১. কহিল অনঙ্গ মার

১. কহিল অনঙ্গ মার

থামো। আর অগ্রসর হয়ো না। পিছনে ফিরে তাকাও। বাহিরে স্তব্ধবাক নীল রাত্রি। আর কক্ষের ভিতর ঘৃতপ্রদীপের আলোক। দুগ্ধফেননিভ শয্যায় শায়িতা, সুষুপ্তা তোমার স্ত্রী—জগতের সকল সৌন্দর্যের কলানিধি—সুন্দরী গোপা যশোধরা। আর তারই ঘুমন্ত বুকের পাশে দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো নিদ্রিত শিশুপুত্র রাহুল। এইদিকে তাকাও। এই তোমার সুখের পৃথিবী। এই সুখশয্যা ছেড়ে কোন অনিশ্চিত জগতের দিকে তুমি চলে যাবে, বলো? কী চাও আর? কী পেতে বাকি আছে তোমার? কোন উন্মাদনা তোমাকে নিশিডাকের মতো বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে আজ?

থামো, সিদ্ধার্থ, থামো! জীবনে সুস্থিতির মূল্য আছে। অনেক শ্রম করে সেই সুস্থিতি অর্জন করতে হয়। এটুকু পেতে অনেকের সমস্ত জীবন চলে যায়, কেউ বা একে সারাজীবনেও লাভ করতে পারে না। তুমি সেই সুস্থিতিকে, সমৃদ্ধিকে জন্মসূত্রেই পেয়ে গেছ। একে এখন অবহেলা কোরো না। কোন উন্মাদনা তোমার মস্তিষ্ককে উত্তপ্ত করেছে এই নিগূঢ় নিশীথে?

এইতো, এইতো তুমি আমার কথা শুনতে পেয়েছ। গ্রীবা ঘুরিয়ে দেখছ। তোমার ভ্রমরের মতো কালো আয়ত চক্ষুদুটি শয্যায় ঘুমন্ত স্ত্রী-পুত্রের উপর এক মুহূর্ত ন্যস্ত হল। কত স্মৃতি, সিদ্ধার্থ, কত স্মৃতি এই নারীকে কেন্দ্র করে তোমার, মনে পড়ে? এ যে তোমার কৈশোরের প্রেমিকা, তোমার নমসহচরী, মর্মসঙ্গিনীও! সেসব বাসন্তী দিন, চৈতি চাঁদের রাত্রি তুমি কি সব ভুলে গেছ? নাকি, ভুলে যাওয়ার ভান করছ? দ্যাখো, ভালো করে ওকে দ্যাখো। তোমার সোনার হরিণীকে দ্যাখো।

কিন্তু, না। দৃষ্টি তোমার আবার ঘুরছে। তোমার অন্বেষী চক্ষু ঘরের ভিতর কাকে যেন খুঁজছে! আমাকে? তুমি কি আমাকে খুঁজছ? ভাবছ, পিছন থেকে কে তোমাকে এমন করে ডাকে? খুঁজতে খুঁজতে স্তিমিতালোকে আমাকে তুমি দেখতে পেলে। স্থির, অপলক নেত্রে আমার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছ। বিহ্বল স্বরে প্রশ্ন করলে, ‘তুমি কে?’

আমি আর কেউ নই। আমি তোমারই অপর সত্তা। তোমার অন্ধকার সত্তা। আমি আসলে তুমিই। আমি মার। আমি প্রত্যেকের মধ্যে আছি। আমি সকলকে জীবনযাপনে ব্যাপৃত রেখেছি। আমি বলে চলেছি, জীবনকে ভালোবাসো। মৃত্যুকে নয়। জীবন বড়ো লোভনীয়। একে তীব্র আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরো। চুম্বন করো জীবনের ওষ্ঠে।

তুমি বলে উঠলে, ‘জীবন এক আদিম সর্পিণী। কোনো না কোনো সময় সে দংশন করবে। তার দংশন আসবে রোগ, জরা আর মৃত্যুর রূপ ধরে।’

আহ্, সিদ্ধার্থ! মূর্খ! ভুলে যাও। ভুলে যাও। দংশনের কথা ভুলে যাও। জীবনকে উপভোগ করো তার সমস্ত উপচারের ভিতর। জীবনকে অতিক্রম করতে যেয়ো না, কারণ জীবনকে অতিক্রম করা যায় না। আমি মার, আমি মূর্তিমান প্রলোভন। আমি তোমাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াব জীবনের সব প্রমোদ কাননের ভিতর দিয়ে। স্বাদ নেওয়াব সুখের। তোমার অধরে তুলে ধরব মধুভরা জীবনের পানপাত্র। তুমি সেই ফেনিল সুরা পান করে উন্মাদ হয়ে যাবে। এসো, সিদ্ধার্থ, আমার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করো।

তুমি মাথা ঝাঁকালে। গ্রন্থিবদ্ধ তোমার কেশভার খুলে ছড়িয়ে পড়ল তোমার সুন্দর মুখের চারিপাশে। অসহিষ্ণুর মতো বলে উঠলে, ‘দুক্‌খং দুক্‌খং সব্বং দুক্‌খং!’

তোমার আসলে কী হয়েছে, সিদ্ধার্থ? তোমার পিতা শাক্যকুলপতি শুদ্ধোদন। তোমার জন্মলগ্নেই কে এক ভবিষ্যদ্বক্তা গণনা করে বলেছিল, তুমি সন্ন্যাসী হবে। প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে দুঃখের শেষ কোথায়, তা অন্বেষণ করবে। যেমনটা এ দেশের একদল উন্মাদ গৃহত্যাগী প্রতি যুগেই করে থাকে। ওরা কিছুই পায় না। শুধু পাওয়ার ভান করে। তুমি সেই পথে যাবে শুনে তোমার পিতা শাক্যকুলপ্রদীপ তোমাকে প্রাসাদে আকণ্ঠ ভোগের ভিতর ডুবিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমি মার; মূর্তিমান প্রলোভন। সেসব আমারই রচনা। ছ-টি ঋতুতে তোমার জন্যে ছ-টি প্রমোদভবন রচনা করেছি আমিই। তোমার পিতা উপলক্ষ্য মাত্র। জগতের সকল সুন্দরী স্ত্রীলোক তোমাকে ঘিরে ছিল। উপভোগের সমস্ত আয়োজন রচেছি তোমার চারিপাশে। এরই মধ্যে তোমার জীবনে এসেছে প্রেম, বিবাহ, সন্তান। তুমি তো এর মধ্যে ডুবেই ছিলে। এখন কী তোমার হল বলো তো, যার জন্য তুমি সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চাও অনিশ্চয়তার অন্ধকার পথে?

‘আমি দেখেছি ব্যাধি, জরা আর মৃত্যুর রূপ… দেখেছি সেদিন রাজপথে…’

হাঃ! সে কে না দেখে? ছন্দক সারথি তোমাকে রথে চড়িয়ে নগরভ্রমণে নিয়ে গিয়েছিল। সেই পথে জীবনে প্রথম এক ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিকে দর্শন করেছিলে। তারপর এক জরাগ্রস্ত ব্যক্তি। তারপর চতুর্বাহকের দ্বারা বাহিত এক মৃতদেহ। এই দেখেই তোমার ভাবান্তর হয়ে গেল?

‘আমি দেখলাম রোগগ্রস্ত ব্যক্তির শরীরে অসুখের বীজ বজ্রকীটের মতো প্রতি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে… বার্ধক্যপীড়িত মানুষটির সর্বাঙ্গ জরা প্রতি পলে গ্রাস করে চলেছে… আর শতদীর্ণ পাত্রের মতো নিঃশেষিতায়ু মৃতদেহটি হিমশীতল হয়ে পড়ে আছে… ওহ্, আমিও এমন হব… আমারও এমন হবে… আমিও একদিন ব্যাধিঘোরে অসুস্থ হব, জরা আমাকেও একদিন গ্রাস করবে… আমারও মৃত্যু হবে… হায়! জীবনের এই অনিবার্য পরিণাম?’

বেশ তো! অনিবার্য বলেই যখন জেনেছ, তবে আর কেন এই মিথ্যা প্ৰয়াস? একে তুমি কখনও অতিক্রম করতে পারবে না। ব্যাধি, জরা, মৃত্যু—এ তো আসবেই। এসব নিয়ে ভেবে কী হবে? তার থেকে যতদিন সুযোগ পাচ্ছ, এ জীবনকে নিঃশেষে উপভোগ করে নাও। কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে দীর্ঘায়ু করব।

‘তারপর? তারপর একদিন তো সেই আয়ুষ্কাল শেষ হবে। তখন? অবধারিতভাবে দেখা হবে রোগের সঙ্গে, জরার সঙ্গে, মৃত্যুর সঙ্গে। হে মার, দেখা হবে তোমার সঙ্গে। আর দীর্ঘায়ু হয়েই বা কী হবে? সেই একই জীবনের ক্লান্তিকর পুনরাবর্তন। এর থেকে মুক্তি কই? নিষ্ক্রান্তি কোথায়?’

না, না, সিদ্ধার্থ, তুমি তোমার পক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছ মাত্র। দ্যাখো, স্ত্রীর প্রতি কি তোমার কোনো কর্তব্য নেই? নবজাত পুত্রের প্রতি? বৃদ্ধ পিতার প্রতি? তোমার রাজত্বের প্রতি? তোমার প্রজাদের প্রতি? কোনো দায়িত্ব নেই?

‘আছে। শুধু স্ত্রী-পুত্র-রাজ্য – প্রজাদের প্রতিই নয়, পৃথিবীর সমস্ত প্রপীড়িত মানুষের প্রতি আমার কর্তব্য আছে। সমস্ত জগৎ দুঃখে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনো আলো নেই। যে-আলোতে তারা নিজেদের মুখ দেখবে, নিজেদের মার্গ খুঁজে পাবে, সেই আলো প্রজ্ঞার আলো। আমি সেই আলোক খুঁজে বের করব। সকলের জন্য।’

আরে, ভাবুক, সেই আলো থাকলে তো তাকে খুঁজে বের করবে! সেরকম কোনো কান্তিময় আলো নেই কেনোদিকে, সিদ্ধার্থ! যা আছে, তা এই জীবন, একে উপভোগ করো। আচ্ছা, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। এই যা বলছ, এসব আসলে তোমার নিজ দুর্বলতাকে আচ্ছাদিত করার কৌশল নয় তো?

‘কী দুর্বলতা?’

রোহিণী নদীর জল নিয়ে শাক্য ও কোলিয়দের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, মনে নেই? সে বিবাদ তুমি ঠেকাতে পারোনি। রক্তে নদীর জল লাল হয়ে গেছে। আর তা দেখে তোমার ভিতর ভয় জেগেছে। রাজ্যশাসনের ভয়। সিংহাসন কখনও নিষ্কণ্টক নয়। রাজা হলে এরকম মানুষের রক্ত মাঝে মাঝেই তোমাকে দুই হাতে মেখে নিতে হবে। তারপর বহিঃশত্রুর আক্রমণ—সে-ও থাকবে। নৃপতি কখনও আরামে নিদ্রা যেতে পারেন না। অশান্তি থাকে, উদ্‌বেগ লেগেই থাকে। এই কঠিন রাজধর্ম থেকে তুমি কি পালাচ্ছ না, সিদ্ধার্থ? নিরুদ্‌বেগ, নিশ্চিন্ত শ্রমণের জীবন রাজার জীবনের তুলনায় আরামদায়ক, শান্তিপ্রদ। দুঃখের নিবৃত্তি অন্বেষণ আসলে তোমার অজুহাত। বস্তুত, তুমি জীবনকে ভয় পেয়েছ, তাই না?

‘না। আমি জানি আমার অন্তরের পিপাসাকে। জীবন-সমস্যার নিষ্পত্তি করতে আমি বদ্ধপরিকর। একদিন নিশ্চয়ই আমি সমস্ত মানুষের জন্য এনে দিতে পারব স্বচ্ছতোয়া নদীর জল—সে-নদী এ পৃথিবীর নয়। সে বোধিনদী। এনে দিতে পারব এক শান্তিরাজ্যের মৃত্তিকা—সে-রাজ্য এ জগতের নয়। সে প্রজ্ঞাভূমি।’

তার থেকে আমি বলি কী, সিদ্ধার্থ, আমার কথা শোনো। তোমার ও কাল্পনিক নদী, স্বকপোলকল্পিত রাজ্যের থেকে এই যে তোমার পিতার সাম্রাজ্য, একেই তুমি শাসন করো। কাল্পনিক প্রজ্ঞার থেকে বাস্তব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অনেক সুখপ্রদ সুখ-দুঃখ ভরা একটা বাস্তব জীবনকে উপভোগ করা অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। তা ছাড়া শাক্য আর কোলিয়দের এই দ্বন্দ্ব মেটাতে গিয়ে যদি তোমার মৃত্যু হয়, তবে তো তুমি বীরগতি প্রাপ্ত হবে। জানো না, বীরের জন্যই স্বর্গদ্বার অপাবৃত? প্রাচীন যুগের প্রথিতযশ নৃপতিদের মতো ইতিহাস-পুরাণে তোমারও নাম পরিকীর্তিত হবে। তুমি কি জীবনান্তে কীর্তি রেখে যেতে চাও না?

এই দ্যাখো, তুমি আমার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলে। তোমার চোখে নির্বোধ প্রতিজ্ঞার আলো। ওষ্ঠ, অধর দৃঢ়সংবদ্ধ। তুমি আমাকে উপেক্ষা করছ। জীবনকে উপেক্ষা করছ। অনুচিত এই উপেক্ষা। শ্রমণজীবনের প্রতি অনুচিত এই আগ্রহ। আর শ্রমণ বললেই তো আর শ্রমণ হওয়া যায় না। সে-পথ অনেক কঠিন, অনেক

ভয়প্রদ, রাজকুমার!

তুমি আত্মগত স্বরে বললে, ‘সে-পথ যতই কঠিন হোক, আমি সেই পথে যাব। যদি তাতে আমার মৃত্যু হয়, তবু সেই পথই আমি বরণ করে নিলাম। রক্তাক্ত হোক সে পথে আমার সত্তা, চুর্ণবিচূর্ণ হোক আমার অহং, নিজেকে হারিয়ে আমি নিজেকেই খুঁজে পাব। আমার সামনে অন্য পথ নেই আর…’

আবারও একবার ভেবে দ্যাখো, সিদ্ধার্থ! হঠকারিতা কোরো না। তাকিয়ে দ্যাখো, এই ঘর, প্রাসাদের এই অন্তঃপুর… এখানেই তো তুমি কাটিয়েছ আশৈশব। তোমার মা, মুখ যার আজ আর তোমার মনেও পড়ে না, একদিন এই কক্ষেই তিনি তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। মায়াদেবী! কত কষ্টে কত পীড়া সহ্য করে তিনি তোমাকে গর্ভে ধরেছিলেন। এই পর্যঙ্কে শায়িত হয়েই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন চাঁদের আলোর মতো এক শ্বেত হস্তী যেন তাঁর উদরে প্রবেশ করছে। তারপরেই তুমি এলে। লুম্বিনী উদ্যানে তোমার জন্ম হল। তুমি জাত হবার পরেই অল্পকালের মধ্যে মায়াদেবীর সঙ্গে মৃত্যুর দেখা হল। তোমাকে কোলে তুলে নিলেন তোমার মাতৃসা গৌতমী। আর তার থেকেই তুমি হলে গৌতম। সেসব এই কক্ষেই তো অনুষ্ঠিত হয়েছে। কত মায়া দিয়ে গড়া এই ঘর! তুমি একে ছেড়ে চলে যাবে, সিদ্ধার্থ?

তারপর ঊষাচঞ্চল শৈশব পার হয়ে এল সোনালি কৈশোর, কোন অজানা জগৎ থেকে নেমে এল এক অচিনপারের দূতী, সে তোমারই হৃদয়ের বোন। নাম তার গোপা যশোধরা। সে তোমাকে চিনিয়েছিল জীবনের অর্থ। লাস্যে, হাস্যে, বিভঙ্গে তোমার চিত্তে সে এনেছিল যৌবনের প্রথম লাবণ্যজ্যোৎস্না। তুমি তাকে ভালোবেসেছিলে, হৃদয় দিয়ে পড়েছিলে হৃদয়ের প্রথম দ্রাবিত অক্ষর। এই কক্ষে একদিন এক বাসন্তী পূর্ণিমার রাত্রে তুমি তাকে কথা দিয়েছিলে পুরুষ যেমন করে কথা দেয় তার নারীর কাছে। তোমাদের প্রণয় রূপ নিয়েছিল পরিণয়ে, তোমাদের ভালোবাসা ধীরে ধীরে পৃথিবীর ধুলো আর ফেনা মেখে রূপ নিয়েছিল এক শিশুর। সেই শিশু জাত হলে তুমি তার নাম দিলে ‘রাহুল’। ‘রাহুল’ শব্দের অর্থ তো বাধা। শিশুসন্তানের জন্মে তুমি কোন বাধা অনুভব করেছিলে, সিদ্ধার্থ? এত দ্রুত তোমার মন পরিবর্তিত হয়ে গেল? তুমি ভুলে গেলে সব? আজ এই নৈশ প্রহরে, তুমি যখন গৃহত্যাগে উদ্যত হয়েছ, সেসব আশ্চর্য মায়াবী কথা দিয়ে গড়া এই স্বপ্নের ঘর—এ কি তোমাকে পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরছে না?

ওই তো তোমার চক্ষু সজল হয়ে উঠেছে, আমার অস্ফুট পরামর্শ তোমার হৃদয়ে প্রবেশ করেছে, কেন তুমি আজ হৃদয়কে কঠিন করেছ, বলো? পিতা শুদ্ধোদন বৃদ্ধ হয়েছেন, ঝরাপাতা হেমন্তপ্রহরী। তোমাকে নিয়ে তাঁর কত স্বপ্ন! তুমি রাজ্যের দায়ভার স্কন্ধে নিয়ে রাজা হবে, কালক্রমে হবে একচ্ছত্র সম্রাট, এটুকু স্বপ্ন দেখা তাঁর পক্ষে কি অন্যায়? তুমি তাঁর স্বপ্নপূরণ করবে, উজ্জ্বল তোমার ভবিষ্যৎ! এসব ছেড়ে তুমি চলে যেয়ো না নির্জন প্রব্রজ্যায়। রৌদ্রে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীতে বিকম্পিত হয়ে তুমি বেছে নিয়ো না সেই সর্ববৈনাশিক তপস্যার কঠিন পন্থা। আজ এই রাত্রে তোমার পার্শ্বে বধূ শুয়ে ছিল, শিশুটিও ছিল, তবে এই গবাক্ষপথে দেখা দিল কোন ভূত? কে তোমাকে এই ভ্ৰান্ত পথে আজ অনির্বার পরিচালিত করছে?

হৃদয় তোমার বধির হয়নি, তবু তুমি দুই চোখ থেকে অশ্রুমার্জনা করে আবার কঠিন হয়ে উঠছ। আমার কথা শুনেও শুনছ না। তোমার ওষ্ঠের প্রান্তে আমার জন্য অবজ্ঞা ফুটে উঠছে। তুমি কোন বিচিত্র ধাতুতে নির্মিত, যুবক?

তুমি পুনরায় ফিরে দাঁড়ালে; এবার দ্বারপথের দিকে তোমার অয়স্কান্ত মুখ এক মুহূর্তে অর্গল ঠেলে অন্ধকারের ভিতর বাহির হয়ে গেলে ঘর থেকে। পরিত্যক্ত কক্ষে পড়ে রইল রুপালি জ্যোৎস্নার মতো সুন্দরীশ্রেষ্ঠা যশোধরা, শিশুপুত্র রাহুল আর আমার ব্যর্থ পরামর্শ।

কিন্তু না। আমি তোমাকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারি না। আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে যাব। তোমাকে অনুসরণ করব, তোমাকে বাধা দেব প্রতি পদে পদে। কারণ, আমি তোমারই ছায়া, তোমারই কৃষ্ণাত্মা। আমি মার, তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী, আমিই তোমার অন্তর্নিহিত পাপপুরুষ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *