1 of 2

০৬. কল-পায়খানা নিয়ে অর্ক

ছয়

কল-পায়খানা নিয়ে অর্ককে ঝামেলায় পড়তে হয় না। লাইন দিয়ে অপেক্ষা করার ধাত তার নেই। ইদানীং লাইনভাঙ্গা নিয়ে কেউ মুখে কিছু বলে না, তিন নম্বরের কয়েকজনের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক বলে সবাই মেনে নেয়। এর ওপর আজ ওর মাথা এবং কনুইতে প্লাস্টার বাঁধা থাকায় স্বাভাবিকভাবে সে অগ্রাধিকার পেল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়ার পর ঘরে ফেরার সময় অর্ক অনুকে দেখতে পেল। অনুদের ঘরের দরজা এখন খোলা। অনুর বাবা ঘরের মেঝেতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, দুটো ভাইকে নিয়ে অনু দরজায় ঠেস দিয়ে বসে। ন্যাড়া নেই। অনুর মুখ পাথরের মত, কি ভাবছে বোঝা মুশকিল।

যেতে গিয়েও অর্ক দাঁড়াল, ‘কাল কখন ফিরেছ?’

অনু মুখ তুলল, ‘এগারটা।’ তারপরই সে দেখতে পেল, ‘কি হয়েছে কপালে?’

‘অ্যাকসিডেণ্ট।’

অনু বলল, ‘তোর মা কাল অনেকবার খুঁজতে এসেছিল।’

‘ও। তুমি কি বললে?’

‘তোরা তো অনেক আগেই শ্মশান থেকে চলে এসেছিলি।’

‘হুম।’ অর্ক বুঝল মায়ের কাছে আর মিথ্যে বলা যাবে না। অনুপমার ওপর তার খুব রাগ হয়ে গেল। সে বেশ শক্ত কথা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় অনুর ভাই বলে উঠল, ‘দিদি, খিদে পেয়েছে।’

অনু ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘কতবার বলব আমার কাছে পয়সা নেই।’

বাচ্চাটার মুখ দেখে জিভ সামলে নিল অর্ক, ‘কিছু খাওনি?’

মাথা নাড়ল অনু, ‘বাবার কাছেও পয়সা নেই।’

পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকাগুলো বের করল অর্ক। কাল মাল খাওয়ার পরও প্রচুর টাকা ওর কাছে রয়েছে। একবার মনে হল পুরোটাই অনুর হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এ টাকা ন্যায্যত ওদেরই। কিন্তু পরক্ষণেই আর একটা মন রাশ টেনে ধরল। সে দুটো দশ টাকার নোট অনুর দিকে বাড়িয়ে ধরল, ‘এটা রাখ।’

বিস্মিত অনুপমা ওর মুখের দিকে তাকাতে অর্কর অস্বস্তি হল, ‘ধরো ধরো, ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে কি হবে।’ নোট দুটো অনুপমার কোলে একরকম ফেলে দিয়েই সে ঘরে ঢুকল।

অনিমেষ তেমনি বসে আছে খাটের মাঝখানে। গামছা দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়ালে লটকানো আয়নায় চুল আঁচড়াতে গিয়ে আড় চোখে বাবাকে দেখল অর্ক। এই মুখ সে কখনও দ্যাখেনি। ঠোঁট টেপা, চোখ বন্ধ। ওই মুখের দিকে তাকিয়ে অর্কর মনে হল তখন ওইভাবে কথাটা বলা ঠিক হয়নি। আসলে বাবা তখন এমন টিকটিক করছিল যে—! অর্ক একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, ‘চা খেয়েছ?’

অনিমেষ জবাব দিল না। অর্ক ঘরের কোনায় তাকিয়ে বুঝল স্টোভ জ্বালানো হয়নি, মা আলু ডিম বের করে দিয়ে যায়নি আজ। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার জন্যে চা আনবো?’

‘না।’

‘কেন? চা খাওনি তো।’

অনিমেষ ছেলের দিকে মুখ ফেরালো, ‘তোর সঙ্গে কথা বলতে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দে।’

‘সারাদিনই তো একা আছ।’

এবার অনিমেষ উত্তেজিত হয়ে উঠল, তার গলার শিরা ফুলে উঠছিল, ‘কি করতে চাস তুই? আমাকে মেরে ফেলবি? ফ্যাল, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’

বাবার এইরকম মূর্তি দেখে অর্ক একটু ঘাবড়ে গেল, ‘যাব্বাবা, এরকম করছ কেন? আমি তোমাকে কি বলেছি?’

‘কি বলেছিস? আশ্চর্য, তুই কি বলেছিস তা জিজ্ঞাসা করছিস?’

‘হ্যাঁ, আমি তো অন্যায় কিছু বলিনি?’

অনিমেষ এবার হতভম্ব চোখে ছেলের দিকে তাকাল। অর্ক চোখে চোখ রাখল না, ‘আমাদের সংসারে রোজগার করে মা, সে কথাই বলেছিলাম। এটা কি মিথ্যে কথা?’

আফসোসে বিছানায় চাপড় মারল অনিমেষ, তারপর যেন নিজেকেই বলল, ‘না, সত্যি কথা।’

‘তাহলে এত রেগে যাচ্ছ কেন?’

কি বলবে অনিমেষ? কানাকে কানা কিংবা অন্ধকে যে অন্ধ বলতে নেই সেই কৃপা চাইবে? নিজের ছেলেকে বোঝাবে এগুলো সৌজন্যে বাধা উচিত! না, করুণা নয়। তাহলে সে এত দুঃখিত হল কেন কথাটা শুনে, কেন রাগে অন্ধ হল? বাবা হিসেবে ছেলের কাছে সে কি চেয়েছিল? পুরোনো মূল্যবোধ? অর্ক তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কথা খোঁজার চেষ্টা করল, ‘আমি রোজগার করতে পারি না কেন?’

‘তোমার পায়ের জন্যে।’

‘তবে?’

‘কি তবে?’

‘তাহলে আমি তোদের খাওয়াবো কি করে?’

‘ওটা কোন কথা হল না। তুমি তো তবু দাঁড়াতে পারো, হাঁটতে পারো ক্রাচ নিয়ে, দু’ পা নেই এমন লোকও রোজগার করে আজকাল।’

অর্ক নির্বিকার মুখে বলল। ঈশ্বরপুকুর লেনের মুখে ট্রাম রাস্তার গায়ে একটা লোকের সিগারেটের দোকান আছে যার দুটো পা নেই, লোকটার কথা বলার সময় ভেবে নিল সে।

অনিমেষ বলল, ‘ঠিক আছে। তুই যখন বলছিস তখন নিশ্চয়ই চেষ্টা করব কিছু রোজগার করতে। আসলে তোর মা কখনো চায়নি যে আমি এই শরীর নিয়ে কিছু করি। ভালই হল, তুই মুখের ওপর সত্যি কথাটা বললি।’

অর্ক বলল, ‘এত যদি বুঝতে পারছ তাহলে রাগ করলে কেন?’

‘সে তুই বুঝবি না।’

‘কেন?’

‘বুঝলে একথা বলতিস না।’

অর্ক কাঁধ নাচাল। তারপর কেটলিটা তুলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অনিমেষ লক্ষ্য করল আজ চা নিয়ে আসতে যাওয়ার সময় অর্ক তার কাছে পয়সা চাইল না। ও পয়সা পেল কোত্থেকে তা সে ভেবে পাচ্ছিল না।

অর্কর কপাল এবং কনুই-এর প্লাস্টার অনিমেষ দেখেছে। ও দুটো কেন কিংবা কি করে হল তা জিজ্ঞাসা করেনি। প্রচণ্ড অপমানে সাময়িক অন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। এখন মনে হল কথাটা। মড়া পোড়াতে গিয়ে কারো কপালে আঘাত লাগে না। কাল মাঝরাতে মাধবীলতা খবর পেয়েছিল ওরা দল বেঁধে শ্মশান ছেড়ে চলে গিয়েছে। একথাও শুনেছে ওখানকার এক মাস্তানের সঙ্গে অর্কর ঝামেলা বেধেছিল। খবরটা নিয়ে এসে মাধবীলতা মাটিতে ধপ করে বসে বলেছিল, ‘একি আমাদের ছেলে?’

এমন একটা বিষাদ জ্বালা এবং অপমান ছিল স্বরে যা একমাত্র মায়েদের গলাতেই আসে বলে মনে হয়েছিল অনিমেষের। সে নিজে খবরটা শুনে উত্তেজিত হয়েছিল, ‘সেকি! ওর কিছু হয়নি তো?’

মাধবীলতা মুখ ফিরিয়েছিল, ‘মানে?’

অনিমেষ বলেছিল, ‘খোকা তো কখনও মারামারি করেনি, ওই ছেলেদের বিশ্বাস নেই।’

মাধবীলতা বলেছিল, ‘আজকাল আর কেউ একা একা মারামারি করে না, দল বেঁধে করে। তোমার ছেলে যাদের সঙ্গে রয়েছে তারা অনেকেই জেলের ভাত খেয়েছে। ওর কিছু হবে না।’

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কারা আছে সঙ্গে? বিলু?’

‘একা বিলু কেন হবে? খুরকি, কোয়া, কিলা। নামগুলো দেখে বুঝতে পারছ না চরিত্র কি? কোন ভদ্রছেলের এরকম নাম হয়? তোমার ছেলের প্রাণের বন্ধু এরাই।’ মাধবীলতা নিঃশ্বাস ফেলল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘আমি বুঝতে পারি না ও কি করে ওদের সঙ্গে মেশে। রুচি পর্যন্ত হারিয়ে গেল এখানে থেকে? অথচ ওকে আমরা ছেলেবেলায় যা শিখেছি তাই শিখিয়েছিলাম।’

মাধবীলতা উঠল, ‘যা হবার তাই হয়েছে। আজ রাত্রে ও ফিরলে আমি ঢুকতে দেব না।’

সেই সময় অনিমেষের মনে পড়েছিল আজ সকালে অর্ক ঘুমের ঘোরে তাকে কি বলেছিল। কথাটা মাধবীলতাকে বলতে গিয়েও পারল না সে। নিজের কষ্টের বোঝা ওর কাঁধে চাপিয়ে কুঁজো করে কি লাভ। কিন্তু কাল সারারাত ওরা ঘুমুতে পারেনি। অনিমেষ প্রতি মুহুর্তে আশা করেছিল দরজায় শব্দ হবে। তার পর একসময় ভোর হল, মাধবীলতা উঠল। নির্লিপ্তের মত কাপড় পাল্টে স্কুলে চলে গেল। বেচারা আজ এত অন্যমনস্ক ছিল যে চায়ের কথাও খেয়াল ছিল না। অথচ আজ সকালে ছেলে যখন ফিরল তখন তার কোন অন্যায় বোধ নেই। ওই বয়সে জলপাইগুড়ির বাড়িতে সারারাত না ফেরার কথা সে চিন্তাও করতে পারত না। অনিমেষ অনেক চেষ্টায় নিজেকে সংযত স্থির করছিল। না, মাথা গরম করে কোন ফল হবে না।

চা নিয়ে অর্ক ঘরে ঢুকল। নিমুর দোকানে আজ তাকে সবাই খাতির করেছে। কপাল এবং হাতের প্লাস্টার দেখে অনেকেই অনেক রকম কল্পনা করছিল কিন্তু সে সত্যি কথাটা বলেনি। মারপিট যে হয়েছিল এ বিষয়ে সবাই নিঃসন্দেহ কারণ কিলা আর খুরকি এখনও পাড়ায় ফেরেনি। দু-একজন তাকে জিজ্ঞাসা করলেও সে এড়িয়ে গেছে।

কাপে চা ঢেলে বাবার দিকে এগিয়ে দিতেই সে প্রশ্নটা আবার শুনল, ‘কি হয়েছে তোর কপালে?’

‘কিছু না।’

‘কিছু না মানে? সত্যিকথা বলতে তোর অসুবিধে হয় কেন?’

‘অসুবিধে হচ্ছে কে বলল?’

‘মুখে মুখে তর্ক করছিস। কেউ শখ করে ওসব শরীরে লাগায় না।’

চায়ে চুমুক দিয়ে অর্ক বলল, ‘অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছিল।’

‘অ্যাকসিডেণ্ট? কি করে?’ চমকে উঠল অনিমেষ।

‘শ্মশান থেকে ফেরার সময়।’ অর্ক মুখ তুলে বাবাকে দেখল। তার পকেটে এখনও লাইসেন্স এবং হার রয়েছে। বাবাকে বলবে নাকি সব কথা? ধুস, বললেই নানান ফ্যাচাং তুলবে। কিন্তু একজন চাই যার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। এসবের প্রয়োজন হতো না যদি হসপিটালে নিজের ঠিকানাটা সে না দিত। সে আবার বাবার দিকে তাকাল।

‘তুই মিথ্যে কথা বলছিস।’

‘মিথ্যে কথা?’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কারো সঙ্গে মারামারি করেছিস। তোর মা ঠিকই বলেছে, গুণ্ডাদের সঙ্গে মিশে মিশে।’

‘কি আঙ সাঙ বলছ। আমি বলছি অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছে আর তুমি সেটা বিশ্বাস করছ না।’ খেপে গেল অর্ক।

‘না। কোন প্রমাণ আছে?’

‘আর জি কর হসপিটালে যাও তাহলে জানতে পারবে।’ তারপর দ্রুত পকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স আর হারটা বের করে বলল, ‘আমি মিথ্যে বলছি, না?’

‘এগুলো কি?’ অনিমেষ বিস্ময়ে জিনিসগুলো দেখল।

‘ওই ভদ্রলোকের জিনিস।’

‘কোন ভদ্রলোক?’

অর্ক বাবার দিকে তাকাল। যাচ্চলে। রেগে গিয়ে যা বলেছে এখন আর তা থেকে ফেরার পথ নেই। ঠিক আছে, বলেছে যখন তখন পুরোটাই বলবে। হঠাৎ তার মাথায় আর একটা চিন্তা খেলে গেল। গতরাত্রে অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছিল বলে সে বাড়িতে ফিরতে পারেনি এটা যদি বাবাকে ভাল করে বোঝানো যায় তাহলে মায়ের মেজাজ ঠাণ্ডা করা যাবে। সে এই সুযোগ ছাড়ল না।

‘যার গাড়িতে আমি আসছিলাম। গাড়িটা আর জি কর-এর কাছে এসে প্রচণ্ড অ্যাকসিডেণ্ট করেছে। আমার তেমন কিছু হয়নি কিন্তু ওঁর অবস্থা খুব খারাপ।’ অর্ক খুব বাঁচিয়ে বলার চেষ্টা করছিল।

অনিমেষকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল এখন। ছেলের হাত এবং মুখের দিকে ভাল করে লক্ষ্য করে সে নিঃসন্দেহ হল আঘাত তেমন নয়। মারামারি করলে কনুইতে লাগাবে কেন। কিন্তু অর্ক কি করে সেই ভদ্রলোকের গাড়িতে উঠল।

‘ভদ্রলোকের নাম কি?’

‘বিলাস, লেক টাউনে থাকে।’

‘তুই চিনলি কি করে?’

‘চিনি না তো।’

‘চিনিস না তাহলে গাড়িতে উঠলি কি করে?’

অর্ক চটপট নিজের মাতাল হওয়ার প্রসঙ্গটা বাদ দিল। বলল, ‘নিমতলা থেকে ফেরার সময় আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সামনে একটা গোলমাল বাধায় ওরা যে যার সরে পড়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে বিডন স্ট্রীটে এসে দেখি এক ভদ্রলোক-এর গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। আমাকে ঠেলতে বললেন। গাড়ি স্টার্ট হলে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কোথায় যাব? বেলগাছিয়া শুনে গাড়িতে উঠতে বললেন। তারপর গল্প করতে করতে আসছিলাম আমরা। হঠাৎ একটা গাড়ি সামনে এসে পড়ায় অ্যাকসিডেণ্ট হয়ে গেল। রাস্তার লোকজন আমাদের আর জি করে নিয়ে গিয়েছিল। ওখানেই সারা রাত ছিলাম।’

কথাগুলো বলতে বলতে অর্ক লক্ষ্য করছিল বাবার মুখের চেহারা বেশ নরম হয়ে আসছে। তারপর একটু ভেবে বলল, ‘কাউকে দিয়ে যে তোমাদের খবর পাঠাব তারও কোন উপায় ছিল না।’

অনিমেষ বলল, ‘অজানা অচেনা লোকের গাড়িতে ওঠা ঠিক নয়। কিছু হলে তো আমরা খবরও পেতাম না। এখন কেমন লাগছে?’

‘মাথাটা একটু ভার ভার লাগছে।’ অর্ক সত্যি কথাটাই বলল।

অনিমেষ বলল, ‘খোকা, এদিকে আয়।’

গলার স্বর হঠাৎ পাল্টে গেল বলে অর্ক অবাক হল। ওরা যে মাল খেয়েছিল সে খবর বাবা জানে নাকি। তাহলে তো পুরোটাই ভেস্তে যাবে। সে চোখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’

‘কাছে আয় বলছি।’

ভয় এবং সন্দেহ নিয়ে অর্ক বিছানার কাছে এল। অনিমেষ খাটের একটা কোণ দেখিয়ে বলল, ‘ওখানে বস।’

‘কি বলবে বল না।’ অর্ক বসল কিন্তু গলার স্বর পাল্টাল না।

‘তোকে আমি আমার দাদুর কথা বলেছি, আমার বাবার কথা, তোর মায়ের কথা এমন কি যে জন্যে আমি নিজের কেরিয়ারের কথা না ভেবে আন্দোলনে নেমেছিলাম, সেই সব। তোর মনে কি একটুও রেখাপাত করেনি?’

‘কেন?’

‘তুই আমাদের ছেলে, তোর পেছনে এই সব ঘটনা আছে, এগুলো ভাবলেই মানুষ নিজেকে স্থির করে, কিন্তু…’

‘কি বলবে বলতো?’

অনিমেষ ছেলের দিকে তাকাল, ‘ওই কিলা খুরকিদের সঙ্গ তোকে ছাড়তে হবে খোকা।’

‘কেন?’

‘তুই আবার প্রশ্ন করছিস? সত্যি কি তুই কিছু বুঝতে পারিস না। তোর সঙ্গে ওদের যে কোন মিল নেই তাও অনুভব করিস না?’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘তোমরা ওদের পছন্দ কর না বলে এসব বলছ।’

‘কেন পছন্দ করি না?’

‘ওরা বেশী পড়াশুনা করেনি, আড্ডা মারে তাই।’

‘মোটেই না। ওদের মধ্যে কোন সুস্থ বোধ নেই তাই।’

‘সেটা কি ওদের দোষ?’

‘কার দোষ তা বিচার করে তোর কি হবে? তুই পড়াশুনার সুযোগ পাচ্ছিস, মন দিয়ে তাই কর।’

অর্কর ঠোঁটের কোণ ভাঙ্গল, ‘তারপর?’

অনিমেষ এই প্রশ্নটা আশা করেনি। সে ছেলের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তারপর শিক্ষিত হয়ে যেটা ভাল লাগবে তাই করবি। তখন আমরা তোকে কিছু বলতে যাব না। এই বয়সে কতগুলো হুলিগানের সঙ্গে আড্ডা মেরে মারামারি করে নিজেকে নষ্ট করবি কেন? ওদের দেখতে পাসনা? মদ খায় আর সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করে। আর একটু বয়স হলে কি হবে।’

‘মদ তো শিক্ষিত লোকরাও খায়।’

‘খায় কিন্তু সবাই খায় না। যারা খায় তারা সেটাকে মানাতে পারে। তোর মতন বয়সে আমি এসব ভাবতে পারতাম না।’

‘তুমি বস্তিতে থাকতে না। তাছাড়া, তুমি শিক্ষিত হয়ে শেষ পর্যন্ত কি করছ? কত বি এ এম এ বেকার বসে আছে। ওই তো প্রণবদা, এম এ পাশ, চাকরি পায়নি বলে রকে আড্ডা দেয়।’

‘ঠিকই। আমরা চেষ্টা করেছিলাম এই ব্যবস্থাটাকে ভাঙ্গতে। হাজার হাজার ছেলে আন্দোলনে নেমেছিল। পুলিসের গুলিকে তোয়াক্কা করেনি। আমাদের আফসোস যে আমরা পারলাম না। কিন্তু একটা সান্ত্বনা যে আমরা তো চেষ্টা করেছিলাম। তুই আমাদের সঙ্গে তোদর তুলনা করছিস?’ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল অনিমেষ।

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘দূর। শেষ পর্যন্ত তোমার সঙ্গে একটা বেকার লোকের কোন পার্থক্য নেই। যে থার্ডের মধ্যে আসতে পারেনি তার সঙ্গে লাস্টের কি তফাত? তোমরা, মা, দিনরাত বল বলে আমি পড়ি নাহলে আমার পড়তে একটুও ভাল লাগে না।’

‘ভাল লাগে না?’

‘না। অশোক কি করেছিল, রবীন্দ্রনাথের প্রার্থনা কবিতাটা মুখস্থ করে আমার কি হবে?’

‘তোর কি ভাল লাগে?’

‘জানি না।’

‘না। জানি না বললে চলবে না। খোকা, তুই অন্তত বারো ক্লাসটা পাশ কর তারপর যা ইচ্ছে করবি।’ অনিমেষ অনুনয় করল।

অর্ক প্রতিবাদ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মাথা নাড়ল। সেটা হ্যাঁ কি না তা বোঝা গেল না। তারপর বলল, ‘আসলে তোমরা এই বস্তির ছেলেদের ঘেন্না কর।’

‘ঘেন্না করি?’

‘হ্যাঁ। নইলে মা ওদের সঙ্গে মেশে না, কথাও বলে না। তুমি শুধু উনুন সারাই-এর দোকান ছাড়া কোথাও যাও না, কেন?’

‘এদের সঙ্গে আমাদের মনের সঙ্গে মেলে না তাই, ঘেন্না নয়।’

‘কেন মেলে না? আমার বন্ধুদের বাবা মা তো খিস্তি করে না।’

‘তুই এখন বুঝবি না।’

তোমার ওই এক কথা, তুই বুঝবি না। বোঝার জিনিস কেন আমি বুঝব না? সেদিন কোয়া বলছিল ওরা নাকি উদ্বাস্তু। ওদের পাকিস্তানে অনেক কিছু ছিল। বাবা মা এখানে পালিয়ে আসার পর কোয়া হয়, তাই ও কিছু দ্যাখেনি। ওর বাবা মা নাকি এখনও আফসোস করে কিন্তু কোয়া করে না। কেন করে না সেটা আমি বুঝতে পারি না?’ অর্ক উঠল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়াতে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, ফাক্‌ দি টাইম কথাটার মানে কি?’

অনিমেষের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এই বস্তির ছেলেদের মুখ থেকে ছিটকে আসা অশ্রাব্য গালাগালি বাধ্য হয়ে দিনরাত তাকে শুনতে হয় কিন্তু এই ইংরেজি খিস্তিটি তো অর্কর জানার কথা নয়। সে নিজেকে সংযত করল অনেক কষ্টে। তারপর সূত্র খোঁজার জন্যে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’

‘কাল রাত্রে সেই ভদ্রলোক গাড়ি চালাতে চালাতে কথাটা বলেছিল। আমি মানে বুঝতে পারিনি।’

‘ও। কথাটা গালাগালি। কিন্তু সেই লোকটা বলল কেন?’

‘জানি না। নিজের মনেই বলছিল। কি গালাগালি?’

‘খুব নোংরা।’

‘খিস্তি?’

‘হ্যাঁ।’

‘যাঃ।’

‘এসব নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। তুই আজ স্কুলে যেতে পারবি? শরীর কেমন লাগছে?’

‘ঘুম পাচ্ছে খুব।’

‘বেশ, তাহলে আজ স্কুলে যেতে হবে না। স্নানটান করে ঘুমিয়ে নে।’

অনিমেষের কথাটা বেশ মনঃপূত হল অর্কর। সত্যি ওর শরীরে এখন অবসাদ, মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু একটা কথা সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও করল না, ফাক্ দি টাইম কি ধরনের খিস্তি। কিলারা যা বলে সেই রকম কি? তাই যদি হয় তাহলে শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে কিলার প্রভেদ নেই। কিন্তু ততক্ষণে অনিমেষ খাট থেকে ক্র্যাচ নিয়ে নেমে পড়েছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরের কোণে গিয়ে তরকারির ঝুড়িটা তাক থেকে নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই বরং স্নান করে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়। আমি স্টোভ ধরিয়ে দিচ্ছি।’

অর্ক বলল, ‘এখন কেউ ভাত খায় নাকি? মা আসার আগে রান্না করো।’ কথাটা বলেই ওর খেয়াল হল মাধবীলতার কথা। মাকে বাবা যদি ম্যানেজ করে তাহলে ভাল হয়। কিন্তু সরাসরি কথাটা বলতে আটকালো ওর। তবে এতক্ষণে এটুকু বোঝা যাচ্ছে বাবা নিশ্চয়ই মাকে তার হয়ে বলবে। অ্যাকসিডেণ্ট হয়েছিল শুনলে মা কিছু না-ও বলতে পারে।

শোওয়ার তোড়জোড় করছিল অর্ক। ক্র্যাচ বগলে নিয়ে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে গেল অনিমেষ। মাদুর পেতে চিৎ হয়ে শুতেই খুব আরাম বোধ হল। আঃ, কতদিন যেন শোয়নি সে। প্যাণ্টটা ছাড়তেও ইচ্ছে করছে না। গত সকাল থেকে এটা পরে আছে সে। শালা, কাল অল্পের জন্যে জান যায়নি। আর একটু বেকায়দায় পড়লে চোট হয়ে যেত। মাতাল হয়ে লোকটা ইংরেজিতে খিস্তি করছিল কেন? বিলাস সোম। নামটা দারুণ। কিন্তু এতক্ষণে হাওয়া হয়ে যায়নি তো? মরে গেলে খবর পাবে কি বাড়ির লোকজন? লেক টাউন বিরাট জায়গা, পুলিস বের করতে পারবে খুঁজে? হসপিটাল থেকে বলেছিল খবর দিতে। দামী হার আর লাইসেন্সটার কথা মনে পড়ল ওর। তড়াক করে উঠে বসে সে খাটের ওপর থেকে সেগুলোকে নিজের কাছে নিয়ে আনল। হারটা বেশ ভারী। লকেটটা কিসের বুঝতে পারল না তবে বেশ দামী বলে বোধ হল। চেপে গেলে কেমন হয়! সে তো আর এই মালটা চুরি করেনি। লোকটার পকেট থেকে আপনিই তার হাতে চলে এসেছিল। তাছাড়া লোকটা যদি টেঁসে যায় তাহলে কেউ জানতেও পারবে না। শুধু তখন উত্তেজনার মাথায় বাবাকে এটা দেখিয়ে ফেলেছে সে। অবশ্য বাবাকে বলে দেওয়া যাবে যে হার সে ফেরত দিয়ে এসেছে। অর্ক ঠিক করল, দুপুরবেলায় একবার হসপিটালে গিয়ে খোঁজ নেবে লোকটা বেঁচে আছে কিনা, সেই বুঝে কাজ করা যাবে।

দরজায় কড়া নড়ে উঠতেই চমকে গেল অর্ক। দ্রুত হারখানা পকেটে ঢুকিয়ে রাখল সে। কে এল? হসপিটাল থেকে তাকে খুঁজতে আসেনি তো! সে দ্রুত চোখ বোলালো চারধারে, হারখানা কোথায় লুকিয়ে রাখা যায়? আর তখনই ডাক শুনতে পেল, ‘অক্ক।’

গলাটা চেনা কিন্তু ধরতে পারল না অর্ক। দ্বিতীয়বার ডাকটা কানে আসতেই সে সাড়া দিল, ‘কে?’

বাইরে থেকে ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। অর্ক দেখল বিলু এসে দাঁড়াল দরজায়। উঠে বসল অর্ক, ‘কি বে?’

বিলুর দুই হাত কোমরে। ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এর মধ্যেই ডানা গজিয়ে গেল তোর অক্ক। আমাকে ল্যাং মারতে চাস?’

‘মানে?’

‘মানে টানে বুঝি না, টাকা দে।’ হাত পাতল বিলু ঘরে ঢুকে।

‘কিসের টাকা?’

‘শালা আমি তোমার কাছে মারাতে এসেছি? ন্যাড়ার মায়ের টাকা তোর কাছে কত আছে তার হিসেব আমি জানি। টাকাটা দে টিকিট তুলতে হবে নটার সময়।’ অধৈর্য হচ্ছিল বিলু।

অর্ক উঠে দাঁড়াতেই বিলু প্লাস্টার দেখতে পেল, ‘কি হয়েছে বে তোর। ঝাড়পিট করেছিস?’

‘না। অ্যাকসিডেণ্ট। খুব জোর বেঁচে গেছি।’

‘খুরকি কিলা কোথায়?’

‘পুলিস তুলে নিয়ে গিয়েছে। টাকাটার জন্যে ওরা মারপিট শুরু করেছিল। বিশ্বাস কর বিলু, আমি তখন এমন আউট হয়ে গিয়েছিলাম যে ওরা যখন আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আমি টের পাইনি।’

‘কি করে অ্যাকসিডেণ্ট হল?’

‘গাড়িতে। এক ভদ্রলোককে ধরে বাড়িতে ফিরছিলাম। সেই লোকটা হাসপাতালে শুয়ে আছে। এই দ্যাখ লোকটার ড্রাইভিং লাইসেন্স।’

‘মরে গেছে?’

‘জানি না।’

‘বাড়িতে খবর দিয়েছিস?’

‘না। খবর দিতে বলেছিল, দিইনি। লেক টাউনে বাড়ি।’

‘দুর বে। তুই শালা বুদ্ধু। কত টাকা আছে তোর কাছে?’

‘যা ছিল তার থেকে কুড়িটা টাকা ন্যাড়ার দিদিকে দিয়েছি।’ পকেট থেকে টাকাটা বের করে গুনল অর্ক। তারপর অঙ্কটা বলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু তোকে আমি এই টাকা দেব কেন?’

টাকাটা দেখার পর বিলুর চেহারাটা বদলে গেল। সে বলল, ‘বাইরে চল, তোর সঙ্গে কথা আছে।’

‘না, আমি বাইরে যাব না, আমি ঘুমাবো।’

‘ফোট, ঘুমাবার সময় অনেক পাবি।’

‘ঘরে কেই নেই।’

‘তোর বাপ শালা উনুনের কারখানায় বসে আছে।’

‘কি করবি বল না?’

‘শোন, খুরকি কিলা ওই টাকা চাইবেই। আমরাও কিছু কমতি না। ওরা আসার আগেই টাকাটা খাটিয়ে দুজনে রোজগার করে নিই চল। ফিফটি ফিফটি।’

‘কিভাবে?’

‘বললাম না, টিকিট তুলব। আজ অ্যাডভান্স দেবে সিনেমার। সুপার হিট ছবি। খুরকির সঙ্গে লাইন আছে হলের। খুরকি যদি না আসতে পারে আমরা ওর মালটা নিয়ে নেব।’

‘খুরকি কিছু বলবে না?’

‘ওতো আজ না এলে কিছুই পেত না তবু আমরা দশ বিশ দিয়ে দেব। দু টাকা পঁয়তাল্লিশ আট টাকায় যাচ্ছে। চল, আর দেরি করিস না।’

‘দূর। আমি ব্ল্যাক ট্‌ল্যাক করতে পারব না।’

‘তাহলে মালটা ছাড়।’

‘তোকে দেব কেন?’

‘ওসব নক্‌শা ছাড় গুরু। হয় দাও নয় চল।’

‘ঠিক আছে, কিন্তু আমি সামনে যাব না।’

‘আচ্ছা।’

জামা গলিয়ে ও যখন বের হচ্ছে তখন বিলু বলল, ‘আ বে, ওই লাইসেন্সটা সঙ্গে নে।’

‘কেন?’

‘লেক টাউনে যাব। লোকটার বাড়িতে খবর দিয়ে আসি চল।’

অর্ক বিলুর দিকে তাকাল তারপর ওটা নিয়ে নিল পকেটে। দরজা ভেজিয়ে উনুনের কারখানার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অর্ক অনিমেষকে দেখতে পেল। ঘুমন্ত ছেলেকে উঠে আসতে দেখে অনিমেষের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল। যেতে যেতেই অর্ক বলল, ‘লোকটা মরে যেতে পারে তাই ওর বাড়িতে খবর দিতে যাচ্ছি।’

বাবার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে ও মুখ ফেরাল না। ঈশ্বরপুকুর লেনে পা দিয়ে সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘ফাক্ দি টাইম।’

বিলু অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি বলছিস বে?’

অর্ক হাসল, ‘তুই বুঝবি না। এটা ইংরেজি খিস্তি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *