১৪. স্বপ্নকথা লিখেছে ময়ূখ
স্বপ্নের ভিতরে আলোর পাখিরা এসে কথা বলে। সাদা-কালো ছিটছিট ডানার পাখিরা সব। পাখি নয়, তারা সব স্মৃতি-সংস্কার। এ জন্মের নয় শুধু, জন্মজন্মান্তরের আলো-আঁধারের রং সেইসব স্মৃতিপাখিদের ডানায় আঁকা। কে এঁকেছে ডানা জুড়ে এমন বিমর্ষ অবসাদ? সেই পটুয়াকে আমি খুঁজি, পাই না কোথাও। শুধু নীল স্বপ্নের উঠানে খইফুল খেতে নামে আলোর পাখিরা।
পরিযায়ী পাখি এরা; উড়ে যায় স্বপ্নাত্তরে। আবার সেখানে ঘরবাঁধাবাঁধি ছল। আবার প্রণয়খেলা, মুখে মুখ রাখা। ডানায় ডানায় ঘষা নরম আদর। বুকের ভিতরে মুখ গুঁজে ঘুম যাওয়া। স্বপ্নের ভিতরে স্বপ্ন, কাহিনির ভিতরে কাহিনির রূপকথা। ডানার অলীক ভেঙে আবার উড়ান।
এখন এখানে আমি আর ময়ূখ নই কোনো… একদিন সৌদাস ছিলাম। সুজাতার স্বামী। তারপর কোনো জন্মে উদাত্ত হয়েছি। সুজাতা হয়েছে মল্লিকা। সৌদাস- সুজাতা কোনো জন্মে উদাত্ত-মল্লিকা। এইভাবে পালটে যায় সব। আবার কোনো জন্মে ময়ূখ হব। সুজাতামল্লিকা হবে বনের হরিণী।
স্বপ্ন এসে ভুলিয়ে দিয়েছে সব। সেই দিনটিতে ফিরে গেছি যেন। মাঘীপূর্ণিমার মেলা। অপরাহুকাল। নদীতীরে মেলাটি বসেছে। বিহারের থেকে মেলা দেখব বলে ভিড়ের ভিতর হারিয়ে গিয়েছি। এসেছে পসরা কত দূর দূর দেশ থেকে। বিপণি বিতান, মাদারির খেলা, ভোজবিদ্যাজীবী কিছু ঐন্দ্রজালিক। মেঠো সুরে গান গায় গ্রাম্য যত গায়কের দল। ঘৃতপক্ক আহার্যের থালি। মহার্ঘ বস্তুর ভারে সমৃদ্ধ আপণ। সেইখানে জমে ভিড় ধনী, রিক্ত যত মানুষের।
নদীর ঘাটের কাছে দেখা হল। সে পরেছে ময়ূরকণ্ঠিরঙা নীলাভ দুকূল। শ্বেত উত্তরীয়ে ঢাকা আছে বক্ষোজ কুসুম। ভ্রমরের মতো চোখে আমাকে সে ডাক দিল অপাঙ্গ দৃষ্টিতে। আমি ভাবলাম, সে কি ডাক দিল আমাকেই?
কাছে যাই। বলি তাকে, ‘কী নাম তোমার?’
‘মল্লিকা। কন্যা আমি বিভবশ্রেষ্ঠীর। দূরে ওই বনবীথি। ওইখানে গ্রাম। তুমি কি ভিক্ষু কোনো মহাবিহারের?’
‘আমি ভিক্ষু উদাত্ত। প্রব্রজিত। সারনাথে আমাদের সঙ্ঘারাম। সেইখানে থাকি।’ সেই নদীতীরে দেখা। মনে হল, কত চেনা জন্ম জন্ম আগে। মনের ভিতর নীড়চেতনায় স্মৃতির পাখিরা ডাকে অবিরল। তাকে আমি তখনই চিনেছি।
আমাদের সঙ্ঘারামে মিতবাক নামে এক স্থবির ছিলেন। একদিন মধ্যদিনে আমি আর আমার এক বন্ধুশ্রমণ সুনন্দ–স্থবির মিত্রবাকের কাছে বসে ছিলাম। জল্পনা আলাপে কাটছিল কিছুটা সময়। হঠাৎ বৃদ্ধ স্থবির আমাকে বলেছিলেন, ভিক্ষু উদাত্ত! আমি দেখছি, তোমার ভিতরে একদিন জেগে উঠবে জন্মান্তরের স্মৃতি।’
তখন এসব কথা মনে হয়েছিল কোনো অলস কৌতুক। কিন্তু আজ মেলাশেষে নদীটির ঘাটে মল্লিকাকে দেখে মনে পড়ল সব। বহু জন্ম আগে সে ছিল সুজাতা আর আমি তার কাব্যের প্রণেতা সৌদাস।
সেই দেখাশোনা শুরু হল। তারপর বহুদিন বিহার থেকে চলে গেছি দূর বনে। সেইখানে সে আসত। আমার অচিনপারের দূতী। আমি তাকে একটু একটু করে চিনলাম। চোখে চোখ, হাতে হাত রেখে কত কথা। সেইসব কথা মঠে ফিরে লিখে রাখতাম।
তাকে বলেছিলাম, ‘অতীত জন্মের কথা মনে পড়ে?’
সে বলেছিল, ‘না।’
বলেছিলাম, ‘মনে নেই সেই গ্রাম গোপীনাথপুর? নৈরঞ্জনা নদী? পরপারে উরুবেলা বন? একজন ধ্যানশীল তপস্বী শ্রমণ ভিক্ষার্থে এসেছিল আমাদের দ্বারে? পায়েসের পাত্র শিরে তুমি গিয়েছিলে একদিন বৃক্ষদেবতার থানে। মনে নেই এসব তোমার?’
আঁধার ঘনালো মুখে। মাথা নীচু করে সে আনমনে বলেছিল, ‘মনে নেই। কিছু মনে নেই।’
মহাবিহারে জলপাত্রের পাশে পুস্তকাধারে রেখেছিলাম আমার রচয়মান কাব্যটি। মল্লিকা সে-কবিতার নায়িকা। লিখেছিলাম, মল্লিকাকুসুম। এখন রাত্রি। তোমার পরিযায়ী পাখির মতন করপুট দুটি মনে পড়ছে খুব।
একদিন সেই কাব্য বিহারের স্থবিরদের চোখে পড়ে। তারপর প্রতিমোক্ষ সভা আহূত হয়। প্রণয়কাব্য কেন আমি লিখেছি প্রব্রজিত ভিক্ষু হয়েও, প্রশ্ন উঠেছিল। স্থবিরেরা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কে এই মল্লিকা?
আমি বলেছিলাম, ‘এক শ্রেষ্ঠীকন্যা। আমার কাব্যের নায়িকা।’
তুমি কি জানো না, ভিক্ষুর পক্ষে এই আচরণ গর্হিত অপরাধ? জানো নাকি, এ যে পাপ!’
‘প্রণয় অপরাধ নয়। কাব্য—সে-ও নয় পাপ। আমার কোনো পাপবোধ নেই, স্থবির। মল্লিকা শ্রেষ্ঠীকন্যা—সে আমার প্রিয়া পূর্বজনমের।’
‘এখনই তুমি সঙ্ঘের কাছে অপরাধ স্বীকার করে প্রতিমোক্ষপাঠ করো। সঙ্ঘের এমনই নির্দেশ।’
প্রতিমোক্ষ পড়িনি আমি। তখন আমাকে বলা হল, বিহার ছেড়ে চলে যেতে। সেইদিনই আমি সঙ্ঘ ছেড়ে চলে যাই। সঙ্গে ছিল মল্লিকাকাব্যের পুথি।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, বিভবশ্রেষ্ঠী কন্যা মল্লিকাকে নিয়ে চলে গেছেন পারাদ্বীপে। হয়তো বাতাসে ভাসছিল কথা। কন্যার প্রণয়প্রার্থী প্রব্রজিত ভিক্ষু এক। এ যে কী বিষম পাপ! হয়তো তাই, বিভবশ্রেষ্ঠী কন্যাসহ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন বহুদূরে।
আমি বিহার ছেড়ে নামলাম পথে। কত গ্রাম, কত জনপদ, কত তীর্থে কেটে গেল কাল। পথিপার্শ্বে, গ্রামপ্রান্তে, নির্জন মন্দিরে রাত্রি কাটাই। শ্রমণজীবন আমাকে শিখিয়েছে অনিশ্চয়তার সঙ্গে কীভাবে বন্ধুত্ব করতে হয়। ঘর ছেড়েছি ঊষসী কৈশোরে। আর আজ মধ্যযৌবনে ছেড়েছি মঠের আমি নিশ্চিন্ত আশ্ৰয়।
ভাবলাম, এই উত্তরাপথ ছেড়ে চলে যাব দক্ষিণে। সে অনেক পথ। তাতে কোনো ভয় নেই। মৃত্যুকে ভালোবাসি আমি। জীবন তাই আমার কাছে নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রমোদের উপাখ্যান।
সে যেন অনেক পথ। বহু বর্ষ মাস যেন কেটে গেল পথে। কত নদী পার হলাম। কত বনমধ্যে রাত্রি হল ভোর। কখনও আশ্রয় দিল সমৃদ্ধ নগর। প্রাসাদে, কুটিরে, হটে কেটে গেল কাল। সরে গেল আচম্বিতে মনের আড়াল। কত নারী বলেছিল, হে বন্ধু, বসত করো আমাদের ঘরে। তবুও মালতি কেন পথপাশে ঝরে? আমি তো পথিক এক রাখালের সুর। আমার দিগন্তমায়া একান্ত সুদূর।
কতদিন চলে গেছে, ঘুরতে ঘুরতে আর্যাবর্ত ছেড়ে চলে এসেছি দাক্ষিণাত্যে। পার হলাম কাবেরীর স্রোত। জনবহুল এক পল্লিতে প্রবেশ করলাম আমি। ভিক্ষা আহরণ করে কাবেরীতটে ফিরে এসে আহার সমাধা করছি, একটি নৌকা এসে ঘাটে লাগল। নৌকা হতে নামলেন এক বণিক। আমাকে দেখে তাঁর কৌতূহল হল। পাশে এসে বসলেন।
বললেন, ‘ভিক্ষু! কী নাম আপনার?
‘ভিক্ষু উদাত্ত। আপনি?
‘আমি নাগদত্ত। বণিক। আপনি কোথায় চলেছেন?’
‘জানি না। পান্থ আমি। পথই আমার ঘর। আর কোনো গন্তব্য নেই। একদিন ছিল।’
আজ আমার গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করুন।’
আমি সেই বণিকের সঙ্গে চললাম। নগরের এক পার্শ্বে তাঁর বিপুল প্রাসাদ। আমার ঠাঁই মিলল বহির্বাটিতে।
বড়ো নির্জন সেই ঘর। একান্তবাসের উপযুক্ত। স্নানাহার সেরে আমার সেই অসমাপ্ত কাব্যের পুথিটি খুলে বসেছি। সঙ্ঘরাম ছেড়ে এ নিতান্ত অনিকেত জীবনে প্রবেশ করার পর আমার কাব্যটি আর এক পদও অগ্রসর হয়নি। জানালা দিয়ে পুথির পাতার উপর এসে পড়েছে মধ্যদিনের আলো। কিছুক্ষণ উদাস নয়নে পুথির হলুদ পাতার দিকে চেয়েছিলাম। মন নেই কাব্যে আর। এ কাব্য যাকে নিয়ে লিখেছি, সে এই কবিতার চেয়ে কত বেশি বাস্তব ছিল। আমার কবিতা শুধু আমার শূন্য মনেরই ফসল। সে-রূপমঞ্জরী আমি আঁকতে পেরেছি কই? পরিবর্তে শব্দের আলপনায় পুথির পাতার শূন্যতাকে ভরিয়ে দিতে চেয়েছি। কিন্তু এক শূন্যতা কি অন্য শূন্যতাকে পূর্ণ করতে পারে?
হঠাৎ কী একটি শব্দে চমকিত হয়ে উঠলাম। নিস্তব্ধ দুপুর যেন কার কঙ্কনবলয়ের শব্দে রণিত হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়ালাম। বাতায়নপার্শ্বে দাঁড়িয়ে দেখলাম, প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে কে এক নারী কূপ হতে জল আহরণ করছে। সম্মুখ হতে তার অবয়ব আমি দেখতে পেলাম না।
জানালার কাছ থেকে সরে আসছি, এমন সময় সে তার মুখ ফেরাল। আমি তার পূর্ণাবয়ব দেখতে পেলাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম। একে যে আমি বড়ো বেশি চিনি।
বিস্ময়ের ঘোর অপসৃত হতে সময় লাগল। অবশেষে বিহ্বলতা সরিয়ে আমি তাকে ডাকলাম তার নাম ধরে অস্ফুটে।
‘মল্লিকা!’
বিস্ময়াহত হয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল এবার। কাছে এল। সেই আশ্চর্য নীল দুটি চোখ তুলে সে আমাকে বলল, ‘তুমি! তুমি এখানে কীভাবে এলে?’
আমি সেই মঠ ছেড়ে দিয়েছি, মল্লিকা! তোমাকে নিয়ে কাব্য লিখেছিলাম। স্থবিররা বললেন, এ পাপ। আমি তা স্বীকার করিনি। প্রতিমোক্ষ পড়িনি আমি। সঙ্ঘ ত্যাগ করে পথে পথে তোমাকে কত খুঁজেছি। কোথায় যে তোমরা চলে গেলে!’
মল্লিকা মাথা নীচু করে থাকল অনেকক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘তোমাকে-আমাকে নিয়ে বারাণসীতে অনেক কথা হচ্ছিল। তাই এক প্রভাতবেলায় আমার পিতা আমার হাত ধরে পারাদ্বীপ চলে যান। সেখানে আমরা ছিলাম বহু বছর। তারপর বণিক নাগদত্তের সঙ্গে পিতা আমার বিবাহ দিলেন। পিতা পারাদ্বীপেই আছেন। আমার স্বামী নাগদত্ত আমাকে নিয়ে এই কাবেরীতটে মণিপট্টনম নগরীতে ফিরে এলেন। সেই থেকে এখানেই আছি।’
‘কিন্তু সুজাতা, তুমি যে বলেছিলে, তুমি আমার চিরন্তনী।’
‘কে সুজাতা?’
‘সুজাতা! সুজাতা! চিনতে পারছ না? আমি তোমার সৌদাস! আমি সৌদাস।’
‘কী বলছ, কিছুই বুঝতে পারছি না, ভিক্ষু।’
‘ভাল করে ভেবে দ্যাখো, সে আমাদের পূর্বজনমের কাহিনি। তুমি গোপকন্যা সুজাতা ছিলে। তোমারই পায়সান্ন আহার করে সিদ্ধার্থ বুদ্ধ হয়েছিলেন। আর আমি–আমি ছিলাম তোমার স্বামী সৌদাস।’
‘এসব তোমার কবিকল্পনা, উদাত্ত। এই বৃথা কল্পনায় তুমি আর তোমার জীবন ক্ষয় কোরো না। সঙ্ঘ যখন পরিত্যাগ করেছ, এবার গৃহে ফিরে যাও।‘
আমার তো গৃহ নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। জানো নাকি, বাসা পুড়ে গেলে পাখি আকাশ আশ্রয় করে থাকে?’
মল্লিকা কিছু বলল না। আবার সে মাথা নীচু করে আছে। হঠাৎ টের পেলাম নিশ্বাসের গভীরে ডুবে গিয়ে সে নিঃশব্দে কাঁদছে। আমার জন্মান্তরকথা সে বুঝতে পারেনি। তবু আমার অন্তর্লীন বেদনা তার মনের অতলে নেমে অশ্রুবারিধারার স্বচ্ছ স্রোতোমুখ খুলে দিয়েছে।
আমি বললাম, ‘কাঁদছ কেন?’
সে বলল, ‘জানি না, কেন কাঁদছি। আমি না-চাইলেও কান্নার স্রোত আমার বুকের শ্বেতপাথর ফাটিয়ে উঠে আসছে যেন। তুমি উদাত্ত, নাকি সৌদাস আমি জানি না। শুধু একটি ভিক্ষা আমাকে দাও।’
‘আমি নিজেই যে ভিক্ষুক! ভিক্ষুকের কাছে তুমি ভিক্ষা নেবে?’
কান্নার ঝড়ের ভিতর নীড়হারা পাখির মতো দিশেহারা হয়ে আকুল স্বরে বলল, ‘তুমি ভিক্ষুক নও গো, ভিক্ষুক নয়। তুমি রাজা। তোমার রাজৈশ্বর্যের কাছে আমার এ নারীজীবন বড়ো তুচ্ছ মনে হয় আজ। তোমাকে কিছুই আমি দিইনি, তবু একটি ভিক্ষা চাই আমি তোমার কাছে আমার করপুট পেতে।’
তুমি জানো না, মল্লিকা, অতীত জন্মে তুমি আমাকে কী দিয়েছ। এই জন্মেও। তুমি যাকে আমার ঐশ্বর্য বলছ, সে তোমারই উপহার। স্মৃতির পাখিরা ডানা মুড়ে আছে বলে তুমি জানতে পারছ না। তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নেই। বলো তুমি, কী চাও।’
‘আমি চাই এই বিচ্ছেদের বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকবার অধিকার। আর কিছু নয়।’
‘বেশ, তাই হবে। আমি চলে যাচ্ছি, মল্লিকা। আর কোনোদিন আসব না। এজন্মে আর কোনোদিন দেখা হবে না আমাদের। তোমার বেদনার সম্ভার থেকে একটি বনফুলের পাপড়িও আমি নিয়ে গেলাম না।’
মণিপট্টনম হতে সেই দ্বিপ্রহরেই আমি চলে এলাম। কাবেরীর জলে ভাসিয়ে দিলাম মল্লিকাকাব্যখানি।
আবার চলেছি আমি। সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ, পথ যেন আমার ফুরায় না। আকাশগঙ্গার স্রোতে আমি বুঝি কোনো তারাফুল জ্যোৎস্নাজোয়ারে ভেসে চলেছি অনন্তকাল।
বহু বৎসর পর আমি উপনীত হলাম কাঞ্চীপুরে। একদিন হট্টমধ্যে দিকশূন্য বসে আছি, দেখলাম, এক তরুণ ভিক্ষু পথ দিয়ে চলেছেন। তাঁর মুণ্ডিত মস্তক, গৈরিক কাষায়, শমিত পদক্ষেপ আমার পূর্বজীবনের সংস্কার উদ্বুদ্ধ করে দিল। স্মৃতিপাখিরা আবার ডানা ঝাপটাচ্ছে আমার বুকের ভিতর।
তরুণ ভিক্ষুকে অনুসরণ করে আমি যেন তাঁদের সঙ্ঘারামে উপস্থিত হলাম। মহাসঙ্ঘিক বৌদ্ধদের বিহার। জনৈক বৃদ্ধ স্থবির আমাকে দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এখানে কী চাও, পান্থ?’
আমি বললাম, ‘সঙ্ঘের আশ্রয়।’
তিনি বললেন, ‘এসো তবে। এই ঘরে থাকো। কাল প্রাতে তোমার উপসম্পদা হবে।’
আমি পুনরায় প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলাম। প্রব্রজ্যা গ্রহণকালে সম্মুখে তথাগতর একটি ধ্যানস্থ মূর্তি ছিল। মনে হল, মহাশ্রমণ আমার দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন। খেলাফেরত শিশুর মুখপানে চেয়ে মা যেমন হাসেন, ঠিক যেন সেইরকম।
পুনরায় আরম্ভ হল স্বাধ্যায় ও সাধনা। মহাসঙ্ঘিকদের দার্শনিক মতবাদ ভালো করে আয়ত্ত করতে লাগলাম। সূত্র ও বিনয় অধিগত করলাম গভীর নিষ্ঠায়। শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর আমি কিছুতেই পাচ্ছিলাম না। সুজাতার প্রদত্ত পায়সান্ন আহার করে সেই বৈশাখী পূর্ণিমার রাত্রে সিদ্ধার্থ কীভাবে উপনীত হয়েছিলেন মহাসত্যে? কী ছিল, অনুভবে উপনীত হবার সোপানসমূহ? শাস্ত্রে অনেক খুঁজলাম। কিন্তু কীটদষ্ট পুথির পাতায় অনুভবের আলোক ছড়ানো থাকলেও সিদ্ধার্থের সেই মহারজনীর অভিজ্ঞতা লেখা নেই।
আচার্য সুভূতি এই দাক্ষিণাত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ পণ্ডিত। তাঁকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম। বললাম, ‘ভদন্ত, নৈরঞ্জনা নদীতীরে উরুবেলা বনে বৈশাখী পূর্ণিমার সেই রাত্রে মহাকারুণিক কীভাবে এই সত্যে উপনীত হলেন, অনুগ্রহ করে আমাকে বলুন। কীভাবে সিদ্ধার্থ বুদ্ধ হলেন?’
আচার্য সুভূতি বললেন, ‘বুদ্ধ কোনো ব্যক্তিনাম নয়। বুদ্ধ একটি অবস্থা। সেই অবস্থায় আমরা প্রত্যেকেই একদিন উপনীত হব। সেখানে পৌঁছানোর জন্য প্রযত্ন করো। ব্যক্তি-সিদ্ধার্থকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ো না।’
‘কিন্তু ব্যক্তি-সিদ্ধার্থ কী উপায়ে সেখানে পৌঁছেছিলেন, তা না-জানলে কেমন করে আমি সে-পথে চলব, ভদন্ত?’
‘দ্যাখো, ভ্রাতঃ! সেই পথ ছিল সিদ্ধার্থের পথ। আমাদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র পথ আছে। সিদ্ধার্থের পন্থা নিয়ে বিব্রত হয়ো না। সিদ্ধার্থের ব্যক্তিমায়া পরিত্যাগ করো তুমি।’
এই কথায় আমার মর্মস্থলে যেন আঘাত লাগল। ধর্ম, দর্শন, প্রব্রজ্যা বড়ো কথা। কিন্তু তারও চেয়ে আমার কাছে মহার্ঘ সম্বুদ্ধের ব্যক্তিজীবন। এমনকি বুদ্ধও নয়, আমার অনুরাগ শুধু সিদ্ধার্থে। সেই যে অগমপারের পথিক যুবক তিনি রাজ্য রাজ্য খেলা ছেড়ে দিয়ে অস্তিত্বের সুবিপুল বেদনা বুকে নিয়ে অনতিপ্রবেশ্য অটবিতে অটবিতে ঘুরে ঘুরে খুঁজেছিলেন মানবমুক্তির পথ, শেষে শাস্ত্রে গ্রন্থে আর তপস্বীদের কাছে জিজ্ঞাসার উত্তর না-পেয়ে নিজেই বসেছিলেন ধ্যানে উরুবেলায়, মনের পাতালপ্রদেশে কুয়াশামাখা অন্ধকার সরিয়ে চেতনার কিরণে স্নাত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন অক্ষোভ্যমূর্তিতে, সেই অভয়মূর্তি—যাঁর কান্তিময় উপস্থিতি পূর্বজন্মে আমাকে মুহূর্তে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আলোকবিসারী অনুভূতির দ্বারপ্রান্তে, সেই সিদ্ধার্থই আমার একতম আশ্রয়। বুদ্ধোপদেশের থেকেও আমার কাছে মূল্যবান তাঁর জীবনের কোনো একটি আখ্যায়িকা, কিংবা তাঁর একটি আলেখ্য অথবা তাঁর ধাতুমূর্তি। তাই আচার্য সুভূতি যখন আমাকে বললেন, সিদ্ধার্থের সেই ব্যক্তিমায়া পরিত্যাগ করতে, তখন সে-উপদেশ যতই প্রজ্ঞানুবর্তী হোক না কেন, আমার কাছে তা মৃত্যুযন্ত্রণার মতোই বেদনানীল ছিল।
বিষাদ নামল মনে গভীর রাত্রিতে শ্রাবণের আকাশভাঙা বারিপাতের মতোই। অন্ধকারে যেন বৃষ্টি পড়ছে। কেউ কোথাও নেই, একা শূন্যমনে প্রশস্ত স্তূপগৃহের সম্মুখের অলিন্দে স্বপ্নচালিতের মতো হেঁটে চলেছি। দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছিল। বাইরে অশ্রান্ত বারিধারা ঝরছে, তারই তুমুল শব্দ রাত্রির জঠর ভরে রেখেছিল, আসন্নপ্রসবা নারীর গর্ভ যেমন ভরে রাখে অজাত সন্তানের সম্ভাবনা। মনে মনে ভাবছিলাম, পরিণতিতে উদাসীন এ-জীবনের আর কোনো তাৎপর্য আছে? আছে কোনো ফলবান বৃক্ষের প্রতিশ্রুতি? পিছনে ফেলে এসেছি জন্মজন্মান্তরের সঙ্গিনীকে; আর তার সঙ্গে দেখা হবে না। এদিকে জানতেও পারলাম না পূর্বজনমের সেই প্রিয়ার দেওয়া পায়সান্ন আহার করে প্রিয়পুরুষ সিদ্ধার্থ কোন উপায়ে জীবনের চরম সিদ্ধিতে পৌঁছেছিলেন।
ঘৃতপ্রদীপের তির্যক আলোক অলিন্দের দেয়ালে প্রলম্বিত সিদ্ধার্থের একটি আলেখ্যের উপর এসে পড়েছে। আমি সেই ছবিটির সামনে কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। অলংকৃত চিত্রপট। কেন্দ্রে সিদ্ধার্থের ধ্যাননিমগ্ন মূর্তি। আর তারই চারিপাশে বৃত্তাকারে ভীষণাকৃতি মার-সেনানীদের ভয়াবহ আকার।
মারসৈন্যরা যেন সিদ্ধার্থের চারিপাশে অশান্তির আগুন জ্বেলেছে। শূলহস্তে মার সিদ্ধার্থের দিকে ‘হান, হান’ শব্দে তেড়ে আসছে। হিংস্র, দন্তুর পশু এবং উদ্যতফনা বিষাক্ত অহিকুল সিদ্ধার্থকে দংশনে উদ্যত। দুইপাশে দুই স্তনভরনমিতা শৃঙ্গারাঢ্যা নারীর মোহিনী মূর্তি। অথচ এত আক্রমণের ভিতরেও কেন্দ্ৰে অকম্প দীপশিখার মতো অনির্বাচ্য প্রশান্তি নিয়ে সিদ্ধার্থ ধ্যানে ডুবে আছেন।
ছবিটি কতক্ষণ ধরে দেখছিলাম, হুঁশ ছিল না। হঠাৎ মনে হল, সমস্ত ছবিটি কাঁপছে। সে-ছবি আর পটের উপর আঁকা জড়বস্তু নয়, তার প্রতিটি তন্তু যেন জীবন্ত হয় উঠেছে। যেন সহস্রাব্দ-প্রাচীন সেই ঘোরা রজনীটি আমার চক্ষের সম্মুখে পুনরভিনীত হচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম, এ বুঝি আমার মনের ভুল। পরমুহূর্তেই সেই সংশয় অপগত হল। আলেখ্যে সিদ্ধার্থের মূর্তি যেন চিন্ময়, যেন তিনি ধ্যান থেকে এইমাত্র জেগে উঠছেন।
তাঁর চক্ষু দুটি পদ্মের পাপড়ির মতো খুলে গেল। আহ, সেই আশ্চর্য করুণাবর্ষী দৃষ্টি, যা আমি জন্মান্তরে দেখেছিলাম। নিজের অজান্তেই আমি তাঁর সম্মুখে নতজানু হলাম। চরণপ্রান্তে আমার শিরোদেশ স্পর্শ করে আমি বলে উঠলাম, ‘তথাগত! হে তথাগত!’
‘উদাত্তসৌদাস! বলো, তুমি কী জানিতে চাহিতেছ?’
‘আমার পূর্বজনমের প্রিয়া সুজাতা… তাকে কি আমি—?’
‘পাইবে। কিন্তু তার পূর্বে সুচিরকালব্যাপী তোমাদের বিরহের সাধনা করিতে হইবে। কোনো জন্মে সে হইবে বনের হরিণী। আর তুমি হইবে এক যুবক ময়ূখ। তখন একবার মাত্র মৃগদাব সারনাথে তোমাদের দেখা হইবে।’
‘এমন কঠিন পরিণতি কেন, মহাকারুণিক?’
‘বিরহের সত্তাপে দগ্ধ হইয়াই তো তোমাদের প্রেম জ্ঞানের স্পর্শ লাভ করিবে। জ্ঞানবিরহিত প্রেম আর প্রেমবিরহিত জ্ঞানই জন্মজরাব্যাধিমৃত্যুর একমাত্র হেতু। এ চক্রনেমির নাভি তৃষ্ণা। এই তৃষ্ণাকে জয় করো, উদাত্ত।’
‘এই যা দেখছি, এ সবই কি স্বপ্ন?’
‘হ্যাঁ, এ সবই স্বপ্ন। সবই মায়া। এই স্বপ্ন হইতে উত্থিত হইয়া তুমি ময়ুখ হইবে। তখন এই স্বপ্নমধ্যে যাহা দেখিলে, যাহা শুনিলে, সমস্ত লিপিবদ্ধ করিবে। তবে মনে রাখিও, এ-উদাত্ত যেমন স্বপ্ন, সে-সৌদাসও তেমনই স্বপ্ন ছিল। এমনকি ময়ূখও তোমার আর-এক প্রকার স্বপ্ন হইবে। সুজাতা, মল্লিকা, হরিণী সকলই স্বপ্ন। সিদ্ধার্থও স্বপ্ন, বুদ্ধও স্বপ্ন।’
তবে এ স্বপ্ন ভাঙবে কবে, সুগত?’
‘স্বপ্ন তো ভেঙেই আছে, যুবক। তুমি কেবল তা বুঝিতে পারিতেছ না। শুধু এই বুঝিয়া লওয়াকেই বোধি বলা হয়। আবার সেই বুঝিয়া লওয়াও কিন্তু স্বপ্নেরই ভিতর।’
‘আমি আরও একটি কথা জানতে চাই, মহাশ্ৰমণ!’
‘বলো, উদাত্ত।’
‘উরুবেলায় নদীতীরে বোধিদ্রুমতলে সেই দারুণ রাত্রিতে কেমনভাবে আপনার চেতনায় বোধিকিরণ নেমে এসেছিল, সেই কথা…’
‘কেন? তার জন্য কি বুদ্ধোপদেশ যথেষ্ট নয়?’
‘বুদ্ধ নয়, বুদ্ধ নয়, প্রভু! আমি সিদ্ধার্থের কথা জানতে চাই।’
মহাকারুণিক যেন স্মিত হাসলেন। তারপর বললেন, ‘তবে সাবধানে শ্রবণ করো, ভিক্ষু। আমি স্বয়ং তোমাকে আজ সেই ঘোরা শর্বরীর কথা বলিব।’