৪. ফ্রাঙ্কলিন অ্যাপার্টমেন্ট

০৪.

যাদের মাসিক রোজগার চার অঙ্কের ওপর, কেবল তাদের জন্য ফ্রাঙ্কলিন অ্যাপার্টমেন্ট। সমাজের ওপর তলার ধনকুবেরদের ত্রিশটির বেশি ফ্ল্যাট আছে এই ব্লকে। সিলভার রিথ ও রোলসরয়েসের মাঝ দিয়ে ছুটছে আমার গাড়ি। পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে পা রাখি ভেতরে। রিভলভিং দরজা। ওক কাঠের লবি।

খানিক দূরে রিসেপশনের ডেক্সের পিছনে এক লম্বা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে বন্ধুত্বের হাসি ছড়িয়ে বলি–মিস্ ক্রিডি আছেন?

নেকটাই নাড়াচাড়া করতে করতে আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে প্রশ্ন কবে সে–আপনাকে কি ডেকেছে মিস ক্রিডি?

না। দয়া করে তাকে বলবেন, আমি তার বাবার সাথে এই মাত্র দেখা করে এসেছি। দু একটা কথা তার সাথে বলতে চাই। আমার নাম লিউ ব্রান্ডন।

নিখাদ সোনার ও মেগা রিস্টওয়াচে চোখ রেখে সে বলে তাকে ডাকার সময় পেরিয়ে গেছে।

–শুনুন মশাই, মিস ক্রিডিকে খবর দিন, তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে দিন।

লোকটার চোখে শঙ্কা। সে চেয়ে থাকে খানিক। তারপর কাউন্টারের পিছনের ঘরে গিয়ে ঢোকে।

প্যাকেট খুলে ঠোঁটে সিগারেট রাখি। মিনিট দুই পরে, সে হাসি মুখে ফেরে। বলে তিনতলা, সাতনম্বর ফ্ল্যাট।

স্বয়ংক্রিয় এলিভেটর পৌঁছে দেয় আমাকে তিনতলায়। সাত নম্বর ফ্ল্যাটের কলিং বেলে হাত রাখি। ভেতর থেকে ভেসে আসে মোসার্টের সিম্ফনি। সৌম্য চেহারার মধ্য বয়স্কা রমণী দরজা খোলে। পরণে সিল্কের পোষাক ও সাদা অ্যাপ্রন।

মহিলার প্রশ্ন–মিস্টার ব্রান্ডন?

–হ্যাঁ। ছোট্ট হল পেরিয়ে যেতে যেতে আমি টুপি দিই মহিলার হেপাজতে। চমৎকার সুদৃশ্য হল। ডিম্বাকৃতি টেবিলে রুপোর পাত্রে, অর্কিড ফুটছে। কর্মচারীনী মহিলা দরজা খুলে মিঃ ব্রান্ডন বলে একধারে সরে দাঁড়ায়। আমি ঘরে ঢুকি।

মস্ত লাউঞ্জ। ঘর, আসবাব আর পর্দার রং সাদা। এমন কি, গদি আঁটা চেয়ারগুলোও সাদা চামড়ার। মেঝের কার্পেট ও মিস ক্রিডির পোষাক সাদা। বিরাট রেডিও গ্রামের পাশে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ আমার দিকে। স্লিম, বেশ লম্বা, ধূসর সোনালী চুল রেশম কোমল। চিরন্তনের বহতা ধারায় কি অপার্থিব সৌন্দর্য। ফুটন্ত ফুলের শোভা তার চোখে। উন্নত স্তন, দীঘল দুটি পা, নিতম্ব যেন তানপুরা। দুধেল শরীরটা ঢেকেছে সান্ধ্য গাউন। গলায় হীরে বানো মালাটি বোধহয় নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কিছু খসিয়ে মিঃ ক্রিডি উপহার দিয়েছিলেন মেয়ের একুশতম জন্মদিনে।

 কনুই ঢাকা গ্লাভস ঢেকেছে দুই হাত। মনিবন্ধে হীরক খচিত প্ল্যাটিনাম ঘড়ি। গ্লাভসের ওপর ছোট্ট অনামিকায় রক্ত রুবির সোনার আংটি। তার শরীরের প্রতিটি ত্বক যেন ঘোষণা করে তিনি কোটিপতি ঘরের মেয়ে। এবার বুঝলাম, মিসেস ও মিস ক্রিডির দ্বন্দ্ব কোথায়।

আমি কুণ্ঠাজড়িত স্বরে বললাম–অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত মিস্ ক্রিডি। বিষয়টা খুব জরুরী বলেই কষ্ট দিলাম।

অস্ফুট হাসি তার চোখে। সে হাসি না আন্তরিকতার না বন্ধুত্বের। শুধু সৌজন্যবোধ। তার বেশি নয়, কমও নয়।

–বাবার সঙ্গে কি কথা হয়েছে আপনার?

–না মানে, সত্যি বলতে কি, আপনার বাবার নাম না করলে আমার মনে হয়েছিল আপনি দেখা করবেন না। স্টার এনকোয়ারী এজেন্সির প্রধান আমি। আশা করি আমায় সাহায্য করতে আপনি রাজি হবেন।

তার মানে–আ–আপনি প্রাইভেট গোয়েন্দা? তার কুঞ্চিত। চিন্তার রেখা কপালে। তবু দু–চোখে সৌন্দর্যের কালো মেঘের খেলা।

–ঠিক ধরেছেন। অপ্রস্তুত হেসে বলি–আমি লড়ছি একটা কেস নিয়ে। মিস ক্রিডি আমায় আপনি সাহায্য করতে পারেন।

সাহায্য! আপনাকে? কি বলতে চাইছেন আপনি। কেন সাহায্য করব আমি।

–কোন কারণ নেই। তবু কিছু লোক কার্পণ্য করেন না অপরকে সাহায্য করতে। 

বলিব্যাপারটা খুলে বললে আপনি উৎসাহিত হবেন। সামান্য ইতস্ততঃ করে একটা চেয়ারে বসেন তিনি–ঠিক আছে বলুন। ঐ চেয়ারে বসতে পারেন আপনি।

বিপরীত চেয়ারে বসে শুরু করি আমাদের অফিস সানফ্রান্সসিসকো থেকে আমার পার্টনার মিঃ সিপ্পি টেলিফোনে একটা কাজের নির্দেশ পেয়ে এখানে আসেন দিন পাঁচেক আগে। যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি নাম জানাননি আমাদের অপারেটরকে। সে সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম না। কে ডেকে পাঠিয়েছেননা জানিয়েই সিপ্পি অফিস ছেড়ে আসেন। কিন্তু তার ব্লটিং পেপারে আপনার বাবার নাম লিখে রেখে এসেছেন। এরপর তিনি কেবল মারফত আমায় এখানে আসতে লেখেন। আমি এসে পৌঁছই সকালে। আগে থেকেই সিপ্পি হোটেলে অন্য রুম বুক করেছিলেন। এসে শুনি, তিনি বেরিয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ পরে তাকে সনাক্ত করার জন্য পুলিশ আমায় নিয়ে যায়। সমুদ্রতীরে এক স্নানের কেবিনে তিনি খুন হয়েছেন।

–কেন? মিস ক্রিডির চোখ বিস্ফারিতও হা হা, সান্ধ্য কাগজে দেখেছি–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না–তিনিই আপনার পার্টনার?

–হ্যাঁ।

–আপনি বলছেন, তার ব্লটারে আমার বাবার নাম লিখে রেখেছেন। কেন লিখেছিলেন?

–জানি না, তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন কিনা আপনার বাবা।

 রক্তরুবি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মিস ক্রিডি বলেন বাবা ডাকবেন না। যদি তেমন দরকার হত, তিনি তার সেক্রেটারিকে ব্যবস্থা করতে বলতেন।

–এসবের সাথে আমার কি সম্পর্ক? আর কয়েক মিনিটের জন্য আমাকে একটু বেরোতে হবে।

–আজ দুপুরে আপনার বাবার সাথে দেখা করেছিলাম। প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি ভাড়া করেছিলেন কিনা সিপ্পিকে। তিনি বলেছেন করেননি। এবং ক্ষেপে গিয়ে হার্জ নামক একজনকে ডেকে আমার ওপর নজর রাখতে বলেছেন।

কি মুশকিল, আমার সঙ্গে এসবের কি সম্পর্ক বুঝতে পারছি না। ক্ষমা করুন, আমাকে এবার উঠতে হয়…

আমি উঠে দাঁড়াই…সিপ্পির গতিবিধি অনুমান করার চেষ্টা করছি। মনে হচ্ছে, সিপ্পি মাসকেটিয়ার ক্লাবে গেছিলেন। কার সাথে গেছিলেন, সেটাই প্রশ্ন। আপনি কি মেম্বার ঐ ক্লাবের? আপনি যদি সেখানে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেন, তাহলে আমি কিছু খোঁজখবর নিতে পারি! মানে তদন্তের জন্য…

মিস ক্রিডি এত অবাক যেন আমি চাঁদে পা দিতে চাইছি–অসম্ভব ব্যাপার। এধরনের ইচ্ছা না থাকলেও, ধরুন যদি আপনাকে আমি ক্লাবে নিয়েও যাই, কোনো মেম্বারই আপনার জিজ্ঞাসাবাদ করাটা পছন্দ করবেন না।

–আমি আপনার সঙ্গে তো যাবো। শুনেছি সেখানে দারুণ বড়লোকের ভিড়। যদি আপনি জিজ্ঞাসাবাদ করেন আমার হয়ে।

–আ’ম সরি মিস্টার ব্রান্ডন। তা এক্কেবারেই অসম্ভব। এখন বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি চলে যান।

মিস ক্রিডি বেল বাজান। মধ্যবয়স্কা পরিচারিকা ঢুকতেই বলেন–অ্যাই টেসা, এখন মিস্টার ব্রান্ডন যাচ্ছেন।

পরিচারিকার হাত থেকে টুপি নিয়ে আমি ঘর ছেড়ে করিডোরে রাখি।

এলিভেটরে নামতে নামতে মনে হল, মর্গট জানে তার বাবা সিপ্পিকে কেন ভাড়া করেছিলেন। অর্থাৎ এটা পারিবারিক ব্যাপার। এ ব্যাপারে মিসেস ক্রিডির বয়ফ্রেন্ড জ্যাকুইস ফ্রিসবির সাথে কথা বলা দরকার।

এখন মাত্র এগারোটা দশ। হোটেলে এত তাড়াতাড়ি ফিরবো? গাড়িতে উঠে কিছুক্ষণ বসে রইলাম চুপচাপ। তারপর সমুদ্রাভিমুখে গাড়ি ছোটালাম।

মিনিট দশেক লেগেছে সমুদ্রতীর পৌঁছতে। অগনিত নারী–পুরুষ নেমেছে সমুদ্রস্নানে। বালিয়াড়ি ভেঙে হাঁটছি তীরের দিকে। বিচ–এর গেট বন্ধ। তালা দেওয়া। যাক্‌ নিশ্চিন্ত। কেউ লক্ষ্য করবে না আমায়। দূরে দেখা যায় স্নানার্থিদের সারিবদ্ধ কেবিন। পাহারার জন্য র‍্যানকিন পুলিশ মোতয়েন করতে পারেন। সমুদ্রতীর ভারি নিঃসঙ্গ।

এই সেই অভিশপ্ত কেবিন, দরজা ঠেলোম, খুললো না, তালাবন্ধ সঙ্গে ফ্ল্যাসলাইট ছিল। জ্বালোম। পকেট থেকে সরু একটা স্টীলের গজ বের করলাম। কড়া ও তালার মধ্যে সেটা ঢুকিয়ে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল।

দরজার কাছে থামলাম। গনগনে আঁচ থেকে যেন তাপ ঝাপটা দিচ্ছে। ফ্ল্যাসলাইটের তীব্র গোল আলো, সারা ঘরে ধীরে ধীরে বোলালাম।

 ঘরে দুটো আসবাব। একটি ডিভান, একটি টেবিল, যেখানে সিপ্পি মারা যায় সেই কোনে রক্তের কালো ছাপ মৃত্যুর আলপনা এঁকেছে। ভয় ভয় লাগে। হিম হয়ে আসে শরীর। আমার বিপরীতে দুটো দরজা। এঘর থেকে দুটো ঘরেই যাওয়া যায়। ওরই একটা ব্যবহার করেছিল সিপ্পি। এই মেয়েটার কথা ভাবতে অবাক লাগে। কোন বদ উদ্দেশ্যে কি সিপ্পিকে এখানে এনেছিল? মেয়েদের ফাঁদে পা দেবার ছেলে সিপ্পি নয়। সিপ্পির মৃত্যুতে ক্রিডির কি কোন হাত নেই?

হাত দিয়ে কপাল মুছি। ভাবতে থাকি মেয়েটাই খুনী নয়তো?

দরজা ভেজিয়ে ঢুকি। সামনের ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে উঁকি দিই ভেতরে। কিছু না পেয়ে অগত্যা বেরিয়ে এলাম। ভাবছি, সময় নষ্ট শুধু শুধু। এবার দেখা যাক পাশের ঘরটা। চকিতে অনুভব করি অন্ধকার কেবিনে একা নই আমি। স্নায়ুর মত দাঁড়িয়ে থাকি। কান পেতে রই। কেবল নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ। ফ্ল্যাসলাইটের বোতামে হাত লেগে নিভে যায়। আমাকে ঢেকে দেয় প্রগাঢ় অন্ধকার। কিছুক্ষণ কাটে। কোন সাড়াশব্দ নেই। ভাবি, আমায় বিভ্রান্ত করেছে আমার কল্পনা। তখনই ক্ষীণ শ্বাস ফেলার শব্দ কানে আসে। কে যেন খুব ধীরে ধীরে মুখ খুলে শাস ফেলছে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে অন্য কোন শব্দ হলে ঐ শব্দে পেতাম না। ভাগ্যিস বন্দুক এনেছি সঙ্গে। দু–পা পিছিয়ে ফ্ল্যাসলাইট জ্বালি। মেঝেতে আলো ছড়ায় বৃত্তাকারে। আলো ঘুরিয়ে দেখি। নজরে কিছুই পড়ে না। তবু ঐ ক্ষীণ শব্দ আমায় তাড়া করে ফেরে। দ্বিতীয় পোষাক ছাড়ার ঘরের দরজায় মৃদু চাপ দিতে খুলে যায়। তুলে ধরি ফ্ল্যাসলাইট।

মেয়েটি বসে আছে মেঝেতে। দৃষ্টি আমার দিকে। পরণে হালকা নীল সাঁতার পোষাক। উজ্জ্বল হরিদ্রাভ ত্বক। চোখদুটি খোলা শূন্য দৃষ্টি। বা কাঁধ থেকে বয়ে গেছে রক্তের ধারা। চব্বিশ পঁচিশ–এর যেন নিখুঁত মডেল, কালো সুন্দর মুখ।

আলোর বৃত্তে অন্তিম শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে অপলক চেয়ে থাকল সে। আমি দাঁড়িয়ে আছি পাথরের মত। সারা শরীর হিম হয়ে গেছে। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে। মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে।

তারপর খুব ধীরে একপাশে কাৎ হয়ে পড়ল। নিস্পন্দ। স্থির।

আমি নড়তে পারছি না। ঠায় দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে রয়েছি। মেয়েটি ঢলে পড়ার মুহূর্তে ছুটে গেলাম। কিন্তু হায়! তখন দেরী হয়ে গেছে বড়।

মৃতার দিকে তাকাতে গিয়ে বরফ খোঁচানো ছুরিটা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলাম। হাতল প্লাস্টিকের। অর্থাৎ যেভাবে সিপ্পি খুন হয়েছিল সেভাবেই যুবতী খুন হয়েছে।

উঠে দাঁড়াই। মুখের ঘাম রুমালে শুষে নিই। ঘরে অসহ্য গরম, বড় ঘরে পা বাড়াই। বেরিয়ে আসতে চোখে পড়ে একটা দরজা। পাশের কেবিনের সাথে যুক্ত। পিছনের দিকে খিল দেওয়া। এই খিড়কি দিয়ে খুনী ঢোকে, বেরিয়ে গেছিল কি? হয়ত এখনো সেই খুনী পাশের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে আমার যাবার অপেক্ষায়। সঙ্গের বন্দুক সাহস জোগায়। দরজার হাতলে হাত রেখে টের পাই, দরজা বন্ধ, চাপ দিলেও খোলে না। খুনী চলে যাবার সময় কি দরজায় পিছন থেকে খিল দিয়ে গেছে কি? নাকি ঐ ঘরে খুনী আছে?

তখনই এক আওয়াজ। শিহরিত হই। সর্বনাশ! ওটা দূরাগত পুলিশের সাইরেন।

দ্রুত ফ্ল্যাসলাইট নেভাই। দরজার হাতলে নিজের হাতের ছাপ মুছে দিই রুমাল দিয়ে। দরজার বাইরে আসি একলাফে। ডান বামে তাকাই। চতুর্দিকে শূন্য তীরভূমি।

সাইরেনের শব্দ আরো তীব্র। কাছে আসছে ক্রমে। পাম ঝোঁপের দিকে যেতে গিয়েও ফিরে আসি। পুলিশের লোক আসছে কেবিনের দিকে। এখন ঐ ঝোপে লুকোতে গেলে ধরা পড়ে যাবো নির্ঘাৎ।

অগত্যা পিছনের বিস্তীর্ণ বালুকাবেলার দিকে ছুটতে থাকি আপ্রাণ। সাইরেনের ধ্বনি কানে আসে। তীরে বোধহয় ওরা এসে পড়ল। পিছনে না তাকিয়ে কম করে ওদের থেকে হাজার গজ দূরে চলে যেতে হবে।

বহুদূরে কেবিনগুলো যেন খেলাঘর। আমার দিকে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এক পেট্রলম্যান। চাঁদের আলোয় বেশ স্পষ্ট। ঐ মৃতার কেবিনে দুটো পুলিশ টুকলো।

অবশেষে রাস্তায় এসে পড়ি। নিজের গাড়িতে উঠে দ্রুত স্টার্ট দিই।

 হোটেলের পার্কিং লটে গাড়ি থামাই। ডাস্টার দিয়ে পোষাক ও শরীরের বালি ঝেড়ে ফেলি। তারপর গাড়ি রেখে হোটেলে ঢুকি।

রাতের হোটেল ক্লার্কের কাছ থেকে ঘরের চাবি নিয়ে এলিভেটরের দিকে এগিয়ে যাই। তখনই ফোন বাজে। ফোন ধরে রাতের ক্লার্ক। এলিভেটরের খাঁচায় সবে পা রেখেছি, সে জানায়–আপনার ফোন।

–কে আবার ফোন করলো এখন? অবাক লাগে।

–হ্যালো, বুথে এসে ফোন ধরি।

—-মিস্টার ব্রান্ডন?

–হ্যাঁ।

মর্গট ক্রিডি বলছি মিষ্টি নারীকণ্ঠ রিরিন্ বাজে।

 –ফোন করার জন্য ধন্যবাদ।

–মাসকেটিয়ার ক্লাব থেকে বলছি। ভিজিটর বই দেখলাম। মিস্টার সিপ্পির নাম নেই।

–হয়তো ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন।

–আমিও তাই ভাবছি। দারোয়ান বললো, কয়েকমাস যাবৎ লালচুলের কোন লোককে সে দেখেনি। সব মনে রাখে লোকটা।

–তাহলে তিনি যাননি বোধহয়।

–তিনি গিয়েছিলেন ভাবছেন কেন?

ওনার স্যুটকেসে একটা ম্যাচ ফোল্ডার পেয়েছি।

–কেউ ওনাকে হয়তো দিয়েছিল।

–দিয়েছিল নিশ্চয়ই কেউ।

–হ্যাঁ, সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ, মিস ক্রিডি, আমি খুব..ক্লিক শব্দটা লাইন কেটে যাবার জানান দেয়। বুথ থেকে বেরিয়ে এলিভেটরের বোতাম টিপি।

ঘরে এসে বিছানায় টুপি খুলে ছুঁড়ে দিই। জ্যাকের স্যুটকেস খুলে বসি। ম্যাচ ফোল্ডারটা, দেখি পঁচিশ পাতা ছেঁড়া হয়েছে। প্রত্যেক কাউন্টার পার্টে মাসকেটিয়ার ক্লাবের নাম খোদিত। ভেতরের প্রত্যেক পাতার পেছনে একটা পটারীর বিজ্ঞাপন ছাপা, বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে এই রকম—-

মারকুসই হ্যান স্কুল অফ সিরামিক্স। দ্য ট্রেজার হাউস অফ ওরিজিন্যাল ডিজাইন।
দ্য চ্যাটিউ
অ্যারো পয়েন্ট
সেন্ট র‍্যাফাইল সিটি।

এরকম এক সামান্য পটারীর বিজ্ঞাপন কি করে স্থান পায় দারুণ রাশভারি ও প্রখ্যাত ধনী ক্লাবের ম্যাচ ফোল্ডারে? এদের পাত্তা দেয় কি করে এত বড় ক্লাব? নিশ্চয় কিছু রহস্য আছে এর মধ্যে।

ম্যাচ ফোল্ডারের একটা পাতা ছিঁড়ে পরীক্ষা করি। পিছনের দিকে কটি সংখ্যা ছাপা আছে–C45il36 : এবং ফোল্ডারের প্রত্যেক পাতার পেছনেই, সংখ্যাগুলো ক্রমানুসারে ছাপা আছে। যেমন শেষ পাতাটির পিছনে ছাপা C451160। ম্যাচ ফোল্ডারের ছেঁড়া প্রথম পাতাটি ফোল্ডারে ঢুকিয়ে আমার ম্যানিব্যাগে রেখে দিই। আপাততঃ ঘুমোনো যাক।

দরজায় হঠাৎ করাঘাত।

 সমুদ্র কেবিনে কি হাতের ছাপ রেখে এসেছি? বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি।

দরজা খুলুন, আমরা জানি আপনি ভেতরে আছেন, ভারী পুরুষকণ্ঠ।

 দ্রুত মানিব্যাগ থেকে ম্যাচ ফোল্ডার বার করে ঘরের কোণে মেঝের কার্পেটের তলায় রেখে দিই। ব্যাগ রেখে দরজা খুলি।

সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ক্যান্ডি। ভারি গলায় বলেনক্যাপ্টেন ক্যাচেন আপনাকে চান।

বিছানা থেকে টুপি তুলে নিয়ে বলি–আমি যাচ্ছি, চলুন।

.

০৫.

ঘরে ছটা চেয়ার, ডেক্স, ফাইলপত্তর রাখার ক্যাবিনেট। ক্যাপটেন ক্যাচেন, লেফটেন্যান্ট র‍্যানকিন এবং একচল্লিশ বছরের শীর্ণ, লম্বা, রিমলেশ চশমা পরিহিত ভদ্রলোক। ক্যাপ্টেন জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখ থমথমে। সিগার ঠোঁটে, রক্ত জমাট।

র‍্যানকিন বসে আছেন উঁচু চেয়ারে। ভারিকি গলায় লম্বা ভদ্রলোক বলেন–এর হাতে হাতকড়া কেন ক্যাপ্টেন?

সহসা মনে হয়, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ক্যাপ্টেনের। ক্যাপ্টেন বলেন–একে গ্রেফতার করায় আপনার যদি আপত্তি থাকে আপনি কমিশনারের সাথে কথা বলতে পারেন।

এনাকে অ্যারেস্ট করা হল কেন?

 ক্যান্ডির দিকে তাকান ক্যাচেন, বলেন–খুলে দিন হাতকড়া।

আমায় হাতকড়া খুলে দেন ক্যান্ডি।

বসুন মিস্টার ব্রান্ডন। খড়ের মত চুলের দীর্ঘ শীর্ণ ভদ্রলোক বলে–আমি হোল্ডিং। আসছি ডিষ্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস থেকে। শুনলাম, আপনাকে দেখতে চেয়েছেন ক্যাপ্টেন, তাই আমিও দেখতে এলাম আপনাকে। হোল্ডিং চোখ থেকে রিমলেশ চশমা সরিয়ে নেন। কাঁচ. পরীক্ষা করে মুছে ফের পরেন, বলেনকর্তব্যের বাইরে ক্যাপ্টেন ক্যাচেন কিছু করতে পারেন না।

জানলা থেকে ঘরে আমার দিকে তাকান ক্যাপ্টেন। চোখে বন্য গরিলার উগ্রতা।

তীক্ষ্ণ কণ্ঠে হোল্ডিং বলেন ক্যাপ্টেন প্রশ্নগুলো আপনি করবেন না আমি করব?

ক্যাচেন চুপ। আমার থেকে হোল্ডিং–এর দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বলেন–আপনিই করুন। আমি কমিশনারের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি। ইদানিং বড্ড বেশি বাধা আসছে আপনাদের অফিস থেকে।

ঘর ছেড়ে চলে গেলেন ক্যাপ্টেন। সার্জেন্ট ক্যান্ডি জিজ্ঞাসা করেন–আপনার আমাকে প্রয়োজন নেই তো মিঃ হোল্ডিং।

–না, ঠিক আছে, আপনি আসতে পারেন। চলে গেলেন ক্যান্ডি।

হোল্ডিং আমার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন ক্যাপ্টেন ক্যাচেন এমাসের শেষের দিকে রিটায়ার করছেন। তার জায়গায় আসছেন লেফটেন্যান্ট র‍্যানকিন।

কনগ্রাচুলেশন, আমি বলি।

প্রত্যুত্তরে র‍্যানকিন অধৈর্যভাবে নড়েচড়ে বসেন। টাই ঠিক করেন। কোন জবাব দেন না।

হোল্ডিং জানান–এই রহস্য উদ্ধারের পুরো দায়িত্ব লেফটেন্যান্ট র‍্যানকিনের ওপর। আমি সমুদ্রতীরের জোড়া খুনের কথা বলছি।

এখন জানলাম এ কেসটা র‍্যানকিনের হাতে। সম্ভবতঃ আমাকে ক্যাপ্টেন ফাসাতে পারবেন না। অতএব সানন্দে আমি একটা বিবৃতি দিতে রাজি আছি।

এবার সহজভাব হোল্ডিং বলেন–ঐ কেবিনে ঢুকতে দেখা গেছে আপনাকেই?

তা বলতে পারবো না। তবে, ওখানে ঢুকে দেখেছি যুবতী মারা যাচ্ছেন।

 উনি কি বলেছিলেন কিছু?

 –না, তাকে দেখার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই উনি মারা যান।

–ওখানে কেন গিয়েছিলেন?

–কোন নির্দিষ্ট কারণে নয়। কোন কাজ ছিলনা হাতে। ভাবলাম অকুঃস্থলটা ফের দেখে আসি। জানি বিশ্বাসযোগ্য হলো না কথাটা। কিন্তু আমার পার্টনার ওখানে খুন হয়েছেন। আজ সকালে যখন যাই তখন আপনাদের বহুলোক ছিল। আমি জায়গাটা শুধু আর একবার দেখতে গেছিলাম।

–কখন গেছিলেন?

 সঠিক সময় এবং ওখানে যা যা দেখেছি সব বললাম। র‍্যানকিন তাকান হোল্ডিং–এর দিকে। তারপর হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে হাসি ফুটলো তার কঠোর শক্ত মুখে–আপনাকে দোষ দিচ্ছি না। আমিও আপনার জায়গায় হলে একই কাজ করতাম। তবে, আর ওরকম কাজ করবেন না। আপনি কত ভাগ্যবান ভেবে দেখুন। আপনাকে খুনের চার্জে ফেলা হয়নি। কারণ ডাক্তারের মতে মেয়েটিকে ছুরি মারা হয়েছে অন্ততঃ আপনি কেবিনে ঢোকার দু–ঘন্টা আগে। কি করে জানলেন ওখানে মহিলা আছেন?

–কেউ আপনাকে ঐ কেবিনে ঢুকিতে দেখে হেড কোয়ার্টারে খবর দেয়।

নিশ্চয়ই খুনীর পাত্তা পাওয়া যায় নি? মৃত মহিলাটি কে? হোল্ডিং ও র‍্যানকিন পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করেন। হোল্ডিং বলেন–সম্ভবতঃ সেই মহিলা যিনি সিপ্পিকে হোটেল থেকে ডেকে আনেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সকাল এগারোটা থেকে মহিলা কি করছিলেন বুঝতে পারছি না।

সনাক্ত করা গেছে মৃতাকে?

থেলমা কাজন নামে এক মহিলা নিরুদিষ্ট হয়ে সকালে কাজে গিয়েছে, এই বলে তার বাড়িউলি রিপোর্ট করেছেন। আমরা দ্বিতীয়বার থেলমাকে পরীক্ষা করতে যাচ্ছি। যার কাছে কাজ করতেন থেলমা, সেই ভদ্রলোকও উপস্থিত থাকবেন।

–তিনি কে?

তার নাম মারকুইস হ্যান–জানান র‍্যানকিন। মজার কথা তিনি অ্যারো পয়েন্টে স্কুল অফ সিরামিক্স নামে পটারীর ব্যবসা চালান। তার ঐ শোরুমে থেলমা কাজ করতেন।

র‍্যানকিন চলে যান।

অনেকক্ষণ বাদে হোল্ডিং বলেন ক্যাপ্টেনের সাথে আজ সকালে আপনার কি কথা হয়েছে? আপনি কি ক্যাচেনকে বলেছেন, সিপ্পিকে কাজের জন্য ক্রিডি ভাড়া করে ছিলেন?

–হ্যাঁ।

–তার কোন প্রমাণ আছে?

আমি সব বললাম। ক্রিডির নাম ব্লটারে লিখে রেখেছিল সিপ্পি তাও জানালাম। শুনে হোল্ডিং বলেন–অন্য কোন লোকও তো ক্রিডি সম্পর্কে খোঁজ নেবার জন্য সিপ্পিকে নিযুক্ত করতে পারে।

নির্বিকার ভঙ্গিতে শুনে যান হোল্ডিং। পাইপ থেকে ধোঁয়া ওড়ে। বলেন–এখন মনে হচ্ছে আমার, সিপ্পিকে লী ক্রিডি ভাড়া করেছিলেন। সিপ্পি খুন হতে ক্রিডি চাইছেন, সিপ্পিকে তার কাজে নিযুক্ত করার কথাটা চেপে যেতে। আচ্ছা সিপ্পির হত্যারহস্যভেদেই আপনার বেশি আগ্রহ তাইনা?

–অবশ্যই।

–তা কিভাবে সিপ্পি হত্যারহস্য ভেদ করবেন ভাবছেন? নিরাপত্তা ছাড়া বেশীদূর যেতে পারবেন না।

–জানি। যে অবস্থায় আছি, নিরাপত্তা ছাড়া চলবে না।

–সে ব্যবস্থা করা যাবে। যদিও এখনি তা কার্যকর করা যাচ্ছে না।

 –আমার গলা থেকে ক্যাচেনের ফাস সরে গেলে হার্জকে ঝেড়ে ফেলতে পারি।

ক্যাচেনকে আটকানো যায়। কঠিন হার্জকে সামলানো। ওকে অত ফ্যালনা মনে করবেন না। ওঠা যাক তাহলে, দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমার শোবার সময় এখন।

–কিন্তু আমি কি তদন্তের স্বাধীনতা পাব।

–সেটা প্রশ্ন নয়। সিপ্পির মৃত্যুর পর আপনি নিজস্ব পদ্ধতিতে তদন্ত করবেন, ধর্তব্য সেটাই, যেহেতু দুজনেই আপনারা গোয়েন্দা ট্রেডের লোক। ঠিক আছে, আমার কার্ড রইল টেবিলে। আপনি আমার সীমাবদ্ধতা বুঝবেন না। উনি বলে যান–আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একটা নতুন মোড় নেবে প্রশাসন। বিরোধীপক্ষরা সুযোগ খুঁজছে এ শহরে ক্রিডির আধিপত্য খর্ব করার। সিপ্পির মৃত্যুর সাথে কোনভাবে যদি ক্রিডি জড়িত থাকেন, বিরোধীরা মস্ত সুযোগ পেয়ে যাবে। বর্তমান প্রশাসন যথেষ্ট জনপ্রিয় না হলেও বিস্তর শক্তিশালী। এখন তারা তীক্ষ্ণ তরবারির ওপর। দাঁড়িয়ে। যে কোন স্ক্যান্ডাল তাদের ফেলে দিতে পারে।

–ওকে। তদন্ত চালিয়ে যাব আমি। আপনাদের অসুবিধা দূর করার জন্যনয়। জাজ হ্যারিসনের ভোটের টিকিট পাবার জন্য নয়। আমার পার্টনার খুন হবার জন্য তদন্ত করবো। যা আমার ব্যবসার পক্ষে অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি আমার অংশীদার ছিলেন বলেই এর পেছনে আমার সেন্টিমেন্ট কাকু করছে। নইলে বেঁচে থাকাই বৃথা আমার। যদি আপনাদের স্বার্থান্বেষী লোকেরাআমার রহস্যভেদের কাহিনী জানতে চান, তাহলে আমার খরচা দাবী করব আমি।

চমকে ওঠেন হোল্ডিং–তাও ব্যবস্থা হবে। তবে তার আগে আমরা নিশ্চিন্ত হতে চাই, ক্রিডি এ কেসের সঙ্গে যুক্ত কিনা।

বুঝতে পাচ্ছি। ইতিমধ্যে কারোর থেকে কি কোন সাহায্য পেতে পারি?

–আপনার জন্য কি ব্যবস্থা করেছি র‍্যানকিন জানেন। সময় সময় তার বাড়িতে যোগাযোগ করলেই জানতে পারবেন, তিনি তদন্তের কাজে কদুর এগিয়েছেন।

–ঐ সম্পাদকের কি নাম?

রালফ ট্রয়। আপনি তাকে বিশ্বাস করতে পারেন। তাকে সত্য কাহিনী দিলে তিনি ছাপবেন।

তার আগে রহস্য ভেদ করতে হবে। দেখা যাক, কদুর যেতে পারি…তারপর দেখা যাবে।

 হোল্ডিং হাত বাড়ান–গুডলাক্। সাবধানে থাকবেন।

 জানি আমার দরকার ভাগ্যের, আমাকে সাবধান হতেই হবে।

হেড কোয়ার্টারের শেষপ্রান্তে লাশ কাটা ঘর। আমি ঐ ঘরে ঢুকতে র‍্যানকিন আমাকে দেখে রুক্ষস্বরে খিঁচিয়ে ওঠেন–কি চাই?

অদূরে উপবিষ্ট একজনকে দেখিয়ে বলি–ঐ লোকটা কি হ্যান?

–হ্যাঁ। ঝানু পটারী ব্যবসায়ী। ওনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। উনি কি বলেছেন জানেন? মৃতার বাহুতে র‍্যানকিনহাত রাখেন–কোন বয়ফ্রেন্ড ছিলনা থেলমার। ধার্মিকটাইপের যুবতী। পটারীদের কাজ করে গরীবদের সেবা করতেন। থেলমা অক্ষত যোনি, ডাক্তার বলেছেন, কুমারী।

–সিপ্পিকে শেষ অব্দি বয়ফ্রেন্ড বলেই কি মনে হয় না?

মর্গের আলো নিভিয়ে দেন র‍্যানকিনা–আপনি হোল্ডিং–এর কথায় নাচছেন? আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলতে থাকেন–লক্ষ্য রাখুন ওনাকে। গত চারবছর ধরে যে পজিসনে উনি আছেন, তাতে কারো না কারোর প্রভুত সাহায্য নিয়েছে। চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত লোকটি সর্বদা নিজের দরকারে কাউকে না কাউকে ব্যবহার করেছেন। উনিই একমাত্র লোক, যিনি প্রশাসনে থেকে বিরোধী পক্ষের সাথে আঁতাত রাখেন। সুতরাং ওনাকে নজরে রাখবেন। র‍্যানকিন বেরিয়ে আসে মর্গ থেকে।

 মাথায় ঘোরে র‍্যানকিনের কথাগুলো। ভাগ্যিস জানলাম, নৈলে বিশ্বাস করে বসেছিলাম হোল্ডিং–কে। তারপর মর্গ ও কোয়ার্টার ছেড়ে গাড়িতে চেপে বসলাম, গন্তব্য হোটেল।

নিজের রুমে গিয়ে চমকে উঠি। দমবন্ধ হবার জোগাড়। সিপ্পির ঘরের মত অবস্থা। আলমারির ড্রয়ার খোলা, ঝুলছে।

বিছানার গদি, তোষক ওলটপালট। ঘরময় সুটকেসের কাগজপত্র ছড়ানো ছিটানো। এমনকি সিপ্পির কাগজপত্রও লণ্ডভণ্ড। দ্রুত ছুটে যাই ঘরের কোণে। হ্যাঁ, কার্পেটের তলায় ম্যাচ ফোল্ডার ঠিক আছে। ফোল্ডার উল্টেপাল্টে দেখি। বোধহয় দুষ্কৃতির চোখ এড়িয়ে গেছে এটা। ফোল্ডারের পেছনে ছাপা নম্বরের স্থানটা ফাঁকা কেন?

উঠে দাঁড়াই। বুঝতে বাকী থাকে না, সিপ্পির ম্যাচ ফোল্ডার নিয়ে কেউ সুনিপুণভাবে নকল একটি ম্যাচ ফোল্ডার রেখে গেছে। আমাকে ধোঁকা দেবার জন্য। না–আসল ম্যাচ ফোল্ডার নয়।

লণ্ডভণ্ড বিছানায় গা এলিয়ে দিই।

.

০৬.

 পরদিন বেলা সোয়া এগারোটা অবধি ঘুমোলাম। গত রাতে নাইট ক্লার্ককে যখন জানিয়েছি কেউ আমার অবর্তমানে আমার ঘর তছনছ করে গেছে, ক্লার্ক তৎক্ষণাৎ পুলিশকে ফোন করে জানায়।

কিছুক্ষণের মধ্যে প্রাতঃরাশ এসে যায়। কফির পেয়ালায় চুমুক রাখতে ঝনঝন করে ফোন বাজে। র‍্যানকিনের স্বর–শুনলাম, কেউ গতরাতে হানা দিয়েছিল আপনার ঘরে।

হ্যাঁ

–কি রকম বুঝছেন?

–কি মাথায় আসছে না। কিছু পেলে জানাবো আপনাকে।

একটু থেমে র‍্যানকিন বলেনধর্মযাজক বলেছেন, কোন পুরুষ বন্ধু ছিল না মৃত থেলমার। ছেলেদের সঙ্গে মোটে মিশতেন না। থেলমা ছিলেন ধর্মপ্রাণ।

ফোন ছেড়ে দেন র‍্যানকিন।

কফি শেষ করে অফিসে ফোন করি এলাকে। কয়েক মিনিট ব্যবসায়িক কথাবার্তা হয়। দুএকদিন পর ফোন করব বলে লাইন কেটে দিই। অসহ্য গরম ঘরে। ইচ্ছে করছে সমুদ্রে বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে রৌদ্র মেখে আসি। কাল বিলম্ব না করে সাঁতারের পোষাক চাপিয়ে এলিভেটরে একতলায় নাবি।

ঘরের চাবি ডেক্লার্ক ব্রিওয়ারকে দিই।

ডে–ক্লার্ক বলে…আমি দুঃখিত মিস্টার ব্রান্ডন। আপনার নামে এত অভিযোগ..আপনি আসার পর চব্বিশ ঘণ্টায় চারবার পুলিশ এখানে হানা দিয়েছে।

জানি, বুঝেছি কেমন লাগছে আপনার। আজ রাতেই আমি চলে যাচ্ছি।

গাড়ি ছুটিয়ে চলে আসি সমুদ্রতীরে। এখন মধ্যাহ্ন। বারোটা বেজে গেছে। বিস্তর ভীড় সমুদ্রতীরে। গাড়ি রেখে এগিয়ে যাই স্নান–ঘাটের দিকে।

একদমে সমুদ্রতীর থেকে বহুদূরে চলে যাই। তারপর, ধীরে ধীরে সাঁতরে ফিরতে থাকি। তীরে উঠে চারদিকে চোখ বোলাই। নির্জনতা খুঁজি। যেখানে স্বচ্ছন্দে গা মুছতে পারি। তখনই চোখে পড়ে এক তরুণীকে। সাদা নীল ছাতার নীচে…দৃষ্টি আমার দিকে। সাঁতারের শ্বেতশুভ্র বিকিনী পরা। চোখে বড় রোদ চশমা লাগানো। রেশম কোমল চুল। অঙ্গসৌষ্ঠব মনে করিয়ে দেয় যেন ঐ মুখ দেখেছি কোথাও। হাতছানি দেন মর্গট ক্রিডি।

আমি তার কাছে পৌঁছতে বলেন–আপনি মিস্টার ব্রান্ডন তো?

যদি না হই, তাহলে নিশ্চয়ই কেউ আমরা চামড়া চুরি করে নিয়ে গেছে। আচ্ছা, ঐ বড় বড় রোদ–চশমার আড়ালে আপনি কি ঠিক মিস্ ক্রিডি?

খিল খিল করে হেসে উঠে সানগ্লাস খুলে তিনি বলেন বসছেন না কেন? ক্লান্ত, নাকি অন্য কোন কারণ আছে?

ধপ করে তার পাশে বসে পড়ি। বলি ক্লান্তি বা অন্য কিছু নয়। গতকাল সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ, আশা করিনি।

ঘটনাচক্রে আমি তখন ক্লাবে ছিলাম। তাছাড়া আমার কৌতূহল ছিল। এ খুনের ঘটনা শুধু আশ্চর্যজনক নয়, নৃশংসতম, তাই না? যখন আপনি প্রশ্ন করলেন, আপনার পার্টনার ক্লাবে এসেছিলেন কিনা, তখনই জানতাম আসেননি, তবু পরীক্ষা করে একবার দেখলাম। ক্লাবের মেম্বার ছাড়া এখন ক্লাবে ঢোকা খুব মুশকিল।

আমি জিজ্ঞাসা করি–কাগজ পড়েছেন, আজ সকালের?

–মানে দ্বিতীয় খুনের কথা বলতে চাইছেন? মেয়েটি কে জানেন? ঐ মেয়েটিই কি আপনার বন্ধুর সাথে দেখা করেছিল, একসাথে কেবিনে ছিল?

–হ্যাঁ, ঐ যুবতীই।

ধরুন ঐ মেয়েটিই যদি সিপ্লিকে খুন করে থাকে। তারপর সে হয়তো কৃতকর্মের অনুতাপে আত্মহনন করে। মেয়েটি নাকি খুব ধর্মপ্রাণ ছিল, খবরের কাগজগুলো তাই বলছে।

–আপনার জায়গায় আমি থাকলে যুবতী কিভাবে মরেছে তা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাতাম না। পুলিশের কাজ ওটা। অ্যারো পয়েন্টে, স্কুল অফ সিরামিক্সে কাজ করতে মেয়েটি। কখনো গেছেন সেখানে?

–অনেকবার গেছি, কেন? হ্যানের তৈরি বহু না আমার প্রিয়। দারুন কারুকাজ। এইতো, গত সপ্তাহে হ্যানের তৈরী এক বাচ্চা ছেলের স্ট্যাচু কিনে নিয়ে এলাম।

–এই যুবতীকে কখনো দেখেছেন?

–মনে নেই। অনেক মেয়েই তো ওখানে কাজ করে।

–আমার ধারণা দোকানটা ভ্রমণার্থীদের জন্য। নিঃসন্দেহে হ্যান একজন বড় শিল্পী। আমি একদিন দেখতে যাবো। সঙ্গে কি আপনি যেতে পারবেন?

— একটু চিন্তা করে মর্গট বলেন–আবার গেলে জানাবো আপনাকে। আপনি কি এখন অ্যাদেলফি হোটেলে আছেন?

মনে করিয়ে দিলেন। ভাল কথা, গতরাতে আমি ঐ হোটেলে আছি কি করে জানলেন?

মর্গট হাসে। সে হাসিতে নিটোল মসৃণ মুক্তোর মত ঝলমল করেদাঁত, যেন পাজরে ধাক্কা দেয়।

আমি বলি–পুলিশ একবার আমার ঘরে যাচ্ছে আসছে বলে ম্যানেজার ভীত হয়ে পড়েছে। আমায় আজ রাতের মধ্যে অন্যত্র জায়গা দেখতে হবে।

সহজ কাজ নয়। এখনই তো সিজন।

–হ্যাঁ, খুঁজে দেখি। হোটেল সংক্রান্ত ব্যাপারে জ্যাক অর্থাৎ সিপ্পি ছিল ওস্তাদ। কোন হোটেলের রুম কত সস্তা, খাবার দুর্দান্ত…এসব তার নখদর্পণে। এই হোটলেও ওই ব্যবস্থা করে দেন।

–আর কতদিন এখানে থাকবেন?

তদন্তের কিনারা যতদিন না হয়। সেটা এক সপ্তাহ বা একমাসও হতে পারে। কতদিন জানি না…।

অ্যারো বে’র সীমান্তে দু–তরের লীজে আমার একটা বাংলো আছে। আমি এখন সেখানে যাই না। এখনও একবছর বাকি লীজের মেয়াদ শেষ হতে। ইচ্ছে হলে, আপনি থাকতে পারেন। সেখানে আসবাবপত্রসহ সব সাজানো আছে। গত একমাস যাবৎ যাইনি। তার আগে দেখে এসেছি সব ঠিকঠাক আছে। লাইটের বিলটা শুধু আপনাকে মেটাতে হবে। বাকী সব ব্যবস্থা আছে। তেমন কাজ না থাকলে চলুন না আজ রাতে ডিনারের পর যাই। আমি রাত দশটা নাগাদ ফ্রি হব।

আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব মিস ক্রিডি, অপরিচিত বিদেশীর জন্য এমন অযাচিত উপকার–দেখুন, আপনাকে কোন রকম কষ্ট দিতে চাই না।

–না না, কষ্ট কিসের। ঘড়ির দিকে তাকাল মর্গট–এবার যেতে হবে, ড্যাডির সাথে লাঞ্চ আছে। তিনি দেরী পছন্দ করেন না। দশটায় মাসকেটিয়ার ক্লাবের বাইরে দেখা করবেন। তারপর একসাথে বাংলোয় চলে যাব।

–বেশ, ওখানে থাকবো আমি।

 –তাহলে এখনকার মত বিদায়।

.

লাঞ্চ সেরে হোটলে ফিরলাম। স্যুটকেস গুছিয়ে নিলাম। বেল বাজিয়ে জোকে ডেকে সিপ্পির জিনিস তার স্ত্রীর কাছে পাঠাতে বললাম। তারপর সিপ্পির স্ত্রীকে সংক্ষিপ্ত চিঠি লিখলাম, সেইসঙ্গে দুহাজার বাক্–এর চেক লিখে দিলাম। যদিও জানি, চেক ফেরৎ আসবে এবং শেষে মোটা অঙ্কের চেক দিতে হবে।

গ্রীভসের অফিসে এলাম। ডাস্টারে জুতো ঝাড়ছেন বললাম কোর্টে যাবেন নাকি?

–আমাকে যেতে বলা হয়েছে। ডাস্টার রেখে, টাই ঠিক করে টুপির জন্য হাত বাড়ালেন–আপনি লিফট দেবেন না বাস ধরবো।

–নিশ্চয়ই দেবো। চলুন।

কোর্টে পৌঁছই আমরা। করোনারের বিচার ব্যবস্থা বড় একঘেয়ে। তিনি আমার কাছে সাক্ষীসাবুদ চাইলেন। ব্রিওয়ারের দাপুটে বিবৃতি শুনলেন বহুদুরে চোখ রেখে নির্লিপ্ততায়। গ্রীভসকে ডাকলেন না। স্নানের কেবিনের দারোয়ানকে বাদ দিলেন। এক সময় র‍্যানকিন উঠে বললেন–পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে এ ঘটনার। সেজন্য একসপ্তাহ সময় মঞ্জুর করা হোক। ভাল মানুষের মতো করোনার সময় মঞ্জুর করলেন। অতঃপর উঠে তার চেয়ারের পেছন দরজা দিয়ে নিমেষে অদৃশ্য হলেন।

সাক্ষ্য প্রমাণ দাখিল করে এসে আমি বসেছিলাম গ্ৰীভসের পাশে। ঝকঝকে চেহারার দুজনকে দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম–ওরা কারা?

উত্তর এল–সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল সমূহেরমধ্যে সবথেকে বড় ও তীক্ষ্ণধীসম্পন্ন অ্যাটর্নিওরা।

–ওরা কি ক্রিডির ব্যবসা দেখেন?

–ক্রিডি ছাড়া এমন কোন বিখ্যাত বড় ব্যবসায়ী নেই যাদের কাজ ওরা করেননি।

কোর্টরুম থেকে বেরিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিই, পথে একস্থানে গাড়ি থামিয়ে পুলিশের কাছ থেকে জেনেনিই কুরিয়ার অফিসের ঠিকানা। তারপর নবলব্ধ ঠিকানায় এসে গাড়ি থামাই।

মিস্টার ট্রয় বললেন–বসুন মিস্টার ব্রান্ডন। আপনার কথা শুনেছি। হোল্ডিং বলেছেন আপনি আসতে পারেন।

 আমি বলি–এখন বেশী কিছু বলতে পারছি না। শুধু পরিচয় করতে এলাম। হয়তো অল্প কদিনের মধ্যে জানাতে পারবো কিছু আপনাকে। বুঝছি, সত্য কাহিনী দিলে আপনি ছাপবেন।

ট্রয় বলেন–এ শহর অন্যায় আর নীতিহীনতায় ডুবে গেছে। কোন রকমে নাম কা ওয়াস্তে একটা প্রশাসন আছে। কাজকর্মের বালাই নেই।

–আজ জাজ হ্যারিসন নয়া সমাজ চান। —

ট্রয় কাঁধ ঝাঁকানি দিয়ে বলল–অঙ্গীকার করেছেন করবেন, যদি নির্বাচনে যেতেন। কিন্তু জিতবেন না। আমি বলছি না এ শহরকে পরিচ্ছন্ন বা উন্নত করা যাবে না। করা যেতে পারে। ক্রিডি বা হ্যারিসন, যেই আসুন, কাজ করে যাবে সেই পুরোনো চক্র। এই হল সিস্টেম। তাছাড়া একজন মানুষ কিছুদূর পর্যন্ত সৎ থাকতে পারেন। সব মানুষকেই হয়তো কেনা যায় না, তবে পয়সা থাকলে হ্যারিসনকে কেনা যায়।

অনুমান করা যায় ঐ কুচক্রীদের নেতা ক্রিডি। ক্রিডি না হলে আর কে?

একমুখ ধোয়া ছেড়ে ট্রয় বলেন–ক্রিডির অর্থ নিয়ে যিনি ব্যবসা চালান এবং এ শহর যার অঙ্গুলি হেলনে চলে, তিনি মাসকেটিয়ার ক্লাবের মালিক কর্ডেজ। এখন ক্রিডি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে জাজ হ্যারিসন ক্ষমতায় এলেও কর্ডেজ তার নিজস্ব স্থানেই থাকবেন। কেউ যদি তার পায়ের তলার মাটি কেড়ে নেয়, তবেই শহর দুষ্টচক্র মুক্ত হবে। কিন্তু কেউ সে কাজে যোগ্য নয়,

–মাসকেটিয়ার ক্লাব নিশ্চয় কর্ডেজের একমাত্র আপত্তি নয়।

–না। ক্রিডির পয়সা লগ্নী করে তিনি পয়সা কামান। ক্যাসিনো একটি উদাহরণ। ক্রিডির পয়সায় যাবতীয় ব্যবসা কর্ডেজ দেখাশোনা করেন, বিনিময়ে পঁচিশ শতাংশ নেন। আমি আপনাকে পরিষ্কার ছবি তুলে ধরলাম। ট্রয় বলে যান–হোল্ডিং বিষধর সাপ। তার স্বার্থে যতক্ষণ চলবেন ততক্ষণ বন্ধু। একপা এদিক–ওদিক হলেই ছোবল খাবেন। সুতরাং তাকে সাবধান।

মনিবন্ধে ঘড়ি দেখে ট্রয় বলেন–এবার যেতে হবে আমায়।

 জিজ্ঞাসা করি–আগামীকাল হেল্পলের সাথে দেখা করবেন। কি, এই নামই তো বললেন?

–হ্যাঁ, ফ্র্যাঙ্ক হেপ্পল।

-মাসকেটিয়ার ক্লাবের কোন মেম্বারকে চেনেন?

আমি? হেসে ফেলে ট্রয়–বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই।

জায়গাটা দেখে আসতাম। –সে আশা ছাড়ুন। বোকামী করবেন না। মেম্বার ছাড়া, মেম্বার যদি কাউকে সাথে নিয়ে না যায়, তবে ওখানে ঢোকা অসম্ভব।

–আচ্ছা ক্রিডির বিরুদ্ধে নিরেট সাক্ষ্য প্রমান ছাড়া কি কিছু করার নেই?

–তার বিরুদ্ধে বেস কিছু করতে গেলে আমার ব্যবসা লাটে উঠবে।

–বেশ, এবার সাক্ষ্য প্রমাণ সহ আসবো।

 ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল ট্রয়।

.

০৭.

 মাসকেটিয়ার ক্লাবের অবস্থান হল, রিজা–প্লাজা হোটেলের শীর্ষতলায়। কিন্তু সেখানে ডোকা যায় কি করে?

হঠাৎ মনে পড়ল গ্রীভস একবার বলেছিলেন, তিনি রিজা প্লাজায় গোয়েন্দাগিরি করেছিলেন কিছুদিন। ফোনে যোগাযোগ করতেই তিনি আমায় থার্ড স্ট্রীটের বার এক্স–এ আসতে বলেন।

এবারের সব থেকে কোণার টেবিলে বসে বিয়ারের অর্ডার দিলাম। বেয়ারাকে দিয়ে সান্ধ্য খবরের কাগজ আনিয়ে পড়তে থাকি। প্রথম পাতায় বিরাট ছবিসহ খবর। ছবিতে র‍্যানকিনকে দেখা যাচ্ছে অকুস্থলে, শার্লক হোমসের দৃষ্টিতে দেখছেন। শেষ পাতায় থেলমার ছবি।

এমন সময় গ্রীভস এলেন। এসে টেবিলের অপরপ্রান্তে বসলেন, গেলাসে চুমুক দিয়ে বলেন–রিঞ্জা প্লাজা সর্বোচ্চ তলা জুড়ে মাসকেটিয়ার ক্লাব। প্রথমে আপনাকে হোটেলে ঢুকতে হবে। তারপর লবি, শেষ প্রান্তে লিফট। লিফট থেকে নেবে লবি ধরে খানিক গিয়ে খাঁচা। তারমধ্যে রিসেপশনিস্ট।

তিনি যদি আপনাকে চিনতে পারেন খাঁচা খুলে ভিজিটার্স বইতে সই করে ঢুকতে দেবেন। এবার ছাড়া পেলে আরেকটা লিফট আপনাকে পৌঁছে দেবে। লিফটে উঠে ওপরে কোথায় কি আছে জানি না। ওরা আপনাকে চিনবে না সুতরাং ঢুকতেও দেবে না। ওসব ভাবনা ছাড়ুন। মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন।

–ওপরে একটা রেষ্টুরেন্ট আছে না?

–এ শহরের শ্রেষ্ঠ রেষ্টুরেন্ট বোধহয়।

রেষ্টুরেন্ট ওপরে থাকায় নিশ্চয়ই একতলা থেকে বার বার মাছ মাংস অব্দি ওপরে যায়?

–হ্যাঁ যারা নিয়ে যায়, তাদের দেখেছি, তারা ডেলিভারি ম্যান।

ডেলিভারি ম্যানদের কাউকে চেনেন। আমায় ভেতরে ঢুকতে দেবার জন্য তাকে চাপ দেওয়া যেতে পারে? আমি শুধু ভেতরটা একবার দেখবো।

বীয়ার শেষ করে গ্রীভস বলেন–হ্যারি বেন্নামকে চিনতাম। এখনো কাজ করছেন কিনা জানি না। দারুন উৎসাহি আর কর্মঠ ছেলে। তবে আপনাকে তিনি সাহায্য না করলে আশ্চর্য হবেনা। আসছি এক মিনিট।

টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন গ্রীভস। টেলিফোন বুথ থেকে মিনিট পাঁচেক পরে এসে বললেন–এইমাত্র কথা বললাম। পঞ্চাশ বাসের জন্য হ্যারি তার বৌকে ছাড়তেও রাজী। ব্যবসায়িক চুক্তি পঞ্চাশ বাস। ভেবে দেখুন, হ্যারি কিন্তু পঞ্চাশ বাসের বিনিময়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আপনাকে বৈচে দিতেও পারে।

–তাই যদি করে, ওরা মেরে ফেলবেনা আমাকে। বড় জোর গলা ধাক্কা দেবে। আপনি ওনাকে রাত সাতটায় সময় দিন।

গ্রীভস মাথা হেলান। হ্যারি এলিভেটরের কাছে থাকবেন।

–যদি ওখানে গিয়ে ঝামেলায় পড়ি কি করা উচিৎ একটু পরামর্শ দিন।

কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে হঠাৎ উঠেবললেন–ঘুরে আসছি। পালাবেন না। আধঘন্টার মধ্যে ফিরে এলেন, হাতে একটা মোড়ক। সেটা সামনে রেখে বললেন–নিন আর কুড়ি বা দিন। আমার পরিচিত এক মদ্য ব্যবসায়ী আছে। যে ওই ক্লাবে মদ সরবরাহ করতে চায়, কোন আশা যে নেই তা বোঝে না। এই বোতলে তার মদের নমুনা। আর এই যে, তার ব্যবসায়িক কার্ড।

কি আশ্চর্য, এটাই তো চাইছিলাম ধন্যবাদ; অসংখ্য ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ! বেশ, এবার উঠি।

উঠতে উঠতে গ্রীস মৃদুস্বরে বলেন–ইয়ে, আপনি জীবনবীমা করেছেন তো?

বললাম–এর চেয়ে কত সাংঘাতিক জায়গায় গুণ্ডাদের শায়েস্তা করেছি।

রিৎজা–প্লাজার নির্দিষ্ট এলিভেটরের সামনে এসে দাঁড়াই। ওপর থেকে নেবে আসে লিফট। কাঠের চৌখুপি থেকে ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে বেরিয়ে আসেন যিনি তিনিই গ্রীস বর্ণিত হ্যারি বেন্নাম। সাদা কোট, কালো ট্রাউজার, ঢুলুঢুলু চোখ। মোটা নাক, মুখশ্রী চমৎকার।

আমি হাসলাম–প্রাপ্য নিয়ে আমায় নিয়ে চলুন। পঁচিশ বা এগিয়ে দিলাম।

হ্যারির চোয়াল শক্ত হল–একি, গ্রীভস বলেছে পঞ্চাশে?

–গ্রীভস এও বলেছেন আপনাকে বিশ্বাস করা যায় না। এখন অর্ধেক, জায়গা দেখে ফেরার সময় বাকী অর্ধেক।

পঁচিশ বাক্স হিপ পকেটে চালান করে দিয়ে হ্যারি বলেন–পিছনের দরজা দিয়ে যান। তবে বিপদে পড়বেন কিন্তু।

–পঁচিশ বা কি এমনিই দিচ্ছি? ওখানে আর কে কে আছে এখন?

এখন কেউ নেই, আর দশ মিনিটের মধ্যে সব এসে পড়বে। বস্ তার অফিসে।

কর্ডেজ?

–মাথা নাড়ে হ্যারি।

আর ওয়াইন ওয়েটার?

–অফিসে।

–বেশ আপনি চলুন আগে, আমি আসছি পেছনে। কোন বিপদে পড়লে আমি ওয়াইন ওয়েটারের খোঁজ করবো। সঙ্গে স্যাম্পেল আর বিজনেস কার্ড আছে। হ্যারি এগিয়ে যান লবির দিকে। অল্প দূরত্ব রেখে আমি অনুসরণ করি। দরজা পেরিয়ে পা রাখি প্রকাণ্ড ককটেল লাউঞ্জে। দেখার মত জায়গা। এমন মনোরম বিশাল বার জীবনে প্রথম দেখলাম। দুই দরজার মাঝে ইংরেজি এস আকারে বার। তিনশো জন লোক একত্রে বসতে পারে। কালো কাঁচের মেঝে। ঘরের অর্ধেক অংশ ছাদ বিহীন। যেখানে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা গোনা যায় এখান থেকে দশমাইল পর্যন্ত দৃষ্টি যায়। চোখে পড়ে সমুদ্র ও বালিয়াড়ি। পাম গাছের আড়ালে বেন্নামের সাথে মিলিত হই। তিনি জানান অফিসগুলো ঐ দিকে। বারের পেছনে দরজার দিকে অঙ্গুলি–সঙ্কেত করেন। রেষ্টুরেন্ট এদিকে। আপনি কি দেখতে চান?

–পুরো জায়গাটা। আচ্ছা, আপনি সবাইকে যে ম্যাচ ফোল্ডার দেন, সেরকম কিছু ম্যাচ ফোল্ডার আমাকে দিন না?

আমি বেন্নামের কাছ থেকে একটা ম্যাচ ফোল্ডার নিই। খুলে উল্টে পিছন দিকে দেখি না, কোন সংখ্যা ছাপা নেই।

এরকম আরো আছে?

–এগুলো তো ম্যাচ–ফোল্ডার, না?

 জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

–আরেক রকম আছে, যেগুলো বস্ দেন। দেখুন মশাই, ওসব বাদ দিন। বেন্নামের মুখ ঘামে ভিজে ওঠে। আপনাকে এখানে কেউ দেখলে চাকরি যাবে আমার।

–অফিসগুলো দেখার সুযোগ হবে না?

 –আসুন।

 এমন সময় বারের পেছন দরজা দিয়ে ল্যাটিন চেহারার মোটা এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। তার সাদা কোর্টের বুকে এমব্রয়ডারী করা আঙুরের ছবি চিনিয়ে দেয় ইনি ওয়াইন ওয়েটার। লোকটার দৃষ্টি বেন্নামকে ঘুরে আমার দিকে স্থির হয়।

মাথা ঠিক রেখে বেন্নাম বলেন–ইনি মিঃ গোমেজ। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কোন কাজ হয় না এখানে। তারপর গোমেজের দিকে ফিরে বলেন–এই ভদ্রলোক আপনার সাথে কথা বলতে চান।

হাসি ছড়িয়ে বলি–আমাকে একটু সময় দিতে পারেন মিঃ গোমেজ, আমি হলাম ওক্লার। ক্যালিফোর্নিয়া ওয়াইন কোম্পানি থেকে আসছি। আমি ট্রেড কার্ড বের করে দিই। ভাবলেশহীন মুখ গোমেজের। কার্ড ফেরৎ দিয়ে বলেন–আপনাদের সাথে কোন কারবার আমার নেই।

–আমরা কাজ করতে চাই মিস্টার গোমেজে। আমাদের বহুমুখী ব্যবসা আছে যাতে আপনারা উৎসাহিত হবেন।

–উনি ভেতরে কি করে এলেন? গোমেজ বেন্নামের দিকে তাকান।

কি জানি, এখানেই ছিলাম আমি, দেখি, আপনাকে ভদ্রলোক এসে খুঁজছেন।

আমি বললাম, মালপত্রের লিফট ধরে এসেছি। ভুল করেছি?

গোমেজ বলেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া সেলসম্যানদের সাথে আমি দেখা করি না।

দুঃখিত মিঃ গোমেজ। কাউন্টারের ওপর ব্রান্ডির মোড়ক রেখে বলি, আগামীকাল আমায় ডেট দিতে পারেন? এই বস্তুটা ইতিমধ্যে চোখে দেখতে পারেন। আমরা কাল ব্যবসার কথা বলবো।

–আমরা এখনই ব্যবসার কথা বলব। পেছন থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।

 ঘুরে দেখি, কেতাদুরস্ত কালো মানুষটি কুড়ি ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। বুকের বোতামে সাদা ক্যামেলিয়া। ঈশ্বর দূতের মত মুখ, খাড়া নাক, ছোট চুল, চঞ্চল দৃষ্টি, রোগা, লম্বা, উনিই কি মিঃ কর্ডেজ?

–এটা? বার কাউন্টারের মোড়কের দিকে ইঙ্গিত করেন তিনি। দ্রুত মোড়ক খোলেন গোমেজ। টেবিলে ব্রান্ডির বোতল এমন ভাবে রাখেন যাতে কর্ডেজ লেবেলটা পড়তে পারেন। লেবেলে চোখ বুলিয়ে কর্ডেজ বলেন–একমাস আগেই না বলেছি। আপনি না মানে জানেন না।

–দুঃখিত। আমি নতুন কাজ করছি তাই জানি না, আমার আগে এটা কেউ আপনাকে দেখিয়েছে।

–বেশ! এবার তো জানলেন। ক্লাব থেকে বেরিয়ে যান। চলে যান।

ও হ্যাঁ। আ’ম সরি। ভাব দেখচ্ছি যেন আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়–বোতলটা যদি রেখে যাই, খুব ভাল ব্রান্ডি, যেকোন শর্তে আমরা এ মাল সরবরাহ করতে পারি।

–বেরিয়ে যান বলছি।

বার থেকে চলে আসি। কাঁচের মেঝেতে সবে পাঁচ–ছ পা ফেলেছি কি ফেলিনি, চোখের নিমেষে তিনজন গুণ্ডা শ্রেণীর লোক যাবার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। ওদের দুজনকে কস্মিনকালেও দেখিনি। লাতিন আমেরিকান মুখ, শক্ত, ভাবলেশহীন। তৃতীয়জনের ভাঙা চোয়ালের দিকে তাকিয়ে ধধ করে আমার হাঁটু কেঁপে ওঠে। এ আর কেউ নয়। সাক্ষাৎ যমদূত, হার্জ।

সাপের হিসহিস শব্দের মত হার্জের সরু ঠোঁট থেকে ছিটকে আসে–এই যে খোচ্চর, চিনতে পারছো?

আমি একপাশে সরে দাঁড়াই যাতে হার্জ ও কর্ডেজকে একসঙ্গে দেখা যায়। কর্ডেজ অবাক হয়ে বলে–কি ব্যাপার?

হার্জ বলে, ছুঁচোর নাম ব্রান্ডন। ব্যাটা টিকটিকি। সিপ্পির সহকারী।

আমার দিকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন কর্ডেজ। কাধ ঝাঁকিয়ে বারের দিকে চলে যেতে যেতে ছুঁড়ে দিয়ে যান কথাটা।

এখান থেকে বের করে দাও ওকে।

 –আলবাৎ। হার্জ বললো–এই ছেলেরা সরো, জায়গা দাও, খোকাকে দেখি একটু।

ভয়ঙ্কর হাসি নিয়ে হার্জ বাকী দুই গুণ্ডাদের সরিয়ে কাঁচের মেঝেতে পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে এল। চকিতে পয়েন্ট থার্টি এইট রিভলভার বের করে চক্রাকারে ঘুরিয়ে হার্জের বুকে তাক করি–থামুন। আমাকে রাগালে ভাঙচুর হবে।

হার্জ এগিয়ে আসে কয়েক পা। দরজার হাতলে হাত রাখে। চোখ আমার দিকে।

দুই তাগরাই গুণ্ডা স্থির। ওরা পেশাদার গুণ্ডা। জানে, আমাকে ঘিরে ধরলে গুলি খাবার সম্ভাবনা আছে।

কর্ডেজ ফিরে আসেন। বলেন–আপনাকে চলে যেতে বলেছি। যান চলে যান।

আমি বলি–বাঁদরটাকে আমার পথ থেকে সরে যেতে বলুন, চলে যাচ্ছি।

–ঠিক তখনই ঝপ করে আলো নিভে যায়।

কাজটা বোধহয় হার্জের। দুমদাম কটা দ্রুত পদশব্দ। কমলা রঙের তীক্ষ্ণ আলো ছুটে গেল। ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল আয়না। কয়েকটি শরীর ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। এলোমেলো অনেকগুলো হাত আমার গলা, হাত, কোমর জড়িয়ে ধরেছে। আমি বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিতেই মাথার কাছে ধাতব কিছু মেঝেয় পড়ার শব্দ। একটা বুট আমার পাশে সজোরে পড়লো। বুঝলাম লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। আন্দাজে মুখ লক্ষ্য করে ঘুষি চালালাম কষে। কাঁচের মেঝেতে দেহ আছড়ে পড়ার শব্দ। সেই সঙ্গে আঁক করে ভয়ার্ত আর্তস্বর। এমন সময় কে যেন আমার চোয়ালে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি হানলো। বেসামাল হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। মাথা ভো ভো করছে। তখনই আলো জ্বলে উঠল।

হার্জ ও দুই গুণ্ডার মধ্যে আমি পড়ে আছি। উফ চোয়ালটা বুঝি ভেঙেই গেছে। যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। আমার বন্দুক কেড়ে নিল এক গুণ্ডা।

কর্ডেজের গম্ভীর গলা–ওকে নিয়ে গিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলল। যেন এমুখো আর না হয়

কর্ডেজ চলে যাচ্ছেন, তার জুতোর শব্দ ক্রমে মিলিয়ে গেল। আমার বন্দুক হার্জের হাতে মুখে শয়তানের উল্লাস, পাকা বন্দুকবাজের মত বন্দুক নাচাতে নাচাতে হঠাৎ বন্দুক স্থির হয় আঙ্গুল ছুঁলো ট্রিগার। জানি পেশাদার বন্দুকবাজরা শত্রর কটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছাড়া সর্বত্র গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয়। এবার নাও, কমাস হাসপাতালের বিছানায় খাবি খাও। মরবে না, যন্ত্রণা পাবে।

নম্র কণ্ঠে বলি–আমায় যেতে দিন আর কোনো গণ্ডগোল করবো না, শুধু এখান থেকে চলে যেতে দিন।

–তুমি যাবে চাঁদু। হার্জের মুখে নৃশংসতম হাসি–আমার রাস্তায় যাবে।

উঠে দাঁড়াই। আচমকা আমার মাথায় বন্দুকের বাঁটের আঘাত করে হার্জ। সরে যাই তৎক্ষণাৎ। পাশ দিয়ে বাতাস কেটে আঘাতটা কাঁধে এসে পড়ে। ফলে কাছাকাছি চলে আসি আমরা। মুহূর্তে হার্জের কোর্টের দুকোণা ধরে শূন্যে তুলে, মাথার ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিই। বারের কোণায় তার মাথা ঠুকে কাঁচের মেঝেতে আছড়ে পড়ে। উপুড় হয়ে নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে হার্জ।

দ্বিতীয় গুণ্ডার দিকে ধেয়ে যেতে প্রথম গুণ্ডা সরে যায়। লোকটা প্রস্তুত ছিল না। তার চোয়াতে এসে পড়ে আমার সর্বশক্তি নিয়োজিত দুর্দান্ত ঘুষি। ধুপকরে পড়ে, গড়িয়ে গেল সে। স্বচ্ছ কাঁচের মেঝেতে পিছলে দেওয়ালে গিয়ে দুম করে মাথা ঠুকে গেল। আওয়াজটা ভারী, বোধহয় ফাটলে মাথাটা।

অমনি তৃতীয় গুণ্ডাটা ছুটে এল মত্ত হাতির মত। কিন্তু তার চোখে ভয়। তার ডান হাতের নিচে মাথা নুইয়ে পাজরে মারলাম মোক্ষম ঘুষি। টাল খেয়ে সে পিছু হটলো। খপ করে তার দুই ঠ্যাং ধরে হিড়হিড় করে টেনে শূন্যে এক পাক ঘুরিয়ে দিলাম আছাড়। মাথাটা মেঝেতে সশব্দে আছড়ে পড়লো। মত্ত শরীরটা সামান্য কেঁপে ওঠে, অস্ফুট আর্তনাদ করে নিথর হয়ে গেল

হার্জের দিকে তাকালাম। বারের কোণে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মুখটা কাৎ হয়ে আছে। দৃষ্টি শূন্য, স্থির।

এক্ষুনি পালাতে হবে নয় তো এখানে কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে সব দেখে যেতে হবে। ভবিষ্যতে আর এখানে আসার সম্ভাবনা নেই। তার চেয়ে লুকিয়ে থেকে সব দেখে নিই। কিন্তু লুকোনো যায় কোথায়? টেরেসের দিকে হেঁটে যাই। ডানদিকে সারিবদ্ধ আলোর বিন্দু জানালায়। অনুমান যদি ভুল না হয়, ঐগুলোই মাসকেটিয়ার ক্লাবের অফিসঘর। টেরেসের ছাদ টপকালে ঢালু কাঠের পাটাতন নেমে গেছে ঐ জানালাগুলির মাথায়। চেয়ে দেখি, গাঢ়তর অন্ধকারে পাটাতন দেখা যাচ্ছে না। ওখানে নামতে হলে আগে টালির ছাদে নামতে হবে। আমি লাফিয়ে টেরেসের ছাদে উঠে পড়ি। প্রথমে কিছুটা সমান্তরাল, তারপর গড়ানে ঢালু টালি নেমে গেছে সটান নিচে। আমি সন্তর্পণে নিচে নামতে থাকি।

ধীরে উঠে দাঁড়াই, আরো নিচে নামতে হবে। ওঠার চেয়ে নামা শক্ত। পা ফস্কালেই তিনশো ফুট নিচে পড়ে মৃত্যু অবধারিত। টালির মধ্যে গোড়ালি গেঁথে শব্দহীন ভাবে সতর্কে পা ফেলে নামতে থাকি। ঢালু টালির শেষ প্রান্তে দু–হাত ধরে শরীর ঝুলিয়ে দিই। তারপর পা তুলে শরীর তুলে দিই।

এখান থেকে দেখা যাচ্ছে অফিস ঘরের টেবিল, দামী পোষাকের সুদৃশ্য রমনী। আমি মিশে আছি অন্ধকারে। টেরেসের শেষপ্রান্তে কেউ না এলে আমায় দেখতে পাবে না। এক চিলতে পরিত্যক্ত লবি। জানালার পেছনে অবিকল বেড়ালের মত লাফ দিই। অল্প হাত পিছলে যায়। শরীর টাল খেয়ে পা হড়কে যায়। কোনরকমে বাঁ হাতে টালির কোণা চেপে ধরি। কিসে যেন পা লেগে খুট করে শব্দ ওঠে। দুপা বেঁকিয়ে দিই লাফ। অফিস জানলার পেছনে পড়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।

এটাও গড়ানে টালি–আরো নিচে নেবে গেছে। তবু সুবিধা এই, এখান থেকে অফিসগুলো স্পষ্ট দেখতে পাব। প্রথম দুটো জানলার ভেতরে তাকাই। লোকজন নেই। টেবিল, টাইপরাইটার ফাইলিং ক্যাবিনেট সব ঠিকঠাক সাজানোনা। প্রথম শ্রেণীর অফিসের মত। তৃতীয় ঘরটি বেশ লম্বা। ঘাড় উঁচু চেয়ারে মস্ত কাঁচ ঢাকা টেবিলের সামনে বসেছেন কর্ডেজ। ঠোঁটের দীর্ঘ পাইপে ব্রাউন রঙের সিগারেট। বড় একটা লেজারের সংখ্যগুলোয় পেন্সিলে দাগ দিচ্ছেন। ঘরে নীল উজ্জ্বল আলো। জানলা থেকে যে আলোর রেখা এসে পড়েছে তা থেকে নিজেকে সরিয়ে চুপিসাড়ে দেখতে থাকি।

দশ মিনিট কেটে গেল। ভাবছি মিছি মিছি সময় নষ্ট। তখনই টোকা পড়লো দরজায়।

 মুখ তোলেন কর্ডেজ–ভেতরে আসুন। বলে ফের কাজে মন দিলেন।

দরজা খুললো, মোটা লোকটা ঢুকলো। ঝকঝকে পোক। বোতামে লাল কারনেশন। ঢুকে লোকটা দাঁড়িয়ে রইল।

যোগ শেষ করে মুখ তোলেন কর্ডেজ। নির্লিপ্ত আন্তরিকতায় বলেন–দেখুন, আপনার কাছে পয়সা যদি না থাকে চলে যান। আপনার কাছ থেকে যা পেয়েছি, তা উশুল করে দিয়েছি।

–পয়সা এনেছি। লোকটা টাই ঠিক করে, পকেট থেকে একতাড়া ডলার টেবিলে রাখে–এই নিন, হাজার ডলার, এবার দুটো চাই। ভুল মাল দেবেন না।

কর্ডেজ ডলারগুলো ঢুকিয়ে রাখেন। উঠে আলমারি খুলে কি নিয়ে আসেন। টেবিলের ওপর ম্যাচ ফোল্ডার এগিয়ে দেন লোকটার দিকে।

লোকটা ফোল্ডারের পাতাগুলো পরীক্ষা করে পকেটে চালান করে দেয়। তারপর বিনাবাক্যব্যয়ে প্রস্থান করে। ফের–লেজার খাতা খুলে বসেন কর্ডেজ।

দীর্ঘ চল্লিশ মিনিটের মধ্যে আরো দুজনকে প্রবেশ, বিল প্রদান ও ম্যাচ ফোল্ডার নিয়ে প্রস্থান করতে দেখা যায়। তাদের একজন হোঁৎকা বয়স্ক এবং অন্যজন কলেজ পড়ুয়ার মত ছোকরা।

মনে পড়ে মর্গটের সাথে দেখা করার কথা। ঢালু চাতাল বেয়ে আরো নিচে নামতে থাকি। আরে কি এটা? মনে হচ্ছে হোটেলের বেডরুমের ব্যালকনি। জানালায় আলো নেই কোন। অর্থাৎ নিরাপদ। এ পথে বেডরুমে ঢুকে তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে যাব। এরপর লিফটে হোটেল ছেড়ে বেরোতে দেরী হয় না।

.

০৮.

 হোটেলের রিভলভিং দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন মর্গট। উজ্জ্বল আলোর নিচে যেন সবুজ রাতপরী।

–হ্যালো। দারুণ লাগছে আপনাকে।

গলাবন্ধ সবুজ পোষাক দ্বিতীয় চামড়ার মত তার শরীর ঢেকেছে। মর্গট হাসেন–আপনার জন্যেই পরেছি। ভাল লেগেছে? জেনে খুশী হলাম।

সাথে গাড়ি আছে?

না। আপনাকে বাংলো দেখাবো, আপনি আমাকে পৌঁছে দেবেন না?

 নিশ্চয়ই দেবো।

দরজা খুলে আমার গাড়িতে ওঠেন মর্গট। গাড়ি ছোটাই। মাঝে পথ নির্দেশ দেন তিনি, আমি চালাতে থাকি।

হঠাৎ স্তব্ধতা ভাঙিদারুণ জায়গা মাসকেটিয়ার্স ক্লাব, আপনি যান কখনো–সখনো?

 –ঐ একটা জায়গা ট্যুরিস্টরা দখল করতে পারেনি। হ্যাঁ আমি গেছি অনেকবার। ক্লাবের অর্ধাংশের মালিক আমার ড্যাডি বলে, আমায় কোন বিল মেটাতে হয়না।

ঘণ্টায় চল্লিশ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলেছি।

মর্গট বলেন–বললে বিশ্বাস করবেন না টাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি মাঝে মাঝে।

–আমিও। দেখুন, টাকার জন্য মরিয়া হওয়া আপনাকে মানায় না। মডেল হিসেবে নাচলে আপনার একটা ভবিষ্যৎ আছে। সেকথা কোনদিন ভেবেছেন?

–ড্যাড করতে দেবেন না তার মর্যাদাহানির ভয়ে। তিনি বলে দিলে কেউ কাজে নেবে না আমায়।

–পালাতে হবে আপনাকে। নিউইয়র্ক আপনাকে সাদরে গ্রহণ করবে।

–আপনি কি মনে করেন আমি পারব? বাঁ–দিকের রাস্তা ধরুন। অন্ধকারভেদী গাড়ির হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট হয় সমুদ্রাভিমুখী বালুকাময় এবড়ো–খেবড়ো রাস্তা। স্পীড কমিয়ে আনি।

ও শুধু কথার কথা, বলা সহজ।

 লেডিজ ব্যাগ থেকে সিগারেট নিয়ে ধরান মর্গট। ধোঁয়া ছেড়ে বলেন–আপনার একা থাকতে ভালো লাগে না?

মনে পড়ে হার্জও তার সাঙ্গপাঙ্গদের কথা। মনের ভাব চেপে বলি–কারণ থাকলে।

আরো আধ মাইল গাড়ি ছুটলো। দু–পাশে অন্ধকার চিরে হেডলাইটের আলো। জ্যোৎস্নায় ছায়া ছায়া পামগাছ ও বালিয়াড়ি। বহুক্ষণ দুজনেই নীরব। হঠাৎ মর্গট বলেন–এসে গেছি।

গাড়ি থামে। মর্গট আমার কাছ থেকে ফ্লাস লাইট নিয়ে যান। যেন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগ হাতড়ে চাবি বের করেন।

মাইলব্যাপী জ্যোৎস্নাপ্লাবিত বালিয়াড়ি। পাইন গাছেরশ্যামলিয়া আর অনন্ত সমুদ্র। দূরে খাড়াই পাহাড়ের ওপর বাড়ির মাথায় সমুদ্রমুখী তীব্র আলো দেখে বলি–ও আলো কিসের?

–ওটাই অ্যারো পয়েন্ট।

–ঐ আলো কি হ্যানসের প্লেস থেকে আসছে?

–হ্যাঁ।

তালা খুললো। আলো জ্বাললো, দেখা গেল দুর্দান্ত মহার্ঘ আসবাবে সাজানো ঘর। দুরে, এককোণে ককটেল বার। একটা টিভি কাম রেডিওগ্রাম কম্বাইন্ড। অনেকগুলো আরামদায়ক দামী চেয়ার। নীল সাদা মোজাইক মেঝে। দেওয়ালে তিনফুট দীর্ঘ জানালার ধারের ডিভান। বাঃ চমৎকার, সত্যি আমায় থাকতে দেবেন এখানে।

দরজা পথে মর্গট। চোখে লাস্যময় মদির হাসি ছড়িয়ে বলেন–পছন্দ।

ঐ হাসি রক্তে হিন্দোল তোলে। –অপূর্ব। বারের দিকে তাকাই। সব ধরনের মদ মজুদ।

–ঐ বোতলগুলো আপনার বাবার না আপনার?

–বাবার, বাড়ি থেকে কিছু কিছু করে এনেছি।

 মর্গট বারের পেছনে ফ্রিজ খুলে এক বোতল হিমশীতল স্যাম্পেইন নিয়ে আসেন। –সেলিব্রেট করা যাক। এই যে, আপনি খুলুন, আমি গ্লাস আনছি। আমি বোতলের ছিপি খুলি। মর্গট লাউঞ্জ থেকে একটা ট্রেতে দুটো গ্লাস আনেন। গ্লাসে মদ ঢেলে দিই। গ্লাসে গ্লাস ঠেকাই–চিয়ার্স। ঠোঁটে তুলি। জিজ্ঞাসা করি–আমরা, কি সেলিব্রেট করছি?

–আমাদের মিলন। তার খোলা চোখে খেলা করে কামনা।

 –আপনিই আমার জীবনে প্রথম, যিনি পরোয়া করেন না আমি গরীব না বড়লোক।

দাঁড়ান দাঁড়ান, কি করে ভাবলেন একথা?

ঠোঁট থেকে নিঃশেষিত গ্লাস নামিয়ে বললেন–আমি বলছি। এবার উঠুন, বাড়িটা ঘুরে দেখুন, কেমন লাগে। আমি খালি গ্লাস নামাই–কোথা থেকে শুরু করবো?

বাঁ–দিকে সোজা গেলে শোবার ঘর।

 পরস্পরের দিকে অপলক তাকাই। বুকের মাঝে দমকা বতাস। দুজনেরই ভাবনা বুঝি একই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিশেছে। চমৎকার বেডরুম। ডাবল বেড।

জানালার ধারে ডিভানে শুয়ে আছেন মর্গট। দুটো কুশনের ওপর মাথা। দৃষ্টি প্রসারিত জ্যোৎস্নাপ্লাবিত সমুদ্রে। আমার দিকে না ফিরেই প্রশ্ন করে, পছন্দ হয়েছে?

খুউব। আমাকে এখানে রাখতে আপনি রাজী তো?

–হুম। আমিতে এটা ব্যবহার করছি না।

–খুনের তদন্ত কদ্দূর এগোলো?

–বিশেষ কিছু না। তবে এ মুহূর্তে, যখন আমার মধ্যে কিসব ঘটছে তখন কাজ নিয়ে মাথা ঘামাবো তা আশা করবেন না।

–কি হচ্ছে আপনার?

–এই–ই নির্জন বাংলো আর রাতপরীর মতো আপনি।

–তাহলে বলুন খুব বিরক্ত করছি আপনাকে!

করতে পারেন। হ্যাঁ আপনিই পারেন।

আমার দিকে তাকান সুন্দরী–কি হবে করলে?

একটুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর তার দীঘল পা মেঝেতে রেখে বলেন–সাঁতার কাটতে যাবেন?

চলুন।

 আমি উঠে দাঁড়াই। গাড়ি থেকে ব্যাগটা নিতে হবে। ব্যাগ নিয়ে ঘরে আসি। বেডরুমে ব্যাগ রাখতে গিয়ে দেখি, পূর্ণ দৈর্ঘ্যের দেওয়াল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মর্গট। ধীরে ধীরে পোক খুলছেন। উন্মুক্ত হচ্ছে নগ্নদেহ। যেন নগ্ন শ্বেতপরী। দু–হাত মাথায় তুলে কাঁধ থেকে চুল সরাচ্ছেন। দৃষ্টি দর্পনে।

ব্যাগ রেখে, ফিসফিস করে বলি–ওটা তোমায় করতে হবে না, আমি করে দিচ্ছি।

ঘুরে দাঁড়ান মর্গট। ধীরে। চোখে কামনার আমন্ত্রণ। ভঙ্গিতে অহংকার তুলে বলেন–তোমার কি মনে হয়, আমি সুন্দর?

তার চেয়েও বেশী।

 ধৈর্যের শেষ সীমায় চলে গেছি। যা ঘটতে চলেছে, মৃদু চেষ্টা করি তাকে থামাতে।

 নিজের অপরাধবোধে বলে উঠি–আমাদের দুঃখিত হওয়া উচিত।

 মাথা নাড়েন মর্গটও কথা বোলো না। আমি যা করি তার জন্য দুঃখিত হই না।

তখনও তার নরম দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ। ধীরে পা ফেলে আমার দিকে এগোতে যাবেন।

আঁধরে মর্গটের কথা ভাসে–একটা সিগারেট দাও। পাশের টেবিল থেকে প্যাকেট খুলে সগারেট দিই। লাইটার জ্বালি। সেই নরম আলোয় দেখি রাতপরীকে। বালিশে শায়িত সোনালী, মাথা। আমার দিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে। হাসি ছড়ায়, লাইটার নেভাই। অন্ধকারে মর্গটের সিগারের লাল আগুনের ছটা। অন্ধকারের নারী বলেন–কি ভাবছো আমার সম্পর্কে? ক্ষমা চাইছি না। আমি খুব স্বাধীন ও সহজলভ্যানই। কিন্তু যখন এমনটি ঘটে, তখন সেটা অবশ্যম্ভাবী। তোমাকে প্রথম যখন দেখি, কি রকম এক অদ্ভুত অনুভব পেয়ে বসে। যে রকম বহুকাল অনুভব করিনি। আর এ হল তার পরিণতি। তুমি বিশ্বাস না করলেও এ খুব সত্য। এই ইচ্ছে–সুখের পাগলামিতে আমি খু–উ–ব খুশি। নির্লজ্জ ভাবে খুশি। হাত বাড়িয়ে আমার হাত খুঁজে নেন মর্গট…তোমাকে যেমন ভেবেছিলাম, তার চেয়েও তুমি সুন্দর। আমার স্বপ্নের প্রেমিককেও হার মানিয়েছ তুমি।

ঘটনার আকস্মিকতায় তখন আমি বিহ্বল। বিমূঢ়। রমনীর প্রতিটি শব্দ রোমাঞ্চিত করে। .তবু মনে হয় যেন বড় অক্লেশে পেয়ে গেলাম। যেখানে আমার পা ফেলার কথা নয়, সেই নিষিদ্ধ এলাকায়, না, আমার পা টলেনি। দু–হাতে ভর দিয়ে মর্গটের শরীরের ওপর শরীর তুলে ঠোঁটে দিই আশ্লেষী চুম্বন।

একসময় তিনি উঠে পড়েন। ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে আমি অনুসরণ করি। দেখি, খোলা দরজার সামনে রাত্রির সমুদ্রের বালিয়াড়ির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে আছেন। চাঁদের আলোয় যেন ছবি। প্রকৃতির হাতে গড়া মূর্তি।

আমরা বারান্দায় আসি। চাঁদের আলোয় ঘড়ি দেখি। দুটো বেজে গেছে।

মর্গট আগে, আমি পরে সমুদ্রে নামি। দুশো গজ সাঁতরে তীরে উঠি দুজনে। জল উষ্ণ ছিল। নিস্তব্ধ চরাচর। যেন পৃথিবীতে পড়ে আছি আমরা দুজন নরনারী। বালিয়াড়ি ভেঙে বাংলোয় পৌঁছই।

বাংলোয় পা দিয়ে হঠাৎ থেমে মর্গট ঘুরে মুখ তোলেন। আমার দুটো হাত তার দীঘল মসৃণ পশ্চাত ছুঁয়ে ক্রমে ওপরে, ঢেউ খেলানো নিতম্বে এসে থামে। নিবিড় করে কাছে টেনে নিই। কতক্ষণ কেটে যায় এভাবে। একসময় খেলা ভাঙে। মর্গট বলেন–ভারী সুন্দর কাটলো লিউ। আমি আবার আসবো। তুমি কিছু মনে করবে না তো?

–কি যে বল। ভাবলে কি করে কিছু মনে করবো?

–আমায় পৌঁছে দিয়ে আসবে?

–এখন? বাকী রাতটা থেকে যাও না।

–থাকতে চাইলেই কি থাকা যায়। ড্যাডির লোক আমায় পাহারা দেয়। সারারাত বাইরে থাকলে নির্ঘাৎ ড্যাডি জানতে পারবেন।

–বেশ, তবে চল।

আমরা গাড়িতে উঠি। ফাঁকা পথ। মাথায় অজস্র চিন্তা। প্রশ্ন করার এই সুবর্ণ সুযোগ। অত্যন্ত সহজে জিজ্ঞাসা করি–তোমার বাবা প্রাইভেট ডিটেকটিভ ভাড়া করেছিলেন কেন?

সীটে মাথা রেখে মর্গট উত্তর দেন তাহলে নিজমূর্তি ধরেছ। তুমি কি ভাবো সব প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। জানি না। তবে আন্দাজ করতে পারি। তিনি গোয়েন্দা নিযুক্ত করলে, তা করেছেন নিজের স্ত্রীর ওপর নজর রাখতে।

–স্ত্রীর ওপর নজরদারীর কোন কারণ ছিল কি?

বহু কারণ থাকতে পারে। এতদিন কেন করেননি তাই ভেবে অবাক হচ্ছি। ঐ মহিলার চারপাশে সর্বদা কিছু ভ্রমর গুঞ্জন করতো। বর্তমানে থ্রিসবির সাথে তার ঘনিষ্টতা চলছে। লোকটা ভয়ানক। সম্ভবতঃ এ নিয়ে বাবা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। বাবার উচিত এখনি ডিভোর্স করা। তাহলে আমি বাড়িতে থাকতে পারি।

তুমি কি তাই চাও।

–কেউই বাড়ি ছাড়া থাকতে চায় না। ব্রিজিত আর আমার একসাথে থাকা অসম্ভব।

–তোমার ওপর নজর রাখতে তোমার বাবা সিপ্পিকে নিযুক্ত করেন নি, মনে হয়।

–সেজন্য পয়সা খরচ করে গোয়েন্দা রাখার দরকার ছিল না বাপির। আমার পরিচারিকাই যথেষ্ট স্পাইগিরি করে তাঁকে। মাইলখানেক পথ গিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করে মর্গট–ব্রিজিতের ওপর নজর রাখার কথা ভাবছো?

না। সিপ্পির খুনের সাথে ওনার যোগসাজস আছে বলে মনে হয় না। ব্রিজিতের ওপর নজর রাখতে গিয়ে সিপ্পি এমন কিছু আবিস্কার করে ফেলেন, যার কাছে ব্রিজিতের ওপর নজরদারী মূল্যহীন। সেজন্য খুন হতে হয় তাকে।

–ওহ তুমি সত্যি তাই ভাবছো?

–অনুমান করছি।

–আচ্ছা, সিপ্পির কাছে এমন প্রমাণ যদি থাকে যাতে ড্যাডি ব্রিজিতকে ডিভোর্স করতে পারেন। আর যদি তা ব্রিজিত জানতে পারে তবে সে মাথা ঠাণ্ডা করে বসে থাকবে না। যথেষ্ট অর্থ তার নেই। ড্যাডি তাকে ডিভোর্স করলে ব্রিজিত তা পছন্দ করবে না। ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে।

–তোমার কি মনে হয় তিনি সিপ্পিকে খুন করেছেন?

না। তবে থ্রিসবি করতে পারে। তুমিতো দেখোনি সেকত ভয়ঙ্কর। সিপ্পি যদি তেমন প্রমাণ পান এবং তার ফলে ব্রিজিত যদি তাকে টাকা দিতে অস্বীকার করে, তাহলে প্রিসবি সিপ্পিকে খুন করতে পারে।

থ্রিসবিকে দেখা দরকার একবার। কোথায় পাবো তাকে?

–শহরের শেষপ্রান্তে ছোট্ট নোংরা একটা জায়গা আছে। হোয়াইট চ্যাটিউ। দেখা যেতে পারে ওখানে। মর্গটের কণ্ঠের তিক্ততা আমায় আকর্ষণ করে–সে শুধু ব্রিজিতকেই আনন্দ দেয় না। টাকা থাকলে যে কোন মেয়েকেই সে আমন্ত্রণ জানায়। এরকম লোক আকছার দেখা যায়। ডানদিকে, সোজা ফ্রাঙ্কলিন আর্মস ধরো।

আমি তার নির্দেশমতো গাড়ি চালাই। অবশেষে তার অ্যাপার্টমেন্টের কাছে থামি।

আমার হাত স্পর্শ করে তিনি বলেন–শুভরাত্রি, আবার তোমায় ডাকবো। থ্রিসবি সম্বন্ধে সাবধান।

গাড়ির দরজা খুলে মর্গট নেমে যান। আমি গাড়ি স্টার্ট দিই। এবার ফেরার পালা।

ফেরার পথে ভাবনা আসে। মগর্ট থেকে কর্ডেজ। সিপ্পির স্যুটকেসে যে ম্যাচ ফোল্ডার পেয়েছি তার প্রতিটি পাতার দাম পাঁচশো ডলার। কর্ডেজ ম্যাচ ফোল্ডারে তিনটে পাতা ছিঁড়ে তিনজনকে দিয়ে প্রত্যেকের থেকে পাঁচশো ডলার নিয়েছে। সিপ্পি যেভাবেই হোক একটি ম্যাচ ফোল্ডার পেয়েছিল। যার জন্য প্রথমে সিপ্পির ওপরে পরে আমার ঘরে দুষ্কৃতী তছনছ করে গেছে। সিগির ঘরে কিছু না পেলেও আমার ঘরে পেয়েছে। আসল ম্যাচ ফোল্ডার নিয়ে তার স্থানে নকল। ম্যাচ ফোল্ডার রেখে সে ভেবেছে, ফোল্ডারের পেছনে সাঁটা সংখ্যা ছাপা লেবেলটা আমার নজরে পড়েনি। অর্থাৎ ঐ সংখ্যাগুলোর একটা তাৎপর্য আছে। হয়তো ম্যাচ ফোল্ডারের জন্যই সিপ্পিকে প্রাণ দিতে হল। আসলে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে এগুলো ছাড়া এখন উপায় নেই। আরো তথ্য প্রমাণ চাই।

রাত সোয়া তিনটে।

বাংলোয় ফিরে সদ্য হুইস্কি সোডা গ্লাসে ঢেলে বার কাউন্টারে যাচ্ছি হঠাৎ নজরে আসে, লাউঞ্জের ধারের টেবিলে মর্গটের হাতব্যাগ পড়ে আছে। ব্যাগ খুলি। কি আশ্চর্য! ব্যাগের ভেতর থেকে হাতে উঠে আসে একটা ম্যাচ ফোল্ডার। পেছনে দেখি, হ্যাঁ সাঁটা লেবেলে স্পষ্ট ছাপ.. ca5i148 থেকে C45160 পর্যন্ত।

এই সেই ম্যাচ ফোল্ডার যা সিপ্পির স্যুটকেস থেকে পেয়েছি। এটাই আমি কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলাম। ফোল্ডার পকেটে রেখে রিসিভার তুলি। –হ্যালো?

–অ্যাই, তুমি…লিউ? উত্তেজনাপূর্ণ গলা মর্গটের।

বলতে হবে না। জানি কি হারিয়েছ তুমি?

 –হ্যাঁ, আমার ব্যাগ। তুমি পেয়েছে?

–ওটা টেবিলে পড়ে আছে এখন।

–ওহ বাঁচলাম। বুঝতে পারছিলাম না ওটা ক্লাবে না বাংলোয় ফেলে এসেছি। আমি সবসময় জিনিস হারাই। কাল সকালে ব্যাগটা নিয়ে আসবো, না তুমি দিয়ে যাবে?

–ঠিক আছে। কাল সকালে যখন হোক পৌঁছে দেব।

থ্যাঙ্ক য়ু ডার্লিং, একটু স্তব্ধতা। তারপর মর্গট বলল–লিউ এখনো তোমার কাছে আছি…তোমার কথা ভাবছি।

পকেটে হাত দিয়ে ফ্লোল্ডার ছুঁই। বলি–আমিও ভাবছি তোমার কথা।

…শুভরাত লিউ।

…শুভরাত, সুন্দর।

সকাল এগারোটা কুড়ি।

বাংলো থেকে গাড়ি ছুটিয়ে এসে গেছি অ্যারো পয়েন্ট। বিচ রোডে সাইনবোর্ড জানায় এই পথে স্কুল অব সিরামিক্স দ্য ট্রেঞ্জার আইল্যান্ড অফ ওরিজিন্যাল ডিজাইন।

ট্যুরিস্টদের সাথে ভেতরে ঢুকি। কুড়ি ফুট চওড়া, পঞ্চাশ ফুট লম্বা ঘর। দু–ধারে লম্বা টেবিল নানান আকারের, নানান রঙের বিচিত্র নক্সাদার চীনে মাটির মহার্ঘ সব জিনিসপত্র। প্রত্যেকটি জিনিসের পিছনে একজন করে মহিলা দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের পরনে সাদা কোট, বুক পকেটে মাছের ছুরি। এই ধরনের কোন কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে কি থেলমা কদিন আগে খদ্দের সামলাতো? ঘরের শেষ প্রান্তে রঙিন পর্দা। বোধহয় আর একটা ঘর আছে ওদিকে। আমি বিভিন্ন সরঞ্জাম দেখার ভান করে বারে বারে ঐ পর্দার দিকে দেখছি। সামনের কাউন্টারের সেলস গার্ল আমার ভাবভঙ্গি দেখে বলে–কোন জিনিস পছন্দ হচ্ছে না? উত্তরে বলি–আপনিই বলুন, এখানকার কোন বস্তুই কি বিয়ের উপহারের যোগ্য?

–একটু দাঁড়ান। মেয়েটি কাউন্টার ছেড়ে বেরিয়ে দরজার কাছের প্রৌঢ়াকে কি যেন বলে। প্রৌঢ়া অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। হাতে হীরের আংটি বা পরণে আমার দুর্লভ পোষাক নেই। মেয়েটি ফিরে এসে জানায়–মিস ম্যাডক্স আপনাকে সাহায্য করবেন। আমি এগিয়ে যাই। প্রৌঢ়া সীট ছেড়ে উঠে আসেন। বলেন–আমাদের আরো অঢেল সামগ্রী আছে। দাম একটু বেশী।

–তা হোক, জীবনে বিয়েতো একবারই। চলুন, সেগুলো দেখাযাক। প্রৌঢ়া ঘরের শেষ প্রান্তের রঙিন পর্দা সরিয়ে আমাকে নিয়ে মাঝারি আকারের এক ঘরে ঢুকলেন।

এ ঘরে মাত্র ছটা একই মাপের মুর্তি–স্যান্ডে রাখা।

–হয়তো এগুলোর মধ্যে পছন্দ হবে আপনার।

চারদিক তাকিয়ে বলি–আগের চেয়ে ভালো।

এমন সময় ঘরে ঢোকেন সাদা মুখের এক ভদ্রলোক। তখনি চিনতে পারি। এই ভদ্রলোকই দানাগুয়ে, যিনি কর্ডেজের কাছ থেকে এক হাজার ডলার দিয়ে দুটো ম্যাচ ফোল্ডারের পাতা কিনেছিলেন।