০৩.
হত্যার নিপুণ শিল্প
বাড়িতে ফিরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
ডেলানিকে খুন করতে আমার কোথাও বাধছে না। এই সিদ্ধান্তে এসে মনে হচ্ছে যে মনের ওপর থেকে একটা চাপ সরে গেল। নিজেকে যেন অন্য কেউ বলে মনে হচ্ছে।
শুয়ে শুয়ে মাথায় শুধু একই চিন্তা কি করে ডেলানিকে খুন করে সরে পড়া যায়।
ডেলানির মৃত্যুতে কি কি সুবিধা হতে পারে সেটা ভেবে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। গিল্ডা মুক্তি পাবে, ও আমার হবে। লোকটার অনেক টাকা পাবো আমরা দুজনে। নতুন জীবন শুরু হবে আমাদের। এই টাকায় আমি জীবনে বড়ো হয়ে উঠবো। আমার শিক্ষা আছে, জ্ঞান আছে, কিন্তু মূলধন ছাড়া আমি কিছুই করতে পারবো না।
গোপনে খুন করার উপায়টা যদি বার করতে পারি, যাতে কেউ আমায় সন্দেহ করবেনা, তাহলে একটা নতুন দারুণ জীবন পাবো আমি আর গিল্ডা।
কিন্তু ব্যাপারটা অতো সহজ নয়। ডেলানি বাইরে বের হয় না, ওকে বাড়িতেই খুন করতে হবে। এমন সময় করতে হবে যখন গিল্ডা গ্রীন ক্যাম্পে গিয়েছে।
শুক্রবার সকাল সাড়ে নটানাগাদ গিল্ডা সপ্তাহের কেনাকাটা করতে যায়, ফেরে বারোটা নাগাদ। এর ভেতরেই কাজটা সারতে হবে। সবচেয়ে বিপদের ব্যাপার হলো খুনটা করতে হবে দিনের আলোয়। যদিওব্লু-জয় কেবিনের সামনের রাস্তাটায় খুব একটা কেউ যাতায়াত করেনা, তবুহয়তো কেউ আমাকে দেখে ফেলতে পারে। তাছাড়া মেরিয়ার কথাও আমাকে ভাবতে হবে। যাতে ও সেই সময় বাড়িতে না থাকে তার ব্যবস্থাও আমাকে করতে হবে।
আমাকে দেখতে হবে যাই করি না কেন গিতা যেন জড়িয়ে না পড়ে। পুলিশ যদি জেনে ফেলে যে আমার আর গিল্ডার মধ্যে প্রেম চলছে তাহলে আর রেহাই নেই। খুন যদি করি তাহলে গিল্ডাকে আমার চাই আর ওঁর টাকাগুলো চাই।
চিন্তা করতে করতে মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা হলো তবুও একটা নিরাপদ কিছুবার করতে পারলাম না।
ডেলানি নিজেই দেখিয়ে দিলেন যে কি করতে হবে।
পরের দিন সকালে টেলিফোন বেজে উঠলো।
ডেলানির গলা মিঃ রেগান নাকি?
ওঁর গলার স্বরে আমার শরীরে একটা অবর্ণনীয় উত্তেজনা বয়ে গেল।
হ্যাঁ, আমি বললাম।
আপনি একবার আসতে পারবেন? আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই, এলে খুশি হবো।
আমার মনে হলো আজ শুক্রবার। গিল্ডা থাকবে না। যাকে খুন করবো ঠিক করেছি তাকে একবার দেখার আমার ইচ্ছে হলো।
আচ্ছা, মিঃ ডেলানি আমি আসছি। ঠিক সাড়ে নটার সময় আমি ব্লু-জয় কেবিনে পৌঁছলাম। ডেলানি হাত দেখিয়ে আমাকে বসতে বললেন। সিগারেটের প্যাকেট বার করলেন।
আমি একটা সিগারেট নিয়ে বসলাম। যাকে খুন করবো তার দিকে তাকাতে গিয়ে শরীর কেমন করে উঠলো। ডেলানি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন।
আমি কাল রাত্রের বিশ্রী ব্যাপারটার জন্য ক্ষমা চাইছি। তখন আমি মাতাল ছিলাম। আমি দুঃখিত।
একটু হুইস্কিতে চুমুক দিলেন উনি, নিজের স্ত্রী বিশ্বাস ভঙ্গ করছে জানলে ভালো লাগে না, তাই বোধহয় বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।
আপনার ক্ষমা চাইবার দরকার নেই। এসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।
ওই সেটটা কতদূর হলো? কবে পাবো?
সোমবার দিয়ে দেবো।
বাঃ, ভালো কথা ডেলানি একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন,
মিঃ রেগান, আমার স্ত্রী সম্পর্কে কি মনে হয় আপনার?
আমি মুখে কোনো অভিব্যক্তি ফুটতে না দিয়েই বললাম, আমি এ বিষয়ে কি বলতে পারি?
ডেলানি বললেন, আমি আমার স্ত্রীর সম্বন্ধে কিছু বলবো। শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন যে কেন আমি ওকে মেরেছিলাম।
মিঃ ডেলানি আমার কাজ আছে, আমি যাচ্ছি।
ডেলানি আমার দিকে চেয়ে বলতে শুরু করলেন, স্টুডিওর সুইমিং পুলে আমি ওকে প্রথম দেখি। যেসব মেয়ের ভালো শরীর আছে বুদ্ধি নেই, তারা যে কাজ করতে পারে তাই করতে ও। আমি অনেক তারকাদের দেখেছি কিন্তু ওকে দেখে আমি ভুলে গেলাম। আমি গিল্ডার প্রেমে পড়ে গেলাম। রাতদিন ওরই কথা ভাবতাম। আমি ওকে সে কথা জানালাম, কিন্তু ও খেলা করতে চাইলো না, হয় বিয়ে করতে হবে নয়তো কিছুই নয়। আমি ওর সঙ্গে ফেঁসে গেলাম। যখন ও সুইমিং পুল থেকে উঠে আসতো গা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়তো। সাঁতারের জামা ওর শরীরে লেগে থাকতো–এ সব দেখে আমি ওর প্রেমে না পড়ে থাকতে পারলাম না। আমার স্ত্রী কি চায় জানেন? ও টাকার জন্য পাগল, টাকা ছাড়া ও কিছুই জানে না। আমাকে বিয়ে করার পর প্রথম ও আমাকে বলেছিল একটা অ্যাক্সিডেন্ট ইনসিওরেন্স করতে। ইনসিওরেন্স কোম্পানী থেকে একটা লোককেও ধরে এনেছিল আমার কাছে। যতক্ষণ না সই করা পলিসিটা ওকে দেখালাম ততক্ষণ ও বিশ্বাস করেনি। কিন্তু ও জানেনা যে ওকে দেখাবার পরেই আমি পলিসিটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি। ডেলানি হাসলেন। তারপর কি হলো জানেন? আমরা একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম। আমার একটু নেশা হয়েছিল। গিল্ডাবললো, ও গাড়ি চালাবে। আমি বোকার মতো চালাতে দিলাম। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। পাহাড়ের পথে ও কোথাও থামলো। গাড়ি থেকে নেমে ওর কোনো বন্ধু সে সামনে গাড়ি থামিয়েছিল, তার সঙ্গে কথা বলতে গেল। যাবার আগে ও ব্রেক লাগিয়ে গিয়েছিল অন্ততঃ সেই রকমই বলেছে। যাই হোক, গাড়িটা গড়িয়ে পড়লো। সেরে উঠতে আমার অনেক দিন লেগেছিল। এখন কি মনে হয় জানেন? গিল্ডা আমার বদলে ঐ একশো হাজার ডলারটাই চেয়েছিল।
আমি বললাম, আমি এসব শুনতে চাই না, আপনার নেশা হয়েছে, আপনি জানেন না আপনি কি বলছেন।
হতে পারে, কিন্তু এই কথাটাই আমার বার বার মনে হয়, এখন ওর প্রেমিক জুটেছে যে লোকটা গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই হতে পারে। ওরা হয়তো দুর্ঘটনাটা মতলব করে করেছিল। পুলিশও একবার তাই ভেবেছিল কিন্তু আমি তখন ওকে ভীষণ ভালোবাসি, তাই বলেছিলাম যে ব্রেকটাতে আমি হাত দিয়েছিলাম। আমি তখন ওকে বিশ্বাস করতাম, কিন্তু এখন করি না।
ডেলানির একটা কথাও আমি বিশ্বাস করিনি, কিন্তু উনি এসব বলছেন বলে আমার আনন্দ হলো। এতে ওঁকে খুন করা আমার পক্ষে সহজ হবে।
আমি যাচ্ছি, মিঃ ডেলানি।
একটু দাঁড়ান, উনি বললেন, যে সেটটা বানাচ্ছেন, ওতে একটা রিমোট কনট্রোল সুইচ করে দিতে পারবেন? আমি প্রতিবার চেয়ার না চালিয়েই সেটটা চালাতে বন্ধ করতে চাই।
সেই মুহূর্তে আমার মাথায় খেলে গেলো ওকে কি করে খুন করবো।
রিমোট কন্ট্রোল সুইচেই খুন করা যাবে। ঐ সুইচটা ডেলানির ধাতব চেয়ারে ঠেকে যাবে টেলিভিশনের বিদ্যুৎপ্রবাহ এসে ইলেকট্রিক চেয়ারের মতই ওঁকে মেরে ফেলবে। এইটুকু ব্যবস্থাই করতে হবে আমাকে।
আমার মুখে যাতে কোন ছায়া না পড়ে সেই কারণে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, হ্যাঁ, তাই হবে মিঃ ডেলানি।
বাড়ি ফিরে মতলবটা ভাবতে লাগলাম। কাল রাতে যা নিয়ে ভাবতে বসেছিলাম, এইটেই হলো তার সমাধান। ওঁর মৃত্যুটা যদি দুর্ঘটনা বলে দেখানো যায় তবেই সবচেয়ে নিরাপদ। শেরিফ জেফারসন তাহলে ব্যাপারটা খোঁজখবর নেবেন। যদি হত্যা বলে মনে হয়, তাহলে তিনি লস এঞ্জেলস পুলিশকে ডাকবেন। তাদের ধুরন্ধর লোকেরা এর তদন্ত করুক আমি চাই না। এল. এ হোমিসাইড স্কোয়াডের লেফটেনান্ট জন বুজকে ঠকানো অতো সহজ হবে না। অনেক খুনীকে ও ধরেছে। তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে আমার নেই।
আগে মতলবটা ভালো করে ভেবে নিতে হবে যাতে কোনোরকম ফাঁকনা থাকে। আগে সেটটা তৈরী করে ফেলতে হবে। আর দেরী না করে আমি কাজ শুরু করে দিলাম।
কাজ করতে করতে বারবার গিল্ডার কথাই আমার মনে পড়তে লাগলো।
প্রতিটা তার জুড়বার সময়, প্রতিটা ভালভ বসাতে বসাতে আমার মনে হচ্ছিল আমি এইভাবে গিল্ডাকে মুক্তি দিতে যাচ্ছি, ওর সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে চলেছি।
সোমবার সকালে আমি টেলিভিশন সেটটা গাড়িতে তুলে ব্লু-জয় কেবিনের দিকে রওনা হলাম।
সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে গিল্ডাকে আমি দেখিনি, ওকে দেখবার ইচ্ছেও হয়নি আমার মতলব হাসিল না করে ওর সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলাম না। ও হয়তো শেষ মুহূর্তে এমন একটা কিছু বলবে, যাতে আমায় পিছিয়ে আসতে হবে, সেইজন্যেই কাজটা আগে সেরে ফেলতে চাইছিলাম।
বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে পড়লাম। গাড়ির শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকালেন ডেলানি। কাগজটা ফেলে দিয়ে চেয়ার চালিয়ে এগিয়ে এলেন।
মিঃ ডেলানি, যা কথা দিয়েছিলাম তা রেখেছি।
বেশ সুন্দর, কি রকম হয়েছে?
আপনি নিজেই দেখুন। সেটের জিনিসপত্র নিয়ে আমি ওপরে উঠে এলাম।
সেটটা বসাতে আমার আধঘণ্টা লাগলো, ডেলানিকে বুঝিয়ে বললাম এটা কিভাবে চালাতে হবে।
একটা এল. পি. রেকর্ড লাগিয়ে ভল্যুমটা বাড়িয়ে দিলাম, ডেলানির মুখ দেখে বুঝলাম যেমন মনে করেছি, সেই রকমই পছন্দ হয়েছে ওর।
রিমোট কন্ট্রোল সুইচটা ওঁর চেয়ারের হাতলে আটকে দিলাম। এটা ওঁর খুব পছন্দ হলো। তিনটে নব আছে–একটা সেটটা চালাতে আর বন্ধ করতে, অন্য দুটো ভলুম আর টিউনিং।
নবগুলোয় রবার লাগানো, যাতে বিদ্যুৎ প্রবাহ এদের মধ্যে দিয়ে না যায়। ঐরবারের আবরণটা খুলে ফেললেই এটার সঙ্গে চেয়ারের বৈদ্যুতিক যোগ ঘটে যাবে।
ডেলানি কন্ট্রোল সুইচ দিয়েই টি. ভি. দেখলেন, বন্ধ করলেন। ওঁর মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
দারুণ হয়েছে।
মিঃ ডেলানি, আপনার জন্য সবচেয়ে ভালটাই তৈরী করেছি। নবটার ওপরে ওঁর আঙুলগুলো দেখতে কিরকম অদ্ভুত লাগছে। যদি বরাত.ভাল থাকে তাহলে শুক্রবার এই করতে গিয়েই ওনার ভবলীলা শেষ হবে।
আমি বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গিল্ডা বুইকটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, একদৃষ্টে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি হাতটা একটু তুললেও গাড়ি থামালাম না।
বাড়ি ফিরে এলাম। চিন্তা করতে লাগলাম। এখন কেবল দেখতে হবে শুক্রবার গিল্ডা গ্রীন ক্যাম্পে যাবে কিনা, তাহলেই ডেলানি একলা হয়ে যাবেন। ওদের বাড়ির মেয়েটি শুনলাম চলে গেছে। ভালোই হয়েছে। সামনে থেকে একটা বড় বাধা সরে গেছে।
কিন্তু সবথেকে বড় বাধাটা পেয়োনো বাকি। বৃহস্পতিবার রাত্রে গিয়ে আমাকে রিমোট কন্ট্রোল সুইচটা বিদ্যুৎপরিবাহী করে দিয়ে আসতে হবে। ডেলানি যখন মারা যাবেন তখন আমার ওখান থেকে অনেক দূরে থাকা দরকার। গিল্ডা বেরোবার আগেই ডেলানি যদি ওই সুইচটা ছুঁয়ে ফেলে তা হলে ডেলানির সঙ্গে গিল্ডাও মরবে। সেই কারণে যখন কেউ থাকবেনা তখনই ব্যাপারটা ঘটাতে হবে।
চিন্তা করতে করতে হঠাৎ দেখলাম একটা গাড়ি আসছে। দেখলাম সেই ইনসিওরেন্সের ম্যাট লাউসন।
গাড়ি থেকে নেমে ও আমার কাছে এগিয়ে এলো।
মিঃ রেগান, আমি কিছু টাকা এনেছি আপনার জন্য। খুব বেশি নয়, তবু খানিকটা তো বটে। এখানে কুড়িটা পলিসি করিয়েছি।
ভালোই তো, আমি চাইলাম ও তাড়াতাড়ি চলে যাক।
নতুন ট্রোজান রেডিও আর টি. ভি. সেট দেখেছেন? লস্ এঞ্জেলসে একমী স্টোরে রয়েছে। ওটার এজেন্সি নেবেন নাকি? আমি বললাম, আমি নিজেই সেট বানাই। তবে একবার দেখবো ওটা।
এর মধ্যে একটা টাইম ক্লক আছে। সেটাকে সেট করে দিলে ঠিক প্রোগ্রামের সময়ে নিজে থেকেই চালু হয়ে যাবে।
আমার পক্ষে উত্তেজনা চেপে রাখা কষ্টকর হলো। আমার সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছি। টাইম ক্লক! এর সাহায্যেই আমি নির্দিষ্ট সময়ে সুইচটাকে বিদ্যুৎ পরিবাহী করে তুলতে পারবো।
লাউসন চলে গেলে মতলবটা পুরোপুরি ভেবে নিলাম। বোকার মতো কিছু করে না ফেললে কেউ ধরতে পারবে না।
এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে ডাঃ ম্যালার্ড ডেলানির মৃতদেহ দেখতে আসবেন। ডাক্তার যদি বলে ডেলানির মৃত্যু একটা দুর্ঘটনা, স্কটল্যান্ড তাই বলবে।
ডাঃ ম্যালার্ড আর শেরিফ জেফারসন–এই দুই বৃদ্ধের অপটুতার ওপরে আমি নির্ভর করে আছি। কোনরকম বিরাট ভুল না হলে আমি ঠিকই বেরিয়ে যেতে পারবো। ভয়ের কোনো কারণই দেখি না। আমার হাতে আর তিনদিন সময় আছে। একটা টাইম সুইচ ক্লক চাই। ভাবলাম যেখানে আমাকে কেউ চেনে না সেইরকম জায়গা থেকেই আমাকে এটা কিনতে হবে। স্যানফ্রানসিসকোর কথাই আমার মনে এলো।
পরেরদিন লস্ এঞ্জেলসে গেলাম। সেখান থেকে স্যানফ্রানসিসকোর ট্রেন ধরে বিকেলের দিকে গিয়ে পৌঁছলাম। তাড়াতাড়ি করে ক্লকটা কিনে বাড়ি ফিরলাম অনেক রাত্রে।
পরের দিন সকালে এগারোটার সময়ে ডেলানিকে ফোন করলাম।
মিঃ ডেলানি, রেগান বলছি, টি.ভি. ঠিক চলছে?
খুব ভালো।
শুক্রবারের প্রোগ্রামটা দেখেছেন? আমি আসল কথাটায় এলাম। ডেম্পসির মারপিটের ছবি দেখাচ্ছে।
তাই নাকি? কটার সময়ে?
শুক্রবার সকাল নটা পঁয়তাল্লিশে।
ধন্যবাদ, ওটা দেখতেই হবে।
টেলিফোনটা ছেড়ে দিয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। ব্যাপারটা বেশ সহজ হয়ে যাচ্ছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে নটা চল্লিশ নাগাদ ডেলানি রিমোট কন্ট্রোলে অবশ্যই হাত দেবেনই, তখন ওটা মারাত্মক হয়ে থাকবে।
সব কিছুই এখন নির্ভর করছে গিল্ডার গ্লীন ক্যাম্পে যাওয়া না যাওয়ার ওপর। আমার পরিকল্পনার এই অংশটাই কেবল আমার হাতে নেই।
ব্লু-জয় কেবিন থেকে কোয়ার্টার মাইল দূরে পাহাড়ের ওপর একটা জায়গা আছে যেখান থেকে এই বাড়িটা আর গ্লীন ক্যাম্পে যাবার রাস্তাটা দেখতে পাওয়া যায়। আমি ঠিক করলাম এইখানে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ফিরে গিয়ে অপেক্ষাকরবো। ওখান থেকেই দেখা যাবে গিল্ডা বেরোলো কিনা। যদিনটা কুড়ির মধ্যে ও না বের হয় তবে আমি তাড়াতাড়ি ব্লু-জয় কেবিনে গিয়ে ডেলানিকে আটকাবো যাতে তিনি রিমোট কন্ট্রোলে হাত না দেন। সেটটা দেখতে এসেছি এরকম একটা অজুহাত দিয়ে আমি ব্যাপারটা সামলে নিতে পারবো। আমার এর পরের চালটা খুবই সহজ। আমার বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে আররু–জয় কেবিন থেকে মাইল দেড়েক দূরে থাকেন জেফ হামিশ, একজন লেখক, তাকে ফোন করলাম। আমি জানতাম হামিশের এল.পি. রেকর্ড যোগাড়ের একটা বাতিক আছে। ওঁকেই আমার অ্যালিবাই করবো। উনি নামকরা লোক, সাক্ষী হিসেবে ভালো হবেন।
টেলিফোনে ওঁকে বললাম, মিঃ হামিশ, একটু বিরক্ত করছি। আমি একটা গ্যাজেট পেয়েছি, আপনার কাজে লাগতে পারে। রেকর্ড চলতে চলতেই এটায় রেকর্ডটা পরিষ্কার করা যায়। ঠিক পিনটার সামনেই এটা ঝোলানো থাকে।
শুনে তো ভালোই লাগছে। একবার দেখলে হয়।
কাল সকালে ওদিকে যাবে। যদি সাড়ে নটা নাগাদ যাই অসুবিধে হবে না তো?
কিছু না। আপনাকে ধন্যবাদ।
ভাবলাম ডেলানি মরবেন নটা পঁয়তাল্লিশে। সেই সময়ে আমি ওখান থেকে দেড় মাইল দূরে হামিশকে গ্যাজেটটা চালিয়ে দেখাচ্ছি। সাড়ে নটা থেকে দশটা পর্যন্ত। একটা নিখুঁত অ্যালিবাই।
বৃহস্পতিবার রাত্রে আমাকে সবচেয়ে বিপজ্জনক আর সবচেয়ে শক্ত কাজ করতে হবে।
সাড়ে নটার একটু পরে আমি টাইম ক্লক আর যন্ত্রপাতি নিয়ে ডেলানির বাড়ি রওনা হলাম।
দশটা বাজতে দশে আমি ডেলানির গেটে এসে পৌঁছলাম, ভেতরে আলো জ্বলছে, টি. ভি. সেটে বাজনা শোনা যাচ্ছে।
সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠলাম। পেছনের দরজায় গিয়ে ঠেলা দিলাম। খুলে গেলো, রান্নাঘরে ঢুকে পড়লাম। আমার পায়ের শব্দ কেউ শুনতে পাচ্ছে না, আমি ভাড়ার ঘরে ঢুকে গেলাম। আমার কাছে একটা টর্চ ছিল, সেটা জ্বেলে ভালো করে দেখে নিলাম। দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম। এখানে আমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
সাড়ে দশটার সময় শুনতে পেলাম টি. ভি. বন্ধ হলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে কান পাতলাম। বুকটা ধক ধক করছে। একটা দরজা বন্ধ হলো।
ডেলানির গলা শোনা গেল শুতে যাচ্ছো? তোমাকে একটা কথা বলবো ভেবেছিলাম। তোমার প্রেমিকের কি হলো? আজকাল তো রাত্রে বের হচ্ছেনা তুমি? সেকি এর মধ্যেই তোমাকে ছেড়ে ভেগেছে?
আমি শুতে যাচ্ছি। শুভরাত্রি।
একটু ফুর্তি করতে ইচ্ছা হচ্ছে, তোমার প্রেমিকের সঙ্গে তো ফুর্তি করো, স্বামীর সঙ্গে করবে না কেন?
তুমি মাতাল হয়ে গেছ, গিল্ডার গলায় ঘৃণা ফুটে উঠলো। তুমি জানো না তুমি কি বলছো।
একটা শব্দ হলো, শুনতে পেলাম গিল্ডা ফুঁপিয়ে উঠলো। স্টোরের দরজা খুলে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। ওখান থেকে লাউঞ্জটা দেখা যাচ্ছে। ডেলানি গিল্ডার কব্জিটা ধরে চেয়ারের কাছে টেনে এনেছেন। চোখ দুটো বীভৎস দেখাচ্ছে। তুমি ভুলে যাচ্ছো, আমি তোমার স্বামী। তোমার কিছু কর্তব্য আছে। তোমার প্রেমিকের সঙ্গে মজা করতে পারো, আমার সঙ্গে পারো না?
ছেড়ে দাও আমাকে, জানোয়ার কোথাকার। ডেলানি আঙুল ঢুকিয়ে টেনে গিল্ডার ব্লাউজটা ছিঁড়ে ফেললেন। একটা আচমকা ধাক্কা মারলেন, গিল্ডা হুড়মুড় করে পড়ে গেল।
ডেলানি চেয়ারে বসে গালাগালি দিতে থাকলেন ওকে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, উত্তেজনায় আমার মুখে ঘাম ফুটে উঠলো। বুকের মধ্যে খুনের নেশা টগবগ করে ফুটতে লাগলো।
গিল্ডা টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো, তার মুখ ফ্যাকাসে, চোখ জ্বলছে। যথেষ্ট হয়েছে, গিল্ডা বললো, আমি তোমার কাছে আর থাকবে না।
ডেলানি হেসে উঠলেন, কোথায় যেতে চাও যাও, তবে আমি মরে গেলে একটি পয়সাও পাবে না।
গিল্ডা শাবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
সমস্ত দৃশ্যটা দেখে আমি উত্তেজনায় কাঁপছিলাম।
কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারলাম, ডেলানি লাউঞ্জের আলো নিবিয়ে দিয়ে ঘরের দিকে চেয়ার চালিয়ে যাচ্ছেন। টের পেলাম যে দরজাটা সজোরে তিনি বন্ধ করে দিলেন।
রাত দুটোর সময় টর্চ জ্বালিয়ে দরজাটা খুললাম। কান পেতে রইলাম খানিকটা। সব নিস্তব্ধ। পা টিপে টিপে আমি লাউঞ্জে গেলাম। দরজাটা বন্ধ করে টি. ভি. সেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি করে আমি মেন সুইচের তারটা খুলে ফেললাম, সেটটার পেছনদিকের প্যানেলটা খুলে নিলাম। রিমোট কন্ট্রোলের তারটা এমনভাবে লাগালাম যাতে বর্ধিত কারেন্টটা সরাসরি কন্ট্রোল নবে চলে যায়।
মেন লাইনে টাইমসুইচ ক্লকটা লাগিয়ে সেটটার পিছনে আড়াল করে রেখে দিলাম।
সমস্ত জিনিসটা একবার মিলিয়ে নিলাম। ব্যাপারটা খুবই সহজ। টাইম ক্লকে দশটা বাজতে কুড়ি না হওয়া পর্যন্ত রিমোট কন্ট্রোল মারাত্মক হয়ে উঠবে না। সেই সময়ে ডেলানি ওটাকে ছুঁলে বর্ধিত কারেন্টের পুরো ধাক্কাটাই লাগবে।
ঐ টাইম ক্লকটাই গিল্ডাকে আড়াল করবে। দশটা বাজতে কুড়ির আগে কিছুই হচ্ছে না। ততক্ষণে গিল্ডা গ্লীন ক্যাম্পে চলে যাবে। যদি সে না যায়, আমি এসে কন্ট্রোল সুইচটা সামলে দিতে পারবো।
সব ঠিক আছে। এখন সমস্তটাই নির্ভর করছে গিল্ডার সকালবেলা গ্লীন ক্যাম্পে যাওয়ার ওপর।
যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিয়ে লাউঞ্জের জানলা খুলে বেরিয়ে এলাম। জানলাটা আবার বন্ধ করে দিয়ে বারান্দায় নেমে পড়লাম।