বুদ্ধ কৈরবী

বুদ্ধ কৈরবী

বন্ধনীভুক্ত প্রথম সংখ্যাটি ‘বুদ্ধচরিতম্’ কাব্যের অধ্যায়ক্রম ও পরের সংখ্যাটি শ্লোকক্রমের সূচক

বন্দনা

পরম-আনন্দ-দানে যিনি গূঢ় বিধিরও অধিক
তমোঘ্ন সূর্যেরও চেয়ে প্রতিস্পর্ধী যাঁহার কিরণ,
চাঁদের থেকেও যিনি নম্রতর করুণায়, জগতের সন্তাপমোচন!
অতুলন সে অর্হৎ—চরণপদ্মে তাঁর আনত প্ৰণাম। (১.১)

কুমার সিদ্ধার্থ বললেন :

‘অবজ্ঞা করি না আমি বিষয়ের সুখ,
জানি লোকে ডুবে থাকে তাদেরই মায়ায়
কিন্তু এ জগৎ আহা অনিত্য নশ্বর!

এই কথা মনে করে হয়েছি বিমুখ
অরুচি সংসারে মন আর না তো যায়।’ (৪.৮৫)

‘যদি না থাকত এই জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর প্রতাপ জীবনে,
আমিও খুঁজতাম সুখ, যা কিছু সে রমণীয় রুচিকর মনে।’ (৪.৮৬)

‘যে-জীবন ক্ষয়ময়, নশ্বরতা আবিশ্বসংসারে,
যে-জীবন ভোগে লিপ্ত, যে-জীবনে আসক্তি দুর্বার,
যে-জীবনে আমি নই প্রকৃতার্থে অধীন আমার,
সে-জীবন হীন বড়ো; নয় ঋদ্ধ মহত্ত্বসম্ভারে।’ (৪.৯১)
সপ্রতিভ ছন্দক, অশ্বশালায় সে যে তুরঙ্গের দেখাশোনা করে।
তাকে ডেকে ঘুম থেকে মধ্যরাত্রে সিদ্ধার্থ বললেন :
আমার কণ্ঠক ঘোড়া ত্বরিতে বাহির করো, হে সারথি!
যাব আমি এখনই তো অমৃতত্ব ধ্রুব অভিসারে।’ (৫.৬৮)

প্রস্ফুট পদ্মের মতো বিকচ নয়ন তুলে একবার তিনি দেখলেন,
নগরী ঘুমিয়ে আছে। দ্বিধাহীন সিংহের মতন দৃপ্তস্বরে সিদ্ধার্থ বললেন :
‘জন্মমৃত্যু-পরপারে কী আছে তা জানবার আগে
ফিরব না আমি আর কপিলের নামাঙ্কিত এ সমৃদ্ধ বিপুল নগরে’। (৫.৮৪)

রাজ্য পরিত্যাগ করে অরণ্য অতিক্রম করে রাজগৃহ নগরীর পথে ভিক্ষাটন সেরে পর্বতের দিকে যাত্রা করলেন।

যথালব্ধ ভিক্ষা নিয়ে তিনি এসে বসলেন নির্জন পাহাড়ি সেই ঝরনার পাশে,
একা একা ভিক্ষাহার সেরে পাণ্ডব-পর্বতশীর্ষে ধীরে ধীরে উঠতে লাগলেন। (১০.১৪)

লোধবৃক্ষে ঢাকা সেই বনভূমি, কুঞ্জ যার ময়ূরের কেকারবে সদা শিহরিত,
সেইখানে কাষায় পরিহিত আলোর মতন দীপ্তিমান একজন মানুষ,
যেন প্রাচীশৈলের উপর উদিত প্রভাতের প্রথম অংশুমালী। (১০.১৫)

গুপ্তচর-প্রমুখাৎ তপস্বী সিদ্ধার্থের কথা শুনে নৃপতি বিম্বিসার সিদ্ধার্থের দর্শনার্থে
উপনীত হলেন। তারপর সিদ্ধার্থকে সম্বোধন করে বললেন :

‘গাত্র তোমার চন্দনরাগ অনুলেপনের জন্য,
এতে কী আর বলো, যুবক, কাষায়বস্তু মানায়?
ওই দু-বাহু প্রজাপালন-সমৰ্থ,
পরের দেওয়া অন্ন তুমি ওই দু-হাতে ভিক্ষা কেন করো?
ধনুকছিলা-আকর্ষণে যে হাত তোমার দড়,
মান্ধাতার মতন তুমি স্বর্গ-মর্ত-পাতাল যখন হেলায় জিনতে পারো,
কেনই তবে দৃপ্ত বাহু—ব্যর্থ তাদের করো?’ (১০.২৪, ৩১)

সিদ্ধার্থ রাজা বিম্বিসারের প্রশ্নের উত্তর দিলেন :

হরিণ বাঁধা পড়ে গানের উচাটনে
আগুন উজ্জ্বল পতঙ্গকে টানে
মাছেরা ঠোকরায় টোপকে স্বাদু ভেবে
বিষয়মুগ্ধতা দুঃখ এনে দেবে।

যে-ভোগে তৃপ্তিতে লগ্ন ক্ষণিকতা,
তাকে কি ভোগ বলে? সে যে কথার কথা!
যেসব শর্তেই সুখের উপভোগ,
তাদেরই অন্যথা দুঃখ সংযোগ।

ভিক্ষা আহারেই যেজন সুখে আছে,
নজর নিচু করে দেখো না তাকে, প্ৰিয়!
জরা ও মৃত্যুর সাগর পেরোবে সে
শান্তি ইহকালে, মুক্তি অবশেষে।

বরং কৃপাচোখে তাকেই দেখে নিয়ো,
যেজন সম্পদে থেকেও তৃষাতুর,
স্বস্তিবঞ্চিত এখানে ইহলোকে,
অন্তে যন্ত্রণা মজ্জমান শোকে।

আমার জেনো, আছে রাজ্য বোধিপুর,
মৃত্যুপাখি সেথা বাঁধেনি তার নীড়
নেই তো উদ্বেগ পুনঃ ফিরে আসা,
জন্মজরাহীন শান্তি সুনিবিড়।’ (১০. ৩৫, ৪১, ৫৪, ৫৫, ৫৯)

অল্প দিন পর সিদ্ধার্থ রাজগৃহ ছেড়ে চলে গেলেন। আরও গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলেন। সেখানে যোগী অরাঢ় কালামের সঙ্গে দেখা হল তাঁর। তত্ত্বজিজ্ঞাসু সিদ্ধার্থকে অরাঢ় কালাম উপদেশ দিলেন :

‘যেমন করে আলাদা করে নিতে হয়
মুঞ্জাঘাসের বহিরাবরণ থেকে তার কমনীয় শিষ,
খাঁচা থেকে যেমন করে আকাশপথে উড়ে যায় পাখি,
তেমনই ক্ষেত্রজ্ঞ এই আত্মা
ক্ষেত্ররূপ দেহ থেকে
জ্ঞানসহ নিঃসৃত তা হলে
মুক্তি বলি তাকে।

এই তো পরম ব্রহ্ম,
নির্লিঙ্গ, ধ্রুব, অক্ষর।
তত্ত্বজ্ঞ মনীষীরা যাকে বলেন
মোক্ষপদ।’ (১২. ৬৪, ৬৫)

অরাঢ় কালামের তত্ত্বব্যাখ্যায় সিদ্ধার্থ সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি উত্তরে বললেন :

‘শুনলাম এই পরম সূক্ষ্ম,
পরম কল্যাণপ্রদ এ তত্ত্ব,
তবুও মনে হল না এই-ই চরম,
যেহেতু দেহেতে দেহেতে লগ্ন
এই যে আত্মা তাকে
কীভবে পরিত্যাগ করব, সেকথা
এখানে হল না আর বলা।

যেমন বীজের ভিতর ভাবী গাছের চলা,
প্রকৃতিবিকৃতি থেকে আলাদা করে নিলেও
তবু প্রসবসম্ভাবনা
এই আত্মাতে রয়েই তো যেতে পারে;
আবার জন্ম, আবার জীবন, আবার আসা যাওয়া
চক্ররেখাকারে।’ (১২.৬৯, ৭০)

অবশেষে নিজেই সাধনা করে জীবনপ্রশ্নের উত্তর খুঁজবেন স্থির করে সিদ্ধার্থ নৈরঞ্জনা নদীর পরপারে উরুবেলা বনে উপনীত হলেন।

অথ নৈরঞ্জনাতীরে শুচিতে শুচি যার পরাক্রম
একান্ত নির্জনে বনে বসবাস করতে লাগলেন। (১২.৮৮)

মানুষের পক্ষে দুর্লভ সেসব সাধন
ছ-টি বছর করে চললেন,
ফল তবু কিছুই মিলল না। (১২.৮৯)

অস্থিচর্ম রইল শুধু স্থির,
মেদমাংসশোনিত গেল ক্ষয়ে
যদিও ক্ষীণ তপোকঠিন দেহ
তবুও তাঁকে দেখাত যেন সমুদ্রগম্ভীর। (১২.৯০)

একদিন ধ্যান থেকে উঠে নদীজলে স্নানার্থে নামলেন।
শরীর এত দুর্বল হস্তপদ সঞ্চালন করতেও বড় কষ্ট হচ্ছে।

স্নান সেরে ধীরে ধীরে নৈরঞ্জনা নদী-আঘাটায়
কৃশকায় তাপস উঠে আসতে লাগলেন,
তীরের গাছগুলি তাদের শাখা বাড়িয়ে দিল তাঁর দিকে
ভালোবেসে,
গাছের ডাল ধরে তিনি উঠে এলেন কোনোমতে তীরে। (১২.১০৫)

‘বুদ্ধচরিতম্’- এ মেয়েটির নাম সুজাতা নয়, নন্দবালা। সেই নন্দবালা একদিন রুগ্ন সিদ্ধার্থের প্রাণ বাঁচালেন পায়সান্ন প্রদান করে।

গোয়ালাদের দলপতির মেয়ে
নাম তার নন্দবালা;
যেন দেবপ্রেরিতা হয়ে এসেছিল কাছে,
হৃদয়ে আনন্দ তার উপজিত সন্ন্যাসীসকাশে। (১২.১০৬)

সাদা শাঁখায় উজলা দুটি হাত,
গভীর নীল পশমিনার শাড়ি
যেন সে নীল যমুনা নদী ফেনকরুণ মুখ।

শ্রদ্ধা আর প্রীতির ভাষা জাগালো বনভূমি,
দুটি সে-চোখ নলিনীনত বিকচকুসুমিত,
আভূমি দীন প্রণত মেয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে,
বলল, ওগো তাপস! তুমি নাও এ দয়া করে
সামান্য এ নিবেদিলাম পায়সান্নপদ। (১২.১০৭, ১০৮)

সিদ্ধার্থের তপস্যায় আকৃষ্ট হয়ে পাঁচজন তপস্বী তাঁর সঙ্গে তপস্যা করছিলেন। সিদ্ধার্থ গোপকন্যা নন্দবালার হাত থেকে পায়েস নিয়ে আহার করেছেন দেখে এই পাঁচজন সিদ্ধার্থকে তপোভ্রষ্ট জ্ঞান করে সেখান থেকে চলে যান।

‘আবার বুঝি সংসারের চাকায় ফিরে এল’-
একথা ভেবে অবজ্ঞায় পঞ্চবর্গীয়
ভিক্ষু পাঁচ ছেড়ে গেলেন তাঁকে;
যেমন ছাড়ে পঞ্চভূত মুক্ত আত্মাকে। (১২.১১১)

ভালই হল। সিদ্ধার্থ নির্জন সেই বনভূমিতে একান্তে ধ্যাননিবিষ্ট হলেন।
বিশ্বে যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তা সবই একান্তেই অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সুদৃঢ় দেহ অচলাসনে অঙ্গ সংহত
যেন সে কোনো মহানাগের সমুদ্যত ফণা,
বজ্রস্বরে নিনাদিলেন অটুট প্রতিজ্ঞায় :
চরম সেই লক্ষ্যে আমি না হয়ে উপনীত
উঠব না এই মাটির থেকে আসন ছেড়ে আর’। (১২.১১৭)

ধ্যানাসনে সিদ্ধার্থের এই কঠিন প্রতিজ্ঞাতে মারের আসন টলে উঠল। কিন্তু কে এই মার?

বিশ্বে যিনি কামেশ্বর নামেতে প্রচারিত
চিত্রায়ুধ, পুষ্পশর কতো না নাম তাঁর!
সকলে যাঁর অধীনে থাকে, কামের অধিপতি
চিরকালীন কাঙ্ক্ষাময় মোক্ষদ্বেষী মার। (১৩.২)

মার সিদ্ধার্থ-সমীপে উপস্থিত হয়ে বললেন :

‘যেহেতু এই তাপস আজও আমার সীমানায়,
যেহেতু আজও জ্ঞাননয়ন ফোটেনি প্রজ্ঞায়,
ভাঙব আমি শপথ তার সর্বশক্তিতে
যেমন করে প্রবল স্রোতে সেতু যে ভেসে যায়।’ (১৩.৬)

‘ওঠো হে ক্ষত্ৰিয়সুত! মৃত্যুভীত নর!
রাজার উচিত কার্য করো হে কুমার!
ছাড়ো যোগীজনগম্য মোক্ষধর্মপথ।
যুদ্ধ করো যজ্ঞ করো জয় করো ধরা,
বাসবের স্বর্গ লভো মৃত্যুর উত্তর। (১৩.৯)

ওঠো শীঘ্র অতঃপর, ফেরো স্বসংজ্ঞায়
আমার সুধার শর দীপ্ত লেলিহান!
রতিপ্রিয় চক্রবাক মিথুন-যুগল
তাদেরও উপরে আমি হানি না এ বাণ। (১৩.১৩)

সিদ্ধার্থ মারের বচন অগ্রাহ্য করলেন।
আরম্ভ হল সিদ্ধার্থের উপর মারের ভয়াবহ আক্রমণ।

হানল সেই শর, শাক্যমুনি তবু অনড় ধ্রুব তাঁর প্রতিজ্ঞায়,
অকম্পিত তিনি ধ্যানের মুদ্রায় করেননি তো মারে কর্ণপাত
 অনড় তাঁকে দেখে বিষাদে ডুবে গেল পুষ্পধনু মার অতঃপর,
বলল ধীরে ধীরে চিন্তা জড়ো করে হতাশ রতিপতি স্তিমিতস্বর : (১৩.১৫)

‘যে-বাণে শম্ভুও অদ্রিজার প্রতি প্রণয়ে জর্জর স্খলিতত
একদা শরাঘাতে শিবেরও চিত্ততে এনেছি সন্তাপ অকস্মাৎ
আজকে কী যে হল! করেনি দৃকপাত বারেকও এ তাপস উপেক্ষায়!
চিত্ত নেই এর? নাকি এ তিরখানি নয় সে সেদিনের পুষ্পশর?’ (১৩.১৬)

বরাহমুখাকার তীক্ষ্ণ দস্তুর মাছের মতো রূপ বীভৎস
অশ্ব গর্দভ উষ্ট্র ব্যাঘ্রের মিলিত আননের হুহুংকার
ঋক্ষ, সিংহের আস্য ভয়ানক, অনেক মুখজোড়া একটি চোখ,
তিনটি মুণ্ডের অনল-ঈক্ষণ মারের সেনানীরা ভয়ংকর। (১৩.১৯)

তামার মতো লাল বিন্দুচর্চিত আয়ুধ হাতে তারা আলোল কেশ
পীতাভ কুন্তল অথবা ধোঁয়াকার সে-কর কর্ণের আন্দোলন চর্মাবৃত কেউ,
কেউ দিগম্বর, অর্ধদেহ শ্বেত, অর্ধশ্যাম, অরুণ ধূম্রের হলুদ,
কৃষ্ণের সর্পফণা সব ভীষণ ভুজ। (১৩.২১)

বইছে দশদিকে প্রকম্পিত বেগে লুপ্তসংসার প্রভঞ্জন,
তারারা নিভে গেছে, অস্তে গেছে চাঁদ, কৃষ্ণ্যবনিকা অন্ধকার
রজনী ঘোররূপা তামসী নিশাকাল গিলছে ত্রিজগৎ লেলিহমুখ
মেদিনী কম্পিত ক্ষুব্ধ আলোড়িত সমুদ্রের শ্যাম বিশাল ঢেউ। (১৩.২৯)

কিন্তু মার-সেনানীর ভয়ংকর আক্রমণে সিদ্ধার্থের একটি কেশাগ্রও কম্পিত হল না।

তথাপি মহর্ষি তিনি। চোখ তুলে দেখলেন মারের সেনানী,
দশদিক হতে তারা আনে ঘোর আক্রমণ ধর্মবিৎ ‘পরে।
অকম্প হৃদয় তবু, অবিচল মহাশান্তি ফুল্ল মুখাম্বুজ,
যেন সিংহ সমাসীন গোযূথের কেন্দ্রে স্থির অভয় উদাস। (১৩.৩৩)

ভয়াবহ রূপ, ভাব—পুরোভাগে ভয়ংকর দানবের দল,
শঙ্কাহীন নিরুদ্বেগ তবুও ভাঙে না তাঁর মুখশ্রী কোমল।
যেন পরিণতবোধ বয়স্ক কোনো সে এক প্রবীণের মন
নেমেছে খেলার মাঠে উদ্ধত শিশুর দল নিয়ে চারপাশে। (১৩.৩৬)

এত যে শরীরে মনে করে মহা আক্রমণ তাঁর চারিদিকে,
এত যে প্রমত্ত শত্রু চতুর্দিকে করে চলে অশনিসম্পাৎ,
আসনে তবুও তিনি অচঞ্চল শাক্যমুনি অক্ষোভ্যসম্ভব।
বন্ধু তাঁর প্রতিজ্ঞার বিনিশ্চল মুখ। (১৩.৪৩)

তখন আকাশ হতে অদৃশ্য এক পুরুষ মারের নিষ্ফল প্রয়াস দেখে গম্ভীর স্বরে বললেন :

ক্লান্তিকর পরিশ্রম কোরো না তুমি আর, হে অনঙ্গ!
হিংস্রতা পরিত্যাগ করে বিশ্রাম নাও এবার শান্তিময়।
বাতাস কখনও মেরুপর্বতকে বিচলিত করতে পারে না।
তেমনই তোমার দ্বারা এই সন্ন্যাসীর তপোভঙ্গ হবে না। (১৩.৫৭)

আগুনও হতে পারে শীতল কখনও বা,
জল ছেড়ে দিতে পারে কখনও বা তার তারল্য,
পৃথিবীও হয়ত কোনোদিন ছাড়লেও ছাড়তে পারে কাঠিন্য,
তবু সিদ্ধার্থ পরিত্যাগ করবেন না তাঁর প্রতিজ্ঞা অবিচল,
অনেক কল্প ধরে আচরিত শুভকর্মের দ্বারা অর্জিত তাঁর এই সংকল্প ভীষণ। (১৩.৫৮)

এই তাঁর পরাক্রম, তাঁর তেজ, সর্বজীবে তাঁর এই অমেয় করুণা!
সম্বোধি লাভ না করে তিনি উঠবেন না এ-আসন থেকে, জেনো সুনিশ্চিত।
সূর্য যেমন অন্ধকার দূর না করে পূর্ব গগনে উদিত হন না কখনও। (১৩.৫৯)

অরণি মন্থন করলে বেরিয়ে আসে আগুন,
মৃত্তিকা খনন করলে জল,
যাঁর এমন অধ্যবসায়, অপ্রাপ্য তাঁর নেই কিছুই;
তাঁর পক্ষে সকলই প্রাপনীয়, সকলই সম্ভব। (১৩.৬০)

রুগ্ন, বাসনাতাড়িত, আর্ত এই পৃথিবীর প্রতি করুণায়
তিনিই ভিষগ, অশ্রান্ত চিত্তে তিনি খুঁজে চলেছেন প্রজ্ঞা-ঔষধ।
তাঁর পথে অসম্ভব তোলা আজ বাধার প্রাচীর। (১৩.৬১)

মহা অন্ধকারে সবাই যখন হারিয়ে গেছে চিহ্নহীন,
ইনিই শুধু জ্ঞানপ্রদীপ দীপ্যমান,
ঘোরা রজনীর বিবরে জুলমান একমাত্র এ প্রদীপ নেভানো যাবে না। (১৩.৬২)

যে মহীরুহের শিকড় সুদৃঢ় সংকল্পে প্রোথিত,
আঁশ যার ধৈর্য, চারিত্র্য যার পুষ্প,
স্মৃতি আর বুদ্ধি যার প্রসারিত শাখা,
ধর্মফলপ্রদাতা এই প্রবর্ধমান জ্ঞানবৃক্ষ,
এর উৎপাটন জেনো একান্ত অসম্ভব। (১৩.৬৫)

এই স্থান ধরিত্রীর নাভি,
শ্রেষ্ঠ স্থানাঙ্ক এই, ধরার পরমতম ধাম,
সারা পৃথিবীতে এমন আরেকটি স্থান নেই,
সম্বোধিপ্রদেশ এই অমিতকল্যাণ।’ (১৩.৬৮)

যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে এই কথা শুনবার পর মারের কী হল?

এই দেববাণী শুনে আর নিষ্কম্প মহামুনিকে দেখে
হতাশ হতোদ্যম মার
পৃথিবী কম্পনকারী সেই বিষাক্ত শরগুলি নিয়ে
ফিরে গেল স্বলোকে তাহার। (১৩.৭০)

যখন প্রস্থিত হল সেই পরাস্ত পাপাত্মা,
আকাশ প্রসন্ন হল চারিদিকে,
চাঁদ বেরিয়ে এল মেঘের আড়াল থেকে নিষ্কলুষ,
স্বর্গ থেকে নামল কুসুমসম্পাত,
আর নির্মেঘ কুমারীর মতো হল রাত্রিকাল। (১৩.৭৩)

তারপর?

ধীরতা আর সংযমের দ্বারা মারবিজয়ের পর
পরমার্থজিজ্ঞাসায় ধ্যানকোবিদ
ধ্যাননিবেশিত হলেন। (১৪.১)

সর্ববিধ ধ্যানসিদ্ধ তাঁর অতঃপর
রজনীর প্রথম প্রহরে
মনে পড়ল অনর্গল একচিত্ততান
পূর্বজন্মপরম্পরাকথা। (১৪.২)

‘এমন স্থানে এমন নামে আমি ছিলাম,
সেখান থেকে চলে এসে
আবার আমি এমন হলাম’–এমনিভাবে
হাজার হাজার জন্মজোড়া পরিক্রমা পুনর্ভাবন। (১৪.৩)

জন্ম ভেবে মৃত্যু ভেবে পুনর্জাত
চক্রাকারে নিজের সাথে
ঘুরছে সবাই। হৃদয় হল প্রণয়স্নাত
সকল জীবের কারুণ্যফল ক্ষুধায় অন্ন তৃষায় সজল অনুদ্ধত। (১৪.৪)

কলাগাছের কাণ্ড যেমন অসারগর্ভ
তেমনই এই নিঃসারতা
এ সংসারে—হাজার হাজার পরিক্রমা জন্মজোড়া
জন্ম দিল এ-বোধ গাঢ় অভিজ্ঞতার (১৪.৬)

রাত্রি তখন দ্বিতীয় যাম
অদ্বিতীয় পরাক্রমে খুলল এবার দিব্যনয়ন;
নিখিল ভুবন মালিন্যহীন মুকুর যেন
আবর্তিত সকল জীবের জন্মমরণ
উচ্চাবচ কর্মকেতন অনুবেদন
খুলল দুয়ার কারুণ্যস্রোত মর্মরিত।

রাত্রি তখন গভীর হল আলোলকেশ দ্বিতীয় যাম। (১৪.৭,৮,৯)

ভদন্ত অশ্বঘোষ-প্রণীত ‘বুদ্ধচরিতম্’ কাব্যের নির্বাচিত
শ্লোকাবলীর সন্মাত্রানন্দকৃত অনুবাদ ‘বুদ্ধকৈরবী’ সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *