১৫. সিদ্ধার্থ

১৫. সিদ্ধার্থ

রাত শেষ হইয়া ভোর আসিবার পূর্বেই অন্ধকার গাঢ়তম হইয়া উঠে। প্রভাতের অস্ফুট আলোক সেই অন্ধকারের সহিত মিশিয়া দুর্ভেদ্য প্রহেলিকায় দৃষ্টি আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল। শেষরাত্রে অশ্বত্থ বৃক্ষের নিম্নে অর্ন্তমুখ হইয়া আমি সিদ্ধার্থ অবস্থান করিতে ছিলাম। চারিদিক নিঃশব্দ, পত্রপতনেরও শব্দ হইতেছে না। সেই শিলীভূত নৈঃশব্দ্যের ভিতর, স্তব্ধ চরাচরের ভিতর প্রাণবায়ু সংরুদ্ধ করিয়া আমি বসিয়াছিলাম।

সহসা কাহাদের পদশব্দে এ উরুবিল্ব বনের নিস্তব্ধতা ভাঙিল। চক্ষুরুন্মীলন করিয়া সহজাবস্থায় ফিরিতে আমার সামান্য বিলম্ব হইল। ক্ষণপরে অস্পষ্ট লক্ষ করিলাম, একজন রমণী, একটি বালিকা ও অপর একটি কিশোর এইদিকেই আসিতেছে। কিশোরটির হস্তে একটি প্রদীপ। সেই প্রদীপের আলোকে পথ দেখিয়া তাহারা চলিতেছে। বালিকার শিরোদেশে একটি পাত্র, এক হস্তে মস্তকোপরি সেই পাত্র ধরিয়া, অন্য হস্ত দেহের পার্শ্বে সঞ্চালনপূর্বক ভাররক্ষা করিয়া বালিকা নৃত্যছন্দে হাঁটিতেছে। আর ইহাদের নেত্রী সেই নারী—বক্ষে একটি শিশুপুত্র লইয়া অগ্রসর হইতেছে। দেখিতে দেখিতে তাহারা সম্মুখে আসিয়া পড়িল।

প্রদীপ ধরিয়া তাহারা আমাকে অবলোকন করিল। দেখিতে দেখিতে নারী ভাববিহ্বল হইয়া পড়িল, বুঝিলাম। তাহার পর বালিকাটির মস্তক হইতে পাত্রখানি নামাইয়া আমার সম্মুখে যত্নসহকারে রাখিল। শিশুটিকে বালিকার ক্রোড়ে ন্যস্ত করিয়া গলবস্ত্র হইয়া নারী ভূমির উপর তাহার শিরোদেশ স্পর্শ করিয়া আমাকে প্রণাম করিল। বালক বালিকা দুইটিও তাহার দেখাদেখি প্রণাম নিবেদন করিল। প্রণাম নিবেদনের পর সেই নারী কৃতাঞ্জলিপুটে কহিল, ‘হে বৃক্ষদেবতা।…’ এইরূপ সম্বোধন করিয়া সে তাহার স্বামী, পুত্র ও অন্যান্য সকলের জন্য প্রার্থনা করিল।

আমি বৃক্ষদেবতা নহি, আমি মনুষ্য, আমি সিদ্ধার্থ। নিখিল জীবের দুঃখে ব্যথিত হইয়া গৃহত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হইয়াছি। তাহারই সমাধান অন্বেষণ করিতেছি। দেবতারা সর্বক্ষমতাসম্পন্ন, আমি ইহা স্বীকার করি না। মানুষের দুঃখ ঘুচাইবার শক্তি মানুষের ভিতরেই নিহিত আছে। কিন্তু এসকল কহিয়া এই গ্রাম্য ললনার সহজ বিশ্বাসকে আমার আঘাত দিতে ইচ্ছা হইল না। আমার সকল তপস্যার শক্তিতে এই নারীর বাঞ্ছা পরিপূর্ণ হউক, এই শুভেচ্ছায় সহসা আমার হৃদয় ভরিয়া উঠিল। কহিলাম, ‘স্বস্তি!’

তাহারা পুনরায় নমস্কার করিয়া যে পথ ধরিয়া আসিয়াছিল, সেই পথ দিয়া চলিয়া গেল। প্রভাত হইতেছে। নবোদিত সূর্যের প্রথম কিরণ অন্ধকারের স্তর ভেদ করিয়া ধরিত্রী, নদী, অরণ্যের উপর ছড়াইয়া পড়িতেছে। ধীরে ধীরে আঁধার কাটিয়া গেল। নদীর কল্লোলধ্বনি আসিয়া কর্ণে প্রবেশ করিল। জীবজগৎ ও উদ্ভিদজগৎ ক্রমে জাগিয়া উঠিতেছে।

অরণ্যের বিহগকুল তাহাদের কলতানে প্রভাতী আকাশ ভরিয়া দিল। দিবাভাগের শুভসূচনা হইতেছে। আমি নারীপ্রদত্ত সেই পাত্রটির অভ্যন্তরে দৃষ্টিপাত করিলাম। পায়সান্ন দিয়া গিয়াছে। কে এই নারী, কোথা হইতে আসিল? নদীর পরপারের গ্রাম হইতে আসিয়াছে, বোধহয়। হয়তো নূতন জননী হইয়াছে, শিশুসন্তানের কল্যাণকামনায় বুঝি বা এই পায়সান্ন নিবেদন করিয়া গেল! তিন দিন আমি ভিক্ষার্থে বহির্গত হই নাই। একাসনে বসিয়াছিলাম। অনুভব করিলাম, আমি ক্ষুধার্ত হইয়াছি। পাত্র হইতে পায়সান্ন লইয়া আহার করিলাম। প্রাণ যেন জুড়াইয়া গেল।

নদীজলে হস্ত মুখ প্রক্ষালন করিয়া বেলাভূমির উপর ধীরে ধীরে হাঁটিতেছিলাম। আজ আমার নিজেকে বড়ো সহজ মনে হইতেছে। বাতাস মধুময় বোধ হইতেছে। আকাশ নীলাজকুসুমের ন্যায় প্রতিভাত হইতেছে। আজ যেন কোথাও কোনো বাধা নাই। সকলই অবাধ, অগাধ হইয়া প্রকৃতির ক্রোড়োপরি মাথা রাখিয়া শুইয়া আছে।

নদীর এই পারে বেলাভূমির ধার দিয়া দিয়া উরুবিল্ব বনের প্রান্তনীলিমা বিথারিত হইয়া রহিয়াছে। বনপথ দিয়া হাঁটিতেছিলাম। মাথার উপর সুশীতল বনচ্ছায়া। নদীর বাতাসে তরুশাখায় নবীন পত্রগুলি মাথা নাড়িতেছে। মধ্যে মধ্যে দুই একটা বিবর্ণ প্রবীণ পত্র বাতাসের ভিতর ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাটির উপর নামিয়া আসিতেছে। পত্রান্তরালে বিহগকুল নীড় বাঁধিতেছে। কাঠবিড়ালি ভীতমনে এক শাখা হইতে অন্য শাখায় লম্ফ দিয়া উঠিতেছে। দুই বৃক্ষের মধ্যস্থলে ঊর্ণনাভ জাল বুনিতেছে

সহসা মনে হইল, আজ হইতে সহস্র সহস্র বৎসর কাটিয়া যাইবে। এই অরণ্য কি এইস্থলেই রহিবে? এই গহন অটবিমধ্যে আমি যে-সকল চিন্তার তরঙ্গ রাখিয়া যাইতেছি, তাহা কি ভবিষ্যতের মনুষ্যের হৃদয়কে স্পর্শ করিবে? অতলান্ত সময়সমুদ্রে যে দুই অঞ্জলি চিন্তাবারি দিয়া আমি আকাশের তলে সত্যের উপাসনা করিয়া গেলাম, তাহার সন্ধান কে পাইবে?

ভাবিতে ভাবিতে মনস্থির হইল। চক্ষুদ্বয় নিমীলিত হইয়া আসিল। ইন্দ্রিয়গুলি স্ব স্ব গোলকে অবস্থান করিতে লাগিল। অতীতের চিন্তা হইতে মন ফিরিয়া আসিতে লাগিল। ভাবীকালের চিন্তা হইতেও ফিরিয়া আসিল। অনুভব হইল, কাল বর্তমানে বদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। যাহা একবার মন হইতে ত্যাগ করিয়াছি, তাহার দিকে চিত্ত আর ধাবিত হইতেছে না। আমি যেন প্রস্তরের ন্যায় নিশ্চল হইয়া উঠিতেছি। শত আঘাতেও আর যাহা ভাঙিবে না। আমি—আমিই এই জগজ্জাল ছিঁড়িয়া মুক্ত সিংহের ন্যায় বাহির হইয়া আসিব, এইরূপ স্থির প্রত্যয় ও আত্মশ্রদ্ধা জাগরিত হইল। সমাহিত চিত্তে সেই অশ্বত্থ বৃক্ষতলে আসিয়া বসিলাম।

মন সাক্ষী হইয়া প্রতিটি চিন্তাকে পরীক্ষা করিতেছে। প্রতিটি বস্তু ও ব্যক্তির ছায়ার ভিতর অনিত্যতার দুরপনেয় ছাপ লাগিয়া আছে। বিশ্বজগতে এমন কিছুই নাই, যাহা আমাকে আর প্রলোভিত করিতে পারে। এ পুনরাবর্তনের কূটনীতি হইতে বাহির হইয়া যাইবার জন্য প্রাণ ব্যাকুল হইয়া উঠিল।

তথাপি, কে আমাকে জন্মজন্মান্তর ব্যাপিয়া এই জগৎকারাগারের ভিতর বন্দি করিয়া রাখিয়াছে? কে সে?

ভাবিয়া তৎক্ষণাৎ এ সমস্যার সমাধান পাইলাম না। রৌদ্র উঠিল। বেলা হইতেছে। স্থির করিলাম, বৃক্ষতল হইতে উঠিয়া নৈরঞ্জনায় স্নান সারিয়া আসিব। ধীর পদক্ষেপে নদীর পাড় বাহিয়া নামিলাম। প্রভাতে সেই নারী যে পাত্রে পায়সান্ন দিয়া গিয়াছিল, উহা ধৌত করিব, ভাবিলাম। নদীতে স্রোত প্রচুর। জলের ভিতর কিছুদূর অগ্রসর হইয়া কী খেয়াল গেল, কৈশোরকালের ন্যায় সন্তরণ করিতে ইচ্ছা হইল। আজ আমার মন বালকের ন্যায় প্রফুল্ল। তাহার উপর দিয়া কী যেন ভার নামিয়া গিয়াছে। লঘুছন্দে সাঁতার দিতেছিলাম। নদীর তরঙ্গমুখর ঊর্মিমালারাশি আমার সহিত প্রগল্ভা বালিকার ন্যায় খেলা করিতেছিল।

নদীর ঘাটের নিকটে যেখানে স্বল্প জল আছে, সেইখানে পায়সান্নের পাত্রটি ভাসাইয়া রাখিয়াছিলাম। সহসা দেখিলাম, স্রোতোবেগে তাহা ভাসিয়া যাইতেছে। আমি হস্ত প্রসারিত করিয়া উহা ধরিতে গেলাম। কী আশ্চর্য! পাত্রটি স্রোতের বিপরীত অভিমুখে ভাসিতেছে! ইহা কি কোনোমতে হইতে পারে? অথচ সেই অসম্ভব ঘটনাটিই আমার চক্ষুর সম্মুখে অনুষ্ঠিত হইতেছে, দেখিতেছি। পাত্রটি ফিরিয়া পাইবার সকল চেষ্টা পরিত্যাগ করিতে হইল। জলের ভিতর অর্ধনিমগ্ন হইয়া দেখিলাম, পাত্রটি তিরবেগে স্রোতের বিপরীতে ভাসিয়া গিয়া একটি প্রস্তরখণ্ডে বাধাপ্রাপ্ত হইয়া চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গেল। পাত্রখণ্ডগুলির সলিলসমাধি হইল। আর তাহাদের জলের উপরে দেখা গেল না।

বুঝিলাম, প্রকৃতি এক আশ্চর্য গূঢ় ইঙ্গিত দিতেছে। স্রোত যেদিকে বহিতেছে, প্রকৃতি জীবকে যেদিকে ঠেলিয়া লইয়া যাইতেছে, তাহার বিপরীত দিকেই— অর্থাৎ স্রোতের বিরুদ্ধেই যাত্রা করিতে হইবে। প্রকৃতি মানুষকে প্রবৃত্তির স্রোতে ভাসাইয়া লইয়া যায়। তাহাকে কাম, ক্রোধ, লোভের দিকে ভাসাইয়া লয়। কিন্তু যদি ইহাদের জয় করিতে হয়, তবে প্রকৃতিরই বিরুদ্ধাচরণ করিতে হইবে। তাহা হইলেই ঘটটি যেরূপ চূর্ণবিচূর্ণ হইয়াছে, আমার বাসনাসংস্কারও সেই রূপেই বিনাশপ্রাপ্ত হইবে। তখনই নির্বাণসলিলে চিরনিমগ্ন হইতে পারিব।

জল হইতে উঠিয়া আসিলাম। এক অপূর্ব আলোকে আমার হৃদয়কন্দর উদ্ভাসিত হইয়া আছে। মন দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় সুস্থির হইয়াছে।

অরণ্যের ভিতর একটি বিশ্বফল পাইলাম। উহা আহার করিলাম। আহার করিতে করিতে অনেক পুরানো কথা মনে উঠিল।

একদিন ছিল, যখন কঠোর তপ অবলম্বন করিয়া আমি ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। দেহের দিকে কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করিতাম না। যোগাসনে উপবিষ্ট হইয়া নির্বাণলাভের জন্য দেহ ও মনকে পীড়ন করিতাম। আহারের মাত্রা হ্রাসপ্রাপ্ত হইতে হইতে সারাদিনে একটি তণ্ডুলকণায় আসিয়া ঠেকিয়াছিল! এক দিন নহে, দুই দিন নহে, এক মাস নহে, দুই মাস নহে, সুদীর্ঘ ছয় বৎসর কাল এইপ্রকার কঠোর সাধনা করিয়াছিলাম। কত রৌদ্র, কত বৃষ্টি, কত শীত, কত গ্রীষ্ম আমার মাথার উপর দিয়া চলিয়া গিয়াছিল, আমি তাহা জানিতেও পারি নাই। আমার দেহের দিব্যকান্তি বিলুপ্ত হইয়াছিল, দৃঢ় বলিষ্ঠ বিশালবপু কঙ্কালে পরিণত হইয়াছিল।

কিন্তু তাহাতে কিছু হইল না। শরীর দুর্বল হইল মাত্র। দুর্বল দেহ নির্বাণপথের অন্তরায়। তাই পুনরায় পরিমিত আহার-বিহারের দ্বারা দেহকে দৃঢ় ও মনকে আশাবান করিলাম। উহা আমার অনুসারী সেই পঞ্চ ভিক্ষুর ভালো লাগিল না। উহারা কৃচ্ছ্রসাধনের অনুপন্থী। তাই উহারা আমাকে ছাড়িয়া গিয়াছে। ভালোই হইয়াছে। জীবনসমস্যা সমাধানের জন্য একাকী হওয়া বড়ো প্রয়োজন।

আহার সমাধা করিয়া পুনরায় ধ্যাননিবিষ্ট হইলাম। চিত্তকে নিবাত নিষ্কম্প প্রদীপশিখাবৎ করিতে হইবে। প্রহরের পর প্রহর প্রাণ নীরব হইয়া কথা-না-বলা পাখিটির ন্যায় চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল। ধ্যান হইতে যখন উঠিলাম, দেখিলাম, রৌদ্র ঘুরিয়া গিয়াছে। দিনান্তে আলোকের তেজ কমিয়া আসিয়া সন্ধ্যার তরল ছায়া পৃথিবীর বক্ষে নামিয়া আসিতেছে।

নৈরঞ্জনা হইতে সন্ধ্যাস্নান করিয়া ফিরিতেছিলাম। আজ বোধ হয় পূর্ণিমা। নদীতীর ঝিল্লিরবে মুখরিত। আকাশে স্বর্ণস্থালিকার ন্যায় সুবতুল চন্দ্রোদয় হইতেছে। সন্ধ্যার আলোআঁধারির ভিতর মনুষ্যপদশব্দে চমকিত হইয়া ফিরিয়া দেখিলাম, কে একজন আসিতেছে। নিকটে আসিলে চিনিতে পারিলাম, সে সেই প্রভাতবেলার কিশোর।

সে শান্ত কণ্ঠে কহিল, ‘ভগবন! আমার নাম সোয়াস্তি! গোচারণ করিয়া থাকি। প্রভাতে আপনাকে কিছু উপহার দিতে পারি নাই। সমস্ত দিন ধরিয়া এই ঘাসের আসন বুনিয়াছি। আপনি এই তৃণাসনটি স্বীকার করিয়া আমাকে ধন্য করুন!

আমি তাহার হস্ত হইতে আসনটি গ্রহণ করিয়া বৃক্ষতলে বিছাইয়া দিলাম। তাহার উপর বসিয়া আমার মন বড়ো স্নিগ্ধ হইল। আর্দ্র কুশঘাসের সদ্যোনির্মিত আসনের সুঘ্রাণ! কিশোরটিকে আশীর্বাদ করিলাম। সে প্রণামনিবেদনান্তর চাঁদের আলোকে পথ দেখিয়া গৃহে ফিরিয়া গেল।

প্রকৃতি নীরব হইয়া আছে। বনভূমি শশীপ্রভায় হাসিতেছে। আমার মাথার উপর কিন্তু অশ্বত্থবৃক্ষটি ছায়া ধরিয়াছে। আমি কায়-শির-গ্রীব সমান করিয়া দৃঢ় হইয়া বসিয়া নির্ভয়ে ঘোষণা করিলাম:

ইহাসনে শুষ্যতু মে শরীরং
ত্বগস্থিমাংসং প্রলয়ঞ্চ যাতু।
অপ্রাপ্য বোধিং বহুকল্পদুর্লভাং
নৈবাসনাৎ কায়মতশ্চলিষ্যতে।।

এই আসনে আমার শরীর শুকাইয়া যায়, যাক। ত্বক, অস্থি, মাংস ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তো হউক। তথাপি, বহুকল্পদুর্লভ বোধিলাভ না করিয়া আমার দেহ এই আসন ত্যাগ করিয়া উঠিবে না।

এই কথা উচ্চারণ করা মাত্র আমার ভিতর হইতে যেন একটা কালো ছায়া আর্তনাদ করিয়া বলিয়া উঠিল: ‘না, না, না!’ ইহা তো বড়ো অদ্ভুত হইল! কে আমাকে ভিতর হইতে বাধা দিতেছে?

আমি সেই নিষেধবাক্য অগ্রাহ্য করিলাম। মনের ভিতর অমন কত কী শুনা যায়!

আমি সব দেবতারে ছাড়িয়া আমার প্রাণের কাছে সরিয়া আসিলাম। হৃদয় হইতে একটি শুভেচ্ছার ভাব, যাহাতে ত্রিজগতের সকল জীব সুখী হয়, শান্ত হয়, আনন্দময় হয়, পরিপূর্ণতা লাভ করে—এই প্রার্থনা দশদিকে বহাইয়া দিলাম। তাহার পর অতন্দ্র চিত্তে প্রাণ-দেহ-মনের ক্রিয়াবিক্রিয়া লক্ষ করিতে লাগিলাম। এই প্রাণ, এই কায়া, এই মন, যে যেদিকে পারে গমন করুক। আমি কেবল উহাদের দেখিয়া চলিব। কীভাবে উহারা উদিত হইতেছে, বাস করিতেছে, তিরোহিত হইতেছে—ইহা জানিব।

প্রাণবায়ু নাসারন্ধ্রপথে দেহে প্রবেশ করিতেছে, আবার বিপরীতমুখে বাহির হইয়া যাইতেছে। কখনও প্রাণবায়ু হ্রস্ব, কখনও দীর্ঘ হইতেছে। আমি উহাদের দেখিয়া চলিতেছি। মন শান্ত ও পূর্ণভাবে জাগিয়া উঠিল।

দেহের ভিতর ও বাহিরে নানাবিধ ক্রিয়া চলিতেছে। চর্মের উপর প্রতিটি সংবেদনা জাগিয়া উঠিতেছে। কোনোটি সুখদ, কোনাটি দুঃখদ। দেহের ভিতর রক্তসঞ্চালন, স্নায়বিক ক্রিয়াবিক্রিয়া, পরিপাক ক্রিয়া, রেচন ক্রিয়া চলিতেছে। দেহ—অর্থাৎ এই নিত্যগতিশীল যন্ত্রটার আমি সাক্ষী হইয়া বসিয়া আছি। শুধু উহাদের দেখিয়া চলিতেছি। আমার বিকার নাই।

মনে নানারূপ চিন্তা উঠিতেছে, বসবাস করিতেছে, মিলাইয়া যাইতেছে। সুখ, দুঃখ, নিরপেক্ষতা, সংশয়, প্রত্যয়, জিজ্ঞাসা, ভয়, লজ্জা, বিস্ময়, ক্রোধ, কাম, লোভ, মোহ, মাৎসর্য, অহমিকা, দ্বিধা, ঘৃণা, প্রেম, ভ্রান্তি, স্মৃতি, কল্পনা ইত্যাদি সর্ববিধ চিন্তার তরঙ্গ মনের সরোবরে ঊর্মিমালার ন্যায় উঠিতেছে, ভসিতেছে, লীন হইতেছে। আমি শুধু উহাদের জানিতেছি। আমি নির্বিকার, অসঙ্গ, নিৰ্ভয়।

মন নিজের ভিতর ডুব দিল। অতল হইতে মণিমুকুতা তুলিয়া আনিতেছে। আমার এই পার্থিব অস্তিত্ব পাঁচটা জিনিসের সমবায় দেখিতেছি। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান।

এই রক্ত-মাংস-শিরা-শোণিতপূর্ণ দেহ—ইহাই ‘রূপ’।

রূপময় দেহের পশ্চাতে মন বা অন্তঃকরণ। বহিরিন্দ্রিয়ের সহিত বাহিরের বিষয়ের সংযোগ হইল, অমনি মনের ভিতর সুখদুঃখের অনুভূতি জন্মিল। ইহাই ‘বেদনা’।

তাহার পর বাহিরের বস্তুনিচয় সম্বন্ধে আমার ভিতরে ‘ইহা ঘট’, ‘উহা মঠ’, ‘ইহা বৃক্ষ’, ‘উহা স্তম্ভ’ ইত্যাকার যে নিশ্চয়-জ্ঞান হইতেছে—ইহাই ‘সংজ্ঞা’।

বস্তুটিকে অনুভব করিবার পর বস্তুটিকে ‘গ্রহণ করিব’ অথবা উহাকে ‘ত্যাগ করিব’ কিংবা উহার সম্পর্কে ‘উদাসীন থাকিব’ ইত্যাকার যেসব ইচ্ছা হয়, তাহাই সামগ্রিকভাবে ‘সংস্কার’। যেমন, পুষ্প দেখিয়া উহা তুলিয়া লইব, কিংবা উহা ত্যাগ করিব কিংবা উদাসীন থাকিব এইপ্রকার ইচ্ছাসমূহের সামগ্রিকতাই সংস্কার। অতঃপর এই রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কারের পশ্চাতে যে অহং-অভিমানী আত্মচেতনা—উহাই ‘বিজ্ঞান’।

আমার পার্থিব সত্তা এই পাঁচটি আবরণে ঢাকা। ঠিক যেন পলাণ্ডুর পাঁচটি কন্দ বা খোসা। ছাড়াইলে কিছুই থাকে না। সেইরূপ এই পঞ্চস্কন্দ—রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞানের পশ্চাতে জ্ঞেয়বস্তু কিছুই আর অবশিষ্ট দেখিতেছি না।

এ তো বেশ হইল! ইহাদের জড়াইয়া লইয়াই আমার ‘আমিত্ব’, ছাড়াইয়া লইলে ‘আমিত্ব’ কোথাও আর দেখা যাইতেছে না! অথচ এই ‘আমিত্ব’ লইয়াই যত অভিমান, যত দুঃখের উৎপত্তি।

কিন্তু এইরূপে জড়াইয়া ভাবিতেছি কেন? কতদিন ধরিয়া ভাবিতেছি? বিচার করিলে সবই উবিয়া যায়, বিচার ছাড়িয়া দিলে আবার যেমন-ছিল-তেমন ফিরিয়া আসে। এ তো কী এক ঐন্দ্রজালিকের মায়া!

কিন্তু ইন্দ্রজাল বলিলেই তো আর চলিবে না। ইহার মূল কী, ধরিতে হইবে। বিশ্লেষণ করিয়া যাহাই হউক, দুঃখ আমাদের অনুভূত সত্য। এই দুঃখ অহেতুক হইতে পারে না। দুঃখের নিশ্চয় কারণ থাকিবে। সেই কারণকে উৎপাটিত করিলে কার্যরূপ দুঃখেরও অন্ত হইবে। আর সেই উৎপাটনের নির্ঘাত কোনো প্রক্রিয়া থাকিবে। দুঃখ আছে। দুঃখের কারণ আছে। দুঃখের নিরোধ আছে। নিরোধের উপায় আছে।

ইহা তো মহাসত্য। মহাজ্ঞান। যাহার এই জ্ঞান নাই, সে অবশ্যই ‘অবিদ্যা’র কবলে পড়িয়াছে।

কিন্তু সেই অবিদ্যাটি কীরূপ? কীরূপে তাহা আমার ভিতর লুকাইয়া আছে? এই কথা ভাবিতে ভাবিতে আমি আরও গভীরে ডুব দিলাম।

দেখিতে লাগিলাম। এই অবিদ্যা হইতেই পাপ, পুণ্য, বৈরাগ্যের ‘সংস্কার’ জন্মিয়াছে।

সংস্কার আছে বলিয়াই ‘বিজ্ঞান’-এর আবির্ভাব হইয়াছে। বিজ্ঞান সেই অহমিকার দীপশিখা, যাহাকে অবলম্বন করিয়া জানিবার সাধ হইয়াছে।

ওই সাধ ছিল বলিয়াই আমি বারংবার মাতৃগর্ভে জাত হইয়াছি। কিন্তু তখন তো আমি ভ্রূণাকারে আসিয়াছি। উহাই ‘নামরূপ’।

ভ্রূণ পরিণত হইয়াছে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মনের উদ্ভব হইয়াছে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় আর মন—এই লইয়া ‘ষড়ায়তন’।

তাহার পর আমি মাতৃগর্ভ হইতে জাত হইয়াছি। বারংবার। পঞ্চেন্দ্রিয় আর মনের সহিত বিষয়ের সংযোগ হইল। উহাকে ‘স্পর্শ’ বলা যাইতে পারে। স্পর্শে স্পর্শে সুখবেদন, শোকবেদন, অনুবেদন হইয়াছে। ইহাই ‘বেদনা’।

এইভাবে জন্মে জন্মে আমি বিষয় আস্বাদ করিয়াছি। আর বিষয় আস্বাদ করিয়াছি বলিয়াই আবার পাইবার ইচ্ছা হইয়াছে। অহো! ইহাই ‘তৃষ্ণা’ বা বাসনা। ইহাই তো আমাকে সর্পিণীর ন্যায় জড়াইয়া আছে।

‘তৃষ্ণা’ আছে, তাই তৃষ্ণার ‘উপাদান’ও আছে।

আর ‘উপাদান’ আছে বলিয়াই আবার ফিরিয়া আসিবার ইচ্ছা—আবার আসিব, আবার পৃথিবীতে ফিরিয়া আসিয়া ভোগ করিব, ইত্যাকার বোধ রহিয়া গিয়াছে। ইহাই সেই ‘ভব’বোধ, যাহা জন্ম হইতে মৃত্যুর দিকে আমাকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। ইহার প্রভাবেই পুনরায় ‘জাতি’ বা পুনর্জন্ম হইবে। আবার ‘দুঃখ’, দৌর্মনস্য, হাহুতাশ ফিরিয়া আসিবে।

ইহাই তো আমার জন্মে জন্মে চলিতেছে। ইহা তো পূর্বে লক্ষ করি নাই! চক্রাকারে ঘুরিতেছে। চক্রাকারে ফিরিয়া আসিতেছে। হায়! কত জন্ম ধরিয়া ইহার খেলা চলিতেছে?

দেখিতে পাইলাম, অনন্ত অনন্তবার আমি জন্মিয়াছি। সেই সব জন্মগুলি চিত্রশালিকার চিত্রের ন্যায় দেখিতে পাইলাম। সেই সুদূর অতীতে ধূলাবালির ভিতর প্রাণহীনের ন্যায় পড়িয়া থাকিতাম। অঙ্গ প্রতঙ্গ হস্ত পদ কিছুই ছিল না। তাহার পর কখনও উদ্ভিদ, কখনও পন্নগ, কখনও ভয়ংকর সরীসৃপ, কখনও ক্ষুদ্ৰ মৎস্য, কখনও বৃহৎ মৎস্য, কখনও বিচিত্র পক্ষী, কখনও অণ্ডজ, কখনও স্বেদজ, কখনও জরায়ুজ হইয়াছি। কখনও পশু হইয়াছি, সিংহ, বানর বা হরিণ। কখনও মানুষ হইয়াছি—কখনও নারী, কখনও বা পুরুষ। ভৃত্য, তস্কর, রাজা, দৌবারিক, শ্রেষ্ঠী, সৈনিক! কত অগণ্য জন্ম যে কাটিয়া গিয়াছে! অশুভ সংস্কার কাটিয়া কখনও শুভ সংস্কারের উদয় হইয়াছে। এসব কী দেখিতেছি? বারবার অন্যের কল্যাণের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করিয়াছি। কখনও স্বাভাবিক মৃত্যু হইয়াছে, কখনও ছিন্নভিন্ন হইয়া গিয়াছি! তাহার পর একবার শুদ্ধ সংস্কার লইয়া এক ব্রাহ্মণের গৃহে জন্মলাভ করিয়াছি। সে কোটি কোটি কল্পপূর্বে। তখন আমার নাম হইয়াছে ‘মেঘ-মানব’

দরিদ্র ব্রাহ্মণের পুত্র। বিদ্যালাভের উদ্দেশ্যে হিমবন্তপ্রদেশে গমন করিলাম। শিক্ষালাভান্তে গুরুদক্ষিণাদানের সামর্থ্য হইল না। সেই হেতু হিমগিরি সন্নিহিত রাজ্যে পরিভ্রমণ করিয়া পাঁচশত মুদ্রা সংগ্রহ করিলাম… ফিরিবার পথে এক রাজ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, ঘর-দ্বার-দেহলীসমূহ পত্রে পুষ্পে শোভিত।

সে এক বিচিত্র দেশ। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, সেখানে সেই কল্পের বুদ্ধ আসিবেন। তাঁহার নাম দীপংকর বুদ্ধ। কিছুদূর অগ্রসর হইয়া এক সুকুমারী পুষ্পলাবী কন্যার সাক্ষাৎ পাইলাম। তাহার হস্তে সাতটি কমলকলিকা। কহিলাম, ‘বুদ্ধ-পূজার নিমিত্ত পাঁচশত মুদ্রার বিনিময়ে আমি তোমার নিকট হইতে পাঁচটি কমলকলিকা কিনিতে চাই। বিক্রয় করিবে?’

সে কহিল, ‘পাঁচ কেন? সাতটি কমলকলিকাই লইয়া যান। মুদ্ৰা লাগিবে না। বিনামূল্যে দিব। কিন্তু আমার একটি শর্ত আছে।’

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কী শর্ত?’

কন্যা উত্তর দিল, ‘আমাকে বিবাহ করিতে হইবে!’

কী বিপদ! একদিকে বুদ্ধপূজা করিবার আগ্রহ, অন্যদিকে এ কন্যার প্রণয়প্ৰাৰ্থনা উপায়ান্তর না দেখিয়া কহিলাম, ‘বেশ। বিবাহ করিব। কিন্তু আমারও শর্ত থাকিবে।’

সে কহিল, ‘কী শর্ত, শুনি।’

বলিলাম, ‘তুমি কখনও আমার ধর্মাচরণের পথে বাধা হইবে না, কথা দাও।’ সে সানন্দে সম্মত হইয়া গেল। তাহার সহিত আমার বিবাহ হইল। সে আমাকে সাতটি কমলকলিকা দিল। তাহা লইয়া আমি বুদ্ধপূজায় গেলাম।

দীপংকর বুদ্ধের অনিন্দ্যসুন্দর দর্শন পাইলাম। তাঁহার চরণে সপ্ত কমলকলিকার পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করিলাম। আমার আস্কন্ধলম্বিত কেশপাশ দ্বারা তাঁহার চরণকমল মুছিয়া দিলাম। তিনি আমার সেবায় প্রসন্ন হইয়া বলিলেন, ‘তোমাকে অহত্ত্ব প্ৰদান করিতেছি। তুমি এখনই নিখিল দুঃখ হইতে মুক্ত হইয়া যাও।’

আমি কহিলাম, ‘না, না। আমি ব্যক্তিগত মুক্তি চাহি না। আপনার প্রভাব যতদিন এ জগতে থাকিবে ততদিন বারংবার জন্মগ্রহণ করিয়া অন্যের সত্তাপ দূর করিবার প্রয়াসে ব্রতী হইতে চাই। তাহার পর আপনার প্রভাব যখন এ জগতে ক্ষীণ হইয়া আসিবে, তখন পৃথিবীতে আসিয়া সমস্ত জীবের দুঃখমুক্তির উপায় আবিষ্কার করিয়া বুদ্ধ হইতে চাই।’

দীপংকর বুদ্ধ অত্যন্ত প্রীত হইয়া কহিলেন, ‘তথাস্তু!’

সেই মেঘ-মানবই আমি—এই জন্মে সিদ্ধার্থ গৌতম হইয়াছি। আর সেই পুষ্পলাবী কন্যাটি এই জন্মে গোপা যশোধরা হইয়াছে। কী আশ্চর্য! ইহা আমি এতদিন জানিতাম না!

তবে তো এইবার দুঃখের শেষ কোথা, তাহা দেখিতে হইবে। এইমাত্র বুঝিয়াছি, তৃষ্ণা থাকিলেই দুঃখ আসিবে। লবঙ্গ খাইলেই যেমন ঝাল লাগে, ইহাও সেইরূপ একটি থাকিলেই অন্যটি আসিবে।

অবিদ্যা থাকিলেই সংস্কার, সংস্কার থাকিলেই বিজ্ঞান, বিজ্ঞান থাকিলেই নামরূপ, নামরূপ থাকিলেই ষড়ায়তন, ষড়ায়তন থাকিলেই স্পর্শ, স্পর্শ থাকিলেই বেদনা, বেদনা থাকিলেই তৃষ্ণা, তৃষ্ণা থাকিলেই উপাদান, উপাদান থাকিলেই ভব, ভব থাকিলেই জাতি, জাতি থাকিলেই দুঃখ—একটি থাকিলেই অন্যটি থাকে।

ইহা হইতে তো নিষ্কৃতির উপায় দেখিতেছি না। নিষ্কৃতির কি কোনো উপায় নাই?

আচ্ছা, একটি থাকিলেই যদি অন্যটি থাকে, তবে একটি না থাকিলে তো অন্যটিও থাকিবে না। ইহা তো বেশ যুক্তিসিদ্ধ মনে হইতেছে।

অবিদ্যা না থাকিলে সংস্কার থাকিবে না, সংস্কার না থাকিলে বিজ্ঞান থাকিবে না, বিজ্ঞান না থাকিলে নামরূপ আসিবে না, নামরূপ না আসিলে ষড়ায়তন গঠিত হইবে না, ষড়ায়তন গঠিত না হইলে স্পর্শ হইবে না, স্পর্শ না হইলে বেদনা জন্মিবে না, বেদনা না জন্মিলে তৃষ্ণা নিভিয়া যাইবে, তৃষ্ণা নিভিয়া গেলে উপাদান জাগিবে না, উপাদান ঘুমাইয়া পড়িলে ভব উদিত হইবে না, ভব অস্ত গেলে জন্ম বা জাতি নিরুদ্ধ হইবে। জন্ম না হইলে দুঃখ নিভিয়া যাইবে।

এইতো উপায় পাইয়াছি! কিন্তু এ চক্রের ঠিক কোথায় আঘাত করিলে ইহা ভাঙিয়া পড়িবে? তৃষ্ণা! তৃষ্ণা! তৃষ্ণাকে উৎপাটন করিতে হইবে। তৃষ্ণা উৎপাটিত করিতে পারিলেই দুঃখের চিরন্তন অবসান হইবে।

এইভাবে ধ্যান করিতে করিতে তৃষ্ণা জয়ের একটি পথ যেন আমার চক্ষের সম্মুখে খুলিয়া গেল। সে-পথ যেন আলোক দ্বারা নির্মিত। আটটি অঙ্গ সেই পথে দীপ্যমান। সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সংকল্প। সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা সম্যক প্রযত্ন, সম্যক স্মৃতি, সম্যক সমাধি। যাহাতে বাসনা নাশ হইয়া সর্বজীবের প্রতি করুণা বিথারিত হয়, তাহাই সম্যক।

আমি একটি একটি লইয়া নিজেকে পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। দেখিলাম, আমার প্রজ্ঞা, শীল ও সমাধি সম্যক হইবার পথে একমাত্র বাধা হইয়া রহিয়াছে বাসনা বা তৃষ্ণা। উহা যেন অন্ধকার সমুদ্রের ভিতর রহস্যময় প্রবালদ্বীপের ন্যায় আপনাতে আপনি জ্বলিতেছে।

এইবার সমস্ত শক্তি একত্রিত করিয়া আমি ওই বাসনার প্রবালদ্বীপকে উৎপাটিত করিতে উদ্যত হইলাম। ভিতর হইতে ঘোর আর্তনাদ উঠিল। প্রচণ্ড নিনাদে অশনিসম্পাত হইল। আকাশটা যেন বিদ্যুতের লেলিহান জিহ্বায় দ্বিধাবিভক্ত হইয়া গেল। আমি চমকিয়া উঠিলাম। মেরুদণ্ডের ভিতর কে যেন ফাল চালাইয়া দিতেছে। অসহ্য যন্ত্রণা হইতে লাগিল। তথাপি, আমি দত্তে দত্ত চাপিয়া প্রবলবেগে বাসনার মূলে আঘাত করিলাম।

মুহূর্তে কী এক ভয়ংকর মূর্তি আমার ভিতর হইতে লাফ দিয়া বাহিরে আসিল। সেই জ্যোৎস্নারাত্রি কখন নিভিয়া গিয়াছে। গগনমণ্ডল নিশ্ছিদ্র কৃষ্ণমেঘে ঢাকিয়া গিয়াছে। প্রচণ্ড ঝড় উঠিয়াছে। আর সেই মসিকৃষ্ণ অন্ধকারের ভিতর রক্তাম্বর পরিহিত জ্বলন্ত দেহ এক পাপপুরুষ রোষষায়িত নেত্রে আমাকে যেন গ্রাস করিয়া লইবার জন্য মুখামুখি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়াছে।

আমি অবাক হইয়া দেখিলাম, ‘সে আর কেহ নহে, যে আমাকে সর্বদা বন্ধু বলিয়া পরিচয় দিত, অহোরাত্র পরামর্শ দিত, সে সেই মার!’

.

এই পর্যন্ত বলে সিদ্ধার্থ নীরব হলেন। এতক্ষণ যেন আমার চোখের সামনে সেই অমোঘ নিশাকালের সমস্ত ঘটনা পুনরভিনীত হচ্ছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম, সিদ্ধার্থ আরও কী বলেন, তা শুনবার জন্য। কিন্তু সিদ্ধার্থ আমার উদ্দেশে আর একটিও কথা উচ্চারণ করলেন না।

সহসা অলিন্দের নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রবল ঝটিকা ও অশান্ত জলকল্লোলের শব্দ হতে লাগল। আমার মনের মধ্যে কী যেন একটা অজানা ত্রাস দারুণভাবে উত্থিত হচ্ছিল। আমি শঙ্কিত চিত্তে অলিন্দের গাত্রে প্রলম্বিত বৃহদাকার আলেখ্যটির দিকে তাকালাম।

দেখলাম, ধ্যাননিমগ্ন সিদ্ধার্থের চতুর্দিকে মারসেনানী জেগে উঠেছে। বিষাক্ত নাগদানবগুলি ভয়াবহভাবে আলেখ্য দংশন করে বিষনিশ্বাস ফেলছে। দন্তুর শ্বাপদকুল মহা হুহুংকারে যেন সিদ্ধার্থকে আক্রমণ করছে। প্রমত্তা রমণী দুটি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে হাস্যে লাস্যে নৃত্যে সিদ্ধার্থকে নির্লজ্জভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে। কী একটা ঝড় উঠছে, ধুলায় ধোঁয়ায় ছবিটি আর দেখা যাচ্ছে না। তার মধ্য থেকেই একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর উঠে এসে যেন এক মুহর্তে আমার কর্ণপটহ ভেদ করে ফেলতে লাগল। সে কী ভীষণ আক্রোশ! কী ভয়ানক গর্জন! আমার বুঝতে আর এতটুকু বিলম্ব হল না, জগতের সমস্ত পাপ মহামারের মূর্তি ধরে এইবার সেই ভীষণ রাত্রিটিতে সিদ্ধার্থের উদ্দেশেই এই ভীতিপ্রদ শব্দগুলি উচ্চারণ করে চলেছে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *