৯. ময়ূখ-সন্দৰ্ভ

৯. ময়ূখ-সন্দৰ্ভ

নিতান্ত ব্যাকুল হয়ে বসে আছি আমি। আমি একুশ শতকের ময়ূখ—আড়াই হাজার বছর আমার লেখার টেবিলে খেলা করছে। ঠিক যে-মুহূর্তে সিদ্ধার্থ ‘মধ্যপন্থা’ আবিষ্কার করলেন, সেই মুহূর্তেই তাঁর পাঁচজন সঙ্গী তাঁকে ছেড়ে গেলেন। ভুল বুঝলেন। এই হয়। সিদ্ধার্থের আগে এই মধ্যপন্থা’ কেউ তো আবিষ্কার করেননি। অন্তত, সেরকম কোনো প্রমাণ নেই। একটি নতুন আবিষ্কার সমকালে গৃহীত হয় না, কেউই আবিষ্কর্তাকে বুঝতে পারে না, সকলেই তাঁকে ভুল বোঝে, ছেড়ে যায়।

কিন্তু আমি—আমি কেন এ বহু-আলোচিত কাহিনি লিখে চলেছি? না লিখে আমার আর অন্য উপায় নেই, তাই। আমি ময়ূখ, চল্লিশোত্তীর্ণ মধ্যবয়স্ক পুরুষ, বিশ শতকের সাতের দশকের শুরুতে আমি জন্মেছি, আমার জীবন কেমন করে সিদ্ধার্থের সঙ্গে জড়িয়ে গেল যে!

হ্যাঁ, অনেকেই বলে আমি স্বাভাবিক নই। বলে, আমি সবসময় কী একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। আমি যে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করিনি, তা তো নয়। এমনকি অনেক মনঃচিকিৎসককেও দেখিয়েছি, তাঁরা কিন্তু পরীক্ষা করে সকলেই আমাকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলেছেন। এই যে আমার চোখের সামনে যেন কোন্ দূর কালের ঘটনা ঘোরে ফেরে, সেগুলো সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ বলে প্রমাণিত হয়নি। ডাক্তাররা বলেছেন, ওগুলো আমার নিছকই কল্পনা। সৃষ্টিশীল মনের কল্পনা। এবং ওগুলো আমার বাস্তব জীবনকে কোনোমতে প্রভাবিতও করছে না। আমার সত্তার গভীরে আমি কোথাও ওগুলোকে সত্য বলে গ্রহণ করি না। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। মা রান্না করত, আর আমি রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে দুলে দুলে পড়তাম। অন্য কোনো বই নয়, স্কুলেরই বই। এমনি করে পড়তে পড়তে একদিন, তখন আমি ক্লাস থ্রি-তে পড়ি, ইতিহাস বইতে পড়েছিলাম বুদ্ধের কথা। আর অমনই মনে হয়েছিল, এসব আমার ভীষণভাবে চেনা। দারুণভাবে পরিচিত। কিন্তু কেন এমন মনে হয়েছিল, আমি জানি না।

সেই থেকে যেন নেশা লেগে গেল। কিছুদিন পরেই পড়েছিলাম অবন ঠাকুরের ‘নালক’। সে বই পড়তে গিয়েও একই দশা। মনে হল, এই সিদ্ধার্থকে, নৈরঞ্জনা নদীকে, সুজাতাকে, পাঁচজন ভিক্ষুকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি। বইতে যেমন লেখা আছে, তার থেকে অনেক স্পষ্টভাবে। ঠিক যেমন করে আমি আমার চারপাশটাকে চিনি, তার থেকেও স্পষ্টভাবে যেন চিনি ওদের। যেন আমার চোখের সামনেই কতকাল আগে এইসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সেই থেকেই বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন আমি যেন একটা আবেশের মধ্যে কাটিয়েছি। স্কুলে কলেজে পড়েছি, কোনো বন্ধু পাইনি। অন্যদের সঙ্গে আমার একটা সংযোগের সাধারণ ভূমি খুঁজে পাইনি। ওরা কী ভাষায় কথা বলে, কেন হাসে, কেন কাঁদে, কিছুই আমাকে স্পর্শ করে যেত না। নিজের ভেতরে আমি যেন নির্বাসিত। শুধু নিজের কাছে ফিরে এসে নিজের মনেই সেই নৈরঞ্জনা তীর, সেই উরুবিল্ব বন, সেই গোপীনাথপুর গাঁ, সিদ্ধার্থ, সুজাতা, পাঁচজন ভিক্ষু—এইসব ছবি নিয়ে তোলাপাড়া করেছি।

বড়ো হয়ে পড়েছি পল ক্যারাস, আর্নল্ডের লাইট অব এশিয়া, এডওয়ার্ড, কোঞ্জের বই… বুদ্ধ-বিষয়ে যে-কোনো বই আমি গোগ্রাসে গিলেছি। ঘুরে বেড়িয়েছি রাজগিরে, সারনাথে, বোধগয়ায়, পাবা নগরীতে। আর সেইসব পড়া, সেইসব বেড়ানোর মধ্যে একটি নাম আমার জাগর-তন্দ্রায় স্পন্দিত হয়ে চলেছে, সিদ্ধার্থ…সিদ্ধার্থ! একবার ভেবেছিলাম বৌদ্ধ শ্রমণ হব, বৌদ্ধ সঙ্ঘে যোগদান করব। কিন্তু কী যেন আমাকে পেছন থেকে টেনে রেখেছে। সে কি কোনো নারী?

আমার এই জীবনে কোনো মেয়েকে আমি ভালোবাসতে পারিনি। এমন নয় যে, প্রেমের সামর্থ্য আমার ছিল না। ছিল, খুবই ছিল। কিন্তু আমাকে যেন কে মনে করিয়ে দিয়েছে, আমি সহস্রাব্দ সহস্রাব্দ আগের কোনো এক নারীর প্রণয়কুসুমের ভ্রমর। সে আমাকে আজও ভালোবাসে। আমিও তাকে…

সেই এক ভালোবাসা আমাকে বেঁধে রেখেছে সর্বক্ষণ। আমি তাকেই খুঁজে চলেছি অন্য নারীদের মধ্যে, কিন্তু পাইনি কোথাও। আর পেলাম না বলেই অন্য কোনো মেয়েকে আমি আর ভালোবাসতে পারিনি।

মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কি তবে জাতিস্মর? অন্য জন্মের কথা মনে আছে? কই, না তো! কিছুই মনে নেই আমার। তা সত্ত্বেও কেন যে আমি ভাবতে ভালোবাসি, কেন যে সুদূর অতীতের কোনো এক চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম বোধ করি, যে-চরিত্রের কথা ইতিহাসের পৃষ্ঠাতেও নেই, কিংবা ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে সেই চরিত্র বহু অমার্জিত হস্তের অবলেপে মুছে গেছে, সেই চরিত্রটি আমি নিজেই—কেন এমন ইচ্ছেভাবনা আমাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায় যে!

সে এক সুদূর কাল… বৈদিক যুগের ঋষিপ্রেমিকদের শেষ আদরের দাগ ভারতবর্ষের মুখশ্রী থেকে তখন যেন মুছে আসছে… জীবনের অর্থ অন্বেষণ করতে একদল মানুষ গৃহ পরিত্যাগ করে শ্রামণ্য গ্রহণ করছেন—কেউ হয়তো ছিলেন রাজপুত্র, কেউ বা শ্রেষ্ঠী… সেই এক সময়, যখন আনুষ্ঠানিক আচার-বিচারের হিরণ্ময় শৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে, পুরোনো প্রথাপ্রকীর্ণতা পরিত্যক্ত হচ্ছে… নতুন প্রশ্ন জাগছে, কোনো স্থবির বিশ্বাসকে মানুষ আর ধরে রাখতে পারছে না পূর্বধ্রুবতায়… সমাজে জাত-পাতের বন্ধন ভেঙে, বর্ণাশ্রমের কঠিন নিগড় চুর্ণ বিচূর্ণ করে জেগে উঠতে চাইছে নতুন এক ভারতবর্ষ… ষোড়শ মহাজনপদে বিভক্ত দেশ স্বপ্ন দেখছে নবীন এক ঐক্যের, সাম্যবাদ হবে যার মহামন্ত্র.. সেই সুদূর যুগের ভিতর থেকে আমার মগ্ন সত্তা উঠে এসে কতগুলো আবিষ্ট চিত্ররূপ এঁকে আমার মনকে তন্ময় করে রেখেছে।

অন্যদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, অন্যরা এই ছবি দেখতে পায় না। শুধু আমার মাথার ভিতরেই এই ছবিগুলো পাক খায়? আমি বোঝাতে পারি না!

না, বিয়ে করা হয়নি আমার। উপার্জন করি একটি প্রাইভেট স্কুলে ছেলে পড়িয়ে। কলেজে ইউনিভারর্সিটিতে ম্যাস পড়েছিলাম। আমি তাই অঙ্কের মাস্টার। কিন্তু সে আমার বাইরের পরিচয়। এই বাইরের পরিচয়টা খুবই সাদামাঠা। কিছুই না। আমি একটা হেঁজিপেজি লোক সেই অর্থে। স্কুলে পড়াই, বাজার-হাট করি, একাই থাকি, নিজের রান্নাবান্না নিজেই করি, মাঝে মাঝে বর্ধমানে দেশের বাড়ি যাই।

কিন্তু বিশ্বাস করুন, এগুলো সব আমার বাইরের পরিচয়। এগুলোতেই আপনি যদি সন্তুষ্ট থাকেন, তবে আপনি আমার চোখে অন্য পাঁচজনের মতোই বাইরের লোক থেকে যাবেন। কিন্তু আপনি যদি আমার বন্ধু হতে চান, তবে আপনাকে তো আমার ভেতরের মানুষটাকে চিনতে হবে!

ভেতরের সেই মানুষটা এখনকার না, এখানকার নয়। সে অন্য কালের মানুষ, অন্য স্থানের। বিশ্বাস করুন, আমি একটুও বানিয়ে বলছি না। আমি জানি আমার কথা আপনার বিশ্বাস হতে চাইবে না। কেউই বিশ্বাস করতে চায় না। আর ওই জন্যেই তো কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হল না আমার। নিভৃত একাকী মানুষের জীবন।

নির্জন কক্ষে নিভৃত দীপাধারে একটি প্রদীপ শুধু জ্বলছে।

একদিন নিভে যাবে। কেউ জানবে না।

এই আমার জীবন।

কিন্তু এসব কথা আমাকে তো কাউকে বলতে হবে। কাকে বলব? কে শুনবে? ভেতরের এই তুমুল তাড়নাটা আমাকে এত বছর কুরে কুরে খেয়েছে। শেষে আর থাকতে না পেরে কলম ধরলাম।

না, আমি কোনো লেখক নই। লেখার প্রকরণ, পদ্ধতি আমি কিছুই জানি না। দেশ-বিদেশের সাহিত্যও আমার তেমন কিছু পড়া হয়নি। অনেক সময় অনেকে যেখানে কথা বলেন, এমন সব আড্ডায় আমি গেছি। একপাশে বসে থেকেছি। অসহায়ের মতন। বেশির ভাগ কথা অন্যরা যা বলেন, আমি বুঝতে পারি না। ভারী ভারী নাম, নানা বইপত্তরের নাম—সবই আমার অজানা। লিখতে কেমন করে হয়, তাই-ই তো জানি না আমি। কাজেই লেখক হবার দূরতম বাসনাও আমার নেই। কিন্তু না লিখে পারছি না, তাই লিখছি। ভেতরে কতগুলো কথা, কতগুলো ছবি জমে আছে। সেগুলোকে মুক্তি দেবার জন্যেই লিখছি। নিজের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যেই লিখছি। আর কিছু না।

লিখতে লিখতে এই কয়েকটা অধ্যায় লেখা হয়ে গেছে। সিদ্ধার্থের জীবনেরই কথা। তাঁর গৃহত্যাগের দৃশ্য দিয়েই শুরু। কতদূর লিখব, তাও জানি না। এক- একটি চরিত্রের চোখ দিয়ে লিখে চলেছি সেই জীবনকথা। মারের চোখ দিয়ে, রাজগৃহ নগরীর চোখ দিয়ে, সিদ্ধার্থের চোখ দিয়ে, নৈরঞ্জনা নদীর চোখ দিয়ে…. এইসব। লিখতে লিখতে একটুও ভাবছি না। যেমন আসছে, বলা ভালো যেমন আমি দেখছি, সেরকমই লিখে চলেছি।

এই যে এখন লিখছি, বাইরে ঘোর বর্ষা নেমেছে। জানালার ওদিকে জোর বৃষ্টি পড়ছে। রাত হয়ে গেছে। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে, দূরের একটা পুকুরের থেকে ব্যাঙের ডাক শোনা যায়। জানালার ওদিকে কতগুলো কদমগাছ। বৃষ্টিভেজা কদম ফুলের সুবাস ভেসে আসছে বাতাসে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, ভাগ্য ভালো এমন বৃষ্টির রাতেও বিদ্যুৎ পরিষেবা চালু আছে। জায়গাটা কলকাতা থেকে বেশি দূরে নয়, তবে কলকাতা এখনও একে গ্রাস করতে পারেনি। এখানেই আমি থাকি। একটা ঘর ভাড়া করে। দিনের বেলা স্কুলে চাকরি করি আর রাত্রে ঘরে ফিরে নিজের জন্যে দুটি ফুটিয়ে নিয়ে লিখতে বসি।

সিদ্ধার্থের যে সমস্ত জীবনী আমি পড়েছি, সেসব বইতে, কেন জানি আমার মনে হয়েছে, অনেক ক-টা চরিত্র যেন নেই। কিংবা উল্লেখ থাকলেও তাদের বিস্তার করা হয়নি। এর একটা কারণ হচ্ছে, সিদ্ধার্থ বা বুদ্ধই সেখানে প্রধান, পার্শ্বচরিত্রগুলি প্রায়শই অনালোচিত। সূর্যের উপস্থিতিতে আলোর বন্যায় যেমন ডুবে যায় আকাশের অন্য তারারা। এই যেমন সিদ্ধার্থের পরিণীতা স্ত্রী গোপা যশোধরার কথা। শুধু সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের সময় তাঁর একটু উল্লেখ আছে। আর আছে বুদ্ধের পরিণত জীবনে। তিনি পুত্র রাহুলকে পাঠিয়েছিলেন পিতৃধন চেয়ে নিতে। প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এর বাইরে, সিদ্ধার্থ যখন সন্ন্যাসী হয়ে গেলেন, তখন তাঁর আর কোনো সংবাদ নেই, তখন কেমন করে তিনি জীবনধারণ করেছিলেন, কী ভেবেছিলেন, সেসব কথা অনুক্তই থেকে গেছে। পণ্ডিত উদরক রামপুত্রের কথা আছে বইপত্রে একটু, কিন্তু বিস্তারিত নয়। সুজাতার কথাও সামান্যই বলা হয়েছে।

অথচ কী অদ্ভুত! আমার মনে হয়, আমি ওদের কথা জানি। আমার কাছে ওরা স্পষ্ট। না, ওদের আমি দেখতে পাই। কেন এমন হয় আমার, আমি জানি না। আপনারা বলতে পারেন, কেন আমার এমন হয়?

আমি ওদের কথা লিখব। ওদের চোখ দিয়ে সিদ্ধার্থের কথা বলব। আমাকে বলতেই হবে। আমার ভেতরে কে যেন জোর করছে। বড্ড জেদি সে। কে আমাকে এসব লেখাচ্ছে। না-লেখা অবধি আমার শান্তি নেই।

ঘর থেকে বাজার যাওয়ার যে-রাস্তাটা, আমি রোজ স্কুলে যাবার সময় ওই পথ দিয়েই ঘুরে মোড়ের মাথা থেকে অটো ধরি। দেখি, মাথায় কাঠ বোঝাই করে কজন বুড়ি টাল সামলে রোজ পথ হাঁটে। মোড়ের মাথায় মুরগি কাটার দোকান। অসহায় মুরগিগুলো মাংসবিক্রেতার হাতের মধ্যে ডানা ঝাপটে ঝাপটে বাঁচার শেষ চেষ্টা করছে। একটা মুদির দোকান। কে একজন দোকানদার আর- একজনকে হেসে হেসে বলছে, ‘ঠাকুরভক্ত? ঠাকুরভক্তি সে তো ভালোই। কিন্তু কর্ম ছাড়া তোমার ঠাকুর থাকবে কি?’

রাস্তার ধারে একটা ঘুমন্ত শ্যাওলাঢাকা মজা পুকুর, তারই পাড়ে সেলুন একটা, সেখানে সারাদিন লোকে চুল কাটাচ্ছে… মিষ্টির দোকানের সামনে ভিড়… বাজার … মুড়ির কারখানা, ধোঁয়া উঠছে চিমনি দিয়ে… অটো রিকশার হ্যান্ডেলের সামনে ঠাকুরের ছবিতে বাসি মালা ঝুলছে… মসজিদের ধারে গলির একপাশে সন্ধেবেলা হাতে গড়া রুটি আর তড়কা বিক্রি করছে একটা রোগা লোক—এইসব পরিচিত দৃশ্য, শব্দ, ঘ্রাণের ভিতর, এই চিরচেনা পথ দিয়ে কেন জানি আমার মনে হয় আজও হেঁটে চলেছেন এক মানুষ, মানুষ হয়েও মানুষের অনেক উপরে যাঁর মানসিক স্থিতি, তাঁর চরণপাতে একটুও শব্দ হচ্ছে না, পথের একটি ধূলিকণাও কাঁপছে না তাঁর পা-তোলায় পা- ফেলায়, প্রেম-জ্ঞান-করুণার ইঙ্গিত তাঁর হস্তধৃত মুদ্রায়—তিনি সিদ্ধার্থ, আমার অতি পরিচিত সিদ্ধার্থ!

লেখার টেবিলে ফিরে আসি। আজ মনটা উদাস হয়ে রয়েছে, মনে হয়, যাকে আমি চিরকাল ভালোবেসে এসেছি, যে আজও আমাকে ভালোবেসে চলেছে, যার জন্য অন্য কোনো নারীকে আমি ভালোবাসতে পারলাম না, তাকে যেন চিনতে পেরেছি। আড়াই হাজার বছর আগের সেই এক মেয়ে। তার কথা বইতে উল্লেখমাত্র আছে।

সে বড়ো অভিমানী মেয়ে, একটু আদরে গলে পড়ে, আবার এক মুহূর্ত মুখ ফিরিয়ে নিলে অভিমানে সকালের মালতীর মতো মুখ লুকিয়ে নেয়। বাসন্তী রঙের কাপড় পরে সে। তার রাঙা রূপ সে ঢেকে রাখে আত্মবিস্মৃতির মেখলায়। তার দিঘল কালো দুই চোখে শতাব্দী শতাব্দী পারের অন্ধকার…

বইতে আছে, গ্রামের মোড়লের মেয়ে সুজাতা, অনেকদিন তার কোনো সন্তান হয়নি। তাই সে নৈরঞ্জনা নদীর পরপারে উরাইল বনের ধারে দেবতা-বৃক্ষের কাছে মানসিক করে। তারপর তার সন্তান হলে এক বৈশাখী পূর্ণিমার বিকেলবেলায় সে তাদের রাঙি গাইয়ের দুধ থেকে পায়েস তৈরি করে নদীর পারে ওই বৃক্ষদেবতার থানে পায়েস নিবেদন করতে গিয়ে সিদ্ধার্থকে দ্যাখে। তার দেওয়া সেই পায়েস আহার করে সেই রাত্রেই বোধিলাভ করেন সিদ্ধার্থ।

এইসব কথাই পুথির পাতায় আছে। কিন্তু পুথির পাতা থেকে হারিয়ে গেছে শুধু একজনের নাম। তার নাম ছিল সৌদাস-সুজাতার স্বামী। সে ছিল কবি। সুজাতাকে সে ভালোবেসেছিল প্রথম যৌবনে। সৌদাস ছিল সুজাতারই গ্রামের যুবক। তার কবিতায় ধরা পড়েছিল সুজাতার প্রেম, সুজাতার অমোঘ সৌন্দর্যের কথা। বইতে সিদ্ধার্থের কথা আছে, সুজাতার কথাও আছে। কিন্তু বইতে সুজাতার স্বামীর কথা কোথাও নেই। জগৎ সুজাতার স্বামীর কথা কোনোদিন জানতেও পারেনি। ভুলোমন ইতিহাস সৌদাস আর তার কাব্যের কথা একেবারে ভুলে গেছে।

কিন্তু আমি ভুলিনি। কারণ, আমিই ছিলাম সেই সৌদাস—সুজাতার প্রণয়ী, সুজাতার স্বামী, সুজাতাকে নিয়ে লেখা অবলুপ্ত সেই একমাত্র কাব্যের কবি। সেই সৌদাসের কথাই এখন আমি বলব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *