চুয়াল্লিশ
খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে অর্ক ছাদের দিকে তাকিয়েছিল। টালিগুলোর মাঝখানে এক ফুটি কাঁচ যার ভেতর দিয়ে ঘরে আলো আসছে। কাঁচটা খোলা, বাইরের কিছুই দেখা যায় না কিন্তু আলো আসে। জন্মাবধি এই ঘরে বাস করে সে অনেকবার ওপরের দিকে তাকিয়েছে কিন্তু কাঁচটাকে নতুনভাবে চোখে পড়ল আজ। এই বস্তি যারা বানিয়েছিল তারাও চেয়েছিল এখানে একটু আলো আসুক।
জলপাইগুড়ি থেকে আসার পর কলকাতাকে তার খুব খারাপ লাগছে। এত চিৎকার, শব্দ আর চারপাশের চেহারা বিকট মনে হচ্ছে। ওখানে তো কিছুই করার ছিল না কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই সেই ঘুঘুর ডাক, গাছপালা আর চুপচাপ বাড়িটাকে অনুভব করতে পারে সে। সঙ্গে সঙ্গে মন খারাপ হয়ে যায়, কিছুই ভাল লাগে না।
অথচ তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন একই রকম রয়েছে। সেই চিৎকার, চেঁচামেচি, হল্লা, খিস্তির ফোয়ারার একটুও কমতি নেই। এসে অবধি নেহাত প্রয়োজন ছাড়া ঘর ছেড়ে বের হয় না অর্ক। মোটামুটি স্থির হয়েছে সে এক্সটার্নাল হিসেবে পরীক্ষা দেবে। পড়ার বইগুলোকে তার এখন খুব একটা খারাপ লাগছে না। যে বিষয়গুলো এতদিন অবোধ্য মনে হত সেগুলো ফিরে আসার পর বেশ সরল সরল বলে মনে হচ্ছে। ফিরে আসার পর মাকে একদম অচেনা মনে হচ্ছে তার। সারাদিন গুম হয়ে থাকে, কথা বললে তবে উত্তর পাওয়া যায়। হঠাৎ যেন অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়ে গেছে মা। চেহারাটা দিনকে দিন ভেঙ্গে পড়ছে। চোখ গর্তে বসেছে! মাঝ রাত্রে মা বিছানায় শুয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। অর্ক ঘুম ভেঙ্গে কাঠ হয়ে শুনেছে সেই কান্না। অনেকবার মনে হয়েছে উঠে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু তখনি বুঝতে পারে সেটা অনুচিত কাজ হবে। মা জানে সে ঘুমিয়ে আছে। এই কান্নাটা বাবার জন্যে কিংবা মায়ের নিজের জন্যেও হতে পারে। সে যে জেনেছে তা জানালে মায়ের লজ্জা বাড়বে ছাড়া কমবে না। অতএব চুপচাপ প্রতিরাত্রে অর্ককে সেটা সহ্য করে যেতে হচ্ছে।
অর্ক বোঝে বাবা মাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অথচ চলে আসার আগের রাত্রে মা স্পষ্ট জানিয়ে এসেছিল যে তাদের মধ্যে আর কোন সম্পর্ক নেই। সেই সময় মায়ের গলা ছিল তীব্র, কথা বলার ভঙ্গীতে ছিল জেদ। আর এখন যে মা রাত্রে একা একা কাঁদে সেই মা অত্যন্ত অসহায়, ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাওয়া মানুষ। অথচ সকালে উঠেই যেন একটা পাথরের মূর্তি স্কুলে চলে যায়। দুপুরে বাড়ি ফিরে আসে মড়ার মত। এ সবের কারণ বাবা। অর্ক অনেকবার ভেবেছে আর বাবা বলবে না। কিন্তু অভ্যেস এমন যে না চাইলেও বাবা শব্দ মনে চলে আসছে। এতগুলো বছর যে মানুষটা এই ঘরে ছিল, ফিরে আসার পর সে আর নেই, নিশ্চয়ই খুব ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। কিন্তু অর্ক নিজে আর কোন টান বোধ করে না। মানুষটা না থাকায় সে কোন অভাব অনুভব করছে না। কিন্তু মা করছে। এই রহস্য অর্ক বুঝতে পারে না। যার সঙ্গে মা নিজে উদ্যোগী হয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করে এল তার জন্যেই কেঁদে মরবে কেন?
হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় অর্ক লাফিয়ে উঠল। বিকেলে পড়াতে যাওয়ার আগে মা বলে গিয়েছিল, ‘পরমহংসকাকুকে যদি পারিস একটা খবর দিস।’ প্রায় ফুরিয়ে আসছে বিকেল। পরমহংসকাকুর কথা মনে হতেই আর একটা মুখ মনে এল। কতদিন দেখা হয়নি। কে জানে, ঊর্মিমালার মনে হয় কি না! কিন্তু এখন এই বিকেলে ওই মুখ মনে পড়া মাত্র অর্কর অন্য রকম অনুভূতি হল। ঊর্মিমালার সঙ্গে জলপাইগুড়ির শান্ত নির্জন বাড়িটার অদ্ভুত মিল আছে।
আজকাল দরজায় দুটো তালা দেওয়া হয়। দুটো তালা পরস্পরকে আঁকড়ে থাকে, দুটো চাবি দুজনের কাছে। অর্ক সেজেগুজে গলিতে পা দিল। ন্যাড়াদের ঘরের সামনে এসে সে অবাক হয়ে অনুপমাকে দেখল। নতুন বউ-এর মত সেজে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে অনুপমা। ওকে দেখে ফিক করে হাসল, ‘তোরা দেশে গিয়েছিলি না?’
অর্ক মাথা নাড়ল। অনুপমা বলল, ‘এসে অবধি দেখছি ঘরে বসে আছিস। তোর বাবা আসেনি?’
অর্ক মাথা নাড়ল আবার! অনুপমাকে একদম অন্যরকম লাগছে। খলবল করে কথা বলছে, একটুও আড়ষ্টতা নেই। বেশ মোটা হয়েছে, চামড়ায় চাকচিক্য এসেছে। অনুপমা বুকের শাড়ি টানল, ‘আমি দুদিনের জন্যে এসেছি। হাজার হোক বাবা ভাই বোন, কিন্তু ও ছাড়তেই চায় না।’ চোখমুখ ঘুরিয়ে কথাগুলো বলতেই অর্ক পা বাড়াল। অনুপমার এত সাজগোজ ওই ঘরে যে মানাচ্ছে না এটা বোধ হয় ও জানে না। অর্কর মনে হল অনুপমা মেয়েটা ভাল নইলে এই অভাবের ঘরে আবার ফিরে আসবে কেন?
গলির মুখে এসে দাঁড়াল সে। এক কোনায় মালের বস্তার মত পড়ে আছে মোক্ষবুড়ি। যেদিন তারা জলপাইগুড়ি থেকে এল সেদিনও চোখে পড়েছিল। মোক্ষবুড়ি আজকাল মুখ তুলে দ্যাখে না। দুই হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে দিনরাত চোখ বন্ধ করে থাকে। কে এল কে গেল জানার যেন দরকার নেই আর। কারও প্রতি টান নেই, কোন দায় নেই, সংজ্ঞাটা মনে পড়তেই অর্ক কেঁপে উঠল। বেজন্মা! মোক্ষবুড়ি রেগে গেলেই বীভৎস স্বরে ওই শব্দটা উচ্চারণ করত। এখন মোক্ষবুড়ির কি সেই অবস্থা? সঙ্গে সঙ্গে সে মাথা নাড়ল। মোক্ষবুড়ি এখন সন্ন্যাসীদের মত, একমাত্র ঈশ্বরের কাছে দায়বদ্ধ। মুখ ফিরিয়ে সে আবার মোক্ষবুড়িকে দেখল। কোনরকম সুখ দুঃখের বাইরে, কিছুই যেন আর স্পর্শ করে না।
ঈশ্বরপুকুর লেন জমজমাট। নিমুর চায়ের দোকানের সামনে বেশ ভিড়। তারস্বরে রেডিও বাজছে। শিবমন্দিরের রকের দিকে তাকাতেই অর্ক বিলুকে দেখতে পেল। একা একা উবু হয়ে বসে সিগারেট খাচ্ছে। ওকে দেখেই সে লাফিয়ে উঠল, ‘আরে তুমি? আও আও।’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘এখন না, একটু কাজ আছে।’
‘আরে ইয়ার, কাজ তো জিন্দেগীভর থাকবে। দুমিনিট বসে যাও। কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম। তুমি যে ফিরে এসেছ তা আমি জানিই না।’
অনুরোধ এড়াতে পারল না অর্ক। ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে রকে বসল। পকেটে দুটো আঙ্গুল ঢুকিয়ে সন্তর্পণে একটা সিগারেট বের করে বিলু সামনে ধরল, ‘নাও গুরু।’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘না। ভাল লাগছে না।’
‘কি ব্যাপার? মনে হচ্ছে খুব পাল্টে গিয়েছ। দেশে কোন নটঘট করে এসেছ নাকি? এইস্যা দেওয়ানা বন গিয়া?’
অর্ক হেসে ফেলল। বিলু বেশ হিন্দী ডায়লগ দিচ্ছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘পাড়ার খবর কি? সব ঠিকঠাক আছে?’
হাত নাড়ল বিলু, ‘পাড়ার খবর আমাকে জিজ্ঞাসা করো না। এসব ধান্দায় আমি নেই। আমি তো পাড়ায় থাকা ছেড়ে দিয়েছি বলতে গেলে। এর জন্যে কিছুটা দায়ী তুমি!’
‘আমি?’
‘হ্যাঁ। খুরকি কিলা মারা যাওয়ার পর কত করে বললাম তোমাকে এক নম্বর হয়ে যেতে তখন শুনলে না। শালা সেদিনের ফড়িং আজকে বাজ হয়ে হোক্কড় মারছে। কি রোয়াব! খুরকি কিলা থাকতে যে শালাকে খুঁজে পাওয়া যেত না সেই শালা আজ পাড়ার টপ রংবাজ।’ মুখ বিকৃত করল বিলু।
‘কে? কার কথা বলছিস?’
‘ওই যে! নিমুর চায়ের দোকান থেকে নামছে।’
অর্ক দেখল কোয়াকে। কোয়া তাহলে ঈশ্বরপুকুর কন্ট্রোল করছে। এই কদিনে কোয়ার জামাকাপড় পাল্টে গিয়েছে। সাফারি স্যুট পরেছে কোয়া, পায়ে নর্থস্টার। হাঁটার ভঙ্গীটাও অন্য রকম। দুজন চামচে রয়েছে পেছনে। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিল কোয়া এমন সময় একটা ট্যাক্সি ওদের পেছনে এসে হর্ন দিল। কোয়ার একটা চামচে হাত বাড়িয়ে ইশারা করল পাশ কাটিয়ে যেতে। ড্রাইভারটা কোন প্রতিবাদ করল না, গাড়ি সামান্য পিছিয়ে নিয়ে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। কোয়ারা মাঝ রাস্তা থেকে এক চুলও নড়ল না। বিলু বলল, “দেখলে গুরু কাণ্ডটা। এইসব করছে আর পাবলিকের কাছে ইমেজ বেড়ে যাচ্ছে। কেউ ওর মুখের ওপর কথা বলতে সাহস পায় না আজকাল। এই জন্যেই পাড়ায় আসি না।’
এই সময় কোয়া শিবমন্দিরের দিকে তাকাল। সঙ্গে তার সিগারেটটা ঠোঁটের বাঁ কোণ থেকে ডান কোণে চলে এল। তারপর হেলতে দুলতে এগিয়ে এল সামনে, ‘আরে বিলু, কেমন আছিস?’
‘চলছে।’ বিলু গম্ভীর মুখে জবাব দিল।
‘আরে এ অক্ক না? ছিপারুস্তম! শুনলাম তোরা কোঠা বাড়িতে উঠে যাচ্ছিস! সেই আবার বস্তিতেই ফিরে আসতে হল?’ হ্যা হ্যা করে হাসল কোয়া।
অর্কর মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছিল। সে নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা করল। এর সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়ে কি লাভ। কোয়া মুখের সামনে হাত নাড়ল, ‘কিরে, বোবা হয়ে গেলি নাকি?’
অর্ক কোয়ার দিকে তাকাল, ‘কোয়া, ভদ্রলোকের মত কথা বল।’
‘ভদ্দরলোক? শালা, কোই হারামি বলতে পারে কে ভদ্রলোক? ভদ্রলোক শেখাতে এসেছে আমাকে? আর একবার বল তোর বাপের বিয়ে দেখিয়ে দেব।’ উত্তেজনায় কোয়া জামার আস্তিন গোটাতে চাইল কিন্তু মোটা কাপড়ের সুটে ভাঁজ পড়ল না।
অর্ক কোয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। সেই চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে কোয়া বলল, ‘তুই আমাকে একদিন পৌঁছিয়েছিলি মনে আছে। আমি সেকথা জিন্দেগীতে ভুলব না। শোন, এ পাড়ায় থাকতে হলে তোকে আমার আণ্ডারে থাকতে হবে। নইলে কোন বাবা তোকে বাঁচাতে পারবে না। এই সব চামচিকে নিয়ে দল গড়লে কোন লাভ হবে না বলে দিলাম।’ হাত বাড়িয়ে বিলুকে দেখিয়ে দিল কোয়া।
অর্ক উঠে দাঁড়াল। ‘তুই আমাকে চিনিস কোয়া। আমি নিজে থেকে কোন ঝামেলায় যেতে চাই না। তুই যদি নিজের ভাল চাস তাহলে আমাকে ঘাঁটাবি না। আর আবার বলছি, যদি আমার সঙ্গে ভবিষ্যতে কথা বলতে চাস তাহলে ভদ্রভাবে কথা বলবি।’
কোয়া কি বুঝল সে-ই জানে। অর্কর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল দুবার। তারপর চামচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লেখা হয়ে গেল। এ শালা ভোগে যাচ্ছে।’ তারপর আবার দলবল নিয়ে ফিরে গেল নিমুর চায়ের দোকানে। ও চলে যাওয়া মাত্র বিলু বলল, ‘শালা এখন থেকেই মাল খাবে। আজকাল নিমুর দোকানে বসেই বাংলু টানে কোয়া।’
‘যাঃ, নিমুর চায়ের দোকানে মদ বিক্রি হয়?’
‘হয় না খায়। আটটায় দোকান বন্ধ হয়ে গেলে একদিন গিয়ে দেখো।’
অর্ক অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘আশ্চর্য! কেউ কোন প্রতিবাদ করে না।’
‘প্রতিবাদ? কোন শালার ঘাড়ে কটা মাথা আছে! তবে তুমি গুরু ওকে অল্পে ছেড়ে দিলে। যদি টাইট দিতে চাও তাহলে আমি তোমার সঙ্গে আছি।’
অর্ক কিছু না বলে রক থেকে নেমে দাঁড়াল, ‘চলি রে, কাজ আছে।’ বিলুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে সোজা হাঁটতে লাগল। এর মধ্যেই সন্ধ্যে নেমেছে। রাস্তায় আলো জ্বলছে। অর্ক ট্রামে চেপে সোজা শোভাবাজারে চলে এল। স্টপেজে পা দিয়েই ওর খেয়াল হল সেই ছেলেগুলোর কথা। আশ্চর্য; আজকে আর বিন্দুমাত্র ভয় করছে না। হয়তো পরমহংস আলাপ করিয়ে দেবার জন্যেই কিংবা এতদিন পার হয়ে যাওয়ার জন্যে সেই বোধটা আর ধারালো নেই। পরমহংসের ঠিকানা খুঁজে পেতে সময় লাগল না। বাড়িটা যে একান্নবর্তী এবং পুরোনো তা সামনে দাঁড়ালেই বোঝা যায়। প্রচুর লোক গুলতানি করছে। একজন প্রৌঢ়কে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, এখানে পরমহংসবাবু থাকেন?’
‘হ্যাঁ। এখন নেই। অফিসে গিয়েছে।’ চটপট জবাব দিয়ে লোকটা সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল, ‘যাই বল না কেন ডন ইজ ডন। তোমাদের গাওস্করের সঙ্গে মূখ ছাড়া কেউ তাঁর তুলনা করবেন না। সে খেলা এই ছোকরা পাবে কোথায়!’
সঙ্গীটি বলল, ‘আপনি ডনের খেলা দেখেছেন?’
‘নিশ্চয়ই। না দেখলে আর ক্রিকেট ছেড়ে দিই?’
‘তার মানে?’
‘এটাও বুঝলে না! নস্যি দাও। হ্যাঁ, তোমাকে যদি কেউ রাবড়ি খাওয়ায় তারপর আর বাতাসা খেতে চাইবে? এ-ও অনেকটা ওই রকম। ডনের খেলা দেখার পর অন্যের খেলা দেখতে গেলে ওই রকম মনে হবে। আর বল করতো লারউড। এইসব মার্শাল ফার্শাল তো তার কাছে শিশু। তাও তো কত কায়দা হয়েছে। মাথায় হেলমেট পরো, হাতে বুকে ব্যাণ্ডেজ বাঁধো, মুখ আড়াল করে খোকাবাবু ব্যাট ধরলেন। ডনের সময় খালি একটা ব্যাট নিয়ে দেড়শ মাইল স্পীডের বল ফেস করতে হতো। গাওস্কর পারবে? ক্যালেণ্ডার হয়ে যেত অ্যাদ্দিনে।’ দু’আঙ্গুলের নস্যিটাকে সশব্দে নাকে চালান করে দিলেন ভদ্রলোক। অর্ক দাঁড়িয়েছিল। ভদ্রলোক যে গতিতে কথা বলে যাচ্ছিলেন তাতে সে সুযোগ পাচ্ছিল না কিছু বলার। নস্যি নেওয়ার ফাঁকে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি কখন ফিরবেন?’
ভদ্রলোকের যেন সংবিৎ এল, ‘কে?’
‘পরমহংসবাবু।’
‘ও, ডু য়ু নো হু ইজ হি? জানো না? আমার ছোট ভাই। দাদা হয়ে তার ওপর খবরদারি করব আমাদের বংশে সে রেওয়াজ নেই। তার ইচ্ছেমতন সে আসবে ইচ্ছেমতন যাবে। আমি জানতে যাব কেন?’ হাঁ করে একটু বাতাস নিলেন ভদ্রলোক, বোধ হয় নস্যিতে নাকের ফুটো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
অর্ক বলল, ‘বেশ। তাহলে বলবেন বেলগাছিয়া থেকে অর্ক এসেছিলো।’
‘মনে থাকলে ববলব।’ ভদ্রলোক ঘুরে দাঁড়ালেন, হ্যাঁ যা বলছিলাম। মহম্মদ নিসারের নাম শুনেছ? বিরাট।’
অর্ক আর দাঁড়াল না। লোকটার ওপর খুব চটে যাচ্ছিল সে। সমানে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর মানুষের ওপর অথচ নিজের ভাই-এর খোঁজখবর রাখে না। এখন পরমহংস কাকু ফিরে এলে এই খবর পেলে হয়। লোকটার গলা শুনলে মনে হয় ঠিক ভুলে যাবে। ট্রামরাস্তার কাছে এসে অর্কর মনে হল ভুল হয়ে গেছে। পরমহংসকাকার বাড়ির কোন মহিলাকে বলে এলে ভাল হত। কিন্তু এখন আর ফিরে যাওয়া যায় না।
অর্ক ঠিক করল ওখানেই সে অপেক্ষা করবে। বাড়িতে যাওয়ার পথ যখন এটাই তখন পরমহংসকাকুর দেখা সে এখানেই পাবে।
ট্রামগুলো আসছে আর চলে যাচ্ছে। বেশ ভিড় এখন ফুটপাথে। একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল অর্কর। মাস্তানগুলোর কাউকেই এখন নজরে পড়ছে না। অর্ক একবার ভাবল সামনের দোকানটায় ঢুকে চা খেলে কেমন হয়? তার পকেটে যে পয়সা আছে ফেরার ট্রাম ভাড়া দিয়েও তিরিশটা বেঁচে থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল জলপাইগুড়িতে খাওয়াদাওয়ার বেশ আরাম ছিল! মত পাল্টালো সে, সামনের সিগারেটের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে ধরালো। নিয়মিত অভ্যেস না থাকায় অস্বস্তি হচ্ছিল, ধোঁয়াটাকে গিলছিল না তাই। হঠাৎ তার মনে এল এটা বেকার। ফালতু পয়সা নষ্ট হল। মায়ের পয়সায় সিগারেট খাওয়ার কোন অধিকার তার নেই। ফেলে দিতে গিয়েও সামলে নিল সে। এখন এটা ফেলে দিলেও পয়সাটা ফেরত আসবে না।
আর এই সময় জুলিয়েনের কথা মনে পড়ল অর্কর। খুব সুন্দর কথা বলে মানুষটা। শুধু অপচয় হয়ে যাচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেশটা। কংগ্রেস সি পি এম কেউ এই দেশের রোগ সারাতে পারবে না যদি দেশের মানুষ না সজাগ হয়। জুলিয়েনের সব কথা অর্ক সেদিন বুঝতে পারেনি। কিন্তু একটা কথা তার মনে লেগে আছে। আমরা তো কখনো আমাদের পাশের মানুষটার সমস্যা বুঝতে চাই না।
চিৎপুরে দাঁড়িয়ে অর্ক মাথা নাড়ল। কথাটা সত্যি। আমরা সব সময় নিজেদের কথাই ভাবি। কেউ অন্য কারো সমস্যার কথা চিন্তা করি না। কংগ্রেস যদি কোন ভাল কাজ করতে যায় তাহলে সি পি এম এসে তার পাশে দাঁড়াবে? কক্ষনো না। আবার সি পি এম-এর বেলাতেও তাই। এত মানুষ সামনে দিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকের কত রকম সমস্যা আছে। অথচ কেউ সে খবর জানে না, জানতে চায় না। জুলিয়েন বলেছিল, অর্ক এখন থেকেই সচেতন হও। বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আলোচনা কর, দেখবে চোখ খুলে যাবে। এই দেশে তোমাদের থাকতে হবে, তাই দেশটাকে নিজের হাতে গড়ে নাও।
হাতে সিগারেটের আগুনের ছাঁকা লাগতেই অর্ক সেটাকে ছুঁড়ে ফেলল। না, এখনও পরমহংসকাকার দেখা নেই। এমনও তো হতে পারে পরমহংসকাকা আজ রাত্রে বাড়িই ফিরল না, সে খামোকা আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। অর্ক হাঁটতে লাগল। তার মনে হল সিগারেট কিনতে গিয়ে সে পয়সাটা বাজে খরচ করেছে। অতএব তার হেঁটে বাড়ি ফিরে ট্রামের ভাড়াটা বাঁচানো উচিত। কতদূর আর হবে, বড় জোর দেড়-দু মাইল।
রাজবল্লভপাড়ার কাছে এসে অর্ক ভাবল গলি দিয়ে চলে যাবে। পাতাল রেল-এর জন্যে বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটা মুশকিল। গলিতে ঢুকতেই ওর বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। নিজের চোখকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। উল্টো দিক দিয়ে ঊর্মিমালা আসছে। পরনে শালোয়ার পাঞ্জাবি, একটা বই বুকের কাছে ভাঁজ করা হাতে, হাসতে হাসতে কথা বলছে। ওর পাশে ছিপছিপে লম্বা একটা ছেলে, চশমা পরা। বছর কুড়ি বয়স হবে তার। ছেলেটিও হাসছে সমানে। ওদের দেখামাত্র অর্কর বুক আনটান করতে লাগল। এত রাত্রে উর্মিমালা এখানে কি করছে ওই ছেলেটার সঙ্গে? কে ছেলেটা? ঊর্মিমালার সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক! যত দেখছে তত এক রকম তেতো স্বাদ মনে ছড়িয়ে পড়ছে। অর্কর মনে হল এখনি তার সামনে থেকে সরে পড়া উচিত। ঊর্মিমালার মুখখামুখি না হওয়াই ভাল। কিন্তু এখানে কোন আড়াল নেই। আচমকা পিছু ফিরলে ওর নজরে পড়ে যাবে সে। অতএব যা হবার সামনাসামনি হোক। যদি পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায় ঊর্মিমালা তো যাক। রাস্তার দিকে মুখ করে অর্ক হাঁটছিল। এবং তখনই সে ঊর্মিমালার গলা শুনতে পেল। মিষ্টি সুরেলা গলা, ‘আরে, আপনি এখানে?’
অর্ক মুখ তুলল। ঊর্মিমালা সুন্দর চোখে তাকে দেখছে, ঠোঁটে আন্তরিক হাসি। ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটি একটু অবাক চোখে তাকিয়ে। অর্ক কথা বলতে গিয়ে দেখল নিজের গলার স্বর অচেনা লাগছে, ‘এই এদিকে একটু এসেছিলাম। ভাল?’
‘এদিকে মান? আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন?’
‘না না।’ অর্ক থেমে গেল। ও বুঝতে পারছিল না কি ভাবে কথা বলবে।
‘বাঃ, আমি মাকে বলছি। আপনি এদিকে এসেও আমাদের বাড়িতে যাননি।’
‘গেলে তো দেখা পেতাম না।’
‘না গেলে জানতেন কি করে?’ আজকে আমাদের একটা ফাংশন ছিল তাই বেরিয়েছিলাম। এই যে এসো তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম অর্ক মিত্র আর এ হল সুমন দত্ত। আমার বন্ধু।’
শেষ শব্দটা শোনা মাত্র অর্ক শক্ত হল। বন্ধু! বন্ধু মানে প্রেমিক? তাহলে ঊর্মিমালার প্রেমিক আছে? ও দেখল সুমন দুই হাত জড়ো করে তাকে নমস্কার করছে। অর্ক সেটা ফিরিয়ে দিল। সুমন বলল, ‘আমি আপনার কথা শুনেছি। মাসীমা আপনার কথা খুব বলেন।’
‘মাসীমা?’
‘আমার মা।’ ঊর্মিমালা হাসলো।
রাগে শরীর জ্বলে গেল হাসিটা দেখে। শালার তাহলে নিয়মিত ওই বাড়িতে যাতায়াত আছে। এই সময় ঊর্মিমালা বলল, ‘আপনাকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে। কি হয়েছে?’
‘কিচ্ছু না। আমি যাই।’
সুমন বলে উঠল, ‘সে কি? আপনার সঙ্গে বাই চান্স আলাপ হয়ে গেল এখনই যাবেন কি? চলুন কোথাও বসে চা খাই।’
অর্ক আবার ঊর্মিমালার দিকে তাকাল, ‘আমি চা খাই না।’
ঊর্মিমালা বলল, তাহলে আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। হেঁটে না গিয়ে ট্রামে ফিরে যাবেন।’
‘না, আমার হাঁটতে ভাল লাগে।’
এই সময় সুমন পকেট হাতড়ালো। তারপর বলল, ‘তোমরা ফয়সালা করে নাও, আমি সিগারেট কিনে আনি।’
সুমন চলে গেলে ঊর্মিমালা বলল, ‘কি ব্যাপার বলুন তো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি রাগ করেছেন?’
সত্যি কথাটা বলতে গিয়েও চেপে গেল অর্ক, ‘বাঃ, রাগ করব কেন? বন্ধুর সঙ্গে বেশ তো বেড়ানো হচ্ছে।’
‘বেড়াচ্ছি না, বাড়ি ফিরছি। আপনিও তো আমার বন্ধু, তাহলে এমন করে বলছেন কেন?’ ঊর্মিমালার মুখে অন্ধকার এল।
‘একটা মেয়ের কতগুলো বন্ধু হয়?’
‘মানে?’
‘মেয়েদের একজনের বেশী বন্ধু থাকা উচিত নয়।’
‘ওমা, কে বলল?’
‘আমার তাই মনে হয়।’
‘ভুল মনে হয়। সুমনকে আমি ক্লাশ ওয়ান থেকে চিনি। ও আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও বন্ধু। আমার বাবাও আমার বন্ধু। আপনি ঠিক ভাবছেন না।’
হঠাৎ অর্ক প্রশ্নটা করে ফেলল, ‘সুমনকে তুমি ভালবাস?’
‘হ্যাঁ। বন্ধুকে না ভালবাসলে বন্ধু হয় কি করে!’
‘না, না। তারও বেশী?’
এবার ঠোঁট কামড়াল ঊর্মিমালা। এবং তখনই সুমন সিগারেট নিয়ে এসে দাঁড়াল সামনে, ‘কি হল? বসা হবে কোথাও?’
ঊর্মিমালা তাকে বলল, ‘না, থাক, আজ আমার বেশ দেরি হয়ে গেছে।’
সুমন বলল, ‘যাচ্চলে! এতক্ষণে মনে পড়ল! ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে পরে আড্ডা মারা যাবে, কেমন, চলি।’
ওরা যাওয়ার জন্যে পথ বাড়াতেই ঊর্মিমালা মুখ ফেরাল, ‘মাসীমাকে আমার কথা বলবেন। আপনারা আমাদের পাড়ায় কবে উঠে আসছেন?’
‘জানি না।’
ঊর্মিমালা হাসল, ‘আপনি আমাকে শেষ যে প্রশ্নটা করেছিলেন তার উত্তর একটাই, না। এলাম।’
ওদের চলে যেতে দেখল অর্ক। বাঁক ঘোরার আগে একবারও উর্মিমালা মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখল না। হঠাৎ নিজের ওপর তার খুব রাগ হয়ে গেল। ঊর্মিমালা তাকে হারিয়ে গেল, আর একবার।