২. কহিল মন্মথ মার
অলিন্দের ভিতর কালো ছায়া স্তম্ভিত হয়ে আছে। এমন নয় যে, আলো নেই। অলিন্দের ছাদ হতে স্থানে স্থানে ধাতব জিঞ্জির নেমে এসে দীপাধার ধারণ করে আছে। কিন্তু সে-সকল দীপের আলোক অন্ধকারকে দূরীভূত না করে যেন ঘনীভূতই করেছে। তুমি এই তমসানিগূঢ় অলিন্দ বেয়ে হেঁটে চলেছ, সিদ্ধার্থ।
তুমি জানো না, এই অন্ধকারই আমি। তোমার পথকে আমিই মসিকৃষ্ণ করে রেখেছি। এখনও বলছি, যেয়ো না। তুমি আমার কথায় কর্ণপাতও করছ না। ছায়া হয়ে আমি তোমাকে ঘিরে ধরেছি। মণিকুট্টিমের উপর হামাগুড়ি দিয়ে শ্বাপদের মতো আমি তোমাকে পদে পদে বাধা দিচ্ছি। অলিন্দের আলিশার উপর একটি কালপেচক হয়ে আমি অশুভ সংকেতে ভরে দিলাম রাত্রির বিবর। তুমি উপেক্ষা করলে।
দ্বিতলের অলিন্দ হতে সোপান বেয়ে নেমে আসছ তুমি। এমন সময় সহসা ঝড় উঠল। প্রবল বাত্যাঘাতে কেঁপে উঠল প্রদীপসমূহের বিশীর্ণ শিখা। তোমার রাজকীয় বস্ত্রের প্রান্তদেশ সেই বাতাসে প্রকম্পিত হল, উড়ে পড়ল তোমার উত্তরীয়। তুমি ভূক্ষেপও করলে না। তোমার কেশপাশ নিদারুণ প্রভঞ্জনে উড়ছে।
সোপাননিম্নে মহার্ঘ বিলাসকক্ষ। স্থানে স্থানে দীপাধারে আলো জ্বলছে। কুট্টিমের ওপর কোমল গালিচায় তোমার পদপাত ডুবে গেল। এই প্রমোদভবন আজই সন্ধ্যায় জেগে উঠেছিল বর্ণে, সুরে, বিভঙ্গে। আজই সন্ধ্যায় তুমি নর্তকীদের নৃত্যগীত উপভোগ করেছিলে। শুধু সে-উপভোগে তোমার মন ছিল না।
তুমি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ভবনটির এক পার্শ্বে দৃষ্টিক্ষেপ করলে। একধারে সন্ধ্যার সেই নর্তকীরা নিদ্রিত হয়ে পড়ে আছে। তাদের অঙ্গে সন্ধ্যারই সেই পরিধান। কারও বসন বিগলিত, কারও নূপুর স্খলিত, কারও কঙ্কণ বাজুবন্ধ হতে বিচ্যুত। কেউ বা ঘুমের মধ্যে হাই তুলছে, কেউ মুখগহ্বর ব্যাদিত করে রেখেছে, ব্যাদিত সেই মুখ হতে কারও বা লালারস নিঃস্রাবিত হচ্ছে। আঃ সিদ্ধার্থ! তুমি ওদিকে দৃষ্টিপাত কোরো না। সুন্দরকে তার যথোচিত অবস্থায় দর্শন করতে হয়। অসময়ে অনবস্থায় তাকে দেখতে নেই। তুমি বরং সন্ধ্যাবেলার সেই শৃঙ্গারাঢ্যা সুন্দরীদের কথা মনে করো। এরা শুধু তোমার ভোগের জন্যই নির্মিত হয়েছে। ওহে সিদ্ধার্থ, সেইসব আশ্চর্য মদবিহ্বল কটাক্ষের কথা মনে পড়ে?
‘হাঁ, মনে পড়ে। সুন্দরীদের সেই কটাক্ষের পেছনে আছে শিরা-উপশিরার জটিলতা, স্নায়ুসংস্থান, মাংসপেশির আলোড়ন—মনে পড়ে বই-কি!’
আহ্ নির্বোধ! অত গভীরে প্রবেশ কোরো না। মনে করো সেই উত্তুঙ্গ স্তনযুগ, সেই চন্দ্রাননা নর্তকীর দল, আলোড়িত জঘন হস্তীশিরের মতো সুবিপুল মসৃণ… মনে পড়ে সেইসব মুগ্ধ তনুরুচি?
তুমি আত্মগত স্বরে নির্মোহ কণ্ঠে বললে, ‘সেই উত্তুঙ্গ স্তনযুগ আসলে দুটি মাংসগ্রন্থি ব্যতীত আর কিছু নয়, সেই চন্দ্রানন আসলে শ্লেষ্মার আগার মাত্র, আর সেই হস্তীশিরের ন্যায় অতিকায় জঘন সময়ে সময়ে স্রাবে, মূত্রে ক্লিন্ন হয়ে থাকে। এই নিন্দনীয় রূপ—শুধু কবিদের বর্ণনায় তার আতিশয্য। আমার এই নারীদের এখন প্রেতচ্ছায়ার মতো মনে হচ্ছে। দূষিত, পরিত্যক্ত, অপবিত্র মাংসের স্তূপ!
এই বলে তুমি প্রমোদভবন পরিত্যাগ করে প্রাঙ্গণের মধ্যে এসে দাঁড়ালে। মাথার ওপর অন্ধকার আকাশ। কে যেন জগতের সমস্ত কালি দিয়ে আজ এ গগন পরিপ্লুত করে রেখেছে। প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্য। তুমি মাথা তুললে আকাশে। ঝড়ের বাতাস বাদুড়ের ডানার মতো তোমার মুখের রেখায় তার অস্ফুট স্পর্শ বুলিয়ে দিয়ে গেল। বাতাসের শব্দ এসে ভেঙে দিয়ে গেল রাত্রির নীরবতা।
তুমি সেই ঝড়ের স্বননের মধ্যে কান পেতে কী যেন শুনতে চাইলে। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, কী তোমার অন্বিষ্ট। কী কথা তুমি এখন শুনতে চাইছ। এমন সময় সেই প্রবল প্রভঞ্জনশব্দের ভিতর মনে হল কারা যেন গান গাইছে। গান গাইতে গাইতে আকাশ বেয়ে উড়ে চলেছে কারা! গানের সেই কথাগুলো আমারও কানে এসে প্রবেশ করল। আমি ভয় পেলাম। এই গীত আমার কাছে ভয়ংকর!
আকাশপথে কারা যেন গাইছে :
‘কোথা হতে আমরা ভেসে আসি, কোথায় ভেসে যাই আমরা জানি না, আমরা শুধু বিশ্রাম চাই, আমরা শুধু শান্তি চাই… এই আমাদের শুধু ফিরে ফিরে আসা, মিছামিছি শুধু এই কাঁদাহাসা… এর কি কোনো শেষ নেই? কে আমাদের খেলায়? আমরাই বা সে-খেলায় কেন অংশ নিই? কী বিচিত্র কুহকে জেগেও ঘুমিয়ে থাকি…. এই রাত্রি কি প্রভাত হবে না আর?… উদ্ভ্রান্ত বাতাসের মতো আমাদের এই নিত্য ধাবমানতা… কে আমরা জানি না, জানি না কোথায় এসেছি, কেন এসেছি… কোথায় চলেছি… কত দেশে দেশে ভেসে ভেসে চলেছি… চারিদিকে কত জীবের কলরোল… যাতনার উদযাপন… এই আছে, এই নেই… কী কাজে আসা, কী কাজে জীবন অতিবাহিত হল… প্রবাহের বারিসদৃশ আমরা একস্থানে রইতে পারি না… কূলহারা নদীর মতো আমাদের লক্ষ্যহীন গতিবিধি… কেউ কি নেই যে আমাদের চেতনা দিতে পারে? কবে বিদূরিত হবে আমাদের এই মোহস্বপ্নের যাতায়াত…? হে চেতনার উদিতভানু, তুমি আমাদের এই অজ্ঞানের অন্ধকার নাশ করো…’
গান শেষ হল। যারা আকাশপথে এ গান গাইছিল, তারা আকাশ বেয়েই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। তুমি অন্ধকারে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলে, তারপর দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করে অশ্বশালার দিকে যাত্রা করলে।
‘ছন্দক! ছন্দক!’ চাপা স্বরে তুমি ডাকলে। কিছুক্ষণ ডাকার পর অন্ধকার আবাস হতে তন্দ্রাতুর ছন্দক বাহির হয়ে এল। চক্ষে তার নিদ্রাবেশ লেগে আছে। কিন্তু অল্প পরেই সেই স্বপ্নাচ্ছন্নতা ভেঙে গিয়ে তার মুখেচোখে বিস্ময়কাতরতা ফুটে উঠল। এত রাত্রে স্বয়ং রাজপুত্র তার মতো এক সামান্য সারথির অঙ্গনে উপস্থিত হয়েছেন! তবে কি এই নিশীথে আচম্বিতে কোনো বহিরাক্রমণকারীর দল রাজ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে? এখনই যুদ্ধার্থে বহির্গত হতে হবে?
ভয়বিহ্বল স্বরে ছন্দক প্রশ্ন করল, ‘রাজকুমার! আপনি, এত রাত্রে?’
মন্দ্রস্বরে তুমি বলে উঠলে, ‘ছন্দক! আজ রাত্রে আমার সময় এসেছে। আমি এখনই আমার পিতার রাজ্য পরিত্যাগ করে চলে যাব।’
‘কী বললেন? না, না! আপনি আমার সঙ্গে পরিহাস করছেন, কুমার!
‘পরিহাস নয়, ছন্দক! আমার শ্বেত অশ্ব কণ্ঠককে এখনই প্রস্তুত করো। আমি সর্বস্ব ত্যাগ করে যাব।’
‘কিন্তু কেন, কুমার? কেন আপনার এই মতিভ্ৰম?‘
‘মতিভ্রম নয়, ছন্দক। এ আমার দীর্ঘ মননজাত সিদ্ধান্ত। আমি আর পারছি না। ওরা আমাকে প্রতি রাত্রে সংকেত পাঠাচ্ছে!’
‘কারা, কুমার? কাদের কথা আপনি বলছেন?’
‘শুনতে পাচ্ছ না? ভালো করে কান পেতে শোনো। এই সোনার প্রাসাদের গায়ে তাদের কান্নার শব্দ বাতাসের সঙ্গে মিশে আছড়ে পড়ছে। তারা বলছে, ত্রাণ করো, ত্রাণ করো। দুঃখ থেকে, শোক থেকে, মহাভয় থেকে আমাদের উদ্ধার করো। ওই, ওই তারা বলছে—
চিরপ্রসুপ্তমিমং লোকং তমঃস্কন্ধাধিগুণ্ঠিতম্।
ভবান্ প্রজ্ঞাপ্রদীপেন সমর্থঃ প্রতিবোধিতুম্।।—
এই সমস্ত জগৎ অনন্তকাল অজ্ঞানের অন্ধকারে, মহাসুপ্তির অতলে ডুবে আছে। একমাত্র আপনিই আপনার হৃদয়স্থিত জ্ঞানদীপের আলোকে আমাদের ঘুম ভাঙাতে পারেন। শুনতে পাচ্ছ না, ছন্দক?’
ছন্দক দু-পাশে মাথা নাড়ল। সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। আর তখনই তার এই বিহ্বলতার সুযোগ নিয়ে আমি মার, তার কণ্ঠে প্রবেশ করলাম। হৃদয়ের সব ব্যাকুলতা নিংড়ে ছন্দকের কণ্ঠে আমি জাগালাম সকরুণ বিলাপ ও আর্তির স্বর।
আমার দ্বারা আবিষ্ট ছন্দক করুণ কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘কিন্তু কাল প্রভাতে আপনার গৃহত্যাগের সংবাদ পেয়ে আপনার পিতা মহারাজ শুদ্ধোদন কী প্রচণ্ড আঘাত পাবেন, একবারও কি ভেবেছেন, কুমার? আপনি এই রাজ্যের একমাত্র ভরসাস্থল। আপনি রাজ্যত্যাগ করে গেলে শুধু আপনার শিশুপুত্র রাহুলই নয়, আপনার প্রজারাও যে অনাথ হয়ে পড়বে! এই আঘাতে মহারাজ হয়তো মৃত্যুমুখে পতিত হবেন, হয়তো আপনার পালিকা মাতা গৌতমী কিংবা আপনার রাজ্ঞী যশোধরা শোকে প্রাণত্যাগ করবেন…’
‘জীবনের মহত্তম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যদি পিতামাতা, স্ত্রী-পুত্র পরিজন প্রাণত্যাগও করে, তাতেই বা কী? আমি মনঃস্থির করেছি, ছন্দক। তুমি অশ্ব প্ৰস্তুত করো। আজ কোনো বাধাই আমার কাছে আর বাধা নয়।’
তোমার এই উত্তর শুনে আমিও কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে গেলাম। মনে মনে তোমার প্রতিজ্ঞার কঠোরতাকে আমি অভিবাদন জানালাম। কিন্তু ওহে সিদ্ধার্থ! তুমি শেষ অবধি এই কঠোরতা বজায় রাখতে পারবে তো? আরে, কত দেখলাম! কত মুনিঋষির প্রতিজ্ঞায় আমি ছিদ্র করেছি, ফাটল ধরিয়েছি তাদের তপঃকঠিন প্রজ্ঞায়, তুমি তো সামান্য যুবক! আমি মার, আমি মূর্তিমান প্রলোভন, আমি মন্মথ মধুসারথি, আমি সেই চিরন্তন তপোভঙ্গকারী অনঙ্গ!
ইতোমধ্যে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছন্দক অশ্বশালা হতে শ্বেত অশ্ব কণ্ঠককে বাহির করে এনে তাতে লাগাম ও রেকাব পরিয়েছে। তুমি ছন্দকের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘আজ আমিই অশ্বচালনা করব, ছন্দক! তুমি আমার পরে অশ্বারোহণ করো।’ এই বলে সেই অনিবার্য নিশীথে এক লম্ফে তুমি অশ্বারূঢ় হলে। ছন্দক তোমার পশ্চাতে উপবেশন করল।
তারপর সে কী প্রচণ্ড গতি! সম্মুখে প্রাসাদের সুবৃহৎ দ্বার পড়ল। দ্বাররক্ষীরা সকলেই নিদ্রিত। আমি ভেবেছিলাম, রক্ষীদের জাগরিত করার প্রয়াসেই তুমুল আলোড়ন উপস্থিত হবে। এত রাত্রে সেই বিপুল প্রাসাদদ্বার উন্মোচিত করতে হলে যে তুমুল শব্দ হবে, তাতেই প্রাসাদের সকল নরনারী জেগে উঠবে; তোমার যাত্রায় অন্তরায় উপস্থিত হবে। আমি সেই সুযোগেই ছিলাম। কিন্তু হায়! আজ আমার সকল প্রয়াসই ব্যর্থ হয়ে চলেছে। কী এক অজ্ঞাত শক্তির প্রভাবে সেই বিপুলাকৃতি দ্বারকপাট নিঃশব্দে উন্মোচিত হল। নিদ্রিত রক্ষীরা জানতেও পারল না, রাজপুত্র প্রাসাদ পরিত্যাগ করে গেছেন।
বিদ্যুৎবেগে অন্ধকারে ভিতর অশ্ব ধাবমান। তুমি আর ছন্দক ব্যতীত আরও একজন তৃতীয় ব্যক্তি যে এই অশ্বেই তোমারই সঙ্গে চলেছে, তুমি তা জানতে পারোনি, কুমার সিদ্ধার্থ! সে ব্যক্তি আমি—তোমার অভিন্নহৃদয় অদৃশ্য মিত্র মার!
ঘোরা রজনী! অশ্বপদতলনিম্নে সরে যাচ্ছে মাঠ, ঘাট, নগরী, গ্রাম, অটবি, বিতান… রাত্রির তমসায় চরাচর নিঃসুপ্ত, কোনো কোনো গ্রামদেশে গৃহস্থের বহিরাঙ্গনে শ্বাপদনিবারক হুতাশন প্রজ্বলিত রয়েছে… কোথাও গ্রামপ্রান্তে বটবৃক্ষতলে কোনো সন্ন্যাসী ধুনির আগুন জ্বেলে সেই প্রজ্জ্বলিত পাবকের সম্মুখে গভীর ধ্যানে নিবিষ্ট হয়ে আছেন… কোথাও পত্রপুষ্পহীন শাখাসর্বস্ব শমীবৃক্ষের শিরোদেশে শেষ রাত্রির চন্দ্রমা একাকী উদিত হচ্ছেন, কোথাও স্থির পুষ্করিণীর জলতলের ওপর বৃক্ষচ্যুত কোনো পত্র অলস ভঙ্গিমায় নেমে আসছে… কোথাও শস্যহীন ক্ষেত্র উদার ধূসর হয়ে পৃথিবীর করোটির মতো জেগে আছে… কোথাও শ্মশানে চিতা জ্বলছে, চিতাগ্নির চারিপাশে শবলুব্ধ শ্বাপদসমূহ গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে… রাত্রির চিত্রসম্ভার চক্ষের সম্মুখে পটচিত্রের মতো আবর্তিত হচ্ছে…
কিন্তু সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে আমি তোমাকে অবলোকন করছিলাম, সিদ্ধার্থ! দুই হস্তে তুমি অশ্বের লাগাম সবলে ধরে আছ! তোমার বাহুতে প্রচণ্ড ক্ষাত্রশক্তি খেলা করছে। কণ্ঠক অশ্ব দুরন্ত ঝড়ের মত ধাবমান, তার উন্মুক্ত মুখগহ্বর শ্বেত- ফেনিল হয়ে উঠেছে। তোমার দৃষ্টি নীল রাত্রির মতো আয়ত, স্থির। আমি এখনও তোমাকে বলছি, সিদ্ধার্থ, একবার ফিরে যাবে কিনা, ভেবে দ্যাখো। কিন্তু আমার পরামর্শ তোমার কর্ণে প্রবেশ করছে না। সেটা স্বাভাবিক। এ তোমার প্রথম বৈরাগ্য, সত্যের প্রতি প্রথম অনুরাগ। এখন আমার কথা তোমার কানে ঢুকবে না। আমাকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। নিশ্চয়ই অল্পদিন পর তোমার এ বৈরাগ্য শিথিল হবে, কে আর চিরকাল দুরন্ত অশ্বের লাগাম শক্ত হাতে ধরে রাখতে পারে? সেই শিথিল বৈরাগ্যের ফাঁক দিয়েই আমি সেদিন তোমার অন্তরে প্রবেশ করব। তোমাকে সংসারের পথে পুনরায় ফিরিয়ে আনার প্রয়াস আমি সেদিন করব, কুমার! এখন আমার শুধু সেই অতর্কিত মুহূর্তের অপেক্ষা!
সে-রাত্রি প্রভাত হল। সূর্যের দীপ্তি প্রথমে কোমল, পরে প্রখর হয়ে উঠল। ছন্দকের হস্তধৃত বর্ষায় সূর্যের আলোক ঝিকিয়ে উঠতে লাগল। সমস্ত দিনমান তুমি অশ্বচালনা করে দিনান্তে এক নদীর ধারে অবতীর্ণ হলে। এই নদী—অনোমা— স্বচ্ছসলিলভারে আপূর্যমানা—মন্দ মন্দ বেগে সম্মুখে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।
কিন্তু এ কী? এ তুমি কী করছ, সিদ্ধার্থ? কটিদেশ হতে তরবারি নিষ্কাশিত করে নিজ কেশকলাপ ছেদন করছ? আহা, অমন কমনীয় কুন্তল মুণ্ডন করে এ তোমার কী প্রকারের তৃপ্তি? ওই কেশরাশি যে গোপার কত প্রিয় ছিল, কত আনন্দসন্ধ্যায় তোমার সুন্দর মুখের চারিপাশে তারা প্রেমচ্ছন্দে আন্দোলিত হত— সেসব তুমি কর্তন করে ফেললে?
অনোমা নদীর তীরে এক শ্মশান ছিল; তারই একপাশে ভূমির ওপর মৃত কোনো ব্যক্তির জীর্ণ পাণ্ডুর বসন পড়ে ছিল। মৃতের সেই ছিন্নবাস পরিধান করে তুমি রাজকীয় বেশ পরিত্যাগ করলে। তারপর সেই রাজবেশ, কুণ্ডলাদি অলংকার, কর্তিত কেশগুচ্ছ, তরবারি—সমস্ত রাজকীয় চিহ্ন রোরুদ্যমান ছন্দকের হাতে তুলে দিয়ে বললে, ‘এবার তুমি ফিরে যাও, ছন্দক! পিতাকে এইসব চিহ্ন প্রত্যর্পণ করে বোলো, আমি চিরতরে গৃহস্থাশ্রম পরিত্যাগ করে প্রব্রজিত সন্ন্যাসী হয়েছি।’