1 of 2

৪৭. বিকেলে হাসপাতালে মাধবীলতা

 সাতচল্লিশ

বিকেলে হাসপাতালে মাধবীলতার স্কুলের টিচার্সরা এসেছিলেন। তাঁরা দেখলেন মাধবীলতা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। নার্স কথা বলতে নিষেধ করেছিল। মাঝে মাঝে দাঁতে দাঁতে শব্দ হচ্ছে। এবং তখনই অস্ফুটে কিছু যন্ত্রণার শব্দ উচ্চারণ। হঠাৎ যদিও বা চোখ খুলেছে কিন্তু দৃষ্টিতে কাউকে ধরতে পারেনি। যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা অসহায় চোখে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি।

অর্ক এসেছিল চারটের সময়। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল টিচার্সরা না আসা পর্যন্ত। নার্স তাকে জানিয়েছে যে ডাক্তারবাবু ওর খোঁজ করেছেন এবং আজই ভিজিটিং আওয়ার্সের পর যেন সে দেখা করে। নার্স আরও জানিয়েছে, পেশেন্টের অবস্থা ভাল নয়। কিন্তু কি হয়েছে তার বিশদে গেলেন না মহিলা। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব বেশী কথা কোনকালেই বলেন না।

শেষ পর্যন্ত হেডমিস্ট্রেস সৌদামিনী সেনগুপ্তা ইঙ্গিত করে সবাইকে বাইরে নিয়ে এলেন। অর্কর ইচ্ছে করছিল না মায়ের পাশ থেকে উঠে যেতে। এই কয়েক ঘণ্টায় মাধবীলতাকে যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে। ভীষণ ফ্যাকাশে এবং বয়সের তুলনায় যেন অনেক ছেলেমানুষ। শরীরটাকে গুটিয়ে ছোট করে এমনভাবে শুয়ে আছে যে সেই মাধবীলতা বলে চেনা মুশকিল! খুব কষ্ট হচ্ছিল অর্কর। তার ইচ্ছে করছিল মাকে একবার ডাকে, ডেকে জিজ্ঞাসা করে কি প্রয়োজন! এইসময় নীপা মিত্র এসে দাঁড়াল তার পাশে, ‘তোমাকে বড়দি ডাকছেন।’

অর্ক খানিকটা অবাক হল। সে ওইভাবে তাকাতে নীপা বলল, ‘তুমি আমাকে চেন না। তোমার মা আমাকে খুব ভালবাসে। আমায় নীপা,’ বলে একটু ইতস্তত করল নীপা। সম্পর্কে তাকে মাসী বলতে বলা উচিত। কিন্তু এতবড় ছেলের মাসী তার ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। সে কথাটা শেষ করল, ‘আমায় নীপাদি বলো।’

নীপার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখল টিচার্সরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে আছেন। সৌদামিনী তাকে দেখে এগিয়ে এলেন, ‘কোন ডাক্তার দেখছে?’

‘ডাক্তার এস কে দত্তগুপ্ত।’

‘দত্তগুপ্ত। এস কে, এস কে মানে সুধীর?’ সৌদামিনীর চোখ দুটো ছোট হল।

‘জানি না।’

‘এসো তো আমার সঙ্গে। অফিসটা কোথায়?’ হন হন করে সৌদামিনী চললো অফিসরুমে। বাধ্য হয়ে অর্ককে সঙ্গী হতে হল। সৌদামিনীর হাঁটার ভঙ্গীতেই বোঝা যায় তিনি কাউকে বড় একটা কেয়ার করেন না। জেরা করে সৌদামিনী আবিষ্কার করলেন তাঁর ধারণাই ঠিক। এস কে দত্তগুপ্ত তাঁর পরিচিত সুধীর। হেসে বললেন, ‘বদ্যি ডাক্তারকে বদ্যি হয়ে চিনবো না! যাক সুধীর যখন দেখছে তখন আর কোন চিন্তা নেই। আমি তাকে বলে দিচ্ছি। সে কোথায়?’

জানা গেল ডাক্তার তখন শ্যামবাজারের এক নার্সিং হোমে অপারেশন করছেন। নার্সিং হোমের নাম্বার নিয়ে সৌদামিনী পাবলিক টেলিফোনে জানিয়ে দিলেন, ডাক্তারকে যেন খবর দেওয়া হয় তিনি হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন। রিসিভার নামিয়ে রেখে তিনি টিচার্সদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘বুঝতেই পারছ কেস ভাল নয়। তবে ভরসা এই যে একজন চেনা ডাক্তারের হাতে ও আছে। তা তোমরা আর এখানে দাঁড়িয়ে কি করবে! সংসার টংসার আছে, তোমরা বাড়ি চলে যাও।’

নীপা মিত্র হাসল, ‘ওসব বালাই তো আমার নেই বড়দি, আমি থেকে যাই।’ সৌদামিনী সেটা অনুমোদন করতে অন্য টিচার্সরা সুপ্রিয়া করের গাড়িতে ফিরে গেলেন। এবার সৌদামিনী অর্কর দিকে তাকালেন, ‘তোমার মায়ের এই ব্যাপারটা প্রায়ই হত, না?’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘আমি বুঝতে পারিনি কখনও।’

‘চমৎকার ছেলে তো। দ্যাখো নীপা, মা অসুস্থ কিনা তা ছেলে খোঁজ রাখা দরকার বলে মনে করে না।’ সৌদামিনী ঠোঁট ওল্টালেন।

নীপা বলল, ‘ওভাবে বলছেন কেন? ওর মা যদি চেপে থাকে তাহলে ও জানবে কি করে। চিরকাল তো মুখ বুজে সহ্য করে গেল।’

‘রাবিশ! সব শরৎচন্দ্রের নায়িকা হয়ে জন্মেছে। ওই লোকটা এইদিকে তাকিয়ে অমন করছে কেন?’ সৌদামিনীর গলায় সন্দেহ।

অর্ক দেখল সকালের সেই লোকটা দূরে দাঁড়িয়ে তাকে ইশারা করছে। সে বলল, ‘এই লোকটার খুব ক্ষমতা আছে। সকালে মাকে ভরতি করতে সাহায্য করেছিল। কোন দরকার হলেই বলতে বলেছে।’

নীপা মিত্র জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে কাজ করে?’

‘না। এই ওর পেশা।’

‘দালাল।’ সৌদামিনী মাথা নাড়লেন, ‘এদের থেকে দূরে থাকতে হয়। দালালদের কখনও প্রশ্রয় দেবে না। হ্যাঁ, মাধবীলতা কি বাড়িতে টাকা পয়সা রেখেছে?’

‘খুব বেশী নেই, মানে আমি পঞ্চাশ টাকা পেয়েছি।’

‘মাত্তর! ঠিক আছে, ওর খরচ আমি দিচ্ছি আপাতত। পরে হিসাব করা যাবে। একটা বসার জায়গা দ্যাখো তো, এভাবে বকের মত দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।’

সন্ধ্যে হব হব এই সময় ডাক্তার সুধীর দত্তগুপ্ত এলেন। সৌদামিনীর তাঁকে কব্জা করতে বেশী সময় লাগল না। সুধীর বললেন, ‘আপনি? কি ব্যাপার? আমি তো খবর পেয়ে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।’

‘আপনাদের হাতে তো মহাপাপ না করলে কেউ পড়ে না! শুনুন। আমার স্কুলের একটি টিচার খুব অসুস্থ হয়ে আজ ভর্তি হয়েছে। শুনলাম আপনার হাতে রয়েছে। আমি চাই ও সেরে উঠে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরুক।’

সৌদামিনী সুস্পষ্ট হুকুম জারি করলেন।

‘কি নাম বলুন তো? কি কেস? আজ ভর্তি হয়েছে?’

‘মাধবীলতা মিত্র।’ সৌদামিনী জানালেন।

অর্ক শুনছিল। উপাধিটা শোনা মাত্র সে ভাবল প্রতিবাদ করবে। এইসময় ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। দাঁড়ান দেখছি।’

অর্ক বলল, ‘আপনি আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন। নার্স তাই বলল, আমার মায়ের কথা উনি বলছেন। আজ সকালে ভর্তি হয়েছেন। পেটে খুব যন্ত্রণা—।’

এবার সুধীর ডাক্তার চিনতে পারলেন, ‘ওহো!’ তারপর গম্ভীর মুখে সৌদামিনীকে বললেন, ‘আপনার স্কুলে পড়ান মহিলা! মাইনেপত্র দেন না নাকি?’

‘মানে?’

‘ভদ্রমহিলা একদম রক্তশূন্য। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া করেননি। পেটে কিছু একটা বাধিয়েছেন। আজ দুপুরে এক্সরে করা হয়েছে। রিপোর্টটা দেখে আমাকে ঠিক করতে হবে অপারেশন করতে হবে কিনা। কিন্তু লক্ষণ তাই বলছে। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। আমি হাতের কাজগুলো শেষ করে কথা বলছি।’

এক ঘণ্টা পরে জানা গেল মাধবীলতার পেপটিক আলসার হয়েছে। অবস্থা খুবই খারাপের দিকে এবং অবিলম্বে অপারেশন করা দরকার। কিন্তু এরকম অ্যানিমিয়া পেশেন্টকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে বেশ ঝুঁকি রয়েছে। সুধীর দত্তগুপ্ত বললেন, ‘এটাকে আত্মহত্যার কেস ছাড়া আর কি বলব। জেনে শুনে নিজেকে শেষ করা হয়েছে। ওঁকে বাঁচাতে গেলে ঝুঁকি নিতেই হবে।’

নীপা মিত্র বলল, ‘আপনি অপারেশন করুন। যা দরকার আমরা করব।’

ডাক্তার বললেন, ‘মিস্টার মিত্র কোথায়?’

এঁরা কিছু বলার আগেই অর্ক জানাল, ‘উনি বাইরে আছেন। যা বলার আমাকে বলুন। আমিই এখন ওর সব।’

কথাটা বলতে পেরে অর্কর মন হঠাৎ খুশিতে ভরে গেল। ডাক্তার একবার ওর দিকে তাকালে, ‘ঠিক আছে।’

অপারেশন হবে ছত্রিশ ঘণ্টা পরে। এ বাবদ যা যা লাগবে সব জেনে নিলেন সৌদামিনী। এদিন আর কিছুই করার ছিল না। ওরা যখন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসছে তখন অর্কর চোখে পড়ল পরমহংস হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে। ওকে দেখেই প্রায় ছুটে এল সে, ‘কি হয়েছে?’

‘মায়ের খুব অসুখ। অপারেশন করতে হবে।’

‘সেকি! কি হয়েছে?’ পরমহংস হতভম্ব।

‘পেপটিক আলসার। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।’

‘কি আশ্চর্য! এসব কবে হল? আমি তো কিছুই জানি না।’

‘আমিও জানতাম টানতাম না। কালই ধরা পড়ল।’

‘অনিমেষ কোথায়? সে আসেনি?’

‘না।’

‘কেন?’

‘দাদু মারা গেছেন। তাই সেখানেই থেকে যেতে হয়েছে’।

দাদু শব্দটা উচ্চারণ করার মোটেই ইচ্ছে ছিল না অর্কর। কিন্তু এখানে সবার সামনে অন্য কিছু বলার কথা মাথায় আসল না। পরমহংস বলল, ‘কি আশ্চর্য! আমি তো কিছুই জানি না। তুমি যে কাল গিয়েছিলে সে খবর আজ সকালে পেলাম। অফিস থেকে ছুটে আসছি। তোমার পাশের ঘরের একটা মেয়ে বলল যে তোমরা হাসপাতালে এসেছ। অনিমেষকে খবর দেওয়া হয়েছে?’

অর্ক কথা না বলে মাথা নাড়ল।

সৌদামিনী এতক্ষণ একটাও কথা বলেননি। কিন্তু পরমহংসকে একটু বিস্ময়ের চোখেই দেখছিলেন। বেঁটে মোটা শরীর নিয়ে পরমহংস ছটফট করছে। অর্ক এবার পরিচয় করিয়ে দিল, ‘পরমহংস কাকু, এঁরা আমার মায়ের স্কুলের টিচার আর ইনিও।’ বলতে হল না অর্ককে, পরমহংস হাতজোড় করে শেষ করে দিল, ‘ওর মা এবং বিশেষ করে বাবার সহপাঠী, বন্ধু। কি অবস্থা মাধবীলতার?’

সৌদামিনী বললেন, ‘অপারেশন হবে। এখন অবশ্য দেখা করে কোন লাভ নেই। ঘুমের ওষুধ দিয়ে রেখেছে।’

শেষের কথাটার ইঙ্গিত পরমহংস যেন ধরতেই পারল না, ‘না, না। আমি দেখা করতে যাচ্ছিও না। কিন্তু অপারেশন যাতে যত্ন নিয়ে করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের এক ডাক্তার বন্ধু বোধহয় এই হাসপাতালেই—’

সৌদামিনী হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন, ‘ওসব দরকার হবে না। আমার পরিচিত ডাক্তারের কাছেই ও পড়েছে। চিকিৎসার জন্যে যা লাগবে তা আপাতত আমরা দিচ্ছি। আপনারা একটু হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। নীপা, চল, শ্যামবাজার পর্যন্ত একসঙ্গে যাই। ও হ্যাঁ, কাল যদি কোন প্রয়োজন হয় তাহলে স্কুলে দেখা করো। আমি বিকেলে আসব।’

নীপা মাথা নাড়ল। সৌদামিনী এগিয়ে গিয়েছিলেন। নীপা অর্ককে বলল, ‘ভয় পেয়ো না, মা সেরে উঠবেই। কিন্তু তুমি এখন একা থাকবে কি করে?’

অর্ক হাসল, ‘কেন? আমি কি ছেলেমানুষ?’

নীপা অর্কর মুখের দিকে তাকাল। তারপর চলে যাওয়ার আগে বলল, ‘যদি কখনও কোন প্রয়োজন হয় তাহলে আমার কাছে চলে এস। বাইশের এক মুকুন্দ দাস লেনে আমি থাকি। চলি।’

পরমহংস ওঁদের চলে যাওয়া দেখছিল। এবার বলল, ‘অপারেশন ছত্রিশ ঘণ্টা পরে হবে কেন?’

‘জানি না।’

‘ডাক্তারের সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলে ভাল হত। তুমি যাবে একবার আমার সঙ্গে!’

‘আমরা তো এইমাত্র কথা বললাম। উনি পরশু অপারেশন করবেন বলে দিয়েছেন।’

‘কেস কিরকম, কিছু বলল?’ প্রশ্নটা করার সময় পরমহংসর গলা নেমে এল।

‘ভাল নয়।’ অর্ক মুখ নামাল।

পরমহংস অর্কর সঙ্গে বেরিয়ে এল ট্রাম রাস্তায়। কতগুলো জিনিসের কথা অর্কর একদম খেয়ালে ছিল না। ভোরে যখন সে মাধবীলতাকে ভর্তি করতে এসেছিল তখন প্রায় খালি হাতেই এসেছিল। বিকেলে হাসপাতালে গিয়ে একটা তোয়ালে সাবান ইত্যাদি দেখতে পেয়েছে। সৌদামিনী একজন পরিচারিকার ব্যবস্থা করেছেন। এসব তার মাথায় ছিল না। পরমহংস ট্রাম রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই তার খেয়াল হল, সৌদামিনীরাই এসব করেছেন।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা শ্যামবাজারের মোড়ে চলে এল। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘খিদে পেয়েছে তোমার?’

অর্ক বলল, ‘না, থাক।’ সত্যি ওর খিদে বোধটুকুই হচ্ছিল না।

‘থাকবে কেন? এস।’ প্রায় জোর করে ওকে নিয়ে পাঞ্জাবীর কষা মাংসের দোকানে ঢুকল পরমহংস। প্রচণ্ড ভিড় দোকানটায়। তার মধ্যে জায়গা করে নিয়ে বসে খাবারের অর্ডার দিয়ে পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার মায়ের সেন্স আছে তো?’

‘বুঝতে পারছি না। এখন বোধহয় ওরা ওষুধ দিয়েছে।’

‘এরকম একটা অসুখ হচ্ছে তোমরা কেউ টের পাওনি?’

‘না।’

পরমহংস মাথা নাড়ল, ‘জলপাইগুড়ির খবর বল।’

অর্ক পরমহংসর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি খবর?’

পরমহংস কি বুঝল সেই জানে! এই সময় খাবারের প্লেট দিয়ে যেতে সে এগিয়ে দিল, ‘খেয়ে নাও।’

অনেককাল আগে চাঁদার পয়সায় এই দোকানে অর্ক আর বিলু কষা মাংস আর রুটি খেয়েছিল। আজকের মেনু অবিকল তাই। কিন্তু এখন খেতে একদম ভাল লাগছে না। অথচ মুখে দেওয়ার পর সে বুঝল তার খিদে আছে। বয়দের চিৎকার, চারপাশে খাওয়ার শব্দ, মাংসের তীব্র গন্ধ এবং পরমহংসর উপস্থিতি সব মিলিয়ে খিদে সত্ত্বেও অর্ককে নিস্পৃহ করে দিচ্ছিল। কোনরকমে খাওয়া শেষ করে সে বাইরে আসতেই বিলুকে দেখতে পেল। পরমহংস তখন বেসিনে হাত ধুচ্ছিল। বিলু খুব সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচমাথার মোড়ে। চোখাচোখি হতেই বিলু মুখ ফিরিয়ে নিল। অর্ক এক পা এগিয়ে থেমে গেল। বিলু যেন তাকে দেখেও দেখছে না। তার মানে এখন চিনতে চাইছে না বিলু। অর্ক অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিল। মানুষজনের ক্রমাগত যাওয়া আসায় বিলুকে নজরে রাখা মুশকিল। এই সময় পরমহংস টুথপিক ঠোঁটে চেপে বেরিয়ে・এল, ‘শোন, তোমাকে আজ আর বেলগাছিয়ায় ফিরতে হবে না। আমার ওখানে চল।’

‘কেন?’

পরমহংস থতমত হয়ে গেল, ‘কেন মানে? তুমি একা থাকবে কি করে?’

‘থাকতে পারব।’

‘বোকামি করো না, চল।’

‘আমি বোকামি করছি না।’ বলতে বলতে অর্কর খেয়ালে এসে গেল, ‘হাসপাতালে মায়ের ঠিকানা দেওয়া আছে। যদি কোন দরকার হয় তাহলে ওরা ওখানেই খবর দেবে। আমি না থাকলে জানতেও পারব না।’

যুক্তি অস্বীকার করতে পারল না পরমহংস। যদিও তার ইচ্ছে ছিল না অর্ক একা থাকুক। সে বলল, ‘তাহলে বাড়ি চলে যাও। আমি কাল সকাল দশটায় হাসপাতালে যাব। তখন দেখা হবে। তোমার কাছে টাকা আছে?’

অর্ক মাথা নাড়ল, আছে।

পরমহংস এবার অর্কর কাঁধে হাত রাখল, ‘ভয় পেয়েছো? তোমার মা ভাল হয়ে উঠবেই। চলি।’ পরমহংসর শরীর ভূপেন বোস অ্যাভিন্যুর দিকে মিলিয়ে যেতে অর্ক হেসে ফেলল। সমান সমান অথবা দৈর্ঘ্যে বড় মানুষ কাঁধে হাত রাখলে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গী হয়, হয়তো পাওয়াও যায় কিন্তু অত খাটো মানুষ যদি উচিঁয়ে হাত রাখে তাহলে—! সে এবার চট করে বিলুর দিকে তাকাল। বিলু ফুটপাথ ঘেঁষে আরও একটু সরে গেছে।

অর্ক এগিয়ে গেল। বিলু তাকে লুকোতে চাইছে অথচ জায়গাটা ছেড়ে যেতে পারছে না। কারণটা জানতেই হবে। সে বিলুর সামনে এসে দাঁড়াতেই বিলু মাথা নাড়ল, ‘সরে যাও কথা বলো না।’

‘কেন?’ বিলুর মুখভঙ্গী দেখে অর্কর হাসি পাচ্ছিল।

‘একজন আসবে।’

‘কে?’

‘তুমি চিনবে না গুরু। অনেক টাকার ধাক্কা। পরে কথা বলব। এখন সরে যাও।’ বলতে বলতে বিলু দু’পা এগিয়ে গেল, যেন অর্ককে এড়াতে চাইল। আর তখনি একটা ট্যাক্সি উল্টো ফুটপাথে এসে দাঁড়াতেই বিলু ছুটে গেল সেদিকে। অর্ক দেখল ট্যাক্সিতে বসে থাকা আরও দুজন লোকের সঙ্গে বিলু চলে গেল শিয়ালদার দিকে। বিলুর হাবভাব, ট্যাক্সিটার নিঃশব্দে আসা এবং দ্রুত চলে যাওয়া, অর্কর বিশ্বাস হল বিলু খুব বড় অপরাধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে। অনেক টাকার ব্যাপার যখন তখন দায়টা কম নয় নিশ্চয়ই। বিলুর জন্যে খারাপ লাগছিল অর্কর। ও যে একটা অপরাধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। এবং এই অপরাধের ধরন পাড়ার মাস্তানির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জাতের তাতে সন্দেহ নেই।

অর্কর কিছুই ভাল লাগছিল না। সন্ধ্যেটা পেরিয়ে গেছে। সে মোহনলাল স্ট্রিট দিয়ে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে দেশবন্ধু পার্কে এসে গেল। গেটের মুখটায় বেশ জমজমাট। বিশাল মাঠটা অন্ধকার আলোয় মাখামাখি। অর্ক মাঠটা পেরিয়ে একধারে বসল। ঘাসের ওপর অজস্র বাদামের খোলা আর মাথার ওপর অগুনতি তারা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ শরীরে কাঁপুনি এল তার। এই পৃথিবীতে যদি সে একা হয়ে যায়? মা এখন হাসপাতালে, অপারেশনের পর যদি আর না বাঁচে? যাকে এতকাল বাবা বলে জানতো তাকে আর এখন বাবা বলে সে ভাবতেই পারছে না কেন? এতকালের সম্পর্ক, কাছে থাকা, সব এক রাত্রে ভেঙ্গে যেতে পারে? জলপাইগুড়ি থেকে আসার সময় সে মায়ের নির্দেশে সবাইকে প্রণাম করেছিল শুধু বাবাকে ছাড়া। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই মা লক্ষ্য করেছে কিন্তু কিছু বলেনি। মা কি বাবাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলেছে? অর্ক ভাবতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল মায়ের যেমন সে এবং বাবা ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই তেমনি মা এবং সে ছাড়া বাবারও কোন আপন মানুষ নেই। তাহলে?

একটা কাঠি কুড়িয়ে অন্যমনস্ক অর্ক মাটি খুঁড়ছিল। এইসময় তার খেয়াল হল সে একা নেই। খানিক দূরে অনেকেই জোড়ায় জোড়ায় বসে ছিল কিন্তু আরও দুজন খুব কাছেই কখন বসেছে। অন্ধকারে তাদের মুখ চোখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটির উচ্ছ্বসিত হাসি তাকে চমকে দিল। আর তারপরেই কাণ্ডটা ঘটল। তিনটে মানুষ অন্ধকার ফুঁড়ে সেখানে উদয় হল। তাদের একজনের হাতে টর্চ। একজন টিটকিরি দিয়ে বলে উঠল, ‘বাঃ, চমৎকার, ব্লাউজের বোতাম এর মধ্যেই খুলে ফেলেছেন? একেবারে প্রদর্শনী! উঠুন বুক ঢাকুন। থানায় যেতে হবে আপনাদের।’

ছেলেটি, কুঁকড়ে উঠল, ‘কেন? আমরা কি করেছি?’

‘কি করেছ? প্রকাশ্যে অশ্লীলতা করার অপরাধে তোমাদের থানায় যেতে হবে।’

ছেলেটি কাকুতি মিনতি করছিল। অর্ক লক্ষ্য করল মেয়েটি কোন কথা বলছে না। হঠাৎ সে সোজা হয়ে বসল। মেয়েটি অনু না? অনুপমা! বিস্ময় বাড়ল ছেলেটিকে দেখে। সেই হকার ছেলেটি যাকে অনু বিয়ে করেছে। ওরা তো স্বামী-স্ত্রী, কিন্তু এখানে কেন? অর্ক এক লাফে উঠে দাঁড়াতেই টর্চ হাতে লোকটা ছেলেটিকে খিচিয়ে উঠল, ‘ফুর্তি মারার আগে খেয়াল ছিল না, পরের বউকে ভাগিয়ে নিয়ে এসে মজা লুটছ?’

ছেলেটির গলায় প্রতিবাদ করার চেষ্টা, ‘এ পরের বউ না!’

‘ফের মিথ্যে কথা, চল।’ ছেলেটির হাত খপ করে ধরল টর্চওয়ালা।

অর্ক এর মধ্যে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিসগুলো ওকে দেখে দাঁত বের করে হাসল, ‘সব বৃন্দাবন করে ছেড়েছে!’

‘ওদের ছেড়ে দিন।’ অর্ক পুলিসদের দিকে তাকিয়ে হাসল।

‘ছেড়ে দেব, কেন?’

‘ওরা স্বামী-স্ত্রী।’

‘আপনি এদের চেনেন?’

‘চিনি।’

এই সময় একটা পুলিস বলে উঠল, ‘এ শালা নিশ্চয়ই সাকরেদ।’

অর্ক আবার হাসল, ‘ওসব বলে কোন লাভ হবে না। আপনারা ওদের থানায় নিয়ে যেতে চান, চলুন, আমিও যাচ্ছি। এরা যে স্বামী-স্ত্রী তা প্রমাণ করতে কোন অসুবিধে হবে না। আপনারা কেস চান তো অন্য জায়গায় দেখুন।’

‘আপনি থানায় যাবেন?’

‘হ্যাঁ। ডি সি নর্থ আমার মেসোমশাই।’

এবার পুলিসগুলোর মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। একজন বলল, ‘যাঃ শালা। এদের ধরতে অন্য কেস হাতছাড়া হয়ে গেল। ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন এরা স্বামী-স্ত্রী তখন—, তবে যা করছিলেন তা কিন্তু বেআইনী।’

অর্ক দেখল দূরের একটা ঝোপ লক্ষ্য করে ছুটে যাচ্ছে পুলিসগুলো। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি অর্কর হাত চেপে ধরল, ‘আপনি আমাদের চেনেন?’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘চিনি। কিন্তু ডি সি নর্থ আমার কেউ হন না, মিথ্যে বলেছি। না বললে ওরা আপনাদের নিয়ে ঝামেলা করত।’ কথাগুলো বলতে বলতে অর্ক অনুপমার দিকে তাকাচ্ছিল। অনুপমা যে তাকে চিনেছে বোঝা যাচ্ছে কারণ তার মুখ মাটির দিকে নামানো।

ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, ‘কি করে চিনলেন?’

‘আমি ওর পাশের ঘরে থাকি। কিন্তু এখানে আর আপনাদের দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। চলে যান।’

ছেলেটি অনুপমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘আপনিও চলুন না, ওই গেটটা পর্যন্ত গেলেই চলবে।’

মিথ্যে কথাটা বলার পর থেকেই অর্কর অস্বস্তি হচ্ছিল। কোন কিছু চিন্তা না করে ও তখন পুলিসগুলোকে ভোলাতে মিথ্যে বলেছে। খুব বড় ওপরওয়ালার নাম শুনলে ওরা দমে যায় সেটা হাতে হাতে প্রমাণ হল। বিলু ঠিকই বলেছিল। কিন্তু হঠাৎ যদি পুলিসগুলো ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করে মেসোমশাই-এর নাম কি তাহলে সে বলতে পারবে না। অর্কর অস্বস্তির সঙ্গে ভয় মিশল। সে ছেলেটির সঙ্গে গেটের দিকে পা বাড়াল। পেছনে চুপচাপ অনুপমা।

হাঁটতে হাঁটতে অর্কর মন খিঁচিয়ে উঠল। এরা আর জায়গা পেল না ওসব করার। বিয়ে করেছে তবু মাঠের অন্ধকারে এসে পুলিসকে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে। এদের সমর্থনে এগিয়ে যাওয়াই ভুল হয়েছে। তখন পুলিসগুলো এমন গলায় ধমকাচ্ছিল আর অনুপমার মুখের চেহারা যেভাবে চুপসে গিয়েছিল যে সে চুপচাপ বসে থাকতে পারেনি। এখন মনে হচ্ছে সে একটা অন্যায়কে সমর্থন করেছে। প্রকাশ্যে ওসব করা নিশ্চয়ই জঘন্য ব্যাপার নোংরামি। এসব নিয়ে যত ভাবছিল তত উত্তেজিত হচ্ছিল। এই সময় ছেলেটি বলল, ‘সিগারেট খাবেন?’

কথাটা অর্ককে আরও উস্কে দিল। সে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঘুষ দিচ্ছেন?’

‘ঘুষ? মানে?’

‘বোঝেন না? ন্যাকা! না?’

‘বিশ্বাস করুন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘এখানে কি করতে এসেছিলেন? এই মাঠের অন্ধকারে?’

ছেলেটা এবার যেন দমে গেল। সে পলকে অনুপমাকে দেখে নিল। অনুপমার মুখ পাথর, অন্যদিকে ফেরানো। ছেলেটি বলল, ‘আমরা গল্প করছিলাম। আসলে কোন রেস্টুরেন্টে বেশীক্ষণ বসা যায় না, পয়সা খরচ হয়, তাই মাঠে বসেছিলাম।’

‘শুধু বসেছিলেন? তাহলে পুলিসগুলো আপনাদের কাছে গেল কেন?’

ছেলেটি এবার উত্তেজিত হল, ‘ওরা যা বলেছে তার সবটা সত্যি কথা নয়। ওরা বাড়িয়ে বলেছে।’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘আপনারা স্বামী-স্ত্রী। এখানে এসে—।’

এবার ছেলেটি যেন চট করে নিবে গেল। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই জানেন অনু ওর বাবার কাছে আছে।’

‘জানি। কদিনের জন্যে—।’

‘কদিনের জন্যে নয়, আমরা একটাই ঘরে পাঁচজনৈ থাকি। বউ নিয়ে আলাদা শোওয়া তো দূরের কথা একটু গল্প করার সুযোগ পর্যন্ত আমাদের নেই। বাবার কাছে এলেও ওই একই অবস্থা। আলাদা যে ঘর নেব তাও ম্যানেজ করে উঠতে পারছি না। বিশ্বাস করুন, বিয়ে করেও আমরা ঠিক স্বামী-স্ত্রীর মত নেই।’

কথাটা শুনে অর্ক এবার অনুপমার মুখের দিকে তাকাল। অনুপমা এতক্ষণে স্পষ্ট চোখে তাকে দেখছে। একটুও সঙ্কোচ কিংবা লজ্জা অথবা অপরাধবোধ নেই।

অর্ক আর দাঁড়াল না। একটা কথা না বলে সে গেট পেরিয়ে একা একা হন হন করে হাঁটতে লাগল৷ এই প্রথম তার মনে হল পুলিসটার কাছে মিথ্যে কথা বলে সে অন্যায় করেনি। কিন্তু কি অবস্থা, স্বামী-স্ত্রীকে ঘরের ভিড় থেকে বেরিয়ে আসতে হয় মাঠের নির্জনে। এদের জন্যে একটা কষ্ট বুকে মুখ তুলতেই সে দাঁড়িয়ে গেল আচমকা। বাবা এবং মাকে জ্ঞান হবার পর থেকে সে কোনদিন কাছাকাছি দ্যাখেনি। তাদের ওই ছোট্ট একটা ঘরে সে একাই কি ভিড় হয়ে ব্যবধান তৈরি করেছিল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *