1 of 2

১২. এক লাফে রিকশা থেকে নেমে

 বারো

এক লাফে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল অর্ক। ঝুমকি পাথরের মত বসে আছে। ওর দৃষ্টি হিলহিলে, অর্ককে যেন সর্বাঙ্গে চাটছে।

‘আমার মায়ের অ্যাকসিডেণ্ট হয়নি?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর ঝুমকির।

‘না। আমি তোমার কাছে হার চাইতে এসেছি।’

‘তুমি, তুমি আমাকে ভড়কি দিয়েছ?’ গলা চড়ায় উঠছিল, সামলে নিল ঝুমকি। ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের এই মুখটায় দাঁড়ানো ধান্দাবাজ মানুষেরা এবার এদিকে তাকাল।

‘চিল্লাচ্ছ কেন? মালটা বের কর।’ অনেকক্ষণ পর অর্ক যেন কথাগুলো ফিরে পেল। সে আড়চোখে দেখছিল লোকগুলো একটু একটু করে বাড়ছে। নেহাতই ভেড়ুয়া মার্কা, ওদের মধ্যে কোন মাস্তান নেই।

ঝুমকি রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটালো। তারপর হন হন করে ট্রাম স্টপের দিকে এগিয়ে গেল। দ্রুত পা চালালো অর্ক। এতক্ষণে তার স্থির বিশ্বাস হয়ে গেছে ঝুমকি হার নিয়েছে। নাহলে নিশ্চয়ই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করত, কিসের হার? সে ঝুমকির পাশে গিয়ে বলল, ‘আমার সঙ্গে নকশা করে কোন লাভ হবে না। তোমাকে যখন খুঁজে বের করেছি তখন ওটা আমি নিয়ে যাব। দাঁড়াও।’

‘পেছন পেছন এলে আমি চেঁচাবো।’ চাপা গলায় বলল ঝুমকি।

‘চেঁচাও। তারপর পাড়ায় ঢুকতে হবে। নিমতলায় পুরো বডি যাবে না, হেঁচুয়া করে ছেড়ে দেব।’ গর্জে উঠল অর্ক।

‘হেঁচুয়া?’ ফ্যাকাশে মুখে তাকাল ঝুমকি।

‘চিল্লাও না, চিল্লাও! কোন ভাতার তোমাকে বাঁচাবে পাড়ায় ঢুকলে? আমার মাল ঝেড়ে দিয়ে আবার রঙ নিচ্ছে!’ অর্কর কথা শেষ হওয়ামাত্র একজন মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে এল, ‘কি হয়েছে, অ্যাই?’

অর্ক ঘুরে দাঁড়াল। পেট মোটা, নাদুস-নুদুস। সে হাত নাড়ল, ‘কি দরকার আপনার, এখান থেকে ফুটুন।’

‘অ্যাঁ, এইটুকুনি ছেলে আবার রঙবাজি হচ্ছে!’ তারপরেই গলা পাল্টে ঝুমকিকে বলল, ‘ওকি তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে?’

লোকটার পেছনে এখন আরও কিছু জুটেছে। ঝুমকি তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না। এটা আমাদের ব্যাপার।’

‘অ। লোকটা যেন চুপসে গেল। তারপর মুখ বিকৃত করে ফুটপাথের ভিড়ের মধ্যে উঠে অন্যদের চাপা গলায় শোনাল, ‘প্রসটিটিউট।’

সঙ্গে সঙ্গে অর্ক ঘুরে দাঁড়াল, ‘সেই ধান্দায় তো এসেছিলেন। এখন সুবিধে হল না বলে—.। আর একবার বলুন ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেব।’

লোকটা তোতলাতে লাগল, ‘কি—কি?’ তারপর প্রায় দৌড়ে চলে যেতে লাগল উল্টোদিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে ভিড় ফাঁকা হয়ে গেল। এই সময় ঘন্টা বাজিয়ে এক নম্বর ট্রাম চলে এল সামনে। ঝুমকি উঠতে যাচ্ছিল। অর্ক দ্রুত তার সামনে চলে এসে মাথা নাড়ল, ‘হার না দিয়ে যাওয়া চলবে না।’

‘কিসের হার?’ এতক্ষণে ঝুমকি কথা বলল। ওর চোখ এবার অর্কর মুখের ওপর স্থির।

‘কিসের হার মানে? কলতলা থেকে যেটা কুড়িয়ে পেয়েছ!’

‘ওটা যে তোমার তার প্রমাণ কি?’

‘আবার নকশা হচ্ছে? আমি প্রমাণ দিলে মিস ডি হওয়া বেরিয়ে যাবে!’ অর্কর চোয়াল শক্ত হল।

‘তোমার হার? বাড়িতে জানে?’

‘না! হঠাৎ কেমন অসহায় বোধ করল অর্ক। ওই বাড়ি শব্দটাই যেন তাকে ঈষৎ শীতল করে দিল। ঝুমকি যদি মাকে গিয়ে বলে তাহলে হাজারটা ঝামেলা বাধবে। নিজের অজান্তেই গলার স্বর নরম হয়ে এল অর্কর, ‘ওটা আমার পরিচিত একজনের হার। তাকে ফেরত দিতে হবে! না দিতে পারলে আমি বিপদে পড়ব।’

‘কার?’

‘তুমি চিনবে না। খুব বড়লোক।’

‘বড়লোক তোমাকে হার দিতে যাবে কেন?’

‘দেয়নি কিন্তু আমি যে নিয়েছি তা জানে। ঝুমকি, তুমি হারটা ফেরত দাও।’ প্রায় অনুনয়ের গলায় বলল অর্ক।

‘আমার কাছে নেই।’

‘কার কাছে আছে?’

‘আমি জানি না।’ কথাটা শেষ করে বুকের ভেতর থেকে একটা রুমাল বের করল ঝুমকি। বেশ মোটা-সোটা গিঁট বাঁধা, ‘তিনশ টাকা পেয়েছি। ইচ্ছে করলে এটা নিতে পারো। মিথ্যে কথা বলছি না, তিনশ টাকা দিয়েছে।’ হাত বাড়িয়ে রুমালের পুঁটলিটা এগিয়ে ধরল ঝুমকি।

‘তুমি, তুমি বিক্রি করে দিয়েছ?’ প্রায় ককিয়ে উঠল অর্ক। ঝুমকি মাথা নাড়ল, বিক্রি না, বন্দক। আমি কি জানতাম ওটা তোমার হার। কলতলার ইটের কোণে পড়েছিল। টাকাটা নেবে?’

পাগলের মত মাথা নাড়ল অর্ক, ‘না, না, টাকা দিয়ে আমার কি হবে? হার না পেলে, হার না পেলে—!’ অর্কর চোখ জ্বলছিল, ‘কার কাছে বন্দক রেখেছ?’

‘তাকে আমি চিনি না। মিস টি-র চেনা লোক।’

‘মিষ্টি?’

‘দূর! মিষ্টি কেন, মিস টি, তৃষ্ণা পাল। আমাদের ওখানে নাচ শিখে এখন খুব নাম করেছে। শোননি?’

অর্ক পাগলের মত মাথা নাড়ল, ‘এক্ষুনি চল ওর কাছে।’

‘অসম্ভব। আমাকে টাকা দিয়ে ও প্রোগ্রামে চলে গিয়েছে। ডায়মণ্ডহারবারে হোল নাইট প্রোগ্রাম। কাল সকালে ফিরবে। তখন যেতে পারি।’

অর্ক ঝুমকির চোখে চোখ রাখল, ‘সত্যি কথা বলছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোথায় থাকে?’

‘আগে যাদবপুরে থাকত, এখন চিৎপুরে।’ নম্বরটা বলল সে। কাল অবধি অপেক্ষা না করে উপায় নেই। অর্ক ছোঁ মেরে ঝুমকির হাত থেকে রুমালটা নিয়ে নিল, ‘কাল সকালে আমার হার চাই।’

ঝুমকি নীরবে মাথা নাড়ল। এই সময় আর একটা ট্রাম এগিয়ে আসতে অর্ক লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। একদম ফাঁকা ড্রাম। ঠিক ড্রাইভারের পিছনের সিটে গিয়ে জানলার ধারে বসল অর্ক। ঝুমকির দিকে আর তাকায়নি সে। কিন্তু ঝুমকিও একই ট্রামে উঠে লেডিস সিটের দিকে না গিয়ে সোজা এগিয়ে অর্কর পাশে বসে পড়ল। বিরক্ত হল অর্ক কিন্তু কিছু বলল না প্রথমে। ট্রামটা যখন ওয়েলিংটন ঘুরে বউবাজারের দিকে ছুটছে তখন ঝুমকি বলল, ‘তুমি কি হারখানার বেশী দাম পাবে?’

চমকে উঠল অর্ক, ‘মানে?’

ঠোঁট ওল্টালো ঝুমকি, ‘মালটা তো বেচে দিতেই হত।’

‘কে বলল?’

‘জানি বাবা জানি। খুরকি আমার কাছে একবার একটা আংটি সাতদিন রেখে একশ টাকায় ঝেড়ে দিয়েছিল। অবশ্য আমাকেও দশ টাকা দিয়েছিল খুরকি। সত্যি বলতে কি ওর দিল আছে।’

‘তোমার সঙ্গে যে খুরকির এত ভাব তা জানতাম না তো!’

‘এককালে ভাব ছিল। তখন এইসব লাইন চিনতাম না।’

‘এখন চিনলে কি করে?’

‘মালতীদি নিয়ে এল, তারপর কপাল। তবে এক বছর পরে আমি আর ওপাড়ায় থাকব না! খুরকির মত দশটা কুকুর তখন আমার পা চাটবে। ফোকটে অনেক দিয়েছি।’ ঠোঁট কামড়ালো ঝুমকি, ‘আমাকে কিছু দেবে তো?’

অর্ক অবাক গলায় বলল, ‘কেন?’

‘বা রে, মালটা ঝেড়ে দিয়ে কামাই করিয়ে দিলাম যে!’

অর্ক হিসহিসিয়ে উঠল, ‘তোর বাপের জিনিস যে ঝেড়েছিস! কাল সকাল দশটায় ট্রাম রাস্তায় চলে আসবি।’ বলে, উঠে পড়ল। দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল ঝুমকিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। কণ্ডাক্টর হাত বাড়িয়েছিল, কিন্তু অর্ক ইশারায় ঝুমকিকে দেখিয়ে দিয়ে নেমে পড়ল চলন্ত ট্রাম থেকে। নকশা! মনে মনে খিস্তি করল অর্ক! শেয়ার চাইছে, ফোট। কিন্তু আর একটু থাকলে টিকিটটা কাটতে হত।

তিনবার ট্রাম পাল্টে অর্ক শ্যামবাজারের মোড়ে যখন পৌঁছে গেল তখন রাত নটা। অন্যদিন হলে এখান থেকে হেঁটেই ফিরতো কিন্তু আজ পকেটে টাকা আছে। আর জি কর পুলের তলায় রাত নটায় হাওয়া খারাপ হয়ে যায়। সে দেখল কালীবাড়ির সামনে শেয়ার ট্যাক্সি লোক ডাকছে। দেখে দেখে পাঁচজন উঠে বসা ট্যাক্সিতে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি চলতে শুরু করল। আর জি কর হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওর বুক ধক্‌ করে উঠল। লোকটা বেঁচে আছে কিনা কে জানে। ভগবান যদি মেরে ফেলে তো পাঁচ টাকার ভোগ দেবে সে। ব্রিজের ওপর থেকে গাড়ি নামা শুরু করলে ও খুব অবাক হয়েছে এমন ভাব করে বলল, ‘আপনি ডানলপে যাচ্ছেন না?’

ট্যাক্সিওয়ালা ঘাড় নাড়ল, ‘না। নাগেরবাজার।’

‘আরে! আমি ডানলপে যাব।’

সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাঁচজন যাত্রী বলে উঠল, ‘ভুল ট্যাক্সিতে উঠেছে, নামিয়ে দিন বেচারাকে। ইস্‌, কতটা দূর ফিরতে হবে।’

ট্যাক্সিওয়ালা বেলগাছিয়ার মোড়ে গাড়ি থামাল, ‘না দেখে ওঠো কেন? আমি একটা প্যাসেঞ্জার লস করলাম, একটা টাকা দিয়ে যাও।’

অর্ক দরজা খুলতে খুলতে বলল, ‘এত রাত্রে আমি চিনতে পারিনি। কি যে—।’

অন্য যাত্রীরা হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘আপনি মশাই কসাই নাকি! ঠিক পেয়ে যাবেন প্যাসেঞ্জার সামনে। চলুন, চলুন। এই যে ভাই, উল্টোদিকের স্টপ থেকে বাস ধরে শ্যামবাজারে ফিরে যাও।’

ট্যাক্সিটা চলে যাওয়া অবধি অর্ক কোনরকমে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর আনন্দে একটু নেচে নিল, জোর ঢপ দেওয়া গেল। পা বাড়াবার আগে রুমালটা ভাল করে দেখে নিল সে। একটা মাল রাখা দরকার সঙ্গে, নাহলে যে কোন দিন ফুটকুড়ি হয়ে যেতে পারে। ঈশ্বরপুকুর লেনের মুখে আসতেই ও দাঁড়িয়ে পড়ল। খুরকি সেই দুটো লোকের সঙ্গে যাচ্ছে। কিলার কাছে শুনেছে যে ওই লোক দুটো ওয়াগন নিয়ে কারবার করে। খুরকি যেদিন ওয়াগনের কারবার করতে যায় সেদিন পাড়ার কারো সঙ্গে মেশে না। কারবার হয়ে যাওয়ার পর দশ দিন এদিকে আসে না। আজ তাহলে ওদের মশলা আছে। কিলা ওদের সঙ্গে নেই অথচ কিলাকে খুরকি কথা দিয়েছিল এবার যাওয়ার সময় ওকে পার্টনার করবে।

ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢুকতেই কিচাইন। সাদা রঙের একটা প্রাইভেট রেশনের লরির সামনে আটকে গেছে। পেছনে দু’তিনটে রিকশা, ঠেলা মিলে জোর ঝামেলা। এইসব মোকা কাজে লাগায় বিলুরা। রেশনের লরির কাছ থেকে কিছু পাওয়া যায় না কিন্তু প্রাইভেট যদি অচেনা হয় তাহলে তাকে কিছু ছাড়তেই হবে। অর্ক দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেখল পাড়ার চারটে ছেলে ড্রাইভারের সঙ্গে ঝামেলা করছে। পেছনের সিটে এক ভদ্রলোক হেলান দিয়ে অলস চোখে ওদের দেখছেন। এত চেঁচামেচিতেও যেন ওঁর কিছু এসে যাচ্ছে না। গিলেকরা পাঞ্জাবি আর ধুতি লোকটার কুচকুচে কালো চুলের প্রৌঢ় শরীরটার সঙ্গে চমৎকার মানিয়েছে। অর্ক এক নজরেই বুঝতে পারল পার্টি হেভি মালদার। কিন্তু এই ছেলেগুলো রুই মাছকে পুঁটি বানিয়ে ছেড়ে দেবে। সে এক হাতের ধাক্কায় রিকশাকে সরিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কি হয়েছে, কি হয়েছে?’

একজন জবাব দিল, ‘প্রাইভেট রং সাইডে ঢুকেছে।’

অর্ক ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে বলল, ‘কি ব্যাপার?’

ড্রাইভার পেছনে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘সাব্‌, হাম বোলাথা আপ মৎ আইয়ে। ইয়ে বহুৎ খতরনাক যায়েগা হ্যায়।’

ভদ্রলোক একটু বিচলিত না হয়ে বললেন, ‘লরিওয়ালাকে বল বাঁ দিকে গাড়িটাকে সরিয়ে নিতে।’

অর্কর মনে হল এই লোকটা খুব সহজে মুরগি হবে না। একটু বাজিয়ে দেখা দরকার। সে খুব মাতব্বরের মত বলল, ‘এই রাস্তা বেশীদূর যায়নি। আপনি কোথায় যাবেন?’

‘আমি এখানেই যাব।’

ঈশ্বরপুকুর লেনের এপাশটায় অনেকগুলো কোঠাবাড়ি, সেখানে ভদ্রলোকরা থাকেন। এই নিয়ে অবশ্য কিলারা প্রায়ই ঝগড়া করে, ‘কি, কোঠাবাড়িতে থাকেন বলেই ভদ্রলোক হয়ে গেছেন, তাই না? মেরে বাপকে হিজড়ে করে দেব।’ তা এই লোকটা কি সেই রকম কারো কাছে যাচ্ছে যারা ওদের চিৎকার কানে গেলেই ভয়ে জানলা বন্ধ করে, রাস্তা দিয়ে হাঁটে চোরের মতন চোখ নামিয়ে। বোধহয় ব্রজমাধবের বাড়িতে যাচ্ছে। তবু সে যাচাই করার জন্যে জিজ্ঞাসা করল, ‘কত নম্বর?’

ভদ্রলোক পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুধের চেয়ে সাদা রুমাল বের করে নাক মুছলেন, ‘তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন।’

চোখ কুঁচকে গেল অর্কর। এত রাত্রে এই রকম মাল তো কখনই তিন নম্বরে আসে না। কোন কোন মালিক ড্রাইভার খুঁজতে আসে, কিন্তু সে তো সকালবেলায়।

সে আর একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করল, ‘কত নম্বর বললেন?’

‘তিন। তুমি কি কানে কম শোন? ওই লরিটাকে সরিয়ে নিতে বল।’

‘তিন নম্বরে কার কাছে যাবেন?’

‘কেন, তোমার কি দরকার?’ খুব বিরক্তি গলায়।

‘আমিও তিন নম্বরে থাকি।’

এবার ভদ্রলোক একটু নরম হলেন, ‘ও, তাহলে ভালই হল! তুমি একটু দ্যাখো তো, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ হাত বাড়িয়ে লরিটাকে দেখিয়ে দিলেন ভদ্রলোক।

এর আগে ড্রাইভার নেমেছিল। কিন্তু তার কথা লরিওয়ালা শুনছে না। পাড়ার ছেলেদের সমর্থন পাচ্ছে সে। অর্ক চটপট ভেবে নিল প্রাইভেটকে হাত করতে হবে। তিন নম্বরের যার কাছেই যাক না কেন এই পথেই বের হতে হবে। সে কয়েক পা এগিয়ে ছেলেদের বলল, ‘সরে যা, কেস জণ্ডিস।’ তারপর ইশারায় লরিওয়ালাকে ব্যাক করতে বলল। মিনিট তিনেক লাগল রাস্তা পরিষ্কার হতে। ভদ্রলোক বললেন, ‘তুমি একটু উঠে আসবে ভাই? আমি তো চিনি না।’

অর্ক এইটেই চাইছিল। সে গাড়ির দরজা খুলে সিটে শরীর রাখল। পাড়ার ছেলেরা যে তাকে ঈর্ষার চোখে দেখছে বুঝতে পেরে সে কার্নি মারল। তারপর ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল এরকম লোকের সঙ্গে সে কোনদিন কথা বলেনি। এমনকি বিলাস সোমও এর কাছে কিছু না। ওঁর শরীর থেকে যা খুশবু বের হচ্ছে তা যে অত্যন্ত মূল্যবান বুঝতে অসুবিধে হবার নয়। যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক বেশী বয়স ভদ্রলোকের। কিন্তু এমন মাঞ্জা দিয়েছে যে—। প্রাইভেট ততক্ষণে অনেকটা এগিয়েছে। ভদ্রলোক অলস চোখে বাইরে তাকিয়েছেন। নিমুর চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে অর্ক বলল, ‘এই যে এসে গেছি।’ সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার প্রায় নিঃশব্দে গাড়ি থামাল।

নিমুর দোকানে তখন ধোওয়া-মোছা চলছে। পাশের সিগারেটের দোকানে গ্যাঁক গ্যাঁক করে বিবিধ ভারতী বাজছে। ভদ্রলোক মুখ বাড়িয়ে তিন নম্বরের চেহারা দেখলেন। বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ওঁর চোখে। বললেন, ‘মাই গড, এটাই তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন? ঠিক বলছ?’

‘হ্যাঁ। আপনি কার ঘরে যাবেন?’ দরজা খুলতে খুলতে জিজ্ঞাসা করল অর্ক। গাড়িটাকে দেখে ফুটে দাঁড়ানো কয়েকজন উৎসুক চোখে তাকাচ্ছে। ভদ্রলোক বললেন, ‘কার ঘর জানি না ভাই, আমি অনি, অনিমেষ মিত্রকে খুঁজছি।’

হাঁ হয়ে গেল অর্ক। বাবাকে খুঁজছে লোকটা! কে এ? এই এত বছরে কোন মানুষকে সে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতে দ্যাখেনি। এরকম বড়লোক বাবার খোঁজ করতে আসবে কেন? অর্ক কিছুই ঠাওর করতে পারছিল না। তাকে চেয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি চেন?’

অর্ক ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। ভদ্রলোক এবার দরজা খুলে নিচে নামলেন। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন পরিবেশটার চেহারা। তারপর ড্রাইভারকে বললেন, ‘কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর।’

ততক্ষণে অর্ক অনেকগুলো সম্ভাবনার কথা ভেবেছে। বাবা এককালে নকশাল ছিল। এই লোকটাও কি তখন বাবার সঙ্গী ছিল? না, তা হতে পারে না। নকশালদের পুলিশ খুব প্যাঁদাতো, এই লোকটা কোনদিন ঝাড় খেয়েছে বলে মনেই হয় না। কিছুদিন আগে ও মাকে বলতে শুনেছে, ‘জানো, সুদীপ মন্ত্রী হয়েছে।’

‘সুদীপ?’ বাবা মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করেছিল।

‘আঃ, সুদীপকে, তোমার মনে নেই? য়ুনিভার্সিটিতে য়ুনিয়ন করত। খুব একরোখা ছিল।’ মা বলেছিল।

‘তাই নাকি! সুদীপকে ওরা মিনিস্ট্রিতে নিয়েছে?’

বাবা এবং মায়ের কথা থেকে অর্ক বুঝতে পেরেছিল ওই মন্ত্রীটাকে ওরা দুজনেই চেনে। অতএব দু’একটা ভদ্রলোকের সঙ্গে বাবার পরিচয় থাকতেই পারে। কিন্তু কি ধান্দায় তারা এত রাত্রে তিন নম্বরে দেখা করতে আসবে? এইটেই মাথায় ঢুকছিল না ওর।

ভদ্রলোক বললেন, ‘অনিমেষ এখন হাঁটতে পারে?’

অর্ক বলল, ‘ক্রাচ নিয়ে পারে।’

গলিতে ঢুকল অর্ক, পেছনে খুশবু ছড়ানো ভদ্রলোক। ওঁর চেহারা দেখতে অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। শুধু মোক্ষবুড়ি চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে যায়?’

অর্ক জবাব দিল না, কিন্তু ভদ্রলোক মোক্ষবুড়ির দিকে ঘুরে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়ালেন না। অনুদের দরজা বন্ধ। হঠাৎ এতক্ষণ বাদে, অর্কর মনে হল এই ভদ্রলোক আসায় আজ সে বেঁচে গেল। দুপুরে মা যা বলেছে তারপরে আজ রাত্রে দেরিতে ফেরার কোন কৈফিয়ৎ দেওয়া যেত না। এই ভদ্রলোক যদি খুব বড় কেউ হয় তাহলে নিশ্চয়ই ওরা একে নিয়ে মেতে থাকবে।

ভেজানো দরজা খুলতেই অর্ক দেখল মা চেয়ারে বসে বই পড়ছে, বাবা বিছানায় গুটিয়ে শুয়ে রয়েছে। শব্দ হতেই মাধবীলতা মুখ তুলল বই থেকে। ছেলেকে দেখামাত্র চোখের দৃষ্টি পাল্টে গেল, ‘কোথায় ছিলি?’

অর্ক চোখেমুখে ইঙ্গিত করল এখন রাগারাগি করো না, ‘হাসপাতালে গিয়ে আটকে পড়েছিলাম। বাবাকে ডাকো।’

‘কেন?’ মাধবীলতার গলার স্বর শক্ত।

‘এক ভদ্রলোক বাবাকে খুঁজতে এসেছেন। গাড়ি নিয়ে।’ কথা বলতে বলতে অর্ক ঘরে ঢুকেছিল। একটা একশ পাওয়ারের বাল্ব ঝুলছিল ঘরে। অনিমেষ সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিল, কারণ এইসব কথার কোন প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে দেখা গেল না। চোখের পাতা বন্ধ। মাধবীলতা এবার বিস্মিত ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াল। খাটের ওপর বই রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোককে দেখতে পেল। ষাটের আশেপাশে বয়স, গিলেকরা পাঞ্জাবি এবং ধুতি, চকচকে জুতো পরা লোকটি খুব স্মার্ট। সে অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে খুঁজছেন?’

‘অনিমেষ এখানে থাকে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওকে ডেকে দেওয়া যেতে পারে?’

মাধবীলতা ঘাড় ফিরিয়ে অনিমেষকে দেখল। মড়ার মত ঘুমুচ্ছে। ট্রাম লাইন অবধি ক্রাচ নিয়ে হেঁটে শরীর কাহিল হয়ে পড়েছে, তাছাড়া মনও খুব বিক্ষিপ্ত ছিল। অবিনাশদের প্রস্তাবের কথা সে বলেছে মাধবীলতাকে। শুনে আঁতকে উঠেছিল মাধবীলতা, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আর কক্ষনো তুমি এমনি করে কাজ খুঁজে বেড়াবে না!’

এখন অনিমেষকে ডাকতে মায়া লাগছিল মাধবীলতার। সে আবার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার নামটা—?’

‘আমি অনিমেষের কাকা!’

মাধবীলতা চমকে উঠল। সে জানে না কেন, সমস্ত শরীর তার রোমাঞ্চিত হতে লাগল। সে চট করে আঁচলটা মাথায় তুলে নিল, ‘আপনি, আপনি ছোটকাকা?’

‘হ্যাঁ। আমি ওর ছোটকাকা, প্রিয়তোষ মিত্র। ও কোথায়?’

মাধবীলতা দ্রুত এগিয়ে প্রিয়তোষকে প্রণাম করল। ‘আহা, থাক থাক’, প্রিয়তোষ সরে দাঁড়াতে গিয়েও পারলেন না। মাধবীলতার হঠাৎ খুব আনন্দ হচ্ছিল। এই প্রথম সে অনিমেষের নিকট আত্মীয় কাউকে দেখছে। আর তখনই দুপ করে আলো নিভে গেল! কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল কোন ঘর থেকে ‘জ্যোতিবাবু চলে গেলেন!’

মাধবীলতার মনে হল সমস্ত পৃথিবীটা তার সঙ্গে শত্রুতা করছে। এই মানুষটা প্রথম যখন এল তখনই আলো নিবল! রোজই অবশ্য ঠিক দশটায় লোডশেডিং হয় তাই বলে এখনই দশটা বাজতে হবে? সে বলল, ‘আপনি একটু দাঁড়ান, আমি আলো জ্বালছি।’

দ্রুত ঘরে ঢুকে সে হ্যারিকেন খুঁজতে খুঁজতে অন্ধকারেই উঠে এল ছেলের কাছে, ‘যা, প্রণাম কর। তোর ছোটদাদু।’ তারপরেই আবার হ্যারিকেন জ্বালাতে ছুটল। মিটমিটে আলো ঘরে ছড়ালে সে হ্যারিকেনটাকে টেবিলের ওপর রেখে অনিমেষের কাছে চলে এল, ‘অ্যাই, শোন, শুনছ?’

চাপা গলার ডাকে অনিমেষ নড়েচড়ে উঠল, ‘আলো নেই?’

‘না। তাড়াতাড়ি ওঠ!’

‘কেন? অনিমেষের চোখে বিস্ময়। সদ্য ঘুম ভাঙ্গার পর সে আবছা আলোয় মাধবীলতাকে অন্যরকম দেখছিল।

‘ছোটকাকা এসেছেন।’ কথা বলতে বলতে মাধবীলতা ঘরের দিকে তাকাচ্ছিল। সর্বত্র অলক্ষ্মীশ্রী। অমন মানুষকে বসানো যায় না। দ্রুত হাতে সবচেয়ে ভাল বিছানার চাদরটা বের করে খাটের ওপর পাততে পাততে বলল, ‘সরো, সরে এস, এটাকে পাততে দাও, আঃ, বসে আছ কেন?’

অনিমেষ তখনও অন্ধকারে, ‘কে এসেছে বললে?’

‘ছোটকাকা। তোমার ছোটকাকা।’

গভীর কুয়োর তলা থেকে ভুস করে অনিমেষ ওপরে উঠে আসছিল, কোনরকমে বলল, ‘ছোটকাকা?’ বলে নেমে দাঁড়াল ক্রাচে ভর করে।

‘হ্যাঁ।’ চাদর ঠিক করে মাধবীলতা দরজায় গিয়ে ডাকল, ‘আসুন।’

বাইরে তখন উঁকিঝুঁকি চলছে প্রিয়তোষকে কেন্দ্র করে। এরই মধ্যে মাধবীলতা লক্ষ্য করেছে যে বলা সত্ত্বেও অর্ক বাইরে গিয়ে প্রিয়তোষকে প্রণাম করেনি।

প্রিয়তোষ দরজায় দাঁড়িয়ে চমকে উঠলেন, ‘একি? অনি!’

অনেকদিন বাদে অনিমেষ লজ্জা পেল। খালি গা, কোমরের নিচ থেকে লুঙ্গি এবং দুই বগলে ক্রাচ নিয়ে যে অভ্যেস হয়েছে এতদিনে তা চট করে বেমানান মনে হল। তবু সে সহজ হবার চেষ্টা করল, ‘কবে এলে তুমি?’

একথার জবাব দিলেন না প্রিয়তোষ। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না এমন ভঙ্গীতে তাকিয়ে ছিলেন। মাধবীলতা চেয়ারটা এগিয়ে দিল, ‘বসুন।’

প্রিয়তোষ সেদিকে একদম লক্ষ্য না করে বললেন, ‘এ আমি কখনও কল্পনাও করতে পারিনি। কি হয়েছিল?’

অনিমেষ হাসল, ‘কি আবার হবে! বসো।’

প্রিয়তোষ চেয়ারটা টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে বসতেই মাধবীলতা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। প্রিয়তোষ হাত নাড়লেন, ‘না না, হাওয়া করতে হবে না।’

‘যা গুমোট গরম আপনি বসতে পারবেন না।’

অনিমেষ আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে এলে?’

‘তিনদিন হল। সুদীপের কাছে তোর খবর পেলাম। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আর তোর খবর ও জানত না। জেলে গিয়ে জানতে পারলাম তুই দীপক নামের একটি ছেলের বাড়িতে গিয়েছিস। তার ঠিকানা পেয়ে সুবিধে হল। দীপকের বাড়িতে গিয়ে অবশ্য ঝামেলা হয়েছিল।’

প্রিয়তোষ থামতে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’

‘দীপক তোর সঙ্গে জেলে ছিল। বছর পাঁচেক হল সে মারা গেছে। তার ঠাকুমা পাগল হয়ে গেছেন, মা-ও অ্যাবনর্মাল। অনেক কষ্টে এই ঠিকানা পেয়ে এলাম।’ প্রিয়তোষ অনিমেষকে খুঁটিয়ে দেখছিলেন।

দীপক মারা গেছে! সেই বোবা-হাবা ছেলেটা! অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। তারপর নিজেকে ফিরিয়ে আনতেই জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি সোজা মস্কো থেকে এখানে এলে?’

‘না। ন্যুয়র্ক থেকে। আমার কথা থাক, আগে তোর কথা আমি শুনতে চাই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *