১. সোনালী চুলের পুতুল

দি গিল্টি আর অ্যাফ্রেড

০১.

সেন্ট রাফাইল সিটি স্টেশনের বাইরে পা রাখতেই নজর কেড়ে নেয় সোনালী চুলের পুতুল পুতুল মেয়েটি। পরনে সাঁতারুর বিকিনি। চোখে মস্ত রোদ–চশমা। মাথা ঢেকেছে বিশাল খড়ের টুপি, আঁটো শরীরের ত্বক কোমল, মসৃণ শক্ত ছাদের ক্যাডিলাকে উঠতে কিছু সময় নেয় মেয়েটি।

ভঙ্গি যেন বলে–ওগো পুরুষ, মেটাও নয়ন তৃষ্ণা তোমার। আমারও দৃষ্টি আছড়ে পড়ে ওইখানে।

চালকের আসনে বসে রমনী। ভঙ্গিতে অহঙ্কার। একবার চতুর্দিকে চেয়ে দ্যাখে তার কৃপাপ্রার্থী পুরুষ সাম্রাজ্য। তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে গাড়ি। যেতে যেতে চোখের কোণায় আমায় দিয়ে যায় অভিসারের নির্ভুল আমন্ত্রণ। আমার মালপত্রবাহক কুলি বলে–ভাড়া গাড়ি লাগবে বাবু?

পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে বুলিয়ে নিয়ে বললাম–লাগবে।

সকাল সাড়ে দশটায় সূর্য আগুন ছড়াচ্ছে। স্টেশন থেকে স্রোতের মত ধেয়ে আসে অগণিত মানুষ। বাইরে অপেক্ষারত মোটর, ভাড়াগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি…। আশাকরি, জ্যাক নিশ্চয়ই হোটেলে আমার জন্য ঘর বুক করে রেখেছে।

একটা গাড়ি এসে থামতে কুলি আবার মালপত্র তুলে দিল। তাকে বকশিস দিয়ে গাড়িতে উঠে। বললাম–হোটেল অ্যাদে ফি চলুন।

গাড়ি ছুটছে যানজট ছাড়িয়ে, রাস্তাটি সমুদ্রাভিমুখী। দু–পাশে সুদৃশ্য দোকানপাট। পামগাছের সারি। ইউনিফর্মধারী পুলিশ। হু হু করে ছুটে যাচ্ছে মস্ত ক্যাডিলাক। দুরন্ত মানুষ যান।

লাল আলোর সংকেতে গাড়ি থামে। জানলা দিয়ে দেখি, স্বাস্থ্যবতী রমনীরা চলেছে। অধিকাংশের পরণে সাঁতারের পোশাক। কেউ কেউ পাজামা কিম্বা খাটো প্যান্ট পরেছে। আবার কারো পরণে ফ্রেঞ্চীয় সাঁতার বিকিনি, বেশীরভাগই স্থূলকায় মধ্যবয়স্কা রমনী। আঁটো পোশাকে স্পষ্ট তাদের স্তনবৃন্ত। জানলার বাইরে মুখ রেখে থুতু ফ্যালে ড্রাইভার। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলে–দেখেছেন, যেন শনিবারের হাট।

জায়গাটা বেশ শহর শহর।

–তাই ভাবছেন? একবর্ণ মিথ্যে বলবো না। জানেন, পৃথিবীর যে কোনো শহরের চেয়ে ঢের বেশী ধনী লোক বাস করে এখানকার দু–মাইলের মধ্যে।

স্বীকার করলাম, কথাটা জানা ছিল না। ইশ, যদি সঙ্গে আরো ডলার নিয়ে আসতাম। জ্যাকের কাছে ধার চাওয়া বৃথা।

সমুদ্রকে পিছনে রেখে খাড়াই পাহাড়ি পথ ধরে গাড়ি ছুটছে। দু–পাশে দ্রুত অপসৃয়মান কমলালেবুর গাছ আর রুক্ষ কঠিন পথ। আর কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামলো কাঙিক্ষত হোটেলে।

বেজায় মোটা রিসেপশন ক্লার্ক দেতো হাসি হেসে খাতা কলম এগোলেন রিজার্ভেশন আছে নাকি স্যার?

–আশা করি। আমার নাম লিউ ব্রান্ডন। মিস্টার সিপ্পি কি আপনাকে বলেছেন আমি আসছি?

 –অবশ্যই মিস্টার ব্রান্ডা, ওনার ঘরের পাশেই আপনার ঘর।

টেবিলে–ঘণ্টার বোয়ামে আঙুল রাখতেই ঘণ্টা বাজে। ছুটে আসে বয়। তিনি নির্দেশ দেন–মিস্টার ব্রান্ডনকে দুশো পঁয়তাল্লিশ নম্বর ঘরে নিয়ে যাও।

ফের বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে বলেন, মিস্টার সিপ্পি আছে দুশো সাতচল্লিশে। মিস্টার ব্র্যান্ডন এখানে খুব আরামে থাকবেন। আপনাদের সেবার জন্যই তো আমরা…

–ধন্যবাদ, মিস্টার সিপ্পি কি ঘরে আছেন?

 –না ঘণ্টাখানেক আগে বেরিয়েছেন, সঙ্গে এক যুবতী।

এডউইন হাসে, সেই সঙ্গে চোখ মটকে আরো যুক্ত করেন–বোধহয় সমুদ্রতীরে গেছেন।

শুনে আশ্চর্য হলামনা, জানি মেয়েদের প্রতি তার অসীম দুর্বলতা। বললাম, ফিরে এলে বলবেন, আমি এসেছি ও ঘরে আছি।

–তাই বলবো মিস্টার ব্রান্ডন। এলিভেটারে দু–তলা টপকে উঠে এলাম। দুশো পঁয়তাল্লিশ নম্বর, ইঁদুর কলের মত ঘুপচি ঘর। জ্বলন্ত চুল্লির উষ্ণতা ঘর জুড়ে। খাট এত ছোট শুলে পা বেরিয়ে থাকবে। জানলা দিয়ে কিছুই দেখা যায় না।

ভাড়া বেশ সস্তা। এই যা ভরসা।

হোটেল বয় আমার মালপত্র রেখে গেছে। রুম সার্ভিসকে ডেকে অর্ডার দিলাম বরফ আর ডাব সিক্সটি নাইন। তারপর পোষাক ছেড়ে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার খুলে দিলাম। ঝরণার নিচে যতক্ষণ স্নাত হচ্ছিলাম, ভালো লাগছিল। বেডরুমে এসে ঘামছি।

এক পেগ স্কচ পান করে ফের ঝরণার তলায় এসে দাঁড়াই। এমন সময় দরজায় ধাক্কার শব্দ। কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে এসে দরজা খুললাম। দীর্ঘকায় লালমুখো এক ভদ্রলোক। নাকে পুরোনো ক্ষতের দাগ, চোখে জিজ্ঞাসা অথবা সন্দেহ। সর্বাঙ্গে পুলিশি ছাপ। ঘরে ঢুকে দরজা ভেজালেন, –আপনার নাম ব্র্যান্ডন? স্বরে গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব।

হ্যাঁ, কি প্রয়োজন?

ওয়ালেট খুলে পরিচয়পত্র দেখলে–সার্জেন্ট ক্যানডি হোমিসাইড।

তারপর প্রশ্ন করেন জ্যাক সিপ্পিকে চেনেন?

–চিনি। উনি কি কোন ঝামেলায় পড়েছেন?

বলতে পারেন। দেখলে চিনতে পারবেন?

 অজানা আশঙ্কা চারিয়ে যায় আমার মধ্যে। কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?

–হি ইজ ডেড। হ্যাঁ, উনি মারা গেছেন। নিন, চটপট তৈরী হয়ে নিন, বাইরে আমার গাড়ি আছে। লেফটেন্যান্ট আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।

–ডেড? লালমুখো সার্জেন্টের দিকে তাকাই কি হয়েছিল?

চওড়া দুটি কাঁধ ঝাঁকাল ক্যানডিসেকথা লেফটেন্যান্টের মুখ থেকেই শুনবেন। চলুন যাওয়া যাক।

দ্রুত জামাকাপড় পরে, চুল আঁচড়ে মোজা জুতো পরে তৈরী হয়ে নিলাম। আমার হাত দুটোর মৃদু কাঁপন টের পাচ্ছি। জ্যাক আর আমি বেশ ছিলাম। জীবনের উত্তেজনায় প্রাণের উচ্ছলতায় টগবগ করে ফুটতে সে, প্রতিটি মুহূর্তকে যেভাবে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে আমি সেভাবে কখনো করিনি। জ্যাক মারা গেছে। না, এ অসম্ভব।

জুতোর ফিতে বেঁধে আরেক পেগ হুইস্কি গলায় ঢেলে বললাম–খাবেন?

 ইতস্ততঃ করে ক্যানডি, একজোড়া পুরু ঠোঁটের ফাঁকে উচ্চারিত হয়–বেশ, বাস্তবিক এখন আমি ডিউটিতে নেই। গ্লাসে বড় করে ঢেলে এগিয়ে দিলাম। তা জলের মত এক নিঃশ্বাসে পান করেন তিনি। তারপর বলেল–চলুন, লেফটেন্যান্ট দেরী মোটেই পছন্দ করেন না। এলিভেটরে নিচে নামলাম। রিসেপশনের হোঁৎকা ক্লার্ক বিস্ফারিত চোখে দেখছেন। সম্ভবতঃ ভাবছেন, আমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বেতের চেয়ারে বসেছিলেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। বৃদ্ধ বললেন ঐ লম্বা চওড়া, লোকটা পুলিশ ছাড়া আর কিছু নয়।

অপেক্ষারত গাড়িতে উঠে চালকের আসনে বসলেন ক্যানডি, আমি পাশে বসলাম। হোটেল চত্ত্বর ছেড়ে বড় রাস্তায় পড়লাম। হঠাৎ প্রশ্ন করলাম–কোথায় তাকে পাওয়া গেছে?

সমুদ্রতীরে। চিউয়িংগাম চিবুতে চিবুতে ক্যানডি জানালেন, ওখানে সারি সারি কেবিন ভাড়া পাওয়া যায়। তারই একটিতে দারোয়ান তাকে পেয়েছে।

হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু না অন্য কিছু?

তাকে খুন করা হয়েছে।

বিহ্বলতা–আঘাত–শাক সব মিশিয়ে আমার মধ্যে কেমন ভাঙচুর হতে থাকে। হাঁটুর নিচে দু–হাত চেপে উত্তেজনা প্রশমিত করতে চেষ্টা করি। আর আমার কিছু বলার নেই। বাইরে তাকিয়ে রইলাম। ক্যানডি গুনগুন করে সুর ভজছেন। আধ ঘণ্টায় সমুদ্র সৈকতে পৌঁছে গেলাম। সমুদ্রতীর বরাবর সমান্তরাল চওড়া রাস্তা ধরে পার্কিং জোনের ছোট্ট জায়গায় এসে থামলাম, এখান থেকে দেখা যায় পাম গাছের ছায়া ঘেরা নির্জন লাল সাদা সারিবদ্ধ কেবিন। ইতিউতি রঙীন ছাতা মেলা। পার্কিং লনে চার–চারটে পুলিশের গাড়ি ও জ্যাকের কনভার্টেবল বুইক। আমি আর জ্যাক যেটা কদিন আগে কিনেছি। সেকেন্ডহ্যান্ড, এখনো এজন্য ডলার গুনতে হচ্ছে।

দূরের এক কেবিনে দুশো মানুষের ভিড়।

কৌতূহলী মানুষের ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাই। কেবিনের কাছাকাছি যেতে ক্যানডি জানান–ঐ বেঁটে ভদ্রলোক হলেন লেফটেন্যান্ট র‍্যানকিন।

আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন র‍্যানকিন। ক্যানডির চেয়ে অনেক খাটো। পরনে হালকা ধূসর স্যুট, মাথার টুপি ডান চোখে ঈষৎ নামানো। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি। শক্ত মুখে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা।

ক্যান্ডি বলেন, ইনিই লিউ ব্রান্ডন।

র‍্যানকিন আমার দিকে দেখেন। চোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি। পকেটে থেকে একটা কাগজ বের করে দেখেন–আপনি এটা পাঠিয়েছেন?

কাগজটার দিকে তাকাই। এটা সেই টেলিগ্রাম যাতে আমার আসার কথা জ্যাককে জানিয়ে ছিলাম।

বললাম হ্যাঁ।

–উনি কি আপনার বন্ধু ছিলেন?

আমরা দুজনে মিলে ব্যবসা চালাই। উনি আমার পার্টনার ছিলেন।

বহুক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত ঘষেন র‍্যানকিন বন্ধুকে ভাল করে দেখে নিন। তারপর কথা হবে।

উষ্ণ বালিয়াড়ি মাড়িয়ে তার সঙ্গে কেবিনে ঢুকলাম।

বিচ্ছিরি মুখের দুজন লোক জানলার কোণে কোণে ওঁড়ো পাউডার ছড়াচ্ছে আততায়ীর হাতের ছাপ পাবার আশায়। রোগা বয়স্ক একজন ছোট টেবিলে বসে আছে। তার পায়ের কাছে কালো বাক্স।

ঢুকতেই সবকটি মুখ আমার দিকে ঘুরে গল। চোখ পড়ল ডিভানে শায়িত মৃত জ্যাকের দিকে। বিধ্বস্ত শরীর। বিছানার এত কাছে, যেন মৃত্যুর সময় সে পালাতে চেয়েছিল, একজোড়া সাঁতারের পোষাক ছাড়া শরীরে আর কিছু নেই। ঘাড়ে এবং পিঠের ডান দিকে কালচে লাল গর্ত। গর্তের চারদিকে মারাত্মক কালশিরা দাগ, তার সূর্যআতপ্ত মৃত মুখে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক।

হিমশীতল ধূসর চোখ মেলে র‍্যানকিন প্রশ্ন করেন

–ইনিই তো?

 –হ্যাঁ।

 রোগা বয়স্ক লোকটার দিকে তাকান র‍্যানকিন।

–কাজ শেষ ডাক্তার?

–শেষ, তবে, পেশাদারি খুনির ছোঁয়া আছে এতে।

তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর দুর্দান্ত সাহস দুটোই কাজে লেগেছে। এ ক্ষেত্রে মনে হয়, খুনী বরফ খোঁচা ছুরি ব্যবহার করেছে। খুব কাছ থেকে বা ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আচষ্কা ছুরি মারা হয়েছে। ফলে, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। আমি বলতে পারি ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ইনি খুন হয়েছেন।

র‍্যানকিন নির্দেশ দেনজলদি ডেডবডি নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন।

আর, আমার দিকে ফিরে বলেন, চলুন, ফেরা যাক।

আমরা কেবিন ছেড়ে বালিয়াড়িতে পা রাখি। র‍্যানকিনের কাছে আসেন ক্যান্ডি। র‍্যানকিন জানান–আমি ব্রান্ডনের হোটেলে যাচ্ছি। দেখুন, এখানে কি পাওয়া যায়। ডাক্তার বলেছেন বরফ খোঁচা ছুরি ব্যবহৃত হয়েছে। জাগসনকে আরো লোক দিন। ওরা ছুরি খুঁজে দেখুক। খুনী ওটা কাছাকাছি কোথাও ফেলে যেতেও পারে। যদিও তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।

অতঃপর তিনি সোনার স্ট্র্যাপ কামড়ানো শীর্ণ মনিবন্ধে ঘড়ি দেখে বলেন–আড়াইটে নাগাদ আমার অফিসে দেখা করবেন মিস্টার ব্রান্ডন।

তপ্ত বালিয়াড়ি ভেঙে তিনি হেঁটে যান। জনতা রাস্তা ছেড়ে দেয়। তাকে অনুসরণ করে পার্কিং জোনে এসে বলি–ঐ বুইকটা সিপ্পির ও আমার। ওটা কি আপনাদের কোন কাজে লাগবে। র‍্যানকিন ফিরে এসে ব্যুইকের দিকে তাকান। এক অধঃস্তন কর্মচারীকে ডেকে বলেন–সার্জেন্ট ক্যান্ডিকে বলল যে বুইকটা করে সিপ্পি এসেছিলেন। তার গায়ের হাতের ছাপ নেওয়া হলে যেন এটি ব্রান্ডনের হোটেলে রেখে আসা হয়।

–ঠিক আছে? র‍্যানকিন আমার দিকে তাকান।

–ধন্যবাদ। আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর।

 আমরা পুলিসের গাড়িতে গিয়ে উঠি। গাড়ি ছোটে হোটেলের দিকে।

কোনের দিকে বসেছেন র‍্যানকিন। সিগার বের করে। ধাতব সিগার টিনে কয়েকবার ঠুকে ছোট ছোট দাঁতের ফাঁকে চেপে ধরেন। আগুন জ্বালিয়ে একমুখ ধোয়া টেনে ধীরে ধীরে নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে থাকেন।

আসুন, সিগার নিন। এবার বলুন, আপনি কে? সিপ্পিই বা কে? কি করে এসব ঘটলো? আস্তে আস্তে বলুন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা খুলে বলবেন।

সিগার ধরিয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাবলাম। তারপর শুরু করলাম। বললাম, সিপ্পি ও আমি সফলতার সঙ্গে গোয়েন্দা তথা এনকোয়ারীর ব্যবসা চালাচ্ছি। নিউ ইয়র্কে আমি তিন সপ্তাহ ছিলাম তখন জ্যাকই অফিস দেখতেন। নিউইয়র্কে থাকাকালীন সিপ্পি আমাকে জরুরী টেলিগ্রামে সেন্ট রাফাইল সিটিতে আসতে লেখেন। সেখানে একটা বড় অর্থাৎ প্রচুর টাকার কাজ হাতে এসেছে। সুতরাং কোন রকমে কাজ সেরে প্লেনে করে উড়ে আসি লস্ এ্যঞ্জলসে, তারপর ওখান থেকে ট্রেনে এখানে সকাল সাড়ে এগারোটায় পৌঁছেছি। নির্ধারিত হোটেলে গিয়ে দেখলাম, সিপ্পি যথারীতি আমার জন্য ঘর বুক করে রেখেছেন। শুনলাম তিনি বেরিয়ে গেছেন। শাওয়ার খুলে যখন স্নান করছিলাম। তখন সার্জেন্ট ক্যান্ডি দরজা আঘাত করেন। তারপর তার সঙ্গে এখানে ব্যস্, এটুকু আমি বলতে পারি।

–সিপ্পি বলেননি কাজটা কি? দু–দিকে মাথা নেড়ে বলি–জ্যাক চিঠি ফিটি খুব একটা লেখেন না। মনে হয় তিনি লেখার চেয়ে সব মুখে জানাবেন বলেই ঠিক করেছিলেন।

 খানিক চুপ থেকে ব্র্যানকিন প্রশ্ন করেন–সঙ্গে আপনার লাইসেন্স আছে?

পকেট বইটা বের করে দিলাম। অভিজ্ঞ চোখে খতিয়ে দেখে সেটা ফেরৎ দিতে দিতে বললেন–আচ্ছা আপনার কি কোন ধারণা আছে কে তাকে কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বা কোন্ কেসের জন্য তিনি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

–আদৌ না।

কঠিন চোখে তাকান র‍্যানকিন–জানলে, আমায় বলতে পারেন।

–সে প্রশ্নই ওঠে না। জানলে বলতাম।

আপনার কি মনে হয় এই কেসের জন্য উনি কি কোন নোট রেখে গেছেন? বা প্রগ্রেস রিপোর্ট?

মনে হয় না। সাধারণতঃ উনি কাগজপত্রে কিছু লিখতেন না। ও কাজটা দুজনে একসঙ্গে বসে করতাম। আর রিপোর্ট আমিই তৈরী করতাম।

–সানফ্রানসিসকোয় অফিস থাকতে নিউ ইয়র্কে গেছিলেন কেন?

ক্লায়েন্টের ডাকে। যার সঙ্গে এর আগে আমরা কারবার করিনি। আমাদের মক্কেল তখন নিউ ইয়র্কে ছিলেন আর তার কাজের ভার শুধু আমাকে দিতে চেয়েছিলেন।

–সিপ্পি তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন? পুরনো মক্কেলের কাজ তাকে করতে হচ্ছিল–সেজন্য কি?

হতে পারে।

–সদ্য যে কাজ উনি হাতে নিয়েছিলেন, তাতে তেমন কোন আলোকপাত উনি করেছিলেন বলে কি আপনার মনে হয়, যার ফলে তাকে খুন হতে হয়?

একটু ইতস্ততঃ করি। মনে পড়ে রিসেপশন ক্লার্ক বলেছিলেন–এক যুবতীর সঙ্গে জ্যাক বেরিয়ে গেছেন। বললাম জানি না। হোটেলের রিসেপশনে আমাকে বলেছিলেন যে এক রমণী এসে ওনাকে ডেকে নিয়ে যায়। মেয়েদের পেছনে ধাওয়া করা ওঁর মস্ত দোষ। পছন্দ মতো এক বিবাহিত মহিলার পাল্লায় পড়ে কি দুর্ভোগ। মহিলার স্বামী এসে অভিযোগ করেন, প্রতিবাদ জানান। আমার মনে হয়, এ ধরনের নারী সংসর্গ তার অনেক ঘটেছে।

–উনি কি বিবাহিতা রমণীদের সঙ্গেও…

–ও নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, সুন্দরী হলেই হল। ভাববেন না ওনাকে নিয়ে কুৎসা গাইছি। উনি আমার প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তবে কাজের ক্ষেত্রে ওঁর এই দুর্বলতা বড় ক্ষতি করতো। আমিও বিরক্ত হতাম।

কিন্তু স্ত্রীর প্রেমিককে বরফ খোঁচা ছুরি দিয়ে খুন করে স্বামী অন্তর্হিত, বড় একটা ঘটে না। কাজটা পেশাদারী হাতের।

হতে পারে সেই স্বামী পেশাদারী খুনীকে ঐ ছুরি ব্যবহার করেছিল তেমন কোন রিপোর্ট আছে আপনাদের রেকর্ডে? মাথা নাড়েন র‍্যানকিন।

না, এ হল ধনীদের শহর। অজস্র ছেলে ছোকরা ঘুরে বেড়ায়–যাদের অনেকে ভয়ঙ্কর ছুরি নিয়ে কাউকে পালাতে দেখা যায়নি, এখন সিপ্পি কি কাজ নিয়ে এখানে এসেছিলেন সে সম্বন্ধে যদি একটু আলোকপাত করেন। আমার ধারণা, ও–ই কাজের মধ্যেই রয়েছে হত্যারহস্য।

জ্যাকের মক্কেলের নাম যতক্ষণ না নিজে ভালোভাবে জানতে পারছি ততক্ষণ র‍্যানকিনকে কিছু না বলাই ভাল। তবে নামটা জানতে, ফিরতে হবে অতীতে। এলা বরং জানতে পারে। এলা হল, আমাদের টাইপিস্ট। সানফ্রান্সিসকোর অফিসে বসে থাকলে ওর কাছেই পাওয়া যবে জ্যাকের মক্কেলের নাম ঠিকানা।

–থামো ড্রাইভারকে নির্দেশ দেয় র‍্যানকিন। পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গেছি হোটেল অ্যাদেলফি।

লবি পেরিয়ে রিসপশনে পৌঁছে দেখি, হোঁৎকা ক্লার্কটির চোখে চাপা উত্তেজনা। স্ত্রী পরিবৃত দুই প্রৌঢ় ভদ্রলোক যেন ভিক্টোরিয়ান উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র। অদ্ভুত প্রাচীন পোষাক। কান খাড়া। নট নড়ন চড়ন। শুধু চেয়ে আছেন ফ্যাল ফ্যাল করে। র‍্যানকিন টিপ্পনি কেটে বলেন–চলুন, অন্য কোথাও গিয়ে কথা বলি, যেখানে এই বুড়ো ভামগুলো শুনতে পাবে না। শেষ কথাগুলো বেশ জোরেই বলেন।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই লেফটেন্যান্ট, বিগলিত ক্লার্কটি আমাদের নিয়ে গিয়ে তার ডেস্কের পিছনে ছোট্ট অফিসে বসায়। বলেন–ইয়ে, কোন গোলমাল হয়েছে নাকি?

–এখানে নয়। র‍্যানকিন শুধোন–আপনার নাম? মুখ শুকিয়ে যায় ক্লার্কটির। কোনরকম উত্তর দেন, এডউইন ব্রিওয়ার।

সিপ্পি ঠিক কখন, এখান থেকে গেছেন?

–সাড়ে দশটা হবে।

সঙ্গে কোনো মহিলা ছিলেন?

–হ্যাঁ। এক মহিলা তার খোঁজ করেছিলেন? সেই মহিলা আমার সাথে কথা বলার সময় এলিভেটর থেকে সিপ্পি নামেন। তারপর দুজনে চলে যান।

মহিলা নাম বলেছিলেন?

অসহায় ভাবে ঠোঁট নাড়েন ব্রিওয়ার। বলেন–ও হ্যাঁ, নাম বলেননি তবে মহিলাকে সিপ্পির ঘনিষ্ঠ বা পূর্ব পরিচিত বলে মনে হয়েছিল।

–কোন দিক দিয়ে?

মহিলাকে দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে সিপ্পি বললেন হ্যালো বেবি ডলতারপর তার কোমরে হাত রেখে দুজনে গল্প করতে করতে বেরিয়ে গেলেন।

তখন মহিলার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

–হাসছিলেন, তবে বুঝতে পারছিলাম, পছন্দ করছেন না। মহিলা ঠিক ঐ টাইপের নয়।

–তাহলে কেমন?

–মহিলার বেশ একটা ব্যক্তিত্ব আছে। যা ব্যাখ্যা করা কঠিন। খেলো বা সস্তা ধরনের মনে হয়না।

মাঝখানে আমি বলি–জ্যাক কারো পছন্দ–অপছন্দের ধার ধারতেন না। সম্মানেরও না। মুড ভালো থাকলে তিনি বিশপের স্ত্রীকেও টিটকারী দিতে পারেন।

ভ্রূ কোচকান র‍্যানকিন। প্রশ্ন করেন ব্রিওয়ার, আপনি ঐ মেয়ের বর্ণনা দিতে পারেন?

দু–হাত কচলান ব্রিওয়ার। কিরকম অসহায় দেখায় তাকে। সেঁক গিলে বলেন–ভারী, আকর্ষণীয়। কালো, চমৎকার চেহারা। পরনে ছিল নেভী স্ন্যাকস আর সাদা সার্ট। চোখে মস্ত রোদ চশমা। মাথায় বড় টুপি। মুখ অতটা দেখতে পাইনি।

বয়স?

কুড়ির মধ্যে পঁচিশও হতে পারে।

 আবার দেখলে চিনতে পারবেন?

–হ্যাঁ, অবশ্যই পারব। ব্রিওয়ারের ডেস্কের অ্যাসট্রেতের‍্যানকিন নিঃশেষসিগারেট গুঁজে দেন। বলেনধরুন, সেই মহিলা যদি মস্ত রোদ চশমা আর টুপিনা পরে কেবলমাত্র সাদা পোষাক পরেন, তাহলেও কি তাকে চিনতে পারবেন? একমুহূর্ত ভেবে ব্রিওয়ার বলেন–সম্ভবতঃ না।

–তাহলে আপনি তার পোষাকগুলো চেনেন, তাকে নয়?

হু

–সেটা যথেষ্ট সহায়ক নয়। আচ্ছা, সিপ্পি হ্যালো বলার পর কি হল?

–সিপ্পি বলেছিলেন, দু–ঘণ্টার মধ্যেই তিনি ফিরে আসবেন, তা এখনই বেরিয়ে পড়া ভালো। — এরপর ওনারা। সিপ্পির গাড়ি করে চলে যান।

তবে কি মহিলা তার গাড়ি এখানেই রেখে যান?

 কই, তেমন তো দেখিনি, মনে হয়, তিনি হেঁটে এসেছিলেন।

 –সিপ্পির ঘরের চাবি দিন।

–গ্রীভসকে ডাকতে পারি কি? উনি আমাদের হাউজ ডিটেকটিভ?

দু–দিকে মাথা নাড়েন র‍্যানকিন– না। আমি চাই না, আপনাদের হাউজ ডিটেকটিভ খ্যাপার মত সব লণ্ডভণ্ড করে খুঁজতে গিয়ে কোন ক্ল নষ্ট করে দিক। অফিস থেকে বেরিয়ে ব্রিওয়ার কী বোর্ড থেকে চাবি এনে দেন। আমরা তাকে অনুসরণ করি। চার বুড়ো আমাদের দিকে অপলকে চেয়ে থাকে। ব্রিওয়ার জানান সম্ভবতঃ সিপ্পির কাছেই তার ঘরের চাবি থেকে গেছে। আপনাদের ডুপ্লিকেট দিলাম, আচ্ছা মিস্টার সিপ্পির কি কিছু হয়েছে?

চার বৃদ্ধ খানিকটা এগিয়ে আসে, কি হয়েছে–জানাতে চায় তীব্র আগ্রহে।

র‍্যানকিন চেঁচিয়ে বলেন–ভদ্রলোকের পেটে বাচ্ছা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম। অবশ্য আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই।

আমরা এলিভেটরের দিকে চললাম। বৃদ্ধাদের চোখে অপার বিস্ময়। তখনো চেয়ে আছে আমাদের গমন পথের দিকে।

তিনতলায় যাবো, এলিভেটরের বোতামে চাপ দিয়ে তিনি বলেন–হোটেলের এসব বুড়োদের আমি ঘেন্না করি। আমি বলি আপনিও একদিন বুড়ো হবেন। হোটেলে ওরামজা মারতে আসেননা।

–সেন্টিমেন্টালে খোঁচা দিলেন তো?

মুখ নামান র‍্যানকিন মেঝের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে বলেন–আমি ভাবতাম সবকিছু আমার দেখা হয়ে গেছে।

এলিভেটরে দ্বিতীয় তলা পার হয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করি–কেবিনের দারোয়ানের কাছে মেয়েটার সম্পর্কে কিছু জেনেছেন? 

–উহু সেই একই বিবরণ। কেবিনে দুটি ঘর ছিল। মাঝে দরজা, একটা ঘর মহিলা, অপরটি সিপ্পি ব্যবহার করেছিলেন। একটি ঘরে মহিলার স্ন্যাকস, সার্ট, টুপি, সানগ্লাস পাওয়া গেছে, অন্য ঘরে সিপ্পির পোষাক পাওয়া গেছে।

–কেবিনে মহিলা তার পোষাক ফেলে গেছেন?

— তাই তো বলছি। এর দুটি অর্থ হয়। এক, মহিলা এ ঘটনা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলার জন্য ঠিক করেছিলেন সাঁতারের পোষাক পরে পালাবেন, এ শহরে প্রত্যেকেই সাঁতার স্যুট পরে ঘুরে বেড়ান, যেন সাঁতার কাটতে যাচ্ছেন… আর দুই খুনী, সিপ্পিকে খুন করার পর মহিলাকে তুলে নিয়ে গেছে। আমার লোকেরা সমুদ্রতীর খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই খুনের সঙ্গে মহিলার কোনো সম্পর্ক নেই বলেই আমার ধারণা।

তৃতীয় তলে থামে এলিভেটর। জিজ্ঞাসা করি ঐ কেবিন থেকে মহিলাকে কেউ বেরুতে দেখেছে? না, তবে এখনো সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। করিডোর দিয়ে হেঁটে যাই দুশো সাতচল্লিশ নম্বর ঘরের দিকে।

চাবি খুলতে খুলতে র‍্যানকিন বলেন–কি সুন্দর ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন মহিলা। এ শহরে লোকে মুখ দেখে না, দেখে ফিগার।

চাবি খুলে ঘরে ঢুকি। আমার চেয়েও বড় ঘর। বায়ুহীন, গুমোট গরম।

ঘরে যেন সাইক্লোন বয়ে গেছে। আলমারির ড্রয়ার খোলা, আসবাবপত্র ছড়ানো। জ্যাকের জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড। বিছানা ওল্টানো। ছুরি দিয়ে ফালা করা তোষক, বালিশ ফাটা। মেঝেতে স্তূপীকৃত তুলল। ভাঙা ব্রিফকেসের কাগজপত্র ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে।

র‍্যানকিন বলেন, খুব তাড়াতাড়ি কাজ সেরেছে।

যাওবা কিছু পেতাম তারও আশা নেই। লোক পাঠাচ্ছি, দেখি, যদি হাতের ছাপ মেলে। তবে বাজি রেখে বলছি। তাও পাওয়া যাবে না। তারপর দরজার তালা বন্ধ করে দেন।

.

০২.

 বিছানায় শুয়ে আছি। কানে আসে দুমদাম শব্দ। পাশের ঘরে পুলিশের লোক ক্লু খুঁজছে। হতাশা আর একাকীত্বে ডুবে যাই।

জ্যাক নিজের ভুল বুঝতে পারেনি, যদিও কাজের ব্যাপারে সে নিখাদ ছিল।

পাঁচ বছর আগে আমাদের প্রথম দেখা। আমি তখন ডিষ্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিসের স্পেশাল ইনভেস্টিগেটর। জ্যাক ছিল সানফ্রান্সিসকো ট্রিবিউন পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার। ক্ৰমে গাঢ় বন্ধুত্ব হয়। একরাতে স্কচের বোতল শেষ করতে করতে দুই বন্ধু ঠিক করলাম ওপরতলার খবরদারি আর সহ্যকরবনা। ফানুসের মতো আমাদের পিছনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে বসে বসে ওরা মজা মারবে। আর আমরা? ছুটবো, শুধু ছুটে যাবো…। না। আজ থেকে আর অর্ডার নেবো না। অল্প নেশাগ্রস্ত হলেও চাকরি ছাড়ার ঝুঁকি, মাস মাইনের অনিশ্চয়তা ও এই শহরে নতুন অফিস খুলে বসার ঝক্কি ঝামেলা নিয়ে বিব্রত ছিলাম। হাতে তেমন মূলধনও ছিল না। জ্যাকের চেয়ে আমি পাঁচশো বেশি দিলাম। বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। ভাবলাম, এই অভিজ্ঞতা পাথেয় করে শুরু করা যাক।

অজস্র অনুসন্ধানী এজেন্সি ছিল শহরে। আমরা তাদের অধিকাংশই জানতাম। তারা আমাদের ভয়ের কারণ নয়। কাজ আমরা ঠিকই পাবো।

আধবোতল স্কচ শেষ করে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

প্রথম থেকেই আমরা ভাগ্যবান। একবছর পর আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। তারপর আর পেছনে তাকাইনি।

জ্যাকের মৃত্যু আমায় ভাবাচ্ছে। যে কাজ হাতে নিয়েছিল তা থেকে ওকে সরানোর উদ্দেশ্যে খুন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং খুব সম্ভব ও কোন কুচক্রী মেয়ের পাল্লায় পড়েছিল। এবং ঐ চক্রই ওকে নিকেশ করে দেয়। র‍্যানকিনের ভাষায় ইঁদুরের লেজের মতো এতটুকু একটা বরফ খোঁচা ছুরি পেশাদারী দক্ষতায় ব্যবহৃত হয়েছে।

হাতঘড়ির দিকে তাকাই। বারোটা পঁয়তাল্লিশ। ক্ষুধার্ত লাগছে। গতরাত থেকে পেটে শক্ত কিছু পড়েনি। পাশের ঘরে ওরা কাজে ব্যস্ত। এখন খেলে সময় বাঁচবে।

গলায় জামার বোম আঁটছি। এমন সময়ে দরজা খুলে র‍্যানকিন মুখ বাড়ান। দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁতের ফাঁকে সিগারেট নাড়াচাড়া করতে থাকেন।

আমি জানাই–খেতে যাচ্ছি। আমাকে দরকার।

পাশের ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন–ও ঘরে কিস্যু নেই। হাজারটা হাতের ছাপ। কাকে সনাক্ত করবে। তদন্তের কোন উন্নতি আশা করবেন না। কোন সূত্র থেকে বুঝতে পারলাম না সিপ্পি কার হয়ে কাজ করছিলেন।

–আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, যে ওঘর লণ্ডভণ্ড করেছে সেও কিছু পায়নি। জ্যাক তদন্তের রিপোর্ট রাখতেন না।

–আপনি এখনো জানেন না মক্কেল কে? র‍্যানকিনের চোখে অনুসন্ধিৎসা–মক্কেলের নাম গোপন করেছিলেন বলেই যে উনি খুন হন তার কোন মানে নেই ব্রান্ডন। ভালো চান তো তার নাম বলুন। না বললে বুঝবো আমাকে ভেডুয়া বানাচ্ছেন।

–ভেড়ুয়া বানাচ্ছি না আপনাকে লেফটেন্যান্ট।

 –আচ্ছা, আপনার কোন সহকারী সেখানে আছেন?

–আমাদের একজন টাইপিস্ট আছে। সদ্য সতেরোয় পড়েছে। বোবার মত ঘাড় গুঁজে কাজ করে মাইনে নেয়। তাকে আমরা কিছু বলি না।

র‍্যানকিনের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস। বেশ মক্কেলকে খুঁজে পেলে আমার সাথে দেখা করবেন। আর, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খুঁজে না পেলে আমি আবার আসবো। তখন দেখে নেবো আপনাকে। দরজা ভেজিয়ে চলে যান র‍্যানকিন।

চুলোয় যাক খাওয়া। র‍্যানকিন সানফ্রান্সিসকোর পুলিশ হেড কোয়ার্টারে ফোনে যোগাযোগ করতে পারেন। তার আগে এলার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আমার কথা বলা দরকার।

এলিভেটরে নিচে নাবি। হোটেলের অদূরে ওষুধের দোকান। সেখানকার ফোন বুথে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল রেখে অফিসে নম্বর ডায়াল করলাম।

র‍্যানকিনকে এলা সম্বন্ধে অর্ধসত্য বলেছি। সদ্য সতেরোয় পা দেওয়া মেয়েটা হাবাগোবা নয়। ক্ষুরধার বুদ্ধি। ভীষণ চালাক। স্বস্তি পেলাম তার গলা শুনে–গুড আফটারনুন, স্টার এজেন্সি থেকে বলছি।

-লিউ বলছি। আমি দ্রুত বলে যাই–সেন্ট রাফাইল সিটি থেকে বলছি। একটা কাজ নিয়ে জ্যাক এখানে আসে এবং টেলিগ্রাম করে আমায় ডাকে। খবর খারাপ এলা। ও মারা গেছে। কেউ ছুরি মেরেছে।

কানে আসে নারীকণ্ঠের স্পষ্ট ফোঁপানি। আহা, মেয়েটি জ্যাককে পছন্দ করতো। প্রায় প্রেমে পড়ে গেছিল।

জ্যাক মারা গেছে। তার স্বরে কাঁপন। 

–হ্যাঁ। এখন শোন এলা, এটা খুব জরুরী। পুলিশ জানতে চাইবে, কাজটা কি ছিল, আর মক্কেল কে। জ্যাক আমায় কিছু বলেনি। তোমায় কি বলেছে?

–না। উনি শুধু বলেছিলেন একটা কাজ এসেছে। তারপরই তো সেন্ট রাফাইল সিটিতে চলে যান। তবে, উনি আপনাকে টেলিফোনে বা টেলিগ্রামে ডেকে নেবেন বলেছিলেন।

জিজ্ঞাসা করো নি, কাজটা কি।

টের পাচ্ছি, মেয়েটা কাঁদছে। এলার জন্য দুঃখ হয়। কিন্তু এখন ভাবাবেগের সময় নয়। প্রশ্ন, করি, কি করে কাজটা পেল? কোনো চিঠি বা টেলিফোন?

–এক ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন।

–তিনি নাম বলেছিলেন?

না। আমি জিজ্ঞাসা করলেও জানান নি। শুধু আপনাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন।

জ্যাক কিছুই জানায় নি। অর্থাৎ, এ কেস মীমাংসার আর কোন রাস্তা নেই।

হঠাৎ মাথায় এক ভাবনা ঝিলিক খেলে গেল। মনে পড়লো, টেলিফোনে কারুর সঙ্গে কথা বলার সময় জ্যাকের অভ্যাস ছিল সামনের কাগজে আঁক কষার। হাতে পেন্সিল আর কানে রিসিভার থাকলে ওর কাজ হল সংলাপের সংক্ষিপ্তসার লিখে রাখা। কখনো আবার ছবিও আঁকতো। অফিসের ছবি।

–এলা, জ্যাকের টেবিলের ওপর যে ব্লটিং পেপার আছে দেখো তো, জ্যাক তার উপর কোন মক্কেলের নাম লিখে রেখে গেছেন কিনা। ওর হিজিবিজি কাটার অভ্যাস তো জানোই।

আমি অপেক্ষা করে থাকি। শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাম গড়ায়। বুথের ভিতর অসম্ভব গরম। একটু দরজা খুলে হাওয়া আসতে দিলাম। তখনই চোখে পড়লো লোকটার পা। সোড়া বার–এর পেছনে। ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে চেহারা বলে দিচ্ছে লোকটা পুলিস, চোখাচোখি হতে, এক কাপ কফি নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ালো। চোখ এদিকে।

নির্ঘাৎ র‍্যানকিনের চ্যালা। হয় তো ভাবছে আমি অফিসে ফোন করছি। ভাবুক গে। টেলিফোনের ও প্রান্তে এলার গলায় সম্বিত ফিরে পেলাম

ব্লটারে অনেক হিজিবিজি। তার মধ্যে একটা নামই পড়া যায়, বড় হরফে লেখা লী ক্রিডি।

–ওকে এলা। এখুনি ব্লটারটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে টয়লেট ফেলে দাও। যে কোন মুহূর্তে পুলিস ফোন করবে তোমায়, ওরা যেন কাগজটা না পায়।

পাক্কা তিন মিনিট অপেক্ষা করার পর ফোনে এলা জানালো কাগজটা নষ্ট করে দিয়েছে।

–লক্ষ্মী মেয়ে। এখন শোনো আমি পুলিশকে বলেছি। তুমি একটি নির্বোধ মেয়ে। হাবাগোবা। তোমাকে আমরা কিছুই জানাই না। সেভাবে অভিনয় কোরো। আর হ্যাঁ, ওদের বোলো, একটা ফোন পেয়ে জ্যাক তোমায় বলে গেছে, সে সেন্ট রাফাইল সিটিতে যাচ্ছে, তুমি যেন এসব কিছুই জানো না। ভয় পেয়ো না।

যা বললাম, মনে রেখো, আরেকটা কথা। আমি যেতে পারলে কাজটা তোমায় দিতাম না। যেতে যখন পারছি না তখন তুমিই জ্যাকের স্ত্রীকে জ্যাকের মৃত্যু সংবাদটি দিও, বোলো, আমি চিঠি দিচ্ছি।

আচমকা গলা নাবিয়ে এলা ফিসফিসিয়ে বলে, দুজন লোক এই মাত্র ঢুকলো। মনে হচ্ছে গোয়েন্দা…বলেই লাইন কেটে দিল।

রুমাল দিয়ে মুখ মুছি, বুথ ছেড়ে সামনের কাউন্টার পেরিয়ে ঐ র‍্যানকিনের চ্যালার কাছাকাছি এসে দাঁড়াই। লোকটা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চকিতে আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ায়। আমি স্যান্ডউইচ আর কফির অর্ডার দিলাম।

খাওয়া সেরে সিগারেট ধরলাম। দেখলাম, অত্যন্ত ক্ষুব্ধ লোকটা ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে কালো গাড়িতে উঠে এক নিমেষে উধাও হল।

বেলা দেড়টা।

হোটেলে ফিরে সোজা নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছি, দেখি, জ্যাকের ঘরের দরজা খোলা, জানলার কাছে পালোয়ান গোছের একটা লোক ব্যাগি স্যুট পরে দাঁড়িয়ে। তার হাত দুটো মস্ত পাছায়। চোখ দুটি ঘুরছে ঘরময়, লোকটা ঘুরেই দেখলো আমাকে। চোখে রাগ ও সন্দেহ দেখে মনে হয় প্রাক্তন পুলিস।

–কিছু চুরি গেছে?

–আপনার এখানে কি দরকার? গম্ভীর গলায় ঝাঁঝ।

–আমি ব্রান্ডন। পাশেই আমার ঘর। আপনি গ্ৰীভস? স্বস্তিতে ঘাড় হেলায় লোকটা।

 ঘরটা দেখছি গোছানো। সাফ সুতরো করা হয়েছে।

ঘরের কোণে জ্যাকের বিবর্ণ স্যুটকেস। রেইন কোট, টুপি আর একটা টেনিস র‍্যাকেটের কাঠামো জড়ো করা, আবর্জনার মতো।

–এগুলি দুষ্কৃতীরা নষ্ট করে দিয়েছে? প্রশ্ন করি। ওপর নীচে মাথা নাড়ায় গ্রীভস।

 –এগুলো আমি ওনার স্ত্রীর কাছে ফেরৎ দিতে চাই। আমার জন্য কি কেউ একাজটা করবে?

–জো করবে। ওকে দরকার পড়লে বেল বাজাবেন।

যদি আপনার বেশি কাজ না থাকে তো আমার ঘরে আসতে পারেন। একটা ডাবল সিক্সটি নাইনের বোতল আছে। খেতে খেতে কাজের কথা হবে।

–হাতে কিন্তু সময় আছে। চলুন। তাকে নিয়ে ঘরে এলাম।

একটা উঁচু চেয়ারে গ্রীভস, আমি বিছানায় বসলাম। বরফ গলছে অনেকক্ষণ। তিন আঙুল হুইস্কি মিশিয়ে গ্রীভূসকে দিলাম। তাকে কেন জানিনা সহ্য করতে পারছি।

পানীয়তে দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বলেন–কে খুন করেছে, ওরা জানে?

–ওরা জানলেও আমায় বলবে না। আমি বলি, জ্যাক যে মেয়েটার সাথে গেছিল। তাকে চেনেন?

মাথা নাড়ে গ্রীভস–মেয়েটাকে দেখেছি। র‍্যানকিন আমার সাথে কথা বললে জানতে পারতেন। কিন্তু উনি শুধু ব্রিওয়ারের সঙ্গে কথা বলতেই ব্যস্ত।

জিজ্ঞাসা করি–কিন্তু আপনি জানাননি কেন তাকে?

–উনি ব্রিওয়ারের কাছে মেয়েটার বর্ণনা চাইলেন। গ্রীভস বলে যান–তাহলেই বুঝুন। কি ধরনের পুলিশ উনি। ব্রিওয়ার কেবল পোষাক দেখেছে। আমি লক্ষ্য করেছি মেয়েটাকে। এমনভাবে আপাদমস্তক ঢেকেছিল যাতে পরে না চেনা যায়। সেদিন চুল ডাই করেছিল বা উইগ পরেছিল। যাই করুক, আমি জানি তার চুল সোনালী রঙের।

–কি করে নিশ্চিত হচ্ছেন এত?

ভারিক্কি চালে হাসেন গ্রীভস–আমার চোখ বলছে। দেখেছি তার বাহুর ওপর চুলের প্রান্ত ভাগের রং। মেয়েটার গাত্রবর্ণ ফর্সা।

তথাপি তাকে নিরুৎসাহ না করে চুপ করে থাকি।

উঠে দাঁড়ান তিনি। লবিতে এসে থেমে বলেন–মেয়েটা ডান হাত, ডান হাতে নিজের উরুর ওপর পিয়ানোর রিড টেপার ভঙ্গিতে আঙুল চালান–সর্বদা এমন করতো। মানে, মেয়েটার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। হয়তো নিজেও সে জানে না এই অভ্যাসের কথা। সঠিক বলা শক্ত, তবু আমার মনে হয়েছে যে সে কোন শো ব্যবসায়ে যুক্ত।

–র‍্যানকিনকে বলেছেন এসব?

সিগারেট নিভিয়ে দু–দিকে মাথা নাড়েন গ্রীভস।

জ্যাকের ঘরে দুষ্কৃতি ঢুকলে কি করে?

–সিপ্পির চাবি নিয়ে। তিনি চাবি নিয়েই বেরিয়ে ছিলেন। তাকে খুন করার পর খুনী চাবি নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি এখানে এসে সন্তর্পণে ওপরে উঠে ঘরে ঢোকে। একাজে স্নায়ুর জোর থাকা চাই। আর খুনীর তা ছিল বলে অক্লেশে কাজ সেরে চলে গেছে নিরাপদে। ওই সকালে আমি বা কর্মচারীরা কেউ ওখানে ছিল না।

ঠিক এসময়ে আমার মনে হল গ্রীভসকে জানানো দরকার কমবেশী আমিও এ ব্যাপারে যুক্ত। আমার কার্ড এগিয়ে দিলাম, কার্ড পড়ে রীতিমত চমকে উঠলেন। অপ্রস্তুত নাক ঘষে কার্ড ফেরৎ দিয়ে বললেন–উনি কি আপনার পার্টনার ছিলেন?

–হ্যাঁ।

সর্বদা আমি আপনাদের দলে ভিড়তে চেয়েছি। আপনাদের লাইনে আমাদের চেয়ে পয়সা বেশি। তো চলছে কেমন?

–এ দুর্ঘটনার আগে বেশ চলছিল। এখন কাজ বন্ধ রেখেছি যতক্ষণ না খুনীকে ধরতে পারছি।

একটু থেমে আবার বললেন–লস অ্যাঞ্জেলস থেকে একবার এক গোয়েন্দা এলেন আত্মহত্যার একটা কেসের তদন্ত করতে। মৃতের বিধবার ধারণা ছিল ওটা আত্মহত্যা নয়, খুন। সেজন্য তিনি গোয়েন্দাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ক্যাচেন তাকে বারণ করেন। তবু গোয়েন্দা তদন্ত চালাতে থাকলেন। একদিন তিনি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ এক মাতাল গাড়ি তাকে ধাক্কা দিল। গাড়ি দুমড়ে–মুচড়ে গেল। কলার বোন ভেঙে গোয়েন্দা প্রবর পড়ে থাকলেন হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে যখন ছাড়া পেলেন, ছমাসের জন্য তার ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হল মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য। অথচ হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগে পুলিসগুলো আধ পাঁইট হুইস্কি তার গায়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল, এ কথা কেউ মানল না।

বাঃ চমৎকার! খবরের জন্য ধন্যবাদ। ক্যাচেন সম্বন্ধে সজাগ থাকবো।

–মদের জন্য ধন্যবাদ। প্রয়োজন হলে ডাকবেন, সাধ্যমত সাহায্য করব।

পানীয় শেষ করে গ্লাস নামান গ্রীভস।

আমি বলি–মনে থাকবে।

 ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ প্রশ্ন করি–আচ্ছা, লী ক্রিডি নামে কাউকে চেনেন?

তাকিয়ে থাকলেন অপলক। তারপর দরজা ভেজিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন–এ শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি।

আমি উত্তেজনা চেপে বলি কত বড় ধনী?

প্রথমে একশো মিলিয়ন বা ছিল তার সম্পত্তি। গ্রীন স্টার সিপিং লাইন কিনেছেন। সানফ্রানসিসকো থেকে পানামা যাতায়াত করে তার ট্যাঙ্কারগুলো।

কিনেছেন এয়ার লিফট করপোরেশন। এখান থেকে মিয়ামী উড়ে যায় তার বায়ুদূত। আরো দীর্ঘ তার সম্পত্তির তালিকা। তার মধ্যে তিনটে খবরের কাগজ, দশ হাজার কর্মী সম্মিলিত এক ফ্যাক্টরি। গাড়িতে বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ লাগাবার কাজে মহিলারা যুক্ত। তিনি ক্যাসিনো কিনেছেন। তার হাতে গড়ে উঠেছে লাইট ওয়েট চ্যাম্পিয়ন, রিঞ্জা প্লাজা হোটেল এক দুর্দান্ত বড়লোকদের মাসকেটিয়ার্স ক্লাব। পাঁচ হাজারের ওপর রোজকার চলে। রক্তপরীক্ষা করার পর হয়তো আপনি ঐ ক্লাবে ঢোকার অনুমতি পাবেন। বুঝতেই পারছেন উনি কত বড় ধনী।

–উনি কি বিবাহিত?

–ও সিওর। ফিল্ম স্টার ব্রিজিৎ বর্দকে মনে আছে? তিনি ওর স্ত্রী।

মনে পড়লো বছর চারেক আগে কোন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ঝড় তুলেছিলেন ব্রিজিৎ। কয়েকটি ছবিতে তাকে দেখেছিলাম। বন্য আর কোমলের সংমিশ্রণের জন্য তার খ্যাতি।

–তা হঠাৎ ক্রিডির সঙ্গে কি ব্যাপার?

–কিছু না, নাম শুনেছি। একজন তার সম্বন্ধে বলছিল। তাই কৌতূহল। লোকটা কে?

–গ্রীভস চিন্তান্বিত হয়ে কয়েক পলক চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। সিগারেট ধরিয়ে আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। জ্যাক বলেছিল একাজে প্রচুর পয়সা আছে। লী ক্রিডি যদি মক্কেল হন তাহলে পয়সার ব্যাপারটা ভুল নয়। তার চারদিকে স্তাবক, চ্যালা, জো হুজুর লোক, সেক্রেটারীর অভাব নেই যারা আমাদের মত লোককে তার কাছেও ঘেষতে দেবে না। জ্যাককে কি ভাড়া করেছিলেন তিনি? কেন? তাকে প্রশ্ন করা সহজ হবে না।

মুড ফিরিয়ে আনতে এক চুমুক হুইস্কি পান করি। অতঃপর টেলিফোন। রিসিভার তুলে ধরি–গ্রীভসকে দেবেন, কথাটা সুইচ বোর্ডের মেয়েটিকে বলি।

অল্প বিরতির পর লাইনের ওপার থেকে আসে গ্রীভসের গলা। বলি একটা টেলিফোন করার ছিল। আপনার সুইচ বোর্ড ক্লিয়ার তো! ইচ্ছে করেই একটু রহস্য রাখি কথায়।

–ভয়ের কিছু নেই। একটা পুলিশ, লাইনে আড়ি পেতেছিল। এইমাত্র চলে গেল।

ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন নামিয়ে আবার রিসিভার তুলে মেয়েটির কাছে লী ক্রিডির লাইন চাইলাম।

মেয়েটা একটু ধরতে বলে, অল্পক্ষণ বাদেই পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে–আমি লী ক্রিডির বাড়ি থেকে বলছি।

মিস্টার ক্রিডিকে দেকেন? আমার কণ্ঠে ব্যক্ততা।

 আপনার নামটা যদি বলেন স্যার, আমি মিস্টার ক্রিডির সহকারীকে দিতে পারি।

লিউ ব্রান্ডন আমার নাম। মিস্টার ক্রিডির সহকারীকে চাই না, মিস্টার ক্রিডিকেই চাই।

–যদি একটু ধরেন, আমি ক্রিডির সহকারীকে লাইন দিতে পারি। ঠাস করে যেন চড় পড়লো গালে। কণ্ঠস্বরের একঘেয়েমি। আর একই কথার পুনরাবৃত্তি যেন অপমানিত করে। এরপর লাইনের মধ্যে কাঁ–কে কট শব্দ। ছেঁড়া ছেঁড়া কথার আভাস। শেষে স্পষ্ট শোনা গেল হ্যামারস্কাল্ট হিয়ার। কে বলছেন?

–লিউ ব্রান্ডন। আমি মিস্টার ক্রিডিকে চাই।

মিস্টার ব্রান্ডন। আপনার কি দরকার? গলায় রুক্ষতা স্পষ্ট।

–সেটা মিস্টার ক্রিডি বলবেন, যদি আপনাকে জানানো দরকার মনে করেন। আমার সময় নষ্ট না করে লাইনটা দিন।

তার সাথে কথা বলা অসম্ভব। কি বলতে চান, যদি সামান্য আভাস দেন। আমি তাকে বলবো। তিনি পরে আপনাকে ফোন করতে পারেন।

বুঝলাম রাস্তা বন্ধ। আমি রূঢ় ব্যবহার করলে আমার চালাকি ধরে ফেলবে লোকটা। সুতরাং শেষ অস্ত্রটি চুড়ি খুব মোলায়েম স্বরে বলুন, সানফ্রান্সিসকোর স্টার এজেন্সির সিনিয়র পার্টনার বলছি। তিনি অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। তাকে দেবার জন্য একটা রিপোর্ট আছে।

–তাই নাকি? কণ্ঠে বিস্ময়। ঠিক আছে মিস্টার ব্রান্ডন বলবো তাকে। পরে আপনাকে ফোন করছি। আপনার ফোন নম্বর কত?

নাম্বার জানিয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। সিগারেট নিভিয়ে হুইস্কি শেষ করে চোখ বুজলাম। ভীষণ টেনসনের পর কখন চোখ লেগে গেছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। ক্ষিপ্র হাতে রিসিভার তুলে নিলাম। মনিবন্ধে তাকালাম। প্রায় পনেরো মিনিট ঘুমিয়েছি।

মিস্টার ব্রান্ডন?

 –হ্যাঁ। হ্যামারস্কাল্টের গলা চিনতে পারলাম।

–আজ দুপুর তিনটের সময় মি. ক্রিডি আপনাকে ডেকেছেন। হ্যাঁ দয়া করে সঠিক সময়ে আসবেন। আজ দুপুরে মিঃ ক্রিডির বহু অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তার থেকে মাত্র কয়েক মিনিট সময় আপনাকে দিতে পারবেন।

–সেই যথেষ্ট। বলে ফোন ছেড়ে দিলাম। ক্রিডি হয়তো জ্যাকের মক্কেল। হয়তো সেজন্য ঐ স্তরের একজন লোক আমার মত লোককে সময় দিতে রাজি হয়েছেন।

***

বহুদুর থেকে চোখে পড়ে লী ক্রিডির সাম্রাজ্য। বাড়ি যেন রাজপ্রাসাদ তিনতলা উঁচু। বিশাল বিশাল জানালা। টেরেস। নীল টালির ছাদ। লতানো ফুল গাছ ঢেকে রেখেছে সাদা দেওয়াল।

হোটলের বাইরে সিপ্পির ব্যুইক রেখে গেছিল পুলিস। সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বুইকটা। পুলিশ না সিপ্পি। কে ক্ষতি করেছে গাড়ির? সম্ভবতঃ সিপ্পিই, সেই ব্যুইকটার সওয়ার হয়ে ক্রিডির সাথে দেখা করতে ছুটেছিল। বুইক ব্যবহার করে ট্যাক্সি খরচ বাঁচানো গেল। পেনিনসুলা থেকে প্রাইভেট রোডে পড়লাম। সামনের সাইনবোর্ড বলছে–থর এস্টেটের সাক্ষাৎপ্রার্থীরাই শুধু এপথ ব্যবহার করতে পারে, অন্যরা নয়। ..

আরো কিছুদূর গিয়ে চোখে পড়ল লাল–সাদা পোল। তারপর ছোটখাটো সাদা গার্ড অফিস। এখানে রাস্তা ব্লক, দুজন সাদা পোষাকের গার্ড এগিয়ে এল। ওরা কাছে আসতে বলি–মিঃ ক্রিডির সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে আমার।

ওদের একজন এগিয়ে আসে–নাম কি?

নাম জানাই। আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ওরা ব্যারিকেড তুলে নেবার নির্দেশ দেয়। বলে সোজা যান। বাঁদিকে ঘোরার মুখে ছনম্বর সারিতে গাড়ি রাখবেন। বাঁদিকের মোড়ে, ছনম্বর সারিতে গাড়ি রাখলাম। দেখি, ওক কাঠের বিভিন্ন ফলকে বাটি অক্ষর জ্বলজ্বল করছে।

সহসা আমার পিছনে কে যেন বললো–যত্ত সব পয়সার অপচয়। ঘুরে তাকাই। সাদা পোষাকের থলথলে বেঁটে এক গার্ড। তার সন্দিগ্ধ চোখ দুটো আমার সর্বাঙ্গে ঘুরে যায় কাকে খুঁজছেন?

–ক্রিডিকে। ঘড়ির দিকে তাকাই। তিনটে বাজতে আর মিনিট বাকি। অগত্যা বলি–তিনটের সময় তার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, তিনি অপেক্ষা করা পছন্দ করেন না।

–হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যান, লোকে তার দেখা পাবার জন্য তিন চার ঘণ্টা বসে থাকে। চলেই যাচ্ছিলাম, চকিতে মাথায় মতলব খেলে যায়। ঘুরে দাঁড়াই–আজ সন্ধ্যা ছটায় সময় হবে আপনার?

–আজ সন্ধ্যা ছটায় আমার অনেক কাজ, বিড়বিড় করে সে।

–এই পুরোনো মালিকের কাছে বারো মাস কাজ করেছি। আজ চাকরি ছেড়ে দিয়ে পেটপুরে মদ খাবো। সেলিব্রেট করবো। ব্যথা ভুলে থাকবো কেন?

–আজ আমিও সেলিব্রেট করবো। যদি অন্য কারোর সঙ্গে আপনাকে বসতে না হয়, তাহলে আসুন না, আমরা একসঙ্গে এনজয় করবো।

–আমার মেয়ে আমার মদ খাওয়া বরদাস্ত করে না, ভাবছিলাম আজ একা একা খাবো ভালোই হল, একজন সঙ্গী জুটে গেল। ঠিক আছে, বলুন, কোথায় আর কখন?

ধরুন ছটায়। ভাল জায়গা জানা আছে আপনার?

–সামস কেবিন। যে কেউ বলে দেবে কোথায় জায়গাটা। আমার নাম টিম। টিম ফাল্টন।

–আমি লিউ ব্রান্ডন। আবার দেখা হবে, চলি। তাকে ছেড়ে একসাথে তিন তিন ধাপ সিঁড়ি টপকে উঠি। বাঁদিকে লম্বা টেরেস পেরিয়ে প্রবেশ পথ।

মাত্র এক মিনিট বাকি। ডোর বেল বাজাই। দরজা খোলে তৎক্ষণাৎ। ছফুট চার ইঞ্চি দীর্ঘ– হলিউডের বাটফলারের ধরনের পোষাক পরিহিত রোগা প্রৌঢ় অল্প মাথা নুইয়ে একধারে সরে দাঁড়ান। আমি ঢুকি। ওরে বাবা। কি মস্তু হল ঘর। ছছটা ক্যাডিলাক একসাথে এখানে গ্যারাজ, করা যায় অনায়াসে।

–আপনি মিস্টার ব্রান্ডন?

–ঠিক ধরেছেন।

 আমি তাকে অনুসরণ করি। হল পেরিয়ে খানিক খোলা জায়গা। এখানে বোদ বড় তীব্র। আবার দরজা পেরিয়ে দীর্ঘ ঘর।

ছজন ব্যবসায়ী অপেক্ষারত। উদগ্রীব। তাদের দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ।

আমি বসে টুপি খুলে হাঁটুতে রেখেকড়িকাঠের দিকে চেয়েরইলাম। তিনটে বেজে তিন। সশব্দে দরজা খোলে। এক যুবক, দীর্ঘকায়, শীর্ণ, চামড়ায় আভিজাত্যের জৌলুস। পরনে কালো কোট ট্রাউজার, কালো টাই, ব্যবসায়ী দুজনই উঠে দাঁড়ায়। প্রত্যেকে ভাবছে, বুঝি তারই ডাক এল।

যুবকের নির্দয় শীতল চোখ সবাইকে ছুঁয়ে আমাকে বিদ্ধ করে–মিঃ ব্রান্ডন? মিঃ ক্রিডি আপনাকে ডাকছেন। উঠে দাঁড়িয়েছি। হঠাৎ ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন বলে ওঠে, ক্ষমা করবেন মিঃ হ্যামারস্কাল্ট, আমি কিন্তু বেলা বারোটা থেকে অপেক্ষা করছি।

হ্যামারস্কাল্টের দৃষ্টিতে ভৎর্সনা। –আমি কি করতে পারি? মিঃ ক্রিডি যা ভালো বুঝবেন। উনি চারটের আগে ফ্রি হবেন না।

ছোট্ট লবি ও দুটো দরজা পেরিয়ে আমরা এসে থামলাম মেহগনি কাঠের জেল্লাদার দরজায়।

সে ধাক্কা দিয়ে দরজার পাল্লা খুলে ভেতরে তাকায়। বলে ব্রান্ডন এসেছেন, স্যার। পাশে সরে দাঁড়ায় সে আমি ভেতরে ঢুকি।

এই ঘর মনে পড়িয়ে দেয় ফিল্মে দেখা মুসোলিনির সেই প্রখ্যাত অফিস। প্রায় ষাট ফুট লম্বা। বহুদূরে দুটো প্রকাণ্ড জানালা। যেখান দিয়ে ভেসে ওঠে সমুদ্র আর থর বে। অনায়াসে বিলিয়ার্ড খেলা যায় এমন একটা ডেস্ক মাঝখানে। ঘরের অন্য অংশে গুটি কয়েক চেয়ার। দেওয়ালের হ্যাঁঙারে ঝুলন্ত স্যুট দুটো। একটা অয়েল পেন্টিং, এত কালো–আসল না নকল, বোঝা দায়।

ডেস্কের অপর প্রান্তে ছোটোখাটো একটা মানুষ। ধূর্ত দৃষ্টি। চশমা কপালে তোলা। ধূসর চুল, খুব অল্প। হাড় সর্বস্ব শক্ত করোটি। দৃঢ় মুখ।

আমি ধীরে এগিয়ে যাই। প্রখর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন ক্রিডি যেন আমার শিরদাঁড়ার হাড়গুলোও দেখতে পাচ্ছেন। ওনার ডেস্কে পৌঁছতে টের পাই, আমি ঘেমে উঠেছি।

চেয়ারে হেলান দিয়ে উনি চেয়ে আছেন। দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য। অনেকক্ষণ স্তব্ধতার পর মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন–কি চান আপনি?

–আমার নাম ব্রান্ডন, সানফ্রান্সিসকোর স্টার এনকোয়ারি এজেন্সি থেকে আসছি। আমার পার্টনারকে আপনি চারদিন আগে ভাড়া করেছিলেন।

দপ করে নিভে গেল মুখের আলো। বললেন–আমি ভাড়া করেছি কি করে এ ধারণাহল?

কথাটা তার ক্ষেত্রে সত্য নাও হতে পারে। তথাপি লড়ে যাই–আমাদের সব মক্কেলের রেকর্ড রাখি আমরা। অফিস ছাড়ার আগে সিপ্পি লিখে রেখে গেছে। আপনি তাকে ভাড়া করেছেন।

–সিপ্পি কে?

আমার পার্টনার। যাকে আপনি ভাড়া করেছিলেন।

আমার অনেক অদরকারি কাজে আমি প্রতি সপ্তাহে কুড়ি পঁচিশ জনকে বহাল করি। কই, সিপ্পি নামের কোন নামতো মনে পড়ছে না। আপনি কি জন্য এসেছেন? কি চাই আপনার?

–আজ সকালে সিপ্লি খুন হয়েছে। ক্রিডির অন্তর্ভেদী চোখে চোখ রেখে বলতে থাকিও যে কাজ করছিল, আমি ভাবছিলাম, আপনি সে কাজের দায়িত্ব আমাকে দিতে পারেন।

কাজটা কি? গালে হাত দিয়ে প্রশ্ন করেন তিনি। জানতাম, আগে হোক পরে হোক, প্রশ্ন উঠবেই। এবং এই সেই মোক্ষম ও শেষ সীমান্ত। উত্তর আমার জানা নেই, কৌশলে জেনে নিতে হবে। বললাম–আমার চেয়ে আপনিই তা ভালো জানেন।

মুখ থমথমে। অন্ধকার। চিন্তিত দেখাচ্ছে। চার সেকেন্ড চুপ থাকার পরে টেবিলে ঘন্টার বোতামে হাত রাখেন তিনি।

মুহূর্তে দরজা খুলে উদয় হয় হ্যামারস্কাল্ট। তার দিকে হৃক্ষেপ করে হাঁক পাড়েন–হার্জ, হার্জ।

–এক্ষুনি, স্যার। চলে যায় সে।

চোখ নিচে। টেবিলে আঙুল বাজান ক্রিডি। আরো পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড কেটে যায় শব্দহীন।

দরজা খোলার শব্দ হয়। এক বেঁটে মোটা লোক ঘরে ঢোকে। তার বাঁ কান বেঁকে মাথার সাথে মিশে গেছে। কোনো অপকর্মের সাক্ষী। মুখ জুড়ে হাড়বিহীন বিরাট নাক, বুনো আক্রোশ ক্ষুদে ক্ষুদে চোখে, কাঁধের কাছে ছড়ানো কালো চুল। পরনে ফ্ল্যানেলের ট্রাউজার ও সাদা স্পোর্টস কোট। টাই–এ হাতে আঁকা হিজিবিজি ছবি।

অতিদ্রুত টেবিলে এসে দাঁড়ায় সে, তার শরীর বুঝি ব্যালে নাচিয়ের মতো ভারহীন। আমাকে দেখিয়ে বলেন ক্রিডি–একে দেখে চিনে রাখো হার্জ। একে চোখে চোখে রাখার দরকার হতে পারে। হার্জ তাকায় আমার দিকে। আমার সর্বাঙ্গ জরিপ করে তার হিংস্র দুটি চোখ। ভাবলেশহীন চোখ, –দেখলে চিনতে পারবো, বস্, হার্জের গলা নরম। বস্–এর ইঙ্গিতে চলে যায় সে।

ক্রিডি বলে–এনকোয়ারি এজেন্টদের আমি পছন্দ করি না। আমার মনে হয় ঐ নোংরা লোকগুলো ব্ল্যাকমেলিং–এর সুযোগ খোঁজে। মিঃ সিপ্পি বা ঐ ধরনের কাউকে আমি ভাড়া করিনি। করার কথা ভাবিনি। আপনাকে পরামর্শ দেবোযথা শীঘ্র এশহর ছেড়ে চলে যান। আমি আপনার মিঃ সিপ্পিকে চিনি না। আপনার সঙ্গে কোন কাজ কারবার করতেও চাই না। আপনি বেরিয়ে যান এখনি। নতুবা যার মূল্য আছে–এমন কিছু বলুন।

আমি হাসি। ক্রিডির অন্তর্ভেদী চোখে চোখ রাখি। ঐ চোখে রাগের বহ্নি। রাগ আমারও কম হয়নি। বোধহয় জীবনে এরকম ক্ষিপ্ত কখনো হইনি। হাসতে হাসতে বলি–হ্যাঁ, আমার কিছু বলার আছে। প্রথমতঃ মিঃ ক্রিডি, আমি সঠিক জানতাম না আপনি সিপ্পিকে ভাড়া করেছিলেন কিনা। এখন জানলাম। ঘটনাচক্রে সিপ্পি তার ব্লটিং পেপারে আপনার নাম লিখে রেখেছিল। কাজে নেমে, সেটাই ছিল আমার একমাত্র সূত্র। কাগজে আঁকিবুকি কাটা তার স্বভাব। তাই ভেবেছিলাম, কেউ হয়তো আপনার নামটা উত্থাপন করায় সিপ্পি তা লিখেছিল খেয়ালবশে। এখন জানলাম তা নয়। আজ সকালে আমি যখন ফোন করি, তখন নিশ্চিৎ ছিলাম আপনি দেখা করবেন না। আপনার শুরের কোনো মানুষ আমাদের মত তুচ্ছ এনকোয়ারি এজেন্টকে পাত্তা দেবেন না, যদি না, সত্যি প্রয়োজন থাকে বা কোন কিছু গোপন করার থাকে। তাছাড়া দুজন ব্যবসায়ীকে, যার মধ্যে একজন তিনঘণ্টা অপেক্ষারত, বাদ দিয়ে আমাকে বেশি গুরুত্ব দেবার কারণ নিশ্চয়ই আছে। আপনি তিন মিনিটের বেশি কারোর কথা শোনেন না, আমি জানি। আপনি যখন জানলেন কত ক্ষুদ্র আমি তখনই আপনি আপনার পোযাগরিলাকে ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে। ভাবলেন, ভয়ে ল্যাজ গুটিয়ে পালাবো আমি হোটেলে। আর সেখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পিঠটান দেবো। সবাই অত সহজে ভয় পায়না মিঃ ক্রিডি, তার মধ্যে একজন আমি।

–বলা শেষ হয়েছে?

সম্পূর্ণ নয়। এখন আমি নিশ্চিত হলাম, সিপ্পিকে আপনি ভাড়া করেছিলেন। এবং সে এমন কিছু উন্মোচন করেছিল যা কারোর কাছে ভাল লাগেনি, তাই সে খুন হয়। আমি জানি আপনার।

কাছে সেই সূত্র আছে যা জানলে পুলিশ খুনীকে ধরতে পারে। এবং আপনি চাইবেন না নিজেকে এই মার্ডার কেসের সঙ্গে জড়াতে। কারণ তাহলে প্রকাশ হয়ে যাবে আপনি কেন সিগ্নিকে ভাড়া করেছিলেন। আমার অভিজ্ঞতা বলে, কোন মিলিয়ার যখন আপন বাসভূমি থেকে তিনশো মাইল দূরের কোন এজেন্টকে ভার করার কষ্ট স্বীকার করেন, তখন বুঝতে হবে তিনি স্থানীয় বড় এজেন্টকে কাজের ভাড় দিয়ে সবকিছু ফাস করতে চান না। আমার প্রিয় সিপ্পি মৃত। পুলিশও যদি তার খুনীকে ধরতে অপারগ হয়, আমি হয়তো পারবো। হার্জ বা মিঃ ক্রিডি যাই করুন, আমি আমার কাজ করে যাব।

ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়াই–দ্যাটস অল। থাক, আপনার পোষা গুণ্ডা ডাকতে হবেনা। আমি চলে যেতে পারবো নিজেই।

দরজার দিকে হেঁটে যাই। শুনতে পাই ক্রিডি বলছেন–আমি কিন্তু আপনাকে শাসাইনি।

দরজা খুলে বেরোই। বাটলার এগিয়ে দিতে আসে। ক্রিডির শেষ কথাটা মাথার মধ্যে লাফাতে থাকে পিং পং বলের মত।

***

হোটেলের সামনে দেখি পুলিশের গাড়ি পার্ক করা। বুইক থেকে নামতেই পুলিসের গাড়ি থেকে এগিয়ে আসেন ক্যান্ডি–আপনাকে ডেকেছেন ক্যাপটেন।

হেসে বলি–যদি না যাই।

–ভাল কথায় না এলে জোর খাটাবো। এখন মর্জি আপনার। পুলিশের গাড়ির পিছনের সিটে বসতে বসতে বললাম কি জন্য ডাকলেন?

জানি না। মনে হল তার মেজাজ ভাল নেই।

 –খুনীকে সনাক্ত করতে পেরেছেন?

–এখনো পারিনি। তবে চেষ্টা চলছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার ঘেঁষে গাড়ি থামে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ ফাঁড়ির পরিচিত ঘ্রাণ নিতে নিতে সিঁড়ি টপকে সুইং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকি।

ক্যান্ডি সতর্ক করে দেন সাবধানে পা ফেলবেন। ক্যাপ্টেন ক্ষেপলে বিপদে পড়বেন। তিনি একটা বন্ধ দরজার ঘা দেন। ঘুরিয়ে দরজা একটু খুলেই আমাকে ঠেলে দেন ভেতরে।

ধোঁয়াচ্ছন্ন ঘর। বিরাট টেবিলের ওপ্রান্তে বসে আছেন পর্বতসম মানুষটি। বয়স হয়েছে। তথাপি শরীরের কাঠামো বেশ শক্ত। কপালে ঝাঁপিয়ে পড়া চুল। মস্ত মুখে কঠোর হিংস্রতা।

দরজা ভেজিয়ে চলে যান ক্যান্ডি।

ব্রান্ডন? সিগারেটে জোরে টান মেরে বলেন ক্যাপ্টেন–আপনি আমাদের কাজে বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন। এই শহর ছেড়ে কখন চলে যাচ্ছেন?

জানিনা। আশা করি, এক সপ্তাহের মধ্যে!

–কি বললেন! এক সপ্তাহ ধরে কি রাজকাজ করবেন এখানে?

 –প্রকৃতি দেখবো। সাঁতার কাটবো। মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করবো।

–হ্যা! আপনি আর এই মার্ডার কেসে মাথা গলাবেন না, তাই তো?

–আমি সাগ্রহে লেফটেন্যান্ট র‍্যানকিনের তদন্তের উন্নতির দিকে তাকিয়ে আছি। আমার সাহায্য ছাড়াই কাজটা তিনি সমাধান করতে পারবেন, ভরসা আছে।

–সে আপনার সহজ–সরল স্বীকারোক্তি। তবে হত্যাকারীকে ধরতে পারলে পিষে

–তা আন্দাজ করতে পারি ক্যাপ্টেন।

–বটে? ছেলেমানুষি করবেন না। এই ধরনের কেসে মাথা গলিয়ে নিজের দুর্ভাগ্য ডেকে আনবেন না। বুঝেছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

হঠাৎ মুখ খিঁচিয়ে ওঠেন–আপনি শুধু জঘন্য বদমাইশই নন, ধোকাবাজ। এসব ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকুন, তাহলে হয়তো বাঁচতে পারেন। এ অফিসে ফের যদি আসেন তাহলে এমন অভিজ্ঞতা হবে জীবনে ভুলবেন না। মনে রাখবেন, ফের যদি বেচাল দেখি, একেবারে ফটকে পুরে দেবো। বদমাশদের পেঁদিয়ে ঠাণ্ডা করতে আমরা ভালই জানি। ক্যান্ডি…ক্যান্ডি–হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন তিনি, এই ধোঁকাবাজটাকে নিয়ে যাও, একে দেখলে আমার বমি আসে।

দরজা খুলে ক্যান্ডি ঢোকেন। ক্যান্ডির সাথে বেরিয়ে যেতে গিয়ে চকিতে থামি, ঘুরে প্রশ্ন করি–আচ্ছা, লী ক্রিডি কি আপনাকে বলেছে আমার সঙ্গে কথা বলতে?

ক্যাপ্টেনের হাত নিসপিস করে–তার মানে?

মিঃ ক্রিডি তার কাজের জন্য সিপ্পিকে ভাড়া করেন। কাজ করতে গিয়ে খুন হল সিপ্পি। ক্রিডি চান ব্যাপারটা চেপে যেতে। সম্ভবতঃ তিনি ভয় পাচ্ছেন। সাক্ষী হিসেবে কোর্টে তলব হতে পারেন। এবং প্রশ্ন উঠতে পারে কেন তিনি সিপ্পিকে ভাড়া করেছিলেন। এ নিয়ে তার সাথে কিছু কথাও হয় আমার। তিনি তার পোষা গুণ্ডা হার্জকে দিয়ে আমায় ভয় দেখান যাতে আমি আর জল না ঘোলা করি। আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি উনি সাবধান হয়েও হননি! আবার আমাকে শাসাচ্ছেন আপনাকে দিয়ে।

আঁৎকে ওঠেন ক্যান্ডি। ক্যাপ্টেনের চোখ মুখের রং বদলায়। চেয়ার ছেড়ে ধীরে দাঁড়ান–ও, এখনোবাকি আছে কিছু দেখছি দাঁত কিড়মিড় করে কথাগুলো বলেই সজোরেকষালেন একড়ে।

মারটা বেশ যুৎসই। ভার না সামলাতে পেরে মাটিতে সটান পড়ে যাই। আমাকে তিনি ওঠার সময় দেন। তারপর তার রক্তজমাট কালো মুখটা আমার মুখের কাছে এনে বলেন–বেরিয়ে যা ধোকাবাজ। পরক্ষণেই ফিসফিসিয়ে বলেন–মার আমাকে, মার।

আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল ঝেড়ে দিই এক ঘুষি। কিন্তু জানি, উনি চাইছেন আমি হাত ওঠাই। মারি। জানি ঘুষি নয়, আমি একটু শাসালেই মুহূর্তে আমায় ফটকে পোরা হবে। অগত্যা, স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

ক্যান্ডি ও ক্যাপ্টেন পরস্পরের দিকে তাকান। তারপর পিছু হটতে হটতে ক্যাপ্টেন চিৎকার করে বলেন–হতভাগাকে এখুনি দূর করে দাও। নইলে খুন করে ফেলবো।

ক্যান্ডি আমার কাঁধ খামচে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যান। দরজার বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। তার রক্তজমাট মুখ থেকে রাগ রিক্তি মিশ্রিত কটাকথা কানে আসে–আগেই সাবধান করেছিলাম। তবু গন্ডগোল পাকালেন। এখন জাহান্নামে যান।

সিঁড়ি ভেঙে পথে নামি।

.

০৩.

 সেন্ট রাফাইল সিটির শেষ প্রান্তেহতশ্রী সা কেবিন। সমুদ্রের খাড়ি থেকে যেন হঠাৎগজিয়ে উঠেছে স্টীলের স্তম্ভের ওপর কাঠের রেষ্টুরেন্টটি।

ছটা বাজতে পাঁচ।

পার্কিং জোন–এ গোটা তিরিশেক গাড়ি। যার মধ্যে একটাও ক্যাডিলাক কিংবা ক্লিপার নেই। সরু জেটি পেরিয়ে বার। জানলার ধারে, কোনের দিকে একটা টেবিলে গিয়ে বসি। ওয়েটার টেবিল মুছে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। অর্ডার দিই, এক বোতল ব্ল্যাক লেবেল, বরফ আর দুটো গ্লাস। ছটার কয়েক মিনিট পরে ঢোকে টিম ফাল্টন। পরনে সবুজ ব্যাগি ট্রাউজার ও বুকখোলা নীল জামা। জ্যাকেট ঝুলিয়েছে কাঁধে।

চারদিকে সে দৃষ্টি বোলায়। আমায় দেখে হাসে। এগিয়ে এসে বসে আমার টেবিলে–এই যে মশাই, শুরু করে দিয়েছেন। আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারলেন না?

বোতল খুলিনি এখনো। সহাস্যে বলিবসুন। তা, ছুটি পেয়ে কেমন লাগছে।

 –লোকটার কাছে এতদিন যে কি করে কাজ করলাম, তাই ভাবছি।

নখ দিয়ে বোতলের ছিপি খোলে টিম। দুগ্লাসে মদ ঢেলে আমি বরফ মেশাই। তারপর একগ্লাস এগিয়ে দিই।

আমরা গ্লাসে গ্লাস ঠেকাই। চিয়ার্স। চুমুক দিই গ্লাসে। সিগারেট ধরাই। পরস্পরের দিকে চেয়ে দেখি।

–ভাল কথা, মানুষটাকে কেমন দেখলেন, চমৎকার, তাই না? টিম প্রচ্ছন্ন কৌতুকে প্রশ্ন তোলে।

–হ্যাঁ, প্রকাণ্ড ঘর আর ঐ অন্তর্ভেদী চোখ। ঘেন্না লাগে ওর সঙ্গে কাজ করতে।

–আপনি একথা বলছেন ভাই! আমি একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছি অন্যত্র। দেখাশোনা করি এক বৃদ্ধার। বড় ভালোমানুষ বৃদ্ধা।

–বৃদ্ধার কথা পরে হবে, আচ্ছা, ঐ হার্জ লোকটা কেমন? টিম ভ্রূকুটি করে, –একি করছেন! মাটি করবেন নাকি সন্ধ্যেটা। ওকে নিয়ে পড়েছেন দেখছি আপনি।

না মানে, যখন যাই ক্রিডির সঙ্গে দেখেছি লোকটাকে। এমন ঝাঁপট মেরেছিল আমায় লোকটা! কে লোকটা? কি করে ঐ অদ্ভুত চরিত্রের সঙ্গে ক্রিডি নিজেকে খাপ খাওয়ান?

–হার্জ আগে গুণ্ডা ছিল। এখন ক্রিডির দেহরক্ষী ও কর্মী। এই এক রোগ বড়লোকদের। সর্বদা ভাবেন লোকে এই বুঝি তাকে গুলি করতে বা ছুরি মারতে আসছে।

–যতটা দেখায়, ততটা কি নিষ্ঠুর হার্জ?

মাথা নাড়ে টিম। –হ্যাঁ ঠিক ততটাই। কোন ফাঁকি নেই ক্রিডির নির্বাচনে।

তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে ক্যাপ্টেন ও হার্জের মধ্যে তো কোন ফারাক নেই। আমি প্রশ্ন করি–আজ সমুদ্রতীরে যে খুন হয়েছে, সে সম্বন্ধে কিছু পড়েছেন খবরের কাগজে?

সেই রকমই যেন সান্ধ্য কাগজে দেখলাম। এ প্রশ্ন হঠাৎ?

মৃত ব্যক্তি আমার পার্টনার। আমার মনে হচ্ছে কয়েকদিন আগে ক্রিডি তাকে ডেকে পাঠান। আপনি তাকে দেখে থাকবেন হয়তো।

ক্রিডি ডেকে পাঠিয়েছিলেন? উৎসাহিত হয়ে টিম বলে–তাহলে দেখেছি হয়তো। এ সপ্তাহের বেশির ভাগ আমি গেট–এ ডিউটি করেছি। তাকে কেমন দেখতে?

আমি নিখুঁত বর্ণনা দিই সিপ্পির! জানি যদি সিপ্পিকে টিম দেখে তাহলে ভুলবেনা। আমার ধারণা মিলে যায়। দ্বিগুণ উৎসাহে সে ফেটে পড়ে–হা, হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি তাকে। লম্বা চওড়া লাল চুল–লোগার পথ ছেড়ে দেয় তাকে, আমি ফটকের সামনে তখন তার নাম জিজ্ঞেস করিনি।

তাকে দেখেছেন, একথা স্বীকার করতে পারবেন? ধরুন, যদি আপনাকে সাক্ষী দিতে হয় কোর্টে?

শেষ মদটুকু গলাধঃকরণ করে বলল সে–আলবাৎ স্বীকার করবো। গত মঙ্গলবার এসেছিলেন।

এই–ই যথেষ্ট। গাড়ির কথায় চিত্রটা আরও স্পষ্ট হয়। তাহলে ঠিকই ধরেছি। ক্রিডির সাথে জ্যাক সিপ্পি দেখা করতে গিয়েছিল। কিন্তু কেন?

কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করে টিম–আপনি বললেন, খুন হয়েছেন!

–হ্যাঁ, পুলিশ ভাবছে কোন ঠগবাজ মেয়ের পাল্লায় পড়ে প্রাণ হারিয়েছিল। হতে পারে। উনি বড্ড বেশী পছন্দ করতেন মেয়েদের।

পুলিসের কাছে গেছিলেন?

–হ্যাঁ। ক্যাপ্টেন ক্যাচেন লোকটা যেন কেমন। তাই না?

–যা বলেছেন। ক্কচিৎক্রিডির সাথে দেখা করতে আসেন। বছরে অন্ততঃকরে চারেক। ক্রিডির ঝুট ঝামেলা সামলান বোধহয়। শুনলে অবাক হবেন, রাতে যত নাইট ক্লাব ও বেশ্যালয়গুলো খোলা থাকে। ক্যাচেন পরোক্ষভাবে সেগুলোর দেখভাল করেন।

–এসবের কি সম্পর্ক ক্রিডির সাথে?

–আরে। এ শহরের অধিকাংশই তার কেনা। এসব যারা চালায় ক্রিডি তো তাদের কাছে সরাসরি টাকা নিতে পারেন না, তাই ভাড়া আদায় করেন পরোক্ষভাবে। ক্যাচেনকে তার দরকার।

–তিনি বিবাহিত। না?

–কে? ক্রিডি? যদুর জানি, বিয়ে করেছিলেন চারবার। তার বেশিও হতে পারে। ব্রিজিৎ বদ তার বর্তমান স্ত্রী। তাঁকে কখনো দেখছেন? প্রাক্তন ফিল্মস্টার।

–একবার। সত্যি, দেখার মত।

–এখনো তাই। তবে তার সতীনের মেয়েকে তিনি দু–চোখে দেখতে পারেন না। আমি দু একবার দেখেছি মেয়েকে। ওহ, চোখ জুড়িয়ে যায়।

–তিনি কি বাড়িতেই থাকেন?

না। আগে ছিলেন। ঘরটা কেউই এখন ব্যবহার করেন না। যখনই বুড়ো ক্রিডি কোন পার্টি দেন, মেয়ে মর্গটই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর সম্মা ব্রিজিৎবাইরে থাকেন। অন্ধকারে, ঠাণ্ডায়, লোকচক্ষুর আড়ালে। ব্রিজিৎমর্গটের বনিবনা নেই। প্রায়ই ঝগড়া হত বলে, জিনিসপত্র নিয়ে মর্গট চলে যান। ফ্রাঙ্কলিন বুলেভার্ডের এক ফ্ল্যাটে থাকেন। সেই থেকে মেয়েকে হারিয়েছে বাপ। আমিও দেখতে পাইনি তাকে আর। ক্রিডির মত ব্রিজিৎ শুধুই বেদনা দিয়েছে আমাদের। চির অসুখী, সর্বদা প্রলাপ বকছেন, সারাদিন ঘুমোচ্ছন, সারারাত বিনিদ্র কাটাচ্ছেন।

টিম বলে যায় মিঃ ক্রিডির সাথে থেকে কেউই সুখীনয়। সর্বক্ষণ টাকার জন্য স্বামীর ব্যস্ততা বরদাস্ত করবে কোন স্ত্রী?

উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা?

মিসেসের বর্তমান প্রেমিক ঝাকড়া চুলের নাদুস নুদুস যুবক জ্যাকুইস ফ্রিসবি। ফ্রেঞ্চ ও কানাডার মিশ্র রক্ত তার শরীরে।

সহসা খেয়াল করি আমাদের টেবিলের দিকে কে যেন এগিয়ে আসছে। মুহূর্তের জন্য ভাবি হয়তো.ওয়েটার। খাবার আনছে। জানলার দিকে তাকাই আর তখনই ফাল্টনের শ্বাস টানার শব্দ। দেখি, টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হার্জ। আমার দিকে দৃষ্টি। তার পেছনে অর্ধবৃত্তাকার করে দাঁড়িয়ে চারজন লম্বা চওড়া, ভয়ঙ্কর গুণ্ডা ধরনের লোক। বন্ধ আমার পালাবার পথ। হার্জের ক্ষুদে ক্ষুদে চোখে হিংস্রতা। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নামলো হিমশীতল প্রবাহ।

হঠাৎ স্তব্ধ হল গুঞ্জন। সবকটা মাথা ঘুরে গেল। সবার দৃষ্টি শুধু আমার দিকে নিবদ্ধ। সঙ্গীন অবস্থা। আমার আর হার্জের মাঝে টেবিল। আমার চেয়ারের পেছনে দেওয়াল। গোলমালের গন্ধ পেয়ে অনেকেই নিঃশব্দে রেষ্টুরেন্ট ছেড়ে প্রস্থানের পথে। ছোট্ট টেবিল সামনে। হার্জের পেছনে কোন দেওয়াল নেই। চোখে পড়ে, ঘরের কোণে এক দীর্ঘকায় নিগ্রো। বার–এর পিছন দিক থেকে সামনে এসে দাঁড়ায়। জো লুইসের মত চেহারা। চওড়া ঠোঁটে ছদ্ম ক্ষমার হাসি। ক্ষিপ্র পায়ে সেই চার সাকরেদ দরজা পেরিয়ে হার্জের পাশে এসে দাঁড়ায়।

টেবিলের কোণা ধরে আমি আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছি। নরম স্বরে নিগ্রো বলে–বস্, এখানে গোলমাল করবেন না। যদি আপনাদের দুজনের মধ্যে কোনো বোঝাপড়ার দরকার থাকে, বাইরে গিয়ে করুন।

মাথা ঘুরিয়ে হার্জ নিগ্রোর দিকে তাকায়। চোখে সামান্য বিদ্যুৎ। ছারপোকা মনে হয় নিগ্রোটিকে। তড়িৎ হার্জের ডান মুষ্টি ছুটে যেতে দেখালাম। নিগ্রোর মুখে আঘাত হানে। প্রথমে টলে পিছিয়ে যায় সে। তারপর হাত–পা মুড়ে লুটিয়ে পড়ে।

চোখের নিমেষে ঘটে যায় সব।

টেবিলের দুই কোণা ধরে ছুঁড়ে দিই আমি। দুজন গুণ্ডা সমেত হার্জ পড়ে যায়। আমি লাফিয়ে উঠে চেয়ার তুলে নিই। চক্রাকারে ঘোরাই মাথার ওপর তুলে জায়গা ফাঁকা হয়। বেরিয়ে যাবার পথ পাই আমি। টিম একটা চেয়ার তুলেছে। কাছের একটা গুণ্ডার মাথায় সজোরে বসিয়ে দেয়। দড়াম করে পড়ে যায় গুণ্ডাটা। ওদিকে ষণ্ডা মার্কা লোক দরজা আটকে দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে একজন নিগ্রো। হার্জ ও তার নি সাগরেদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে। হার্জের মাথায় মেরে চেয়ারটা ভেঙেছে। লাঠির মত চেয়ারের দুটো পায়া আমার হাতে। এগুলো পশুর মত অতিকায় হার্জের বিরুদ্ধে নেহাতই নগণ্য।

দাঁত কিড়মিড় করে হার্জ। তার উদ্যত ডান হাত আঘাত করার আগেই আমি লাফিয়ে কাছে চলে আসি। মুখের মাঝামাঝি ঘুষি চালাই। জব্বর হয়েছে ঘুষিটা। মাথা টাল খায় হার্জের। সে সুযোগে পালাবার জন্য পা বাড়াই। অকস্মাৎ প্রবল বাঁ হাতের ধাক্কায় ফিরে আসি ফের হার্জের কাছে। হার্জের এক সাগরেদের কাছ থেকে এল মারটা।

চকিতে হার্জের কোমর জড়িয়ে ধরি আমি। তার একটা হাত কাঁধে তুলে নিয়ে, অর্ধেক ঘুরে, শূন্যে তুলে ছুঁড়ে দিই। আমার মাথার ওপর দিয়ে তার শরীর রকেট গতিতে মাটিতে আছড়ে পড়ে। সারা বাড়ি কেঁপে ওঠে।

ঘাড় ঘুরিয়ে ফাল্টনকে খুঁজি। সে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুমালে মুখ ঢাকা। কনুই থেকে হাতটা ঝুলছে। তার অপর বাহু আকর্ষণ করে বলি বাইরে যাই, চলুন।

হার্জের এক চ্যালা পথ আটকে দাঁড়ায়। আমার মাথা লক্ষ্য করে ছুটে আসে। তড়িৎগতিতে মাথা ঘুরিয়ে পাঁজরে প্রচণ্ড জোরে এক ঘুষি চালাই। সেইসঙ্গে লাথি কষাই পা লক্ষ্য করে। তারপর সেদিকে না তাকিয়ে টিমকে কোনরকমে টেনে নিয়ে দৌড়ই বেরুবার পথের দিকে।

বাইরে এসেও নিস্কৃতি নেই। সামনে সঙ্কীণ; দীর্ঘ জেটি। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে। শেষ প্রান্তে আলোকিত পার্কিং জোন।

টিম ভীষণ জখম। জ্ঞান হারাবার মত অবস্থা। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হার্জ দলবল সহ হাজির হবে।

টিম গোঙাতে থাকে–ছেড়ে দিন, এক পাও আর যেতে পারছি না। আপনি পালান ওরা ধরার আগে। ওর একটা হাত আমার মাথা ঘুরিয়ে কাঁধে রাখি। প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকি পার্কিং জোনের দিকে। হার্জ ছুটে আসছে জেটিতে। আমি টিমকে বলি দৌড়োন, ওদের আমি আটকাচ্ছি।

টিমকে ছাড়তে সে আপ্রাণ দৌড়ায়। ততক্ষণে হার্জ আমার মুখোমুখি। আমার পাশে ঘুরতে থাকে মুষ্ঠি যোদ্ধার ভঙ্গিতে। যেন শিকারের ওপর ঝাপানোর আগে বাঘের সতর্ক ভঙ্গি।

আমি স্থান বদলাই। এমনভাবে দাঁড়াই যাতে মাথায় ওপর দিয়ে আলো এসে লাগে হার্জের চোখে। ধন্ধ করছে তার রাগী চোখদুটো। আমি মাথা ঠাণ্ডা রাখি।

খ্যাপা বাইসনের মত ঘুষি বাগিয়ে তেড়ে আসে সে। আমি অল্প সরে দাঁড়িয়ে অব্যর্থ ঘুষি চালাই তার মুখে। হার্জের মাথাটা পেছন দিকে টাল খায়। সুযোগ বুঝে ডাইনে ঘুরে দ্বিতীয় আঘাত করি গায়।

আচমকা অনুভব করি আমার বাঁদিকে যেন হাতুড়ির ঘা পরে।

 পিছু হটে যাই দু–পা। হার্জ এগিয়ে আসে। এবার এক লাথি, সে ছিটকে পড়ে। পিছু ফিরে দেখি টিমকে দেখা যাচ্ছে না আর। এই সুযোগ, এবার পালাই। এক দৌড়ে পার্কিং জোন–এ আসতে কানে আসে ভারী কণ্ঠের ডাক–এই ব্রান্ডন, এদিকে আসুন।

দেখি গাড়ির মধ্যে টিম বসে আছে। সামনের সিটে উঠে গাড়ি ছেড়ে দিই। পেছনে, মাত্র কুড়ি গজ দূরে রাগে ফুঁসছে হার্জ। পার্কিং অঞ্চল ছেড়ে দুরন্ত বেগে গাড়ি ছোটাই। দু–পাশে সুদৃশ্য গাছপালা, নুড়ি বিছানো পথ গেছে বড় রাস্তায়। প্রধান সড়কে পড়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিই। পাঁচ মিনিটের মাথায় প্রার্থিত হাসপাতালের দরজায় গাড়ি থামাই। গাড়ি থেকে নেমে টিম বলে–এবার যেতে পারবো নিজে। আমি বোকা, পেটে কথা থাকেনা। সব খুলে বলেছি মাপনাকে।

–আমি দুঃখিত। আপনাকে এরকম পার্টি দেবার জন্য ডাকিনি। বিশ্বাস করুন। আমরা কেস করতে পারি হার্জের বিরুদ্ধে। সাক্ষী আছে অনেক।

–ঢের হয়েছে। আমি আর নেই এসবে। থাকলে বিপদে পড়ব। কালই মালপত্তর নিয়ে চলে যাবো এ শহর ছেড়ে। বহুৎ শিক্ষা হয়েছে। আর না।

অসহ্য যন্ত্রণায় নজ। টিম ফাল্টন এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ঢুকে যায়। আমি গাড়িতে উঠে হোটেলে করতে থাকি।

হোটেলে ফিরে স্নান শেষে বিছানায় শুলাম। মনে পড়ল, রাতের খাবার খাওয়া হয়নি। ক্লান্ত ক্ষুধার্ত লাগছে।

রুম সার্ভিসকে স্যান্ডউইচ, মাখন রুটি ও বরফ শীতল এক পাঁইট বিয়ারের অর্ডার দিলাম।

 শুয়ে শুয়ে ভাবছি সারাদিনের কর্মকাণ্ডের কথা। জানি, বাঘের গুহায় পা দিয়েছি। জানি না ততক্ষণ নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারব। তাছাড়া হার্জকে কায়দা করলেও ক্যাপ্টেনের সাথে কি এঁটে উঠবো? যে কোন মিথ্যা চার্জে লকআপে ভরে দেবে।

এভাবে চিন্তা করতে করতে উঠে, মর্গটের ফোন নম্বর খুঁজি টেলিফোন ডাইরেক্টরী খুলে। ফ্রাঙ্কলিন বুলেভার্ডে ফ্ল্যাট তার। এইতো পেয়েছি। বড় হরফে লেখা ফ্রাঙ্কেন আর্মস।

দরজায় করাঘাতের শব্দ শুনে দরজা খুলি। ওয়েটার উপস্থিত খাবার নিয়ে।

খাবার শেষ করে সিগারেট ধরাই। তারপর হোটেলের প্যাড থেকে কাগজ ছিঁড়ে জ্যাকের স্ত্রীকে চিঠি লিখতে বসি। সাড়ে দশটায় চিঠি লেখা শেষ হয়। চিঠিতে আমি তাকে স্বামী হারানোর জন্য ক্ষতিপূরণবাবদ এককালীন মোটা টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। জানি, এ নিয়ে দীর্ঘদিন তর্কাতর্কি করে বিশ্রীভাবে শেষে ভালরকম আদায় করবেন। আমাকে কখনোই পছন্দ করতেন না তিনি। যাই দিই, তিনি খুশী হবেন না।

কাগজটা খামে ভরে ঠিকানা লিখে ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখি আগামীকালের ডাকে দেব বলে। জ্যাকের জিনিষপত্র আমার ঘরে কেউ উঁই করে রেখেছে। কৌতূহলবশতঃ জ্যাকের সুটকেসগুলোয় একবার চোখ বুলিয়ে নিই যাতে আপত্তিকর কিছু না থাকে। যা পেয়ে জ্যাকের স্ত্রী হতাশ বা দুঃখিত হয়।

কয়েকটা ফটোগ্রাফ ও চিঠি পাই যা প্রমাণ করে গত কয়েক বছর ধরে জ্যাক স্ত্রীকে ঠকাচ্ছিল। সেই ছবি ও প্রেমপত্রগুলো নোংরা ফেলার বাক্সে ফেলে দিই।

তন্নতন্ন করে খুঁজেও আর কিছু পেলাম না। স্যুটকেসের গোপন খাপে হাত রাখতে উঠে এল একটি ম্যাচ–ফোল্ডার। নাইটক্লাব ও রেষ্টুরেন্টে এগুলো দেয় বলে কোথায় যেন বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। কালচে লাল সিল্কে মোড়া ম্যাচ–ফোল্ডারের ওপর সোনালি হরফে লেখা দ্য মাসকেটিয়ার ক্লাব ও তার ফোন নম্বর।

দুআঙুলের ফাঁকে দেশলাই বাক্সের মত ম্যাচ–ফোল্ডার নিয়ে ডিটেকটিভ গ্রীভসের কথা মনে পড়ে–এই শহরের সবচেয়ে বিত্তশালীদের ক্লাব। কি করে এই ফোল্ডার পেল জ্যাক? সেকি গেছিল ঐ ক্লাবে? তাকে যতটা জানি, ব্যবসায়িক কারণ ছাড়া বড়লোকদের ক্লাবে সে যাবে না।

 ফোল্ডার পেয়ে যেন মাটি পেলাম পায়ের নিচে। একটু চিন্তা করে, ঘর ছেড়ে এলিভেটর ধরে নিচে লবিতে নাবি।

গ্রীভস কাছে পিঠে আছে কিনা খোঁজ নিই রিসেপশনে। ক্লার্ক জানায়–এইমাত্র তার অফিসে গেলেন। নিচের ঘরে, ডানদিকে চলে যান। আপনার কি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে?

–ওহ এই চোখ, না। ওয়েটারকে স্যান্ডউইচ পাঠাতে বলতে, সে খাবার ছুঁড়ে মেরেছিল। তাই না, সেজন্য মনে কিছু করিনি। আমি এধরনের ব্যবহার পেতে অভ্যস্ত।

ক্লার্ক তো কথা শুনে হাঁ। আর আমি সোজা অফিসে। খোলা দরজায় পা দিতেই নজর পড়ে নাতিদীর্ঘ ঘরে ছোট্ট টেবিলে গ্রীভস বসে আছে।

–আপনার মুখের চেহারা কেউ বদলে দিয়েছে দেখছি। উৎসুকভাবে বলে গ্রীভস।

–হ্যাঁ। ম্যাচ ফোল্ডারটা টেবিলে ছুঁড়ে দিই চমকে ওঠে গ্রীভস। –এটা এল কোত্থেকে?

–সিপ্পির স্যুটকেস থেকে।

বাজি রেখে বলতে পারি। কখনই সেখানে যাননি উনি। উনি সেই শ্রেণীর লোক নন। তার অত পয়সা বা খুটির জোর ছিল না যে সেখানে প্রবেশাধিকার পাবেন।

–কেউ নিয়ে গেছিল হয়তো, সেটা সম্ভব তো।

হতে পারে। একজন সভ্যবা মেম্বারতার পছন্দের লোককেক্লাবেআনতে পারেন। তবেঅন্য মেম্বাররা তাকে কোন কারণে অপছন্দ বা আপত্তি করলে সে সভ্যের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে।

জ্যাক হয়তো এটা কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।

–শুনুন যারা ঐ মাসকেটিয়ার ক্লাবে যান, তারা কখনোই নিজেদের চাপাকলির মত আঙুল ক্লেদাক্ত করবেন না এরকম ম্যাচ ফোল্ডার ছুঁয়ে। ভয় পাবেন ওঁরা। নির্ঘাৎ–এ জিনিস রাস্তায় পড়ে ছিল। বিস্তর জীবাণু লেগে আছে। তবে আমার যা মনে হচ্ছে কেউ ঐ ক্লাবে যেতেন তা প্রমাণ করতে জ্যাককে সাথে নিয়ে গেছিলেন, হয়তো ব্যাপারটা স্রেফ বাজি রাখার খেলা।

–মেম্বারদের লিস্ট কোথায় গেলে পেতে পারি? গ্রীভসের মুখে বুদ্ধিদীপ্ত হাসি। কাঁপার্ডের আড়াল থেকে অবিকল এই রকম একটা ছোট বই বের করে বললেন–হোটেল রিজাৎ প্লাজার একটি হোটেল থেকে এটা পেয়েছি। রেখে দিয়েছি কোনদিন কাজে লাগবে ভেবে। যদিও দুবছর আগের ডেট লেখা আছে।

বইটা অবিকল ম্যাচবক্সের মত। লাল–জল সিল্কের ওপর সোনালী হরফে লেখা ক্লাবের নাম, ফোন নম্বর। –এটা পরে ফেরৎ দেবো। ধন্যবাদ বলে, পকেট বই ও ম্যাচ ফোল্ডার পকেটে রাখি।

–কে এই পাপ আপনার ঘাড়ে চাপিয়েছে?

কারোর দরকার নেই জানার। বলে, বেরিয়ে আসি। লাউঞ্জে যেতে যেতে বই–এর পাতা ওল্টাই। পাঁচশ জন সভ্যের নামধাম লেখা। তার মধ্যে আমার কাছে চারশো সাতানব্বই জন অর্থহীন। বাকি তিনজন… মিসেস ব্রিজিৎ ক্রিডি, মিঃ জ্যাকুইস ফ্রিবি এবং মিস্ মর্গট ক্রিডি।

মাথার মধ্যে অসংখ্য ঝিঁঝির ডাক। তার মধ্যে হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকে ওঠে। মাল নিয়ে কুলি যাচ্ছিল। তাকে ডেকে বলি–ও ভাই, ফ্রাঙ্কলিন অ্যাভিনিউ কোথায় বলতে পারেন?

–ডান দিকে গিয়ে দ্বিতীয় রাস্তা ধরুন। তারপর বাঁদিকে প্রথম সিগন্যালের পাশের রাস্তা।

ধন্যবাদ জানিয়ে, নিজের গাড়ির দিকে এগোই।