৩. নগরী কহিল ধীরে
ধরিত্রীর প্রত্নধূসরা প্রাচীনতরা এক নগরী আমি; নাম—রাজগৃহ। সুদূর অতীতের গর্ভে কুয়াশা আর অন্ধকার মেখে আমি ছিলাম সুনিহিত; তখন আমার নাম ছিল ‘গিরিব্রজ’। সুপ্রাচীন মহাকাব্যে আমার উল্লেখ, মগধাধিপতি জরাসন্ধের রাজধানী ছিলাম আমি। আমি ‘রাজগৃহ’—প্রাকৃত পালিতে ‘রাজগেহ’ নামে আমার পরিচয়। আমার শরীর প্রহরীর মতো ঘিরে রেখেছে উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণি। শ্যাম তৃণগুল্মে আচ্ছাদিত বৈভার আমার প্রথম মুকুট, বিপুল্ল শৈলশির আমাকে অবলোকন করছে দেহরক্ষীর মর্যাদায়, যার পাদদেশ ধৌত করে চলেছে সমুষ্ণ ঊর্মিমালায় মুখরিত স্নিগ্ধ স্রোতস্বিনী—তীরদেশে শান্ত ছায়ানিবিড় তপোবন—মধ্যে মধ্যে স্থিরবক্ষ হ্রদ প্রতিবিম্বিত করেছে কৃষ্ণপ্রস্তরময় অদ্রিমালাকে। দক্ষিণ-পূর্বে আমার শৈলগিরি, যার গৃধ্রকূট শিখর কথা বলে আকাশের নিবিড় নীলিমার সঙ্গে। আর পূর্বে রত্নগর্ভ রত্নগিরি, যার গাত্র বেয়ে গড়িয়ে নেমে এসেছে বিসর্পিল পন্থা, শত পদচিহ্নরেখাঙ্কিত উপলখণ্ড সে-পথে পথে ছড়ানো… এই পথ তোমাকে নিয়ে যাবে পুষ্পরাজি-আকীর্ণ বনভূমির দিকে, শস্যভরা কৃষিক্ষেত্রের পাশ দিয়ে বেনুবনের পথ ধরে, মধুমক্ষিকার গুঞ্জরণে মুখর আম ডুমুর খেজুরের সারি কাণ্ড নমিত করে তোমাকে অভিবাদন জানাবে।
আরও যদি যেতে পারো, তবে এক মুখর জনপদ… গৃহ, সৌধ, প্রাসাদের শ্রেণি… মধ্যে মধ্যে অগণ্য বিতান… ব্যস্ত আপণিক আর ক্রেতাদের কলরোল… পদাতিক জনতার চলাচল আর রাজা কিংবা রাজন্যবর্গের রথের ঘর্ঘর… সুসজ্জিত শ্রেষ্ঠীদের গমনাগমন… মাদারির খেলা দেখায় ঐন্দ্রজালিক… নট, বিট, নাগরিক, পুরললনাদের বাক্যালাপ… পথিপার্শ্বে শৌণ্ড্রিকালয় পানশালা… একধারে গণিকাদের আবাস… এমনই শব্দময় কথাকাব্যের মতো আমি এক সুপ্রাচীনা নগরী—আমি রাজগৃহ—নৃপতি বিম্বিসারের করধৃত আমি প্রকৃতির সম্ভারে পরিবৃত এক ব্যস্ত জনপদ।
সম্প্রতি আমার রাজকীয় পন্থায় আর গৃধ্রকূটের শিখরে এক তরুণ তাপসের আগমন ঘটেছে; গৈরিক চীরবাস অতিক্রম করে তাঁর দেহের রেখায় রেখায় ফুটে আছে রাজকীয় লক্ষণ। শুনেছি, তাঁর নাম ‘সিদ্ধার্থ’; শাক্যবংশের রাজপুত্র। এ দারুণ তারুণ্যে স্ত্রী-পুত্র-রাজ্য-বৈভব পরিত্যাগ করে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছেন। বিচিত্র তাঁর জিজ্ঞাসা—আত্মা, ব্রহ্ম বা ঈশ্বরকে তিনি জানতে চান না—নিখিল জীবের বেদনার স্বরূপকে তিনি বুঝতে চান, বেদনার অতিক্রম খুঁজে পেতে চান। গৃধ্রকূটের নির্জন এক গুহায় তিনি অবস্থান করেন, দিনের প্রথমভাগে সেই শিখর থেকে নেমে এসে নদীতে স্নান সেরে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে ফেরেন। আমি তাঁকে অনুসরণ করেছি, তাঁর পদচিহ্ন ধরে রেখেছি আমার বক্ষে।
এরই সঙ্গে আরও একটি বিচিত্র ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি, সাধারণ মানুষের সে-বিষয় নিরীক্ষণ করার সামর্থ্য নেই। সিদ্ধার্থের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরই মতন অবিকল আর-এক পুরুষ গমনাগমন করে। অন্য সেই পুরুষের গাত্রবর্ণ কৃষ্ণ, যদিও ইচ্ছামতো সে তার বর্ণ পরিবর্তন করতে পারে। কখনও নীলাভ, কখনও হরিৎ, কখনও বা আরক্তভীষণ। সিদ্ধার্থকে সে শুধু অনুসরণই করে না, তাঁর সঙ্গে কথাও বলে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সে সিদ্ধার্থের সঙ্গে এক হয়ে আছে, কখনও আবার মনে হয়, সিদ্ধার্থের থেকে সে সম্পূর্ণ বিশ্লিষ্ট। আমি এই অন্য পুরুষটিকে চিনতে পেরেছি। সে মার—সে মন্মথ, সে এক মূর্তিমান সম্মোহন।
প্রকৃত প্রস্তাবে, সে যে বাইরে কোথাও আছে, তা নয়। সে সিদ্ধার্থের ভিতরেই আছে। সে তাঁকে ক্রমাগত তপস্যা পরিত্যাগ করতে বলছে। কখনও অনুনয়ের ভাষায়, কখনও ভীতিপ্রদর্শনের ভঙ্গিমায়। জন্মজন্ম ধরে সে সিদ্ধার্থকে প্রলোভিত করে আসছে। সে পরামর্শ দিচ্ছে ধ্যান ছেড়ে সিদ্ধার্থ যেন স্বরাজ্যে ফিরে যান; যেন রাজসিক জীবনকে উপভোগ করে চলেন। সিদ্ধার্থের সঙ্গে তার অবিরত তর্ক চলছে। সিদ্ধার্থ কিন্তু সর্বদাই এই মারের পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন। মাঝে মাঝে কোনো কোনো অপরাহুবেলায় এই রক্তাক্ত দ্বৈরথসমরে সিদ্ধার্থকে বড়ো ক্লান্ত দেখায়। ক্লান্ত তিনি, কিন্তু দমিত নন।
দিনান্তে যখন সূর্য অস্ত যায়, গৃধ্রকূটের সেই গুহার সম্মুখে একটি প্রস্তরখণ্ডের উপর সিদ্ধার্থ এসে দাঁড়ান। ধ্যানচ্ছেদে এই সমস্ত জগৎটাকে তাঁর স্বপ্নবৎ প্রতীত হয়। মনে হয় বুঝি তাঁর, এই স্বপ্ন কেন যে সত্যের মতো দেখায়! আকাশের ছিন্নমেঘ অস্তরাগ মেখে নীল গগন বেয়ে উড়ে যায়, বাতাসের বেগে ছিন্নভিন্ন হয়ে দিগন্তের নীলাভায় মিলিয়ে যায় কোথায়… মনে হয়, তাঁর জীবনও কি ওই ছিন্ন মেঘেরই মতো ব্যর্থ হবে?… প্রতিকূল পবনে লীন হয়ে মিশে যাবে মহাশূন্যতায়? তারপর সেই অবসন্নতার অন্ধকারের ভিতর ধীরে ধীরে পর্বতের সানুদেশে দূরস্থ জনপদের গরাক্ষে গবাক্ষে জ্বলে ওঠা প্রদীপের প্রথম শিখার মতো স্থির এক প্রত্যয় জেগে ওঠে, তবু সে যেন ক্ষণিক আশার আলোক… সিদ্ধার্থের অন্তরস্থিত মার অস্ফুট স্বরে সেই আলোকের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে সিদ্ধার্থকে নিষেধ করে… কিন্তু সিদ্ধার্থ মারের সে-নিষেধকে অগ্রাহ্য করে ধীর পদক্ষেপে গুহার ভিতরে চলে যান… সেখানে অটল শিলাসনে পুনরায় ধ্যান ধরে বসেন… বিনিদ্র শৃগাল আর ক্ষুৎকাম শার্দুলের উচ্চকিত রবে কুয়াশামাখা রাত্রি নেমে আসে গিরিশ্রেণির উপর।
বস্তুত যে-সমস্যা নিয়ে সিদ্ধার্থ ভাবিত, আমিও তা নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু সমাধান কিছু পাইনি। আমি রাজগৃহ নগরী, আমার বুকের উপর অগণ্য জীবকুল জন্মগ্রহণ করে, বেড়ে ওঠে, জরাগ্রস্ত হয়, মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাদের পরিত্যক্ত দেহ ভস্মীভূত হয়। সেই চিতাগ্নির অতীত কোনো সত্তা আছে কিনা, থাকলেও তার গতি কোনদিকে, আমি তা জানি না। আমি শুধু দেখি, বৃষ্টির ফোঁটার ভিতর প্রাণবিন্দু কোথা থেকে উড়ে এসে আমার বুকের ওপর পতিত হয়, শস্যের ভিতর প্রবেশ করে কেউ কেউ, সেই শস্য আহার করে জীব-জন্তু-প্রাণী-মানুষ। পুরুষের শরীরের ভিতর দিয়ে সেই প্রাণ শুক্রবীজ আশ্রয় করে, নারীর যোনিতে প্রবিষ্ট হয়, তারপর মাতৃকুক্ষিতে অবয়ব পায়। আবার জন্ম-জীবন-জরা-মরণের ঘর— সেই এক আবর্তন। এই আবর্তন থেকে মুক্তির উপায় কী? নির্বাণ কোন পথে? সিদ্ধার্থ আসলে কী খুঁজে চলেছেন? তাঁর অন্বেষণের আছে কি কোনো পরিসমাপ্তি, সমস্যাসমাধানের আছে কি কোনো অনিবার্য সূচিমুখ?
আমি সিদ্ধার্থের অন্বেষণকে বুঝতে পারিনি, তবু সিদ্ধার্থকেই শুধু আমি অন্বেষণ করে ফিরি। প্রতিদিন সূর্যোদয়কালে তিনি গৃধ্রকূটের শিখরচূড়া থেকে পায়ে পায়ে নেমে আসেন। গিরিপদতলে স্বচ্ছতোয়া হ্রদে অবগাহন সেরে নেন। তারপর ভিক্ষাপাত্র হাতে আমার পথে পথে তিনি ভিক্ষার্থে যাত্রা করেন। মনে হয়, নবোদিত সূর্য প্রভাতের কিরণসম্পাতের ভিতর দিয়ে যেন নেমে এসেছেন পৃথিবীর উপর। অর্চিষ্মান তাঁর উপস্থিতি, যৌবনের সকল সৌন্দর্য বুঝি বা ঘনীভূত হয়ে তাঁর সস্মিত আননের চারিপাশে জ্যোতির্বলয় রচনা করেছে। তাঁর পদক্ষেপ ত্বরিত নয়, মন্থরও নয়। কোথাও এখনই তাঁকে পৌঁছোতে হবে এমন নয়, আবার জীবনের লক্ষ্যের প্রতি মৃদুতম ঔদাস্যও তাঁর পদবিক্ষেপে প্রতীত হয় না। অঙ্গের তরঙ্গায়িত চীরবস্ত্র বৈরাগ্যের উত্তাপে সমুজ্জ্বল, বিথারিত নয়নদ্বয় নিখিল জীবের প্রতি মহাকরুণায় ঢলোঢলো; যেন স্নেহলাবণ্যে পরিপূর্ণ সরসী। শিরোদেশে সদ্যোখিত কুন্তলগুচ্ছ চূড়াকৃত, অধরে মৃদুমঞ্জুল হাস্যরেখা যেন অন্তরের অস্তস্থলে লুক্কায়িত, ঈষৎ সাচীকৃত চিবুক, উন্নত ভ্ৰূযুগ, ললাট… দক্ষিণ করে ধৃত ভিক্ষাপাত্র… তিনি গৃহস্থের দ্বারপ্রান্তে নিঃশব্দে অপেক্ষা করেন।
তাঁকে দর্শন করে বহু গৃহে গৃহবাসী স্বতই বাহিরে এসে তাঁর ভিক্ষাপাত্র ভরে দেন। কেউ বা তাঁর উদ্দেশে নমস্কার নিবেদন করেন, শিশু-যুবক-যুবতী-বৃদ্ধা সকলেই তাঁর ব্যক্তিত্বে অভিভূত হয়ে যান। কিশোরীরা মুগ্ধা হরিণীর ন্যায় তাঁকে দর্শন করে, বৃদ্ধারা বিলাপ করে বলেন, ‘কার গৃহ অন্ধকার করে এ মানুষ সন্ন্যাসী হয়েছে!’ প্রৌঢ় ব্যক্তিবর্গ পরস্পর পরামর্শ করেন, ‘এ ব্যক্তি কি মনুষ্য, নাকি দেবতা!’ তিনি কিন্তু সর্বত্র অবিচলিত চিত্তে ভিক্ষাগ্রহণান্তর ‘স্বস্তি’ উচ্চারণ করে পথে চলতে থাকেন। কোনো গৃহে কেউ তাঁকে অবহেলা বা উপেক্ষা করলেও তাঁর মঙ্গলপ্রদ মঞ্জুল বদনে তিলমাত্র মালিন্য পরিদৃষ্ট হয় না।
সিদ্ধার্থ এইভাবে যখন ভিক্ষা করে থাকেন, তখন তাঁর ছায়াসঙ্গী মার কিন্তু এক মুহূর্তও নিশ্চুপ থাকে না। সে সিদ্ধার্থকে সর্বদাই অসৎ পরামর্শ দিতে থাকে। মার অস্ফুট স্বরে কী বলছে, আমি তা সব শুনতে পাই। শুনি, মার বলছে, ‘দ্যাখো সিদ্ধার্থ! কী বিপুল তোমার ব্যক্তিমায়া! তোমাকে এইসব প্রাকৃত জনতা চেনে না। তথাপি না চিনেই এরা তোমার পদপ্রান্তে লুটিয়ে পড়ছে। তাহলে ভিক্ষাপাত্র ধারণ না করে তুমি যদি রাজদণ্ড হাতে নিতে, তবে যে তুমি সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হতে পারতে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বৃথাই তোমার এই স্বেচ্ছাবৃত দুশ্চর তপস্যা, ব্যর্থ তোমার এই ভিক্ষান্ন গ্রহণ। মানুষের কাছে হাত পাততে তোমার লজ্জা করে না, শাক্য রাজকুমার? গৃহস্থের অন্নে তোমার কী অধিকার আছে?’ এমনই কত কথা মার সিদ্ধার্থের কর্ণকুহরে ঢেলে দেয়। সিদ্ধার্থ সে- সকল কথা শুনেও শোনেন না।
একদিন এক রাজন্য সিদ্ধার্থের ভিক্ষারত মূর্তি দর্শন করে মুগ্ধ হয়ে রাজসকাশে সকল কথা নিবেদন করলেন। সম্রাট বিম্বিসার তাঁর কথায় উৎসুক হয়ে উঠলেন। কিছুদিন পর এক প্রভাতবেলায় তিনিও দেখলেন নগরপথে ভিক্ষানিরত সিংহপুরুষ সিদ্ধার্থকে। সেই দিনই স্থির করলেন, তিনি সিদ্ধার্থের সঙ্গে আলাপ করবেন। গুপ্তচরমুখে সম্রাট বিম্বিসার জানতে পারলেন, সিদ্ধার্থ এখন গৃধ্রকূট শিখরে অবস্থান করছেন।
কিয়দ্দিবস পর এক অপরাহুবেলায় নৃপতি বিম্বিসার গোপনে শৈলগিরিশিরে উপস্থিত হলেন। অপরাহ্ন সায়াহ্নের ভিতর ঢলে পড়ছে… ছায়া গাঢ় হয়ে আসছে। গিরিচূড়ায় উপস্থিত হয়ে তিনি দেখলেন, সিদ্ধার্থ সেই প্রস্তরখণ্ডটির উপর দণ্ডায়মান। পশ্চাতে সূর্য অস্তাচলগামী।
পরস্পর নমস্কার বিনিময়ের পর রাজা বললেন, ‘আপনার কথা অমাত্যমুখে আমি সম্যক অবগত আছি, শ্ৰমণ। ইদানীং আপনি আমার রাজ্যে পদার্পণ করেছেন। আমি আপনার ব্যাপারে সবিশেষ কৌতূহলী। কোথায় আপনার জন্ম? সম্প্রতি কোন দেশ হতে আগত?’
সিদ্ধার্থ বললেন, ‘আমি শ্রমণ—সন্ন্যাসী। পূর্বাশ্রমীয় জীবনের অতীতস্মৃতিচারণে অনধিকৃত।
রাজা সহাস্যে বললেন, ‘আপনার নিকট হতে এরূপ উত্তরই আশা করেছিলাম। যাই হোক, গুপ্তচরসূত্রে আমি জেনেছি, আপনি শাক্যবংশীয় রাজকুমার। আপনার মনোহর আকার, বলিষ্ঠ ও তেজোব্যঞ্জক মূর্তি সেই ক্ষাত্রশক্তিকেই স্মরণ করায়। আপনার হস্তদ্বয় রাজদণ্ড ধারণ করার উপযুক্ত, ভিক্ষাপাত্র ধারণের উপযোগী নয়। রাজ্যশাসন না করে আপনি ভিক্ষা করেন কেন?’
সিদ্ধার্থ বললেন, ‘রাজ্যশাসনের দুর্বিনীত অহংকার দূর করার জন্যই আমি ভিক্ষা করি।’
আহা! আমি কান পেতে যতি ও নৃপতির বাক্যালাপ শুনছিলাম। সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যে দিনান্তের অস্তরাগ মিশে যাচ্ছিল।
রাজা বললেন, ‘কিন্তু রাজ্যশাসনেই তো রাজার অধিকার! রাজ্যভোগ রাজার নিকট স্বতই উপস্থিত হয়। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত সেই আরামের জীবন পরিত্যাগ করে এমন কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের জীবন আপনি বেছে নিলেন কেন?’
‘অরণ্যের তরুদল যতদিন আমাকে ফল, বল্কল প্রদান করে, পাহাড়ের ঝরনাধারা আর পর্বতপাদদেশের নদী যতদিন আমার স্নানপানের জল প্রদান করে, শ্যামলবর্ণা উর্বী যতদিন ভূতলে আমার জন্য কোমল লতাপাতার শয্যা রচনা করে, ততদিন আমার তাপসজীবনে প্রকৃতিদত্ত আরাম-উপকরণের অভাব হয় না। এমন সহজ আনন্দ যখন সর্বত্র সুলভ, তখন দুর্বিনীতের গর্ব সহ্য করে রাজদণ্ড ধারণ করার তাৎপর্য কী?
বিম্বিসার খানিক চিন্তা করে ধীরে ধীরে বললেন, ‘কিন্তু এই জীবনদর্শন কতই না বিপজ্জনক, শ্রমণ! আজ যদি পৃথিবীর নৃপতিবর্গ আপনার এই ভাবনায় প্রাণিত হয়ে রাজ্য পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন, তবে যে ভূমণ্ডলে অরাজকতার সৃষ্টি হবে!’
‘সকলে এককালে একত্রে এই ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হবে না, রাজা। আপনি সকলের কথা কেন বলছেন? সকল রাজার কথা চিন্তা করে কি আপনি সিংহাসনে আসীন হয়েছেন?’
রাজা সরাসরি এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘সে-কথা থাক। আমার মনে হয়, এটুকুই সব নয়। কোনো মনোবেদনা কি আপনাকে পীড়িত করেছে, শ্রমণ? সেই মনোবেদনাই কি আপনার গৃহত্যাগ তথা রাজ্যত্যাগের কারণ? আপনি আমাকে সব কথা খুলে বলুন।’
সিদ্ধার্থ বললেন, ‘আমার বেদনা তুচ্ছ বৈষয়িক দুঃখ নয়। আমার বেদনা অস্তিত্বের দায়ভাগ।’
‘আপনার কথা সম্যক অনুধাবন করতে পারলাম না, শ্রমণ।’
‘আমাদের অস্তিত্বই বেদনাজর্জর। জন্ম দুঃখময়, জীবন দুঃখময়, যৌবন ক্ষণিকের, জরা অপেক্ষমাণ, মৃত্যু ধাবমান। অস্তিত্বই বেদনা। অস্তিত্বই দুঃখাবহ। আমি এই বেদনার উপশম অন্বেষণ করে ফিরছি।’
‘কিন্তু এই দুঃখের উচ্ছেদ কি সম্ভব? আপনি কোন দুরাশায় এই অনিবার্য বেদনার দায়ভার বহন করে বৃথাই সন্ন্যাসী হয়েছেন?’
‘বৃথা নয়। আমার সত্তার ভিতর এ সমস্যা সমাধানের পূর্বাভাষ আমি পেয়েছি। কিন্তু এখনও তাকে সম্যক উপলব্ধি করতে পারিনি। আর তাই আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছি। সন্ন্যাসীর জীবন সেই সমাধান অন্বেষণের সর্বথা অনুকূল।’
সিদ্ধার্থ যখন এই কথা বলছেন, তখনই আমি লক্ষ করলাম, মার তার সম্মোহন রাজা বিম্বিসারের উপর প্রয়োগ করল। মারের দ্বারা পরিচালিত হয়ে নৃপতি বিম্বিসার সহসা বলে উঠলেন, ‘আমি আপনার সমস্যা অবধারণ করতে পারছি না। আমি আপনার বন্ধুত্বের প্রত্যাশী। বন্ধু হিসাবেই আপনাকে আমি বলছি, আপনি কুশলী তার্কিক, রাজনীতি-অভিজ্ঞ ক্ষত্রিয় রাজপুরুষ। আমি বলি কী, আপনি আমার সঙ্গে যোগ দিন। আসুন, এই বিশাল মগধ সাম্রাজ্য আমরা উভয়ে পরিচালনা করি। যদি এতে আপনার রুচি না হয়, তবে আপনি আমার উপদেষ্টা হ’ন। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী আমি রাজ্যশাসন করি।’
বিম্বিসার এই কথা বলা মাত্রই মার সিদ্ধার্থের কর্ণে পরামর্শ দিতে লাগল, ‘সিদ্ধার্থ! এর থেকে বড়ো সুযোগ আর উপস্থিত হবে না। তুমি এখনই স্বীকৃত হও। বিম্বিসারের সঙ্গে একত্রে এই বিরাট সাম্রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করো। অথবা বিম্বিসারের প্রধান উপদেষ্টারূপে সমৃদ্ধি, খ্যাতি, যশ, বিত্ত প্রভূত পরিমাণে উপভোগ করো। বৃথা তপস্যায় দেহক্ষয় কোরো না।’
সিদ্ধার্থ কিন্তু স্মিত হাস্যে অবিচলিত কণ্ঠে বললেন, ‘যে নিষ্ঠীবন আমি একবার পরিত্যাগ করেছি, তা কি পুনরায় গ্রহণ রুচিকর? জালে আবদ্ধ পাখি, একবার মুক্তি পেলে সে কি আর জালের ভিতর ফিরে যেতে কাঙ্ক্ষা করে? সাপের মুখ থেকে যে শশক একবার রক্ষিত হয়েছে, সে কি পুনরায় ভুক্ত হবার জন্য সমুখে ফিরে যেতে চায়? মশালের আগুনে যার হাত একবার পুড়েছে, মাটিতে ফেলে দেবার পরেও সে কি সেই মশাল হাতে তুলে নিতে চাইবে? আমি পার্থিব রাজ্যসম্পদ পরিত্যাগ করেছি, পুনরায় তা গ্রহণ করার ইচ্ছা করি না।’
এই কথা বলতে বলতে সিদ্ধার্থ প্রস্তরখণ্ডের উপর হতে অবতরণ করতে লাগলেন। নৃপতি বিম্বিসারের সমীপস্থ হয়ে সিদ্ধার্থ মৃদুল অথচ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘হে রাজন! এই মগধ সাম্রাজ্যের থেকেও বিশালতর, সমগ্র জম্বুদ্বীপ কিংবা নিখিল ভূমণ্ডল অপেক্ষাও বিপুলতর এক সাম্রাজ্য আছে। আমি সেই সাম্রাজ্য কামনা করি। আমার ‘আমিই’ সেই অতুল সাম্রাজ্য। এই ‘আমি’ রূপ সাম্রাজ্য যদি আমি জয় করতে পারি, তবে এক লহমায় এই ত্রিভুবন আমার পদতলে বশীভূত হবে। আর তার জন্য যুদ্ধজয় বা রক্তপাতের কোনো প্রয়োজন হবে না। অসঙ্গ, অভয় ও মহাকরুণার মন্ত্রে এই সমুদ্রমেখলা পৃথিবী হবে আমার ভুবন, আমার দিক্চিহ্নহীন সাম্রাজ্য…’
সিদ্ধার্থের কণ্ঠস্বরে কী এক বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয় সন্ধ্যার বাতাসে বিম্বিসারের নিকট ভেসে এল। তিনি আবিষ্ট, অভিভূত হয়ে সিদ্ধার্থের চরণপ্রান্তে আনত হয়ে বললেন, ‘সেইদিন তবে আপনি আমাকে প্রেমের মন্ত্রে বশীভূত করবেন।’
গিরিশিখরে অন্ধকার নেমে এল। সেই অবগুণ্ঠিত তমসার ভিতর আমি ধরিত্রীর ধূসরতরা রাজগৃহ নগরী—বহু চেষ্টা করেও আর কিছুই প্রত্যক্ষ করতে পারলাম না।