১৬. মহামারগর্জন
“বন্ধুকে যে বন্ধু বলিয়া চিনিতে পারে না, তাহাকে আমি ঘৃণা করি, সিদ্ধার্থ! আমি মার, তোমার জন্মজন্মান্তরের বন্ধু। তোমাকে সর্বদা আমি সুখকর পথে চলিতে পরামর্শ দিয়াছি। কিন্তু তুমি নির্বোধ, আমার কথায় তুমি কান দাও নাই। সর্বদা নিজের জেদে চলিয়াছ। আজ আমি আমার ধৈর্যের শেষ বিন্দুতে পৌঁছিয়াছি। আর নহে। এইবার শেষ বোঝাপড়া হইবে।
বারংবার বলিয়াছি, রাজা হও। রাজ্যসুখ ভোগ করো। উহাই তোমার উপযুক্ত। কথা শুনিলে না। অরণ্যে প্রান্তরে শ্মশানে বনে ঘুরিয়া বেড়াইলে। রাজা বিম্বিসার তোমার সহিত একত্রে রাজ্যশাসনভার ভাগ করিয়া লইতে চাহিয়াছিলেন। আমি তোমাকে তাঁহার পরামর্শ শুনিতে বলিয়াছিলাম। তুমি শুনিলে না।
অরাঢ় কালাম, উদরক রামপুত্র তোমাকে শিক্ষান্তে তাঁহাদের সহিত অধ্যাপনা করিতে বলিয়াছিলেন। ইহাও অতি উত্তম প্রস্তাব ছিল। সে-কথা আমি তোমাকে বলিয়াছিলাম। উহাও তুমি প্রত্যাখ্যান করিলে। নিজেকে তুমি কী ভাবো?
এই অরণ্যে কঠোর তপশ্চর্যার ভাব ধারণ করিয়াছিলে। তোমার তপোবিভূতিতে আকৃষ্ট হইয়া পাঁচজন ভিক্ষু এখানেই বসবাস আরম্ভ করে। পাঁচ কেন, পাঁচ সহস্ৰ গুণমুগ্ধ ব্যক্তি আমি আনিয়া দিতাম। তোমার যশোরাশি ভুবনময় পরিব্যাপ্ত হইত। তুমি তাহাও করিলে না। কৃচ্ছ্রসাধনা ছাড়িয়া মধ্যপন্থায় ব্রতী হইলে। পাঁচ ভিক্ষু অন্যত্র চলিয়া গেল।
আমার সকল আশা তুমি অঙ্কুরে বিনষ্ট করিয়াছ। এখন বসিয়াছ দুঃখমুক্তির সর্বজনগম্য পন্থা আবিষ্কার করিতে। উহা তো আমি হইতে দিতে পারি না। আমি মার। জীবকুলকে দুঃখের অন্ধকারে চিরতরে ডুবাইয়া রাখাই আমার ব্যবসায়। তুমি সেই ব্যবসায়ের মূলধনে টান মারিতেছ? ভালো কথা বলিতেছি, এখনও তপস্যা রাখো। এই নদীর পরপারে গ্রাম। যাও, কাষায় কমণ্ডুল ছাড়িয়া ওই গ্রামের মধ্যে মিশিয়া যাও। সাধারণ মানুষের ন্যায় সংসার করিয়া সুখে থাকো। তাহাতেই শান্তি পাইবে।
সাধারণ মানুষের জীবনে কত শান্তি! তাহার স্ত্রী-পুত্র আছে। সংসার আছে, জমিজমা আছে। এই লইয়া সে সুখেই কালাতিপাত করে। তাহার জীবনে কোনো অভিনব সত্তাসংকট নাই। কোনো দার্শনিক সমস্যা তাহাকে পীড়িত করে না। তাহার জীবনে রাজনৈতিক অভিসন্ধি নাই, রাষ্ট্রনৈতিক অশান্তি নাই, বড়ো কোনো আদর্শের অত্যাচার নাই, বহিরাক্রমণকারীর ভয় নাই। তুমি রাজা হইতে চাও নাই। ভালো কথা। তুমি কৃষক হও। ওই নদীপারের গ্রামের কোনো অনুঢ়া কন্যাকে বিবাহ করিয়া সুখী নিরাপদ সংসারীর জীবনযাপন করো। কী? হাসিতেছ কেন?
এই হাসির অর্থ কি আমি বুঝি না? তুমি ভাবিতেছ, তুমি—একমাত্র তুমিই এ সংসার প্রহেলিকার বাহিরে যাইবার পথ খুঁজিয়া বাহির করিবে। তাহা সকল সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করিয়া যাইবে. তুমি বুদ্ধ হইবে? বৃথাই তোমার এই বুদ্ধ হইবার আকাঙ্ক্ষা। আমি মার, আমি মহাভয়, আমাকে অতিক্রম করিয়া কেহ কখনও বুদ্ধ হইতে পারে নাই। এই যে তুমি ধ্যানের ভিতর দেখিলে কালান্তরে দীপংকর বুদ্ধ আবির্ভূত হইয়াছিলেন, উহা সত্য নহে। উহা তোমার ভাবের খেয়াল মাত্র। ওই ভাব পরিত্যাগ করো। আমি সর্ববিজয়ী। আমার নিকট সকলেই পরাস্ত হয়। তুমিও আমার সম্মুখে নতজানু হও। আমি তোমাকে ভুবনবিজয়ী বীর করিয়া দিতেছি। আমার কৃপায় তুমি সসাগরা পৃথিবীর একছত্রাধিপতি অধীশ্বর হইবে একবার, শুধু একবার আমার সম্মুখে প্ৰণত হও।
দ্যাখো, দেবতারাও আমার অধীন। তাঁহারাও আমাকে অতিক্রম করিতে পারেন নাই। তুমি ছার মনুষ্য, তুমি কী করিবে? কী বলিলে? মনুষ্য দেবতা অপেক্ষাও মহত্তর? ইহা তুমি কোথা হইতে পাইলে? আমি বলিতেছি, মানুষ অত্যন্ত দুর্বল। তাহার কী শক্তি আছে? মনুষ্য মদধীন, মনুষ্য আমার চরণের ভৃত্য। সে আমাকে অতিক্রম করিয়া বুদ্ধ হইতে পারে না।
আবার দ্যাখো। তুমি তো সমস্ত আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিবে বলিয়া ধ্যানে বসিয়াছিলে। বুদ্ধ হইবার আকাঙ্ক্ষাও এক প্রকার আকাঙ্ক্ষা। উহা ত্যাগ করিতেছ না কেন? কী বলিতেছ? হেলঞ্চ শাক যেমন শাকের মধ্যে নহে, জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষাও সেইরূপ আকাঙ্ক্ষার মধ্যে পরিগণিত হয় না? এইসব কথা কোথা হইতে পাইতেছ? উঠ। চলিয়া যাও। তুমি কিছুতেই বুদ্ধ হইতে পারিবে না। আমি তাহা হইতে দিব না।
আমরণ চেষ্টা করিয়া যাইবে? করো। তাহা তো অতি উত্তম। জন্মিয়াছ যখন, মরিতেই হইবে। এই অরণ্যমধ্যে ওই প্রাণান্ত প্রয়াস করিয়া, তপস্যা করিয়া মরিয়া যাও। তাহাও তো অতি মহৎ কার্য হইবে। আমি তোমার মৃত্যুসংবাদ সকলের নিকট পৌঁছাইয়া দিব। সকলে জানিবে, শাক্য রাজকুমার শুদ্ধোদনপুত্র সিদ্ধার্থ এত ধার্মিক যে, ধর্মাচরণ করিতে গিয়া তাহার মরণ হইয়াছে। তুমি ভুবনবিদিত হইবে। খারাপ কী? দ্যাখো, উহাই করিবে কিনা, ভাবিয়া দ্যাখো।
মোট কথা, তোমাকে সার বলিতেছি, যে উদ্দেশ্য লইয়া গৃহত্যাগ করিয়াছিলে, উহা অসার ছিল। তুমি খুঁজিতেছ, দুঃখের শেষ আছে কিনা। আমি বলিতেছি, দুঃখের শেষই নাই। ওই যে চারিটি সত্য বাহির করিয়াছ, উহার প্রথম দুইটি কেবল সত্য। দুঃখ আছে, ইহা সত্য। আমি ইহা মানিয়া লইতেছি। দুঃখের কারণ আছে, অর্থাৎ দুঃখের কারণ বাসনা, ইহাও না হয় কোনোমতে মানিয়া লইলাম। কিন্তু দুঃখের নিরোধ আছে, কিংবা দুঃখনিরোধের উপায় আছে, এই দুই কথা আমি মানিয়া লইতে পারিলাম না। এই দুই কথা তোমার কল্পনা মাত্র। যাও, যাও, উঠিয়া যাও।
কিংবা অরণ্যবাসী সেইসব পরিব্রাজকদের কথা মনে করো। পূরণ কাশ্যপ বলিয়াছিলেন, শুভ বা অশুভ কোনোরূপ কর্মের কোনো ফল নাই। নিশ্চেষ্ট হইয়া পড়িয়া থাকাই উপায়। মক্খলি গোশাল বলিয়াছিলেন, অদৃষ্টই শেষ কথা। মানুষ স্বচেষ্টায় কিছুই করিতে পারে না। নিগস্থ নাথপুত্ত বলিলেন, দেহ ও মনের সকল ক্রিয়া হইতে নিজেকে প্রত্যাহার করিয়া লওয়াই চরম, তাহাতে দুঃখ-সুখ কিছুই রহিবে না। সঞ্জয় বেলঠিপুত্ত বলেন, সুখ বা দুঃখের বাহিরে যদি কিছু থাকেও, তবে তাহা আমাদের অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। অজিত কেশকম্বলী উপদেশ দিতেছেন, মৃত্যুর পর আর কিছুই থাকিবে না। অতএব, এই জীবনটা যেভাবে পারো, উপভোগ করিয়া লও। পকুধ কচ্চায়ন নির্দেশ দিলেন, জড়পদার্থ, সুখ, দুঃখ ও আত্মা এইগুলি শাশ্বত পদার্থ। ইহারা পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়াবিক্রিয়াও করে না। অনন্তকাল ইহারা একইরকম রহিয়াছে।
ইহাদের মতবাদের ভিতর কোনো ঐক্য নাই, যে যাহা খুশি বলিতেছে। তুমি ইহাদের মধ্যে কাহারও একটা মত স্বীকার করিয়া লও। সমস্যা মিটিয়া গেল। ইহাদের মতামতে কোনো ঐক্য নাই, ইহা হইতে কী প্রমাণিত হইতেছে? প্ৰমাণিত হইতেছে, সত্য বলিয়া আসলে কিছুই নাই। উহা মানুষের মনগড়া একটা খেয়াল মাত্র।
তুমি আমার কোনো কথা শুনিতেছ না। বলিতেছ, তুমি কী যেন খুঁজিয়া পাইয়াছ? আমার দিকে তাকাইয়া, সিদ্ধার্থ, তুমি কী বলিতেছ? আমি কান পাতিয়া শুনিলাম, তুমি বলিতেছ—
‘অনেকজাতিসংসারং সন্ধাবিস্সং অনিসিং।
গহকারকং গবেসন্তো দুক্খা জাতি পুনপ্পুনং।।
গহকারক দিঠোসি পুন গেহং ন কাহসি।
সব্বা তে ফাসুকা ভগ্গা গহকূটং বিসঙ্গিতং।
বিসঙ্খারগতং চিত্তং তণ্হানং খয়মজ্ঝাগা।।
সংসারে বহু জন্ম বিশ্রাম না করিয়া নিরন্তর এই গৃহকারকের সন্ধান করিয়াছি এবং বারংবার দুঃখ ভোগ করিয়া চলিয়াছি। অবশেষে এখন গৃহকারককে চিনিয়া ফেলিয়া বলিতেছি, হে গৃহকারক! তোমাকে দেখিয়া ফেলিয়াছি, আর তুমি আমার চতুর্দিকে গৃহনির্মাণ করিতে পারিবে না। তোমার সব খুঁটি ভাঙিয়া গিয়াছে, ঘরের চূড়া নষ্ট হইয়া গিয়াছে এবং আমার নির্বাণকামী চিত্তের তৃষ্ণা মিটিয়া গিয়াছে।’
এত সাহস? আমাকে লইয়া বসিয়া বসিয়া ছড়া কাটিতেছ! তোমাকে তো দৃশ্য দেখাইতে হইবে। তুমি জানো, তোমার এই সাধুজীবন কীসের মূল্যে? এই দ্যাখো, এতদিন তোমার সম্মুখে আমি ইহাদের ঢাকিয়া রাখিয়াছিলাম। আর নয়, এইবার দ্যাখো। তুমি অন্যদের কত কষ্ট দিয়া অরণ্যে এই লক্ষ্যশূন্য জীবন কাটাইতেছ। দ্যাখো—
এই বৃদ্ধা তোমার পালিকা মাতা প্রজাপতি গৌতমী। বৃদ্ধা হইয়াছেন, তোমার শোকে উন্মাদপ্ৰায় হইয়া মৃতবৎ জীবনধারণমাত্র করিতেছেন। তাঁহার রূপ চলিয়া গিয়াছে, চর্ম লোল হইয়াছে, কেশ পলিত হইয়াছে। তিনি কাতর কণ্ঠে বলিতেছেন—
‘বাছা! ফিরিয়া আইস। তোমা বিহনে আমি প্রাণশূন্যা হইয়াছি। আর্দ্র বস্ত্র নিংড়াইয়া যেরূপ শেষ বিন্দু জল নিষ্কাসিত করিয়া লওয়া হয়, তোমার জন্য আমার হৃদয় সেইরূপ কাঁদিতেছে। তোমা বিনা কপিলাবস্তু অন্ধকার হইয়া গিয়াছে। শাক্যকুলপ্রদীপ! কোন অরণ্যে জীবনধারণ করিতেছ? আমরা কি তোমার কেহ নই? আমাদের কেমন করিয়া ভুলিয়া আছ? ফিরিয়া আইস, ফিরিয়া আইস!’
আবার এই দ্যাখো। এই নারীকে চিনিতে পারো? ইহাকে তুমি একদিন ভালোবাসিয়াছিলে, বিবাহ করিয়াছিলে। সে তোমাকে সন্তান উপহার দিয়াছিল। এই নারী গোপা যশোধরা। তোমার স্ত্রী। ইহার সেই ভুবনমোহিনী রূপ চলিয়া গিয়াছে, কেশ শুষ্ক ও স্বল্প হইয়াছে। অতি শীর্ণা, সর্বদা রোরুদ্যমানা এই নারী তোমার বিরহতাপে গতায়ুপ্ৰায়া হইয়াছে। যেদিন তুমি গৃহত্যাগ করিয়াছ, সেইদিন হইতে ইহার আহারনিদ্রার কোনো স্থিরতা নাই, ভূতলে শয়ন, পাণিপাত্রে দিবসায়ে একবার মাত্র ভোজন, কী দারুণ মনস্তাপে তাহার জীবন জ্বলিয়া গিয়াছে। বিহ্বল আর্তস্বরে তোমার উদ্দেশে গোপা বলিতেছে—
‘স্বামিন! কোন অপরাধে আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন? আমি কী করিয়াছিলাম? নিদ্রার আবেশ আমার সংজ্ঞা হরণ করিল, আপনি অমনই আমাকে ফেলিয়া চলিয়া গেলেন! এ বনভূমিমধ্যে এই কঠোর তপশ্চর্যা—ইহা তো আপনার উপযুক্ত নহে। আপনার শ্রীতনুতে কত আঘাত লাগিতেছে, কী বেদনা আপনার মনকে জর্জর করিয়া রাখিয়াছে, ইহা যে আমি আর সহিতে পারি না! আপনার আহারবিহারের কোনো নিয়ম নাই, আপনার কত কষ্ট হইতেছে। কেন আপনি আমার সেবা করিবার অধিকার কাড়িয়া লইলেন? নিখিল জীবের দুঃখের সমাধান খুঁজিতে বসিয়াছেন, গোপা যশোধরার দুঃখকে কি অনুভব করেন নাই? হা হা নাথ! আপনি আমার বক্ষের হার, মস্তকের চূড়ামণি! আমাকে আর ফেলিয়া থাকিবেন না। ফিরিয়া আসুন, আমার হৃদয়সিংহাসন আপনার জন্যই সাজাইয়া রাখিয়াছি!’
আর এই দ্যাখো শিশুপুত্র রাহুল! তোমার ধর্মোন্মাদনায় এই বালক অনাথ অভিভাবকশূন্য হইয়াছে। তাহাকে দেখিবার কেহ নাই। ‘পিতা’ কী বস্তু, বালক তাহা কখনোই জানিল না। তাহার চোখের জল চোখেই শুকাইয়া গেল, কেহ তাহা মুছাইয়া দিল না। এই বালকটিকে পিতৃস্নেহ হইতে বঞ্চিত করিবার কোন অধিকার তোমার ছিল, সিদ্ধার্থ?
আর এই বৃদ্ধ পিতা শুদ্ধোদন! লোলচর্ম, বলিরেখাঙ্কিত, করুণ, অথর্ব। ইনি পুত্রবিরহে চিরকাতর। একদিকে সিংহাসন অরক্ষিত, অন্যদিকে মৃত্যু প্রতিদিন অমোঘ ইঙ্গিত দিতেছে। এই বৃদ্ধের পিতৃহৃদয়ের যন্ত্রণা তুমি দূর করিতে পারিলে না, সিদ্ধার্থ? তোমার তো সে ক্ষমতা ছিল। তথাপি, দায়িত্বপালনে পরাজুখ হইলে। ছি, ছি, ছি! পলাতক কাপুরুষ!
তুমি বলিলে, ‘হে মার! তুমি বৃথাই আমাকে এইসব দৃশ্য দেখাইতেছ। বহু পূর্বে আমি ইহাদের কথা নিরন্তর ভাবিয়াছি। জীবনের বৃহত্তর আহ্বান আসিলে ক্ষুদ্রতর কর্তব্যের আহ্বান ভাসিয়া যায়—ইহাই নিয়ম। আমার জীবনে সেই বৃহত্তর আহ্বান আসিয়াছিল। তাই ইহাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করিতে পারি নাই। আজ যদি আমি দুঃখমুক্তির সর্বজনগম্য পন্থা আবিষ্কার করি, তবে তাহা তো আমার একার অবদান হইবে না, ইহাদের সকলের অবদান হইবে। আর আমার কথা ভাবিতে ভাবিতে আমার পরিবারস্থ সকলেরই মন নির্বাণোন্মুখ হইয়াছে আমি গৃহে থাকিলে তাহা তো হইত না। আমি গৃহত্যাগ করিয়াছি বলিয়াই ইহারা নিয়ত আমার সাধুজীবনকে ধ্যান করিয়াছে, ফলত ইহাদের চিত্ত অতি নির্মল ও সংশুদ্ধ হইয়াছে।’
উঃ, কী পাষাণ তোমার চিত্ত! তোমাকে শিশু রাহুল, রাহুলমাতা যশোধরা, জননী গৌতমী, রাজা শুদ্ধোদন—সকলের করুণ পরিণতি দেখাইলাম, তৎসত্ত্বেও তোমার চিত্ত একটু টলিল না! শুধু চক্ষু হইতে একবিন্দু বারিকণা নিঃস্ৰাবিত হইয়া কপোলের উপর মুক্তাবিন্দুর ন্যায় স্থির হইয়া রহিল।
তুমি বলিলে, ‘হে মার! তুমি এখন আর কোনোমতেই আমাকে টলাইতে পারিবে না। আমি সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় সমদর্শী হইয়াছি। ইহা আমার ধ্যানার্জিত ফল! আমি সমত্ববুদ্ধিতে প্রতিষ্ঠিত হইয়া হৃদয়ে মহাশান্তির অধিকারী হইয়াছি। তুমি আমার কী করিবে?’
বেশ, তাই যদি হয়, তবে দ্যাখো, তোমাকে একটি নূতন পরামর্শ দিতেছি। তুমি যে ধ্যানের ফলে শম-সুখ অর্জন করিয়াছ, এই শান্তি লইয়াই তুমি এস্থলে অবস্থান করো। শান্ত, সাধুজীবন হইবে। আর অগ্রসর হইও না। ভিতরে যে বাসনা লুক্কায়িত আছে, তাহার সহিত আর যুদ্ধ করিয়ো না। যাহা চাহিয়াছিলে, পাইয়াছ তো। শান্তিময় সন্ন্যাসীর জীবন উপভোগ করো।
‘না, ইহা আমি চাহি নাই। আমি দুঃখমুক্তির উপায় খুঁজিতেছি। ইহা তো শান্তির ঘোরে নেশা করিয়া থাকিবার মতো। নেশার ঘোর যখনই কাটিবে, আবার দুঃখরাশি ফিরিয়া আসিবে। আমি শান্ত হইতে চাহি না। না, না, আমি সাধুও হইতে চাহি না। আমি বাসনাবিজয়ী হইতে চাই। তাহা করিতে গিয়া যত অশান্তি আসে, আসুক। আমি অশান্তির আগুনে দগ্ধ হইয়া খাঁটি সোনা হইয়া উঠিতে চাই। হে মার! তোমার যাহা ইচ্ছা, তুমি তাহাই করিতে পারো। এ আসন হইতে আমি বোধিলাভ করিবার পূর্বে উত্থিত হইব না!’
এই কথা বলিবামাত্র আকাশ গুরু গুরু শব্দে ডাকিয়া উঠিল। আমিও আমার পূর্বের আকার পরিত্যাগ করিয়া এক ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করিলাম। গগনস্পৰ্শী আমার শিরোদেশ, তাহার বদ্ধ জটা আমি খুলিয়া দিলাম। আলুলায়িত কেশপাশে সমস্ত নভোদেশ আবৃত হইয়া গেল। আমার চক্ষু ক্রোধে অগ্নিকটাহের ন্যায় জ্বলিতে লাগিল। নখাঘাতে আকাশটার এক প্রান্ত ধরিয়া আমি টান মারিলাম। ছিন্ন বস্ত্রের ন্যায় উহা ধরিত্রীর উপর লুটাইয়া পড়িল। সেই মহা অন্ধকারের ভিতর প্রবল রক্তবৃষ্টি আরম্ভ হইল।
নরকরোটির মালা পরিয়া আমি এক ভয়ংকর নৃত্য আরম্ভ করিলাম। আমার পদাঘাতে ভূলোক দ্যুলোক কাঁপিয়া উঠিল। পদতলে মেদিনী থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। উরুবিল্ব বন যেন অগ্নিস্রোতের ভিতর চাকার মতো ঘুরিতেছে। তাহার ভিতর সেই বনস্পতিতলে সিদ্ধার্থ যেন চুর্ণবিচূর্ণ হইয়া যাইতেছে। মহাপ্রলয় আরম্ভ হইয়াছে।
প্রচণ্ড ঝড় উঠিল। বনের বৃহৎ বনস্পতিগুলিকে উৎপাটিত করিয়া নভোপথে ছুঁড়িয়া মারিতে লাগিলাম। দ্যাখো, সিদ্ধার্থ, দ্যাখো আমার কত শক্তি! সৌরমণ্ডলের ভিতর পৃথিবীকে আমি কীটের মতো মুছিয়া দিতেছি।
সমস্ত আগ্নেয়গিরির মুখ খুলিয়া দিয়াছি। আতঙ্কজনক অগ্নুৎপাত হইতেছে। লাভাস্রোত ভয়াবহ বেগে নামিয়া আসিতেছে। মানুষের অগণ্য করোটি, অস্থি, মজ্জা আকাশ হইতে শিলাবৃষ্টির ন্যায় নামিয়া আসিতেছে। কাহারও নিস্তার নাই।
সমুদ্র, নদী উত্তাল হইয়া উঠিয়াছে। নৈরঞ্জনা তাহার কূল ছাপাইয়া সহস্ৰতল প্রাসাদের উচ্চতায় মহাতরঙ্গ তুলিয়া ধাইয়া আসিতেছে। সাগর হইতে বীভৎস আকৃতির দন্তুর জলজন্তু উঠিয়া আসিতেছে। তাহাদের ব্যাদিত মুখগহ্বরে সমস্ত গ্রস্ত হইয়া যাইতেছে। অশ্বত্থবৃক্ষ সহ সিদ্ধার্থকে যেন তাহারা গ্রাস করিয়া লইতেছে।
বিদ্যুতের লেলিহান শিখা অন্ধকার শূন্যের ভিতর এক দিক হইতে অন্য দিকে ঝলসিয়া উঠিল। গ্রহহীন, তারকাহীন, অদৃষ্টপূর্ব অন্ধকার শূন্যে ঘুরিতেছে। আমি ভয়ংকর অট্টহাস্য করিতেছি। চরাচর থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। মুখগহ্বর ব্যাদিত করিয়া মনুষ্যশিশু প্রসব করিতেছি। তাহার পর পুনরায় তাহাদের অস্ত্রতন্ত্র ছিঁড়িয়া নখাঘাতে শির উপড়াইয়া রক্তপান করিতে করিতে প্রবলবেগে চর্বন করিতেছি।
এইরূপে প্রহরের পর প্রহর ধরিয়া প্রলয়রোল চলিতে লাগিল। সকল দৃশ্য, শ্রাব্য মুছিয়া গেল। শুধু সেই নিমেষশূন্য অন্ধকারের ভিতর, আমি মার, প্রচণ্ড তাণ্ডবনৃত্য করিতে লাগিলাম।
দীর্ঘকাল পর উন্মত্ত আমার দৃষ্টি সিদ্ধার্থের উপর গিয়া পড়িল। কী আশ্চর্য! তুমি স্থির হইয়া বসিয়া আছো? এত ঝঞ্ঝা, বিদ্যুৎ, অগ্ন্যুৎপাত, ভূকম্প, বন্যা, রক্তবৃষ্টি, প্রলয়কলরোল তোমাকে এতটুকুও স্পর্শ করে নাই! এমন ভয়াবহতার চিত্র তোমার মুখের একটি রেখাকেও কম্পিত করে নাই! তুমি শান্ত হইয়া বসিয়া আছ! অভয়, অসঙ্গ, আনন্দ!!
আমি নিতান্ত ক্ষিপ্ত হইয়া তোমার সম্মুখে আসিয়া ভূতলে সজোরে পদাঘাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ওহে সিদ্ধার্থ! এমন প্রলয়ের ভিতর স্থির হইয়া বসিয়া আছ তুমি কার শক্তিতে?’
তুমি শান্ত কণ্ঠে বলিলে, ‘হে মার! জন্মের পর জন্ম ধরিয়া আমি অন্যের উপকার করিবার জন্য প্রাণ দিয়াছিলাম। সেইসব জীব, যাহারা আমার দ্বারা উপকৃত হইয়াছিল, তাহাদের সম্মিলিত শুভেচ্ছার শক্তিতে আমি এই প্রলয়ের মধ্যেও এই আসনে স্থির হইয়া বসিয়া আছি।’
আমি হো-হো করিয়া হাসিয়া বলিলাম, ‘তোমার সেইসব জন্মই বা কোথায়? আর সেইসব জীব, যাহারা তোমার দ্বারা উপকৃত হইয়াছিল, তাহারাই বা কোথায়? আমি মার, সর্ববৈনাশিক! আমি তোমার পূর্ব পূর্ব জন্মের শরীর, সেইসব উপকৃত জীবের শরীর—সেসব আমি খাইয়া ফেলিয়াছি। তোমার সেসব শুভকর্মেরই বা কে সাক্ষী রহিয়াছে? কেহ নাই!’
তুমি সহসা তোমার দক্ষিণ হস্ত ঊর্ধ্বে তুলিলে। তাহার পর ধীরে ধীরে সেই হস্তের তর্জনী তোমার সম্মুখের ভূমির উপর নামাইয়া দৃঢ় বজ্রকঠিন স্বরে উচ্চারণ করিলে, হাঁ, সাক্ষী আছে। সাক্ষী এই পৃথিবী — কর্মভূমি!’
আহ্! কী ভয়ংকর যন্ত্রণা আমার হইতেছে। আমি আর নিজেকে ধরিয়া রাখিতে পারিতেছি না। এই শব্দগুলিই আমার মৃত্যুবাণ! আমি জ্বলিয়া যাইতেছি। পুড়িয়া ছাই হইয়া গেলাম। নিরালম্ব বায়ুভূত হইতেছি। আহ্! এ তুমি কী বলিলে? আমার মরণান্তিক আর্তনাদে আকাশ, পৃথিবী ভরিয়া উঠিতেছে…
তুমি শান্ত আনন্দিত কণ্ঠে বলিলে, আমি বুদ্ধ হইয়াছি। আমি অখিল জীবের জন্য দুঃখমুক্তির মার্গ আবিষ্কার করিয়াছি। আমি ধন্য। আমি কৃতকৃত্য। আমি, সকলকে আশীর্বাদ করিতেছি। অভয় ঘোষণা করিতেছি। আর ভয় নাই। নির্ব্বাণং পরমং সুখম্!
তোমার সেই অভয়-বিঘোষণাই আমার ভয়ের কারণ হইল। আমি পলাইয়া যাইতেছি। আমি হারিয়া গিয়াছি। তুমি ধরিত্রীর উপর উঠিয়া দাঁড়াইলে, আমি ধরিত্রীর নিম্নে শততল পাতালের তলদেশে—মানবমনের অতল অবচেতনায় ডুবিয়া গেলাম। এক্ষণে আমাকে লুকাইয়া থাকিতে হইবে।
পৃথিবীতে ঝড় ঝঞ্ঝা প্রলয়রোল সহসা থামিয়া গিয়াছে। মেঘ কাটিয়া চন্দ্ৰ বাহির হইয়া আসিয়া সমস্ত আকাশ আলো করিয়া হাসিতেছে। সেই জ্যোৎস্নালোকে বনভূমি দুঃখনিশার অন্তে মায়াময় দেখাইতেছে। তুমি বোধিবৃক্ষতলে প্ৰসন্ন, নিৰ্ভয় বদনে দাঁড়াইয়া আছ। তোমার চরণ ধুইয়া দিতেছে নৈরঞ্জনা।
অহো! আজ আমি পরাস্ত। আমার আত্মাভিমান চূর্ণীকৃত। আমি তোমাকে জন্ম জন্ম ভ্রান্তপথে চালিত করিবার প্রয়াস করিয়াছিলাম। ব্যর্থ হইয়া অনঙ্গ অন্ধকারে আজ মুখ লুকাইয়া আছি। লজ্জা! লজ্জা আমাকে গ্রাস করিয়াছে। আমি তোমার নিকট হারিয়া গিয়াছি। তোমার কেশাগ্রও আমি স্পর্শ করিতে পারি নাই। তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি।
আমাকে জয় করিয়া আনন্দে তুমি বোধিদ্রুমতলে পদচারণা করিতেছ। তোমার সর্বাঙ্গ হইতে ঝরিয়া পড়িতেছে জ্ঞান, আনন্দ ও প্রেমের বৈভব!
আমি পরাস্ত হইয়াছি। তবু হে সিদ্ধার্থ! একবার কান পাতিয়া শোনো। তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু তোমার মহৎ উদ্দেশ্যকে আমি ব্যর্থ করিয়া দিয়াছি। তুমি বোধিলাভ করিলে, তুমি নির্বাণলাভ করিলে —সত্য। কিন্তু যাহাদের জন্য তোমার এই অমানুষিক তপস্যা, তাহারা কয়জন তোমার এই জ্ঞান চায়? কয়জন জন্মমৃত্যুর বন্ধন কাটাইয়া নির্বাণলাভ করিতে চায়? প্রায় কেহই নয়। সে-কথা তুমি ভাবিয়াছ কি?
প্রায় সকলেই সুখপূর্ণ জীবন চায়। সেই সুখ পাইবার জন্য বিপুল দুঃখও তাহারা সহ্য করিয়া লইতে চায়। দুঃখসুখপরিপূর্ণ একটা জীবন তাহাদের কাঙ্ক্ষিত। তাহারা বারংবার ইহারই জন্য ফিরিয়া আসিতে চায়। নির্বাণ কেহই প্ৰায় চাহে না। কেন তবে তুমি এই অসাধ্য প্রয়াস করিলে? কাহাদের জন্য?
তোমার এই আদর্শ কেহ মনে রাখিবে না। মূর্তি গড়িয়া তোমার পূজা করিবে। দীপ ধূপ দেখাইবে। তোমাকে লইয়া শিল্পবস্তু নির্মিত হইবে। তুমি ধীরে ধীরে গৃহসজ্জার উপকরণে মাত্র পর্যবসিত হইবে। কেহ তোমার আদর্শের অনুসরণ করিবে না। তোমার প্রেমের বার্তা ব্যর্থ হইয়া যাইবে। আমিই তাহা ব্যর্থ করিয়া দিব।
আমি চিরকাল তোমার মানবভ্রাতাভগিনীদিগকে হিংসা, অন্ধ বিশ্বাস ও ধর্মান্ধতার বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিব। বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটাইয়া নরশোণিতে পৃথিবীর পথ পিচ্ছিল করিয়া তুলিব। আমি প্রতি মানবের অন্তঃকরণে বসিয়া দিনে রাত্রে এই ছায়া ও আলোকের ভিতর সন্নিপতিত চরাচরকে গ্রাস করিবার উত্তেজনা প্রেরণ করিব। গ্রামে গ্রামে, রাজ্যে রাজ্যে, দেশে দেশে সংকীর্ণ স্বার্থের গরলে মানবমস্তিষ্ককে ঘুলাইয়া তুলিব। পররাজ্যলোলুপ রাজাগণ প্রত্যেকেই নিজ নিজ অস্ত্র শানাইবে। কেহ কাহারও ভাষা বুঝিবে না। অস্ত্রাঘাতের ভিতর দিয়াই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি খুঁজিবে। হত্যা, অপহরণ, গণধর্ষণে আক্রান্ত আর্ত মানবাত্মা চিরকাল গগনভেদী ক্রন্দনে আকাশ বাতাস আকুল করিয়া তুলিবে।
সমগ্র বিশ্বব্যাপী পরের পর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হইবে। মন্বন্তর শেষ হইলে নব মন্বন্তর শুরু হইবে। যুদ্ধ শেষ হইলে নূতন যুদ্ধের নান্দীরোল উঠিবে। মানুষ দিনরাত গবেষণা করিয়া মারণাস্ত্র আবিষ্কার করিবে। কোটি কোটি অসহায় নরনারীর মস্তকের উপর ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করিয়া তাহারা সেই মারণাস্ত্র প্রয়োগ করিবে। তাহার প্রভাবে যুগের পর যুগ ধরিয়া বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হইবে। মারণাস্ত্রের পরীক্ষা সম্পন্ন করিয়া সংকেতে বার্তা পাঠাইবে, ‘বুদ্ধ হাসিতেছেন’। তুমি কি আর এমতাবস্থায় হাসিতে পারো?
তোমার বিশাল বিশাল মূর্তি চূর্ণবিচূর্ণ করা হইবে। তোমার প্রতিকৃতির মুণ্ড ধুলার উপর গড়াগড়ি খাইবে। তোমার অনুসারী বলিয়া পরিচিতি-প্রদানকারী কাষায় পরিহিত বৌদ্ধ শ্রমণের দল অস্ত্র বহন করিবে। তাহারা শিশুহত্যা, নারীহত্যায় পারঙ্গম হইয়া উঠিবে। নিজ দেশ হইতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বিদিগের অনুপ্রবেশকারী বলিয়া বাহির করিয়া দিবে।
কী, সিদ্ধার্থ? কেমন শুনিতেছ? শিহরিয়া উঠিলে কেন? ইহাই ভবিষ্যৎ। ইহাই ঘটিবে। তুমি জ্ঞান ও প্রেমের মন্ত্রে আমাকে পরাস্ত করিতে পারো, কিন্তু তোমার ও প্রেমের বাণী শুনিবে কে? তোমাকে আমি স্পর্শ করিতে পারি নাই বটে, কিন্তু তোমার আদর্শকে আমি ধুলায় মিশাইয়া দিয়াছি।
তুমি বলিলে, ‘না। ইহার পরেও মানুষ সান্ত্বনা ও শক্তির জন্য আমাকেই স্মরণ করিবে। ইহার পরেও কেহ না কেহ আমার পথ অনুসরণ করিয়া বোধিলাভ করিবে। আমি তাহাদের নিকট চির-অনুপ্রেরণার স্থল হইয়া থাকিব। মনন, ধ্যান, তপস্যার সুমহান আদর্শ দ্বারা আমি ভাবীকালের জীবকুলকে নিত্য অনুপ্ৰাণিত করিয়া চলিব। হে মার! মানুষ তোমার দ্বারা ক্ষণতরে প্রভাবিত হইতে পারে। কিন্তু কখনোই কেহ তোমাকে আর চরম বলিয়া গ্রহণ করিবে না। অন্তিমে মানুষকে আমার আদর্শের নিকট আসিতেই হইবে। ইহা বিশ্বজগতের আলোকবর্তিকাস্বরূপ বিরাজ করিয়া দিশূন্যহীন অন্ধকার জীবনসমুদ্রে পথভ্রান্ত নাবিকদিগকে দিশা দেখাইবে, বিস্মৃতমার্গ অভিযাত্রীকে অমোঘ আলোকসংকেতে শান্তির তটরেখায় ফিরাইয়া আনিবে।’
ইহার পরেও তোমার এত আশা, সিদ্ধার্থ? এত প্রত্যয়? এত কথার পরেও এই বলিলে? হায়! এ লজ্জা আমি রাখিব কোথায়? কেমন করিয়া ভুলিব যে, সহস্রবিধ আক্রমণ করিয়াও তোমার শুভ প্রচেষ্টাকে… তোমাকে… আমি ছুঁতে পারিনি? হায়! তোমাকে আমি ছুঁতে পারিনি!”