০২.
খুনের চিন্তা
গিল্ডা আমার ঘরে পর পর তিন রাত্রি এলো, আমরা দুজনে দুজনকে ভালোবাসলাম।
উত্তেজনার প্রথম ধাক্কাটা কেটে যাবার পর দেখলাম এটা আমার পক্ষে তৃপ্তিকর হচ্ছে না।
কেউ ওর আসা যাওয়া দেখে ফেলবে ভেবে গিল্ডা খুব ভয়ে ভয়ে থাকতো। ওর স্বামী টের পেয়ে যাবে যে ও বিশ্বাসভঙ্গ করেছে, এই ভেবে ও আতঙ্কিত হতো।
আমাদের তাই লুকিয়েই প্রেম করতে হতো। কোন রকম একটু শব্দ হলেই ও ভয়ে আমার হাত চেপে ধরতে।
তিন রাত্রেই ও আমার সঙ্গে এক ঘণ্টারও কম সময় ছিল। ঐ অল্প সময়েই আমরা মরিয়া হয়ে প্রেম করে নিতাম। ও বাড়ি ফিরে যাবার আগে আমাদের কথা বলার সময়ই হতো না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওকে আমি ভালোবাসতাম। আমার কাছে এই মিলন কেবল দৈহিক ছিল না। আমি মাঝে মাঝে বিচলিত হতাম ওর ওপরে ওর স্বামীর প্রভাব আছে জেনে।
আমি চাইতাম ও নিজের সম্বন্ধে বা আমার সম্বন্ধে কোনো কথা বলুককিন্তু ও যখনই কোনো কথা বলতো তা ওর স্বামীর সম্পর্কে।
ও প্রায় ওর স্বামীর কথা চিন্তা করতে করতে বলতো যে, ওর স্বামী যদি টের পেয়ে যায় তবে ও কখনই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। তৃতীয় রাত্রে প্রেমক্রিয়ার পর জামা পরতে পরতে ও বলছিলো, আমার মনে হচ্ছে ও আমাকে চাইছে। আগে ওর কখনো রাত্তিরে ব্যথা হলে আমাকে জাগিয়ে কিছু চাইতো এখনোও আমাকে ডাকতে পারে।
দোহাই গিল্ডা, ওই চিন্তা ছেড়ে দাও। তোমার স্বামীকে সত্যি কথা বলে দাওনা কেন? কেন বলোনা যে তুমি আমায় ভালোবাসো। তুমি মুক্তি চাও?
আমি ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম, গিল্ডা, তুমি কি আমায় ভালোবাসো?
ও আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো, টেরি, তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো? আমি তোমায় ভালোবাসি। দিনের প্রতি মিনিটে আমি তোমার কথা ভাবি। তোমার কাছে আমি থাকতে চাই। কিন্তু ও যদি মারা যায় তবেই এটা সম্ভব। ও মারা না গেলে আমি মুক্তি পাবো না। ও আমাকে টেনে নিয়ে জানলার কাছে গেল। বাইরে চাঁদের আলো।
এখানে আসার আগে ডাক্তার দেখে বলেছে ওর স্বাস্থ্য খুব সুন্দর রয়েছে। ও স্বচ্ছন্দে আরো তিরিশ বছর বাঁচবে।
তাহলে ওঁর মারা যাবার কথা ভেবে সময় নষ্ট করছো কেন? আমরা তিরিশ বছর অপেক্ষা করতে পারি না। তোমার ডিভোর্স নেওয়া উচিত। তোমার স্বামীর টাকা আছে। নিজেকে দেখার জন্য উনি একটা নার্স রাখতে পারেন। আর তুমিও মুক্তি পেতে পারো।
গিল্ডা সরে গেলো, তা আমি পারবো না। ও আস্তে আস্তে স্পষ্ট গলায় বললো, যদি ও মরে যায় টেরি, তাহলে এই টাকাটা আমার হবে। তুমি আর আমি এটা নেবো।
আমি হঠাৎ ভাবতে বসলাম, অতত টাকা পেলে আমি কি করব, ভাবতে গিয়ে আমার, মেরুদণ্ডে পিচ্ছিল স্রোত বয়ে গেল।
ঐ টাকা পেলে আমি একবছরে দ্বিগুণ করে ফেলতে পারি। লস এঞ্জেলসে একটা দোকান খুলবো। সারা জেলায় তিন চারটে সার্ভিস ভ্যান রাখবো, হাই–ফাই সেট বানাবো। প্রচুর টাকা কামিয়ে ফেলবো।
গিল্ডা ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গেলো। আমি ওর পেছনে গেলাম।
আমরা কি করবো টেরি? আমার দিকে না তাকিয়ে ও বললো আমরা আর দেখা করবো না। এ ছাড়া আর উপায় কি? প্রবঞ্চককে আমি ঘৃণা করি। যখন থেকে আমরা প্রেম করছি তখন থেকে আমার নিজের ওপর ঘেন্না করছে। এটা বন্ধ করতে হবে। এটাই হলো একমাত্র রাস্তা। আর কোনো উপায় নেই। আমাদের দেখা হওয়া বন্ধ করতে হবে।
আমি বললাম, শোনো…তাড়াতাড়ি করার কিছু নেই। কাল রাত্রে আমরা এ বিষয়ে কথা বলবো।
কাল রাত্রি বলে কিছু নেই। কাল আমি আসবো না। এখনই এটা বন্ধ করতে হবে।
আমি ওকে ধরতে গেলাম, ও ছিটকে সরে গেল।
না, আমার পক্ষে ব্যাপারটা আরো শক্ত করে তুলল না, টেরি। তুমি জানো না, তোমার চেয়ে বেশি আমি এটা চাই, কিন্তু আমি জানি এটা বন্ধ করতেই হবে। আমি যাচ্ছি। আর আমাদের দেখা হবে না।
ওর কথা বলার স্বরে এমন একটা হতাশা আর দৃঢ়তা ছিল যে আমি সরে দাঁড়ালাম, বুকের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা হলো আমার।
গিল্ডা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম ও গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার মনে হলো ও ঠিক বলছে না, এটা কেবল বিবেকের তাড়না, কাল রাত্রে ও নিশ্চয়ই আসবে। কিন্তু ও এলোনা। শেষকালে যখন বারোটা বেজেছে আমাকে মেনে নিতে হলে যে গিল্ডা আসবে না।
পরদিন রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে করতে শেরিফ জেফারসনের সঙ্গে দেখা হলো, ওঁর সঙ্গে একজন অচেনা যুবক।
নজর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না, সুতরাং আমি জেফারসনকে হাত নেড়ে ডাকলাম। উনি বললেন, ম্যাট লাউসনের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই। মিঃ লাউসন, ইনি টেরি রেগান, যার কথা বলছিলাম।
আমি লাউসন-এর সঙ্গে করমর্দনকরলাম। লাউসন বললো, মিঃ রেগান, আমি সংক্ষেপেবলছি, আপনার তাড়া রয়েছে। আমি ন্যাশনাল ফাইডেলিটি থেকে আসছি। টি. ভি. ইনসিওরেন্স করিয়ে থাকি আমরা। আপনি তো এই অঞ্চলে টি.ভি সেটগুলো দেখেন। আপনি যদি আপনার খরিদ্দারের নামগুলো আমায় দেন, তাহলে আমার পরিশ্রম বেঁচে যায়। আমি অবশ্য এমনি এমনি চাইছি না, আমি একটা কমিশন দেবো আপনাকে।
এই ধরনের প্রস্তাবকে আমি দূরে ঠেলে দিতে পারলাম না। আমি জানতে চাইলাম কি ধরনের ইনসিওরেন্স করা হয়ে থাকে।
যেমন হয়ে থাকে, টিউবটার জন্য, মেরামতির জন্য আর পার্টস বদলের জন্য। এই অঞ্চলে যাদের টি. ভি. সেট আছে, কেবল তাদের নাম ঠিকানা কেবল আমি চাই।
পাবেন। গাড়িতে আমার ঠিকানা লেখাবইটা আছে। আমি আপনাকে ওটা দিয়ে দিচ্ছি। আপনি লিখে নিয়ে শেরিফকে দিয়ে দেবেন। পরে যেদিন শহরে আসব, আমি ওটা নিয়ে নেব।
ঠিকানার বইটা বার করতে করতে আমি বললাম, ন্যাশনাল ফাইডেলিটি টি. ভি.ইনসিওরকরে জানতাম না। আমি জানতাম ওরা কেবল জীবন বীমাই করে।
আমরা সবরকম ইনসিওরই করাই, অবশ্য সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো জীবনবীমা।
ঠিকানা লেখা বইটা ওকে দিয়ে আমি আমার বাড়িতে ফিরে এলাম। ডেলানির সুপার সেটটার জন্য অনেক জিনিস আমি জোগাড় করেছিলাম। বিকেলে কাজে লেগে গেলাম।
এই কাজটা আমি দুটো কারণে ধরেছি-এর আগে আমি কখনও কোনো সুপার সেট তৈরী করার সুযোগ পাইনি, এটা করতে আমার খুব গর্ব হচ্ছিল। কিন্তু আরো জরুরী কারণটা হচ্ছে যে, আমি বুঝে ছিলাম গিল্ডার কথাই ঠিক ও আর আসবে না। এই সুপার সেট নিয়েই আমি আবার ব্লু-জয় কেবিনে যেতে পারবো, কিছুটা সময় কাটাতে পারবো আর ওকে দেখতে পাবো।
আমি কাজ করে যেতে লাগলাম। টেলিফোনের আশায় উৎকর্ণ হয়ে রইলাম, টেলিফোন এলো না। গিল্ডার মত পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করলাম, যদিও জানি ওর মত বদলাবেনা। আমি যতই কাজ করে চললাম ততই বুঝতে পারছিলাম যে আমার আর গিল্ডার মাঝখানে বাধা হয়ে রয়েছেন ঐ প্রৌঢ় লোকটি, যিনি দিনের পর দিন একটা চাকাওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন। যার কোনো প্রয়োজন নেই।
ডেলানির সুপার সেটের ক্যাবিনেটের জন্য কাঠের ব্যবস্থা করতে আমি পরের দিন লস এঞ্জেলসে গেলাম। কাঠ বেছে নিয়ে সেটাকে কেটেকুটে দিতে বললাম, ওরা বললো ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হয়ে যাবে।
এক ঘণ্টা কাটাতে হবে, আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে দোকানগুলো দেখতে দেখতে ঘুরছিলাম। একটা জন্ত্রীর দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম, হঠাৎ নজরে পড়ল একটা নীল রঙের পাউডার কেস, নীল রঙটা গিল্ডার চোখের রঙের সঙ্গে মিলবে ভালো।
আমি সেটা কিনে ফেললাম। দোকানে বললাম কেসটার ডালার ভেতরে গিল্ডার নাম লিখে দিতে। কাজটা করতে বেশি দেরী হলো না। বাড়ি ফিরে ব্লু-জয় কেবিনে, হ্যালো, গিল্ডার গলা শুনতে পেয়ে আমার বুক ধকধক করে উঠলো। কাল রাত্রে আমার সঙ্গে লস এঞ্জেলসে ডিনার খাবে। আমি তোমাদের বাড়ির বইরে এগারোটার সময়ে থাকবে। স্পষ্ট করে বললাম আমি।
একটু চুপ করে থেকে ও বললো, আপনার রং নাম্বার হয়েছে বোধহয়, না, ঠিক আছে। অসুবিধার কিছু নেই। ও টেলিফোনটা ছেড়ে দিল।
বুঝতে পারলাম ডেলানি ঘরে আছেন। কাল রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।
পৌনে এগারোটার সময় আমি ব্লু-জয় কেবিনের সামনে এলাম, এগারোটা বাজার দুমিনিট আগে গিল্ডা বাইরে বেরিয়ে এলো। ওকে দেখেই আমার রক্ত দুর্বার হয়ে উঠলো।
কাছে এসে ও থামলো। আমি গেটটা খুলে দিলাম।
টেরি—
আমি কিছু না বলে ওকে কাছে টেনে নিতে চাইলাম। কিন্তু ও সরে গেলো।
না, টেরি না। আমি আগেই বলেছি, আমরা আর প্রেম করবো না। আমরা এখন থেকে শুধুই বন্ধু। বন্ধু না হতে পারলে আমাদের আর দেখা করা উচিত নয়।
আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। ঠিক আছে, আমি মেনে নিচ্ছি।
টেরি, তোমার পক্ষে এটা কি খুব শক্ত?
ও নিয়ে ভেবো না। আমি তো মেনে নিয়েছি। চলল, দেরী হয়ে যাচ্ছে।
আমরা গাড়িতে উঠলাম। এঞ্জিন চালু করে বললাম, একটা রেস্তোরাঁ আছে। সেটা একটু দূরে, কেউ আমাদের চিনবে না।
সেই-ই ভালো।
লস এঞ্জেলস ওখান থেকে আশি মাইল। রাতাটা ভালো হলেও প্রায় দুঘন্টা লেগে গেলো পৌঁছতে। পথে আমরা বিশেষ কিছু কথা বলিনি। গিল্ডা প্রথমে এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে চাইলেও কোনো লাভ নেই জেনে বাকি রাস্তাটা আমরা চুপ করেই ছিলাম।
হার্মোসা বীচে একটা ইটালিয়ান রেস্তোরাঁ, এখানকার খাবার ভালো। রেস্তোরাঁর টেবিলে ঢাকা দেওয়া আলো, খুব মৃদু বাজনা বাজছে। সাদা পোশাক পরা ওয়েটারগুলো ঠিক মেসিনের মতো যোরাফেরা করছে।
আমরা স্ক্যাম্পি, কেলোনীজ আর একবোতল মদ নিলাম। আমি ওর চোখের দিকে উৎসাহের সঙ্গে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু নিরাশ হতে হলো।
গিল্ডা হঠাৎ বললো, চার বছর বাদে আমি এই প্রথম কারো সঙ্গে বের হলাম।
তোমার যদি ভালো লাগে, তবে আমরা আরো আসতে পারি। আমি বললাম।
আমার গলায় একটা তীক্ষ্ণতা ছিল, গিল্ডা সেটা ধরতে পারলো বোধহয়। চট করে মুখ তুলে তাকালে আমার দিকে।
টেরি…তোমার নিজের কথা কিছু বলল, তোমার এই যে দোকানটা..তোমার কতটা আশা আছে এর ওপর?
আমার কথাগুলো ভালো না লাগলেও বললাম–যদি আমার পয়সা থাকতো, আমি নিজে একটা দোকান দিতাম। আমি জায়গা চিনি, আমি এমন একটা দোকানঘর চাই যেখানে ভালোভাবে আমার তৈরী হাই–ফাই সেটগুলো সাজিয়ে রাখতে পারবো, ডিমাকবাজিয়ে শোনবার জন্য একটা ভালো ঘর থাকবে। কিন্তু এটা পাওয়া সহজ নয়। এত টাকা আমার কখনই হবে না।
কত চাই তোমার?
পঁচিশ হাজারেই হতে পারে। ওর দ্বিগুণ পেলে বিরাট করে কিছু করা যায়।
টেরি, ও যদি মারা যায়, তাহলে তোমার যা দরকার তুমি পাবে।
একথা তুমি আগেও বলেছ। যদি মারা যায়…
দেখলাম ও ঘড়ি দেখছে।
আমি ওয়েটারকে বিল দিতে বললাম।
গাড়িতে উঠতে উঠতে গিল্ডাবলল, আজকের প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার ভালো লেগেছে, টেরি।
ধন্যবাদ।
আমি কিন্তু ওর মতো আমারও ভালো লেগেছে এই মিথ্যা কথাটা বলতে পারলাম না।
গাড়ি লস্ এঞ্জেলস ছাড়িয়ে পাহাড়ের পথে ঢুকলো।
আমরা চুপ করেই ছিলাম। ব্লু-জয় কেবিনের মাইল দুয়েক দূরে আমি গাড়িটা থামালাম।
গিল্ডা আমার দিকে তাকিয়ে বললো থামালে কেন?
আমি কিছু না বলে পাউডার কেসটা বার করে ওর কোলের ওপর ফেলে দিলাম। আমি ড্যাশবোর্ডের আলোটা জ্বেলে দিলাম। ও বাক্সটা নেড়ে চেড়ে দেখলো। দারুণ দেখাচ্ছিল। আমি টের পেলাম ও জোরে নিঃশাস নিল।
এটা আমার জন্য?
হ্যাঁ, তোমার চোখের সঙ্গে এর রং মিলেছে।
টেরি আমি এটা নিতে পারি না। তোমার এরকম উপহার দেওয়া উচিৎ নয়।
আমি তোমাকে লোভ দেখাচ্ছি না, আমার এটা দেখে মনে হলো যেন এটা তোমার জন্যই তৈরী। আমি চাই শুধু তুমি এটা নাও।
আমি গাড়ি চালু করে দিলাম। গিল্ডা আমার পাশে চুপ করে বসে রইলো।
গেটের কাছে পৌঁছতে গাড়ি থামালাম, দুজনে দুজনের দিকে তাকালাম।
টেরি তুমি জানো না আজকের দিনটা আমার কত ভালো লেগেছে। এই পাউডার কেসটার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। এটা আমার প্রথম পাওয়া উপহার।
গিল্ডা আমার দিকে সরে এসে দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরলো আমার ঠোঁট।
আমার কোন তৃপ্তি হচ্ছিল না। ওকে জড়িয়ে থাকতে থাকতে আমি ভাবছিলাম সেই লোকটির কথা যিনি এখনও বিছানায় শুয়ে আছে, হয়তো ঘুমোচ্ছন, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে একশো গজ দূরে। উনি যতক্ষণ বেঁচে আছেন ততক্ষণ আমাদের লুকিয়ে চুরিয়ে ভালোবাসা, ছাড়া আর কিছু করার নেই।
গিল্ডা পরের দিন ভোরেই আমাকে ফোন করলো।
কাল আমি যখন বাড়ি ফিরলাম তখন ও জেগে ছিল। ওর ঘরে আলো জ্বলছিল।
উনি কি জেনেছেন যে তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলে?
জানিনা। আজকে উনি একেবারেই চুপচাপ রয়েছেন। দু-একটা কথা ছাড়া কোন কথাই আমার সঙ্গে বলেন নি। টেরি, এভাবে আর সম্ভব নয়। তোমাকে দুরেই থাকতে হবে। আমি দুঃখিত। কিন্তু আর দেখা করব না। আমাকে মাপ করো…দোহাই আর টেলিফোন করো না।
লাইনটা কেটে গেল। কোন লোক যখন প্রেমে পড়ে, যেমন আমি গিল্ডার প্রেমে পড়েছিলাম, আমার মনে হয়, তার একটু মাথার গোলমাল হয়ে যায়। চারটে দিন আর চারটে বিশ্রী রাত কাটাবার পর আমার মনের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছিলাম না, কিছুই বিক্রী করতে পারলাম না। তিনবার ব্লু-জয় কেবিনে ফোন করেছিলাম কিন্তু বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিতে হয়েছে।
রাত্রে চোরের মত আমি ওদের বাগানে ঘুরে বেড়াতাম। জানলার পর্দায় শুধু ওর ছায়া দেখতে আমার এতো কষ্ট হতো যে বলার নয়। আমি বিচলিত হয়ে পড়তাম।
পঞ্চম রাত্রে আমিইস্কি খেলাম। বুঝতে পারছিলাম যে গিল্ডার জন্য এই নিদারুণ যন্ত্রণা, একে কমাতেই হবে। সেই সমস্যার সমাধান করলো হুইস্কি। চারদিন বাদে আমি প্রথম ঘুমোলাম। কিন্তু স্বপ্নে ওকেই দেখলাম। আটদিন বাদে এমন একটা ঘটনা ঘটলো যাতে এই দুঃস্বপ্নের চরম হয়ে এল।
তখন রাত নটা। আকাশে চাঁদ নেই, বৃষ্টি হতে পারে। আমি বারান্দায় বসেছিলাম। টেলিফোনটা বেজে উঠলো।
ঘরে ঢুকে আমি রিসিভার তুললাম। মিঃ রেগান নাকি? ডেলানির গলা চিনতে পারলাম, আমার বুকে ঘা পড়ছিল।
হা।
সেটটা চলছেনা। টিউবটা বোধহয় গেছে। এই কদিনে আমি প্রথম একটা ভালো খবর শুনলাম। ওকে দেখতে যাওয়ার একটা কারণ পাওয়া গেল।
আমি এখনই আসছি।
দশ মিনিটের মধ্যে আমি ব্লু-জয় কেবিনে পৌঁছে গেলাম।
আলো জ্বলছিল, যন্ত্রপাতি নিয়ে আমি বারান্দায় উঠলাম। ভেবেছিলাম গিল্ডাকে দেখতে পাবো কিন্তু ভাবতে পারিনি ও ইচ্ছে করে আমাকে এড়িয়ে যাবে। তীব্র হতাশায় আমি ভেঙে পড়লাম।
ডেলানি টি. ভি. সেটটা দেখিয়ে বললেন, টিউবটা বোধহয় পুড়ে গেছে।
আমি ভালবগুলো দেখছি, ডেলানি হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনাকে একটা কথা বলে রাখি। যদি আমার স্ত্রী কখনো আপনাকে গাড়িতে যাবার প্রস্তাব করে মোটেই রাজি হবেন না। ওর গাড়ি চালানো বিপজ্জনক। আমি একবার ওকে চালাতে দিয়ে বোকামি করেছিলাম। তাই সারাজীবন এই চেয়ারে বসে কাটাতে হচ্ছে।
আমি কিছু না বলে গাড়ি থেকে একটা ভাল এনে লাগিয়ে টি. ভি. চালু করলাম। পর্দায় ছবি ফুটে উঠলো। আমি অ্যাডজাস্ট করে দিলাম।
ডেলানি জানতে চাইলো, কত লাগবে?
তিন ডলার।
গলা তুলে ডেলানি ডাকলেন, গিল্ডা এদিকে এসো।
দরজা খুলে গিল্ডা ভেতরে এলো। অদ্ভুত বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। ওকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। আমার দিকে তাকিয়ে ও ভদ্রতাসূচক মাথা ঝাঁকালো।
ডেলানি বললেন, তিনটি ডলার দাও।
গিল্ডা এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে ব্যাগটা আনতে গেল।
আমি টি. ভি. সেটটা জায়গায় বসিয়ে স্ক্রুটা আটকে দিচ্ছিলাম।
গিল্ডা ডেলানির কাছে গিয়ে ব্যাগটা খুললো, তিনটে এক ডলারের নোট বার করলো সে, আর তাই করতে গিয়ে ব্যাগটা হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল। ব্যাগের জিনিসগুলো ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে।
সেই পাউডার কেসটা চোখে পড়লো ডেলানির। একমুহূর্ত গিল্ডা দাঁড়িয়েছিল, তারপর এগিয়ে গিয়ে কেসটা দ্রুত তুলে নিলো। ডেলানি ওর কব্জিটা মুচড়ে কেসটা ছিনিয়ে নিলেন।
কয়েক মুহূর্তেই ব্যাপারটা ঘটে গেল। ডেলানির মুখটা বীভত্স হয়ে গেছে, বাঁ হাত দিয়ে উনি প্রচণ্ড জোরে গিল্ডার নাকে ঘুষি মারলেন। বেশ জোরে শব্দ হলো।
আমার ভীষণ ভাবে ইচ্ছে হচ্ছিল যে লোকটাকে গলা টিপে শেষ করে দিই, কিন্তু যেমন ছিলাম তেমনি দাঁড়িয়ে রইলাম।
গিল্ডা মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। ডেলানি পাউডার কেসটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গিল্ডা উঠে দাঁড়ালো নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, মুখটা সাদা হয়ে গেছে। ডেলানি কেসটা খুলে ডালার ভেতরে গিল্ডার নামটা দেখতে পেলেন। তাঁর মুখটা রাগে থথ করছে।
তোমার তাহলে প্রেমিক জুটেছে, গলা শুনে আমার শরীরটা কেমন করে উঠলো।
গিল্ডা কথার কোনো উত্তর দিলনা। দুহাতে বুক চেপে রেখেছে, নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
কেবল আমাকে জখম করেই তোমার আশ মেটেনি, এবারে বেশ্যা সাজতে ইচ্ছা হয়েছে। পাউডার কেসটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন উনি।
আয়নাটা চুরমার হয়ে গেল।
গিল্ডা ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ডেলানির হঠাৎ খেয়াল হলো যে আমি ঘরে আছি।
আপনি যান, উনি চীৎকার করে উঠলেন, একথা যদি শহরে ছড়ায় তবে আমি দেখে নেবো, বেরিয়ে যান।
আমি যন্ত্রের বাক্সটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গেট পর্যন্ত চালিয়ে গাড়ি থামালাম। তারপর গেটটা খুলতে যাবো এমন সময় অন্ধকারের মধ্য থেকে গিল্ডা ছুটে গাড়ির হেডলাইটের সামনে এসে দাঁড়ালো।
গিল্ডার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, নাক ফেটে গেছে, চিবুকে শুকিয়ে আছে রক্ত, চোখদুটো জ্বলছে।
আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। আমি ওকে বললাম, এর পরে তুমি আর ওর সঙ্গে থাকতে পারো না গিল্ডা, চলে এসো আমার সঙ্গে আমি তোমায় সুখী করবো। তোমাকে ডিভোর্স নিতেই হবে।
না, এখান থেকে তুমি যাও, তোমার সঙ্গে প্রেমে পড়ার মতো বোকামি করেছিলাম বলেই আজ আমার জীবন বিপন্ন।
ওভাবে কথা বলো না, ওর সঙ্গে আর তুমি থাকতে পারো না, আমার সঙ্গেই তোমায় থাকতে
আমি ওকে ধরে টেনে নিতে চাইলাম, কিন্তু ও ছিটকে বেরিয়ে গেল।
আমার কাছ থেকে সরে যাও। তুমি কি চাও আমি এর জন্য তোমার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে ভিক্ষে চাই? তুমি যদি আর না আসো, আমি জ্যাককে বোঝাতে পারবো যে, ওটা আমিই কিনেছিলাম। কতবার তোমাকে বলবো যে আমি ওকে ছেড়ে যেতে পারবো না।
যতক্ষণ না ও মরছে, আমি ধীর গলায় বললাম, তাই বলেছিলে না?
ও মরবে না। অনেকদিন বাঁচবে। আমার কাছ থেকে চলে যাও, নাহলে, এখন তোমায় যতটা ভালোবাসি, ততটাই ঘেন্না করতে হবে তোমাকে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে ও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
আমি ওর পেছনে যাবার চেষ্টা করলাম না।
সেই মুহূর্তে আমি ঠিক করে ফেললাম যে আমি ডেলানিকে খুন করে ফেলবো। এছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
আমি খুব অবাক হলাম যে, এই সমাধানটা আমি আগে কেন ভাবিনি।