২. কলের উৎস

বুধবার, সাতাশে মে :

আর্নল্ড যদি কথাবার্তা চালিয়ে যেত তাহলে ওর কলের উৎসটা জেনে যেতো। এ ব্যাপারে মার্টেল নিশ্চিত। প্রকৃত আনন্ডের চেয়ে নকল আর্নল্ডের কাজকর্মই বেশী ভাল।

বুথ ছেড়ে মার্টেল হাউপ্টব্যানহফের দিকে এগোলো। খানিকটা ঘোরাফেরা করল। ডিপারচার বোর্ডটা দেখল। মিউনিকে এর অংশটায় খুন হয়ে যাওয়া ওয়ার্নারের জন্যে একটা মোহ জড়িয়ে আছে।

মাৰ্টেল জায়গাটার একটা তালিকা করলো। গ্রেইস এক থেকে সোল। সবশুদ্ধ ষোলটা প্লাটফর্ম। রাস্তাগুলো এখানেই শেষ হয়েছে। সারি সারি ফোনবুথ। অনেকগুলো ঢাকার আর বেরোবার রাস্তা। ম্যাক বুথও আছে।

মার্টেল দ্রুত রাস্তায় নামল। হাঁটতে হাঁটতে লিমাট নদীর ধারে এসে দাঁড়ালো। এই জলের মধ্যেই ক্লেয়ার হারের ক্ষত-বিক্ষত দেহ পড়েছিল। শোধ ওকে নিতেই হবে, কারণ নৃশংস ব্যাপারটা ওকে খুবই আঘাত করেছে।

চারিদিকে পুলিস কোয়ার্টার। এখানেই ওর বন্ধু ইন্টেলিজেন্স-এর চীফ ইন্সপেক্টর ডেভিড নাগেল কাজ করে। ঘড়িতে দেখল পৌনে এগারোটা। শেষ ট্রেন ছাড়তে আর এক ঘণ্টাও বাকী নেই। জুরিখের এই মরণফাঁদ থেকে মুক্তি পেতেই হবে।

ও লিনডেনহফস্ট্রাসেতে গিয়ে পুলিস হেড কোয়ার্টারে ঢুকল। সামনেই রিসেপশনিস্ট জানাল নাগেল অফিসে আছে, কিন্তু দেখা করতে হলে ফর্ম পূরণ করতে হবে।

মার্টেল তা না করে গম্ভীর মুখে জানালো, ওকে গিয়ে আমার নাম বলল। তাড়াতাড়ি, আমার সময় মূল্যবান।

লোকটা আমতা আমতা করতেই মার্টেল বলল, ও আমার জন্যেই অপেক্ষা করছে…।

***

কয়েক মিনিটের মধ্যে ও নাগেলের খোলামেলা অফিসঘরে ঢুকে গেল।

–আমি তো তোমাকেই আশা করেছিলাম। করমর্দন করে নাগেল বলল, টুইড আমাকে লন্ডন থেকে জানিয়েছিল তুমি আসছো, কোন সাহায্যের দরকার?

ডেভিড জাতে সুইস। সুগঠিত চেহারা, কালো গোঁফ, কালো চুল, ধূর্ত–চোখ। অবিবাহিত, বুদ্ধিমান, স্পষ্টভাষী।

-তুমি তো ফর্মটা পূরণ করেনি, তাই না? নাগেলের চোখেমুখে যেন অস্বস্তি। মার্টেল চোখ থেকে সৌখিন চশমাটা খুলল। নাগেল ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ফার্দি আর্নল্ডের সিকিউরিটির লোকেরা তোমাকে সব জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছে।

 মার্টেল সিগারেট খেতে আরম্ভ করল। টুইড ওকে জানিয়েছিল, নাগেল আর্নল্ডকে অপছন্দ করে। নাগেল বলল, তোমার নামটা কোন ব্যাপার নয়। তুমি কোড নাম ব্যবহার করবে আর কোন অফিসিয়াল রেকর্ড রাখবে না। আমি আমার রিসেপশানের লোকটাকে বলে দেবে, তুমি আমার বিশ্বস্ত লোক। তাহলে আর্নল্ডের লোকজনের হাত থেকে রেহাই পেতে সহজ হবে।

 মার্টেল মাথা নাড়লো।নাগেল বলল, এখানে আমার ফোন নাম্বার আছে। জরুরী হলে অবশ্যই ফোন করবে।

দশ মিনিট আগে হফার আমাকে ফোন করেছিল। ও জানতে আমরা বন্ধু। ক্লেয়ারকে আমি বিশ্বাস।

মার্টেল শরীরে শিহরণ বোধ করল। ওর সামনের ঘূর্ণাবর্ত আরো দ্বিগুণ জোরে ঘুরে চলেছে।

***

বুধবার, সাতাশে মে :

 সিগারেট হোল্ডারটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরেছিল।

 নাগেলের কথা ওর মনে পড়ল, দশ মিনিট আগে ও ফোন করেছিল।

আধঘণ্টা আগে আর্নল্ড ওকে ফোনে বলেছিল ক্লেয়ারের মৃতদেহ লিমাট নদীতে পাওয়া গেছে। সুতরাং এই ঘটনার এক ঘণ্টা আগে হফার বেঁচেছিল। নাগেলের লেখা সেন্ট গ্যালেনের ফোন নম্বরের কাগজটা এখন ওর হাতে ধরা। নাগেলের কণ্ঠস্বর মার্টেল চেনে।

-কোথাও গণ্ডগোল একটা…? নাগালের নরম কণ্ঠস্বর মার্টেলের কানে গেল।

–হুঁ,বলে কাগজের টুকরোটা ও পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। জিজ্ঞেস করলো,রাতে কি করছো?

রুটিন মাফিক কাজ।

মার্টেল ভাবতে লাগল গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ব্যক্তি। সে এখনও নিজেই জানে না ব্যানহফস্ট্রাসেতে কি ঘটেছে?

ফার্দি আর্নল্ডকে তুমি অবিশ্বাস করো কেন?

-আচ্ছা তাহলে হফার, যে আর্নল্ড-এর হয়েই কাজ করে, তোমাকে আমার কথা বলেছিল ওই তো…?

–আসলে ক্লেয়ার জানে আমরা দুজনে বন্ধু। ও পাল্টা গুপ্তচর হবার আগেই আমার কাজ করছিল।

–তুমি বললে, আজ রাতে রুটিন মাফিক কাজ আছে।

-না একটা অন্য কাজও আছে। লিমাট নদীর দিক থেকে একটা শব্দ পেয়েছিলাম, একটা লঞ্চে বিস্ফোরণে এক হতভাগা মারা গেছে। এই বলে নাগেল জানলার ধারে তাকালো।

মার্টেল নাগেলের দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকালো। নাঃ ও কোনরকম মিথ্যে কথা বলছে না বলেই মার্টেলের মনে হল।

আবার দেখা হবে? চলি। কিন্তু আমি তোমাকে কিছু বলতে চাইছি, তুমি শুনছো না। নাগেল ওকে তিনটে ফোন দেখিয়ে বলল, এর মধ্যে তোমাকে একটা ছেড়ে দিতে পারি..ঐখানে সুইচবোর্ডে সরাসরি লাইন আছে।

না ডেভিড, তার দরকার নেই। আমার সময় কম।

যাইহোক মার্টেল, জরিখ সফর তোমার সখের হোক এই কামনা করি।

***

– ঠিক এগারোটায় মার্টেল পুলিস হেড কোয়ার্টার ছাড়ল। সেন্ট গ্যালেনের ট্রেনের আর আধ ঘণ্টা সময় আছে, ওকে ধরতে হবে। বাইরে এল। দুটো পেট্রল কার পার্ক করা আছে। দুজন ইউনিফর্মধারী বসে আছে। বহফসট্রাসের সেই শয়তানটা এখন কোথায়?

হাউপ্টব্যানহফ-এ যেতে হবে বলে ও মিথ্যে বলেছে। মার্টেল ভাবল এই সুইসটাকে বিশ্বাস করা যেতে পারে, কিন্তু ফোনের ব্যাপারটাতে নয়।

স্টেশনের সামনেই অনেকগুলো ফাঁকা বুথ। একটায় ঢুকলো ও। নাগেলের দেওয়া নম্বরে ডায়াল করলো ও।

সেন্ট গ্যালেনের হোটেলের রিসেপশনিস্ট বলল, ক্লেয়ার হফার ওদের সঙ্গে ছিল। মেয়েটি ওকে অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল।

খানিক পরে একটা ফোন এলো, ওপারে মহিলা কণ্ঠস্বর। মার্টেল জিজ্ঞেস করলো, কে বলছো?

জবাব এলো, আমাদের বন্ধু নাগেল, তোমার কথা আমাকে জানিয়েছে। আমি চাই দ্রুত ব্যবস্থা নাও। বাইরে যদি কোন ফোন পাও তাহলে এই নাম্বারে ফোন করো।

বলে ও বুথের নাম্বারটা বলে গেল। আবোও বলল, এটা জুরিখের ফোন নাম্বার। যাইহোক আমার হাতে সময় কম। গুডবাই…।

মার্টেল ঘামতে ঘামতে অনুভব করলো যে ও ক্রমশঃ ফাঁদে পড়ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার তুলে শুনল, সেই একই কণ্ঠস্বর।

আমাদের বন্ধুর নামটা…

ডেভিড নাগেল…।

–ক্লেয়ার হফার কথা বলছি…।

–আমি যা বলেছি তুমি তাড়াতাড়ি করো। হোটেলে একটা যুক্তি খাড়া করে বিলটা মিটিয়ে দাও।

–শোন, সেন্ট গ্যালোনে আর একটা হোটেল নিয়ে আমার জন্যে একটা ঘর রিজার্ভ করো। ওদের বলল আমি ঠিক ভোর একটায় পৌঁছবো। ট্রেনে যাবো।

মার্টেল ফোনটা ছেড়ে দিয়ে ভাবল সময় অতি মূল্যবান। মেয়েটাকে ভালই লাগল। ওর মনে হল যেন ও কোন মৃতের সঙ্গে কথা বলেছে। আবর্তটা ওর চোখের সামনে আরো সজোরে ঘুরতে লাগল।

মার্টেল সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে রাখল। ওর মনের মধ্যে কেমন যেন অস্থিরতা। চারিদিকে তাকালো ফাঁকা জায়গা। কয়েন বক্সটা একবার দেখল। ও একটা ড্রাগ মুখে দিলো। আবার ফোন করলো। আবার সেই মেয়েলী কণ্ঠস্বর।

আমাদের বন্ধু…।

নাগেল, আমি মাৰ্টেল…।

বাঃ, কপালটা ভালই। দোতলার ঘরে দুটো বিছানা। হোটেল মেট্রোপল। স্টেশনের বাইরের দিকে মুখ। তুমি চলে এসো। আমার ঘরের নাম্বারটা খামের মধ্যে রেখে আসবো। কেমন? ভালই হবে। গুড বাই।

পরের কয়েক মিনিট মার্টেল দ্রুত কাজ সারলো। হোটেলে ও ঘর ভাড়া নিয়েছে যদিও বেশীক্ষণের জন্যে নয়। বাতিল করতেই হত।

হোটেলের রেজিস্ট্রেশান ফর্মে লিখল, আমি কনসালট্যান্ট মেডিক্যাল। আমার একটা রোগীর বাড়িতে যেতে হবে। লিখে সই করল।

***

ওর ব্যাগটা ভোলাই আছে। যখন কোথাও যায় তখন এই ভাবেই ও সাবধান হয়। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে এলো। স্টেশনের বাইরের প্রথম ট্যাক্সিতে চেপে ড্রাইভারকে প্যারোডিপ্লেসে’ নিয়ে যেতে বলল। ওখানে আমি একজনকে একটা জিনিষ দিয়ে আবার তোমার গাড়িতেই আবার এখানে আসবো। তুমি ট্রাম স্টপেজে অপেক্ষা করবে।

ড্রাইভার সম্মত হলো। গাড়ি এগোল। রাস্তা-ঘাট ফঁকা।

সেন্ট গ্যালেনের ট্রেন ছাড়বার কয়েক মিনিট বাকি। ওর বিশ্বাস ম্যানেজ করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। বিস্ফোরণের জায়গাটাও দেখেছে।

মার্টেল ড্রাইভারকে বললো, কিছুক্ষণ আগে এখানে একটা বিস্ফোরণ হয়েছিল, শুনেছিলে।

–হুঁ, শুনেছি। তবে গুজব নৌকোয় একজন ট্যুরিস্ট মারা গেছে।

মার্টেল বুঝলো ব্যাপারটায় এখন সবাই সতর্ক হয়ে গেছে। ওরা এতক্ষণে প্যারোডিপ্লেসে’ চলে এসেছে। ড্রাইভার বললো, একটু আগে পুলিশের মুখে শোনা…।

–পুলিশ? ভুরু কুঁচকে মার্টেল বলল।

–হুঁ, হাউপ্টব্যানহফে একটা পেট্রোল কার থেমেছিল। ওর ড্রাইভারটা এসে ট্যুরিস্টের ব্যাপারটা বলেছিল।

–চেনো নাকি?

 আমি এই শহরে কুড়ি বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছি, শহরের প্রতিটা পুলিশকে আমি চিনি। কিন্তু একে আমি আগে কখনও দেখিনি।

সম্ভবতঃ নতুন…।

না, বয়েস অনেক। যাইহোক আমি এখানেই দাঁড়াই?

প্যারোডিপ্লেসের মধ্যেই গাড়িটা পার্ক করা হলো। মার্টেল এগোল।

রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা। নিজের জুতোর শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি রাস্তা পেরিয়ে থমকে দাঁড়ালো। সেই আবর্ত ওর চোখের সামনে আবার পাক খেতে লাগল।

দু-ঘন্টা আগের সেই রক্তাক্ত ঘটনার চিহ্নমাত্র নেই। সঠিক জায়গায় যে সে এসেছে, সেই খিলানটা দেখে চিনলো। এখানেই ও আর মেয়েটা এসেছিল। ডানদিকে বড় ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কের দরজায় ডাবল প্লেটের কাঁচ লাগানো।

রাস্তার ধারে কোথাও কাঁচের চিহ্ন নেই। সুইসরা রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখতে নিপুণ। কিন্তু এখানে কেমন যেন বিবেচনার অভাব।

রাস্তায় এখন রক্তের কোন চিহ্নই নেই। ওর জুতোয় এখনও সেই শুকিয়ে যাওয়া রক্ত লেগে আছে। বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া গাছটার বদলে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নতুন একটা গাছবসান হয়েছে। সুইসরা এমনই নিখুঁত।

***

বৃহস্পতিবার, আঠাশে মেঃ

ব্যাভেরিয়ার অ্যালগাও’তে একেবারে ভেতরের দিকের একটা জায়গা। নিজের লাইব্রেরীর ঘরের জানালার সামনে রেইনহার্ড দিয়েত্রিচ দাঁড়িয়েছিল। মাঝ রাত অতিক্রম করে গেছে বৈদ্যুতিক সংকেত যন্ত্রটা একটানা বাজতে আরম্ভ করল।

ও এসে একটা ড্রয়ারের চাবি খুলল।

রিসিভারটা তুলল।

 এরউইন ভিনজ নিজের পরিচয় দিতেই দিয়েত্রিচের কণ্ঠস্বর সংক্ষিপ্ত হয়ে গেল।

 গম্ভীরভাবে বলল, খবর আছে?

–ইংরেজটা জুরিখ ছেড়ে গেছে।হাউপ্টব্যানহফ থেকে এগারোটা উনচল্লিশের ট্রেন ধরেছে। আমাদের লোকেরা পৌঁছবার আগেই ও কম্পার্টমেন্টে ঢুকে গেল।

জুরিখ ছেড়ে গেল! কি বলছো? সেন্ট্রাল হক অ্যাপার্টমেন্টে কি হল?– অপারেশন সম্পূর্ণ সফল হয় নি।ভি নার্ভাস গলায় বলে উঠল। দিয়েত্রিচের মুখটা কঠিন হয়ে গেল। কোথায় কি হয়েছে সঠিক ভাবে আমায় বল।

–মেয়েটা একেবারে ছুটি নিয়েছে। সুতরাং ওর কাজের ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। আমাদের যেটা লাভ হল, ও কোনরকম খবর দিতে পারবে না। ওর ব্যাপারে তোমার ভয়ের কিছু নেই।

–কিন্তু মার্টেলের বিষয়ে ভয়ের আছে বইকি! ও কোথায়? কোন্ ট্রেনে গেছে?

–ওর গন্তব্যস্থল সেন্ট গ্যালেন।

–দিয়েত্রিচ রিসিভারটা মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে ভিনজকে কিছু নির্দেশ দিয়ে ফোনটা ড্রয়ারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল।

ব্রান্ডির গ্লাসে চুমুক দিয়েই গ্লাস শেষ করে বেলটা বাজাল।

একজন কুঁজো লোক ঘরে ঢুকল। মাথার দু’পাশের কানদুটো একেবারে চ্যাপটা। পরনে সবুজ পোষাক। প্রভুর গ্লাসটা হাতে নিল ও।

–অস্কার আরও ব্রান্ডি নিয়ে এসো। ভিনজ আর ওর দলের লোকেরা কাজটা নষ্ট করেছে। মার্টেল এতক্ষণে সেন্ট গ্যালেনে। আমরা তো ইংরেজটার সঙ্গে অস্কার বলল।

দিয়েত্রিচের বয়স ষাটের মত।নাকের নীচে মোটা গোঁফ, রূপোলী চুল, লম্বা সুগঠিত চেহারা। পোষাক-পরিচ্ছদে স্মার্ট লাগছিল।

ও প্রথমে ইলেকট্রনিক্‌সের লাইনে ঢুকেছিল। হেডকোয়ার্টার স্টাটগাটের। অ্যারিজোনাতেও ওর বিরাট ফ্যাক্টরী আছে। অস্কারের দিকে চেয়ে বলল, আমাদের লোকেদের সঙ্গে ভিনজ সেন্ট গ্যালেনে যাচ্ছে। রাতের বেলা মাৰ্টেলকে ধরা যাবে। কিন্তু রাতের বেলা মার্টেল কোথায় যাবে? সুইস রমনী ক্লেয়ারকে তো বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অপারেশন ক্রোকোডাইলকে কোনকিছুই ব্যাঘাত করবে না। তেসরা জুন সামিট এক্সপ্রেস জার্মানী অতিক্রম করবে। চৌঠা, ব্যাভেরিয়ায় নির্বাচন। ডেল্টা ক্ষমতায়

–কিন্তু মাৰ্টেল।

–নির্দেশ আছে–হত্যা।

***

সেন্ট গ্যালেনের রাতের ট্রেনে মার্টেল চেপে বসল। ও নিশ্চিত যে কেউ ওকে অনুসরণ করছে না। জানলা দিয়ে তাকালো একবার। কোন যাত্রী এখনও ওঠেনি। প্রথম শ্রেণীর কামরা। ও ধারের একটা সীটে গিয়ে বসল।

 সেন্ট গ্যালেনে ট্রেন থেকে নামার কথা। দ্রুত স্যুটকেসটা নিয়ে প্ল্যাটফর্মের বেরোবার দিকে এগোলো। হারের কথানুযায়ী স্টেশনের সামনের হোটেলে গিয়ে ঘরের ভাড়া জিজ্ঞেস করল। দু’রাতের জন্য ঘরের ভাড়া ও দিয়ে দিল। ক্লান্ত লাগা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করল ওর কোন খবর আছে কিনা।

হোটেলের লোকটা ওর হাতে একটা খাম দিল। হোটেলের নিয়মানুযায়ী তিনটে ফর্ম পূরণ করে সময় উল্লেখ করতে হয়। রাতে পুলিশ এসে এক কপি নিয়ে যায়। কিন্তু মার্টেল ফর্ম পূরণের ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখালোনা, কারণ ও এখানে আছে এটা অন্ততঃ চব্বিশ ঘণ্টা গোপন রাখতে চাইছিল।

অবশেষে ঘরে ঢুকে খামটা খুলল। মেয়েলি হস্তাক্ষরে লেখা রুম নম্বর বারো। ও দ্রুত গিয়ে দরজায় টোকা মারল। মেয়েটা দরজা খুলতে মার্টেল ঘরে ঢুকল। দরজা বন্ধ করে দিল।

পরস্পর বন্ধু?

–ডেভিড নাগেল।

আমি তোমাকে স্টেশনে জানালা দিয়ে আগেই দেখেছি। এজন্যে তুমি অবশ্য আমাকে দোষ দিতে পারো না।

যাইহোক সাবধান হওয়া উচিত, আমি এখন ক্লান্ত…।

–দেখেই বুঝতে পারছি।

হাতে যে তোয়ালেটা ছিল ওটা সরাতেই মিলিমিটারের একটা পিস্তল দেখা গেল। ওটা বালিসের তলায় রেখে দিয়ে বলল, তোমার তেষ্টা পেয়েছে।

–আমি বোতলের জল খাবো।

বিছানায় উঠে বসে মার্টেল মহিলাকে ভালো করে একবার দেখে নিল। বেশ লম্বা, আকর্ষণীয় চেহারা, কালো চুল, চোখ দুটো নীল।

তুমি আমার পরিচয়ের প্রমাণ চাইবে।

বলেই পাসপোর্টটা বের করে ওর হাতে দিল। মেয়েটাও ওর পরিচয়পত্র দেখাবার চেষ্টা করল। জুরিখের গিসেলা জোবেলকে ও নিজেই চেনে। যাইহোক অন্য একটা মেয়েকে ও বাঁচিয়েছে। ওর চোখের সামনে সেই আবর্ত দ্বিগুণ বেগে ঘুরে চলেছে। মেয়েটা চলে যেতে ও ঘুমিয়ে পড়ল।

***

খুব সাবধানী মেজাজে ওর ঘুম ভাঙলো। ও নিশ্চিত নয় যে ও এখন কোথায় আছে। চারিদিক অন্ধকার। অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে গেছে।

হঠাৎ ওর গায়ে একটা শিহরণ খেলে গেল। ওর মনে হল যেন কেউ ঘরে রয়েছে। ওর টাই, শার্ট, জুতো খুলে নিচ্ছে। কোন শব্দ না করে মাথাটা ঘুরিয়ে ডান হাতটা সামনের দিকে এগোল। আলো আসার আগেই একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর বলে উঠল,–তুমি ঠিকই আছো। সেন্ট গ্যালেনের মেট্রোপল হোটেলেই তুমি আছো। আমি ক্লেয়ার হফার। এখন ভোর চারটে। তুমি দুঘণ্টা মাত্র…।

–ঠিক আছে তাতেই হবে।

 মার্টেলের গলা শুকিয়ে কাঠ। ও উঠে বসল। দেখল হারের পরনে ধূসর রঙের টু-পিস্ স্যুট।

বিছানার ধারের টেবিলে তোমার পিস্তল আছে, ওটা নিয়ে ভাল ঘুম হয়। যাই হোক দরজা একেবারে বন্ধ।

–তুমি সব কিছুই ভাবছো? মার্টেল হারের কথায় বলে উঠল।

জুরিখ অ্যাপার্টমেন্টের কথা মনে আসতে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল মার্টেল।

–কি চিন্তা করছো?

এই যে…। বলে মার্টেল থেমে গেল। তারপর শার্টের পকেট থেকে ডেলটা ব্যাজটা যেটা বহফস্ট্রাসেতে মৃতের পকেট থেকে পেয়েছিল, ওটা হফারের সামনে বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিল। হফার প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল। আতঙ্কে চোখদুটো কেমন বড় হয়ে গেল।

–তুমি এটা কোথায় পেলে?

মেয়েটা সত্যিই চতুর আর চটপটে। কয়েক সেকেন্ডর মধ্যেই ওর দিকে পিস্তল তাক করলো।

ব্যাজটা দেখে ভয় পেয়েছো?

–তুমিই তো এখন ভয় পাইয়ে দিচ্ছো। গুলি করতে আমার কোনরকম দ্বিধা…।

–আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।

টেবিলের ড্রয়ারের দিকে ওর হাতটা সরিয়ে নিলো। মহিলার কথায় বা ব্যবহারে কোনরকম নম্রতা নেই।

–গতরাতে আমি বহফস্ট্রাসে একটা মৃতদেহের পকেট থেকে এটা পেয়েছি। আমি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কখন বেরোবো, এই ভরসায় অপেক্ষা করছিল। ডেলটা, তোমাদের কোন লোকেদের মুখোশ ছিল না। ওদের প্রত্যেকের পকেটে একটা করে ব্যাজ। জায়গাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।

তুমি বলছ রক্ত’, আবার বলছো আমাদের’…।

–সেন্ট্রাল হক–এ আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করনি কেন? ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল।

-ওয়ার্নারের খুনের পরে ডেলটা ইনভেস্টিগেশন থেকে আর্নল্ড আমাকে তুলে নিতে চেয়েছিল। সেকারণেই আমি আন্ডার গ্রাউন্ডে এসেছি। সম্ভবতঃ লিসবেথ তোমাকে এখানে এনেছে, তোমাকে অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা নিশ্চিত হতে। আর্নল্ডের অনুসরণকারীদের কাউকে কাউকে ও চেনে।

এছাড়া ও স্বয়ং ফার্দি আর্নল্ডকেও চেনে?

 না, ওদের কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। কেন বলতো?

 ও এবার আর্নল্ডের বর্ণনা দিল। তিরিশের ওপর বয়েস। বাদামী চল, ধসর চোখ…।

–কিন্তু?

–আমরা অ্যাপার্টমেন্টে আছি এটা কেউ ওকে বলেছে বোধহয়। লিসবেথকে আমি সন্দেহ করি। কারণ ও নোটবুক থেকে নাম্বারটা নিয়েছিল। ব্যাপারটা ও জেনেছিল। আমার আসার আগেই সম্ভবতঃ আর্নল্ড ফোন করার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারটা বুঝিয়েছিল। কে…?

খুব সতর্কভাবেই শব্দগুলো ব্যবহার করছিল। বললো, সেই মহিলা যে তোমাকে নামিয়েছিল।

–ওর বিয়ের আগে আমরা দু’জন ডেভিড নাগেলের কাছে আই. বি. পুলিশে কাজ করতাম। আমরা একদিন ওর সঙ্গে রসিকতা করি। একই পোষাক পরে অফিসে গিয়েছিলাম দশ মিনিটের তফাতে। ও তো তফাৎ ধরতেই পারেনি। আমরা ব্যাপারটা বলাতে ও ভীষণ রেগে গেল। তোমরা যে বোকা বনে যাবে এতে অবাক হবার কিছু নেই।

ওর মধ্যে আস্থার ভাব দেখা গেল। পিস্তলটা বালিশের তলায় রেখে দিল। মৃদু হেসে ও প্রশ্ন করল, লিসবেথ কোথায়? ও কি জুরিখের ট্রেন ধরার জন্যে স্টেশনে অপেক্ষা করছে?

-ও এলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। মনে ভাববে আমার বোন, কিন্তু ও আমার কেউই নয়।

***

এদিকে লন্ডনে টুইডের চোখ ফাইলে নিবদ্ধ। আতঙ্কজনক খবরটা কখন পেয়েছিল, সেটাই ভাবছিল। ওর-সহকারী মিস্ ম্যাকনেইল একটা খবর দিল।

একটা সুন্দরী মহিলার দিকে রাস্তার লোকেরা তাকিয়ে দেখছিল। ও যে কে তা কেউই জানেনা। একমাত্র টুইডই চেনে। ওর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ।

-বেইরুট থেকে এসেছে।

অ্যালার্ম বেলটা বাজতে লাগল। টুইড ড্রয়ার খুলে কোড নম্বর দেখে নিল।

সেই মুহূর্তে সিগন্যালটা আবার স্বাভাবিক বাজতে লাগল।

 বেইরুট হচ্ছে ব্যাভেরিয়ায়। লিন্ডাউ ওয়ার্নারের শেষ জায়গা।

 ম্যাকেনেইল বলল, তোমাকে একটু একা পাওয়া যাবে?

না, আমি এখন…।

কাজের শেষে টুইড ওর দিকে তাকালো। চোখের দৃষ্টি একেবারে শূন্য।

–কোন খারাপ খবর?

–খুবই খারাপ।

–তুমি সেই পোষাক পরবে। পরো…।

-আমি ওরকম ঢাকা দেওয়া পোষাক পরি না। পূর্ব জার্মান থেকে ব্যাভেরিয়ার সীমান্ত ম্যানফ্রেড সবেমাত্র পেরিয়েছে। ওঃ।

টুইড সিগন্যাল পড়া মাত্রই কেমন হয়ে গেল। ও মানসচোখে রুটটা দেখতে পেল। স্টেটের সিকিউরিটির জন্যে প্রথমে মন্ত্রীসভার মধ্যে ওর এজেন্ট ঢোকানো আছে লিপজিগ অর্থাৎ পূর্ব জার্মানীতে। ওর মোবাইল ট্রান্সমিটার থেকে একটা রেডিও ম্যাসেজ করা হল। বেইরুটের টুইডের স্টেশন থেকে সংগ্রহ করা হলো।

বেইরুট থেকে একজন দূত দ্রুত গাড়িতে বসে বৃটিশ অ্যামবাসীতে এলো। সেখানে সিকিউরিটির কাছে ব্যক্তিগত ভাবে সিগন্যালটা দেওয়া হলো। এরপরে ওটাকে পার্ক ক্রিসেন্টে ঘোরানো হলো। সিগন্যালটা কোনরকম কোড করা ছিল না। ওটাতে যা ছিলঃ

ম্যানফ্রেড আজ বুধবার সাতাশে মে পশ্চিম জার্মানীর হফ’-এর কাছে পূর্ব জার্মান অতিক্রম করেছে। চরম গন্তব্য এখনও অজানা।

কোন কথা না বলে ম্যাকেনেইলকে সিগন্যালটা দিলো। এরপর দেওয়ালের মানচিত্রের দিকে এগিয়ে গেল। পরীক্ষা করে নিল যে ম্যানফ্রেড কোন্ রুটটা বেছেছে।

হফ-এর আঞ্চলিক সীমা থেকে একটা অটো দক্ষিণে দৌড়োচ্ছিল। নুরেমবার্গ হয়ে গন্তব্য ব্যাভেরিয়ার রাজধানীতে। এখান থেকেই হাউপ্টব্যানহফের ওপর বিশেষভাবে নজর রেখেছিল। কিন্তু কেন কে জানে? ও ওর ঘোরানো চেয়ারে ফিরে গেল।

আমরা তো ম্যানফ্রেডের ব্যাপারে বেশী জানি না, তাই না? ম্যাকনেইল বলল।

আমরা কিছুই জানি না এবং আমরা অনেক কিছুই জানি। টুইড ভ্রূ কুঁচকে বললো। একটা ফাইল নাড়াচাড়া করছিল ও।

বুড়ো বয়সে আমি মানসিক রোগী হয়ে যাবো। তুমি যখন সিগন্যালটা আনলে তখন আমি ওর দিকে দেখছিলাম।’

-হা, ও হচ্ছে উঁচু দরের পূর্ব জার্মান এজেন্ট, তাই না। ওর জাতিগত বিষয়ে খোঁজখবর চলছে। প্রথম শ্রেণীর কুশলী গুপ্তঘাতক, নিখুঁত পরিকল্পনায় ওস্তাদ। সত্যিই অস্বাভাবিক গুণের। কিন্তু কালেসি একজন অস্বাভাবিক চরিত্রের। টুইড চশমাটা চোখের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল।

তুমি কি সত্যিই ভাবো ও কালেসি? ওর ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি।

আমেরিকানরা অনুমান করছে কিছু, কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভুত। আমি বুঝিনি ডেলটা হচ্ছে নয়া নাজীদের…।

ম্যানফ্রেড হচ্ছে বেশীর ভাগ বড় ধরনের নাশকতামূলক অপারেশান ফ্রিল্যান্স কমিউনিস্ট এক্সপার্ট। তাহলে অপারেশান ক্রোকোডাইলের পেছনে কে আছে?

-তোমাকে সত্যিই বিমর্ষ দেখাচ্ছে। কফি করবো, খাবে?

 টুইড ডেক্সের ফোনের দিকে এগিয়ে গেল।

–ঈশ্বরের দোহাই, মার্টেল চলে এসো। দেরী হবার আগেই তোমার সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। নাজী আর কমিউনিস্ট দু’দিক দিয়েই তোমার বিপদ।

***

এটসট্রাসেতে মিউনিখ পুলিশের হেড কোয়ার্টারের কাছেই বড়ো বিল্ডিং। ওরই একটা অন্ধকার অ্যাপার্টমেন্টে দস্তানা পরা একটা হাত ফোনটা তুলল। দস্তানাটানাইলনের। ও একটা নাম্বার ডায়াল করলো। তখন ভোর চারটে।

–কে বেজন্মা? সময় সম্পর্কে কোন ধারণা নেই…? রেইনহার্ড দিয়েত্রিচের ঘুমটা ভেঙ্গে যেতেই ও রেগে গেছে। যদি ভি হয় তাহলে আবার ও কেটে…না।

–ম্যানফ্রেড বলছি।

কণ্ঠস্বর সংযত ও বিনয়ী। আবার বলল ম্যানফ্রেড, শুনলাম তোমার নাকি কি একটা সমস্যা যার ফলে আমরা অসুবিধেয় পড়েছি।

দিয়েত্রিচ দ্রুত উঠে বসলো। জুরিখের ব্যাপারটা ও কিছুটা জানে। কণ্ঠস্বর নরম করে বলল, এমন কিছু নয় যে আমরা চালাতে পারবো না। আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি–

কিন্তু জুরিখে ব্যাপারটা ভুলভাবে চালানো হয়েছে। তাহলে আমরা পরবর্তী সেন্ট গ্যালেনে কি আশা করতে পারি?

ম্যানফ্রেডের জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনে দিয়েত্রিচের মনে আতঙ্ক জেগে উঠল।

ম্যানফ্রেড যখন কম দামে স্টাটগার্টে অস্ত্রশস্ত্র আর পোষাক সাপ্লাই করার প্রস্তাব দিল তখন ও প্রায় সুযোগটা লুফে নিয়েছিল। কিন্তু ও এখন দুঃখিতভাবেই সিদ্ধান্ত নিলো যে, ব্যাপারটা অনেক দেরী হয়ে গেছে।

-তোমাকে সেন্ট গ্যালেনের ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে না।

অদ্ভুত স্বরে আবার বলল, আমি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবার সব বন্দোবস্ত ইতিমধ্যে করে ফেলেছি।

–শুনে খুশী হলাম। একই ওয়ার হাউস থেকে কিন্তু সংগ্রহের জন্য আরো অস্ত্রশস্ত্র আর পোষাক পাওয়া যাচ্ছে। কোথায় আর কখন তুমি এগুলো নেবে?

দিয়েত্ৰিচ ওকে বললো, এবারে একটা ক্লিক শব্দ হলো তার ফলে শিল্পপতি বুঝলো ম্যানফ্রেড আর লাইনে নেই। একগুঁয়ে, বদমাস, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মিলেছে। ঈশ্বর জানে যে ওরা অনেক নষ্ট করেছে। কেমন করে বি. এন. ডি-র এরিখ স্টোলার জায়গাটাকে অনুসরণ করল বুঝতে পারছেনা।

এদিকে মিউনিকে ম্যানফ্রেড ডেকের আলোটা নিভিয়ে দিল। পশ্চিমের ও যেখানেই থাকুক না কেন সব সময় দস্তানা ব্যবহার করে। তাহলে এপার্টমেন্ট ছাড়ার পরে কোথাও আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে না। ওর মুখের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা হাসি। পরিকল্পনানুযায়ী অপারেশান ক্রোকোডাইল এগোচ্ছে।

***

লিসবেইথের খুনের ব্যাপারটা মার্টেল হফারকে বলতেই ও কেমন হয়ে গেল। মেট্রোপল হোটেলের শোবার ঘরে তখন ওরা দু’জনে। ও অবশ্য একটা ব্যাপার বললো না যে ওকে রীতিমত অত্যাচার করা হয়েছে।

হঠাৎ ক্লেয়ার ওকে চেপে ধরলো। বলল, ও তোমার জন্যেই ওদের হাতে ধরা পড়েছিল। হারামজাদা।

বলার পরেই ও মার্টেলের গালে একটা চড় মারলো। আবার মারতে যেতেই ওর হাতটা ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল।হঠাৎ মার্টেলের মনে পড়ল গিসেলা জোবেলের সঙ্গেও ঠিক এরকমই একদিন হয়েছিল, সেন্ট্রাল হফের অ্যাপার্টমেন্টে।

কিন্তু এ মেয়েটা আলাদা। মেয়েটা রুক্ষ কিন্তু আবার ব্যবহার সংযতই বলা যায়। বিছানার পাশের আলোতে ওর চোখ দুটো বেশ বড় দেখাচ্ছে। ও ওর কপালে একটা চুমু খেলো, তাতেই মেয়েটা নরম হয়ে গেল।

–অন্ততঃ এক ডজন ডেলটা সশস্ত্র সৈন্য আক্রমণকারী ছিল। মার্টেল নরম স্বরে বললো। দুটো গাড়িতেই সবাই ছিল। আমি তিনজনকে গুলি করেছি। ওরা সবাই মার্সিডিসের মধ্যে লিসবেইথ-এর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আমি তখন ব্যবস্থা নিলাম…।

–এক ডজন সশস্ত্র…। মেয়েটার চোখ দুটো বড় হয়ে গেল। কিন্তু তুমি কেমন করে লিসবেইথকে রক্ষা করতে পারলে? কেনই বা ঘটনাটা ঘটালো, ওকেই বা নিয়ে গেল কেন?

–ওরা তোমার ব্যাপারে সন্দেহ করেছিল।

–আমি কেন?

–বড় একটা কিছু হচ্ছিল বোধহয়। তাহলে যে এজেন্টরা একটু অন্য গাইছে তাদেরই ডেলটা বিছিন্ন করছে। প্রথম নাম চার্লস ওয়ার্নার। তারপর তুমি, আমি ওদের তৃতীয় লক্ষ্য। লিন্ডার্ড থেকে সুইজারল্যান্ড পর্যন্ত কেনই বা ওয়ার্নার ট্রেন ব্যবহার করলো না, কেন নৌকতে গেল?

–ও নৌবাহিনীর প্রাক্তন লোক ছিল, বলেছিল, ট্রেন ট্যাপ হতে পারে। আচ্ছা আমরা ঐ লোকগুলোকে প্রত্যাঘাত করতে পারিনা?

–আমরা সেটাই করতে যাচ্ছি। আর সেজন্যই আমার গন্তব্যস্থল সেন্ট গ্যালেন। ওখানে এমব্রডারী মিউজিয়াম খুবই কম তাই না?

–হুঁ, বলে চুলগুলো আঁচড়াতে লাগল ও। বললো, জায়গাটাকেই ডেলটার ব্যাপারে চার্লস রাঁদেভু হিসাবে ব্যবহার করত, তুমি কিভাবে জানলে?

–আমরা ফিরে আসি। তুমি জানো ডেলটার কতখানি গভীরে ওয়ার্নার ঢুকে গিয়েছিল?

আমি যেরকম বলেছি, সেইরকমই। ওর মনের ভেতরটা তো আমি জানিনা। চার্লস নিজেকে অনেকখানি পর্যন্ত লুকিয়ে রাখতে পেরেছিল।

থেমে আবার বলল, ওর ছদ্মনাম স্ট্যাল। যাইহোক তুমি ডেলটার হালফিলের খবর দেখেছ।

ও একটা খবরের কাগজ ওকে দিল। আগের দিনের কাগজ। একটা হেডলাইন পড়েই ও রীতিমত চমকে উঠলো।

এ্যালগাউতে নয়া-নাজীদের নতুন সংগ্রহ অস্ত্রশস্ত্র আর তৈরি পোষাক পাওয়া গেছে।

খবরটা খুবই সাধারণ। বিশেষ সূত্র ধরে ব্যাভেরিয়ান পুলিশ ভোরে একটা খামার বাড়িতে হানা দিয়ে অস্ত্রের একটা ভাণ্ডার পায়। ফার্ম হাউস এখন কর্মব্যস্ত কিন্তু তল্লাসীর সময় তা ছিলনা।

ক্লেয়ার বলল, গত চার সপ্তাহে ওরা ডেলটার এরকম অস্ত্র রাখার সাত নম্বর ক্যাম্প খুঁজে পেয়েছে।

ব্যাপারটা যেন কিরকম!

 –কি ভাবছো? তোমাকে আবার সেরকম দেখাচ্ছে?

 মার্টেল দেওয়ালের দিকে তাকালো। টুইডের সঙ্গে কথোপকথোনের দৃশ্যগুলো ওর মনে ভাসছিল।

ওয়ার্নারের দেহের মধ্যে ব্যাজ পাওয়া গেছে। ওরা কাজ শেষ করে ওর পেছনে ডেলটা প্রতীক এঁকে দিয়েছিল।

ভাবনা থামিয়ে মার্টেল বলে উঠলো, আমার মনে হচ্ছে কোন একটা ব্যাপার আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি।বলে ঘড়ি দেখল, সাড়ে চারটে। আবার বলল, কিন্তু আমরা বদমাইশগুলোকে ফাঁদে ফেলতে পারি। সেন্ট গ্যালেনে এমব্রডারী মিউজিয়াম আছে। এখান থেকে আট ঘণ্টা কম সময়ে

কথা শেষ হলো না। হফারের দিকে তাকালো ও।

***

বৃহস্পতিবার আঠাশে মেঃ

–হ্যাঁ, এই ব্যাপারেই আমরা কথা বলছি। আমি আশা করি।

ডাইনিংরুমে ব্রেকফাস্টের সময় মার্টেল ওকে কমলা রঙের একটা টিকিট দিল।

জার্মান ভাষায় কি যেন একটা সংখ্যা লেখা আছে।

–মরার সময়ে ওয়ার্নারের ওয়ালেটে এটা ছিল।

ক্লেয়ার বলল, এটা তো গ্যালেনের এমব্রডারী মিউজিয়ামে ঢোকার টিকিট। বিল্ডিংটা পুরোন শহরে। হেঁটে দশ মিনিট।

–পেছনে দেখ।

 ক্লেয়ার টিকিট উল্টে লেখাটা দেখল। লিন্ডাউ যাত্রার সময়ে এটাই ওর শেষ হস্তাক্ষর।

এস. টি. এগারো পঞ্চাশ, মে আঠাশ।

–মে আঠাশ,…অর্থাৎ আজ..ঘড়িটা দেখল, বলে উঠল, ন’টা। এস. টি. অবশ্যই স্ট্যাল-এর জন্যে অপেক্ষা করবে। আমাদের ওখানে গিয়ে কথা বলতে অন্ততঃ ঘণ্টা তিনেক লাগবে।

-কিন্তু মাৰ্টেল একাই যেতে চায়। বলল, ও গেলে কাজ নাও হতে পারে।

 ক্লেয়ার পাল্টা জবাবে বলল, তোমাকে ও চিনবেনা।

মার্টেল শান্তভাবে বলল, শোন ক্লেয়ার, সংবাদ জোগাড়ের এর থেকে ভাল উপায় আর নেই।

একটু থেমে আবার বলল, আমি একা কাজ করতে ভালবাসি। আর আমি মনে করি এটাই উত্তম পদ্ধতি।

আবার থামলো, তারপর মার্টেল আবার বলল, জুরিখে এসেছি কিন্তু কোথাও কিছু ঘটেনি। সেন্ট্রালহকের অ্যাপার্টমেন্টে ডেলটা একটা মেয়েকে দিয়ে আমাকে বাইরে বের করে দিয়েছিল। কাপবোর্ডের কাছে আরোও একজন মেয়েকে আমি ভেবেছিলাম হফার।

–আমি তো বলেছি কেন এরকম, বলতে গিয়ে ক্লেয়ারের চোখ এড়ালো না। বললো, এরপর ব্যানহফস্ট্রাসেতে যা ঘটলো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সবকিছু উবে গেল?

ক্লেয়ার বলল, ঐ ফার্দি আর্নল্ডের স্কোয়াড।

–আবার আসবে?

–তুমি বলছো যে আগেই ভেবেছিলে ওরা সমস্ত কিছু পরিষ্কার করেছিল, যাতে ট্যুরিষ্টরা ভয় না পায়। আর্নল্ডের স্পেশাল টিম আছে যেমন ইঞ্জিনিয়ার, বিল্ডার সবাই। আর এরা সবাই পাকা লোক।

মার্টেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আর্নল্ড এমন বলেছিল ব্যাপারটা কিছুই নয়।

–এইরকম বানানো গল্পতে নাগেলের গোয়েন্দারাও ভুল বুঝেছিল। তুমি কি সত্যিই মনে করো স্ট্যাল-এর সঙ্গে আমার কথাবার্তায় কিছু লাভ হবে?

–হুঁ, হফার বলল।

 –আমি এগারোটা পঁয়তাল্লিশে আসবো। তুমি জায়গাটা দেখাবে।

–এগারোটা পঞ্চাশ।

–তাহলে আমি পাঁচ মিনিট আগে এসে অপেক্ষা করে দেখবো, ঘরে কেউ ঢুকেছে কিনা। ওয়ার্নারও অনুসরণ করতে পারে।

–ও সতর্কই। এখন ও একেবারেই মৃত তাই না।

***

মিউনিখের ম্যাক্স মিলিয়ানস্ট্রাসের রাস্তাটা বেশ চওড়া। ম্যাক্স জোসেফের দিকে হয়ে সোজা ব্যভেরিয়ার স্টেট পার্লামেন্টের দিকে চলে গেছে। সামনে ইমার নদী। পূর্ব তীরে পৌঁছতে গেলে দুটো বড় ব্রীজ পেরোতে হয়। প্রথম ব্রীজটার তলাতেই দেহটা পাওয়া যায়।

সেন্ট গ্যালেনের মেট্রোপলে মার্টেল যখন ব্রেকফাস্ট করছিল তার ঠিক ঘণ্টা দুয়েক আগে দেহটা পাওয়া যায়। মার্টেল যখন ব্রীজটা পেরোচ্ছিল একজন উকিল ওর দিকে তাকিয়েছিল।নদীর চারটে বড় থামের একটার তলায় দেহটা ছিল।

একজন ডুবুরী খবর দিয়েছিল, মাথায় গুলি করা একটা মৃতদেহ এখানে আছে। তখন ক্রিমিনাল পুলিশ একজন ডাক্তার নিয়ে এলো। নদীর তীরেই প্রাথমিক পরীক্ষা হলো।

কয়েক মিনিট পর ইন্সপেক্টর ত্রুগার ডাক্তারের দিকে তাকালো।

ডাক্তার বলল, মাথায় তিনবার গুলি করা হয়েছে। পোড়া পাউডারও পাওয়া গেছে। দড়ি-টড়ি পায়নি। তাই দড়ির ফাঁস আটকে ওকে মারেনি।

–আমি ওকে সনাক্তকরণের জন্যে পোষাকগুলো দেখতে পারি ডাক্তার?

 ক্রগার অভ্যস্ত হাতে দ্রুত পরীক্ষা করতে লাগল। ওর সহকারী ওয়েইল চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল। ওর চীফের পরীক্ষা শেষ হল। একটা রিষ্টওয়াচ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। ঘড়ির পেছনে একটা মাত্র শব্দ এনগ্রেভ করা। শব্দটা হচ্ছে স্ট্যাল।

***

মার্টেল আর ক্লেয়ার এমব্রডারী মিউজিয়ামে গায়েগায়ে এগোচ্ছিল আর নানারকম কথাবার্তা বলছিল। ডেলটার প্রসঙ্গ উঠেছিল। আর্নল্ড ওকে খুঁজছে এ ব্যাপারে দু’জনেই ওয়াকিবহাল।

মার্টেল একবার বলল যে, মিউজিয়ামের মধ্যে ওর সঙ্গে হারের না যাওয়াই ভাল। সে কথা শুনে হফার রীতিমত খাপ্পা হয়ে উঠল। তারপর খানিকটা নরম হয়ে মার্টেলকে রিভালভার নিয়ে যাবার জন্যে বলল।

ওরা সেন্ট গ্যালনে যাবার সংকীর্ণ জায়গাটা দিয়ে এগোচ্ছিল। দু-পাশে ঢালু জায়গা। এলাকাটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন গত শতাব্দীর।

বাতাসের গন্ধে ঝড় উঠবে বলে মনে হলো।

মার্টেল খুব আস্তে প্রবেশমুখের দিকে এগাছিল। চোখ দুটো সতর্ক। পাশের দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখল একজন সুবেশা মহিলা বসে আছে।

ও বললো, পুলিশ স্টেশন সামনেই আছে তাই না?

হফার জবাবে জায়গাটা ওকে বলে দিলো। ওরা দ্রুত এগোতে লাগলো। এমার্জেন্সীর বিষয়টাও হফারের কাছ থেকে ভাল ভাবেই জেনে নিলো।

দোকান ছাড়িয়ে ও মিউজিয়ামের দিকে দ্রুত কথা বলতে বলতে এগোতে লাগল। জায়গাটায় পৌঁছল। গাড়িটা থামালো। ক্লেয়ার বলল, আমি এই জায়গাটাতে থাকি। কেউ ঢুকলেই দেখতে পাবো।

মিউজিয়ামের প্রবেশ মুখের ঠিক সামনেই জায়গাটা আঙুল দিয়ে দেখালো। চওড়া রাস্তার ওপর কমলা রঙের একটা বুথ।

সামনে কালো পর্দা ঝুলছে। বুথের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা প্রনটোফট পাসফোটাস।

ক্লেয়ার বলল, যাবে যখন, তখন আমাকে ডেকে নিও কিন্তু।

মার্টেল চারিদিকটা একবার দেখে নিল। মিলিয়ানস্ট্রাস অতিক্রম করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল।

***

ক্লেয়ারের বর্ণনা মত ব্যাপারটা এইরকম। সিঁড়ি দিয়ে গেলে বিরাট একটা হল। সামনের কাউন্টার থেকে একটা টিকিট নিলো ও। ওয়ার্নারও এই টিকিট নিয়েছিল। মুখটা খানিকটা রুমাল দিয়ে ঢাকা দিয়েছিল, যাতে সামনের মহিলাটি ওকে চিনতে না পারে।

মিউজিয়ামের দোতলায় একটা নোটিশ। ও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দেখল ভীষণ ফাঁকা জায়গাটা। এজন্যই ওয়ার্নার ডেলটার সঙ্গে এখানে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিল। বাইরের প্লেটে খোলার সময় লেখা আছে। বাঁদিকে লাইব্রেরী।ও সন্তর্পণে গিয়ে দরজাটা ঠেলে দেখল, বন্ধ আছে। আবার দ্রুত মিউজিয়ামের দরজা খুলে ঢুকল। নিস্তব্ধ ঘর। ঢুকে দরজাটা আস্তে বন্ধ করে এগিয়ে গেল।

কাঁচের বাক্সে দ্রষ্টব্য জিনিষ আছে।

জায়গাটা ফাঁকা দেখে দ্রুত সমস্ত কুলপীগুলো দেখতে লাগল। এরপর ও কোল্টটা খুলে মুখে সাইলেন্সার লাগালো। ঠিক যখন ঘড়িতে এগারোটা পঞ্চাশ’, ও আস্তে আস্তে দরজার হাতল ঘোরালো।

চারিদিকটা দেখতে লাগল মাৰ্টেল। পেছনে রিভলভার। দরজা খানিকবাদে খুলল। মার্টেল ভিতরে ঢুকল।

ওর কানে ক্লিক’ জাতীয় একটা শব্দ এলো। খুব সন্তর্পণে ও নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। মাঝে মাঝে ইঁদুরের চলাফেরার শব্দ পাচ্ছিল।

ঠিক সেই সময়ে নতুন আগন্তুক স্ট্যাল চোখের সামনে আসছে। মার্টেল তাকালো। প্রাগৈতিহাসিক কঙ্কালরা সাক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।

সামনের লোকটার গায়ে ওভারকোট। কোটের কাছে একটা রূপোর ব্যাজ লাগানো, প্রতীক চিহ্ন ডেলটা।

ওর ডানদিকে একটা ফেন্ট-টিপ, পেন জাতীয় বস্তু।লোকটা মার্টেলের প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে। মার্টেল হাত শক্ত করে সামনে এগোলো। লোকটা ছুঁচলো জিনিষটাকে মার্টেলের পেট লক্ষ্য করে ধরে আছে। হঠাৎ মার্টেল দুবার ফায়ার করলো। চারিদিকের নৈঃশব্দ ভেঙ্গেশব্দ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

এদিকে সেই লোকটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জটা ফেলে দিল। ছিটকে পড়লো কাঁচের বাক্সের ওপর। রক্তের ধারায় মুখমণ্ডল বীভৎস হয়ে উঠল।

মার্টেল না দেখেই জায়গাটা ত্যাগ করলো। রিভলভার ভিতরে ঢুকিয়ে নিলো। কাউন্টারের মেয়েটা পিছন ফিরে আছে। দ্রুত রাস্তায় এসে পড়তে হবে।

কিন্তু রাস্তাতেই অপেক্ষা করছিল ডেলটা।

ওরা একটা লোককে ভিতরে পাঠিয়ে অনেকে বাইরে অপেক্ষা করছিল। এটাই ওদের সংস্থার কাজের ধারা।

ব্যানহফস্ট্রাসের ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা মার্টেল ভোলেনি। ও দরজাটা খুললো।

বাইরে এসে ক্লেয়ারকে খুঁজতে লাগল। কোথায় ও? আস্তে আস্তে এগোতে থাকল।

সমস্ত ব্যাপারটায় সতর্কতা প্রয়োজন।ও একটা সিগারেট ধরিয়ে বুথের সামনে এসে দাঁড়ালো। পর্দার ভেতরে চোখ রেখে দেখল, কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। কথা আরম্ভ হল।

–ওরা ডেলটা অপারেটিভ পাঠিয়েছিল। মিউজিয়ামের মধ্যে মরে পড়ে আছে। আমাকে দু মিনিট সময় দাও। তারপর মেট্রোপলে যেও। ওখানে আমি যতক্ষণ না তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি–হুঁ।

এরপরে ও চলে গেল। একটা পুরনো শহর ওর গন্তব্যস্থল। দোকানপাট নতুন। জায়গাটা প্রাচীন বলে ওর এখনও মনে আছে। ও রাস্তাটা ধরে এগোতে লাগল।’নিউগ্যাসে পাঁচ’ ক্লেয়ার বলেছিল।

পুলিশ হেডকোয়ার্টার। ও এগোতে এগোতে জানলার দিকে একবার তাকালো। ওর ধারণা নেই জায়গাটায় কি কি বিক্রি হয়। তাই চারদিকে দেখতে লাগলো। অপর দিক থেকে লেদে চামড়ার একটা লোক এসে দাঁড়ালো। হাতে বড় একটা ব্যাগ আর ঠোঁটে সিগারেট। ওর লাইটার জ্বলতেই মার্টেল এগিয়ে গেল।

ইংরেজের রক্ত ওর গায়ে। সেই লোকটার ছায়া ক্রমশ ওর দিকে এগোচ্ছিল। ও এগোতে লাগলো।

স্ট্যাড পোলিজি। এবড়ো-খেবড়ো ধূসর দেওয়াল। সাটারটা দেওয়াল ঘেঁষে। জায়গাটা দেখতে অর্ধগোলাকার। ও এগোল।

একটা বিশিষ্ট জায়গায় ও এলো যেটা ক্লেয়ার ওকে ম্যাপে দেখিয়েছিল। মনে পড়ল, জায়গাটা মার্কেট গ্যাসে।

ও এবারে বাঁ দিকে বেঁকে গেল। মুখোমুখি দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। অন্য একটা দোকানের জানলা দিয়ে হলদেটে চামড়ার লোকটা তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলযোগ হয়েছে।

ব্যাপারটা আগেই গেজিয়েছে। একটা লোক অন্ততঃ একশো গজ দূরে ছায়ার মত দাঁড়িয়ে। মার্টেল ধৈর্য সহকারে দেখল। ওদেরও ইচ্ছা মার্টেলের নজরে আসা।

অন্য সময়ে হলে না হয় কথা ছিল। সামনে বিপদ! সাবধান!

ও কাঠের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। দূরে অর্থাৎ রাস্তার মাঝখানে ছেলেদের তৈরী একটা খেলনা ট্রেন। ড্রাইভারও আছে।

হলদেটে চামড়ার লোকটা একভাবে জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে মহিলাদের ব্যবহার করা পোষাক। মার্টেল দ্রুত এগিয়ে গেল। ট্রেন তখনও চলেনি। সামনে বড় বিল্ডিং। ওটা একটা হোটেল। ওখানেই ক্লেয়ার আছে। ও রাস্তা পেরিয়ে সকলের দিকে তাকাতে তাকাতে এগোতে লাগল।

ও খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হোটেলের পাশটা পেরোতেই হুইসেল শোনা গেল। ও ক্রমশঃ ট্রেনটার দিকে এগোতে লাগলো। একেবারে শেষ কোচটায় ও দেখতে পেল স্বয়ং ক্লেয়ার হফারকে।

ওদের দুজনের পাশে একটি কমবয়েসী মেয়ে দুটো বাচ্চা নিয়ে বসে। ক্লেয়ার মার্টেলের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু একি? ওর রিভলভারটা যেন ওরই দিকে তাক করা।

মার্টেলের মনে হল ওর বাঁদিকেও যেন কেউ আছে। ট্রেন থেকে অদূরে মার্টেলের চোখ পড়তে ওর মনে হল যেন একজন লম্বা মহিলা আছে। মাথায় কালো টুপি। মুখে একটা আবরণ। কাঁধে একটা ব্যাগ ধরা। ডানহাতে ঘুমুখো হাইপোডারমিক।

এদিকে সেই হলদেটে চামড়ার লোকটা প্রাণপণ চেষ্টা করছে, আড়ালে থাকতে। ও যথেষ্ট সতর্ক হলো।

হঠাৎ কোথা থেকে একটা শব্দ হলো, গাড়ীর হর্নের শব্দ। শব্দ শুনে মহিলাটি পাশের দেওয়ালে আত্মগোপন করলো। ওর ভি-কাট পোষাকের মাঝখানে একটা ছোট্ট গোল গর্ত।

মহিলাটি টুপীটা খুলে মুখের আবরণটাও সরালো। মার্টেল মুখে বিরক্তি নিয়ে এগোবার চেষ্টা করলো। কিন্তু একি! এ তো গিসেলা জোবেলের সেই মৃত মুখ।

ট্রেনটা এগোচ্ছিল। ক্লেয়ার একভাবে নিজের জায়গায় বসে। হলদে চামড়াকে দেখা যাচ্ছেনা। চলন্ত ট্রেন থেকে সুইস মেয়েটা তার সম্ভাব্য আক্রমণকারীর ওপর গুলি চালালো। মার্টেল এরকম এনকাউন্টার আগে করেনি। সামনেই মাটির ওপর কিছু যেন একটা পড়ে আছে আর হোটেলের সামনে হঠাৎ ভীড় জমে গেল।

***

বৃহস্পতিবার আঠাশে মেঃ

মেট্রোপলের হোটেলে শোবার ঘরে মার্টেল প্রবেশ করতে ক্লেয়ারের কাঁপুনি কিছুটা কমলো। এবারে ও ভেঙ্গে পড়ল এবং মার্টেলের বুকের মধ্যে মুখ লুকোলো। মার্টেল ওর কালো চুলে হাত বোলাতে লাগল।

পরম নিশ্চিন্ত লাগলো ওর নিজেকে।

–তুমি নির্দেশ না মেনে ফটো বুথে ছিলে অথচ আমি তোমাকে এখানে আসতে বলেছিলাম। তারপর দেখলাম ট্রয় ট্রেনটায়।

-তোমার হয়ে আমি একটা ভাল কাজই করেছি।

একটু থেমে কণ্ঠস্বর পাল্টে হফার বললো, তুমি বলেছিলে না মেয়েটা তোমাকে মারতে চায়নি  কিন্তু আমি ওর হাতে ছুরি দেখতে পেয়েছি।

না ওটা ছুরি নয়। ওটা সঁচ মানে হাইপোডারমিক, ডেলটাদের অস্ত্র। তুমি আমাকে খুব জোর বাঁচিয়েছ। স্বাভাবিক গলায় মার্টেল বলল।

ক্লেয়ার খানিকটা শান্ত হলে মার্টেল বলল, তুমি কিভাবে এগিয়েছিলে আমি তো দেখিনি।

একটু থেমে মার্টেল আবার বললো, তুমি যাকে মারলে ওটা গিসেলা জোবেল, সেন্ট্রাল হকের লিসবেথের মেয়ে। ডেলটার নিষ্ঠুরতা চরম সীমায় পৌঁছেছে। প্রথমে ওরা আমাকে মারবার জন্যে মিউজিয়ামে লোক পাঠিয়েছিল, পকেটে ডেলটার প্রতীকও আমি দেখেছি।

–তুমি ওকে ওখানে ছেড়ে দিলে।

হ্যাঁ। আসলে ওদের একটা টীম আছে। ঐটীমেরই লোক হলদেটে চামড়াটা আমাকে বরাবর অনুসরণ করে এসেছে। আর ঐ মেয়েটাতো আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল।

মার্টেল হারের দিকে তাকাল।

বুথের ফাঁক দিয়ে আমি ওদের দুজনকেই দেখেছিলাম। সেজন্যই আমি তোমার পেছনে…। ক্লেয়ার বলল।

মার্টেল এবার বলল, নাও এবার আমরা সেন্ট গ্যালেনের ট্রেন ধরবো, সব ঠিকঠাক করে নাও। আমরা এখন পূর্ব ব্যাভেরিয়ার দিকে যাচ্ছি।

–এত তাড়া কেন?

 ক্লেয়ারের কথার জবাবে বললো মাৰ্টেল, পুলিশ। ওদের হাতে এখন দুটো খুন। একটা আমি মিউজিয়ামে মেরেছি আর তুমি একটাকে হোটেলের সামনে শেষ করেছে। ওরা ইতিমধ্যেই সেন্ট গ্যালেন ছেড়ে যাওয়া সব ট্রেনে তল্লাসী চালাচ্ছে।

***

মিউনিক এক্সপ্রেসের প্রথম শ্রেণীর কামরায় ওরা দুজন বসেছিল। মার্টেল জানে যে ব্যাভেরিয়ায় ডেলটাদের হেড কোয়ার্টার। সেখানে আরও বিপদ।

সুইজারল্যান্ড ইউরোপের সবচেয়ে নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানেও মরণ ফাঁদ পাতা। জুরিখ আর সেন্ট গ্যালেনে যে অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল ভবিষ্যতে তার চেয়েও কেমন ভয়াবহ হবে তা ওদের জানা নেই।

***

সেন্ট গ্যালেনে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার ফাঁকে টুইডকে লন্ডনে ফোন করলো। সুইজারল্যান্ডে ফোনের অনেক সুবিধা আছে, অসুবিধা ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া মার্টেল এমন সাঙ্কেতিক ভাষায় কথা বলে যে কেউ তা টেপ করলেও কিছু বুঝবেনা। এই টেকনিকেই ও টুইডকে সব কিছুই জানালো।

আজকের তারিখ আঠাশে মে, বৃহস্পতিবার। মার্টেল ডেলটার ব্যাপারে টুইডকে সবকিছু জানালো। ডেলটা সুইজারল্যান্ডের ভেতরে খুবই সক্রিয়।…এজেন্ট ব্যবসায়ীর পোষাক পরে থাকে…,ডেলটার প্রতীক পকেটে প্রকাশ্যে থাকে…স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে সহযোগিতা একেবারেই নেই…নকল আর্নল্ডও গ্রেপ্তার করে…,দুজন হফারের মধ্যে প্রচুর মিল…মনেহয় যমজ বোন…ফার্দি আর্নল্ড রিপোর্ট করেছিল ঐ একজনের দেহ লিমাট নদীর জলে পাওয়া গেছে…,এখন আসল ক্লেয়ারের সঙ্গে যাচ্ছি।

সেন্ট গ্যালেন ছেড়ে ওকে নিয়ে যাচ্ছি ওয়ার্নারের খুনের সন্ধানে–অপারেশন ক্রোকোডাইল…নয়া-নাজী…অবশ্যই যাচ্ছি।

এই হলো টুইডকে পাঠানো মার্টেলের বক্তব্য। টুইড এবার ফোনে ওকে জানালো, বেইরুটের রিপোর্ট অনুযায়ী ম্যানফ্রেড পশ্চিম জার্মানীর হ্রদের কাছে সীমান্ত অতিক্রম করছে। বুঝতে পেরেছো?

তাই নাকি?

রিসিভারটা রেখে মার্টেল স্যুটকেসটা নিয়ে দৌড়ে প্লাটফর্ম পেরিয়ে কামরার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ক্লেয়ার দরজাটা খুলে রেখেছিল। ঢুকে দরজাটা বন্ধ করলো। ট্রেন পূর্বদিকে ছুটে চললো। মার্টেল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একটা সীটে গিয়ে বসলো।

***

সবেমাত্র বিকেল হয়েছে। মিউনিখ অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের চারতলা। ঘরের ভেতর একজন ডেস্কের ম্লান আলোটা সরিয়ে রাখলো। ফোনের শব্দে ও ঘরের মধ্যে ঢুকেছিল। গ্লাভস জড়ানা হাতে রিসিভারটা তুললো।

–ভিনজ, লিনডাউ থেকে বলছি।

আমরা এখানেই আছি। ম্যানফ্রেড শান্ত গলায় বলল, সেন্ট গ্যালেনের ব্যাপারটা সফল হয়েছে?

–দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, হয়নি। এরউইন ভিনজ বলে উঠলো, কোলহার ওখান থেকে খবর পাঠিয়েছে।

-কেন?

–যার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল তার তেমন সাহায্য পাইনি। এর ফলে আমাদের দুজন লোক।

ভিনজের ফোন ধরা হাত ঘামতে লাগল।

সবটুকু শোনার পরে ম্যানফ্রেড রাগে ফেটে পড়ল। ওর চোখের মণিদুটো জ্বলজ্বল করতে লাগল। ভিনজ কাঁপা গলায় আবার বলল, ইংরেজটা এবার মিউনিখের দিকে।

ম্যানফ্রেড থমথমে গলায় বলে উঠলো, তুমি ওর সঙ্গে সবকিছু ব্যাপারটা সেরে ফেলেছে। যাই হোক মিউনিখে ঢোকার আগে ওর সঙ্গে যা করবার করে ফেলল।

আমি ব্যক্তিগতভাবে সবকিছু করেছি। সমস্ত ব্যাপারটা তুমি চেক করলে।

-হ্যাঁ সবসময় আমার সঙ্গে চেক করে নেবে ভিনজ সব সময়ে। এরপর সৌজন্যের খাতিরে মিঃ রেইনহার্ড দিয়েত্রিচকে একবার জানিও।

–আমি এগোবার ব্যাপারটা জানাবো।

ব্যাভেরিয়ার মূল ভূখণ্ডে ফোন বুথের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিনজ বুঝতে পারলো এবারে ফোনের সংযোগ কেটে গেছে। দ্রুত বেরিয়ে এসে অস্পষ্ট কুয়াশার মধ্যে মিশে গেল ও।

***

লিনডাউ-এর একটা মধ্যযুগীয় শহর। চারিদিকে কুয়াশায় ঢাকা। পুরোনো শহর, নুড়িবিছানো রাস্তাঘাট। অন্ধকারে গলিগুলো এক ভয়ঙ্কর আকার নেয়।

আইন মেনে চলা লিন্ডাতে কোন বিপদ নেই স্বাভারিক অবস্থায়।

ম্যানফ্রেড ফোন ধরার পরেই তিনটে গাড়ি দ্রুত ব্রীজের ওপর দিয়ে হাউস্টব্যানহফের দিকে ছুটে চললো। অস্ট্রিয়া আর জার্মানীর সীমান্ত এই লিন্ডা স্টেশনটা দেখবার মতো। লিন্ডা থেকে মিউনিকে যাবার পথে কোন সীমান্ত পেরোতে হয়না। কিন্তু সঠিক পাশপোর্ট না থাকলে জেলে যাবার সম্ভাবনা।

ভিনজের নেতৃত্বে আটজন লোক তিনটে গাড়িতে হাউপ্টব্যানহফের দিকে এগিয়ে চলেছে। দুজনের হাতে স্যুটকেস, তাতে ইউনিফর্ম আছে। এদিকে মিউনিখ এক্সপ্রেস লিন্ডা ছেড়ে চলে যাবার পথে।

ওদের পরনে রেলওয়ে টিকিট ইন্সপেক্টর আর জার্মান পাশপোর্ট কন্ট্রোল অফিসিয়ালদে মতো। এদের বিশ্বাস এবং পরিকল্পনা যে পাশপোর্ট ডাবল চেক করলেই মার্টেলকে ধরা যারে আটত্রিশ বছরের ভিনজই এর মূল চার্জে।

ভিনজের পরনে পাশপোর্ট কন্ট্রোলের ইউনিফর্ম। ভিনজের ভাবনায় মাত্র কুড়ি সেকেন্ডের মধ্যেই নিশ্চয়ই মার্টেলকে ধরা যাবে। নিশ্চয়ই দরজাটা খোলাভি জানে এই ট্রেনগুলে একেবারেই ফাঁকা যায়।ওর কামরায় অন্য কেউ থাকলেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এবার ট্রেন আসবে। ফাঁকা জায়গা দিয়ে আটজন আলাদাভাবে নেমে এগোলো। ওদের অশরীরীর মতো মনে হচ্ছিল। ঠিক সময়েই এসেছে। আর মাত্র কুড়ি মিনিট বাকী।

***

আঠাশে মে, বৃহস্পতিবার :

–কেইথ তোমার লিনডাউ পছন্দ হবে। ক্লেয়ারের কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে মার্টেল এক্সপ্রেসের জানলার দিকে তাকালো। হফারের কণ্ঠস্বর আবার বলে উঠল, এটা জার্মানীর খুব পুরোনো সুন্দর শহর।

জানি অন্যমনস্কভাবে মার্টেল আবার বলল, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বি. এন. ডি-র এরিখ স্টোলারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। ব্যাপারটা ওর একবার দেখার

বলতে বলতে মার্টেল বাক্স থেকে একটা রুমাল বের করে তার মধ্যে থেকে নীলচে রঙের একটা বড় পেনের মতো বস্তু বার করল। ফেসিং-এ একটা বোতাম আর বেসের দিকে আর একটা বোতাম আছে।

এমব্রডারী মিউজিয়ামে লোকটা যখন গুলি খেয়ে পড়ে গেল তখন ওর হাত থেকে ছিটকে পড়া ডেলটার এই খেলনাটা পেয়েছি। এতে একটা সূঁচ আছে আর তাতে বিষমাখানো আছে স্টোলারের ফরেনসিকের লোকেরা বলতে পারবে বিষটা কি?

–ঐ মেয়েটা, যাকে আমি হোটেলের বাইরে গুলি করেছি।

 –ওটাও ঐ একই ব্যাপার। দিয়েত্রিচের কাছে ইলেকট্রনিক্স শুদ্ধ আছে। ব্যাপারটা দারুণ…

–ওকি এই জিনিস তৈরী করে নাকি?

–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বাক্সের মধ্যে মার্টেল ওই সূঁচজাতীয় জিনিসটা ঢুকিয়ে রাখলো।

জানালার দিকে তাকিয়ে সুইজারল্যান্ডের চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল। বাইরে সবুজ ক্ষেত আর পাহাড়, ট্যুরিস্টদের পক্ষে দারুণ।

এবারে দৃশ্যটা বদলাচ্ছে। কোনস্তানজ লেকের ওপরে কুয়াশার ঘন পর্দা। কিছু কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে। মার্টেল দৃশ্যটা দেখতে দেখতে হফারকে জিজ্ঞেস করলো, এটাই তো রাইন ডেলটা?

–হু, আমরা নদীটা পেরোচ্ছি। এরপরে এটা লেকে গিয়ে মিশেছে।

 ডেলটা লেকের একেবারে পূর্বদিকের শেষপ্রান্তের ভৌগলিক অবস্থানটা বেশ রহস্যময়।

মার্টেল চশমাটা পরে নিয়ে সিগারেট ধরালো। ক্লেয়ার বলে উঠলো, আমরা একটু পরেই লিন্ডাউতে পৌঁছবো। আর আমরা নিশ্চয়ই দেখবো…। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে ক্লেয়ার বলে ওঠে, এই জায়গাতেই ওয়ার্নারকে শেষ দেখা গিয়েছিল।

-কিন্তু আমরা অষ্ট্রিয়ার ব্রেজেঞ্জে নামবো। একেবারে শেষ অবধি যাবো না।

—কেন?

-ওখানে নামাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটাই ডেলটার অনুমান করার শেষ জায়গা…।

–হাউপ্টব্যানহফ। মিউনিখ..হাউপ্টব্যানহফজুরিখের… ডেলটা.. সেন্ট্রালহক… ব্রেজেঞ্জে… ওয়াশিংটন, ডিসি…কিলট লুমিস..পুলাখ, বি. এন. ডি…অপারেশান ক্রোকোডাইল।

সবগুলোই ওয়ার্নারের কালো ছোট্ট নোটবুকটায় লেখা ছিল। গোপন পকেটে এটা পাওয়া গেছে। এরিখ স্টোলার নোটবুকটা পেয়ে লন্ডনে টুইডকে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

ব্রেজেঞ্জ। 

এক্সপ্রেসের গতি কিছুটা কমলো। জানলা দিয়ে কোনস্ট্যানজ লেকের ধূসর জলরাশি দেখা চ্ছে। এক্সপ্রেস থামলে মার্টেল সুটকেস হাতে নিয়ে দরজা খুলল। কিন্তু কোন প্লাটফরম নেই। লাফালো। ক্লেয়ারের হাতে স্যুটকেস। ও ক্লেয়ারের কনুই ধরে নামিয়ে রেললাইন পেরিয়ে কটা পুরোন একতলা বাড়ির দিকে এগোতে লাগল।

তুমি ভয় পেয়েছো…?

–কি ঘন কুয়াশা। ক্লেয়ার বলল।

 ক্লেয়ারের দেহে রেনকোট থাকা সত্ত্বেও ওর ঠাণ্ডা লাগছে। হঠাৎ এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাসে ময়ার শিউরে উঠলো। এটা ঠিক কুয়াশা নয় এক ধরণের ধূসর রঙের বাষ্প।

ব্রেজেঞ্জের পেছন দিকটা অস্পষ্ট জঙ্গলের মতো দেখাচ্ছে। স্টেশন ওরা পেরোতেই ক্লেয়ারের খে পড়ল কুয়াশার অস্পষ্টতা ভেদ করে একটা পাথরের দেওয়াল। অনেকদূর চলে গেছে। ওরা রিয়ে একটা স্বয়ংক্রিয় ধাতব কামরার মধ্যে নিজেদের লাগেজ জমা করে দিয়ে ব্রজেঞ্জের দিকে গোতে লাগলো।

জায়গাটা একেবারে রবিবারের মতো ফাঁকা। স্টেশনের মুখোমুখি একটা পুরোনো ধাঁচের বাড়ি মুখে মার্টেল দাঁড়িয়ে চারিদিকটা ভাল করে দেখতে লাগল। ক্লেয়ার কৌতূহলী দৃষ্টিতে ওর দিকে খেতে লাগল।

চশমাটা পড়ে তোমার ব্যক্তিত্বই পাল্টে গেছে। যাইহোক আমরা এখানে কিজন্যে এসেছি?

মার্টেল টুইডের দেওয়া দুখানা ফটো বের করে একটা ক্লেয়ারের হাতে দিল। ক্লেয়ার দেখল এই সেই নিহত লোক যার সঙ্গে ও ছমাসেরও বেশী কাজ করেছে আর যে জায়গায় ও দাঁড়িয়ে আছে এখান থেকে সামান্য দূরে ও নৃশংসভাবে খুন হয়েছে।

–আমরা এখন ওয়ার্নারের খোঁজ করছি। মার্টেল ওকে বলল, ওর স্ত্রী বোধহয় এখানেই কোথাও আছে, আর উনি খুব অসুস্থ। আমরা একটা ম্যাপ কিনে জায়গাগুলোকে কটা ভাগে ভাগ করে দুঘণ্টার মধ্যে…।

ব্যাপারটা কাজের কাজ হবে। কথার মাঝখানেই ক্লেয়ার বলে উঠলো।

ওয়ার্নার যে এখানে ছিল সেটা ওর নোটবইতে আছে। লোকটার একটা ব্যক্তিত্ব ছিল। যাই হোক আমরা ঠিক করে নেবো কোন্ জেলায় আমরা প্রত্যেকে যাবো।

***

মিউনিখের অ্যাপার্টমেন্টে গ্লাভস পরা হাতটা ফোনের রিসিভারটা তুলল। ম্যানফ্রেড যাকে ভাবছিল সেই এরউইন ভিনজ-ই ফোন করেছে।

–আমি মিউনিখের হাউনহফ থেকে বলছি।

 ভিনজ নিজের কোড নাম্বার দিয়ে পরিচয় দিল আর বললো, কয়েক মিনিট আগে ট্রেন নড়েছে।

ভিনজ কেমন যেন আমতা আমতা করছে বলে ম্যানফ্রেড ভাবলো পুরো ব্যাপারটায় হয়ত দু গণ্ডগোল হয়েছে। ম্যানফ্রেড ওকে আসল ঘটনা জানাতে বলল।

চমৎকার! ভালই হয়েছে, চালিয়ে যাও।  

–ইংরেজটা ট্রেনে ছিলনা। সম্ভবতঃ ও আগেই হয় রোম্যানৰ্শন নয় সেন্ট মারগারেখেন-এ থেমে গেছে। সুইজারল্যান্ডেই নেমেছে। সেন্ট গ্যালেনের এক্সপ্রেসে কোলহার ওকে দরজা বন্ধ হতে দেখেছে।

ম্যানফ্রেডের কণ্ঠস্বর শান্ত কিন্তু জটিল। মনের ভেতরটা বাইরে থেকে বোঝা দায়। ভিনজ এখন নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ ব্যাপারটা অসহ্য! কিছুতেই মানতে পারছেনা ম্যানফ্রেড।

ও বললো, যদি ট্রেনটা সুইজারল্যান্ড দিয়ে বরাবর যেতো তাহলে কোলহার জানতে পারত…।

ম্যানফ্রেড আবার বলল, সুইস বর্ডার থেকে তোমার কাজ শুরু। লিন্ডাউতে তুমি ট্রেনে আছো…।

বদমাইসটা ব্রেজেঞ্জেই নেমেছে। কারণ জায়গাটা একেবারে খোলামেলা। বলতে গিয়ে ভিনজ-এর গলা কাঁপছিল।

বেজেঞ্জের নামটা চিবিয়ে বলতে বলতে ম্যানফ্রেড সজোরে রিসিভারটা চেপে ধরলো ম্যানফ্রেড একেবারেই চায়নি মার্টেল এই শহরটায় ঢুকুক। ওর গলা ফাটিয়ে চকার করতে ইচে করলেও ভিনজের কাছে প্রাণপণে নিজেকে সংযত রাখলো।

–যাইহোক, আর্মি ব্রেজেঞ্জে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একটা টীম পাঠাচ্ছি। ভিনজের এই কথা অপরপ্রান্ত থেকে কোন সাড়া এলো না।

খানিক বাদে ম্যানফ্রেড বলল, তোমার টীম আধঘণ্টার মধ্যেই যোগাযোগ করুক এটাই চাই ব্যাপারটাতে তোমাকে সফল হতেই হবে।

ওর এই কথায় ভিনজ কেঁপে উঠল। এটাই তাহলে ম্যানফ্রেডের সতর্কবাণী। যেমন করে হোক ইংরেজটাকে খতম করতেই হবে।

***

সেন্ট গ্যালেন থেকে মার্টেলের ফোন পাওয়ামাত্র টুইড অফিস থেকে ফ্ল্যাটের দিকে নজ দিলো। কিন্তু হাওয়ার্ডের নতুন সহকারী ম্যাসন ওকে খানিকটা দেরী করে দিয়েছিল। অবশ্য টুই মুহূর্তেই বেরিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিয়েছে।

-স্যার চীফ আপনাকে একবার অফিসের দিকে ডাকছে। খুবই জরুরী দরকার।

জরুরী কি সবসময়েই। ঠিক আছে। ফিরে এসে দেখা করবো।

টুইড ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে একটা ক্যাব নিলো.এবং সঙ্গে সহকারিণী মিস ম্যাকনেইলকেও নিল ওর হাতে ধরা হোল্ডেলে মার্টেলের টেপটা লুকোনো। ক্যাবের মধ্যেই ও একবার জিজ্ঞেস করলে ম্যাসনকে নতুন নেওয়া হয়েছে। লোকটা কেমন?

-দেহরক্ষী হিসাবে ভাল। ম্যাকনেইল স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ও জুডো, ক্যারাটে এসবে দক্ষ হাতবন্দুকও ভাল চালাতে পারে। হাওয়ার্ড ওকে নিতে স্পেশাল ব্রাঞ্চ ভীষণ খুশী।

ফ্ল্যাটে পৌঁছে ম্যাকনেইল মার্টেলের কথাবার্তার টেপটা চালিয়ে দিল আর মাঝে মাঝে নো নিতে লাগলো। টুইডকে চা খাবার খেতে বলল। টুইড নিজের ব্যস্ততার জন্যে তা প্রত্যাখ্যান করল

এই ফ্ল্যাটে টুইড একাই থাকে। নিজেই সব কিছু করে নেয়, তবে একটা দেহাতী সিসিলিয়া আছে কাজকর্ম করে দেয়। টুইড নীচের রেস্তোরাঁ থেকে চাআনালো। চা খেতে খেতে প্রশ্ন করলে মার্টেলের তথ্যগুলোতে বিশেষ কিছু আছে?

-হ্যাঁ দুটো জিনিস আছে। প্রথমতঃ ডেলটাদের সংগঠনটা উন্মাদ আর রক্তপিশাচ বলে মনে হচ্ছে। দ্বিতীয়তঃ ডেলটা নয়া নাজীদের ব্যাপারে কিছু একটা মিথ্যে বা মেকি। আমি ঠিক বুঝতে…

ম্যাকনেইল তুমি সত্যিই সুন্দর। আমি নিশ্চিত যে, দোসরা জুনই হচ্ছে একেবারে শেষ দেখা। যেদিন সামিট এক্সপ্রেস প্যারিস ছাড়লো। কারণ সকালেই এটা ব্যাভেরিয়া অতিক্রম করছে।

তুমি কি ব্যাভেরিয়াতে নির্বাচনের কথা ভাবছো?

নিশ্চয়ই। তিনটে প্রধান দল ক্ষমতার জন্যে লড়ছে, কে রাজ্যের সরকার গড়বে। দিয়েত্রিচে ডেলটা, নয়া নাজী, চ্যান্সেলার ল্যাংগার-এর সরকারী দল এবং বামপন্থীরা যাদের সঙ্গে প্রাক্তন কম্যুনিস্টরা আছে। যদি তেসরা জুন অর্থাৎ নির্বাচনের আগের দিন নাটকীয় কিছু ঘটে, তাহলে নির্বাচনের ফল টফলারের হাতে চলে যাবে অর্থাৎ বামদের দখলে। থেমে আবার বলল, তার মানে পশ্চিমে একটা বিপর্যয়।

–কি নাটকীয় ঘটনা?

চায়ে চুমুক দিয়ে টুইড বললো, আমি স্থির নিশ্চিত যে, ডেলটার একটা গোপন–পরিকল্পনা আছে।

–আর ঐ মিথ্যে?

 ম্যাকনেইল চুপ করে বসেছিল। টুইড চশমার ফাঁক দিয়ে ওকে একবার দেখলো। তারপর খুব আস্তে বলে উঠলো, ডেলটার মধ্যে একটা আলাদা গ্রুপ গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কার্যকলাপই এখন বলে দিচ্ছে যে, তারা নির্বাচনে হারবে।

–হুঁ। ম্যাকনেইলের ছোট্ট জবাব।

***

–তোমরা দুজন কোথায় ছিলে?

ম্যাকনেইল আর টুইডকে দেখে হাওয়ার্ড বলে উঠলো ও অফিসেই ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল। হাওয়ার্ডের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠছিল। পেটের ওপর দিয়ে ও একবার হাতদুটো জোড়া করলো। ওখানে একটা সোনার ঘড়ির চেন রয়েছে। টুইড ওকে খুব ভাল করেই লক্ষ্য করলো। বেশ হাসি খুশী স্বভাবের।

–এই একটু রিজেন্টপার্কে গিয়েছিলাম। এমনিই…। টুইড ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলল।

হাওয়ার্ড বলল, তোমরা একটা সমস্যার মধ্যেই কাজ করছো না?

ম্যাকনেইলের মনে হল এস. আই. এস-এর প্রধান কেমন যেন নার্ভাস। ওর হোন্ডেলটা এখন ফাঁকা। টেপটা ফ্ল্যাটে রেখে এসেছে।

হোন্ডেলের ভিতর কি আছে হাওয়ার্ড জানতে চাওয়াতে ও জবাব দিলো, এই বিশেষ কিছু নয়। স্যান্ডউইচ, চীজ এসব।

বলে ও বাইরের দিকে এগিয়ে গেল।

 হাওয়ার্ড এবার বলে উঠল, তুমি কি কেইথ মার্টেলের ব্যাপারে কিছু শুনেছো? প্রশ্নটা টুইডের উদ্দেশ্যে।

–আমি তো ভেবেছিলাম ভিয়েনার সামিট কনফারেন্সে তুমি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। তাহলে মার্টেলের ব্যাপারে আর আগ্রহ কেন?

–হুঁ, এ তো প্রতিটা লোককেই করতে হবে।

তবে আমাকে একটা কথা বলল। তুমি যদি ব্যাপারটা রেকর্ড রাখতে চাও, তাহলে আমাকে একটা মিনিট পাঠিয়ে দাও। ওটা মন্ত্রীকে দেখাবো।

টুইড চশমাটা নাকের ওপর ঠেলে দিয়ে হাওয়ার্ডের দিকে তাকালো। বললো, যাইহোক আমার মনে হয় সাধারণ লোক কি আমেরিকা, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট কিংবা জার্মানীর চ্যান্সেলারের নিরাপত্তার ভার নিতে পারবে?

–টিম ও’মিয়েরা ওয়াশিংটনে আছে। অ্যালিন ফ্রাসে প্যারিসে আর এরিখ স্টোলার বনে। এগুলো কি সত্যিই তোমার…?

না, আমি আশ্চর্য হচ্ছি আমার পুরোনো বন্ধুরা সবাই কাজে ব্যস্ত। টুইড ওর চীফের দিকে তাকালো। এরপরই হাওয়ার্ড গম্ভীর মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ম্যাকনেইল একবার দরজার দিকে তাকালো।

–ও বেরিয়ে গেছে?

–হ্যাঁ, বৃটিশ সিংহ গর্জন করছে। এখন অবশ্য নিরাপদ।

 এরপরে দ্য টাইমস অ্যাটলাসের কপিটা খুললো। তারপর বলে উঠল, ক্রোকোডাইল–এই কোডটার গন্ধ যেন আমার নাকেই লাগছে।

***

এরউইন ভিনজ ওর একজিকিউশান স্কোয়াড-কে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত ব্রেজেঞ্জের দিকে রওনা হলো। আটজন তোক বিমান থেকে নেমেই তিনটে গাড়িতে তাড়াতাড়ি সীমান্ত দিয়ে এগিয়ে চললো।

তিনটে নাগাদ ওরা স্টেশনের মুখোমুখি এসে হাজির হলো।

–আমার ধারণা মার্টেল এখানেই ট্রেন থেকে নেমেছে। ভিনজ গাড়ির ভেতরের দুজনকে বলল। চারিদিক তাকিয়ে আবার বললো, ও এখনও মনে হয় ব্রেজেঞ্জেই আছে। তোমরা এখানেই থাকো, আমরা বাকী কজন শহরটা একবার চক্কর মেরে আসি যতক্ষণ না ওকে খুঁজে পাই।

আমরা যদি ওকে ট্রেনে দেখতে পাই? একজন ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

 তাহলে ওর কপালে নির্ঘাত দুর্ঘটনা আছে। যাইহোক ও এখনো মিউনিকে পৌঁছায়নি। ভিনজ বলল।

এরপরে ভিনজ অন্য পাঁচজনের সঙ্গে খানিকটা পরামর্শ করলো। বললো, মাৰ্টেলকে কেউ ধরতে পারলে বিশ হাজার ডয়েটমার্ক তাকে পুরস্কার দেওয়া হরে। জনসাধারণকে বলবে একটা পাগলাটে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। বিপজ্জনক। এখন থেকে দু-ঘণ্টা পরে আমরা আবার এখানেই মিলিত হবো। কেমন?

***

মার্টেল চার্লস ওয়ার্নারের পদচিহ্নসংগ্রহকরলো বলা যেতে পারে। কেইসারট্রোসেতে একজন মাঝবয়সী বই বিক্রেতার সঙ্গে রাস্তায় ক্লেয়ারও মার্টেলের সঙ্গে আধ ঘণ্টার জন্য সাক্ষাঙ্কারের ব্যবস্থা করা হল। ওয়ার্নারের ফটো বই বিক্রেতাকে দেখাতেই ওর মুখে প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠল।

বিক্রেতা বলল, আমি তোমার বন্ধুকে চিনি। গ্রিফ সম্ভবতঃ ওর সঙ্গী ছিল।

–গ্রিফ? মার্টেল সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করল।

-হ্যাঁ, ওর প্রিয় বন্ধু। এখানে বেড়াতে এসেছিল আর তখনই মারা যায়। ঘটনাটা ঘটেছিল ভোরালবার্গ আর টাইরস ফরাসী মিলিটারীআসার সময়। যুদ্ধের পর ওর বন্ধুকে এখানেই সমাধিস্থ করা হয় আর এতেই ওর মনে হয়েছিল বন্ধুকে যথোচিত সম্মান দেখানো হয়েছে।

-আচ্ছা…।

মার্টেল সতর্ক। লোকটা আবার বলতে লাগলো, এই ব্রেজেঞ্জে দুটো ক্যাথলিকদের, একটা প্রোটেস্ট্যান্টদের সমাধিস্থল আছে। ওর বন্ধুটার আবার বিচিত্র ব্যাপার। জন্মেছিল প্রোটেস্টান্ট হয়ে। পরে হল ক্যাথলিক। আরো পরে কোন বিশ্বাসই ছিল না। আমার কাছে এসে তিনটে সমাধিস্থলই কোথায় জানতে চেয়েছিল। আমি ওকে স্ট্রীটের একটা ম্যাপে ওগুলো দেখিয়েছিলাম।

কতদিন আগে?

 প্রায় সপ্তাহখানেক আগে। গত শনিবার।

 –আমি একটা ওরকম ম্যাপ কিনবো।

 বই বিক্রেতা একটা ম্যাপ খুলে ওকে তিনটে সমাধিস্থল বুঝিয়ে দিল।

***

ক্লেয়ার মার্টেলের জন্য সাবওয়ের সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়েছিল। ক্লেয়ার মনোযোগ দিয়ে সামনের একটা প্রাচীন দেওয়ালের জানালার ধ্বংসাবশেষ নিরীক্ষণ করছিল।

হঠাৎ মার্টেল ওর মনোযোগ ভঙ্গ করে বলে উঠল, গত শনিবার আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, এখান থেকে একশো ফুটেরও কম দূরত্বে ও দাঁড়িয়েছিল।

শনিবার ছিল। তারপরই লেকে খুন হয়। দিনটা রবিবার।

–আচ্ছা কতদিন আগে অস্ট্রিয়াতে মিলিটারী ঢুকেছিল?

অস্ট্রিয়ার ব্যাপারটা শেষ হয়েছিল মে মাসের পনেরো তারিখে। সাল ১৯৫৫। কিন্তু ওয়ার্নার…।

ব্যাপারটা তত অর্ধশতাব্দীর। তাহলে আজকে সেইরকম কিভাবে ঘটতে পারে?

–আমাদেরকে সব কিছুই খুঁজে বের করতে হবে। সমস্ত ব্যাপারের মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাঁক।

–কিন্তু কোথা থেকে আমরা আরম্ভ করব?

-ওয়ার্নার যে তিনটে সমাধিস্থল দর্শন করেছিল, আমরা একটা গাড়ি ভাড়া করে ঐ তিনটে সমাধিই দেখবো। আশা করি এগুলোর একটার মধ্যে কোনো গোপনতা…।

এদিকে কেইসারস্ট্রাচেতে সেই বইয়ের দোকানে এরউইন ভিনজ এসে হাজির হল। ব্রেজেঞ্জেতে ও দেরী করে পৌঁছনোয় মার্টেল সুবিধে পেয়ে গেছে। ও ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করল।

এক তলাতে ভিনজের সঙ্গে বিক্রেতার কথাবার্তা হল। বিক্রেতা মন দিয়ে সব শুনলো।

তারপর বিক্রেতা বলল, তুমি বলছ লোকটা উন্মাদ আশ্রম থেকে পালিয়ে এসেছে?

কথাটা বলে অস্ট্রিয়ানটা ভিনজের দিকে ঐ কুঁচকে তাকালো।

-হ্যাঁ, এমনিতে দেখলে স্বাভাবিক বলেই মনে হবে, কিন্তু আসলে ও একটা ভয়ঙ্কর রকমের উন্মাদ। আর এটাই আরো বিপজ্জনক। দেখেছো নাকি লোকটাকে?

***