দি ওয়ার্ল্ড ইন মাই পকেট
০১.
ওরা চারজন–তাস খেলার গোল টেবিলটাকে ঘিরে বসে আছে।
পোকার খেলার প্লাস্টিকের চাকতি টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে। দুটো অ্যাসট্রে, পোড়া সিগারেটের টুকরোয় ঠাসা। এক বোতল হুইস্কি আর তার পাশে চারটে শূন্য কাঁচের গেলাস।
আধো–আধারিতে ঘরটা ঢাকা। শুধু মাথার ওপরে ঝোলানো একটা শেড দেওয়া আলো টেবিলের একটা বৃত্তাকার অংশকে সবুজ আলোয় আলোকিত করে তুলেছে। সিগারেটের সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী সেই সবুজাভ আলোর বৃত্ত ছাড়িয়ে অন্ধকারের উদ্দেশ্যে ভেসে চলেছে।
চারজনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দশাসই চেহারার লোকটা তার হাতের চারটে তাস টেবিলে চিত করে নামিয়ে রাখলো। তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে ভাবলেশহীন মুখে অন্য তিনজনের দিকে তাকালো। তার ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা টেবিলের ওপর চঞ্চল হয়ে উঠলো। আঙুলের টোকায় এক বিচিত্র ছন্দময় শব্দের সৃষ্টি হলো।
কিছুক্ষণ অন্য তিনজন স্থিরভাবে বসে রইলো। তিন জোড়া চোখই টেবিলের উপর পড়ে থাকা চারটে সাহেবের দিকে নিবদ্ধ। অবশেষে বিরক্তিভরে তারা নিজেদের তাসগুলো ছুঁড়ে ফেললো।
ফ্র্যাঙ্ক মরগ্যানের চঞ্চল, শীতল চোখের তারা আরো চঞ্চল হয়ে উঠলো। বিজয়ীর হাসি পাতলা ঠোঁটে ফুটে উঠলো! সে হাসি বুঝি ধূর্ত নেকড়ের হাসির মতোই তুলনীয়।
জিপো, আরো একবার তাহলে আমার কাছে তোমাদের হারতে হলো? –তার বিপরীত দিকে বসে থাকা জিশেপ ম্যানডিনির দিকে তাকিয়ে মরগ্যান কৌতুকভরে প্রশ্ন করলো।
জিশেপ ম্যানডিনির কালো কোঁকড়ানো চুলে রগের কাছে সামান্য পাক ধরেছে। ছোট তীক্ষ্ণ নাক। গায়ের রঙ বাদামী। সে মরগ্যানের কথায় ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি বের করে বিষণ্ণভাবে হাসলো। তারপর অস্বাভাবিক স্থূলকায় শরীরটাকে সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে তার প্লাস্টিকের চাকতিগুলো ঠেলে দিলো মরগ্যানের দিকে, আমি আর নেই। ফ্র্যাঙ্ক! আমার ভাগ্য–টাগ্য সব খরচের খাতায় জমা পড়ে গেছে। শালা সন্ধ্যে থেকে একটা নওলার বেশী কোনো তাস পেলাম না।
এডওয়ার্ড ব্লেক মরগ্যানের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিজের চাকতিগুলোর দিকে তাকালো। আলতো করে আঙুল চালালো সাজানো চাকতির ওপর। তারপর চারটে চাকতি টোকা মেরে এগিয়ে দিলো মরগ্যানের দিকে। তার মুখ নির্বিকার।
সুদর্শন এডওয়ার্ড ব্লেক লম্বা, সূর্যস্নাত দেহের রং ঈষৎ বাদামী। তার সৌন্দর্যের আতিশয্য মহিলাদের কাছে আকর্ষণীয় হলেও পুরুষের মনে জাগিয়ে তোলে সতর্কতার সংকেত। ব্লেকের পরনে ধূসর–রঙা স্যুট, গায়ে সবুজ টাইয়ের ওপর হলুদ রঙে আঁকা সোয়ালো পাখির ছবি।
চারজনের মধ্যে তার বেশবাসই একমাত্র চোখে পড়ার মতো।
আলেক্স কিটসন, চারজনের চতুর্থ জন। বয়েস তেইশ হবে। বলিষ্ঠ চেহারা, কঠিন চোয়াল, নাকটা মুষ্টিযোদ্ধাদের মতোই চ্যাপ্টা, কালো চোখে সতর্ক ভাব। তেইশ বছরের সরলতা তার মুখ থেকে মিলিয়ে গেছে।
বুক–খোলা শার্ট কিটসনের গায়ে আর পরনে সস্তা মোটা সুতীর–প্যান্ট। সে তার চাকতিগুলো ঠেলে দিয়ে মুখভঙ্গী করলো, আমিও আর নেই। ভেবেছিলাম দানটা জিতে যাবো। শালা চারটে বিবি পড়েছিলো, কিন্তু…কথা শেষ না করেই থেমে গেলো কিটসন। তার নজরে পড়লো ব্লেক এবং জিপো তাকিয়ে মরগ্যানকে লক্ষ্য করছে। কিটসনের কথা ওদের কানেও ঢুকছে না।
জিপো, ব্লেক এবং কিটসনের এগিয়ে দেওয়া চাকতিগুলোকে মরগ্যান তিনটে ভাগে সাজিয়ে ফেলেছে। তার পাতলা ঠোঁটে একটা জ্বলন্ত সিগারেট।
খুশিমতো চাকতিগুলোকে সাজানো হয়ে গেলে মরগ্যান তাকালো, শীতল চোখজোড়া তাদের মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
সইতে পারলো না ব্লেক। অধৈর্যভাবে বলল–ফ্র্যাঙ্ক, তোমার মতলবটা কি, খুলে বলো তো? সেই থেকে দেখছি কিছু বলার জন্য চেষ্টা করছে!
তারপর হঠাৎই প্রশ্ন করলো, দু–লাখ ডলার করে পেলে তোমরা নিতে রাজী আছ?
তিনজনেই চমকে উঠলো। কারণ মরগ্যানকে ওরা চেনে। ওরা জানে মরগ্যান ঠাট্টা করে না করেওনি।
জিপো আগ্রহে ঝুঁকে এলো। প্রশ্ন করলো, কি বললে?
প্রত্যেকে দুলাখ করে। মরগ্যান জোর দিলো, টাকাটা বলতে গেলে আমাদের নাকের ডগায়, কিন্তু কাজে ঝুঁকি আছে।
পকেট থেকে ব্লেক এক প্যাকেট সিগারেট বের করল। একটা সিগারেট বের করে তাকালো মরগ্যানের দিকে। প্রশ্ন করলো, মোট টাকার পরিমাণ আট লক্ষ ডলার?
না, দশ লাখ, এবং টাকাটা ভাগ হবে পাঁচ ভাগে–অর্থাৎ তোমরা যদি আমার সঙ্গী হও।
পাঁচ–ভাগ! পঞ্চম ব্যক্তিটি কে? জানতে চাইলো ব্লেক।
পরে আসছি সে কথায়, কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো মরগ্যান। তার ফ্যাকাশে মুখমণ্ডল সুপ্ত উত্তেজনায় টলমল।
দশ লাখ ডলার! জিপো তখনও অবাক বিস্ময়ে মরগ্যানের দিকে তাকিয়ে
ক্ষুধার্ত হায়নার মতো মরগ্যান হাসলো।
ফ্র্যাঙ্ক, তুমি কি রকেট রিসার্চ স্টেশনের সাপ্তাহিক মাইনের কথা বলছো? –ব্লেক আচমকা প্রশ্ন করলো। .
মরগ্যান মুখে বিজ্ঞের হাসি হেসে ব্লেকের কথায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলে, তোমার বুদ্ধি আছে, এড। হ্যাঁ আমি ঐ টাকার কথাই বলছি।
মরগ্যান কিটসনের দিকে তাকালো, কিটসনের দু–চোখের তারায় হতচকিত শূন্য দৃষ্টি।
কি হলো, আলেক্স, একেবারে বোবা হয়ে গেলে তো!
আলেক্স বললো, তুমি কি পাগল হয়েছে, ফ্র্যাঙ্ক!
মরগ্যান প্রশ্ন করলো ব্লেককেই, তুমি কি বল এড, কাজটা আমাদের পক্ষে অনুচিত হবে?
ব্লেক সিগারেট ধরালো। একমুখ ধোয়া ছেড়ে তাকালোমরগ্যানের দিকে, টাকার ওজন যতোই হোক না কেন, এ ধরনের কাজে অন্ততঃ আমি হাত দিতাম না ফ্র্যাঙ্ক।
এই হচ্ছে এডওয়ার্ড ব্লেক, সমস্ত ঘটনা না জেনে কোনরকম মতামত প্রকাশে সে রাজী নয়।
জিপো তার স্থূলকায় শরীরটাকে টান টান করে সোজা হয়ে বসলো। কিটসনের থেকে চোখ সরিয়ে মরগ্যানের দিকে তাকালো। অস্বস্তির সঙ্গে প্রশ্ন করলো, কাজটার গণ্ডগোলটা কোথায়?
সে প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে হাত তুলে কিটসনের দিকে, তুমিই বলল, আলেক্স। তোমারই তো জানার কথা। তুমি কিছুদিন চাকরিও তো করেছিলে সেখানে।
কিটসন নিস্পৃহস্বরে বললো, হ্যাঁ করেছিলাম সুতরাং আমি জানি–এবং ভাল ভাবেই জানি। মাসের পর মাস প্রত্যেকেই এই রকেট রিসার্চ স্টেশনের টাকাকে সযত্নে এড়িয়ে গেছে। কেন জানো? কারণ তারা সকলেই সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন বুদ্ধিমান লোক। আমাদের মতো নির্বোধ এবং উন্মাদ নয়।
না, আমি ঠাট্টা করছিনা। ফ্র্যাঙ্ক জানে। ওয়েলিং আর্মার্ড ট্রাক এজেন্সীর প্রতিটি ভাজে লুকিয়ে রয়েছে বিপদের অশুভ সংকেত।
গালে হাত ঘষে জিপো ভুরু কুঁচকে বললো, তুমি নিশ্চয়ই কিছু বলতে পারবে ফ্র্যাঙ্ক?
মরগ্যান জিপোর কথা কানে তুললো না। কিটসনের দিকে তাকিয়ে, থামলে কেন, আলেক্স? বলে যাও–ওদের জানিয়ে দাও এ কাজে কতোটা ঝুঁকি!
আমি ঐ এজেন্সীর চাকরি যখন ছেড়ে দিই, সেই সময়ে ওরা একটা নতুন ধরনের ট্রাক আমদানি করে। হঠাৎ কিটসন মুখ খুললো। তার আগে ওরা যে ট্রাকটা ব্যবহার করতো, নতুন ট্রাকটার তুলনায় সেটাকে একটা রদ্দি টিনের বাক্স বললেও অত্যুক্তি হয় না। এবং তাতে থাকতে সশস্ত্র চারজন রক্ষী। তারা তীক্ষ্ণ নজরে টাকার বাক্স পাহারা দিত। কিন্তু, এই নতুন ট্রাকের মজাটা কি জানো? কিটসন মুচকি হাসলো। সে হাসিতে বুঝি সামান্য ইঙ্গিত যে, কোনো সশস্ত্র রক্ষীর প্রয়োজন এ ট্রাকে নেই। তার ওপর, কোম্পানী এই ট্রাকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে এতোই নিশ্চিন্ত যে ট্রাকে আগের মতো ইনসিওর করার কথাও ওরা আর ভাবে না!
মরগ্যান বললো, তাহলে ট্রাকটার কিছু বিশেষত্ব আছে, কি বলো?
কিটসন কিছুটা অস্বস্তি হলেও সে মরগ্যানের কাছে প্রমাণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে কাজটা তাদের পক্ষে অসম্ভব।
কিন্তু তবুও এ কাজে সে মন থেকে সাড়া দিতে পারছে না।
মরগ্যান, ব্লেক, জিপো, কিটসন–ওরা চারজন গত ছমাস আগে জোট বেঁধেছে; এবং এর মধ্যেই ছোটখাটো বেশ কয়েকটা কাজ নির্বিঘ্নে গুছিয়ে নিয়েছে।
কিটসন বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, দশ লাখ ডলার তো দূরের কথা, তুমি ঐ ট্রাকের, ধারে কাছেও পৌঁছতে পারবেনা। ফ্র্যাঙ্ক, কিটসনের স্বরের দৃঢ়তায় কেঁপে উঠলো, একটা নতুন ধরনের সঙ্কর ধাতুর চাদর দিয়ে ঐ ট্রাকটা তৈরী। বাইরে থেকে সেই ধাতব দেওয়াল কেটে ভেতরে ঢোকা অসম্ভব। হয়তো অ্যাসিটিলিন টর্চ ব্যবহার করলে সে দেওয়ালকে গলানো যেতে পারে। কিন্তু তাতেও সময় লাগবে এক সপ্তাহ। দ্বিতীয়তঃ ট্রাকটার দরজায় লাগানো আছে একটা সময়–নির্ভর তালা। ট্রাকে টাকা বোঝাই করার পর ওরা দরজায় তালা দিয়ে দেয়। তুমি তো জানো, এজেন্সী থেকে রিসার্চ স্টেশনে পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। সুতরাং সেই সময় নির্ভর তালাকে এমন যান্ত্রিক উপায়ে বন্ধ করা হয়, যাতে চার ঘণ্টার জন্য সেই তালা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়বে। কেবলমাত্র চার ঘণ্টা পরেই সেই অদ্ভুত তালাকে ভোলা যাবে। বুঝতেই পারছো, ড্রাইভারের সুবিধের জন্যই একঘণ্টা বেশী দেওয়া হয়।
তাছাড়া বোতাম টিপলে ঐ সময় নির্ভর তালা চিরতরে বন্ধ হয়েই থাকবে। চার ঘণ্টা কেন চার বছর অপেক্ষা করলেও সে তালা খুলবে না। হ্যাঁ, উপায় একটা আছে–তবে সে কাজ যে সে লোকের নয়। একজন রীতিমতো দক্ষ কারিগরের পক্ষেই সে তালা খোলা সম্ভব। শুধু এই নয়, আরো আছে। এতোসব বন্দোবস্ত সত্ত্বেও সবসময় ওদের সঙ্গে থাকে একটা শর্টওয়েভ ট্রান্স মিটার। এজেন্সী থেকে ট্রাক বেরোনো মাত্র ট্রাক ড্রাইভার ও এজেন্সীর সঙ্গে চলে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে কথোপকথন এবং সেই যোগাযোগ বন্ধ হয় একেবারে রিসার্চ ষ্টেশনে ট্রাক পৌঁছানোর পর।
আচ্ছা, ড্রাইভার আর রক্ষীটাকে কোনরকমে কায়দা করা যায় না? মরগ্যান কিটসনকে বললো।
কিটসন জোরালো ভাবে হাত নাড়লো, কায়দা? ওদের সঙ্গে? তুমি কি পাগল হয়েছ, ফ্র্যাঙ্ক? কে তোমাকে বলেছে যে ওদের কায়দা করা এতোই সহজ?
কুৎসিত ক্রোধে মরগ্যানের চোখ ঝলসে উঠলো, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছি। আলেক্সজ্ঞান দিতে বলিনি। আমি পাগল হয়েছি কিনা সেটা আমি বুঝবো। বেশী মুখ না ছুটিয়ে কথার জবাব দাও!
ব্লেক মরগ্যানকে চটতে দেখে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো, রাগ করো না, ফ্র্যাঙ্ক। ছোকরার কোন দোষ নেই। ও যতটুকু জানে ততটুকু বলছে। তাই বলে ওর চিন্তাধারার সঙ্গে আমাদের মিল থাকতে হবে, তার কি মনে আছে?
মাথা নেড়ে মরগ্যান বললো, ঠিক আছে এড, আগে আলেক্সের কথাই তাহলে শেষ হোক। বলো হে ছোকরা ঐ ড্রাইভার আর প্রহরীকে কাবু করতে অসুবিধেটা কোথায়?
ততক্ষণে আলেক্স কিটসন ঘামতে শুরু করেছে। মরগ্যানের দিকে কঠিন চোখে চেয়ে কিটসন বলতে লাগল, আমি একসময় ওদের সঙ্গে কাজ করেছি। ওদের আমি ভালমতই চিনি। ড্রাইভারের নাম ডেভ টমাস, আর বন্দুকবাজ প্রহরীর নাম মাইক ডার্কসন। ওরা দুজনেই রিভলবার চালাতে ওস্তাদ, এবং বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ ওদের চোখের নজর। এ ছাড়া ঐ ট্রাক লুটের যে কোন পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করতে পারলেই ওরা প্রত্যেকে পাবে দু-হাজার ডলার করে, পুরস্কার। ওরা জানে, কারো পক্ষেই ট্রাকের তালা ভেঙে ঐ দশ লাখ ডলার হাতানো সম্ভব নয়। সুতরাং ওরা যে টাকার লোভে আমাদের দলে যোগ দেবে সেরকম সম্ভাবনাও কম। অর্থাৎ ডেভ টমাস ও মাইক ডার্কসন আমাদের পথে এক শক্ত বাধা।
হঠাৎ কিটসনকে বাধা দিয়ে জিপো বলে উঠলো, ওরে বাবা! এতো ঝামেলা থাকলে ও টাকায় আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
মরগ্যান জিপোর কথায় হাসলো। তালা খোলার ব্যাপারে জিপো পয়লা নম্বরের ওস্তাদ। তার পেশাদার অভিজ্ঞ আঙুলের কাছে পরাজিত না হয়েছে এমন তালা পৃথিবীতে নেই। তবে এ পর্যন্ত যত তালা জিপো খুলেছে, সবই নিজের খুশিমতো, ধীরে সুস্থে ঠাণ্ডা মাথায়। কখনো তাকে তাড়াতাড়ি খোলার জন্যে চাপ দেওয়া হয়নি। সে যেমন ভালো বুঝেছে সে ভাবেই খুলেছে। কিন্তু মরগ্যান জানে, এবারের কাজটায় জিপোকে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করতে হবে। তাই মরগ্যান চিন্তিত। জিপো কি পারবে সফল হতে! অবশ্য ওকে বলে কয়ে রাজী করানো যাবে। কারণ জিপো কখনোই তার কথা ঠেলতে পারে না। কিন্তু তাতে লাভ হবে কতোটুকু? যখন সময় আসবে জিপোর আসল অগ্নি পরীক্ষার, তখন সমস্ত কিছুই নির্ভর করবে শুধুমাত্র জিপোর দক্ষতার ওপর। মরগ্যানের কথায় কিছুই যাবে আসবে না। তখন যদি জিপো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তাহলে তাদের সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে মিলিয়ে যাবে করুণ হতাশায়।
মরগ্যান জিপোর কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিলো, চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই জিপো। যেদিন থেকে আমরা চারজন এক হয়েছি, তোমাদের সমস্ত দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছি, তোমাদের যুৎসই কাজের সন্ধান দিয়েছি, তোমাদের পরিচালনা করেছি–তাই তো?
ঘাড় নেড়ে কিটসন সম্মতি জানালো। কিটসন ও ব্লেক অপলকে তাকিয়ে মরগ্যানের দিকে।
কাজগুলো খুব বড় ছিল না বটে, কিন্তু মোটামুটি তোমরা প্রত্যেকেই বেশ কিছু করে টাকা পেয়েছ। কিন্তু আজ হোক কাল হোক, আমাদের ওপরে পুলিশের নজর পড়বেই। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমরা এইসব ছোটখাটো লুটপাট চালিয়ে যেতে পারি না। তাতে টাকাও আসবে কম, এবং পুলিশের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনাও বেশী। তাই বেশ কিছু আয় করতে হবে তাড়াতাড়ি।
যা বলছিলাম আলেক্স এ কথা একবারও বলেনি যে, ট্রাকটা গত পাঁচ মাস ধরে প্রতি সপ্তাহেই টাকা আনা নেওয়া করছে। এবং প্রত্যেকেই ট্রাকটাকে দুর্ভেদ্য বলে মেনে নিয়েছে। যথা–আমাদের আলেক্স কিটসন। ওর মতো আরো অনেকেরই ধারণা, ওই ট্রাকটাকে লুঠকরার চিন্তা পাগল হওয়ার পূর্বলক্ষণ। এ ধরনের কোনো বদ্ধমূল ধারণাকে নাছোড়বান্দার মতো আঁকড়ে বসে থাকা মানেই প্রতিদ্বন্দীর কাছে নিজেকে অরক্ষিত করা। তারপর প্রয়োজন শুধু একটা ক্ষিপ্র রাইট হুকব্যস! চতুর সুযোগ সন্ধানী প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে নির্বোধ মুষ্টিযোদ্ধার শোচনীয় পরাজয়।
ইচ্ছে করেই মরগ্যান কিটসনকে ঠেস দিয়ে উদাহরণ দিল মুষ্টিযোদ্ধার, কারণ জিপোর মতো কিটসনকেও তার নিজের দলে টানা দরকার। এখন সে ভাবটা আগের চেয়ে অনেকটা কমে এসেছে। করানোর এই সুবর্ণসুযোগ। সুতরাং সে বলে চললো, আলেক্স তোমাদের যা যা বলেছে সবই আমি খবরের কাগজে মাস কয়েক আগে পড়েছি। ওয়েলিং কোম্পানী এই বিশেষ ট্রাকটা নিয়ে প্রচারের লোভটুকু পর্যন্ত সামলাতে পারেনি। যাকগে, যা বলছিলাম–যেদিন থেকে ঐ ট্রাকটার কথা আমি কাগজে পড়েছি, সেদিন থেকেই ওটাকে লুঠ করার চিন্তা আমার মাথায় ঢুকেছে। আমাদের পক্ষে কাজটা মোটেও অসম্ভব নয়।
সিগারেটের টুকরোটাকে ব্লেক টেবিলে ঘষে নিভিয়ে ফেললো এবং পরক্ষণেই অভ্যস্ত হাতে ধরিয়ে ফেললো আর–একটা। তার চোখজোড়া মরগ্যানের মুখে স্থির।
অর্থাৎ এই বক্তব্যের স্বপক্ষে তোমার কোনো জোরালো পরিকল্পনা আছে?
হ্যাঁ, আছে। মরগ্যান সিগারেট ধরিয়ে শান্তভাবে ধোঁয়া ছাড়লো। আবছা সবুজাভ ধোঁয়া ভেসে চললো। বিপরীত দিকে বসে থাকা জিপোর দিকে। –মোটামুটি একটা পরিকল্পনা আমি ছকে রেখেছি। কিন্তু সেটাকে বার বার যাচাই করে নিখুঁত করতে হবে। তাছাড়া আমরা পরিকল্পনাটা নিয়ে ভাববার সময়ও পাবো যথেষ্ট। কারণ এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে ট্রাকটা রকেট রিসার্চ স্টেশনের মাইনের টাকা নিয়ে যাবে। আর এইভাবে যতই দিন যাবে, ওরা ততই নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে অসাবধানী হয়ে পড়বে। তারপর ঝোঁপ বুঝে কোপ মারলেই কাজ হাসিল।
কিটসন আর সহ্য করতে পারলো না। সামনে ঝুঁকে কর্কশ স্বরে বললো, থামো, ফ্র্যাঙ্ক। গাঁজায় দম দিয়ে আর উল্টো–পাল্টা বকো না। একটা বোতাম টিপতে কত সময় লাগে জানো? কোন লোক যদি ঘুমিয়েও থাকে, তাহলে জেগে উঠে বোতাম টিপতে তার দু সেকেন্ডের বেশী সময় লাগতে পারে না। অর্থাৎ তিনটে বোতাম টিপতে মাত্র ছ সেকেন্ডব্যস। তারপরই ট্রাকটা হয়ে দাঁড়াবে একটা ইস্পাতের চৌকো বাক্স আমাদের কফিনের শেষ পেরেক। তোমার কি ধারণা মাত্র ছ–সেকেন্ডের মধ্যেই ট্রাক থামিয়ে দরজা খুলে টমাস আর ডার্কসনকে তুমি কাবু করতে পারবে? হু–উর্বর মস্তিষ্ক ছাড়া ও ধরণের দিবাস্বপ্ন দেখা অসম্ভব।
মরগ্যান ঠাট্টার সুরে বললো, তোমার তাই মনে হয় বুঝি?
মনে হয় না। আমি নিশ্চিতভাবে জানি বলেই বলছি। ট্রাক থামিয়ে তার দিকে এক পা এগোনোর আগেই পুরো ট্রাকটা ঢাকা পড়ে যাবে ইস্পাতের চাদরে, সময়–নির্ভর তালা হয়ে যাবে ওলট–পালট। ট্রান্সমিটারে শুরু হবে সাহায্য প্রার্থীর অবিরাম বিপদ–সংকেত।
মরগ্যান কপট বিস্ময়ে ভুরু উঁচিয়ে বললো, সত্যি বলছো, আলেক্স?
কিটসনের ইচ্ছে হলো সপাটে একখানা ঘুষি মরগ্যানের নাকে বসিয়ে দেয়।
হা–সত্যি। তুমি যতই বলল না কেন, এই অসম্ভব ব্যাপারটাকে আমি কোনরকমেই বিশ্বাস করতে রাজী নই।
অনেক হয়েছে আলেক্স। জ্ঞানদানের কাজটা তুমি ভালই পারো দেখছি। তা, এখানে না এসে পাদ্রীগিরি করলেই পারতে।
কিটসনের মুখ লাল হয়ে উঠলো অপমানে। রাগতভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। গম্ভীরভাবে একবার ব্লেককে আর একবার মরগ্যানকে দেখতে লাগলো। অবশেষে সংক্ষিপ্তভাবে সে বললো, ঠিক আছে। কিন্তু, আমি আবারও বলছি, কাজটা অসম্ভব।
ব্লেক সপ্রশ্ন দৃষ্টি মেললো মরগ্যানের দিকে, এবারে ঝেড়ে কাশে, ফ্র্যাঙ্ক।
মরগ্যান বললো, গতকাল আমি এজেন্সী থেকে রিসার্চ স্টেশন পর্যন্ত গিয়েছিলাম। গাড়ির মাইলমিটার অনুসারে দুটো জায়গার দূরত্ব ঠিক তিরানব্বই মাইল। তিরানব্বইয়ের মধ্যে সত্তর মাইল বড় রাস্তা, দশ মাইল সাধারণ রাষ্য, দশ মাইল একটা নির্জন কাঁচা সড়ক এবং শেষ তিন মাইল রিসার্চ ষ্টেশনের নিজস্ব রাস্তা যে রাস্তা ধরে সোজাসুজি রিসার্চ ষ্টেশনে পৌঁছানো যায়। আমি ট্রাকটাকে থামাবার জন্য একটা উপযুক্ত জায়গা খুঁজছিলাম। সুতরাং প্রথমেই বড় রাস্তা এবং দশ মাইল সাধারণ রাস্তাকে একেবারে বাদ দিতে হয়। কারণ ঐ দুটো রাস্তায় লোজন এবং যানবাহনের ভিড় বড্ড বেশী। রকেট রিসার্চ স্টেশনের নিজস্ব রাস্তাটায় দিনরাত সশস্ত্র প্রহরা থাকে। সুতরাং হাতে রইলো দশ মাইল লম্বা কাঁচা সড়কটুকু।
মরগ্যান সিগারেটের ছাই ঝাড়লো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তিনজনকে দেখলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, সাধারণ রাস্তা থেকে কাঁচা সড়ক ধরে চার মাইল গেলে দশ নম্বর জাতীয় সড়কে যাবার সর্টকাট রাস্তা। এই রাস্তাটাই রিসার্চ স্টেশন হয়ে দশ নম্বর রাস্তায় মিশেছে। এই কারণে অনেক গাড়িই এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। এই রাস্তাটা কাঁচা সড়কের মতো খারাপ নয়। কিন্তু রিসার্চ স্টেশনের মাইল দুয়েক আগে একটা বিপজ্জনক বাঁক আছে; দুটো বিশাল পাথর দু–পাশ থেকে এগিয়ে এসে রাস্তাটার প্রস্থকে প্রায় অর্ধেক করে দিয়েছে। পাথর ছাড়াও জায়গাটা ছোট–বড় ঝোপে ছেয়ে আছে। অর্থাৎ আত্মগোপন অথবা মোটর দুর্ঘটনার পক্ষে আদর্শ জায়গা।
মরগ্যানের কথায় ব্লেক সমর্থন জানালো, ঠিক বলেছো, ফ্র্যাঙ্ক। একবার ঐ রাস্তায় আমিও শালা আরেকটু হলেই গিয়ে ছিলাম আর কি! একটু অসতর্ক হলেই খেল খতম! –এমনি অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে এখন ওখানে পথ–নির্দেশ লাগানো হয়েছে।
হ্যাঁ, দেখেছি জানালো মরগ্যান, আচ্ছা, এবার ট্রাকে বসে থাকা টমাস, ডার্কসনের অবস্থাটা ভেবে দেখা যাক। এখানকার যা আবহাওয়া তাতে ঐ বদ্ধ ট্রাকে গরম হবে অসহ্য। তা ছাড়া যাতায়াত করার ফলে ওদের রাস্তার সমস্ত খুঁটিনাটি মুখস্থ হয়েছে। এককথায় বিরক্তি, ক্লান্তি এবং একঘেয়ামী ট্রাকভ্রমণের যন্ত্রণা হবে নিত্যসঙ্গী। মনে কর ওরা পৌঁছলে বিপজ্জনক বাঁকের মুখে। মোড় ঘুরেই ওরা দেখতে পাবে অভাবনীয় দৃশ্য। একটি গাড়ি পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে রাস্তার ধারে উল্টে পড়ে আছে, গাড়ির অবস্থা শোচনীয়। আর রাস্তার ঠিক মাঝখানে ভেসে যাওয়া রক্তের সমুদ্রে পড়ে আছে সুন্দরী যুবতী। তার সর্বাঙ্গ রক্তে ভেজা। জামাকাপড়ের অবস্থাও তথৈবচ। আচমকা ব্লেকের মুখের সামনে ঝুঁকে এলো মরগ্যান। আস্তে হিসহিস করে উঠলো, এখন, একটা কথা আমি জানতে চাই এড, টমাস ও ডার্কসন এ অবস্থায় কি করবে? মেয়েটাকে চাপা দিয়ে যাবে, না নেমে দেখবে মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা, না আহত হয়েছে?
দাঁত বের করে শয়তানের হাসি হাসলো ব্লেক। তাকালো কিটসনের দিকে, কি হে স্বামী জ্ঞানানন্দ, শুনছো তো? উর্বর–মস্তিষ্কের দিবাস্বপ্ন কি বলো?
ওরা কি করবে? বলল, মরগ্যানের প্রশ্নে কিটসন নড়েচড়ে বসলো। তার মুখে পরাজয়ের ইঙ্গিত।
ব্লেকই উত্তর দিলো, ওরা থামতে বাধ্য। সম্ভবতঃ একজন নেমে মেয়েটাকে দেখতে যাবে, আর অন্যজন ট্রাকে বসেই ট্রান্সমিটারে সাহায্য চেয়ে পাঠাবে–অর্থাৎ কিটসনের কথা অনুযায়ী সত্যিই যদি ওরা অহোটা সাবধানী চরিত্রের লোক হয়।
কিটসনের দিকে ফিরলো মরগ্যান, তোমার কি মনে হয়? কি করবে টমাস আর ডার্কসন?
কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করলো কিটসন। অবশেষে কাঁধ ঝকালো, এড ঠিকই বলেছে। টমাস বসে থাকবে, আর ডার্কসন দেখতে যাবে পড়ে–থাকা মেয়েটাকে। রাস্তার মাঝখান থেকে সরিয়ে ওরা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাঠাবে। তারপর ট্রাকে উঠে আবার চলতে শুরু করবে রিসার্চ স্টেশনের দিকে।
আমারও তাই ধারণা বললো মরগ্যান। সুতরাং দাঁড়াচ্ছে এই, টমাস রইলো গাড়ির ভেতরে, ডাকসন রইলো রাস্তায়। এবার আরেকটা উত্তর দাও, আলেক্স। মরগ্যানের চোখ সরাসরি কিটসনের দিকে, টমাস এক্ষেত্রে ড্যাশবোর্ডের বোম টিপে তালাকে অকেজো করে দেবে? নাকি ইস্পাতের আড়ালে ট্রাকটাকে ঢেকে ফেলার চেষ্টা করবে?
রুমাল দিয়ে মুখ মুছলো কিটসন।
সম্ভবতঃ নয়। ধীরস্বরে জবাব দিলো সে।
মরগ্যান তাকালো ব্লেকের দিকে, তোমার কি মনে হয়, এড?
টিপবে না কখনো! বলে উঠলো ব্লেক, কিটসনের কথা অনুযায়ী একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কারিগরের প্রয়োজন। সুতরাং যতক্ষণনা টমাস বুঝতে পারছে, যে ওরা বিপদে পড়েছে, ততোক্ষণ সে কিছুই করবে না। বরং জানলা দিয়ে ঝুঁকে দেখতে চেষ্টা করবে ডার্কসন কি করছে, বা মেয়েটা বেঁচে আছে কি না।
সম্মতি জানালো মরগ্যান, যাক, সবশেষে আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। কারণ ট্রাকটাও থামানো গেছে এবং টমাস বোতামও টেপেনি। তাহলে দেখছি, আলেক্সের কথামতো সম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপারটাকে আমরা সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছি। কিটসনের দিকে আঙুল উঁচিয়ে ধরলো মরগ্যান, তুমি বলেছিলে, সবটাই উদ্ভট দিবাস্বপ্ন! এখন কি মনে হচ্ছে তোমার?
এতে হাসাহাসির কি আছে বুঝতে পারছি না! বলে উঠলো কিটসন, মানলাম তুমি জিতেছে; কিন্তু তাতে কি হয়েছে?
তার মানে আমার বক্তব্য তুমি মেনে নিচ্ছো? হাসলো মরগ্যান, যাক ট্রাকটাকেও থামিয়েছি, আর ডার্কসনকেও গাড়ির বাইরে বের করেছি। আচ্ছা, এবার ভাবো বাঁকটার কথা। ট্রাকটাকে ঠিক ঐ জায়গাতেই আমি থামাতে চাই। তার কারণ একটা আছে। তা হলো রাস্তার দুপাশে অসংখ্য বুনো ঝোঁপ। তাতে দু–তিনজন লুকিয়ে থাকতে পারে। এবার ডাকসন নেমে যাবে পড়ে–থাকা মেয়েটার দিকে। এখন কথা হচ্ছে, টমাস জানালা বন্ধ করে দেবে? তোমার কি মনে হয়?
কিটসনকে লক্ষ্য করেই বললো। সুতরাং অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে কিটসন মাথা নাড়লো। এই গরমে জানলা বন্ধ করে তিরানব্বই মাইল ওরা পাড়ি দেবে মনে হয় না।
শুধু মনে হয় নানয়। ওরা জানলা খোলা রাখতে বাধ্য। কারণ বাইরের চেয়ে ইস্পাতের তৈরী ট্রাকের ভেতরে গরম আরও বেশী হবে। অতএব ট্রাকটা থামছে রাস্তার ধারের ঝোঁপগুলোর কাছে। যার আড়ালে দুজন লোক সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে। ড্রাইভার উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে তার সঙ্গীর কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে এবং ডার্কসন এগিয়ে চলেছে। পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে ওরা দুজনের কেউই বিপদের আশঙ্কা করছে না। কারণ ওই বিপজ্জনক বাঁকের কথা ওরা ভালভাবেই জানে। জানে যে গত ছ মাসে এখানে পাঁচ পাঁচটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। অতএব এই দুর্ঘটনাটাও ওদের কাছে নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। ট্রাক থেকে ফুট দশেক দূরে একটা ঝোঁপের আড়ালে আমি লুকিয়ে থাকবো। ডার্কসন যেই পড়ে থাকা মেয়েটার ওপর ঝুঁকে পড়বে। আমি ঝোঁপের আড়াল থেকে ট্রাকের জানলার কাছে গিয়ে ড্রাইভারের রগে একটা রিভলবার চেপে ধরবো। এবং ঠিক একই সময়ে পড়ে থাকা মেয়েটা লাফিয়ে উঠে, ডার্কসনের পেটে রিভলবার ঠেসে ধরবে। মরগ্যান অ্যাসট্রেতে সিগারেটের ছোট টুকরোটা খুঁজে দিয়ে, এবার বলো, ডার্কসন এবং টমাস কি করবে? আত্মসমর্পন করবে, না গুলিভরা রিভলবারের সামনে ওরা বীরত্ব দেখাবে?
কিটসন শান্তস্বরে বললো, দেখাতেও পারে। ওদের বিশ্বাস নেই। টমাস এবং ডার্কসন বড় সাংঘাতিক লোক।
হতে পারে সাংঘাতিক কিন্তু পাগল তো আর নয়। খোলা রিভলবারের সামনে অহেতুক বীরত্ব প্রদর্শনের চেষ্টা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। এবং সেটা ওরা ভালভাবেই জানে।
নিস্তব্ধতায় কিছুক্ষণ কেটে গেলো। অবশেষে জিপো কাঁপাস্বরে বললো, কিন্তু ফ্রাঙ্ক। এতে সহজে কি ওরা হার মানবে?
মরগ্যানের চোখ শয়তানি জিঘাংসায় পলকের জন্য চকচক করে উঠলো, তাহলে ওদের দুঃখজনক ভবিষ্যতের কথা ভেবে সমবেদনা জানানো ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।
যেখানে আমরা প্রত্যেকে দু–লক্ষ ডলার করে টোপে গাঁথছি। সেখানে সামান্য একটু–আধটু রক্তপাত কিছু নয়।
আরো কিছুক্ষণ নিশ্চল নিস্তব্ধতা। জিপোই আবার মুখ খুললো, ফ্রাঙ্ক, এসব আমার ঠিক ভালো লাগছে না। আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত আমরা এ কাজটা পেরে উঠবো না।
অধৈর্যভাবে মরগ্যান বললো, ঘাবড়ে যেও না, জিপো, তোমাকে অকুস্থলে থাকতে হবে না। তোমার জন্য আমি একটা বিশেষ কাজ ঠিক করে রেখেছি। এবং তোমার সাহায্যের বাইরে নয়। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।
ব্লেকের দিকে ফিরে মরগ্যান বললো, তোমার বক্তব্য কি, এড? দু–দুজন বীরপুরুষের কথা তো শুনলাম। এবার তোমারটা শুনি।
ব্লেক সিগারেট ধরিয়ে জ্বলন্ত কাঠিটাকে নিভিয়ে অন্ধকারে ছুঁড়ে বললো, দুধচোষা খোকাদের কথা ছেড়ে দাও, ফ্র্যাঙ্ক। তবে আমার মনে হচ্ছে টমাস আর ডার্কসন কোনো ঝামেলা করবে না। আর একান্তই যদি সাহস দেখাতে চায়। তাহলে একটা বিয়োগান্তনাটকের শেষ দৃশ্যের জন্যে ওদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
মরগ্যান ব্লেকের কথায় খুশী হয়ে বললো, বাস্তবকে অস্বীকার করার মতো নির্বোধ আমি নই, এড। টমাস এবং ডাকসনের নিয়তি স্বয়ং ভগবানের হাতে। আমরা নিমিত্ত মাত্র। তাহলে তুমি, আমি এবং মেয়েটি–এই তিনজনেই ট্রাক থামানোর ব্যাপারটা সামলাবো। জিপো আর কিটসনের জন্য কোনো হালকা কাজ ঠিক করা যাবে–তবে একটা কথা। সেই সঙ্গে ওদের পাওনা টাকার পরিমাণও কিন্তু কমে যাবে। কারণ আমরাই যখন সমস্ত ঝুঁকি নিচ্ছি। তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের পাওনা বেশী হওয়া উচিত, তাই না?
সংশয়ে কিটসনের ভুরু কুঞ্চিত হলো। দু–লক্ষ ডলারের ভাবনা তার মনে প্রভাব বিস্তার করতে লেগেছে।
তাহলে আমাদের ভাগে কত পড়ছে জানতে পারি কি?
সঙ্গে সঙ্গে মরগ্যান বললো, নিশ্চয়ই। এক লক্ষ পঁচিশ হাজার ডলার তুমি পাবে। আর জিপোর কাজ যেহেতু কলকজা সংক্রান্ত–সেহেতু সে পাবে একলক্ষ পঁচাত্তর হাজার। তোমাদের দুজনের থেকে যে এক লক্ষ ডলার বাঁচবে, সেটা আমার আর এডের মধ্যে ভাগ হবে।
কিটসন ও জিপোর মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো। সবাই নীরব। শেষে কিটসন উত্তেজিতভাবে বলে উঠলো, কিন্তু ওরা যদি কোনো ঝামেলা বাধায়। তাহলে আমাদের কেউ মারা যেতে পারে। মারা যেতে পারে টমাস আর ডার্কসন। নাঃ, কাজটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। এতদিন আমরা যে সব কাজ করেছি, সেগুলোতে কোনো ঝঞ্ঝাটের ভয় ছিলো না। ধরা পড়লে বড়জোর বছর দুয়েক জেল খাটতাম। কিন্তু এবারে ধরা পড়লে আমাদের আর নিস্তার নেই। সোজা ইলেকট্রিক চেয়ার! না, এসব খুনোখুনির মধ্যে আমি নেই।
ভয়ার্তস্বরে জিপো বললো, আলেক্স ঠিকই বলেছে, ফ্র্যাঙ্ক। খুনের দায়, বড় দায়। আমি তাতে .. জড়াতে চাই না।
হিংস্রভাবে মরগ্যান হাসলো, ঠিক আছে, তাহলে ভোট হোক। কোনো কাজ নিয়ে দ্বিমত দেখা দিলে আমরা বরাবরই ভোটের মাধ্যমে তার মীমাংসা করেছি। এক্ষেত্রেও তাই হোক।
কিটসন তীক্ষ্ণস্বরে বললো, তার কোনো প্রয়োজন নেই। এড যদি তোমার পক্ষেও যায় তবুও তুমি জিততে পারবেনা ফ্র্যাঙ্ক। কারণ তাহলে ভোটের ফলাফল দাঁড়াবে দুইদুই। এবং তোমরই তৈরী নিয়ম অনুযায়ী কোনো কাজে ভোটের ফলাফল সমান–সমান হলে সে কাজটা আমরা করি না। আশা করি তুমি নিয়মটা ভুলে যাওনি?
মরগান অর্ধস্ফুট স্বরে হেসে উঠলো, না, ভুলিনি। কিন্তু তাতে ভোটাভুটি করার বাধাটা কোথায়? নিয়ম মাফিক সব কাজ করাই আমি পছন্দ করি। তারপর, নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে, গৃহীত হবে আমাদের সিদ্ধান্ত, রাজী?
কিটসন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমার কোনো আপত্তি নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে বলেই বলছিলাম
চেয়ার টেনে মরগ্যান উঠে দাঁড়ালো। তার সুগঠিত পেশীবহুল দেহের বিশাল ছায়া টেবিলে পড়লো।
ভোটের কাগজগুলো তৈরী করো জিপো।
জিপোর মুখে পরিষ্কার হতবুদ্ধি ভাব। একটা নোটবই বার করে একটা পাতা ছিড়লো। তারপর ছুরি দিয়ে সেটাকে সমান চার টুকরো করলো। টুকরো কাগজগুলো টেবিলের ওপর দিয়ে, এই নাও
হালকাস্বরে মরগ্যান বললো, মাত্র চারটে কাগজ কেন, জিপো?
মরগ্যানের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কেন, আমাদের তো বরাবর চারটেই কাগজ লাগে?
মরগ্যান নরম করে হেসে, দশ লক্ষ ডলার হবে পাঁচ ভাগ–মনে আছে? সুতরাং মেয়েটারও ভাগ আছে একটা।
মরগ্যান দরজার দিকে এগিয়ে এক ঝটকায় দরজা খুলে উচ্চস্বরে কাউকে আহ্বান জানালো, ভেতরে এসো, জিনি। ওরা এই কাজটার ব্যাপারে ভোটাভুটি করতে চায়। সুতরাং বুঝতেই পারছো। তোমার ভোটটা আমার একান্ত প্রয়োজন।
অন্ধকারের ছায়া আবর্ত থেকে যেন হাওয়ায় ভর করে জিনি সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখ ঝলসানো সবুজ আলোর বৃত্তে মরগ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে হতবাক জিনিকে দেখতে লাগলো। তারা অপলকে জিনির দিকে তাকিয়ে রইলো।
বাইশ, তেইশ বছরের মেয়ে জিনি। সাধারণের তুলনায় একটু বেশী লম্বা। মাথায় একরাশ তামাটে চুল যত্নসহকারে ফিতে দিয়ে বাঁধা। ওর আয়ত ধূসর সবুজ চোখ সমুদ্রের মতোই গভীর অথচ অভিব্যক্তিহীন, স্কুরিত ওষ্ঠাধারে এক অদ্ভুত নেশা। উদ্ধত চিবুকে দৃঢ়তার ভাষা সোচ্চার। সব মিলিয়ে এক জীবন্ত চাবুক।
একটা রক্তরঙা রেশমী শার্ট, আর কালো স্কার্ট জিনির পরণে। স্ফীত বক্ষসৌন্দর্যের তুলনায় কটি দেশ অত্যন্ত ক্ষীণ। সুঠাম নিতম্বের ঢাল গিয়ে মিশেছে আকর্ষণীয় সুগঠিত দু–পায়ের প্রান্তে। রুই মাছের টোপ গেলার মতো বিস্ফারিত চোখে ব্লেক, জিপো এবং কিটসন তখনো জিনির দিকে তাকিয়ে। যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কোনো ইতালীয় অভিনেত্রীর দেহসৌন্দর্য দেখছে।
হতভম্ব তিনজনের মুখে মরগ্যানের শীতল কালো চোখজোড়া খেলে বেড়ালো। সে হেসে উঠলো, মরগ্যান জানতো জিনির আকস্মিক উপস্থিতি ওদের স্বাভাবিক চিন্তাধারাকে পঙ্গু করে দেবে। সেই আকস্মিক মানসিক সংঘর্ষের পরিণতি দেখার জন্য মরগ্যান যথেষ্ট কৌতূহলী ছিল।
জিপোর ডান হাত যান্ত্রিক ভাবে তার লাল টাইয়ের দিকে এগিয়ে গেল। টাইয়ের নটটাকে নেড়েচেড়ে ঠিক করলো। আর একই সঙ্গে পুরু ঠোঁটের আবরণ সরিয়ে তার ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি বার করলো। বাঁকা চোখে জিনির দিকে চেয়ে জিপো হেসে উঠলো।
এরকম অবস্থার জন্য ব্লেক মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। সে ভুরু উঁচিয়ে ঠোঁট কুঁচকে শিস দেবার। ভঙ্গী করলো। তার বিবর্ণ চোখের তারায় শূন্য দৃষ্টি।
কিটসনের অবস্থা পুরোপুরি আচ্ছন্ন। যেন একটা বিশমণী হাতুড়ী কেউ সপাটে তার ব্রহ্মতালুতে বসিয়ে দিয়েছে। সে যেন নীরবে আসন্ন মৃত্যুর প্রহর গুণে চলেছে।
ওদের চমক ভাঙলো মরগ্যানের স্বরে, এই হলো জিনি গর্ডন।
এক মুহূর্তের দ্বিধা। পরক্ষণেই চেয়ার ছেড়ে ব্লেক উঠে দাঁড়ালো, তার দেখাদেখি জিপোও। কিন্তু কিটসন বসেই রইলো। তার বলিষ্ঠ হাতের আঙুল উৎকণ্ঠায় মুষ্ঠিবদ্ধ। চোখের তারা স্বচ্ছ কাঁচের মতো। মুখের ভাব তখনো হতচকিত।
মরগ্যান বললো, ডানদিক থেকে শুরু করছি। এ হলো এডওয়ার্ড ব্লেক। আমার অনুপস্থিতিতে দলের ভার থাকে এরই হাতে। জিপো ম্যানডিনি, আমাদের কলকজা বিশারদ, প্রতিভা ধর–মরগ্যান হাসলো, আর সবশেষে আলেক্স কিটসন–গাড়ি চালাতে ওর জুড়ি নেই।
কিটসন বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে হঠাৎই যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। এক ঝটকায় সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তার ধাক্কায় আরেকটু হলেই টেবিলটা উল্টে পড়ছিলো। কিন্তু কিটসন সেদিকে না তাকিয়ে, সম্মোহিতের দৃষ্টি নিয়ে সে তখনও জিনির দিকে তাকিয়ে, হাতের তালু মুষ্ঠিবদ্ধ।
জিনির চঞ্চল চোখ পলকের জন্য তিনজনের চোখে থামলো। তারপর ও একটা চেয়ার টেনে মরগ্যানের পাশে বসলো।
জিনির পাশে দাঁড়িয়ে মরগ্যান বলতে লাগলো, ওদের দুজনের ধারণা কাজটা নাকি আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমাদের নিয়ম হলো কোনো কাজ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ হলে আমরা ভোটের সাহায্যে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করি। সুতরাং এক্ষেত্রেও ভোট নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
জিনি সংশয়ের সঙ্গে একটু অবিশ্বাসের হাসি হাসল, তার মানে? তুমি বলতে চাও, দু–লাখ ডলার নিতে রাজী নয় এমন গর্দভও পৃথিবীতে আছে?
মরগ্যান হাসলো, না ঠিক তা নয়। ওদের ধারণা, এ কাজটায় রক্তপাতের আশঙ্কা রয়েছে। তাই
অবাক চোখে জিনি গর্ডন জিপোর দিকে তাকালো, তারপর ওর ধূসর সবুজ চোখের তারা ব্লেকের চোখে স্থির হলো, সবশেষে গিয়ে থামলো কিটসনের মুখমণ্ডলে। যেন প্রত্যেককে ও জরীপ করে দেখলো। –ও, তোমার দলের যে এই অবস্থা তা কে জানতো! মরগ্যানকে লক্ষ্য করেই বললো। কিন্তু খোঁচা লাগলো কিটসনের পৌরুষে। সে অস্বস্তি ভরে মুখ ফিরিয়ে নিলো। অপমানে তার কান দিয়ে আগুন ছুটলো।
মরগ্যানের হাসি আরো বিস্তৃত হলো, সেটা তো আমিও ভাবছি। আমাদের হাতে এই প্রথম এসেছে একটা বড় কাজের সুযোগ। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য যে জিপো আর কিটসনের কাজটা মোটেই পছন্দ নয়।
জিনি এবার উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে বললো, হ্যাঁ, শুধু সুযোগ না–সুবর্ণ সুযোগ। দশ লক্ষ ডলার ছেলেখেলার কথা নয়। তুমি বলেছিলে একাজে তোমার দল সবরকম সাহায্য আমায় করবে। এবং তাও বিনা স্বার্থে না। কিন্তু এখন দেখছি, আমার এখানে আসাই ভুল হয়েছে। এখন তুমি আবার ভোট নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছ। হুঃ, যত্তো সব ন্যাকামো।
ওরা চমকে উঠলো। মেয়েটার মুখে এমন রুক্ষ, অপমানজনক কথা শুনে মনে মনে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলো।
মেয়েদের পক্ষে পশুসুলভ আচরণের ব্যাপারে ব্লেকের যথেষ্ট কুখ্যাতি আছে। সে আর থাকতে না পেরে বললো বক্তৃতার পরিমাণটা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে না সুন্দরী। এবার দয়া করে একটু চুপ করো দেখি!
জিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ওর সুন্দর মুখে বরফের কাঠিন্য।
মরগ্যানকে লক্ষ্য করে বললো, মনে হয় এখানে এসে আমি ভুল করেছি। আচ্ছা–তাহলে ব্যাপারটা এখানেই শেষ হোক। এই পরিকল্পনা নিয়ে আমি সাহায্য চাইবো এমন লোকের কাছে, যাদের শরীরের প্রতি শিরায় রক্ত বইছে। তোমাদের মতো অপদার্থ কাপুরুষদের সঙ্গে কথা বলে
অনর্থক সময় নষ্ট করতে চাই না।
জিনি বলেই দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগোলো।
মরগ্যান হাত বাড়িয়ে ওর হাত চেপে ধরে ওকে থামালো। হেসে বললো, উত্তেজিত হয়ে না, জিনি। এতে ওদের কোন দোষ নেই। এ ধরনের কাজ একদম প্রথম বলে একটু অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু সময় দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এই জিপো ম্যানডিনি তালা খোলায় শহরের সবচেয়ে সেরা কারিগর। মরগ্যান জিপোর পিঠে হাত রাখলো। –এড বুদ্ধি বিবেচনায় আমার চেয়ে কিছু কম যায় না। আর আলেক্সের মতো গাড়ি চালাতে পৃথিবীতে কম লোকই জানে। তবে রক্তপাতের ব্যাপারটা ওরা ঠিক পছন্দ করছে না।
জিনি তিনজনের ওপর চোখ বুলিয়ে, তাই নাকি? তাহলে দশ লাখ ডলারের বেলায় ওদের পছন্দ অপছন্দ যাচ্ছে কোথায়? বুক পকেটে? –ই, এইসব হরিদাস পালের গোয়াল নিয়ে তুমি দল তৈরী করছো? তোমার লজ্জা হওয়া উচিত, ফ্র্যাঙ্ক! জিনির কর্কশ কণ্ঠস্বর প্রত্যেকের কানে ঢেলে দিলো গরম সীসে, এ দুশ ডলারের ব্যাপার নয়, পুরো দশ লাখ ডলার। সেক্ষেত্রে কার কি হলোনা হলো, অতো দেখতে গেলে চলে না। সেটা ওদের ভালো করে বুঝিয়ে দাও।
জিনি মরগ্যানের হাত ছাড়িয়ে সরাসরি চোখ রাখলো কিটসনের চোখে, দু–লক্ষ ডলারের চেয়ে আহত হবার ভয়টাই কি তোমার কাছে বেশী হলো? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
জিনির আগুনঝরা অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে কিটসন কুঁকড়ে মৃদুস্বরে বললো, কাজটা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। ওয়েলিং কোম্পানীতে আমি কিছুদিন চাকরী করেছিলাম। সুতরাং টমাস এবং ডার্কসনকে আমি ভালভাবেই চিনি। এতো সহজে ওরা হার মানবেনা। যেখানে খুনোখুনির সম্ভাবনা আছে সেখানে আমি নেই।
জিনি নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললো, ঠিক আছে, তাহলে তোমাকেও আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। অতএব তোমার এই হারকিউলিস মার্কা চেহারা নিয়ে নিঃসঙ্কোচে কেটে পড়তে পারো। আমরা কেউ বাধা দেব না।
অপমানের কালো ছায়া নেমে এলো কিটসনের মুখে। সে উত্তেজিত ভাবে বললো, মুখ সামলে কথা বলল। আমি বলছি এ কাজটা অসম্ভব। তোমরা মিথ্যে স্বপ্ন দেখছো!
হাওয়ায় তর্জনীনাচিয়ে দরজার দিকে ইশারা করলো জিনি, দেখছিই তো! নইলে তুমি এখনো বসে রয়েছ কেমন করে? যাও বাড়ি গিয়ে মায়ের কোলে বসে ডু ডু খাও। তোমাকে আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই।
ধীরে ধীরে কিটসন উঠে দাঁড়ালো। তার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে আস্তে আস্তে জিনির কাছে এগিয়ে গেলো। ও তখনও একইভাবে সোজা হয়ে দৃপ্তভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে। চোখের দৃষ্টি কিটসনের চোখে নিবদ্ধ।
অবশিষ্ট তিনজন রুদ্ধশ্বাসে ওদের দেখতে লাগলো। ব্লেকের চোখে চিন্তার ছায়া। কারণ সে জানে, উত্তেজিত হলে কিটসনের মাথার ঠিক থাকে না। জিপো ভুরু কুঁচকে অস্বস্তিভরা দৃষ্টিতে ওদের লক্ষ্য করছিলো। কিন্তু মরগ্যানের মুখের হাসি তখনও রয়েছে।
কোনো শালা আজ পর্যন্ত এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পায় নি! জিনির মুখোমুখি এসে কিটসন থামলো। দু হাতের আঙুল অস্থির উত্তেজনায় হাওয়া আঁকড়ে ধরছে।
জিনি যেন একটি ছোট্ট পুতুল কিটসনের বিশাল চেহারার কাছে। কিন্তু ওর দৃপ্ত চাবুকের মতো ভঙ্গী মনে করিয়ে দেয় কেউটের শীতল চাউনিকে। আর আলেক্স কিটসনের অপমানিত পৌরুষ বুঝি আহত বাঘের মতোই ক্ষিপ্ত ভয়ঙ্কর। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য।
জিনি ঘৃণাভরা চোখে কিটসনকে দেখলো। শান্তস্বরে বললো, তুমি যদি আমার কথা বুঝতে না পেরে থাক, তাহলে আবার বলছি, যাও বাড়ি গিয়ে মায়ের কোলে বসে ডু ডুখাও। তোমাকে আমাদের প্রয়োজন নেই।
একটা চাপা গর্জনের সঙ্গে কিটসনের ডান হাত ক্ষিপ্রবেগে জিনির দিকে এগিয়ে এলো কিন্তু মাঝপথেই সে নিজেকে সামলে নিলো, নামিয়ে নিলো তার উদ্যত হাত।
জিনি তীক্ষ্ণ স্বরে বললো, কি হলো, থামলে কেন, মারো! তোমার মতো অতো প্রাণের ভয় আমার নেই।
হো হো করে হেসে উঠলো মরগ্যান।
মাথা নীচু করে কিটসন আপন মনেই কি যেন বিড় বিড় করে দরজার দিকে শ্লথপায়ে এগিয়ে গেল।
মরগ্যানের কর্কশ স্বরে সকলে চমকে উঠলো, কিটসন, এখানে এসে বসো। ভোট তোমাকে দিতেই হবে। তুমি যদি দল ছেড়ে চলে যাও এই মুহূর্তে, তবে এর পরিণতির জন্য আমি কিন্তু দায়ী থাকবো না।
কিছুক্ষণ ইতস্ততঃকরে তারপর ধীরে ধীরে কিটসন ফিরে এসে চেয়ারে বসলো। মুখভাব গম্ভীর দ্বিধাগ্রস্ত।
জিপোর দিকে মরগ্যান ঘুরে, আর একটা ভোটের কাগজ, জিপো।
জিপো নোটবইয়ের পাতা কেটে আর এক টুকরো কাগজ দিলো।
কিছুক্ষণ ধরে ব্লেক উসখুস করছিলো, এবারে বললো, ভোট দেবার কাজটা সম্বন্ধে আরো কয়েকটা কথা আমি জানতে চাই, ফ্র্যাঙ্ক। এই মেয়েটা এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়লো কেমন করে? জিনির দিকে বুড়ো আঙুল ঝাঁকিয়ে বললো ব্লেক! ,
মরগ্যান বললো, গত পাঁচ মাস ধরে আমি শুধু এই ট্রাকটাকে সাফ করার মতলব ভেজেছি। কিন্তু অনেক ভেবেও কোনো উপায় খুঁজে পাইনি। হঠাৎ মাস তিনেক আগে জিনি আমার কাছে ট্রাক লুঠের একটা সাজানো গুছানো পরিকল্পনা ফেলে দিলো। সত্যি বলতে কি এর পুরো কৃতিত্বই জিনির। যে কারণে দশ লাখ ডলারকে ভাগ করা হচ্ছে পাঁচ ভাগে। ও সমস্ত দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাপারটাকে ভেবেছে এবং সেই অনুযায়ী তৈরী করেছে ওর নিখুঁত প্ল্যান। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওর প্ল্যানে কোনো ফাঁক নেই।
জিনির দিকে তাকিয়ে ব্লেক বললো, তোমার বাড়ি কোথায়, খুকী? –আর এই ট্রাক লুঠের দুবুদ্ধিই বা তোমার মাথায় এলো কি করে?
মেয়েটি ওর সস্তা ভ্যানিটিব্যাগ খুলে সিগারেট বার করে, অভিব্যক্তিহীন শীতলদৃষ্টিতে ব্লেকের দিকে তাকিয়ে, সিগারেট ধরালো, আমার বাড়ির খবর জেনে তোমার কি লাভ? আর ট্রাক লুঠের পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞেস করছো? …টাকার প্রয়োজনটা হঠাৎ খুব বেড়ে ওঠায় হঠাৎ প্ল্যানটা মাথায় গজিয়ে উঠেছে। এবং আমাদের যখন পরস্পরের নামটা অজানা নয়, তখন নাম ধরে ডাকাটাই উচিত। ঐ ন্যাকা–ন্যাকা স্বরে, খুকু বলাটা ছাড়া দেখি!
দাঁত বের করে ব্লেক হাসলো। মেয়ে মানুষের তেজ বরাবরই তাকে আকর্ষণ করেছে।
নিশ্চয়ই, তুমি যখন পছন্দ করো না সেটা কি আমার করা সাজে? কিন্তু একটা কথা আমাদের দলের খবর তোমাকে কে দিলো? আর আমরাই যে এই কাজের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত লোক, সেটাই বা জানলে কেমন করে?
জিপোর দিকে জিনি দেখালো, তার কারণ আমি খোঁজখবর করে জেনেছিলাম, তালা খোলার ব্যাপারে ওর চেয়ে ওস্তাদ কারিগর আর এ শহরে নেই। এবং এ কাজে আমাদের প্রধান প্রয়োজন সেইটাই। আরো শুনলাম তোমার কথা। তোমার মতো ঠাণ্ডা রক্তের দুঃসাহসী পুরুষ নাকি খুব কমই আছে। মরগ্যানের আছে বুদ্ধি। সেই সঙ্গে দল পরিচালনার অদ্ভুত ক্ষমতা। তাছাড়া গাড়ি চালানোতে কিটসনের নামটাই সর্বাগ্রে। সুতরাং তোমাদের এখানে না এসে পারি কি করে?
অস্বস্তি কেটে জিপোর মুখে ফুটলো হাসির রেখা। সে প্রশংসা শুনতে বরাবরই ভালবাসে। বিশেষতঃ, একজন সুন্দরী তরুণীর মুখে। না, জিনি মিথ্যে বলেনি–ভাবলো জিপো। তারসঙ্গে অন্য কারিগরের কোনো তুলনাই হয় না। কারণ জিপো ম্যানডিনি, তালার লাইনে একমেব দ্বিতীয়ম।
কিটসনের ক্রোধ মিলিয়ে গেল। অপ্রতিভভাবে সে টেবিলের দিকে চোখ নামিয়ে নিল। চেয়ে রইলো–হুইস্কি গ্লাসের বৃত্তাকার ভিজে ছাপের দিকে।
ব্লেক সন্দেহাকুল কণ্ঠে বললো, ওরা, মানে কারা?
জিনি একটু বিরক্তভাবে বলল, বহু জায়গায় আমি উপযুক্ত লোকের খোঁজ করেছি। তারপর জেনেছি তোমাদের নাম। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কারো নাম করা মুশকিল। আমরা শুধু শুধুই সময় নষ্ট করছি। আমি ভেবেছিলাম ঠিক লোকের কাছেই এসেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমার হয়তো ভুল হতে পারে। আর তা যদি হয়, তাহলে আমাকে অন্য কোথাও দেখতে হবে।
ব্লেক সিগারেট ধরিয়ে জিনির দিকে তাকিয়ে, আমি কিন্তু অন্য কথা ভাবছি। ঐ ট্রাকটা থামাতে তোমাকেই যদি শুয়ে থাকতে হয় রাস্তায়, তাহলে মানতে দ্বিধা নেই, সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজটাই তুমি নিজের জন্যে বেছে নিয়েছে। এটাও কি তোমারই পরিকল্পনা নাকি?
নিশ্চয়ই।
আচ্ছা, এবার দেখা যাক তোমাকে কি কি করতে হবে। তুমি রাস্তার ঠিক মাঝখানে শুয়ে থাকবে। তোমার কাছে লুকানো থাকবে একটা রিভলবার। ডার্কসন যেই তোমার কাছে এগিয়ে যাবে; অমনি তুমি রিভলবার চেপে ধরবে তার তলপেটে–তাই তো?
সম্মতি জানালো জিনি মাথা হেলিয়ে।
এতে কিন্তু যথেষ্ট বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে; এবং ব্যাপারটা যতটা সহজ ভাবছো ততটা সহজ নাও হতে পারে। ব্লেক বললো, এক্ষেত্রে দুটো জিনিষ ঘটতে পারে। হয় ডার্কসন সরাসরি হাত তুলে তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করবে নয়তো তোমাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে রিভলবারটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করবে। ডার্কসন সম্বন্ধে আমি যতটুকু শুনেছি, অতো সহজে হাল ছাড়ার লোক সে নয়। ও হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়ে তোমার রিভলবারটা কেড়ে নিতে চাইবে। তখন?
জিনি শান্তভাবে ধোয়া ছাড়লো।
নেহাত অল্প নয় দশ লক্ষ ডলার। শীতল নির্বিকারস্বরে জবাব দিলো জিনি গর্ডন, অতএব ডার্কসন যদি ভালোয় ভালোয় পোষনা মানে, তবে ওকে গুলি করা ছাড়া আমার আর উপায় থাকবে না।
পকেট থেকে রুমাল বের করে জিপো মুখ মুছলো। জিভটাকে একবার বুলিয়ে নিলো শুকনো ঠোঁটের ওপর; অস্বস্তিভরে একবার দেখলো মরগ্যানের দিকে, তারপর তাকালো কিটসনের দিকে।
ঠিকই বলেছে জিনি। মরগ্যান ওদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলো, দশ লক্ষ ডলারের জন্য ওসব সামান্য ব্যাপারে নজর দিলে চলে না। তাছাড়া বাস্তবকে অস্বীকার করার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই।
জিনিকে লক্ষ্য করছিলো ব্লেক গভীর দৃষ্টিতে।
না, মেয়েটা মিথ্যে বলছে না। বাপ রে! এ যে দেখছি কেউটের বাচ্চা।
না, তা নয়–আমি শুধু খোলাখুলি ব্যাপারটা জানতে চাইছি। একটা সিগারেট নিয়ে টেবিলে বারকয়েক টুকলো ব্লেক, এবার তোমার মতলবের বাকীটা শোনা যাক, ফ্র্যাঙ্ক।
মাথা নাড়ালো মরগ্যান, উন্থ; ভোট দেবার আগে সে বিষয়ে আর একটা কথাও জানার উপায় নেই। জিনির সঙ্গে আমার সেইরকমই শর্ত হয়েছে। তবে ও বলছে, ট্রাক লুঠের প্লান নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্রও মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। সবটাই ও দাবার ছকের মতো পরিষ্কার করে সাজিয়ে রেখেছে। আমি যা বললাম সেটা মোটামুটি পরিকল্পনার মূল ব্যাপারটা। যদি আমরা জিনিকে সাহায্য করতে রাজী থাকি, তবেই ও বাকী অংশটা আমাদের শোনাবে। তার আগে নয়। আর রাজী না হলে তো মিটেই গেল। ও তখন অন্য কোনো দলের কাছে যাবে–এই প্রস্তাবে আপত্তি করার কিছু দেখছি না। তোমরা কি বলল?
কিন্তু সত্যিই কি ও প্রত্যেকটা সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে? ব্লেক প্রশ্ন করলো, আমার তো মনে হয় সেটা সম্ভব না। এখন পর্যন্ত আমরা শুধু ট্রাকটা থামাতে পেরেছি, আর টমাস ও ডাকসনকে কজা করেছি। তার বেশী কিছু নয়। অবশ্য খানিকক্ষণ আগে আমরা এটাকে অসম্ভব মনে করেছিলাম। কিন্তু ফ্রাঙ্ক, তোমার কথা যদি সত্যি হয় মানে ট্রাকটা যদি ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে এজেন্সীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে থাকে তো ব্যাপারটা ভীষণ ঘোরালো হয়ে দাঁড়াবে। যে মুহূর্তে ট্রাকের সঙ্গে ট্রান্সমিটারের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে এজেন্সীর লোকেরা পুলিশে খবর দেবে। আর ওরা তো জানেই ট্রাকটাকে কোথায় পাওয়া যাবে। তাছাড়া শুধু পুলিশ নয়, সৈন্যবাহিনীর লোকেরা পর্যন্ত আমাদের পেছনে লাগবে। অর্থাৎ শয়ে শয়ে তোক হেলিকপ্টার ও গাড়ি নিয়ে আমাদের খুঁজবে। আর এই সামান্য তিরানব্বই মাইল চক্কর দিয়ে আমাদের খুঁজে বের করতে একটা হেলিকপ্টারের মিনিট কয়েকের বেশী লাগবে না। তুমি তো ভালোভাবেই জানো, ঐ রাস্তায় ট্রাক নিয়ে লুকোবার কোনো জায়গাই নেই। যাও আছে, তাও পঁচিশ মাইল দূরে। আমি তো বুঝতে পারছি না। কেমন করে আমরা ট্রাক লুট করে টাকা নিয়ে সরে পড়বো! নাঃ, ওদের চোখে ধূলো দেওয়া একেবারেই অসম্ভব।
মরগ্যান কাধ ঝাঁকিয়ে, আমিও সেই কথাই ভাবছিলাম। কিন্তু জিনি বলছে, এ নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সমস্ত কিছু ও ছকে রেখেছে।
জিনির দিকে ব্লেক তাকিয়ে, তাই নাকি? এই জটিল সমস্যার উত্তরও তুমি জানো?
জিনি শীতলস্বরে বললো, হ্যাঁ, এইটাই আমাকে সবচেয়ে বেশী ভাবিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমিই জিতেছি। আমি জানি ট্রাকটাকে নিয়ে কিভাবে পুলিশের চোখে ধুলো দিতে হবে।
জিনির আশ্বাসভরা দৃঢ়স্বরে কিটসন পর্যন্ত বিচলিত হলো। এতক্ষণ সে নির্বিকার ভাবে চুপচাপ বসে ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে তার মনে হলো, নাঃ, কাজটা জিনির পক্ষে সম্ভব হতে পারে।
ব্লেক কাঁধ ঝাঁকাল, ঠিক আছে। তোমার কথাই আমি বিশ্বাস করলাম। কিন্তু এই অদ্ভুত সমস্যার সমাধান কেমন করে করবে তাই ভাবছি। অবশ্য এখনও দুটো জিনিস আমরা ভেবে দেখিনি। এক নম্বর হলো, আমরা যখন ট্রাক থামিয়ে টমাস আর ডার্কসনকে কায়দা করবো, তখন যদি অন্য কোনো গাড়ি ঘটনাস্থলে এসে পড়ে, তাহলে? মানছি, ঐ রাস্তা দিয়ে খুব একটা গাড়ি–টাড়ি যায় না। কিন্তু হঠাৎ এসে পড়তে কতক্ষণ? ব্যস তাহলেই চিত্তির।
বিরক্তি নেমে এলো জিনির মুখে। ও ভাবলেশহীন মুখে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। আঁটোসাঁটো লাল শার্টের নীচে ওর উদ্ধত বুক প্রকট হয়ে উঠলো।
সে নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তুমি তো জানো। দুটো রাস্তা পাশাপাশি গিয়ে দশ নম্বর সড়কে মিশেছে। এখন ট্রাকটা যেই ওর রোজকার রাস্তায় ঢুকবে, অমনি আমরা একটা পথনির্দেশ বসিয়ে দেবো জোড়া রাস্তার মুখে। তাতে তীরচিহ্ন দিয়ে অন্যান্য গাড়িদের নির্দেশ করা হবে পাশের রাস্তা ব্যবহার করার জন্য তাহলেই অন্য আর কোনো গাড়ি ঐ রাস্তা দিয়ে আসবে না। অর্থাৎ ব্যাপারটা খুব একটা কঠিন নয়, তাই না?
ব্লেক একগাল হাসলো। খুশী যেন ওর চোখেমুখে উপছে পড়লো।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, একেবারে জলের মতো সহজ। কিন্তু মেহেবুবা, এই সমস্যাটার সমাধান করো দেখি। ধরে নিলাম ট্রাকটা দখল করে আমরা বেশ একটা জুতসই জায়গায় গা ঢাকা দিলাম। কিন্তু তারপর ট্রাকের তালাটা খুলবো কি করে? ফুসমন্তরে? কিটসন বলছে, ওটার তালা খোলার চেয়ে যুদ্ধ করে জয় করা অনেক সহজ। তাছাড়া আমাদের খুব তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। উঁহু, ব্যাপারটা নেহাত সোজা নয়।
জিনি মাথা ঝাঁকালো। জিপোর দিকে ইশারা করে বললো, সেটা ওর মাথাব্যথা, ও বুঝবে। তালার ব্যাপারে ও একজন ওস্তাদ। সুতরাং সে দায়িত্বটা ওরই, আমাদের নয়। আমরা শুধু ট্রাকটা ওর কাছে এনে দেব, তারপর যতসময় লাগে লাগুক। ইচ্ছে হলে এক মাস, চাই কি দু–মাস সময়ও জিপোকে দেওয়া হবে। জিনির সাগর সবুজ চোখ জিপোর দিকে ঘুরলো, কি হে, পারবে না এক মাসে ঔ ট্রাকের তালাটা খুলতে?
জিপোর অবস্থা তখন দেখে কে? প্রশংসায়–প্রশংসায় সে যেন রঙীন শূন্যে ভাসছে। জিনির প্রশ্নের উত্তরে ঘাড় নাড়লল, পারবো না মানে? আমি এক মাস সময় পেলে নক্ৰ দুর্গের সমস্ত দরজা খুলে ফেলতে পারবো।
জিনি বললো, তোমাকে একমাস সময়ই দেওয়া হবে। এবং তাতেও যদি না হয় তবে আরো এক মাস সময় আমাদের ভাবনার কারণ হবে না।
মরগ্যান বললো, ব্যস, ও নিয়ে আর কথা নয়, আগেই তো বলেছি। জিনি সব সমস্যারই সমাধান করে রেখেছে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওর পরিকল্পনা সফল হবে। এসো, এবার ভোট দেওয়া যাক। তবে আবার বলছি, কিঞ্চিৎ রক্তপাতের জন্য প্রত্যেককেই প্রস্তুত থাকতে হবে। অর্থাৎ দু পক্ষেরই কেউ না কেউ আহত হতে পারে। এমনকি মারাও যেতে পারে। যদি টমাস বা ডার্কসনের কেউ মারা যায় তবে আমরা খুনের জালে জড়িয়ে পড়বে। অথবা যদি সামান্য কোনো ভুলের জন্য আমরা ধরা পড়ি, তবে নির্ঘাত দশ থেকে বিশ বছরের জেল–সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর অন্যদিকে রয়েছে সনালী দুনিয়ার হাতছানি;নগদ দু–লাখ ডলার! আমাদের অবস্থাটা মোটামুটি এই।
–তোমাদের যদি আর কোনো প্রশ্ন না থাকে, তাহলে এবার ভোট নেবার কাজ শুরু করা যাক, মরগ্যান থামলো। তিনজনের দিকে একবার দেখলো, তবে একটা কথা মনে রেখো। ভোটের মাধ্যমে আমরা যে সিদ্ধান্ত নেব, সেটাই কিন্তু হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমাদের দলের নিয়ম কানুন তো তোমরা ভালভাবেই জানো, ভোটে যে পরাজিত হবে তাকে হয় আমাদেরই সঙ্গে কাজ করতে হবে, নয়তো চিরদিনের জন্য দল ছেড়ে চলে যেতে হবে। তোমাদের তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। বেশ ধীরেসুস্থে ভেবেচিন্তেই তোমরা সিদ্ধান্তনাও। মনে রেখো, জমার খাতায় দুলাখ ডলার। আর খরচের খাতায় দশ বিশ বছরের জেল হয়তো বা ইলেকট্রিক চেয়ার। অতএব ইচ্ছে করলে তোমরা আরো কিছু সময় নিতে পারো। পুরো ব্যাপারটা ভালো করে খতিয়ে দেখো।
এসো তাহলে ভোট দেওয়া যাক–ব্লেক আহ্বান জানালো এবং একই সঙ্গে হাত বাড়িয়ে কাগজ তুলে নিলো।
তুলে নিলো জিনি এক টুকরো কাগজ। বাকী তিন টুকরো কাগজ তুলে নিলো মরগ্যান। একটা এগিয়ে দিলো কিটসনের দিকে, আর একটা জিপোর দিকে। তারপর পকেট থেকে কলম বের করে অবশিষ্ট কাগজে কি লিখতে লাগলো। লেখা হলে কাগজটা ভাঁজ করে রাখলো টেবিলের ঠিক মাঝখানে।
ফ্র্যাঙ্কের কলমটা চেয়ে নিলো জিনি। লেখা শেষ করে কাগজটা এগিয়ে দিলো মরগ্যানের রাখা কাগজের পাশে।
ব্লেক ইতিমধ্যে লেখার কাজ সেরে ফেলেছে। কাগজটা হাওয়ায় নাচিয়ে ভাঁজ করলো ব্লেক, রাখলো অন্য দুটো কাগজের পাশে।
জিপো কাগজটার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো। অবশেষে দ্রুতহাতে লিখে লেখা কাগজটাকে ভাঁজ করে টোকা মেরে এগিয়ে দিলো অন্য কাগজগুলোর কাছে।
বাকী রইলো শুধু কিটসন। দ্বিধাগ্রস্তভাবে সে হাতের কাগজের দিকে তাকিয়ে। জিনি এবং অন্য তিনজন তাকে লক্ষ্য করছে।
তার দিকে কিটসন চোখ তুলে তাকালো। তারপর জিনির মুখে। ওরা চেয়ে রইলো পরস্পরের দিকে, তারপর মরগ্যানের কলমটা তুলে নিলো কিটসন। হিজিবিজি কি সব লিখে ভাজ করে, রাখলো অন্য কাগজের ওপর।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। একসময় মরগ্যানই হাত বাড়িয়ে দিলো কাগজগুলোর দিকে। খুলে দেখলো একটা, রাজী।
আরেকটা খুললো মরগ্যান।
রাজী, চমৎকার! এবার দেখা যাক অন্যগুলো কি বলে।
কাগজগুলো ক্ষিপ্রহাতে খুলে ফেললো মরগ্যান। দেখলো সবাই রাজী।
সবার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলো মরগ্যান। ফুটে উঠলো নেকড়ের হিংস্র হাসি, তাহলে আপত্তি নেই এই কাজটার ব্যাপারে দেখছি। আমি সেই রকমই ভাবছিলাম। দুলক্ষ ডলার পায়ে ঠেলার– মতো লোক এই পৃথিবীতে নেই–নেহাত।
জিনির চোখে কিটসন চোখ রাখলো।
তার দিকে জিনিও তাকালো, কিটসনের দিকে চেয়ে হাসলো জিনি। নীরব অথচ কোমল হাসি।
.
০২.
পরদিন সকাল। প্রায় আটটা বাজে। ওয়েলিং আর্মার্ড ট্রাক এজেন্সীর প্রবেশপথের কাছে এসে থামলো একটা কালো ধূলিধূসর বুইক সেঞ্চুরী।
রাস্তার দু–পাশে অসংখ্য গাড়ির ভিড়ে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে কালো গাড়িটার একটুও সময় লাগলো না।
গাড়ির চালক ফ্র্যাঙ্ক মরগ্যান। মাথার তেলচিটে ময়লা টুপিটা চোখের ওপর নামানো। পাতলা ঠোঁটে একটা সিগারেট। তার পাশে বসে এডব্লেক।
এজেন্সীর দরজার দিকে দেখলো তারা। দরজার ওপরে কাটা তারের বেড়া। ডানদিকের পাল্লায় ঘন্টি বাজাবার বোতাম। এবং পাশেই সাদা ফলক আঁটা তাতে লাল রঙের বড় বড় হরফে পরিষ্কার করে লেখা;
–দি ওয়েলিং আর্মার্ড ট্রাক এজেন্সী
আপনার নিরাপত্তা আমাদের নিতে দিন। পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা এবং নিরাপদ ট্রাক পরিবহন ব্যবস্থা।
নিজেদের সম্বন্ধে ওরা একটা বিরাট ধারণা করে বসে আছে দেখছি–ফলকের লেখা পড়ে বললো ব্লেক, ঠিক আছে, আর কটা দিন; তারপরেই ওরা দেখবে ওস্তাদের কেরামতি।
বলা যায় না, এর উলটোটাও তো ঘটতে পারেব্যঙ্গের হাসি হাসলো মরগ্যান।
তা পারে, তবে আমার মনে হচ্ছে, একাজটায় আমরা সাফল্য লাভ করবোই। ব্লেক বললো, মেয়েটা এমন সুন্দরভাবে প্রত্যেকটা সমস্যার সমাধান করছে যে ভাবলে অবাক হতে হয়, তাই না?
হা। ঠোঁট থেকে সিগারেটটা তুলে নিলো মরগ্যান, ওর পরিকল্পনায় কোন খুঁত নেই, কিন্তু সেই অনুযায়ী সবকিছু করতে পারলে হয়। কারণ কতকগুলো জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। বিশেষ করে জিপোকে নিয়েই ভাবনা।
জিপোর যাতে সে অবস্থা না হয়, তার দায়িত্ব আমাদের। জবাব দিলো ব্লেক, জিপোর জন্য আমি বিন্দুমাত্রও চিন্তিত নই।
কিন্তু জিনির তো সে ভয় নেই ব্লেকের ঠোঁটের কোণে হাসির ছোঁয়া।
তা ঠিক।
মেয়েটা কে, ফ্র্যাঙ্ক?
মরগ্যান ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাঁকালো, কি করে বলবো? যদুর জানি এ শহরে থাকে না। তবে একটা কথা বাজি রেখে বলতে পারি, ও এর আগেও অন্য কোনো দলের হয়ে কাজ করেছে।
আমারও তাই মনে হয়, ব্লেক চোখ নামিয়ে হাতঘড়িতে সময় দেখলো, তবে একটা ব্যাপার কি জানো? এই ট্রাক লুটের পরিকল্পনাটা যে জিনির একার মাথা থেকে বেরিয়েছে, তা আমার মোটেই বিশ্বাস হয় না। ওই কচি মেয়ের মাথায় এ মতলব আসতেই পারে না। আর যে ভাবে সমস্ত জটিল সমস্যাগুলো ও সমাধান করেছে তা অবিশ্বাস্য। যদি এই ট্রাকটার ব্যাপারে অন্য কোনো দলও মাথা ঘামায় তাহলে একটুও অবাক হবো না। কারণ আমার ধারণা, অন্য কোনো দলের কাছ থেকে জিনি এই ট্রাক লুঠের পরিকল্পনাটা চুরি করেছে। হয়তো বেশী বখরার লোভেই ও সেই দল ছেড়ে আমাদের দলে এসে যোগ দিয়েছে। অতএব, জিনি সম্বন্ধে সতর্ক থেকো, ফ্র্যাঙ্ক। পরে হয়তো দেখা যাবে, আমাদের মতো আরেকটা দলও একই দিনে একই সময়ে ট্রাকটাকে খালি করার মতলব ভাঁজছে–সেটা আমাদের পক্ষে খুব একটা উপাদেয় হবে না; বিশেষ করে ওরা যদি সে ব্যাপারে আমাদের টেক্কা দেয়।
মরগ্যান অস্বস্তিভরে টুপিটাকে মাথার পেছনে ঠেলে ভুরু কুঁচকে ব্লেকের দিকে তাকালো, হুঁ! সবই আমি ভেবেছি। কিন্তু তবু আমাদের একটা সুযোগ নিতে হবে। আগামী শুক্রবারের আগে কিছুতেই এ কাজে হাত দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ প্রচুর প্রস্তুতি দরকার এর পেছনে। –আচ্ছা, কটা বাজলো?
ঠিক সাড়ে–আটটা।
তাহলে তো বাস আসার সময় হয়ে গেল!
হা।
ওরা সামনের বাসস্টপে দাঁড়ানো লোকগুলোর দিকে তাকালো। ব্লেক সেদিকে স্থির চোখে চেয়ে রইলো। অস্ফুটস্বরে বললো, যাই বলো ফ্র্যাঙ্ক, জিনির চেহারায় চটক আছে। উফ, একখানা জিনিষ বটে। ব্লেক অন্যমনস্কভাবে ঠোঁট কামড়ালো।
বরফের কাঠিন্য নেমে এলো মরগ্যানের মুখে। তার কালো সাপের মতো চোখ জোড়া ব্লেকের চোখে স্থির হলো! সে কর্কশস্বরে বলে উঠলো প্রসঙ্গ যখন উঠলোই তখন একটা কথা ভাল করে জানিয়ে দিই এড, জিনির কাছে ঘেঁষবার চেষ্টা তোমরা করোনা। কারণ, ওকে নিয়ে কোনোবাঁদরামি আমি সহ্য করবো না। সপ্তা দুয়েক, কি তারও বেশী ও আমাদের সঙ্গে থাকবে। দিনের মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টাই হয়তো ওকে আমাদের পাশে বসে কাটাতে হবে কিন্তু তাই বলে ওর সম্বন্ধে ভুল ধারণা গড়ে উঠুক, তা আমি চাই না। সুতরাং প্রথম থেকেই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। কোনোরকম লক্কাবাজি আমি সহ্য করবো না।
মুখমণ্ডল ঘৃণায় বিকৃত করে মরগ্যানের দিকে তাকিয়ে ব্লেক বললো, তাহলে কি ধরে নেবো, জিনিকে তুমি নিজের জন্যই রেখেছো?
মাথা নাড়লো মরগ্যান, না। আমি তোমাকে আবার সাবধান করে দিচ্ছি, এড–জিনির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শুধু লেনদেনের; তার বেশী কিছু নয়।
মরগ্যানের শীতল, নিপ্রাণ কালো চোখের তারা যেন ঝিলিক মেরে উঠলো। ব্লেক সেদিকে চেয়ে অস্বস্তিভরে হাসতে চেষ্টা করলো–আমাকে এসব না বলে কিটসনকে গিয়ে বলো। যদি কিছু করার হয় ও–ই করবে, আমি নয়। কাল রাতে কিরকম করে জিনিকে দেখছিলো মনে আছে?
মরগ্যান বললো, তোমাদের তিনজনের ওপরেই নজর রাখা দরকার। তুমি কিংবা জিপো–কিটসনের চেয়ে এমন কিছু কম নও।
ব্লেকের চোখে ক্রোধের ঝিলিক ফুটে উঠলো, তোমার মাথা থেকে দেখছি যীশুখ্রীষ্টের মতো জ্যোতি বেরোচ্ছে।
ক্রুদ্ধভাবে মরগ্যান কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু বাসটাকে আসতে দেখে বললো, ঐ যে বাস আসছে। চুপচাপ নজর রাখো।
উইন্ডস্ক্রিনের ওপর দুজনেই ঝুঁকে পড়লো। সামনের রাস্তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলো। বাসটা এজেন্সীর সামনে এসে থামলো। দুজন লোক নামলো। একজনের চেহারা খাটো, রোগা, কিন্তু অন্যজন প্রায় ছ ফুট লম্বা–বৃষস্কন্ধ, শক্তসমর্থ চেহারা। চলাফেরার ভঙ্গী সাপের মতো ক্ষিপ্ত ও নিশ্চিত। তার পরনে ওয়েলিং আর্মার্ড ট্রাক এজেন্সীর ইউনিফর্ম। মাথায় লম্বা টুপি–তাতে। বসানো চকচকে ইস্পাতের ব্যাজ। কোমরে পিস্তল ঝোলানো। অভ্যাসবশতঃই বাঁ হাতটা পিস্তলের খাপের ওপর রাখা।
একবার ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটা চারপাশে দেখলো। তারপর ক্ষিপ্র পায়ে এজেন্সীর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। ঘণ্টির বোতামে আঙুল চেপে ধরলো।
ব্লেক প্রশ্ন করলো, এই নাকি?
মরগ্যান তখন লোকটির আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত, অস্বস্তিভার বললো, হ্যাঁ, এই মাইক ডার্কসন। টমাস হয়তো এর পরের বাসে আসবে।
শালাকে দেখে তো মনে হচ্ছে এক নম্বরের হারামজাদা–ব্লেক ঠিক খুশী হতে পারলো না ডার্কসনকে দেখে। এক অজানা আশঙ্কায় সে বললোনাঃ, ব্যাটা যে সাহসী, তা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যায়।
ডার্কসন ঘুরে দাঁড়িয়ে কালো বুইকটাকে অন্যমনস্ক ভাবেই দেখছিলো। ওর বয়েস পঁচিশের বেশী হবে না। দেখতে সুশ্রী না হলেও ডার্কসনের মুখে সাহস ও দৃঢ়তার আভাস রয়েছে। এবং সেটা মরগ্যানের চোখ এড়ালো না।
ডার্কসনকে খুন করা ছাড়া জিনির আর কোনো উপায় নেই ব্লেক ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো। সে হঠাৎই যেন ঘামাতে শুরু করেছে আচ্ছা, জিনি কি ডার্কসনকে একবারও দেখেছে?
হা গতকাল দেখেছে। কিন্তু একবারও মেয়েটা ভয় পায়নি। বারবারই বলেছে, ডার্কসনকে ও ঠিক কব্জা করতে পারবে? তারপর জানি না, কি করবে।
এমন সময় এজেন্সীর দরজা খুলে গেলো, ডার্কসন ভেতরে ঢুকলে আবার দরজা বন্ধ হয়ে গেলো।
কিটসন দেখছি ঠিকই বলেছে। এ তো সহজে হার মানবার পাত্র নয়। ব্লেক শান্তস্বরে বললো, প্রথমেই একে শায়েস্তা করতে হবে, ফ্র্যাঙ্ক, তা নইলে পরে বিপদ হতে পারে।
মরগ্যান বললো, হ্যাঁ, এবং সেই শায়েস্তা করার দায়িত্বটা তোমার! জিনির ওপর এ দায়িত্ব দেওয়া চলবে না, কারণ ও হয়তো ডার্কসনের ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঠিক পেরে উঠবে না। ড্রাইভারকে আমিই টিট করবো। তোমার কাজ হবে একটা রাইফেল নিয়ে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা। ডার্কসন যেই ট্রাক ছেড়ে বেরোবেতখনি তুমি তার দিকে রাইফেল তাক করবে। একমুহূর্তের জন্যও অন্যমনস্ক হবে না। জিনির রিভলবারের সামনে ওর চালচলনের এতোটুকু এদিক ওদিক দেখলেই গুলি করবে। কোনোরকম ইতঃস্তত করবে না, বুঝেছো?
ব্লেকের গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ, একটা তিক্তস্বাদ অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে শুকনো জিভটাকে মুখের চারপাশে বুলিয়ে নিলো, ঘাড় নাড়লো, নিশ্চয়ই, সেজন্য তুমি ভেবো না। ডার্কসনকে আমি চোখে-চোখে রাখবো।
মরগ্যান দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ঐ যে দ্বিতীয় বাসটা আসছে। সেই সঙ্গে আমার শিকার আসছে–ডেভ টমাস।
ওয়েলিং এজেন্সীর ট্রাক ড্রাইভার টমাস বেশ লম্বা–চওড়া লোক। চলাফেরায় ডার্কসনের সঙ্গে অনেক সাদৃশ্য আছে। সেই একই রকম উদ্ধত চিবুক, শীতল অচঞ্চল চোখ, পাতলা টানা ঠোঁট। কিন্তু টমাসের বয়স কিছু বেশীই হবে–তিরিশ–বত্রিশের কাছাকাছি। বাস থেকে নেমে সেও এজেন্সীর দরজার দিকে এগিয়ে চললো।
একদৃষ্টে, সরীসৃপশীতল চোখেমরগ্যানটমাসের দৃঢ়বলিষ্ঠ পদক্ষেপ দেখতে লাগলো। চিন্তার ভাজ পড়লো কপালে।
মরগ্যান বিরক্ত ভাবে বলে উঠলো, এই হলো দুনম্বর হারামজাদা। নাঃ; লোক বাছাই করার ব্যাপারে ওয়েলিং এজেন্সীর তুলনা নেই। কোত্থেকে যে এই লোক দুটোকে যোগাড় করলো কে জানে। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ এড টমাসকে আমার খুনই করতে হবে। তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
ব্লেক মাথা থেকে টুপি নামিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। হঠাৎ তার বুকের স্পন্দন যেন বেড়ে উঠলো। আমাদের এই পরিকল্পনার একটু এদিক-ওদিক হলেই আমরা কিন্তু জালে আটকা পড়বো ফ্র্যাঙ্ক। সুতরাং আমাদের ভীষণভাবে সাবধান হতে হবে।
মরগ্যান স্বপ্নাচ্ছন্ন স্বরে বললো, এ কাজে সাফল্যের পুরস্কার দশ লক্ষ ডলার। এবং সেই কারণে আমার দৃষ্টিভঙ্গি একটু আলাদা। এড, আমার বয়স বর্তমানে বিয়াল্লিশ বছর তার মধ্যে পনেরোটা বছরই জেলে কেটেছে। যে কবছর বাইরে ছিলাম, সে কটা বছরও পুলিসের নজর বাঁচিয়ে, লুকিয়ে চলতে হয়েছে। এই করে জীবনের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে। এতদিনে জীবনের সার যা বুঝেছি, তা হলো টাকা। অতএব ঐ ট্রাকের টাকা হাতানোর ব্যাপারে কোন বাধাই আমাকে রুখতে পারবে না–টমাস, ডার্কসন তো দূরের কথা। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছো এড, আমরা এখন ঠিক কি অবস্থায় আছি। আমরা মরলাম কি বাঁচলাম তাতে কার কি এসে যায়? সূর্য যেমন উঠছিলো তেমনি উঠবে। শহরের কর্মব্যস্ত জীবনে এতটুকু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবেনা। আমরা একেবারে ফালতু।
ব্লেক শান্তস্বরে বললো, ভাবিনা যে নয়। তবে আমি কি ভাবছি জানো? আমি ভাবছি কিটসন আর জিপোর কথা। জিনির সামনে বাহাদুরি দেখাবার জন্যে তো রাজী হলো–ভোটও দিলো আমাদের স্বপক্ষে। কিন্তু পরে কি হবে সেটা কি চিন্তা করে দেখেছো?
মরগ্যান দৃঢ়কণ্ঠে বললো, ও নিয়ে ভাববার কি আছে? ওরা যখন রাজী হয়েছে তখন কাজটা ওদের করতেই হবে।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত যদি ওদের মাথার ঠিক থাকে
থাকতেই হবে। না হলে
তোমার কথাই যেন সত্যি হয়। তবে বলা যায় না, শেষ পর্যন্ত হয়তো ওরা
অচঞ্চল চোখে মরগ্যান ব্লেকের দিকে তাকিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপেকর্কশ স্বরে বললো। একবার যদি টাকাটা আমরা দখল করতে পারি, তবে ওটা আমরা খুলবোই–ওদের দুজনের সাহায্য নিয়েই হোক বা না নিয়েই হোক! এতোটা পথ এসে ফ্র্যাঙ্ক মরগ্যান, কোনো মতেই হাল ছাড়তে রাজী নয়।
মাথা নেড়ে ব্লেক সম্মতি জানালো, কিন্তু এ ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে, ফ্র্যাঙ্ক। এই কাজের প্রাথমিক খরচ হিসেবে অন্ততঃ দু হাজার ডলার আমাদের দরকার। কাল রাতে আলোচনার সময় আমরা কিন্তু এ কথাটা একবারও ভেবে দেখিনি। টাকাটা যোগাড় হবে কোত্থেকে বলল দেখি?
আমাদের একটা ছোট কাজে হাত দিতে হবে–যে কাজে বিপদের কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ আমাদের সামনে পড়ে রয়েছে আসল কাজ–দশ লক্ষ ডলার, তার আগেই যদি পুলিশ আমাদের পিছু নেয় তবে এতো পরিশ্রম, এত সাবধানতা সব পণ্ড হবে। সেই জন্যই আমরা যে ছোট কাজটায় হাত দেবো, সেটা সহজ, সরল, নির্ঝঞ্ঝাট হওয়া দরকার। আমি কাল রাত থেকেই এ নিয়ে ভাবছি
সিগারেটে এক জোরালো টান দিলো ব্লেক, দশ নম্বর সড়কের পেট্রল পাম্পটা লুঠ করলে কেমন হয়? ঐ যে, ডুকাস যাবার পথে
হ্যাঁ, করা যায়। তবে আমি ভাবছিলাম আরও নির্জন কোনো জায়গার কথা–মানে ঠিক বড় রাস্তার ওপর কোনোরকম ঝামেলা করতে চাইছি না। আচ্ছা এড, ম্যাডক্স স্ট্রীটের ঐ কাফেটার কথা তোমার মনে পড়ছে। যেটা সারারাত খোলা থাকে?
হ্যাঁ, কিন্তু কেন?
আমি ওটার কথাই মনে মনে ভাবছি। রাত্রিবেলা থিয়েটার সিনেমার শেষে বেশীরভাগ লোকই ঐ কাফেটায় যায়। আর পকেট তাদের ভারীই থাকে। কাজটায় কোনো উটকো ঝামেলার ভয় নেই।
আমতা আমতা স্বরে ব্লেক বললো, কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক, কাজটা কি সত্যিই খুব সহজ? আমার তো তা মনে হয় না? হঠাৎ যদি কোনো খদ্দের অতিমাত্রায় সাহসী হয়ে ওঠে, তাহলে?
মরগ্যান ধূর্ত হাসি হাসলো, তাহলে তো খুব ভালো হয়, আমরা আসল কাজের মহড়া দিয়ে নিতে পারবো। কারণ তুমি ভালোভাবেই জানো, টমাস এবং ডার্কসন–ওরা দুজনেই খোলা রিভলবারের সামনে দুঃসাহসী হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া জিনিকেও একটু পরীক্ষা করা যাবে।
তার মানে মেয়েটা এ কাজেও আমাদের সঙ্গে থাকবে?
হা। আর থাকবে কিটসন। ওর ওপরে থাকবে গাড়ির দায়িত্ব। রিভলবার নিয়ে তুমি ও আমি কাফের লোকগুলোকে সামলাবো। জিনির কাজ হবে প্রত্যেকের কাছ থেকে টাকাগুলো আদায় করা–ব্যস!
ব্লেক ব্যঙ্গভরে প্রশ্ন করলো, ট্রাকের ব্যাপারটা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু জিপো কি এই কাজেও কোনো গতর খাটাবে না, ফ্র্যাঙ্ক?
শোনো এড, জিপোকে নিয়ে তোমার এই চুকলিপনা বন্ধ করো। এ কাজে জিপোকে আমাদের প্রয়োজন হবে না। কেবলমাত্র এজেন্সীর ট্রাকের তালা খুলতে আমরা ওর সাহায্য নেবো। কারণ জিপোছাড়া আর কারো পক্ষে যে ওই তালা খোলা সম্ভবনয়, সেটা তুমি বেশ ভালোভাবেই জানো। তুমি কি বল?
ব্লেক কাঁধ ঝাঁকালো, নিশ্চয়ই। তবে ভাবছি, জিপোর মতো আমিও যদি তালা বিশারদ হতাম তাহলে বেশ পায়ের উপর পা তুলে আরামে দিন কাটাতে পারতাম। যাক গে এবার বলল, ক্যারাভানটা আমরা কোত্থেকে যোগাড় করছি?
শুনেছি মার্লোয় একটা দোকান আছে, যারা ক্যারাভান বিক্রি করে। টাকাটা হাতে আসামাত্রই আমি কিটসন আর জিনিকে সেখানে পাঠিয়ে দেবো। ওরা গিয়ে স্বামী স্ত্রী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেবে। বলবে, মধুচন্দ্রিমা কাটানোর জন্য একটা ক্যারাভান ওদের দরকার।
ব্লেক হাসলো, কিটসনের দিকে নজর রেখো ফ্র্যাঙ্ক। ও যেন এই মধুচন্দ্রিমার ব্যাপারটাকে আবার সত্যি বলে না ভাবে।
মরগ্যান খিঁচিয়ে উঠলো, এক কথা বার বার বলা আমি পছন্দ করিনা এড। এমনিতেই আমাদের হাতে সমস্যার অন্ত নেই। তা সত্ত্বেও যদি কেউ জিনির ব্যাপারে কৌতূহল দেখাতে চায় তবে ভুল করবে। তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি; কোনোরকম লক্কাবাজি আমি বরদাস্ত করবো না। কিটসন আমাদের চেয়ে বয়সে ছোট। সুতরাং সদ্য–বিবাহিত স্বামীর ভূমিকায় সে–ই অভিনয় করবে। তবে সেটা কেবলমাত্র অভিনয়, তার বেশী কিছু নয়। আর আলেক্সের মাথায় যদি এই ব্যাপারটা না ঢোকে তবে সবার আগে ওকে আমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
ব্লেক বললো, কিন্তু জিনি? তুমি কি এ সম্বন্ধে ওকে সাবধান করে দিয়েছো? বলেছো, ওকে কিভাবে সংযত হয়ে চলতে হবে?
চাপা হিংস্রস্বরে মরগ্যান উত্তর দিলো, আমি জানতাম একসময় কথাটা উঠবে। আমি যখনই জিনিকে দেখেছি, তখনই জানি, তোমরা তিন ভেড়ুয়া ওর পেছনে লাগবে। সেইজন্য প্রথম দিনই ওকে আমি বলেছি, কোনোরকম ছেনালিপনা দেখলেই সোজা তাড়িয়ে দেবো। আমার কথা শুনে ও কি বলেছিলো জানো? ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। আমার শুধু টাকার দরকার। অতএব তোমার পেয়ারের কুত্তাদের তুমিই সামলাবে। সুতরাং বুঝতেই পারছো, টাকা ছাড়া মেয়েটা কিছুই বোঝে না। কিটসন যদি মেয়েটাকে নিয়ে কোন গণ্ডগোলের সৃষ্টি করতে চায়। তবে ও নিজেই বিপদে পড়বে। তোমার আর জিপোর বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হবেনা। সুতরাং মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দাও। এবারে আশা করি কথাগুলো তোমার মাথায় ঢুকেছে?
জোরালো গলায় ব্লেক হাসলো, নিশ্চয়ই। আমারও মনে হয় এক্ষেত্রে সেরকম কিছু ঘটনার সম্ভাবনা নেই।
বিদ্যুৎ ঝলকের মতো মরগ্যানের শীতল, সরু পাঁচটি আঙুল আঁকড়ে ধরলো ব্লেকের কব্জি। চমকে উঠে সে তাকালো মরগ্যানের কালো হায়না চোখে।
মরগ্যান নরমস্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, আমি ঠাট্টা করছিনা, মিস্টার এডওয়ার্ড ব্লেক। আমার ছকে বাঁধা অন্ধকার জীবন থেকে বেরিয়ে আসার এই একমাত্র সুযোগ। তুমি যদি ভেবে থাকো একটা বিশ বছরের মেয়ের সঙ্গে লেপটা–লেপটি করে আমার পরিকল্পনার ফাটল ধরাবে–তবে মনে রেখ, যদি আমি দেখি, তোমার রিপু সংক্রান্ত দুর্বলতার জন্য আমাদের এই সুবর্ণসুযোগ নষ্ট হতে যাচ্ছে, তখন তোমাকে কুকুরের মতো গুলি করে মারবো। মনে কোরো না, তোমার, জিপোর বা কিটসনের যৌন তাড়নার জন্য আমি আমার ভবিষ্যতের গোড়ায় কুড়ুল মারবো। আমার কথা বুঝতে নিশ্চয়ই তোমার অসুবিধে হচ্ছে না?
ব্লেক শুকনোমুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, তোমার হলো কি, ফ্র্যাঙ্ক? আমি এমনি ইয়ার্কি করছিলাম।
ব্লেকের দিকে সামান্য ঝুঁকে মরগ্যান তামাকের গন্ধভরা নিশ্বাসের ঝাপটা মারলো, ইয়ার্কিই যেন হয়!
একদীর্ঘ উৎকণ্ঠাময় নিস্তব্ধতা। দুজনের স্থির কঠিন দৃষ্টি–পরস্পরের ওপর নিবদ্ধ। অবশেষে পরিস্থিতি হালকা করার উদ্দেশ্যে ব্লেক বলে উঠলো, তোমার কি মনে হয় এই গাড়িটা ক্যারাভানটাকে টানতে পারবে?
পারতেই হবে–অবশ্য ক্যারাভানটা যে ভারী হবে না তা আমি বলছি না। তবে রাস্তাও খুব একটা উঁচুনীচুনয় যে ক্যারাভানটাকে টেনে নিয়ে যেতে গাড়িটার অসুবিধে হবে। শুধু প্রথম তিরিশ চল্লিশ মিনিট আমাদের একটু কষ্ট করতে হবে। কারণ ওই সময়ের মধ্যেই অকুস্থল থেকে যতোটা দূরে যাওয়া যায় আমাদের সরে পড়তে হবে। তারপরে আর ভাবনার কিছু নেই।
আসল কাজের দিন দুয়েক আগে কোনো একটা পার্কিং করা গাড়ি লোপাট করলেই হবে। তুমি দুটো নকল নাম্বার–প্লেট আগে থাকতেই তৈরী করে রেখো, আর জিপোর কাজ হবে চোরাই গাড়িটার রঙ পাল্টে নতুন রঙ লাগানো। জিনি যখন গাড়িটা চালাবে, তখন যেন ওটা চোরাই গাড়ি বলে কোনো পুলিশের চোখে ধরা না পড়ে।
ব্লেক হঠাৎ কনুই দিয়ে মরগ্যানের পাঁজরে একটা খোঁচা মারলো। মরগ্যান চমকে তাকাতেই দেখে ট্রাকটা আসছে
আর্মার্ড ট্রাক এজেন্সীর চওড়া কাঠের দরজা হাট করে খুলে গেলো।
মরগ্যান আর ব্লেক আগে ট্রাকটাকে কখনও স্বচক্ষে দেখেনি। ওরা ট্রাকের প্রতিটি অংশের ছবি নিখুঁত করে মনে এঁকে নিলো।
ব্লেক ভেবেছিলো এই অদ্ভুত যুগান্তকারী জিনিসটা বেশ বড় সড়ই হবে। কিন্তু ওটার, ক্ষুদ্র আকৃতি ওকে অবাক করলো। চারটে চাকার ওপর বসানো একটা ছোট্ট, ইস্পাতের বাক্স–আর তার সামনে ড্রাইভারের কেবিন–ব্যস। টমাসের হাতজোড়া স্টিয়ারিংয়ের ওপর সহজ অথচ পেশাদারী ভঙ্গীতে আলতো করে রাখা, চোখের সতর্ক দৃষ্টি সামনের রাস্তার ওপর। টমাসের পাশেই টান টান হয়ে মাইক ডার্কসন বসে।
আস্তে আস্তে ট্রাকটা রাস্তার ওপরে নেমে এলো। মরগ্যানও তার গাড়ীর ইঞ্জিন চালু করলো। এমনিতেই রাস্তাটায় হাজারো গাড়ির জটলা। অনেক চেষ্টায় মরগ্যান চলন্ত ট্রাকটার কাছাকাছি এগিয়ে গেলোমাঝখানে শুধু দুটো গাড়ির ব্যবধান।
ভেবেছিলাম ট্রাকটা অনেক বড় হবে, কথা বলতে বলতে ব্লেক উঁচু হয়ে সামনের লিংকন গাড়িটার বাধা কাটিয়ে ট্রাকটাকে দেখতে চেষ্টা করলো দেখে তো জিনিষটাকে খুব একটা শক্ত পোক্ত বলে মনে হচ্ছে না।
মরগ্যান হাসল, তাই নাকি? তোমার মতো অনেকেই ট্রাকটার এই ছোট আকার দেখে ভুল করে।
রাষ্য একটু ফাঁকা হতেই অভ্যস্ত ক্ষিপ্রতায় মরগ্যান লিংকন গাড়িটার পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে এলো। এবারে ট্রাকের পেছনটা ওরা পরিষ্কার দেখতে পেলো, কারণ মরগ্যানের বুইক আর ওয়েলিং এজেন্সীর ট্রাকের মধ্যে এমন ব্যবধান শুধু একটা হুড খোলা স্পোর্টস কার।
ট্রাকের পেছনের দরজায় ছাপা হরফে লেখা–
দি ওয়েলিং আর্মার্ড ট্রাক সার্ভিস
আবিষ্কারের জগতে এক নতুন আলোড়ন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে নিরাপদ ট্রাক আপনার সামনে উপস্থিত। মূল্যবান জিনিষপত্র পরিবহনের দায়িত্ব আমাদের হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন।
শ্বাস প্রশ্বাস ভারী হয়ে এলো ব্লেকের।
মরগ্যান হঠাৎ বলে উঠলো, ডানদিকে দ্যাখো?
ব্লেকের বিবর্ণ চোখ ডানপাশে ফিরে তাকালো।
একজন দ্রুতগামী পুলিশ মোটর বাইক নিয়ে গাড়ির ভীড় কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে অপসৃয়মান ট্রাকের দিকে।
মরগ্যান বললো, এবার কেটে পড়াই ভালো। এই শালা এখন থেকে শহরের শেষ পর্যন্ত ট্রাকটার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকবে। আর আমরা যদি এখুনি ঐ ট্রাকের পিছু না ছাড়ি, তবে ঐ মোটর বাইকওলা সন্দেহ করবে।
মরগ্যান গাড়ি ঘুরিয়ে পাশের একটা রাস্তায় ঢুকে পড়লো।
ওয়েলিং এজেন্সীর ট্রাকটা শেষবারের মতো ব্লেকের চোখে পড়লো–তার পাশাপাশি সেই দ্রুতগামী পুলিশ অফিসার এগিয়ে চলেছে।
মরগ্যান সামনে একটা গাড়ি রাখার জায়গা দেখে বুইকটা থামালো, যাক, ট্রাকটা তাহলে তোমার দেখা রইলো
তা রইলো, কিন্তু তাতে সুবিধে হলোবলে তো মনে হয় না। শুধু একটা ইস্পাতের বাক্স–ব্যস। ওহহো, তুমি সময়টা লক্ষ্য করেছিলে তো। কখন ট্রাকটা এজেন্সী ছেড়ে বেরোলো?
মরগ্যান একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, হ্যাঁ। ঠিক আটটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিটে। এখন থেকে মোটামুটি তিনঘন্টা পরে ট্রাকটা সেই বিপজ্জনক বাঁকের কাছে পৌঁছবে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, জিপো আর কিটসন এই গরমে ঝোঁপের পিছনে বসে গলদঘর্ম হয়ে ট্রাকটার অপেক্ষা করছে।
তুমি ঠিকই বলেছো, ফ্র্যাঙ্ক। কাজটা যে বড় সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই–তবে একেবারে সোজা নয়। এর জন্য আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
যদি ভাগ্য সহায় থাকে। তাহলে চিন্তার কোনো কারণ নেই। ভালো কথা–এখন একবার সেই কাফেটায় গিয়ে চোখ বুলিয়ে আসতে হবে। কারণ ওটা লুঠ করার পর আমরা কোন রাস্তা দিয়ে পালাবো সেটা আগে থাকতেই দেখে রাখা দরকার। শোনো এড, এই ছোট কাজটায় আমাদের কোন রকম ভুল করলে চলবে না। এর ওপরেই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
শুধু এটা কেন, আসল কাজেও আমাদের কোনো গলতি হবে না। এখন থেকে আর কোনো ভুল নয়।
মরগ্যান মাথা নাড়লল। তারপর গাড়ি সামনের রাস্তায় ছুটিয়ে দিলো।
.
এদিকে কিটসন আর জিপো সাড়ে এগারোটার কিছু পরে বিপজ্জনক বাঁকের কাছে পৌঁছলো। রিসার্চ স্টেশন থেকে বাঁকটার দূরত্ব মাইল দুয়েক হবে। কিটসন গাড়ি থামাতেই জিপো নেমে পড়লো। ঝরঝরে লিংকটা চালিয়ে কিটসন আশ্রয়ের খোঁজে চললো। তারপর ধীরে ধীরে আবার পা বাড়ালো বাঁকের দিকে–যেখানে জিপো অপেক্ষা করছে।
কিটসনের কাছে সূর্যের প্রখর রোদের তাপ অসহ্য বলে মনে হলো। সে অল্পক্ষণের মধ্যেই। ঘামতে শুরু করলো।
কিটসনের পরনে বুক ভোলা গাঢ় নীল রঙের শার্ট আর আঁটোসাঁটো কালো প্যান্ট। এতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকার পর হাত পা ছড়ানোর সুযোগ পেয়ে তার ভালোই লাগলো। সে ধুলো ভরা রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো।
কিটসন বাঁকটার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে কৌতূহল ভরে জায়গাটা দেখতে লাগলো।
হঠাৎ রাস্তাটা সোজা এসে এই জায়গায় খানিকটা সরু হয়ে গেছে। রাস্তার দুধারে পড়ে রয়েছে দুটো বিশাল পাথর, সম্ভবতঃ দুপাশের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তায় গড়িয়ে এসেছে। পাথরগুলো যেন ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা–অর্থাৎ গা ঢাকা দেওয়ার পক্ষে চমৎকার জায়গা।
কিটসনের হঠাৎ খেয়াল হলো, জিপোর যেখানে অপেক্ষা করার কথা সেখানে সে নেই। কিন্তু একটা হালকা অস্বস্তিকর অনুভূতি তাকে জানিয়ে দিলো, আশেপাশেই সে কোথাও লুকিয়ে আছে–কিটসনকে লক্ষ্য করছে।
কিটসন খুশীই হলো। জিপোর মতো কোনো স্থূলকায় লোকও যে এতো নিখুঁতভাবে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তার হারানো আত্মবিশ্বাস আবার ফিরে এলো।
কিটসনের প্রথম থেকেই এই কাজে আপত্তি ছিলো। কেমন যেন একটা অজানা আতঙ্ক ওর সমস্ত সাহসকে শুষে নিচ্ছিলো। ওর বার বারই মনে হয়েছে, টমাস অথবা ডার্কসন কিছু একটা গণ্ডগোল না বাঁধিয়ে ছাড়বে না।
গত ছমাস ধরে বক্সিং ছাড়বার পর থেকে কিটসন মরগ্যানের কাছেই রয়েছে। কিটসনের শেষ লড়াই ছিলো একজন বেঁটে খাটো অনামি মুষ্টি যোদ্ধার সঙ্গে। কিন্তু এমনই অদ্ভুত ব্যাপার সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই ক্ষিপ্র, খর্বকায় ব্যক্তিটি কিটসনের মতো নওজোয়ানকে রিংয়ের ভেতর একেবারে তুলোধোনা করলো।
টমাস ও ডার্কসন যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে হার স্বীকার করবেনা তা কিটসন জানে;বরং রিভলবার চালাবার চেষ্টা করবে–হয়তো কেউ মারাও পড়বে। আর তারপর যদি কিটসন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, তাহলে বিশ বছর জেল নয়তো সোজা ইলেকট্রিক চেয়ার।
আজ পর্যন্ত কোন মেয়ে জিনির মতো করে কিটসনের সঙ্গে কথা বলেনি, এমন অদ্ভুতভাবে কোনদিন কেউ তাকায়নি। মেয়েটার এই বিশেষত্বই মুগ্ধ করেছে কিটসনকে। এমন কি প্রথম সাক্ষাতের নেশাটুকুও সে কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। তার চোখের সামনে ভাসছে জিনির একরাশ তামাটে চুলের জলছবি। ওর সাগর সবুজ চঞ্চল চোখ জোড়া
অর্থাৎ জিনির জন্য কেবলমাত্র জিনির জন্যই সে এই কাজে মরগ্যানকে সমর্থন করেছে। কিটসন জানে, এই দুঃসাহসের পরিণতি তেমন মধুর হবে না; হয়তো চরম পরিণতির মুখোমুখি তাকে দাঁড়াতে হবে কিন্তু তবুও সে পিছিয়ে আসতে পারছেনা। পারছেনা জিনির উপহাসের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে।
কিটসন জিপোকে খুঁজলো চারদিকে চেয়ে আরো একবার, কিন্তু কোথাও ওকে দেখতে পেলো না।
জিপো, ঠিক আছে–এবারে বেরিয়ে এস। কিটসন উঁচু গলায় ডেকে উঠলো।
জিপো একটা ঘন ঝোঁপের আড়াল থেকে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো। কিটসনের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ালো, লুকিয়েছি কিরকম বলো? এক্কেবারে হাপিস! তুড়ি বাজিয়ে এক অদ্ভুত ইশারা করলো জিপো।
জিপোর কাছে কিটসন এগিয়ে গেলো।
একটা লুকোবার জায়গা বটে! উবু হয়ে জিপোর পাশে বসে জায়গাটা দেখতে লাগলো সে, তারপর একপলক হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললো, আর মিনিট কুড়ির মধ্যেই ওরা এসে পড়বে।
মাটির ওপর জিপো চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। ওপরের নীল আকাশের দিকে শূন্য চোখে চেয়ে একটা কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে লাগলো।
আলেক্স, নীল আকাশের দিকে তাকালেই আমার দেশের কথা মনে পড়ে। মনে হয়, সেখানকার আকাশ যেন এর চেয়েও সুন্দর, এর চেয়েও নীল।
জিপোর দিকে কিটসন তাকালো। জিপোকে তার ভালো লাগে।
জিপো, কোথায় দেশ তোমার? কিটসন উপুড় হয়ে শুয়েছিলো। অতি সন্তর্পণে মাথা উঁচিয়ে সে সামনের রাস্তার দিকে দেখলো।
ফিসোলে, ইটালির ফ্লোরেন্সের কাছাকাছি। মুখে গভীর চিন্তার ভাব ফুটিয়ে জিপো বললো, তুমি কোনদিন ইটালিতে গেছে, আলেক্স?
উ হু–
যাওনি? গেলে বুঝতে পারতে পৃথিবীতে তার চেয়ে সুন্দর দেশ আর নেই।
কিটসন ভাবলো–যদিনা মারা যাও। যদিনা জাহাজে ওঠার আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়ো।
কিটসনের দিকে জিপো খুশীভরা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, তোমার টাকা নিয়ে কি করবে ভাবছো? কিভাবে খরচ করবে ঠিক করেছে?
জিপোর কথা শুনে কিটসনের মনে হলো সে যেন কোনো অপরিণত বুদ্ধি সম্পন্ন কিশোরের সঙ্গে কথা বলছে।
আমার মনে হয় টাকাটা হাতে পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা ভালো। সাত তাড়াতাড়ি এতো সব পরিকল্পনা করার মানে হয় না। বলা যায় না, শেষ পর্যন্ত হয়তো আমরা হেরে গেলাম–তখন সমস্ত স্বপ্ন এক ঝাপটায় মিলিয়ে যাবে।
অস্বক্তিভরে জিপো বললো, একটা কথা কি জানো আলেক্স। জীবনে স্বপ্ন দেখাটাই সবচেয়ে সুন্দর জিনিস। জানি, সে স্বপ্ন হয়তো কোনদিন বাস্তবে রূপ নেবে না। কিন্তু তবুও স্বপ্ন দেখায় এক অদ্ভুত আনন্দ আছে। আমি সব সময় আসন্ন ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল ভাবতে ভালবাসি। এ আমার বহু বছরের স্বভাব। স্বীকার করছি, আজ পর্যন্ত আমার সমস্ত স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে, কিন্তু এবারের কথা আলাদা। দু লক্ষ ডলার……..এতো টাকা কিভাবে খরচ করবো ভেবেই পাচ্ছি না।
কাঁধ ঝাঁকালো কিটসন, হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু আসল কথাটা কি জানো? টাকাটাই আমরা এখনও হাতে পাইনি, বলে হাসলো।
জিপো শুকনো মাটি মুঠো করে তুলে হাত মেলে ধরলো। তার মোটা সোটা আঙুলের ফাঁক দিয়ে ধুলো ঝরে পড়লো। আমি বাজি রেখে বলতে পারি তুমি প্রথমেই গাড়ি কিনবে। বলল আলেক্স ঠিক বলেছি কিনা? আমি জানি। তুমি গাড়ি চালাতে ভালোবাসো। তোমার মতো গাড়ি চালাতে আমি আর কাউকে দেখিনি। সুতরাং প্রথমেই তোমার একটা স্পোর্টসকার কেনা উচিত। তারপর খুঁজেপেতে নিজের জন্য একটা সুন্দরী বউ যোগাড় করো বাকি জীবনটা সুখে কাটিয়ে দাও। আচ্ছা, জিনিকে তোমার কেমন লাগে বলো তো? দারুণ দেখতে, না? একটা কথা আলেক্স –ইটালীর মতো জায়গাতেও জিনির মত সুন্দরী কমই আছে। তবে মেয়েটা আমার তুলনায় বড্ড বাচ্চা, না হলে ওকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতাম। তোমার সঙ্গে জিনিকে কিন্তু দারুণ মানাবে। আলেক্স, ওর রুক্ষ ব্যবহারকে তেমন আমল দিও না। ও সবই উপর উপর। তুমি যদি ওর হৃদয়ে পৌঁছতে পার, তবে দেখবে ওর ভেতরটা আর সব মেয়ের মতোই সুন্দর নরম। আমার তো মনে হয়, তোমাকে ও কিছুতেই ফেরাতে পারবে না!
চুপচাপ কিটসন শুনলো। উন্মুক্ত ঘাড়ে উত্তপ্ত সূর্যের পরোক্ষ স্পর্শ অনুভব করলো। জিপো ছাড়া অন্য কেউ যদি তাকে এ ধরণের কথা বলতো, তাহলে মোটেই আমল দিত না। কিন্তু জিপো একেবারেই তার মনের কথা বলেছে। কথাগুলো হয়তো ঠিক।
আলেক্স, আমার কাছে একটা কথার খোলাখুলি জবাব দাও তো? তুমি সত্যি সত্যি কি ভাবছো? জিনির কথা? জানো, তোমার জন্যে মাঝে মাঝে আমার চিন্তা হয়। এই কথায় তোমার হয়তো হাসি পাবে। কিন্তু আমি ঠাট্টা করছিনা, আলেক্স। কাল রাতে ফ্র্যাঙ্কের কথায় যখন মনে মনে রাজি হলাম, তখনও আমি তোমার কথা ভেবেছি। আমি জানতাম, আমার মতো তোমারও এ কাজে অন্তরের সায় নেই। তুমি এ কাজটা করতে চাওনি, তাই না? আমিও চাইনি। কিন্তু পরমুহূর্তেই তুমি হঠাৎ মনস্থির করে ফেললে, তুমি রাজী! কেন? আমাকে সোজাসুজি জবাব দাও!
কিটসন হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো, আগে বলল তোমার রাজী হওয়ার কারণ কি?
জিপো মৃদু স্বরে বললো, মেয়েটার মধ্যে কি যেন একটা আছে! ও যখন ঘরে ঢুকলো, তখন ওকে দেখে অবাক হলাম। ওর কথা বলার দৃপ্ত ভঙ্গী, আত্মবিশ্বাস আমাকে অবাক করলো। আমি যেন নিজের ওপর আস্থা ফিরে পেলাম। ফ্র্যাঙ্কের কাছে যখন কাজটা সম্পর্কে শুনেছি, তখন একেবারে রাজী হইনি। সমস্ত পরিকল্পনাটাকে কেমন খেলো, অবাস্তব বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু জিনি এসেই সব ওলট–পালট করে দিলো। মনে হল মেয়েটার পরিকল্পনা নেহাত পলকা নয়। তার ওপর দু লক্ষ ডলারের হাতছানি আমাকে পাগল করে তুললো।
কিটসনের স্বরে অস্বস্তির সুর, হঁ, তুমি ঠিকই বলেছে। মেয়েটার মধ্যে কি যেন একটা আছে। তাই তোমার মতো আমিও রাজী হয়ে গেলাম।
সে যে জিনির ঘৃণার মুখোমুখি দাঁড়াতে না পেরে মরগ্যানের স্বপক্ষে ভোট দিয়েছে, সে কথা কিটসন মরে গেলেও স্বীকার করতে পারবে না।
আশ্চর্য ব্যাপার, তাই না? ঐটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে কিনা আমাদের রাজী করিয়ে ছাড়লো। এখন মনে হচ্ছে–আচমকা জিপো নেমে গেলো। চকিতে দেখলো চারপাশের ঝোঁপঝাড়ের দিকে।
কি ব্যাপার? কিটসন জানতে চাইলো।
জিপো কান খাড়া করে স্থিরভাবে বসে। কিসের যেন একটা শব্দ হলো না? যেন কিছু একটা চলে বেড়াচ্ছে? সাপ নয়তো, আলেক্স?
সাপ? তো কি হয়েছে? সাপ আমাদের ধারে কাছেও ঘেঁষবে না। কিটসন চাইছিলো জিনি সম্পর্কিত কথাবার্তা চালিয়ে যেতে। জিনিই এখন তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
জিপোর জলহস্তী চেহারা ভয়ে কাঠ। শুকনো গলায় বললো, বলা যায় না; এসব জায়গায় সাপের উপদ্রব থাকতে পারে, আলেক্স। আর এমনিতেই সাপকে আমি খুব ভয় পাই। যেন মনে হলো পাশ দিয়ে কি একটা চলে গেল।
জিপোর নির্দেশিত জায়গায় কিটসন কিছুই দেখতে পেলো না।
আলেক্স, আমার ছোট ভাই সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিলো। আমি এইমাত্র যেভাবে শুয়েছিলাম সেও এই ভাবেই শুয়েছিল। আর কোত্থেকে হঠাৎ একটা সাপ এসে ওর মুখে ছোবল মারলো। কোনো ভাবে বাড়ি পৌঁছবার আগেই ও মারা গেলো। –ওর চোখে মুখে অমানুষিক যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠেছিলো। এই সাপটা
জিপো চুপ করে গেলো। কিটসনের রুক্ষ স্বরে ভগবানের দোহাই, জিপো, দয়া করে তোমার বকবকানি বন্ধ করো।
জিপো ঘৃণাভরে কিটসনের দিকে তাকালো।
তোমার ভাই যদি এইভাবে সাপের ছোবলে মারা যেতো, তাহলে তুমি আর এধরণের কথা বলতে না, আলেক্স। আমার ছোট ভাইয়ের সেই করুণ মৃত্যুর কথা কি আমি ভুলতে পারবো? কেন জানি না, তারপর থেকেই সাপ দেখলেই আমার ভীষণ ভয় করে।
কিটসন অধৈর্য সুরে বলল, কোথায় মেয়েটাকে নিয়ে দিব্যি কথা বলছিলাম, আর মাঝখান থেকে তুমি, এই সাপের ব্যাপারটা টেনে আনলে।
না, আমার মনে হলো যেন কিসের একটা শব্দ, তাই
ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে–মেনে নিচ্ছি তুমি একটা অদ্ভুত শব্দ শুনেছো। কিন্তু তাই বলে ধরে নিলে ওটা সাপ। তোমার কল্পনার বলিহারিই…।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো জিপো, কিন্তু বহুদূরে চলন্ত ধুলোর মেঘ চোখে পড়ায় চুপ করে গেলো। কিটসনের কাঁধে হাত রেখে আঙুল তুলে ধুলোর কুণ্ডলীর দিকে দেখালো।
ওরাই আসছে বলে মনে হচ্ছে না?
সুদূরপ্রসারী আঁকাবাঁকা রাস্তার দিকে কিটসন চেয়ে রইলো। একটা জমাট আতঙ্কের পিণ্ড তাকে শ্বাসরুদ্ধ করতে চাইলো।
সে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে হাত বাড়িয়ে জিপোকে নীচু হতে বললো, জিপো তার চাপা উত্তেজিত ফিসফিসে কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। লুকিয়ে পড়ো! ওরাই আসছে!
ওরা নিশ্চলভাবে পড়ে থেকে দ্রুত এগিয়ে আসা ট্রাকটাকে লক্ষ্য করতে লাগলো।
সামনের একটা বাঁকে ট্রাকটা মুহূর্তের জন্য অদৃশ্য হলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওদের অপলক চোখের সামনে আবার হাজির হলো। ওরা লক্ষ্য করলো, এবারে ট্রাকটার গতি যেন বেশ কিছুটা কমে গেছে। সম্ভবত, বিপজ্জনক বাঁকের কাছে পৌঁছে ওরা কোনোরকম দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিতে চাইছে না। ট্রাকটা ওদের অতিক্রম করার সময় কিটসন হাতঘড়িতে সময় দেখলো।
হাওয়ার ঝাপটা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে ট্রাকটা বেরিয়ে যাবার সময় পলকের জন্য ওরা দেখতে পেলো টমাস এবং ডার্কসনকে।
জিপো চলন্ত ট্রাকের ছবিটা মনের পর্দায় খোদাই করে উঠে বসলো।
একটা বাঁকের আড়ালে ট্রাকটা অদৃশ্য হতেই ওরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ধুলোর মেঘ থেকে চোখ সরিয়ে অস্বস্তিভরে পরস্পরের দিকে তাকালো।
জিপো গাল চুলকিয়ে বললো, একটা ট্রাক বটে। কিন্তু তোক দুটোকে দেখেছো? যেন শয়তানের চ্যালা!
চলন্ত ট্রাকে বসে থাকা টমাস ও ডাকসনকে কিটসন বেশ ভালো ভাবেই দেখতে পেয়েছে। সে ওদের দুজনকেই চেনে। তাই মরগ্যানকে বার বার সে সাবধান করে দিয়েছে। এখন ওদের দেখার পর কিটসনের সেই পুরোনো ভয়টা আবার ফিরে এলো। উইন্ডস্ক্রিনের ও–পিঠে বেজির চোখ নিয়ে বসে থাকা টমাস ও ডাকসনের ছবি তার মনে টেনে দিলো আতঙ্কের পর্দা। কিটসনের মনে পড়লো, আর কিছুদিনের মধ্যেই ওদের সামনে তাকে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জে দাঁড়াতে হবে। কেউ যেন একমুঠো বরফ কুঁচি ছড়িয়ে দিলো তার মস্তিষ্কে।
কিটসন সহজ হবার চেষ্টা করলো, তুমি কি জন্য ভয় পাচ্ছো, জিপো? তোমাকে তত আর ওদের সামনে আসতে হচ্ছে না। আর তাছাড়া, আমরাই কি কম নাকি? ওরা যদি শয়তানের চ্যালা হয়, তবে আমরাও অমানুষের অনুচর!
অস্বস্তিভরে জিপো মাথা নাড়লো। ওদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবেনা ভেবে আমি সত্যিই হালকা বোধ করছি। …ওরা নেহাত সহজ লোক নয়!
পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে কিটসন তাতে ট্রাকের বিপজ্জনক বাঁক অতিক্রম করার সময়টা টুকে নিলো। — কিটসন বিরক্তিভরে জবাব দিলো, তোমাকে কিছু ভাবতে হবেনা। মরগ্যান আর ব্লেকই ওদের সামলাবে।
কিন্তু জিনি? ওর কথাটা ভেবে দেখেছো? ওইটুকু একটা মেয়ে সে বলে কিনা দরকার পড়লেই গুলি চালাবে। আমার তো বিশ্বাসই হতে চায় না। তোমার কি মনে হয় ও সত্যি সত্যিই তাই করবে?
এই কথাটাই কিটসনও ভাবছিলো। জিনি সত্যিই কি তা পারবে! সে যেন দেখতে পেলো জিনির অতলান্ত সবুজ চোখ। উৎকণ্ঠাময় অভিব্যক্তি।
কিটসন ঠোঁট উল্টে বললো, কি জানি? যাকগে, এবার চলো, সে উঠে বসে রাস্তার এদিক ওদিক দেখে নিলো। কিন্তু জিপো, ট্রাকটা তুমি খুলতে পারবে তো?
ফ্র্যাঙ্ক তো বলছে, ট্রাকটা খুলতে আমাকে তিন–চার সপ্তাহ সময় দেবে। তাহলে তো ভাবনার কোনো কারণই নেই। যন্ত্রপাতি আর সময় ঠিক মতো পেলে আমি খুলতে পারবো না এমন তালা তৈরী হয়নি।
ফ্রাঙ্ক সেই কথাই বলছিলো। কিন্তু মনে করো যদি কিছু একটা গোলমাল হয়ে যায়? যদি তোমাকে তাড়াহুড়োর মধ্যে ট্রাকের তালা ভাঙতে বলা হয় তাহলে কি তুমি পারবে, জিপো?
অস্বস্তির ছায়া পড়লো জিপোর মুখে, একথা কেন বলছো, আলেক্স? ফ্র্যাঙ্ক তো আমাকে কথাই দিয়েছে তিন চার সপ্তাহ সময় দেবে। তাহলে আর ভয় কি? এতদিন ধরে তো দেখছি আজ পর্যন্ত ফ্র্যাঙ্কের কথার কোনো নড়চড় হয়নি! তোমার তালা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা না থাকলেও বেশ বুঝতে পারছো এই ট্রাকটা খোলা ছেলেখেলার কথা নয়।
কিটসন এগিয়ে চললো গাড়ির সন্ধানে, তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি গাড়িটা নিয়ে আসছি।
কিটসনের দিকে জিপো চিন্তিতভাবে তাকিয়ে ভাবলো জিনির কথা, ওর প্রতিটি ভাবভঙ্গী। কিটসনের সঙ্গে ওর কথা বলার ধরন; শেষ পর্যন্ত জিপো, নিশ্চিন্ত বোধ করলো।
এই কাজটা নিয়ে এত আলোচনার কি আছে? –সে ভাবলো। সূর্যের অসহ্য উত্তাপ অনুভব করলো। ফ্র্যাঙ্ক যখন ওদের আশ্বাস দিয়েছে, তখন আর কোনো ভয় নেই। তার ওপর ঐ পুঁচকে মেয়েটা যেন ধরেই নিয়েছে, দু লক্ষ ডলার ওর হাতের মুঠোয়। তাছাড়া এ কাজে জিপোর ভূমিকা খুব একটা বিপজ্জনক নয়। তাকে শুধু ট্রাকের তালাটা খুলতে হবে। আর ফ্র্যাঙ্ক যখন বলেইছে, ওকে তিন–চার সপ্তাহ সময় দেওয়া হবে তখন আর চিন্তার কি আছে? তালা এবং বিভিন্ন ধাতু সম্বন্ধে যাদের একটু অভিজ্ঞতা আছে, তারা ঐ সময়ে যে কোনো তালাই খুলে ফেলতে পারবে–তা সে যতো শক্তই হোক!
নিঃশব্দে ওয়েলিং আর্মার্ড ট্রাক এগিয়ে চলেছে রিসার্চ স্টেশনের দিকে। তার চালক অথবা রক্ষী, কেউই জানতে পারলোনা চারজোড়া অনুসন্ধানী চোখ তাদের দৈনন্দিন কর্মপন্থাকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখছে। সাদা ধুলোর কুণ্ডলীকে পেছনে ফেলে ওরা এগিয়ে চললো…..।