৬. তুমি সিদ্ধার্থ আমি সুগত

৬. তুমি সিদ্ধার্থ আমি সুগত 

আবার আমার পথ চলা শুরু হল। অরণ্য অতিক্রম করে নদী, নদী পার হয়ে গ্রাম, গ্রামের প্রান্তে দিগন্তছোঁয়া চাষের খেত, খেত পেরিয়ে আবার নিবিড় বনভূমি সেই বনের মধ্যে পায়ে পায়ে গড়ে ওঠা পথ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শুধু আকাশস্পর্শী বনস্পতিদের বংশ পরস্পর নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িত, তাদের শাখাপ্রশাখার জটলা পেরিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া কঠিন। কোথাও রাত্রির থেকেও গভীরতর অন্ধকার, কোথাও কেশবতী কন্যার কঙ্কতিকার মতো অরণ্যের পত্রছাদ অতিক্রম করে নেমে আসা রবিকিরণ বনভূমিকে সামান্য আভায়িত করে রেখেছে। সেই আভায় ঝিলমিল করে উঠছে এ-গাছ থেকে ও-গাছ পর্যন্ত বিস্তৃত ঊর্ণাজাল, যা মুখে- চোখে মাথায় লেগে প্রগাঢ় অস্বস্তির জন্ম দেয়। কোথাও সুদীর্ঘ সরীসৃপ গাছের ডাল জড়িয়ে মুখ হাঁ করে ঘুমিয়ে আছে; অজান্তে স্পর্শ করলেই অবধারিত মৃত্যু। কোথাও অরণ্যের অন্তরাল থেকে বন্য শ্বাপদের হুহুংকার—শার্দুল, ঋক্ষ, শৃগালাদির গর্জন-উল্লাপন, কোথাও বা কৃষ্ণসার হরিণের সর্ সর্ ধাবনশব্দ। সেই ভয়াবহ অরণ্যের মধ্যে আমি যেন নিজের চোখ জ্বেলে পথ খুঁজে ফিরছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি রাজপুত্র সিদ্ধার্থ নই, এমনকি শ্রমণ গৌতমও নই—আমার অতীতের সুখস্মৃতি নাই, বর্তমানের কর্মতৎপরতা নাই, ভবিষ্যতের স্বপ্নচ্ছবি নাই, চলবার পথ নাই, উপনীত হবার গন্তব্যও নাই—আমি যেন সেই অতীতের সিদ্ধার্থের মুণ্ডহীন প্রেত, স্বকৃত কর্মফলে নির্মিত গভীর সংসার-অরণ্যের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে মুক্তির আলোক অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছি।

এইভাবে হাঁটতে হাঁটতে কতকাল চলে গেল, কত দিন এল, কত রাত্রি বিদায় নিল, কে বলতে পারে? ঘন অটবির ভিতর দিন-রাত্রির প্রভেদ বোঝা যায় না, শুধু এক অবিমিশ্র অন্ধকারের শ্যাম আবরণ সময়ের মুখশ্রীর উপর পড়ে থাকে। কখনও পত্রান্তরালে সূর্যের স্তিমিত আভা হতে দিবাভাগ অনুমিত হয়, কখনও জ্যোৎস্নার আঁচলের একটুকু প্রান্ত ভূমির উপর লুটিয়ে পড়ে অস্ফুট স্বরে বলে, আজ পূর্ণিমা কিংবা আজ শুক্লপক্ষের কোনো রাত্রি। এ ছাড়া আলোক আর নাই। বহুদিন আহার করিনি, শরীরের শক্তি নিঃশেষিতপ্রায়, মনের চিন্তা বিশৃঙ্খল, সত্তার অতল তলদেশ হতে কতগুলো ছবি চিত্তসরসীর উপরিতলে সংস্কারের কাদাজল মেখে ভেসে ওঠে—সেসব ছবি কার, অতীতের না ভবিষ্যতের—কিছুই আর বিচার করতে ইচ্ছাও হয় না, সামর্থ্যও নাই।

এমন অব্যবস্থিত চিত্তে টলতে টলতে একদিন, তখন প্রভাতকালই বোধহয় হবে, আমি স্বপ্নালোকিত একটি পথ দেখতে পেলাম। বিশদ পন্থা কোনো নয়, দুই পাশে গাছে গাছে ছাওয়া উন্নত টিলার মধ্যবর্তী বনের ভিতর দিয়ে সূক্ষ্ম তন্তুর মতো বিশীর্ণ এক পায়ে-চলা পথ। কিন্তু টিলার উপরে দাঁড়িয়ে নীচের সেই পন্থাটুকু দেখে হৃষ্ট হবার মতো মানসিক উৎসাহও তখন আমার আর অবশিষ্ট ছিল না। তথাপি, সহসা বহু মানুষের সম্মিলিত আর্তস্বরে আমি উচ্চকিত হয়ে উঠলাম। এ নিঃশব্দ নির্জন পথে কারা এমন করে সম্মিলিত ভাবাবেগে বিলাপ করতে করতে যায়?

ভালো করে দৃষ্টি স্থির করে দেখলাম, জনা দশেক যুবকের একটি দল এই পথ ধরেই এগিয়ে আসছে। তাদের বেশবাস থেকে মনে হল, তারা শ্রেষ্ঠী। শ্রেষ্ঠী, কিন্তু মলিন ও ছিন্নভিন্ন তাদের বহুমূল্য বেশবাস। প্রত্যেকেই নগ্নপদ, কেউ স্খলিতকেশ, কারও একটি হস্তে কঙ্কন অন্য হস্ত রিক্ত, কারও উত্তরীয়প্রান্ত ছিন্ন, সকলেরই চক্ষু আরক্ত, নয়নপ্রান্তে কারও বা ক্লেদপুষ্পিকা, কেশপাশ বিশৃঙ্খল— যেন সকলেই ঘুম থেকে জেগে উঠে তখনই হাঁটতে শুরু করেছে। তাদের স্খলিত পদক্ষেপ ও জড়িত কণ্ঠস্বর থেকে তারা সকলেই যে সমস্ত রাত্রি মদ্যপান করে নিদ্রিত হয়েছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হল না। চলন দেখে বোঝা যায়, এখনও আসব-আবেশ ভাঙেনি। আরও অবাক হলাম এই ভেবে, যদিও মূল্যবান অথচ ছিন্ন বহুমূল্য পরিধান তাদের গাত্রে, তথাপি শ্রেষ্ঠীজনোচিত অলংকারাদি একটিও তাদের অঙ্গে নাই। এরা কি অরণ্যের বহির্দেশে কোথাও সারারাত মদ্যপান করে হাঁটছিল এবং সেই অবস্থায় দস্যুদলের হস্তে পড়ে অলংকারাদি সবই খুইয়েছে?

সম্মুখবর্তী একজন বলল, ‘মনে হয় এই পথ দিয়েই গিয়েছে। এখনও দ্রুতপদে হাঁটতে পারলে সন্ধ্যার পূর্বেই ওকে ধরতে পারব।’

আরেকজন জড়িত কণ্ঠে সায় দিয়ে সোৎসাহে বলে উঠল, ‘আ-রে, যা-যাবে কোথায়? অরণ্যের বাহিরে নিশ্চয়ই ন-নগর আছে। বা-বামাল স-সমেত ঠিক গিয়ে ধরব।’

অন্যরা তন্দ্রামদির কণ্ঠে হো-হো শব্দে উল্লাস করে উঠল। যদিও উল্লাসরত, তথাপি তাদের কণ্ঠে যেন একটা সর্বস্ব হারানোর বিষাদখিন্ন সুর। এই বিমর্ষ অথচ মত্ত, ধনী অথচ বিপন্ন, উৎসাহী অথচ ভ্রষ্ট যুবকদের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, বনের হিংস্র ব্যাঘ্র ঋক্ষরাও যেন এদের তুলনায় সুস্থিত শান্তির অধিকারী।

হঠাৎ তাদের সম্মিলিত কোলাহল থেমে গেল। তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করেই আমি দেখলাম, পথের বিপরীত দিক হতে একজন গৈরিক কাষায় পরিহিত সন্ন্যাসী আসছেন। সন্ন্যাসী ত্রিশোর্ধ্ব বয়ঃপ্রাপ্ত, তথাপি তাঁর মুখশ্রী দর্শন করে মনে হল, তিনি তরুণ। বেশ কিছুদিন শিরোদেশ মুণ্ডন করেননি, ফলত অযত্নবর্ধিত কুঞ্চিত পিঙ্গল কেশগুচ্ছ মাথার উপর স্তূপাকৃতি রুদ্রাক্ষের রূপ পরিগ্রহ করেছে। অঙ্গের গৌরকান্তি ঈষৎ তাম্রাভ গৈরিক বসনের সঙ্গে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। সন্ন্যাসী ধীর পদক্ষেপে চলেছেন, তথাপি তাঁর গতি মন্থরও নয়। পথপ্রান্তে তাঁর আচম্বিত উপস্থিতি মহিমান্বিত এবং ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক মনে হচ্ছিল। সর্বোপরি তাঁর আয়ত লোচন এবং কমনীয় মুখশ্রী হতে এমন এক অপার্থিব করুণা ও লাবণ্যের ভাব বিকিরিত হচ্ছিল যে, তাঁর মুখের চারিদিকে যেন একটা জ্যোতির্বলয় রচিত হয়েছে বলে ভ্রম হল। তাঁর এক হস্তে একটি ভিক্ষাপাত্র এবং অন্য হস্তে একটি জলপাত্র ন্যস্ত ছিল।

পথের এদিক হতে উচ্ছৃঙ্খল যুবকের দল তাঁকে দেখা মাত্রই অগ্নিলুব্ধ পতঙ্গপুঞ্জের মতো ধেয়ে গেল। কিন্তু, সন্ন্যাসী তাদের প্রতি কোনো অতিরিক্ত আগ্রহ দেখালেন না। সম্মুখবর্তী যুবক সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভদন্ত! আপনি কি এই পথে কোনো সালঙ্কারা যুবতী রমণীকে যেতে দেখেছেন?’

সন্ন্যাসী তাঁর শান্ত নয়ন দুটি তুলে মন্দ্র স্বরে বললেন, ‘হাঁ, তা দেখেছি বটে। তবে তার অঙ্গে অলঙ্কার ছিল কিনা, তা জানবার আগ্রহ বোধ করিনি। কে সে? আর তোমরাই বা কারা?’

সকলে হাঁ-হাঁ করে বলে উঠল, ‘তবে আপনি ঠিকই দেখেছেন, ভদন্ত! অলঙ্কারসমূহ নিশ্চয়ই তার পুঁটুলিতে ছিল। সে নগরীর বারাঙ্গনামুখ্যা মদনিকা আমরা শ্রেষ্ঠী যুবকবৃন্দ, মদনিকাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এই অরণ্যের বাহিরে নদীতীরে একটি প্রমোদকাননে বিহার করতে এসেছিলাম।’

সন্ন্যাসী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে যুবকদিগের মুখপানে চেয়ে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা তার পারিশ্রমিক দিয়েছিলে?’

ঈষৎ মত্ত যুবকটি উত্তর দিল, ‘হাঁ ভ-ভদন্ত, ব-বহু কার্ষাপণ মূল্যে আমরা তা- তাকে এক রাত্রির জন্য ক-ক্রয় করেছিলাম। কিন্তু সে এত অকৃতজ্ঞ যে…’

‘তোমাদের মদবিহ্বল নিদ্রার সুযোগে তোমাদের অঙ্গ হতে সমস্ত রত্নালংকার উন্মোচন করে নিয়ে সে পালিয়ে গেছে? তাই তো?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন, ভদন্ত। আর সেইজন্যেই আমরা তার সন্ধানেই চলেছি।’

‘চমৎকার! কিন্তু কীভাবে জানলে, মদনিকা এই বনের মধ্য দিয়েই যাবে?’ আর কোনদিক দিয়েই বা পালাবে, ভদন্ত? চতুর্দিকেই তো অরণ্য। এইটিই তো একমাত্র পায়ে চলার পথ।

‘তোমাদের অনুমানশক্তির প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু নদী পার হতেও তো পারত!’

নদীতে নৌকা কই যে পার হবে? আমরা আর কালক্ষেপ করব না, ভদন্ত। আপনি যখন মদনিকাকে এ পথ দিয়েই যেতে দেখেছেন, তখন এই পথে গেলেই আমরা তাকে অলংকার সমেত ধরে ফেলতে পারব।’

যুবকেরা তখনই সন্ন্যাসীকে অতিক্রম করে অগ্রসর হতে উদ্যত হল। তথাপি, সন্ন্যাসী বললেন, দাঁড়াও।’

ঈষৎ বিরক্ত হয়ে তারা সপ্রশ্ন চোখে ঘুরে দাঁড়াল।

সন্ন্যাসী বললেন, ‘এই পথ কিছু দূর গিয়েই দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। তার মধ্যে একটি পথ দিয়ে সেই নারী গমন করেছে।’

সম্মুখবর্তী যুবক বলল, ‘বেশ। তবে ভদত্ত, আপনিই আমাদের সঙ্গে চলুন। সেই মদনিকা কোন পথ দিয়ে গেছে, আপনিই আমাদের তা দেখিয়ে দেবেন।’

তাদের এই প্রস্তাব শুনে আমি এবার সত্যই হতবাক হয়ে গেলাম। এরা কি এতদূর প্রমত্ত হয়েছে যে, সমস্ত কাণ্ডজ্ঞানরহিত হয়ে এরা একজন সন্ন্যাসীর কাছে গণিকার সন্ধান চাইছে? কিন্তু কী আশ্চর্য! তাদের এই অশিষ্ট প্রস্তাবে সন্ন্যাসী মৃদু হাস্যে সম্মত হয়ে বললেন, ‘বেশ তো। চলো না। আমিই তোমাদের সেই নারী কোন পথে গেছে, তা দেখিয়ে দিচ্ছি।’

সমস্ত দলটি সন্ন্যাসীর সঙ্গে চলতে লাগল। আমি কিছুটা দূরত্ব রেখে তাদের অনুসরণ করতে লাগলাম। কিছুদূর যাবার পর পথটি সত্যিই দ্বিধাবিভক্ত দেখা গেল। পথের দুটি শাখা বনের মধ্য দিয়ে দু-দিকে ঘুরে কোথায় যেন চলে গেছে। তারই একটির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে সন্ন্যাসী বললেন, ‘এই দিকের পথ ধরেই গিয়েছে মদনিকা।’

এই কথা শোনা মাত্রই যুবকেরা সে-পথে পা রাখতে গেল। সন্ন্যাসী কিন্তু তখনই তাদের বাধা দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন, ‘তবে সাবধান, ভ্ৰাতঃ! এ পথে একটি দারুণ বিপদ আছে। সেই বিপদ সম্বন্ধে অবহিত হয়ে তারপরই এ পথে পা দিও।’

সভয়ে পিছিয়ে এসে কিছুটা বিহ্বল, কিছুটা আর্ত স্বরে তারা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী বিপদ?’

সন্ন্যাসী বললেন, ‘এই আরণ্যক পথে এমন এক বিচিত্র মায়াকুহক ছড়ানো আছে যে, এ পথ দিয়ে যে যায়, সে ক্রমে ক্রমে নিজেকে ভুলে যায়। এখন কী করবে, তোমরাই ভেবে দেখো। যদি নিজেকেই ভুলে যাও, তাহলে মদনিকাকে কি আর খুঁজে বের করতে পারবে?’

একজন যুবক অগ্রসর হয়ে বিস্ফারিত চোখে প্রশ্ন করল, ‘নিজেকে ভুলে গেলে কী হবে, ভদন্ত?’

সন্ন্যাসী হেসে বললেন, ‘কী আর? তুমি কে, কী তোমার পরিচয়, কোথা থেকে এসেছ, কোথায় যাবে এরপর—সবই বিস্মৃত হয়ে যাবে।’

‘সে তো প্রায়োম্মাদ দশা!’

‘হ্যাঁ। তবে প্রায়োন্মাদ নয়, বদ্ধ উন্মাদ! এখন বলো, কী করবে? ইতোমধ্যেই তোমাদের মধ্যে আমি সেই আত্মবিস্মৃতির লক্ষণ ফুটে উঠছে, দেখতে পাচ্ছি। তোমরা সম্ভ্রান্ত বিত্তবান পরিবারের সন্তান। এবং এখানে আসার আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলে। কিন্তু এ মুহূর্তে তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে, তোমরা হৃতসর্বস্ব ভিক্ষুক মাত্র। তোমাদের বেশবাস ছিন্ন, কেশপাশ অবিন্যস্ত, চক্ষু আরক্ত, নিশ্বাস দুর্গন্ধবাহী, তোমাদের মন উদ্‌বিগ্ন ও অশান্ত। মদনিকা যে-পথে গেছে, সেই পথ দিয়ে গেলে আত্মবিস্মৃতির এই রোগ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং শেষে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যাবে। কী করবে, এখনই ঠিক করো তোমরা। নিজেকে খুঁজবে, নাকি মদনিকাকে খুঁজবে?’

সন্ন্যাসীর কথায় এত শক্তি ছিল যে, সম্মুখবর্তী সেই যুবকদের দেখে আমার মনে হল, তারা যেন প্রত্যেকেই নিজেদের এই অসুখের লক্ষণ কথঞ্চিৎ ধরতে পেরেছে। তাদের চোখের তারায় যেন গ্রামের মেলায় হারিয়ে যাওয়া শিশুর উদ্‌বেগ ও অসহায়তা আমি দেখলাম। কিছুক্ষণ তারা কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর একজন মুখ খুলল, আমি নিজেকেই আগে খুঁজে বের করব, ভদন্ত! আমি সুস্থ হব।’

অন্যরাও একে একে বলতে লাগল, ‘আমিও, আমিও।’

সন্ন্যাসী প্রসন্ন হেসে বললেন, ‘বেশ। তবে মদনিকা যে-পথ দিয়ে গিয়েছে, সেই আত্মবিস্মৃতির পথটি দিয়ে যেয়ো না। অপর পথ ধরে এগিয়ে যাও। কিছুক্ষণের মধ্যেই অরণ্যের বাহিরে উপনীত হবে। সেখানে একটি ভিক্ষুদের সঙ্ঘারাম আছে। তোমরা সেখানে গিয়ে বলবে, আমিই তোমাদের পাঠিয়েছি। সেই সঙ্ঘারামের ভিক্ষুগণ তোমাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।’

আমরা সেখানে গিয়ে কী নাম বলব আপনার, আর্য?’

ঝরাপাতার মতো ঝরঝর শব্দে সন্ন্যাসী বলে উঠলেন, ‘বলবে—যে নিজেকে অনেক খুঁজেও পায়নি—সেই-ই তোমাদের সঙ্ঘে প্রেরণ করেছে। সঙ্ঘের ভিক্ষুগণ এই কথা শুনলেই সব বুঝতে পারবেন।’

যুবকেরা অবাক হয়ে সন্ন্যাসীর মুখপানে চেয়ে রইল। সন্ন্যাসী বললেন, ‘আর বিলম্ব কোরো না। অগ্রসর হও। আমি কিছুদিন পর ওই সঙ্ঘারামে আসব। সেখানে আমাদের আবার দেখা হবে।’

যুবকেরা সঙ্ঘানুগামী পন্থায় অগ্রসর হল। সন্ন্যাসীও আর অণুমাত্র কাল বিলম্ব না করে ফিরে আসতে লাগলেন। আমি সন্ন্যাসী ও যুবকদের এই বিস্ময়কর কথালাপ শুনতে শুনতে ক্ষণতরে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। সন্ন্যাসী আমার পাশ দিয়েই লঘুভার ছন্দোময় মেঘের মতো পায়ে হেঁটে চলে গেলেন, অথচ কী আশ্চর্য! আমাকে যেন তিনি একেবারেই দেখতে পেলেন না। আমি আবার তাঁর পশ্চাতে কিঞ্চিৎ ব্যবধান রেখে তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলাম।

ক্রমশ পন্থা পুনরায় অরণ্যসমাকুল হয়ে উঠতে লাগল। কেন জানি আমার মনে হল, অরণ্যের ভূ-প্রকৃতি এখানে পরিবর্তিত হয়েছে। এ যেন পূর্বদৃষ্ট অরণ্য নয়, এ যেন অন্য কোনো স্থান।

সেই নীলকুন্তল অন্ধকার আরও প্রগাঢ়তর হয়ে উঠল। কাজল আঁধারের বুক চিরে দ্যুতিমান জোনাকিরা উড়ে বেড়াতে লাগল। শুধু পাতায় ঢাকা অরণ্যছাদের মধ্য দিয়ে পরিশ্রুত দিনের আভা যতটুকু পথের উপর ম্লান আশার মতো পড়ে আছে, তাতে আমার সম্মুখবর্তী সন্ন্যাসী যে ধীর অমন্থর পদক্ষেপে হেঁটে চলেছেন, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না। তাঁরই পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, ইনি কী বিচিত্র মানুষ! এঁর ভয় নেই, উদ্বেগ নেই, অতিরিক্ত আগ্রহও নেই, অথচ জীবন সম্পর্কে নিতান্ত উদাসীনও নন। যে-ইঙ্গিতময় কথোপকথনের দ্বারা ইনি সেই প্রমত্ত যুবকদের সঙ্ঘে প্রেরণ করলেন, তা আমাকে বিস্ময়বিমূঢ় করে দিয়েছিল। এ মুহূর্তে এই বনপথ দিয়ে ইনি কোথায় চলেছেন?

এমন সময় সহসা আমার চিন্তাসূত্র এক প্রবল গর্জন-শব্দে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। আমি চমকে সম্মুখে তাকালাম। প্রথমে মনে হল, এক হিংস্র শার্দূল সন্ন্যাসীর পশ্চাতে পথের উপর লম্ফ দিয়ে এসে পড়েছে। আমি সভয়ে পেছনের দিকে হঠে সরে এলাম।

আবছা অন্ধকারের মধ্যে ত্রস্ত দৃষ্টি যতদূর যায়, ততদূর প্রসারিত করে দেখলাম, সন্ন্যাসীর পশ্চাতে যে লাফ দিয়ে পড়েছে, সে শার্দূল নয়, মনুষ্য। কিন্তু মনুষ্য কি এত ভয়ংকর হতে পারে? বীভৎস তার আকার, সমস্ত শরীর দীর্ঘরোমাবৃত, কেশশ্মশ্রুসমাচ্ছন্ন ভয়াবহ মুখ, পরনে ব্যাঘ্রচর্ম, নখ প্রবর্ধিত ও বঙ্কিম, ঘূর্ণিত চক্ষু জবাপুষ্পের ন্যায় লোহিত, হস্তে সুধার ভল্ল এবং গলায় সম্ভবত রক্তপলাশের মালা দুলছে। এ লোকটা নিশ্চয়ই পথের পাশে বৃক্ষের অন্তরালে গূঢ়পুরুষের মতো শিকারের অপেক্ষা করছিল। এখন নিরস্ত্র সন্ন্যাসীর পথের উপর অরণ্যের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে সে হুহুংকার শব্দে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

সন্ন্যাসী যেন একবার পেছন ফিরে তার দিকে চোখ তুলে তাকালেন, তারপর আবার ঘাড় ঘুরিয়ে যেমন হাঁটছিলেন, তেমনই হাঁটতে লাগলেন। দস্যু আমার দিকে তাকালোও না। সে সন্ন্যাসীর উদ্দেশে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘থামো, শ্ৰমণ, থামো!’

তথাপি অকম্পিত পদক্ষেপে একই ভাবে সন্ন্যাসী চলতে লাগলেন। দস্যু সন্ন্যাসীর পশ্চাতে সবেগে অগ্রসর হতে লাগল। আমি এক ভয়াবহ ও করুণ দৃশ্যের সাক্ষী হতে হবে বলে কম্পিতবক্ষে যন্ত্রবৎ অগ্রসর হচ্ছিলাম। আমি দেখলাম, দস্যু সন্ন্যাসীর দিকে সবেগে ধাবিত হচ্ছে, অথচ কী আশ্চর্য, সে কিছুতেই সন্ন্যাসীর নাগাল পাচ্ছিল না। সন্ন্যাসী পূর্বের মতোই মন্দ মন্দ পদবিক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছেন। দস্যু সগর্জনে লাফ দিয়ে সন্ন্যাসীর উপর চড়াও হতে গেল, কিন্তু যেখানে গিয়ে সে লাফ দিয়ে পড়ল, সেখান হতে সন্ন্যাসী ঠিক দুই হাত দূরে হেঁটে যাচ্ছেন। দস্যু মাটি আঁকড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পুনরায় হা-হা শব্দে লাফ দিল, কিন্তু এবারও সে তার শিকার ধরতে পারল না। সন্ন্যাসী শান্ত মনে বনপথ দিয়ে হেঁটে চলেছেন।

এইবার আমার সন্দেহ হতে লাগল, এই সন্ন্যাসী কি বাস্তব কোনো মানুষ, নাকি একটি কল্পছায়া? বনের মধ্যে কোনো অশরীরীকে কি আমি দেখছি? তা না হলে দস্যু তাঁকে ধরতে পারছে না কেন?

বারংবার উল্লম্ফনে ক্লান্ত দস্যু বিকট চিৎকার করে এবার বলল, ‘থামো, মায়াবী পুরুষ, থামো!’

সন্ন্যাসী স্থির হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি তো থেমেই গেছি, অঙ্গুলিমাল! বহুদিন পূর্বেই আমি থেমে গেছি। কিন্তু তুমি তো থামোনি। তুমি থামো এবার।’ দস্যু গলিত কণ্ঠস্বরে বলে উঠল, ‘কী বললে, ভিক্ষু? এত সাহস তোমার? আমি দস্যুরাজ অঙ্গুলিমাল, আমাকে দেখে তোমার ভয় করে না? এই যে আমার গলার মালা, এ কী বস্তু তুমি কি দেখেছ?’

সন্ন্যাসী মৃদু হেসে বললেন, ‘দেখেছি, অঙ্গুলিমাল! আর কটি অঙ্গুলি হলে তোমার শত সংখ্যা পূর্ণ হবে?’

এইবার যা দেখলাম, তাতে আমি ভয়ে প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। দস্যুর গলদেশে যে-মালাটি রয়েছে, তা পলাশফুল দিয়ে গাঁথা নয়। মানুষের হাতের আঙুল দিয়ে সে মালা গাঁথা হয়েছে।

দস্যু বিকৃত স্বরে বলে উঠল, ‘আর মাত্র দশটি অঙ্গুলির প্রয়োজন। তাহলেই এই মালায় অঙ্গুলির সংখ্যা একশত পূর্ণ হবে। তুমি দেখছি, আমার কথা জানো!

‘সমস্ত জানি না, অঙ্গুলিমাল। সমস্ত জানা কার পক্ষেই বা সম্ভব? তবু বলছি, এবার তুমি থামো। আমি আগেই থেমেছি।’

‘কী অর্থ কী এর, মায়াবী ভিক্ষু? কেন আমাকে বারবার থামতে বলছ?’

‘তুমি যে বিরামহীন ছুটে চলেছ, অঙ্গুলিমাল! ছুটে চলেছ শিকারের পশ্চাতে, লোভের পশ্চাতে, ক্ষমতার দম্ভের পশ্চাতে, অহমিকার পশ্চাতে, বাসনার পশ্চাতে। তাইতো বলছি, থামো এবার। বিশ্রাম নাও।’

‘না, না না। তুমি কিচ্ছু জানো না, ভিক্ষু, কিচ্ছু জানো না। আমি নিজে ছুটে চলিনি’—এই কথা বলতে বলতে দস্যু যেন হাহাকার করে উঠল। তার সেই আমর্ম হাহাকার বনের বাতাসকে যেন ভরে দিল রুদ্ধশ্বাস ক্রন্দনবাষ্পে।

সন্ন্যাসী দস্যুর নিকটে এসে তাঁর কমনীয় করাঙ্গুলি নির্ভয়ে দস্যুর অনাবৃত বক্ষপটের উপর রেখে আশ্চর্য মায়াজড়িত স্বরে বললেন, ‘জানি না বলেই তো জানতে চাই, অঙ্গুলিমাল। বলো আমাকে। কে তোমাকে এমন অনির্বার ধাবনে ব্যাপৃত করল?’

কী ছিল সেই অমোঘ কণ্ঠস্বরে আর স্পর্শমায়ায় জানি না, দস্যু যেন একটা স্মৃতিবেদনাময় আবেগের অসেতুসম্ভব খাদের ভিতর বিচূর্ণ-মেরু সরীসৃপের মতন বসে পড়ল। উত্তপ্ত দীর্ঘশ্বাসে বনের বাতাস মথিত করে মাথা নেড়ে দস্যু বলল, ‘নাহ, সে অনেক দিন আগের কথা… এখন আর ভালো মনেও পড়ে না… তক্ষশিলার চতুষ্পাঠীতে আমি তখন সদ্যোযুবক বিদ্যার্থী…’

সন্ন্যাসী বললেন, তক্ষশিলা? তবে তো তুমি মেধাবী ছাত্র ছিলে! কী নাম ছিল তোমার? অঙ্গুলিমাল বলে তো কারো নাম হতে পারে না।’

‘আমার নাম সহিংসক… না, না, অহিংসক ছিল বোধহয়। সেখানে… তক্ষশিলায়…’

‘তক্ষশিলায় কী? চতুষ্পাঠীতে কী হয়েছিল? ভালো করে একবার মনে করো দেখি।’

‘কয়েকজন সতীর্থ… তারা আমার সঙ্গেই পড়ত… আমার মেধার কারণে তারা আমাকে খুব ঈর্ষা করত… হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখন মনে পড়েছে’—দস্যুর মুখ এইবার সব কথা মনে পড়ার উত্তেজনায় এক মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল, পরমুহূর্তেই খিন্ন পরিতাপে নিভে গেল

‘সতীর্থ সহাধ্যায়ীরা কী করেছিল তোমাকে? উৎপীড়ন?’

‘না, তারা গুরুর নিকট আমার সম্পর্কে অভিযোগ করেছিল। মিথ্যা অভিযোগ। সে এমন বিষম অভিযোগ যে, গুরুও আমার প্রতি ভয়ানক ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কিছু করবার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তিনি নিজেও একান্ত বিপন্ন, অসহায় বোধ করছিলেন।’

সন্ন্যাসী নিশ্চল শালবৃক্ষের মতো কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে কী যেন ভাবলেন। তাপর বললেন, ‘চতুষ্পাঠীর গুরু কি বিপত্নীক, নাকি অকৃতদার?’

‘না, না, বিপত্নীক বা অকৃতদার হবেন কেন? তিনি কৃতোদ্বাহই ছিলেন। সস্ত্রীক গুরুকুলের প্রান্তে বসবাস করতেন।’

‘হুম্! চতুষ্পাঠীর অন্যান্য ছাত্ররা তোমার বিরুদ্ধে গুরুর নিকট কি এই অভিযোগ করেছিল যে, তুমি গুরুপত্নীর প্রতি প্ৰণয়াসক্ত?’

মানুষটি নিতান্ত অবাক হয়ে সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কীভাবে একথা জানলেন?’

‘লোকচরিত্রজ্ঞান, অহিংসক। আর সামান্য অনুমান। এবং আমার সেই অনুমান আরও বলছে, গুরুপত্নী তোমার প্রতি আসক্ত ছিলেন এবং তোমাকে বারংবার আকর্ষণ করার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু তুমি সাড়া দাওনি।’

অহিংসক এবার উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। মুগ্ধ হয়ে বলল, ‘অদ্ভুত আপনার অনুমানজ্ঞান, শ্রমণ! আমি সাড়া দিইনি। সেই নারী অতি তরলচিত্ত ছিলেন।’

‘সেইজন্যেই গুরু অত অসহায় বোধ করেছিলেন। তারপর?’

তারপর থেকেই গুরু আমার মনের ভিতর হিংসার বীজ রোপণ করতে শুরু করলেন। আমার নাম পরিবর্তন করে রাখলেন সহিংসক। যা অনৈতিক, যা- অশালীন, যা হিংসাকর, সেই অর্থেই তিনি আমার কাছে শাস্ত্রব্যাখ্যা করতে লাগলেন। আমাকে বারবার সুরাপান ও মৃগয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলে বলতে লাগলেন, এসব রাজকীয় ধর্ম। বললেন, রাজধর্ম পালন করো। আমি যেন দিনে দিনে অন্য মানুষ হয়ে যেতে লাগলাম। আরও কিছুদিন পর আমার জাতপত্রিকা পরীক্ষা করে বললেন, আমি রাক্ষসের অংশে জন্মেছি। রাক্ষসের মতোই রক্তপিপাসু হয়ে ওঠাই নাকি আমার একমাত্র ভবিতব্য; আমি চেষ্টা করলেও নাকি এর অন্যথা করতে পারব না।’

চলে এলে না কেন, অহিংসক?’

‘একবার ভেবেছিলাম, চতুষ্পাঠী পরিত্যাগ করে চলে আসব। কিন্তু ততদিনে আমার মনের ভিতর বিষক্রিয়া আরম্ভ হয়ে গেছে। হিংসার নেশা, হত্যার তৃপ্তি আমার স্নায়ুমণ্ডলীকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। তবে আমার গুরুগৃহবাস শেষ হয়ে আসছিল। অন্তিম দিবসে তিনি এক বিকট দ্রব্য গুরুদক্ষিণা হিসাবে চাইলেন, যা প্রদান না করলে আমার উপর তাঁর অভিসম্পাত এসে পড়বে।’

সন্ন্যাসী দস্যুর গলদেশে লম্বিত অস্থিময় মালাটিতে মৃদু করস্পর্শ করে বললেন, ‘এই অঙ্গুলিমালাটি? এটিই তিনি গুরুদক্ষিণা হিসাবে চেয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, একশোটি অঙ্গুলির মালা। সেই থেকে আমি এই অরণ্যে অবস্থান করতে আরম্ভ করলাম। আমার দিন নাই, রাত্রি নাই, শুধু এই মালা নির্মাণে আমি মোহাবিষ্ট। বনের ভিতর মৃগয়া করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করি আর নিরীহ পশুদের সঙ্গে কামক্রিয়া করে শরীরের ক্ষুধা পরিতৃপ্ত করি। ধীরে ধীরে আমি সত্যই মনুষ্যরূপী পিশাচে পরিণত হলাম। এইপথের পাশে প্রচ্ছন্ন বসে থেকে আগন্তুক পথিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে… ওহ্!’

অহিংসক আর কিছু বলতে পারল না। তার দুই চোখ হতে শ্রাবণের অবিরল ধারার মতো ঝরঝর করে অনুতাপাশ্রু ঝরে পড়তে লাগল।

সন্ন্যাসী তাকে কাঁদবার অবসর দিলেন। তারপর ঝটিতি মাটি থেকে সেই বিশালদেহী দস্যুকে দুই হাত দিয়ে টেনে ধরে ভূমির উপর দাঁড় করালেন। করুণাকঠোর তেজোময় কণ্ঠে বললেন, ‘ওঠো, অহিংসক। উঠে দাঁড়াও। উচ্চারণ করো, তুমি কখনও কোনোদিন কোনো অবস্থায় কাউকে উৎপীড়ন করোনি।’

সন্ন্যাসীর এই কথা শুনে আমি নিতান্ত বিস্মিত হলাম। এ যে দস্যুর পক্ষে নিতান্ত মিথ্যাভাষণ হবে!

বিমূঢ় দস্যুও বলে উঠল, ‘তা কী করে হবে? এ যে নিতান্তই মিথ্যা। আমার দুটি হাত কত শিশু, কত নারী, কত বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, যুবকের রক্তে রক্তাপ্লুত হয়ে গেছে যে…’

দস্যু আবার হাহাকারে উদ্যত হল। কিন্তু সন্ন্যাসী তাকে আর সে-সুযোগ না দিয়ে বলদৃপ্ত স্বরে বললেন, ‘না, মিথ্যাচার নয়। আমি বলছি, তুমি কোনোদিন কোনো অন্যায় করোনি। তুমি নির্মল। তুমি অহিংসক। আমার কথা তোমার বিশ্বাস হয় না?’

‘না, হয় না।’

‘বেশ, তবে যা বলছি, তা করো। বিশ্বাস হবে। তুমি এই অরণ্যের নিগূঢ় পন্থাসমূহ জানো। অরণ্যের উত্তর-পশ্চিমে একটি নদী ও তার তীরভাগে একটি গ্রাম আছে। তুমি এই বন থেকে বাহির হও। নদীতে স্নান সেরে শিরোদেশাদি মুণ্ডন করে সুসংস্কৃত হও। স্নান সেরে উঠে দেখবে, নদীতীরের শ্মশানে মৃতের পরিত্যক্ত বস্ত্রসমূহ মাটিতে পড়ে থেকে থেকে গৈরিক বর্ণ ধারণ করেছে। সেই বস্ত্র পরিধান করে শ্রমণ পরিচয়ে তুমি ভিক্ষার্থে সেই গ্রামে যাবে। সেই গ্রামের এক গৃহদ্বারে দাঁড়িয়ে তুমি শুনতে পাবে এক আসন্নপ্রসবা নারীর সকাতর যন্ত্রণাবিলাপ।

‘কিন্তু এসব যে হবে, আপনি কা কীভাবে জানেন?’

সন্ন্যাসী ধ্রুবস্বরে বললেন, ‘আমি জানি। কীভাবে জানি, সেটা এখন প্ৰয়োজনীয় প্রশ্ন নয়। তুমি সেই গৃহদ্বারে আসন্নপ্রসবা নারীর কাতর রোদনধ্বনি শুনে গভীর যন্ত্রণায় মথিত হবে। তিন দিন তিন রাত্রি সে মরণান্তিক কষ্ট পাচ্ছে। সেইখানে দাঁড়িয়ে তুমি শুধু একটি কথা বোলো, যা আমি তোমাকে শিখিয়ে দিচ্ছি।’

‘কী কথা?’

‘তুমি বলবে, ‘যেহেতু জন্মাবধি আমি কোনো হিংসাত্মক কর্ম করিনি, তাই আমার পুণ্যকর্মের প্রভাবে আমার ভগিনীর যন্ত্রণা নিরাময় হয়ে সুপ্রসব হোক’। বলতে পারবে?’

‘পারব। কিন্তু জানি না, এমন অর্থহীন কথার ফল কী হতে পারে।’

‘পূর্বাহ্নে কল্পনা না করে, বাস্তবে আন্তরিকতার সঙ্গে এই কথা, এই শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেই দ্যাখো না, ফল কী হয়। তাহলেই তুমি তো আমি সত্য বলেছি কিনা, তা নিজেই উপলব্ধি করতে পারবে, যুবক!’

অহিংসক স্বল্পক্ষণ কী যেন ভাবল, তারপর সন্ন্যাসীচরণে প্রণত হয়ে উঠে দাঁড়াল। গলা থেকে সেই অঙ্গুলিমালাটি খুলে একবার মায়াভরে নিরীক্ষণ করল। পরমুহূর্তেই সেই মালা সে অন্ধকার অরণ্যের মধ্যে নিক্ষেপ করে বনাভিমুখে অগ্রসর হল। আমি দেখলাম, তার দুই চোখে জ্বলে উঠেছে কঠিন সংকল্পের আলো।

সন্ন্যাসী কিন্তু আর সেদিকে তাকালেন না। তিনি আবার চলতে শুরু করেছেন। অতর্কিতে এই যে এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল, এ মুহূর্তে তাঁর অবয়বে যেন তার চিহ্নমাত্রও নাই।

সন্ন্যাসীকে অনুসরণ করে কত দিন পর আমি অরণ্যের বাহিরে এলাম। সামান্য অগ্রসর হতে ঝিমন্ত একটি গ্রাম পড়ল। রৌদ্রের আলোছায়ামাখা পথ, কয়েকটি কুটির, অলস সারমেয়দের জটলা, ভূম্যবনত বাঁশ বেতের ঝোপ, মধ্যে মধ্যে অপেক্ষাকৃত ধনী ব্যক্তিদের হর্ম্য, প্রাসাদ। মাঝখান দিয়ে ধুলামাখা একটা দরিদ্র পথ।

সন্ন্যাসীর থেকে সামান্য দূরে ক্ষুধাতৃষ্ণায় প্রায় টলতে টলতে আমি হাঁটছিলাম। আগেও যেমন, এখনও তেমনই—সন্ন্যাসী আমাকে লক্ষও করেননি। কিছুক্ষণ পর সন্ন্যাসী একটি গৃহস্থের আলয়ে দ্বারপথে করাঘাত করে দাঁড়ালেন।

অনতিবিলম্বে গেহপতি কপাট উন্মোচন করল। সে-ব্যক্তির চাহনিতে বিরক্তির ভাব সুপরিস্ফুট। সংক্ষেপে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী প্ৰয়োজন?’

সন্ন্যাসী বললেন, ‘আমি ভিক্ষার্থী।’

লোকটি তির্যক ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করল, ‘তোমাকে ভিক্ষা দিয়ে আমার লাভ?’ সন্ন্যাসী স্মিত হেসে চলে আসছিলেন। কিন্তু গেহপতি গলা তুলে বলল, ‘ওহে সন্ন্যাসী, দাঁড়াও।’

সন্ন্যাসী পূর্ববৎ স্মিত হাস্যে ফিরে গেলেন। লোকটি বলল, ‘বনভূমির এক পার্শ্বে যে-বিহার আছে, তুমি কি সেখানকার ভিক্ষু নাকি?’

সন্ন্যাসী বললেন, ‘হাঁ। আমি সেই বিহারের সঙ্ঘপ্রধান।’

অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিলে শিখা যেমন লকলক করে ওঠে, লোকটির ক্রোধাগ্নি যেন তৎক্ষণাৎ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। সে ক্রোধে কাঁপছে, নাসারন্ধ্র স্ফীত হয়ে উঠেছে, হস্ত মুষ্টিবদ্ধ, মুখমণ্ডল অরুণবর্ণ ধারণ করেছে।

অতি পরুষবাক্যে লোকটি সন্ন্যাসীকে বলল, ‘অ, তাহলে তো ঠিকই চিনেছি! তুমি তো একটা ভণ্ড। রাজ্যশাসনের শক্তি থাকা সত্ত্বেও রাজকীয় দায়িত্ব পরিত্যাগ করে অহিংসা প্রচারের নামে মঠে বিলাসব্যসনে ডুবে থাকো আর আমাদের সমর্থ যুবক সন্তানগুলিকে ভুলিয়েভালিয়ে বিহারে নিয়ে গিয়ে নিজের সেবায় নিযুক্ত করো। মিথ্যাবাদী, চোর, প্রবঞ্চক! শুনতে পাই, তুমি নাকি বেদদ্রোহ করেছ। আমরা অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণ। আমাদের সকল আচার-বিচার মিথ্যা বলে তুমি প্রচার করো। জাতপাত মানো না। অনাচারী, কূটনীতিকুশল, অলস, অপদার্থ, পরস্বাপহারী, লম্পট! তোমার মুখ দেখলেও প্রভূত পাপসংগ্রহ হয়…’

এইভাবে মুখে যা আসে তাই অনর্গল কটুবাক্যস্রোতে লোকটি সন্ন্যাসীকে তিরস্কার করতে লাগল। কিন্তু বড়োই বিস্ময়কর এই যে, এত তিরস্কারবাক্যের মধ্যেও সন্ন্যাসীর ওষ্ঠপ্রান্তে সেই একই মুকুলিত হাস্যরেখা এতটুকু ম্লান হল না। যেন কী একটা কৌতুককর ব্যাপারই না অনুষ্ঠিত হচ্ছে! সন্ন্যাসীর সেই হাসিতে গৃহস্থের অন্তরাত্মা পর্যন্ত যেন জ্বলে যেতে লাগল। সে দ্বিগুণবেগে কণ্ঠস্বর চড়িয়ে তর্জনগর্জন করতে আরম্ভ করল।

কিন্তু মানুষ বেশিক্ষণ রোষাবিষ্ট অবস্থায় থাকলে ক্লান্ত হয়ে যায়। শেষপর্যন্ত লোকটি একটু শ্বাস নেবার জন্য স্থির হয়ে দাঁড়াল।

তখনই সন্ন্যাসীর বাকস্ফূর্তি হল। তিনি হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘শেষ হয়েছে?’

‘কী শেষ হবে?’

‘না, বলছি, যদি আপনার কথা শেষ হয়ে থাকে, তবে আপনাকে আমি একটি প্রশ্ন করতাম।’

‘কী প্রশ্ন করবে, করো—’

‘বলছিলাম, যদি আপনি কাউকে কিছু দান করেন, আর সেই ব্যক্তি যদি আপনার দান গ্রহণ না করে, তাহলে আপনার প্রদত্ত বস্তু কোথায় যায়?’

‘কোথায় আবার যাবে? আমার দেওয়া জিনিস—সে না নিলে আমার কাছেই ফিরে আসবে।’

‘ঠিক। আপনিও এতক্ষণ আমাকে যা যা বললেন, যে যে পরুষবাক্য আমাকে উপহার দিলেন, তার একটি শব্দও আমি গ্রহণ করলাম না। আপনার দেওয়া সেইসব গালিগালাজ এখন আপনার কাছেই ফিরে যাক।’

গৃহস্থ ব্যক্তি বিস্ফারিত নেত্রে ভাবতে লাগল এবং অচিরেই বুঝতে পারল, সে প্রতারিত হয়েছে। ক্রুদ্ধ স্বরে সে সন্ন্যাসীকে পিছু ডাকতে লাগল। কিন্তু ততক্ষণে সেখানে আর অপেক্ষা না করে সন্ন্যাসী চলতে শুরু করেছেন।

আরও বেশ কিছুদূর যাবার পর এক দরিদ্র গৃহে তিনি ভিক্ষা পেলেন। আমিও তারপর দুয়েকটি কুটির অতিক্রম করে সামান্য চিপিটক ও গুড় ভিক্ষা পেলাম।

গ্রামের শেষ প্রান্তে একটি নদীতীরে এসে বসলাম। কিছুটা দূরে এক বৃক্ষছায়ায় সেই সন্ন্যাসীও এসে বসেছেন। নদীর বাতাসে শরীর শীতল হয়ে যাচ্ছে। আহ্ কী আরাম!

হঠাৎ চোখ তুলে দেখলাম, তিনি আমার দিকেই যেন তাকিয়ে আছেন। মুখে সেই মৃদুমল হাসি। এতক্ষণ তো তিনি কী অজানিত কারণে আমাকে লক্ষও করেননি। এখন হাসছেন কেন?

সন্ন্যাসী এবার আমাকে প্রীতিপূর্ণ উচ্চরবে আহ্বান করলেন, ‘ওহে ভিক্ষু! কী ভিক্ষা পেলে? এদিকে এসো, দেখি।’

আমি তাঁর নিকটে উপস্থিত হয়ে বললাম, ‘সামান্য চিপিটক আর গুড়।’

তিনি বললেন, ‘মন্দ কী? আমি এই কদলী আর তক্র পেয়েছি। এসো, উভয়ের ভিক্ষা মিশ্রিত করে এই বৃক্ষতলে বসে দুজনে আহার সমাধা করি। বোসো, বোসো। ইতস্তত করছ কেন?

আমি সন্ন্যাসীর মুখোমুখি বসলাম। তিনি তাঁর ভিক্ষাপাত্রে চিপিটক, তক্র, গুড় ও কদলী মিশ্রিত করে উত্তমরূপে মাখলেন। আমি অপাঙ্গদৃষ্টিতে তাঁকে লক্ষ করছিলাম। এমন মহা ব্যক্তিত্ববান, তেজোময় অথচ এত সহজ পুরুষ! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার নাম পরিচয় কী, ভদন্ত?’

তিনি হেসে বললেন, ‘আমার কোনো পরিচয় নাই, ভিক্ষু। এই যে সম্মুখে নদী, তুমি কি এর নাম জানো? জানো না। কিন্তু সেই না-জানাতে কি এর মৃদুমন্দ বাতাস সেবন করতে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে?’

আমি বুঝলাম, তিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তথাপি বললাম, ‘আপনি শ্ৰেষ্ঠী যুবকদের সঙ্ঘাভিমুখে চালিত করে বললেন, তারা যেন নিজেকে খুঁজে বের করে। অথচ এও বললেন যে, আপনি অনেক খুঁজেও নিজেকে খুঁজে পাননি। এমন বিপরীত কথার অর্থ কী?’

সন্ন্যাসী আনন্দিত স্বরে বললেন, নিজেকে অন্বেষণ করার জন্যই তো গৃহত্যাগ করেছিলাম, ভিক্ষু। কিন্তু নিজেকে তো পেলাম না। পেলাম মহাশূন্যতা। ‘

শূন্যতার কথায় যে কেউ এত আনন্দিত হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। বললাম, ‘তবে তো আপনার জীবন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে!’

তিনি বললেন, ‘তা কেন? শূন্যতাতেই তো পরম আনন্দ, শূন্যতাই তো সর্বতোভদ্র, শূন্যতাই জীবনের পরম আপ্তি। আর নিজত্বই তো কণ্ঠদেশে বিদ্ধ হয়ে থাকা একমাত্র কণ্টক। ওসব কথা থাক। তুমি বলো, তোমার নাম কী?’

‘সিদ্ধার্থ।’

‘সি-দ্ধা-র্থ?’–এই বলে সন্ন্যাসী হাহা করে হাসতে লাগলেন। যেন আমার নামটি তাঁর কাছে অসম্ভব কৌতুককর ঠেকেছে। তারপর হাস্যবেগ প্রশমিত হলে বললেন, ‘তুমি সিদ্ধার্থ। আর আমি সুগত।’

বুঝলাম, তিনি সুরসিক। কিন্তু আমিও তাঁর রসিকতায় যোগ দিয়ে বললাম, ‘সুগত? সুগত শব্দের অর্থ তো যা চলে গেছে এমন—অর্থাৎ অতীত।’

সন্ন্যাসী সহসা গম্ভীর হয়ে গেলেন। যেন স্তব্ধবাক রাত্রি। সেই স্তব্ধতা ভেঙে ধীরে ধীরে গম্ভীরস্বরে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমি অতীত নই, ভিক্ষু। আমিই তোমার ভাবীকাল।’

আমি তাঁর কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না। তিনি আমার বিহ্বলতা লক্ষ করে এক লহমায় সহজ হয়ে বললেন, ‘এসব অতীত, ভাবীকাল—এবম্বিধ দার্শনিক আলোচনা এখন পরিত্যাগ করো দেখি। বর্তমানে আমাদের সম্মুখে রয়েছে অতি সুস্বাদু শালিধান্যের চিপিটক, অম্লস্বাদ তক্র, অমৃতোপম কদলী ও ইক্ষুরসে জ্বাল দেওয়া গুড়। এসো, আহার করি।’

তাঁর সঙ্গে একই পাত্রে আহার করতে আমার বড়ো সংকোচ হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর আন্তরিক ব্যবহারে সেই সঙ্কোচ সহজেই দূর হয়ে গেল। আমরা আহার করতে লাগলাম। দেখলাম, সন্ন্যাসী কী মনোযোগ সহকারে তাঁর আহার্যের অংশের প্রতিটি কণা গ্রহণ করছিলেন।

আহার সমাধা হলে জলপাত্র হতে জল নিয়ে আমরা হস্তমুখ প্রক্ষালন করলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় যাবে, সিদ্ধার্থ?’

বললাম, ‘জানি না।’

তিনি বললেন, ‘শোনো। অনর্থক দার্শনিক প্রতর্কে কালক্ষেপ কোরো না, সিদ্ধার্থ। এই নদীর নাম নৈরঞ্জনা। এর তীরভূমি ধরে দক্ষিণাভিমুখে গমন করলে উরুবিল্ব নামক একটি বন পাবে। সেইখানে একান্তে উপবেশন করে নিজেকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করো।’

‘কিন্তু আপনি যে বললেন, নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় না?’

‘এহি পশ্য, ভিক্ষু, এহি পশ্য। এসো, দ্যাখো, নিজের চোখে দ্যাখো। নিজে পরীক্ষা করে দ্যাখো, কী পাও। অনর্থক অনুমানে কী লাভ?… আমি এখন আসি।

এই বলে তিনি আনন্দপ্রোজ্জ্বল মুখে উঠে দাঁড়ালেন। আর তখনই আমার মনে পড়ল, এঁকে পূর্বে আমি কোথায় দেখেছি। সে বহু বর্ষ পূর্বে। আমার পিতা আমাকে রাজপ্রাসাদে ভোগবিমগ্ন করে রাখার প্রয়াস করেছিলেন। কিন্তু আমি পিঞ্জরাবদ্ধ পক্ষীর মতো সেই মণিজিঞ্জির কেটে বাহির হয়ে আসতে চেয়েছিলাম। পিতার অনুমতি নিয়ে নগরভ্রমণে বাহির হয়ে পথিমধ্যে দেখেছিলাম, এক রোগগ্রস্ত ব্যক্তি, এক জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ আর একটি খট্টাঙ্গবাহিত মৃতদেহ। সেই প্রথম জেনেছিলাম, জীবনের অনিবার্য পরিণতি। এই আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত দুঃখের উপশম কোথায়, এই কথা যখন আমি প্রাসাদসংলগ্ন উদ্যানে বসে চিন্তাকুল হৃদয়ে আকাশপাতাল ভাবছি, তখন আমারই চক্ষুর সম্মুখ দিয়ে এই সন্ন্যাসীই সেদিন নিরর্গল পায়ে হেঁটে চলে গিয়েছিলেন। ইনিই তিনি, সেই আনন্দদীপ্ত মূর্তি। কিন্তু তিনি এখানে কীভাবে এলেন?

পুনরায় আমার স্কন্ধোপরি হাত রেখে তিনি অতি প্রীতিভরে বললেন, ‘আসি।’ তারপর তিনি চলে গেলেন। কিন্তু ওইদিকে কোথায় গেলেন? ওদিকে তো কোনো পায়ে চলা পথ নেই!

আমি তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম, এ ধীরোদাত্ত সৌম্য কে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *