চব্বিশ
ফেরার পথে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘পরমহংসকাকু, আপনাদের বাড়িটা কোথায়?’
পরমহংস একটু থমকে দাঁড়াল, ‘বেশী দূরে নয়, মিনিট কয়েক। যাবে?’ জিজ্ঞাসা করেই মত পাল্টালো, ‘না, থাক। গিয়ে দরকার নেই।’
মাধবীলতা হেসে ফেলল, ‘কি ব্যাপার?’
‘ওটা তো আমার বাড়ি নয়। একখানা ঘর আমার বরাদ্দ। তাতে বুড়ো আঙ্গুল থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সব ঠাসা আছে। তার চেয়ে—’। পরমহংস কোথায় বসবে ভাবছিল।
মাধবীলতা বলল, ‘এবার একটা বিয়ে করে ফ্যালো। এরপর আর বউ জুটবে না।’
পরমহংস চশমার ফাঁকে কৌতুকের চোখে তাকাল, ‘এখনই জুটবে তাই বা কে বলল?’
‘না। চল্লিশে এসে দেখছি ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়নি। একটু চেষ্টা করলেই ভাল পাত্রী খুঁজে পেতে পারি। করব?’
‘খ্যাপা।’
‘উড়িয়ে দিচ্ছ কেন?’
‘দ্যাখো, এই বেশ আছি। খাচ্ছি দাচ্ছি বগল বাজাচ্ছি। যাকে বিয়ে করব সে এসে একটার পর একটা ভ্যারাইটিস বল করে যাবে আর আমি প্রতিটি বলে আউট হব।’
‘মানে?’
‘এই ধরো, মিষ্টিমুখে খসাবে মানে স্পিন ছাড়বে। একটু অভিমান অর্থাৎ ইয়র্কার, চোখ রাঙালে বাম্পার আর কিছুই যেটায় বুঝতে পারব না সেটা গুগলি!’
ওর বলার ধরন এবং হাত নাড়া দেখে মাধবীলতা শব্দ করে হেসে উঠেছিল, অর্কও। দুপাশের কেউ কেউ মুখ তুলে তাকিয়েছিল সেই শব্দ শুনে। মাধবীলতা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘সব ব্যাপারে তোমার ফাজলামি।’
‘মোটেই নয়। আমার উচ্চতা দেখছ? তোমাদের বাতিল করা বাতাস আমি টানি। যে মেয়েকে তুমি পছন্দ করবে তাকে নিশ্চয়ই আমার চেয়ে ছোট কিংবা সমান হতে হবে। এবার আমাদের ফসলের কথা ভাবো, উঃ, দেশটা ক্রমশ লিলিপুটে ছেয়ে যাবে। নো, ইম্পসিব্ল। দেশের প্রতি আমার নিশ্চয়ই কর্তব্য আছে।’ অত্যন্ত গম্ভীর মুখে কথাগুলো বলল পরমহংস কিন্তু ততক্ষণে মাধবীলতার মুখে সিঁদুর জমেছে। অর্ক হাসি চাপতে চাপতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েছে। মাধবীলতা ইশারায় অর্ককে দেখিয়ে বলল, ‘কি হচ্ছে কি?’
পরমহংস বলল, ‘নাথিং রং। ষোল বছর হলে বন্ধু হয়ে যায় ছেলেমেয়ে।’
মাধবীলতা প্রতিবাদ করল, ‘ওর এখনও ষোল হয়নি।’
‘হয়নি হবে। তাছাড়া শ্লোকটা লেখা হয়েছিল আদি যুগে। তখন ষোলতে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবা হতো। যুগের সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের চিন্তাভাবনা করার শক্তি এত বেড়েছে যে এখন ওটাকে ষোল থেকে নামিয়ে আনা যায়। আমার এক ভাইপো আছে, মাত্র চার বছর বয়স। রোজই বেরুবার সময় জিজ্ঞাসা করে, কাকু কি আনবে? তা আমি কাল ঠাট্টা করে বললাম, খুব সুন্দরী রাজকন্যা, তোর বউ।’ শুনে ভাইপো খুব গম্ভীর মুখে বলল, ‘না কাকু বউ এনো না। আমি তো চাকরি করি না।’
চোখ বড় করল পরমহংস, ‘বোঝ!’
মাধবীলতা বলল, ‘সত্যি, আজকালকার বাচ্চারা খুব পাকা হয়ে গিয়েছে।’
পরমহংস হাত নাড়ল, ‘অতএব অর্ককে আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে ভাবতে পারি।’
কথা বলতে বলতে ওরা ট্রামরাস্তার ওপরে চলে এসেছিল। আসা মাত্র অর্কর মনে পড়ল সেদিনের ঘটনাটা। ছেলেগুলো তাকে এখানেই মেরেছিল। চিৎপুর আর গ্রে ষ্ট্রীটের মোড়। পরমহংস বলল, ‘চল, কোথাও গিয়ে চা খাওয়া যাক।’
মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ‘তার চেয়ে আমাদের ওখানে চা খাওয়াবো।’
‘দূর। অদ্দূরে চা খেতে যাব কেন? একটু এগোলেই ভাল দোকান আছে।’
মাধবীলতা ইতস্তত করছিল। সেটা বুঝতে পেরে পরমহংস বলল, ‘উঃ, তুমি দেখালে বটে। এক কাপ চা খাবে তাও বোধহয় অনিমেষের কথা ভাবছ। চল অর্ক।’ অতএব আর আপত্তি টিকলো না। অর্ক মুখ ফিরিয়ে পরমহংসের সিঁথি দেখতে পাচ্ছিল। বেঁটেখাটো মানুষ কিন্তু হাঁটে বেশ আত্মমর্যাদার সঙ্গে। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি এদিকে আগে এসেছ?’
অর্ক ঘাড় নাড়ল, ‘হ্যাঁ।’ বলতে বলতে সে বাড়িটাকে দেখতে পেল। ওর মনে হল যে ঘটনার পর থেকে মায়ের ব্যবহারে পরিবর্তন ঘটেছে সেই ঘটনা ওই বাড়িটার জন্যে ঘটেছিল। এবং তারই সঙ্গে সে কেমন সিরসিরে আকর্ষণ অনুভব করছিল। ঊর্মিমালাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব। সে মুখ নামিয়ে মাধবীলতাকে বলল, ‘মা, ওই বাড়িতে ঊর্মিমালারা থাকে।’
মাধবীলতা চট করে মুখ তুলে ছেলেকে দেখল। ঊর্মিমালা নামটা শুনে সে কিছুই বুঝতে পারছিল না প্রথমটায়। অর্ক আবার বলল, ‘সেই যে, যে মেয়েটাকে ট্রামে বিরক্ত করেছিল বলে আমার সঙ্গে মারামারি হয়েছিল!’
‘ও’। মাধবীলতা মুখ ফিরিয়ে বাড়িটাকে দেখল।
‘তুই কি পরে ওখানে গিয়েছিলি?’
‘না।’
পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার?’
মাধবীলতা এড়িয়ে যেতে চাইছিল, পারল না। সব শুনে সপ্রশংস চোখে অর্কর দিকে তাকাল, ‘সাবাস। এই তো চাই, পুরুষের মত কাজ করেছিস। আমরা মাইরি পথে ঘাটে ভেড়ুয়ার মত চলাফেরা করি। প্যাঁদাবি, বদমাইসি করতে দেখলেই ধরে প্যাঁদাবি। তুই নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ পড়িসনি। আমাকে পড়তে হয়েছিল এম এ পড়তে গিয়ে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, অন্যায়ের ছুরির কোন বাঁট থাকে না। যে মারে সে নিজেও রক্তাক্ত হয়। তোর সম্পর্কে আমার ধারণাটা বেড়ে গেল রে।’
মাধবীলতা বলল, ‘থাক, আর হাওয়া করো না তুমি, একেই মা মনসা—’।
অর্ক বলল, ‘আমি কি মহিলা যে মনসার সঙ্গে তুলনা করছ?’
পরমহংস বলল, ‘কারেক্ট। কিন্তু সেই ঘটনার পর ওদের কিছু হয়নি তো?’
‘মানে?’ অর্কর চোখ ছোট হল।
‘তুই তো মেয়েটাকে বাঁচিয়ে গেলি কিন্তু তারপরে ওরা এসে ওদের কোন ক্ষতি করেনি তার ঠিক কি! একবার খোঁজ নিলে হয়।’ কথাটা শেষ করে পরমহংস অর্কর দিকে নিরীহ ভঙ্গীতে তাকাল। সেটা দেখতে পায়নি মাধবীলতা, বলল, ‘কিছুই অসম্ভব নয়। এই সব ছেলেদের কাজকর্ম বোঝা মুশকিল। এই নিজের ছেলেকেই তো এক সময় আমি বুঝে উঠতে পারতাম না।’
পরমহংসের সামনে মায়ের এই রকম কথা বলা পছন্দ হচ্ছিল না অর্কর। পরমহংস বলল, ‘যা অর্ক, একবার চট করে ঘুরে আয়, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি।’
আর তখনই অস্বস্তি হল অর্কর। সে গিয়ে কি জিজ্ঞাসা করবে? আপনারা কেমন আছেন তাই দেখতে এলাম? কেমন ক্যাবলা ক্যাবলা শোনাবে না সেটা। কিন্তু সেই সঙ্গে আকর্ষণটাও তীব্রতর হচ্ছিল । ডিমের মত মুখ, লম্বা মোটা বেণী, দুই ভুরুর তলায় কি শান্ত টানা চোখ। আর তখনই মাধবীলতা বলল, ‘তাড়াতাড়ি আসবি।’
খুব আড়ষ্ট পায়ে অর্ক এগোচ্ছিল। মায়েদের সঙ্গে যত ব্যবধান বাড়ছে বাড়িটার সঙ্গে সেটা তত কমছে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এসে কলিং বেলে হাত রাখা মাত্র দরজা খুলে গেল। একটি অল্পবয়েসী মেয়ে, সম্ভবত কাজের লোক, জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই?’
অর্কর গলায় তখন রাজ্যের জড়তা। কোনরকমে বলল, ‘ওঁরা আছেন?’
‘কার কথা বলছেন?’
‘মাসীমা। এছাড়া কোন সহজ উত্তর অর্কর মুখ থেকে বের হল না।
‘কি নাম আপনার? মেয়েটির চোখে তখনও সন্দেহ।
‘অর্ক, অর্ক মিত্র।’
দরজার দুটো পাল্লা ভেতর থেকে একটা চেনে আটকানো থাকায় ইঞ্চি দেড়েকের বেশী ফাঁক হচ্ছে না। বাইরে থেকে ঠেললেও খোলা যাবে না। মেয়েটি চলে যাওয়ায় কিছু বাদেই পায়ের শব্দ শুনতে পেল। এবং তারপরেই ওই দেড় ইঞ্চি ফাঁকের মধ্যে একশ সূর্য যেন হেসে উঠল। ঊর্মিমালা যে দৌড়ে এসেছে তা বোঝা যাচ্ছে। সমস্ত মুখ হাসিতে উজ্জ্বল। একটা হালকা কমলা রঙের মিডি পরনে এবং তার হাতা কনুই-এর সীমা ছাড়িয়ে নেমে সামান্য ছড়ানো। চটপটে হাতে শেকল খুলে সে ডাকল, ‘আসুন।’
অর্কর ভাল লাগছিল। এরকম ভাল লাগার মুহূর্ত তার জীবনে কখনও আসেনি। বুকের মধ্যে যেন কানায় কানায় ভরা একটা নিটোল দীঘির জল দুলছে।
সে কোনরকমে মাথা নাড়ল, ‘না। মাসীমা নেই?’
‘আহা, আগে ভেতরে আসুন তো।’ পাল্লা দুটো সরিয়ে দিয়ে একপাশে দাঁড়াল ঊর্মিমালা। অর্ক ইতস্তত করে বলল, ‘কোন বিপদ হয়নি তো?’
‘কিসের বিপদ?’ দুই ভুরুর তলায় যে চোখ দুটো ছায়া পড়ল।
‘ওই ছেলেগুলো আর আসেনি তো?’ অর্ক জানতে চাইল।
এবার সুন্দর হাসল ঊর্মিমালা, ‘কেন, আপনি সেদিন বললেন যে, যারা ভয় পায় তারা কিছু করে না! না, আর কিছু হয়নি। এবার আসুন।’
মাথা নাড়ল অর্ক, ‘না, আজ হবে না। আমি চলি?’
‘ও, শুধু এইটুকু জানবার জন্যে এসেছেন?’ ঊর্মিমালার মুখ পলকেই অন্ধকার।
‘হ্যাঁ।’ অর্ক ঘুরে দাঁড়াল।
‘কোন দরকার ছিল না এইভাবে দয়া দেখাতে আসবার।’
অর্ক চমকে উঠে মুখ ফেরাতেই অন্ধকারটাকে দেখতে পেল। ও তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আজকে বসতে পারব না কারণ আমার মা আর এক কাকু নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কাউকে দয়া দেখাতে আসিনি।’
‘ওমা, তাই?’ এবার প্রচণ্ড বিস্ময় ঊর্মিমালার মুখে, ওঁরা নিচে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কি আশ্চর্য! ওঁদের নিয়ে এলেন না কেন?’
‘বাঃ, এ বাড়ির কাউকে কি ওঁরা চেনেন?’
‘আপনি চেনেন তো।’
‘আমি তো মাত্র একদিন এসেছি।’
‘ও!’ শব্দটা ঠোঁট থেকে বের হওয়ার সঙ্গে ঊর্মিমালার চোখ অর্কর মুখ ছুঁয়ে গেল; তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘চলুন।’
অর্ক অবাক হল, ‘আরে, আপনি কোথায় যাবেন?’
ঊর্মিমালা ঘাড় ঘুরিয়ে কাজের মেয়েটিকে ডাকল, ‘আমি এক্ষুনি আসছি, তুমি এখানে দাঁড়াও, দরজা খোলা রয়েছে। চলুন।’
প্রায় বাধ্য ছেলের মত অর্ক ঊর্মিমালার পাশাপাশি নিচে নেমে এল। হাঁটার সময় একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে আসছিল, মিষ্টি কিন্তু মোটেই তীব্র নয়। সে আড়চোখে দেখছিল ঊর্মিমালাকে। কেমন স্বপ্নের মত দেখতে। গায়ের রঙ শ্যামলা কিন্তু কি নরম। এ মেয়ে ফরসা হলে মোটেই মানাত না।
নিচে নামামাত্র মাধবীলতারা ওদের দেখতে পেল। এবং সেই তাকানো দেখে ঊর্মিমালারও বুঝতে অসুবিধে হল না। অর্ক কিছু বলার আগেই ঊর্মিমালা এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে সেই ফুটপাথে দাঁড়ানো মাধবীলতার পা স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে মাধবীলতা আপত্তি করে উঠতে গিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল, ‘বাঃ, কি সুন্দর মেয়ে। কি যেন তোমার নামটা?’
‘ঊর্মিমালা মুখার্জী।’ মাধবীলতার হাতের বাঁধন আলগা হতেই ঊর্মিমালা নামটা বলে পরমহংসের পায়ের দিকে হাত বাড়াতেই সে তিড়িং করে লাফ দিয়ে সরে গেল, ‘আরে আরে কি সর্বনাশ। চেনা নেই জানা নেই হুটহাট প্রণাম করতে আছে?’ ওর ভঙ্গী দেখে ঊর্মিমালা হেসে ফেলল, ‘আপনি তো ওর কাকা!’
‘মাই গড! সেটাও জেনে বসে আছ? এ একদম বডি-লাইন থ্রো । এড়াবার কোন উপায় নেই। পরমহংস কথাটা বলে হাসতে লাগল। অর্ক দেখছিল দুই ফুটপাথের অনেকগুলো চোখ এখন এইদিকে। মাধবীলতাকে প্রণাম করাটা যত না চোখে পড়েছে পরমহংসের লাফানো এবং চিৎকার অনেকের নজর কেড়েছে। এবার ঊর্মিমালা এগিয়ে এসে মাধবীলতার হাত ধরল, ‘আসুন।’
‘কোথায়?’ মাধবীলতার চোখ যেন কপালে উঠল।
‘আমাদের বাড়িতে।’
‘না গো, আজ নয়। বাড়িতে অনেক কাজ ফেলে এসেছি।’
‘তা হোক। আমি কোন কথা শুনব না। আপনি এলে আমার ভাল লাগবে।’
মাধবীলতা মেয়েটির মুখ দেখল। এরকম নিষ্পাপ মুখ আজকাল সচরাচর দেখা যায় না। স্কুলে তো অজস্র মেয়ে দেখল, তাদের অনেকের মুখে এই বয়সে কেমন যেন একটা পাকামির ছাপ পড়ে। অধিকাংশই কপালের পাশের চুল কাটে, গালে ব্রণর দাগ এবং মুখের ভেতর একটা খসখসে চালাকি ছড়ানো থাকে। এই মেয়ের সর্বাঙ্গে এমন একটা স্নিগ্ধতা আছে যা মনটাকেই মিষ্টি করে। যেন বাধ্য হয়েই যাচ্ছে, এমন ভঙ্গীতে সে বলল, ‘বেশীক্ষণ বসব না কিন্তু।’
ঊর্মিমালার পাশাপাশি যখন মাধবীলতা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে তখন অর্ক দেখল পরমহংস সেখানই দাঁড়িয়ে। সে ইশারা করতেই পরমহংস মাথা নাড়ল, সে যাবে না। অর্ক একটু গলা তুলে বলল, ‘মা, পরমহংস কাকু—।’
মাধবীলতা ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হল?’
পরমহংস নির্বিকার মুখে জবাব দিল, ‘তুমি গেলে কারো ভাল লাগবে, আমাকে তো কেউ যেতে বলেনি। আমি কি ফেকলু?’
কথাটা শুনে অর্ক হেসে উঠল। আর ঊর্মিমালা এগিয়ে এল পরমহংসের কাছে, ‘আমার অন্যায় হয়ে গেছে।’
সঙ্গে সঙ্গে পরমহংস মুখটা বিকৃত করল, ‘দূর! এ মেয়ে দেখছি রসিকতাও বোঝে না। একেবারে গোবরঠাসা। চল চল।’
মাধবীলতা হেসে বলল, ‘তোমার কোনটা ঠাট্টা কোনটা নয় তা আমিই বুঝতে পারি না তো এ বেচারা বুঝবে কি করে বল!’
ঊর্মিমালা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল, ‘না, না, আমি বুঝতে পেরেছিলাম।’
পরমহংস হাঁ হয়ে গেল, ‘বুঝতে পেরেছিলে? তা বুঝেও ক্ষমা চাইলে কেন?’
মাথা নিচু করে ঊর্মিমালা বলল, ‘না হলে আপনি যে আসতেন না!’
‘অ্যাঁ।’ পরমহংস চোখ বড় করল, ‘তার মানে তুমি আমাকে ঠাট্টা করেছ?’
মুখে কিছু বলল না, কিন্তু দ্রুত মাথা নেড়ে না বলে ঊর্মিমালা বাকি সিঁড়ি দৌড়ে শেষ করে দরজায় পৌঁছে গিয়ে বলল, ‘আসুন।’
পরমহংস হাত উল্টে অর্ককে বলল, ‘এক্কেবারে ইনিংসে হারলাম রে।’
মাধবীলতা ভেতরে ঢুকেই বলল, ‘তোমার মা কোথায়?’
‘মা বাথরুমে ছিল, নিশ্চয়ই বেরিয়ে পড়েছে এতক্ষণে, আপনারা বসুন আমি দেখে আসছি।’ হাত দিয়ে সোফা দেখিয়ে দিয়ে ঊর্মিমালা ভেতরে চলে গেল।
সোফায় সবাই বসলে মাধবীলতা বলল, ‘বেশ মেয়েটি তাই না?’
পরমহংস গম্ভীর মুখে বলল, ‘ভাগ্যিস তোমার মেয়ে হয়নি।’
‘মানে?’ মাধবীলতার কপালে ভাঁজ পড়ল।
‘তাহলে সে এর ডুপ্লিকেট হয়ে যেত।’
‘যাঃ।’ মাধবীলতার মুখ লালচে, ‘কি যে বল না!’
অর্ক হাসি চেপে ঘরের জিনিসপত্র দেখছিল। এসব দেখলেই তার খুব অস্বস্তি হয়। জন্ম ইস্তক বই-এর সুন্দর আলমারি, দামী সোফা, দেওয়ালে নানান সুদৃশ্য বস্তু সে নিজেদের ঘরে দ্যাখেনি। হঠাৎ একটু হালকা লাগল তার। নতুন বাড়িতে চলে এলে একটা ঘর অন্তত এরকম করে সাজাতে হবে। নতুন বাড়িতে চলে এলে একদিনে হবে না কিন্তু একটু একটু করে তো সাজানো যায়। হঠাৎ মাধবীলতার কণ্ঠস্বর কানে এল, ‘কি দেখছিস?’
অর্ক মুখ ফেরালো, কি সুন্দর সাজানো, না?’
‘হুম্।’ মাধবীলতা মুখ নামাল, ‘আমার খুব সঙ্কোচ হচ্ছে। এভাবে হুট করে চলে আসাটা, এঁরা কি ভাববেন কে জানে!’
বলতে বলতে ঊর্মিমালা যাঁকে নিয়ে এল তাকে দেখে ভাল লাগল মাধবীলতার। মোটাসোটা গিন্নিবান্নি চেহারা, বেশ মা মা ভাব আছে। মাধবীলতা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল, ‘দেখুন তো মিছিমিছি এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম। আপনার মেয়ে কিছুতেই ছাড়ল না—।’
নমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা হাত ধরলেন মাধবীলতার, ‘ওমা, তাতে কি হয়েছে। আপনারা এসেছেন এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। মেয়ে আমার ঠিক কাজ করেছে। আমি ক’দিন থেকে ওঁকে বলছি ছেলেটার খোঁজ নাও, বিপদ-আপদ হতে পারে, তা ওঁর আর সময় হয় না।’
মাধবীলতা হেসে বলল, ‘বিপদ ওর হয়নি আমাদের হয়েছিল।’
‘সেকি! কি ব্যাপার?’
‘বাবু খুব অসুখ বাধিয়েছিলেন। বেশ ভুগেছেন।’
ভদ্রমহিলা হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আমার নাম মণিমালা, আপনাকে কি বলে ডাকব?’
‘মাধবীলতা। ইনি আমাদের খুব বন্ধু, পরমহংস।’
পরমহংস হাত তুলে নমস্কার করে বলল, ‘আমি আর অর্কর বাবা সহপাঠী ছিলাম।’
ভদ্রমহিলা নমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এদিকে কোথায়?’
মাধবীলতা বলল, ‘ও এদিকেই থাকে, শোভাবাজারে। একটা বাড়ির খবর পেয়ে আমাদের দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল।’
‘তাই নাকি? পছন্দ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনার কর্তা আসেন নি?’
মাধবীলতা কিছু বলার আগেই পরমহংস বলে উঠল, ‘অনিমেষের পক্ষে এখন হাঁটাচলা করা একটু মুশকিল। একটা অ্যাকসিডেন্টের পর থেকেই ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না। মানে ট্রাম বাসের ব্যাপারটা—।’
‘ওহো!’ মণিমালার গলায় বিষাদ। মাধবীলতা লক্ষ্য করল কথাটা শুনেও মণিমালা কি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল জিজ্ঞাসা করলেন না। কিন্তু সে মনে মনে পরমহংসের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ল। প্রথমত, সে বলেছে অনিমেষ তার সহপাঠী ছিল। সেইসঙ্গে যদি মাধবীলতার নামও জুড়ে দিত তাহলে ওদের বিবাহটা মণিমালার কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত। অবশ্য তাতে কিছুই যায় আসে না মাধবীলতার কিন্তু অনর্থক মানুষকে জানিয়ে কি লাভ। দ্বিতীয়ত, অনিমেষকে পুলিস এরকম করেছে, সে নকশাল ছিল, এ সব গল্প না করে যে পরমহংস অ্যাকসিডেন্ট বলে এড়িয়ে গেল সেটাও তার বেশ স্বস্তি। এবং মণিমালাও যে কৌতূহল প্রকাশ করলেন না সেটাও ওর বেশ ভাল লাগল। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, ‘ঊর্মির বাবা কোথায়?’
‘হাতিবাগানে গিয়েছে। খবর পেয়েছে ওখানে এক ভদ্রলোকের বাড়িতে অতুলপ্রসাদের নিজের গলার রেকর্ড আছে তাই টেপ করে নিয়ে আসবে। গানবাজনার খবর পেলে একদম পাগল হয়ে যায়!’ মণিমালা হাসলেন।
মাধবীলতা বলল, ‘বাঃ, খুব ভাল শখ। তা তুমিও নিশ্চয়ই গাও?’
ঊর্মিমালা হেসে মাথা নাড়ল। মণিমালা যে সোফায় বসেছিলেন তার পেছনে দাঁড়িয়েছিল সে। মায়ের সঙ্গে মেয়ের চেহারার বিন্দুমাত্র মিল নেই।
মণিমালা বললেন, ‘ওর শখ ছবি আঁকা। পাশ করে উনি আর্ট কলেজে ভর্তি হবেন, বি. এ. এম. এ. পাশ করবেন না। সেদিন আঁকার স্কুল থেকে ফেরার সময় ওই কাণ্ড হল। আমি সাধারণত ওকে একা ছাড়ি না। দিনকাল খারাপ, রাস্তায় এত বাজে মানুষের ভিড়। ওই একদিন একা গেল আর অমন কাণ্ডটা ঘটে গেল। আপনার ছেলে না থাকলে কি হত কে জানে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যেন জঙ্গলের রাজত্বে বাস করছি।’
পরমহংস নিচু গলায় বলল, ‘জঙ্গলও এর চেয়ে ভাল।’
মাধবীলতা বলল, ‘আচ্ছা, এবার আমরা উঠি—।’
মণিমালা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন, ‘সেকি! প্রথম এসেই মুখে কিছু না দিয়ে চলে যাবেন? না, তা কিছুতেই হবে না।’
মাধবীলতা বলল, ‘তাতে কি হয়েছে? সে পরে একদিন হবে খন!’
মণিমালা বললেন, না পরে টরে নয়। সামান্য তো চা। ওটুকু না খেয়ে গেলে আমার মেয়ের বিয়ে হবে না।’
মাধবীলতা তাই শুনে শব্দ করে হেসে ফেলতেই ঊর্মিমালা লজ্জা পেয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেল। পরমহংস সোফায় গা এলিয়ে বলল, ‘তাহলে বসেই যাও। মিস্টার মুখার্জীর সঙ্গেও দেখা হতে পারে। তাছাড়া আমরা চা খেতেই তো যাচ্ছিলাম। আমারটায় কম চিনি দেবেন।’
মণিমালা সম্মতি জানিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করতে উঠে গেলে মাধবীলতা পরমহংসর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা কি হল?’
‘কিছুই না। চারটে চায়ের দাম বেঁচে গেল।’
‘আশ্চর্য! তোমার কোন চক্ষুলজ্জা নেই। কিন্তু মিষ্টি কম দিতে বললে কেন?’
‘শুধু চা কি থাকবে? সঙ্গে দুটো মিষ্টি নিশ্চয়ই দেবে। চায়ে যারা চিনি কম খায় তারা মিষ্টি ভালবাসে, এটা নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা জানেন।’ পরমহংস হাসতে হাসতে কথাটা শেষ করল। আর তখনই আধভেজানো দরজায় একটি সুন্দর চেহারার প্রৌঢ় এসে দাঁড়ালেন। তাঁর কপালে ভাঁজ পড়েছিল। ঘরের মধ্যে কয়েকজন অচেনা মানুষকে দেখলে যেমন হয়। তারপরেই অর্ককে চিনতে পেরে বলে উঠলেন, ‘আরে, তুমি কখন এসেছ। আমি একটা চিঠি দিয়েছি, পেয়েছ?’
‘না।’ অর্ক বিস্মিত। ভদ্রলোক সত্যি তাকে চিঠি দিয়েছেন। তারপর সে বলল, ‘আমার মা আর কাকু। উনি ঊর্মিমালার বাবা।’
মাধবীলতা এবং পরমহংস দাঁড়িয়ে নমস্কার করতেই ভদ্রলপক নমস্কার করে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘কি আশ্চর্য, দাঁড়ালেন কেন, বসুন-বসুন। আমার কি সৌভাগ্য যে আমার এখানে আপনাদের পায়ের ধুলো পড়ল। সত্যি আপনি রত্নগর্ভা। এমন ছেলের মা হতে পারাটা কম নয়।’
মাধবীলতা চকিতে অর্কর দিকে তাকাল। দেখল, অর্কর মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। সে বলল, ‘ও এমন কিছু করেনি।’
‘না, না, কি বলছেন আপনি! আজকাল পথেঘাটে কোন অন্যায় দেখলে কেউ প্রতিবাদ করে? সবাই নিজের গা বাঁচিয়ে সরে যায়। বাট হি ডিড ইট। কিন্তু ওরা কোথায়? আপনারা একা বসে আছেন, ঊর্মি, ঊর্মি—’
ভদ্রলোক গলা তুলে ডাকলেন।
মাধবীলতা বলল, ‘আহা, আপনি ব্যস্ত হবেন না। ওঁরা এইমাত্র ভেতরে গেলেন। এই সময় ঊর্মিমালা ফিরে এল, ‘ডাকছ বাবা?’
‘হ্যাঁ। এরা বসে আছেন তোমরা সবাই ভেতরে কেন?’
‘মা ছিলেন তাই—।’
‘কি আশ্চর্য! মা তো কোন কাজে ভেতরে যেতেই পারেন। তুমি তোমার আঁকা ছবি অর্ককে দেখিয়েছ? অর্ক, যাও দেখে এসো। ও বেশ ভাল আঁকে।’
ভদ্রলোক অর্ককে বললেন। রত্নগর্ভা শব্দটি শোনার পর থেকেই অর্কর মনে একধরনের অপরাধবোধ এসেছিল। কথাটা সত্যি নয় তা সে যেমন জানে মাধবীলতাও তেমন জানে। অথচ অর্ক দেখল মা কোন প্রতিবাদ না করে তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। সেই চোখ যেন অর্ককে বলল, শোন, কথাটা শোন, নীলবর্ণ শেয়াল। আর ওটা বোঝামাত্র অর্কর মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে খুব ছোট বলে মনে হচ্ছিল। ঊর্মিমালা যতই ভাল আঁকুক তার কি যায় আসে। সে চুপ করে রইল।
পরমহংস বলল, ‘কি রে যা!’
অতএব অর্ককে উঠতে হল। পাশের ঘরে ঊর্মিমালার পেছন পেছন উপস্থিত হয়ে দেখল ঘরটা ছিমছাম। একটা খাট আর বইপত্তরে ঠাসা। এটা যে ঊর্মিমালার ঘর বুঝতে অসুবিধে হয় না। ঊর্মিমালা বলল, ‘আমি মোটেই ভাল আঁকি না। বাবা বাড়িয়ে বলেছে।’
অর্ক জবাব দিল না। ও দেওয়ালে টাঙানো একটি যুবকের ছবি দেখছিল। দুটো উজ্জ্বল বড় চোখ, মুখে সামান্য দাড়ি, গায়ের রঙ অসম্ভব ফর্সা। এত সুন্দর অথচ ব্যক্তিত্ববান পুরুষটির সঙ্গে এই বাড়ির কি সম্পর্ক তা সে ঠাওর করতে পারছিল না।
ঊর্মিমালা তখন হাঁটুগেড়ে বসে একটা ছোট আলমারি থেকে ছবি বের করছে। ওর চওড়া পিঠ, সরু কোমর এবং মাঝারি নিতম্বের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল সে। আবার মনের শিকড় ধরে টানাটানি শুরু হয়ে গেল। না, তাকে ভাল হতেই হবে। আজ ওই রত্নগর্ভা শব্দটি যদি পরিহাসের মত মায়ের কাছে শোনায় তাহলে কেন সেটা আগামীকাল সত্যি করতে পারবে না? ঊর্মিমালার কাছে সে কিছুতেই হেরে যাবে না। মেয়েটাকে দেখলেই মনে হয় ও সবকিছুতেই তার চেয়ে এগিয়ে আছে। অর্কর চোখ আবার দেওয়ালের দিকে ফিরে গেল। ওই যুবকটির সঙ্গে ঊর্মিমালার কোন মিল নেই। কিন্তু—। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কার ছবি?’
ছবিগুলো টেবিলের ওপর রেখে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ঊর্মিমালা নরম গলায় বলল, ‘রবীন্দ্রনাথ।’