৪. সিদ্ধার্থ-জিজ্ঞাসা

৪. সিদ্ধার্থ-জিজ্ঞাসা

রাজগৃহে বসবাস আমার আর নির্বিঘ্ন মনে হল না। আমি সিদ্ধার্থ; ব্যাধি-জরা- মরণ-সংকুল এই মানবজীবনের নিখিল দুঃখের আত্যন্তিক নিবারণ খুঁজতে সন্ন্যাসী হয়েছি, সেই উদ্দেশ্যেই রাজগৃহে গৃধ্রকূট শিখরে ধ্যান ধরে আছি, কিন্তু আজ আমার সমীপে মগধাধিপতি বিম্বিসার এসেছেন, আগামীকাল হয়তো তাঁর অমাত্যবর্গ আসবেন, পরশ্ব নগরীর প্রজাসাধারণ ভিড় জমাবে—এমতাবস্থায় আমার একাকী ধ্যাননিষ্ঠ জীবনের ব্যাঘাত হবে—তা তো আমি হতে দিতে পারি না। আমি চাই নির্জনে একাত্তবাস—জীবনের কঠিন সমস্যাগুলি নিয়ে ভাববার নির্জন অবসর। এই কথা ভেবে আমি পরের দিনই গৃধ্রকূট পরিত্যাগ করে নগরীর দক্ষিণে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলাম।

তা ছাড়া এও আমার মনে হচ্ছে, আমার পূর্বে অন্যান্য চিন্তাবিদগণ এই জীবনসমস্যা নিয়ে কী প্রকারে চিন্তা করেছেন—সে-কথাও আমার জানা প্রয়োজন। শুনেছি, অরণ্যে সাধকগণ অবস্থান করেন। আমার মনোবেদনা যদি আমি তাঁদের নিকট জ্ঞাপন করি, নিশ্চয়ই তাঁরা এ বিষয়ে যা জানেন, আমাকে বলবেন। কিন্তু তাঁদের সন্ধান আমি কীভাবে পাব?

অরণ্য জটিল, বহু শাখাপ্রশাখাসমন্বিত; দিবাভাগেও এত অন্ধকার যে পায়ে চলার পথ অন্বেষণ করা মধ্যে মধ্যে দুর্ঘট হয়ে পড়ে। এসব স্থানে ভিক্ষা মেলে না; বনের ফল আর নদীর জল ক্ষুধাতৃষ্ণানিবৃত্তির একমাত্র উপায়। রাত্রিকালে এ শ্বাপদসংকুল বনভূমিতে প্রথম প্রথম কোনো বৃহৎ বনস্পতির ডালে উত্তরীয়বস্ত্র দ্বারা নিজদেহ বন্ধন করে নিদ্রা যেতাম। কয়দিন পর বিবেকের নির্দেশ পেলাম। আমি সন্ন্যাসী; কেন আমার এই মৃত্যুভয়? তারপর থেকে বৃক্ষতলে বনস্পতিমূলে মাথা রেখেই বিশ্রাম করতাম, মনে হল, এতে যদি আমাকে কোনো বনের পশু আহার করে যায়; সে-ও ভালো। অন্তত, আমি সেই ক্ষুধার্ত পশুর বুভুক্ষা মেটাতে তার উদরবিবরে প্রবেশ করব, অকৃতার্থ জীবনের সার্থক পরিসমাপ্তি হবে।

মাঝে মাঝে বনের শুষ্ক লতাপাতা সংগ্রহ করে অগ্নিমন্থ প্রস্তর ঘর্ষণ করে ধুনি জ্বালাতাম; সে প্রস্তর আমার কাছেই ছিল। সেই ধুনির সম্মুখে রাত্রির পর রাত্রি গভীর মনঃসংযোগ করে দুঃখের প্রকৃতি ও তার নিবারণ অনুসন্ধান করতাম। কিন্তু অস্তিত্বের সুগোপন প্রদেশ অবধি শুধু বেদনার কালো করাল ছায়া ব্যতীত আর কিছুই আমার প্রত্যক্ষ হচ্ছিল না। সুখ কি নাই? আছে। কিন্তু সেসব কিছুর পশ্চাতেই আমি দুঃখের নিষ্ঠুর দন্তুর হাস্য অবলোকন করছিলাম। সমস্ত জীবনটা যেন এক পুষ্পাচ্ছাদিত শবদেহ, আর সেই শবদেহ নিত্য পচনশীল। সেই পচনের দুর্গন্ধ তার উপরের পুষ্পাস্তরণ ভেদ করে যেন আমার নাসায় প্রবেশ করতে লাগল। যেখানেই একবিন্দু হাসি আছে, সেখানেই বুকফাটা ক্রন্দনের কারণও লুক্কায়িত। প্রতিটি মিলনই অন্তিমে বিচ্ছেদে রূপান্তরিত হয়। প্রতিটি আলিঙ্গন নিষ্পেষণে।

একই সঙ্গে আমার মনের ভিতর হতেও একটা কণ্ঠস্বর সময়ে সময়ে উঠে আসে। সে আমারই অপর এক সত্তা। সে আমাকে ধ্যান ছেড়ে দিতে বলছে। রাজ্যে ফিরে যেতে বলছে। কখনও বন্ধুর মতো অনুনয়ের ভাষায়, কখনও প্ৰবল শত্রুর ন্যায় ভীতিপ্রদর্শন করছে। কখনও প্রলোভন দেখাচ্ছে। কখনও আমাকে ব্যঙ্গ করে চলেছে। ধ্যানের ভিতর উদ্ভট বিকৃত মূর্তির উদ্ভব ঘটিয়ে সংশয় তুলছে। কখনও আবার আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পদাঘাত হেনে, থুতু ছিটিয়ে, কালিমালিপ্ত করে আমার মনে বিক্ষেপ আনছে। এ কে? এ যে আমিই! আমিই আমাকে বাধা দিয়ে চলেছি জন্ম জন্ম ধরে। এত বীভৎস চিন্তা আমি করতে পারি? এর হাত থেকে কি আমার নিস্তার নেই?

কখনো কখনো সে আমার ভিতর হতে ভয়ানক মূর্তি ধরে বাহিরে আসে। প্রহরের পর প্রহর তর্ক করে। বলে, সে মার! সে কামদেব। আমি তাকে এখনও চিনতে পারিনি। সে নাকি আমার বন্ধু! যদি সে বন্ধুই হত, তবে সে কেন আমার অন্বেষণে বাধা দেয়? আমি কিছুতেই এ প্রহেলিকার নিষ্পত্তি করতে পারছি না।

একদিন বনপথ দিয়ে চলতে চলতে মধ্যাহ্নবেলায় সম্মুখে এক প্রান্তর পড়ল। প্রান্তর কীভাবে পার হব ভাবছি, এমন সময় এক শিংশপা বৃক্ষের তলদেশে এক ব্যক্তিকে আমি দর্শন করলাম। সম্মুখে উপনীত হয়ে দেখি, সে ব্যক্তি জীর্ণ এক বস্ত্রে আচ্ছাদিত হয়ে নিতান্ত নিশ্চেষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে। আমি তারই নিকটে উপবেশন করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভদ্রমুখ! আপনি কে? এখানে নিশ্চেষ্ট অবস্থায় পড়ে আছেন কেন?’

সে বলল, ‘আমার নাম পূরণ কাশ্যপ। কোনো কর্ম, কোনো চেষ্টার কোনো অর্থ নাই বলে, আমি এস্থলে এভাবে নিশ্চেষ্ট দশায় পড়ে আছি।’

আমি বললাম, ‘কর্মের কোনো ফল নাই? সকল চেষ্টা নিরর্থক?’

‘আপনি ঠিকই শুনেছেন, ভিক্ষু!’

‘শুভকর্ম আর অশুভ কর্মের মধ্যে কোনো প্রভেদ নাই? তা কী করে হতে পারে? শুভকর্মে পুণ্যফল, অশুভকর্মে পাপফল—এ যে জগতের নিয়ম!’

‘কে এই নিয়ম স্থির করেছে? এ সকল ব্রাহ্মণদিগের মিথ্যাবাদ। কর্ম হতে পাপ বা পুণ্য কোনোরূপ ফল উৎপন্ন হয় না।’

আমি তর্কে প্রবৃত্ত হলাম। বললাম, ‘কেউ যদি অন্যায় করে, তবে সে শাস্তি পাবে না?’

‘না, পাবে না। শুধু তাই নয়, মিথ্যাবাদ, পাপাচার, অন্যের ক্ষতিসাধন, অত্যাচার, চৌর্যবৃত্তি, ভ্রূণহত্যা, পরস্ত্রীগমন, হত্যা— কোনোকিছুতেই পাপ হয় না। জগতের সকল প্রাণীকুলকে তীক্ষ্ণধার চক্রে খণ্ডবিখণ্ডিত করে এ বিশ্বকে বীভৎস মাংসস্তূপে পরিণত করলেও কোনো পাপ হয় না।’

‘সে কী? তবে দান, সংযম, অহিংসা, সত্যবচন—এসবের অর্থ কী?’

‘কোনো অর্থ নাই। দান, সংযম, অহিংসা সত্যবচন প্রভৃতিতেও কোনো পুণ্যফল অর্জিত হয় না। সদাচরণ নিরর্থক। ওইগুলির অনুষ্ঠান পণ্ডশ্রম মাত্ৰ। কোনো কর্ম—সে সৎ-ই হোক, আর অসৎ-ই হোক—তার কোনো ফল নাই। এই কথা আমি সম্যক অনুধাবন করেছি। আর তা অনুধাবন করেছি বলেই আমি সৎ বা অসৎ কোনোরূপ কর্মে অংশগ্রহণ করি না। নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে থাকি। এই নিশ্চেষ্টতাই জীবনের চরম আপ্তি।’

আমি বললাম, ‘বেশ। অক্রিয়বাদে আপনার যখন এতই আসক্তি… আহার-বিহার, এমনকি শ্বাসনিষ্পত্তি—এগুলিও তো কর্ম। এগুলি বন্ধ করে দেখুন, প্রাণধারণ করতে পারেন কিনা!’

আমার এই কথায় সেই পূরণ কাশ্যপ আমার দিকে এমন জ্বলন্ত দৃষ্টিক্ষেপ করতে লাগল যে, এখনই সে আমাকে ভস্ম করে ফেলবে। আমি মৃদুহাস্যে এ উন্মাদকে উপেক্ষা করে পুনরায় প্রান্তরের পথ ধরলাম।

আর-এক দিন। হাঁটতে হাঁটতে দেখছি, মাথার ওপর অরণ্যের চন্দ্ৰাতপ লঘু হয়ে আসছে; এতদঞ্চলে বনভূমি তত নিবিড় নয়। কিছুক্ষণ চলবার পর অটবির প্রান্তদেশে সুপরিষ্কৃত এক আশ্রম দৃষ্টিগোচর হল। বনচ্ছায়ায় কতগুলি নিৰ্মল কুটির, তাদের মধ্য দিয়ে রক্তমৃত্তিকায় নির্মিত একটি পথ এঁকেবেঁকে কোথায় যেন চলে গেছে। এখানে-ওখানে আর্দ্র পরিধেয় শুষ্ক করার নিমিত্ত লম্বিত রয়েছে। আকাশের বর্ণ মসিকৃষ্ণ—এখনই বৃষ্টি নেমে আসবে।

আর কিছুদূর অগ্রসর হতেই এক আশ্রমিক আমার পথরোধ করে আমার পরিচয় ও এখানে আসার উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, ‘আমি এক জিজ্ঞাসু, নাম আমার সিদ্ধার্থ। এ আশ্রমের কুলপতি কে? তাঁরই আমি দর্শনের অভিলাষী।’

আশ্রমিক বললেন, ‘আশ্রমের কুলপতির নাম মক্‌খলি গোশাল। আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

আমাকে তিনি আশ্রমের কুলপতির নিকট নিয়ে গেলেন। দেখলাম, মক্‌খলি গোশাল প্রৌঢ় ব্যক্তি। বংশনির্মিত একটি উচ্চাসনে আসীন। গাত্রে একটি গৈরিক বাস।

পরিচয়বিনিময়ের পর তিনি আমার কী প্রশ্ন আছে, জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, ‘মানবজীবন আজন্মমরণ দুঃখময়। জন্মান্তরেও এই দুঃখের পুনরাবৃত্তি। এর হাত থেকে নিস্তারের কী উপায় আছে, আপনি স্থির করেছেন?

মক্‌খলি গোশাল আমাকে প্রতিপ্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি নিজ চেষ্টায় দুঃখের নিবৃত্তির উপায় অনুসন্ধান করছেন?’

আমি বললাম, হাঁ, অবশ্যই।’

তিনি বললেন, ‘তা তো হবার নয়। আপনি নিজে চেষ্টা করলেও দুঃখের অন্তে উপনীত হতে পারবেন না। দুঃখ আমাদের অদৃষ্ট। আমাদের নিয়তি। এই নিয়তি বা অদৃষ্ট আমাদের জীবনকে পরিচালিত করছে। মানুষ চেষ্টা করলেও নিয়তিনির্দিষ্ট পন্থা হতে একবিন্দু সরে দাঁড়াতে পারবে না।’

‘সে কীরূপ?’

‘যেমন স্রোতের মধ্যে পতিত তৃণখণ্ড নিজেকে একবিন্দুও নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না। স্রোতই তাকে সম্মুখে বহন করে নিয়ে যায়; স্রোতই ঠিক করে দেয়, সে কোনপথে যাবে। আমরাও ওই স্রোতের ভিতর পতিত তৃণখণ্ডের ন্যায়।’

‘তাহলে দুঃখের কি কখনও নিবৃত্তি হয় না?’

‘হয়। কিন্তু সে লক্ষকোটি জন্মের পর। নিয়তিতাড়িত জীব এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে, এইভাবে অগণ্য জন্ম পরে মুক্ত হয়। কিন্তু তাতে সেই জীবের কোনো হাত নেই। নিয়তি যেদিকে নিয়ে যাবে, সেইদিকেই যেতে হবে।’

এসব কথা যখন মক্‌খলি গোশাল বলছিলেন, তখনই আমার ভিতর থেকে কে এক অসুন্দর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এ কথা আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, সিদ্ধার্থ! তুমি নিজের চেষ্টায় কিছুই করতে পারবে না। তাই বলি, জীবন যেমন দেয়, সেরকমই ভোগ করো।’

আহ্! এই এক জ্বালা! আমার ভিতরে এই সংশয়ী সত্তা ক্রমাগত আমাকে অত্যাচার করে চলে। আমি নিজের মনেই আত্মগত স্বরে বলে উঠলাম, ‘ওরে দুর্বৃত্ত মার! স্তব্ধ হও। আমাকে বিচার প্রয়োগ করে মক্‌খলি গোশালের এই তত্ত্বকে পরীক্ষা করতে দাও।’

আমি মক্‌খলি গোশালের উদ্দেশে প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে আমাদের কর্তব্য কী?’

তিনি বললেন, ‘অদৃষ্টকে মেনে নেওয়া। এই আমাদের কর্তব্য। নিজে কোনোরূপ চেষ্টা না করা। ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ করা। এ ছাড়া অন্য কর্তব্য নেই।’

‘আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে আপনি, মক্‌খলি গোশাল, গৃহস্থাশ্রম পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়েছেন কেন? সে-ও তো আপনি নিজের চেষ্টাতেই হয়েছেন।!’

তিনি উত্তর দিলেন, ‘সন্ন্যাসী হওয়া আমার নিয়তি ছিল, তাই সন্ন্যাসী হয়েছি। সবই নিয়তি, সবই অদৃষ্ট।’

‘ধ্যান, সংযম, তপস্যার অর্থ কী তাহলে?’

‘কিছুই না। ধ্যান-তপস্যা করা যার নিয়তি, সে ধ্যান-তপস্যা করে। পৃথকভাবে ওসবের আর কোনো মূল্য নেই। সবসময় নিয়তি বা অদৃষ্টের দিকে তাকিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই।

এ ব্যক্তি ‘নিয়তি’ আর ‘অদৃষ্ট—এই দুই কথা ছাড়া আর কিছু জানে বলে মনে হল না। অপ্রসন্ন মনে আমি কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হলাম।

আশ্রমের পক্ষ হতে আমাকে চিপিটক ও তক্র ভিক্ষা দেওয়া হল। আশ্রমের বাহিরে এক বৃক্ষতলে বসে আহার করছিলাম। এমন সময় আশ্রমে প্রবেশকালে যে আশ্রমিককে দেখেছিলাম, তিনি আমার নিকটে এলেন।

হাসিমুখে আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী? আপনার জিজ্ঞাসা তৃপ্ত হল?’

আমি বললাম, ‘কই আর হল? শুনলাম, সবই নিয়তি বা অদৃষ্ট!’

তিনি বললেন, ‘ওই এক কথা আমিও বিগত তিন বৎসর শুনে আসছি। শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল।’

আমি বললাম, ‘আপনি কী উদ্দেশ্যে এই আশ্রমে এসেছিলেন?’

‘পঞ্চদশ বর্ষপূর্বে জীবনজিজ্ঞাসায় মথিত হয়ে আমি গৃহত্যাগ করি। এ আশ্রমে প্রবেশ করার পূর্বে দুইটি আশ্রম—নিগন্থ নাথপুত্ত ও সঞ্জয় বেলঠিপুত্তের আশ্রমে ছিলাম। সেখানেও কোনো সমাধান পাইনি। ‘

আমি বললাম, ‘তাঁরা আপনাকে কী বলেছিলেন, যদি অনুগ্রহপূর্বক বিশদে বলেন!’

‘নিগন্থ নাথপুত্ত আমাকে বললেন, সুখ ও দুঃখ পরস্পর সংযুক্ত। সুখটি আকাঙ্ক্ষা করলেই দুঃখও পেতে হবে। অতএব, দুঃখের হাত থেকে নিষ্কৃতির উপায় সুখ পরিহার করা।’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ সুখ-দুঃখ উভয় হতে দূরে অবস্থান করো। কঠোর সংযম অভ্যাস করো। লোকসমাজ পরিত্যাগ করে গিরিগুহাগহ্বরে বা কোনো নির্জন স্থানে চলে যাও। এমন স্থানে যাও, সেখানে পঞ্চেন্দ্রিয়ের বিষয় কিছুমাত্র না থাকে। যদি প্রয়োজন হয়, চক্ষু-কর্ণ উৎপাটিত করো। মনকে অসাড় করে দাও। একমাত্র এই উপায়েই দুঃখকে এড়ানো সম্ভব।’

‘বুঝলাম। হস্তে বিস্ফোটক হয়েছে বলে হস্ত-কর্তনের ব্যবস্থা। শিরঃপীড়া দূর করার জন্য শিরশ্ছেদের আয়োজন। আপনি এই মত অনুশীলন করেছিলেন?’

‘করেছিলাম। কিন্তু ফল হল ভয়াবহ। আমি যে খুব নৈতিক জীবনযাপন করছি, আমাতে তার তীব্র অহংকার উপস্থিত হল। ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করে রাখলেও অন্তরে বাসনা প্রবলতর হতে লাগল। অবশেষে… আপনি আন্তরিক জিজ্ঞাসু তাই আপনাকে বলছি… কিছুদিন পরেই আমার এক দারুণ নৈতিক পতন হয়। সে অবস্থায় আমি নিগন্থ নাথপুত্তের আশ্রম ছেড়ে সঞ্জয় বেলঠিপুত্তের আশ্রমে আসি।’

‘সঞ্জয় বেলঠিপুত্তের শিক্ষাই বা কীরূপ ছিল?’

‘তাঁর বক্তব্য ছিল নিগন্থ নাথপুত্তের সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি বলতেন, যা আছে এই সুখদুঃখপূর্ণ জগৎটাই আমাদের সামনে আছে। এই ব্যাপারেই আমরা যা একটু নিশ্চিত হতে পারি। আর এই সুখদুঃপূর্ণ জগতের বাইরে যদি বা কিছু থাকেও, সে-কথা আমরা জানতে পারি না। আমি কোনো বস্তুকে এক প্রকারে জানি না। আমি অন্য প্রকারেও কিছু জানি না। আমি যে জানি না, তাও জানি না। কিংবা তাও নয়।

‘অর্থাৎ, সম্পূর্ণ অজ্ঞেয়বাদী?’

সম্পূর্ণ অজ্ঞেয়বাদী। সেখানেও বছর কতক থাকলাম। কিছুই পেলাম না। অবশেষে এই মক্‌খলি গোশালের আশ্রমে এসে আছি। এখানেও কিছু নেই। মানুষ অদৃষ্টের উপর কতদিন নির্ভর করে পড়ে থাকতে পারে, মহাশয়? মাঝে মাঝে ভাবি, এমন কি কোনো পন্থা নেই, যা মানুষ সজ্ঞানে অনুসরণ করে দুঃখের অতিক্রম খুঁজে পেতে পারে?’

আশ্রমিক ব্যক্তিটির কথা শুনতে শুনতে আমিও আকাশের দিকে তাকিয়ে একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম। কিন্তু মেঘমলিন আকাশে কোনো উত্তর নেই— শুধু একটা স্তম্ভিত জিজ্ঞাসা আকাশ জোড়া মেঘের মতো থমকে দাঁড়িয়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *