1 of 2

৪০. হঠাৎ একটা কনকনে ঢেউ

 চল্লিশ

হঠাৎ একটা কনকনে ঢেউ যেন এই ঘরে আছড়ে পড়ল। মাধবীলতা এবং অনিমেষ এখন অসাড়, ওদের চোখ দরজার দিকে। রাত এখন কত কে জানে। দরজায় অর্ক দাঁড়িয়ে, ওর মুখচোখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, সে ওদের দেখছে। অনিমেষ খুব দুর্বল বোধ করছিল। অর্ক যে সব শুনেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মাধবীলতার ওপর প্রচণ্ড ক্রোধ ছাড়া তার অন্য কোন অনুভূতি এল না। খামোকা চিৎকার চেঁচামেচি করে সে ছেলেটাকে—। রাগ বাড়ছে অথচ সে প্রকাশ করতে পারছে না।

মাধবীলতার বুকের ভেতরটা ধক্‌ করে উঠেছিল। অর্ক যে পাশের ঘরে জেগে আছে তা তার মাথায় আসেনি। আসলে নিজেকে এমন ছিন্নভিন্ন লাগছিল যে অনিমেষ কথা শুরু করা মাত্র উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল। সেই মুহূর্তে অন্য কোন ভাবনা কাজ করেনি। নিজের কাছে যেটা সত্যি, চূড়ান্ত সত্যি, যাকে এতদিনে অনেক চেষ্টায় চাপা দিতে চেয়েছিল, আজ হঠাৎ—! এখন আর কিছুতেই কিছু এসে যায় না। যা স্বাভাবিক তাই মেনে নেওয়া ভাল। এইটুকু ভাবতে পেয়ে সে ক্রমশ সহজ হয়ে এল। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারল তার গলা কাঁপছে, ‘কি রে ঘুমোসনি?’

অর্ক অন্ধকার ঘরটায় এতক্ষণে দুটো শরীরকে আলাদা করে চিনতে পেরেছে। কয়েকটা কালো থাবা এতক্ষণ তার বুকের ভেতরটা আঁচড়াচ্ছিল, মাথার ভেতরে একটা গনগনে উনুন উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে তার ঘুম প্রায় এসে গিয়েছিল। এইসময় একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর তার কানে গেল। গলাটা মেয়েদের এবং তারপরেই বুঝতে পারল ওটা মায়ের। মা কখনও এই গলায় কথা বলে না। খুব অবাক হয়েছিল অর্ক। মায়ের কি শরীর খারাপ করল? সে চটপট বিছানা থেকে নেমে এসেছিল। কারো একটা কিছু হয়েছে এ রকম বোধই তার মনে কাজ করছিল। দরজার কাছে পৌঁছে সে বাবার গলা শুনতে পেয়েছিল। খুব অনুনয়ের ভঙ্গীতে বাবা মাকে বোঝাচ্ছিল। এবং তার পরেই মা কাটা কাটা গলায় কথা বলল। এই মুহূর্তে অর্ক আবিষ্কার করল মা কোন বিপদে পড়েনি, বাবার সঙ্গে কথা বলছে মাত্র। কিন্তু এরকম গলায় সে ওদের কোনদিন কথা বলতে শোনেনি। তারপরেই তার খেয়াল হল মা বাবা তো স্বামী-স্ত্রী। কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছিল সে। কিন্তু সেইসঙ্গে তার খেয়াল হল আজ অবধি কখনও বাবা মাকে স্বামী-স্ত্রীর মত কথা বলতে শোনেনি। ওরা যখনই গল্প করেছে কিংবা ঝগড়া সেটা বন্ধুর মতই করেছে। অর্কর উপস্থিতি কখনই ওদের তেমন অসুবিধে করেনি। স্বামী এবং স্ত্রী যা যা করে বলে সে জেনেছে তার কোন কিছুই এত বছরে এক ঘরে থেকে বাবা মাকে করতে দ্যাখেনি। মায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক তার থেকে বিন্দুমাত্র আলাদা ছিল না। সেইটে আজ হঠাৎ পাল্টে গেল কি করে? মা এইরকম নিষ্ঠুর গলায় কথা বলছেই বা কেন? অর্কর কৌতূহল হল। তার আশঙ্কা হল ঝগড়ার বিষয়বস্তু সে নয় তো? তাকে নিয়ে মায়ের সবসময় দুশ্চিন্তা। হয়তো আজ বিকেলে তিস্তার চরে যাওয়া নিয়ে মা রাগারাগি করছে বাবার ওপরে। কিংবা তখন সে এখানে থাকতে চেয়েছিল বলে মা তাকে চড় মেরেছে। সেই প্রসঙ্গেই হয়তো এই ঝগড়া! অর্ক দরজার জোড়ায় কান পাতল। এতক্ষণ বৃষ্টির জন্যেই বোধহয়, যে কথাগুলো ঝাপসা ছিল তা পরিষ্কার হল। শুনতে শুনতে অর্কর মনে হচ্ছিল মা ঠিক বলছে। হঠাৎ এই প্রথম সে মাকে অন্য চোখে দেখতে পেল। মা সারা জীবন তাদের জন্যে করে গেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মা বলছে যা করেছে সব বাবার মুখ চেয়ে। তার কথা কিছু বলছে না। এক ধরনের ঈর্ষা বোধ করলেও সে বুঝতে পারছিল মা অন্যায় বলছে না। মা আর পাঁচটা বিবাহিতা মহিলার মতন জীবনে কিছুই পায়নি। অথচ এতদিন এটাই তাদের চোখে স্বাভাবিক ছিল। আজ মা এসব কথা বলছে বাবা এখানে থেকে যেতে চায় বলেই! সে থাকতে চেয়েছিল বলে মা চড় মেরেছিল। বাবাকে সেরকম করা সম্ভব নয় বলেই এসব কথা বলছে। অর্ক কান পাতল। এবং তখনই একটা গরম সিসে ছিটকে এল তার কানে। বাস্টার্ড। বাস্টার্ড মানে কি? স্পষ্ট না হলেও সে অনুমান করতে পারল। বাবা এবং মায়ের বিয়েই হয়নি? বাবা এবং মা অবিবাহিত অবস্থায় এতকাল একসঙ্গে ছিল। শান্তিনিকেতনে বাবা একদিন মাকে ভোগ করেছে বলে সে এসেছে পৃথিবীতে! অর্কর সমস্ত শরীর জ্বলতে লাগল। বাবা চিৎকার করল কিন্তু কথাটাকে অস্বীকার করতে পারছে না। মা শুধু বাবাকে ভালবেসেছিল বলেই তাকে লালন করেছে। অর্কর মাথার ভেতরটা গুলিয়ে যাচ্ছিল। চোখ বন্ধ করতেই সে সেই দৃশ্যটাকে দেখতে পেল। খাটের ওপর একটা রুগ্ন বিকলাঙ্গ মানুষ বসে আছে। মা দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে নরম গলায় বলছে, ‘তোমার বাবা।’ সেই প্রথম সে বাবাকে দেখেছিল। তার আগে শুধুই মা, আর মায়ের কাছে গল্প শুনেছে বাবা জেলে আছে। আর তখনই মাধবীলতা অনিমেষকে বলছিল অর্কর দায়িত্ব নিতে, সে একাই কলকাতায় ফিরে যেতে চায়।

অর্ক কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। মা বলল, পাঁচজনে জানলে তাকে বাস্টার্ড বলবে। অর্থাৎ অবিবাহিত মানুষদের সন্তানকে লোকে বাস্টার্ড বলে! মোক্ষবুড়ি প্রায়ই একটা গালাগাল দিত, বেজম্মা। যার জন্মের কোন ঠিক নেই। কথাটার মানে এতদিন খুব স্পষ্ট ছিল না। অর্ক আর পারল না। তার শরীরে এখন যেন এক ফোঁটা রক্ত নেই। কাঁপা হাতে দরজাটা খুলল সে। একটু একটু করে কপাট আলাদা হতে সে অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পেল না। তার কয়েক মুহূর্ত বাদে মায়ের গলা শুনতে পেল, ‘কি রে, ঘুমোসনি?’

অর্ক জবাব দিল না। সে কেন দরজা খুলেছে একথা বুঝিয়ে বলার ভাষা তার মনে আসছিল না। সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল দুটো মানুষের দিকে। অন্ধকার আচমকা যেন পাতলা হয়ে যাচ্ছে ওই ঘরে।

মাধবীলতা খুব দ্রুত নিজেকে ফিরে পেল। এ ঘরের কথাবার্তা যে ছেলের কানে পৌঁছেছে তাতে তার সন্দেহ ছিল না। সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, ‘কি হয়েছে, কথা বলছিস না কেন?’

এইবার অর্ক যেন নড়ে উঠল, সে নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করল, ‘এতক্ষণ তুমি যা বললে তা সত্যি?’

সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল অনিমেষ, ‘কি বলেছে ও? কিছুই বলেনি। আর যদি কিছু কথা হয়ে থাকে তা আমাদের মধ্যে হয়েছে, তোর সে কথা শোনার কোন প্রয়োজন নেই। যা, শুয়ে পড়।’

অর্ক সেই একই স্বরে বলল, ‘কিন্তু আমি যে শুনেছি।’

অনিমেষ এবার খুব দুর্বল হয়ে পড়ল। সে দেখল মাধবীলতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে। এখন আর কোন ফিকিরেই এই ভাঙ্গা বাঁধ জোড়া দেওয়া যাবে না। অথচ কিছু একটা করা উচিত! কিন্তু সেটা কি তা তার মাথায় আসছিল না। এই সময় মাধবীলতা বলল, ‘কি শুনেছিস?’

‘তোমার সঙ্গে বাবার কখনও বিয়ে হয়নি?’

মাধবীলতা চোখ বন্ধ করল। তার সমস্ত শরীর যেন এই মুহূর্তেই খরা। আশ্চর্য, চোখে একফোঁটা জল আসছে না। এই সত্য, চূড়ান্ত সত্যটির মুখোমুখি হতে হবে একদিন তা কি তার জানা ছিল না? ছিল, কিন্তু কখনই তাকে পরোয়া করেনি। তাহলে আজ কেন গরম হাওয়ার হলকা ছাড়া বুকের ভেতরে কিছুই অবশিষ্ট নেই। সে পায়ে পায়ে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অন্ধকারের শরীরে কেউ যেন কাঁচা দুধ গুলে দিয়েছে। ফলে একটা মোলায়েম আলো পড়েছে ভেজা গাছের পাতায়, আকাশের গায়ে। ওপাশে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া সুপুরি গাছগুলো অদ্ভুত মায়াময় হয়ে উঠেছে। এখন রাতের ঠিক-দুপুর পার হওয়া সময়।

‘তোমার সঙ্গে বাবার কখনও বিয়ে হয়নি?’ অর্কর গলাটা একটু জোরে।

মাধবীলতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, না। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, ‘এসব তুমি কি বলছ ওর কাছে? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

‘আজকে ওর সত্যিটা শোনা উচিত। যথেষ্ট বড় হয়ে গেছে তোমার ছেলে। শোন, তোর বাবার সঙ্গে আমার আইনের কিংবা ধর্মের বিয়ে হয়নি। সেটা করার কোন প্রয়োজন আমি বোধ করিনি।’ মাধবীলতা মুখ ফেরাচ্ছিল না।

‘কেন? সবাই তো তাই করে, এটাই নিয়ম।’

‘তুই বুঝবি না। আমি মনে করি আইনের চেয়ে বিশ্বাস অনেক বড়। সেই বিশ্বাস যতদিন থাকবে ততদিন আমরা স্বামী স্ত্রী। খোকা, এই প্রশ্ন পৃথিবীর অন্য কেউ করলে আমি জবাব দিতাম না। কিন্তু তোর জানা উচিত।’

অর্ক বলল, ‘তুমি বাবাকে ভালবাসতে, বিশ্বাস করতে, তাই বিয়ে করোনি। কিন্তু আমি কি দোষ করেছি?’

‘তুই নিজেকে দোষী ভাবছিস কেন?’

‘নিশ্চয়ই। যদ্দিন তোমাদের বিশ্বাস ছিল তদ্দিন আমি তোমাদের ছেলে ছিলাম। এখন আমার পরিচয় কি হবে?’

মাধবীলতা বলল, ‘আমি তোকে পেটে ধরেছিলাম। জন্মাবার পর তুই আমাকেই প্রথম চোখ মেলে দেখেছিলি। আমি তোকে যা যা চিনিয়েছি তুই তাই চিনেছিস। এটা তো কখনই মিথ্যে হতে পারে না। তুই আমার ছেলে।’

অন্ধকারে অর্কর গলায় সামান্য হাসির ছিটে মিশল, ‘তাহলে আমাকে রেখে যাচ্ছ কেন এখানে? কি পরিচয়ে থাকব আমি?’

‘তুই তোর বাবার কাছে থাকবি।’

‘কি করে বুঝব উনি আমার বাবা?’

‘খোকা!’ চাপা গলায় গর্জে উঠল মাধবীলতা।

‘চেঁচিও না মা, আমার প্রশ্নটা যে মিথ্যে তা প্রমাণ কর।’

মাধবীলতার মনে হল ছেলের এই কণ্ঠস্বর আগে কখনও শোনেনি। আচমকা যেন সে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। অথচ এখন কথা বলা দরকার। যখন শুরু হয়েছে তখন খোলাখুলি সব বলা ভাল। কিন্তু সেইসময় অনিমেষ চাপা গলায় বলে উঠল, ‘তোর কোন অধিকার নেই মাকে অপমান করার।’

‘আমি মাকে অপমান করছি না। মা নিজে বলুক তুমি আমার বাবা।’

‘এটা কি নতুন কথা, তুই প্রথম শুনলি?’

‘কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? তোমরা বিয়ে করোনি।’

‘বিয়ে? বিয়ে বলতে কি বুঝিস তুই? শুধু মন্ত্রপাঠ আর কাগজে সই করলেই বিয়ে হয়? আমার সমস্ত নিশ্চয়তা ছেড়ে এই মানুষটার কারনে আমি কষ্ট সহ্য করেছি কি জন্যে? সেটা বিয়ের চেয়ে কম?’ মাধবীলতা হাঁপাচ্ছিল।

‘তাহলে আজ তুমি ছেড়ে চলে যাচ্ছ কেন?’

এবার মাধবীলতা ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। সে কেন যাচ্ছে তা বোঝাবে কি করে! অর্ক মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল আবার, ‘তুমি কি ওঁকে ভালবাস না?’

‘নিশ্চয়ই বাসি।’

‘তবে?’

‘তুই বুঝবি না, এ বোঝার বয়স তোর হয়নি। শুধু এটুকু জেনে রাখ, আমি আজ প্রথম নিজেকে খুব—।’ মাধবীলতার গলার স্বর ডুবে যাচ্ছিল। কোনরকমে সে বলতে পারল, ‘অপমান বুকে নিয়ে একসঙ্গে থাকা যায় না।’

কিছুক্ষণ এই ঘরে কোন শব্দ নেই। তিনটে মানুষ যেন নিঃশ্বাস দিয়ে পরস্পরকে জানবার চেষ্টা করছিল। শেষ পর্যন্ত অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘লতা, কি সামান্য কারণে তুমি, তোমরা আমাকে ভুল বুঝলে। যাক, যা ভাল বোঝ তাই করো।’ তারপর ধীরে ধীরে দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে গেল।

অর্ক এবার মাধবীলতার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মাধবীলতা তখন জানলার দিকে ফিরে দাঁড়িয়েছে, তার চিবুক বুকের ওপর। বাইরের জানলায় তখন ছিমছাম আকাশ। হঠাৎ অর্কর মনে হল তার এত চিন্তা করার কি আছে? জ্ঞান হবার পর সে মাকেই দেখেছে, মায়ের চেষ্টায় একটু একটু করে বড় হয়েছে। বাবার কাছ থেকে কতকগুলো গল্প ছাড়া সে কিছুই পায়নি। বাবা যদি মাকে বঞ্চিত করে থাকে সে নিজেও কিছু কম হয়নি। আজ যদি পৃথিবীর মানুষ তাকে বেজন্মা বলে তাতে সে কি আর বেশী হারাবে? কোন অধিকতর সম্মান পেত যদি তার বাবা মা আইনসম্মত বিবাহিত হত? কিস্যু না। কিন্তু মাকে ছেড়ে তার পক্ষে এ বাড়িতে থাকা অসম্ভব। এই মানুষটা তার বাবার কাছে কিছুই পায়নি, সেই ঋণ তার শোধ করা উচিত। অর্ক মাধবীলতার হাত আঁকড়ে ধরল, ‘মা, আমি তোমার সঙ্গে কলকাতায় ফিরব।’

মাধবীলতা কেঁপে উঠল, ‘না।’

‘না বলো না। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।’

‘বোকামি করিস না খোকা। এই বাড়ি তোর, এখানকার পরিবেশ তোকে মানুষ করবে।’

‘তুমি কাছে না থাকলে আমার মানুষ হওয়ার দরকার নেই মা। কি হবে মানুষ হয়ে। চারপাশে তাকিয়ে দ্যাখো, কত লোক মানুষ হয়েছে। কি করছে তারা? তুমি জানো না আমি অনেককে চিনি যাঁরা খুব শিক্ষিত এবং বড়লোক, সমাজের চোখে তাঁরা মানুষ হয়েছেন কিন্তু তাঁদের কথা ভেবে আমার বমি পেয়েছিল। মানুষ হওয়ার নিয়মটা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে মা।’ অর্ক কেটে কেটে কথাগুলো উচ্চারণ করছিল। মাধবীলতা অবাক হয়ে তাকাল। এই ছেলে, এক রাত্রে এতটা পাল্টে গেল? আজ বিকেলেই না সে ওকে চড় মেরেছে! কিন্তু তবু একটা অভিমান তার বুকের দেওয়ালে মাথা ঠুকছিল। সেই মুহূর্তে অর্ক তাকে জড়িয়ে ধরল, ‘মা, আমাকে ছেড়ে যেও না।’

মাধবীলতা বুঝতে পারছিল না তার কি করা উচিত। কিন্তু তার বাঁধ ভাঙ্গছিল। এই ছেলেকে সে শরীরে ধারণ করেছিল, বড় করেছিল। যতক্ষণ এ তাকে ত্যাগ করে না যায় সে ছাড়বে কেন?

একটু হাওয়া বইলেই গাছগুলো থেকে টুপ টুপ করে জল ঝরছে। ঘাসগুলো চপচপে ভিজে। অথচ আকাশের কোনায় একফালি চাঁদ উপুড় হয়ে রয়েছে। কোথাও মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। অনিমেষ এবার ঠাণ্ডা আবিষ্কার করল। সিরসির করছে শরীর। ভেজা ঘাসে পা থাকায় ঠাণ্ডাটা আরও জোরদার হয়েছে। সে মুখ ফিরিয়ে বারান্দাটার দিকে তাকাল। বাড়িটা অন্ধকার।

কি থেকে কি হয়ে গেল। এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাধবীলতা এমন কাণ্ড করবে সে ভাবতে পারেনি। মেয়েটার অভিমানবোধ এত বেশি তা সে আঁচ করতে পারেনি। ছোটমা আর পিসীমার কাছে অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে সে স্বীকার করেছিল এখানে থেকে যাবে। তখন মনে হয়েছিল পরে মাধবীলতাকে বুঝিয়ে বললেই চলবে। কিন্তু! হঠাৎ তার মনে হলো মাধবীলতা কি তার কাছ থেকে নিষ্কৃতি চাইছিলো? এতদিন ধরে বোঝা টেনে টেনে ও কি হাঁপিয়ে উঠেছিল? তাই সামান্য একটা ঘটনাকে আঁকড়ে ধরে এইভাবে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইছে? এইরকম একটা বিপরীত চিন্তা করতে পেরে অনিমেষের ভাল লাগল। কিন্তু তারপরেই মনে হল কেন করল মাধবীলতা? এই বাড়িতে তাকে জোর করে সে-ই নিয়ে এসেছে। এই বাড়ির বউ-এর সম্মান সে নিজেই আদায় করে নিয়েছে। এখন আর তার কি অভিযোগ থাকতে পারে? হিসাব মেলাতে পারছিল না অনিমেষ। কিন্তু অর্ক? অর্কর কাছে তো তাকে ধূলিসাৎ করে দিল মাধবীলতা। ওই ছেলের সামনে এত কথা বলার কি দরকার ছিল? অর্ক যখন উদ্ধত গলায় প্রশ্ন করছিল তখন তার উত্তর যুগিয়ে গিয়েছে মাধবীলতা। সেটা তাকেই অপমান করা নয়? এবং তখনই তার মনে পড়ল সে জেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে বসে বিয়ের কথা বলতেই মাধবীলতা জানিয়েছিল আনুষ্ঠানিক বিয়ে ওর কাছে তখন অসম্মানের হবে। তাহলে তার অন্যায় কোথায়? অনিমেষ ছটফট করতে লাগল।

ক্রাচে ভর দিয়ে সে গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মাধবীলতা কলকাতায় চলে যাবে। এই যাওয়া যে চূড়ান্ত যাওয়া তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে কি মাধবীলতাকে ছেড়ে থাকতে পারবে? ব্যাপারটা চিন্তা করতেই অনিমেষের বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। এত বছর একসঙ্গে থেকে, যে মেয়েটা তার জন্যে নিজের জীবন নিংড়ে দিল তাকে চোখের ওপর দেখে দেখে—! অনিমেষ মাথা নাড়ল। সে কি করে পারবে? দু’চারমাস আলাদা থাকা যায় কিন্তু চিরকাল? অনিমেষ চোখ বন্ধ করল। এবং তখনই তার জেলখানার দিনগুলো মনে পড়ল। তখন তো সে একটু একটু করে মাধবীলতাকে ভুলতে পেরেছিল। এমন কি তাকে এড়াতে মুক্তি পাওয়ামাত্র সে অন্য লোকের বাড়িতে উঠতে পেরেছিল। স্বৰ্গছেঁড়াকে একসময় তার প্রাণের চেয়ে বেশী মনে হত। সেই বাতাবি লেবুর গাছ, মাঠ, চা-গাছ আর আংরাভাসা নদীকে ছেড়ে কোনদিন থাকতে পারবে না বলে মনে হত তখন। কিন্তু একসময় জলপাইগুড়িতে থাকতেই সব ফিকে হয়ে গেল। তার নিজের মা, মাধুরী? যার গায়ের গন্ধ নাকে না এলে ঘুম আসতো না তাকে ছেড়ে সে জলপাইগুড়িতে এসেছিল। আর সেই মা মারা যাওয়ার পর রোজ রাতে আকাশের একটি বিশেষ তারার দিকে তাকিয়ে থাকত। মা বলেছিল মন খারাপ হলেই যেন সে তারাটার দিকে তাকায় তাহলে মন ভাল হয়ে যাবে। হায়, কতকাল, সে কতকাল কে জানে, মন ভাল করার জন্য তারাটার দিকে তাকাতে হয়নি। আর এখন তো সে কিছুতেই হাজার তারার মধ্যে বিশেষ তারাটাকে খুঁজে পাবে না। কলকাতায় চলে যাওয়ার পর এক এক করে হেমলতা আর সরিৎশেখর তার কাছে নিষ্প্রভ হয়ে যাননি? নাহলে জেল থেকে বেরিয়েও এত বছর সে এখানকার মানুষগুলোর খবর না নিয়ে থাকল কি করে? বাবার অসুস্থতার খবর পেয়েও সে তো ছুটে আসেনি? অনিমেষ অন্ধকারে নিজেকে অভিযোগ করল, তুমি স্বার্থপর, তোমার মনে ভালবাসা নেই অনিমেষ। নাহলে লালবাজারে গর্ভবতী মাধবীলতার ওপর অত্যাচার দেখার পরও তোমার একবারও মনে হয়নি মেয়েটা কেমন আছে? অতএব আজ যদি মাধবীলতা চলে যায় তাহলে দুদিন বাদে তুমি নিশ্চয়ই এতগুলো ঘটনার মত এটাকেও ভুলে যাবে। অনিমেষ ঝুলন্ত চাঁদের দিকে তাকাল। আমি কি মানুষ নই? তাহলে আমার এমন হয় কেন? কোন কিছুকে আঁকড়ে ধরে চিরকাল থাকতে পারি না কেন? অদ্ভুত একটা যন্ত্রণা বুকের মধ্যে পাক খেতে লাগল ওর। অথচ এমন তো কথা ছিল না। এরকম নিরক্ত হয়ে বেঁচে থেকে লাভ কি! সে আবার বাড়িটার দিকে তাকাল। সরিৎশেখর কত ভালবেসে এই বাড়ি তৈরি করেছিলেন। এর প্রত্যেকটা ইটের গায়ে তাঁর স্পর্শ লেগে আছে। আজ তিনি নেই অথচ বাড়িটা। একটা কিছু রেখে যাওয়া দরকার। কিন্তু কিছুই সে রেখে যেতে পারল না। সাধারণ মানুষ তাদের সন্তানদের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে যেতে পারে। অর্ক তার সম্পর্কে কি ধারণা নিয়ে পৃথিবীতে থাকবে?

ধীরে ধীরে অনিমেষ গেট খুলল। ঝিম ধরে আছে চারধার। মৃত নগরীর মত মনে হচ্ছে। অনিমেষ পায়ে পায়ে গলি দিয়ে বড় রাস্তায় চলে এল। রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। এখন কত রাত কে জানে। ডানদিকের রাস্তাটা চলে গেছে শহরের দিকে। বাঁদিকটা মুখ থুবড়েছে বাঁধের গায়ে। সেদিকে হাঁটতে শুরু করল অনিমেষ। আশ্চর্য, এখন তার কোমর বা থাইতে কোন ব্যথা নেই। বেশ স্বচ্ছন্দ লাগছে। অথচ কলকাতায় থাকতে এতটা সে ভাবতেও পারত না। অনিমেষের মুখে হাসি ফুটে উঠল। নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু সে বোধহয় কোনকালেই ভাবতে শিখবে না।

এই সময় পাশে ভোঁস ভোঁস শব্দ হতেই সে থমকে দাঁড়াল। রাস্তার ধারে একটা সাদা গরু মুখ তুলে তাকে দেখছে। গরুটা ছাড়া এবং নিঃসঙ্গ। এর মালিক হয়তো খবর রাখে না কিংবা ফাঁক পেয়ে পালিয়েছে। দুটো বড় বড় চোখে সে এখন অনিমেষের দিকে তাকিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল তার দিকে। অনিমেষ চেষ্টা করল দ্রুত এগিয়ে যেতে। গরুটা তাকে ঢুঁস মারলে তার কিছুই করার থাকবে না। কিন্তু গরুটাও যেন বেশ মজা পেয়ে গেছে। নিশ্চিন্তে তার পিছনে চলে আসছে ওটা। দ্রুত চলার জন্যে বাঁধের ওপর উঠে বেদম হয়ে পড়ল অনিমেষ। তারপর একটা ক্রাচ কোনরকমে শূন্যে তুলে নাড়তেই গরুটা দাঁড়িয়ে পড়ল। অথচ ফিরে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। অনিমেষ বুঝল সে চলা শুরু করলেই ওটা পিছু নেবে। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল অনিমেষ। বাঁধের ঢালু পথ দিয়ে নামতে নামতে ও অন্ধকার মাখা তিস্তার চরে দোতলা কাঠের বাড়িটাকে আবছা দেখতে পেল। গরুটা এবার হুড়মুড়িয়ে নামছে। অনিমেষ শক্ত হয়ে দাঁড়াল। প্রায় দৌড়েই তার শরীরের পাশ দিয়ে চরে নেমে গেল গরুটা। নেমে মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখে হাম্বা স্বরে চিৎকার করে উঠল। অনিমেষ শুনল চরের কোন প্রান্ত থেকে আর একটা গরু গলা তুলে জানান দিল ওকে। এবার নিশ্চিন্ত প্রাণীটি সেই শব্দ লক্ষ্য করে রওনা দিল বালি মাড়িয়ে। অনিমেষ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই যাওয়া দেখল। একে কি বলে? টান, না ভালবাসা? সে ঠোঁট কামড়াল।

বালির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ক্রাচ দুটো বারবার গেঁথে যাচ্ছে বালিতে টেনে তুলে হাঁটতে গিয়ে এবার থাই-এর টনটনানি শুরু হল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই চরের দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। সেই বিশাল নদী কোথাও নেই। এই চরে যেন নতুন একটা উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। জুলিয়েন বলেছিল কাঠের দোতলা বাড়ির কথা। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়নি তখন কিন্তু এখন তো চোখের ওপরই দেখতে পাচ্ছে। তার কৈশোরে এখানে রাত কাটানোর কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না। শীতকালের সেই রহস্যময় কাশ গাছ আর পক্ষীরাজ ট্যাক্সিগুলো আর বর্ষায় কেউটের মত ফুঁসে ওঠা ঢেউগুলোর ছবি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। পৃথিবীটা কি দ্রুত পাল্টে যায়। কি দ্রুত!

কাঠের দোতলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে দম নিল অনিমেষ। এবং তখনই তার চোখে পড়ল দোতলার একটা ঘরের ফাঁক দিয়ে আলো বেরুচ্ছে। এই বিশাল চরে ঢলে পড়া রাতের শরীরে ফালি চাঁদ যা করতে পারেনি ওই চেরা আলো তার থেকে অনেক বেশি প্রাণের স্পর্শ দিচ্ছে। এত রাত্রে কেউ নিশ্চয়ই জেগে আছে ওখানে। এই চরের মানুষদের আর্থিক সঙ্গতি যা তাতে সারারাত কেরোসিন পোড়াবার বিলাসিতা কেউ করবে না।

অনিমেষ এবার কাঠের সিঁড়িটাকে লক্ষ্য করল। স্বৰ্গছেঁড়ার ফরেস্ট কোয়াটার্সের মত, গোটা আটেক কাঠের মোটা বিমের ওপর দোতলাটা দাঁড়িয়ে। পাশ দিয়ে এক-রেলিং দেওয়া সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। অনিমেষ কোনরকমে ক্রাচে ভর দিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গতে লাগল লাফিয়ে। একটু বেসামাল হলেই নিচে গড়িয়ে পড়তে হবে। কিন্তু অদ্ভুত জেদ চেপে গেল তার। সামান্য সিঁড়িটা ভাঙ্গতে দীর্ঘসময় লাগল তার। কিন্তু ওপরের বারান্দায় ক্ৰাচটা আওয়াজ করতেই চিৎকার ভেসে এল, ‘কে?’ আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো নিবে গেল।

অনিমেষের তখন কথা বলার অবস্থা ছিল না। বুকের খাঁচাটা হাপরের মত কাঁপছে। মুখ হাঁ, চোখ বিস্ফারিত। এইসময় দরজাটা খুলে গেল। আর একটা লোক সন্তর্পণে মুখ বের করে তাকে দেখল। অনিমেষ আর দাঁড়াতে পারছিল না। তবু কোনরকমে ক্ৰাচটাকে আঁকড়ে ধরে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিল।

এবার লোকটি চাপা গলায় ঘরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলে বারান্দায় এসে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে আপনি? কি চান?’

অনিমেষ হাত তুলল কোনমতে, বলতে চাইল একটু দাঁড়ান।

ততক্ষণে আরো কয়েকজন বাইরে বেরিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন ছুটে এল কাছে, ‘আরে অনিমেষ! কি ব্যাপার, হঠাৎ এখানে, এইসময়? বিকেলে তো কিছু বলেননি আমাকে?’

অনিমেষ মাথা নাড়ল। তারপর জুলিয়েনের দিকে তাকিয়ে কোনরকমে বলতে পারল, ‘আমি এলাম!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *