ছাব্বিশ
মাধবীলতা ততক্ষণে দরজায়, হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দিন।’
সইসাবুদ করিয়ে টেলিগ্রামটা দিয়ে লোকটা চলে গেল। অনিমেষ এক টানে খামের মুখটা ছিঁড়লো। তারপর লেখাগুলোর দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাধবীলতার দিকে বাড়িয়ে দিল। এইসময় পরমহংস বলে উঠল, ‘কি ব্যাপার?’
অর্ক মাধবীলতার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। উঁকি মেরে সে পড়তে পারল, ‘ফাদার সিরিয়াসলি ইল, কাম শার্প।’
মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, ‘কি করবে?’
অনিমেষ দরজার দিকে তাকিয়েছিল। তখন বাইরে ছায়া ঘন হয়ে এসেছে। কিংবা বলা যায় রাতের ছায়া পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে অনিমেষ কোন উত্তর দিল না। মাধবীলতার হাত থেকে পরমহংস টেলিগ্রামটা নিয়ে শব্দ করে পড়ল, ‘ফাদার সিরিয়াসলি ইল, কাম শার্প। ছোট মা। ছোট মা কে?’
অনিমেষ জবাব দিল না। মাধবীলতা বলল, ‘ওর মা।’
‘তুই জানতিস কিছু? মানে, এই অসুস্থতার ব্যাপারে?’
অনিমেষের বোধহয় কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। ও তখন একদৃষ্টিতে ছায়াকে আঁধার হয়ে যেতে দেখছিল। মাধবীলতা বলল, কিছুদিন আগে ছোটকাকার মুখে শুনেছিলাম যে উনি অসুস্থ, প্যারালিসিস—।’
সেইসময় হঠাৎ স্টোভে চাপানো কেটলি থেকে শব্দ বের হতে লাগল। সোঁ সোঁ শব্দটা যেন অনিমেষকে ধাক্কা মারতেই সে চেতনায় ফিরে এসে বলল, ‘টেলিগ্রামটা দেখি।’ পরমহংস ওটা অনিমেষকে দিল, দিয়ে বলল, ‘কি করবি?’
অনিমেষ অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘কি করব! আমি কি করতে পারি!’ তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টেলিগ্রামটাকে দেখতে লাগল। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘কি দেখছিস?’
‘ভাবছি আমার ঠিকানাটা পেল কোথায়? ওহো! ছোটকাকা, ছোটকাকা দিয়েছে। তাহলে—।’ অনিমেষ আবার চোখ বন্ধ করল। কদিন দাড়ি কামায়নি অনিমেষ। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে মুখ ছেয়ে গিয়েছে। ইদানীং চিবুকের কাছে সাদা হয়েছে। দাড়ি না কামালে অনিমেষকে খুবই বয়স্ক দেখায় এবং তাই মুহূর্তে বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘কত বয়স হয়েছে ওঁর?’
অনিমেষ বন্ধুর দিকে তাকাল। হয়তো মনে করার চেষ্টা করল তারপর বলল, ‘ষাট তো হয়েই গেছে অনেকদিন।’
মাধবীলতা ইতিমধ্যে চায়ের জল নামিয়েছে, পাতা ভিজিয়ে কাপ ঠিক করেছে। অর্কর নিয়ে আসা তেলেভাজা একটা থালায় ঢেলে সে এগিয়ে ধরল পরমহংসের সামনে, ‘নাও।’
পরমহংস চমকে উঠল, ‘ও বাবা, এত কে খাবে! তাছাড়া আমার এখন খেতে ভালও লাগছে না।’
‘কেন? খেতে চাইলে এখন না বললে শুনবো কেন? মুড়িটা দিচ্ছি, তাও খেতে হবে। কেনার পর নষ্ট হতে দেব না আমি।’ মাধবীলতার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে তাকাল পরমহংস। থমথম করছে মুখ। তারপর নিচু গলায় সে বলল, ‘এই টেলিগ্রামটা—।’
‘তোমার মুড নষ্ট করে দিল? যার নামে টেলিগ্রাম এল সে কি করব কি করতে পারি বলে হাত পা ছড়িয়ে বসে রইল আর তোমার ভাবনায় খিদে উড়ে গেল! চমৎকার।’ মাধবীলতা থালাটাকে সরিয়ে মেঝেতে শব্দ করে রেখে অর্ককে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই খাবি?’
অর্ক মাথা নাড়ল, পরে খাব, এখন খিদে নেই।’
মাধবীলতা উল্টো দিকে মুখ করে চা ঢালছিল। অর্ক এগিয়ে এসে খাটের ওপর পড়ে থাকা টেলিগ্রামটা তুলে নিল। অনিমেষ হঠাৎ ওর হাত থেকে টেলিগ্রামটা নিয়ে আর একবার চোখ বোলালো, ‘এটাকে সত্যি ভাবার কোন কারণ নেই।’
‘সেকি!’ পরমহংস চমকে উঠল, ‘জলপাইগুড়ি থেকে তোকে ঠাট্টা করে ওটা পাঠাবে নাকি! কি যে বলিস!’
‘আমার ছোটকাকাকে বিশ্বাস নেই। যখনই আসেন তখনই একটা কিছু গোলমাল পাকিয়ে যান। ওঁর এখন ইচ্ছে আমরা জলপাইগুড়ির বাড়িতে গিয়ে থাকি। তাতে মা বাবা এবং পিসীমাকে দেখাশোনা করা যাবে। তাছাড়া হয়তো ওঁর মনে পিসীমা সম্পর্কে যে বিবেকবোধটা খোঁচা মারে তা আমরা ওখানে গেলে শান্ত হয়ে যাবে। এইজন্যেই যদি টেলিগ্রামটা করা হয়?’ অনিমেষ যুক্তিগুলো খাড়া করে মাধবীলতার দিকে তাকাল। তখনও মাধবীলতার চা করা শেষ হয়নি। ওর পিঠের দিকে তাকিয়ে অনিমেষের হঠাৎ মনে হল এবার যেন ভাঙ্গনের টান লেগেছে মাধবীলতার শরীরে। ঘাড়ের পাশে ওই ভাঁজগুলো তো আগে ছিল না, পিঠটাকেও এত সরু কখনও মনে হয়নি।
পরমহংস বলল, ‘জানি না ভাই। তবে যদি সত্যি হয়? জেল থেকে বের হবার পরে তুই নিজেও কোন যোগাযোগ রাখিসনি?’
অনিমেষ বলল, ‘না।’ তারপরেই তার খেয়াল হল এই প্রশ্নের উত্তর সে আগেও দিয়েছে। জেলখানায় যাওয়ার আগেও তো মহীতোষের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিল না। তখন নকশাল আন্দোলনে এত সক্রিয় যে সম্পর্ক রাখার সময়ও ছিল না। সেসময় সম্পর্ক রাখা মানে বাবাকে বিব্রত করা কিংবা পুলিসের হাতে ধরা পড়া। আর জেল থেকে বেরিয়ে এখানে আসার পর তার মনে হয়েছিল এতদিন বাদে স্ত্রী পুত্র নিয়ে পঙ্গু হয়ে বাবার কাঁধে ভর করার কোন যুক্তি নেই। এসব নিয়ে সে এখন আর ভাবে না। অথচ ঘনিষ্ঠ কেউ বারে বারে এ প্রশ্ন করবে। প্রথমদিকে মাধবীলতা করেছিল, ছোটকাকা করেছে এবং পরমহংসও করছে। অর্ক কখনই অভিযোগ করেনি কিন্তু ছেলেবেলায় জানতে চাইত। হয়তো মাধবীলতা তাকে বুঝিয়েছে, কি বুঝেছে সে-ই জানে।
চায়ের কাপ সামনে রাখল মাধবীলতা তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘মুড়ি মাখব না?’
পরমহংস হাসবার চেষ্টা করল, ‘দাও, তেলেভাজা খাচ্ছি, মুড়ি মাখতে হবে না।’
অনিমেষ দেখল মাধবীলতা চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তেলেভাজা তুলে নিল। তার সামনেও চায়ের কাপ রাখা হয়েছে কিন্তু কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে খেতে। অথচ না খাওয়ারও কোন যুক্তি নেই। পরমহংস দ্বিতীয় বেগুনি নিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় খোঁজ নেওয়া উচিত!’
মাধবীলতা মুখ তুলল, ‘কিসের?’
‘টেলিগ্রামটা ঠিক না বেঠিক?’
মাধবীলতা বলল, ‘বেঠিক ভাবলে অনেক দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুবিধে হয়।’
পরমহংস বলল, ‘এরকম করে বলো না।’
‘আমি অন্যায় কিছু বলছি না। ওই বাড়ির একমাত্র ছেলে ও। য়ুনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ও যে আদর্শটাকে শ্রেয় মনে করেছে তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেসময় উত্তেজনা এত বেশী ছিল যে কারো কাছে অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। জেলে গিয়ে যখন সেই উত্তেজনায় ভাটা পড়ল, যখন বুঝল শারীরিক সক্ষমতা নেই তখন রক্ত দুর্বল হতে বাধ্য। সেসময়ে মনে হয়েছে আর কখনও ও বাবা মা পিসীমার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। বাড়ির ছেলে হিসেবে ও কোন কর্তব্য করতে পারবে না। শুধু ওদের কথা কেন, আমাকেও এড়াতে চেয়েছিল ও। জেলখানায় পরিচিত একটা ছেলের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল তাই। ভেবেছিল আমার ঘাড়ে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকার বোঝা বাড়াবে কেন? আমার তো কোন উপকারই করতে পারবে না। আমি নির্লজ্জের মত সেখান থেকে জোর করে না নিয়ে এলে কোনদিন আসতো? আসলে এই এড়িয়ে যাওয়া ক্ষতি করতে নয়। নিজের অক্ষমতার অভিমান ওর এত বেশী যে প্রিয়জনদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চায়।’ একটানা কথাগুলো বলতে বলতে মাধবীলতার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। শেষে নিচের ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়াল। ঝট করে গামছাটা টেনে নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পরমহংস কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইল। তার সেই হাসিখুশি মেজাজটা হঠাৎ যেন উধাও হয়ে গেছে। অনিমেষের দিকে তাকাতেই সে ম্লান হাসল, ‘কি জানি, হয়তো ও ঠিকই বলছে।’
পরমহংস বলল, ‘দ্যাখ এসব তোদের নিজস্ব ব্যাপার, আমার কিছু বলা সাজে না। তবে আমার মনে হচ্ছে তোদের একবার জলপাইগুড়িতে যাওয়া উচিত।’
‘অসম্ভব। আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ অনিমেষ কথাটা ছুঁড়ে দিল।
‘অসম্ভব কেন?’
‘তুই ক্ষেপেছিস? আমার যা শরীর তাতে ট্রেনে উঠব কি করে?’ অনিমেষ প্রস্তাবটাকে সরাসরি বাতিল করে দিল। এতক্ষণ অর্ক চুপচাপ কথাবার্তা শুনছিল। বাবার বাবা খুব অসুস্থ এবং তাকে দেখবার জন্যে বাবাকে যেতে বলা হয়েছে। জলপাইগুড়ি অনেক দূরে। সেখানে শুধু পাহাড় আর চায়ের বাগান আছে। বাবার কাছে এবং স্কুলে যা শুনেছে তাতে তার কোন আকর্ষণ বোধ হয় না। যদিও বাবা খুব রঙ চড়িয়ে সেইসব বর্ণনা করত। বাবার এক পিসীমা আছে যিনি নাকি দারুণ পায়েস রাঁধেন। কিন্তু জন্মাবার পর সে শুধু মাকে দেখেছে, তার কিছু পরে বাবাকে। এছাড়া আর কোন আত্মীয়স্বজনকে সে চোখে দ্যাখেনি। কাকা জ্যাঠা তার থাকার কথা নয় কারণ সে শুনেছে বাবার কোন ভাইবোন ছিল না। অবশ্য এই সেদিন বাবার কাকা এসেছিল। কিন্তু আর কাউকে তো সে চেনে না। এই সুযোগে একবার জলপাইগুড়িতে গিয়ে দেখে এলে হয় সবাইকে। সে কথা বলতে যাচ্ছিল এই সময় মাধবীলতা ঢুকল। এইটুকু সময়ের মধ্যে যেন সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেছে সে নিজেকে, মুখের সেই থমথমে ভাবটা নেই। হাবভাবে যে উত্তেজনা এসেছিল সেটি উধাও। ঘরে ঢুকে গামছাটা রেখে খুব শান্ত গলায় বলল, ‘জলপাইগুড়ির ট্রেন কখন ছাড়ে?’
অনিমেষ কিছুটা বিরক্ত কিছুটা অবাক চোখে মাধবীলতাকে দেখল। প্রশ্নটা পরমহংসর দিকে তাকিয়ে তাই সে জবাব দিল, ‘জলপাইগুড়ি অবধি ট্রেন আছে কিনা জানি না তবে সব ট্রেনই নিউ জলপাইগুড়ি যায়। দার্জিলিং মেইল, কামরুপ এক্সপ্রেস। কিন্তু ট্রেনের খোঁজ করছ কেন?’
‘কখন ছাড়ে ওগুলো?’
‘সন্ধ্যেবেলায়।’
‘আমরা জলপাইগুড়িতে যাব। মাধবীলতার গলায় সামান্য উত্তেজনাও নেই।
এবার অনিমেষ কথা বলল, ‘আমরা মানে?’
‘আমাদের সংসারে আমরা বলতে কি বোঝায় তা তুমি জানো না?’ চেয়ার থেকে কাপড় সরিয়ে মাধবীলতা ধীরে ধীরে সেখানে বসল। কথাটা বলার সময় অনিমেষের দিকে যে তাকাল না সেটা লক্ষ্য করছিল অর্ক।
‘আমাকে বাদ দিয়ে ভাব।’ অনিমেষের গলা একরোখা শোনাল।
‘কেন?’
‘আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।’ এবার আর উত্তেজনাটা চাপা থাকল না।
মাধবীলতা এবার সরাসরি তাকাল, ‘বেশ। তাহলে এ প্রসঙ্গ এখানেই শেষ হোক।
অর্ক হঠাৎ কথা বলে উঠল, ‘মা, গেলে হতো, তাই না?’
মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ‘না। যার পরিচয় নিয়ে আমরা যাব সে যদি না যায় তাহলে গিয়ে কি লাভ। আমাদের তো কেউ চিনবে না ওখানে।’ কথাগুলো বলার সময় অদ্ভুত একটা বিষাদের ছায়া নামল গলায়।
তারপর সব চুপচাপ! এই ঘরের চারজন মানুষ কোন কথা বলছে না। এইসময় পৃথিবীর সব নিস্তব্ধতাকে খান খান করে একটি কণ্ঠস্বর তীব্র হয়ে উঠল, ‘সেই খানকির ছেলেটা কোথায়? আমি তাকে শেষ করে ফেলব আজ। আই, কোথায় গেছে সেটা বল।’ আর তখনই কয়েকটি শিশু যেন চিৎকার করে কেঁদে উঠল। মুহূর্তেই হইচই পড়ে গেল বস্তিতে। অর্ক তড়াক করে দরজায় চলে এসেছিল। এখান থেকেই সে অনুর বাবাকে দেখতে পেল। ওই শীর্ণ হতাশ চেহারার নির্জীব মানুষ এখন প্রচণ্ড খেপে বাচ্চা দুটোকে পিটিয়ে যাচ্ছে। বস্তির মানুষরা ভিড় করে দেখছে কিন্তু কেউ কথা বলছে না। অর্ক দৌড়ে গেল সামনে তারপর অনুর বাবাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, ‘মারছেন কেন, ওরা মরে যাবে এভাবে মারলে।’
অনুর বাবা বাধা পেয়ে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, ‘ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে। এই বংশ নির্বংশ করে ফেলব আমি। তিনি চলে গেলেন ড্যাংডেঙ্গিয়ে, মেয়ে ভেগে গেল ভাতারের সঙ্গে। আমি কি করব? আমি এই সাপগুলোকে দুধকলা খাওয়াবো একটু ফণা গজালেই ছোবল খাওয়ার জন্যে?’ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল অনুর বাবা। অর্ক সেই প্রৌঢ়ের শরীরটাকে ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। অনুর বাবা কাঁদতে কাঁদতে অর্ককে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ওরে, তোরা আমাকে মেরে ফ্যাল। দে ছুরি চালিয়ে। আমি বেঁচে যাই—।’
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে? এরকম করছেন কেন?’
অনুর বাবা কান্নার দমকে কোন জবাব দিতে পারল না। তাকে মাটিতে বসিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে অর্ক দেখল বাচ্চা দুটো দরজায় দাঁড়িয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে। অর্ক ওদের জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে রে?’
বড়টা বলল, ‘দাদা মাল খেয়েছে।’ সরু কচি গলায় অদ্ভুত শোনাল শব্দটা।
‘মাল খেয়েছে?’ অর্ক অবাক। ন্যাড়া তো এখনও বাচ্চা।
‘মাল খেয়ে থালা গ্লাস ঝেড়ে দিয়েছে।’ ছোটটার গলা আরও সরু।
হতভম্ব হয়ে বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়েছিল অর্ক। ন্যাড়া মাল খাওয়ার জন্যে যে অবাক হওয়া তার চেয়ে অনেক বেশী এই বাচ্চাদুটোর মুখে ‘মাল’ আর ‘ঝেড়ে দেওয়া’ শব্দ শুনে। সে ধীরে ধীরে নিজেদের ঘরের দিকে ফিরে এল। যারা ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল তারা হতাশ হল। একজন বলে উঠল, ‘থামিয়ে দিয়ে যেন কত উপকার করল! হুঁ! চিৎকার করে মনের কষ্ট বের করছিল সেটা সহ্য হল না!’
নিজেদের দরজায় দাঁড়াতেই পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে?’
‘ন্যাড়াটা মদ খেয়েছে।’
‘সেকি!’ মাধবীলতা চমকে তাকাল, ‘হায়, ভগবান!’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘বাচ্চা দুটোকে মারছিল কেন?’
অর্ক সরল গলায় কথাটাকে আবৃত্তি করল, ‘বড় হয়ে ছোবল মারবে সেই ভয়ে!’
এই ঘরে আর কথা জমল না। খানিকক্ষণ বাদে পরমহংস বলল, ‘আজ উঠি। তোমরা তাহলে এক তারিখে ওখানে চলে যাচ্ছ।’
‘ওখানে যাচ্ছি মানে?’ অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
‘ওহো তোকে তো কিছুই বলা হয়নি। মাধবীলতার বাড়িটা অপছন্দ হয়নি। আমি টাকা পয়সা মিটিয়ে দিচ্ছি। তোরা এক তারিখে শিফ্ট করবি।’
মাধবীলতা বলল, ‘তোমার কাছে ঋণ বেড়ে যাচ্ছে পরমহংস।’
‘দূর! সামান্য কটা টাকা। শোধ করে দিলে ঋণ থাকবে না।’
‘শুধু এটা কেন? আগেরটাও তো দেওয়া হয়নি।’
‘আগেরটা?’ পরমহংস অবাক হয়ে মাধবীলতার দিকে তাকাল।
‘বাঃ, অর্কর অসুখের সময় যেটা দিয়েছ সেটা ভুলে গেলে? খুব বেশী টাকা হয়ে গেছে মনে হচ্ছে!’ কথাটা বলে মাধবীলতা মুখ নামাতেই অর্ক প্রাণপণে ইশারা করল পরমহংসকে চুপ করতে। পরমহংস কিছুতেই বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ অনিমেষ বলল, ‘কিন্তু বাড়িটাকে কদিন ধরে রাখা যাবে রে?’
‘ধরে রাখা? এই বাজারে বাড়ি ধরে রাখা যায়?’
‘কিন্তু আমরা যদি জলপাইগুড়িতে যেতাম?’
‘জলপাইগুড়িতে যাচ্ছিস না যখন তখন ও প্রশ্ন উঠছে কেন? আর যদি যেতিস তাহলে অ্যাডভান্স করে ভাড়া দিয়ে গেলে তোদেরই থেকে যেত।’ পরমহংস কথা শেষ করে অর্কর দিকে তাকাল। অর্ক এখন মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে এমন ভঙ্গীতে যেন পরমহংস বের হলে সে এগিয়ে দেবে। পরমহংস ঠিক করল মাধবীলতার কথাটার ব্যাখ্যা তখনই জেনে নেবে সে অর্কর কাছে।
অনিমেষ পরমহংসকে ডাকল, ‘তুই এখনই যাস না, একটু বস।’
মাধবীলতা পরমহংসর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আর বসে কি হবে! তোমার সন্ধ্যেটা আমি নষ্ট করলাম, কিছু মনে করো না। এরকম একটা অবস্থা হবে জানলে নিশ্চয়ই ডেকে আনতাম না। বেশ হিন্দী ছবি দেখতে আরাম করে, রাত্রে ঘুম হতো।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘হিন্দী ছবি দেখিস নাকি?’
পরমহংস খানিকটা বিব্রত ভঙ্গীতে বলল, ‘ছেড়ে দে ও কথা। কি বলছিলি বল!’ তারপর ঘুরে মাধবীলতাকে বলল, ‘তোমরা কি রোজ এরকম ঝগড়া কর?’
‘ঝগড়া? ও মা, কোন দুঃখে ঝগড়া করতে যাব?’ মাধবীলতা যেন কষ্ট করে হাসল।
পরমহংস কাঁধ নাচিয়ে ফিরে এসে খাটে বসল, ‘এই জন্যেই শালা বিয়ে করলাম না।’
‘কি জন্যে? তোমরা তোমাদের খেয়াল-খুশিমত যা হুকুম করবে মেয়েদের তা মেনে নিতে হবে? তোমাদের নিজস্ব পছন্দ যদি অন্যায়ও হয় তাহলে তার প্রতিবাদ যে মেয়ে করবে সে-ই খারাপ হয়ে যাবে? তোমরা কম্যুনিজমের কথা বল, অফিসে গিয়ে বিপ্লবের বুলি আওড়াও অথচ বাড়িতে ফিরে এসে তোমরা এক একজন হিটলার কিংবা মুসোলিনীর চেয়ে কম ডিক্টেটর হও না। মেয়েদের পান থেকে চুন খসলেই তারা তোমাদের কাছে ঝগড়াটে হয়ে যায়!’ মাধবীলতার গলার স্বর চাপা কিন্তু তার ঝাঁঝ অত্যন্ত কড়া। পরমহংস সঙ্গে সঙ্গে হাত জোড় করল, ‘ক্ষমা চাইছি, ওরে বাবা, এইসব ভেবে বলিনি আমি।’ ওর গলার স্বরে ঠাট্টা ছিল এবং তারই জের টেনে বলল, তোমরা নিজেদের খুব ছোট ভাব। অথচ দ্যাখো, তোমাদের আমরা কত উঁচু আসনে বসিয়েছি। জগৎ-জননী তো মেয়েদের বলা হয়। এমনকি কালীর পায়ের তলায় শিব—।’
মাধবীলতা এবার হেসে ফেলল, ‘ওটাও তো বিরাট ভাঁওতা। তোমরা জানো মেয়েরা খেপে গেলে সর্বনাশ হবে। আর তাদের পায়ের তলায় পড়লে আর যাই হোক লজ্জিত না হয়ে পারবে না তাই সেই সুযোগটা নাও। নিয়ে আবার বিক্রম দেখাও।’ বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে হল অর্ক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব কথা গিলছে। সে ঝাঁঝিয়ে বলল, ‘অ্যাই, তুই হাঁ করে কি শুনছিস?’
অনিমেষ বলল, ‘অর্ক, তুই দাঁড়া। হ্যাঁ পরমহংস, আমরা যদি কাল জলপাইগুড়িতে যাই তাহলে তুই সাহায্য করতে পারবি?’
হাঁ হয়ে গেল পরমহংস, ‘জলপাইগুড়িতে যাবি?’
মাথা নাড়ল অনিমেষ, মুখে কিছু বলল না। কথাটা শুনে অর্কও চমকে গেল। হঠাৎ যে বাবা মত পাল্টে জলপাইগুড়ি যাওয়ার কথা বলবে তা সে কল্পনাও করেনি। শুধু মাধবীলতার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে একই ভঙ্গীতে বসে রইল।
পরমহংস বলল, ‘কিন্তু আগামীকালের রিজার্ভেশন পাওয়া খুব মুশকিল হবে। আমি যেবার দার্জিলিং গিয়েছিলাম সেবার মাসখানেক আগেই টিকিট কেটেছিলাম। শুনেছি ব্ল্যাকে টিকিট পাওয়া যায়—!’
‘না, ব্ল্যাকে টিকিট কিনব না। রিজার্ভেশন ছাড়া যাওয়া যায় না?’
‘অসম্ভব। বাসে যাওয়া যায়। রকেট বাস। ওভারনাইট জার্নি। কিন্তু তোর পক্ষে সারারাত বসে থাকা কি সম্ভব হবে?’
এবার মাধবীলতা কথা বলল। যেন এতক্ষণ যেমন কথাবার্তা এই ঘরে হয়েছে তা তার কানেই ঢোকেনি কিংবা সে নিজেও কোন কথা বলেনি এমন ভঙ্গীতে সহজ গলায় পরমহংসকে বলল, ‘বাসে ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।’
পরমহংস বলল, ‘ঠিক আছে আমি দেখছি। টিকিট যদি পাই তাহলে কাল বিকেল চারটে নাগাদ চলে আসব।’
‘ট্রেন কটায়?’ অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
‘সন্ধ্যেবেলায়। সঠিক সময় জেনে আসব। তোরা রেডি থাকিস।’
‘শোন। তুই চারটে টিকিট কাটিস।’
‘চারটে? কেন?’
‘তুই সঙ্গে যাবি।’
‘অসম্ভব। তোর মাথা খারাপ হয়েছে? বলা নেই কওয়া নেই যাবি বললেই হল? এমন কথা বলছিস যার কোন মানে হয় না।’
‘আমরাও তো বলে কয়ে যাচ্ছি না!’
‘তোদের কথা আলাদা। তোদের বাড়িতে বিপদ, বিপদের সময় মানুষের কোন যুক্তি কাজ করে না। আর আমার অফিসে ছুটি পাওয়ার সমস্যা আছে।’
‘ছুটি যদি ম্যানেজ করতে পারিস?’
পরমহংস খানিকটা অসহায় ভঙ্গিতে মাধবীলতাকে বলল, ‘দ্যাখো তো, এরকম করে বলার কোন অর্থ হয়? কত বছর তোমরা ওখানে যাওনি, সেখানকার কি অবস্থা তোমরা জানো না, আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয়?’
মাধবীলতা বলল, ‘আমি কিছু বলব না। নিজেদের স্বার্থের জন্যে তোমাকে টেনে নিয়ে যেতে আমার খারাপ লাগবে। তাছাড়া ওখানকার কাউকে আমি চিনি না।’
অর্ক বলল, ‘পরমহংসকাকু, আপনি গেলে বাবার সুবিধে হত।’
‘সুবিধে হত? মানে?’
‘আমার একার পক্ষে ওঁকে ওঠানো নামানো—।’
‘ও। সে অন্য প্যাসেঞ্জারদের বললে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। আগে টিকিট পাই কিনা তাই দেখি। আমার এক বন্ধু আছে ইস্টার্ন রেলের পি আর ও অফিসে কাজ করে। তাকে ধরলে যদি ভি আই পি কোটায় টিকিট বের করে দিতে পারে, দেখি।’ পরমহংস উঠল।
মাধবীলতা বলল, ‘দাঁড়াও।’
পরমহংস বোধহয় চিন্তায় ছিল। অন্যমনস্ক হয়ে তাকাল। মাধবীলতা খাটের তলায় হাত ঢুকিয়ে একটা সুটকেস টেনে বের করে টাকা গুনল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এখানে বেশী নেই, বাকিটা কাল তোমাকে দেব।’
পরমহংস হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিল। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর শেষপর্যন্ত সুমতি হয়েছে দেখে ভাল লাগল। কাল চারটে নাগাদ আসব। রেডি থাকিস।’
মাধবীলতা দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘টিকিট না পেলেও খবর দিও। তৈরি হয়ে থেকে না যাওয়া হলে ভাল লাগে না।’ সে ইশারা করতেই অর্ক পরমহংসর সঙ্গী হল।
গলিটা কোনরকমে পেরিয়ে এসে পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার বল তো অর্ক? তোমার মা—।’
অর্ক বলল, ‘এর আগে মায়ের হাতে টাকা ছিল না। সেইসময় বাবা মাকে টাকা দিয়ে বলেছিল আপনার কাছ থেকে নিয়েছে। মা তাই জানে।’
‘আচ্ছা! লুকোচুরির কি দরকার ছিল?’
‘আসলে বাবার হাতে তো টাকা থাকার কথা নয়, তাই—।’
‘টাকা ও কোত্থেকে পেল?’
‘আমি দিয়েছিলাম।’
‘তুমি?’
‘হ্যাঁ। আমি একটা কাজ করে টাকা পেয়েছিলাম। মা জানে না।’
‘কি কাজ?’
‘এক ভদ্রলোককে বাঁচিয়েছিলাম। উনি কৃতজ্ঞ হয়ে দিয়েছিলেন।’
‘সেকি! না না, এভাবে টাকা নেওয়া তোমার উচিত হয়নি।’
‘জানি। আমরা ঠিক করেছি টাকাটা তাঁকে ফিরিয়ে দেব।’
‘গুড।’ পরমহংস এবার হালকা হল।
দরজা থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই মাধবীলতা দেখল অনিমেষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই অনিমেষ বলল, ‘তুমি কিছু বললে না?’
‘কি বলব?’
‘লতা, এদিকে এসো।’
‘কেন?’
‘এসো না।’ অনিমেষের গলায় আবেদন।
মাধবীলতা একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে খাটের পাশে এসে দাঁড়াতে অনিমেষ খপ করে তার হাত ধরল, ‘তুমি আমার ওপর রাগ করেছ?’
‘কি করছ? ছাড়ো, কেউ এসে পড়তে পারে।’ মাধবীলতা মৃদু আপত্তি জানাল। অনিমেষ বলল, ‘আগে উত্তর দাও।’
‘কি বলব বল!’
অনিমেষ ম্লান হেসে বলল, ‘তুমি আমাকে একটুও বোঝ না!’
‘বুঝি না?’
‘না। আমি কেন যেতে চাইছিলাম না তুমি জানো? আমি পঙ্গু, ওদের কিছুই করতে পারব না এ তো সত্যি কিন্তু আর একটা কথা মনে হল। ওরা যদি তোমাকে সসম্মানে না নেয়, যদি তোমাকে অবহেলা করে আমি সহ্য করতে পারব না।’ অনিমেষ হাত ছেড়ে দিল।
মাধবীলতা হেসে বলল, ‘পাগল!’
অনিমেষ অবাক হল, ‘মানে?’
আর একটু কাছে এসে মাধবীলতা এক মুহূর্ত অনিমেষের কপালে হাত রেখে দাঁড়াল। তারপর অদ্ভুত গলায় বলল, ‘কপালে যাই থাক না কেন মেয়েদের একবার শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া উচিত। ওখানে না গেলে নিজেকে বউ বলে—।’ কথাটা বলতে বলতে থেমে গেল মাধবীলতা। তারপর মুখ নামিয়ে বলল, ‘এসব মেয়েলি ব্যাপার, তুমি বুঝবে না।’