কুড়ি
চারজোড়া চোখ তখন অর্কর ওপর স্থির। চারটে বয়স্কা শরীরের কাপড় আলুথালু ও প্রত্যেকটা মুখে কড়া প্রসাধন। একমাত্র মিসেস সোম ছাড়া কেউ দেখতে ভাল নন কিন্তু উগ্রতা দিয়ে সেটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা প্রকট। ঘরের কোথাও স্টিরিওতে উদ্দাম ঢেউ উঠছে বিদেশী সুরের। এই বাড়িতে যে একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে শুয়ে রয়েছে তা যেন কারো মনেই নেই।
‘এ গুড কালেকশন!’ রোগামতন একজন মহিলা ভুরু তুললেন যাঁর বুকের আঁচল মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মিসেস সোম ঠোঁট ছোট করলেন, ‘তোমরা ভুল করছ। বিলাসের সঙ্গে গাড়িতে ছিল, আমাকে খবর দিয়েছে, এইটুকুই সম্পর্ক!’
যে ভদ্রমহিলা ওপরে গিয়েছিলেন তিনি হাত নাড়লেন, ‘আঃ, তোমাকে আর অজুহাত দেখাতে হবে না। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্যি হয় তাহলে বেশ এনজয় করা যাবে। ডাকো ওকে।’
মিসেস সোম এবার হাসলেন, ‘এসো অর্ক। এরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। ইনি মিসেস গুপ্তা, মিসেস চ্যাটার্জী আর এর সঙ্গে তো তোমার আলাপ করিয়ে দিয়েছি।’
ভদ্রমহিলা চোখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমাকে শানুদি বলে ডেকো। আঃ, ওরকম ক্যাবলার মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? অ্যাই, স্টিরিওটা কমিয়ে দাও তো! আমরা সবাই বিলাসের ভাল হয়ে ওঠা সেলিব্রেট করছি, বুঝলে?’
‘উনি তো ভাল হয়ে ওঠেননি!’ অর্কর মুখ ফসকে বেরিয়ে এল। শানুদি কাঁধ নাচিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে সুরুচির দিকে তাকালেন। সুরুচি এমন ভাবে হাসলেন যেন কোন শিশুর মুখে চপল বাক্য শুনলেন। ‘ওই এক বাতিক হয়েছে, বিলাস-এর বদ্ধ ধারণা ও ভাল হয়নি। যে কাছে যাবে তাকেই একথা বোঝাবে। আচ্ছা তোমরা বল, যে মানুষটার জীবনের কোন আশাই ছিল না, ডাক্তাররাও হাল ছেড়ে দিয়েছিল সে আবার বাড়ি ফিরে এসেছে বই পড়ছে পাঁচটা কথা বলছে—এটা ভাল হয়ে ওঠা নয়? হ্যাঁ, এখনই হাঁটাচলা করতে পারবে না কিন্তু, ছয়মাস বাদে আর একটা অপারেশন হয়ে গেলেই সেটা পারবে।’
মিসেস গুপ্তা বললেন, ‘পুরুষমানুষ যতক্ষণ ঘরের বাইরে যেতে না পারছে ততক্ষণ নিজেকে অসুস্থ ভাবে।’
শানুদি বললেন, ‘বিলাস ড্রিঙ্ক করছে?’
সুরুচি যেন আঁতকে উঠলেন, ‘ওমা, এখনই ড্রিঙ্ক করবে কি?’
শানুদি এগিয়ে গিয়ে সোফায় বসলেন, ‘একটু একটু করে দিতে পারো। লোকটা মদ খেতে তো খুব ভালবাসতো। তাছাড়া ওর লিভারে যখন কিছু হয়নি তখন অল্প দিতে পারো। তাহলে দেখবে নিজেকে আর অসুস্থ ভাববে না বিলাস। ওমা, এ ছেলে যে ক্যাবলার মত দাঁড়িয়েই রইল।’
মিসেস গুপ্তা এগিয়ে এসে অর্কর হাত ধরলেন, ‘এসো ভাই, ক্যাবলাই ভাল, ওইসব ছুঁচোমুখু স্মার্ট ফড়িংদের আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। বাইরেই যত ভড়ং ভেতরটা ফাঁপা।’
মিসেস চ্যাটার্জী ঘাড় নাড়লেন, ‘যা বলেছ। এরা বরং অনেক ফ্রেস। মাটির জিনিস টাটকা হবেই।’
মিসেস গুপ্তা অর্ককে শোফায় বসিয়ে দিলেন। শানুদি বললেন, ‘ওকে একটু ইজি হতে দাও। স্টিরিওটা বাড়িয়ে দাও সুরুচি। তারপর হাত বাড়িয়ে একটা সাদা বোতল টেনে নিলেন। অর্ক দেখল বোতলটার গায়ে ইংরেজিতে ভোদকা লেখা রয়েছে। ওটা যে মদ তা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। খুরকিদের শিবমন্দিরে রকে বসে অনেক বোতল খেতে দেখেছে সে। তবে সেগুলোর চেহারা অন্যরকম, বিটকেল গন্ধ ছাড়ে। এই যে শানুদি গ্লাসে ঢেলে নিলেন সে কোন গন্ধই পেল না। না দেখলে কে বলবে ওটা জল নয়। ওপাশে আবার বাজনা উত্তাল হয়েছে। মিসেস গুপ্তা এসে ওর পাশে বসলেন, ‘কোথায় থাকো তুমি?’
‘বেলগাছিয়ায়।’ অর্ক মহিলার দিকে তাকাল। গলার লাল শিরা দেখা যাচ্ছে। চামড়ায় যেন কুঞ্চন এসেছে। কিন্তু তার ওপর পুরু মেকআপ থাকায় চট করে বোঝা যায় না। সেই মেকআপ নামতে নামতে বুকের জামার তলায় চলে গেছে। অর্কর মনে হল এরা বোধহয় সর্বাঙ্গে মেকআপ করেন। কত পাউডার খরচ হয় রোজ কে জানে।
‘এখান থেকে খুব দূরে?’ মিসেস গুপ্তার চোখ টানটান। গলার স্বর বেশ মিষ্টি। অর্কর মনে হল মাধবীলতার চেয়ে অনেক বড়, বয়সে।
‘না, বেশী দূরে নয়।’
‘খুব ঘন ঘন আসো তুমি এ বাড়িতে?’
‘না। আজ দ্বিতীয়বার এলাম।’
‘ওমা, সুরুচির মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়নি?’
‘না।’
‘তুমি খুব ভাল ছেলে! গুড বয়!’ আঙ্গুলের ডগা দিয়ে অর্কর চিবুকে টোকা দিলেন মিসেস গুপ্তা। সঙ্গে সঙ্গে শানুদি প্রতিবাদ জানালেন, ‘উহুঁ। ডোন্ট ক্রশ দ্য লাইন। মিনিমাম একটা সৌজন্য রাখতে হবে, কি বল সুরুচি! তোমরা কেউ ড্রিঙ্ক নিচ্ছ না যে!’
মিসেস চ্যাটার্জী হাত নাড়লেন, ‘চারটে নিয়েছি। আর না।’
শানুদি ফুঃ জাতীয় শব্দ করলেন জিভে তারপর এক চুমুকে গ্লাসের বাকি তরল পদার্থ গলায় ঢেলে উঠে দাঁড়ালেন, ‘আমার ভীষণ নাচতে ইচ্ছে করছে।’
অর্ক তাঁর বিশাল নিতম্বের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। মিসেস সোম চোখ ফেরাতেই বলল, ‘এবার আমি যাই!’
সুরুচি যেন বুঝতে পারলেন, ‘তুমি যাবে? বেশ তো—।’
‘যাবে মানে? ওর জন্যে আমরা এতক্ষণ নষ্ট করলাম আর ও চলে যাবে? তাছাড়া ওর সেইসব কথাবার্তাই তো শুনলাম না এখনও। মিসেস গুপ্তা প্রতিবাদ করলেন, ‘তুমি বসো, আমি বলছি বসো।’
অর্ক কোনরকমে বলল, ‘কিন্তু আমি এখানে কি করব?’
মিসেস গুপ্তা বললেন, ‘কিছু করতে হবে না তোমাকে। আগে বল, আমাদের তোমার ভাল লাগছে কি না? খুব খারাপ মানুষ আমরা?’
‘না, আমি সেকথা বলিনি। আসলে আমার খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে—।’
‘দেরি হয়ে যাচ্ছে? একদিন নাহয় হ’ল। তাছাড়া আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। তোমাকে পৌঁছে দেওয়া যাবে। বসো তুমি। হাত ধরে জোর করে বসিয়ে দিলেন মিসেস গুপ্তা। অর্ক কি করবে বুঝতে পারছিল না। ওদিকে বাজনা উত্তাল হয়েছে। শানুদি তাঁর বেঢপ শরীর নিয়ে নাচার চেষ্টা করছেন ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। অর্কর মনে হল এরকম কুৎসিত দৃশ্য জীবনে দ্যাখেনি সে। তিন নম্বরের কোন ছেলে নাচ শেখে না কিন্তু তারা এঁর চেয়ে অনেক ভাল নাচতে পারে। পুজোর সময় বা কোন মিছিলে বিলু কোয়া যা নাচে তা এর চেয়ে ঢের সুন্দর। শানুদি শরীর কাঁপাবার চেষ্টা করছেন আর বাকি তিনজন খুব হাততালি দিচ্ছেন। হঠাৎ শানুদি ঘুরে বললেন, ‘বাঃ, আমি একা একা নাচব নাকি? তোমরা কেউ এসো, কাম অল—।’ হাত নাড়লেন শানুদি।
মিসেস গুপ্তা মাথা নাড়লেন, ‘ও গড! আমি পারব না—।’
‘আমিও।’ মিসেস চ্যাটার্জী চোখ বন্ধ করলেন, ‘বড্ড হাই হয়ে গেছি!’
সুরুচি সোম বললেন, ‘বেশ তো নাচছো, নাচো না।’
‘নাঃ। একা নেচে সুখ নেই। শানুদি টলতে টলতে এগিয়ে এলেন, ‘এই ছেলে, তুমি নাচতে পারো না? এসো নাচি।’
অর্ক বলল, ‘আমি পারি না। আর আপনিও নাচ জানেন না।’ সঙ্গে সঙ্গে গালে হাত দিলেন শানুদি, ‘ওমা! একি বলে গো! জানো আমি এককালে কত প্রাইজ পেয়েছি নাচের জন্যে। আর একবার বললে তোমার গালে আমি একটি চড় মারবো।
আর সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা বিগড়ে গেল অর্কর। চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘মুখ সামলে কথা বলবেন। এসব বাতেলা অন্য লোককে দেখাবেন।’
মিসেস গুপ্তা প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ওর গায়ে, ‘কি বললে, কি বললে?’
অর্ক চেষ্টা করল ওঁকে ঝেড়ে ফেলতে, ‘সরুন তো।’
শানুদি তখন চোখে চোখ রেখেছেন, ‘খুব মাস্তান বলে মনে হচ্ছে?’
অর্ক ফুঁসে উঠল, ‘মাস্তানি তো আপনি করছেন। ওরকম রংবাজি আমার সঙ্গে দেখাতে আসবেন না। চড় মারা অত সস্তা নয়।’
‘তুমি কি বলতে চাও?’
‘কিছুই চাই না। অনেক বাতেলা করেছেন এবার ছেড়ে দিন আমাকে।’ অর্ক কথা শেষ করা মাত্রই শুনল হাসির ঝড় উঠল ঘরে। মহিলারা হেসে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছেন। অর্কর রাগ চট করে মিলিয়ে গেল। সে হতভম্বের মত এদের দেখতে লাগল। কোত্থেকে কি হল সে বুঝতে পারছে না। তার মধ্যেই শানুদি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ফাইন, ফাইন।’
মিসেস সোম কোনরকমে হাসি থামিয়ে বলে উঠলেন, ‘কি! ঠিক বলেছি কিনা। আমার তো সেদিন কথাবার্তা শুনে চোখ কপালে উঠেছিল।’
‘কি যেন বলেছিল তোমাকে?’ মিসেস গুপ্তা দম নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘ন্যাকড়াবাজি। তখন থেকে আপনি ন্যাকড়াবাজি করছেন—।’ অর্কর গলা নকল করে লাইনটা বলার চেষ্টা করতেই আবার হাসির হুল্লোড় উঠল। তার মধ্যেই শানুদি অর্কর পাশে এসে বসলেন, ‘কথাটার মানে কি ভাই?’
‘কি কথা?’
‘ওই যে’, মুখে হাত চাপা দিলেন শানুদি, ‘ন্যাকড়াবাজি?’
‘ন্যাকড়াবাজি মানে বিলা করা।’
‘বিলা করা?’ আবার খিল খিল হাসির ফোয়ারা ছিটকালো। এবং তখনই রহস্যটা বুঝতে পারল অর্ক। ওরা তার মুখে তিন নম্বরের শব্দগুলো শুনে খুব মজা পাচ্ছে। তার মানে, তাকে উত্তেজিত করার জন্যেই শানুদি তখন চড় মারার কথা বলেছিল? সুরুচি কি ওর ভাষা নিয়ে আগেই এঁদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন? নিশ্চয়ই!
শানুদি বললেন, ‘তোমাকে তো ছাড়ছি না ভাই। আমাদের এসব কথা শেখাতে হবে।’ তারপর মিসেস চ্যাটার্জীর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন, ‘আমি আবার ন্যাকড়াবাজি শব্দটার মানে অন্যরকম ভাবছিলাম।’
‘তুমি একটা যা তা—।’ মিসেস চ্যাটার্জী ব্লাশ করার চেষ্টা করলেন।
‘আহা! তোমরা যেন ভাবোনি! তা ভাই বিলা কথাটার মানে কি?
অর্ক হঠাৎ আবিষ্কার করল এঁদের কাছে তার মূল্য বেশ বেড়ে গেছে। তিনজনেই তাকে ঘিরে বসে আছে। মিসেস সোম সামান্য দূরে। একবার তিন নম্বরের শিবমন্দিরে একজন সাধু এসেছিল। সেই সাধুর পায়ের তলায় তিন নম্বরের বুড়িগুলো এইরকম ভঙ্গীতে একটু কৃপা পাওয়ার জন্যে বসে থাকতো। নিজেকে এখন সেই সাধুটার মত মনে হচ্ছিল তার। এই সুযোগটা ছাড়া যায় না। সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঢ্যামনাগিরি করা।’
আবার হাসি ছড়ালো। মিসেস গুপ্তার শরীর কাঁপতে কাঁপতে অর্কর কোলের ওপর পড়ে যেতেই শানুদি তাঁকে খোঁচা দিলেন, ‘অ্যাই, অমন করো না। প্রথম দিনেই ছেলেটাকে ঘাবড়ে দিচ্ছো! ওঠো ওঠো।’
মিসেস গুপ্তা কোনরকমে উঠে বসতেই অর্ক হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। মিসেস চ্যাটার্জী শিক্ষার্থীর ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা ভাই, কেউ যদি খুব ঝামেলা করে, তোমাকে ডিস্টার্ব করে তাহলে সেটাকে কি বলবে?’
অর্ক একটু চিন্তা করল। কিলা-খুরকিদের ভাষাগুলো মনে করার চেষ্টা করল। দুজনেই শালা মায়ের ভোগে চলে গেছে এখন! তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঝামেলা করা মানে কিচাইন করা।’
‘কিচাইন।’ মিসেস চ্যাটার্জী শব্দটা দু’তিনবার আওড়ে নিয়ে বেশ গর্বের গলায় বললেন, ‘আজই কর্তার মুখের ওপর বলতে হবে ডোন্ট মেক কিচাইন উইদ মি। শব্দটার মধ্যে বেশ জোর আছে, না?’
প্রায় একঘণ্টা ধরে ওই ঘরে হাসির তুবড়ি ফাটলো। অর্ক ততক্ষণে ব্যাপারটা কবজা করে নিয়েছে। এই প্রৌঢ়া মহিলারা রকের ভাষা শুনে নিজেরাই কিলবিল করছে। অর্ক যতটা জানে ততটাই ওদের প্রশ্নের উত্তরে বলে যাচ্ছিল। ক্রমশ প্রশ্নগুলো নরনারীর প্রেম এবং শারীরিক সম্পর্কের ধার ঘেঁষে চলে এল। এর অনেক শব্দ অর্ক জানে না। কিন্তু সে বুঝতে পেরেছিল যে অজ্ঞতা দেখালে এরা খুব হতাশ হবেন। অতএব যা মনে আসে তাই বলে যেতে লাগল সে। শেষ পর্যন্ত শানুদি বললেন, ‘ওঃ ফাইন। দারুণ জমেছিল আজ। সুরুচি তুমি কিন্তু খুব স্বার্থপরের মত এতবড় একটা অ্যাসেট লুকিয়ে রেখেছিলে। আর ওকে ছাড়া হচ্ছে না।’
মিসেস গুপ্তা বললেন, ‘এর পরের দিন আমার বাড়িতে এসো সবাই। অর্ক, তুমিও আসবে। তোমাকে বাদ দিয়ে আমি পার্টির কথা ভাবতেই পারছি না।’
মিসেস চ্যাটার্জী বললেন, ‘আমার ওখানে কবে আসছ?’
শানুদি বললেন, ‘আরে বাবা হবে হবে। অর্ক তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। গ্র্যাণ্ড হয়।’
মিসেস গুপ্তা সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কি আইডিয়া?’
‘আমরা তো সামনের মাসে দার্জিলিং-এ যাচ্ছি, অর্ক চলুক না আমাদের সঙ্গে। খুব জমবে তাহলে। ও থাকলে আমাদের আরও অনেক উপকার হবে, তাই না?’ শানুদির গলা অন্যরকম শোনাল।
‘ফাইন, ফাইন।’ চিৎকারগুলো শানুদিকে সমর্থন করল। কিন্তু মিসেস সোম মাথা নাড়লেন, ‘তোমরা একটা ব্যাপার কিন্তু একদম ভাবছ না। বাড়ি থেকে পারমিশন না পেলে ও বেচারা যাবে কি করে!’
শানুদি বলল, ‘সেটা ও নিশ্চয়ই ম্যানেজ করতে পারবে। জোয়ান ছেলে বলে কথা। কিগো তুমি ম্যানেজ করতে পারবে না?’
‘দেখি।’
‘দেখাটেখা চলবে না। তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতেই হবে। যদি দরকার হয় আমি গিয়ে তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলব।’ শানুদি জানালেন।
মিসেস গুপ্তা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে কে আছে বাড়িতে?’
‘মা আর বাবা।’
‘চমৎকার! তুমি কখনও কলকাতার বাইরে গিয়েছ?’
‘না।’
‘আঃ দারুণ! একদম ফ্রেস ফ্রম সয়েল! ও সুরুচি! তুমি একটা দারুণ ডিসকভারি করেছ।’ মিসেস গুপ্তা পুলকিত হলেন।
‘কিন্তু ওর পড়াশুনা—।’ মিসেস সোমের আপত্তিটা স্পষ্ট।
‘সাত দিন না পড়লে এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে? এই যে তোমার মেয়ে স্কুলের সঙ্গে বাইরে গেছে, ওর পড়াশুনা খারাপ হয়ে যাবে?’ শানুদি প্রতিবাদ জানালেন।
তখনই পার্টি ভেঙে গেল। প্রত্যেকেই অর্ককে ঠিকানা টেলিফোন নম্বর দিলেন। অর্ক নিজের ঠিকানাটা বলতে কেউ চিনতে পারল না। কিন্তু সবাই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিল যেন অর্ক আগাম সপ্তাহে শানুদিকে টেলিফোন করে।
মিসেস সোম ওদের গেট অবধি এগিয়ে দিতে গেলেন। অর্ক লক্ষ করছিল প্রত্যেকেরই নেশা হয়েছে। খুব জোরে কথা বলছে সবাই। গাড়ির কাছে এসে মিসেস গুপ্তা বললেন, ‘শানুদি, আমি অর্ককে কথা দিয়েছি বাড়িতে পৌঁছে দেব, তুমি রাস্তাটা জেনে নাও।’
শানুদি ঠাট্টার গলায় বললেন, ‘ওবাব্বা! এর মধ্যেই গোপনে গোপনে কথা শুরু হয়ে গেছে! তা কোনদিক দিয়ে যেতে হবে ভাই?
অর্ক বলল, ‘টালা পার্ক বেলগাছিয়া দিয়ে।’
‘গড্। ওটা তো খুব খারাপ রাস্তা। ভি আই পি ছাড়া এদিকে আসা যায় না। ওকে বরং একটা ট্যাক্সি ধরিয়ে দিই—।’ শানুদি খুব অসন্তুষ্ট গলায় কথাগুলো বলতেই মিসেস গুপ্তা ঠোঁট বাঁকালেন, ‘আহা! একদিন না হয় গেলে। তাতে তোমার গাড়ি খারাপ হয়ে যাবে না। অর্ককে আমি কথা দিয়েছি না?’
অর্ক বলল, আমার জন্যে আপনারা ভাবছেন কেন? আমি ঠিক ফিরে যাব।’ মিসেস গুপ্তা। দরজা খুলে বললেন, ‘তোমাকে পাকামি করতে হবে না, বসো তো। তারপর চাপা গলায় শানুদির কানে কিছু বলতেই তাঁর মুখের চেহারা পাল্টে গেল, ‘ও, তাই বল। তোমার মাথায় খেলেও বাবা। ঠিক আছে, ওঠো তোমরা।’
শানুদি স্টিয়ারিং-এ বসলেন, মিসেস চ্যাটার্জী তাঁর পাশে। পেছনে মিসেস গুপ্তার সঙ্গে অর্ক। গাড়িতে উঠেই মিসেস গুপ্তা বললেন, ‘শানুদি, তুমি ঠিক আছো?’
মিসেস সোমের দিকে হাত নেড়ে শানুদি গাড়ি চালু করলেন, আমি আর যাই করি না কেন বিলাসের মত একটা কাণ্ড করব না। বিলাস যে মেয়েটার সঙ্গে অ্যাটাচ্ড তার এলেম আছে।’
মিসেস চ্যাটার্জী ঠোঁট বেঁকালেন, ‘সুরুচি বলল সে নাকি ষ্ট্রীট গার্ল!’
শানুদি মাথা নাড়লেন, ‘ওই তো মুশকিল। এই পুরুষজাতটার কোন রুচির বালাই নেই। দেখে দেখে ঘেন্না ধরে গেল ভাই।’
লেক টাউন থেকে বেরিয়ে গাড়িটা তখন যশোর রোডে উঠে বাঁ দিকে বাঁক নিয়েছে। হঠাৎ মিসেস গুপ্তা বললেন, ‘অর্ক, তুমি বিলাসের প্রেমিকাকে দেখেছ? খুব সুন্দরী কি?’
আচমকা প্রশ্নে অর্ক কি বলবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মাথা নাড়ল, ‘না, আমি কাউকে দেখিনি। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত জড়িয়ে ধরলেন মিসেস গুপ্তা, ‘না, তুমি মিথ্যে কথা বলছ। অ্যাকসিডেন্টের সময় বিলাসের সঙ্গে তুমি ছিলে। বিলাস নিশ্চয়ই সেই মেয়েটার কাছ থেকে ড্রাঙ্ক হয়ে ফিরছিল।’
অর্ক বলল, ‘আপনি বিশ্বাস করুন আমি মাঝ রাস্তায় গাড়িতে উঠেছি।’
গাড়ি চালাতে চালাতে শানুদি বললেন, ‘এটা বিশ্বাসযোগ্য পয়েণ্ট নয়। এই যে আমি গাড়ি চালাচ্ছি, এখন কেউ আমাকে হাত দেখালে আমি তাকে গাড়িতে তুলে নেব? অসম্ভব।’
‘ওঁর গাড়ি রাস্তায় খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তখন আলাপ।’। অর্ক বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল। মিসেস গুপ্তা ওর হাতে মৃদু চপেটাঘাত করলেন, কিন্তু সুরুচি বলেছে তোমার সঙ্গে বিলাসের নাকি একটা গোপন আঁতাত আছে।’
অর্ক কথা বলল না। ওর খুব ক্লান্তি লাগছিল। সে চেষ্টা করল মিসেস গুপ্তার হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিতে। কিন্তু ভদ্রমহিলা যেন সাঁড়াশির মত তাকে ধরে রেখেছেন। হঠাৎ মিসেস চ্যাটার্জী সামনের সিট থেকে ঝুঁকে পড়লেন, ‘উহুঁ, ওটা ঠিক হচ্ছে না। আমরা যা করব তা একসঙ্গেই করব, কন্ট্রাক্টটা ভুলে গেলে চলবে না।’
এবার মিসেস গুপ্তা যেন লজ্জা পেয়েই হাত ছেড়ে দিলেন। অর্ক ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। তবে ওর মনে হচ্ছিল এই তিনজন মহিলার মধ্যে কোন গোলমেলে ব্যাপার আছে। এই সময় শানুদি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমার পার্স!’
মিসেস চ্যাটার্জী উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘তুমি আনোনি?’
গাড়িটাকে একপাশে দাঁড় করিয়ে শানুদি বললেন, ‘একদম ভুলে গিয়েছি। ওটা সুরুচির বাড়িতে পড়ে আছে। কি হবে এখন?’
‘কি আর হবে,’ মিসেস গুপ্তা বললেন, ‘বাড়ি ফিরে ওকে ফোন করে দিও।’
মাথা নাড়লেন শানুদি, ‘পার্সে দশ হাজার টাকা আছে। কোন কারণে যদি ওটা না পাওয়া যায় তাহলে বিপদে পড়ব। কাল সকালেই টাকাটা দরকার।’ বলতে বলতে গাড়ি ফেরালেন উনি। অর্ক ভাবল এবার তাকে নামিয়ে দিতে বলবে। কিন্তু গাড়ি তখন খুব জোরে ফিরছে। বড় জোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে আসবে। সে পেছনের সিটে গা এলিয়ে দিতে মিসেস গুপ্তার ফিসফিসানি শুনতে পেল, ‘তুমি কাল বিকেলে আমাকে ফোন করবে, খুব দরকার আছে। এই ধরো, তিনটে নাগাদ। ভেরি গুড বয়!’
অর্ক কোন উত্তর দিল না। ওর মনে হচ্ছিল এঁরা যেন ঠিক সুস্থ মানুষ নন। বিলাস সোমের বাড়ির সামনে গাড়িটা ফিরে এল। শানুদি দরজা খুলতে খুলতে বললেন, ‘সুরুচি আবার আমায় না ভুল বোঝে!’
মিসেস চ্যাটার্জী বললেন, ‘হ্যাঁ, ভাবতে পারে তুমি ওকে অবিশ্বাস করছ।’
অর্ক বলল, ‘আপনারা বসুন, আমি নিয়ে আসছি।’
শানুদি বললেন, ‘সেই ভাল, আমরা দুজনেই যাই চল।’
গেট খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে অর্ক বুঝল শানুদি অতগুলো টাকার জন্যে তাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। প্যাসেজ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শানুদি বললেন, তুমি কি ব্যায়াম করো?’ অর্ক ঘাড় নাড়ল, না।
‘বাঃ, তা সত্ত্বেও এত সুন্দর ফিগার তোমার!’ শানুদির গলায় প্রশংসা শুরু হতেই দপ করে আলো নিবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ভুষো কালির মত অন্ধকার নামল চারধারে। শানুদি বিব্রত হয়ে বললেন, ‘যাঃ, লোডশেডিং! কি হবে!’
অর্ক বুঝতে পারল শানুদি অন্ধকারে হাঁটতে পারছেন না। ভদ্রমহিলা বোধ হয় চোখে খুব কম দ্যাখেন। অবশ্য ততক্ষণে ওরা বারান্দার কাছে চলে এসেছিল। সে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমাকে ধরে উঠুন।’
‘ওঃ, অর্ক, থ্যাঙ্কস।’ প্রায় তাকে জড়িয়ে ধরে শানুদি ওপরে উঠে এলেন। তারপর আন্দাজে দরজার পাশে হাত বুলিয়ে কলিং বেলের বোতামে চাপ দিয়ে বললেন, ‘ওঃ, এখন তো এটাও বাজবে না।’ তারপর খুব মৃদু আওয়াজ করলেন দরজার গায়ে। ওপাশে কোন সাড়া না পাওয়া যাওয়ায় শব্দটা এবার জোরে করলেন কিন্তু তাতেও কোন ফল হল না, একি বাবা, আমরা বেরিয়ে যাওয়ামাত্র এরা ঘুমিয়ে পড়ল নাকি!’
অর্ক নিজেও দু’তিনবার দরজায় শব্দ করল কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া এল না। শানুদি বললেন, ‘কি করা যায় বল তো?’
অর্ক বারান্দা থেকে নেমে এল। এবার সে পাশের দরজাটা দেখতে পেল। ওই দরজা দিয়ে নবীন তাকে ঢুকিয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে সামান্য ঠেলতেই বোঝা গেল পাল্লাদুটো ভেজানো ছিল। সে শানুদিকে বলল, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন আমি এই দরজা দিয়ে ভেতরে যাচ্ছি।’
শানুদি বোধ হয় আপত্তি করছিলেন কিন্তু তার জন্যে অপেক্ষা করল না অর্ক। ছোট্ট গলি দিয়ে সে পেছনের বারান্দায় চলে এল। সমস্ত বাড়িতে এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বন্ধ দরজায় আঘাত করতে নবীনের গলা পাওয়া গেল, কে? কে ওখানে?’
‘আমি অর্ক। একটু আগে এসেছিলাম, দরজা খোল।’
নবীন খুব অবাক হয়ে দরজা খুলতেই অর্ক দেখল ওর হাতে একটা মোমবাতি জ্বলছে। অর্ক বলল, ‘বাইরের দরজায় অনেকক্ষণ ধাক্কা দিয়েছি, শুনতে পাওনি?’
‘না তো। ওখানে বেল না বাজালে এদিক থেকে শোনা যায় না।’
‘শানুদি একটা পার্স ফেলে গেছেন, ওটা দাও।’
নবীন ওকে আলো দেখিয়ে তিন চারটে ঘর পার করে যেখানটায় নিয়ে এল সেখানেই ওরা বসেছিল। প্রথমে দেখতে পায়নি অর্ক। তারপর সোফার পাশে পার্সটাকে খুঁজে পেল সে। বেশ ভারী, ভেতরে টাকা গজগজ করছে। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মেমসাহেব কোথায়?’
‘ওপরে।’
‘একবার ডাকো, বলে যাই।’
‘আপনি যান না, ওপরে উঠে ডান হাতি ঘর। ওদিকের দরজা খোলা রয়েছে, আমি বন্ধ করে আসি। নবীন ওপরে উঠতে চাইল না।’
অর্ক ওর হাত থেকে মোমবাতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কুকুরটা?’
‘ওই পাশে বাঁধা আছে, কোন ভয় নেই।’
মোমবাতির আলোয় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল অর্ক। সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ। ডান দিকের ঘরের দরজায় আসতেই কিছু একটা শব্দ কানে এল। খুব মৃদু একটা কান্নার আওয়াজ। একটানা কিন্তু চাপা। অর্ক ঘরের ভেতর দু’পা এগিয়েই চমকে উঠল। একটা বিশাল বিছানার মাঝখানে মিসেস সোম উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। কান্নার দমকে তাঁর পিঠ উঠছে নামছে। সমস্ত শরীরে এক ইঞ্চি সুতো নেই। এই অন্ধকার চিরে মোমবাতির যে আলো তাঁর নগ্নদেহে পড়েছে তাতে তাঁকে অন্য গ্রহের মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতে মহিলা এমন অন্ধ হয়ে গিয়েছেন যে কোন কিছুই তাঁর খেয়াল নেই। এমন কি এই যে সে মোমবাতি নিয়ে ঘরে ঢুকেছে তাও টের পাচ্ছেন না।
লজ্জা নয়, অর্কর খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল এই মুহূর্তে সুরুচি সোমকে ডাকা অন্যায় হবে। পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলেও কান্নার সুরটা যেন কানে লেগেই রইল। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে সে নিচে নেমে আসতেই চমকে উঠল। অন্ধকারে ভূতের মত নবীন সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে। একটু বিস্মিত গলায় নবীন প্রশ্ন করল, এত তাড়াতাড়ি নেমে এলেন?’
অর্ক খুব অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকাল। এই আবছা অন্ধকারে নবীনের মুখ ভাল করে বোঝা না গেলেও সে অনুমান করতে পারছে ও খুশি হয়নি। সে বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করল, ‘আমার খুব দেরি হবে বলে ভেবেছিলে নাকি!
মুখ নামাল নবীন। তারপর অপরাধীর গলায় বলল, ‘যা দেখেছেন তা কাউকে বলবেন না বাবু। ওই মেমসাহেবদেরও বলবেন না।’
এবার অর্ক বুঝতে পারল লোকটা সব জানে। জেনে শুনেই ও তাকে ওপরে পাঠিয়েছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মেমসাহেব কি রোজ এরকম করে?
মাথা নাড়ল নবীন, ‘বাবু হাসপাতাল থেকে ফেরার পরেই। সারা রাত কাঁদে। মেমসাহেবকে ঘরে একা ঢুকতে দেন না বাবু। এসব কথা কাউকে বলবেন না যেন!
হঠাৎ অর্কর মনে হল তার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। চার ধারের মানুষগুলো কি অদ্ভুত। সেজেগুজে থাকলে তাদের ভেতরের চেহারাটাকে একদম বোঝা যায় না। বাইরে যে তিনজন অপেক্ষা করছে তাদেরও হয়তো এরকম চেহারা আছে। এসব বুঝতে গেলে কোন কুল পাওয়া যাবে না। সে অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, ‘দরজাটা খুলে দাও, আমি বেরিয়ে যাব।’