলাম কি বলবো ঠিক করতে না পেরে, কৃতজ্ঞ থেকে গেলাম আপনার সহানুভূতির জন্য। একা লাগছিলো বড়
শুনেছি, অনেক আকর্ষণ ক্যাসিনোতে–
হয়তো, কিন্তু আমার পছন্দ নয় ওদের তেমন।
টোল পড়লে গালে, শুনি পছন্দটা আপনার আমার কোনোকালেই নেই মজা করার অভ্যাস। আমি সোজা কথার মানুষ, এই কেউ আপনার মত। দেখবেন পাড়া মাৎকরবেন না যেন আবার চেঁচিয়ে। জানতে চাইলেন আপনি, দিলাম জানিয়ে। সেইদলেরনই আমি কিন্তু স্থির চোখে তাকালো ভার্জিনিয়া, আপনাকে নিশ্চয়ই নিয়ে আসতাম না এখানে সেই দলের ভাবলে– পরিবেশ মেঘমুক্ত হলো। ভার্জিনিয়া দিয়ে চললো তার কাজের ফিরিস্তি, কাজটাতে টাকা আছে ওর কথাতেও মনে হলো স্বাধীনতাও কিছু। ওর কাহিনী শুনতে ভালোই লাগছিলো। এখন স্বস্তি পাচ্ছি অনেকটা। কাজ হয়েছে স্কচে পানীয় পরিচর্যা করে চলেছে স্নায়ুর। ও বললো বেশ কিছু পরে, তখন থেকেই বলে চলেছিতো আমার কথাই। এবার শুনি আপনার কথা–আপনি কি করেন?
আশংকা করছিলাম এরকম কিছু একটার তাই মাথায় ছিলো উত্তরও। জীবন বীমা–আমি এক ক্ষুদে কর্মচারী পিটসবার্গ জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর। কাজটা ভালো লাগে?
মন্দ কি–এই আপনার মতোই কতকটা বেড়ানো যায়–তা, নিশ্চয়ই ভালোই পান টাকা, পয়সা–শুনেছি তো অনেক টাকার দরকার ক্যাসিনোতে থাকতে–অচিরাৎ পরিষ্কার করা উচিৎ রহস্য, প্রতিজ্ঞা ছিল আমার একটা, দিনদুয়েকের জন্য হলেও অন্ততঃ আজবো কোটিপতি। এইজন্য টাকা জমিয়েছি বছরের পর বছরযাক হলো তাও। পালাবো ভাবছি মঙ্গলবার নাগাদ। আপনার তাহলে ভালোই লাগে কোটিপতি হতে? ভাজিনিয়া শুধোলো গালে হাত দিয়ে। হাসলাম, ভাবাই যায় না আর কিছু। ই, তাই মনে হয় আমারও। কিন্তু স্বপ্ন থাকলে কি হবে কোটিপতি হবার, চোখেই দেখিনি কোনদিন অতটাকা, দূরঅস্ত পাওয়া তো। আমার জীবনের এই একমাত্র লক্ষ্য অনেক টাকা খরচ করতে পারবো। একটা পোষাক, মহড়া তারই, বলতে পারেন ক্যাসিনো বাস।
অনেক টাকা? ও তাকালো আগ্রহের দৃষ্টি মেলে। অনেক টাকা হা, ম্যাডাম
কিন্তু কোথায় পাচ্ছেন? থেমে গেলাম। মনে হলো বলে ফেলেছি অনেক কথা।
না-না। মাথায় নেই এখন কোনো পরিকল্পনাই, বলতে পারেন সবই দিবাস্বপ্ন।
বললাম হাল্কা গলায় একটু থেমে, হয়তো কেউ অনেক টাকা রেখে যাবে আমার জন্যে মরবার সময়।
ভার্জিনিয়ার কৌতূহল জমলে উজ্জ্বল চোখদুটোয়। মওকা খুঁজছিপ্রসঙ্গ পাল্টাবার ভার্জিনিয়ার মনে পড়লো এমন সময় বিঠোফেনের ফিফথ সিম্ফনির অনুষ্ঠান আছে রেডিওতে। ও চালিয়ে দিল রেডিওটা। শুনবেন পরিচালনা করছেন টসকানিনি, অনুষ্ঠান?
চলুক–কোনোদিন শুনিনি বিঠোফেনের সিম্ফনি, বিঠোফেন কেন, সিম্ফনি শুনিনিকারোর। বলতে গেলে এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই। কিন্তু আমাকে এক অন্য জগতে নিয়ে গেলো রৌদ্রস্নাত অপরাহ্নিক নিস্তব্ধতায় সঙ্গীতের মূৰ্ছনা। কাজ নয় শেষ হলো। ভার্জিনিয়া সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো ঝুঁকে। লাগলো কেমন? অপূর্ব! সব উন্নাসিকদের জন্যেই সৃষ্ট আমার ধারণা ছিল– তার মানে ভালো লেগেছে বলুন আপনার?
কি জানি, একথা বলতে পারি আমার অন্তরে একটা সাড়া উঠেছে–জাদু জানে লোকটা। শুনবেন আরো? আছে নাকি আরো? আছে, আরো ভালো নাইনথটা আপনার মাথার চুল খাড়া হয়ে যাবে।
শুনতেই হয় তাহলে তো। বসলাম জমিয়ে।
তাহলে আমাকে একটু সাহায্য করুন। ভেতরে আসুন। ওর পেছনে ঢুকলাম একটা বড় লাউঞ্জে। ঠাসা ঘর বই আর জলরং ছবিতে। রেডিওগ্রাম একটা প্রকাণ্ড দেওয়ালের গায়ে, রেকর্ড পাশের তাকে। বললাম, চারপাশে তাকিয়ে, আচ্ছা, আপনারই তো এ বাড়িটা?
হা। তবে এখানে থাকি না সব সময়। সেই সময়টা আমার এক লেখিকা বান্ধবী থাকে। সে নিউইয়র্কে এখন, এসে পড়বে কিছুদিনের মধ্যেই।
কোথায় যাবেন আপনি তখন?
কোথায় চীনে হয়তো। আমার অস্বস্তি হলো, কিন্তু আছেন তো এখন কিছুদিন?
হ্যাঁ, বড়জোর সপ্তাহ তিনেক। নিজেকে ছেড়ে দিলাম একটা আরাম কেদারায় সৈকতের দিকে মুখ করে। ভার্জিনিয়া দখল করলো একটা সেটি। মিললো ওর কথা। আমার চুলে শিহরণ উঠলো বাজনার আমেজে। ভার্জিনিয়া মেন্ডেলসন আর শুবার্ট শোনালো প্রয়োগ কৌশলের ফারাক বোঝাতে। চমকে উঠলাম দেয়াল ঘড়ির শব্দে। পড়লো সাতটা ঘন্টা। পরে হিসেব করে নিশ্চিন্ত হলাম। আমার পাঁচটা ঘণ্টা এখনো হাতে। ডিনারে কোথাও যাবেন নাকি?
দরকার নেই দামী কোথাও যাবার, আর ক্যাসিনোতে ফিরতে চাইনা পোষাক পাল্টানোনার জন্য। আবার বললাম, একটু ইতস্তত করে, নাকি দেওয়া আছে কাউকে তারিখ? তৈরী ছিলাম রূঢ় কিছু শোনার জন্য, কিন্তু হলো না সেরকম কিছু। জিজ্ঞেস করলো ভার্জিনিয়া, কখনো গেছেন রল–এ?
নাতো, সেটা কোথায়? আপনার অজানা থেকে গেছে অনেক কিছুই। রল—এ না গিয়ে থাকলে। হোটেলটা সৈকতেই, চলুন বেশ মজা হবে। রল–এ পৌঁছলাম ভার্জিনিয়ার লিঙ্কন কনভার্টিবলে চড়ে। ছোট রেস্তোরাঁ গ্রীক পরিচালিত, মাছের আধার দেয়ালে। বাহুল্য চারিদিকে গদি আঁটা চেয়ার আর আয়নার। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে রল স্বয়ং উঠে এলো।
নিজেই আমাদের বানিয়ে দিলো মেনুবিনের স্যুপ পয়লা এলো, ক্রমে কাছিমের স্টিক, অ্যাসপ্যারাগাস সুপ, সবশেষে পেয়ারার মিষ্টান্ন। কথা বলে চলেছি খেতে খেতে।
ঘড়িতে সরব ঘোষণা হল আমার কথার মাঝেই, মনে মনে গুনে চললাম…যেন হাতুড়ি পিটিয়ে চললো বুকে একটা একটা ঘণ্টা…দশটা…এগারোটা…বারোটা।
.