২. দুষ্প্রাপ্য বইয়ের দোকান

মে ফেয়ার স্ট্রীটের একটা দুষ্প্রাপ্য বইয়ের দোকানের ওপরে জুলি মিসেস ফ্রেঞ্চের অফিস খুঁজে পেল। বইয়ের দোকানের ডানদিকের দরজা দিয়ে ঢুকে সামনে সিঁড়ি।

একটি মেয়ে পিকনিজ কুকুর কোলে নিয়ে দরজায় শড়িয়েছিল। জুলির দিকে চাইল সে, কিন্তু কোন কৌতূহল ফুটে উঠল না তার চোখে। তারপর গাঢ় রঙ মাখা চোখ দুটো রাস্তার দিকে ফেরাল। একটি লোক প্রথমে মেয়েটিকে তারপর জুলির দিকে চেয়ে হেঁটে চলে গেল। মেয়েটি ভ্রূক্ষেপও করল না। এর মধ্যে লোকটি এখান দিয়ে দুবার হেঁটে গিয়েছে। যারা মনস্থির করতে সময় নেয়, এ হয়তো সেই ধরনের লোক। ও আবার ফিরে আসবে।

জুলি লবিতে ঢুকল। মেয়েটা নাক সিঁটকাল। আমি কোনদিন অত নিচে নামব না। জুলি স্বগতোক্তি করলো।

এদিক ওদিক চাইতে চাইতে দেখতে পেল বইয়ের দোকানের কাঁচের ওদিক থেকে একটা লম্বা, হাড়গিলে লোক ওকে দেখছে। মাথায় এক ঝুড়ি সাদাপাকা চুল। জুলি অস্বস্তি বোধ করল। ও বুঝল যতক্ষণ ওকে দেখা যাবে, বুড়োটা ওকে দেখে যাবে।

সিঁড়ির মাথায় একটা দরজায় লেখা,

মিসেস ফ্রেঞ্চ।
ডোমেস্টিক এজেন্সি
ভেতরে অনুসন্ধান করুন।

 দরজাটা ঠেলে জুলি একটা ছিমছাম, সাজানো ঘরে ঢুকল। ঘরে ফুল, ঝলমলে রোদ।

জানলার ধারে একটা চালাক-চতুর, মার্জিত মেয়ে বসে টাইপ করছে। মেয়েটির বাদাম–সোনা চুল ওপরে তুলে আঁচড়ানো। লাল বোতাম, সাদা পোষাকটি শরীরে এঁটে বসেছে। ঈর্ষায়, কৌতূহলী আগ্রহে জুলি ওকে দেখতে লাগল।

মেয়েটি ওকে দেখল। হাত তখনও টাইপ করে চলেছে। জুলিকে দেখে ও টাইপ করা থামাল, বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে চেয়ার ঠেলে কাউন্টারে এসে দাঁড়াল।

মেয়েটি পোষাকের দোকানের মডেলের মতো লম্বা। চলাফেরায় একটা সহজ লাবণ্য আছে। ওকে দেখে জুলির যেন নিজেকে খেলো রঙচটা মনে হল। সঙ্গে সঙ্গে জুলি মনে মনে তেরিয়া হয়ে উঠল।

কিছু চাইছিলেন? মেয়েটি জুলিকে অতর্কিতে জিজ্ঞেস করল। ওর চাউনিতে তাচ্ছিল্য। গলাটা নিচু, কেমন যেন চেনা চেনা।

জুলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, মিঃ হ্যারি আমাকে মিসেস ফ্রেঞ্চের সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন।

–ও আপনি বুঝি জুলি হল্যান্ড, বসুন। একটু অপেক্ষা করুন। মা এখন ব্যস্ত আছেন। বলে ও টাইপ করতে চলে গেল।

জুলি একটু আহত হলো মেয়েটির ব্যবহারে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে হলো। শুধু টাইপের খুটখাট শব্দ আর লাইন শেষের টুং আওয়াজ। মেয়েটিকে লক্ষ্য করতে লাগল জুলি, আর ভাবতে লাগল, এরা নিশ্চয় ভাল পয়সা দেয়। ফ্রকটার কাটছাঁট সুন্দর, নাইলনের মোজাও পরেছে দেখছি। ওরকম একটা জামা আমার যদি থাকত। আমাকে ওর চেয়ে অনেক ভাল দেখতে।

হঠাৎ মেয়েটি এক তোড়া কাগজ নিয়ে অফিসে ঢুকে গেল। বেরিয়ে এসে বলল, যান ভেতরে।

মিসেস ফ্রেঞ্চ একটা বড় টেবিলে জানলার ধারে বসেছিলেন। পরনে মিশমিশে কালো পোষাক। দেখে জুলি মনে ধাক্কা খেল। কেন যেন ওর মনে হল কোন আত্মীয়ের শ্রাদ্ধবাসরে এসেছে। মহিলার কানে ঝোলা জেট পাথরের দুল। মেয়ের রূপলাবণ্যের কিছুই নেই ওর মধ্যে, কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আঁটসাঁটো ঠোঁটে আর চিবুকে দুজনের সাদৃশ্য খুব স্পষ্ট।

মনে হল জুলির বিষয়ে ইনি সব কিছু জানেন, আচমকা কাজের কথা পেড়ে বসলেন।

গ্লেব আমায় তোমার কথা বলেছে। যদি মাথা খাটিয়ে চল, দেখবে কাজটা সহজ। দেখে তো হাবা মনে হচ্ছে না।

জুলি এখনও দাঁড়িয়ে দেখে উনি অধৈর্য হয়ে বললেন, বস, বস। হাতের ইশারায় একটা চেয়ার দেখালেন। গলাটা ভারি রুক্ষ।

আজ বিকেলে তুমি ৯৭, পার্কওয়েতে যাবে। অ্যালবার্ট হল কোথায় জান? পার্কওয়ে তার পাশেই। ভুল তোমার হবে না। বাড়িটা যেমন কুচ্ছিত তেমনি বড়। মিসেস হাওয়ার্ড ওয়েসলি তোমার খাস মনিব। তুমি তার চাকরানী হবে। তোমায় ওঁর জিনিষপত্র সামলাতে হবে, পোশাক পরা হয়ে গেলে গুছিয়ে রাখতে হবে, কেউ এলে দরজা খুলতে হবে, ককটেল দেবে, ফুল সাজাবে, টেলিফোন ধরবে। কাজের কথা ধরলে কাজটা সোজা। ও বাড়িতে আরো বাঁধা লোকজন অন্য সব কাজকর্ম করে। খাবার আসে রেস্টুরেন্ট থেকে। মিসেস ওয়েসলি তোমায় থাকা খাওয়ার পর হপ্তায় তিন পাউন্ড দেবেন। প্রতি শনিবার বিকেলে এখানে এসে তোমার বাড়তি টাকা নিয়ে যাবে। বুঝলে তো?

–হ্যাঁ।

 মিসেস ফ্রেঞ্চের ভেতর যেন কি একটা আছে, ওর অস্বস্তি হতে লাগল। গাঢ় অন্ধকারে কোন অস্বাভাবিক শব্দ শুনলে যেমন মনে হয় এখনি ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে, ঠিক তেমনি ভয়মেশানো অস্বস্তি।

–তোমার ইউনিফর্ম ওখানে ওই মোড়কে।

মিসেস ফ্রেঞ্চ কথা বলতে বলতে কানের চুলে হাত দিলেন। যেন কোন গোপন রহস্য টের পেলেন। মুখ হাসিতে ভরে গেল, যদি ফিট না করে, বদলে নিও। মনে হয় ঠিকই হবে। দোহাই ওখানে ময়লা জামা পরোনা, মিসেস ওয়েসলি বেজায় রেগে যাবেন। এই যে তোমার প্রশংসাপত্র। দুটো খাম উনি দিলেন, পড়ে দেখ। মিসেস ওয়েসলি বিশেষ খুঁটিনাটি দেখবেন না, তবে বলা যায় না। একজন ডাক্তার, একজন ধর্মযাজকের প্রশংসাপত্র। এগুলো জোগাড় করতে আমাকে অনেক খরচও করতে হয়েছে। হারিও না যেন।

ধন্যবাদ। জুলি ঘাবড়ে গিয়ে খামদুটো ব্যাগে ভরল। মিসেস ফ্রেঞ্চ বলে চললেন, এখন বুঝলে তোমায় কি করতে হবে? ওয়েসলিদের কথা তোমায় একটু বলে দিই। তুমি নিজেই টের পেয়ে যাবে, তবু সাবধান করে দিচ্ছি। এরোপ্লেন ডিজাইনার ফার্ম ওয়েসলি বেনটনের সিনিয়ার পার্টনার হাওয়ার্ড ওয়েসলি। কারখানাটা নর্টহোল্ট বিমান ঘাঁটির কাছে। ওয়েসলি সেখানে রোজ যান। ওঁর কথা তুমি পড়ে থাকতে পার। উনি অন্ধ। জ্বলন্ত বয়ার প্লেন চালিয়ে ফেরত আনার জন্যে ভিক্টোরিয়া ক্রস পেয়েছিলেন। প্লেনের কর্মীদের বাঁচিয়েছিলেন নাকি যেন, সব আমার ঠিক মনে নেই। যাইহোক, উনি অগাধ ধনী, অন্ধও বটে।

একটা পেন্সিল নিয়ে মহিলা ব্লটিং-এ দাগ কাটলেন, বললেন, মিসেস ওয়েসলি বিয়ের আগে মিউজিক্যাল কমেডির অভিনেত্রী ব্লানশ ট্যুরেল ছিলেন। তুমি হয়ত ওঁকে দেখে থাকবে। উটের মতো মদ গেলেন ঐ মহিলা। সেই কারণে রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে দিলেন। ওয়েসলি চিরদিন ওঁকে নিয়ে পাগল। উনি নিজেকে ছাড়া কারো জন্যে ভাবেন না। শুনেছি ওয়েসলির টাকার জন্যে ওঁকে বিয়ে করেছেন, এরপর থেকে নরক যন্ত্রণা দেন। ভয়ঙ্কর মেজাজ ওঁর, বেজায় ছোট মন, আর চরিত্র, রাস্তার বেড়ালের মতো সচ্চরিত্র।

একটু ভেবে বললেন, পয়লা নম্বর কুত্তী একটা।

 জুলি হতভম্ব হয়ে বলল, আচ্ছা!

মিসেস ফ্রেঞ্চ আবার বলতে লাগলেন, তোমার ওঁকে নিয়ে ঝামেলা হবে। তোমার কাজ বেশ সোজা হবে। মিসেস ওয়েসলিকে বাগানো সোজা হবে না। আর সেজন্য তোমায় এত টাকা দিচ্ছি। টাকাটা কষ্ট করে রোজগার করতে হবে, ভেবনা কাজটা খুব আরামের।

জুলির দিকে খুশি-খুশি চোখে চাইলেন, আমি যদূর জানি উনি তিন হপ্তার বেশী একদিনও চাকরানী রাখতে পারেননি। কিন্তু তোমার কাজই হলো যতক্ষণ না আমি তোমায় ছাড়তে বলছি, ততক্ষণ টিকে থাকা। আমরা তৈরী হবার আগে ভাগে ছেড়ে দিলে সেই পঞ্চাশ পাউন্ড আর পাচ্ছে না। বুঝলে?

জুলি ধারালো গলায় বলল, কিসের জন্যে তৈরী হলে?

আমরা যখন জানাতে চাইব তখন তুমি জানবে। এখন তোমার কাজ হল পার্কওয়েতে গিয়ে ঢোকা আর গেড়ে বসা। আমরা যে টাকা দিচ্ছি, তাতে তুমি খুশী? খুশী না?

–হ্যাঁ। টাকা ঠিকই আছে।

তবে খুশী থাক। প্রশ্ন কোরনা।

দেরাজ খুলে মহিলা বললেন, এখন এস। মুখ থেকে ওই রং মুছে ফেল। মনে রেখো, এখন তুমি চাকরাণী, সিনেমার অভিনেত্রী নও।

–হ্যাঁ। জুলির ঘেন্না হল মহিলার ওপর। টাকাগুলো ও ব্যাগে পুরল।

–মেজাজ সামলে চলো। মিসেস ওয়েসলি যখন কড়কাতে থাকবেন, তখন মেজাজ ঠিক রেখো। খুব হুঁশিয়ার হলেও সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে তখন।

বুঝলাম।

–বেশ। তাহলে এখন কেটে পড়ো। বেরোবার সময় ডানাকে বোল, আমি ওকে ডাকছি।

জুলি ইউনিফরমটা নিচ্ছিল। মহিলার মুখে ডানা নামটা শুনে হাত থেকে মোড়কটা পড়ে গেল প্রায়। তাহলে এই মেয়েটাই ডানা। হ্যারির কথা ওর মনে পড়ল, ও বলেছিল, ডানা তোমার মতো রূপসী নয়, ওর কথা ভাবার দরকার নেই। রূপসী নয়? কেমন করে হ্যারি ওকে মিথ্যেটা বলল? সবই তো আছে, ঠাট, রূপ, ভাল পোশাক। খুব রাগ হলো জুলির। মনটা ভেঙে গেল। হ্যারি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, মেয়েটির কোন মূল্য নেই ওর কাছে। ওরকম মেয়ে

মিসেস ফ্রেঞ্চ হাঁক ছাড়লেন, দেরি করছ কেন? তুমি তো জান এখন কি করতে হবে, না কি জান না?

–হ্যাঁ। জুলি অফিসের বাইরে গেল।

জুলির দিকে পেছন ফিরে ডানা টেলিফোন করছিল, হা, এখন অফিসে আছে। দেখে তো মনে হচ্ছে ঠিকই আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে জুলিকে দেখে কথা থামাল।

মিসেস ফ্রেঞ্চ আপনাকে ডাকছেন। জুলি বুঝল ওর নিজের গলা কাঁপছে। অফিস থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ও কান পাতল।

কাঁচের শার্সির ওপাশ থেকে ডানার স্পষ্ট গলা শোনা যাচ্ছে।

এই মুহূর্তে বিদায় হলো। একটু বেশ্যা টাইপের, তবে যদি কাজ হাসিল করে…কি বললে? না তা আমি ঠিক জানি না। হ্যাঁ টাকা ওরা সবাই চায়। ওই কথাই তো ভাবে ওরা। ঠিক আছে আজ রাতে কথা বলা যাবে।

কার সঙ্গে ডানা কথা বলছে, জুলি ভাবল। ওর মুখ গরম হয়ে উঠেছে। না হ্যারি নয়। ও কিছুতেই বিশ্বাস করবে না, ওকে বেশ্যা টাইপের মেয়ে বললে হ্যারি তা বরদাস্ত করবে। অফিসে ঢুকে ডানাকে একখানা চড় কষাতে ইচ্ছে হলো ওর। তারপর হঠাৎ যেন ওর মনে হলো ওর ওপর কেউ নজর রাখছে। ও পেছন ফিরল। ভেতরের অফিস থেকে বাইরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস ফ্রেঞ্চ। সিঁড়ির মুখের জানলার রোদ ওঁর কানের দুলে পড়ে ঝম করছে। মিসেস ফ্রেঞ্চ নড়লেন না, কথাও বললেন না। ভয়ঙ্কর ভয় দেখানো হলো ওকে। চেম্বার অফ হররস–এখানে যে সব মোমের মূর্তি থাকে, তাদের মতো পৈশাচিক। জুলি রাগটাগ ভুলে, থতমত খেয়ে সিঁড়ির দিকে পিছিয়ে গেল।

রুদ্ধশ্বাসে বলল, আমি শুনছিলাম না কিছুই।

 মিসেস ফ্রেঞ্চ একদৃষ্টে পাথর–পাথর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

জুলি ঘুরে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামল। সিঁড়ির মোড়ে গিয়ে যে মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল তার সঙ্গে ধাক্কা লাগছিল, আরেকটু হলেই। যে লোকটাকে জুলি পথে দেখেছিল, সে মেয়েটির পেছনে উঠছে। লোকটা জুলির দিকে চাইল না। ওর চোখ সিঁড়ির ওপর দিকে। মুখটা টটকে লাল।

নিচে, বইয়ের দোকানের দরজার কাঁচের ওপর থেকে সেই রোগা, সুটকো লোকটা ওর দিকে চেয়ে আছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুটে মে ফেয়ার স্ট্রীটের গরম, ব্যক্ততা, হুড়োহুড়িতে যতক্ষণ না জুলি পৌঁছল, ততক্ষণ লোকটা ওর দিকে চেয়েই রইল।

.

ঝিনুকের বুকের মতো গোলাপী রঙের রাতকামিজের ওপর সিল্কের স্কার্ফ জড়িয়ে ৯৭ পার্কওয়ের সদর দরজা হ্যাঁচকা টানে খুলে খেঁকিয়ে উঠল এক মহিলা, কি চাও? জ্বালাবার আর সময় পাওনি? কেউ বলে দেয়নি আমার চাকরানী নেই? মহিলার ভুরু চুল সব সোনালী সাদা। পুতুলের মতো মিষ্টি ফুটফুটে মুখটা ঘুমের আবেশে ফোলাফোলা। দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র ঘুম থেকে উঠলেন।

জুলি হতচকিত ও অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আপনাকে যদি বিরক্ত করে থাকি, আমি দুঃখিত।

মহিলা তার রাগ চাপবার কোন চেষ্টাই করল না। জুলি বলল, আমাকে মিসেস ফ্রেঞ্চ পাঠিয়েছেন, ভেবেছিলাম আমার আসার কথা আপনি জানেন।

ব্লানশ ওয়েসলি বলল, তবে ভেতরে এস না ছাই। বহুদিন কোন কাজের লোক নেই আমার। তাদের থেকে যা ব্যবহার পাই। সত্যিই!

হলের লাউঞ্জে ঢুকল মহিলা। জুলি সদর দরজা বন্ধ করে পেছন পেছন এলো।

ব্লানশ তার ধারালো আঙুলগুলো সোনালী, কোঁকড়া চুলের ভেতর চালাতে চালাতে বলল, একটু কফি না খেলে আমি তোমার সঙ্গে কথাই বলব না। এসে যখন পড়েছো খুঁজে বের করে কফি বানাও। এই যে রান্নাঘর। দয়া করে একগাদা প্রশ্ন কোর না। আমার মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। আগে আমায় কফি দাও। এই প্যাসেজ পেরিয়ে শেষের ঘরটায় আমি আছি।

জুলির দিকে মহিলা এতক্ষণে ভালভাবে চেয়ে দেখল, বলল, আরে তুমি তো দেখছি বেশ ফুটফুটে। এতদিন কুচ্ছিত মুখগুলো দেখে দেখে আমার চোখ পচে গেছে। এই কাজের লোকগুলো যে কেন এত বিতিকিচ্ছিরি হয় আমি ভেবে পাইনা। কিন্তু যাও। দাঁড়িয়ে আছে কেন? কফি বানাতে পারো, না কি তাও পারো না?

–হ্যাঁ। জুলি এক টুকরো হাসলো।

 ব্লানশ চোখ কুঁচকে বন্ধ করলো।

–তা ভাল, কিন্তু আমার দিকে চেয়ে দয়া করে হেসো না। আমার নার্ভে সইবে না। পায়ের সাটিনের চটি জোড়ার দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি চাই আমার সঙ্গে যখন কথা বলবে ম্যাডাম বললে ভাল হয়। তাতে অসুবিধা হবে না আশা করি।

না ম্যাডাম। জুলির মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। মুখটা লাল হয়ে গেল।

চটে গেলে? পেনসিলে আঁকা ভুরু জোড়া কপালে তুলে বলল, তোমাকে চটাবার মতো কি বলেছি? লাল বিটের মতো লাল হয়ে গেলে। আমার মনে হয় ওতে ভারী বিশ্রী দেখায়।

–না ম্যাডাম। পেছনে হাতের মুঠো দুটো শক্ত হয়ে গেল জুলির।

 ব্লানশ আত্মতৃপ্তভাবে বলল, হয়তো চটিয়ে দিতেই পারি, এখন অথবা পরে। মিঃ ওয়েসলি বলেন আমি চাকরদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে জানিনা। হয়ত তা সত্যি। কিন্তু আমার মনে হয় যদি কেউ ভালো মাইনে দিতে পারে, তবে তার যা খুশী বলার অধিকার আছে।

জুলি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মনভোলানো ছোট্ট পুতুলের মতো মুখখানা, চুলের রাশি ঘিরে আছে মুখটার চারপাশে, সবশুদ্ধ ওকে বিমোহিত করে ফেলেছে।

ব্লানশ ভুরু কুঁচকে বলল, আমায় চোখ দিয়ে অমন করে গিলোনা। আমায় দেখে তোক চেয়ে থাকে, তাতে অবশ্য আমি অভ্যস্ত। কিন্তু ওরকম বাড়াবাড়ি করলে আমার মেজাজ বেজায় খারাপ হয়ে যায়।

–দুঃখিত ম্যাডাম। জুলি বলল বটে। কিন্তু এই মহিলার এমনই একটা অমানুষী, বর্বর আকর্ষণী ক্ষমতা আছে যে বেশীক্ষণ চোখ ফিরিয়ে থাকা যায় না।

ব্লানশ আঙুল দিয়ে রগ টিপে ধরল আর বলল, আজ সকাল থেকে আমার শরীরটা অসুস্থ লাগছে। আমি যদি মরেও যাই, তাতে কার কি এসে যায়। তারপরই হঠাৎ ভীষণ রাগে ব্লানশ চিৎকার করে উঠল, ঈশ্বরের দোহাই তুমি কি কফিটা আনবে, না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে গিলবে? আমি কি একটা বেবুন আর আমার পাছা দুটো নীল, যে এমনভাবে দেখছো?

জুলি ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলল, দুঃখিত ম্যাডাম, আমি এখনি আনছি।

রান্নাঘরে গিয়ে ও তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল। মনে মনে ভাবল, আমাকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মহিলা যে এমন আমি ধারণাও করতে পারিনি। বাব্বাঃ কাজটা টিকিয়ে রাখতে গেলে খুব সাবধানে, সামলে চলতে হবে।

জল ফোঁটার সময়ের মধ্যে জুলি তাড়াতাড়ি ফ্রক খুলে, মোড়ক থেকে ইউনিফর্ম বের করে পরল। ভাবল, ইউনিফর্ম পরা দেখলে মহিলা হয়তো খুশী হতে পারেন। আমি যে আমার অবস্থা জানি, তা অন্ততঃ বুঝবেন। জুলি হাসল।

 জুলি ট্রে নিয়ে যখন ব্লানশের ঘরে ঢুকল, তখন ঘর চোখ ধাঁধানো আলোয় জ্বলছে। ঘরে বাসি এসেন্স আর ব্রান্ডির গন্ধ। ঘরের বাতাসটা বদ্ধ, ভারি। বিকেল তিনটে বেজে গেলেও একটি পর্দা বা জানলা খোলা হয়নি।

ঘরে অতুল বিলাসোপকরণ, অসম্ভব বিশৃঙ্খলা। তারই মধ্যে পায়চারি করছিল ব্লানশ। হালকা নীল লেপের সেলাই দেওয়া পুরু আস্তরণে দেওয়ালগুলো ঢাকা। নীল-সাদা চামড়ার গদী ঘরের সাদা পুরু কার্পেটের ওপর ইতস্ততঃ ছড়ানো। ইজি চেয়ার ও লেপমোড়া ডিভান। কারুকার্যকরী ড্রেসিংটেবিলের ওপর পাউডার, পেইন্টের টিউব থেকে পেইন্ট, অনেক শিশি উলটে পড়ে আছে। মেঝেতে, বিছানায়, চেয়ারে পোষাক ছড়ানো। ঘরের চেয়ারে জুতো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা।

–কি সময়টাই না নিলে, প্রায় খেঁকিয়ে উঠল ব্লানশ। বলল, এখানে কাজ করতে চাও তো আরো তাড়াতাড়ি কাজ করতে হবে। বুঝলে?

জুলির দিকে পিটপিট করে চেয়ে দেখে বলল, একি পোষাক বদল করা হয়েছে দেখছি। বা তোমায় ভালই দেখাচ্ছে। কি সুন্দর ইউনিফর্ম। বিছানার পাশে একটা টেবিল দেখিয়ে বলল, ওখানে ট্রেটা রেখে চলে যাও। হয়তো বাথরুমটা পরিষ্কার করতে পারো। তারপর আমরা কথা বলব। ওই যে বাথরুম। কয়েক মিনিট বাদে কথা কইব।

বাথরুমটা দেখে জুলির হিংসে হল। আলাদা ঘরে শাওয়ার, মেঝেতে নিচু বাথটাব, ড্রেসিংটেবিল, মুখ ম্যাসাজের মেশিন, গিজার, চুল শুকোবার যন্ত্র। একটি অলস, আহ্লাদে মেয়ের সমস্ত চাহিদার সম্ভার সাজানো। শোবার ঘরের মত সবই আছে, কিন্তু এখানেও চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। বাথটাব খালি করা হয়নি। দুধের মতো তোয়ালে জলে ভাসছে। মেঝেতে ছড়ানো ছিটোনো বাথসল্টগুলো জুলির জুতোর চাপে ভাঙতে লাগল। জুলি মুখ মোছর টিস্যু কাগজ, ক্রীমমাখা হাত–তোয়ালে তুলতে লাগল।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাথরুমটা পরিষ্কার করে ফেলল। টবটা খালি করল, ভোয়ালেটা নিংড়ে মেঝে মুছে ফেলল।

ও যখন শোবার ঘরে এলো, ব্লানশ তখনো পায়চারি করেই চলেছে। ড্রেসিং টেবিলের পেছন থেকে উঁকি মারছে অর্ধেক ব্র্যান্ডি বোঝাই পাত্র।

–এই তো তুমি এসে গেছে, ব্লানশ হাসল। এখন ওকে আরো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে এবং আরো খুশী খুশী।

–তোমার নামটা কি জিজ্ঞেস করিনি, করেছি কি? করিনি বোধহয়।

জুলি হল্যান্ড, ম্যাডাম।

ব্লানশ একটা ইজিচেয়ারে বসল, এক লহমা চোখ বুজল, তারপর মুখ তুলে জুলিকে বেশ ভাল করে তাকিয়ে দেখল।

তুমি কি বললে মিসেস ফ্রেঞ্চ তোমায় পাঠিয়েছেন। আমার আজকাল কিছুই মনে থাকছে না।

–হ্যাঁ, ম্যাডাম।

–ঠিক আছে। মনে হয় তোমায় দিয়ে কাজ চলবে। তোমার প্রশংসাপত্রটা আছে কি?

জুলি দুটো খাম বের করে ওনার হাতে দিল।

ব্লানশ খামগুলো খুলতে খুলতে বিরক্ত হয়ে বলল, মেয়েছেলেটা এত পাকা কাজ করে। প্রশংসাপত্রগুলোয় চোখ বুলিয়ে ছুঁড়ে টেবিলে ফেলে দিয়ে বলল, তোমায় মাইনের কথা বলেছে। বোধহয়?

–হ্যাঁ, ম্যাডাম।

–ঠিক আছে। ধরে নাও আজ থেকে তুমি বহাল হলে। একটু ঝুঁকে আয়নায় মুখ দেখে বলল, দেখা যাক, কেমন মানিয়ে চলতে পার। কফিটা তো ভালই বানিয়েছে। তুমি বাড়িটা পরিষ্কার রাখবে আর আমি যখন বলব তখন কাজ করবে, এইটুকুই মাত্র চাই। এই প্যাসেজের ওদিকে তোমার ঘর। ঘরটা ভাল। লোকজনকে আরামে রাখায় বিশ্বাসী আমি। তুমি এখনি কাজ শুরু করতে পারো।

–হ্যাঁ, ম্যাডাম।

 ব্লানশ চিরুনী তুলে নিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল।

–আজ রাতে আমি বাইরে থাকব। তুমি এখনি চলে এসো এখানে। ফ্ল্যাটটা খালি রাখতে চাই না আমি। তোমার কি মনে হয় এখনি আসতে পারবে?

–হ্যাঁ, ম্যাডাম। এই ঝকঝকে পুতুলটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ক্লান্তি বোধ করছিল জুলি।

–রাতে একা থাকতে আপত্তি নেই?

জুলি অবাক হল, না ম্যাডাম, মোটেই না।

ব্লানশ অলস ভঙ্গীতে বলল, কি সাহস তোমার। আমার একা থাকতে বিরক্ত লাগে। মিঃ ওয়েসলি গত পনেরো দিন যাবৎ প্যারিসে, আমার ভয় করে। কে জানে কখন কে ঢুকে পড়বে। আজকাল রাতে এতসব অদ্ভুত অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আর চুরিও বেড়ে গেছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এ বাড়িতে ভূত আছে। তোমার ভূতের ভয় নেই?

জুলি জোর দিয়ে বলল, না, ম্যাডাম।

কল্পনাটল্পনা না থাকা নিশ্চয় ভাল। ব্লানশ ওর চুলের কোকড়াগুচ্ছে হাত বুলোত বুলোতে বলল, আমি এত অনুভূতি কাতর, এমন ভিতু! একেকবার আমার মনে হয়, সত্যি যেন কেউ প্যাসেজ দিয়ে আসছে, যাচ্ছে। সে বোধহয় আমার নার্ভের জন্য।

কিংবা মদের ঝোঁকে ঝুঁদ হয়ে থাক বলে, জুলি মনে মনে ভাবল, হাসতে ইচ্ছে করল ওর। মুখে বলল, স্নানের জল ভরব ম্যাডাম?

–ভর। একটা ব্যাগ গোছাতে হবে। কাল সন্ধ্যের আগে আমি ফিরছি না। মিঃ ওয়েসলিও সেই সময় নাগাদ ফিরবেন। আমার অনেক কাজ থাকে। বহুদিন কোন লোক নেই। আমার সব অগোছালো হয়ে আছে। সব ঠিক করে গোছাতে হবে। লক্ষ্মীমেয়ে, ঐ কাবার্ডটা খোল। ওইটে। দেখ, আমার প্রতিটি পোশাকের আলাদা নম্বর আছে। ঐ যে হ্যাঙারে ঝুলছে।

ঘরে তিনটে বিশাল বিশাল কাবার্ড। তাতে ঠেলে বন্ধ করার দরজা। জুলি সেটা খুলে দেখল, সারি সারি পোক ঝুলছে, ফ্রক আর ইভনিং গাউন।

প্রত্যেকটা পোষাকের সঙ্গে ম্যাচিং-করা টুপি, নিচের পোষাক, দস্তানা, ব্যাগ আর জুতো আছে। ব্লানশ ক্লান্ত, ক্ষীণ গলায় বলল, নিয়মটা আমিই বের করেছি। প্রত্যেকটা জিনিষের নম্বর আছে। নম্বরী জিনিষগুলো মিলিয়ে একসঙ্গে রাখাই তোমার কাজ। পারবে বলে মনে হচ্ছে?

–হ্যাঁ ম্যাডাম।

–ওখানে একটা আলমারী আছে। দেওয়ালের ভেতর গাঁথা, দেখতে পাবে না। ওটা আমি নিজে দেখেশুনে রাখি। ওতে আমি ফারের জিনিষ আর গয়না রাখি। এখন তুমি তাড়াতাড়ি স্নানের জল দাও। আমাকে পাঁচটা কুড়ির ট্রেন ধরতে হবে। দেরী হয়ে যাচ্ছে।

ব্লানশ যখন স্নানের ঘরে গেল, জুলি তখন শোবার ঘরটা খুব ভাল করে পরিষ্কার করল। সন্ধ্যেবেলা এত তাড়াতাড়ি ছুটি পাবে ও ভাবেনি, তাই ভাবল সন্ধেবেলাটা কিভাবে কাটাবে। যদি ও হ্যারির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত, তাহলে দুজনে একটা সিনেমায় যেতে পারত। কিন্তু যোগাযোগের তো কোন উপায় নেই। তবে হ্যারি বলেছিল মিসেস ফ্রেঞ্চ ওর কাছে খবর পৌঁছে দেবেন। একবার চেষ্টা করে দেখলে হয়।

ব্লানশকে রওনা করা একটা প্রাণান্তকর অবস্থা। মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়। দুবার সুটকেশ খুলতে হল, কেন না, ব্লানশ কি নিয়ে যাবে আর কি নিয়ে যাবেনা, স্থির করতে পারছিল না।

তারপর যখন সব ঠিকঠাক গোছগাছ হল, জুলি ট্যাক্সির জন্যে ফোন করতে যাবে, তখন ব্লানশ খুঁতখুঁত করতে লাগল আর ঠিক করল যাবে না।

ইজিচেয়ারে ধপ করে এলিয়ে পড়ল ও। পোষাক পরে, মুখে রঙ মেখে ওকে আশ্চর্য সুন্দর দেখাচ্ছিল। রংচঙে আকর্ষণীয় একটা পুতুল যেন। বসে পড়ে বলল, সত্যি মনে হচ্ছে আমি এত ঝামেলা করতে পারবো না। আমি যে ওদের তেমন পছন্দ করি তাও নয়। ওরা এত খারাপ যে বলার কথা নয়। তাছাড়া আমার শরীরও ভাল লাগছে না। আমি যাব না…ব্যস। সব ভাজ নষ্ট হবার আগেই সুটকেশ খুলে তুলে দাও আলমারীতে।

তারপর হঠাৎ যেন যন্ত্রণা হচ্ছে এমনি গলায় ও চেঁচিয়ে উঠল, বেচারা জুলি! আমাকে তো যেতেই হবে। আমি ভুলেই যাচ্ছিলাম বাকী ওখানে থাকবে। ওর সঙ্গে দেখা করতেই হবে আমাকে। শিগগীর সব ভর, নাহলে আমি ট্রেন ধরতে পারবো না। তোমায় এত খাটাচ্ছি বলে আমি যে কি দুঃখিত তা কি বলব।

জুলির তখন চোখ ফেটে জল আসার যোগাড়। সমস্ত জিনিষ দুমদাম সুটকেশে ভরতে লাগল। ও যেই ডালা বন্ধ করতে যাবে, অমনি ব্লানশ বলল, না জুলি এখনি বন্ধ কোর না। কি যেন…ঐ আমি ঐ গোলাপ–বেগুনী জামাটা নেব না। নিচের দিকে আছে, ওটা পড়লে আমাকে মড়ার মতো দেখায়।

জুলির তখন রাগে ব্লানশের গলা টিপে মারতে ইচ্ছে করছে। হ্যাঁচকা টানে জামাটা বের করতে সব ওলট–পালট হয়ে গেল। ওকে রেগে যেতে দেখে ব্লানশ একটা পালটা চাল চাললো।

খুব আলতো করে বলল, তুমি কি গাউনটা নিতে চাও জুলি? আমার ওটা ভাল লাগে না। জিনিষটা অব্যবহারে নষ্ট হবে কেন?

জুলি মেঝেতে বসে পড়ল, ওর সব রাগ গলে জল হয়ে গেল।

–কি বললেন ম্যাডাম? গাউনটা ও আঙুল বুলিয়ে আদর করল।

জামাটা সুন্দর, তাই না? হার্টনেলের তৈরী। রংটা আমার ভালো লাগে না। ভেবেই পাই না, কেন ওটা কিনেছিলাম। তুমি চাও ওটা?

আমি? জুলির চোখে খুশীর ঝিলিক, হ্যাঁ, নিশ্চয়। ধন্যবাদ ম্যাডাম।

ব্লানশ তখন নিষ্ঠুর, একঝলক হাসি হাসল, যা দেখে জুলির আশা দপ করে নিভে গেল। আর তখনি ব্লানশ বলল, আমি ভেবে দেখবখন। আমি এটা দিতে পারব না। ঐ দেড়শো গিনি না কত যেন দাম লেগেছিল ওটার। বিশ পাউন্ড দিলে আমি তোমায় ওটা দিয়ে দিতে পারি।

আশাভঙ্গে জুলি চেয়ারের পিঠে পোষাকটা রেখে নিচু হয়ে সুটকেস গোছাতে লাগল।

ব্লানশ কায়দা করে বলল, তোমার নিশ্চয়ই একটা পোষাকের পেছনে বিশ পাউন্ড খরচ করার ক্ষমতা নেই?

–না ম্যাডাম। জুলি মুখ ফিরিয়ে নিল।

যাগে কিছু ভেবনা। দুঃখের কথা এই যে, তোমার অবস্থার একটি মেয়ে পোষাকটা পরলে নেহাত বেমানান হতো। সবাই তোমায় দেখে হাসত। তার চেয়ে আমি টাইম কাগজে বিজ্ঞাপন দেব, দিতে পারি না?

জুলি চট করে একবার ব্লানশের মুখের দিকে চেয়ে, ওর বিকৃত উল্লাস দেখে বুঝল যে, ব্লানশ ইচ্ছে করে ওকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে মজা পাচ্ছিল।

মনে মনে জুলি বলল, ঠিক আছে, নোংরা বিল্লী কোথাকার, তামাশা কর। তবে তোমার ফাঁদে আমি ধরা দিচ্ছি না।

ব্লানশ চলে যাবার পর জুলি ভাবল, ও যদি আমার মাথা খারাপ করে দেবার চেষ্টায় থাকে তবে সে গুড়ে বালি। সামনে চব্বিশ ঘন্টা ও থাকছে না। হ্যারি ওর কি ক্ষতি করবে করুক, আমি তোয়াকাও করি না। হ্যারিকে সাহায্য করতে যদি ওর নাকটা খুবলে নিতে হয় নেব।

জুলির মনে হল, এখন দু-ঘন্টা মতো ফ্ল্যাটটার পেছনে খাটলে তবে পরিষ্কার করে উঠতে পারবে। হ্যারির সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হলে সাতটায় ওরা দেখা করতে পারে।

জুলির মিসেস ফ্রেঞ্চের ওখানে ফোন করার কোন ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আর তো কোন উপায়ও নেই। তাই একটু ইতস্ততঃ করে ও ফোন করল।

ডানা ফোন ধরল।

ডানার গম্ভীর গলা শুনে জুলি আড়ষ্ট হয়ে বলল, জুলি হল্যান্ড কথা বলছি। আমি মিঃ গ্লেবের– সঙ্গে কথা বলতে চাই, তার নম্বরটা পেতে পারি কি?

ধরুন। ডানা বলল।

খট করে টেবিলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল ডানা। জুলি শুনতে পেল, সেই হল্যান্ড মেয়েটা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।

হ্যারির কথা শুনে জুলি অবাক হয়ে গেল।

–কি হয়েছে? হ্যারির গলায় ধার।

–কিছু না, সব ঠিক আছে। সন্ধ্যেটা একদম ফাঁকা। মিসেস ওয়েসলি বাড়িতে নেই। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলাম। সাতটা নাগাদ দেখা করতে পারি?

হ্যারি যেন বিরক্তস্বরে বলল, দুঃখিত, আমি এখন খুব ব্যস্ত।

–কিন্তু হ্যারি, তবুও আমরা দেখা করতে পারি নিশ্চয়। জানি না আবার কবে ছুটি মিলবে। এখন আমি একেবারে একা। কিছু করার নেই আমার।

–বিশ মিনিটের মধ্যে ট্রেন ধরব। আমি দুঃখিত, আমার কিছু করার নেই। যখন ফিরব তখন পারলে দেখা করব। এক মিনিটও সময় নেই। চলি। হ্যারি ফোন রেখে দিল।

জুলির রাগ হয়ে গেল। ভাবল, গোল্লায় যা সব! উচ্ছনে যাক! খুব বিপদে পড়া গেল। কারোর সঙ্গে কথা বলা যাবে না, বেরোনো যাবে না। সন্ধ্যেটা ফাঁকা, কি দুর্ভাগ্য! এত সহজে হ্যারিকে পেলাম, আর ও আমার সঙ্গে আর একটু ভালভাবে কথাও বলল না। হাজার হলেও আমরা প্রেম করছি।

তারপর ও ভাবল, হয়তো ডানা শুনছিল বলে হ্যারির কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই ঐভাবে কথা বলেছে।

খানিকক্ষণ পর, নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে ও নিঃসঙ্গ সন্ধ্যার দুঃখ ভুলে গেল। নিজের ঘর দেখে তো ও ভীষণ খুশী। এ ফ্ল্যাটের অন্যান্য ঘরের মত এ ঘরেও সুসজ্জিত আসবাব, টেলিফোন, বিছানার পাশে ট্রানজিস্টার আর সঙ্গে পরিচ্ছন্ন একটা বাথরুম রয়েছে।

এর মধ্যে জুলি ফুলহ্যাম প্যালেস রোডে নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে বাক্স গুছিয়ে নিয়ে এসেছেনতুন আস্তানায়। এই নতুন জীবনে, বিশালবাহুল পরিবেশে ওর নিজেকে আর উপেক্ষিত মনে হল না। এই সুন্দর ঘর, গরম জলে স্নান, রেডিও, ফোন, হ্যারিকে দেখতে না পাওয়ার, সঙ্গ না পাওয়ার দুঃখ ভুলিয়ে দিলো। আর এই আরামপ্রদ বিছানায় সব ক্লান্তির অবসান।

সাড়ে এগারোটায় রেডিও বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শোবার ব্যবস্থা করতে যাবে, এমন সময় ও শুনতে পেল এই ফ্ল্যাটের কোথায় যেন একটা দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হল। আওয়াজ শুনে। ওর হাত থেমে গেল। অস্বস্তি নিয়ে, কানপেতে ও অপেক্ষা করতে লাগল। ছোট্ট নিস্তব্ধ ঘরটাতে অপেক্ষা করতে করতে ওর মনে পড়ল মিসেস ব্লানশের কথা, আমার একা থাকতে ভয় করে, আমি জানি এখানে ভূত আছে। রাতে এমন সব শব্দ হয়।

জুলি ভাবল, ঐ কথাগুলো হয়ত ও আমায় ভয় দেখাতে বলেছিল। আবার আলো নেভাতে যাবে দেখল পর্দাগুলো ফুলে ফুলে উঠে থেমে গেল। নিজেকে ভরসা দিল, ও কিছু নয়, বোধহয় বাতাসে…। কিন্তু ও সতর্ক হয়ে শুনতেই লাগল।

ফ্ল্যাটটায় কোন আওয়াজ ঢোকে না এমনভাবেই তৈরী। এখন ঘড়ির আওয়াজ আর বুকের দ্রুততালে ধধ ছাড়া আর কোন শব্দই নেই।

অধীর হয়ে ও আলো নেভাল। ঘর অন্ধকার হয়ে যেতেই ও ভাবতে লাগল, ফ্ল্যাটে কি কেউ ঢুকেছে? পর্দা সত্যিই কি বাতাস লেগেই ফুলে উঠছিল?

নাঃ…এ একেবারেই যাচ্ছেতাই! আমি যদি ভয় না পাই, তবে এ ফ্ল্যাটে এমন কিছুই নেই আমায় ভয় দেখাতে পারে। জুলি ভাবল।

ঠিক তখন ও স্পষ্ট শুনতে পেল, একটা নরম, মৃদু মৃদু পা ফেলার আওয়াজ ওর ঘরের দিকে আসছে। ওর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এ তো ভুল হবার কিছু নেই।

বিছানার পাশের বাতিটা জ্বালতে গিয়ে বাতিটা মেঝেয় উটে পড়ে গেল। কার্পেটের ওপর আলোটা পড়ে যেতেই ও বিছানা থেকে ঝুলে, হন্তদন্ত হয়ে ওটা খুঁজতে লাগল। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা উঠছে আর নামছে। তারপর ও টের পেল অন্ধকারে দরজার হাতলটা ঘুরে যাচ্ছে, তখনি ওর খেয়াল পড়ল দরজায় তালা বন্ধ করা হয়নি।

দরজা খুলে যেতেই প্যাসেজের আলোর রেখা ঘরে এসে ঢুকল। জুলি বিছানার ওপর গুঁড়ি মেরে পিছিয়ে গিয়ে, ঘাড় গুঁজে ভয়ে কাঁটা হয়ে বসে রইল। মেঝের ওপরে সরু আলোতে ভয় দেখানো ছায়া। দরজাটা খুলছে না আর। প্যাসেজে কার নিঃশ্বাসের নরম আওয়াজ।

এত ভয় পেয়ে গেল জুলি যে ওর মুখ থেকে একটা আওয়াজ বেরোল না। ভয়ে থ মেরে গেল।

সাদা অস্পষ্ট কি যেন একটা দরজার ওপারে এগিয়ে এলো। জুলির ভেতরে একটা আর্তনাদ ফেটে পড়বে বলে ডেলা পাকিয়ে উঠল। গলা দিয়ে একটা ভাঙা, বিকৃত আওয়াজ বেরোল শুধু।

আলো জ্বলে উঠল। দরজায় দাঁড়িয়ে ওয়েসলি। আলোছায়ায় ওকে একটা উল্লসিত প্রেতের মত দেখাচ্ছে।

জুলি আবার চেঁচাল।

ব্লানশ নিষ্পাপ গলায় বলল, আমি কি তোমায় বিরক্ত করলাম? ভেবেছিলাম চুপিচুপি এসে দেখে যাবো তুমি ঠিকমত শুয়েছে কিনা।

নীল ফুলের মত নীল চোখদুটো জুলির আতঙ্কিত মুখে স্থির হয়ে এঁটে রইল। ব্লানশ আবার বলে উঠল, শেষ অবধি মত পালটালাম। শেষ ট্রেনে বাড়ি ফিরলাম। তোমায় অজানতে ভয় পাইয়ে দিয়েছি বলে দুঃখিত।

হঠাৎ ব্লানশের মুখে উল্লসিত হাসি ছড়িয়ে পড়ল, তুমি বলেছিলে না তুমি ভিতু নও, বলেছিলে কিনা? না কি তুমি শুধুই বড়াই করেছিলে?

আলো নিভিয়ে অন্ধকারের মধ্যে ব্লানশ বলল, গুড নাইট জুলি।

 দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

.

অদ্ভুত, বিকৃত মানসিক অবস্থা ব্লানশের। ওর মাথায় হয়তো কোন গোলমাল আছে, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলে জুলি। যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে জুলি বুঝল ও যতই হুঁশিয়ার হয়ে চলুক, ব্লানশের সঙ্গে ও এঁটে উঠতে পারবে না। এবং তাই চট করে ও ফাঁদেও পড়ল।

প্রাতঃরাশ তৈরী করতে করতে জুলি ভাড়ার রাখার কাবার্ড থেকে চা নিয়ে আসছে, হঠাৎ দেখল আলো আঁধারে মেঝের ওপর উপুড় হয়ে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে।

মুহূর্তের মধ্যে ওর শরীর ছেড়ে যেন প্রাণটা বেরিয়ে গিয়ে ঘুরপাক খেয়ে আবার শরীরে এসে ঢুকল। এই অতর্কিত আঘাতে রান্নাঘরটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এল, খানিক বাদে জুলির মাথা ঘুরতে লাগল, খানিক বাদে স্নায়ু বিপর্যয়ে জুলির পেশী ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল, ও মেঝেতে এলিয়ে পড়ল। বেশ কয়েক মিনিট কাটলে জুলি সাহস সঞ্চয় করে দেহটার দিকে তাকাতে বুঝল ওটা ভয় পাবার মত কিছু নয়, কয়েকটা জামাকাপড়ে কুশন ভরে ওটা বানানো হয়েছে। জুলি বুঝল ব্লানশ আবার টেক্কা দিয়েছে।

রান্নাঘরে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে ও এক কাপ চা তৈরী করে বসল। ভাবল, এরকম যদি চলতেই থাকে তবে ওকে কাজটা ছাড়তেই হবে। অতটা ভয় পাওয়া আমার বোকামি হয়েছে, কিন্তু কে বুঝবে অত মন দিয়ে মেয়েছেলেটা মরাটা বানাবে?

পরে ও দেরাজে পদাটর্দা তুলছে হঠাৎ গুটোনো চামড়ার কি যেন একটা হাতে ঠেকল। তাকিয়ে দেখল দেরাজের নিচে একটা কুণ্ডলী পাকানো ভয়ানক সাপ। দেখে ও পাথর হয়ে গেল। সাপে ওর ভীষণ ভয়, কান ফাটানো চীৎকার করে ও দরজার দিকে ছুটল।

ভয়ের চমকটা কাটতে ও এটাও ব্লানশের চমক ভেবে ফিরে গিয়ে ভয়ে ভয়ে দেরাজটা দেখল। কাঁচের চোখ, ভেতরে অন্য জিনিষ ঠাসা, তবু ওটা সাপই বটে। শিউরে উঠে ওটা কাপড় চোপড় চাপা দিয়ে দেরাজটা বন্ধ করল। ভয়ে হাত-পা খুলে যাবার যোগাড়, ঠিক তখনই বেল বেজে উঠতে ও চমকিয়ে লাফিয়ে উঠল।

দরজা খোলার কথা খেয়ালই নেই ওর। সম্বিত ফিরে আসতে দেখল একটি লম্বা, সুসজ্জিত চেহারার লোক ওকে শীতল উৎসুক চোখে দেখছে।

–মিসেস ওয়েসলি ওঠেনি বোধহয়? লোকটা ওকে নালিশের ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করল। তারপর সটান ভেতরে ঢুকে জুলির হাতে কোট আর টুপিটা দিল। জুলি টুপিটা নিয়ে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল। লোকটা হাতের দস্তানা খুলে টুপিতে ফেলল।

জুলি বলল, না, মিসেস ওয়েসলি ওঠেননি। ভাবল, লোকটা কে? কি চায়?

–আমি মিঃ হিউ বেনটন, মিঃ ওয়েসলির পার্টনার, লোকটা বলল। ওর মুখটা পাতলা, নিখুঁত করে দাড়ি কামানো, রং ফ্যাকাশে, চুল সাদাটে, ঠোঁট রক্তশূন্য, চোখ হলদেটে। গলার স্বর যেন, ও গির্জার ভেতর কথা বলছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল ও জুলিকে, যেন অশ্ববিক্রেতা সদ্য খরিদ করা ঘোড়া দেখছে। বলল, তুমি বোধহয় নতুন চাকরানী? মিসেস ওয়েসলিকে বলবে আমি এসেছি।

–এত তাড়াতাড়ি ডাকা উনি পছন্দ করেন না।

–বাঃ, বেশ! লোকটি হাসল। ছোট ছোট দাঁতগুলো এমন যান্ত্রিক ভাবে দেখাল যে ওটাকে হাসি বলা যায় না। বলল, তোমার চেয়ে আমি মিসেস ওয়েসলিকে অনেক বেশীদিন ধরে চিনি। ওঁর অভ্যেস আমার জানা আছে। বল, আমি এসেছি।

–কিন্তু আমার মনে হয়না…। জুলি বলতে গেল। ও তো জানে সকাল সাড়ে এগারোটায় ডাকলে ব্লানশ কি রকম খেপে যেতে পারে!

বেনটন মুখ বিকৃত করে বলল, তুমি কি মনে করবে সে জন্যে তোমায় মাইনে দেওয়া হয় না। যা বলা হবে তা মেনে চলার জন্যে মাইনে দেওয়া হয়।

জুলি পেছন ঘুরে ব্লানশের ঘরের দিকে গেল। ঐ লোকটাকে এত কথা বলতে সুযোগ দিয়েছে। বলে ওর নিজের ওপরে রাগ হতে লাগল। দরজায় টোকা দিয়ে ও ঘরে ঢুকল।

ব্লানশ ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে শুয়ে আছে। হাতের কাছে টেবিলে ব্রান্ডির পাত্র।

 মুখ তুলল ও। ফ্যাকাশে, ফোলা ছোট্ট মুখটা কঠিন হয়ে উঠল।

–আমি নিশ্চয়ই তোমাকে সব সময় ঘরে ঢুকতে পার বলিনি, বলেছি কি? ওর চোখ রাগে ঝক্ঝক্ করে উঠল। বলল, দরকার হলে ঘন্টা বাজিয়ে তোমাকে ডাকব। বেরিয়ে যাও।

জুলি আস্তে আস্তে বলল, আপনাকে বিরক্ত করায় দুঃখিত। কিন্তু মিঃ বেনটন এসেছেন, আপনাকে ডাকতে বলছেন বারবার। আমি বলেছি আপনি বিশ্রাম নিচ্ছেন।

সমস্ত রাগ মিলিয়ে গিয়ে ব্লানশ ধড়ফড় করে উঠে বসল।

–হিউ? এই অসময়ে? ওকে দাঁড় করিয়ে রাখা চলবে না। জুলি ঘরটা তাড়াতাড়ি সাফ কর। আমার মেকআপের বাক্সটা দাও। তাড়াতাড়ি। মরা মাছের মতো দাঁড়িয়ে থেকো না।

এ যে অন্য এক ব্লানশ। সেই নিষ্ঠুর, পিশাচী, অধীর, বিকারগ্রস্ত ব্লানশের চেয়ে এই ছটফটে, ছোট মেয়ের মত উত্তেজনায় অধীর ব্লানশ যেন আরো ঘৃণ্য।

ব্লানশ দ্রুততার সঙ্গে মুখে রং মাখতে লাগল। জুলি ছুটোছুটি করে ঘরের বিশৃঙ্খল অবস্থাকে। বাগে আনতে লাগল।

ফ্যাকাশে গালে রং লাগাতে লাগাতে ব্লানশ হুকুম দিল, চারিদিকে সুগন্ধী ছড়াও। ঘরে কি দুর্গন্ধ। রুজের তুলি রেখে এক চুমুকে ব্রান্ডি খেয়ে গ্লাসটা রেখে বলল, তাড়াতাড়ি একটা জানলা খোল। এমন টেনে টেনে ছুটছো যেন তোমার পিঠ ভেঙে গেছে।

রুদ্ধশ্বাসে জুলিকে যা যা ছড়ান, ছেটানো, গোছান করতে বলা হলো ও সব করল। নোংরা। তোয়ালেগুলো বান্ডিল করে বাথরুমে রাখল।

যখন ও বাথরুম থেকে ঘরে এল, তখন দেখল ব্লানশ বালিশে মাথা রেখে শুয়ে, সুডৌল হাত দুটো মাথার ওপর ভাজ করা, দেখে মনে হয় এক মোহময় আকর্ষণের মূর্তি।

সেই ফ্যাকাশে, সাদাটে মেয়েছেলেটার এমন স্বপ্নের আশ্চর্য রূপান্তর দেখে জুলি ঈর্ষায় জ্বলে উঠল, ভাবল, ওঃ, খুকি পুতুলটি সাজগোজের জানেটা কি?

ব্লানশ খ্যাচ করে উঠল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমায় গিলছো কি? ওকে ডাক।

বেনটন লাউঞ্জে মুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বিরক্ত, বিরস মুখে পায়চারি করছিল। জুলি ঢুকতেই বলল, তৈরী হয়েছেন উনি? তুমি তো অনেকক্ষণ গেছে।

দয়া করে এদিকটায় চলুন। ওর সামনে হাঁটতে হাঁটতে জুলির অস্বস্তি হচ্ছিল। ও যখন ব্লানশের দরজার কাছে পৌঁছল বেনটনের একটা হাত ওর উরু স্পর্শ করল। ঠিক যেন একটা মাকড়সা হেঁটে গেল, জুলি শিউরে উঠল।

ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে জুলির দিকে চেয়ে থেকে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতটা সরিয়ে নিল। তারপর ব্লানশের ঘরে ঢুকে সরু গলায় বলল,

–ও ব্লানশ! কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়, কি তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে। দরজাটা ঠেলে দিল। পুরো বন্ধ করল না। জুলির সারা শরীর জুড়ে তখন শিহরণ। ও শুনল বেনটন বলছে, খবর আছে, হাওয়ার্ড তার করেছে, সোমবারের আগে ফিরছে না।

সুবিধেবাদী, সুযোগসন্ধানী কোথাকার! ব্লানশ হেসে বলল।

বেনটন ধীরে ধীরে বলল, নয়ই বা কেন? আজ বিকেলেই আমি আবার আসতে পারি। আমরা পুরো শনিবারটা একসঙ্গে কাটাতে পারবো।

ব্লানশ বলল, ডার্লিং দরজাটা বন্ধ করে দিলে হয়না? ফ্ল্যাটের চতুর্দিকে কুকীর্তির কথা রটিয়ে দিতে চাওনা নিশ্চয়ই।

জুলি তাড়াতাড়ি সরে এলো। ভাবল, ওঃ জুটি বটে একখানা। মরুকগে ওরা। তবে কি ব্লানশ সত্যিই পুরো শনিবারটা বাইরে থাকছে?

তখনি ওর হ্যারির কথা মনে পড়ল। কাল হ্যারি ম্যানচেস্টার থেকে ফিরছে। নানারকম প্ল্যান করে কাজ নেই। ওই ব্লানশ নাও যেতে পারে আর হ্যারিও নাও ফিরতে পারে। হয়তো জুলিকে এই লম্বা দুটো দিন একলা এই নির্জন ফ্ল্যাটে কাটাতে হবে।

অনেক পরে বেনটন ব্লশের ঘর থেকে বেরোল। জুলি রান্নাঘর থেকে শুনল ও প্যাসেজ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রান্নাঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

জুলি টেবিলে পিঠ রেখে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল।

–আপনি কি কিছু চান? জুলির ঠাণ্ডা গলা।

 –চাই। হা…আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

জুলি তখন মনে মনে রুখে উঠছে আর ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ওকে দেখতে দেখতে বেনটন ব্যাগ থেকে পাঁচ পাউন্ডের একটা নোট বার করল।

–হ্যাঁ। নোটটা ছোট্ট, নিখুঁত ভাজ করল বেনটন, কি যেন বলছিলাম। ভাজকরা নোর্টটা আঙুলের গাঁটে ঠুকতে ঠুকতে বলল, তুমি মিসেস ওয়েসলির খাস চাকরানী। হয়তো অনেক কিছু দেখবে বা শুনবে, যা তোমার আওতার মধ্যে নয়। একজন খাস চাকরানী গাবিয়ে বেড়ায়না। বুঝলে?

জুলি রেগে লাল হয়ে বলল, সে কথা আপনাকে বলে দিতে হবে না।

বেনটনের ভুরু দুটো কপালে উঠে গেল।

–দোহাই তোমার। রেগে যেওনা। মিসেস ওয়েসলি অসম্ভব ঝামেলা পাকাতে পারেন। বেশীর ভাগ সময়ই উনি চাকরানীদের এক সপ্তাহের বেশী রাখতে পারেন নি। আমার মনে হয় ওর চাকরানী অর্থাৎ তুমি, তোমার সঙ্গে আমার একটু কাজের কথা আছে।

এক মুহূর্ত মাত্র জুলি ইতঃ করল। সে তো এই কাজের ফাঁদে পা দিয়েছে লুটে নেবার জন্যে? তাহলে ঐ ফ্যাকাশে লোকটা ওকে ঘুষ দিলে নিতে বাধা কোথায়? পাঁচ পাউন্ড! পরে হয়তো আরো দেবে। বেনটনের চোখজোড়ায়, চোখ রেখে, হয়তো হয়েছেবলতে জুলির সাহস দরকার হল।

–আমি জানি আমি ভুল বুঝিনি তোমায়। দেখ আমি চাই না মিঃ ওয়েসলি কিছু কথা জানুন। বেনটন মুখে বিকৃতি নিয়ে বলল, উনি অন্ধ। আর জানবে অন্ধরা ভয়ানক খুতখুতে, সন্দেহবাতিক হয়। আমি ওকে আঘাত দিতে চাই না।

বুঝেছি।

বেনটন বলে চলল, এ ফ্ল্যাটে কি হচ্ছে না হচ্ছে, যতক্ষণ তুমি দেখতে যাচ্ছে না, শুনতে যাচ্ছে না, ততক্ষণ তুমি আমি বেশ মানিয়ে চলতে পারব। এই ধর, আজ সকালে আমি এখানে

আসিনি। বুঝলে?

জুলি মাথা নেড়ে বোঝাল সে সবকিছু বুঝেছে।

এই বন্দোবস্তটা তোমার–আমার মধ্যেই থাকুক। মিসেস ওয়েসলি এটা পছন্দ নাও করতে পারেন।

আবারও জুলি মাথা নাড়াল।

চমৎকার।

 বেনটন সোজা হয়ে দাঁড়াল। লম্বা লোকটার গায়ে ল্যাভেন্ডার আর চুরুটের গন্ধ। নোটটা জুলির হাতে দিয়ে আদরের ভঙ্গিতে বাহুতে চাপড় মারল। ওর স্পর্শে শিউরে উঠে জুলি পিছু হাঁটল। কিন্তু পিছনে টেবিল। বেনটন ওকে টেবিলে ঠেসে ধরল। এই ভয়াবহ মুহূর্তে জুলি ভাবল ও বুঝি ওকে চুমো খাবে। কিন্তু বেনটন তা না করে সরে গেল। দরজা খুলতে খুলতে বলল, যেখান থেকে এটা এলো, সেখানে আরো নোট আছেজুলি। সুতরাং সহজ কথাটা বুঝেছো নিশ্চয়। কিছু দেখ না, কিছু শুনো না। বেনটন বেরিয়ে যেতেই ব্লানশ ঘণ্টা বাজাল।

ব্লানশের ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে জুলি দেখল ওর দেওয়ালের আড়ালের আলমারিটা খোলা। ভেতরে ইস্পাতের খুপরিতে দুটো শক্তিশালী বাল্ব জ্বলছে। জুলি দেখল ভেতরে সারি সারি ফারকোট ঝুলছে। ও একটা কার কতদিন মনে মনে চেয়েছে। কতদিন লোভার্ত চোখে ঘণ্টার পর ঘন্টা ওয়েস্ট এভের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ও ফার দেখেছে। এখানে চিঞ্চিলা, সিল্ক, বীভার, সেবল, সাদা শেয়ালের চামড়ার জামা আর আর্মাইন ঝুলছে। আলমারীর অন্য দিকে ইস্পাতের দেওয়াল আলমারী দেখে জুলি বুঝল ওটা নিশ্চয় গয়নার আলমারী।

ব্লানশ ড্রেসিং টেবিলে বসে ফিনফিনে মোজা পরছিল। মুখ তুলে ও জুলির দিকে তাকিয়ে হাসছিল।

গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, লন্ডনের প্রত্যেকটা চোর আমার ফার চুরি করা নিয়ে কথা বলে। কিন্তু ওরা তা পারবেনা, কারণ যত আলমারী এ পর্যন্ত তৈরী হয়েছে, তার মধ্যে ওটা সবচেয়ে নিখুঁত, ওটা খোলা সকলের অসাধ্য। আমার স্বামী ওটা তৈরী করেছেন। ঠিক মনে নেই এ পর্যন্ত ছ জন বা আটজন চোর ওটা ভাঙতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ওরা আর চেষ্টা করবে না। যে ওই আলমারীতে হাত দেবে, তখনি কেনসিংটন পুলিশ স্টেশনে ঘণ্টা বেজে উঠবে, দু মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে পড়বে।

জুলি মনে মনে ভাবল, এটার জন্যই তাহলে হ্যারির আগ্রহ। ওই জন্তুটার কি শিক্ষাই না হবে, ফারগুলো চুরি করতে এলে।

ব্লানশ বলল, শুধু আমি আর মিঃ ওয়েসলি জানি কেমন করে ওটা খুলতে হয়, কোথায় ওর চাবি।

জুলি ইচ্ছে করে কথার প্রসঙ্গ পাল্টালো যেন আলমারীটার ব্যাপারে ওর কোন আগ্রহই নেই। বলল, আমি কি কিছু করতে পারি ম্যাডাম?

–আমি এই সপ্তার শেষটা বাইরে থাকছি। মিঃ ওয়েসলি সোমবারের আগে ফিরছেন না। আমি জিনিষের ফর্দ করে লিখে রেখেছি। তুমি জিনিষগুলো গুছিয়ে দাও।

গতবার বাক্স গোছানোর কথা জুলির মনে আছে। হয়ত এবারও ঐরকম করবে। জুলি ফর্দ অনুযায়ী জিনিষপত্র গোছাল, কিন্তু ব্লানশ কিছু বলল না। তবু জুলি ওর অন্য বদমাইশির আশায় অপেক্ষা করতে লাগল।

হঠাৎ ও বলে উঠল, জুলি এ ছুটিটা কি করবে?

 জুলি হঠাৎ এই প্রশ্নে আমতা আমতা করে বলল, জানি না ম্যাডাম।

কুঁড়েমি কোরনা। দেখবে অনেক সেলাই করার আছে, রুপোর জিনিষগুলো সাফ করবে। কাজ নিয়ে থেকো। আমায় যেন বলে দিতে হয়না, কি করবে। ফুল সাজিও, আমার জুতোগুলো পরিষ্কার কোর। চারদিকে তাকালেই দেখবে অনেক কাজ আছে।

–হ্যাঁ, ম্যাডাম।

রবিবার তুমি বেরোতে পার, কিন্তু বাড়িটা ফাঁকা থাক এটা আমার পছন্দ নয়। বুঝেছো? দোহাই তোমার কোন উটকো পুরুষ মানুষকে বাড়িতে ঢুকিও না। তোমাদের মত মেয়েদের আমি চিনি। বাড়ির দারোয়ান জানে তুমি একা থাকবে।

জুলির মুখ-চোখ গরম হয়ে গেল।

ব্লানশ ভুরু কুঁচকে বলল, মেজাজ খারাপ কোরনা। আমি বলছি না তুমি বাড়িতে পুরুষ ঢোকাবে, যদি ঢোকাও তো আমি সহ্য করব না। এদিকে এস।

জুলি এগিয়ে গেল। ওর মুখে ক্ষোভ, বিদ্রোহ।

ব্লানশ ওর শুকনো কাঠির মত আঙুলগুলো দিয়ে জুলির গাল ছুঁলো, জুলি শিউরে পিছিয়ে গেল। ব্লানশ বলল, কি ভালো ফিগার তোমার, কি সুন্দর চামড়া। আমায় ভয় পেও না। ব্লানশের চোখ ঝকঝক করে উঠলো, ভয় পাও না তো আমাকে?

না, ম্যাডাম। জুলির গলায় অস্বস্তি।

 ব্লানশ হেসে বলল, ঠিক আছে। কেউ কেউ আমায় ভয় পায়, কিন্তু কোন মানে হয়? আমি প্রত্যেকের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করি। মাঝে মাঝে একটু তামাসা করি, সে শুধু মজা করে। তারপর জুলিকে খুব তীক্ষ্ণ নজরে দেখে বলল, কাবার্ডের সামনের সেই মানুষটা দেখে ভয় পেয়েছিলে?

–বেশী না। জুলির গলায় আগ্রহ নেই।

–পাওনি? নীল ফুলের মতো চোখদুটো কঠিন হয়ে উঠল।

অন্য একটা চাকরানীর হিস্টিরিয়া হয়েছিল। সে যা মজা! আর সাপটা? দেখে চমকাওনি? হেসে উঠে বলল, সাপটা নিয়ে রগড় করতে আমি ভালবাসি। আমার স্বামী ওটাকে ঘেন্না করে। ওর বিছানায় মাঝে মাঝে ওটাকে ফেলে রাখি।

জুলি মুখটা ঘুরিয়ে নিল। ওর মুখের ঘৃণা ব্লানশকে দেখাতে চাইল না। ওর ইচ্ছে করল, ব্লানশকে ধরে ঝাঁকি মারতে।

জুলি তুমি কি ফার ভালবাস? ব্লানশ মেকাপ শেষ করতে করতে অতর্কিতে জিজ্ঞেস করল।

জুলি মনে মনে ঠিক করল, তুমি আর আমায় ফাঁদে ফেলতে পারছনা। মুখে বলল, হ্যাঁ ম্যাডাম, হয়ত ভালবাসি।

–আমার ফারগুলো দেখা ছোঁও ওগুলো জুলি। আমি চাই তুমি ওগুলো ছুঁয়ে দেখ, ভালবাস। জুলি নড়ল না।

ধন্যবাদ ম্যাডাম। অন্যের ফারে আমার কোন আগ্রহ নেই।

 ব্লানশ কৌতুকে হেসে উঠল, বাজে কথা। দেখ ওগুলো। একটি মেয়েও নেই যে ওগুলো পাবার জন্যে চোখ অবধি উপড়ে দিতে চাইবেনা। এই সিল্কের কোটটার দাম পাঁচ হাজার পাউন্ড, সাদা শেয়ালের গায়ের ফারটা…আমি দাম বলতে চাই না। যাও না ভেতরে। দেখ ওগুলো।

জুলি আলমারীর কাছে গেল। ফারগুলো খুব সুন্দর। কিন্তু ও কোন আগ্রহ দেখাল না।

 ব্লানশ বলল, সিল্ক কোটটা হ্যাঁঙার থেকে নামাও। গায়ে দিয়ে দেখতে পারো ইচ্ছে হলে।

জুলি আলমারিতে ঢুকে সিল্ক কোটটার গায়ে হাত দিতে গেল। হঠাৎ সুইল করে শব্দ করে, ইস্পাতের দেওয়ালগুলো বাতাসের ঝাপটা মেরে জুলিকে বন্ধ করে ফেলল।

এক মুহূর্ত জুলি এমনই হতভম্ব হয়ে গেল যে একটুও নড়তে বা কোন কিছু ভাবতে পারলো না। জুলি নিজেকে সামলালো।

ভাবল, এত সেধে ডেকে আনল। বোঝা উচিত ছিল ও কোন মতলব ভাজছে। ওকে ট্রেন ধরতে হবে, আমাকে বেশীক্ষণ পুরে রাখতে পারবেনা। কিন্তু আর একটু নড়াচড়ার জায়গা থাকলে ভাল হতো। এখানে বাতাসও বেশী নেই, আর এই জঘন্য ফারগুলোর গরমে কষ্ট হতে লাগল। ও যদি আমার প্রাণটাকে খাঁচা ছাড়া করতে চায় আমি তা হতে দেব না। আমি মাথা ঠাণ্ডা করে বসে থাকবো যতক্ষণ না আমাকে বের করে দেয়।

ভয়টা শাসনে রেখে জুলি আলমারীটার মেঝেতে বসে পড়ল। ফার কোটগুলো ওর মাথা ছুঁয়ে যাচ্ছে।

তারপর ওর ভাবনা এলো, যদি ঐ মাথা খারাপ মহিলাটা আমাকে এখানে রেখে সত্যিই চলে যায়, আমি তো এই কম বাতাসে বেশীক্ষণ টিকে থাকতে পারবো না। এখনই নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে।

হঠাৎ আলো দুটো নিভে গেল। তপ্ত, শাসরোধকারী অন্ধকার ওকে ঘিরে ধরল।

জুলি উঠে দাঁড়াল। ও বুঝতে পারল ও কাঁপছে। বন্ধ জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ওর মনে হল এই শ্বাসরোধী ভয়ঙ্কর অন্ধকারে যেন ওকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে।

মাথা গোলমাল হয়ে গেল ওর। বন্য চীকারে ফেটে পড়ে ও ইস্পাতের দেওয়ালে ঘুষি, লাথি মারতে লাগল, আঁচড়াতে লাগলো। চারদিকের ফারগুলো যেন চেপে জড়িয়ে ধরতে চাইছে ওকে। ঘুষি মারতে মারতে হাতগুলো যেন অকেজো রবারের হাতুড়ির মত হয়ে গেছে। ক্রমশঃ শ্বাসরোধী অন্ধকারে ডুবে যেতে লাগল ও। আর্তনাদ করতে লাগল। ওর অস্থির ছটফটানিতে একটা ফারকোট হ্যাঁঙার থেকে খুলে পড়ে ওকে চাপা দিল।

.

গাঢ় অথচ অস্বক্তিভরা ঘুম থেকে ধীরে জেগে ওঠার মতো করে জুলির চেতনা ফিরে এল। ওপর দিকে চেয়ে ও অনেকক্ষণ কাঁদল। কেন যে কাদল ও নিজেও জানেনা। বোধহয় ভীষণ ভয় পেয়েছিল, এখনও ওর স্নায়ুগুলোকে শাসনে আনতে পারেনি বলে এই কান্না।

তারপর আর কাঁদতে পারল না। তখন ওর মনে হল কে ওকে বিছানায় নিয়ে এলো! হিউ বেনটনের স্পর্শের কথা মনে হতেই ওর গা শিউরে উঠল বিতৃষ্ণায়।

ও ভাবল, আর নয়, আমি আর থাকবনা। ব্লানশ পাগল, বিপজ্জনকও বটে, আমি মরে যেতেও পারতাম।

বিছানা ছেড়ে উঠে ও ব্লানশের ঘরে গেল। মনে হল, ব্লানশ যেন ঘরেই আছে। কিন্তু না, ব্লানশ চলে গেছে। বিরাট, বিলাসবহুল কামরাটা অস্বাভাবিক ফাঁকা লাগছে ব্লানশ নেই বলে। বাতাসে ল্যাভেন্ডার আর চুরুটের ক্ষীণ গন্ধে জুলি শিউরে উঠে বুঝল তাহলে বেনটন এসেছিল।

বিছানার পাশের কাবার্ড থেকে এক বোতল ব্রান্ডি আর একটা গ্লাস বের করল। বিছানায় আরাম করে বসে খানিকটা ব্রান্ডি খেয়ে অচৈতন্য ভাবটা কেটে গেল।

 জুলি ভাবল, আর থাকছি না। আজই জিনিষপত্র গোছগাছ করে রাতে চলে যাবো। আমি যতই সমঝে চলি না কেন ও আমায় ফাঁদে ফেলবেই। হ্যারি যাই বলুক, যথেষ্ট ভোগান্তি হয়েছে।

জুলির চলে যাবার মুখ্য কারণ যতই ব্লানশ হোক, তবু ঐ দামী ফারকোটগুলোই ওকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। এখানে থাকা মানেই বিপদের ঝুঁকি নেওয়া। পুলিশ খোঁজ পাবে ও হিউয়ার্টের ওখানে কাজ করত, ওরা বুঝবে জুলি ছিল চোরদের সঙ্গী। সন্দেহ হবে চুরির সঙ্গে ওর যোগ আছে। না। ব্লানশ, ফারকোট কোন কিছুর সংস্পর্শেই ও থাকবে না।

হঠাৎ ফ্ল্যাটের কোথায় যেন একটা টেলিফোন বাজল। হাত বাড়িয়ে ও রিসিভার তুলল।

জুলি?

–হ্যাঁ। তুমি কোথায় হ্যারি? আমি তোমার কথা ভাবছিলাম। তোমার সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে। তুমি ফোন করেছ বলে আমি খুব খুশী। আশ্চর্য! ঠিক যখন তোমার কথা ভাবছিলাম!

কি হয়েছে? হ্যারি তীক্ষ্ণ গলায় জানতে চাইল।

–তোমার সঙ্গে দেখা করব হ্যারি। জুলি একেবারে ভেঙে পড়ল, তুমি যতই ব্যস্ত থাক, আমার তোমার সঙ্গে দেখা করা ভীষণ জরুরী। আমি তোমায় দেখতে চাই হ্যারি।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে, উত্তেজিত হয়ো না। একঘণ্টার মধ্যে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি। তুমি বেরোতে পারবে?

–মেয়েছেলেটা দুদিনের জন্যে বাইরে গেছে। ওঃ হ্যারি! তোমার গলা শুনেও ভালো লাগছে। ওর একটা কথা মনে হলো, হ্যারি তুমি এখানে চলে এসো। এখানে আমি ছাড়া কেউ নেই। বাড়িটাও দেখতে পারবে। তাও তত চাও তুমি, তাই না?

–টেলিফোনে এসব কথা থাক। কেউ আসবে না তো? হ্যারি প্রশ্ন করল।

না কেউ আসবে না। মিঃ, ওয়েসলি সোমবার রাতের আগে আসবে না। বিছানার পাশের ঘড়িটা দেখে জুলি বলল, সাড়ে চারটে বাজে। তুমি কখন আসবে?

ছটা। হয়ত সওয়া ছটা।

–হ্যারি, সাবধানে ঢুকো। দারোয়ান বাড়ির ওপর নজর রেখেছে।

লাইনের অপরপ্রান্তে খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপর হ্যারি বলল, হয়তো আমি না এলেই ভালো। এত ঝামেলা করার পর জিনিষটা কেঁচিয়ে দিতে চাই না।

–তোমায় আসতেই হবে। ওপর তলায় চলে যাবে লিফট নিয়ে, হেঁটে নামবে। ওপর তলায় মিসেস গ্রেগরী থাকেন, তুমি ভান কর ওর কাছে যাচ্ছে।

চালাক হয়ে গেছ তুমি। হ্যারি হাসতে হাসতে বলল, ঠিক আছে যাবো।

–তোমায় আবার দেখব ভেবে ভাল লাগছে।

কিন্তু হ্যারি ফোন ছেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে, জুলি যে এখানে থাকবে না শুনে হ্যারি কি বলবে ভেবে জুলি চিন্তিত হলো। হঠাৎ ওর মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। ব্লানশের পোশাকের আলমারীর দিকে ছুটে গেল ও।

মনে মনে খুশী হয়ে ভাবল, আমি ওকে খুব চমকে দেব। আমাকে এত সুন্দর দেখাবে যে, ও আমার কথা ঠেলতে পারবে না।

ব্লানশের অজস্র পোষাক থেকে ইভনিং গাউনটা বেছে নিল। যে গাউনটা ও বাছল সেটা পপি ফুলের মতো রং, গলাটা নিচু কাটা, চওড়া ঘের দেওয়া স্কার্ট। জুলি ওর ঘন, গাঢ়, বাদামী চুল কাঁধ অব্দি আঁচড়ে ছটার মধ্যেই তৈরী হয়ে গেল।

 আয়নায় নিজেকে দেখে ভাবল, ওকে এত সুন্দরী দেখাচ্ছে যে ডানা ওর পায়ের কাছেও দাঁড়াতে পারবে না। জুলি বয়সে অনেক তরুণ, মুখে সারল্য, অনেক বেশী চিত্তহারিণী। আর পোষাকটা পরে ও এখন অনেক বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। যা অন্য পোশাকে কখনও হয়নি। জুলির নিজেকে চিনতেও ভুল হচ্ছে।

ছটার একটু পরে দরজায় ঘণ্টা বাজল। দরজা খুলে দেখল টুপিটা বাঁকা কায়দায় নামিয়ে ওভারকোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হ্যারি দাঁড়িয়ে ওর সামনে। এক লহমায় ও জুলিকে চিনতেই পারল না। তারপর তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলো, বিহ্বল হাসিতে ভরে গেল ওর মুখ।

জুলি! এই ধারকরা পোষাকে তোমায় দারুণ দেখাচ্ছে। আমি তো একেবারে ভিরমি খেয়ে গেছি। সেকথা সত্যি। হ্যারি জুলিকে চিনতে পারছিল না। হ্যারি ভাবল, ওঃ। অপূর্ব দেখতে ওকে! একেবারে কোহিনুর? আর আমি সে কথা জানতামই না।

জুলিকে জড়িয়ে ধরল ও, জুলি হাত ছাড়িয়ে বলল, আমাকে ছুঁয়োনা। আমার পোষাক লাট খেয়ে যাবে।

জুলির চোখের কঠিন দৃষ্টি দেখে হ্যারি চমকে গেল। থতমত খেয়ে গেল। জুলির দিকে হাঁ করে চেয়ে বলল, জুলি তুমি অসাধারণ! সিন্ডারেলা তোমার কাছে কিছুই নয়। তোমায় দেখে তো আমার মাথা ঘুরছে। এটা সেই মেয়েছেলেটার পোশাক?

নিশ্চয়ই। তুমি নিশ্চয় ভাবতে পারো না যে এ পোষাকটা আমি কিনতে পারি। নাকি তাই ভাবো? কিন্তু তুমি ভেতরে এসো। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। এসো।

হ্যারি ওর পেছনে লাউঞ্জে ঢুকল। জীবনে এই প্রথম ও একটা কেমন অসুবিধে বোধ করছে। জুলির সৌন্দর্য আর বাড়ির পরিবেশ ওর আত্মবিশ্বাস টলিয়ে দিয়েছে। জুলির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হ্যারি বুঝল ও জুলির প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে ও কিভাবে খাপ খাওয়াবে ভেবে পেল না।

জুলিও বুঝল ওর সৌন্দর্য হ্যারির মনে কি রকম প্রভাব ফেলেছে। ফায়ার-প্লেসের সামনে স্থির, অবিচল দৃষ্টিতে হ্যারির দিকে চেয়ে থেকে ও হ্যারির এই অবস্থাটাকে নিজের কাজে লাগাতে চাইল।

–কি ব্যাপার জুলি! তুমি আমাকে একটা চুমোও দেবে না?

না। জুলি কাটা কাটা গলায় বলল, আমি এখানকার কাজ ছেড়ে দেব। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

–কেন, কি ব্যাপার জুলি? হয়েছেটা কি?

 জুলি ব্লানশের ভয় দেখানোর সমস্ত ঘটনা বলল।

জুলির দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাব দেখে হ্যারি হতাশ হলো। বলল, শোন জুলি, অত উত্তেজিত হয়ো

–ওকে ভয় করে আমার।

সোফায় গিয়ে বসল হ্যারি। হ্যারি ঠিক করলো জুলিকে একাজে বহাল রাখতে হলে ওকে কেন এখানে রাখা হয়েছে খুলে বলতে হবে।

অস্থিরভাবে সিগারেট ধরিয়ে বলল, জুলি আজ জানলেও জানবে, কাল জানলেও জানবে। আমি ঐ ফারগুলো চাই। তুমি তা বুঝেছ, বোঝনি?

–তুমি কি আমাকে হাঁদা ভেবেছো নাকি? নিশ্চয়ই বুঝেছি। আমার ভাল লাগছে না।

–তোমার কোন চিন্তা নেই, তুমি নিরাপদেই থাকবে। তোমার কাজ খালি আলমারীটা কি করে খোলে জেনে নাও। শহরে এটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি ঠিক করেছি আলমারিটা ভাঙব। তোমার সাহায্য চাই। তুমিই একমাত্র লোক যে আমাকে সাহায্য করতে পারবে।

জুলি সংক্ষেপে বলল, ওটা তুমি ভাঙতে পারবেনা। ব্লানশের থেকে জেনেছি আলমারীটার সঙ্গে কেনসিংটন পুলিস স্টেশনের যোগাযোগ আছে।

হ্যারি সামনে এগিয়ে বসল, এইতো। এ সব খবরের অপেক্ষাতেই তো ছিলাম। আমি জানতে চাই, ও আর কি বলেছে?

 বলেছে, আটজন চোর ওটা খুলতে গিয়ে ধরা পড়েছে। কেমন ব্যাপারটা?

–চারজন, আটজন নয়। আমি ভেবেছিলাম ওই জন্যেই ধরা পড়েছে সবাই, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। দেখছনা সোনা? তুমি যদি লেগে থাকতে পার, তাহলে আমায় সব দরকারী খোঁজ খবর দিতে পার। ফারগুলোর কথা বল।

–একটা সিল্ক কোট আছে। ও বলল, সেটার দাম পাঁচ হাজার পাউন্ড। জুলি চোখ কোঁচকাল। ফারগুলোর কথা ভুলতে পারছেনা ও। ওগুলো দেখার পর থেকেই ওর পেতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলল, একটা সাদা মেরু শেয়ালের ফার, অপূর্ব দেখতে। ওই পিশাচীটার পক্ষে খুব বেশী ভাল। তাছাড়া বীভার, চিঞ্চিলা, আর্মাইন, সেবল।

–কোনও গয়নাগাটি দেখলে?

না। তবে আমি জানি ওই আলমারীর ভেতর একটা ইস্পাতের সিন্দুকে গয়না আছে।

 ওকে প্রশ্ন করতে করতে হ্যারি ভাবছিল কেমন করে জুলিকে এখানে থাকতে রাজি করানো যায়। জুলির কোন দুর্বলতার কথা জানতে হবে, যাতে ঘা মেরে ওকে যেমন করেই হোক রাজি করাতেই হবে।

–তুমি বললে তুমি ভেতরে ঢুকতেই আলমারীটা বন্ধ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি বন্ধ হলো না আস্তে?

জুলি শিউরে উঠে বলল, ইঁদুর ধরার কলের মত দুম করে। দরজা একবার বন্ধ হলে, ভেতরে। কোন হাওয়া নেই তুমি দম বন্ধ হয়ে মরবে।

বন্ধ যাতে না থাকতে হয়, সেই চেষ্টাই করতে হবে। ব্লানশ কি দরজা বন্ধ করে দেয় না ওটা আপনা থেকেই বন্ধ হলো?

ব্লানশ তো ধারে কাছেই ছিল না। সত্যি বলছি আমি জানি না।

–বেশ দেখা যাক, আমাকে ওর শোবার ঘরে নিয়ে চলো।

–বেশ। দেখতে চাও তো দেখ, ভাল করে দেখ, তবে আমার সাহায্যে দেখা-টেখা হবে না। আমি এ সবের মধ্যে আর থাকছিনা।

আরো হতাশ, অসহায় হ্যারি ওর পেছন পেছন ব্লানশের ঘরে গেল। জুলির এই কাজ ছেড়ে দেবার দৃঢ় সিদ্ধান্ত হ্যারিকে যেন হারিয়ে দিচ্ছে।

জুলি ওকে লেপ ঢাকা দেওয়াল দেখাল।

–ওর পেছনে। ওটা ছুঁয়োনা। আমরা চাই না এখুনি পুলিশ এসে পড়ুক।

–ঠিক বলেছ। আমরা চাই না। হ্যারি একটু অস্বস্তির সঙ্গে দেওয়ালটা খুঁটিয়ে দেখার পর বলল, কোথাও কোন চিহ্নই নেই। নিখুঁত কাজ। দরজার পাল্লা কি বাইরের দিকে খুলে যায়, না পাশে সরে যায়?

পাশে সরে গিয়েছিল।

দেওয়ালের দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে কয়েক মিনিট চেয়ে মাথা নাড়ল হ্যারি, না, কোন লাভ নেই। আমি হাত দেবার আগে আমাদের ভাল করে জেনে নিতে হবে কি করে খোলে আলমারীটা। তোমাকেই জানতে হবে জুলি।

জুলি ওর অস্বস্তি টের পেয়ে বলল, আমি পারবো না, তোমাকে তো বলেইছি, আমি থাকতে পারবো না।

হ্যারি ওকে কাছে টেনে নিল।

–আরেকটু লেগে থাক জুলি। আমি তোমাকে পঞ্চাশের বদলে একশো পাউন্ড দেব। জুলি, প্লিজ, আরেকটু সাহস তোমাকে দেখাতেই হবে। তুমি তো এ পর্যন্ত চমৎকার চালালে।

জুলি মুখ তুলল। ওর পুরুষ্টু ঠোঁট হ্যারির ঠোঁটের নাগালে।

না হ্যারি। যথেষ্ট হয়েছে আমার। দেখ আমি তোমার প্ল্যান সব শুনেছি। ফলে এ কাজে আমি তোমার বিপক্ষ হলাম। আমি পুলিশের ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চাই না। তাছাড়া ঐ মেয়েছেলেটাকে আমি কত ভয় পাই তুমি জানো। আমি ওকে সহ্য করতে পারছি না।

হ্যারির মনে একটা কথা তড়িৎ গতিতে খেলে গেল। হ্যারি উপলব্ধি করল এ মেয়েটির মূল্য ওর জীবনে কতখানি। ও মনে মনে ভাবল, কথাটা ভোলাখুলি বলে ফেলাই ভাল। ও আমায় কাত করে ফেলেছে, আমি ওকে হারাতে চাই না। ওর মতো আমার জীবনে কেউ আসেনি। ওকে যদি বিয়েও করতে হয় করব। চুলোয় যাক্ সব, আমি তাই চাই।

জুলির হাত ধরে হ্যারি বলল, তুমি কি একটু বেশী বেশী দেখাচ্ছো না জুলি? আর দু-তিন দিনের মধ্যেই তো কাজ ফতে হয়ে যাবে। তারপর আমরা বিয়ে করে ফেলব, কেমন লাগবে তোমার?

জুলির দিকে সাগ্রহে চেয়ে ওর আরো কাছে গিয়ে বলল, বাকী জীবনটা আরামে থাকার মত প্রচুর পয়সা থাকবে আমার হাতে। আমরা আমেরিকায় চলে যেতে পারি। মনের সুখে থাকতে পারি।

জুলি ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ওর মুখের দিকে চাইল। এ একেবারে আশাতীত। ওর শিরদাঁড়া দিয়ে উত্তেজনার স্রোত বয়ে গেল।

বিয়ে করবে আমাকে? আমেরিকা নিয়ে যাবে?

–কেন করবনা? তুমি আনন্দ চাও, চাও না? হ্যারি উত্তেজিত হয়ে উঠল, আমি তোমাকে আনন্দ দেব। সমস্ত পৃথিবীটা থালায় সাজিয়ে তোমায় উপহার দেব। তুমি বুঝছ না সোনা, আমি তোমাকে কত ভালবাসি। আমি তোমার জন্যে পাগল হয়ে গেছি।

–যদি মিথ্যেমিথ্যে বল…, জুলির চোখ চক্ করে উঠল।

নিশ্চয়ই মিথ্যে বলছিনা। সত্যি বলছি জুলি। তুমি যদি এ কাজটা ছেড়ে দাও কি হবে তোমার? কোথায় যাবে তুমি? ধর আমাকে ছেড়ে গেলে, কোথায় যাবে তুমি? হিউয়ার্টের কাছে? সে তোমায় আর নেবে না। কারখানায় হপ্তায় চার পাউন্ডের চাকরি করতে তোমার আর ভাল লাগবে? আমি তো তোমায় যা যা চাও সব দিতে চাইছি–পোষাক, টাকা, মজা, যদি আমাকে চাও তো আমাকেও। জাহান্নামে যাক সব, এর চেয়ে বেশী কিছু তো আমার দেবার নেই। আমেরিকায় আমার কিছু বন্ধু আছে, আমরা মহাশূর্তিতে কাটাবো বাকী দিনগুলো। কি বলল?

 ওকে একটু চেয়ে দেখল জুলি। এইতো ওর জয়ের মুহূর্ত। হ্যারির মনের কথাটি মুখে এসেছে। হ্যারি ওকে ভালবাসে। এখন জুলিকে সতর্ক হয়ে চাল চালতে হবে, যাতে কোন বিপদের ঝুঁকি না নিয়ে ও হ্যারির থেকে যা ইচ্ছে তাই আদায় করতে পারে।

হ্যারির গলা জড়িয়ে ধরল জুলি। বলল, আমিও তোমাকে ভালবাসি হ্যারি। কিন্তু আমি এখানে থাকতে চাই না। আমি চোর নই। স্বীকার করছি, যা আমার করা উচিত নয় তেমন কাজ আমি করেছি, তবে আইন বাঁচিয়ে। আমি কোনদিন এমন কাজ করিনি বা করবো না, যাতে আমাকে জেলে যেতে হয়। হ্যারি দোহাই, তুমি এ কাজ ছেড়ে দাও। আমি জানি তুমি ধরা পড়বেই। ব্লানশ পিশাচের মতোই ধূর্ত। তুমি ধরা পড়লে আমার কি হবে?

হ্যারি জুলিকে কাছে টেনে নিল।

হ্যারি ভাবল, এখানেই খেলা ফুরিয়ে গেলে আমি কি করবো। যদি চোখ খোলা না রাখি তবে ওকে হারাবো। মিসেস ফ্রেঞ্চের সঙ্গে দেখা করতে হবে। কোন উপায় ওকে বের করতেই হবে। তিনি এ কাজে অন্য মেয়ে খুঁজে বের করুন।

–বেশ জুলি, হ্যারি চুমো খেল, এই যদি তোমার ইচ্ছে হয়, তোমায় আমি জোর করে ধরে রাখতে তো পারবো না। তাতে আমাদের সম্পর্কের তফাৎ হবে না কিছু। আমি যে করে হোক ওই টিনের কৌটোটায় ঢোকার উপায় খুঁজে বের করবই। তবে তুমি চলে যাও। আমি তোমার জন্যে পাগল হয়ে গেছি সোনা। তোমায় ঠিকই দেখব।

–সত্যি হ্যারি। সত্যি বলছ?

–নিশ্চয়ই।

–কিন্তু কেন এ কাজ করছ হ্যারি? চল না আমেরিকায় চলে যাই দুজনে। এ ঝুঁকি নিও না হ্যারি।

হ্যারি একটু অধীর হয়ে বলল, আমাকে একাজ হাসিল করতেই হবে। তুমি ভাবছ কোথা থেকে টাকা আসবে? শোন জুলি, একাজটা করতে পারলে আমার ভাগে পাবো আট হাজার পাউন্ড। আমায় করতেই হবে।

আট হাজার পাউন্ড!

একটি মুহূর্ত ভাবল, ওর প্রলোভনে থেকে যায় এখানে, সাহায্য করে হ্যারিকে। তারপর হুঁশিয়ার হয়ে ভাবল, সে এ চিন্তাকে আমল দেবে না। হ্যারি নিশ্চয়ই একটা ফন্দী ঠাওরাবে ঠিকই। যারি ঠিক চালিয়ে নেবে। তারপর সে টাকা জুলির জন্যেই খরচ করবে। বেকার ঝক্কি পোয়াতে  যাবে কেন?

–বেশ হ্যারি…জুলি বলতে শুরু করল।

 –ওটা কি? হ্যারি শক্ত, আড়ষ্ট হয়ে গেল, কিছু শুনতে পেলে?

জুলি ওকে ঠেলে সরিয়ে দিল।

না? কি বলছো তুমি?

 চট করে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা খুলতেই, চটপট করে আবার দরজাটা বন্ধ করে দিল।

ফ্ল্যাটে কেউ ঢুকেছে মনে হচ্ছে। হ্যারি ফিসফিসিয়ে বলল।

ব্লানশ!

জুলি অজ্ঞান হয়ে গেল প্রায়। ব্লানশের শোবার ঘরে, ওরই পোষাক পরা অবস্থায় ধরা পড়লে কি অবস্থাটাই হবে জুলির। ভয়ে জমে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

প্যাসেজ দিয়ে একজোড়া পা হেঁটে আসছে।

মিসেস ওয়েসলি? জুলির ভয়ে খাবি খাওয়ার অবস্থা। কি করব আমি। জানলার দিকে মিথ্যেই ছুটে গেল ও। আমাকে লুকোতেই হবে।

দরজা খুলে গেল। একটা তীব্র আর্তনাদ চেপে নিয়ে হাত মুঠো পাকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল জুলি। একটি লোক ঢুকল। কালো চশমা তার চোখে। দরজায় দাঁড়িয়ে কালো চশমা জোড়ার ভেতর দিয়ে সোজা জুলির মুখের দিকে চেয়ে আছে।

–কেউ আছে এখানে? লোকটি আস্তে বলল, ব্লানশ, তুমি আছো?

এখন তীব্র উদ্বেগ থেকে সহসা মুক্তির স্বস্তিতে বিভ্রান্ত হতে হতে জুলি বুঝল এ হাওয়ার্ড ওয়েসলি। ওয়েসলি ওকে দেখতে পাচ্ছেন না।

.

হাওয়ার্ড ওয়েসলি খুব একটা লম্বা মানুষ না হলেও জুলির মনে হল লোকটা বিশালদেহ। শক্তসমর্থ শরীর, চওড়া কাধ, সোজা হয়ে হাঁটেন। কালো চশমার ভেতর দিয়ে জুলি লক্ষ্য করল ওর চোখ-মুখ অতি সুশ্রী, দৃঢ়বদ্ধ ঠোঁট, শক্ত চিবুক ওঁর শরীরের মধ্যে একটা কর্তৃত্বের আভিজাত্য এনে দিয়েছে। চওড়া কপালের ওপর অবাধ্য বাদামী চুলে সবে রগের কাছে পাক ধরেছে। পরে ও জেনে অবাক হয়েছিল যে, ওর বয়স মাত্র আটত্রিশ।

জুলি আর হ্যারি দুজনেই ওঁর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল। উনি ঘরে ঢুকতে ওরা সরে দাঁড়াল।

ঘরে কেউ আছে কি? উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন।

 হ্যারি জুলিকে হাত নেড়ে ইশারা করে এই পরিস্থিতিকে কি ভাবে সামলাতে হবে, সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছে।

জুলি ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিল, হা…আমি।

ওয়েসলি ওর দিকে মুখ তুলে এমনভাবে ভুরু কোচকালেন যেন আগাগোড়াই উনি জানতেন জুলি এখানে আছে।

–তুমি কে? প্যান্টের পকেট থেকে সোনার সিগারেট কেস বের করে একটা সিগারেট ধরালেন।

–আমি জুলি হল্যান্ড, নতুন চাকরানী। জুলি নিজের গলাকে সংযত শাসনে রাখার চেষ্টা করল।

–ওঃ। উনি পকেট হাতড়ালেন। কপালটা কুঁচকে গেল, বললেন, আমাকে একটু আগুন দিতে পারো। মনে হচ্ছে ওভারকোটের পকেটে আমি দেশলাই ফেলে এসেছি।

চারিদিকে উদ্ভ্রান্তের মত চাইল জুলি। হ্যারি পকেট থেকে লাইটারটা বের করে, টেবিলে রেখে, বুড়ো আঙুল দিয়ে ও ওয়েসলিকে দেখাল। হ্যারির না যাওয়া দেখে জুলি অবাক হল। ও স্থির, সতর্ক দৃষ্টিতে ওয়েসলিকে লক্ষ্য করছে।

হ্যারির এই ধীরভাব দেখে জুলি বিরক্ত হলো। জুলি কাঁপছে, থরথর করে, ওর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। লাইটারটা ছোঁ মেরে তুলে ও ওয়েসলির দিকে এগোল। ও আগে যেখানে দাঁড়িয়েছিল ওয়েসলি সেদিক পানেই তাকিয়ে আছে দেখে প্রমাণ হয়ে গেল যে, উনি সত্যিই অন্ধ। ওদের দেখতে পাননি।

লাইটারটা জ্বালাতে চেষ্টা করল জুলি। ওর আঙুল এত কাঁপছে যে ওটা পড়ে যাবার যোগাড় হল প্রায়।

–আমাকে দাও। ওয়েসলি হাত বাড়ালেন।

জুলি লাইটারটা দিল।

মিসেস ওয়েসলি কোথায়?

–উনি এই শনিবার বাইরে গেছেন স্যার। জুলি হ্যারির দিকে তাকাতে হ্যারি ওর দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে, চোখ টিপে দরজার দিকে সরে গেল।

–আচ্ছা। ওয়েসলি সিগারেট ধরিয়ে লাইটারটা জুলিকে দিয়ে বললেন, ধন্যবাদ।

 জুলি লাইটার নিয়ে টেবিল রাখলো, হ্যারি ওটা তুলে নিল।

 ওয়েসলি প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললেন, কবে ফিরবেন বলেছেন?

 সোমবারের আগে আপনি আসবেন বলে ভাবেন নি উনি। সোমবার নাগাদ ফিরবেন।

–তুমিও ভাবোনি আমি আসব? ওয়েসলি হাসলেন, তোমার সন্ধ্যেটা মাটি করে দিলাম না তো?

–না স্যার। জুলি সাব্যস্ত হয়ে বলল। মনে ভয় হল উনি আবার সন্দেহ করছেন না তো? –আমার কিছু করার ছিল না। ম্যাডামের ঘর পরিষ্কার করছিলাম।

করছিলে বুঝি? তোমার গায়ের সুবাসে আমার মনে হচ্ছে তুমি কোন পার্টিতে যাচ্ছ। একটু হেসে বললেন, আমি তোমাকে কোন কটু কথা বললাম না তো? তবে আজকাল আমায় নাক আর কানের ওপর নির্ভর করে চলতে হয় কিনা। ভারি সুন্দর সুগন্ধি মেখেছ তো!

জুলি লাল হয়ে গেল, পিছিয়ে এল দু–পা। সুন্দর সুগন্ধিই তো হবার কথা। ব্লানশের সুগন্ধি

ও তোতলামি করে বলল, আ–আমি বেরোচ্ছিলাম না।

ওয়েসলি বললেন, মিঃ গেরিজ মালপত্র দেখছেন। উনি আমার সেক্রেটারী। এখনি ওপরে আসবেন। তুমি আমাদের কফি খাওয়াতে পারবে?

–হ্যাঁ স্যার। জুলি ভাবল এখনি এই পোষাক ছাড়তে হবে।

–তাড়াতাড়ি কফি দিও। আমার কাজ আছে। ওয়েসলি মাথা ঘোরাল, মনে হল উনি হ্যারির দিকে সটান চাইলেন। হ্যারি তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গেল। ওয়েসলি বলল, আমার কেবলি মনে হচ্ছে, এ-ঘরে আরো কেউ আছে। আছে কি? ওয়েসলি দরজার হাতলটা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগলেন।

হ্যারি ওয়েসলির হাতের কাছেই এসে গেল। জুলি নিঃশ্বাস বন্ধ করে ওকে সরে যেতে বলল ইশারা করে।

না স্যার, কেউ নেই।

ওয়েসলি ভুরু কোঁচকালেন, আমার এমনি মনে হল। ঠিক আছে, যত তাড়াতাড়ি পার কফি বানাও। উনি বেরিয়ে গেলেন।

উনি চলে যেতেই হ্যারি ফিসফিস করে বলল, ও। খুব বাঁচান বেঁচেছি। পোশাকটা ছাড়। আরেকটা লোক তোমায় যেন এ পোশাকে না দেখে ফেলে।

–আমার দোষ নেই, আমি জানতাম না উনি আসবেন। জুলির কেঁদে ফেলার যোগাড়।

–সে থাকগে! তাড়াতাড়ি পোশাকটা ছেড়ে ফেল।

 ব্লানশের আলমারী থেকে ইউনিফর্ম বের করে, ছুটে সেটা বাথরুমে নিয়ে গিয়ে এক মিনিটের মধ্যে পোশাক পাল্টে এলো।

ও যখন ফিরে এল, হ্যারি তখন কান পেতে কি যেন শুনছে। ও তাড়াতাড়ি ফিসফিস্ করে বলল, ওদের কফি দাও। আমি বেরিয়ে যেতে চাই।

জুলি রুদ্ধশ্বাসে বলল, আবার কবে আমাদের দেখা হবে? আমি আর এখানে থাকব না। এরপরে তো নয়ই।

কাল বিকেল অব্দি থাকো। আমি ঠিক তিনটের সময় উল্টো দিকের পার্কে থাকব। কেটে পড়ো। এখন যাও। কাল কথা হবে। আমি এখন যেতে চাই।

জুলি এক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করল।

–ঠিক আছে। তবে আমাকে জোরাজুরি করে লাভ হবে না। আমি এখানে থাকব না। জুলি তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে চলে গেল।

ও যখন কফি নিয়ে ফিরে এলো ওয়েসলি তখন ইজিচেয়ারে বসে চুরুট খাচ্ছেন। একটি যুবক টেবিলে বসে কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। বয়সে জুলির চেয়ে সামান্য বড় হবে। ওর পাতলা, কুশ্রী মুখখানা জুলিকে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জুলি অনুমান করল ইনিই নিশ্চয়ই ওয়েসলির সেক্রেটারী, গেরিজ। ওয়েসলির কাছেই একটা টেবিল দেখিয়ে দিয়ে ও আবার কাজ করতে লাগল।

জুলি নীচু হয়ে ট্রে-টা রাখতে ওয়েসলি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নিশ্চয়ই সদ্য এসেছ?

কাল এসেছি স্যার।

সংশয়ভরা গলায় ওয়েসলি বললেন, আশা করি এখানে তোমার ভাল লাগবে। আমরা এত তাড়াতাড়ি ফিরব ঠিক ছিলনা, তা তোমার যদি এই শনি-রবিবার কোথাও যাবার থাকে, আমাদের জন্যে নষ্ট কোর না। আমাদের কিছু লাগবে না। আমরা শনিরবিবারটা কারখানায় থাকব। কালকে ব্রেকফাস্ট দেবার জন্য বিরক্ত করব, শুধু। বুঝলে? রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিয়ে দিতে পার। সকাল নটার মধ্যে আমরা বেরোব, তুমি সাড়ে আটটার মধ্যে দিলেই হবে, কেমন?

–ঠিক আছে স্যার। জুলি জবাব দিল।

ব্লানশের শোবার ঘরে যেতে যেতে ভাবল, উনি খুব ভাল, দয়ালু মানুষ। অন্ধ হওয়া কি অভিশাপ? ব্লানশের মতো পিশাচী, জানোয়ারটাকে কি দেখে উনি বিয়ে করলেন?

ব্লানশের ঘর গোছানো হয়ে গেলে ও রান্নাঘরে গেল। কি যে করবে ভেবে পাচ্ছে না ও। এখনো হাতে অনেক সময় আছে। বেরোতে পারলে ভাল হতো কিন্তু একা একা ঘুরতে ভাল লাগে না। পায়চারি করতে করতে জুলি ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগল।

হ্যারির কথা মনে এলো। ওয়েসলি আসার আগে হ্যারির সঙ্গে আমেরিকা যাবার কথা ভাবতে ওর রোমাঞ্চ অনুভব হচ্ছিল, কিন্তু এখন যেন তেমন লাগছে না। মনে মনে ওয়েসলির সঙ্গে হ্যারির তুলনা করতে লাগল। এ যেন নকল হীরের সঙ্গে আসল হীরের তুলনা। ওর হঠাৎ মনে হল হ্যারি চরিত্রহীন, হ্যারির পোশাক-আশাক রং-চঙে, কু-রুচি সম্পন্ন। ওয়েসলি ধনী, আভিজাত্য তার চোখে মুখে। হ্যারি জীবনেও ওঁর মত ধনী হবে না। হ্যারি ফারগুলো চুরি করে আট হাজার পাউন্ডের মাল্পিক হয়ে কতদিন থাকবে? আমেরিকা গিয়ে মনের সুখে টাকা ওড়ালে বেশীদিন থাকবে না টাকা। তখন কি হবে?

ও নিজের মনেই স্বীকার করল, হ্যারি একটি ভাল চোর। ডসন ওকে হ্যারির কথা বলে সাবধান করে দিয়েছিল। হিউয়ার্ট ওকে ঘেন্না করে। ঐ জঘন্য মিসেস ফ্রেঞ্চের সঙ্গে হ্যারির কারবার চলে। তারপর ঐ ডানা মেয়েটা। হ্যারিকে বিয়ে করে আমি কটা ঝামেলা ডেকে আনব?

বিয়ে যদি করতে হয় তবে ওয়েসলির মত লোককেই বিয়ে করা উচিত। জুলি যা যা চায়, গাড়ি, বাড়ি, পোষাক, দাস–দাসী সব। তবে হ্যাঁ, ওয়েসলি ওকে চেয়েও দেখবে না। তাছাড়া ওঁর তো বিয়ে হয়ে গেছে।

যদি জুলি ওঁকে চুরির কথা সব বলে দেয়? হয়ত জুলির সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবেন উনি। হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল জুলি। এসব কি ভাবছে ও। এরকম ভাবা ঠিক নয়। এতে বিপদ আছে। ওর মনে এল সেই মেয়েটির কথা যে সব কথা চাউর করে বেড়াত। তার কথা হিউয়ার্ট কি বলেছিল! এ-সব মনে আনা ঠিক নয়।

দরজায় আস্তে টোকা পড়তে ওর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। গেরিজ কফির ট্রে হাতে ঢুকল।

–হ্যালো, মনে হল ট্রে-টা নিয়ে আসি। চমৎকার কফি খেলাম। গেরিজের মুখে সহৃদয় হাসি।

জুলি খুশী হয়ে গেরিজের হাত থেকে ট্রে-টা নিয়ে বলল, তোমাদের দরকার ছিল কফিটা।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে রান্নাঘরে ঘুরতে ঘুরতে যুবকটি বলল, আমি টম গেরিজ। আমি মিঃ ওয়েসলির সব কাজকর্ম দেখি। আমাদের আলাপ হলে খুব খুশী হবো। তুমি আমাকে এখানে ঘনঘমই দেখবে।

–দেখব বুঝি?

–হ্যাঁ। মিঃ ওয়েসলিকে বললাম তুমি দেখতে চমৎকার।

জুলি মুখ ফিরিয়ে কফির বাসনগুলো ঘোয়ার জায়গায় রাখতে লাগল।

আশা করি তুমি কিছু মনে করলে না। সত্যি কথা বলবে।

জুলি হাসল। না আমি কিছুই মনে করিনি। তবে আমার মনে হয় ওয়েসলি আমার সম্বন্ধে খুব আগ্রহ দেখিয়েছেন।

গেরিজ ভরসা দিল, দেখিয়েছেন বই কি। মুখে না বললেও কান খাড়া করে শুনছিলেন।

জুলি হাসতে হাসতে বাসন ধুতে লাগল।

গেরিজ বলল, মিঃ ওয়েসলি এখন ডিক্টাফোনে কথা বলছেন। তাই তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম। কিছু মনে করনি তো?

–চমৎকার! এখানে থাকতে কেমন লাগছে?

 –তেমন ভাল নয়, জুলি সত্যি কথা বলল।

মিসেস ওয়েসলি নিশ্চয় তামাসাগুলো করেছেন?

–হ্যাঁ।

–সেই নকল সাপ, আলমারীতে পুরে বন্ধ করে দেওয়া।

জুলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন করে জানলে?

–সকলের সঙ্গেই করেন। আমার সঙ্গেও এই বদরসিকতা করেছিলেন। আমি ঐ হতভাগা আলমারীতে দশ মিনিট বন্দী ছিলাম। ভেবেছিলাম মরে যাব।

জুলি দৃঢ়গলায় বলল, এখানে ঐ বিপজ্জনক মহিলার সঙ্গে আমার বেশীদিন থাকার ইচ্ছে নেই।

না না, থাক। একবার অভ্যেস হয়ে গেলে দেখবে, মিসেস ওয়েসলি চমৎকার মহিলা। কিছুদিন বাদে উনি আর খোঁচাখুচি করবেন না। এই তো, এখন আমাকে আর বিরক্ত করেন না। তোমারও ওয়েসলিকে ভাল লাগবে।

জুলি হেলান দিয়ে দাঁড়াল। গেরিজের মুখ থেকে সমস্ত গল্প শোনার জন্যে ওর মন বেশ তৈরী।

ভদ্রলোক টাকা দিয়ে মহিলাকে বিদায় করে দেননা কেন?

–ওঁর টাকা নেই বলে। এখন পাইলটদের বদলে যে যন্ত্র দিয়ে প্লেন চালানো হয়, অর্ধেক সময়ে, অর্ধেক খরচে, সেটি তৈরী করবার জন্যে ওয়েসলি একটা যান্ত্রিক পদ্ধতি আবিষ্কার করতে চেষ্টা করছেন। এই প্রচেষ্টার রিসার্চের জন্যে উনি কানাকড়িটিও লাগিয়ে বসে আছেন। মিসেস ওয়েসলি একথা খুব ভালভাবেই জানেন যে উনি কিছুতেই টাকাকড়ি দিয়ে বিদায় করে দিতে পারবেন না।

জুলি শুনে অবাক হয়ে বলল, কি ভয়ানক অবস্থা! তার ওপর আবার উনি অন্ধ।

–হ্যাঁ, গেরিজ মাথা নাড়ল, এ সপ্তাহে ওনার একটা বড় আশায় ঘা খেলেন উনি। একজন ফরাসী স্পেশালিস্ট ডাক্তার ওনাকে আশা দিয়েছিলেন, তিনি ওঁর চোখ অপারেশন করে ভাল করতে পারবেন। তাই আমরা প্যারিসে গিয়েছিলাম।

ঘড়ির দিকে চেয়ে শিস্ দিয়ে গেরিজ বলে উঠল, আমি যাই। বলেছিলাম শুধু পাঁচ মিনিট দেরি হবে। পরে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।

পরে, জুলি যখন শুয়ে পড়েছে কানে এল গেরিজ হেঁকে বলছে, গুডনাইট! চমকে উঠল ও, মনে ভাবল তাকেই ডেকে বলছে গেরিজ। গেরিজকে তার ভাল লেগেছে। তারপর বুঝল ও ওয়েসলির সঙ্গে কথা বলে চলে গেল। সদর দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। জুলির হঠাৎ মনে হল এই ফ্ল্যাটে ও আর ওয়েসলি ছাড়া কেউ নেই।

ওয়েসলি লোকটা বেশ ভাল। জুলি ভাবল চিন্তার কিছু নেই। ওই জায়গায় যদি বেনটন থাকত আজ, তাহলে জুলি ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকত।

জুলির ঘুম এসে গিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ কাঁচ ভাঙার শব্দে ওর ঘুম ভেঙে যেতে ও লাফিয়ে ড্রেসিং গাউনটা চড়াল।

ওর ভয় হল ওয়েসলির হয়ত কোন দুর্ঘটনা হয়েছে। প্যাসেজ দিয়ে ওয়েসলির ঘরে কান পাততে ঘরে মানুষের নড়াচড়ার আওয়াজ পেল। ও ধাক্কা দিল।

–কে ওখানে? ওঃ! ভেতরে এস জুলি, ওয়েসলি বলল।

জুলি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখল পরনে ড্রেসিংগাউন ও পায়জামা পরে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন ওয়েসলি। এখনো চোখে সেই ভারী, কালো চশমা। জুলির মনে হল ওটা তো খুলে ফেলতে পারেন। আর পায়ের কছে ভাঙাচোরা কাঁচের পাত্র ছড়ানো। কাপেটট ভিজে গেছে।

–হ্যালো জুলি! ওয়েসলির মুখে হাসি, আমাকে উদ্ধার করতে এসেছো?

–আমি শুনতে পেলাম…কথা বলতে গিয়ে ওয়েসলির হাত থেকে রক্ত পড়তে দেখে জুলি বলল, একি, আপনার হাত কেটে গেছে?

–হতভাগা পাত্রটা হাত থেকে পিছলে পড়ে গেল। পরিষ্কার করতে গিয়ে আঙুলে কাঁচের টুকরো বিধে গেল।

–আমি ব্যান্ডেজ নিয়ে আসছি। ওয়েসলিকে সাহায্য করতে পেরে জুলি মনে মনে খুশী হলো। তাড়াতাড়ি ব্লানশের বাথরুম থেকে ফাস্ট এইডের বাক্স নিয়ে এসে বলল, বসুন, আমি বেঁধে দিচ্ছি।

ধন্যবাদ। চারদিক হাতড়িয়ে ওয়েসলি বিড়বিড় করে বললেন, আঃ, চেয়ারটা কোথায়? আমি সব কেমন গণ্ডগোল করে ফেলেছি।

জুলি ওর হাত ধরে ওকে চেয়ারের কাছে নিয়ে এল।

বসতে বসতে ওয়েসলি বললেন, এত অসহায় হওয়া বিশ্রী ব্যাপার। তুমি এসে না পড়লে কি যে করতাম, জানি না।

জুলি কি বলবে ভেবে পেল না। খানিকক্ষণ আড়ষ্টতার পর ওয়েসলির আঙুলের রক্তটা মুছিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। বলল, এর ওপর দিয়ে আঙুল ঢাকা পরিয়ে দিই, তাহলে আপনার কোন অসুবিধা হবেনা।

–খুব ভাল কথা। অনেক উপকার করলে। তুমি ঘুমিয়েছিলে নাকি?

না, একটা নরম চামড়ার আঙুল ঢাকা ব্যান্ডের ওপর দিয়ে পরাল জুলি, ওয়েসলির কব্জি ঘিরে টেপটা বাঁধল। জিজ্ঞেস করল, এতে একটু আরাম বোধ হচ্ছে কি?

–চমৎকার। ওয়েসলি আঙুলটা ভাজ করে মুড়ে দেখলেন। বললেন, জায়গাটা আমি কি ভয়ানক নোংরা করে ফেলেছি।

–না, না। ঠিক আছে, আমি পরিষ্কার করে নিচ্ছি।

জুলি ঝাড়ু আর ময়লা তোলার বাসন এনে কাঁচগুলো তুলে কার্পেটের ভিজে দাগ মুছে নিল।

এখন সব পরিষ্কার করে দিয়েছি। আর কিছু করতে পারি কি?

হঠাৎ ওয়েসলির একটা প্রশ্নে জুলি চমকে উঠল, জুলি তোমার বয়স কত?

–একুশ। একটু ঘাবড়ে গিয়ে উত্তর দিল।

–দেখতে সুন্দর?

 –আমি জানি না, জুলি একটু লজ্জা পেল।

গেরিজ বলছিল তুমি নাকি দেখতে সুন্দর। গেরিজ এ সব ভাল বোঝে। আমার হঠাৎ মনে হল তোমার সঙ্গে একা থাকা ঠিক নয়। মিসেস ওয়েসলি এতে খুশী হবেন না।

ওয়েসলি ড্রেসিং–গাউনের কোমরের দড়িটা নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, এখন আবার ক্লাবে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমার হয়তো তাই করা উচিত, কিন্তু আমি আর পারছি না। যাই হোক, আমি যে রাতে এখানে ছিলাম একথা আমি ওকে বলব না। তুমিও না বললে খুশী হবো।

না কিছু বলব না আমি। জুলি তখনই ভেবে নিল ব্লানশ একথা ঘুণাক্ষরে টের পেলে চরম  নোংরামি করবে।

ধন্যবাদ, এ একটা বাজে ব্যাপার বটে। কিন্তু কি আর করা যায়। যাও শুয়ে পড়। ওয়েসলি বলল।

–আর কিছু করবার নেই তো?

জুলি যাবার আগে আমাকে একটা কথা বলবে? ওয়েসলি হেসে বললেন, আমি যখন ছিলাম না, এখানে মিঃ হিউ বেনটন এসেছিলেন কি? আমার পার্টনার?

জুলির মুখ দিয়ে হা বেরিয়ে এসেছিল প্রায়। কিন্তু ওয়েসলির বসে থাকার ভঙ্গি, হাতের নড়াচড়া যেন ওকে সাবধান করে দিল। এখন গভীর লজ্জায় ওর মনে পড়ল মুখ বন্ধ রাখার জন্যে ও বেনটনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে।

না। এই মিথ্যেটা বলতে ওর নিজের ওপর ঘেন্না হল। বলল, কেউ আসেনি।

–আচ্ছা। ওয়েসলি ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিলেন, ঠিক আছে, শুভরাত্রি জুলি। বাতিটা নিবিয়ে দিও। আমার আলোর দরকার নেই।

এই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে উনি একা বসে আছেন, জুলি চলে যাচ্ছে, এ যেন কিরকম। ভাবলে মন বিষ হয়ে ওঠে।

.