তৃতীয় পরিচ্ছেদ
০১.
একই ভাবে পরের তিনদিন কাটল। প্রতিদিন সকালে নটায় অফিসে আসতাম, ফিরতাম রাত সাতটায়। গেবলসের সামনের বড় রাস্তার মোড়ে একটা ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয় খেয়ে নিতাম। বড় বাড়িটায় আটটায় এসে পৌঁছতাম। ঘণ্টা দেড়েক ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচানা এবং দরকারি ফোন ও চিঠিপত্রের আলোচনায় আইকেনের সঙ্গে কাটাতাম। পরে নীচে ক্যাডিলাকে আসতাম যেখানে লুসিলি অপেক্ষা করছে।
দৈনন্দিন জীবনের বাকী সময়টা কোনরকমে এই মুহূর্তটা এলে যেন বেঁচে যেতাম। কিনসকে শুভরাত্রি বলায় সে যখন দরজাটা বন্ধ করে দিত তখন যেন সত্যিকারের জীবন ফিরে পেতাম।
আমি ও লুসিলি রাত সাড়ে নটা থেকে এগারটা পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতাম। বেশি কথা হত না সে গাড়ি চালাতে বেশি মনোযোগ দিত। তার সঙ্গে কথা বললেই দেখতাম গাড়িটা রাস্তায় বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরত। ক্যাডিলাকটা চালাতে সে এত আনন্দ পেত যে তার আনন্দের সময়ে কোনরকম বাধাকে সে আমল দিত না। গেবলসের ফটকের সামনে এসে যখন আমরা দাঁড়াতাম তখনই কেবল মিনিট পাঁচেক কথা বলে কাটাতাম।
তার সঙ্গে তিনটি সন্ধ্যা কাটাবার পর তার প্রতি আমার অনুরাগ এত বেড়ে গেল যে আবেগ সংযত করা আমার পক্ষে কষ্টকর হল।
আমার সঙ্গ পছন্দ করে এমন এক বন্ধুর মত ব্যবহার সেকরত। আমিও জানতাম সে আমাকে পছন্দ করে।
নিজের ব্যবহার নিয়েই আমার ভয় ছিল। জানতাম যদি সে সামান্য উৎসাহ দেখাত তবে তার সঙ্গে প্রেম করতে দ্বিধা করতাম না।
জানতাম আগুন নিয়ে খেলা করছি। আইকেন যদি কখনও জানতে পারেন আমার চাকরি যাবে। সে বলেছিল তিনি ভোগী মানুষ কিন্তু তার স্ত্রীকে নিয়ে তাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করবে তিনি কিছুতেই ছেড়ে দেবেন না।
যতক্ষণ না লুসিলি আমার প্রেমে পড়ছে ততক্ষণ গাড়ি চালানো শেখানোতে কোন ক্ষতি নেই কিন্তু নাগালের বাইরে যাবার আগে এসব থামিয়ে দেওয়াই ভাল।
তৃতীয় দিন শুভরাত্রি জানিয়ে বললাম, পরদিন রাতে আমি বাড়ি থাকব না। সপ্তাহের শেষের দিকটা মিঃ আইকেন আমাকে ছুটি দিয়েছেন তাই আমি থাকব না।
এতে কি বোঝায় যে আমি কাল কিছু শিখতে পারব না?
সোমবার রাত পর্যন্ত শেখা হবে না।
আপনি কি কোথায়ও যাচ্ছেন?
না, যাচ্ছি না।
তাহলে যথারীতি আসুন না কেন? এখানেই আমার দেখা পাবেন। বাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে না। আপনি আসতে চান না। তাই না?
চাই না, ঠিক তা নয়। তবে মাঝে মাঝে ভয় হয়। আমার বিশ্বাস, আপনার স্বামী জানতে পারলে রেগে আগুন হয়ে যাবেন।
সে হেসে দুই হাত আমার বাহুতে রেখে অল্প নাড়া দিয়ে বলল, সে সত্যিই রেগে যাবে, কিন্তু মনে করার কিছু নেই আমাদের। তাছাড়া সে কখনই দেখতে পাবে না।
ওয়াটকিনস বা মিসেস হেপল দেখে ফেলতে পারে….
তারা কোনদিনই রাতে বার হয় না। আমি আপনার বাড়িতে বাইসাইকেলে চেপে যাব। আপনার বাংলোটা দেখা হয়ে যাবে।
আপনি ওখানে যাবেন না। না, আপনার ওখানে যাওয়া উচিত হবে না। যদি সত্যিই আসতে চান তবে এখানে আসুন, আমি ঠিক নটায় এসে যাব।
সে গাড়ির দরজা খুলে বেরোতে বেরোতে বলল, আমি এখানেই আসব। চেস, তোমার মত সুন্দর লোক দেখিনি। অনেকটা শিখে ফেলেছি তাই না? আশা করি, দু–এক দিনের মধ্যেই পারমিটের জন্য দরখাস্ত দিতে পারব।
সুন্দর শিখেছ। ঠিক আছে, কাল দেখা হবে।
বাড়ি ফিরে ডবল হুইস্কি ও সোডা নিয়ে বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে বসে নিজের অবস্থাটা ভাবছিলাম।
গত পাঁচ রাত ধরে তাকে জানার পর এটুকু বুঝেছি যে তাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়ের প্রেমে পড়তে পারি না। কিন্তু সে কি ভাবছে, ঠিক এই ব্যাপারটাই আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
বাংলোতে আসার প্রস্তাবটা আমার চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। তাকে বলেছিলাম চাকরটা সন্ধ্যে সাতটার সময় চলে যায় এবং আমি একাই থাকি।
সে কখনও উৎসাহ দেখায়নি এবং বোঝাতে চায়নি যে আমি একজন সাহায্যকারী বন্ধুর চেয়ে বেশী কিছুনয়। প্রতিদানে কিছু আশা না রেখেই কি গাড়ি চালানো শেখাচ্ছে বা তাকে প্রচুর আনন্দ দিচ্ছে।
দেখতে হবে আমি যে ঝুঁকি নিয়েছি সে তা বোঝে কিনা। সমস্ত ভবিষ্যটা ভরাডুবি দিতে চলেছে। আইকেন জানতে পারলে নিউইয়র্কের চাকরীটা ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাবে।
সারারাত ছটফট করে কাটালাম। পরদিন অফিসে মেজাজ বেশ গরম ছিল। যখন সব কাজ শেষ করে সপ্তাহের শেষে দেখার জন্যে কাগজপত্র চেয়ে নিলাম তখন স্বস্তি পেলাম।
বিনা প্রতিবাদে আমার মেজাজ সহ্য করার পর প্যাট সই করার জন্য কয়েকটা কাগজ নিয়ে এল।
হায় ভগবান! ভেবেছিলাম সব কিছু সই করে দিয়েছি।
মাত্র ছটা।
দ্রুতগতিতে কাগজের উপর সই করে বললাম, প্রথমতঃ সোমবার ফিরব। এখনই বেরিয়ে যাচ্ছি। ছটা বেজে গেছে, তাই না?
প্রায় সাড়ে ছটা, এখনই বেরিয়ে যাচ্ছো?
ভুরু কুঁচকে বললাম, জানি না। যেতে পারি। সম্ভবত গলফ খেলব।
আশা করি ভালভাবে বিশ্রাম নেবে। কিছু ভাবতে হবে না চেস, তোমার সব কাজ সুন্দর ভাবেই হচ্ছে।
রাগের সঙ্গে বললাম, সোমবার দেখা হবে। মাথা নেড়ে তার কাছে বিদায় নিলাম।
জো তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, স্টেশন পর্যন্ত লিস্ট দেবে, চেস?
হ্যাঁ।
তাকে সঙ্গে নিতে ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বাড়ি যাবার পথে স্টেশন পড়ে।
যখন নিচে নামছিলাম জো জিজ্ঞাসা করল, আজ আর. এ.–কে দেখতে যাচ্ছ?
না, তিনি আমাকে সপ্তাহের শেষটা ছুটি নিতে বলেছেন। ওয়াসারম্যানের টি ভি স্ক্রিপটা সঙ্গে নিয়েছি দেখার জন্য। মনে হয় খুব খারাপ নয়।
কাজকর্ম ফেলে তুমি ছুটি নাও না কেন? তোমাকে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে। উদ্বেগের কারণ কি?
কিছুই নয়, আমার ক্যাডিলাকটার দিকে যাবার সময় বললাম।
জো আমার সঙ্গে এল।
হ্যাঁ, গত দুদিন ধরে তুমি পাউলাকে কাঁদিয়ে ছেড়েছ।
পাউলা ভীষণ ভীতু। ওয়াসারম্যানের সঙ্গে ফোনের লাইন দিতে, কিন্তু একবারও পারে নি।
হয়তো খারাপ ছিল।
ইঞ্জিন চালু করলাম।
এসব কি জো?
এস যাই সীটে বসতে বসতে জো বলল। এবার আমার পালা। ঠিক আছে, তবে একটু বিশ্রাম কর। কাজে হুমড়ি খেয়ে পড়েছি।
সে ঠিক বলছে আমি জানতাম, সেজন্য লজ্জা বোধ হল।
দুঃখিত, জো। সপ্তাহের শেষে ঠিক হয়ে উঠব।
আমিও সেই ভাবে চলব, জো বলল। এখন তোমার অনেক কাজ। আলোচনার বিষয় পালটে সে বলে চলল, জান এই গাড়িটার জন্যে তোমাকে হিংসে করি।
আমার ক্যাডিলাক কেনার শখ ছিল। দাম প্রচুর কিন্তু পয়সা উঠে এসেছে। যদিও আঠার মাস, এখনও বেচলে প্রচুর দাম পাব।
যদি নিউইয়র্কের পরিকল্পনা দানা বাঁধে আর আমার মাইনে বাড়িয়ে দেয় তবে যে কোন ভাবে আমিও একটা গাড়ি কিনব।
প্ল্যানটা যদি ঠিক হয়, জো, তবে চেষ্টা করব যাতে তোমার মাইনে বাড়ে।
ভবিষ্যৎ নিয়ে আর কোন কথা বলেছে?
গত রাতে একবার বলেছিলেন কত তাড়াতাড়ি আমি টাকাটা তুলতে পারব।
তুমি কি মনে কর, চেস তার ব্যবসায়ে টাকা খাটান ঠিক হবে?
নিউইয়র্কের ব্যবসা কখনও খারাপ হতে পারে না। যদি ব্যবসার ঝুঁকি নিই তবে মাইনে ছাড়াও লাভের শতকরা পাঁচ ভাগ পাব। এই সুযোগ ছাড়া পাগলামি। ব্যবসা মোটামুটি আমিই দেখব। ফলে আমার স্বার্থ আমিই রক্ষা করতে পারব।
জো বলল, আমারও এমন সুযোগ পেতে ইচ্ছে করছে। মোট লাভের শতকরা পাঁচ ভাগ। বড়লোক হতে চলেছ, চেস।
দেখ জো, ভাগ্য নির্ভর করবে ব্যবসা কেমন চলবে তার ওপর।
কত শীঘ্র ব্যবসা খাড়া করতে পারবে, চেস?
দালালদের বলেছি কাজ চালাতে, কয়েকদিনের মধ্যেই জানতে পারব। বাজার এখন বেশ চড়া। ভাগ্যের ব্যাপার ডুবেও যেতে পারি।
স্টেশনের কাছে আসতেই গাড়ি থামালাম। জো গাড়ি থেকে বেরিয়ে বলল, ধন্যবাদ চেস। এমন দিনও আসতে পারে যেদিন আমি এই গাড়িটাই হয়ত কিনে নেব। যখন নিউইয়র্ক যাবে তখন একটা এলডোরাডো নিতে পারবে। তুমি কি আমার কাছে বিক্রী করার কথা ভাবতে পার?
দাঁত চেপে তার দিকে চেয়ে বললাম, টাকা জোগাড় না করা পর্যন্ত অপেক্ষা কর, তবে আমি কিনতে পারব। সপ্তাহের শেষটা ভালভাবে কাটাবে আশা করি।
তাড়াতাড়ি বাংলোর দিকে ছুটলাম।
.
০২.
আমি গেবলসের প্রবেশ পথের ফটকটার সামনে নটা বাজতে এক মিনিট আগে এসে। পৌঁছলাম।
লুসিলি ছায়ায় দাঁড়িয়েছিল আমার অপেক্ষায়।
তাকে এগোতে দেখেই আমি গাড়ির দরজা খুললাম। চাঁদের আলোয় দেখলাম সে একটা হালকা নীল পোশাক ও জ্বলজ্বলে রং-এর স্কার্ট পরে। সরু ফিতে দিয়ে চুলটা বাঁধা। সুন্দর দেখাচ্ছিল।
সে ড্রাইভিং হুইলের নিচে বসতেই আমি সরে যাচ্ছিলাম।
সে হেসে বলল, হ্যালো। তোমার সময়জ্ঞান দারুণ। আমার পোশাক পছন্দ হয়েছে? কেবল তোমার জন্যেই এটা পরেছি।
দারুণ।
তোমাকেও দারুণ দেখাচ্ছে।
তুমি কি সত্যিই তাই ভাবছ?
হ্যাঁ
আচ্ছা, আমরা আজ কোথায় যাব? চল, আজ সমুদ্রের দিকে যাই।
ঠিক আছে।
সে রাতে সে জোরে গাড়ি না চালিয়ে ঘণ্টায় পঁচিশ মাইল বেগে সুন্দরভাবে গাড়ি চালাল।
সে গাড়ি চালানোর সঙ্গে গুনগুন করে গান করছিল। বুকের ভিতরটা মোচড় দিল যখন বুঝলাম সে শীঘ্র পারমিট করবে আর গাড়ি চালানোও শেষ হয়ে যাবে।
একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম। একটা খাড়া বাঁক নিতেই দেখলাম সামনে বালির স্তর, পামগাছের সারি ও সমুদ্রের জল চকচক করছিল।
গাড়ি চালানোর পর এই প্রথম কথা বলল, কি সুন্দর তাই না? বুঝতে পারবে না এই গাড়িটা চালিয়ে আমি কত আনন্দই না পাচ্ছি। চেস্, এর মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই। আমি এখন সত্যিই ভাল চালাচ্ছি, তাই না?
খারাপ নয়। তবে পারমিটের দরখাস্ত দেবার আগে আরও প্র্যাকটিস দরকার। তুমি এখনও পিছনে চালাতে পার না। পিছনে চালাবে এখন?
এখন নয়।
গাড়ির গতিবেগ কমিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল। চাঁদের স্বচ্ছ আলোয় মাইলের পর মাইল সমুদ্রতট পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। সেখানে কোন জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। মনে হচ্ছিল সমগ্র পৃথিবীতে কেবল আমরা দুজন।
গাড়ির আলো নিভিয়ে সে বলল, সাঁতার কাটতে যাচ্ছি। তুমি কি আসবে?
চমকে বললাম, তোমার গাড়ি চালানো শেখার কথা। সময় বেশি নেই। এখন দশটা বাজতে কুড়ি মিনিট।
রোজারকে বলে এসেছি সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। মাঝরাতের আগে আশা করবে না। গাড়ি খুলে সে বাইরে এল। এখানে কেউ নেই সমুদ্রতট এখন আমাদের। যদি সাঁতার কাটতে না চাও গাড়িতে বস আর আমার জন্যে অপেক্ষা করবে।
বালির উপর দিয়ে ছুটে গেল পাম গাছের দিকে।
গাড়িতে বসে লক্ষ্য করছিলাম। যে প্রশ্ন রাতের পর রাত আমাকে উতলা করে তুলেছিল, তারই উত্তর। যদি এর অর্থ আমার প্রতি প্রেম করার সুযোগনা হয় তাহলে সে এই নির্জন জায়গায় আসত না।
মনে মনে বললাম, আইকেনের স্ত্রীকে বোকা বানাতে চাইছ। এখন যদি এ পথে এগিয়ে যাও তবে সারা জীবন তার জন্য অনুতাপ করতে হবে।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। সে তখন পাম সারির কাছে। সে জুতো দুটো ছুঁড়ে দিল, পরে উপরের জামাটা নিচের দিকে টেনে খুললো নীচে সাঁতারের পোশাক ছিল।
গাড়ির পেছনে গিয়ে জুতো খুলে তোয়ালে ও সাঁতারের পোশাক নিলাম। আমি সবসময়ই এই পোশাকটা গাড়িতে রাখি। তোয়ালে পরে এগিয়ে গেলাম।
সে আমার দিকে ফিরে হাসল, জানতাম তুমি আসবে। চিরদিন চাঁদের আলোয় সাঁতার কাটতে ভালবাসি কিন্তু রোজার কিছুতেই দেবে না। তার ধারণা এ কাজ বিপজ্জনক।
মনে হচ্ছে যে কাজগুলো তোমার করা উচিত নয় সেগুলোই আমার সঙ্গে করছ।
সে জন্যেই তোমাকে এত পছন্দ করি।
তারপর সে ছুটে ছপাৎ করে জলে এসে পড়ল।
সে কিন্তু সত্যিই সাঁতার কাটতে খুব ভাল পারে। সে আমার নাগালের বাইরে চলে গেল কিছুক্ষণ পরেই সে যত বেগে গিয়েছিল সেই বেগেই ফিরে এল।
সে আমার চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল।
এখানে আসার জন্যে তোমার আনন্দ হচ্ছে না?
হচ্ছে।
আমি চিত হয়ে চাঁদের দিকে ভাসতে লাগলাম। সাঁতার কাটা শেষ করে ফিরে যাবার জন্য আমি তখন অধীর। সে ফিরে এসে আমার পাশে ভাসতে লাগল।
আর বিলম্ব সহ্য করতে পারলাম না।
এবার ফিরে যাওয়া যাক।
আমরা সাঁতার কেটে তীরে উঠে এলাম। সে তার পোশাকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, চেস, কাল কি করবে?
জানি না…বিশেষ কিছু নয়। গলফ খেলতে পারি।
কাল দেখা হবে কিনা জানি না। আমার এক মেয়ে বন্ধু কাল নিমন্ত্রণ করেছে। তাকে এড়িয়ে কাল অনেক দূরের গ্রামে যাওয়া যায়।
একটা তোয়ালে তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে অন্যটা দিয়ে আমার মাথা মুছে বালির উপর বসে বললাম, দেখা যাক কি করা যায়।
একটু সাবধান হওয়া দরকার। সাইকেলে আমি তোমার বাড়ি আসতে পারি। বড় রাস্তা এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।
আমার মনে হয় লুসিলি, দিনের বেলায় দেখা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। যে কেউ দেখে ফেলতে পারে।
আমার পাশে বসে বলল, চুপচাপ বসে থাকা ভয়ানক বিরক্তিকর। তাই না?
নিশ্চয়ই।
সমস্ত দিন গাড়ি চেপে ঘুরে বেড়ান বেশ মজার। তাই না? আমরা কাল পিকনিক করতে পারি। তুমি কি মনে কর, এটুকু ঝুঁকি নেওয়া যায় না?
তুমি এরকম ঝুঁকি নিতে চাও?
বুঝতে পারছি না কে আমাদের দেখবে। আমি বেশ বড় কালোটুপি ও সানগ্লাস পরতে পারি চুলটা উপর দিকে তুলে নিতে পারি। বাজী রেখে বলছি কেউ চিনতে পারবে না।
যদি তোমার স্বামী জানতে পারেন, লুসিলি, তুমি ভয় করবে কি?
সে চিবুকটা হাঁটুতে ঠেকিয়ে বলল, হ্যাঁ করব।
তিনি কি করবেন তোমার মনে হয়?
নিশ্চয়ই ভীষণ রেগে যাবেন। তোমার বাড়িতেও সারাটা দিন একসঙ্গে কাটাতে পারি। বেশ নির্জন, তাই না? আমরা সাঁতার কাটতে পারি, পিকনিক করতে পারি। কেউ দেখতে পাবে না
তুমি নিশ্চয়ই সিরিয়াস নও, তাই না?
না, মনে হয় সিরিয়াস নই। বেশ শীত করছে, পোশাক পরতে যাচ্ছি।
সে লাফ দিয়ে উঠে তার পোশাক ও জুতো নিয়ে গাড়িটার দিকে ছুটল।
প্রায় দশ মিনিট আমি সেইভাবে পাথরের মত বসেছিলাম। সে আমাকে ডাকছে।
চেস…।
আমি নড়লাম না, ফিরে চাইলামও না।
আসবে না, চেস?
তবুও ফিরে চাইলাম না।
সে ছুটে এসে আমার পাশে এসে, তোমাকে ডাকছি, শুনতে পাও নি?
সে এখন পোশাক পরে নিয়েছে কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হল না যে সে জামার নীচে কিছুই। পরেনি।
বসবে, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
বালির উপর কয়েক ফুট দূরে সে পা মুড়ে বসে, বল, চেস।
তুমি কি সত্যিই চাও কাল গাড়ি নিয়ে পিকনিক করতে যাব–কেবল আমরা দুজনে?
সে অবাক হয়ে, মনে হয় তুমিই বলেছিলে…।
তুমি কি পিকনিক করতে চাও?
কেন, না? নিশ্চয়ই চাই।
ঠিক আছে। তোমার স্বামীকে গিয়ে বল যে আগামীকাল সারাটা দিন তুমি আমার সঙ্গে কাটাবে। যদি তিনি রাজী থাকেন তবে আমরা যাব।
আমি তা করতে পারব না। সে–সে জানে না যে আমি তোমাকে চিনি।
তাহলে বল যে আমাদের পরিচয় হয়েছে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি রাগ করেছ মনে হচ্ছে। কি ব্যাপার চেস?
গিয়ে বল যে আমাদের পরিচয় হয়েছে।
আমি তা পারব না। সে কিছুতেই পছন্দ করবে না।
কেন না?
চেস, আমার মনে হয় এসব বন্ধ করে দাও। সে আমার ব্যাপারে ঈর্ষাকাতর এবং বোকার মত ব্যবহার করে। সে কিছুতেই বুঝতে চাইবে না।
কি বুঝতে চাইবেন না?
চেস, তোমাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। কি ব্যাপার?
আমাকে বল, তিনি কি বুঝতে চাইবেন না।
সে চায় না আমি অন্য মানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই।
কেন? তিনি কি তোমাকে বিশ্বাস করেন না?
চেস? কি হয়েছে? এত রাগ করছ কেন? কেন তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছ?
তিনি কি মনে করেন যে আমার সঙ্গে বাইরে গেলে বিশ্বাস হারাবে?
আমি জানি না চেস। যদি এইভাবে বকে চল, আমি এখনই এখান থেকে চলে যাব।
ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষেপে বললাম, কেন পছন্দ করছ না? সত্য ঘটনার মুখোমুখি হতে ভয় কোথায়? তুমি বিবাহিত, তাই না? তুমি কুমারীনও। তুমি নিশ্চয়ই জান যখন তোমার মত সুন্দরী মেয়ে কোন মানুষকে রাতের বেলায় নির্জন স্থানে নিয়ে আসে, তখন তার মনের অবস্থা কেমন হয়। তুমি কি এতই বোকা যে এসব বোঝ না?
সামনে এগিয়ে গিয়ে বললাম, লুসিলি, তুমি কি আমাকে ভালবাস?
সে শক্ত হয়ে বলল, তোমার সঙ্গে প্রেম? না, না, এসব কি বলছ?
আমার গলা সপ্তমে উঠে গেল, তবে কেন এখানে এসেছ? কেন নিজেকে আমার ওপর। চাপিয়ে দিতে চাইছ? তুমি কি মনে কর আমি পাথর দিয়ে তৈরী?
আমি যাচ্ছি…।
আমি ছুটে গিয়ে তার মনিবন্ধ চেপে ধরলাম ও নিজের দিকে টান দিলাম। তার মুখটা তখন আমার মুখের কাছে।
চেস আমাকে যেতে দাও।
আমি পাথর দিয়ে তৈরীনই, বলেই তার মুখের ওপর মুখ রাখতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু আশ্চর্য তার গায়ে ভয়ানক জোর। সে একটা হাত মুক্ত করে ভয়ানক জোরে আমার মুখে মারল।
ঘা খেয়ে আমার জ্ঞান ফিরল।
আমি তাকে যেতে দিলাম। সে জোরে গাড়ির দিকে ছুটল।
সমুদ্রের দিকে চেয়ে চুপ করে বসেছিলাম। হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
ক্যাডিলাকটা চলতে লাগল।
লুসিলি! যেও না…লুসিলি!
গাড়িটা জোরে বৃত্তাকারে ঘুরে সমুদ্রতটের রাস্তার উপর দিয়ে ছুটল।
লুসিলি।
আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠল ইঞ্জিনের একটানা শব্দে।