৫. মার-সিদ্ধার্থ-সংবাদ
‘সিদ্ধার্থ, দাঁড়াও, কথা আছে।’
‘কী কথা তোমার সঙ্গে থাকতে পারে, হে মার? তুমি কেবলই পশ্চাদ্দিক হতে আমাকে ডেকে চলেছ। তোমার কথার মূল বিষয় আমি তো বুঝতে পেরেছি। তুমি চাও, আমি আমার পুরোনো জীবনে ফিরে যাই। তুমি চাও, আমি আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে যেন উপনীত না হই। এইতো?’
‘এই দ্যাখো, তুমি কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়ছ। তুমি ভিক্ষু। উত্তেজনা তোমার শোভা পায় না।’
‘তোমাকে পরিহার করলেই আমি শান্তি পাব। ভিক্ষুজনোচিত শান্তি।’
‘তুমি কেন বুঝতে পারছ না, সিদ্ধার্থ, আমি তোমার বন্ধু। তোমার একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধু। বলো, আমার মতো তোমাকে আর কেউ ভালোবাসে? আমি যে তোমাকে জন্মজন্মান্তর অনুসরণ করে চলেছি। প্রাণের বন্ধু ব্যতীত আর কেউ তা কি করে?’
‘তুমি আমার বন্ধু নও। আমার বন্ধু আমার বিবেক। আর সেইসব মনীষীরা যাঁরা আমার পূর্বে তত্ত্বের অন্বেষণ করেছেন, তাঁরাই আমার সন্মিত্র।’
‘তাই? তা তোমার এই সন্মিত্রদের—এইসব মনীষীদের সংসর্গে এযাবৎকাল পর্যন্ত তুমি কোন জ্ঞান আহরণ করতে পারলে?’
‘হাঁ, আমার সমস্যার সমাধান আজও অবধি কেউ দিতে পারেননি, তা সত্য। তবু তাঁদের জীবনপ্রণালী থেকে আমি বহু সদ্গুণরাশি আহরণ করেছি।’
হাঃ! তপস্বীসুলভ গুণরাশি! এর থেকে তুমি যদি রাজা হতে, বহু রাজপ্রতিনিধিদের নিকট হতে রাজনীতি শিক্ষা করতে, তবে তোমার জীবন অনেক বেশি উজ্জ্বল হত। অনেক মহত্ত্বপূর্ণ হত। এইসব তপোবনবাসী ভিক্ষাজীবীর দল তোমাকে কী শেখাবে? আমার তো মনে হয়, তোমার এই আশ্রমে আশ্রমে ঘুরে মরাই সার হচ্ছে।’
‘না।’
‘না?’
‘না। সত্যের জন্যে মানুষ নিজেকে কীভাবে বিপন্ন করেছে, কতদূর অগ্রসর হয়েছে, কোথায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থেমে গেছে, তা আমার জানা দরকার ছিল।’
‘বেশ। কিন্তু এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে, তুমিও এদের মতোই বিপন্ন হবে, তা সত্ত্বেও অগ্রসর হবে, এবং তুমিও একদিন থেমে যাবে বাধার পাহাড়ে প্রতিহত হয়ে?’
আমি তা মনে করি না। কেন এঁরা থেমে গেছেন, আমি তা সম্যক পর্যালোচনা করেছি। এঁদের উদ্দেশ্য আমার উদ্দেশ্য ছিল না। এঁরা তত্ত্বের অনুসন্ধান করেছেন। আমি সত্যের অনুসন্ধান করছি।’
‘এ তোমার অহংকার, সিদ্ধার্থ! তুমি, একমাত্র তুমি, সারা পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই সফলকাম হতে পারবে—এ তোমার দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। আমার কথা শুনবে, সিদ্ধার্থ?’
‘বলো, শুনছি।’
দ্যাখো, রাজ্য তো তোমার গেছেই। সেখানে ফিরে গিয়ে আবার লোক হাসাতে চাও না, সে আমি বুঝি। কিন্তু বলছিলাম, এখন যখন তুমি তোমার আচার্যদের প্রিয়পাত্র হয়েছ, তাঁরাও তোমাকে তাঁদেরই সঙ্গে অধ্যাপনা করবার প্রস্তাব দিয়েছেন, তখন সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া যুক্তিযুক্ত হয় না। তুমি এই উদরক রামপুত্রের আশ্রমে অধ্যাপক হিসাবে আত্মনিয়োগ করো। সম্মান পাবে, নিরাপত্তা পাবে, স্থিতিসুখ পাবে।’
আর এইভাবে আমি হয়ে উঠব আর-একজন অজিত কেশকম্বলী কিংবা পাকুধ কাচ্চায়নের মতো ভ্ৰান্তিবাদী?’
‘তাঁরা যে ভ্রান্তিবাদী, তুমি কীভাবে জানলে?’
‘তাঁদের শিক্ষা আমার অস্তিত্বের অনুমোদন পায়নি।’
‘সে কেমন? কেন, অজিত কেশকম্বলী তোমাকে কী বলেছিলেন?’
‘তিনি বললেন, যতদূর সম্ভব সুখে কালাতিপাত করো। মৃত্যুতে সব শেষ হয়ে যাবে। দেহপাতের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ অংশগুলি জগতের ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ ভাগে বিলীন হয়ে যাবে। মৃত্যুর পর আর কিছুই থাকবে না। অতএব, এই জীবনটা যেভাবে পারো, উপভোগ করে নাও।’
‘এ মত তোমার রুচিকর বোধ হল না?’
‘না, হল না। কারণ, এ যদি সত্য হয়, তবে তো কর্মের কোনো তাৎপর্য থাকবে না। ভয়াবহ পাপ করলেও ভয় নেই, মৃত্যুর পর কিছুই আমাকে অনুসরণ করবে না। দান, তপঃ, শৌচ, ধ্যানেরও কোনো অর্থ থাকে না। মৃত্যুতেই চরম বিনাশ হয়ে যায়।’
‘যদি এরকমটাই সত্য হয়?’
‘হে মার, মানুষের মনে স্বজ্ঞা বলে একটি ব্যাপার আছে। আমার সেই স্বজ্ঞা আমাকে এ মত গ্রহণ করতে বাধা দিচ্ছে। এমন চরম তাৎপর্যহীন তত্ত্ব আমার নিতান্তই লঘুচিন্তা বলে মনে হয়েছে।’
‘বেশ। পাকুধ কাচ্ছায়নের মত তো গ্রহণ করতে পারতে?’
‘না, তিনি আবার শাশ্বতবাদী। তিনি বললেন, জড়পদার্থ, সুখ, দুঃখ ও আত্মা এগুলি শাশ্বত পদার্থ। এরা পরস্পরের মধ্যে ক্রিয়াবিক্রিয়াও করে না। অনন্তকাল এরা একইরকম রয়েছে।’
‘এ মতেই বা সমস্যা কী?’
‘সমস্যা এই, প্রথমত, এই পদার্থগুলি বিকারশীল। দ্বিতীয়ত, তারা অবশ্যই পরস্পর-বিক্রিয়। কাজেই অনন্তকাল এরা একইভাবে রয়েছে, এ কথা ধরে নেওয়ার পশ্চাতে যুক্তি কী?’
‘কেউই যখন তোমাকে পথ দেখাতে পারলেন না, তখন তোমার আর কী করার থাকতে পারে? ফিরে চলো।’
‘হে মার! আমি বুঝলাম, আমাকে উত্তম গুরুর নিকট ধ্যান শিক্ষা করতে হবে।’
‘সেইজন্যেই প্রথমে অরাঢ় কালাম, পরে এই উদরক রামপুত্রের আশ্রমে আগমন?’
‘হাঁ। সেই উদ্দেশ্যেই আসা। এঁরা ধ্যাননিপুন। আমি বহু যত্নে এঁদের কাছে ধ্যানশিক্ষা করেছি।’
‘ভাল তো। তাহলে যা চাইছিলে তা তো পেলে।’
‘পেলাম না। অরাঢ় কালাম আমাকে ধ্যানের উচ্চস্তরে মনোনিবেশ করতে শিক্ষা দিলেন। তাঁর শিক্ষায় কিছুদিনের মধ্যে আমি অকিঞ্চনায়তনে প্রবেশ করতে পারলাম। সে এক শূন্যতার ধ্যান। মন গভীর শান্তিতে ডুবে গেল। কিন্তু—’
‘কিন্তু?’
‘কিন্তু সেই ধ্যানাবস্থা থেকে মন যখন স্বাভাবিক দশায় ফিরে এল, সেই এক দুঃখময় জগৎ, ব্যাধি-জরা-মৃত্যুর সেই এক ক্লান্তিকর আলোড়ন। আমি ধ্যানশিক্ষা করলাম ঠিকই, কিন্তু তাতে আমার মৌল প্রশ্নের কোনও মীমাংসা তো হল না। দুঃখের অন্ত কোথায়? নির্বাণ কোন পন্থায়?’
‘আর তাই তুমি উদরক রামপুত্রের আশ্রমে এলে? কিন্তু তিনি কি এর থেকে বেশি কিছু দিতে পারলেন?’
‘হাঁ, পারলেন। তিনি আরও উচ্চতর ধ্যানাবস্থায় আমাকে নিয়ে গেলেন। সে অবস্থায় কোনো অনুভব নেই, আবার অনুভবের অভাবও নেই। সে এক অব্যক্ত অবস্থা। কিন্তু সেখানেও সেই একই সমস্যা। ধ্যানে মহাশান্তি পেলাম, কিন্তু ধ্যানচ্ছেদে পুনরপি এই দুঃখময় জগৎ ও বেদনাময় অস্তিত্বের জাগরণ। এই শিক্ষাতেও আমার সমস্যার কোনো সমাধান হল না।’
‘সে-কথা কি তুমি অরাঢ় বা রামপুত্রকে বলেছিলে?’
‘বলেছিলাম। কিন্তু তাঁরা বললেন, এর উপরে আর কী আছে, তাঁরা জানেন না। তাঁরা আরও বললেন, আমি বর্তমানে তাঁদের সমতুল সিদ্ধিতে উপনীত হয়েছি।’
‘এ-কথা শুনে তোমার নিশ্চয় খুবই তৃপ্তি হল?’
‘না, হল না। কারণ, আমি তো আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। নিখিল জীবজগৎ বেদনায় আর্তনাদ করে চলেছে। আমি তাদের জন্য কোনো পথ আবিষ্কার করতে পারিনি, হে মার!’
‘অরাঢ় এবং রামপুত্র তাঁদের স্ব স্ব আশ্রমে তোমাকে অন্য শিষ্যদিগকে এই যোগশিক্ষা দিতে বলেছিলেন। তুমি তাতে সম্মত হলে না কেন?’
‘তাতে যে আমি লক্ষ্যভ্রষ্ট হব।’
‘তোমার লক্ষ্যটা কী, একটু স্পষ্ট করে বলবে, সিদ্ধার্থ?’
আমার লক্ষ্য নিখিল জীবের জীবনব্যাপী দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি অনুসন্ধান করা। এমন একটি মার্গ খুঁজে বের করা, যে-পথে বেদনার্ত মানুষ তার সকল দুঃখের পরিসমাপ্তি খুঁজে পাবে।’
‘এখন কী করবে ভাবছ?’
‘কী করব, সে কথাই ভাবছি। পথ দেখতে পাচ্ছি না। আজই এখান থেকে চলে যাব। কোন পথে যাব, পথই সেকথা বলবে। যদি হাঁটতে হাঁটতে দেখতে না পাই পথের শেষ, তাহলে পথের উপরেই লুটিয়ে পড়ে শেষ হব। তবু আমি আমার পিতার রাজ্যে ফিরব না।’
তুমি নিজের সর্বনাশ করবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছ, দেখছি। এখনও বলছি, আমার কথা শোনো। কপিলাবস্তু ফিরে চলো, কুমার!
চুপ, চুপ! আমাকে ‘কুমার’ বলে ডেকো না। যাও, যাও, আমার কাছ থেকে সরে যাও। আমার সঙ্গে এসো না তুমি আর। আমাকে অনুসরণ করা বন্ধ করো।’
‘তা কি হয়, সিদ্ধার্থ? আমি যে তোমার সত্তাকে সর্পিণীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে আছি। আমি যে তোমার সঙ্গেই চলেছি। আমি যে মার—তোমার চিরসুহৃদ! জন্মজন্মান্তর।’