জগতের সমস্ত বিস্ময়কে কি একটিমাত্র প্রশ্নের মধ্যে প্রকাশ করা যায়? সেই একটি প্রশ্নের মধ্যেই ধিক্কার দেওয়া যায় জগতের সর্বাপেক্ষা অসহনীয় ধৃষ্টতাকে?
আরো কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব কিনা জানি না, কিন্তু দেখা গেল অন্তত একজনের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে!
বারুইপুরে বায্যে-গিন্নীর একটিমাত্র ছোট্ট প্রশ্নে ধ্বনিত হল বিশ্বের সমস্ত বিস্ময় আর সমস্ত ধিক্কার-বাণী।
পাঠাল না!
না।
পথশ্রান্ত নাপিত-বৌ শুধু এই একটি শব্দ উচ্চারণ করে পা ছড়িয়ে বসল।
প্রথম বড় ঢেউয়ের পরবর্তী আর একটি ছোট ঢেউ।
তুই হার মেনে ফিরে এলি?
এবার বিস্ময় আর ধিক্কারের পালা নাপিত-বৌয়ের, শোনো কথা! তাদের মেয়ে, তারা পাঠালে না, আমি কি তাদের ঘর থেকে মেয়ে কেড়ে নিয়ে আসব?
এবার বাড়ূয্যে-গিন্নী নিজেই পা ছড়িয়ে বসলেন, দুই ভ্রূ এক জায়গায় এনে জড়ো করার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ছুতোটা কী দেখাল?
শোনো কথা! ছুতো আবার কিসের, সোজাসুজি মুখের ওপর ঝাড়া জবাব, এখন পাঠাব না।
নাপিত-বৌ আঁচল খুলে পানের কৌটো বার করে।
এক্ষুনি মুখে পান ভরিস নে নাপিত-বৌ, চোদ্দবার উঠবি পিক ফেলতে। আমার কথাগুলোর আগে উত্তর দে। বলি ছুতো যুক্তি কিছু না–শুধু পাঠাব না?
এখন পাঠাব না।
তা কখন পাঠাবেন? আমার ছেরাদ্দর সময়? আমি যে ভেবে থই পাচ্ছি না রে নাপিত-বৌ, মেয়ের বাপের এত বড় বুকের পাটা! পৃথিবীতে এখনও চন্দ্র-সূর্য্যি উঠছে, না থেমে গেছে? এ কথা ভেবে বুক কাপল না যে, তোর মেয়েকে যদি ত্যাগ দিই!
নাপিত-বৌ নিষেধ অগ্রাহ্য করে মুখে পান-দোক্তা পুরে বলে, বুক কাঁপবে! হুঁ! একটা কেন একশটা মেয়েকে ঘরে ঠাই দেবার, ভাত কাপড় দে’ পোষবার ক্ষমতা তাদের আছে। লক্ষ্মীমন্তর ঘর বটে।
খুব বুঝি গিলিয়েছে! বড়য্যে-গিন্নী দুরন্ত ক্রোধকে পরিহাসের ছদ্মবেশ পরিয়ে আসরে নামান, তাই বেয়াইবাড়ির লক্ষ্মীর ঘটায় চোখ ঝলসেছে! বলি ঘরে ভাত থাকলেই মেয়ের শ্বশুরবাড়ির আশ্রয় ঘোচাতে হবে? এত বড় আস্পদ্দার পর আর ওদের মেয়ে আনব আমি?
খাওয়ার কথা তুলে খোটা দিও না বামুন-বৌদি, তোমাদের আশীর্বাদে নাপিত-বৌয়ের অমন খাওয়া ঢের জোটে। তবে হ্যাঁ, নজর আছে বটে। শুধু পয়সা থাকলেই হয় না, নজর থাকা চাই।
কথাটা অর্থবহ এবং সে অর্থ বড়য্যে-গিন্নির অন্তরে ছুঁচের মত গিয়ে বেঁধে, তবু তিনি নিজেকে সংযত করে বলেন, তা নজরের পরিচয় কি দেখাল? বিশ ভরির চন্দরহার গড়িয়ে দিয়েছে তোকে, নাকি পঁচিশ ভরির গোট?
উপহাস্যির কিছু নেই, যা অনেয্য তা বললে চলবে কেন? একজোড়া ফরাসড্যাঙার থান, একখানা কেটে ধুতি আর নগদ পাঁচ টাকা কে দেয় গা কুটুমবাড়ির লোককে?
দেবে না কেন, যারা মেয়ে ঘরে আটকে রেখে দিতে চায়, তারা ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করে কুটুমের লোকের। নইলে তুই তাদের যাচ্ছেতাই শুনিয়ে দিয়ে না এসে সুখ্যেত করছিস বসে বসে! তোর ওপর আমার ভরসা ছিল, এ তল্লাটে তোর মতন মুখ তো কারুর দেখি না, আর তুই-ই ডোবালি? বাঘিনী হয়ে মেড়া বনে এলি?
কী যে তকরার করো বামুন-বৌদি, মেয়ের বাপ নিজে তফাতে দাঁড়িয়ে গিন্নীকে বলে দিল, মা, কুটুমবাড়ির মেয়েকে বলে দাও, বিয়ের সময় কথা হয়েছিল মেয়ের কুমারীকাল পুন্ন না হলে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে না, সে কথা তারা হয়ত বিস্মরণ হয়ে গেছেন, আমি তো হই নি। সময় হলে যাবে বৈকি!
বড়য্যে-গিন্নী বিবাহকালের শর্ত উল্লেখে ধেই ধেই করে ওঠেন, কী বললি নাপিত-বৌ, বিয়ের কালের শত্ত-সাবুদের কথা তুলেছে? কথা অমন কত হয়–বলে লাখ কথা নইলে বিয়ে হয় না–বলি তাদের চরণে খত লিখে দিয়েছিল কেউ? আমার ঘরের বৌ আমার যদি আনতে ইচ্ছে হয়! আচ্ছা আমিও দেখছি কত তাদের আস্পদ্দা, কত তাদের তেজ! মেয়েকে শুধু ভাত-কাপড় দিলেই যদি সব মিটে যেত, তা হলে আর কেউ তাকে বিয়ে দিয়ে পরগোত্তর করে দিত না, বুঝলি নাপিত-বৌ? আসছে মাসেই বেটার আবার বিয়ে দেব আমি, এই তোকে বলে রাখলাম।
নাপিত-বৌ নিমকহারাম নয়। অনেক খেয়ে অনেক পেয়ে এসেছে, তাই বেজার মুখে বলে, সে তোমাদের কথা তোমরা বুঝবে, বেয়াই তো পত্তর লিখে দিয়েছে বামুনদাদার নামে, ন্যাও রাখো।
তুই যে তাজ্জব করলি নাপিত-বৌ, এই কদিনে তোকে তুক করল না গুণ করল লো! তাই ঘরশত্তুর বিভীষণ হলি! কেবল ওদের কোলে ঝোল টেনে কথা বলছিস! কই, পত্তর কোথা?
এই যে। নাপিত-বৌ নিজের গামছাটার পুঁটলির গিট খোলে।
বড়য্যে-গিন্নীর অবশ্য তৎপরতার অভাব নেই, তিনিও সঙ্গে সঙ্গে পুঁটলির মধ্যে শ্যেনদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, কই, বড়মানুষ কুটুম কী দিয়েছে দেখি!
একটি ছেঁড়া ন্যাকড়ার পুঁটলি খুলে একখানি দোমড়ানো মোচড়ানো চিঠি বার করে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে নাপিত-বৌ প্রাপ্ত সম্পদ দেখায়, এই কেটে, এই কাপড়ের জোড়া, এই গামছা, আর-
ও বাবা, আবার নতুন ঘটি কাঁসি দিয়েছে যে দেখছি! বড়য্যে-গিন্নী বলেন, সাধে কি আর বলছি ঘুষ দিয়েছে! তা নাকুর বদলে নরুণ নিয়ে ফিরলি তুই! কাসিখানা তো দেখছি ভারী পাথরকুচি!
তা ভারী আছে। আর কথাবার্তাও ভাল। বাড়িসুদ্ধ গিন্নীরা যেন আমায় হাতে রাখে কি মাথায় রাখে! সে তুমি যাই বলো বামুন-বৌদি, কুটুম তোমার খুব ভাল হয়েছে। অমন কুটুমের সঙ্গে অসসরস করলে তুমিই ঠকবে। তবে গিয়ে বৌ তোমার মিছে বলব না, একটু বাচাল।
বাচাল!
সহসা যেন পাথরে পরিণত হলেন বাঁড়ুয্যে-গিন্নী।
বাচাল! আর সে কথা এতক্ষণ বলছিস না তুই? হবেই তো, বাচাল হবে না? বাপের চালচলন তো বুঝতেই পারছি, পয়সার গরমে ধরাকে সরা দেখেন, মেয়েকে আসকারা দিয়ে ধিঙ্গী অবতার করে তুলেছেন আর কি! আমিও এলোকেশী বামনী, বাচাল বৌকে কেমন করে ঢিট করতে হয় তা আমার জানা আছে!
তা আর জানা থাকবে না? ঠোঁটকাটা নাপিত-বৌ বলে বসে, আরও একটা মানুষের মেয়েকে ঘরে পুরে কী হালে রেখেছ তা তো আর কারু অজানা নেই। তা এই বৌকে আর তুমি ঢিট করছ কখন, বেটার তো আবার বে দিচ্ছ!
নাপিত-বৌয়ের কথায় এবার একটু ভয় খান বাঁড়ুয্যে-গিন্নী এলোকেশী। ও যা মুখফোড়, পাড়ায় পাড়ায় সমস্ত রটিয়ে বেড়াবে, হাটে হাঁড়ি ভাঙবে। বড়য্যের বৌ আনতে পাঠিয়েছিল, বড়মানুষ বেহাই মেয়ে পাঠায় নি, এ খবর রাষ্ট্র হলে কি আর মাথা হেঁট হবার কিছু বাকী থাকবে? নাপিতবৌকে চটানেটো ঠিক হয়নি চটায় না ওকে কেউ, চটাতে সাহসই করে না। সকলের হাড়ির খবর রাখে, সকল ঘরে যাতায়াত করে, আর সময়-অসময়ে নাপিত-বৌয়ের শরণ না নিলে কারুর চলে না। যেমন তেজী তেমনি বিশ্বাসী, আর তেমনি জোরমন্ত ডাকাবুকো। একটা মদ্দজোয়ানের ধাকা ধরে নাপিত-বৌ। বৌ মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বাপেরবাড়ি করতে নাপিত-বৌ এ গ্রামের ভরসাস্থল। চৈতন্য হয় সেটা এবার, তাই আর একবার সেঁতো হাসি হাসেন বাঁড়ুয্যে গিন্নী, তবে আর কি, যা দেশ-রাজ্যে রাষ্ট্র করে আয়, আমি আবার বিয়ে দিচ্ছি বেটার! মরণ আর কি, গা জ্বলে যায়! কিন্তু তুই-ই বল, রাগে মাথায় রক্ত চড়ে ওঠে কিনা। যাক বিশদ বৃত্তান্ত বল্ দিকি, তুই কি বললি, তারা বলল, মেয়েই বা–
সাতকাণ্ড রামায়ণ গাইবার সময় এখন আমার নেই বামুন-বৌদি, দু দিন দু রাত পায়ের ওপর, সব্বাঙ্গ যেন ভেঙে আসছে। ঘরে যাই এখন।
ঘরে আর যাবি কেন, বাঁড়ুয্যে-গিনী নিষ্প্রভ ভাবে বলেন, এখানেই নয় দুটো।
না বাবা, ওতে আর দরকার নেই। কথায় বলে ভাইয়ের ভাত ভেজের হাত। ঘরে গে দু-দুও জিরোই, তারপর বোঝা যাবে।
আরো নরম হতে হয়, আরো তোয়াজ করতে হয়। শক্তের ভক্ত পৃথিবী।
হ্যাঁলা, তা মাথায় বিষবাণ বিধে রেখে দিলি, উদ্ধার কর! মেয়ে কি বলল তাই বল্? তুই কুটুমের বাড়ি থেকে গিয়েছিস, তোর সামনে কি বাচালতা করল?
করল কি আর গাছে চড়ল? তা নয়। তবে ঠাকুরমাদের সঙ্গে খুব হাত মুখ নেড়ে বক্তিমে করছিল দেখছিলাম। গিন্নীরা বলছিল, কুটুম চটানো ঠিক নয়, তোমার বেয়াইয়ের দুর্বুদ্ধির নিন্দে করছিল, তা দেখি ঘরের মধ্যে ঝাঁজ দেখাচ্ছে, বাবার কথার ওপর কথা! বাবার চাইতে তোমাদের বুদ্ধি বেশী! বে’র সময় যদি কথা হয়ে গেছল বারো বছর বয়েস না হলে তারা বৌ নিয়ে যাবে না তো নিতে পাঠায় কোন্ আইনে, এই সব!
কিন্তু বাঁড়ুয্যে-গিন্নীর তখন আর বাকস্ফূর্তির ক্ষমতা নেই। পুত্রবধূর বাকবিন্যাস-প্রণালীর সংবাদে সে ক্ষমতা লোপ পেয়েছে তার।
কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে থেকে সনিঃশ্বাসে বলেন, হ্যাঁলা বৌ, তুই তো আমাকে খুব উপহাস্যি করলি বেটার আবার বে দেব বলেছি বলে, তা তুই-ই নিজে মুখে স্বীকার কর, এ বৌ নিয়ে ঘর করা যাবে? বাবার জন্মে তো এমন কথা শুনি নি নাপিত-বৌ যে শ্বশুরঘরে যাওয়ার কথা নিয়ে ঘরবসতের বৌ কথা কয়, চিপটেন কাটে!
বাপের একটা তো, একটু বাপসোহাগী আছে। তা ও দোষ কি আর থাকবে? আপনিই যাবে। কথাতেই তো আছে গো–হলুদ জব্দ শিলে, চোর জব্দ কিলে, আর দুষ্ট মেয়ে জব্দ হয় শ্বশুরবাড়ি গেলে!
জানি নে মা, আমার তো ভয়ে পেটের মধ্যে হাত-পা সেঁদিয়ে যাচ্ছে। বুড়ো বয়সে বেটার বৌয়ের হাতে কি খোয়ার আছে তা জানি না। আবার বে দেব আর কোথা থেকে! তোর বামুনদাদা যে বেয়াইয়ের বিষয়-সম্পত্তির ওপর ট্র্যাক করে বসে আছে। বলে বাপের একটা মেয়ে, বাপ চোখ বুজলে সব মেয়ে-জামাইয়ের।
শোন কথা! এবার গালে হাতের পালা নাপিত-বৌয়ের, ওই বিরিঙ্গির গুষ্টি, অমন সব সোনারচাঁদ ভাইপো রয়েছে, তারা পাবে না? তা ছাড়া ভাগভেন্ন তো নয়!
তা জানি নে বাপু, কত্তা বলে তাই শুনি। বলে বাপটা একবার চোখ বুজলে হয়!
কার চোখ আগে বোজে, কে কার বিষয় খায়, কে বলতে পারে বামুন-বৌদি! বেয়াইয়ের তো তোমার সোনার গৌরাঙ্গর মতন চেহারা, এখনো বে দিলে বে দেওয়া যায়! যাক গে বাবা, তোমাদের কথা তোমরা বোঝ, যাই, উঠি। বামুনদাদাকে পত্তরখানা দিও।
নাপিত বৌ উঠতে যায়, আর সেই মুহূর্তেই বামুনদাদার আগমনবার্তা ঘোষণা করে খড়মের খট খট।
এ কী, নাপিত-বৌ ফিরে এলি যে!
প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের উঠোন থেকে ভিতর-উঠোনে পা ফেলেন বাড়ূয্যে।
ফিরে না এসে অকারণ আর কতদিন কুটুমের অন্ন ধ্বংসাব! অবিশ্যি তারা অনেক বলেছিল আর দশদিন থেকে
তা তুই গিয়েছিলি কি করতে? বৌ কই?
পাঠাল না।
বজ্রনির্ঘোষ ধ্বনিত হয় গৃহিণীর কণ্ঠ হতে।
পাঠাল না।
আর একবার প্রমাণিত হল, একটি প্রশ্নের মধ্যেই জগতের সমস্ত বিস্ময় প্রকাশ করা সম্ভব হল।
ছেলেকে খেতে বসিয়ে কথাটা পাড়লেন এলোকেশী। নাপিত-বৌ-নিষিক্ত অগ্নিধারা শরীরের মধ্যে পরিপাক করতে করতে বেগুনেরঙা হয়ে উঠেছিলেন তিনি, তাই ভাতের থালাটা ছেলের পাতের গোড়ায় ধরে দিয়ে যখন পিদ্দিমের সলতেটা একটু বাড়িয়ে পা ছড়িয়ে বসলেন, মায়ের ভীষণাকৃতি মুখ দেখে বুকটা কেঁপে উঠল নবকুমারের।
নবকুমারের বয়স আঠারো-উনিশ হলেও মায়ের কাছে সে দুগ্ধপোষ্যের সমগোত্র। আর মা এবং যম তার মনের জগতে সমতুল্য। মা যখন মুখ ছোটায়, তখন ভয়ে নবকুমারের হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে যায়। যার উদ্দেশেই সেই বহ্নিস্রোত প্রবাহিত হোক, নবকুমার ভয়ে কাঁপে।
আজকের গালিগালাজের স্রোতটা আবার নবকুমারেরই শ্বশুরবাড়িকে কেন্দ্র করে, কাজেই খাওয়া আর হয় না বেচারার। ভয়ে লজ্জায় ঘাড়টা নিচু হতে হতে প্রায় থালার সঙ্গে ঠেকে আসে।
নাপিত-বৌ কুটুমবাড়ি যাওয়া পর্যন্ত মনের মধ্যে একটি পুলকের গুঞ্জরণ বইছিল নবকুমারের, ছড়ানো ছিটানো কথায় শুনতে পাচ্ছিল এলোকেশী নাকি বৌকে আনতে পাঠিয়েছেন।
কেমন সেই বৌ, কি তার নাম, কি রকম দেখতে, এসব লজ্জাকর চিন্তাকে কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছিল না নবকুমার। শয়নে স্বপনে একটি মুখচ্ছবি আবছা আবছা ছায়া ফেলে বাড়ির এখানে সেখানে এলোকেশীর কাছে কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ঘোমটা টেনে টেনে।
শোবার ঘরে? অনবগুণ্ঠনে?
ওরে বাবা, অত দুঃসাহসী কল্পনার সাহস নবকুমারের নেই। সে ভাবনার ধারে-কাছে গেলেই বুক গুরগুর করে ওঠে তার। মার সামনে দাঁড়ালে তো কথাই নেই, আশঙ্কা হয় ছেলের মনের ভিতরটা কাঁচদীঘির জলের ভিতরটার মতই দেখতে পাচ্ছেন এলোকেশী।
না, শোবার ঘরের এলাকায় কি নিজের ধারে-কাছে বৌয়ের উপস্থিতির অবস্থা চিন্তা করে না নবকুমার, করে শুধুই মায়ের ধারে-কাছেই।
নাপিত-বৌয়ের অভিযান কার্যকরী হবে না, এরকম অবিশ্বাস্য দুর্ঘটনার কথা তার স্বপ্নেও মনে আসে নি, তাই এই কদিন প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ভবতোষ মাস্টারের কাছে ইংরেজি পড়া পড়ে বাড়ি ফিরে উৎকর্ণ হয়ে থাকে একটি মৃদু ঝুনঝুন মলের শব্দের আশায়।
কিন্তু কই?
ক’দিনের কড়ারে গেছে নাপিত-বৌ, সে খবর নবকুমারের জানবার কথা নয়, তবু আশা করছিল পূজোর আগে অবশ্যই। আর পূজোর উৎসবের সঙ্গে হৃদয়ের আর এক উৎসবকে যুক্ত করে নিয়ে অবিরত বিহ্বল হচ্ছিল সে।
পূজো আসছে!
বৌ আসছে!
পূজোটা জানা, কিন্তু না-জানি কেমন সে বৌ।
বিয়ে হয়েছিল পনেরো পার হয়ে, এমন কিছু অজ্ঞানের বয়সে নয়, তবু লাজুক-প্রকৃতি নবকুমার বিয়ের কোন অনুষ্ঠানের সময়ই একটু চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেও কনে বৌকে দেখে নেবার চেষ্টা করে নি। এখন যদি কেউ বদলে অন্য মেয়ে গছিয়ে দেয়, ধরার সাধ্য হবে না নবকুমারের।
এমন কি এই কদিন ধরে শত চেষ্টাতেও বৌয়ের নামটা মনে আনতে পারছে না সে। এতদিন অবশ্য মনে আনবার খেয়ালও হয় নি, নাপিত-বৌয়ের অভিযানই সহসা নবকুমারকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে কৈশোর থেকে যৌবনের ধাপে।
বিয়ের সময় সম্প্রদানকালে নামটা তো দু-একবার উচ্চারিত হয়েছিল মনে হচ্ছে, কিন্তু কে তখন ভেবেছে এই নামটা মনে রাখবার দায়িত্ব তার! নবকুমার তো তখন অবিরাম ঘামছে!
ওই ঘামটাই মনে আছে, নাম-টাম নয়।
একে তো বিয়ের বর, তা ছাড়া শ্বশুরের সেই দৃপ্ত উন্নত চেহারা, গম্ভীর স্বর আর রাশভারী ভাব। সেটাও সেই ভয়কে বাড়িয়ে দেওয়ার সহায়তা করেছিল।
তা ছাড়া বাসরঘরে আরও কত রকম ভয়।
সে ভয় এখনও বুঝি একটু একটু আছে। কিন্তু বৌ শব্দটি মিষ্টি। ভয়ের মধ্যেও রোমাঞ্চ।
কও
না কথা মুখ তুলে বৌ,
দেখ না চেয়ে চোখ খুলে!
মনের মধ্যে বাজছে সুর আর শব্দ। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বৌয়ের আসন্ন আবির্ভাব নিয়ে আলোচ• করবার ক্ষমতাও নেই নবকুমারের। পাড়ার বন্ধু যারা খবরটা শুনেছিল তারা যদি একটু-আধটু ঠাট্টা করছে, “ধেৎ, ধেৎ” ছাড়া আর কোনও উত্তর দিতে পারছে না সে।
অথচ যখন ভবতোষ মাস্টারের কাছ থেকে পড়া সেরে সন্ধ্যায় কাঁচদীঘির নির্জন পাড় দিয়ে বাড়ি ফিরেছে তখন অনুচ্চারিত শব্দে বার বার ফিরিয়ে ফিরিয়ে গেয়েছে–
এনেছি
বকুলমালা, করবে আলা
তেল-চোয়ানো তোর চুল!
… …
মিশি দাঁতের হাসিটি বেশ,
মুখখানি বেশ ঢলঢলে!
তারপর কি? তাই তো! মুখখানি বেশ ঢলঢলে, মুখখানি বেশ-পরের লাইনটা কিছুতেই মনে পড়ে না, কোথা থেকে যে শিখেছিল তাও মনে পড়ে না। তবু ওই অসমাপ্ত গানটাই অপূর্ব সুরে গুঞ্জরিত হতে থাকে সমস্ত রাস্তাটা।
ক’দিনের প্রত্যাশার পর আজ বাড়ি ফিরে এলোকেশীর প্রদত্ত সমাচারে বুকটা ছলাৎ করে উঠল। আর সেই বিয়ের দিনের মত ঘাম ছুটে গেল মুহূর্তের মধ্যে।
নাপিত-বৌ এসেছে শুনেছিস? বলে উঠলেন এলোকেশী।
বাঘিনীর মত বসেছিলেন দাওয়ার ধারে। ছেলে এসে পা-টা হাতটা ধোবে, এটুকু সময়ও দেরি সইল না তার। দিয়ে বসলেন সংবাদ। অন্ধকারেই বলে বসলেন, আলোটাও আনলেন না ছেলের সামনে।
নবকুমারের কাছে অবশ্য এ সংবাদ অন্য অর্থ বহন করে এনেছে, তাই তার চিত্তে বিহ্বলতা তাই মার বর্তমান অবস্থা ধরতে পারল না সে। ধরতে পারল না কণ্ঠস্বরের ভীষণতাও। তাই না-জানা একটা সুখে শিউরে উঠল।
কিন্তু কতক্ষণের জন্যেই বা!
ক্ষণকালের মধ্যেই নিষ্ঠুর সত্য প্রকাশিত হল।
মান্যগণ্য বেহাইয়ের উদ্দেশে ‘ছোটলোক’, ‘চামার’, আসপদ্দাবাজ’ ইত্যাদি শোভন-সুন্দর বিশেষণমালা প্রয়োগ করে এলোকেশী জানালেন, “মেয়ে পাঠাল না।”
মেয়ে পাঠাল না!
এ কি অদ্ভুত বাণী!
মেয়ে না পাঠানো যে সম্ভব, সে কথা তো একবার মনের কোণেও আসে নি নবকুমারের!
কিন্তু এ কথায় আর কি কথা কইবে নবকুমার! আর উত্তরের প্রত্যাশা করেও কথা বলেন নি এলোকেশী।
আরও খানিকক্ষণ ধরে বেয়াইয়ের পয়সার গরম তুলে, নাপিত-বৌকে ঘুষ দিয়ে হাত করার বার্তা জানিয়ে, অবশেষে হঠাৎ আবিষ্কার করলেন এলোকেশী, ছেলেটা সেই অবধি উঠোনেই দাঁড়িয়ে আছে কাঠ হয়ে।
মাতৃস্নেহ জেগে উঠল।
আর দাঁড়িয়ে থেকে কি করবি, হাত-মুখ ধো! বলে এলোকেশী উচ্চগ্রামে চিৎকার করলেন, ভাত নেমেছে সদু?
রান্নাঘর থেকে সাড়া এল, নেমেছে মামীমা।
আয় মুখ ধুয়ে, ভাত দিই। বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন এলোকেশী। আর নবকুমার আস্তে আস্তে গায়ের কোটটা খুলে দেয়ালে লাগানো একটা গজালে টাঙিয়ে রেখে চলে গেল খিড়কির পুকুরের দিকে।
হঠাৎ মনটা কেমন শিথিল আর ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে। যা ছিল না, কোন দিনই যার স্বাদ জোটে নি, তেমন জিনিস হারালেও এমন শূন্যতা বোধ আসে? সব ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকে?
কিন্তু তখনই বা হয়েছে কি!
আসল কথা পাড়লেন এলোকেশী ছেলেকে খেতে দিয়ে, পিদ্দিমের সলতে উসকে পা ছড়িয়ে বসে।
সে মুখ দেখে বুক কেঁপে উঠল নবকুমারের।
আমি এই তোকে বলে রাখছি নবা, শেষবেশ একটা চিঠি চামারটাকে দেওয়াব কর্তাকে দিয়ে, তাতেও যদি মেয়ে না পাঠায়, এই সামনের অঘ্রাণেই তোর আবার বিয়ে দেব।
আবার বিয়ে!
মা কি আজকে বুক ধড়াস ধড়াস করিয়েই মারবে নবকুমারকে?
আবার বিয়ে!
তার মানে আবার আর একবার নবকুমারকে নিয়ে সেই নকড়া-ছকড়া খেলা, আবার আর একটা বাড়িতে গিয়ে সেই সম্প্রদান, সেই বাসর, সেই কানমলা, সেই ঘাম।
ঘাড়টা প্রায় পাঁতের সঙ্গে ঠেকে যায় নবকুমারের। মুখ দিয়ে কথাও বেরোয় না, মুখের মধ্যে ভাতের গ্রাস ঢোকে না।
হঠাৎ একসময় কটুক্তি থামিয়ে এলোকেশী বলেন, খাচ্ছিস কই?
খাচ্ছি তো! এতক্ষণে অস্ফুটে একটা কথা বলে নবকুমার এবং বাক্যের সত্যতা রক্ষার্থে এক গ্রাস ভাত ঠেলেঠুসে মুখের মধ্যে চালান দেয়।
এবার সদু বা সৌদামিনীর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব। মাটির সরায় একসরা ধোয়াওঠা গরম ভাত নিয়ে এসে অবাক গলায় বলে উঠে সে, ওমা, ই কি! যেখানকার ভাত সেখানে পড়ে! এতক্ষণ কি করলি রে নবু?
খাচ্ছি তো! আরও একবার পূর্ব-কথা এবং পূর্বোক্ত কাজের পুনরাবৃত্তি করে নবকুমার।
দিয়ে যাই আর দুটো?
না না, আর নয়। ভরা মুখে হাত মুখ মাথা সব নেড়ে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে নবকুমার।
খিদে নেই?
নবকুমার আর একবার বলে, খাচ্ছি তো।
এদিকে ঠেলে-ওঠা চোখে জল আসতে চায়।
খিদে আর থাকবে কোথা থেকে? এলোকেশী বলে ওঠেন, শ্বশুরের নিন্দে, করেছি যে! একালের ছেলে তো! কিন্তু তোকে আবারও এই বলে রাখছি নবা, তোর দেমাকে-শ্বশুরের ওই খাড়া নাক যদি না খুঁয়ে ঘষটে দিই তো আমি কি বলেছি বাপ বাপ বলে ওই মেয়ে ঘাড়ে করে নাকে খত্ দিতে দিতে আসে তো ভাল, নচেৎ আবার ছাদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে তোকে। এবার আর নবাবের বেটী আনব না, গরীব-গুরবো ঘরের মেয়ে নে আসব।
ওই শোন’ সদু হেসে ওঠে, আর মুখ গোঁজ করে থাকবার কিছু নেই রে নবু, আশ্বাস-বাকি পেয়ে গেলি। এখন বড় বড় থাবায় খেয়ে নে। …বৌ এল না বলে মনের দুঃখে নবু অমন সরলপুঁটির টকটাই ভাল করে খেল না, দেখছ মামী?
সব সময় ন্যাকরা করিস নে সদু, এলোকেশী বেজার মুখে বলে, চব্বিশ ঘণ্টা হাসি-মসকরা কার ভালও বা লাগে! প্রাণে কিসের যে এত উল্লাস তাও তো বুঝি না।
.
কথাটা সত্যি।
উল্লাস আসবার কথা সদুর নয়।
তবু আসে।
তবু রং-তামাশা করে সদু, হি-হি করে হাসে। কিন্তু হাসি আসে কি করে সদু নিজেই কি জানে ছাই!
হয়তো এ জগতে একমাত্র ওইটুকুই ওর নিজের এক্তারে আছে বরে আনায়। দুর্ভাগ্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হি-হি করে হেসে বেড়ায় সে বুকের পাথরখানা ঠেলে ফেলে দিতে।
অবিরত ওই পাথরখানা বুকে বইতে হলে কি ঘুরেফিরে আর অসুরের মত খেটে বেড়াতে পারত?
গাঁ-সুদ্ধ সবাই তো ধিক্কার দেয় সদুর ভাগ্যকে, সবাই তো জানে সদুকে বরে নেয় না। অকারণ, শুধু খেয়ালের বশে সদুকে সদুর বর ত্যাগ করেছে। স্বভাবচরিত্র খারাপ তো অনেকেরই থাকে, পরিবারকে ত্যাগ আর কজন করে!
সদুর মা নেই, বাপ নেই, আজন্ম মামার বাড়ি মানুষ। মামা দু-তিনবার চেষ্টা করে করে শ্বশুরবাড়ি রেখে এসেছিল তাকে, কিন্তু কিছুতেই নিজের আসন দখল করতে পেরে উঠল না হতভাগা মেয়েটা। দুর্ব্যবহারের চোটে পালিয়ে আসতে পথ পায় নি।
তদবধি আবার এই মামার বাড়িতেই স্থিতি।
তা ছাড়া উপায় কি?
মামার বাড়িতে আছে, দুবেলা হেঁসেল ঠেলছে, জুতো-চণ্ডী সব নাড়ছে আর মামীর মুখ। খাচ্ছে।
তবু সে হাসে।
বলিহারি!
বলিহারি যাই বাবা!– মামী বলে, পাড়াসুদ্ধ সবাই শুনে শুনে নবকুমারের এখন ধারণা হয়ে গেছে, হাসিটা সদুদির পক্ষে গর্হিত, তাই সে হাসিঠাট্টায় কোনও দিনই তেমন করে যোগ দিতে পারে না। আর আজকের কথা তো স্বতন্ত্রই। আজকের হাসি-ঠাট্টার বিষয়বস্তু তো নবকুমার নিজেই।
দুধটা আনবি, না দাঁড়িয়ে রঙ্গ করবি?
ধমকে ওঠেন এলোকেশী।
ছেলের কোলের গোড়ায় ভাতের থালাটি বসিয়ে দেওয়া ছাড়া আর বেশী নড়াচড়া করেন না এলোকেশী। দ্বিতীয়বার যা কিছু লাগে ‘সদু সদু’ হাঁক। মস্ত সুবিধে, সধু বিধবা পুষ্যি নয়। বিধবা হলে তো এক মহা ঝঞ্ঝাট-রাত্তিরে আঁশ হেঁসেলের ভার দেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে আর কোন দ্বিধা দায় নেই। বড় বড় সরলপুঁটির টক সদু তো নিজেও একটু খাবে, অতএব কুটুক বাছুক রাঁধুক।
কর্তা নীলাম্বর বড়য্যের বয়স যাই হোক, রাতে ভাত খাওয়া ছেড়েছেন তিনি অনেক দিন। ঘরের গরুর খাঁটি দুধ দেড়সেরখানেককে মেরে আধসের করে সর পড়িয়ে রাখা হয়, তাতেই বাড়িতে ভাজা টাটকা খই ফেলে গোটা আষ্টেক মনোহরা মেখে আহার সারেন নীলাম্বর।
সে সারা তার সন্ধ্যাহ্নিক সেরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই হয়। নবু মাস্টারের কাছে পড়ে ফেরার আগেই। আবার তিনি যখন বেড়িয়ে ফেরেন, নবুর তখন অর্ধেক রাত্তির, কাজেই এ বেলায় বাপে ছেলেতে দেখা হয় না। ছেলের যে এই এক বেয়াড়া খেয়াল হয়েছে, ইংরিজি শিখবে! ওই ম্লেচ্ছের ভাষা শিখে কি চতুর্বর্গ লাভ হবে কে জানে, তবু খুব একটা বাধাও দেন নি নবকুমারের স্নেহশীল পিতা। বলেছেন, ইচ্ছে হয়েছে পড়ুক!
আসল নষ্টের গোড়া তো ওই ভবতোষ বিশ্বাসটা। কলকেতা থেকে ইংরিজি শিখে এসে গাঁয়ে এখন ইস্কুল খোলা হয়েছে বাবুর। সকাল-বিকেল দুবেলা ইস্কুল বসায়। গাঁয়ের ছোঁড়াগুলোকে ক্ষ্যাপানোর গুরু। কানে মন্তর দিচ্ছে, ইংরিজি না শিখলে নাকি উন্নতি নেই, শিখে কলকাতায় গিয়ে হাজির হতে পারলে সাহেবের অফিসে মোটা মাইনের চাকরি অবধারিত। ছুটছে সবাই ওর ইস্কুলে চালাকের রাজা ভবতোষ ফাসটু বুক, সেকেন বুক, কত সব শক্ত বই কিনে এনেছে কলকাতা থেকে, তাই থেকে পড়িয়ে পড়িয়ে বিদ্যে-দিগগজ করছে সবাইকে।
বামুনের ঘরের ছেলেগুলো যাচ্ছে শুদুরের কাছে বিদ্যে নিতে! কলি পূর্ণ হতে আর কতই বা বাকি!
তবু ছেলেকে বাধা দেন নি নীলাম্বর, কলির তালেই চলেছেন। শুধু ওই ম্লেচ্ছ-ভাষা-শিখে-আসা জামা-কাপড়গুলো ঘরে তোলে না, পরে কিছু ছোয় না, ছেড়ে হাত-পা ধুয়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করে, এই পর্যন্ত।
নবকুমারকে খাইয়ে মামী-ভাগ্নী দুজনে রান্নাঘরে বসে পড়ে খেতে। ওরা তো আর ভাত বেড়ে পিড়ি পেতে খাবে না, কাসি গামলা যাতে তাতে খেয়ে নেবে মাটিতে থেবড়ে বসে। তা এ সময় গল্পটা চলে ভাল। ফি হাত ধমক দিলেও ভাগ্নীকে নইলে চলেও না এলোকেশীর। কথা কইবার সঙ্গী বলতে দ্বিতীয় আর কে?
খাওয়ার পর রান্নাঘর ধোয়ার ভার সৌদামিনীর।
ঘর ধুয়ে পরদিনের জন্যে রান্নার কাঠ গুছিয়ে চকমকি ঠিক করে রেখে কাজ-করা কাপড় কেটে ৩বে শুতে যায় সদু। শোবার জন্যে তার নামে একটা ঘর আছে বটে, বিছানাও আছে বটে, কিন্তু সে ঘরে সে বিছানায় কতটুকুই বা শুতে পায় সে? নীলাম্বর যতক্ষণ না আসেন এলোকেশীকে আগলাতে হয়, কারণ এলোকেশীর বড় ভূতের ভয়।
নীলাম্বর আসার পর তার জল চাই কিনা, তামাক চাই কিনা খোঁজখবর করে তবে সদুর ছুটি। তা সে ছুটিটা প্রায় রাতের আধখানা গড়িয়ে গিয়ে হয়।
অবিশ্যি তার পর বাকী রাতটা সদুকে কে আগলাবে, এ প্রশ্ন ওঠে না। সদু তো সদু! ওকে যদি তা নিয়ে আক্ষেপ প্রশ্ন করো, নিশ্চয় হেসে উঠে বলবে, ভূতই আমায় আগলায়। জানো না– আমি যে শাকচুন্নী!
তবু সদু মামীকে ভালোবেসে মামাকে ভক্তিসমীহ করে, নবকুমারকে প্রাণতুল্য দেখে।
তার এই বত্রিশ বছরের জীবনে ভালবাসার, ভক্তি করবার, স্নেহ করবার জন্যে পেলই বা আর কাকে?
.
ভোরবেলাই ঘুমটা ভেঙে গেল।
কারণ কিছু মনে নেই, তবু যেন মনে হল নবকুমারের, বুকটায় কী একটা পাষাণভার চেপে রয়েছে। যেন আস্ত একটা পাহাড়ই কেউ বুকের ওপর বসিয়ে দিয়েছে কোন্ ফাঁকে! রাত্রে ঘুমের মধ্যেও ছিল যেন কি এক আতঙ্কের স্বপ্ন।
একটুক্ষণ খোলা জানলার দিকে চেয়ে বসে থাকতে সব মনে পড়ল। মনে পড়ল মায়ের শপথবাণী। মনে পড়ে হাত-পা ছেড়ে এল।
ধীরে ধীরে উঠে পড়ল, বেরিয়ে এল ঘর থেকে কেঁচার খুঁটটা গায়ে দিয়ে। ভোরের দিকে বেশ শীত-শীত পড়ে গেছে। আর শরৎকালের সকালের এই গা-সিরসিরে হাওয়াটাই তো কোন উধাও পাথারে মনটাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়।
বাইরে এসে দেখল সৌদামিনী উঠোনে ছড়াঝাট দিচ্ছে। কাছে গিয়ে বলল মা ওঠে নি সদুদি?
মামী। সকালবেলাই হেসে গড়িয়ে পড়ে সৌদামিনী। মামি আবার এমন সময়ে কবে ওঠে রে নবু? ভোর ঠাকুরের সঙ্গে যে মামীর বিরোধী।
খচখচ ঝাঁটা চালাতে চালাতে বলে সদু, সরে দাঁড়া নবু, ধুলো লাগবে।
লাগুক গে। বলে বরং কাছেই সরে এল নবকুমার, কাছে এসে হঠাৎ শীতকালে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার ভঙ্গীতে বলে উঠল, সদুদি, তুমি মাকে বলে দিও, ওসব পারব-টারব না।
ঝাঁটা বন্ধ হল সৌদামিনীর!
চোখ গোল গোল করে বলল, কি বলে দেব মামীকে? কী পারবি না?
ওই সব! নবকুমার বলে ওঠে, শুনলে তো কাল নিজের কানে, আবার শুধোচ্ছ কেন?
নাঃ, তুই আমায় অথই জলে ফেললি নবু! কালকের দিনভোর কত কথাই তো শুনেছি, কোনটা তোর মনে গিথে আছে, তা কেমন করে বুঝব?
আঃ, আচ্ছা জ্বালায় ফেললে তো! নাপিত পিসির ব্যাপারে রেগে গিয়ে মা যা বলল মনে নেই তোমার?
ও হরি, তাই বল! তোর আবার বিয়ে দেবে, এই কথা তো? ফের সদুর সেই হি-হি হাসি, সেই চিন্তেয় রাতভোর ঘুমুস নি বুঝি? নাকি সেই ঠাকুরঘরে কে, না আমি তো কলা খাই নি তাই? মামী পাছে প্রিতিজ্ঞে বিস্মরণ হয়ে যায় তাই আমি পারব না আমি করব না বলে স্মরণ করিয়ে দিতে এসেছিস?
আঃ সদুদি, ভাল হবে না বলছি। আমি এই তোমায় বলে রাখছি ওসব পারব না। আবার ওই কানমলা-টানমলা–ওরে বাবা!
সদু ফের হাতের কাজে মনোনিবেশ করে বলে, তা আমায় বলে কি হবে? মামীকে বল!
আমি বলব? আমি বলব মাকে?
সদু হাসতে হাসতে বলে, বলবি না কেন? ডাগর হয়েছিস, সাহস হচ্ছে না?
মার কাছে সাহস! হুঁ! এই তোমায় বলছি সদুদি, আমি তোমার কাছে বলে খালাস, যা বিহিত করার তুমি করবে।
সৌদামিনী ফের হাত থামিয়ে বলে, বেশ বলব মামীকে, নবুর আমাদের প্রেথম পক্ষের ওপর বড় আঁতের টান, ওকে ত্যাগ দিয়ে অন্যত্তর বিয়ে করবে না!
সদুদি ভাল হবে না বলছি! বলি, আবার এই সব ভুতুড়ে কাণ্ডর দরকার কি? নাই বা পাঠাল কেউ মেয়ে, পরে ঘরের মেয়ে নইলে বুঝি সংসার চলে না?
কই আর চলে? সদু হাত মুখ নেড়ে বলে, চলে আর এই আদি-অন্তকাল ধরে মানুষে ওই সব ভূতুড়ে কাণ্ড করত না, বুঝলি রে নবু! এর পর ওই পরের মেয়েই জগতের সেরা আপন হবে।
ছাই হবে! ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলে নবকুমার, কই, জামাইবাবুর তো হল না।
সদুর উচ্ছাস কমে, একটু গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, ও-কথা বাদ দে। আমার মতন ছাই-পোরা কপাল যেন অতি বড় শত্রুরও না হয়!
নবকুমার সদুর ভাবান্তরে ঈষৎ থতমত খেয়ে বলে, আমি কিছু ভেবে বলি নি সদুদি। কিন্তু যা বললাম, তোমাকে আমার রক্ষেকত্তা হতে হবে!
বেশ বলব মামীকে, যা দেখেছি দু-ঘা ঝাটা আছে ললাটে।
.
তা সদুর কথা মিথ্যা নয়। এলোকেশী সেই ব্যবস্থাই করেন।
তবে ললাটের-ঝাঁটাটা দৃশ্যমান নয় এই যা। শব্দ অদৃশ্য। তবু এলোকেশী যখন কথার তুবড়ি ছোটান, মনে হয় তার মুখ থেকে আগুনের হলকার মত দৃশ্যমানই কিছু বার হচ্ছে বুঝি!
শাক বাছতে বাছতে কথাটা পেড়েছিল সৌদামিনী, ওগো মামী, তুমি তো বলছ ওরা পশুপাঠ মাত্তর মেয়ে না পাঠালে তুমি ছেলের আবার বিয়ে দেবে, এদিকে ছেলে তো বেঁকে বসে আছে!
কী! কী বললি?
মুহূর্তে অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল।
সদু কেন ভুতো ন ভবিষ্যতি করে গাল দিয়ে ঘোষণা করলেন এলোকেশী, যে আমার খেয়ে আমার পরে আমার সংসার ভাঙবার তাল খুঁজবে, তাকে ঝেটিয়ে দূর করে দেব তা এই বলে রাখছি সদু। আমার ছেলেকে কানে বিষ-মন্তর দিয়ে পর করে নিতে চাস লক্ষ্মীছাড়ি! উঠুক তোর মামা আহ্নিক করে, দেখাচ্ছি মজা!
সদু প্রতিবাদও করে না, নিজের সাফাইও গায় না এবং এ প্রশ্নই তোলে না, তার অপরাধ কোথায়? এমন কি তার মুখ দেখে এই মনে হয়, এই বাক্যবাণের লক্ষ্য বুঝি তার অপরিচিত কেউ!
নীলাম্বর আহ্নিক সেরে উঠে বাইরে তামার কুশিতে সূর্যার্ঘ্য নিবেদন করে কুশিটা মাটিতে উপুড় করে, আর এক দফা সূর্যপ্রণাম সেরে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াতেই এলোকেশী দুধকলা দিয়ে কালসাপ পোষার নজীর তুলে স্বামীকে অবহিত করিয়ে দিয়ে বলেন, তুমি যদি এই দণ্ডে চিঠি লিখে রওনা করে না দেবে তো আমার মাথা খাবে।
নীলাম্বর আহাহা করে উঠে বলেন, দিব্যি গালাগালির কি আছে। পত্র লিখছি, কিন্তু পাঠাবার কি হবে তাই ভাবছি। নাপতে-বৌ-তো–
কেন গাঁয়ে কি ও ভিন্ন আর মানুষ নেই? রাখাল তো গেছল সেবার?
রাখাল যাবে? কিন্তু অতখানি পথ একেবারে একলা! তাই ভাবছি।
তা হলে গোবিন্দ আচায্যির ছেলে গোপনাকে পাঠাও। গাঁজার পয়সা দিলে রাজী হয়ে যাবে।
গোপনাকে কুটুমবাড়ি পাঠাব! কি বলতে কি বলে আসবে!
আসুক না। এলোকেশী বীরদর্পে বলেন, ওই গেজেলের কটুবাক্যিতে যদি মিনসের চৈতন্য হয়! তার পর দেখি কেমন সোহাগিনী মেয়ে নিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে! গোপনাকে এও বলে দেবে, ওখানে আশেপাশে কুলীনের মেয়ের সন্ধান পায় কিনা দেখে আসতে। নাকের সামনে হলেই ভাল হয়।
নীলাম্বর আর কথা বাড়ান না, কাগজ কলম নিয়ে বসেন। এবং অনেক মুসাবিদান্তে একখানি চিঠির খসড়া করেও ফেলেন।
তাতে এই কথাই বিশদ বোঝানো থাকে, রামকালী যদি পূর্ব জিদ বজায় রাখতে চান, তাঁর কপালে অশেষ দুঃখ আছে। ছেলের তো আবার বিয়ে দেবেনই এঁরা, তা ছাড়া আরও যা করবেন ক্রমশ প্রকাশ্য। রীতিমত ভয় দেখানো চিঠি।
পত্রের ভাব ও ভাষায় এলোকেশী প্রীতিপ্রকাশ করেন। অতএব নীলাম্বর তৎপর হন পাঠাবার চেষ্টায়। কিন্তু মনে তার দুশ্চিন্তা, রামকালীর একমাত্তর মেয়ে সত্যবতী! বেশী টান কষলে দড়ি না ছিঁড়ে যায়।
এত কথার কিছুই নবকুমার জানে না। সে স্কুলে।
বেলায় যখন ফিরল, সদুর কাছে গিয়েই আগে দাঁড়াল। সদুদি, তেল!
সদু পলায় করে তেল এনে ওর হাতে দিয়ে বলে, দেখলি তো, বললাম কাজ কিছু হবে না, শুধু আমার কপালে ঝাটা, তাই হল। তোর শ্বশুরের মৃত্যুবাণ তৈরি, এতক্ষণে বোধ হয় পাঠানোও হয়ে গেল। যদি বা দুদিন দেরি হত, তোর অমত শুনে মামী একেবারে ধেই ধেই।
হাতের তেল আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বেচারা নবকুমার।
সদু বোধ করি ওর মুখভঙ্গী দেখেই করুণাপরবশ হয়ে বলে, যাক গে, তুই আর ও নিয়ে মন উচাটন করিস নে, দিতে হয় আর একবার টোপর মাথায় দিবি। কত আর কষ্ট! তোর একটা বৌ পেলেই হল। তবে মনে নিচ্ছে এবার তালুইমশাই নরম হবে, যতই হোক মেয়ের বাপ!
হঠাৎ নবকুমার একটা বেখাপপা এবং অবান্তর কথা বলে বসে, সায়েবরা শুধু একটা বিয়ে করে, কখনো অনেক বিয়ে করে না।
ব্যস, আর যায় কোথা!
সদুর হাসির ধুম পড়ে যায়। ওমা, তাই নাকি? ও বুঝেছি, ওই সায়েবদের বই পড়ে তোরও সেই বুদ্ধি মাথায় ঢুকেছে! তা হারে নবু, সায়েবরা যদি একটা বৈ বিয়ে করে না তো বাকী মেমগুলোর কী দশা হয়? বিধাতা পুরুষ যখন পৃথিবী ছিষ্টি করেছিল, তখন একটা করে বেটাছেলে আর দেড়কুড়ি করে মেয়েমানুষ গড়েছিল, এ তো জানিস? তা হলেই বল, বাকীগুলোর গতি কে করবে, যদি একটা বৈ বিয়ে না করে?
যত সব আজগুবী! যদিও নবকুমার মার আড়ালে বেশ সশব্দেই কথা বলে, পৃথিবী সুদ্ধ বেটাছেলে বুঝি দেড়কুড়ি করে–
মুখের কথা মুখেই থাকে, রঙ্গস্থলে এলোকেশী দেখা দেন, বলি নবা, চান করতে যেতে হবে কিনা? যখন দুটোয় এক হবে, অমনি হাসি-মস্করা। হ্যাঁলা সদি, তোকেও বলি, ও কি তোর সমবয়সী? তা তো না, রাতদিন কেবল কানে কুমন্তর দেওয়া! রোস, বৌ একটা আসুক না ঘরে, হাঁড়ি গলায় গেঁথে দেবার লোক হোক, তোকে একবারে ঝেটিয়ে বিদেয় করি।
মাতৃ সন্নিধানে নবকুমারের সর্বদাই চোরের ভূমিকা। তাই সদুদির এই অপমানে তার প্রাণটা ছটফটিয়ে উঠলেও মুখ দিয়ে রা ফোটে না। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই, সদুর মুখের রেখায় কোনভাব বৈলক্ষণ্য ফোটে না। সে যথাপূর্বং হাস্যবদনে নবুকে চোখ টিপে ইশারা করে, যার এই অর্থ হয় যা নাইতে যা, মামী ক্ষেপেছে!
হাতের তেল তেলো থেকে সবটাই গড়িয়ে গেছে, তেলালো হাতটাই শুধু মাথায় ঘষতে ঘষতে সোজা কাঁচদীঘিতে চলে যায় নবু। আজ আর যেন খিড়কি পুকুরে মন ওঠে না।
যেতে যেতে হঠাৎ সেই একদিন দেখা শ্বশুরের ওপর ভারী রাগ এসে যায় নবকুমারের। এত ঝামেলার কিছুই তো হত না, যদি সেই মেয়ে না কি পাঠাতেন তিনি!
বুকটায় শুধু পাষাণভারই নয়, যেন কাঁটাও বিধেছে। দূর ছাই!