1 of 2

৪৩. দুপুর থেকেই আকাশটা পিচকালো

 তেতাল্লিশ

দুপুর থেকেই আকাশটা পিচ-কালো, একটুও হাওয়া নেই। দূরের জিনিস দেখার মত আলো নেই পৃথিবীতে। থম ধরে আছে চারধার। অনিমেষ এই বিশাল বাড়িটায় ছটফট করছিল। আজ দুপুরে নিরামিষ খাওয়া হয়েছে। সে ব্যাপারে তার কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু তারপরেই দমবন্ধ করা নির্জনতা। সামান্য শব্দ হলেই এই বাড়ির ভেতরে সেটা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ফিরে আসে।

ঘরের মধ্যে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছিল বলে সে বাড়ির পেছন দিকটায় এসে দাঁড়াল। এদিকের দরজাটা বড় একটা খোলা হয় না। বিরাট আম গাছের নিচে এখন হাঁটুসমান আগাছা। অন্ধকারমাখা ছায়া দিনদুপুরে সেখানে নেতিয়ে। সেদিকে তাকিয়ে অনিমেষের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে তার আর কেউ নেই। অন্তহীন অন্ধকারে সে একা। এই গাছপালা এই মেঘ এই ছায়ামাখা দিন, এগুলোরও জড়িয়ে মিশিয়ে যে অস্তিত্ব এবং মুহূর্তরচনার ভূমিকা আছে সেটা তার নেই। ব্যাপারটা নিয়ে অনিমেষ আর ভাবতেই পারছিল না। তার মস্তিষ্ক অসাড় এবং শরীর স্থির হয়ে ছিল। এখন চোখ বন্ধ করলেই সে মাধবীলতার মুখ দেখতে পায়। অথচ আশ্চর্য, অর্ক তাকে টানছে না। ক’দিনে অর্কর মুখ তার তেমন মনে আসেনি। যতবারই নিজের কথা ভেবেছে ততবার মাধবীলতা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

অনিমেষ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না কেন মাধবীলতা এরকম ব্যবহার করেছে। যে কারণ দেখিয়ে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে গেল সেটা কি আদৌ কোন কারণ? অনিমেষের স্বভাবচরিত্র তো তার চেয়ে আর কেউ ভাল জানে না। হয়তো সে বোঝার মত তার কাঁধে চেপেছিল কিন্তু ওই কারণে সেই বোঝা ছুঁড়ে ফেলার কি যুক্তি থাকতে পারে? তার কেবলই মনে হচ্ছিল, অন্য কোন কারণ আছে যা সে জানে না।

মাধবীলতা চলে যাওয়ার পর কটা দিন বেশ কেটে গেল। সে তো দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারল শুয়ে বসে। খুব প্রয়োজন ছাড়া ছোটমা তার সঙ্গে কথা বলেন না। কি দ্রুত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন এবং এখন নিজেকে নিয়েই থাকেন। হেমলতা ঠাকুরঘর এবং রান্নাঘর করে যে সময়টুকু কোনক্রমে পান সেটুকু অনিমেষের কাছে এসে খরচ করেন। প্রায় ধরা বাঁধা সেই কথাগুলো। প্রথমে কিছুক্ষণ সরিৎশেখরের বিরুদ্ধে নালিশ। তিনি যেসব অবিবেচক সিদ্ধান্ত নিয়ে মারা গিয়েছেন তার বিরুদ্ধে জেহাদ। তারপর ঈশ্বরকে কোতল করেন তিনি। রাজ্যের অভিযোগ জড়ো করে বলেন ভগবানকে পেলে তিনি দেখিয়ে দিতেন মজা এই যন্ত্রণা দেবার জন্যে। তারপরেই ওঁর সুর পাল্টে যায়। মাধবীলতার প্রশংসায় চলে আসেন তিনি। অমন ভাল মেয়ে নাকি হয় না। কি সুন্দর বউ। এই এক কথা শুনতে শুনতে অনিমেষ ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অথচ মুখে কিছু বলার উপায় নেই। যাওয়ার আগের রাত্রে মাধবীলতার সঙ্গে তার যেসব কথা হয়েছে তা চিরকাল এঁদের কাছে লুকিয়ে রাখতে হবে।

দরজা বন্ধ করে অনিমেষ আবার বাড়ির ভেতরে ফিরে এল। তারপর জামা পাল্টে ভেতরের বারান্দায় গিয়ে ডাকল, ‘পিসীমা, পিসীমা।’

হেমলতা সাড়া দিলেন না। এটাও ওঁর একটা অভ্যেস। ইদানীং মাঝে মাঝে তিনি নীরব হয়ে থাকেন। যেন বোবামানুষ। তখন দশটা প্রশ্ন করলেও সাড়া পাওয়া যায় না। আবার কথা বলতে শুরু করলে থামতে চান না। তৃতীয়বার ডাকার পর ছোটমা বেরিয়ে এলেন। ছোটমা এখন পুরোনো বাড়িটায় শুচ্ছেন। বোধহয় পিসীমার কাছাকাছি থাকার প্রয়াস। এই নতুন বড় বাড়িটায় অনিমেষ একা।

অনিমেষ ছোটমার মুখের দিকে তাকিয়ে থিতিয়ে গেল। খুব সাদা এবং রোগা দেখাচ্ছে মুখ। কাপড়ে সামান্য রঙ নেই। এত সাদা সহ্য করা যায় না। ছোটমাকে কদিন থেকেই তো দেখছে, কিন্তু এমন নিঃসঙ্গ এবং সিরসিরে অনুভূতি আর কখনও হয়নি। শরীরে মেদ নেই তো বটেই যেন মাংসও ঝরে গেছে।

‘কিছু বলছ?’

‘হ্যাঁ। আমি একটু বেরুচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দিতে হবে।’

ছোটমা আকাশের দিকে তাকালেন, ‘এইসময় কেউ বের হয়?’

‘ঠিক আছে।’ অনিমেষ’ যেন আর আলোচনায় যেতে চাইল না।

‘ছাতাটা নিয়ে যাও।’

‘ছাতা ধরার জন্যে আমার কোন হাত নেই।’ অনিমেষ হাসল। তারপর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল। গেট খুলে গলিতে পা দিয়ে তার মনে হল এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। নেহাতই বাড়িতে ভাল লাগছিল না বলেই সে বেরিয়েছে। জুলিয়েন দিন দুয়েক আগে মালবাজারে গিয়েছে। ক’দিন থেকে নাকি শহরে একটা চাপা উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। জুলিয়েনদের ডেরাটার ওপর নাকি পুলিসের নজর পড়েছে। সোনার দোকানে ডাকাতির ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করেই এই উত্তেজনা। শহরের মানুষের বিশ্বাস এরকম দিনদুপুরে ডাকাতি নাকি সাধারণ ডাকাতদের কর্ম নয়। খবরের কাগজে যেসব নকশালদের কথা পাওয়া যায় এ তাদেরই কীর্তি। জুলিয়েন বলেছিল, ‘দেখুন আমরা কিরকম নাম কিনেছি, কেউ কোন গুণ্ডামি ডাকাতি করলেই দোষটা আমাদের ওপর সরাসরি চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। নকশাল মানেই যেন ডাকাত।’ সাবধানের মার নেই তাই জুলিয়েনের ছেলেরা ওই কাঠের বাড়িতে বা নদীর চরে এখন থাকছে না। এ ব্যাপারে অনিমেষ অবশ্য জুলিয়েনকে সতর্ক করেছিল। দিন তিনেক আগে থানা থেকে লোক এসেছিল এখানে। অনেক পুলিস দেখেছে অনিমেষ, কিন্তু এরকম নিরীহ এবং ভদ্র পুলিস কখনও চোখে পড়েনি। মাস ছয়েক বাকি আছে ভদ্রলোকের অবসর নেবার। ধুতি পাঞ্জাবি পরে টাক মাথার মানুষটি সেদিন বিকেলে বাড়িতে এসে বললেন, ‘এই বাড়িতে মাধবীলতা মিত্র থাকেন?’

অনিমেষ বারান্দার চেয়ারে বসেছিল। মাধবীলতার নাম শুনে চমকে উঠেছিল। তখনও পৌঁছানোর সংবাদ আসার সময় হয়নি। সে একটু দুর্বল গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি?’

‘আমি? আমি মশাই পুলিসে চাকরি করি। অবনী রায়।’

পুলিসের লোকের মাধবীলতাকে কি দরকার ভাবতে গিয়েই ওই ডাকাতির কথাটা মনে পড়ল। মাধবীলতা বলেছিল পুলিস হয়তো ওর খোঁজে এখানে আসতে পারে। তা এতদিনে কেউ যখন কোন খোঁজ খবর করেনি তখন ধরে নেওয়া গিয়েছিল ওটা চাপা পড়ে গিয়েছে। মফস্বলে ডাকাতির তদন্ত কতটা করা হয় তাতে সন্দেহ আছে। অনিমেষ নিশ্চিন্ত ছিল মাধবীলতার তেমন কিছুই হারায়নি। আংটিটা ফেরত এসেছে এবং ছোটমার গয়নার জন্যে ন্যায্যমূল্যের বেশী টাকা পাওয়া গিয়েছে। অতএব এই ডাকাতি নিয়ে কোন চিন্তা মাথায় ঠাঁই পায়নি। মাধবীলতারা চলে যাওয়ার পর সে চমকে উঠেছিল। জামার পকেটে একটা ভারী সোনার হার অনিমেষ আবিষ্কার করেছিল। এই হার তার মায়ের, মহীতোষ নতুন বউ এর মুখ দেখেছিলেন সেদিন ওই হার দিয়ে। মাধবীলতা যাওয়ার আগে সেটা তার পকেটে রেখে দিয়ে গেছে নিঃশব্দে। অনিমেষ অবাক হয়নি। এটাই মাধবীলতার স্বভাব। কিন্তু হারখানার কথা এ’বাড়ির দুই মহিলাকে বলতে পারেনি অনিমেষ। সেইসময় তার মনে হয়েছিল আর একটা কথা। গয়না বন্ধক রাখবার সময় মাধবীলতা ওই দামী হারটা নিয়ে যায়নি। মহীতোষের আশীর্বাদী গয়না কিংবা অনিমেষের মায়ের স্মৃতিটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। একবারও মুখে পর্যন্ত ওই গয়নার কথা তোলেনি। যাওয়ার সময় সেটাই সে রেখে গেল অনিমেষের পকেটে। আগের রাত্রে যে সম্পর্কটাকে নিষ্ঠুর হাতে ছিন্ন করল পরের সকালে সে বিরাট অনাসক্তি দেখাল। সারাটা দিন অনিমেষ মুহ্যমান ছিল। শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, অন্য কোন মেয়ে হলে এটা ভাবার এবং সমীহ করার বিষয় হত, কিন্তু মাধবীলতা যা তাই করেছে।

পুলিসের লোক, যার নাম অবনী রায়, দাঁড়িয়েছিলেন। অনিমেষ উঠল না। দুটো হাত জড়ো করে বলল, ‘বসুন।’

অবনী রায় বসলেন। তারপর চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা তো সরিৎশেখরবাবুর বাড়ি। খুব একরোখা মানুষ ছিলেন। মাধবীলতা মিত্র তাঁর কে হন?’

‘আমার স্ত্রী। আমি ওঁর নাতি।’

‘আপনি? আপনি সরিৎবাবুর নাতি? নকশাল?’

লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসি পেল অনিমেষের। সে বলল, ‘ভয় পাচ্ছেন কেন? আমার দুটো পা তো আপনারা নিয়ে নিয়েছেন।’

‘অ্যা।’ অবনী অনিমেষের পায়ের দিকে তাকাল, ‘কি করে হল?’

‘কি করে হল আপনারা জানেন না। নকশাল আমলে আপনি নিজে কটা মানুষ খুন করেছেন হিসাব রেখেছেন?’

‘আমি? খুন? নেভার। পুলিসে চাকরি করি তাই বলে খুনী হব কেন।’

‘ভদ্রলোকে এ চাকরি করে না মশাই, কি করে যে এতকাল ম্যানেজ করে এসেছি তা ঈশ্বরই জানেন। আর কটা মাস, তারপর—। কিন্তু রিটায়ার্ড হলে আর এক জ্বালা। দুই মেয়ের এখনও বিয়ে হয়নি।’

‘কেন, পয়সা জমাননি? প্রচুর ঘুষ পেতেন তো!’

‘ওই তো! ঘুষ নিতে পারিনি। চাকরিতে ঢোকার সময় মা বলেছিলেন অসৎ হবি না। সেটাই মেনে এসেছি। আরে তাই আমার প্রমোশন হল না। আমার বস বলতেন, অবনী একটু রাগতে শেখ। পুরুষমানুষ না রাগলে বীর্যবান হয় না। যাক, এসব ব্যক্তিগত কথাবার্তা। আপনার স্ত্রীকে ডাকুন।’

অবনী তার হাতের ফাইলটা খুললেন।

‘কি ব্যাপার বলুন তো?’

‘ওই গয়নার দোকানে ডাকাতির ব্যাপারে ওঁকে থানায় যেতে হবে।’

‘কেন?’

“বাঃ, এনকুয়ারি হবে না? কত টাকার ইন্‌সুরেন্স ছিল জানেন?’

‘তার সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক?’

‘উনি ডাকাতির সময় ওই স্পটে ছিলেন। পুলিস ওঁর কাছে একটা স্টেটমেন্ট নিয়েছে। উনি নাকি একটা কানপাশা খুইয়েছেন। সেইসব ব্যাপার আর কি?’ অবনী রায় হাসতে গিয়ে গম্ভীর হলেন, ‘আচ্ছা, সেসময় ওঁর সঙ্গে যে ছেলেটি ছিল সে কে?’

‘আমাদের ছেলে, অর্ক।’

‘অর্ক। পার্টি করে?’

‘দূর! ও তো শিশু। পনের ষোল বছর বয়স।’

‘না মশাই, কারেক্ট এজটা আপনি জানেন না।’

‘বাঃ, চমৎকার আমি বাবা হয়ে জানব না?’

‘বাবাদের হিসাবে ভুল থাকে। এই তো, আমি আমার বড় মেয়ের বয়স অ্যাদ্দিন জানতাম বত্রিশ। পঁচিশে বিয়ে করেছিলাম, ছাব্বিশে হয়েছিল। গত সপ্তাহে স্ত্রী কোত্থেকে কুষ্ঠী করিয়ে আনলেন ছাব্বিশ। আমার হিসাব নাকি ভুল। খবরদার কাউকে যেন এসব না বলে বেড়াই। আপনি জানেন আপনার ছেলে একা তিনটে মাস্তানকে ঠেঙিয়েছে?’

‘কি বললেন?’

‘ওই তো। কিছুই জানেন না। আপনার দোষ নেই, আমিও জানি না। আমার মেয়েরা কোথায় কি করছে সব খবর রাখতে পারলে তো অ্যাদ্দিনে প্রমোশন পেতাম গোটা চারেক। কিন্তু মজার ব্যাপার দেখুন, ওই ছেলের সম্পর্কে আমার ফাইলে এইসব খবর আছে কিন্তু ও যে বিখ্যাত নকশাল নেতা অনিমেষ মিত্রের ছেলে সেটা কোথাও বলা নেই। মিসেস মিত্রকে ডাকুন।’

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘ওরা এখানে নেই। কলকাতায় চলে গিয়েছে।’

‘সে কি মশাই। তদন্ত চলাকালীন সাক্ষী স্থানত্যাগ করে কি করে? শাস্তি হয়ে যাবে। কবে গেল?’ অবনী রায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

‘আপনারা কি ওদের এখানে থাকতে বলেছিলেন?’

‘নিশ্চয়ই বলা হয়েছিল।’

‘আমার মনে হয় বলা হয়নি।’

‘কি মুশকিল! ওঁদের কলকাতার ঠিকানাটা কি?’

‘কি ব্যাপার বলুন তো? ওদের খুব প্রয়োজন?’

‘দেখুন এসব কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। ডাকাতিটা স্বাভাবিক ডাকাতি বলে পুলিস মনে করছে না। নকশাল বলে একটা গুজব উঠেছে। আপনার ছেলের যেরকম চেহারা আর বয়স তাতে ওর পক্ষে নকশাল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তারপর যখন জানা যাবে যে অর্ক নকশালের ছেলে তখন বিশ্বাসটা আরও শক্ত হবে। তখন যে এরকম ধারণা হবে না, অর্ক ওই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল, তা কে বলতে পারে!’

‘কিন্তু আমার স্ত্রী ওদের বাধা দিয়েছিল।’

‘তাই নাকি? সেটা তো এই রিপোর্টে লেখা নেই।’

‘বাঃ, শেষ ডাকাত বের হবার সময় মাধবীলতা বাধা দিয়েছিল বলেই ওরা অনেক গয়না আর টাকা নিয়ে যেতে পারেনি। অর্ক যদি ওদের দলের লোক হবে তবে সে কেন ডাকাতের হাত ধরতে যাবে!’

অনিমেষের কথা শুনে অবনী রায় হাঁ হয়ে গেলেন। তারপর রিপোর্টটা আদ্যোপান্ত পড়ে বললেন, ‘যাচ্চলে, এসব ঘটনার কথা কিস্‌স্যু লেখা নেই। দাঁড়ান, আপনি আগাগোড়া সব বলে যান তো আর একবার, আমি লিখে নিই।’

অনিমেষের বলা শেষ হলে অবনী রায় কলম বন্ধ করলেন, ‘ঠিক আছে, আমি রিপোর্টটা দিচ্ছি। কিন্তু ওঁকে পেলে ভাল হত। উনি জলপাইগুড়িতে আছেন জানলে সন্দেহটা কমত। কলকাতার ঠিকানাটা কি?’

‘তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেন। অবশ্য কথা আছে বাড়ি বদলাবার তবু ওই ঠিকানায় মনে হয় কদিন থাকবে।’

‘আপনি গেলেন না কেন?’

‘আমি।’ অনিমেষ সোজা হয়ে বসল, ‘গেলাম না!’

অবনী রায় কি বুঝলেন তিনিই জানেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সত্যি কথা বলুন তো, আপনারা এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত কি না!’

অনিমে হেসে ফেলল, ‘পাগল!’

অবনী রায় মাথা নাড়লেন, ‘ঠিক আছে। আপনার স্টেটমেন্টটা আমি ভেরিফাই করছি। যদি সত্যি হয় তাহলে আমি আপনার পক্ষে আছি।’

অনিমেষ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার পক্ষে?’

‘হ্যাঁ! চাকরি তো শেষ হয়ে এল। বাকি দিনগুলো সৎ থাকি।’ তারপর বারান্দা থেকে নেমে গেটের কাছে পৌঁছে বললেন, ‘আমি আপনাদের পাড়াতেই উঠে এসেছি। দেখা হবে।’

‘কোথায়?’ অনিমেষ ক্রাচদুটো টেনে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

‘করলা নদীর ধারে, ব্রিজটার ডান হাতে যে একতলা বাড়ি সেটাই এখন আমার আস্তানা। নমস্কার।’

সেদিন অনিমেষ অনেকক্ষণ আবিষ্ট হয়েছিল। অবনী রায়ের চেহারা এবং ব্যবহার পরিচিত পুলিসদের মত নয়। তারপরেই তার মনে হয়েছিল সমস্ত ঘটনাটা মাধবীলতাকে লিখে দেওয়া দরকার। জলপাইগুড়িতে সে নিশ্চয়ই ফিরতে চাইবে না। কিন্তু আইন তাকে বাধ্য করতে পারে ফিরে আসতে। কিন্তু এভাবে সে ফিরে আসুক অনিমেষ কখনই চায় না। যদি অবনী রায়ের কোন হাত থাকে তাহলে তাঁকে অনুরোধ করলে নিশ্চয়ই রাখবেন। অনিমেষের ধারণা ছিল না অবনী রায় কিভাবে তার স্টেটমেন্ট যাচাই করবেন। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হল মাধঝীলতা কোন চিঠি না দেওয়া পর্যন্ত সে যেচে কিছু লিখবে না। কে জানে, হয়তো মাধবীলতা ভাববে অনিমেষ তাকে অকারণ ভয় দেখাচ্ছে।

আজ এই মেঘের দুপুরে টাউন ক্লাব মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে অনিমেষের মনে হল অবনী রায় সেই যে গেছেন আর এ’মুখো হননি। হাতে যখন কোন কাজ নেই, কারো সঙ্গে দেখা করার কথা মনে পড়ছে না তখন একবার গিয়ে অবনী রায়ের খোঁজ করলে কেমন হয়! করলা নদীর ধার পর্যন্ত হেঁটে যেতে তার কোন অসুবিধে হবে না। অবনীবাবুকে যদি বুঝিয়ে বলা যায়-! অনিমেষের মনে হল মাধবীলতাকে কোন ব্যাপারে না জড়াতে দেওয়া তার কর্তব্য।

করলা নদীর দুপাশে যে ঘরবাড়ি অনিমেষ কৈশোরে দেখে গিয়েছিল এখন তার তেমন পরিবর্তন হয়নি। ছবিটা একই আছে শুধু এদিকটায় কিছু নতুন বাড়ি তৈরি হলেও সেগুলোর চেহারা এখন পুরোনোদের মতন। হয়ত প্রতি বছর নদীর জল ওদের ধুয়ে দিয়ে যায়। অনিমেষ অবনী রায়ের বাড়িটাকে অনুমান করতে পারল। রাস্তায় একটাও মানুষ নেই। মেঘগুলো যেন আরও নিচে নেমে এসেছে। ছায়া আরও ঘন এবং তাতে অন্ধকার মিশেছে। বন্ধ বাড়ির দরজার কড়া নাড়ল অনিমেষ।

এরকম নির্জন দুপুরে এরা সবাই দরজা জানলা বন্ধ করে আছে সেটাই খুব অবাক হওয়ার মত ঘটনা। একটা পচা গন্ধ আসছে পাশের নদীর শরীর থেকে। অনিমেষ দ্বিতীয়বার কড়া নাড়তে দরজাটা খুলল। ঘরের ভেতরটা বেশ অন্ধকার তবু অনিমেষের অনুমান করতে অসুবিধা হল না মহিলা যুবতী। গলাটা বেশ কর্কশ, ‘কি চাই? কাকে চাই?’

‘অবনী রায়ের বাড়ি এটা?’

‘হ্যাঁ। আপনি কে?’

বিন্দুমাত্র ভদ্রতাবোধ নেই, একদম চাঁচাছোলা প্রশ্ন কোন যুবতী করতে পারে তা অনিমেষের ধারণায় ছিল না। সে নিরীহ গলায় বলল, ‘আমার নাম অনিমেষ।’

‘বাবার সঙ্গে কি দরকার?’

অনিমেষ সামান্য ইতস্তত করে বলল, ‘উনি জানেন।’

‘তাহলে ঘুরে আসুন।’ দরজাটা প্রায় বন্ধ হচ্ছিল।

অনিমেষ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘উনি বাড়িতে নেই?’

‘আছে। একঘণ্টার আগে দেখা হবে না। স্নানটান করছে।’

‘ও। অনিমেষ দ্বিধায় পড়ল। এই মেঘ মাথায় নিয়ে সে কোথায় যাবে! তাহলে আবার পরে কখনো আসতে হয়। এইসময় ভেতর থেকে দ্বিতীয় নারীকণ্ঠ ভেসে এল, ‘দিদি, জেনে নে কি দরকার!’

‘করলাম তো, বলল বাবা জানে। আচ্ছা, আপনি বসতে পারেন। ল্যাংড়া মানুষ আবার কোথায় ঘুরবেন। সুস্থ মানুষ হলে বসতে দিতাম না।’ দরজাটা হাট করে খুলে গেল। অনিমেষের অস্বস্তি আরও বাড়ল। এ গলায় এমনভাবে কোন মেয়ে কথা বলতে পারে? কিন্তু মেয়েটি এমন ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে যে চলে যেতে সঙ্কোচ হল। অনিমেষ ভেতরে ঢুকল। সাধারণ সাজানো ঘর। চেয়ারে বসে সে আবার মেয়েটিকে দেখল। অত্যন্ত স্বাস্থ্যবতী, মুখটা মেদবহুল, যৌবন একটু বাড়াবাড়ি রকমের। ওপাশে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে সে ঠিক এর বিপরীত। রোগা, বড্ড রোগা কিন্তু মুখটি মিষ্টি।

‘বলুন কি দরকার?’ জেরা করার মত প্রশ্নের ধরন। পুলিসের মেয়ে হিসেবে একে চমৎকার মানায়। অনিমেষের রোখ চেপে গেল। সে কিছুতেই.একে আসার কারণটা বলবে না। তার বদলে জিজ্ঞাসা করল, ‘সুস্থ মানুষদের অপছন্দ করেন?’

‘হ্যাঁ। জোয়ান সুস্থ মানুষ বজ্জাত হয়।’

অনিমেষ ঢোক গিলল। এ কিরকম কথাবার্তা। দ্বিতীয় মেয়েটি বলল, ‘এই দিদি! এসব বলিস না।’

‘চুপ কর তুই। যা সত্যি তা বলতে মায়া রায়ের জিভ কাঁপে না।’

অনিমেষ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গীতে বলল, ‘সবাই কি একরকম?’

‘সব্বাই। মেয়েদের কাছে এক ধান্দায় আসে, সেটা ফুরিয়ে গেলেই হাওয়া হয়ে যায়। পাঁচ পাঁচবার এই অভিজ্ঞতা আমার। আপনি খোঁড়া না হলে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে দিতাম না। ব্যাটাছেলে দেখলেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়।’

অনিমেষ মুখ নিচু করল। তারপর বলল, ‘এটা ঠিক নয়। সবাই কি একরকম হয়? আপনার বাবাকে ডেকে দিন।’

‘বললাম তো বাবার কলে লাগবে আধঘণ্টা, খেতে আধঘণ্টা। এইজন্যেই তো বাবার প্রমোশন হল না। মা বলে, তুমি যা নিড়বিড়ে তোমার কিছু হবে না।’ মায়া নাম্নী মেয়েটি শেষ করা মাত্র ছোটটি দরজা থেকে বলল, ‘এই দিদি তোকে মা ডাকছে।’

‘ডাকুক। কি জন্যে ডাকছে জানি। সত্যি কথা সব সময় বলব!’ মেয়েটি এক রোখা ভঙ্গীতে একটা চেয়ারে বসতেই ভেতরের দরজায় অবনী রায় এসে দাঁড়ালেন, ‘আরে আপনি! কি সৌভাগ্য। আমার এই পাগল মেয়েটা কি বলছে?’

মায়া সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কি? আমি পাগল? তা তো বলবেই। গলায় কাঁটা হয়ে আছি তো। দেব একদিন ওই করলায় ঝাঁপ তখন বুঝবে।’

অনিমেষ সোজা হয়ে বসল, ‘আপনাকে বিব্রত করতে এলাম।’

‘না না কিছুমাত্র না! আমিই আজ আপনার কাছে যেতাম। একটা সুখবর আছে। আপনার স্ত্রী এবং ছেলেকে এই কেস থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওদের আর দরকার হবে না।’ অবনী রায় হাসতে লাগলেন।

‘কি রকম?’

‘ওই আপনার স্টেটমেন্টটাই হেল্প করল। দোকানের কর্মচারী সুনীতকে বলতে সে স্বীকার করল ঘটনাটা সত্যি। তার মালিক গয়না আর টাকার কথা স্রেফ চেপে গিয়েছে। আপনারা সত্যি কথা বলে দিতে পারেন সাক্ষী হলে এটা জানার পর মালিক তদ্বির করে সাক্ষী হিসেবে আপনাদের নাম কাটিয়ে দিল। ডাকাত তো ধরা পড়বে না মনে হচ্ছে, আপনারা আর জড়ালেন না। অবশ্য আমাকে একটু ভয় দেখাতে হয়েছিল।’ অবনী রায় হাসলেন।

অনিমেষ নমস্কার করল, ‘আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।’

‘কিছু না। মানুষ যদি মানুষের মত আচরণ না করে তবে কেন আর জন্মানো! কই মা, একটু চা করো, উনি প্রথম এলেন।’

অনিমেষ কিছু বলার আগেই মনে হল বাজ পড়ল। টিনের ছাদে ঝমঝম শব্দ শুরু হল। আকাশটা যেন মুহূর্তেই ধসে পড়ল মাটিতে। এত শব্দ অনিমেষ কোনদিন শোনেনি। মায়া উঠল, ‘এই বৃষ্টিতে যেতে পারবে না বলে চা করছি।’ তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানেন, আজ বন্যা হবে। সব ব্যাটাছেলেগুলো যদি বন্যায় ডুবে মরত।’ তারপর মুখ ফিরিয়ে ভেতরে চলে গেল।

অবনী রায় এবার কাঁচুমাচু হলেন, ‘আপনি কিছু মনে করবেন না।’

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘না, না, ঠিক আছে।’ সে দেখল দ্বিতীয় মেয়েটিও ভেতরে চলে গিয়েছে।

অবনী রায় চেয়ারটা টেনে আনলেন অনিমেষের কাছে, ‘এই হল আমার মেয়ে। বড় মেয়ে। মাথাটা ঠিক নেই।’

‘বুঝতে পেরেছি।’

‘কিন্তু বিয়ে দিতে পারছি না। কবে কোন ছেলে এসে কি করে গেছে আর মেয়ে তাই ধরে বসে আছে। পাত্রপক্ষ এলে এইসব কথা বলে। এরপর আর কেউ বিয়ে করতে চায়!’

অবনী রায়ের মুখ দুমড়ে গেল।

অনিমেষ কি বলবে বুঝতে পারল না। হঠাৎ অবনী রায় বলল, ‘আপনি কি ভগবানে বিশ্বাস করেন?

‘একথা কেন?’

‘নকশালরা তো ওসব মানে না।’

‘কি জানি। বলুন।’

‘আমি বিশ্বাস করি। জীবনে কখনও কোন অন্যায় করিনি। আমার ভাগ্যে এমন হবে কেন? হতে পারে না। এই মেয়ে ভাল হয়ে যাবে। যাবে না, বলুন?’

‘নিশ্চয়ই যাবে।’

অবনী রায় ইতস্তত করলেন, ‘আপনি একটু বসুন, আমি আসছি।’

অনিমেষ বলল, ‘বৃষ্টি না ধরলে-।’

‘আরে ঠিক আছে। আমি দুটো খেয়ে নিই-’

অবনী রায় চলে গেলে চুপচাপ বসেছিল অনিমেষ। মেয়েটির ওপর তার একটুও রাগ হয়নি। বরং কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে। আজ মাধবীলতা কি তার সম্পর্কে একই কথা বলতে পারে? সে প্রয়োজনে ওকে ব্যবহার করেছে এখন প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলে-। অনিমেষ দুহাতে মুখ ঢাকল। এই মেয়েটির যা যন্ত্রণা তা তো মাধবীলতারও হতে পারে। হঠাৎ অনিমেষের নিজেকে নতুন করে অপরাধী বলে মনে হতে লাগল। যেন এই মেয়েটির এমন আচরণের জন্যে সে-ও দায়ী।

‘আপনার চা।’

অনিমেষ হাত সরিয়ে দেখল ছোট মেয়েটি চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। অনিমেষ কাপটা নিতেই মেয়েটি বলল, ‘মা বলেছে আপনি যেন কিছু মনে না করেন। দিদিটা ওইরকম।’

‘না না ঠিক আছে। তোমার দিদি কোথায়?’

‘জল দেখছে।’

‘তুমি দাঁড়াও।’ অনিমেষ দু’চুমুকে চা-টা খেয়ে নিল। তারপর ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘আমাকে ওখানে নিয়ে চল।’

‘আপনি যাবেন?’ মেয়েটি অবাক হল।’

‘তোমাদের অসুবিধা হবে?’

‘না, না। আসুন।’

ভেতরের বারান্দায় পৌঁছে অনিমেষ নদীটাকে দেখতে পেল। বড় বড় জলের ফোঁটা পড়ছে নদীর ওপরে। সাদা হয়ে আছে পৃথিবীটা। মেয়েটি তাকে বারান্দার কোণে নিয়ে যেতে সে মায়াকে দেখতে পেল। অবনী রায় বোধহয় পাশের রান্নাঘরে। তাঁর স্ত্রী বোধহয় পরিবেশন করতে করতে মুখ বাড়িয়ে অনিমেষকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন।

বারান্দাটা এল-প্যাটার্নের। অনিমেষ মায়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটা উবু হয়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে। শব্দ শুনে সে মুখ ফেরালো। অনিমেষ হাসল, ‘ভাই, আমি যাচ্ছি।’

‘আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? ও, চা দিলাম বলে?’

‘না, অত বকেছ তাই।’

‘আমাকে তুমি বলছেন কেন?’

‘বাঃ, তুমি আমার বোন। তোমাকে তুমি বলব না?’

মায়া মুখ ফেরাল। তারপর অদ্ভুত গলায় বলল, ‘জল বাড়ছে। ঠিক বন্যা হবে। আমি জানি।’

‘এই বন্যার জলে তোমার দাদা ভেসে যাক তুমি চাও?’

‘আমি আপনার কথা বলিনি।’

‘ও তাই বল। তাহলে যাই।’

‘আপনার মাথা খারাপ? এই বৃষ্টিতে যাবেন কি করে?’

‘খোঁড়া মানুষ, জল বাড়লে ডুবে যাব।’

‘মোটেই না। এখন যাওয়া চলবে না। কি ভাবেন আপনারা? মেয়েদের আপনারা কি ভাবেন অ্যাঁ? চলুন, আপনাকে বসতে হবে।’ মায়া উঠে দাঁড়াল। অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘তাহলে রাগটাকে কমাতে হবে। ঠিক আছে?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *