বত্রিশ
পিসীমা আর দাঁড়াননি।
মাধবীলতা কাপড়খানা সেই কাগজেই কোনোরকমে মুড়ে অনিমেষকে বলল, ‘আশ্চর্য!’
অনিমেষ হতভম্ব হয়ে পিসীমার যাওয়ার পথ দেখছিল। এবার নিজের মনেই বলল, ‘কি কথা থেকে কোন কথায় চলে গেলেন।’
‘তোমার এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। মানুষের সেন্টিমেন্টে আঘাত দিয়ে—।’
‘আমি আঘাত দিতে চাই নি। আগে পিসীমার সঙ্গে আমি অনেকরকম রসিকতা করতাম। গুরুজন হলেও সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর। সব পাল্টে গিয়েছে।’
‘তুমি লক্ষ্য করেছ পিসীমা তোমার কথার জবাব দিচ্ছিলেন না?’
‘হুঁ।’ অনিমেষ মাথা নাড়ল। তারপর ক্রাচ দুটো টেনে টেনে ঘরে ফিরে এল। খাটের ওপর বসে চোখ বন্ধ করল সে। মাধবীলতা টেবিলের ওপর কাপড় রেখে দিয়ে সুটকেস খুলে টাকা বের করল। তারপর একটু ভেবে অনিমেষকে বলল, ‘তুমি বলবে?’ অনিমেষ বুঝতে পারছিল ওর শরীরে কাঁপুনি আসছে। পিসীমার এই ব্যবহার ওকে ছিন্ন করে ফেলবে যে কোন মুহূর্তে, চোখে যেন জল ছুটে আসছিল। মাধবীলতার কথা যেন একটু আশ্রয় দিল। সে জিজ্ঞাসা করল মুখ সরিয়ে, ‘কি?’
‘খোকাকে বাজারে পাঠানোর কথা তুমি বললেই ভাল হয়।’
‘তুমি বললে দোষ কি?’
‘আমি, আমি এখনও পরের বাড়ির মেয়ে। এঁদের কি মনে হবে কে জানে।’
‘ওকে বাজারে পাঠাচ্ছই বা কেন?’
‘পাঠাচ্ছি কারণ পাঠানো প্রয়োজন। নাহ’লে ওই দুজন একে ওকে ধরে জিনিস আনাবেন। আমরা থাকতে সেটা করতে দেব কেন?’ মাধবীলতা অনিমেষের অবুঝপনায় বিরক্ত হল।
‘আচ্ছা!’ অনিমেষ যেন অনেকটা ধাতস্ত হল। সমস্যা যে আবেগকে দখল করতে পারে সেটা বুঝতে পেরে স্বস্তি পেল, ‘আমি এই ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তোমাকে কি ওরা এঁদের অবস্থার কথা কিছু বলেছেন?’
মাধবীলতা ভাবল। তারপর মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, সুদের টাকায় কোনরকমে চলছে।’
অনিমেষ বলল, ‘আমাদের কেন টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছে জানো? বাবার শরীর যতটা না কারণ তার চেয়ে অনেক বেশী আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করিয়ে দেওয়া। ছোটমা স্পষ্ট বলে গেলেন যে উনি আর এই সংসারের ভার বইতে পারছেন না।’
মাধবীলতা অনিমেষের দিকে স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে বলল, ‘স্বাভাবিক।’
‘আমাদের পক্ষে সেটা কিভাবে সম্ভব?’
‘তা ওঁরা ভাবতে যাবেন কেন? এইটুকু আশা তোমার কাছে ওঁরা করতেই পারেন।’
‘আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।’ অনিমেষ একটু উত্তেজিত গলায় বলল, ‘এইসব কারণেই আমি টেলিগ্রাম পেয়েই এখানে ছুটে আসতে রাজি হইনি।’
‘ছিঃ। এরকম এসকেপিস্টের মত কথা বল না। তুমি দেখছ না এঁরা কি ভাবে বেঁচে আছেন।’
অনিমেষ যেন চাবুক খেল। এবং সেই মুহূর্তেই সব শীতল হয়ে গেল তার। উত্তেজনার মুহূর্তে যে কথা সে বলেছে তা যে বলার নয় এটা বুঝতে পেরেই নিজেকে অত্যন্ত ছোট বলে মনে হচ্ছিল। বিশেষত অর্কর সামনে—। সে মাথা নাড়ল, আমি দুঃখিত। ঠিক এইভাবে আমি বলতে চাইনি। তোমরা আমার অবস্থাটা বুঝবে না। আমি যে কত হেল্পলেস!’
মাধবীলতার গলার স্বর এবার নরম, ‘কে বলল তুমি হেল্পলেস! তোমার ছেলে রয়েছে আমি রয়েছি। তাছাড়া—তাছাড়া।’
‘তাছাড়া কি?’
‘না, থাক। দ্যাখো, এঁরা আমাদের কতটা গ্রহণ করবেন জানি না কিন্তু আমাদের দিক থেকে যেন কোন ত্রুটি না থাকে। তুমি দেখলে না, কতবার কতবছর ধরে জমিয়ে রাখা গয়না শাড়ি আজ ওঁরা এককথায় কোন আবেগে আমাদের দিয়ে দিলেন?’
‘গয়না, শাড়ি—।’ অনিমেষ নিজের খেয়ালে মাথা নাড়ল। তারপর দুটো হাতে ক্রাচ খামচে ধরল, ‘কিন্তু কিভাবে সম্ভব? তোমার স্কুল আছে, খোকার স্কুল আছে। এখানে আমরা অনন্তকাল বসে থাকতে পারি না!’
‘না পারি না। কিন্তু আমরা আজই চলে যাচ্ছি না। এসব নিয়ে ভাবনার সময় অনেক পাওয়া যাবে।’ মাধবীলতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘তুমিও তো এরকম ছিলে না।’
অনিমেষ তাকাল, ‘মানে?’
‘এত সাধারণ সমস্যায় আগে কখনো আপসেট হতে না।’
‘আমি কখনও সাংসারিক সমস্যার মুখোমুখি হইনি।’
মাধবীলতা হেসে ফেলল এবার, ‘তাহলে বোঝ,তোমাদের বাইরের সমস্যা, রাজনীতি, বিপ্লব এসবের চেয়ে আমরা মেয়েরা কত জটিল সমস্যার মধ্যে দিন কাটাই। নাও, এখন ওঠো, খোকাকে বাজারে পাঠাও।’
অনিমেষ অর্কর দিকে তাকাল। এই ঘরে এতক্ষণ এত কথা হল কিন্তু ছেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনেছে। ওর সামনে এসব বলা বোধহয় ঠিক হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ ভাবনাটাকে নস্যাৎ করল। না, ও বড় হয়েছে। জীবনটাকে জানুক। লুকোচুরি করে কি হবে? সে অর্ককে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই বাজারে যেতে পারবি তো?’
অর্ক হাসল, হেসে মাথা নাড়ল। আর তাই দেখে অনিমেষের কেমন খটকা লাগল। ও কি তাকে ঠাট্টা করল? ওই হাসির মানে কি? মাধবীলতার মতো কি অর্ক তাকে এসকেপিস্ট ভাবছে? এসকেপিস্ট শব্দটার মানে কি অর্ক জানে! অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, ‘এখান থেকে বেরিয়ে রিকশা নিবি। প্রথম দিন রাস্তা চিনতে অসুবিধে হতে পারে। তাছাড়া বেলা হয়ে গেছে। বাজার আনতে দেরি হলে রান্না হবে না।’ তারপর মাথা ঘুরিয়ে বলল, ‘ওঁদের রাঁধতে দিও না।’ মাধবীলতা হেসে ফেলল, ‘বাঃ, এই তো বেশ সাংসারিক জ্ঞান আছে দেখছি।’
অনিমেষ আর দাঁড়াল না। শরীরটাকে টেনে টেনে ভিতরের বড় বারান্দায় চলে এল। বেশ রোদ বাগানে। ওঁদের দুজনকে দেখতে পেল না সে। বারান্দা ধরে খানিকটা এগোতেই কাঁচের জানলার ভেতর দিয়ে বাঁ দিকের ঘরটা নজরে এল। ঠাকুর ঘরটা পাল্টায়নি। পিসীমা ঘর মুছছেন। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল পিসীমার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু সে মুখ ফিরিয়ে নিতেই ছোটমাকে দেখতে পেল। ভেজা কাপড় নিয়ে বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন। সে সিঁড়ির কাছ অবধি গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
‘আপনার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।’
‘বল।’ ছোটমা বাগানে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
‘আমি অর্ককে বাজারে পাঠাতে চাই।’
কপালে ভাঁজ পড়ল ছোটমার, ‘কেন?’
‘বাজারে তো কাউকে না কাউকে যেতেই হবে, ও যাক।’
‘কি দরকার। বেচারা আজই প্রথম এল, চিনতে পারবে না। তাছাড়া আমি পাশের বাড়ির লোকটাকে খবর দিয়েছি।
‘চিনে নিলেই চিনতে পারবে। অর্কই যাক। বাবা কি মাছ মাংস খান?’
‘না।’
‘তুমি?’
‘না। তবে তোমাদের জন্যে আনাতে পারো।’
‘খান না মানে একদম ছেড়ে দিয়েছেন?’
‘না, পাই না বলেই খাই না। ওকে আজ পাঠানোর কোন দরকার নেই। প্রথমদিন আমিই ব্যবস্থা করছি।’ ছোটমা কাপড়গুলো রোদে মেলবার জন্যে এগোতেই অনিমেষ বলল, ‘এত পর পর ভাবছেন কেন?’
‘পর পর?’ ছোটমা হাসলেন, ‘আগে তুমি আমাকে আপনি বলতে না।’
অনিমেষ হোঁচট খেল, তারপর হেসে বলল, ‘অনভ্যাস। তাছাড়া আমি তখন ছোট ছিলাম। এতদিন না দেখাশোনায়—।’
ছোটমা কাপড়গুলো তারে স্তূপ করে রেখে এগিয়ে এলেন, ‘অভ্যেস না থাকলে বুঝি সম্পর্কগুলো পাল্টে যায়? ছোটবেলায় যাকে যে চোখে মানুষ দ্যাখে বড় হয়ে আর সেই চোখ থাকে না, তাই না? হায় ভগবান! অবশ্য এখন তোমার মুখে আপনি খুব সুন্দর মানিয়ে গেছে।’ ছোটমা রান্নার ঘরের দিকে চলে গেলেন। অনিমেষের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। এসব মানতেই হবে। কিছু কিছু জিনিস না মেনে উপায় থাকে না।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুশি হল অর্ক।
ওই বিশাল বাড়িতে তিনজন বয়স্ক মানুষ আর বাবা মায়ের মধ্যে একধরনের চাপা উত্তাপ তাকে খুব অস্বস্তিতে ফেলছিল। বাজারের ব্যাগ আর কুড়িটা টাকা নিয়ে সে গেট খুলে চারপাশে তাকাল।
এই বাড়ি থেকে সরাসরি পিচের রাস্তা দেখা যায় না। চারধারে বাউণ্ডারী দেওয়া কাঠের বাড়ির ফাঁক দিয়ে পায়ে চলা পথ, একটা রিকশা কোনমতে ঢুকতে পারে। বড় একটা লোকজন বোধহয় এদিকে আসা যাওয়া করে না। বড় রাস্তায় এসেও মনে হল খুব ফাঁকা চারধার। বাঁদিকে একটা খেলার মাঠ আর ডানদিকে সারি সারি কাঠের বাড়ি। এখন বেশ বেলা হয়েছে।
তেমাথার মোড়ে এসে সে একটাও রিকশা পেল না। বাজারটা কতদূরে কে জানে। অর্কর চোখে পড়ল একটা বড় গাছের তলায় সিগারেটের দোকান। সেখানে একটি ওর বয়সী ছেলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে ঢোল্লা-পা সাদা প্যান্ট, একটা নীল গেঞ্জি আর মাথায় চুল অমিতাভ বচ্চনের মত ঘাড়ের কাছাকাছি। ছেলেটার স্বাস্থ্য তেমন ভাল নয়। অর্ক ছেলেটার দিকে চোখ রেখে সিগারেটঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাজার কোনদিকে?’
লোকটা বাবু হয়ে বসে দুলে দুলে বিড়ি বাঁধছিল। মুখে কোন শব্দ না করে মুখটা সেই অবস্থায় একবার সামনের দিকে বাড়িয়ে নামিয়ে নিল। অর্ক ডানদিকে তাকাল। ওই পথটাই বোঝাল লোকটা। মেজাজটা গরম হয়ে গেল ওর, মুখে কথা বলতে কি অসুবিধে হয়। সে ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাজার কি এখান থেকে অনেক দূরে?’
ছেলেটি এবার এমন ভঙ্গীতে মুখ ফেরাল যা দেখে হাসি চাপা মুশকিল। সেইসঙ্গে কাঁধ নাচিয়ে মোটা গলায় বলল, ‘সোজা চলে গিয়ে বাঁদিকে। এই শহরে কি নতুন?’
‘হ্যাঁ। আজই এসেছি কোলকাতা থেকে।’ অর্কর মনে হল অমিতাভ বচ্চনও এইভাবে কথা বলতে পারে না। ছেলেটার একটা চোখ ছোট হয়ে গেল, ‘ক্যালকাটা?’ আর ঠিক তখনই ঘটনা ঘটল। তিনটে সাইকেল ওপাশের রাস্তা দিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে এল। সিগারেটের দোকানের সামনে এসে তিনজন ছেলে লাফিয়ে নামল। অর্ক কিছু বুঝে ওঠার আগেই সদ্যপরিচিত ছেলেটি আর্তনাদ করে উঠল। আগন্তুকদের একজনের হাতে লোহার স্প্রিং দেওয়া হান্টার। ছেলেটি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছিল কিন্তু ওই হান্টারের আঘাতে তাকে ধরাশায়ী হতে হল। একজন ওর বুকের ওপর পা তুলে বলল, ‘বল শালা, আর আমাদের পাড়ায় হিড়িক দিতে যাবি? শর্মিলার নাং হতে আর ইচ্ছে আছে?’
ছেলেটা চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। মুখ যন্ত্রণায় বেঁকে যাচ্ছে, রক্ত বের হচ্ছে। অর্ক আর চুপ করে থাকতে পারল না। যে ছেলেটির হাতে হান্টার ছিল তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, ‘কি হয়েছে?’
ছেলেটা উত্তেজিত ভঙ্গীতে হান্টারটা ওর দিকে তুলে আবার পায়ের দিকে তাকাল।
অর্ক গলা তুলল, ‘ওকে মারছেন কেন?’
‘তোমার বাপের কি?’ ছেলেটা রক্তচোখে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় খুন চেপে গেল অর্কর। এক ঝটকায় হান্টারটা কেড়ে নিল সে। আর তারপরেই যেন খিরকি কিলার গলার স্বর ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘আব্বে, সামলে!’
ওই মুখ স্বর এবং ভঙ্গী দেখে তিনজনেই যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। অর্ক সজোরে হান্টার চালাতেই ছেলেটা ছিটকে দূরে সরে গেল, ‘বাপ তোলা হচ্ছে! এগিয়ে আয় বে!’
সেই সময় আরও কিছু লোককে এ পথে আসতে দেখা গেল। তিনটি ছেলে আর দাঁড়াল না। তড়িঘড়ি সাইকেল তুলে যে পথে এসেছিল সে পথে চলে গেল। যাওয়ার আগে একজন বলল, ‘ঠিক আছে, দেখা হবে।’
‘ফোট, বেশী বকলে ভোগে চলে যাবি।’ অর্ক চিৎকার করে জবাব দিল। তিনটে সাইকেল চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেলে অর্ক শায়িত ছেলেটিকে দেখল। বড় বড় পা ফেলে কাছে এসে বলল, ‘ওঠো।’
ছেলেটি তড়াক করে উঠে বসল। তারপর দুহাতে মুখের রক্ত পরিষ্কার করে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল, ‘ওরা আমাকে মেরে ফেলত, ঠিক শেষ করে দিত।’
‘শেষ যখন হওনি তখন উঠে দাঁড়াও।’ অর্কর শরীর থেকে তখনও উত্তেজনা যায়নি।
ছেলেটা কাঁপতে কাঁপতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দুতিনটে কালসিটে পড়েছে ঘাড়ে, গালে। ‘তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ।’ খুব শ্রদ্ধার চোখে সে অর্কর দিকে তাকাল। এবার অর্ক লক্ষ্য করল ওর সেই অমিতাভ বচ্চনী ভাবটা এখন একটুও নেই।
রাস্তায় তখন মানুষের ভিড় জমে গেছে। সবাই ছেলেটা এবং অর্ককে দেখছে। অর্ক বলল, ‘এখানে ডাক্তারখানা কোথায়?’
হঠাৎ পেছন থেকে গলা পেল সে, ‘হাসপাতাল তো সামনেই, শানুদা, আপনে হাসপাতাল চলে যান। এই যে, আপনের ব্যাগ। বাজারের পথেই হাসপাতাল।’ শেষের কথাটা অর্ককে উদ্দেশ্য করে। সিগারেটঅলাকে এই ভঙ্গীতে দেখে অর্ক হেসে ফেলল। উত্তেজনার সময় ব্যাগটা হাত থেকে যে পড়ে গিয়েছিল তা ওর খেয়ালে ছিল না। সে মাথা নাড়ল। লোকটা যেন তাকে সমীহ করছে। সে ব্যাপারটা উপেক্ষা করে ছেলেটিকে বলল, ‘চল, আমি যাচ্ছি।’ আর তখনি তার খেয়াল হল এখনও হাতে সেই হান্টারটা রয়ে গেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে অর্ক সিগারেটঅলাকে বলল, ‘এটা তোমার কাছে রেখে দাও। আমি না বললে কাউকে দেবে না। মনে থাকে যেন।’
বাজারের ব্যাগটা নিয়ে অর্ক বলল, ‘চল।’
দাঁড়িয়ে যাওয়া মানুষগুলো এবার সিগারেটঅলাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে দেখতে পেয়ে অর্ক দ্রুত জায়গাটা ছেড়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু ছেলেটির যেন তেমন গরজ নেই। খানিকটা এগিয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কি?’
‘শানু।’ ছেলেটি একবার পেছন ফিরে তাকাল। তারপর বলল, ‘আমি এখন হাসপাতাল যাব না। কাজ আছে।’
অর্ক চমকে উঠল, ‘সে কি? এরকম কেটে গেছে ওষুধ দিতে হবে না?’
‘অন্য জায়গায় দিয়ে নেব। হাসপাতালে গেলেই ঝামেলা হয়ে যাবে। ওরা জানতে চাইবে কেমন করে হল।’ ছেলেটা যে যন্ত্রণা পাচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে।
অর্ক এবার ভাল করে ছেলেটিকে দেখল। তার চেয়ে বয়সে বেশীই হবে। অথচ সে স্বচ্ছন্দে ‘তুমি’ বলে যাচ্ছে এবং ‘আপনি’ শুনছে। তার মানে ছেলেটি নিশ্চয়ই তাকে ছোট ভাবছে না। এটা বুঝতে পেরে অর্কর বেশ গর্ব হল।
সে বেশ মাতব্বরের ভঙ্গীতে বলল, ‘দ্যাখো ভাই, তোমার জন্যে তিনটে ছেলেকে আমার শত্রু করে ছাড়লাম। অতএব আমার কথা শুনতেই হবে। তুমি আমার সঙ্গে হাসপাতালে চল। ওসব কিছু হবে না।’
ছেলেটি অসহায় চোখে তাকাল। এই মুহূর্তে ওকে খুব ভীরু বলে মনে হচ্ছে। তারপর বোকার মত বলে ফেলল, ‘আপনি কোলকাতার মাস্তান, না?’
‘‘মানে?’ অবাক হয়ে গেল অর্ক।
‘না, মানে, আপনি যেভাবে ওদের ধমকালেন তাতে, কিছু মনে করবেন না, আপনি না থাকলে আজ কি হত কে জানে!’
এই কথাটা আর একবার বলল ছেলেটা। অর্ক গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা মারল কেন?’
এবার কাঁধ নামল ছেলেটা, ‘হিংসেয়। শালারা শর্মিলার কাছে পাত্তা পায় না বলে আমাকে খতম করে দেবার মতলব।’
‘শর্মিলা কে?’
‘মাই লাভার।’
এবারের বলার ধরনটায় অর্কর মজা লাগল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরা কি অন্য পাড়ার ছেলে?’
ছেলেটা বলল, ‘হ্যাঁ। শর্মিলার পাড়ার মাস্তান। বহুৎ বদমাস।’
‘শর্মিলা তোমাকে ভালবাসে?’
‘ভালবাসবে কি করে? চান্স দিচ্ছে না তো শালারা। আমি ওর ক্লাশের একটা মেয়ের হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম কাল বিকেলে বাঁধে বেড়াতে আসার জন্যে। ওর মাসীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তো। কিন্তু হলে হবে কি, ওই শালারা পেছনে ফেউ-এর মত লেগে থাকে। আমি হাসপাতালে যাব না।’ হঠাৎ ছেলেটি দাঁড়িয়ে গেল। অর্ক দেখল ওরা একটা বড় হাসপাতালের সামনে চলে এসেছে। সে ছেলেটার হাত ধরল, ‘আমাকে চটিও না।’ আশ্চর্য, তাতেই কাজ হল। ছেলেটা সুড়সুড় করে ভেতরে ঢুকে গেল। অর্কর এখন ঠিক মজা লাগছে না, বরং আত্মবিশ্বাস এসে যাচ্ছে। এই ছেলেটি তার হকুম মানছে।
মিনিট পনের বেশী সময় খরচ হল। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কি করে এমন হল? কেউ মেরেছে? এসব থানায় রিপোর্ট করতে হবে।’
শানু অর্কর দিকে তাকাল। অর্ক মৃদু হেসে ডাক্তারকে বলল, ‘আগে ওকে বানিয়ে দিন তারপর আপনার সঙ্গে কথা আছে।’
ডাক্তারের চোখ কুঁচকে গেল এবং মুহূর্তেই মুখের রঙ পাল্টে গেল। আড়চোখে অর্ককে দেখে তিনি শানুর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষ করলেন। অর্ক বলল, ‘সামান্য ব্যাপার। লাভার নিয়ে রেষারেষি। এর মধ্যে দুনম্বরি কোন ব্যাপার নেই। বুঝলেন?’ ডাক্তার যেন আর এদের ওপর মনোযোগ দিতে চাইছিলেন না। অর্ক কারণটা বুঝতে পারল। তার গলায় বিশেষ ধরনের স্বর, দুটো শব্দ ডাক্তারকে বিব্রত করেছে। বাঃ। ট্রেনে, একটু আগে মারামারির সময় এমনকি এই ডাক্তারের কাছেও কিলা-খুরকিরা তাকে বাঁচিয়ে যাচ্ছে।
বাইরে বেরিয়ে এসে অর্ক শানুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কোথায় থাকো?’
শানু বলল, ‘জেলা স্কুলের সামনে।’
‘সেটা কতদূর!’
‘ওই সিগারেটের দোকানের কাছে।’
‘আর ওই ছেলেগুলো কোথায় থাকে?’
‘রূপশ্রী সিনেমার পাশে আড্ডা মারে।’
‘বাজার এখান থেকে কতদূর?’
‘পাঁচ মিনিটও লাগবে না। চলুন আমি সঙ্গে যাচ্ছি।’
‘দূর! দেখছ না, রাস্তার লোকজন তোমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তুমি বাড়ি যাও। আজ বিকেল পাঁচটার সময় ওই সিগারেটের দোকানের সামনে আসবে।’ অর্ক আর দাঁড়াল না। এমনিতেই অনেক বেলা হয়ে গেছে। এখন বাজার নিয়ে গেলে রান্না করতেই দুপুর শেষ হয়ে যাবে।
বাজারে গিয়ে হাঁ হয়ে গেল অর্ক। কলকাতার চেয়ে এখানে জিনিসের দাম এত বেশী সে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। কি কিনবে বুঝে উঠতে পারছিল না সে। ছোট কই মাছের দাম পঞ্চাশ টাকা কেজি!
কোনোরকমে বাজার শেষ করে সে একটা রিকশা নিল।
মাছের দাম শুনে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এখানে এত দাম কেন?’
লোকটা হেসে বলেছিল, ‘বাবু বুঝি নতুন?’
‘হ্যাঁ। লোকে এসব মাছ কেনে?’
‘কিনবে না কেন? বাবুদের পকেটে পয়সা আছে। চা বাগানের পয়সা।’
‘এখানে তো গরীব মানুষ আছে, তাই না?’
‘গরীবে মাছ খায় না। ঢেঁকির শাক আর ভাত।’
‘ঢেঁকির শাকটা আবার কি জিনিস?’
লোকটা হা হা করে হেসে উঠল, ‘সবজিপট্টিতে যান। গ্রামের লোক বিক্রি করছে। মাথাটা শুঁড়ের মত বাঁকানো শাক। টাকি মাছ নিয়ে যান, সস্তা। পনের টাকা কিলো।’ মাছ কেনা হল না। হাঁস মুরগি মিশিয়ে ডিম নিয়ে নিল গোটাকতক। তারপর রিকশায় উঠল।
দিনবাজারের পুলটা ছাড়িয়ে রিকশা নামতেই পুলিশ হাত দেখাল। ওপাশ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। জায়গাটা বেশ জমজমাট। প্রচুর দোকান পাট আর মানুষের ভিড়। হঠাৎ অর্কর চোখে পড়ল এক ভদ্রলোক সাইকেল হাতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাঝবয়সী ভদ্রলোক। ফর্সা, মোটাসোটা। একটু বেশী বয়সেও রঙ চঙা কায়দা করা শার্ট পরেছেন। মাথার কোকড়া চুলে সাদাটে ভাব এসেছে। যেন অর্ককে দেখতে পেয়ে খুব অবাক হয়েছেন। অস্বস্তি হচ্ছিল ওর, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করল লোকটা কেন তাকে দেখছে? মারামারির সময় কাছে পিঠে ছিল নাকি? সে আবার মুখ ফেরাল এবং দেখল লোকটা তখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে।
এইসময় পুলিশ হাত নামাতেই রিকশাঅলা প্যাডেল ঘোরাল। সাঁই সাঁই করে হাসপাতালের সামনে দিয়ে ছুটে গেল রিকশাটা। অর্ক পেছন ফিরে আর লোকটাকে দেখতে পেল না। সাইকেল রিকশায় এই প্রথম চড়ছে অর্ক। বেশ মজা লাগছে এখন। মনে হচ্ছে রথে চেপে যাচ্ছি।
সেই সিগারেটের দোকানের কাছে আসতেই অর্ক লোকটাকে দেখতে পেল। ফাঁকা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই হাত নেড়ে চিৎকার শুরু করতে অর্ক রিকশাঅলাকে থামতে বলল। লোকটা এবার দৌড়ে এল রিকশার কাছে, ‘ওরা আবার এসেছিল, বুঝলেন!’
‘কারা?’
‘ওই যাদের আপনি তাড়িয়ে দিলেন তখন। এবার ছ-সাতজন। আপনে কোথায় থাকেন, নাম কি, এইসব প্রশ্ন জিগালো।’
‘তুমি কি বললে?’
‘আমি তো আপনেরে চিনিই না।’
‘ওরা এসেছিল কেন?’
‘জানি না। তবে অস্ত্রটার কথা জিগালো। আমি দেই নাই।’
‘ভাল করেছ।’ অর্ক রিকশাঅলাকে চলতে বলল। বড় রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা। রাস্তায় বাঁক নেওয়ার সময় অর্ক দেখল অনেক দূরে সিগারেটঅলা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই দেখছে। ও সঙ্গে সঙ্গে রিকশাঅলাকে থামতে বলে নেমে পড়ল। দাম মিটিয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না রিকশাটা চোখের আড়ালে চলে যায়। ওকে বাড়ি অবধি নিয়ে গেলে ঠিকানাটা চাপা থাকবে না। প্রথম দিন শহরে পা দিয়েই সে একটা গোলমালে জড়িয়ে পড়েছে এ খবর মাধবীলতাকে জানতে দেওয়া ঠিক হবে না।
দরজা খুলে দিল অনিমেষ! ‘এত দেরি হল কেন?’
বাবার ভ্রু কোঁচকানো মুখের দিকে তাকিয়ে অর্ক বলল, “যা দাম!’
‘দামের সঙ্গে দেরির কি সম্পর্ক?’
অর্ক আর দাঁড়াল না। ওর হঠাৎ মনে হল এখানে আসার পর বাবা যেন বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বেশ মেজাজী। কলকাতায় চিরকাল ওই মানুষটাকে সে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছে। কিন্তু এখানে যেন আচমকা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।
ভেতরের বারান্দায় আসতেই ছোটমার মুখোমুখি হয়ে গেল অর্ক। ছোটমার মুখে হাসি ফুটল, ‘বাজার হল?’
‘হ্যাঁ। তবে মাছ পাইনি।’
‘কেন?’
‘যা আছে খুব দাম।’
‘ইস্। প্রথম দিনেই তোমাকে কি কষ্টটাই না করতে হল। যাও, রান্নার ঘরে ওটা রেখে এসো।’ ছোটমার হাতে দুটো বাটি। সাবধানে সে দুটো নিয়ে তিনি ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। অর্কর মনে হল ওতে গলা গলা কিছু রয়েছে। একটা চামচও।
রান্নারঘরের সামনে এসে অর্ক অবাক হল। ঘরে মা ছাড়া কেউ নেই। কাঠের উনুন থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মাধবীলতা উবু হয়ে একটা লোহার নল উনুনে গুঁজে ফুঁ দিচ্ছে। বাজারের থলে নামিয়ে অর্ক ডাকতেই মাধবীলতা মুখ ফেরাল। লাল হয়ে গেছে মুখ, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কোনোরকমে আঁচলে মুখ মুছে মাধবীলতা হাসল, ‘কোনদিন এই উনুন ধরাইনি তো, নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি। এত দেরি করলি কেন?’
অর্ক কাঁধ নাচাল। তারপর বলল, ‘মাছ আনিনি।’
‘কেন?’
‘উরেব্বাস, যা দাম। ছোট কই মাছের কিলো পঞ্চাশ টাকা। এখানে সব বড়লোকরা থাকে, বুঝলে। আমরা এখানে থাকতে পারব না।’
‘এরা কি করে আছেন?’
‘কি জানি। তুমি প্রথম দিনেই রাঁধছ?’
‘তুই এখান থেকে যা, আমায় কাজ করতে দে।
অর্ক ঘুরে দাঁড়াল, ‘এখানকার লোকজন না কেমন ধরনের কথা বলে। ঠিক বাঙালও নয় আবার।’ বলতে বলতে অর্ক থেমে গেল। মাধবীলতা তখনও উনুন নিয়ে বিব্রত। অতএব তার চোখে পড়ার কথা নয়। কিন্তু অর্ক দেখতে পাচ্ছে। বাগানের পেছন দিক দিয়ে একজন ঢুকছে। আর একটু কাছে এলে ও থতমত হল। সেই মেয়েটা যাকে সে স্নান করতে দেখেছিল। নেপালি। ও এখানে এল কেন? ওদিক দিয়ে যে ভেতরে আসার দরজা আছে তাই জানতো না সে। মেয়েটা ওকে দেখতে পেয়ে গম্ভীর হতে হতে হেসে ফেলল। হাসিটাও যেন অদ্ভুত। তারপর খুব মাতব্বরের মত ভঙ্গী করে জিজ্ঞাসা করল, ‘মাসী কোথায়?’
‘কে মাসী?’ অর্কর বুক দুকবুক করছিল। তার দেখার কথাটা বলতে আসেনি তো? মেয়েটি চিৎকার করল, ‘মাসী, ও মাসী?’
ওপাশের ঠাকুরঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন হেমলতা, ‘কিরে, চেঁচাচ্ছিস কেন?’
‘কাঠের দামটা দাও। বাবা চাইছে।’
হেমলতা মাথা নাড়লেন, ‘এখনও মাস কাবার হয়নি, এখনই চাইছিস?’
‘জানি না বাবা পাঠালো।’
এইসময় মাধবীলতা রান্নাঘরের দরজায় এল, ‘কি ব্যাপার পিসীমা!’
হেমলতা হাত ঘুরিয়ে বললেন, ‘ওই যে, ওর বাবা কাঠ দেয় আমাদের। মাস কাবারে দাম নেওয়ার কথা এখনই তাগাদা দিতে এসেছে। তোর বাবাকে বলিস এবারে ভিজে কাঠ দিয়েছে।’
‘ইস আমরা কি জল দিয়ে ভিজিয়েছি। এখন দাম দেবে না যে আমি জানতাম।’
মেয়েটা ঘুরে দাঁড়াতেই অর্ক মাধবীলতাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, আমার কাছে টাকা আছে, দিয়ে দেব?’
‘বাব্বা! খুব বড়লোক দেখছি।’ মেয়েটি আবার মুখ ফেরাল।
হেমলতা তখন চিৎকার করলেন, ‘না, না, তোমরা দিও না। ছোটবউ শুনলে খুব রাগ করবে। তুই জানিস কার সঙ্গে কথা বলছিস? ও আমাদের নাতি, এই বাড়ির ছেলে!’