১২. কতো কথা সুজাতার…

১২. কতো কথা সুজাতার…

নারীর মন বুঝা বড়ো দায়। দেবতারাই বুঝিতে পারেন না, তো ছার মানুষের আর কথা কী! পুরুষের কথা ছাড়িয়া দিলাম। এক নারীই কি আর অন্য নারীর মন বুঝিতে পারে? তথাপি, যে যার নিজের মন বুঝিতে তো আর অসুবিধা হইবার কথা নহে, নাকি? আজ মনে হয় তাহাও কঠিন, বেশ দুরূহ ব্যাপার। ছোটোবেলায় পুতুল খেলিতাম। বর পুতুলের সহিত বউ পুতুলের বিবাহ দিতাম! মনের ভিতর ওই স্বপ্ন লইয়াই জন্মাইয়াছিলাম বুঝি বা! এখন মনে হয়, ইহাপেক্ষা যদি শৈশবে যুদ্ধযুদ্ধ খেলিতাম, তো ভালো হইত। জীবনটা অন্যরকম হইত। নারী কি আর যুদ্ধ করিতে পারে না? হয়তো নারী-সেনা হইতাম। কিংবা অন্য কিছু। কিন্তু জন্ম হইতেই এ যে কী বিষম দায় লইয়া জন্মাইয়াছি; অন্যরকম হইতেই পারি না।

কিছুদিন কাটিল, কর্তার বিষণ্ণ ভাব কাটিয়াছে। আমার উপর দিয়া সে গেল যা! মানুষটা খায় না, দায় না, দিন দিন শুকাইয়া যাইতেছে। অথচ প্রথম পরিচয়ে আমার স্বামীকে কত প্রাণবন্ত দেখিয়াছিলাম। সেই সে বহুদিন আগের কথা। নদীতীরে প্রথম গোপনে দেখা হইয়াছিল। প্রথম আলাপ, কত লুকালুকি, কত আধেক চোখের চাহনি, কত অস্ফুট উচ্চারণ, কত আচম্বিত স্পর্শ, শিহরন— আহা সে কী দিনই না ছিল!

পিতা গ্রামমুখ্য ছিলেন, কাজেই এ গোপীনাথপুর গাঁয়ে আমি মুক্ত বিহঙ্গমার ন্যায় বাড়িয়া উঠিয়াছিলাম। বয়স বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বালিকাদের যে সব ধরাকড়ার ভিতর রাখা হয়, আমার বেলায় সেসব কিছুই হয় নাই। প্রভাতের আলোর ন্যায়, শরতের লঘু উদাস মেঘের ন্যায়, নৈরঞ্জনার মুক্তধারার ন্যায় আমার জীবন মুক্তানন্দে বিভোর ছিল।

বয়স তখন ষোলো অতিক্রম করিয়া সতেরো হইয়াছে, একদিন বৈকালবেলায় নদীর ঘাটে জল আনিতে গিয়াছি। জল নেওয়া হইল না। বৃক্ষের অন্তরাল হইতে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখিলাম। ঘাটের রানার উপর এক অতিশয় সুন্দর গৌরকান্ত তরুণ, পরনে একখানি শ্বেত বস্ত্র, গাত্রে বাসন্তী রঙের একখানি উত্তরীয়, কাঁধের উপর কাঁদি কাঁদি কৃষ্ণ চাঁচর কেশ আসিয়া পড়িয়াছে, পদ্মের ন্যায় মুখমণ্ডলে শিশিরবিন্দুর ন্যায় স্বেদবিন্দু কাঁপিতেছে, অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উন্মাদের ন্যায় আপনমনে কী বিড়বিড় বকিতেছে আর অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাইতেছে।

সে যে পাগল নয়, কিন্তু কী এক ভাবের ঘোরে আছে, তাহা বুঝিতে আমার অসুবিধা হয় নাই। কিন্তু তাহার চালচলনে কৌতুককর এমন উপাদান পাইয়াছিলাম, না হাসিয়া পারি নাই। সে হাস্য নীরব মুচকি হাসি ছিল না, সূর্যের আলোর নিম্নে কেতকী পুষ্পের উল্লাসের ন্যায় সে হাসি ফাটিয়া পড়িয়াছিল। আমার সেই উচ্চ হাস্যের শব্দে তরুণটি ঘাড় ঘুরাইয়া দেখিয়াছিল। অহো! সে-দৃষ্টি আমি আজও ভুলিতে পারি নাই। এক মুহূর্তে দৃষ্টিবাণ দিয়া সে যেন আমার হৃদয়কে কিশোরী মৃগীর ন্যায় বিদ্ধ করিয়া লইল।

তাহার পর ঘরে ফিরিয়া আসিয়া ঘন ঘন সেই মুখ মনে পড়ে, ভ্রমরকৃষ্ণ চক্ষের সে সজল দিঠি মনে পড়ে, কাজে আর মন লাগেই না। স্বপ্নের ভিতর সেই মুখ ভাসিয়া উঠে… জাগরণেও অন্যমনস্ক হইয়া থাকি, এক কাজ করিতে গিয়া অন্য কাজ করিয়া বসি। আমার এ উন্মনা ভাব মায়ের চোখে পড়িল। কিন্তু বহু প্রশ্ন করার পরেও যখন আমার নিকট হইতে কোনো উত্তর পাইলেন না, তখন সাতিশয় বিরক্ত হইয়া চুপ করিয়া গেলেন।

কাহাকেও মুখ ফুটিয়া বলিতে পারি না। নিজেও কথাটা বিশ্বাস করিতে পারি না। সত্যই কি…? সত্যই কি আমি প্রেমে পড়িয়াছি? তাহা না হইলে এইরূপে হৃদয় কাঁপিতেছে কেন? কথা নাই, বার্তা নাই, সহসা লজ্জা আসিয়া বুক জুড়িয়া বসবাস করিতে শুরু করিল কেন? কর্ণমূল রাঙা হইয়া কাঁপিতেছে কেন? কেন মুখ সহসা স্বেদাক্ত হইয়া উঠিতেছে? কী হইবে? কেহ যদি জানিতে পারে?

কেহ জানুক, আর না জানুক, তিনি জানিতে পারিলেন। বৈকাল বেলায় মন উচাটন হইত, জল আনিবার ছলে ঘাটে যাইতাম। কোনো না কোনো উপলক্ষ্যে তাঁহার সহিত দেখা হইয়া যাইত।

ক্রমে ক্রমে তাঁহাকে জানিতে পারিলাম। তিনি কহিলেন, তিনি কবি। আমি দেখিলাম, রূপমুগ্ধ। তিনি কহিলেন, তিনি স্বয়ম্ভর। আমি বুঝিলাম, তিনি স্নেহের কাঙাল। তিনি কহিলেন, তিনি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। আমি জানিলাম, প্রগল্ভ। এমনই করিয়া তিনি এক বলিলেন, আমি আর-এক বুঝিলাম। এই ভিন্ন প্রকারের বুঝাবুঝি করিতে করিতেই আমি কখন যেন তাঁহাকে হৃদয় এমনভাবে দিয়া ফেলিলাম যে, আর ফিরাইয়া লওয়া চলে না। আমি আমার হস্তের অঙ্গুলির অগ্রভাগে পুষ্পরাগ মাখিতাম, আমার অঙ্গুলিগুলি আচম্বিতে ছুঁইয়া দেওয়া তাঁহার প্রিয় খেলা ছিল। বুঝিতেন না, তাঁহার স্পর্শে স্পর্শে আমি কেমন করিয়া শিহরিয়া উঠি।

সেই শিহরন পূর্ণতর হইল, যখন পিতা আমার হস্ত তাঁহার হস্তে অর্পণ করিলেন। তাঁহাকে জামাতারূপে পাইয়া আমার জনকজননী বড়ো আহ্লাদিত হইয়াছিলেন। কিন্তু আমার যাহা হইয়াছিল, তাহা কি ভাষায় প্রকাশ করা চলে? তাহা নারীর গোপন সুখ, উহা সে কাহারও সহিত ভাগ করিয়া লইতে পারে না, স্বামীর সহিতও নহে।

পিতৃগৃহে আমার সকল আদেশ পালন করিবার জন্য এক বালকভৃত্য ছিল। তাহার নাম স্বস্তি। পাড়াগাঁর লোক ভাঙিয়া বলিত ‘সোয়াস্তি’। সেই সোয়াস্তি বিবাহের পর আমার সহিত আমার শ্বশুরালয়ে চলিল। সে বড়ো চঞ্চল বালক, কিন্তু তাহার একমাত্র সুখ ছিল, আমার হুকুম তামিল করা। এক্ষণে আমার বিবাহ হইয়াছে। ভাবিয়াছিল, তাহাকে ভুলিয়া, তাহাকে ফেলিয়া শ্বশুরগৃহে যাইব। তাই কয়দিন তাহার বড়ো অভিমান হইয়াছিল। কিন্তু সে যখন শুনিল, সে-ও আমার সহিত আমার পতিগৃহে যাইবে, তখন তাহার আর আনন্দের সীমা নাই। মাথায় একটা পাগড়ি বাঁধিয়া পালকির আগে আগে নৃত্য করিতে করিতে চলিল।

আর শ্বশুরগৃহই ছিল কতদূরে বা? গ্রামের এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত। আমার স্বামী শৈশবেই মাতৃহীন ছিলেন। তাঁহাদের গৃহে তিনি এবং তাঁহার পিতা ব্যতিরেকে তৃতীয় কেউ ছিল না।

গৃহ পরিষ্কার করিয়া উত্তমরূপে সাজাইয়া লইতে আমার অধিক বিলম্ব হইল না। কয়দিনের মধ্যেই হইল। সোয়াস্তি আমার সহিত অবিরত পরিশ্রম করিয়াছিল। পাকশালা, শয়নকক্ষ, আমার শ্বশুরের কক্ষ, আমার স্বামীর কাব্যরচনার সামগ্রী, গোশালা, দুয়ার, উঠান, অঙ্গন সকলই ঝকঝক করিতে লাগিল। এই সংস্কারসাধন প্রক্রিয়ায় আমার স্বামী সৌদাসও আমাদের প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা করিয়াছিলেন।

আমি সকলকে লইয়া থাকিতে বড়ো ভালোবাসি। পিতৃগৃহ বহু আত্মীয়স্বজনে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এ শ্বশুরালয় বড়ো নির্জন। সেই নির্জনতা আমার ও আমার স্বামীর বিবাহোত্তর প্রণয়ের উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করিয়াছিল বটে, নিভৃত মন্দিরে আমরা আমাদের হৃদয়বিনিময়ের অনেক খেলা খেলিয়াছিলাম। কত বরিষনমন্ত্রিত নিশীথরাত্রি, কত শীতনিবিড় ঘনিষ্ঠতা, কত বসন্তদিনের উচ্ছলতায় আমার প্রাণ ভরিয়া উঠিতেছিল। তথাপি, এ জনবিরল গৃহ মধ্যে মধ্যে আমার মনকে চাপিয়া ধরিত। সে নৈঃশব্দ্যের গাঢ় আলিঙ্গন হইতে আমি নিষ্কৃতি খুঁজিতাম, নানা কাজের ভিতর অবসর যাপনের উপায় আবিষ্কার করিতাম, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও আমার হৃদয় কখনো কখনো বড়ো শূন্য ঠেকিত

বিশেষত, যখন আমার স্বামী তাঁহার পুথির ভিতর মুখ ডুবাইয়া রাখিতেন, শ্বশুর গ্রামবৃদ্ধদের সভায় চলিয়া যাইতেন, সোয়াস্তি অন্যান্য গ্রাম্য বালকদের সহিত খেলা করিবার নিমিত্ত কোথায় যেন বাহির হইয়া যাইত, রৌদ্র ঝাঁ-ঝাঁ করিতেছে, শূন্যাকাশে একটা গগনবিহারী চিল অনেক উপরে উঠিয়া দূরাগত স্বরে টানিয়া টানিয়া ডাকিতেছে, তখন আমার মন কেমন জানি করিত, যেন এক অর্থহীন অবসাদ হৃদয়ের উপর নামিয়া আসিত।

আষাঢ় মাসে নৈরঞ্জনাতীরে গ্রামের উপকণ্ঠে মেলা বসিত, আমি অন্যান্য গ্রামনারীদের সহিত সেই মেলায় গিয়াছিলাম। কুমারেরা মাটির তৈয়ারি অলংকার লইয়া আসিয়াছিল, তাহারই দুই-একটা পছন্দ করিয়া কিনিলাম। এক বিপণিতে লাক্ষারস বিক্রয় হইতেছিল, তাহাও অলক্তরাগ হিসাবে ব্যবহার করিব ভাবিয়া ক্রয় করিলাম। সোয়াস্তি পাতার বাঁশি কিনিয়া বাজাইতে বাজাইতে কর্ণপটহ প্ৰায় ভেদ করিয়া দিল। তাহার পর গীতবাদ্যের এক সভা হইতেছে দেখিয়া, সেস্থলে উঁকি মারিয়া দেখি, আমার স্বামী তাহারই মধ্যে তাঁহার স্বরচিত পদ সুর করিয়া গাহিতেছেন। ইনি যে এস্থলে আসিবেন, আমাকে বলেন নাই তো! পরনে পট্টবস্ত্র, গলদেশে বাসন্তী উত্তরীয়ের উপর গুঞ্জাফুলের মালা, কাঁধের উপর আসিয়া পড়িয়াছে কুণ্ডলিত কেশদাম—বাহ্ বেশ মানাইয়াছে!

কিছুক্ষণ পর সে গীতসভা হইতে তিনি বাহির হইয়া আসিয়া আমাকে দেখিয়া তো একেবারে অবাক! গান শুনিতে গিয়া সঙ্গিনীদের হইতে পিছনে পড়িয়াছি, উহারা সোয়াস্তিকে লইয়া অগ্রসর হইয়া গিয়াছে। আমাদের সমকালে স্বামীর সহিত প্রকাশ্যে কোথাও বেড়াইতে যাওয়া দৃষ্টিকটু ছিল। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা করিতেছিল, স্বামীর হাত ধরিয়া মেলা হইতে ফিরিয়া আসি।

হয়তো আমার মনের কথা দেবেন্দ্র শুনিতে পাইয়াছিলেন, অন্তর্যামী বিধাতা ফিরিবার পথে ঝড় দিলেন। মেলায় প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবাত উঠিয়াছে। ধুলায় পথ দেখা যায় না। আমি আমার স্বামীর হাত ধরিয়াই ফিরিতেছিলাম। কখন যেন টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হইল। মেলার বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, এক বটবৃক্ষতলে এক নিতান্ত শিশু বালিকা হাপুস নয়নে কাঁদিতেছে।

মেয়েটি কে, কোথা হইতে আসিল, কিছুই খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলাম না। সেই বালিকাও কোনো কথা ভালো করিয়া বুঝাইতে পারে না। অবশেষে তাহাকে লইয়া আমরা গৃহে ফিরিয়া আসিলাম। তাহাকে প্রশ্ন করিয়া জানিলাম, তাহার নাম পুন্না।

আমার স্বামী মেয়েটির সম্পর্কে অনেক খোঁজখবর লইয়াছিলেন। কিন্তু কিছুই জানিতে পারিলেন না। সেই হইতে সেই মেয়ে আমাদের গৃহেই রহিয়া গেল। তাহাকে আমি আমার কন্যাসম প্রতিপালন করিতে লাগিলাম। তাহাকে নাওয়ানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, মন ভুলানো এইসব করিয়াই আমার দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল।

মনে বড়ো অভিমান হইয়াছিল, সে কেন আমাকে ‘মা’ বলে না। শরতের হিমে ভিজিয়া জ্বর বাঁধাইয়া বসিল। জ্বর বেশ হইয়াছে, গ্রামের কবিরাজ ঔষধ দিয়া গিয়াছেন, উহা খল নুড়িতে বাটিয়া খাওয়াইতে হয়। তথাপি, জুর কমিতেছে না। এক রাত্রে তাহারই শিয়রে বসিয়া কপালে আর্দ্র বস্ত্র স্থাপন করিয়া জ্বরোপশমের চেষ্টা করিতেছি, একবার তাহার ওষ্ঠাধর কাঁপিয়া উঠিল। কী যেন সে বিড়বিড় করিয়া বলিতেছে। তাহার মুখের অত্যন্ত নিকটে কান পাতিয়া শুনিলাম, বলিতেছে, ‘মা… মা!’

তখনই তাহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া তাহার শরীরের সমস্ত তাপ নিজ শরীরে টানিয়া লইতে চাহিলাম। শিয়রের নিকট ঘৃতপ্রদীপটি ক্ষীণ শিখায় জ্বলিতেছে।

কয়দিনের শুশ্রূষায় পুন্না নিরাময় হইয়া গেল। এই ক-দিন দুয়ারপ্রান্তে সোয়াস্তি বসিয়া রহিত। কখন কী প্রয়োজন পড়ে। এই দুই বালক-বালিকার ভিতর হৃদয়ের একখানি আন্তরিক যোগাযোগ ও প্রীতিপূর্ণ সৌহার্দ্য আমি বিলক্ষণ লক্ষ করিয়াছি।

এইভাবেই দিন চলিয়া যাইতেছিল। আমার শ্বশুর নানা কর্মে বাহিরে ব্যস্ত থাকেন, আমার স্বামী কাব্যরচনায় নিবিষ্ট, সোয়াস্তি গোশালার গোরুগুলি লইয়া নৈরঞ্জনাতীরে চরাইতে যায়, আমি আমার পালিত কন্যা পুন্নাকে ল‍ইয়া গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকি। এতদিনে পুন্না আমাকে ‘মা’ বলিয়া ডাকিতে শিখিয়াছে।

তাহার অর্থ এই নহে যে, আমার ও আমার স্বামীর নিজস্ব সময় ছিল না। তিনি তাঁহার ভাবে বিভোর থাকিতেন বটে, কিন্তু আমাকে দিবার মতন সময় তাঁহার যথেষ্টই ছিল। সে আমাদের একান্ত অবসর। সেসব স্বকীয় প্রহরে আমরা উভয়ে উভয়কে পূর্ণরূপে পাইতাম; যুগ্মজীবনে কোনো অপূর্ণতা ছিল না।

তবে কথা হইল এই, গ্রামে সকলকে লইয়া সকলেই আলোচনা করিতে থাকে। আমরাও সেসব আলোচনার বাহিরে ছিলাম না। কয়েক বৎসর বিবাহ হইয়াছে, তথাপি কেন আমি সন্তানবতী হই নাই, তাহা লইয়া রসালো আলোচনা চলিত। এসকল কথা কিছু কিছু নদীর ঘাটে আমার কর্ণে পশিয়াছিল, কিন্তু আমি গ্রাহ্যের মধ্যে আনি নাই। আমার স্বামী এসকল তখনই শুনিয়াছিলেন কিনা, বা তাহাতে তাঁহার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হইয়াছিল কিনা, তাহা আমি বলিতে পারি না।

একদিন প্রভাতবেলায় আমাদের গৃহপ্রাঙ্গণের প্রান্তদেশে এক তরুণ তাপসকে দেখিলাম। মনে হইল, তাপস নদীর পরপার হইতে ভিক্ষার্থে আসিয়াছিলেন। তাঁহার সৌম্যমূর্তি যে-কোনো মানবের হৃদয়েই শান্তির উদ্রেক করে। আমার স্বামী মুগ্ধ হইয়া তাঁহার নিকটে গেলেন ও ভিক্ষা দিলেন। রন্ধনশালা হইতে দেখিলাম, আমার স্বামী তরুণ ভিক্ষুকে কী যেন বলিতেছেন। সেই তরুণ তপস্বীও আমার স্বামীর প্রার্থনায় সম্মতি দিলেন, মনে হইল।

সেই দিন হইতেই আমার স্বামী যেন কেমন পরিবর্তিত হইয়া গেলেন। আহার- বিহারে মন নাই। কাব্যচর্চায় উৎসাহ নাই। আমার সহিত ভালো করিয়া একটা কথাও বলেন না। সমস্ত দিন নদীতীরে বসিয়া পরপারের দিকে তাকাইয়া থাকেন। তাঁহাকে যেন আমার নিতান্ত অপরিচিত মনে হইতে লাগিল। তিনি এক অন্য জগতের মানুষ হইয়াছেন। কোনোমতে শিশুর ন্যায় তাঁহাকে নাওয়াইতাম, খাওয়াইতাম। কথা বলিবার চেষ্টা করিতাম। দুই-একটার বেশি কথার জবাব পাইতাম না।

বড়ো ভয় হইল। একেই দেশে-গ্রামে কথা উঠিতেছে, তাহার উপর ইনি যেন সংসারের বাহির হইয়া গেলেন। কোনোমতেই তাঁহার মন ফিরাইতে পারিতেছিলাম না। রাত্রে শয্যায় শুইয়া কাঁদিতাম, চোখের জলে বক্ষের বসন ভিজিয়া যাইত। সমস্ত প্রেম কি চলিয়া গেল? কিছুই রহিল না? কী যে হইল! সেই সন্ন্যাসীর ভাব কি আমার স্বামীর ভিতর ঢুকিল? ইনিও কি গৃহসংসার পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইবেন? ভয়ে ত্রাসে আমার বুক কাঁপিত।

আমি প্রতিবেশীদের পরামর্শে এক মানসিক করিলাম। নদীর পরপারে উরাইল বনের বহির্দেশে এক বনস্পতি, এক অশ্বত্থবৃক্ষ আছে। আমরা গ্রামের লোকেরা ওই বৃক্ষকে দেবতা হিসাবে নমস্কার করিতাম। গ্রামের ঘাটে স্নান করিতে গিয়া কোনো কোনো কুয়াশামাখা সন্ধ্যায় সেই বৃক্ষের নিম্নে কাহাকে যেন অস্পষ্টভাবে দর্শন করিয়াছি। একটু পরেই মনে হইত, বৃক্ষনিম্ন হইতে কে যেন নিঃশব্দে সরিয়া গেল। বুঝিয়াছিলাম, উনিই বৃক্ষদেবতা। দুই কর জোড় করিয়া তাঁহার উদ্দেশে নমস্কার করিয়া প্রার্থনা করিয়াছিলাম, ‘হে বৃক্ষদেবতা! আমার সংসারে শান্তি ফিরাইয়া দাও। আমার স্বামী যেন সুস্থ হইয়া উঠেন। আর আমি যেন তাঁহার সন্তানের জননী হইতে পারি। তোমাকে আমাদের রাঙি গাইয়ের দুধের পায়েস রাঁধিয়া নিবেদন করিব। ‘

তাহার পর আবার সেই এক দিন। পুনরায় সেই তরুণ ভিক্ষু আমাদের গৃহের দ্বারপ্রান্তে আসিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আমার স্বামী অতি দ্রুত নিকটে গিয়া ভূমির উপর সাষ্টাঙ্গ প্রণাম নিবেদন করিলেন। আমিও সত্বর তাঁহাকে ভিক্ষা প্রদান করিলাম। স্বামীর সহিত তাঁহার কী যেন কথা হইল। তিনি চলিয়া গেলেন।

সেই পল হইতে স্বামী আবার স্বাভাবিক হইয়া আসিলেন। তিনি অনিয়মিত জীবন পরিত্যাগ করিলেন। আহারে বিহারে আবার মন ফিরিল। আমা হইতে তাঁহার মন যে এতদিন প্রত্যাহৃত হইয়া গিয়াছিল, তাহা এক্ষণে দ্বিগুণ বেগে আমার দিকেই ফিরিল। আমি সানন্দে আবিষ্কার করিলাম, তিনি আমারই আছেন, কোথাও চলিয়া যান নাই।

কয় মাস কাটিল। একদিন আমি অনুভব করিলাম, আমি অন্তবত্নী হইয়াছি। আমার সন্তান আসিয়াছে। অঙ্গলক্ষণ সকল ফুটিয়া বাহির হইল। গ্রামের লোকে এই কথা লইয়া পুনরায় হৃষ্টচিত্তে আলোচনা করিতে লাগিল। সকলেরই ধারণা হইল, ইহা নদীপারের বৃক্ষদেবতার আশীর্বাদ এবং মানসিকের ফল। আমাদের গোহালে রাঙি গাইটিও গর্ভবতী হইয়াছে।

নয় মাস পর আমার প্রসব হইল। একটি ক্ষুদ্র পুত্তলিকার ন্যায় পুত্রসন্তান। তফাত এই, এ পুত্তলিকা নড়েচড়ে, ক্ষুধা পাইলে কাঁদিয়া উঠে। সেই ক্ষুদ্র মানবকটির প্রতি আমার কী যে স্নেহের উদয় হইল! যেন মনপ্রাণ ভরিয়া গেল! পূর্ণ মাতৃত্বের অনুপম স্বাদ জীবনকে সার্থক করিয়া দিল।

কিছুদিন পর আমি সুস্থ হইলাম। মানসিকের কথা মনে পড়িল। রাঙি গাইটিরও বাছুর হইয়াছে। ঘরে দুধ অনেক। একদিন ভোরে উঠিয়া দুধ দুইয়া পায়সান্ন রাঁধিলাম। অন্ধকার থাকিতে থাকিতে পুন্না আর সোয়াস্তিকে লইয়া বাহির হইলাম শিশুপুত্রটিকে বুকে লইয়াছি। সে হাত দুইখানা মুঠা করিয়া রাঙা মুখখানা আমার বুকের ভিতর চাপিয়া ঘুমাইয়া রহিয়াছে।

খেয়াঘাটে নৌকা ছিল। সোয়াস্তি দাঁড় টানিয়া লইয়া চলিল। নৌকার গলুইয়ের কাছে আমি আর পুন্না বসিয়া আছি। দেখিতে দেখিতে নৌকা পরপারে লাগিল। সাবধানে নৌকা হইতে তীরে নামিলাম।

ধীরে ধীরে আমরা উরাইল বনের দিকে অগ্রসর হইলাম। সেই অশ্বত্থবৃক্ষের নিকটে আসিতে মনে হইল, বৃক্ষের নিম্নদেশ যেন আলো হইয়া আছে। প্রভাত তখন সবে ফুটিতেছিল। কুয়াশার ভিতর দেখিলাম, বৃক্ষতলে কে এক সন্ন্যাসী বসিয়া আছেন। তাঁহার গাত্রে গৈরিক কাষায়।

আরও নিকটে আসিয়া মনে হইল, ইনিই যে আমাদিগের গৃহে ভিক্ষা করিতে গিয়াছিলেন। সেই তরুণ ভিক্ষুর সহিত অবিকল সাদৃশ্য! ঠিক দেখিতেছি কি? চক্ষু রগড়াইয়া দেখিলাম। না, ইনি তো তিনি নহেন! ইনি এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি! কী দেখিলাম, ভালো বুঝিতে পারিলাম না। একবার মনে হইল, ইনিই তিনি। আবার মনে হইল, ইনি তিনি নহেন।

বুঝিলাম, এই সন্ন্যাসীই বৃক্ষদেবতা। ইহারই কৃপায় আমি পুত্রমুখ দর্শন করিয়া ধন্য হইয়াছি। পুন্নার শিরোদেশ হইতে পায়সান্নের পাত্রটি নামাইয়া তাঁহার চরণপ্রান্তে রাখিলাম। বলিলাম, ‘ভগবান! আপনারই দয়ায় আমি মা হইয়াছি। হে বৃক্ষদেবতা! আশীর্বাদ করুন, যেন আমার পুত্র সুস্থদেহে বাঁচিয়া থাকে, আমার স্বামী সুস্থ থাকেন, পুন্নার যেন বিবাহ হয়, সে যেন সোয়াস্তির মতো স্বামীলাভ করে!

বৃক্ষদেবতা একটু হাসিলেন। একবার উত্তান মুদ্রায় হস্ত উত্তোলন করিয়া কেবল সম্মিত মুখে বলিলেন, ‘স্বস্তি! ‘

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *