৭. একটি নামহীন অধ্যায়
নদীটি শীর্ণা; তবু স্রোত বয়। শীতের রৌদ্রের ভিতর সে শুয়ে থাকে অপার আলস্যে। জল কাকচক্ষুর মতো স্বচ্ছ—সেদিক থেকে তার নৈরঞ্জনা নাম সার্থক। মধ্যে মধ্যে নদীগর্ভ হতে দুয়েকটা পাথর মাথা উঁচু করে থাকে। স্রোত সেইসব পাথরের চারিপাশে ঘূর্ণি তৈরি করে। প্রতিহত হয়ে ফিরে যায়। নৈরঞ্জনা বড়ো রূপসী নদী।
নদীর এক তীরে একটি ঘুমন্ত গ্রামদেশ, অন্য তীরে নিবিড় বনশ্রী। কেউ বলে উরুবিল্ব বন, কেউ বা শুধুই উরাইল। ঘনপাদপসমাবিষ্ট নিবিড় অরণ্য। সেই অরণ্যের বহির্দেশে একটি বৃহৎ বনস্পতি। স্থানীয় লোকের বিশ্বাস, সে-বনস্পতি এক দেবতা-বৃক্ষ। তার কাছে আন্তরিক যা চাওয়া যায়, তাই-ই পাওয়া যায়।
নদীর এপারে গ্রামটি ছবির মতন। কৃষক-গোপ-কর্মকার-কুম্ভকারের গ্রাম। গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি পায়ে চলার পথ। দু-পাশে পাতায় ছাওয়া ঘর। ঢেঁকিশালা 1 গোশালা। পথের পাশে পড়ে থাকে বন্ধনমুক্ত ঊর্ধ্বমুখ গোযান। নগ্ন শিশুর দল খেলা করে ঘরের দাওয়ায়। ঘরের চালের ওপর দিয়ে উড়ে যায় সবুজ টিয়াপাখির ঝাঁক। গৃহাঙ্গণে ধান মেলা আছে, পাখি আসে সেই ধান খেতে। গোয়ালঘরের পাশ দিয়ে গলা ফুলিয়ে বেরিয়ে আসে কুক্কুট। গ্রামের আকাশে গোল হয়ে উড়ে বেড়ায় কপোত-কপোতীরা।
সন্ধে হলে ঘরে ঘরে ধূপ-ধুনো, দ্বারপথে জ্বলে ওঠে মাটির প্রদীপ। গ্রামের মাঝখানে শুকনো পাতার স্তূপে আগুন জ্বেলে গ্রাম্য বৃদ্ধরা আলাপ করে। কেউ বলে, ‘ও চাষার পো, তোমাদের ইন্দ্রপূজায় তেমন জলুস এ বছর আর হল না যে!’
যাকে উদ্দেশ করে বলা, সে লোকটা একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে, ‘হবে কোথা থেকে? এ বছর শ্রেষ্ঠীরা নদী বেয়ে আজও অবধি ফিরল না। তাঁরাই হলেন গে আমাদের খুঁটি। তাঁদের অনুদান ছাড়া উৎসব তেমন তেমন জমবে কেন?’
‘সার্থবাহ নিয়ে ওঁরা সব ভেসে যায় কোন উদিসে?’
‘সে কথা কি আমরা জানি? আমাদের জন্মের মধ্যে কম্মো হল এই গোপীনাথপুর গাঁ, ওই নৈরঞ্জনা নদী আর ওই উরাইল বন। এর বাইরে আমরা আর গেছি কোথা মশয়?’
‘কেন শোনো নি? কীসব পারাদ্বীপ, সূপারক বন্দর, সুবর্ণদ্বীপ—কত কথা তাঁরা ফিরে এসে বলেন বটে! লোকে চোখ গোল গোল করে শোনে।’
তুমিও যেমন! আমাদের ওসব নাম শোনাই সার। হত যদি জন্ম শ্রেষ্ঠীর ঘরে, দেশে দেশে আয়েশ করে ঘুরে বেড়াতাম।’
‘ও কাকা, এবার যদি ইন্দ্ৰপূজা তেমন তেমন নাই হল, তাহলে গ্রামে বিপদ হবে না? ইন্দ্র যদি কুপিত হন, তবে তো বেবাক সব্বোনাশ!’
‘সেই তো চিন্তা। মোড়লের মেয়ে সুজাতা, এ গেরামেই বিয়ে হল। তা আজ পাঁচ বচ্ছর হবে। ছেলেপুলের মুখ দ্যাখেনি এখনও। কী হবে গো?’
‘সেই কথাই ভাবছি। ইন্দ্র কুপিত হলে আমাদের গাঁ-ঘরের কত মেয়ে বাঁজা থেকে যাবে বলো দেখি!’
‘আচ্ছা, আমি বলি কী, উরাইল বনের বৃক্ষদেবতার থানে পূজা দিলে হয় না? দেবতার কৃপায় যদি মেয়েগুলোর বন্ধ্যাত্ব ঘোচে?’
‘এ একটা কাজের কথা সময়ে মনে করিয়েছ, কামারের পো। এ কথাটা আমার তো মাথাতেই আসেনি।’
‘আসবে কী করে, কাকা? মাথার আর দোষ কী? সারাদিন গোরু আর গোবর নিয়ে তোমার কারবার। এই গোরু ঘাঁটতে ঘাঁটতে মাথার বুদ্ধিও গেছে ঘুঁটের মতো শুকিয়ে। হে হে হে!’
‘তোমাদের ওই হয়েছে এক দোষ! বুড়ো মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা আর মশকরা।‘
‘আমার কথায় রাগ কোরো না, কাকা! তোমারে খুব আপন ভাবি, তাই বলে ফেললাম।’
‘তো সে যাই হোক, কথাটা তাহলে মোড়ল মশায়ের কানে দিই, কী বলো?’
‘সেই ভালো। আর বেশি দেরি করা ঠিক নয়। কালকেই একটা উপায় করে ফ্যালো, দেখি।’
কেমন করে মোড়ল মশায়ের কানে কথাটা দেওয়া যায়, তাই নিয়ে এবার জল্পনাকল্পনা শুরু হয়। বৃক্ষদেবতাকে কী মানসিক করা যায়, তা নিয়েও কথা চলতে থাকে।
আর এইসব কথায় কথায় রাত্রি বাড়ে। পাতার স্তূপে নিভে আসে আগুন। রাত হলে যে যার ঘরে ফিরে যায়। নৈশ অন্ধকার চিরে রাত্রিচরা পাখি উড়ে যায় এক গাছ হতে অন্য গাছে। গ্রামরাত্রির নিজস্ব ভাষা আছে। আছে সব অপার্থিব শব্দমালা। অন্ধকার ভেঙে সেসব শব্দ সুপ্তির ভিতর আলোড়ন তোলে। তারপর ডুবে যায় নৈঃশব্দ্যের সমুদ্রের ভিতর।
নদীটিও অন্ধকারে পাশ ফিরে শোয়। গর্ভ থেকে সুপ্তিহীন মীনশাবকেরা স্রোতের উপর লাফ দিয়ে চকিত উল্লাসে জলতল ক্ষণিক ক্ষুব্ধ করে পুনরায় গভীরে ডুব দেয়। গর্ভবতী নদীর শিয়রে একা জেগে থাকে চাঁদ। তার আলো স্রোতের বুকের উপর খেলা করে… চাঁদের ছায়া নদীর বুকে পড়ে ভেঙে ভেঙে যায়। এই চাঁদ— আলো দেয় উরাইল বনের মাথাতেও। বাতাসের সঙ্গে কথা বলে। বাতাস তার অবাধ্য প্রেমিক। চাঁদ যতবার মেঘ দিয়ে তার মুখ ঢাকে, বাতাস ততবার সেই মেঘাবরণ সরিয়ে দেয়। সারারাত ধরে চলে এই চাঁদ আর বাতাসের প্রণয়- উপাখ্যান।
রাত শেষ হলে ভোর আসে আচম্বিতে। রাত্রির ব্যাকুলতার পরেই অরুণোদয়। সাতরঙা উত্তরীয় উড়িয়ে সূর্য উঠে আসে নৈরঞ্জনা নদীর গর্ভ থেকে। ধীরে ধীরে জাগে নদীতীরের সেই গ্রাম। প্রথমেই কুক্কুটেরা মন্দ্রস্বরে প্রভাতকে বরণ করে নেয়। গোহালে গোহালে শুরু হয় গাভিদের পরিচর্যা। গ্রামপথের উপর শুরু হয় মানুষের চলাফেরা। নতুন একটা দিন। অন্য দিনের মতোই। কুয়াশায় ঘিরে থাকে গ্রামের সকাল।
এই সেই গ্রাম। এই ভারতবর্ষ বা জম্বুদ্বীপের চিরপদার্থ। এখানে জীবনপ্রবাহের প্রকৃতিগত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। চিরকাল এমনই আছে। এ দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব গ্রামের জীবনচিত্র অল্পই বদলায়। যা পরিবর্তন, সব উপর উপর। গভীরে ডুব দিয়ে দ্যাখো, সেই এক অনাবিল জীবন। আজ যেমন, আড়াই হাজার বছর আগেও তেমনই।
নদীর ঘাটে গ্রামের লোক দাঁতন দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকে। আজ কি ঘাটে এসে ভিড়বে শ্রেষ্ঠীদের বাণিজ্যতরী? বেলা বাড়ে। রৌদ্র প্রখর হয়। বাণিজ্যতরী আসে না। দ্বিপ্রহর স্তব্ধ চোখে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। হাওয়ায় হাওয়ায় গ্রামের পথে ধুলো ওড়ে। পথ দিয়ে ধীরে ধীরে যায় গোযান। সোনালি খড়ের ঘন স্তূপ আঙিনায় জমা হয়ে থাকে। সেই স্তূপের উপর মাটির হাড়ি উলটে বসানো। তার গা বেয়ে নেমে এসেছে শ্যাওলার কস। সারাবছরের খড়। কত কাজে লাগে!
কামারশালায় হাতুড়ি পেটার শব্দ। আগুনে পুড়ে লাল হয়ে যাওয়া লোহার পাতের উপর হাতুড়ির ক্রমাগত আঘাত। এই দিয়ে হবে গো-শকটের চাকার বেড়। চাকা সেই গতির প্রতীক। যেহেতু তা রৈখিক গতি নয়, যেহেতু সেই গতি বৃত্তাকার—তাই, গ্রামজীবন যেন বারবার ঘুরে ঘুরে একই বিন্দুতে ফিরে আসে। হয়তো শুধু গ্রামজীবনই নয়, হয়তো সমগ্র সভ্যতার সেই একই চক্রাকার গতি।
কুমোরশালায় মাটি থেকে গড়ে ওঠে সরা, কলসি, কুম্ভ, ভিক্ষাপাত্র। ঢেঁকির পাড় পড়ে ঢেঁকিশালায়। গ্রামের বৌ-ঝিরা ধান ভানে, চিঁড়ে কোটে, গান গায়। ঘুমপাড়ানি গান। বুকের মধ্যে শুয়ে ঘুমোয় শিশু। নিস্তব্ধ, নির্জন মধ্যাহ্ন
মধ্যাহ্নও ধীরে ধীরে বিবর্ণ অপরাহ্ণের ভিতর নিজেকে হারায়। শুকনো পাতা বিকেলের বাতাসে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে তেঁতুলতলায়। নদীর বাতাস গ্রামঘরের দাওয়ায় দাওয়ায় ঘুরে মরে একা। তারপর সন্ধে আসে বিষণ্নতার রং তুলি দিয়ে আকাশের বুকে অস্তরাগের ছবি এঁকে।
এমনই কোনো সন্ধ্যায় যদি কেউ নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে পরপারের অস্পষ্ট হয়ে আসা উরাইল বনের দিকে তাকিয়ে দেখত, তবে সে হয়তো দেখতে পেত, বনের বহির্ভাগের সেই দেবতা-বৃক্ষের নীচে কে যেন আসন করে বসেছেন ধ্যানে। অন্ধকার কুয়াশার ভিতর তাঁর পরনের গৈরিক কাষায়বস্ত্র দশদিক উজ্জ্বল করে আছে। গ্রামের মানুষ জানে না, তাদের নৈরঞ্জনা নদীটির পরপারে উরুবিল্ব বনের ধারে ইতিহাসের এক অমোঘ মুহূর্ত তৈরি হতে চলেছে।