৮. মর্মরিল নদীসখী

৮. মর্মরিল নদীসখী

যে-উৎস হতে আমি বাহির হয়ে এসেছি, চলার আনন্দে তা যেন কখন আমি ভুলেই গেছি। গতির আনন্দ আমার সমস্ত শরীরে; আর তাই কোনো আবিলতা আমাকে স্পর্শ করেনি। কত মাঠ-ঘাট-বন, কত জনপদ, কত গ্রাম, গ্রামপ্রান্তে ভগ্ন দেবদেউল কিংবা জনাকীর্ণ হাট দেখতে দেখতে আমি সম্মুখে, শুধুই সম্মুখে বহে চলেছি। আমার দু-পায়ে বেজে চলেছে গতির নূপুর, কোথাও বাঁধা পড়তে আমি জন্মাইনি, আমি চিরচঞ্চলা নৃত্যপটীয়সী। আমার অতীত নেই, স্মৃতিকাতরতা নেই, নেই ভাবীকালের জন্য কোনো উদ্‌বেগ। আমি শুধু মুহূর্তজীবী। আর এই মুহূর্তই শাশ্বত। প্রতি মুহূর্তই আমার কাছে নবীন। আমি তাই অন্তহীন আনন্দের উৎসার অঞ্জনহীনা আমি নৈরঞ্জনা—আমি ক্ষণশাশ্বতীর ঊর্মিমালা।

চলতে চলতে শুধু একদিন আমি যেন এক নিমেষের জন্য থমকে দাঁড়ালাম এই উরুবিল্ব বনের ধারে। তীরভাগে দেখলাম এক তরুণ তাপসকে। তাঁর অঙ্গে উজ্জ্বল গৈরিক কাষায়; কিন্তু তাঁর দীপ্ত অঙ্গকান্তি না পরনের সেই গৈরিক চীবর— কে কাকে মহিমান্বিত করেছে, তা আমি স্থির করতে পারলাম না। তাঁর চরণ ধুলায় ধূসর, কিন্তু শ্রান্তির চিহ্নমাত্র তাঁর মুখমণ্ডলে নেই। তাঁর কেশগুচ্ছ চূড়া করে বাঁধা, অনেক রুদ্রাক্ষ একত্রে স্তূপাকৃতি করলে যেমন দেখায়—সে কেশকলাপ সেইরূপ। অধরোষ্ঠ কী যেন প্রতিজ্ঞায় দৃঢ়সংবদ্ধ, আননে ও কপালে প্রতিভার অমল দীপ্তি। আমি দু-চোখ ভরে তাঁকে দেখতে লাগলাম। মনে হল, আমার নদীজন্ম আজ বুঝি সফল হল। ওই উরুবিল্ব বনের ধারে বইতে বইতে সেসব মুহূর্তের মালা গেঁথে আমি তাঁকে দেখে চললাম দিনের পর দিন।

নদী আসলে নারীর মতন। তার একটা অন্তঃস্পন্দন আছে। সেই স্পন্দন দিয়ে সে অনেক না-বলা-কথা এমনিতেই টের পায়। আমিও কেমন করে জানি টের পেলাম, ইনি সাধারণ তপস্বী নন। ইনি কোনো এক রাজ্যের রাজকুমার, জীবজগতের বেদনার্ত আকুল ক্রন্দন সহ্য করতে না পেরে তার প্রতিকারার্থে সন্ন্যাসী হয়েছেন। যৌবনের সুখভোগ, রাজ্যসম্ভোগ এঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। আমি কান পেতে তাঁর প্রতিটি অস্ফুট উচ্চারণ শুনতে লাগলাম।

তাঁর বস্ত্রপ্রান্তে সামান্য চিপিটক ছিল, আমার জল দিয়ে ভিজিয়ে তিনি তা-ই আহার করলেন। তারপর কিছুক্ষণ আমার তীরে আনমনা হয়ে বসে রইলেন। আমি শুনতে পেলাম, তিনি নিজের মনে বলছেন, ‘আমি বহু আচার্যের নিকট সত্যের অন্বেষণ করেও কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। এখন আমি নিজেই এ সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করব। নিজ তপশ্চর্যার আলোকে আমি জানব, দুঃখের শেষ কোথায়। আমি সিদ্ধার্থ, এ জীবনের সিদ্ধ অর্থ আমি স্বয়ং লাভ করব।’ তাঁর উচ্চারণে দৃঢ় প্রত্যয় অভিব্যক্ত হচ্ছিল।

তিনি আমার তীর হতে ধীরে ধীরে উত্থিত হলেন। উরুবিল্ব বনের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। তাঁর সম্মুখে বনের বহির্ভাগে একটি বৃহৎ বনস্পতি দণ্ডায়মান ছিল। অশ্বত্থ বৃক্ষ। তিনি ওই বৃক্ষটিকে আনন্দিত চিত্তে নিরীক্ষণ করলেন। তারপর বৃক্ষটির দিকে অগ্রসর হলেন।

বৃক্ষের নিম্নভাগ পরিষ্কার করে তিনি কিছু পাতা আর খড় বিছিয়ে তাঁর আসন নির্মাণ করলেন। সেই আসনে তিনি উপবেশন করলেন। মনে হল তাঁর মন স্বস্তি পেয়েছে। গভীর শ্বাস গ্রহণ করে তিনি গভীর শ্বাস পরিত্যাগ করলেন। মনে মনে বললেন, আমার হৃদয় হতে প্রেমের তরঙ্গ উঠে পূর্বে, পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে, ঊর্ধ্ব ও অধোদিকে প্রসারিত হোক। সমগ্র জীবজগতের কল্যাণ হোক। সকলে সুখী হোক, শান্ত হোক, আনন্দময় হোক, পরিপূর্ণ হোক। সর্বজীবের প্রতি সম্প্রীতিভাবনার পর তিনি আত্মগতভাবে বললেন, ‘আমি এমন তপস্যা করব, যে-তপস্যা এ ধরিত্রীতে কেউ কখনও করেনি। আমি বহু আচার্যের নিকট গমন করেছি। তাঁদের উপদেশ অনুসরণ করেও আমি কোনো ফললাভ করতে পারিনি। অর্থাৎ, আমার যা জিজ্ঞাসা, সেই জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর আমি পাইনি। এখন আমাকে নিজেকেই অমানুষী তপস্যা করে দেখতে হবে, আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলে কিনা।’

শুরু হল সিদ্ধার্থের কঠিন তপ। আমি নৈরঞ্জনা নদী; আমি সেই তপস্যার সাক্ষী হয়ে আছি। তিনি ভিক্ষার্থে বহির্গত হতেন না। দিনান্তে গাছের কোনো একটা ফল আহার করে জীবন ধারণ করতে লাগলেন। সে বড়ো কঠিন কৃচ্ছ্রসাধন। গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার অশ্রান্ত বারিধারা, শরতের মেঘের ঔদাস্য, হেমন্তের ধূমল ধূসরতা, শীতের রুক্ষতা, বসন্তের নবপত্রের হিল্লোল—কোনোদিকেই তাঁর দৃষ্টিমাত্র ছিল না। তিনি অচঞ্চল চিত্তে তপস্যা করে চলেছেন। সেই কঠোরতায় তাঁর অঙ্গকান্তি মলিন হয়ে গেল, শরীর মরা গাছের মতো শুকিয়ে গেল, হনু উদ্যত, চক্ষু কোটরাগত হয়ে পড়ল। অস্থিচর্মসার দেহ, যেন একখানা কঙ্কালের উপর গাত্রচর্ম জড়ানো আছে। তাঁর উদরদেশ এতদূর সংকুচিত হয়ে পড়ল যে, উদরে হাত দিলে মেরুদণ্ড স্পর্শ করা যায়। তিনি শ্বাস নিলে কর্মকারের ভস্ত্রার মতো শব্দ হতে লাগল। আমার ভয় হল, মনে হল, এই তপস্যাতেই না সিদ্ধার্থের প্রাণবিয়োগ হয়।

এই কালেই আমি আর-একটি আশ্চর্য ব্যাপার দেখে মহা বিস্মিত হয়েছিলাম। সিদ্ধার্থের ভিতর থেকে তাঁরই অনুরূপ আর-এক ব্যক্তি বাহির হয়ে আসত। সে প্রথমে বারংবার সিদ্ধার্থকে তপস্যা থেকে নিবৃত্ত হতে পরামর্শ দিচ্ছিল। সে বলছিল, ‘দ্যাখো সিদ্ধার্থ! এই বিজন প্রদেশে কঠোর তপস্যা করে তুমি নিজেকে ক্ষয়িত করে ফেলবে। তপস্যা ত্যাগ করো। ভিক্ষার্থে বহির্গত হও।’

সিদ্ধার্থ বললেন, ‘হে মার! আমি তপস্যা করে আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। তুমি আমাকে বিরক্ত কোরো না।’

সে-ব্যক্তি বলল, ‘তুমি রাজপুত্র! কী অপূর্ব তোমার রূপ ছিল! তুমি সেই রূপ হারালে। এখন তুমি যে কুশ্রী হয়ে গেছ!’

‘হে মার! এ দেহ ক্ষণিক। এর রূপসৌন্দর্যও ক্ষণিক। আমি আমার রাজকীয় রূপের অপেক্ষা করি না। আমি সর্বজীবের দুঃখের আত্যন্তিক নিবারণ শুধু কাঙ্ক্ষা করি।’

‘এমন কঠিন তপস্যা করলে উপবাসে অনশনে তোমার মস্তিষ্কবিকৃতি হতে পারে।’

‘বেশ, যদি তাই হবার হয়, তবে তাই হোক। একটা জীবন না হয় এভাবেই ব্যর্থ হবে। তবু আমার উদ্দেশ্য মহৎ।’

সিদ্ধার্থ মারের কথায় কর্ণপাতও করলেন না। তখন, কী আশ্চর্য, কিছুদিন পর মার সম্পূর্ণ বিপরীত পরামর্শ দিতে লাগল। সে বলতে লাগল, ‘সিদ্ধার্থ! তুমি এখন সত্যই তপস্বী হয়েছ। আরও কঠোর তপস্যা করো, যাতে তোমার তপস্যার খ্যাতি দিগবিদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে!

আমি নিঃসন্দেহ হলাম, সিদ্ধার্থকে তপস্যার ভিতর আরও ডুবিয়ে দিয়ে তাঁকে মেরে ফেলাই মারের চক্রান্ত। সিদ্ধার্থ কিন্তু মারের এই অভিসন্ধি প্রথমে বুঝতে পারেননি। তিনি একঝোঁকা হয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাত্রা দিনের পর দিন বাড়িয়েই চললেন।

মধ্যাহ্নবেলায় তিনি আমার স্রোতে স্নানে নামতেন। আমি তাঁর দুর্বল দেহ আমার বারিধারায় ধৌত করে দিতাম। এত দুর্বল, যে-কোনো সময়ে স্রোতোবেগে ভেসে যেতে পারেন। আমি তাই আমার চলার বেগ সামান্য স্তিমিত করে দিতাম। তিনি কোনোমতে আমার বক্ষের উপর প্রসারিত বেতসশাখা ধরে স্রোত থেকে উঠে যেতেন।

কিছুদিন পর। এক নিদাঘ অপরাহ্ণে পাঁচজন ভিক্ষু সেখানে উপস্থিত হলেন। কৌণ্ডিন্য, মহানামা, অশ্বজিৎ, ভদ্র ও বাষ্প তাঁদের নাম। তাঁরাও সিদ্ধার্থের মতন দুঃখের অন্ত কোথায় তা খুঁজছেন। বহু আচার্যের নিকট গমন করেছেন, কিন্তু উত্তর কোথাও পাননি। তাঁরা উত্তরদেশ হতে এসেছিলেন। আমার জলে হস্ত-পদ প্রক্ষালিত করে তাঁরা বনের দিকে গেলেন। আর তখনই সিদ্ধার্থের তপোব্রত ধ্যানমূর্তি তাঁদের চোখে পড়ল।

তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন। কৌণ্ডিন্য বললেন, ‘কী আশ্চর্য! এমন তপস্যা কি মানুষ করতে পারে?’

মহানামা বললেন, ‘সত্যই। ইনি নিশ্চয় কালক্রমে বুদ্ধ হবেন।’

ভদ্র অগ্রসর হয়ে এসে বললেন, ‘আমার মনে হয়, অন্য কোথাও না গিয়ে আমরা এখানেই অবস্থান করি। ইনি জ্ঞানলাভ করলে নিশ্চয় আমাদের সেই জ্ঞান উপদেশ করবেন।’

অশ্বজিৎ বললেন, ‘ঠিক কথা! আমরাও এই মহাপুরুষের কৃপায় জ্ঞানী হব। দুঃখের অন্ত কোথায়, তা জানব।’

বাষ্প এদিক-ওদিক দেখে বললেন, ‘দেখুন, এই বৃক্ষের পাঁচ দিকে পাঁচটি বনস্পতি রয়েছে। আমরা এইসব বনস্পতির নিম্নে অবস্থান করি।’

মহানামা বললেন, ‘এই মহাপুরুষের অনুসরণে আমরাও তপস্যায় রত হব। এ আমাদের মহা সৌভাগ্য!’

সেই থেকে এই পাঁচজন ভিক্ষু উরুবিল্ব বনে সিদ্ধার্থের পাঁচ দিকে অবস্থান করতে লাগলেন। আমি সিদ্ধার্থের এই পাঁচজন অনুসারীকে ভালোভাবে লক্ষ করে চললাম। কিন্তু সিদ্ধার্থের মধ্যে যে-আলো আমি দেখেছিলাম, সেই আলো আমি এঁদের মধ্যে দেখতে পেলাম না।

আমি নদী। চলাই আমার ধর্ম। চলতে চলতে আমি কথা বলি। কথা বলি

আকাশের সঙ্গে, আকাশের মেঘেদের সঙ্গে। বনের তরুলতার সঙ্গে। তাদের জিজ্ঞাসা করি, ‘আচ্ছা, এই সিদ্ধার্থ যে এমন তপস্যা করে চলেছেন, কোনোদিন কি তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হতে পারবেন?’ আকাশ কথা কয় না, মেঘ উত্তর দেয় না, তরুলতা নিশ্চুপ হয়ে থাকে। কেউ যেন এ প্রশ্নের উত্তর জানে না।

তবু আমার স্রোতোশব্দে মিশে থাকে এই প্রশ্ন, এই আশ্চর্য মর্মর!

একদিন বৈকালবেলা। আলো কমে আসছে। ছায়া নিবিড় হয়ে আসছে। সিদ্ধার্থ ধ্যান থেকে উঠলেন। তাঁর ইচ্ছা হল, আমার স্রোতে একবার অবগাহন করবার। তপস্যার ফলে দেহে প্রচণ্ড তাপ অনুভূত হচ্ছে। জলের ভিতর গাত্র নিমজ্জিত করে কিয়ৎক্ষণ শান্তি পেতে চান। নিজেকে তিনি একবার প্রশ্ন করলেন, ‘এত তপস্যায় আমি পেলাম কী?’

মনের ভিতর থেকে কে যেন হাহাকার করে বলে উঠল, ‘কিছুই না।’

সিদ্ধার্থ আমার স্রোতে নামলেন। আমি তাঁর গা ধুইয়ে দিতে লাগলাম পরম যত্নে। স্নান সেরে তিনি ঘাট বেয়ে উঠতে গেলেন। শরীর এত দুর্বল, হস্ত-পদ ভীষণভাবে কম্পিত হচ্ছে। জলের উপর প্রসারিত বেতসশাখাটি ধরতে গেলেন। কিন্তু নাগাল পেলেন না। দুর্বল দেহ ঘাটের উপর লুটিয়ে পড়ল উৎপাটিত বনস্পতির মতন।

এই দেখে সেই পাঁচজন ভিক্ষু ধরাধরি করে তাঁকে তরুতলে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর সংজ্ঞা ফিরল। মহানামা নত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রশ্নের কি কোনো উত্তর পেলেন, প্ৰভু?’

সিদ্ধার্থ কম্পিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘না, এখনও নয়।’

সন্ধ্যা এসেছে। আকাশ ভরে গেছে নক্ষত্রদীপিকায়। শায়িতাবস্থায় সেই তারায় ভরা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধার্থ শুনতে পেলেন, আকাশ বেয়ে কারা যেন গান গাইতে গাইতে চলেছে। সেই গান, আমি নৈরঞ্জনা নদী, আমিও শুনতে পেলাম। কারা যেন গাইছে:

‘আমার এই সাধের বীণা, একে আমি বাজাতে পারি না, যদি এর তার শিথিল থাকে। আর যদি বীণার তার খুব শক্ত করে বাঁধি, তাহলেও এ দিয়ে কোনো সুর বিনিঃসৃত হয় না। বীণাকে বাঁধতে হবে মধ্যম টানে, খুব শিথিলও নয়, খুব শক্তও নয়। তবেই তাতে বেজে উঠবে অনুপম সুর…’

সিদ্ধার্থ নিজেকেই বললেন, ‘তাইতো। আমারই ভুল হয়েছিল। রাজপ্রাসাদে ভোগসর্বস্ব জীবনে আমি আমার ইন্দ্রিয়নিচয়কে শিথিল করে দিয়েছিলাম। তাই সেখানে আমি কোনো সমাধান পাইনি। আর এই অরণ্যে আমি নিজের দেহমনকে এত কঠিন তপস্যার বন্ধনে বেঁধেছি যে, আজ এই শরীর যাবার জোগাড় হয়েছে। আজ থেকে আমি আমার শরীরকে মনকে বিলাসিতাতেও ভাসাব না, কঠোরতাতেও শুষ্ক করে দেব না। মধ্যপন্থা—মাঝের পথই সঠিক।’

এই ভেবে পরের দিন থেকে তিনি ভিক্ষার্থে নদীর পরপারের গ্রামে বহির্গত হতে লাগলেন। ভিক্ষায় যা পান, তাই তিনি আহার করেন। কেউ পরিধেয় বস্ত্র দিলে তাই তিনি পরিধান করেন। ভিক্ষাশেষে তিনি আবার সেই বনস্পতিনিে প্রত্যাবর্তন করে ধ্যানচিন্তায় ডুবে যান।

উগ্র তপস্যার ভাব পরিত্যক্ত হয়ে তাঁর দেহে আবার তাঁর আগের সেই সতেজ সৌম্যকান্তি ফুটে উঠতে লাগল। মনের ভিতর জেগে উঠল সহজ প্রফুল্লতা।

কিন্তু সিদ্ধার্থের আচরণগত এই পরিবর্তন পাঁচজন ভিক্ষুর পছন্দ হল না। অশ্বজিৎ বললেন, ‘এ কী হল? ইনি তো তপস্যা পরিত্যাগ করলেন!’

কৌণ্ডিন্য হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, না, মনে হয়, এঁর আর বুদ্ধ হওয়া হল না।’

বাষ্প বললেন, ‘আমরা তবে এখন কী করব?’

মহানামা বললেন, ‘চলো, আমরা চলে যাই। এঁর কাছে কাছে থেকে আর কোনো লাভ নেই।’

ভদ্র বললেন, ‘বেশ কথা। আমরা অন্য কোনো তপস্বীর অনুসন্ধান করি চলো।’

এইভাবে সেই পাঁচজন ভিক্ষু সিদ্ধার্থকে পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। আমি তাঁদের গমনপথের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখলাম। মনে হল, হয়তো একদিন এঁদের সঙ্গে সিদ্ধার্থের দেখা হবে। সেদিন হয়তো এঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন। কিন্তু সেদিন কতদূর?

সিদ্ধার্থ একেবারে নির্জন হয়ে গেলেন। যে একাকী, সেই নির্ভয়। সিদ্ধার্থ আরও গভীরভাবে তাঁর নিজের মনের ভিতর ডুব দিলেন। আরও অন্তর্মুর্খ, আরও একাগ্র, আরও তন্ময়।

আর তাঁর সাধনের আসনখানির নিম্নে নিরন্তর গড়িয়ে চললাম আমি— সিদ্ধার্থবান্ধবী সাধনসাক্ষী নৈরঞ্জনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *