[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

৫২. দারিদ্র্যের ছায়া

বিলেত দেশটা যেমন মাটির, সেইরকম ঐশ্বর্যের দেশ আমেরিকা-কানাডাতেও দারিদ্র্যের ছায়া উঁকি মারে মাঝে-মাঝে। অস্ত্রশস্ত্র ও পেট্রোল ছাড়া অন্যান্য অনেক ব্যাবসাতেই মন্দা চলছে। যখন তখন লোক ছাঁটাই হয়। বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে দিন-দিন, আমার উচিত নয় এদেশে সেই বেকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা।

আমার টিকিটটা যদিও বাতিল হয়ে গেছে, আবার নতুন টিকিট কেনার প্রশ্নই ওঠে না, তবু আমার ফিরে যাওয়ার একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে।

দেশে যিনি আমায় টিকিটটা দিয়েছিলেন, তিনি অবশ্য বলেই দিয়েছিলেন যে ওটা নির্দিষ্ট চার মাসের টিকিট, খুব সস্তা বলেই এ রকম সময় বাঁধা। তবে, কোনও কারণে সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিয়ে ম্যানেজ করা যেতে পারে।

সে কথা দীপকদাকে জানাতেই দীপকদা গম্ভীরভাবে বললেন, সেটা সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে জানাতে হয় কোম্পানিকে। একবার সময় পার হয়ে গেলে আর কিছু করবার উপায় নেই। এখন চুপচাপ বসে থাকো!

আমি বললুম, তা হলে কি একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকব?না একটু-একটু চিন্তা করব?

দীপকদা বললেন, যত ইচ্ছে চিন্তা করতে পারো, কোনও লাভ হবে না।

পুরো দাম দিয়ে কেনা আন্তর্জাতিক বিমান টিকিটের অনেক সুবিধে। সিট কনফার্মড করেও নির্দিষ্ট দিনে ফ্লাইট ধরতে না গেলেও টিকিট নষ্ট হয় না। এক বছর ধরে টিকিটটা ঘুম পাড়িয়ে কাছে রেখে দেওয়া যায়। ইচ্ছে করলেই এয়ার লাইনস বদল করা যায়। যাওয়ার সময় ইওরোপ হয়ে গিয়ে ফেরার সময় জাপান ঘুরে আসতে পারে যাত্রীরা। আমারটা খুব সস্তা বলেই তার তিন অবস্থা। যাওয়া-আসা একই পথে, এয়ার লাইনস বদলাবার উপায় নেই আর সময়সীমা চার মাস।

আমার সনির্বন্ধ অনুরোধে দীপকদা তাঁর ট্র্যাভেল এজেন্টকে ফোন করলেন। ইনি একজন ভারতীয় ব্যবসায়ী। ইনি বললেন, আমার টিকিটটা একেবারেই অচল, তবে তিনি সস্তায় আমায় আর একটা টিকিট দিতে পারেন, তার দামটা ভারতে ফিরে গিয়ে দিলেও চলবে, যদি দীপকদা আমার জামিন থাকেন।

এ বার্তা শুনে আমি বললুম, হোপলেস! ফিরে গিয়ে অত টাকা দিতে হলে আমার ব্যাঙ্ক ডাকাতি করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। নভিস ডাকাত হিসেবে আমি নির্ঘাত ধরা পড়ে যাব। তাহলে

তো দেখছি আপনার বাড়িতেই আমায় কাজের লোক হয়ে থেকে যেতে হচ্ছে।

এবারে ফোন করা হল এক সাহেব এজেন্টকে। সাহেব খানিকটা ভরসা দিয়ে বললেন, যদি কোনও ডাক্তারের সার্টিফিকেট দিতে পারো, তা হলে চেষ্টা করা যেতে পারে।

আমি উল্লসিত হয়ে বললুম, ব্যাস, তাহলে তো হয়েই গেল। ডাক্তারের সার্টিফিকেট জোগাড় করা এমন কী আর শক্ত।

দীপকদা ধমক দিয়ে বললেন, কে তোমায় সার্টিফিকেট দেবে শুনি? তোমার কি সত্যি অসুখ হয়েছে? তোমার কী অসুখ হয়েছে শুনি?

আমি সগর্বে বললুম, অসুখ? আমার অসুখ হবে কেন? আমার একেবারে লোহার মতন স্বাস্থ্য।

–তবে? এ কি ইন্ডিয়া পেয়েছ যে অফিসের ছুটি নিতে হলেই পাড়ার ডাক্তারকে দু-পাঁচ টাকা দিলেই সার্টিফিকেট পাবে? এ দেশে কেউ ফলস সার্টিফিকেট দেয় না। ধরা পড়লে সে ডাক্তারের লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হয় সঙ্গে-সঙ্গে।

আমি বললুম, কিন্তু অনেক বাঙালি ডাক্তারও তো আছেন এ দেশে।

দীপকদা বললেন, তাঁদের তো আরও বেশি অসুবিধে! বিদেশে কাজ করছেন, ধরা পড়ার ভয় তাঁদের আরও বেশি থাকবে। এটাই তো স্বাভাবিক। কোনও বাঙালি ডাক্তারকে এরকম অনুরোধ করে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলাই অনুচিত।

–তা হলে কী হবে?

–যেরকম অবস্থায় ছিলে, সে রকমই থাকবে!

রয়ে গেলাম নিশ্চেষ্টভাবে দু-তিনদিন। তারপর একদিনেই পরপর দুটি কাঁচের গেলাস পড়ে গেল আমার হাত থেকে। দীপকদা ও জয়তীদি দুজনেই ভুরু তুলে তাকালেন আমার দিকে। এ রকম কাজের লোককে কতদিন রাখা নিরাপদ সে সম্পর্কে ওঁদের মনে সংশয় দেখা দিয়েছে।

বাধ্য হয়েই দীপকদা ফোন করলেন আরও কয়েক জায়গায়। শেষ পর্যন্ত দু-হাজার মাইল দূরের এক সহৃদয় ডাক্তার, তাঁর নাম জানাতে চাই না, একখানা সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দিতে রাজি হলেন। সেটা হাতে পাওয়ার পর দেখা গেল, আমার পায়ের শিরায় থ্রম্বোসিস হয়েছে বলে সেই ডাক্তার মহোদয় সন্দেহ করছেন। এই অবস্থায় আমায় একদম চলাফেরা করা বাঞ্ছনীয় নয়।

এ নাকি এমন এক অসুখ, যা বাইরে থেকে দেখে বোঝবার উপায় নেই। পরীক্ষা করলেও সহজে ধরা পড়ে না।

দীপকদা বললেন, যাও, চুপচাপ শুয়ে থাকো। মেডিক্যাল বোর্ড যদি তোমায় পরীক্ষা করতে চায়, তা হলে পুরো থ্রম্বোসিস রোগীর মতন হাবভাব করতে হবে কিন্তু!

আমি মনে-মনে চিন্তা করতে লাগলুম, কোনও নাটকে বা সিনেমায় আমি কোনও থ্রম্বোসিস রোগীর অভিনয় দেখেছি কি না! খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে? কিংবা ওয়েস্টার্ন ছবিতে পায়ে গুলি খাওয়া নায়ক যেরকম বুকে হেঁটে-হেঁটে এগোয় সেরকম…

সাহেব এজেন্ট সেই ডাক্তারের সার্টিফিকেট দেখে খুশি হয়ে বললেন, বাঃ, বেশ, এই তো চাই! এতেই কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু–

আমি ভয়ার্ত গলায় জিগ্যেস করলুম, আবার কিন্তু?

সাহেব বললেন, এরকম অসুস্থ লোককে তো প্লেনে তোলা যায় না। এবারে ফিট সার্টিফিকেট নিয়ে আসুন!

এটা কোনও সমস্যাই নয়। আমি যে ফিট আছি তাতে তো কোনও সন্দেহই নেই! শুধু হাঁটা কেন, আমি লাফিয়ে, দৌড়ে, এমনকী নেচেও আমার ফিটনেস দেখাতে পারি যে-কোনও ডাক্তারের সামনে।

দীপকদার এক বন্ধু ডাক্তার অবশ্য সে সব পরীক্ষা নিলেন না। বরং একদিন নেমন্তন্ন করে খাইয়ে তারপর সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন।

সব দেখে এজেন্ট সাহেব বললেন, হ্যাঁ, মনে হচ্ছে আর কোনও গণ্ডগোল নেই। এবারে আমি ভ্যাঙ্কুবারে বিমান কোম্পানির কাছে সব কিছু পাঠিয়ে দিচ্ছি।

তারপর আবার প্রতীক্ষা। এবং প্রতীক্ষার অবসানে সুসংবাদ। দুদিন বাদেই জানা গেল যে আমার টিকিট মঞ্জুর হয়ে গেছে। এখন যে-কোনওদিন আমি যাত্রা করতে পারি।

এবারে সত্যিই আমার আনন্দে নৃত্য করা উচিত। এতদিনের আশানিরাশার দ্বন্দ্ব মিটে গেল। কিন্তু এবারেও হরিষের পরেই বিষাদ। বিমান কোম্পানি আর একটি দুঃসংবাদও পাঠিয়েছে।

আমার আর মাঝপথে কোথাও থামা চলবে না। কানাডা থেকেই সোজা ভারতে ফিরতে হবে।

আমি আর্তনাদ করে বললুম, সে কী! আমার যে রোমে নেমন্তন্ন আছে। সেখানে গেলে আমার একটাও পয়সা লাগবে না। আমার বন্ধু ভাস্কর বারবার টেলিফোন করে বলেছে ফেরার পথে একবার লন্ডনে নামতে। আমি লন্ডনে যেতে না পারলেও ও সপরিবারে রোমে এসে আমার সঙ্গে যোগ দিয়ে সারা ইওরোপ ঘুরবে। তা ছাড়া অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আমায় বিশেষ স্নেহ করেন, তিনি বলে রেখেছেন পশ্চিম জার্মানির উলমে ওঁর বাড়িতে একবার অবশ্যই যেতে। সেসব হবে না!

আমি বললুম, আমার টিকিটে তো রোমের স্টপ ওভার আছেই। সেখানে তো আমাকে নামতে দিতে বাধ্য।

এজেন্ট মশাই মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু! ও কথা আর এখন খাটবে না। কোম্পানি জানিয়েছে যে, উনি একবার যখন ও রকম গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন আর ঝুঁকি নেওয়া একেবারেই উচিত হবে না। কোথাও থামলে যদি আবার সেই অসুখ হয়, তা হলে কে দায়ী হবে? সুতরাং ওঁকে এখন আমরা সরাসরি দেশে ফিরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাই।

–কিন্তু আমার তো ওরকম অসুখ, মানে, ইয়ে, আমি বলছিলুম যে…

–ব্যস, ব্যস, আর ও কথা উচ্চারণও করবেন না। দুদিন পরের ফ্লাইটেই একটা সিট খালি পাওয়া যাচ্ছে, তাতেই চড়ে বসুন।

বাংলার পাঁচের মতন মুখ করে ফিরে এলুম বাড়ি। জয়তীদি বললেন, কী, সব ঠিকঠাক হয়ে গেল, এখনও মন ভালো হচ্ছে না?

আমি বললুম, কোথায় সব ঠিক হল। শীতকালের ইওরোপ খানিকটা দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। ভাস্কর কিংবা অলোকরঞ্জন তো আমার টিকিটের বিচিত্র ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন না। ওঁরা ভাববেন, আমি শীতের ভয়ে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে গেলুম!

রাত্তিরবেলা খাওয়ার টেবিলে আমরা অনেকক্ষণ চুপচাপ। এক সময় জয়তীদি মুখ তুলে বললেন, সত্যি তুমি পরশু চলে যাচ্ছ? তোমার মন খারাপ হয়ে গেছে বুঝতে পারছি। টিকিট যখন ঠিক হয়ে গেছে, তখন অত তাড়াহুড়ো করার কী আছে? বরং আর ক’টা দিন থেকে যাও।

আমি বললুম, রোমেই নামা হবে না, তা হলে আর শুধু-শুধু এই পচা এডমন্টনে আর বেশিদিন থেকে কী হবে?

জয়তীদি বললেন, এডমন্টন পচা? তুমি ভারী অকৃতজ্ঞ তো?

–এখন এই বরফ-ঢাকা এডমন্টনে আর কী করবার আছে আমার?

দীপকদা বললেন, তোমার যাওয়ার কোনও ঠিক-ঠিকানাই ছিল না, কোনওমতে টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলুম, তার জন্য একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলে না!

আমি মুখ গোঁজ করে বললুম, কত স্বপ্ন দেখেছি ইটালি যাওয়ার। রোম, ভেনিস।

দীপকদা আর জয়তীদি হাসি মুখে পরস্পরের দিকে তাকালেন। তারপর জয়তীদি বললেন,

আচ্ছা, এক কাজ করো। তোমাকে তো অ্যামস্টারডমে নেমে প্লেন বদল করতেই হবে। সেখানে নেমে তুমি তোমার এই প্লেনের টিকিটটা ছুঁড়ে ফেলে দাও।

-তারপর?

–তারপর সেখান থেকে কলকাতার আর একটা নতুন টিকিট কেটে নাও!

–টিকিট কেটে যাব মানে?টাকা?

–সে টাকাটা আমরা তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি!

দীপকদা মুখ নীচু করে বললেন, হ্যাঁ, সে টাকাটা আমরা তোমাকে কোনওক্রমে জোগাড় করে দিতে পারব মনে হয়। তুমি ছেলেমানুষ, মন খারাপ করে আছ যখন।

আমি স্তম্ভিত হয়ে একটুক্ষণ বসে রইলুম। এ আমি কী শুনছি? মানুষের কাছ থেকে এতখানি ভালো ব্যবহার পাবার উপযুক্ত কী করেছি আমি? কিছুই তো না! জয়তীদি বললেন, ব্যাস, আর গোমড়া মুখে থেকো না। আমার মেয়েরা তোমার দিকে তাকাতেই ভয় পাচ্ছে। সব ঠিক হয়ে গেল তো!

দীপকদা বললেন, অ্যামস্টারডাম থেকে তোমার ফেরার টিকিট আমি এখান থেকেই কেটে দিতে পারি। কোথায়-কোথায় স্টপওভার চাও বলো।

আমি এক গাল হেসে বললুম, কোথাও চাইনি। এই যে আপনারা আমাকে অফারটা দিলেন, এতেই তো আমার স্বর্গ দেখা হয়ে গেল!

–না, না, আমরা সিরিয়াসলি বলছি!

–জয়তীদি, লন্ডন, উলম কিংবা রোম, এইসব জায়গাগুলোতে পালিয়ে যাচ্ছে না। পরে আবার কোনওবার এসে দেখলেই হবে। একেবারেই সব দেখে নিতে হবে, তার তো কোনও মানে নেই। আমি অত পেটুক নই।

এর পরের তৃতীয় দিন ভোরবেলা পড়ে গেল সাজো-সাজো রব। দীপকদারা সবাই আমাকে পৌঁছে দিতে যাবেন এয়ারপোর্টে। জিয়া আর প্রিয়াও জামাকাপড় পরে তৈরি। অত ভোরেই জয়তীদি ব্রেকফাস্ট বানাতে বসে গেলেন। আমি যত বলি যে এত সকালে আমি কিছু খেতে পারি না, তা ছাড়া প্লেনে তো খাবার দেবেই, তবু তিনি শুনলেন না।

যেন বরফের সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। ভালো করে আলো ফোটেনি। তার ওপর আবার তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে। সামনের বা দুপাশের কিছুই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। দীপকদা হেডলাইট জ্বেলে গাড়ি চালাচ্ছেন, এর মধ্যে একবার গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে আর কোনও উপায় নেই। সবচেয়ে মজা লাগে কারখানার চিমনির ধোঁয়াগুলো দেখতে। এ ধোঁয়া উড়ে পালাতে পারে না, চিমনির একটু ওপরেই মেঘ হয়ে জমে থাকে।

দীপকদাদের বাড়ি সেন্ট এলবার্টে। সেটা ছাড়িয়ে এডমান্টন শহরে ঢোকার আগে সাসকাচুয়ান নদী পার হতে হয়। সেই নদী এখন বরফের সড়ক। ব্রিজের দুপাশেও থোকা-থোকা বরফ ঝুলছে। এরকম সাদা রঙের পৃথিবী আগে কখন দেখিনি, ভবিষ্যতে আর কখনও দেখব কি কে জানে!

এয়ারপোর্টের ভেতরের চেহারাটা একেবারে অন্যরকম। এত সকালেও সেখানে প্রচুর লোক, ভেতরটা আলোয় ঝলমল করছে। কফি আর হট ডগ ভাজার গন্ধ ম ম করছে বাতাসে।

বিদায় বাক্যটি যত সংক্ষিপ্ত হয় ততই শুনতে ভালো লাগে। প্রথমে মালপত্র চেক ইন করে কিছুক্ষণ আমরা গল্প করতে লাগলুম একটা বেঞ্চে বসে। তারপর যখন সিকিউরিটির ডাক হতে লাগল বারবার, শেষ মুহূর্তে আমি কিছু না বলে দৌড়ে গেলুম সেদিকে।

সুড়ঙ্গ পথটিতে ঢোকার আগে আমি পেছন ফিরে হাত নেড়ে বললুম, আবার দেখা হবে!

এডমান্টন থেকে টরেন্টো চার ঘণ্টার পথ। স্রেফ ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলুম। টরেন্টো থেকে বড় বিমান এক লাফে পার হয়ে যাবে অ্যাটলান্টিক। তার আগে বিমান বন্দরে ছ’ঘণ্টার অপেক্ষা।

আগেই ব্যবস্থা করা ছিল, এডমন্টনের দিলীপবাবুর এক আত্মীয় এসে আমায় নিয়ে গেলেন এয়ারপোর্ট থেকে। সেখানে তাঁর স্ত্রী চটপট ভাত আর মাছের ঝোল বেঁধে খাইয়ে দিলেন। আরও কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে আলাপ হল সেখানে। কোনওরকম উদ্বেগ নেই, বেশ নিশ্চিন্তে ঢিলেঢালা ভাবে সময়টা কাটিয়ে দিয়ে আবার ফিরে এলুম টরোন্টো এয়ারপোর্টে।

এরপর সোজা অ্যামস্টারডাম। বারো না চোদ্দো ঘণ্টার ব্যাপার। আমার একটুও মন খারাপ লাগছে না, বরং একটা অস্থিরতা বোধ করছি। কখন পৌঁছব, কখন পৌঁছব। সুদীর্ঘ জেট যাত্রায় দিনরাত্রির হিসেব গুলিয়ে যায়, কখন ঘুম, কখন জাগরণ তার ঠিক থাকে না। আসবার পথে প্লেনের নানারকম যাত্রীদের লক্ষ করে কত আনন্দ পেয়েছি, ফেরার পথে কারুর সম্পর্কেই কোনও আগ্রহ নেই। বিরক্তি ভোলবার জন্য এরা বারবার খাবার দেয়, আবার সেই খাবার দেখলেই বিরক্ত লাগে।

সব মিলিয়ে প্রায় তেত্রিশ ঘন্টা বাদে দিল্লি পৌঁছলুম আর একটি ভোরবেলা। ল্যান্ডিং-এর আগে প্লেনের জানলা দিয়ে ভারতবর্ষের মাটি দেখতে পেয়েই বুকের মধ্যে বেশ আরাম হল। ওই মাটির ওপরে আমি শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারি।

যে-কোনও দেশেই বিমান থেকে প্রথমে নামার সময় খানিকটা অস্বস্তি লাগে, নিজেকে আগন্তুক মনে হয়। কিন্তু দেশে ফিরলেই মনে হয়, ওই তো একটু দূরেই আমার বাড়ি। যদিও দিল্লির জানুয়ারির শীত বেশ বিখ্যাত। কিন্তু আমার গরম লাগল, ওভারকোট খুলে হাতে নিতে হল।

প্রচুর মানুষের ভিড়, ঠ্যালাঠেলি, কুলিদের ফিশফাশ, বকশিশ-লোভী চোখ, তবু বেশ সাবলীল বোধ করতে লাগলুম। কাঁধ দুটো আর টানটান রাখার দরকার নেই। এখানে যে-কোনও লোকের সঙ্গে দরকার হলে ধমকে কথা বলতে পারি।

এত ভোরেও আমার জন্য মিহির রায়চৌধুরি এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমার টেলিগ্রামটি ঠিক সময়ে পৌঁছেছে দেখে আমি ভারতীয় ডাক বিভাগের কৃতিত্বে চমৎকৃত হলুম। এই ক’মাসেই দেশটা বেশ বদলে গেছে দেখছি। কাস্টমসে কোনও গণ্ডগোল হল না, বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সিওয়ালা বেশি ভাড়া চাইল না, এ যে দেখি বিস্ময়ের পর বিস্ময়।

মিহিরের সঙ্গে এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে মাটির খুড়িতে গরম-গরম চা খেলুম দু’কাপ। তারপর ভাবলুম, এত তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরে কী হবে? এইরকম সুন্দর শীতকালে একবার সাঁওতাল পরগনা ঘুরে গেলে মন্দ হয় না!

–: সমাপ্ত :–