১৩. ময়ূখলেখন

১৩. ময়ূখলেখন

মজা পুকুরের জলে হলুদ পাতা ঝরিয়া পড়িয়াছে। জলের ভিতর মেঘমুক্ত নীলাকাশ প্রতিবিম্বিত হইয়া রহিয়াছে। আকাশ মহৎ হইলেও, ক্ষুদ্র ডোবা পুকুরেও তাহার ছায়া পড়ে। সুদূর সিদ্ধার্থের ছায়াও আমার মতো মানুষের মনে ভাসিয়া উঠিতেছে।

কাল বা সময় বস্তুত কোনো ব্যবধান নহে। মানুষের মন বিচিত্র উঠাপড়ার ভিতর গঠিত হয়। মানবের ইতিহাস বস্তুত এই মনেরই ইতিহাস। যে-প্রক্রিয়ায় এই মন জন্মজন্মান্তর ধরিয়া বিবর্তিত হইতে হইতে আজিকার রূপ ধরিয়াছে, তাহারই বিপরীত প্রক্রিয়ায় মনের গ্রন্থি বা গিঁট খুলিতে থাকিলে অতীত পৃথিবীর ঘটনাবলি ক্রমে ক্রমে উদ্‌ঘাটিত হইয়া যায়। লাটাইতে লাল, নীল সুতা যে অনুক্রমে জড়ানো হইয়াছে, তাহার বিপরীত অনুক্রমে সুতা ছাড়িতে থাকিলে নীল, লাল রঙের সুতা খুলিয়া বাহির হইয়া আসে। মনের বিপরীতমুখী গতিই অতীতের উন্মোচক। ইহা ব্যতীত টাইম মেশিন বলিয়া আর কিছু নাই।

কয়দিন হইল, সুজাতা-সৌদাস-সিদ্ধার্থ মনের ভিতর উঠিতেছে পড়িতেছে। উহা আমার স্বভাব বা ব্যাধি—কিছু একটা হইবে। এই অতীত লইয়া নাড়াচাড়া করিবার অভ্যাস। কখনও মনে হয়, আমিই সৌদাস। কখনও মনে হয়, আমি সে নহে। এই লইয়া চলিয়া যাইতেছে।

বর্ষা শেষ হইয়া শরৎ আসিয়া পড়িল। পূজার ছুটি আসিতেছে। ভাবিলাম, এই ছুটিতে একবার বাহির হইব। কোথায় যাই? একবার মনে উঠিল, সারনাথ যাইব। উহা আমার অতি প্রিয় স্থান। বেশ কয়েকবার গিয়াছি। তবু আবার যাইতে ইচ্ছা হইতেছে।

ছুটি হইতেই বাহির হইয়া গেলাম। হাওড়া স্টেশন হইতে রাজধানী এক্সপ্রেসে আসন সংরক্ষিত ছিল। ট্রেনের ছন্দে দুলিতে দুলিতে একটা বই চোখের কাছে খুলিয়া পড়িতে পড়িতে রাস্তাটুকু পার হইয়া গেল। কাশী পৌঁছাইলাম যখন, তখন বেলা দুপুর।

হোটেলে উঠিয়াছি। বৈকালে বিশ্বনাথ-অন্নপূর্ণা দর্শনে চলিলাম। তাহার পর গরম গরম জিলাপি ও কচুরি খাইয়া হরিশচন্দ্র ঘাটে বসিয়া আছি। নিকটেই চিতাগ্নি জ্বলিতেছে। কাহারা পৃথিবী হইতে বিদায় লইয়াছে। তাহাদের শেষকৃত্য উদাস হইতেছে। সমস্ত পরিবেশ সূর্যাস্তের মায়াময় আলোয় যেন বৈরাগ্যের সুরে হইয়া আছে।

একটা নৌকা ভাড়া করিয়া সন্ধ্যাকালে গঙ্গা-আরতি দেখিলাম। শত সহস্ৰ পুণ্যার্থী পাতার ঠোঙায় জলে প্রদীপ ভাসাইতেছে। তাহাদের কত কী যে মনস্কামনা! আমার সেরূপ কিছু চাহিবার নাই। একটা জীবন—যে কোনোভাবে কাটিয়া যাইলেই হইল। কাহারও উপর যেন নির্ভর না করিতে হয়। বিশেষত অন্তিম বয়সে।

নৌকায় বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছিলাম, সুজাতার কথা আমি লিখিয়াছি। কিন্তু ইহা কি সত্যই সুজাতার কথা? ইহা তো আমি যেমনভাবে সুজাতাকে বুঝিয়াছি, তাহারই ছবি। সত্যই সুজাতা কেমন ছিল, কী ভাবিত, সে-সকল কথা আমি জানিব কীরূপে? আমি তো সুজাতা নহি, আমি সৌদাস।

আমরা কেহ কি অন্যকে জানিতে পারি? কখনও পারিয়াছি? মনে তো হয় না। অন্যের ব্যবহার, আচার-আচরণ হইতে অন্যের সম্পর্কে ধারণা করিয়া লই। ওই ধারণা তো আমাদেরই মনের অন্যপ্রকার ছবি। অন্যের কথা লিখিতে গিয়া আমরা আমাদের কথাই লিখি। ইহা হইতে নিস্তার নাই। যে যাহা কিছু লিখে, নিজের আত্মজীবনীই লিখে। কখনও ‘আমি’, ‘আমি’ করিয়া লিখে, কখনও অন্য কোনো চরিত্র খাড়া করিয়া তাহারই মুখ দিয়া নিজেই কথা বলে। সেই যে একপ্রকার বিলাইতি জাদু আছে, যাহাকে ভেন্ট্রিলোকুইজ্‌জ্ম বলে। জাদুকরের হস্তে একটা পুতুল থাকে। তাহাকে প্রশ্ন করিলে পুতুলটা কথার উত্তর দেয়। বস্তুত, জাদুকর নিজেই কিন্তু স্বরপরিবর্তন করিয়া কথা কয়। বাহিরের লোক দেখিলে ভাবে, পুতুলটাই যেন কত কথা বলিতেছে। আমাদের রচিত কাহিনিগুলাও ওই ভেন্ট্রিলোকুইজমেরই ন্যায়। চরিত্রগুলা লেখকের হাতের পুতুল। তাহাদিগের মুখ দিয়া লেখক নিজেই নিজের কথা বলিতে থাকে। পাঠক মনে করে, চরিত্রগুলা কথা বলিতেছে।

পরদিন প্রভাতবেলায় গোধূলিয়ার মোড় হইতে অটো ধরিয়া সারনাথের উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।

পৌঁছাইলাম যখন, তখন সকাল নয়টা। মূল মন্দিরে প্রবেশ করিলাম। ইহা নূতন মন্দির। অনাগরিক ধর্মপাল ইহার প্রতিষ্ঠা করেন গত শতাব্দীতে। বুদ্ধের ধ্যানস্থ মূর্তি সমস্ত স্থানটিকে গম্ভীর করিয়া রাখিয়াছে। কিছুক্ষণ এই স্থলে বসিলাম। বাহির হইবার সময় দেখিলাম, দেশি বিদেশি বহু ভ্রামণিকে স্থানটি ভরিয়া উঠিয়াছে। এক স্থলে বুদ্ধ-বিষয়ক বহু গ্রন্থ, জপের মালা, জপযন্ত্র ইত্যাদি বিক্রয় হইতেছে।

বাহির হইয়া আসিয়া মন্দিরের বামদিকে সেই স্থানটিতে গেলাম, যেখানে তথাগত ও তাঁহার পাঁচজন শিষ্যের মূর্তি রহিয়াছে। পাঁচজন তথাগতকে ঘিরিয়া বসিয়াছেন। ইহারাই সেই পাঁচজন ভিক্ষু যাঁহারা বুদ্ধের মধ্যপন্থা-আশ্রিত আচরণে বিরক্ত হইয়া উরুবিল্ব বন পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া আসিয়াছিলেন।

বোধিলাভের পর তথাগতর ইঁহাদের কথা মনে পড়িয়াছিল। তিনি জ্ঞানলাভের আনন্দে বিভোর হইয়া পথ চলিতে চলিতে এস্থানে, এই সারনাথে আসিয়াছিলেন। যোগবলে তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন, পাঁচজন ভিক্ষু তখন এখানেই অবস্থান করিতেছিলেন। কৌণ্ডিন্য, মহানামা, ভদ্র, বাষ্প ও অশ্বজিৎ।

দূর হইতে পাঁচজন ভিক্ষু তথাগতকে দেখিতে পাইয়াছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়াই কৌণ্ডিন্য বলিয়াছিলেন, ‘দ্যাখো, দ্যাখো! সেই ভণ্ড সিদ্ধার্থ আসিতেছে, যে তপস্যা পরিত্যাগ করিয়াছিল। সে এইখানে আসিলে আমরা উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে অভিবাদন জানাইব না।’

মহানামা বলিলেন, ‘উহাকে আমরা পা ধুইবার জল বা বসিবার আসন পর্যন্ত প্রদান করিব না।’

ভদ্র বলিলেন, ‘আমরা কেহ তাহাকে কুশলপ্রশ্নও করিব না।’

এইরূপে প্রত্যেকেই তথাগতকে অভ্যর্থনা করিতে অসম্মতি প্রকাশ করিলেন। তাহার পর তথাগত তাঁহাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার মুখমণ্ডলে এমন তেজোপ্রভ বিভা বিচ্ছুরিত হইতেছিল, ব্যক্তিত্বের এমন অপূর্ব জ্যোতিতে তাঁহার অবয়ব অর্চিষ্মান হইয়াছিল যে, সকলেই নিজেদের অজ্ঞাতসারে উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

মহানামা করিলেন, ‘হে সিদ্ধার্থ! সুস্বাগতম্! এই চরণ ধৌত করিবার জল বা পাদ্য গ্রহণ করুন। এই আসনে আসিয়া উপবেশন করুন।’

ভদ্র বলিয়া উঠিল, ‘হে সিদ্ধার্থ! আপনার সকলই কুশল তো?’

তথাগত একটু হাসিলেন। তাহার পর গম্ভীর স্বরে বলিলেন, ‘আমাকে এখন আর সিদ্ধার্থ বলিয়া সম্বোধন করিয়ো না। আমি বোধিলাভ করিয়াছি। আমি বুদ্ধ হইয়াছি। তোমাদিগকে সেই উন্নত বোধি লাভ করিবার উপায় উপদেশ করিব। সাবধানে শ্রবণ করো।’

ইহারই পর তথাগত তাঁহার বিখ্যাত ধর্মপ্রবর্তনসূত্র উপদেশ করিয়াছিলেন। শুনিতে শুনিতেই কৌণ্ডিন্য বোধিজ্ঞান লাভ করেন। তাই কৌণ্ডিন্যের নাম হইয়াছিল ‘কৌণ্ডিন্য জ্ঞাতা’।

এসকল সিদ্ধার্থের বোধিলাভের পরের কথা। কিন্তু আমি তো বুদ্ধকে চিনি না। আমি সিদ্ধার্থকে চিনি, যিনি এই জ্ঞানলাভ করিবার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করিয়াছিলেন।

এই স্থানটি ঘুরিয়া আমি মূল মন্দিরের পশ্চাতে গেলাম। ধামেক স্তূপ, ধর্মরাজিকা স্তূপের নিকট ঘুরিয়া বেড়াইলাম। এসব স্তূপ উৎখনন করিয়া বাহির করা হইয়াছে। আরকিয়োলজিকাল সারভে অব ইন্ডিয়া ইহাদের রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছেন।

প্রথম যেবার আসিয়াছিলাম, গাইড একটি স্থান নির্দেশ করিয়া বলিয়াছিল, এইখানে বুদ্ধ আসিয়া বসিতেন। তাঁহার চারিদিকে দেশনাপ্রার্থী ভিক্ষুর দল ঘিরিয়া বসিত। ইহার পর যতবার গিয়াছি, আর গাইড লই নাই, কারণ তাহার আর প্রয়োজন ছিল না। প্রতিবারই এই স্থানটির নিকটে এক স্থানে কিছুক্ষণ বসিয়া থাকি। চক্ষু মুদ্রিত করিলে মনে হয়, কাহার মন্দ্রস্বরে স্থানটি ভরিয়া উঠিতেছে। আড়াই হাজার বৎসর পূর্বের মহামানবের কণ্ঠস্বর যেন এখনও শুনিতে পাই। মনে হয়, চোখ খুলিলেই তাঁহাকে দেখিতে পাইব।

অশোকস্তম্ভের নিম্নে শিলালিপিটি দেখিয়া কুমারদেবী-প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘারামের সম্মুখে গেলাম। ইহা অনেক পরবর্তীকালের নির্মাণ। বর্তমানে ইহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। পূর্বে এখানে মাটির তলা দিয়া যাইবার একটা সুড়ঙ্গ ছিল। ওই পথ দিয়া আমিও পূর্বে নামিয়াছি। ক্ষুদ্রাকার প্রকোষ্ঠ, ভিক্ষুগণ এইসব প্রকোষ্ঠে থাকিয়া ধ্যান-চিন্তা, স্মরণ-মনন করিতেন। কেন জানি মনে হইয়াছিল, এখানেও আমি ছিলাম। কখনও যেন আসিয়াছি। সবই হয়তো মনের ভুল।

সেই সঙ্ঘারাম পার হইয়া সারনাথের শেষ প্রান্তে আসিয়া পৌঁছাইলাম। লোহার তার দিয়া স্থানটি ঘেরা রহিয়াছে। তারের ওপাশে অগণ্য হরিণ খেলিয়া বেড়ায়। ইহা হরিণের মুক্তাঞ্চল। আমি একটা শ্যাম পর্ণে পূর্ণ গাছের ডাল লইয়া জালের নিকটে দাঁড়াইলাম। তারের জালের ফাঁক দিয়া সবুজ পাতা খাইবার লোভে হরিণ সব সার সার দিয়া দাঁড়াইল। আমি উহাদের পাতা খাওয়াইতেছিলাম। এমন সময় এক অদ্ভুত ব্যাপার হইল।

আমার বাম দিক দিয়া একটা হরিণী আমার গা ঘেঁষিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। আমি তাহার দিকে তাকাইয়া অবাক হইয়া গেলাম। অমন সজীব মনুষ্যোচিত দৃষ্টি হরিণীর চক্ষে আমি কখনও দেখি নাই। সে যেন বড়ো বড়ো আর্দ্র চক্ষু তুলিয়া কী কথা আমাকে বলিতে চাহিতেছে। তাহার চক্ষুর সহিত আমার চক্ষু সংযুক্ত হইল।

যেন চোখ দিয়া আমার প্রাণকে টানিতেছে। আমি মুগ্ধ, অভিভূতের ন্যায় দাঁড়াইয়া আছি। দেখিতে দেখিতে মনে হইল, আমার প্রাণবায়ু তাহার অক্ষিজালের ভিতর দিয়া অন্তর্মুখী স্নায়ুপথ দিয়া গড়াইয়া পড়িতেছে। আমি যেন শ্যাম ধূসর কী একটা সান্দ্র পদার্থের উপর গড়াইয়া পড়িয়া জ্ঞান হারাইলাম…

একটি প্রাচীন সঙ্ঘারামের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আমি দাঁড়াইয়া আছি… মাথার উপর একটা তিন্তিড়ি বৃক্ষ সহস্র শীর্ণ শ্যাম ডালপালা মেলিয়া রাখিয়াছে। নিজের দিকে তাকাইলাম। আমার পরনে ভিক্ষুজনোচিত গৈরিক কাষায়, গাত্রে একই বর্ণের একটি উত্তরীয়। আমার মনের অবস্থা উদ্ভ্রান্ত হইয়া আছে।

কে যেন আসিল… আর-একজন ভিক্ষু। আমার নিকটে সরিয়া আসিয়া সে বলিল, ‘ভিক্ষু উদাত্ত! কী করিবে স্থির করিলে?’

আমি উত্তর দিলাম, ‘কী আর? এখন আমাকে পথেই বাহির হইয়া যাইতে হইবে। আজ হইতে পথই আমার আলয় হইল।’

‘তুমি তো তোমার দোষ স্বীকার করিয়া প্রতিমোক্ষ পাঠ করিতে পারিতে! করিলে না কেন?’

‘কারণ, ইহা আমি কোনো দোষাবহ বলিয়া মনেই করি না। কোন শাস্ত্রে লিখিত আছে, ভিক্ষু কাব্যরচনা করিতে পারিবে না?’

‘কাব্যরচনায় দোষ নাই, বন্ধু। কিন্তু তুমি যে শ্রেষ্ঠীকন্যা মল্লিকাকে লইয়া প্রণয়কাব্য রচিয়াছিলে!’

‘ইহা আমি অস্বীকার করি না, মল্লিকাকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসা কি পাপ? আমি তো তাহাকে লইয়া কেবল কাব্য রচনা করিয়াছি।’

‘এই মাত্র? তুমি কি অস্বীকার করিতে পারো, তুমি তাহার সহিত মাঘীপূর্ণিমায় দীর্ঘক্ষণ কথা বলিয়াছিলে? ভিক্ষুর পক্ষে নারীসম্বোধন বিহিত নহে।

‘এই বিধিনিষেধ ভগবান বুদ্ধের অনেক পরবর্তীকালের। আমি এসকল মানি না।’

আমি তোমার অভিমান বুঝিতে পারিতেছি। কিন্তু আমি তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তোমার সখা। আমার নিকট তুমি স্বীকার করো। কেন শ্রেষ্ঠীকন্যা মল্লিকার প্রতি আকৃষ্ট হইলে?’

‘স্থবির মিত্রবাকের কথা তোমার মনে আছে, সুনন্দ?’

‘আছে বই-কি। সেই যে আমরা দুইজন তাঁহার নিকট বসিয়াছিলাম। তিনি তোমার সম্পর্কে কতগুলি অদ্ভুত কথা বলিয়াছিলেন, উদাত্ত!’

‘কী কথা মনে আছে?’

‘আছে। তিনি বলিয়াছিলেন, তোমার ভিতর জন্মান্তরীণ স্মৃতি জাগরিত হইবে। তুমি জাতিস্মর!’

‘তাঁহার সে-কথায় তোমার আস্থা হয়?’

‘হয়। পূর্বজন্মের কোন রহস্য তোমার পরিজ্ঞাত হইয়াছে, আমাকে বলিবে কি?’

‘দ্যাখো, সুনন্দ। আজ তোমাকে বড়ো গোপন কথা বলিব।’

‘বলো, শুনিতেছি।’

‘আমি পূর্বজন্মে সৌদাস নামে এক কবি ছিলাম। তথাগতর বোধিলাভের পূর্বে যে-নারী তাঁহাকে পায়সান্ন নিবেদন করিয়াছিল, সেই সুজাতাই ছিল আমার স্ত্রী। আর সেই সুজাতাই এই জন্মে শ্রেষ্ঠীকন্যা মল্লিকা।’

‘কী বলিলে?’

‘ঠিকই বলিলাম। এই কথা আমি জানিতাম না। কিন্তু মাঘীপূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিহারের বহির্দেশে মেলা বসিয়াছিল। সেই মেলায় শ্রেষ্ঠীকন্যা মল্লিকাকে আমি প্রথম দেখিলাম। আর দেখামাত্রই আমার পূর্বজনমের স্মৃতি জাগরুক হইল…’

‘তাহাকে তুমি এ কথা বলিয়াছিলে?’

‘স্পষ্ট করিয়া বলিবার সুযোগ পাই নাই। অস্পষ্ট আভাষ দিয়াছিলাম। সে বুঝিতে পারে নাই। তাহার পূর্বজন্মের কথা কিছুই মনে নাই।’

‘সে কি তোমাকে ভালোবাসে?’

‘জানি না। এত অল্প সময় কথাবার্তা, কেমন করিয়া জানিব?… হয়তো বাসে, কিন্তু চেনে না…’

‘এখন কি তাহার নিকট যাইবে?’

‘কোথায় আর যাইব? শুনিতেছি, শ্রেষ্ঠী তাহার কন্যাকে লইয়া পারাদ্বীপ না কোথায় গিয়াছেন।’

‘কবে ফিরিবেন?’

‘ঠিক নাই। কেহ বলিতে পারিতেছে না।’

‘তুমি কি তাহাকে খুঁজিবে না?’

‘খুঁজিব। কিন্তু তাহার মানবী রূপের ভিতর আর নয়। অনল-অনিলে, লতায়পাতায় উদ্ভিজ্জে, আকাশের গাত্রে, শিলালেখে শিলালেখে তাহাকে—সেই প্রত্নমানবীকে—খুঁজিয়া ফিরিব। সে আমার সর্বময় হইয়া গিয়াছে যে!’

‘দুঃখ হয়, সঙ্ঘ তোমাকে বুঝিল না।’

‘সঙ্ঘ সঙ্ঘের নিয়মে চলিবে। তাহার নিয়মনিগড়ের ভিতর দিয়া সঙ্ঘ ভিক্ষুদিগকে নিরাপত্তা দিয়াছে, কাড়িয়া লইয়াছে স্বাতন্ত্র্য। ধর্মাচরণের স্তূপের নিম্নে কত যে অপরিপূরিত বাসনা… কত অশ্রুপাত! আমি আর নিজেকে ইহার ভিতর আবদ্ধ করিয়া রাখিতে পারি না।’

‘ইচ্ছা হইতেছে, আমিও তোমার অনুসরণ করি।’

‘তুমি কেন আমাকে অনুসরণ করিবে? আমাকে আমার কর্মবিপাকে সঙ্ঘত্যাগ করিতে হইতেছে। তোমার কর্মানুসারে তোমাকে সঙ্ঘেই থাকিতে হইবে। আর আমাদের দেখা হইবে না। … বিদায় …!’

.

সহসা যেন কী এক আঘাতে ঘোর ভাঙিয়া গেল। যেন কোন সুদূর পৃথিবীর স্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিলাম। দেখিলাম, হরিণীর সহিত চোখের সংযোগ ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। সে সরিয়া গিয়া হরিণের দলের সহিত মিশিয়া যাইতেছে। আর তাহাকে অন্য হরিণ হইতে পৃথক করিতে পারিলাম না।

কবেকার কথা এসব! কোন সে প্রাচীন মঠ, কে সেই ভিক্ষু উদাত্ত, শ্রেষ্ঠীকন্যা মল্লিকা, ভিক্ষু সুনন্দ! কোথায় যে হারাইয়া গিয়াছিলাম!

তাহাকে যেন আচম্বিতে চিনিতে পারিলাম। সে এইবার অন্যরূপে আসিয়াছে। মৃগীরূপে জন্ম লইয়াছে। সেই সুজাতা!

মন বড়ো বিষণ্ণ হইয়া গেল। মধ্যাহ্ন ঢলিয়া পড়িল। অপরাহ্ণ আসিতেছে। ছায়া দীর্ঘতর হইতেছে।

হোটেলে ফিরিয়া আসিলাম। সমস্ত দিনের ভ্রমণক্লান্ত শরীর বাথরুমে শাওয়ারের নীচে পাতিয়া দিলাম। শীতল বারিকণা শাস্তি বিছাইয়া দিল।

আজ আর বাহিরে যাইব না। হোটেলে রুম সার্ভিস বলিয়া দিলাম। ঘরে খাবার দিয়া গেল। খাবার সারিয়া বিছানায় গা ঢালিয়া দিলাম। দুই চোখের পাতায় রাজ্যের ঘুম নামিয়া আসিল।

কী এক বিচিত্র স্বপ্নের মধ্য দিয়া যাইতেছি। কাহারা যেন কথা বলিতেছে। মহৎ প্রাণের কণ্ঠস্বর। কত শত শত বৎসর পূর্বের সব কথা।

অন্ধকারে অস্ফুট চিত্র স্ফুটতর হইয়া উঠিতেছে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *