১১. ময়ূখ লিখিতেছে….

১১. ময়ূখ লিখিতেছে….

পূর্বের অধ্যায় লিখিবার পর বহুদিন কাটিয়া গেল, কিছুই লেখা হইল না। আটপৌরে জীবন কাটাইয়া চলি, বাজার-হাট, স্কুলে পড়াইতে যাই, ঘরে ফিরিয়া আসি, নিজের জন্য দুইটা ভাতডাল ফুটাইয়া লই। ইহার মধ্যেই রচনাটির নিকট মধ্যে মধ্যে আসিয়া বসি, পুরানো রচনা পড়ি, কিন্তু নূতন কিছু লিখিতে আর পারি না। বর্ষা ঘনঘোর নামিয়াছে। দিনের বেলায় ঘর অন্ধকার হইয়া থাকে, লেখার টেবিলে আলো জ্বালাইয়া বসিতে হয়। সারা রাত্রি বৃষ্টি হইলে দিবাভাগে বাজার করিতে গেলে দেখি, পথে ঘাটে অলিতে-গলিতে জল জমিয়াছে। রিকশাগুলি চালকের মাথার উপরেও ছাউনি টানিয়া লইয়াছে, দেখিতে ঠিক যেন এ স্বল্পস্থায়ী পথসরোবরে ছই তুলা নৌকার ন্যায় লাগে। আমার জানলার ওইদিকে সেই কদমগাছগুলির ফুল বৃষ্টিতে ভিজিয়া ভিজিয়া খ্যাতলাইয়া গিয়াছে, তাহাদের পূর্বতন সে-শোভা আর নাই। সারি সারি সুপারিগাছের প্রসারিত শাখা বৃষ্টিতে ভিজিয়া আকার হারাইতেছে। এইসব দৃশ্য অলসভাবে দেখিয়া দেখিয়া দিন কাটাই।

লিখিতে কেন জানি আর ইচ্ছা করে না। লিখিবার অনেক আছে, কিন্তু উঠিয়া বসিয়া সে-সকল কথা লিপিবদ্ধ করিবার কী যে ক্লান্তি! বাজার করিতে ক্লান্তি, রান্না করিতে ক্লান্তি, স্কুলে যাইতেও ক্লান্তি, যাহা করি সবই ক্লান্তির সহিত করিয়া থাকি। শুধু পড়িয়া পড়িয়া ঘুমাইতে ইচ্ছা করে। ঘুমাইলেই দীর্ঘ দীর্ঘ সব স্বপ্ন, কোন যেন অস্পষ্ট নদীতীর… জন্মান্তরের কোন গ্রাম… কে এক নারী প্রণয়কাঙ্ক্ষিণী… এক তরুণ শ্রমণ—এইসব এলোমেলো ভাসিয়া উঠে। ইহা তো মহা জ্বালা হইল! কেন এত আলস্য?

কলেজজীবনের এক বন্ধু ছিল, এখন ডাক্তার হইয়াছে, অনেক দিন পর তাহাকে ফোন করিলাম। এ কথা সে-কথা কহিবার পর আমার এই প্রকার অসুস্থতার কথা বলিলাম। সে আমাকে তাহার ডিসপেনসারিতে আসিতে বলিল। ডাক্তার বন্ধুটি দেখিয়া শুনিয়া কয়েকটি টেস্ট করিবার জন্য লিখিয়া দিল। ব্লাড টেস্ট করাইলাম। ব্লাড রিপোর্ট আসিল। ভিটামিন ডি-র সাংঘাতিক অভাব দেখাইতেছে। ইহারই ফলে শরীরে ট্রাইগ্লিসারাইড বাড়িয়া গিয়াছে।

ডাক্তার বন্ধুটি ঔষধ লিখিয়া দিল। তাহাই খাইতেছি। ইহা তিন মাসের উপর খাইতে হইবে। তবেই নাকি উৎসাহ আসিবে। ইহা সত্য। কিন্তু আমার মনে, এইরূপ ক্লান্তির অন্য কারণ অনুভূত হইতেছে। এই যে দিনে রাত্রে আড়াই হাজার বৎসরের ভিতর দিয়া মনের আগুপাছু যাতায়াত, ইহাই মনকে ক্লান্ত করিতেছে বোধ হয়। ইহা তো আর ডাক্তারকে বলিতে পারি না। মনের এরূপ অভ্যাস ছাড়িয়া থাকিতেও পারি না। উহাই মনের স্বাভাবিক গতিধর্ম হইয়া উঠিয়াছে সারাজীবন ধরিয়া। এক্ষণে ইহার দিকবদল করিতে পারিব না। এক জীবনে যেন দুইটা জীবনযাপন করিতেছি। আমি ময়ূখ… আবার আমিই সৌদাস; বড়ো আশ্চর্য কথা!

আবার বৃষ্টি আসিল। সকাল হইতে ঘোর বর্ষণ। আজ আর স্কুলে যাইতে ইচ্ছা করিতেছে না। গতকাল কয়েক দিনের বাজার করিয়া আনিয়াছি, তাই বাজারে যাইবারও আর প্রয়োজন নাই আজ। ঘরে বসিয়া কী করিব কী করিব ভাবিতেছি, খাতা খুলিয়া বসিলাম। সৌদাসের অধ্যায়টি শত শত অক্ষরে ভরিয়া আছে। উহাই পড়িতে লাগিলাম। সহসা ইহার ভাষা সাধু হইল কেন? ইহার পূর্ব পর্যন্ত তো বেশ চলিত ভাষায় লিখিতেছিলাম। হঠাৎ সাধুভাষা কেন?

মনের ভিতর তলাইয়া ইহার কারণ অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। মনে হইল, সাধুভাষার ভিতর একটা আর্কাইক সৌন্দর্য আছে বটে! আর্কাইক বলিয়াই উহার সহায়তায় আমার মনের অবচেতনে ঢুকিয়া পড়া সহজ হইতেছে। অতীত যুগের হারানো সেই ‘আমি’—সেই সৌদাসের সহিত আজিকার এই ‘আমি’ ময়ূখের সংযোগ সাধন—কিংবা ভালো করিয়া বলিতে গেলে অতীতের সকল কিছুর সহিত সাম্প্রতিকের সংযোগ এই সাধুভাষাতেই সম্ভব—ইহাই মনে হইতেছে। ইহার পূর্বে যে-চলিত ভাষায় অধ্যায়গুলি লিখিয়াছিলাম, তাহাতে অসুবিধা হয় নাই, কারণ ওই অধ্যায়গুলিতে ‘আমি’ নাই। পূর্বের ওই অধ্যায়গুলিতে বস্তুসমূহ ও ব্যক্তিবর্গের নিরপেক্ষ বর্ণনা দিয়াছি—উহা বড়ো দূর হইতে দেখা। কিন্তু এখন যাহা লিখিতেছি, ইহার সহিত আমার আঁতের ভাব মিশিয়া আছে। ফলত, মন ক্রমাগত অতীতের সহিত মিশিয়া যাইতেছে, পূর্বের ন্যায় দূরে দাঁড়াইয়া ঘাড় ঘুরাইয়া সিংহাবলোকন করিতে পারিতেছে না। তাই, এই সাধুভাষা, সাধু ক্রিয়াপদ, সাধু সর্বনাম স্বতই উঠিয়া আসিতেছে।

আসুক। তাহাতে আমার অসুবিধা নাই। যে-ভাষায় সহজে নিজের অবচেতনে জমিয়া থাকা চিত্রাবলি ও কথামঞ্জরীকে মুক্তি দিতে পারি, তাহাতেই লিখিব। ভাবিতেছি, এখন হইতে পরের অধ্যায়গুলি এই সাধুভাষাতেই লিখিব। ইহাই আমার ভাষা, আমার জাতিস্মরকল্প প্রাণের অভিব্যক্তি।

সৌদাসের ভিতর গৃহস্থ সংস্কার অল্পবিস্তর ছিল। কিন্তু সবার উপরে ছিল তাহার প্রেমিক স্বভাব। সেই সৌন্দর্যমুগ্ধ প্রেমিক-স্বভাবের জন্যই সুজাতা তাহার কাছে আসিয়াছিল। তাহার প্রেমের প্রতিমা ও কাব্যের নায়িকা হইয়া উঠিতে পারিয়াছিল। তাহারা ঘর বাঁধিয়াছিল। কিন্তু সেই গৃহের দ্বারপ্রান্তে একদিন সিদ্ধার্থের প্রশান্ত অবয়ব দেখা দিল। উহা কবি সৌদাসকে পাগল করিল। সৌন্দর্য হইতে অপার্থিবতার উচ্চতায় মন উঠিয়া গেল। সিদ্ধার্থের কৃপায় সিদ্ধার্থের ভাব সৌদাসের মনে প্রবেশ করিল বটে, কিন্তু সৌদাসের আধার সে-মহৎ ভাব ধারণ করিবার উপযুক্ত ছিল না।

ক্ষুদ্র আধারে বৃহৎ ভাব ঢুকিয়া তোলপাড় করিয়া দিল। শেষে এমন হইল যে, সৌদাস সেই মহাভাবের অত্যাচার হইতে নিষ্কৃতি পাইবার নিমিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিল। সিদ্ধার্থের কৃপাতেই সেই ভাবের উপশম হইল বটে, কিন্তু যাহা সে স্বল্পকালের জন্য পাইয়াছিল, তাহা হারাইয়া বড়োই কাতর হইল। আত্মক্ষোভ উৎপন্ন হইল। তাহার পর আবার সেই গার্হস্থ্য জীবন। কিন্তু ইহাতেই কি আর নিষ্কৃতি হইল?

হইল না। কেন-না, একবার সেই ভাব যে আস্বাদ করিয়াছে, সে বহু চেষ্টা করিয়াও সেই আস্বাদের স্মৃতি হইতে মুক্তি পাইবে না। একবার যে এই জগত্যবনিকা ছিঁড়িয়া ফাঁড়িয়া দেখিবার সুযোগ পাইয়াছে, বিশেষত এই জগতের ঊর্ধ্বে আর-একটা সেই জগৎছাড়া ভাব একবার যাহার মস্তিষ্ককে অধিকার করিয়াছে, সে-ভাবের আবেশ সারিয়া গেলেও মন বারবার ওইদিকে যাইবার জন্য ছটফট করিতে থাকে। ধরিয়া যদি লই, সুজাতাকে লইয়া ইহার পর সে সুখে কালাতিপাত করিয়াছিল, তথাপি সেই সুখের ভিতরেও সেই জগদতীত ভাবের পুনরাবর্তন চলিত, সুসজ্জিত সংসারের প্রাকার ভেদ করিয়া সে-অপার্থিব ভাবের মুকুল মুখ তুলিত, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।

সৌদাস মরিয়া গিয়াছে। তাহার পর সহস্র সহস্র বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। পৃথিবী যেমন সূর্যের চতুর্দিকে ঘুরিতেছিল, তেমনই ঘুরিতেছে। শরৎ-বসন্ত-নিদাঘ-প্রাবৃট ধরিত্রীর উপর ঘুরিয়া ফিরিয়া আসিতেছে। তাহার পর ময়ূখ আসিয়াছে। ময়ুখ আর সৌদাস কি একই ব্যক্তি? এক নহে। তবে কি ভিন্ন? না, তাহাও নহে। তাহা হইলে কী?

এইখানে আমার মনে একটি প্রাচীন উপমা ভাসিয়া উঠিতেছে। প্রাচীন বৌদ্ধ দার্শনিকগণ ওই উপমাটি ব্যবহার করিতেন। গ্রিক বীর মিলিন্দের সমীপে বৌদ্ধ পণ্ডিত নাগসেনা এই উপমাটি ব্যবহার করিয়াছিলেন। ধরা যাউক, একটা প্রদীপ সন্ধ্যা হইতে নিশান্ত অবধি জ্বলিতেছে। প্রদীপে ঘৃত ইন্ধনরূপে ব্যবহৃত হইতেছে। প্রদীপের সলিতায় আগুন দেওয়া হইয়াছে। এখন এই যে শিখা, ইহা তো প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হইতেছে। প্রতি মুহূর্তে ঘৃত পুড়িয়া সলিতা দগ্ধ হইয়া নূতন নূতন শিখার উদ্ভব ঘটাইতেছে। এই ক্ষণের শিক্ষা পরক্ষণের শিখা হইতে পৃথক। তাহা সত্ত্বেও সমস্ত রাত্রি ধরিয়া একটাই শিখার প্রতীতি হইতেছে। কিন্তু এই প্ৰতীতি ভ্রান্ত। সন্ধ্যার প্রদীপশিখা, মধ্যরাত্রির প্রদীপশিখা ও নিশান্তের প্রদীপশিখা পৃথক পৃথক। প্রতি মুহূর্তেই ভিন্ন ভিন্ন প্রদীপশিখা উৎপন্ন হইতেছে। তথাপি, এই সকল ভিন্ন ভিন্ন শিখার ভিতর দিয়া একত্ব প্রতীয়মান হইতেছে। আবার এক মুহূর্তের প্রদীপশিখা পরমুহূর্তের প্রদীপশিখার সহিত সম্পূর্ণত ভিন্নও নহে। কিছুটা আছে, কিছুটা গিয়াছে।

এই একই ভাবে সৌদাস পুড়িয়া ময়ূখ হইয়াছে। মধ্যে আড়াই হাজার বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। এই আড়াই হাজার বৎসর ধরিয়া সৌদাস ও ময়ূখের মধ্যস্থলে কত আসিয়াছে, কত গিয়াছে। সৌদাস পুড়িয়া ‘ক’ হইল, ‘ক’ মরিয়া ‘খ’ হইল, ‘খ’ মরিয়া ‘গ’ হইল… তাহার পর একসময় ‘ময়ূখ’ হইল। কে কাহার সহিত সম্পূর্ণ এক? কে বা কাহা হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন? কিছুটা গিয়াছে, কিছুটা পড়িয়া রহিয়াছে। সৌদাসের মন কিছুটা ভাঙিয়া চুরিয়া ময়ূখের মন হইয়াছে। তাই ময়ূখের মনে সৌদাসের স্মৃতি উঠে। এমন করিয়া ভাবিলে তবে আমার এই অসুখের একটা ব্যাখ্যা পাই। জানি না, ইহা আমার মনগড়া ব্যাখা কিনা

সে না হয়, যাহা হইবার তাহাই হল, কিন্তু সুজাতার কী হইয়াছে? সৌদাস মরিয়া গিয়াছে আর সুজাতা চিরজীবিনী হইয়া রহিয়াছে, তাহা তো আর হইতে পারে না। সুজাতাও হারাইয়া গিয়াছে। তাহার দেহের পূতাস্থিগুলি নৈরঞ্জনা নদী ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে সুদূর সমুদ্রে। কালের নিয়ম কে রোধিবে? কালের সেই স্রোতোপথ বাহিয়াই হয়তো সুজাতা পুনঃপুনঃ জাত হইয়াছে, পৃথিবীর এই খেলাঘরে বারংবার ফিরিয়া আসিয়াছে। হয়তো কোনো জন্মে পাখি হইয়াছে, আকাশের নিবিড় নীলিমার সহিত মিতালি পাতাইয়াছে। কখনও ইউফ্রেটিস নদীর ধারে কোনো ঘাস-মাতার সুস্বাদ অন্ধকারের ভিতর নামিয়া ঘাসফুল হইয়া জন্মিয়াছে, নদীর বাতাসে মাথা দুলাইয়া দুলাইয়া শ্রুতিপারের শব্দে গান গাহিয়াছে। হয়তো বনের হরিণী হইয়া জন্মিয়াছে, অরণ্যের শ্যামশোভার ভিতর দুরন্ত হলুদ আগুনের শিখার ন্যায় ছুটিয়া গিয়াছে। হয়তো কোনো জন্মে নির্জন কোনো প্রাসাদে রাজকন্যা হইয়াছে, বাতায়নপথে মুখ রাখিয়া তাহার স্বপ্নের রাজকুমারের জন্য দিন গণিয়া গণিয়া জরাগ্রস্তা হইয়াছে। হয়তো অপর কোনো জন্মে গৈরিক বাস পরিহিত শ্রমণ হইয়াছে, মধ্যদিনে ভিক্ষা লইয়া ফিরিয়া আসিয়া সোমপুরী বিহারের ক্ষুদ্র কক্ষে মাধ্যমিক-কারিকার পুথির ছিন্ন পৃষ্ঠার উপর আনতগ্রীব হইয়া বসিয়া রহিয়াছে।

কিন্তু তাহার পরের পরের জন্মগুলিতে সুজাতা অন্য কাহাকেও আপন করিয়া পাইয়াছিল, ইহা আমার বিশ্বাস করিতে মন চাহে না। সে যে বলিয়াছিল, সে শুধু আমারই, অন্য কাহারও নহে। আমার বিশ্বাস, এই আড়াই হাজার বৎসরের অলাতচক্রে চংক্রমণ করিতে করিতে শত শত জন্মমৃত্যুর ভিতর দিয়া সে আমাকেই খুঁজিয়া ফিরিয়াছে, কিন্তু পায় নাই। আমি যেমন তাহাকে খুঁজিতেছি, সে-ও আমাকে খুঁজিয়া ফিরিতেছে। এখন সে কোথায়? এই পৃথিবীর পথের ধুলায় সে কই আছে? ঘাস, লতা, উদ্ভিদ, মানুষ, পাখি—লীলাবৈভব কোন সত্তার রূপে তাহার ইদানীং আত্মপ্রকাশ ঘটিয়াছে, আমি জানি না। আমি শুধু তাহাকে অন্বেষণ করিয়া ফিরিতেছি, দিনে-রাত্রে, আলোকে-অন্ধকারে।

কিন্তু এইসব লইয়া ভাবিতে ভাবিতে বসিয়া থাকা তো চলে না। আমার বর্তমান জীবনের দাবিকে কী করিয়া অগ্রাহ্য করি? উঠিতে হইবে, স্কুলে যাইতে হইবে। প্রতিদিন ছুটি লওয়া চলে না। দিন ফুরাইয়া রাত্রি চলিয়া আসে, রাত্রি ঘুরিয়া ভোর। সকাল সকাল স্নান সারিয়া দুইটা আহার করিয়া ব্যাগের ভিতর ছাতাটা মুড়িয়া ঢুকাইয়া পথে বাহির হই। বৃষ্টি আজ একটু ধরিয়াছে। দোকানগুলির ঝাঁপ খুলিয়াছে। পথ হইতে জল নামিয়া গিয়াছে। রিকশা টিন টিন শব্দ করিতে করিতে চলিতেছে। আমিও মোড়ের মাথা হইতে একটা অটো ধরিয়া স্কুলে রওয়ানা হইয়া গেলাম। স্কুলের বড়ো গেটটার নিকট স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা কলকল শব্দে কথা কহিতেছে। ধীরে ধীরে টিচার্স রুমে আসিয়া বসিলাম। একটু পরেই প্রার্থনার ঘণ্টা বাজিবে। বয়স্ক ইতিহাসের শিক্ষক মোহিতদা আমাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কাল স্কুলে আসোনি? কী হল?’

উত্তর দিলাম, ‘শরীরটা বড়ো সুবিধের নয়। তাই কাল নিজেকেই নিজে ছুটি দিয়েছি।’

মোহিত মৈত্র চক্ষু হইতে চশমা খুলিয়া রাখিয়া চিন্তিত স্বরে বলিলেন, ‘সে কী? ডাক্তার দেখিয়েছ? একা মানুষ, শরীরের যত্নটত্ন তেমন করো না।’

আমি বলিলাম, ‘না, ডাক্তার দেখানোর মতন অবস্থা নয়, মোহিতদা! আসলে ওয়েদারটাই এমন যে…’

‘সে কথা আর বোলো না, ভাই! এ যা শুরু হয়েছে, যেন আকাশ ফুটো করে ঝরছে। আজ তবু একটু ধরেছে, তা না হলে এ-ক’দিন, ইস্কুল… বাজার… টিউশনি—একেবারে নাজেহাল অবস্থা।’

একটু পরেই স্কুলের প্রার্থনাসভা হইয়া গেল। প্রথম পিরিয়ডের ঘণ্টা পড়িল। আমি ইলেভেন সায়েন্সের ক্লাসটিচার, গুটি গুটি পায়ে অ্যাটেন্ডন্স রেজিস্টার লইয়া ক্লাসে উপস্থিত হইলাম। ছাত্রদের হাজিরা লইয়া অঙ্কের বই খুলিয়া নূতন অধ্যায় আরম্ভ করিলাম। কোয়াড্রাটিক ইকুয়েশন অর্থাৎ দ্বিঘাত সমীকরণ।

এইসব সমীকরণের দুইটি অজ্ঞাত বীজ। ওই দুইটি বীজের ভিতর প্রদত্ত সম্পর্ক হইতে অজ্ঞাত সমীকরণটিকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। ইহা বুঝাইতে বেশি বেগ পাইতে হয় না। তাহার পর ইহারই একটু সামান্য রকমফের হইতে শুরু করিল। যদি কোনো প্রদত্ত দ্বিঘাত সমীকরণের বীজ দুইটি ‘ক’ ও ‘খ’ হয়, তবে সেই দ্বিঘাত সমীকরণটি বাহির করো, যাহার বীজদ্বয় হইবে ‘ক+১/খ’ এবং ‘খ+১’ ইত্যাদি।

বোর্ডের উপর মার্কার পেন খসখস করিয়া চলিতে লাগিল। ছাত্রছাত্রীরা মাথা নীচু করিয়া যে যাহার খাতায় আঁক কষিতেছে। মাঝে মাঝে মুখ তুলিয়া বোর্ডে অঙ্কটি কোন পথে যাইতেছে, লক্ষ করিতেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ হইয়া গেল।

এসব অঙ্ক সহজেই শেষ হইয়া যায়। কিন্তু জীবনের অঙ্ক সহজে মেলে না। সহসা মনে হইল, আমি আর সুজাতা যেন একটি দ্বিঘাত সমীকরণের দুইটি বীজ। একটি খুঁজিয়া বাহির করা হইয়াছে। সে আমি। ময়ূখ কিংবা সৌদাস। কিন্তু অপর বীজটি খুঁজিয়া পাই নাই। উহা অজ্ঞাতই থাকিয়া গিয়াছে।

সারাটা দিন ক্লাসে-অবসরে কাটিয়া গেল। স্কুলের ছুটি হইলে ভাবিলাম, কলেজ স্ট্রিট যাইব। অনেক দিন যাওয়া হয় না। কবি সুভাষ স্টেশন হইতে মেট্রো ধরিলাম। সেন্ট্রালে নামিলাম। ফুটপাথ ধরিয়া পুরানো বইয়ের পসরার উপর চোখ রাখিয়া হাঁটিতেছি।

সাময়িক পত্র ও অন্যান্য গ্রন্থাদির পুস্তক-বিপণি। এটা ওটা নাড়াচাড়া করিতেছি। দুই-একটা পত্রিকা ক্রয় করিলাম। অবসরে পড়া যাইবে। প্যারামাউন্টের শরবত দোকান হইতে শরবত পান করিলাম। আকাশ আবার ঘন হইয়া আসিতেছে। ভাবিলাম, সিগনেট প্রেসের দোকানে যাইব। একটা সিগারেট ধরাইলাম।

মহাবোধি সোসাইটির নিকট আসিয়াছি, একটা ধুলাঝড় উঠিয়া থামিয়া গেল। শো-রুমের কাচের ডিসপ্লের ওইদিকে একটা বই আমার নয়ন আকর্ষণ করিতে লাগিল। জ্ঞানবজ্রের লেখা মিলারেপার জীবনী। ভাবিলাম, ইহা একবার উলটাইয়া পালটাইয়া দেখিতে হইবে। ভিতরে গেলাম। বইটি হাতে তুলিয়া পাতা উলটাইতেছি। মহাতাপসের সাধক-জীবন। বইটির সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ হইতেছে। কিনিলাম। ব্যাগের ভিতর রাখিয়া বাহির হইতেছি, দেখিলাম বৃষ্টি বেশ জোরে জোরে পড়িতেছে। কী করিব?

মহাবোধির ধ্যানঘর এখন নিশ্চয়ই খুলিয়া গিয়াছে। খাতায় নাম সই করিয়া উপরে গেলাম। প্রার্থনাগৃহের দ্বার উন্মুক্ত। কিন্তু ভিতরে কেহ কোথাও নাই। বড়ো বড়ো বুদ্ধমূর্তি। সম্মুখে পূজার আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি। হলের ভিতর ফরাস পাতা।

বসিলাম। ধূপের ভারী একটা ঘ্রাণ ঘরময় ঘুরিতেছে। চোখ বুজিয়া আসিল। মন ধীরে ধীরে অন্তর্মুখ হইতেছে। বাহিরের শব্দ যেন অনেক দূরে সরিয়া গিয়াছে। মনের ভিতর কতগুলা ছবি উঠিতেছে। আড়াই হাজার বৎসর পূর্বের অস্পষ্ট ছবি সব।

অস্পষ্ট ক্রমশ স্পষ্ট হইল। মনে হইল, সৌদাসের কথা লিখিয়াছি। তাহার চক্ষু দিয়া সিদ্ধার্থকে দেখিয়াছি। কিন্তু সুজাতার চক্ষু দিয়া তো দেখি নাই! সুজাতা কেমন করিয়া সৌদাসকে ভালোবাসিয়াছিল? কেমন করিয়া সিদ্ধার্থের দর্শন পাইয়া জীবনকে কৃতকৃতার্থ করিয়াছিল? সে-সকল কথা বাহির করিয়া আনিতে হইবে। সুজাতার চক্ষু দিয়া পুনরায় দেখিতে হইবে। ছবির পর ছবি আসিতেছে….

সে ধীরে ধীরে ফুটিয়া উঠিতেছে। নদীতীরের প্রস্ফুট প্রসূন। তাহার সুরভি- সৌন্দর্যে আকাশ আলো হইতেছে। কোন এক কবিকে ভালোবাসিল। কিন্তু উহাই তো সব নহে। তাহার পরমান্নের পাত্র পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ভরিয়া উঠিবে যে! তাহাই তো নিবেদিত হইবে। ইতিহাসের এক অনুপম ক্ষণ রচিত হইবে। বুদ্ধজীবনীকারগণ সেই দৃশ্য কুড়াইয়া লইয়া কাব্য রচনা করিবেন। ইতিহাসের সহিত কবিতার মিলন হইবে।

কিন্তু সে-সকল কথা অনেক পরে। তাহার পূর্বে সুজাতার ক্রমবিবর্তনের কথা বলিতে হইবে। সুজাতার বয়ানেই বলিতে হইবে। সুজাতা কী দেখিয়াছিল, কী নিবেদন করিয়াছিল, কী পাইয়াছিল, তাহারই মুখে ভাষা দিতে হইবে। তবেই তো মূক ইতিহাস কথা বলিয়া উঠিতে পারিবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *