ছেলের বিয়ের জন্য মনটা প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু প্রস্তুত করে ফেলার পর হঠাৎ অনুভব করল সত্য, খুব খুশি-খুশি লাগছে।
ছেলের ওই পুলক গোপন করা লাজুক মুখটা ভারী কৌতুকজনক, মাঝে মাঝে বিয়ে সংক্রান্ত এক-একটা কথা ফেলে সেই পুলকটা দেখে নিচ্ছে আর মনে মনে মুখ টিপে হাসছে সত্য।
সত্যর মনের উপরে যে অনেকগুলো বয়সের ভার জমে উঠেছিল, তার থেকে কি কতকগুলো বছর ঝরে পড়ে গেল। তার ইদানীংয়ের স্তিমিত আর তিক্তস্বাদ দিনগুলো যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে। মধুর এক কৌতুকরসে চঞ্চল হয়ে উঠছে দিনের চেহারা রাতের চিন্তা।
বিয়ের গোছের সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ভাবতে শুরু করেছে সত্য, সম্পর্কে এমন কাউকে দেখতে পাচ্ছি না যে ওদের ফুলশয্যের ঘরে আড়ি পাতবে। সত্যর সঙ্গে সম্পর্কটা যে বড়ই সাংঘাতিক, একেবারে “মা” বলে কথা। তবু ভাবতে থাকে সত্য, তাদের বারুইপুরের বাড়ির যে ঘরটায় বরকনের ফুলশয্যে হবে, সেই ঘরের জানলা-দরজায় কোথাও একটা ছ্যাদা করে রাখতে হবে। কেউ কি আর সেটা কাজে লাগাতে পারবে না? সত্যর বাপের বাড়ির অনেকেই তো আসবে। এই চিন্তাটাতেই মনটা যেন উৎসাহে উদ্বেল হয়ে উঠেছে। প্রথম সন্তান যদি মেয়ে হত, হয়েও তো ছিল, থাকল না তাই, যদি থাকতো কোন কালে তার বিয়ে-থাওয়া হয়ে যেত, শাশুড়ী হয়ে যেত সত্য।
কিন্তু সে ঘটনাটা ঘটে উঠতে পায় নি। এতখানি বয়সে সত্যর এই প্রথম কাজ। আর সে কাজ কন্যাদায় উদ্ধার নয়, ছেলের বিয়ে। ছেলের মামার বাড়ি থেকে সবাইকে না এনে ছাড়বে নাকি সত্য? কারুর কোনো ওজর-আপত্তি শুনবে না।
নবকুমার যে আবার ঠিক এই সময়ে চলে গেল, তা নইলে এখনই তাকে দিয়ে নেমন্তন্ন পত্তর লিখিয়ে ফেলতো সত্য। দিন স্থির করে পাকাঁপাকি নেমন্তন্ন করবার আগে একখানা জানান, চিঠি দিতে হবে বৈকি। জানানো কোথায় বিয়ে হচ্ছে, কী বৃত্তান্ত, তাছাড়া তাদের একটু প্রস্তুত করেও রাখা। ছেলের বিয়ে বলে ব্যাপার, অন্তত পাঁচ-সাতদিন তা থাকতেই হবে সবাইকে।
সারদাকে তো অবিশ্যিই আসতে হবে, বড়দার দ্বিতীয় পক্ষকেও আসতে না বললে ভাল দেখাবে। রাসুর আরো সব ভাইদেরও বিয়ে হয়েছে, তাদেরও বলা দরকার। নতুন ঠাকুমা এখনো রয়েছে সিথেয় সিঁদুর নিয়ে “ভাগ্যবানি এয়োরাণী”! কিছু না পারুন, বসে বসে এয়োলক্ষণগুলো করতে পারবেন তিনি।
মায়ের জন্যে একটা নিঃশ্বাস পড়ল সত্যর। ওঁদের থেকে কত ছোট ছিলেন মা, অথচ কতকাল হল হারিয়ে গেছেন! আজ যদি মা থাকতেন?
একটুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আবার মনে মনে তালিকা গড়তে লাগল সত্য। ছেলেপুলের সংখ্যা যে এখন তার বাপের বাড়িতে কটি, কার কতগুলি, সে সব সঠিক জানে না ভেবে মনে মনে লজ্জিত হল, ভাবলো এমন কৌশল করে লিখতে হবে যাতে কেউ না সত্যর সে অজ্ঞতাটি টের পায়।
তুড়ুর সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশার সম্পর্কের আছে অবিশ্যি একজন। সে-জন হচ্ছে বড়দার বড় ছেলের বন্ধুর বৌ। যার বিয়ের সময় সত্যকে নিয়ে যাবার জন্যে অনেক বলাকওয়া করেছিল রাসু।
কিন্তু সত্যর তখন অবস্থা শোচনীয়।
সুবর্ণ জন্মাবার পরের অবস্থা সেটা। প্রায় শয্যাগত সত্য বিয়েবাড়ি যাবার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারে নি। তাছাড়া মনেও সে উৎসাহ ছিল না। বড়দা বড়বৌ অবিশ্যিই সত্যর সে ত্রুটি ধরবে না। সত্যকে সত্যিকার ভালবাসে, ওরা।
একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা মনে পড়ে যাওয়ায় একা-একাই হেসে উঠল সত্য। মনে পড়ে গেল, সেই সারদার ঘরে শেকল তুলে দিয়ে জব্দ করার কথা।
সত্যি, কী হাঁদাই ছিল সত্য তখন!
পরে একদিন সে কথা তুলে হাসি-ঠাট্টা করেছিল সারদা। যেবার সত্য প্রথম সন্তান হতে বাপের বাড়ি গিয়ে অনেকদিন ছিল। তখন আর সারদা বয়সের পার্থক্য ধরত না, ননদ-ভাজ সম্পর্কটা দেখত। সারদার কাছে অনেক ধরনের সাংসারিক গল্প শুনেছে তখন সত্য, মাঝে মাঝে তর্ক তুলেছে, মাঝে মাঝে প্রতিবাদ। সারদা বলেছে, আচ্ছা বাবা, দেখবো পরে! তোমার এই একবগগা বুনোমি কেমন বজায় রাখতে পারো! সংসার এমন জাঁতা না, মুগ মুসুর অড়র ছোলা সব এক করে পিষে ছাড়ে!
সত্যকে কি পেষাই করতে পেরেছে সংসার?
মাঝে মাঝে নিজেই ভাবে সত্য।
.
কিন্তু এখন মনটা উদ্বেল। এখন ওসব ভাবনা দাঁড়াচ্ছে না। এখন সত্য ভাবছে, তখন নিত্যানন্দপুরের সংসারটা কী ভালোই ছিল। সে বাড়িতে এখন বাবা নেই।
জানি কেমন সেই চেহারাটা সংসারের!
নেড়ুর কথা ভেবেও দুঃখ হয়, আবার কোথায় যে আছে সে এখন! সেই একবার কদিনের জন্যে এসে থেকে মায়া বাড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে গেল। আর পাত্তা নেই। কে বলবে সেই পড়া ফাঁকি দেওয়া নিরীহ-নিরীহ ছেলেটার মধ্যে অমন একটা ঘরছাড়া খামখেয়ালি মন ছিল লুকানো!
নিত্যেনন্দপুরের খবর পায় সত্য মাঝে মাঝে বড়দাকে চিঠি লিখে। খুবই দূরে দূরে অবশ্য। বড্ড যখন মনটা কেমন করে তখন। রাসুর উত্তরগুলো অবশ্য সংক্ষিপ্ত, তবু খবরগুলো দেয়।
রামকালী তো চিঠি দিলে উত্তরই দেন না।
একবার শুধু লিখেছেন, পত্র না পেলে দুঃখিত হয়ো না। কিন্তু কেন সেই না পাওয়ার অবস্থা ঘটবে তা লেখেন নি।
সত্য বোঝে ইচ্ছে করেই আর লিখবেন না চিঠি।
মায়ামুক্ত করছেন নিজেকে।
তবু ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাবাকে একবার পায়ের ধুলো দিতে আসতে বলবেই সত্য। বলবে, বাবা, আপনার আশীর্বাদ না পেলে ওদের বিয়েটাই তো বৃথা!
ছেলের বিয়ে উপলক্ষ করে চিত্তসমুদ্রের অনেক নিচের ঢেউ উপরে উঠে আসছে সত্যর, অনেক ধুলোর স্তরে চাপা পড়ে যাওয়া অনুভূতি তীব্র হয়ে সাড়া তুলছে।
একদা যে পুণ্যি সত্যর প্রাণের বন্ধু ছিল, সেই পরম মূল্যবান কথাটাও যেন ভুলতে বসেছিল সত্য। কত কাল কত যুগ যে দেখা হয় নি! অথচ বেশী দূরে থাকে না পুণ্যি, শ্রীরামপুরে তার শ্বশুরবাড়ি। নৌকোয় চেপে বসতেই যা দেরি, একদণ্ডেই পৌঁছে যাওয়া যায়। সত্যও কখনো ভাবে নি যাওয়া যায়, পুণ্যিও কখনো ভাবে নি আসা যায়।
তা সত্য অবিশ্যি না ভাবতে পারে, পুণ্যির শ্বশুরবাড়িটা কুটুমবাড়ি, মেলাই লোক তাদের, বিনা উপলক্ষে যাওয়ার কথা ওঠে না। কিন্তু সত্যর এই বাসাবাড়িটায় তো সে বাধা নেই? পুণ্যি তো একবার কালীদর্শনের ছুতোয় আসতে পারতো?
আসল কথা, সংসার মানুষকে চেপে পিষে ফেলে, বিশেষ করে মেয়েমানুষকে।
তার ভিতরকার যা কিছু মাধুর্য, যা কিছু কোমলতা, যা কিছু ছাঁচ, সব যেন ঘষে ক্ষইয়ে ভেঁতা করে শুকিয়ে চারটি ধুলোবালি করে ছেড়ে দেয়। নইলে পুণ্যির বৈধব্য-সংবাদেও তো একবার গিয়ে দেখা করে উঠতে পারে নি সত্য!
পুণ্যিকে আনতেই হবে তুড়ুর বিয়েতে।
হঠাৎ মনটা ভারী চঞ্চল হয়ে ওঠে, একটা দোয়াত কলম আর একখানা কাগজ নিয়ে পুণ্যিকে চিঠি লিখতে বসে সত্য।
শ্রীচরণকমলেষু পাঠই দেয়, যতই হোক পিসি। তুড়ুর বিয়ের সংবাদ জানিয়ে আবেদন জানায়, পিসি যেন ছেলে, ছেলের বৌ ও মেয়েদের নিয়ে নিশ্চয় করে আসার ব্যবস্থা করে, সম্মতিপত্র পেলেই আনতে লোক পাঠাবে সত্য।
লোক পাঠাতে হবে বৈকি।
নইলে অত দূর-কুটুম্ব আসবে কেন? সমাজ-সামাজিকতার মধ্যে বন্ধুত্ব কথাটার কোনো মূল্য নেই।
চিঠি লেখা হলেও এখন ডাকে দেওয়া চলবে না। নবকুমার এখন অনুপস্থিত, তাকে না দেখিয়ে এত কর্তাত্বি ফলানো ঠিক নয়। সংসারে যতই ডাকাবুকো হোক সত্য, এসব নিয়মগুলো মানে বৈকি।
নিত্যেনন্দপুরেও নিজে সে বিশদ একখানি পত্রে সবাইকে আহ্বান জানালেও, মূল পত্রটা নবকুমারকে দিয়েই লেখাতে হবে, সেটাই ভব্যতা।
বাড়িসুদ্ধ সকলকে ঢালা নেমন্তন্ন করলেও, কাকে কাকে বিশেষ জানাতে হবে তারও একটা তালিকা বানিয়ে ফেলে সত্য।
এসব কাজ যতটা লিখিত-পড়িতের মধ্যে হয় ততই ভাল, দৈবাৎ যদি কারো নামোল্লেখে ভুল হয়ে যায়, লজ্জার শেষ থাকবে না।
নবকুমারের দিকে আত্মীয়ের পাট নেই।
দূর সম্পর্কে কে নাকি এক পিসি আছে, আর জ্ঞাতি মামাতো ভাইয়েরা আছে। আর তো কখনো কারো নাম শোনে নি সত্য। আর আছেন শাশুড়ীর এক সই, তাকেই দেখেছে দু-একবার। পুজোয় তাঁর নামে শাড়ি যায়, পালা পার্বণে তত্ত্ব যেতে দেখেছে।
আর কই? এলোকেশীর সব কিছুই পড়শীদের নিয়ে।
তবে একটা বড়সড় ঘর এখন হয়েছে।
সে ঘর সদুর।
সদুর সংসারটি বড় ছোট্ট নয়।
তা সে ভাবলে চলবে না। ছেলের বিয়ে-ব্যাপারটিও তো ছোট নয়।
নিজের সেই বাল্য-কথা মনে পড়ে যায় সত্যর।
কত বড় বড় যজ্ঞি হত এক-একটা কাজে! ভাত পৈতে বিয়ে তো দূরের কথা, ঠাকুমার ‘অনন্তচতুর্দশী ব্রত’ উদযাপনেই যা ঘটা হয়েছিল সেবার, উঃ!
ভাতমাছের যজ্ঞি নয়, সবই লুচিমিষ্টির ব্যাপার, তবু সে কী কাণ্ডর ভিয়েন! ‘জুলি’ কেটে কেটে উনুন বানিয়েছিল, হালুইকর ঠাকুরদের একটা মেলা বসে গিয়েছিল। মাছের অভাব পূরণ করতে দুই ক্ষীর ছানার পায়েসের নদী সমুদ্র বইয়ে দিয়েছিলেন রামকালী, মিষ্টির পাহাড় বানিয়েছিলেন।
যজ্ঞি ভাবতে গেলেই সেই সব দৃশ্য চোখের উপর ভেসে ওঠে। উৎসব মনে করতে গেলেই সেই সেকালটার ছবি ফুটে ওঠে।
তেমন ধরনের না করতে পারলে মন উঠবে না সত্যর।
একটু-আধটু কথা তুলতে গিয়েছিল সত্য, নবকুমার ভয়ে চোখ কপালে তুলেছে। বলেছে, পয়সাকড়ির জন্য বলছি না, ভগবানের ইচ্ছেয় পয়সাকুড়ির কথা ভাবি না, কিন্তু করবে কে? লোকবল কোথা? কথায় বলে-ধনবল জনবল আর মনোবল। তিনটেই দরকার। আছে তোমার তা?
এ ধরনের কথা যে শুনতে হবে, সে আন্দাজ সত্যর ছিল, তাই তার প্রস্তুতিও ছিল। অতএব সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিয়েছিল সত্য, ধনবলই জনবলকে ডেকে আনে, আর মনোবল ওই দুটোকেই চালায়, তা সে বস্তু তোমার না থাক আমার আছে।
তোমার তো সব কথাই লম্বাচওড়া, পেল্লায় একটা যজ্ঞি কেঁদে শেষ অবধি তোক হাসাবে আর কি!
সত্য দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিল, লোকই বা হাসাবো কেন? বরাবর যেমন কাজকর্ম দেখে এসেছি, সেইভাবেই ভাবতে শিখেছি। লোক হাসবে এ কথা ভাববও না।
সত্যিই সে কথা ভাবতেই পারে না সত্য।
যাতে না কোন বিশৃঙ্খলা ঘটে, সেই প্রতিজ্ঞাই গ্রহণ করেছে সে।
.
কাজটা কলকাতায় করতে পেলে অবিশ্যি সুবিধের অবধি থাকত না, কলকাতা শহরে কড়ি ফেললে অর্ধেক রাত্রে বাঘের দুধ মেলে। কিন্তু সেই সুখসুবিধাময় মধুর কল্পনাটিকে সবলেই নির্বাসন দিয়েছে সত্য মন থেকে। প্রথম ছেলের বিয়ে, বাসাবাড়ি থেকে হওয়ার কথা ভাবাও অসঙ্গত। আর শুধু প্রথম ছেলেই বা কেন, ছেলে-মেয়ে কারো বিয়েই ভিটের বাইরে দেওয়া উচিত নয়। নান্দীমুখ শ্রাদ্ধ হবে, সাতপুরুষ জলপিণ্ড পাবেন, সে কাজ কি যেখানে সেখানে করতে আছে?
তাই দেশের বাড়িটার ওপরই সব ছবি আঁকছে সত্য, সব চিন্তা রাখছে। এ ব্যাপারে সত্যর বন্ধু, উপদেষ্টা, সাহায্যকারী সব হচ্ছে বটে ছেলে সরল।
গ্রীষ্মের ছুটি চলছে, তাই সুবিধেও আছে। যখন তখনই সত্য ডাক পাড়ছে, খোকা, দোয়াত কলমটা একাবার পাড় তো বাবা, কটা কথা মনে এসেছে এই বেলা লিখে নে, নচেৎ ভুলে যাবো।
সরল হাসে, তুমি আবার ভুলে যাবে! জ্যেষ্ঠপুত্তুরের বিয়ে বিয়ে করে তো তোমার মাথার মধ্যে রাতদিন রেলগাড়ির ইঞ্জিন চলছে!
সত্যও হেসে ওঠে, তোর বুঝি হিংসে হচ্ছে? তা তোর বিয়ের সময়ও কম যাবো না, মাথায় জাহাজ চালাবো!
নমস্কার মা। দেখেই আমার বাসনা মিটে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সরলের এই রকমই কথাবার্তা।
‘গুরুজন’ বলে শিহরিত-কলেবর কোনো সময়েই নয় সে। বাবার কথায় অনায়াসেই সে আড়ালে হেসে হেসে বলে, বাড়ির কর্তার রায় দেওয়া হয়ে গেল? বলে, যাক, কর্তার কর্তব্য সমাপন করা হয়ে গেছে
সত্য হাসি চেপে বলে, এই পাজী ছেলে! কী কথার ছিরি! গুরুজন না?
সরল সভয়ের ভান করে বলে কী সর্বনাশ! তাতে কোনো সন্দেহ দেখিয়েছি আমি? তবে হ্যাঁ, হাসির ব্যাপারে না হেসে থাকতে পারি না আমি।
সরলের যত কথা মায়ের সঙ্গে।
রান্নাঘরে জলচৌকিতে বসে হাঁড়ি কড়া বোগনো যা পায় একখানা নিয়ে তবলা ঠোকে আর গল্প করে, বুঝলে মা, আজ রাস্তায় এক তাজ্জব গাড়ি বেরিয়েছে। গাড়িও অনাসৃষ্টি, নামও অনাসৃষ্টি ট্রাম গাড়ি। ঘোড়ায় টানছে। উঃ, সেই ট্রামগাড়ি দেখবার জন্যে কী ভিড়টাই হয়েছে! রাস্তার দু ধারে কাতারে কাতারে লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে।
বলে, বুঝলে মা, আজ হেদোর ধারে একটা বন্ধুর সঙ্গে কথা কইতে কইতে হয়ে গেল এক চোট! সে বলে কিনা, বাঙালি জাতটার কিছু হবে না! ভণ্ড আর হুজুগে জাত একটা! চড়ে গেল রাগ। খুব শুনিয়ে দিলাম।
সত্য আগ্রহভরা মুখে বলে, কী শোনালি?
এবার সরল লজ্জিত হয়, হেসে ফেলে বলে, কী আর! বললাম, জাতের কলঙ্ক ঘোচাবার চিন্তা নেই, হেসে হেসে নিন্দে করতে লজ্জা করে না? গলায় দড়ি দাওগে। নচেৎ এই হেদোর জলে ঝাঁপ দাও গিয়ে।
সন্ধ্যাবেলা রান্নার সময়টা হচ্ছে সত্যর আনন্দের সময়, এই সময়ই সরল এসে বসে।
সাধন বরাবরই অন্য ধরনের। চুপচাপ মুখবোজা লাজুক। তা ছাড়া একটু বিজ্ঞ বিজ্ঞ। রান্নাঘরে এসে বসার কথা সে ভাবতেই পারে না। এক গ্লাস জল গড়িয়ে খাবার ক্ষমতাও তার নেই। যা কিছু কাজ সরল করে। সরল সত্যর ডান হাত।
এখনও ভূমিকালিপি পূর্ববৎ, শুধু সংলাপের সুর অন্য।
সরল বলে, বাবা তো শুনেছি, ভেলভেটের চোগা-চাপকান-টুপি পরে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন, দাদা কি পরে যাবে মা?
সত্য তাড়া দেয়, বটে রে ফাজিল কেষ্ট ছেলে, ভেলভেটের চোগা-চাপকান পরা সেই মূর্তি তুই দেখেছিস বুঝি?
সরল বলে, আহা, পূর্বাহ্নেই তো বলছি, শুনেছি!
কার কাছে শুনলি শুনি?
কেন, পিসির কাছে। পিসির কাছে তোমার ছোটবেলার কথা, বাবার ছোটবেলার কথা সব শুনেছি।
হুঁ, পিসি তা হলে তোকে বাপের বিয়ে দেখাচ্ছে! সত্য হাসে। তারপর বলে, তুড়ু কি পরে বিয়ে করতে গেলে মানায় তুই-ই বল!
আমি কি বলবো? আর বললেই বা শুনছে কে? চোগা না চাপাও, সেই বেগুনরঙা চেলির জোড় তো চাপাবেই তার ঘাড়ে! তবে? বিয়ে করা মানেই সং সাজা। বাব্বা!
আচ্ছা তোকে আর বিয়ের মানে ব্যাখ্যা করতে হবে না, সত্য তাড়া দেয়, মিষ্টির ফর্দটা বরং শোনা আর একবার, দেখি শুনতে কেমন লাগছে! ছাদার মিষ্টি আলাদা ধরেছিস তো?
.
কলকাতা থেকে কারিগর যাবে, মিষ্টি তারাই করবে। আজ সরলকে পাঠিয়েছিল সত্য তাদের কাছে পাকা কথা কইতে। সরল সব সন্ধান রাখে।
সরল বাড়ি নেই, সাধন তো থেকেও নেই।
নবকুমার আর সুবর্ণ আজ কদিনই বাড়িছাড়া, দুপুরবেলা হঠাৎ মনটা বড় খালি-খালি লাগলো। নেহাৎ নাকি ফর্দ লেখার উন্মাদনায় মত্ত রয়েছে ক’দিন সত্য, তাই সুবর্ণর অনুপস্থিতিটাও সয়ে গেছে। নইলে সেই কথার রাজা মেয়েটা কাছে না থাকা সত্যর পক্ষে কম শূন্যতার নয়।
দশ দিন বলে গিয়ে বারো-তেরো দিন করছে নবকুমার। এদিকে বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। সব সময় মানুষটা দায়িত্বজ্ঞানহীন।
খুচরো কাজ আপাতত হাতে কিছু নেই। বিয়ের ভোজের সুপুরি কাটবার ভার নিয়েছে নিতাইয়ের বৌ, সদু বলেছে বড়ির ভার তার। এক মণ ডালের বড়ি সে দিচ্ছে রোজ কিছু কিছু করে। সলতে পাকাবে সদুর সতীন।
উৎসাহ সকলেরই।
তা ছাড়া বিয়ের কাজে সবাইয়ের সাহায্য নেওয়াই সামাজিকতা, না নেওয়াই নিন্দে। কনের বাড়ি খুব দূরে নয়। তাদের কাছ থেকেও নানা ব্যাপারে লোক আনাগোনা করছে, নমস্কারী শাড়ি কখানা দিতে হবে, ননদঝাপি কটা, এয়োডালায় কি কি দিতে হয় আপনাদের, এই সব নানা কথা।
নবকুমার কিনা এই সময় দেশে গিয়ে বসে রইল!
অভাববোধ এবং অভিমানবোধটা হঠাৎ চাড়া দিয়ে উঠে মনটা কেমন খা খা করে তুলেছে আজ। হঠাৎ খেয়াল হল–ছেলের ঘরটা সাজিয়ে ফেলি।
বারুইপুর থেকে ফিরে তো এই বাসা-বাড়িতেই বাস করতে হবে বৌ নিয়ে! বয়েসওলা মেয়ে, তাকে আর ঘরবসতের অপেক্ষায় এক বছরের মত বাপের বাড়ি রাখতে ইচ্ছে নেই সত্যর। আজকাল কলকাতায় পাড়াপড়শীদের মধ্যে একটা ব্যবস্থার চল দেখেছে সত্য- ধুলোপায়ে ঘরবসত!
অষ্টমঙ্গলার মধ্যে একবার বাপের বাড়ি ঘুরিয়ে এনে ফের বরকনেকে গাঁটছড়া বাঁধিয়ে দাঁড় করিয়ে বরণ করে তোলা হয়, তার নাম “ধুলোপায়ে ঘরবসত”। তাতে নাকি আর বছরের মধ্যে বৌ আনতে দোষ নেই।
সত্য এ ব্যবস্থাটি নেবে।
ছেলের তার বৌ-বৌ মন হয়েছে, এ বার্তাটুকু মনে মনে টের পেয়েছে সত্য।
বৌকে তাড়াতাড়িই আনতে হবে।
তা আজকে ঘরটাই বরং ঠিক করে ফেলা যাক।
দোতলায় দুখানা ঘর।
তার একটায় সাধন সরল দুই ভাই শোয়, আর একটায় সংসারের নানাবিধ জিনিস জমানো আছে। সত্য নীচের ঘরে শোয় একটা চৌকিতে সুবর্ণকে নিয়ে। আর একটা চৌকিতে নবকুমার।
যে বাসায় সুহাসকে নিয়ে থেকেছে, একতলা সেই বাসাটায় ঘর ছিল কম, জায়গা ছিল স্বল্প, নবকুমার বেচারী অনেক বঞ্চিত হয়েছে। এখনকার এ ব্যবস্থা সত্যরই। মানুষটার বয়েস হচ্ছে, রাতে একা পড়ে থাকবে? এক ঘটি জলও তো হাতে এগিয়ে দেবার কেউ থাকবে না একা থাকলে। ছেলেদের বারো মাস রাত জেগে লেখাপড়া, সে ঘরে নবকুমারের অসুবিধে। অতএব এই ব্যবস্থা। এখন আর এ ব্যবস্থা চলবে না।
এখন দোতলায় ওই জিনিসের ঘরটা খালি করে সুবর্ণকে নিয়ে সত্যকে আড্ডা গাড়তে হবে, সকলকে চালান করতে হবে নীচে নবকুমারের ঘরে। এ ছাড়া উপায় নেই। ছেলের বৌয়ের সামনে স্বামীর সঙ্গে এক ঘরে শোওয়াটা ভব্যতার আইনে বাধে। অন্তত সত্যর কাছে।
ছেলেদের ঘরটা সত্যর ভাল করেই সাজানো।
দেয়ালে দেয়ালে দেব-দেবীদের এবং মহাপুরুষদের ছবি, দেয়াল-আলমারিতে সারি সারি বই, এক কোণে পড়ার টেবিল, তার সামনে দুটি টুল, টেবিলে লেখাপড়ার সরঞ্জাম। বড় চওড়া চৌকিতে দুই ভায়ের বিছানা।
এ-ঘরের পরিবর্তন সাধন করতে করতে মনে মনে একটু হাসে সত্য, ব্রহ্মচারী এবার সংসারী হবেন! পাশে ভাইয়ের বদলে বৌ!…
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা রোমাঞ্চ জাগে সত্যর। নেহাৎ ছেলেমানুষের মত ভাবতে বসে, ওই লাজুক ছেলে না জানি কেমন করে বৌয়ের সঙ্গে ভাব করবে, কেমন করে বৌকে আদর করবে!
তারপর ভাবে, এই যে একটু বয়েস হয়ে বিয়ে হওয়া, এ কত সুন্দর! কী অদ্ভুত “কাল” ছিল সত্যদের! কনের বরের নামে গায়ে জ্বর, বরের বৌয়ের নামে কালঘাম। সত্য যখন ঘরবসতে এসেছে, তখন অবিশ্যি “ঘর-বর” পায় নি, কিন্তু যখন পেয়েছে, তখন মানসিক অবস্থা ওর থেকে উন্নত নয়। আর বিয়ে?
মানে জেনেছে তখন তার? ছি ছি! সে বিয়ে যেন ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে বড়দের পুতুল খেলার সাধ মেটানো!
মস্ত মস্ত এক লোভ দেখিয়ে রাখা হয়েছে, “গৌরীদান” “কন্যাদান” “পৃথিবীদান”! আর কিছুই নয়, মেয়েগুলোর চোখ-মুখ ফোঁটাবার আগেই হাড়িকাঠে গলা দিয়ে রেখে দেওয়া!
সত্যর মতন এত দজ্জাল আর কটা মেয়ে হয়?
ভয়ে জড়সড়, সর্বদা অপরাধিনী, এই তো অবস্থা সবাইয়ের!
আবার একটু হাসি ফুটে ওঠে সত্যর মুখে। নবকুমারের মত এমন তদগতপ্রাণ বর না হলে অবশি সত্য কি করতে পারত। সত্যে মনের অগোচর কিছু নেই, স্বামী সম্বন্ধে ভিতরে ভিতরে অনেক অবজ্ঞা আছে সত্যর, তবু হঠাৎ আজ এই গ্রীষ্মের দীর্ঘ দুপুরে খাঁ খাঁ করা মনে সেই অবজ্ঞার মানুষটার জন্যেই হঠাৎ আজ এই গ্রীষ্মের দীর্ঘ দুপুরে খাঁ খাঁ করা মনে সেই অবজ্ঞাত মানুষটার জন্যে হঠাৎ বড় বেশী মন-কেমন করে উঠল তার। নবকুমার বেচারাই কি সুখী হতে পেল? নিজেকে একটু অপরাধিনীই মনে হতে থাকলো।
সত্য যদি নেহাৎ সাধারণ একটা “সংসারসর্বস্ব” মেয়ে হত! বেচারা নবকুমারের জীবনটা অনেক বেশী সুখের হত তাতে আর সন্দেহ নেই।
এই তো আজই তো সত্য সেই বেচারার শেষ সুখটুকুও কাড়তে বসেছে। কিছু নয়, তবু এক ঘরেও তো থাকতো, দুটো গল্পগাছার সময়ই তো রাত্তির। সত্যর মনমেজাজ ভাল থাকলেই তো নবকুমারের আপিসের গল্প আর আপিসের বন্ধুদের গল্প চেগে ওঠে। সে সুখটুকু থেকে বঞ্চিত হবে এবার।
ছেলের বৌয়ের সামনে এক ঘরে বাসের নীতি যে দুর্নীতি এ কথা নবকুমারকে বোঝানো শক্ত। এলোকেশী তো স্বামীর মৃত্যুকাল পর্যন্ত ঘর আঁকড়ে থেকেছেন। সোনাটা চিরদিনই হাতছাড়া বলেই হয়তো আঁচলে গেরো দেওয়ার তত ঘটা ছিল।
অবিশ্যি দৃষ্টান্ত আরো অনেক আছে।
একা এলোকেশীকেই দোষ দিলে উচিত হবে কেন?
কাকার থেকে ভাইপো বড়, এ তো হামেশাই দেখা যায়। গিন্নীর কনিষ্ঠ পুত্তরটি পৌতুরদের কাঁথা কাজললতার প্রসাদে মানুষ হয়।…
হয় সত্য জানে। কিন্তু সত্যর তাতে বড় বিতৃষ্ণা।
তবু সত্য আজ নিজের বিছানাটা দোতলায় আনার কথা ভাবতে নবকুমারের জন্যে মন কেমন করে উঠছে। ….ছেলেপুলে কাছে কাছে থাকাই ভালো। তাতে মনে এসব পাগলামি চাগে না। সুবৰ্ণটা নেই বলেই বোধ করি এমন হু হু করে ভাব আসছে।
যে জন্যেই যা হোক বাক্সতোরঙ্গ টানটানি আর ভাল লাগল না। হাতের কাজ অসমাপ্ত রেখে জানলার ধারে এসে দাঁড়ালো সত্য।
ঝা-ঝ করা রোদে আকাশটা যেন ফাটছে, রাস্তার ধারের গাছটা, রাস্তার ওপারের বাড়িগুলো সেই দাহে যেন পুড়ে খাক হচ্ছে।… পাশের রাস্তাটা দিয়ে বোধ করি কোন বাসনওলা যাচ্ছে, ঢং ঢং কাঁসর পিটিয়ে, শব্দটা ক্ষীণ থেকে প্রখর এবং প্রখর থেকে ক্ষীণ হয়ে গেল।
দূরে কোথায় একটা গরুর গাড়ি চলেছে, তার চাকার ক্যাচ শব্দের সঙ্গে গরুর গলার ঘন্টিটা বেজে চলেছে একতালে।…
আরো দূরে কোথায় ঘুঘুর ডাক স্তব্ধ প্রকৃতির গায়ে করুণ আর্তনাদের ছুরি বিধোচ্ছে। ঘুঘুর ডাক কি কখনো শোনে নি সত্য? জীবনভোরই তো শুনছে।
তবে হঠাৎ কেন আজ ঘুঘুর ওই কান্নাটার মত কাঁদছে ইচ্ছে করছে সত্যর? কেন মনে হচ্ছে তার কেউ কোথাও নেই, চিরদিন সে একা, চিরদিন নিঃসঙ্গ। তার উপর কারো মায়া নেই, মমতা নেই, ভালোবাসা নেই। সেই স্নেহ-ভালবাসাহীন রুক্ষ মরুভূমির পথ ধরে একা সে চলছে আর চলছে!…
রোদের আঁচ আর আগুন ঝলসানো বাতাসের হলকা চোখেমুখে এসে লাগছে, তবু জানার বাইরের ওই দৃশ্যটা যেন নেশার বস্তুর মত আটকে রেখেছে সত্যকে। সে নেশার সঙ্গে মিশে রয়েছে একটা বিধুর বিষণ্ণ বেদনা।
এ বেদনা কেন?
এ শূন্যতা কিসের?
বিছানায় পড়ে অকারণ কান্নার মত অদ্ভুত একটা কবিত্ব করতে বসবে কি সত্য?
হয়তো তাই করতো, হয়তো করতো না, হঠাৎ চোখে পড়লো সদু আসছে রাস্তা দিয়ে ভিজে গামছা মাথায় চাপিয়ে, পায়ের তলা বাঁচাতে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে।…
একটা অশুভ আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল।
এ কী! হঠাৎ এমন সময়ে কেন?
চমকে উঠে নেশা কাটলো।
জানলা থেকে সরে এসে দ্রুত পায়ে নেমে এল সত্য।
আর নীচে আসতেই সদু শুকনো গলায় বলে উঠল, এই যে বৌ! ছেলেরা কেউ নেই?
সত্য মাথা নাড়লো, বসতে বলতে ভুলে গিয়ে।
সদু একটু ইতস্তত করে কাছের চৌকিটায় বসে পড়ে বলে ওঠে, একটা খবর আছে বৌ, বলছি। সব। আগে এক ঘটি জল দে দিকি।
ঢক ঢক করে এক ঘটি জল শেষ করে, থেমে জিরিয়ে–অগোছালো এলোমেলো করে সদু যা বললো তার সারমর্ম এই, সত্যকে বারুইপুরে যেতে হবে।
বারুইপুরে যেতে হবে?
সে তো জানেই সত্য, যাবেই তো! এই তো কদিন পরেই
না না, সেই কদিন পরের কথা পরে হবে, এখন এই দণ্ডে যাওয়া দরকার। আজ হলেই ভালো হত, তবে নাকি গাড়ি-পালকির ব্যবস্থা করতে কিছু-কিঞ্চিৎ সময় তো লাগবে। অতএব কাল। আগামীকাল, একেবারে ঊষাকালে। মুখুজ্যে মশাই দিচ্ছেন সবই ব্যবস্থা করে, শুধু সত্যর বড়ছেলে একবার তার সঙ্গে বেরোক।
খুব গুছিয়ে আর খুব হালকা করে বলতে চেষ্টা করে সদু, তবু কেমন যেন উল্টোপাল্টা লাগে কথাগুলো, আর সদুকে অদ্ভুত রকমের বোকা-বোকা দেখতে লাগে।
কী যেন রেখে-ঢেকে বলছে সদু, অথচ যেন উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ছে সেই গোপন করার চেষ্টা।
সদুর মুখচোখের যে বিবর্ণতা সে শুধু এই রোদ্দুরে হেঁটে আসার বিবর্ণতা? সদুর গলার স্বরে যে উত্তেজনার কাপন, সে কি শুধু সত্যকে অভয় দেবার ব্যাকুলতায়?
হ্যাঁ, বার বার অভয় দিচ্ছে সদু সত্যকে, ভয় করিস নে বৌ, ভয়ের কিছু নেই।
কিন্তু এই অভয় দানের মধ্যেই ভয়ের বাসার সন্ধান পাচ্ছে সত্য। তাই সত্যর বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেছে, হাত-পা বারকতক কেঁপে কেঁপে হঠাৎ বুঝি কাঁপবার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে অবশ হয়ে আসছে।
একবারও প্রশ্ন করে নি সত্য, শুধু বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে সদুর মুখের দিকে। সদু কি তরে আর রেখে-ঢেকে বলবে না? সহসা খুলে বলবে সব?
না, সে সাহস নেই সদুর।
সদু তাই শুধু ফাঁকা-ফাঁকা সাহসের কথাই বলছে, ভাবনা করিস নে বৌ, মন উচাটন করিস নে, গিয়ে সব ভালই দেখবি। আমিও তো যাচ্ছি তোর সঙ্গে।
.
সদুও যাচ্ছে সত্যর সঙ্গে!
আর তবে সন্দেহের কী আছে?
সর্বনাশের কালো ছায়াটা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে সত্য।
এতক্ষণে সত্যর কণ্ঠ থেকে স্থলিত হয়ে পড়ে একটা শব্দ।
ঠাকুরঝি!
এ স্বর সত্যর?
এ হালছাড়া স্বর?
এবার কি তবে সে তার হাতের হালখানা নামিয়ে রাখছে? যে হালখানাকে শক্ত মুঠোয় বাগিয়ে ধরে অনেক সমুদ্র ঠেলে এই এতখানি এল সত্য?
কিছুতেই হার মানবে না পণ করে এতদিন চলে এসে এইবার ভাগ্যের হাতে হার মানবে?
সত্য কি ভিতরে ভিতরে এত ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল?
সদু বলে, এই দেখ কাণ্ড! তুই যে একেবারে বসে পড়লি বৌ! তুই তো কখনও এমন নয়? কোনো কিছুতেই তো হেলিস না, দুলিস না। আজ হঠাৎ এত ঘাবড়াচ্ছিস কেন?
সত্য হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে।
নিজের এ অধঃপতনে লজ্জিত হয়। কিন্তু তবু শিথিল স্বরটাকে সামলাতে পারে না। তেমনি শিথিল স্বরেই বলে, কি জানি ঠাকুরঝি, হঠাৎ মনটা কেমন কু’ গাইছে, মনে হচ্ছে সব যেন ফুরিয়ে যেতে বসলো!
দুর্গা দুর্গা, ষাট ষাট।
সদু ব্যস্ত হয়ে ষাট বানায়, আমি তোকে বলছি বৌ, ভাল ভিন্ন মন্দ কিছু ঘটে নি। তবে অকস্মাৎ তলবটা কেন এল ভাল বুঝতে পারছি না!
হ্যাঁ, তলব এসেছে। বারুইপুর থেকে নাকি লোক এসেছে। এসেছে সদুর কাছে। শুধু এদের সবাইকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে বলেছে সদুকে। আজ বেরোতে পারলে আজ, না পারলে কাল যত ভোরে সম্ভব!
সত্য একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, পষ্ট কথা আমার মনই বলছে ঠাকুরঝি, মনে হচ্ছে যেন বিসর্জনের বাজনা শুনতে পাচ্ছি। সেবার ওর অত বড় অসুখেও এমন হয়নি আমার।
হ্যাঁ, মনের মধ্যে নবকুমারের কথাই তোলপাড় করে উঠছে সত্যর।
হয়তো ক্ষণপূর্বকালের সেই মন-কেমনটার সঙ্গে এক আকস্মিক সংবাদের একটা যোগসূত্র ধরা পড়েছে সত্যর মনের মধ্যে।
ধরা পড়েছে বুঝি নিজের মনের দুর্বলতাও।
নইলে নবকুমারের জন্যে যেবার সাহেব ডাক্তার ডেকে দেখিয়েছিল সত্য, সেদিনের কথাই বা হঠাৎ মনে পড়বে কেন? সেদিন যে নিশ্চিন্ত সর্বনাশ’ জেনেও লড়বার শক্তি সংগ্রহ করেছিল সত্য, সে কথাটা ভেবে আশ্চর্য লাগছে এখন তার।
যাক, বিসর্জনের বাজনা তবে সত্যিই বাজলো এবার। সত্যর তেজ আসপর্দা দাপট সব কিছুই যে সেই মেরুদণ্ডহীন মানুষটাকে মেরুদণ্ড করে, এ কথা কি এখন টের পেল সত্য? যখন মানুষটা
ঠাকুরঝি, চলে যাচ্ছ তুমি?
সত্য ব্যাকুলভাবে সদুর হাত ধরে।
সদু বিচলিত হয়।
সদু এই ভয়ানক একটা অমঙ্গল আশঙ্কায় কণ্টকিত মানুষটাকে কি ওই ভয়ঙ্কর মানসিক অবস্থা থেকে উদ্ধার করবে? বলবে–
না, বেশী কিছু বলে না সদু। শুধু সত্যর হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যস্তভাবে বলে, কেন অমন উতলা হচ্ছিস বৌ, আমি বলছি নবু ভাল আছে, মঙ্গলে আছে– বলতে বলতেই দাওয়া ছেড়ে উঠোনে নামে সদু। বলে, যাই, আমারও তো যাত্রার গোছগাছ আছে একটু-তুইও যেমন পারিস গুছিয়ে নে। তুড়ু ফিরলেই আমার ওখানে পাঠিয়ে দিস।
সদু যেন একপ্রকার পালিয়েই যায়।
আর সত্য সদুর সেই যাওয়ার পথের দিকে নিথর হয়ে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
এবার নবকুমারকে ছেড়ে আর এক আশঙ্কা বুকটাকে করাত দিয়ে কাটছে। সদুর শেষ কথাটা কানে বাজছে… নবু ভাল আছে। মঙ্গলে আছে…
তবে?
কে তবে মঙ্গলে নেই?
‘সুবর্ণ’ নামটা মনে আনতেও মন শিউরে উঠছে। তবু মনের চিন্তা কে ঠেকাতে পারে?…. শতবার সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করলেও যে সেই ঠেলে রাখা দুশ্চিন্তাকে সহস্রবার ডেকে আনে মন।
এবার বোঝা গেছে।
সুবৰ্ণর ভয়ানক একটা কিছু হয়েছে, খুলে বলল না সদু!
কী সেই ভয়ানক?
খুব মারাত্মক কোনো অসুখ?
নাকি একেবারেই চরম দণ্ড দিয়ে দিয়েছেন ভগবান?
সুবর্ণ সুবর্ণ নামটা সত্যর জীবন থেকে মুছে যাবে?
বিসর্জনের বাজনাটা সত্যিই বুঝি বাজতে থাকে সত্যর প্রতিটি রক্তকণিকায়।
তবু কিছু গোছ করতেই হয়।
ছেলেরা এলে বলতেও হয় সদুর বার্তা।
এবং তারা যখন পিসিমার বাড়ি ঘুরে এস জানায় গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেছে, ঘোড়ার গাড়ি এবং গোরুর গাড়ির সাহায্যে ঘণ্টা কতকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যাবে, তখন তাদের মুখের দিকে তাকাতে সাহস করে না সত্য।
কিন্তু শুধুই কি সত্য?
হঠাৎ উতলা হয়ে যাওয়া, হাল ছেড়ে দেওয়া সত্য?
সত্যর ছেলেরাই কি মুখ দেখাতে সাহস করছে মাকে? তাদের সেই ভয়-খাওয়া কালিমাড়া শুকনো মুখ?
বাড়ি চাবি দিয়ে যেতেই হবে। ঘরে ঘরে চাবিগুলো লাগাতে থাকে সত্য, আর ওর মনে হতে থাকে, তার জীবনের সমস্ত দরজাগুলোও বুঝি বন্ধ করে ফেলছে সে।
এই বন্ধ দরজাগুলো খুলে খুলে আর যেন সংসার করবে না সত্য।
.
সত্যর বড়ছেলের বিয়ে না ক’দিন পরে?
সে বিয়ে কি সত্য দেখবে?
হবে কি সে বিয়ে?
সব যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে…অলীক মনে হচ্ছে।
গতকালই যে সকালে নিতাইয়ের বৌয়ের কাছ থেকে আসা কাটা সুপুরির গাদা বেতের ঝাপিতে ঢালতে ঢালতে আহ্লাদে উৎফুল্ল হয়েছে সত্য, সুপুরিগুলো দিব্যি সরু সরু কুচনো হয়েছে বলে, সে কথা কি কিছুতেই এখন বিশ্বাস করতে পারা যাবে?
অকারণে কী এমন হয়?
হয় না।
মন আগে থেকে টের পায়।
আর যদি অকারণেই হবে, ওরা এমন স্তব্ধ কেন? গাড়িতে যারা চলেছে সঙ্গে?
সাধন, সরল, সদু?
অন্য যে কোনো দিন হলে নিশ্চয় সত্য ওদের ওই স্তব্ধতা ভাঙিয়ে ছাড়তো। দৃঢ় গলায় বলতো, অত লুকোছাপা করে লাভ নেই, যা হয়েছে তা তো জানতেই পাচ্ছি, বেঁধে মেরে দরকার কি? যা হয়েছে শুনবো, শুনতে প্রস্তুত হচ্ছি–
কিন্তু আজ পারছে না।
কাল দুপুর থেকে সত্যর মনটা অকারণেই হঠাৎ বিকল হয়ে গেছে।
.
নির্দিষ্ট জায়গায় ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে গরুর গাড়িতে উঠতে হল। আর উঠে বসার পর সদু একবারে স্তব্ধতা ভাঙলো। সত্যকে উদ্দেশ্য করে নয়, ছেলেদের উদ্দেশ করে বলে উঠলো, তোদের পিসেমশাইয়ের আসার ইচ্ছে ছিল, শুধু এই গো-গাড়ির ভয়ে পিছিয়ে গেলেন। বয়েস হয়েছে তো! আর চিরটাকাল কলকাতায়
শেষের কথাগুলো শুনতে পায় না সত্য।
শুধু কানে বেজে উঠেছে ‘ইচ্ছে ছিল’!
ইচ্ছে ছিল মানে কি? কর্তব্য ছিল নয়, ইচ্ছে।
কোন্ দৃশ্যের মুখোমুখি হবার ইচ্ছে হচ্ছিল আয়েসী আত্মসুখী লোকটার?
নীরবতাই ভীতিকর।
কথাই সাহসের জন্মদাতা।
কথার পর তাই আবার কথা কইতে পারছে সদু, তাছাড়া বললেন, কদিন পরেই যেকালে তুড়ুর বিয়েতে যাচ্ছি, তখন পালকিতে যাবো এ পথটা-
তুড়ুর বিয়েতে যাচ্ছে!
কদিন পরে তুড়ুর বিয়েতে যাচ্ছি!
ওরা তা হলে সে আশা পোষণ করছে এখনও? তুড়ুর বিয়ে যথাদিনে হবে, লোকজন সবাই যাবে নেমন্তন্নে?
সত্য এবার যেন একটু লজ্জিত হয়।
সত্য একটু বেশী বিচলিত হয়ে পড়েছে। আর সেই বিচলিত ভাবটা ধরা পড়িয়ে ফেলেছে। সবাইয়ের কাছে। ছি ছি, কী লজ্জা!
হয়তো সামান্য কিছু অসুখবিসুখ করেছে সুবর্ণর। যে লোকটা খবর দিতে এসেছিল সেই লোকটাই বোকা হাঁদা, কি বলতে কি বলেছে!
তাই সত্য এবার কথা বলে।
বলে, তুমি চলে এলে, ঠাকুরজামাইয়ের একটু অসুবিধে হল—
হঠাৎ সদুর মুখে একটা হাসির আলো খেলে যায়। হাসতেও পারছে তা হলে সদু?
তা পারছে।
মুচকি হেসে বলছে, তা যা বলেছিস! এখন এমন হয়েছে, উঠতে বসতে এই সদু বামনী! তাই তো বলে এলাম, এই ক’বছরেই এত! চিরটাকাল তো আমি বিহনে কাটলো! তা উত্তুর হল, আর সম্পর্কটা যে জন্ম-জন্মান্তর কালের। মাঝের ওই কটা দিনের ভুলভ্রান্তির জন্যে কি আর সে বাঁধন ঢিলে হবে?
সদুর ওই হাসি দেখে সত্যরও বুঝি বুকের বল বাড়ে। তাই সত্যও প্রায় হাসির মত করে বলে, সম্পর্ক যদি জন্ম-জন্তান্তরের, তা হলে তো স্বর্গে গিয়েও তোমার সতীন-জ্বালা ঠাকুরঝি…! তার সঙ্গেও তাহলে জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধন! কে জানে সেখানে গিয়ে অন্য কোনো জন্মের স্বর্গলাভ হওয়া আরো চারটি সতীন এসে কাড়াকাড়ি লাগাবে কিনা!
প্রায় হেসেই ফেলল সত্য।
জন্ম-জন্মান্তর শব্দটাকে কী এমন কৌতুকের খোরাক পেল সে?