ঊনপঞ্চাশ
শেষ পর্যন্ত পুলিসের ভ্যান ফিরে এল। অর্ক দেখল সেই অফিসারটি দলে নেই। ভ্যানের আগে একটি জিপও রয়েছে। তাতে জাঁদরেল চেহারার কিছু অফিসার। ভ্যান থেকে নেমে সাধারণ চেহারার পুলিসগুলো যখন লাইন দিয়ে হুকুমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে তখন জিপে আসা অফিসারদের একজন জনতার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে? এখানে এত ভিড় কেন?’
অর্ক খুব অবাক হয়ে গেল। যেন এঁরা কিছুই জানেন না। এতক্ষণ ঘুমুচ্ছিলেন, হঠাৎ আকাশ থেকে টুপ করে কেউ এঁদের এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে। ঈশ্বরপুকুরে সন্ধ্যে থেকে এত কাণ্ড ঘটে গেল, একটি নিরপরাধ মানুষ খুন হল অথচ এঁর মুখ দেখলে মনে হবে ইনি কিছুই জানেন না। তাছাড়া ঈশ্বরপুকুরের এত ভেতরে কেউ খবর না পেয়ে বেড়াতে আসবে না!
সেই সঙ্গে আর একটি জিনিস অর্কর চোখে পড়ল। এতক্ষণ অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে ঈশ্বর পুকুরের জনতা ফুঁসছিল। নুকু ঘোষের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে কয়লাকে ছিঁড়ে ফেলার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। অনেক কষ্টে তাদের সামলে রাখতে হচ্ছিল। সেই মানুষগুলোর চেহারা এখন পাল্টে গিয়েছে। পুলিসদের দেখা মাত্রই প্রত্যেকে যেন একটা করে মুখোশ পরে ফেলেছে এবং সব মুখোশের আদল এক। এই মিইয়ে যাওয়া ভীতু মানুষদের দেখলে কল্পনাই করা যায় না খানিক আগে এরাই তড়পাচ্ছিল। শুধু সাদা পোশাকই ওদের এমন পাল্টে দিল? এইসব পুলিস তো সাধারণ মানুষের ভাই দাদা কিংবা বাবা। অথচ সাধারণ মানুষ এদের দেখলেই ভয় পায়। কেন?
অফিসার আবার বললেন, ‘আমার কথা কানে যাচ্ছে না?’
অর্ক সুবলের দিকে তাকাল। তারপর বারান্দা থেকে দ্রুত নেমে এল জিপের সামনে। জনতাই তাকে পথ করে দিল। অফিসার কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালেন। অর্ক বলল, ‘আমার নাম অর্ক মিত্র। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুরে থাকি। আপনি জানেন না এখানে কি হয়েছে, কেন এত ভিড়?’
অফিসার নির্বোধের মত মাথা নাড়লেন। কিন্তু বোঝা গেল ওটা ওঁর ভান। প্রকৃত বুদ্ধিমান ছাড়া নির্বোধের অভিনয় করা বেশ শক্ত। অর্ক বুঝল কিছু করার উপায় নেই। সে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলল, ‘আমরা দোষীর শাস্তি চাই তাই এই বাড়ি ঘেরাও করে আছি।’
‘বেশ কথা। তাই বলে নিশ্চয়ই আইন নিজের হাতে নিতে চাও না!’
‘না। তাহলে তো এতক্ষণে অন্যরকম হয়ে যেত।’
‘কোন্ পার্টি এটা অর্গানাইজ করছে?’
‘পার্টি? এই বিক্ষোভের সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই।’
‘তাই নাকি? সোনার পাথরবাটিও হয় তাহলে।’ হঠাৎ অফিসারের গলার স্বর পাল্টে গেল, ‘প্যাক আপ! চলে যান, যে যার বাড়িতে চলে যান। রাস্তা পরিষ্কার করে দিন।’
জনতা নড়বড়ে হল। কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন চেঁচাল, ‘মোক্ষবুড়ির খুনী কে? কয়লা কয়লা।’ ব্যস সঙ্গে সঙ্গে জনতার চরিত্র পাল্টে গেল। হঠাৎ মুখোশগুলো অন্য চেহারা নিয়ে নিল। সমস্বরে চিৎকার উঠল, ‘খুনী কয়লার বিচার চাই।’
পুলিস অফিসার তাঁর সঙ্গীর সঙ্গে আলোচনা করলেন। তারপর চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কয়লা খুন করেছে তার প্রমাণ আছে?’
হাজারটা গলায় এক জবাব এল, ‘কয়লা খুন করেছে।’
সঙ্গে সঙ্গে পুলিস অফিসার বললেন, ‘ব্যস, তাহলে তো মিটেই গেল। আমি কয়লাকে গ্রেপ্তার করছি। আপনারা শান্ত হয়ে আমাদের কর্তব্য করতে দিন।’
অফিসারের হুকুম হওয়ামাত্র পুলিসগুলো নুকু ঘোষের বাড়ির দরজা পর্যন্ত লাইন দিয়ে দাঁড়াল। জনতাকে সামান্য দূরে সরিয়ে দিল তারা। ভ্যান এবং জিপটাকে ঘুরিয়ে নেওয়ার পর অফিসার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দরজায় আঘাত করলেন, ‘দরজা খুলুন।’
তিনবার ধাক্কা দেওয়ার পর একটি চাকর গোছের লোককে নিয়ে নুকু ঘোষ দরজা খুলে এসে দাঁড়ালেন, ‘কি চাই?’
অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি নুকু ঘোষ?’
‘তাই তো জানি।’
‘এটা আপনার বাড়ি?’
‘অন্য কারও কিনা তা জানি না।’
‘আপনার বাড়িতে কয়লা এসেছে, তাকে বের করে দিন।’
‘কয়লা? ও নামের কাউকে আমি চিনি না।’
‘কয়লা আপনার বাড়িতে আসেনি?’
নুকু ঘোষ সবেগে মাথা নাড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে দূরে দাঁড়ানো জনতা চিৎকার করে উঠল, ‘এসেছে, কয়লা এসেছে।’
অফিসার আবার বললেন, ‘আপনি মিথ্যে কথা বলছেন নুকুবাবু।’
‘মোটেই না। কয়লা বলে কাউকে আমি চিনি না। আমার বাড়িতে একজন অতিথি এসেছেন, তার নাম শ্রীনবকুমার দত্ত।’
‘তাকেই নিয়ে আসুন।’
‘তাই বলুন। এতক্ষণ কি কয়লা কয়লা করে ধমকাচ্ছিলেন? এই যা, নববাবুকে আসতে বল। পুলিস সাহেব এসেছেন। দিন এমন চিরকাল যাবে না। বদল দিন আসবেই। শালা আমার বাড়িতে হামলা, গাড়িটাও পোড়ানো হয়েছে। বেশ বেশ। সব তোলা থাকছে। কিন্তু অর্গানাইজ করল কে? কোন শালা—।’ চাকরটাকে হুকুম দিয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল নুকু ঘোষ। এইসময় দরজায় কয়লা তার দুজন অনুচর নিয়ে এসে দাঁড়াল। নুকু ঘোষ বলল, ‘এই যে ভাই নব, জনতা চাইছে তোমাকে গ্রেপ্তার, এরা তাই এসেছেন। জনতার সেবক!’ মুখ বেঁকালেন নুকু ঘোষ। কয়লা অফিসারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওয়ারেন্ট আছে?’
সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার শুরু হল। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ কেউ ঢিল ছুঁড়ল এদিকে। হঠাৎ অফিসার কয়লার হাত ধরে টানল, ‘কথা বাড়াবেন না। চলে আসুন।’
পুলিস দিয়ে ঘিরে কয়লা এবং তার দুই সঙ্গীকে ভ্যানে তোলা হল। অর্ক এই প্রথম কয়লাকে দেখল। পরনে ছাই-রঙা সাফারি। গায়ের রঙ মোটেই কয়লার মত নয়। চেহারাতে কোন আহামরি বৈশিষ্ট্য নেই। তবু এই লোকটার ভয়ে বেলগাছিয়া থেকে লেকটাউন আর শ্যামবাজার কাঁপে। অনেকদিন আগে বিলু তাকে বলেছিল, ‘কোলকাতা শহরটা গোটা পাঁচেক মাস্তান ভাগ করে নিয়েছে। তারা শের কা শের। পুলিস বলো আর পার্টি বল কেউ ওদের গায়ে হাত দিতে পারে না।’ কয়লা হল সেরকম একজন।
কয়লাকে যখন ভ্যানে তোলা হচ্ছিল তখন আর একটা জিনিস অর্কর চোখ এড়ায়নি। সেটা হল, কয়লা ভয় পেয়েছে। ওর চোখে বিস্ময় এবং ভয় একসঙ্গে ফুটে উঠেছিল। যেন ভ্যানের ভেতরে উঠে নিশ্চিন্ত হল সে।
পুলিস ভ্যানের পেছন পেছন জনতা ঈশ্বরপুকুর ধরে ট্রাম রাস্তা অবধি বেরিয়ে এল। অর্ক মানুষগুলোকে দেখছিল। কয়লা ধরা পড়েছে দেখে এখন আহ্লাদে আটখানা। ব্যাপারটা যেন স্বপ্নের বাইরে ছিল। কয়লার মত মাস্তানকে পুলিসের ভ্যানে মুখ লুকিয়ে যেতে হচ্ছে, এইটুকুই যেন বিরাট পাওয়া।
সতীশদা দাঁড়িয়ে ছিল তিন নম্বরের সামনে। অর্ককে দেখে বলল, ‘আশা করি কিছুদিন পাড়া ঠাণ্ডা থাকবে। তবে তোমরা যে এভাবে অর্গানাইজ, করতে পারবে ভাবিনি।’
অর্ক বলল, ‘অর্গানাইজ কে করেছে? সবাই তো রেগে গিয়ে জড়ো হল। কিন্তু তাতে কি লাভ হয়েছে জানি না।’
সতীশ হাসল, ‘একথা তোমার কেন মনে হচ্ছে?’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘সব যেন কেমন সাজানো বানানো। প্রথমে যে পুলিস এসেছিল সে কোয়াকে খোঁজ করল কিন্তু কয়লার কথা শুনতেই চাইল না। পরের দলটা যেন ওই ঘটনা জানেই না। আমার মনে হচ্ছে নুকু ঘোষরাই টেলিফোন করে পুলিস আনিয়েছে যাতে কয়লা ভালভাবে গলি থেকে বেরিয়ে যেতে পারে ভ্যানে চেপে। অথচ পাবলিক এসব বুঝল না।’
সতীশদা অর্ককে দেখল। আশেপাশে কেউ নেই যার কানে কথাগুলো যেতে পারে। ছেলেটার বুদ্ধি তাকে চমৎকৃত করেছে বোঝা যাচ্ছিল। তার মনে পড়ল এই ছেলেকে বলা সত্ত্বেও পার্টি অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। অথচ একে পেলে দলের উপকার হত। সতীশদা বলল, ‘অর্ক, কাল বিকেলে একবার অফিসে এসো, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।’
কাল বিকেল? সঙ্গে সঙ্গে অর্ক বাস্তবে ফিরে এল। সে মাথা নাড়ল, ‘না সতীশদা, কাল বিকেলে আমার সময় হবে না।’
সতীশের কপালে ভাঁজ পড়ল। ছেলেটার ওপর ওর বাবার প্রভাব মনে হচ্ছে প্রচণ্ড। তবু সে সরল মুখে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’
‘আমার মা খুব অসুস্থ। হাসপাতালে আছে। কাল অপারেশন হতে পারে।’
‘সেকি! কি হয়েছে ওঁর?’
‘আলসার। অবস্থা ভাল নয়।’
‘কোন হাসপাতাল?’
‘আর জি কর।’
‘ও।’ সতীশদা দু’মুহূর্ত চিন্তা করল, ‘বেশ, কোন প্রয়োজন থাকলে আমাকে বলো। এখন তুমি বাড়ি ফিরে যাও। বিশ্রাম নাও।’
অর্ক হাসবার চেষ্টা করল, ‘আচ্ছা সতীশদা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’
‘বল।’
‘আপনারা সি পি এম করেন, সরকার আপনাদের হাতে, মানুষের উপকার করার কথা বলেন। আপনারা ইচ্ছে করলে এসব বন্ধ করতে পারেন না?’
‘কি সব?’ সতীশদা অবাক হয়ে তাকাল।
‘এই গুণ্ডাবাজি। আমাদের ঈশ্বরপুকুরে চোলাই মদ বিক্রি হয় তিন-চার জায়গায়, সেগুলো খেয়ে প্রকাশ্যে মাতলামি চলে খিস্তিখেউড় হয়। পাঁচ-ছয়জন ছেলে শুধু মুখের জোরে আর ছুরি দেখিয়ে মাস্তানি করে যায়। এদের আপনারা একদিনেই থামিয়ে দিতে পারেন না?’
‘পারি।’
‘তাহলে থামাচ্ছেন না কেন?’
‘এর উত্তরটা আমার জানা নেই! কিংবা বলতে পারো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি এদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয় তাহলে তাদের আমরা সমর্থন করব। আবার এমনও হতে পারে, আমরা এত বড় বড় ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত যে এইসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না।’ যেন নিজেকেই প্রবোধ দিচ্ছে সতীশদা এমন মনে হচ্ছিল। এবং এর মধ্যে যে বিরাট ফাঁকি রয়ে গেছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না অর্কর। সতীশদা অর্কর কাঁধে হাত রাখল, ‘আমি নিজেও সন্তুষ্ট নই অর্ক। কিছু কিছু ব্যাপারে প্রতিবাদ করেছি বলে দলের নেতারা আমাকে খুব ভাল চোখে দেখছেন না। কিন্তু একটা কথা কি জানো, তুমি একা এই দেশে কিছুই করতে পারবে না। দেশ কেন বলছি, এই পাড়াতে কোন ভাল জিনিস তোমার একার পক্ষে করা অসম্ভব। তোমার পেছনে একটা দল চাই, একটা সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি চাই। সি পি এমের কিছু কিছু ত্রুটি আছে। আমরা আমাদের বিরুদ্ধে কোন সমালোচনা সহ্য করতে পারি না। মানছি। কিন্তু ভারতবর্ষে আমরাই হলাম একমাত্র দল যারা একটা নির্দিষ্ট আদর্শে বিশ্বাস করি। সাধারণ মানুষের বাঁচার লড়াইটাকে জোরদার করতে বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মসূচীমত এগোতে চাই। সুতরাং কিছু করতে হলে এই দলে তোমাকে আসতেই হবে। নদীতে তোমার একটা নৌকো দরকার হবে। ফুটো বা পলকা নৌকোর চেয়ে মজবুত নৌকোতেই চড়া বাস্তবসম্মত কাজ। আর নৌকো ছাড়া নদী পার হতে গেলে তোমাকে একা সাঁতরে যেতে হবে। সেটা কতদিন সম্ভব? চারধারে অজস্র হাঙর।’
রাত্রে একদম ঘুমুতে পারল না অর্ক। আজ বিকেল এবং রাত্রের উত্তেজনা তাকে মাধবীলতার কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রেখেছিল। এখন একা হতেই সেই সব ভাবনা আবার ফিরে এল। বস্তির এই ছোট্ট ঘরে আজ মা নেই। মা যদি আর ফিরে না আসে? মোক্ষবুড়ি বলত হাসপাতালে গেলে আর ফিরবে না। ফালতু কথা, কোন যুক্তি নেই। কিন্তু এখন যেন সেটাই বুকের মধ্যে সিরসির করতে লাগল। জলপাইগুড়িতে একটা খবর দেবে? নিজের মনেই মাথা নাড়ল অর্ক। না। মা চায়নি। মা যা চায়নি তা সে করবে না।
অর্ক বিছানা থেকে উঠল। তারপর বাক্সগুলো হাতড়াতে লাগল। মা যেখানে যেখানে টাকা রাখে সেগুলোয় খোঁজ নেবার পর তার হাতে দুশো কুড়ি টাকা জমা হল। এই হল তার সম্পত্তি। এই টাকায় মাকে সারাতে হবে। অবশ্য মায়ের স্কুলের টিচার্সরা বলেছেন তাঁরা খরচ দেবেন। কিন্তু সে কি করবে? অর্কর মনে হচ্ছিল সে যদি আরও দশটা বছর আগে জন্মাতো, যদি—। সে মাথা নাড়ল। কি হতো তাতে? কিছুই হতো না। বি এ এম এ পাশ করে দেড় হাজার টাকা মাইনের চাকরি করত। দুবেলা পেট ভরে খেত। বিয়ে করত। সুখী সুখী ভান করে জীবনটা কাটিয়ে দিত। কিংবা সতীশদার মত এমন রাজনীতি করত যেটা না করলে তার কোন উপায় থাকত না। চারপাশের মানুষেরা সকালে ঘুম থেকে ওঠে আবার রাত্তিরে ঘুমুতে যায়। এর মধ্যে যা যা করে তার একদিনের সঙ্গে আর একদিনের কোন পার্থক্য নেই। রোজ বাজার করে, রোজ ভিড় ঠেলে অফিসে যায়, রোজ অফিস ফেল করে। এর মধ্যে একটার পর একটা দিন কখন ফুরিয়ে যায় খেয়ালও করে না। তারপর বুড়ো হয়, মরেও যায়। এইভাবে বেঁচে থাকার কি মানে? মাকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিল সে একদিন। আশ্চর্য; মা-ও জবাব দেয়নি। আবার ওইভাবে যারা বেঁচে আছে, এই বি এ এম এ পাশ করে চাকরি পেয়ে বিয়ে-থা করে তাদেরও সামর্থ্য অনুযায়ী ইচ্ছে করতে হয়। প্রত্যেকের নিজস্ব চৌহদ্দি তৈরি হয়ে যায় আর তার মধ্যেই মুখ বুজে থাকে। আবার যারা ওসব পাশফাস করে না, রকবাজি গুণ্ডামিতে যৌবনের শুরু করে তারা মাঝেমধ্যে এদের চেয়ে ভাল থাকে আবার খারাপও। কিন্তু ওই নিয়মবদ্ধ লোকগুলো এদের ভয় পায়। এই যেমন কয়লাকে দেখলে জিভ শুকিয়ে যায় তিন-চারটে এম এ পাশ ভদ্রলোকের। মুখ নামিয়ে চলে যাবে তারা। আড়ালে যতই গালাগালি করুক সামনে স্বর বের হবে না।
মা যদি চলে যায় তাহলে সে কি পরিচয় নিয়ে থাকবে? অর্ক আলো নেবালো। মা বলেছিল ভালবাসা থেকে যে বিশ্বাস তা বিয়ের নিয়মের থেকে অনেক বড়। শুধু সেই বিশ্বাসকে অপমান না করার জন্যে মা পরে বিয়ে করেনি। কিন্তু যখন মা সম্পর্ক ভেঙ্গে এল তখন সেই বিশ্বাসটায় অবশ্যই চিড় ধরেছিল। তাই যদি হয় তার জন্ম ভাঁওতা থেকে, বিশ্বাস থেকে নয়। আইন নেই, বিশ্বাস নেই, পৃথিবীতে তার আসাটাই যখন ক্ষণিকের উন্মাদনায় তখন আগামীকালের অস্তিত্বের জন্যে সে কেন এত ভাবছে? মা তো ভাবেনি অর্কর কি হবে? অর্ক কি করবে? তাহলে তার ভাবার কি আছে। বরং একটা দিক থেকে সুবিধেই হল, তার কোন সামাজিক বন্ধন নেই। কোন লৌকিক চক্ষুলজ্জা নেই। সে যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে পৃথিবীতে চলে ফিরে বেড়াবে। মা না থাকলে কোন নিয়মের পরোয়া করবে না।
অর্ক ঘুমুতে পারল না। তার মাথার ভেতরটা ভীষণ হালকা লাগছিল। অথচ ঘুম আসছে না। ওর মনে হল মাকে একবার দেখলে হত। একবার যদি মায়ের মুখ দেখতে পারত তাহলে হয়তো আরাম হতো। যতদিন মা বেঁচে আছে ততদিন অনেক কিছু না থাকলেও একটা ছোট্ট আরাম বেঁচে থাকে। সেই আরামটার জন্যে সে লালায়িত হল। এখন মাঝ রাত পার হতে চলেছে। এই সময় হাসপাতালের দরজা নিশ্চয়ই বন্ধ। কিন্তু তার মন মানছিল না। হেঁটে গেলে মিনিট পনেরর মধ্যে হাসপাতালের দরজায় পৌঁছে যাওয়া যায়। অর্ক ছটফট করল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। কোথাও কোন শব্দ নেই। তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন এখন ভীষণ শান্ত। দরজায় তালা দিয়ে সে গলিতে পা রাখতেই চমকে উঠল। বুকের ভেতর এমনভাবে হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠেছিল যে সহজ হতে সময় লাগল। না, ওটা শুধুই একটা বস্তা। উনুনের কারখানার সামনে ছায়ায় মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু অভ্যস্ত দৃশ্যের মত সে প্রথমে ওটাকেই মোক্ষবুড়ি বলে ভেবেছিল। মোক্ষবুড়ি এখন কোথায়! কি সুন্দর বেঁচে গেল শেষ পর্যন্ত। ওর এই মরে যাওয়াতে আর একটুও খারাপ লাগছে না। এইভাবে পড়ে থাকা, ঘষটে ঘষটে সেঁটে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া বেশ আরামের।
গলির মুখে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। ঠিক মুখে নয় নিমুর দোকানের আড়াল ঘেঁষে দুজন মানুষকে অনভ্যস্ত চোখে দেখল সে। তার উপস্থিতি ওরা টের পায়নি। নিমুর দোকানের পাশে একটা ছোট্ট রক অনেকটা আড়াল নিয়ে রয়ে গেছে। ওখানে নিমু জলের ড্রাম রাখে দিনের বেলায়। রাত্রে সেটা তুলে রাখে দোকানে। এখন নিমুর ঝাঁপ বন্ধ। ঈশ্বরপুকুরে একটি প্রাণীও হাঁটছে না। কিন্তু দুটো মানুষ যে পরস্পরের কাছাকাছি এসেই ছিটকে সরে যাচ্ছে সেটা স্পষ্ট। যে সরছে সে মেয়ে। অর্ক আধা-অন্ধকারে তাদের ঠাওর করতে পারছিল না। তবে এমন প্রকাশ্যে এসব কাজ করার জন্যে ওরা এত সুন্দর সময় বেছে নিয়েছে যে অন্যদিকে তাকানোর ব্যাপারে পুরুষটি নিস্পৃহ ছিল। মেয়েটি কিন্তু তাকে সজাগ করছে আবার কাছেও এগিয়ে যাচ্ছে। পুরুষটি তখন বেশ উন্মত্ত। ওই ছোট্ট রকে সে মেয়েটিকে শুইয়ে দিতে চাইছে। মেয়েটির ব্যবহারে বোঝা যাচ্ছিল চূড়ান্ত কিছুতে সে নারাজ।
অর্ক যে ঠিক গলির মুখে দাঁড়িয়েছে সেদিকে ওদের লক্ষ্য নেই। এবং এক পা এগোতেই অর্ক এদের চিনতে পারল। পেরে চমকে উঠল। লোকটার বয়স পঞ্চাশ তো হবেই। বিড়ি বাঁধে দিনরাত ঝুঁকে ঝুঁকে। সংসার নেই। তিন নম্বরের একটা চিলতে ঘরে থাকে। আর মেয়ে বলে যাকে ভাবছিল তার বয়স কমসে কম পঁয়তাল্লিশ কিন্তু দেখলে আরও বেশী মনে হয়। রোগা, শরীরে সামান্য মাংস নেই, গাল ভাঙা, কিন্তু মুখ-চোখে খুব ঢঙ আছে। অনেকগুলো বাচ্চা আছে বউটার। বউটার স্বামী মাতাল, কর্পোরেশনে কাজ করে।
রেগে যেতে গিয়েও অর্ক হেসে ফেলল। এই মানুষ দুটোর জন্যে পৃথিবীতে কোন ভাল জিনিস অপেক্ষা করে নেই। সারা দিনরাত শুয়ে হতাশ আর একই অভাবের মধ্যে দম বন্ধ করে বেঁচে থাকা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। হিসেব মতন এদের যৌবন গিয়েছে। অথচ এখন দেখলে মনে হবে দুটো সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত বিশ্বচরাচর ভুলে পরস্পরের সান্নিধ্য পেতে ব্যগ্র। তার মানে সমস্ত একঘেয়েমির মধ্যেও মানুষ কখনও কখনও একটু সুখ খুঁজে নিতে পারে। সেটা বৈধ হোক কিংবা অবৈধ।
অর্ক চোখ ফিরিয়ে নিল। বউটি বোধহয় নিজের কাছে হেরে যাচ্ছে। কারণ লোকটি তাকে কোলের ওপর বসিয়ে জড়িয়ে ধরেছে। ছোট্ট রকের ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়ায় ওরা এখন চোখের আড়ালে চলে গেছে অনেকটা। অর্ক স্বস্তি পেল। এতক্ষণ সে পা বাড়াতে পারছিল না। রাস্তায় নামলেই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। ওকে দেখলে ওদের যতটা না লজ্জা তার চেয়ে ওর নিজের যেন বেশী অস্বস্তি। কয়েক পা হাঁটতে না হাঁটতেই একটা গলা শুনতে পেল সে।
লোকটা আসছে। দুটো হাত দুদিকে বাড়ানো। অকথ্য শব্দ ছিটকে ছিটকে উঠছে মুখ থেকে। পরনে একটা ময়লা ধুতি আর শার্ট। বেঁটেখাটো, লিকলিকে চেহারা, যতটা না বয়স তার চেয়ে অনেক বুড়ো দেখাচ্ছে। এতটা রাস্তা যে কিভাবে হেঁটে এল সেটাই বিস্ময়কর। আকণ্ঠ মদ্যপান করে এখন বিশ্বচরাচরের উদ্দেশে যে শব্দ ব্যবহার করছে তা সঞ্চয় করা সহজসাধ্য নয়। রাত্রির এই নির্জনে সেই সব জড়ানো শব্দগুলো ঈশ্বরপুকুরের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করছে না।
অর্কর শরীরে জ্বলুনি শুরু হল। একে মাতাল তার ওপর খিস্তি তার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছিল। এদের কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হয় অল্পবয়সী মাস্তানরা। সে এগিয়ে যাওয়ার আগেই ঘটনাটা ঘটে গেল। তীরের মত ছুটে এল বউটা। এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার ওপর। ‘সারাদিন খাইনি, ঘরে একফোঁটা দানা নেই আর তুমি রাত শেষ করে মদ গিলে ফিরলে! আঃ, মরণও হয় না আমার! হেই ভগবান, গলায় দড়ি দিয়ে টেনে নাও না কেন? ছি ছি ছি।’
আক্রান্ত হওয়ামাত্র লোকটার চেহারা পাল্টে গেল। টান টান হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে সে বউটাকে দেখল, ‘অ্যাই, এখানে কি করছিলি? ঘরের বউ রাস্তায় কেন অ্যা?’
সঙ্গে সঙ্গে বউটা চেঁচালো, ‘মুখ খসে যাবে সন্দেহ করলে। ঝ্যাঁটা মার ঝ্যাঁটা মার অমন পুরুষের মুখে। বউ বাচ্চাকে দ্যাখে না আবার তেজ কি! ওরে, আমি রোজ না দাঁড়িয়ে থাকলে পথ দেখিয়ে ঘরে নিয়ে যেত কে?’
অর্ক বউটার দিকে তাকাতে পারছিল না। হাড়জিরজিরে শরীরটা এখন বীভৎস হয়ে উঠেছে। মুখের চেহারা আহত শেয়ালের মত। চোয়াল দুটো বারংবার ওঠানামা করছে। এই মুখ এবং আচরণের সঙ্গে একটু আগে দেখা দৃশ্যের কোন মিল নেই। কল্পনাতেও কাছাকাছি আসে না। এই বউটা ওই শরীর এবং বয়সে অত প্রেম পায় কোখেকে? এবং এত দ্রুত সেটা মিলিয়ে দিতেও পারে কোন ক্ষমতায়? কিন্তু অর্কর জন্যে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। লোকটি আর একটি অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করে হাত চালাতে বউটি ছিটকে পড়ল ফুটপাথে। লোকটা তখন চেঁচাচ্ছে, ‘কি! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আমি মাল খাই বেশ করি। তোর বাপের পয়সায় খাই! তুই এখানে এত রাত্রে কি করিস আমি জানি না? আমার সঙ্গে শুতে গেলে তোর ঘেন্না করে অ্যাঁ? আমারও করে। শুনে রাখ।’
অর্কর মাথার পোকাটা নড়ে উঠল। সে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মারলেন কেন?’
‘কে শালা তুমি? নদের চাঁদ! মায়ের বয়সী বউ-এর সঙ্গে পেরেম করছ?’ হাত ঘুরিয়ে লোকটা কথা বলতেই অর্ক নিজেকে সামলাতে পারল না। বেধড়ক মারতেই লোকটা ককিয়ে উঠল। তারপর হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। এইবার বউটা ফুটপাথে উঠে বসে চিৎকার শুরু করল, ‘ওরে বাবা রে, মেরে ফেলল রে।’
অর্ক চেঁচালো, ‘চুপ করুন। একটু আগে যা করেছেন আমি দেখেছি।’
সঙ্গে সঙ্গে বউটা মুখ বন্ধ করে সুড়সুড় করে গলির ভেতরে ঢুকে গেল। আর লোকটা কান্না থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘দেখেছ, তুমি দেখেছ?’
অর্ক ওর জামার কলার ধরে টেনে তুলল, ‘আপনি মাল খেয়ে আসেন কেন রোজ? কেন এভাবে খিস্তি করেন?’
‘তোমার বাবার কি? আমি বেশ করি।’
সঙ্গে সঙ্গে চড় মারল অর্ক, ‘এবার মাল খেয়ে এলে জ্যান্ত পুঁতে ফেলব। নিজের বউ বাচ্চা খেতে পায় না, বউ অন্যের সঙ্গে প্রেম করছে আর আপনি মাল খেয়ে পাড়াটাকে নরক করে মাঝরাত্রে ফিরছেন। আপনাদের কাছ থেকে আমরা এইসব শিখব, না?’
‘জ্ঞান মারিও না জ্ঞান মারিও না। মাল না খেলে আমার কোন উপায় নেই। আমি মরে যাব। স্রেফ মরে যাব।’
‘এটা কিভাবে বেঁচে আছেন?’
‘আছি। যা মাইনে পাই আমি মাল না খেলে তাতে কুড়ি দিন চলে দশ দিন উপোস। মাল খেলে দশ দিন যাবে কুড়ি দিন উপোস। আমি তাই মাল খাই। দশ দিন যারা উপোস করতে পারে তারা কুড়ি দিন পারবে।’
‘কত টাকা মাইনে পান আপনি?’
‘কেটেকুটে দুশো টাকা।’
‘এ তো অনেক টাকা।’
‘অনেক টাকা? হ্যাঁ হ্যাঁ। কি নাম বাবা তোমার? ঠিক আছে, দিয়ে দেব তোমার হাতে দুশো টাকা, সারামাস ওদের ভাত খাওয়াতে পারবে? যদি পার তাহলে আমি মদ খাওয়া ছেড়ে দেব। দেব দেব দেব। তিন সত্যি করলাম। অনেক টাকা! তাহলে হিজড়েও মা হয়ে যাবে।’ দুহাতে আকাশ ধরে লোকটা গলিতে ঢুকে গেল পাখির মত।