ছেচল্লিশ
তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনের একটা বিশেষ সুবিধে, আপদে বিপদে গাড়ি পেতে অসুবিধে হয় না। বিশেষ করে সকালের দিকটায়। ভোরে এখানে গাড়ি ধোওয়া হয় লাইন দিয়ে। প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভাররা নিমুর দোকানে চা খেতে খেতে সে কাজ তদারকি করে। পরিষ্কার গাড়ি নিয়ে তারা ডিউটি করতে যায় বাবুদের বাড়িতে। অতএব সাতসকালে নির্মলের গাড়িটা পেয়ে গেল অর্ক। তিন নম্বরের কেউ অসুস্থ, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে কিন্তু গাড়ি পাওয়া যাবে না, এ হয় না।
সারা রাত ঠায় জেগে কাটিয়েছে অর্ক। মাধবীলতার মুখে মাঝে মাঝে যন্ত্রণার ছাপ ফুটেছে, শরীর বেঁকেছে, আবার ঘুমে তলিয়ে গেছে। কিন্তু ভোরের দিকে আবার চেতনায় ফিরে এল সে। এবং তখন থেকেই একটা গোঙানি বেরিয়ে আসছে ওর সমস্ত শরীর ছেঁচে। দুহাতে পেট খামচে ধরে সমানে ককিয়ে যাচ্ছে মাধবীলতা। অর্ক ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘মা, খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার? মা!’
মাধবীলতা একবার চোখ মেলে ছেলের দিকে তাকিয়েছিল। ঘোলাটে চোখ। দাঁতে দাঁত। কথা বলতে পারেনি সে। আবার চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বোঝা যায় প্রাণপণে সে যন্ত্রণাটাকে দমাতে চাইছে। লড়াই করার শক্তিটাকে তখনও জিইয়ে রেখেছে। মায়ের শরীরটা যেন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। অর্ক আর অপেক্ষা করেনি। এক ছুটে সে বেরিয়ে এসেছিল নিমুর দোকানের সামনে। তখনও ভাল করে সকাল হয়নি কিন্তু রাতও নেই। নিমুকে ঘটনাটা বলতে নির্মল এগিয়ে এল চায়ের গ্লাস হাতে, ‘কোন হাসপাতালে যাবে? আর জি কর?’
অর্ক ঘাড় নাড়তেই সে বলল, ‘নিয়ে এস।’ তারপর চিৎকার করে যে গাড়ি ধুচ্ছিল তাকে সে নির্দেশ দিল, ‘এখন জল ঢালিস না। হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে ওসব হবে।’
নির্মলকে এর আগে দেখেছে অর্ক। তিন নম্বরের পেছন দিকটায় থাকে। কথা হয়নি কখনও। নির্মল বলল, ‘তোমার মা হেঁটে আসতে পারবে?’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘কোলে করে নিয়ে আসতে হবে।’
‘চল।’ চায়ের গ্লাস নামিয়ে রেখে নির্মল অর্কর সঙ্গী হল, ‘কদিন থেকে হচ্ছে?’ গলিতে পা দিতেই অর্কর নজরে পড়ল মোক্ষবুড়ি প্রায় হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে গলির মুখে। সে নিচু গলায় জবাব দিল, ‘কাল থেকে। ডাক্তারবাবু বললেন আজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে।’
‘লিখে দিয়েছে সে কথা?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে ভাল। নইলে আজকাল ভর্তির ব্যাপারে নানান ফ্যাচাঙ।’ নির্মল বলল।
মায়ের শরীর এত হালকা তা আগে আন্দাজ ছিল না। পাঁজা কোলা করে অর্ক সহজেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে পারল, নির্মলের সাহায্য দরকার হল না। দরজায় তালা দিয়ে দিল নির্মল। বস্তির দু-একজন মানুষ তখন সবে জেগেছে। মাধবীলতা বাইরে বেরিয়ে আসতেই চোখ খুলল। তারপর কোনমতে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায়?’
অর্ক হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘চুপ করে থাকো।’
গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই কিন্তু ভিড়টা জমে গেল। দু-একজনের বদলে ততক্ষণে দশ বারো জন ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। নির্মল গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে হাত লাগাল। সবাই ঝুঁকে পড়ে মাধবীলতাকে দেখছে। নিমুর দোকানে যারা চা খাচ্ছিল তারাও নেমে এসেছে। কিন্তু কারো মুখে কোন শব্দ নেই। মায়ের মাথাটা কোলে নিয়ে অর্ক পেছনে বসতেই নির্মল দরজা বন্ধ করে ড্রাইভারের আসনে বসতে গেল। আর তখনি মোক্ষবুড়ির ভাঙ্গা গলা ছিটকে এল, ‘কৈ গেল?’
সবকটা মানুষ অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকাল। মায়ের মাথা কোলে নিয়ে অর্ক জানলা দিয়ে দেখল মোক্ষবুড়ি উবু হয়ে বসে অন্ধচোখে দেখতে চেষ্টা করছে শূন্যে হাত নেড়ে, ‘কে গেল, কাকে নিয়ে গেল? বল না তোমরা?’
কেউ পাশ দিয়ে গেলে মোক্ষবুড়ি বলত, কে যায়? কিন্তু এখন এই মুহূর্তে ‘কে গেল’ প্রশ্নটা যে মানে বোঝাল তাতে শিউরে উঠল অর্ক। কেউ একজন জবাব দিল, ‘অর্কর মা হাসপাতালে যাচ্ছে, অসুখ।’
‘অ হাসপাতালে! কার মা?’
‘অর্কর।’
‘অ্যাঁ। মাস্টারনি? মাস্টারনিও হাসপাতালে চলল।’ বলতে বলতে বুড়ি ডুকরে উঠল, ‘আমাকে ছোঁবে না রে। এই গুখেগোর ব্যাটা, অ্যাই ঢ্যামনা, সবাইকে নিচ্ছিস আমাকে নিবি না কেন? ও মাস্টারনি তুমি গেলে আমাকে খেতে দেবে কে? এই যে অ্যাদ্দিন ছিলে না কেউ কি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে আমি কি খেয়ে আছি!’
শুরু করে কান্না ধরতেই নির্মল গাড়ি ছেড়ে বলল, ‘যত অযাত্রা। শালা বুড়িটা মরেও না।’
অর্ক পাথরের মত বসেছিল। ওর চোখের ওপর চট করে হেমলতার মুখ ভেসে উঠল। মহীতোষ মারা যাওয়ার সময় হেমলতা ঠিক এই গলায় ভগবানের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। ভাষাটা আলাদা কিন্তু ভাবটা একই। সে দুহাতে মাধবীলতাকে জড়িয়ে ধরতেই শুনতে পেল, ‘কি হল?’
মাধবীলতা চোখ মেলেছে, যেন চেতনা পরিষ্কার হচ্ছে, জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিস?’
অর্ক কান্না চাপতে নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। কথা বলতে গেলে কি হবে সে যেন অনুমান করতে পারছিল। মাধবীলতার হাত ছেলের কনুই স্পর্শ করল, ‘তুই অমন করছিস কেন? হাসপাতালে তো মানুষ রোগ সারাতেই যায়!’
কথাগুলো এখন অনেক স্পষ্ট।
গাড়িটা খুব জোরে চালাচ্ছে না নির্মল। কিন্তু বাইরের পৃথিবীটা যেন ছায়ার মত চোখের অগোচরে থেকে যাচ্ছিল অর্কর। কোনরকমে কান্নাটাকে গিলে সে অভিযোগ করল, ‘অসুখটা তুমি ইচ্ছে করে বাধিয়েছ!’
‘ইচ্ছে করে?’ মাধবীলতা হাসবার চেষ্টা করল, ‘না বাধালে তোর এত সেবা পেতাম? তুই আমার কত ভাল ছেলে।’ বলতে বলতে তার চোখ বন্ধ হল আবার। অর্ক বুঝল মায়ের যন্ত্রণাটা ফিরে আসছে ঢেউ-এর মত। সমস্ত শরীর কুঁকড়ে উঠছে। দুটো হাত দিয়ে পেট খিমচে ধরেছে মাধবীলতা। অর্ক এবার হু হু করে কেঁদে ফেলল, নিঃশব্দে।
গাড়িটা থামিয়ে ঘুরে এল নির্মল, ‘অ্যাই, তুমি ছেলেমানুষ নাকি? ওঁকে নামাতে হবে। দাঁড়াও, আমি একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসি।’
অর্ক চোখ মুছল। আবার গোঙানি আরম্ভ হয়েছে মাধবীলতার। অর্কর কোলে মাথাটা এপাশ ওপাশ করছে। হাসপাতালের চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। এইসময় নির্মল দুজন লোককে নিয়ে ফিরে এল। লোকগুলো পেশাদার হাতে মাধবীলতাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে ভেতরে নিয়ে যেতে নির্মল বলল, ‘চল ভর্তির কাজগুলো সেরে নিই।’
নির্মলের যে এই হাসপাতালে কিঞ্চিৎ জানাশোনা আছে সেটা বোঝা গেল। ডাক্তারবাবুর চিঠিতে যতটা না কাজ হতো নির্মলের তদ্বিরে তার চেয়ে অনেক দ্রুত হল। আর জি কর হাসপাতালে একটা বিছানা পেয়ে গেল মাধবীলতা। নির্মলকে ডিউটিতে যেতে হবে বলে সে কিছুক্ষণ বাদেই গাড়ি নিয়ে ফিরে গেল। অর্ক দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। ডাক্তারবাবু দেখেশুনে বলবেন কোন ওষুধপত্র লাগবে কিনা।
বাড়ি থেকে বেরুবার সময় অর্ক যা টাকা সামনে পেয়েছিল তাই তুলে নিয়ে এসেছিল। ওষুধ কেনার জন্যে কত টাকা লাগবে তা সে অনুমান করতে পারছে না। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখছিল। এর আগে বিলাস সোমের সময়ে যে অবস্থায় সে হাসপাতালটাকে দেখে গিয়েছে এখনও সেই অবস্থায় রয়েছে। ন’টার আগে ডাক্তারবাবু রাউণ্ডে বের হবেন না। ততক্ষণ কিছুই করার নেই। সে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এল। এবং তখনই তার মনে হল এই পৃথিবীতে সে একা। আজ দিনে কিংবা রাত্রে তাকে শাসন অথবা ভালবাসার মত মানুষ কেউ ধারে কাছে নেই। কারো সঙ্গে পরামর্শ কিংবা কারো কাছে একটু সাহায্য আশা করা যাবে না। এইসময় তার মনে পড়ল পরমহংসকে। কাল সন্ধ্যায় খবর দিয়ে এসেছিল, সে খবর পেয়েছে কিনা কে জানে। কিন্তু এই মানুষটির ওপর আর কতটা নির্ভর করা যায়? শেষ পর্যন্ত একটা একরোখা ভাব জোর করে টেনে আনল অর্ক। যা হবার তা হবে, সে তো আর বাচ্চা ছেলে নয়। মাকে যেমন করেই হোক সারিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এবং তখনই সে জলপাইগুড়ি প্রসঙ্গটি মন থেকে সরাসরি বাদ দিয়ে দিল। যে মানুষটার জন্যে মায়ের এই অবস্থা তাকে খবর দেওয়ার কোন কারণ নেই।
হাসপাতালের এক কোণে ছোটখাটো ভিড়। সেখানে চা বিক্রি হচ্ছে। কাল রাত্রে পাঁউরুটিটা খাওয়া হয়নি। খিদেটা হঠাৎই টের পেয়ে অর্ক এগিয়ে গেল। চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে সে একটা সিগারেট কিনল। তারপর পাশের একটা বারান্দায় আরাম করে বসল।
সিগারেট খেতে তার এমনিতে ভাল লাগে না কিন্তু এখন বেশ লাগল। দেখতে দেখতে অতবড় সিগারেটটা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। খুব সাবধানে টান দিচ্ছিল অর্ক যাতে ছাইটা না ভাঙ্গে। আগুনটা যত নেমে আসছে তত সিগারেটের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। হালকা ছাইটা লম্বা হয়ে একটু বেঁকে আছে। দুই আঙ্গুলে সেটাকে ধরে রেখেছিল অর্ক। শেষের দিকে আর টান দিতে সে ভরসা পাচ্ছিল না। এখন একটু নড়াচড়া হলে ছাইটা নির্ঘাৎ পড়ে যাবে। অথচ এখন ধোঁয়া টানতেও ইচ্ছে করছে। অর্ক সাবধানে ওটাকে ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসতেই ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ল এতক্ষণের বাঁচানো ছাই। নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে সে ছুঁড়ে ফেলল সিগারেটটা, আর টানল না।
‘পারলে না ভাই?’
অর্ক মুখ ফিরিয়ে দেখল একটু পাকা দাড়ি শুড্যা ওর দিকে তাকিয়ে কুতকুতে হাসছে। এবার এগিয়ে এল লোকটা, ‘হয় না, দুকূল রাখা যায় না। ছাইটা হল গিয়ে তোমার স্মৃতি আর আগুনটা হল বর্তমান। তা কি উদ্দেশ্যে আগমন তব, বলে ফেল।’
অর্ক দেখল খুবই সাধারণ জামাকাপড় লোকটার পরনে। কথাবার্তায় কেমন যেন রহস্য, একটু যাত্রা যাত্রা ধরন আছে। সে পরিষ্কার জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কে?’
লোকটা হাসল। সামান্য হাত বোলানো দাড়িতে। তারপর বলল, ‘মুশকিল আসান। সব মুশকিলের আসান করি আমি। শুধু এই হাসপাতালের মুশকিলগুলো কিন্তু। আছে তোমার কোন মুশকিল, বলে ফেল, আসান করে দিচ্ছি। তবে হ্যাঁ, যদি বল কারো প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে, পারব না। যদি বল কাউকে মারতে হবে, পারব। কিছু বুঝলে? কি বুঝলে?’
‘আমি কিছুই বুঝলাম না।’
লোকটা বলল, ‘একটা সিগারেট দাও বুঝিয়ে দিচ্ছি।’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘আমার কাছে সিগারেট নেই।’
ছোট চোখে লোকটা যেন অর্ককে জরিপ করল। তারপর বলল, ‘সাবাস। আমার ব্যবসাক্ষেত্র হল এই হাসপাতাল। মানুষ এখানে রোজ আসছে বিপদে পড়ে। কিন্তু এলেই তো আর কাজ হয় না, আমি সেই কাজগুলো করিয়ে দিয়ে দুটো পয়সা পকেটে পুরি। তোমার কি কেস? কাউকে ভর্তি করতে হবে? কেবিন চাই? এক্সরে করাতে হবে? পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এক্ষুনি দরকার। সব এই শর্মার হাতে। পনের বছর ধরে লাইন ঠিক রেখে চলছি ভাই। শুধু ওষুধ পাচারটা করি না কিন্তু দুনম্বর ওষুধের ব্যবস্থাটা করে দিই।’
‘দুনম্বর ওষুধ?’
‘বুঝলে না? ধরো তোমাকে ওরা একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিল। একশ টাকার ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে। তুমি আমাকে ষাট টাকা দাও, ওগুলো এই হাসপাতালেই পাওয়া যাবে। এবার বুঝলে? না, চা সিগারেট ছাড়া এত কথা হয় না।’ লোকটা পাকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে পাশ ফিরছিল কিন্তু অর্ক তাকে ডাকল। সে বুঝতে পারছিল লোকটা একটা দালাল, হয়তো চারশো বিশ কিন্তু ওর বলার ধরনটা তার ভাল লাগছিল। একটা সিগারেট কিনে এনে লোকটার হাতে দিয়ে বলল, ‘আমার কাছে দেশলাই নেই।’
‘আমিও রাখি না।’ বলে দড়ি থেকে ধরিয়ে বলল, ‘এই হাসপাতালের গেট পেরিয়ে এলে আমি আর নিজের পয়সায় কিছু খাই না। তা সমস্যাটা কি?’
অর্ক ইতস্তত করে বলে ফেলল, ‘আমার মায়ের খুব অসুখ। পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে! এইমাত্র এখানে ভর্তি করেছি।’
‘বেড পেয়েছে?’
‘মনে হয় পেয়েছে। ভেতরে নিয়ে গেল ওরা।’
‘নিয়ে গেলেই যে পাবে তার কোন মানে নেই। মেঝেতে ফেলে রাখতে পারে। নটার ডাক্তার আসার আগে টেঁসে যেতে পারে। আহা, ওভাবে তাকিও না। বাড়িতে তোমার মা কিন্তু এখানে তো পেশেন্ট। কেসটা নেব?’
অর্ক কি বলবে বুঝতে পারছিল না। নির্মল যেভাবে ব্যবস্থা করে গেল তাতে মনে হচ্ছিল এখন আর কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু এই লোকটার কথা শুনে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সে অসহায় গলায় বলল, ‘দেখুন, আমার কাছে বেশী পয়সা নেই। আপনি যা ভাল মনে করেন তাই করুন।’
‘পেশেন্টের নাম কি?’
‘মাধবীলতা।’ নামটা বলে অর্ক আবার উচ্চারণ করল, ‘মাধবীলতা দেবী।’
‘এখানে দাঁড়াও, আমি ঘুরে আসছি।’ সিগারেট খেতে খেতে লোকটা বারান্দায় উঠে গেল। অর্ক দেখল সেখানে দাঁড়িয়ে গাঁজা টানার ভঙ্গীতে দুই টানে পুরো সিগারেট শেষ করে সে ভেতরে ঢুকে গেল স্বচ্ছন্দে। অথচ এখন ভিজিটার্সদের ভেতরে যেতে দেওয়া হয় না। লোকটাকে কেউ আটকাল না।
বেলা যত বাড়ছে হাসপাতালে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পরে লোকটাকে দেখতে পেল সে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইশারা করে তাকে ডাকলে। কাছে যেতেই তাকে বলল, ‘মাটিতে ফেলে রেখেছিল, ফ্রি বেড নেই। পেয়িং বেড নেবে তো ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’
অর্ক ঘাড় নাড়ল। সে জানে না পেয়িং বেডে কত টাকা লাগে, কিন্তু মা মাটিতে পড়ে আছে এটা সে ভাবতে পারছিল না। ঘণ্টাখানেক বাদে লোকটা আবার ফিরে এল, ‘যাক, ব্যবস্থা হয়েছে। কেস মনে হচ্ছে ভাল না। সন্ধ্যের আগে চিন্তা করার কোন মানে হয় না। তার আগে তোমাকে আর দরকার হবে না। এখন আমার সঙ্গে অফিসে এসে, বাবু ডাকছে।’
এগারটা নাগাদ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল অর্ক। মাধবীলতা পেয়িং বেডে ভর্তি হয়েছে। ভাক্তার তাকে দেখেছেন। কিন্তু দেখে তিনি কি বুঝেছেন তা সে জানতে পারেনি। লোকটা তাকে বলেছিল, ‘তুমি গরীব মানুষ, তোমার কাছে বেশী নেবো না। তবে এ লাইনে বিনিপয়সায় কোন কাজ করতে নেই। তুমি তাই আমাকে পাঁচটা টাকা দাও, আমি তোমার মায়ের ওপর নজর রাখব।’ হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল লোকটা। অর্ক না দিয়ে পারেনি। এতক্ষণে তার বিশ্বাস হচ্ছিল মায়ের জন্য লোকটা অনেক করেছে।
হাঁটতে হাঁটতে অর্কর মন তেতো হয়ে উঠল। শালা এই হল হাসপাতাল? একটা লোক অসুস্থ হয়ে এলে তার যত্ন হবে না যদি না সে বড় লোক হয় কিংবা তার কোন দালাল না থাকে? এটা নাকি গণতান্ত্রিক দেশ! সকলের সমান অধিকার আছে? বিলাস সোম যে আরামে এখানে থাকতো তার মা সেই আরাম পাবে না কেন? কেন ওরা ভিখিরির মত মেঝেতে ফেলে রেখেছিল? অর্কর মনে হচ্ছিল তার হাতে যদি ক্ষমতা আসতো তাহলে এরকমটা হতে দিত না। যারা পার্টি করে তারা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না কেন?
বাসস্ট্যাণ্ডে এসে অর্ক অসহায় চোখে তাকাল। এত ভিড় যে দরজা পর্যন্ত খোলা যাচ্ছে না। অফিসে ছুটছে মানুষেরা মনুষ্যত্ব হারিয়ে ছাগলরাও বোধ হয় এর চেয়ে আরামে যায়। এরকম দৃশ্য দেখতে অর্ক অভ্যস্ত, কিন্তু আজ যেন নতুন করে এটা চোখে পড়ল। এই যে জন্তুর মত যাওয়া আসা তাতে কারো কোন ক্ষোভ নেই। সবাই এটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। অর্কর ইচ্ছে করছিল বাসটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সবাইকে বলে ওভাবে যাবেন না। প্রতিবাদ করুন। সবাই মিলে প্রতিবাদ করলে ওরা আমাদের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেবেই। কিন্তু অর্ক কিছুই করতে পারল না। ঝুলন্ত মানুষগুলোকে প্রায় উড়ে যেতে দেখল সে। আর তখনই তার মনে হল ‘ওরা’ বলতে সে কাদের কথা ভাবছে? যারা সরকার চালায়? তাদের তো সাধারণ মানুষই ভোট দিয়ে পাঠায় ও খারাপ কাজ করলে সাধারণ মানুষই তাদের বাতিল করে অন্য দলকে সমর্থন করে। তবু অবস্থার হেরফের হয় না কেন? তাহলে কি সাধারণ মানুষ যদ্দিন সরকার তৈরি করছে তদ্দিন এরকম আর কষ্ট আর অবিচার চলবে?
ঠিক সেই সময় চোখের ওপর কাণ্ডটা ঘটল। খালপাড় থেকে একটা মালবোঝাই লরি আসছিল। পুলের কাছে যে ট্রাফিক পুলিসটা দাঁড়িয়েছিল সে লরিটাকে আটকালো। প্রচণ্ড তর্কাতর্কি হচ্ছে ড্রাইভার আর পুলিসটার মধ্যে। দুপাশের গাড়িঘোড়া রাস্তা বন্ধ থাকায় দাঁড়িয়ে গেছে। অফিসযাত্রীরা বেশ অসহিষ্ণু গলায় চেঁচাচ্ছে। পুলিসটা হাত বাড়িয়েই আছে। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই তার। শেষ পর্যন্ত ড্রাইভার একটা আধুলি ছুঁড়ে দিতে পুলিস লরি ছেড়ে দিল। আধুলিটা পিচের রাস্তায় গড়িয়ে এদিকে চলে আসছিল। পুলিস দৌড়ে আসছে ওটাকে ধরবার জন্য। বাসযাত্রীরা এবার হো হো করে হাসল, ‘শালা মাল নেবার জন্য জ্যাম করালো।’
চকিতে অর্ক এগিয়ে গেল। আধুলিটা মুঠোয় নিয়ে সে পুলিসটার দিকে কটমটে চোখে তাকাল। পুলিস সেটা একদম লক্ষ্য না করে নিঃশব্দে হাত বাড়াল তার দিকে। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘কি চাই?’
‘হামারা পয়সা।’
‘ওটা তোমার পয়সা?’
‘হ্যাঁ। হামলোককা মিলতা হ্যায়।’
হঠাৎ অর্কর মাথা গরম হয়ে উঠল, ‘মারব শালা এক থাপ্পড়। সবার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুষ নিচ্ছে আবার বলছে মিলতা হ্যায়।’
পুলিসটা যেন থতমত হয়ে গেল। একবার হলদে দাঁত বের করে হাসবার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত হন হন করে ফিরে গেল ডানলপের বাক্সের ওপর। তারপরে সদর্পে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল সে। কিন্তু অর্ক দেখল লোকটা তাকে আড়চোখে লক্ষ্য করছে। ওকে দেখিয়ে অর্ক একটা ভিখিরি বুড়িকে ডেকে আধুলিটা তুলে দিল তার হাতে। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে এল শ্যামবাজারের মোড়ে।
এতক্ষণে তার উত্তেজনা কমে এসেছিল। ভীষণ অবসাদ লাগছিল এখন। পেটের ভেতরটা কনকন করছে কিন্তু খিদে বোধটুকু পর্যন্ত হচ্ছে না। অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না কোথায় যাওয়া যায়! তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে ফিরে যেতে একটুও ইচ্ছে করছিল না তার। একা ওই ঘরে থাকা অসম্ভব।
মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। ওর কাছে এখন গোটা পঞ্চাশেক পড়ে আছে। ভোরে মাকে নিয়ে আসার সময় এটাই এনেছিল সে। ঘরে মায়ের জমানো টাকা কিছু আছে কিনা জানা নেই। অবশ্য জলপাইগুড়ি থেকে ঘুরে আসার পর মায়ের হাতে টাকা না থাকাই স্বাভাবিক। কোথায় টাকার জন্য যাওয়া যায়? প্রথমেই মনে পড়ল তার মাধবীলতার স্কুলের কথা। সেখানে গিয়ে মায়ের অসুস্থতার খবর দেওয়া দরকার। দিলে নিশ্চয়ই কিছু টাকার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল খবর দেওয়া এক কথা আর টাকা চাওয়া—সেটা সম্মানের হবে কি? ওরা ভাবতে পারে যে এমন ছেলে যে মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে না। অবশ্য মায়ের যদি চিকিৎসা বাবদ কোন টাকা স্কুল থেকে পাওনা হয় তাহলে আলাদা কথা। এই ব্যাপারটা সে কিছুই জানে না। তবে খবরটা দিতে হবে।
এছাড়া আর কোত্থেকে টাকা পাওয়া যাবে? পরমহংসের মুখ মনে পড়ল তার। মায়ের অসুখের খবর পেলে পরমহংসকাকু নিশ্চয়ই কিছু সাহায্য করবে। এছাড়া? হঠাৎ তার মনে বিলাস সোমের মুখটা ভেসে এল। লোকটা বড়লোক। গিয়ে দাঁড়ালে কি ফিরিয়ে দেবে? তাছাড়া সে লোকটার দুর্বলতা জানে। ধ্যুৎ, ওটা একদম চারশো বিশি কারবার হবে। নিজের মনে মাথা নাড়ল সে।
স্কুল থেকে বেরিয়ে অর্ক কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে রইল। মাকে যে এঁরা এতটা ভালবাসেন তা সে অনুমান করতে পারেনি। হেডমিসট্রেসকে খবরটা দেওয়ামাত্র হইচই পড়ে গেল যেন। অন্য টিচাররা ছুটে এলেন। এতক্ষণ ধরে অর্ককে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছেন ওঁরা মাধবীলতা কেমন আছে। কি হয়েছে তা স্পষ্ট করে না বলতে পারলেও উপসর্গ জেনে এক একজন এক একটা রোগের নাম করেছে। বিকেলে কখন গেলে দেখতে পাওয়া যাবে জেনে নিল সবাই। সৌদামিনী বললেন, ‘তোমার বাবা তো অশক্ত মানুষ, তাঁর পক্ষে ছুটোছুটি করা বোধহয় সম্ভব হবে না। তুমি দেখবে যেন তোমার মায়ের কোন অযত্ন না হয়। আমরা আছি যখন যা দরকার হবে বলবে! জেনে রেখো, পৃথিবীতে মায়ের সেবা করার চেয়ে পুণ্য আর কিছুতেই নেই।’ তারপর কিছু মনে পড়ায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের কাছে টাকা পয়সা আছে তো!’
আর একজন টিচার তখন বললেন, ‘এব্যাপারে মিস্টার মিত্রের সঙ্গে আলোচনা করাই ভাল।’
সৌদামিনী ঘাড় নাড়লেন, ‘ঠিক। তোমার বাবার সঙ্গে কিভাবে দেখা হবে? উনি কি বিকেলে হাসপাতালে আসবেন?’
অর্ক একটু ইতস্তত করল। মা কি বলেছে এঁদের তা সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু সত্যি কথাটা লুকিয়ে কোন লাভ নেই। এঁরাই একমাত্র মায়ের প্রকৃত বন্ধু। সে নিচু গলায় বলল, ‘উনি এখন জলপাইগুড়িতে!’
সৌদামিনীর কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘তাই নাকি? তাঁকে খবরটা জানিয়েছ? জানাওনি! ইমিডিয়েটলি একটা টেলিগ্রাম করে দাও। ঠিক আছে, বিকেলে আমি গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে যা করার করব।’
স্কুল থেকে বেরিয়ে আচ্ছন্নভাবটা কেটে গেলে অর্কর একটু হালকা লাগল। যাক, মায়ের চিকিৎসার কোন ত্রুটি হবে না। কিন্তু তাই বলে সে কিছুতেই জলপাইগুড়িতে টেলিগ্রাম করতে পারবে না। মা নিজেও চায়নি তার অসুস্থতার কথা অন্য কেউ জানুক।
শরীরটায় কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। স্নানটান করে একটু শুলে হয়তো ভাল লাগবে ভেবে অর্ক ঈশ্বর পুকুরে ফিরে এল। এখন ভর দুপুর। নির্জন গলি দিয়ে অর্ক বাড়িতে ঢুকল। অনুদের দরজায় তালা ঝুলছে। দরজা খুলে সে খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তেই গা গুলিয়ে উঠল। মুখ তেতো হয়ে যাচ্ছে। এখন তার আর খিদে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ শোওয়ার পর তার আর উঠতে ইচ্ছে করছিল না। অবসাদ থেকে কখন যে ঘুম এসে যাচ্ছে তা সে টের পেল না।
হঠাৎ কপালে একটা শীতল নরম স্পর্শ পেতেই চমকে উঠে বসল অর্ক। ঝুমকি জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হল?’
‘তুমি কখন এলে?’ অর্ক বিস্মিত হয়ে ভেজানো দরজার দিকে তাকাল।
‘এই তো। মা কেমন আছে?’
‘ভাল। তুমি যাও।’
‘যাবই তো। আমি কি থাকতে এসেছি? ভাত খাবে?’
‘না আমি কিস্যু খাব না। তুমি চটপট চলে যাও নইলে বস্তির লোকে নানান কথা বলবে।’
‘বলুক। তুমি ভাত খেলে আমি রেঁধে দিতে পারি।’
‘তুমি রাঁধতে যাবে কেন?’
এবার যেন লজ্জা পেল ঝুমকি। তারপর নিচু গলায় মুখ নামিয়ে বলল, ‘আমি খুব খারাপ মেয়ে তাই বলে আমার কিছু ইচ্ছে করতে নেই?’
অর্ক হতভম্ব হয়ে বলল, ‘যাচ্চলে!’