শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্তের অচ্ছেদ্য শৃঙ্খলার শূলে বন্দী এই নিয়মতান্ত্রিক পৃথিবী রাজ্যটার প্রধান প্রজা মানুষগুলোর জীবনের কিন্তু না আছে নিয়মের নিশ্চিন্ততা, না আছে শৃঙ্খলার আশ্বাস। তাকে না বিধাতা, না প্রকৃতি, কেউ কোনদিন দেয় নি নিশ্চিত নিয়মের ভরসা।
তাই সহজ সুস্থ মানুষও রাতে ঘুমুতে যাবার আগে স্থির বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারে না, সকালের আলো সে দেখবেই! বলতে পারে না, তার ভরা বসন্তের মাঝখানে বজ্রের অভিশাপ নেমে আসবে না, শরতের সোনালী আলোকে মুছে দিয়ে শুরু হয়ে যাবে না অপ্রতিরোধ্য ধারা বর্ষণ।
না, জোর করে এসবের কিছুই বলতে পারে না মানুষ। সে জানে না কখন তার আশায় গড়া সুখের ঘরখানি তছনছ করে দিয়ে যাবে অতর্কিত মৃত্যুর নিষ্ঠুর থাবা অথবা সে ঘরকে বিকল করে দিয়ে যাবে আকস্মিক দুর্ঘটনা অথবা দুরারোগ্য ব্যাধি। কে বলবে এই অনিয়মের দেবতা কোথায় বসে আছেন তার অমোঘ নিয়ম নিয়ে!
তবু রামকালী কবরেজের সংসারে উপর্যুপরি দুর্ঘটনাগুলো দেশসুদ্ধ লোককে হতচকিত করে দিল।
আগুন লেগে বাইরের বড় আটচালা ভস্মীভূত হয়ে যাওয়াটাতেও কেউ অতটা বিস্ময় বোধ করে নি, কারণ হুতাশনের ক্ষুধাটা ভাগ্যের মার হলেও তার মধ্যে মানুষের অসতর্কতা অথবা মানুষের কারসাজির ছাপটা স্পষ্ট দেখা যায়। তা ছাড়া রামকালীর উপর ভাগ্যের মারটা সেই প্রথম।
না, রামকালীর আটচালায় আগুন লাগার মধ্যে কেউ শত্রুর কারসাজি আবিষ্কার করতে যায় নি। ওটা যে নিতান্তই অসতর্কতার ফল এটা সবাই বুঝেছিল। ব্যাপারটা এই
এ বাড়ি থেকে আগুন সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া কাছাকাছির প্রায় প্রতিটি পড়শীরই নিয়ম। বরাবরই সে-সব বাড়ির কেউ না কেউ নিজেদের প্রয়োজন মাফিক সময়ে এসে এ বাড়ির রান্নাঘর থেকে একখানা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে যায়। ঘরে তাদের উনানে শুকনো নারকেলপাতা, খটখটে খুঁটে অথবা সরু করে কুচনো কাঠকুটো ডালপালা সাজানোই থাকে, জ্বলন্ত কাঠখানা এনে তাতে সংযোগ করে দিতে পারলেই মিটে গেল কাজ।
কিন্তু এ তো সবে প্রথম।
এর কয়েক দিন পরেই দীনতারিণী ঘাট থেকে চান করে এসেই হঠাৎ শরীর কেমন করছে বলে পক্ষাঘাত হয়ে পড়লেন।
পক্ষাঘাত পাতক রোগ, দীনতারিণীর তা অজানা নয়। ছেলের দিকে তাকিয়ে তিনি অশ্রু কলঙ্কিত চোখের ইশারায় কাতর আবেদন করলেন, তাকে তাড়াতাড়ি পার করতে।
রামকালী শুধু কপালের ঘাম মোছার ছলে একবার কপালে হাত ঠেকালেন।
দিনতিনেক পরেই মারা গেলেন দীনতারিণী।
না, অত বড় বদ্যি হয়েও মাকে বাচাতে পারলেন না বলে কেউ দুষল না রামকালীকে। বরং দীনতারিণীর ভাগ্যিকে ধন্যি ধন্যি করতে লাগল সবাই। বলল, খুব গিয়েছে বুড়ী। ভুগল না ভোগাল না, এমন মৃত্যুই তো কাম্য।
তবে এ কথা বলতে ছাড়ল না, বছরটা একটু সাবধানে থেকো রামকালী, অগ্নির কোপ, তায় মহাগুরু নিপাত, সময়টা তোমার ভাল যাচ্ছে না।
পাড়ার বয়োজ্যষ্ঠরাই বলেন, এ ছাড়া আর কার সাহস।
রামকালীর কাকা-দাদা তো সাধাপক্ষে তাঁর সামনে আসেনি, সামনে আসে রাসু, কবরেজী শেখে কাকার কাছে। তবে প্রায়ই হতাশ করে কাকাকে। রামকালী কখনো ভ্রূকুটি করেন, কখনো হেসে ফেলে বলেন, তোর কিছু হবে না রাসু!
কিন্তু শুধুই কি রাসুর?
কুঞ্জর কোন ছেলেটার বা কি হয়েছে? পাঠশালায় গিয়ে অনাসৃষ্টি অনাসৃষ্টি খেলা উদ্ভাবন করা ছাড়া মাথা আর খেলতে দেখা যায় না রাসুর কোনো ভাইটারই। রাসু তো তবু ছাত্রবৃত্তি পাস করেছে, টোলেও পড়েছে কিছুদিন, তাছাড়া চেহারাটা সুকান্তি আর বেশ মার্জিত ভাব।
অনেকটা কাকার ধাচের রং-গড়ন তার। তাই সমানে দাঁড়ালে একটা মানুষের মত দেখতে লাগে। আরগুলো তো তাতেও না।
তাছাড়া কবরেজী বিদ্যে মাথায় না ঢুকুক, অনেক ব্যাপারেই রাসু রামকালীর ডান হাত।… এই যে দীনতারিণীর শ্রাদ্ধের অত বড় কাণ্ডটা, রাসু সামনে না থাকলে রীতিমত বেগ পেতে হত না কি রামকালীকে? কারণ স্বপাক হবিষ্যান্ন, ত্রিসন্ধ্যা স্নান, ইত্যাদি করে বহুবিধ নিয়মের পাকে বাঁধা থাকায় নিজে তো ঠিক মুক্তজীব ছিলেন না।
রাসু কাজকর্মের ব্যাপারে যথেষ্ট পারগ।
দানসাগর করলেন রামকালী মাতৃশ্রাদ্ধে, সেই সমারোহে সত্য এল। নবকুমারও এল।
রাসুই আনতে গেল।
ঠাকুরমা মারা যাওয়ার খবরে সত্যর প্রাণটা আকুলিব্যাকুলি করছিল, রাসুকে দেখে যেন স্বর্গের চাঁদ দেখল। এ সময় যে বাবা রাখু কি গিরি তাতিনীকে পাঠান নি, খুব ভাল করেছেন।
সাড়ে তিন বছর পরে এই প্রথম বাপের বাড়ি যাওয়া।
কিন্তু সত্যর দেহের অন্তঃপুরে তখন যে আর এক ‘প্রথম’ সম্ভাবনার সূচনা দেখা দিয়েছে, সে কি সত্য জানত না? না বুঝতে পারে নি?
তা সত্য না পারুক, সদু পেরেছিল বুঝতে। কিন্তু রণচণ্ডী মামীকে এই সূচনা মাত্রতেই জানাতে সাহস করে নি সদু। ভেবেছিল যাক আর গোটাকতক দিন, তেমন প্রবল লক্ষণ ধরা পড়লে আপনি জানবে বুড়ী।
এই সময় দীনতারিণীর বার্তা।
সদু ভয় পেল। এ সময় এই!
ভাবল, মামীকে বলি কি না বলি।
কিন্তু বলা আর হয়ে উঠল না।
বলতে দিল না তার মমতা। এ খবর শুনে যদি এলোকেশী আবার বৌয়ের যাত্রায় বাদ সাধেন!
আহা বেহারা এই এতদিন এসেছে, একনাগাড়ে আছে। আপন বুদ্ধির দোষেই হোক আর যার দোষেই হোক আছে তো! এই ছুতোয় যেতে পারে তো যাক। ভগবান ভালই করবেন।
তবে যাত্রাকালে চুপি চুপি সাবধান করে দেয় সত্যকে, বাপেরবাড়ি যাচ্ছিস, দীর্ঘকাল পরে যাচ্ছিস, কিন্তু সাবধান, বাধা-গরু ছাড়া পাওয়ার মত লাফঝাঁপ করিস নে। আমার বাপু সন্দ হচ্ছে–
সত্য একটু ভাবনার মত তাকিয়ে অস্ফুটে বলে ফেলেছিল, কি?
এই দেখ! পষ্ট করে না বললে হবে না বুঝি? এদিকে তো পাকা গিনী! সন্দ হচ্ছে পেটে বাচ্ছা কাচ্চা কিছু এসেছে, বুঝলি? সাবধানে থাকা দরকার।
ভয় না আহ্লাদ? ভয়, ভয়, সম্পূর্ণ ভয়! তবে এক অদ্ভুত ভয়!
নিজের মধ্যে কী এক অজ্ঞাত রহস্য বাসা বেঁধেছে, একথা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
.
গরুরগাড়ির ভিতরে বসে ঘোমটার মধ্যে থেকে বার বার নবকুমারকে দেখে সত্য আর মানুষটাকে যেন নতুন মনে হয়।
এ খবর ও পেলে?
কী না জানি হবে সেই অবস্থাটা!
গরুরগাড়িতে বেশ ঝাঁকুনি লাগছিল।
একসময় তাই বলেও ফেলে চুপি চুপি, পালকি আনলে না কেন বড়দা?
রাসু অপ্রতিভ মুখে বলে, খুব কষ্ট হচ্ছে, না রে? আমি বলেছিলাম, খুড়োকাকাই বললেন, একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলে রাসু, বললেন, কাজের বাড়িতে চারিদিক থেকে আত্মকুটুম্ব আসবে, সবাইকে তো আর পালকি যোগানো যাবে না! আমি তাও অবিশ্যি বলেছিলাম, সব আর জামাই তো সমান নয়? তাতেও বললেন, জামাইও তো বাড়িতে একটি নয় রাসু, ওকে আর কে বোঝাবে বল?
সত্য অন্যমনস্কে চুপি চুপিটা ভুলে বেশ স্পষ্ট গলাতেই বলে ওঠে, তা এর আর বোঝবার আছে বড়দা, সত্যিই তো! জামাই সবাই সমান! নিজের জামাইটি বলে সারপর করলে চলবে কেন বরং পুণ্যির নতুন বিয়ে হয়েছে– কথা শেষ না করেই নবকুমারের উপস্থিতি স্মরন করে জিভ কেটে চুপ করে।…
কিন্তু সমুদ্রে বালির বাঁধ কতক্ষণ? আবার এক সময় কথা কয়ে ওঠে সে।
কত প্রশ্ন, কত ঔৎসুক্য!
এই সাড়ে তিনটে বছরে কত ঘটনা ঘটেছে, কত জন্ম-মৃত্যুর লীলা-খেলা হয়েছে, কত ছোট্ট মানুষ বড় হয়েছে, কত আইবুড়োর বিয়ে হয়ে গেছে, সেই সব তথ্যগুলো তো কম মূল্যবান নয় জানতে হবে না সে সব?
তুমি কিন্তু একটুও বদলাও নি বড়দা!
সহাস্য মুখে বলে সত্য।
আর নবকুমার বিগলিত বিস্ময়ে সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিস্ময়? তা বিস্ময় বৈকি! সত্যর এই মুখ সে কবে দেখেছে? সত্যর মুখটা যে হেসে উঠলে এমন অপূর্ব লাবণ্যময় দেখায় সে কথাই বা কবে জেনেছে?
তা সত্যর সেই প্রশ্নে রাসুও হেসে উঠে বলে, আমি আবার এই কদিনে বদলাবো কি?
কদিন!
সত্যর যে মনে হচ্ছে কত যুগ-যুগান্তর পার হয়ে গেছে। সেকথাই বলে সে বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে, কদিন? বল কি বড়দা, সাড়ে তিনটে বছর– কদিন হল?
সাড়ে তিন বছর! রাসু আবার হেসে ওঠে, বলে, সাড়ে তিন বছর হয়ে গেল এর মধ্যেই তা ওই শুনতেই সাড়ে তিনটে বছর, কোথা দিয়ে কেটে গেছে!
সত্য নিঃশ্বাস ফেলে বলে, তা তোমাদের আর না কাটবে কেন? স্বাধীন সুখী মানুষ। আমাদেরই মনে হচ্ছে যেন আর একটা জন্ম পেরিয়ে এলাম!
.
তা বাপের ভিটেয় পা দিয়েও ঠিক সেই কথাই মনে হয় সত্যর। যেন আর একটা জন্ম পার হয়ে এল।
কিন্তু কোথায় এল?
ঠিক যে জায়গাটা থেকে চলে গিয়েছিলে, সেই জায়গাটায় কি? সেটা কি এখনো তেমনি পড়ে আছে? ফাঁকা, খালি?
হয়তো ছিল হয়তো আছে, কিন্তু এই জন্মান্তর পার হয়ে আসা মেয়েটাকে কি আর এখন সেই খাঁজে ধরবে? কোনো মেয়েকেই কি ধরে? গোত্রান্তরের সঙ্গে সঙ্গেই কি অন্তরের বিরাট একটা পরিবর্তন হয় না?
যে মেয়েটা হয়তো উঠতে বসতে বকুনি খেয়েছে আর নিতান্ত অবহেলায় খেলে খেলিয়ে বেড়িয়েছে, সে হয়ে ওঠে আদরের অতিথি, সমীহর কুটুম্ব। কোন্খানে তবে আশ্রয় পাবে সেই মেয়েটা?
এত বড় কাজের বাড়ি, তবু ওরা সত্যর সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে। সারদা, ভুবনেশ্বরী, শিবজায়ার নাতনী দুটো, এমন কি মোক্ষদা পর্যন্ত। সত্য কি খাবে, সত্য কোথায় শোবে, সত্য কোথায় বসবে সত্যর কিছু চেয়ে না পাওয়া হল কিনা এই সব। ভুবনেশ্বরীর তো কথাই নেই। তার শাশুড়ী গেছেন, মহা অশৌচ, ছুঁয়ে নেড়ে কিছু করার ক্ষমতা নেই, তবু বলে বলেই যা পারে।
ব্যাপারটা স্বস্তিকর নয়, এ যেন প্রতি মুহূর্তে মনে পড়িয়ে দেওয়া, তুমি কুটুম, তুমি অতিথি!
একসময় ঝেঁজেই উঠল সত্য। মা’র ওপরই উঠল।
কী চাও বল তো তোমরা? এক্ষুনি আবার শ্বশুরবাড়ি চলে যাই? বাবাঃ, তোমাদের এই আদরের ঠ্যালা সামলানো আমার কম্ম নয়। বাড়িতে তো আরো শ্বশুরতি মেয়ে এসেছে, কই তাদের নিয়ে তো এত হৈ-চৈ করছ না?
কথাটা সত্যি।
আরো শ্বশুরঘর করা মেয়ে এসেছে। পুণ্যি তো এসেইছে, কুঞ্জর দুই গিন্নীবান্নী মেয়ে এসেছে, শিবজায়ার মেয়ে এসেছে, রামকালীর যে ছোট খুড়ো নেই তার তিনটে মেয়ে এসেছে, কুঞ্জর সহোদর বোনেরা এসেছে, তারা ঝকের কৈ হয়ে রয়েছে। শুধু সত্যকে নিয়েই
ভুবনেশ্বরী মেয়ের এই ঝঙ্কারে অপ্রতিভ হয়ে বলে, তারা সবাই পেরায় পেরায় আসে। তোর মতন কে এমন ঘরবসতে গিয়ে একেবারে তিন-চারটে বছর।
কথা শেষ করতে পারে না ভুবনেশ্বরী।
সত্য মা’র এই রুদ্ধবাক মুখের দিকে তাকিয়ে একটু নরম হয়ে বলে, বুঝলাম। কিন্তু আছি তো দিনকতক। কাজ মিটতেই তো পালাচ্ছি না, সে কথা হয়ে গেছে ওখানে। তখন কোরো মেয়েকে আদরগোবর। এখন তোমার শাশুড়ীর ছেরাদ্দ, এখন মানায় মেয়ে নিয়ে সোহাগ করা?
ভুবনেশ্বরী সজল চোখে বলে, কদিন থাকবি তুই-ই জানিস!
থাকবো বাবা, মাস দুই অন্তত থাকবো, হয়েছে সে-কথা।… চল পুণ্যি, আমাদের সেই বটতলার খেলাঘরটা দেখে আসি!
বলে পুণ্যির হাতটা চেপে ধরে প্রায় টেনেই বার করে নিয়ে যায় তাকে সত্য খিড়কির দোর দিয়ে।
.
ওদের এই খেলাঘর’টা বাস্তবিকই একটি মনোরম ঠাঁই। স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে প্রশংসা অর্জন করতে পারে ওরা।
প্রকাণ্ড একটা বুড়ো বটগাছ ঝুরি নামিয়ে নামিয়ে খানিকটা জায়গা এমন একটি ছায়াপূর্ণ আশ্রয়গৃহ নির্মাণ করে রেখেছে যে, দু-এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলেও বোধ করি সেই গৃহবাসীর মাথা ভিজবে না। রোদের তো কথাই নেই, প্রায় প্রবেশ নিষেধ তার।
এইখানেই সত্যদের শৈশবের খেলাঘর। তা শ্বশুরবাড়ি যাবার কদিন আগে অবধিও খেলেছে সে। এখনই পরিত্যক্ত ভূমি। এখনকার ছোটদের অন্য খেলাঘর।
নিকানো-চুকোনো গাছের গোড়াটা এখন ধূলোভর্তি হয়ে থাকলেও সারি সারি ছোট্ট ছোট্ট উনুনগুলো এখনও পুরনো স্মৃতি বহন করে পড়ে আছে ক্ষত-বিক্ষত দেহ নিয়ে।
কী যত্নেই এই উনুনগুলি পেতেছিল ওরা!…
কিছুক্ষণ গোড়ায় বসেই থাকল সত্য চুপ করে। ঠিক সেই মুহূর্তে যেন কথা কইবার শক্তি নেই। অগত্যা পুণ্যিও চুপ।
অনেকক্ষণ কাটার পরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সত্য বলে, আশ্চয্যি দেখেছিস পুণ্যি, সবাই বদলে গেছে, সবই বদলে গেছে, অথচ এই তুচ্ছ জিনিসগুলো অবিকল আছে!
পুণ্যিও নিঃশ্বাস ফেলে, সত্যি, যা বলেছিস!
সত্য আস্তে আস্তে দেখিয়ে দেখিয়ে বলে, এই উনুনটা পুঁটির, এটা খেদির, এটা টেপির, এটা গিরিবালার, এটা সুশীলার, এটা তোর– তাই না?
নিজের কথাটা আর বলে না।
পুণ্যি বলে সে কথা, এইটে তোর ছিল, দেখ ভাঙা হাঁড়িকুঁড়িগুলোও রয়েছে পাঁশকুড়ে!
হ্যাঁ, খেলাঘরের পাঁশকুড়ও একটা ছিল বৈকি। সবই তো থাকা প্রয়োজন। পাঁশকুড়, পুকুরঘাট, গোয়াল, চেঁকিঘর– অনুষ্ঠানের ত্রুটি হবে কেন? বড়রা যে খেলাঘর নিয়ে মত্ত, ওরা তো তারই নিখুঁত অনুকরণ করবে। ওদের মাটির আর কাঠের পুতুলগুলোও ঘাটে বাসন মেজেছে, ক্ষার কেচেছে, চেঁকিতে পাড় দিয়েছে, বেঁধেছে, কুটনো কুটেছে, বাটনা বেটেছে, ছেলে ঘুম পাড়িয়েছে, কর্তব্যে তিলমাত্র ফাঁকি দিতে পায় নি। তাদের কাজের ছুতোয় মুখর হয়ে উঠেছে এই বুড়ো বটতলা।
বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সত্য।
বলে, চ পুণ্যি, আর দেখতে ইচ্ছে করছে না, বুকের ভিতরটা কেমন মুচড়ে উঠছে।
তা পুণ্যির মধ্যেও সেই মোচড় পড়ছিল, সেও বলে, চ আর মায়া করা বিড়ম্বনা। যেদিন পরগোত্তর করে দূর করে দিয়েছে, সেদিন থেকেই তো সব ঘুচেছে। মেয়ে জন্মটাই ছাই।
সত্য আর একবার বড়সড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, মেয়ে জন্মটাই ছাই নয় রে পুণ্যি, আমাদের বিধেন দাতারাই ছাই। পরগোত্তর করে দিয়ে জন্মের শোধ পর করে নেড়ু দেবার হুকুম ভগবান দেয় নি। এই যে তুই আমার চিরকালের বন্ধু, তোর বিয়েতে আসা হল না, এ দুঃখু কি মলেও যাবে? যাবে না। তবু তো এলাম না। এসব কি ভগবান বলেছে?
তা নিঃশ্বাস ফেলেছে বলে যে হাসছে না, গল্প করছে না, পাড়া বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে না, সেকথা ভাবলে ভুল হবে, সেটা যথারীতিই চলছে। গল্পের সমুদ্র, কথার পাহাড়। পাড়ার কোন মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি গেছে, কোন্ মেয়েটা বাপেরবাড়ি আছে তার তল্লাস করে বেড়ানো আর গল্পে মুখর হয়ে ওঠা, এটা প্রবল প্রবাহেই চলেছে। নিঃশ্বাসটা নিভতে।
একান্ত নিভৃতে, মনের অন্তরালে রয়েছে সেই নিঃশ্বাস। এত পূর্ণতার মধ্যেও কোথায় যেন একটা সগভীর শূন্যতা, সেই শূন্যতার ওপরই বুঝি পা রাখতে হয়েছে সত্যকে, তাই পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পাচ্ছে না।
সে শূন্যতা– সত্য আর এদের নয়। এ সংসার সত্যর নয়।
.
বিরাট কাজের বাড়িতে কে কোথায় ঠাঁই পেয়েছে কে জানে! মেয়েরা মেয়েমহলে, পুরুষরা বারমহলে। কোটাঘরে সব জামাই-কুটুম, আর নবনির্মিত আটচালার নিচে জ্ঞাত-গোত্তর,.. নবকুমার যে কোন্খানে আছে সত্য জানে না, মাঝে মাঝে সেটা মনে পড়ছে। আহা মানুষটা মুখচোরা লাজুক, কোথায় কি ভাবে আছে কে জানে! এসে অবধি তো দেখা হয় নি!… বাবা সহস্র কাজে বেড়াচ্ছেন, বাবার এমন সময় নেই যে জামাই নিয়ে তদারকি করে বেড়াবেন! যা করে পাঁচজনে.. কি ভাবছে ও আমাকে কে জানে!
থেকে থেকেই সেই মানুষটার কথা মনে পড়ছিল। মনকেমন মনকেমন ভাবটা ছিল, আবার একটু অহঙ্কারী অহঙ্কারী দুষ্টুবুদ্ধিও ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল একবার লোকটাকে ডেকে বলে, দেখছ তো? সবই দেখছ? বুঝতে পারছ, তোমার মা যতই হেলাফেলা করুন, নেহাৎ হেলাফেলা ঘরের মেয়ে আমি নই!
কিন্তু এসব বলার সুযোগ কোথা?
বিয়েবাড়ি নয় যে সবাই রঙ্গরসে মাতবে। মাতৃদায় উদ্ধার বলে কথা। তাছাড়া অনেকের মধ্যে একজন হলেও দীনতারিণীর পদটা বাড়ির গিন্নীর ছিল, ছোট ননদদের তিনি যতই ভয় করে চলে থাকুন, আর ছেলেকে যতই সমীহ করে আসুন, সবাই জানতো গিন্নী বলতে দীনতারিণীই। সেই গিন্নীর জায়গা শূন্য হয়ে গেলে সবাইয়েরই ফাঁকা ফাঁকা লাগে বৈকি। খেটে খেটেও জেরবার হচ্ছে সবাই, এর মাঝখানে কার এ কথা মনে উদয় হবে, সত্যর সঙ্গে সত্যর বরের দেখা করিয়ে দিই কোন ছলছুতোয়। তাছাড়া চাতক পক্ষীর অবস্থা তো নয় সত্যর। এই দীর্ঘকাল নিচ্ছিদ্র বরের ঘর করে এসেছে সে। সত্যর বরকে সত্যর দেখতে ইচ্ছে হবে, এ চিন্তা তাদের মনে উদয় হবার কথা নয়।
উদয় হচ্ছে এক ভুবনেশ্বরীর।
কিন্তু সে তো সব দিকেই বন্দিনী। একে তো শাশুড়ী মরার নিয়ম-নীতির দায়, তার উপর মেয়ের ভয়ের দায়। ওরকম চেষ্টা করতে গেলে সত্য যে ক্ষেপে উঠবে না, এ প্রতিশ্রুতি কে দেবে ভুবনেশ্বরীকে?
কিন্তু সত্যর মা কি সত্যকে সবটা বুঝে উঠতে পেরেছে?
পারে নি।
সত্য যে ছলছুতো খুঁজে বেড়াচ্ছিল, এ তার ধারণার বাইরে।
তা অবশেষে হয়ে গেল যোগাযোগ।
নিয়মভঙ্গের যজ্ঞি মিটতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছল, সত্য পুকুরঘাট থেকে আঁচিয়ে একবার নিজের মামার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল মামীদের সঙ্গে, জোরপায়ে ফেরার সময় নেড়ুর সঙ্গে দেখা।
নেড়ু দাঁড় করালো।
মুখটা রহস্যে উদ্ভাসিত করে বলল, এই সত্য, তোর ভূতের ভয় আছে?
ভূতের ভয়!
হুঁ হুঁ, গেছো ভূতের ভয়! নির্ঘাত আছে, তাই না?
নির্ঘাত আছে!, সত্য মুখ নেড়ে বলে, এলেন আমার গণকার ঠাকুর!
নেই ভয়? ঠিক বলছিস? এই ঝিকিমিকি বেলায় তোদের সেই বটগাছতলায় যেতে পারিস? সে যেতে আর হয় না। হুঁ, জনমনিষ্যি যায় না সেখানে।
ওরে আমার কে রে? কেউ যায় না সেখানে? তুই যাস না তাই বল। তুইও কম খেলিস নি সেখানে, তবু মায়ামমতা নেই। আমাদের কথাই আলাদা, আমি আর পুণ্যি যাই নি যেন।
তা হঠাৎ ন্যাকা হচ্ছিস কেন রে নেড়ু? পেঁচার চোখ গুনতে যেতাম না আমরা?
আরে সে তো আগে। এখন শ্বশুরঘর করে করে সাহস হরে যায় নি?
ইল্লি রে! গেলেই হল! চল্ না দেখিয়ে দিচ্ছি, একপোর রাত অবধি বসে থাকতে পারি, তা জানিস?
বলে গটগট করে এগিয়ে যায় সত্য নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে, এই কনে দেখা আলোতেও যেখানটা গভীর অন্ধকার।
কিন্তু কে ওখানে?
কে! কে!
প্রায় চেঁচিয়েই উঠছিল সত্য, সামলে নিল নেড়ুর ভয়ে। শুনতে পেলে আর রক্ষে রাখবে? সত্যর ভয়ের কথা ঢাক পিটিয়ে বেড়াবে।… কিন্তু লোকটা যে এদিকেই আসছে! পালাবে সত্য? উঁহু, এ নির্ঘাত নেড়ুর কোন কারসাজি, তা নইলে–
হঠাৎ একটা সম্ভাবনায় পা থেকে মাথা অবধি একটা তড়িৎপ্রবাহ বয়ে যায়, আর পরক্ষণেই সম্ভানাটা প্রত্যক্ষের মূর্তিতে দেখা দেয়!
ইস তুমি! তুমি এখানে যে—
জেনে বুঝেও বিস্ময়ের ভান করে সত্য।
নবকুমার হতাশ গলায় বলে, কেন আর, তোমারই দর্শন আশায়! উঃ বাপেরবাড়ি এসে একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে গেছ, লোকটা মরল কি বাঁচল খোঁজও নেই!
সত্য পুলক গোপনের ব্যর্থ চেষ্টায় হেসে ফেলে বলে, আহা, কথার কি ছিরি রে! আমিই তো খোঁজ করে বেড়াব!
তা একবার দেখা তো দেবে? আমি হতভাগ্য যাই অনেক বুদ্ধি খেলিয়ে—
তা তো দেখতেই পাচ্ছি। নেড়ু ছাড়া আর কারুর কানে গেছে নাকি?
নাঃ, শুধু ও_
যাক, তবে ঠিক আছে। নেড়ু বিশ্বাসঘাতক নয়। তা বলি দরকারটা কি?
দরকার! নবকুমার আরো হতাশ গলায় বলে, বিনি দরকারে বুঝি নিজের পরিবারকে একটু দেখতে ইচ্ছে করে না? তোমার মতন পাষাণহৃদয় তো নয়?
পাষাণহৃদয়! তা বটে।
সত্য অনুচ্চস্বরে হেসে ওঠে। তারপর বলে, কেমন লাগছে?
খুব ভালো। নবকুমার অকপটে বলে, মাইরি বলছি, স্বপ্নেও ভাবি নি শ্বশুরবাড়িটা আমার এমন! কী ঐশ্বয্যি, কী দবদবা! দেশটাও চমৎকার! মা গঙ্গা দেখলে প্রাণ জুড়োয়!
সত্য একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, তবেই বোঝ, মেয়েমানুষকে কতটি ত্যাগ করতে হয়!
তা সত্যি।
নবকুমার আরও একবার অকপটে স্বীকার করে, এসে অবধি সেই কথাই ভাবছি। বলতে গেলে তুমি তো একটি রাজকন্যে। সে তুলনায় আমি
আবেগের মাথায় বেশী কিছু বলে ফেলার আগে সত্য সামলে দেয়, দুগগা দুগগা, ও কি কথা! তুমি হলে স্বামী, গুরুজন। রাজকন্যের কথা নয়, তবে প্রাণটা হু-হু করতে পারে কি না!
একশোবার পারে। হাজারবার পারে।
বলে নবকুমার অসমসাহসিকতায় ভর করে হাতটা বাড়িয়ে সত্যর কাঁধে একটা হাত রাখে।
তা সত্য কি এই স্নেহস্পর্শে অথবা প্রেমস্পর্শে পুলকিত হয় না? হয়। তবু মেয়েলী সাবধানতায় চুপি চুপি বলে, এই সরে দাঁড়াও, কে কমনে দেখে ফেলবে, এরপর আর তাহলে জনসমাজে মুখ দেখাবার জো রইবে না! খিড়কির পুকুর বৈ গতি থাকবে না!
নবকুমার কিন্তু এ ভয়ে ভীত হয় না। বরং আরও একটা হাত স্ত্রীর আরও একটা কাঁধে দিয়ে ঈষৎ আকর্ষণের ভঙ্গীতে বলে, কেন, পরপুরুষ নাকি?
না হোক, লোক-লজ্জা বলে একটা জিনিস তো আছে।
সে যদি বলল, এখানে নিরালায় চুপি চুপি দেখাতেই নিন্দে হতে পারে, কিন্তু তোমার ভাই তো বলেছে এখানে কেউ আসে না।
তা আসে না বটে…
সন্ধ্যের অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে
নবকুমার হঠাৎ একটা কবি-কবি কথা বলে বসে, তা সত্যি। তোর বাবাকে ইয়ে শ্বশুরঠাকুরকে দেখলে আমার এমনি বটবৃক্ষের কথা মনে আসে। বিরাট বটবৃক্ষ।
সত্য চমকে ওঠে।
সত্য অভিভূত হয়!
আর তারই আবেগে হঠাৎ লোকলজ্জা ভুলে নবকুমারের হাত দুটো হাতে চেপে ধরে বলে, সত্যি বলছ? আমার বাবাকে তোমার ভাল লেগেছে?
ভাল লাগার কথা বলতে পারছি না, বলছি ভক্তির কথা সমীহের কথা। বিরাট বটবৃক্ষ দেখলে যেমন সমীহ আসে
কথা কয়েছ বাবার সঙ্গে?
কথা? ওরে বাস! তিনি কোথায়, আমি কোথায়? কত ব্যস্ত মানুষ, দূরে থেকেই দেখছি
সত্য আবৃছা বিহ্বল গলায় আস্তে বলে, বাবাকে সবাই দূরে থেকেই দেখে। সবাই। মা পর্যন্ত। শুধু এই সত্য মুখপুড়ীই
লোকলজ্জা আরও বিস্মৃত হয়ে সত্য নবকুমারের তৃষিত বক্ষে মাথাটা রাখে।
নবকুমারও অবশ্য বেশ কিছুটা সময় এই মধুর আস্বাদের সুযোগ গ্রহণ করে নেয়, তারপর চুপি চুপি বলে, নতুন জামাই, প্রথম এলাম এমন একটা শোক-দুঃখুর উপলক্ষে। কারুর বে-থায় এলে অবিশ্যিই আমাদের দুজনকে ঘর দিত, কি বলো?”
সত্য এই মেয়েলী কথাটা শুনে হেসে ফেলে। হেসে বলে, দিলেই বুঝি নিতাম?
নিতে না?
পাগল! ঘটে লজ্জা নেই বুঝি? বর বস্তুটা শ্বশুরবাড়িতেই ভাল, বুঝলে?
নবকুমার অভিমানভরে বলে, বুঝলাম। তাই এই হতভাগা চলে যাবার পর আরও দু’মাস ভাল করে থাকা হবে।
সত্যর মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ-শিহরণ খেলে যায়। দু’মাস কি কত মাস কে জানে! পিস্ঠাকুমা তো সেই মোক্ষম কথাটা বলে বসেছে। আসার সময় সদুদি যা বলে ভয় জন্মিয়ে দিয়েছিল।… ক্রমশ সত্যও যেন অনুভব করছে, শরীরের মধ্যে কোথাও একটা অস্বস্তি বাসা বেঁধেছে… মনে হচ্ছে যেন গলার কাছটাতেই প্রধান অস্বস্তি। কেবলই যেন ভেতর থেকে ঠেলা মারছে, খাদ্যবস্তু নামতে চায় না, উঠে আসার তাল করে।….. ওই খাওয়া থেকেই ধরে ফেলেছে পিসঠাকুমা। আর সঙ্গে সঙ্গে নানাখানা বিষয়ের উপদেশ দিয়ে জব্দ করেছে। তার মধ্যে প্রধান নিষেধ ছিল… সাজ-সন্ধ্যেয় আগানেবাগানে গাছতলায় না যাওয়া।
তা সত্য নিষেধটা মানছে ভাল!
হঠাৎ একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে সত্য। বলে, যাই রাত হয়ে যাচ্ছে, বকবে!
এখানে আবার বকবে কে? নবকুমার নিশ্চিন্তে বলে, এখানে তো তুমি মহারানী। নেড়ু আমায় সব বলেছে। কী আদুরে মেয়ে তুমি, কী লাঞ্ছনাতেই পড়েছ–
সত্য এবার নিজস্ব দৃঢ়তায় ফেরে।
দৃঢ়স্বরে বলে, ওসব কথা বলছ কেন? যার যা নিয়তি। শ্বশুরঘরে বকুনি-ঝকুনি আর কোন মেয়েটার নেই? ছাড়ো ওকথা। যাচ্ছি–
নিতান্তই যাবে? কি আর বলব? আবার কবে দেখা হবে?
তা কি করে বলি!
আমি তো এই সামনের বুধবারে চলে যাব, তার মধ্যে একবার হবে না?
আচ্ছা দেখি!
নবকুমার আস্তে আস্তে বলে, ইচ্ছে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই। কী বাড়ি! সদাই সরগরম! আর আমাদের বাড়িতে যেন
তা হোক। নিজের যা তাই ভাল। সত্য আবার দৃঢ়স্বরে বলে, তুমিও কালে-ভবিষ্যতে দশের একজন হবে, তোমার সংসারও তেমনি সরগরম হবে।
আমার? হু! সে যাক্, কবে আবার গরীবের ঘরে যাবে?
সত্য ঝপ করে বলে বসে, বলতে পারছি না, ছ মাস এক বছরও হতে পারে
ছ মাস এক বছর! নবকুমার বিহালভাবে বলে, তার মানে?
আছে মানে। বলে হঠাৎ তুরিগতিতে দৌড় দেয় সত্য।
যদিও ঘরে-পরে সবাই বলছে, কী বড়ই হয়েছে সত! বলছে, রূপ যেন ফেটে পড়ছে, কী বাড়বাড়ন্ত গড়নই হয়েছে– তথাপি দৌড়ঝাপের কমতি নেই তার
তবে পিসঠাকুমার সামনে আর দৌড়ঝাঁপ চলবে না মনে হচ্ছে।
নবকুমার অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আকাশপাতাল চিন্তা করে। তারপর সিদ্ধান্তে আসে কিছুই নয়, মেয়ে অনেক দিন শ্বশুরঘর করছে, মা-বাপ এবার হাতে পেয়ে আটকে ফেলবে।
.
হেসে খেলে পাড়া বেড়িয়ে বেড়াচ্ছিল সত্য, এখানে আসার প্রাক্কালে সদু যে সন্দেহ প্র! করেছিল সেটাকে চোখ বুজে অস্বীকার করে। ভিতরে যদি কোনো অস্বস্তির আলোড়ন অজানা এক ভয়ের ছায়া ফেলেও থাকে, বাইরের আলোড়নে সেটা মুছে গেছে।
চট করে কারো সন্দেহও আসে নি, কারণ সত্য কতক্ষণই বা কার চোখের ওপর আছে? যজ্ঞের আনুষঙ্গিক জের নিয়ে ব্যস্ত সবাই। হঠাৎ একদিন সন্দেহ জাগল ভুবনেশ্বরীর। যে মা চোখ দুটো সহস্র কাজের মধ্যেও সত্যর চোখ-মুখের কাছাকাছিই আছে।
সন্দেহ জাগতেই চুপি চুপি সারদার কাছে ব্যক্ত করল ভুবনেশ্বরী, আর সারদাও লক্ষ্য ঘনীভূত করে নিঃসংশয় হল।
ব্যস, মুহূর্তে এ-মুখ থেকে ও-মুখ, এ-কান থেকে ও-কান। গ্রামসুদ্ধ মহিলা খবরটা জেনে ফেললেন একটা বেলার মধ্যেই। মহিলাদের মারফৎ পুরুষরাও।
কিন্তু রামকালীর কানে উঠতে কিছুটা দেরি হয়েছিল। কারণ মাতৃবিয়োগের পর থেকে বাড়ির ভিতর শুচ্ছিলেন না রামকালী। পুরোপুরি কালাশৌচের কালটা যে এই নিয়মেই চলবেন তিনি, সেটা যেন অদৃশ্য কালিতে লেখা হয়ে গিয়েছিল।
ভুবনেশ্বরী তবে কোন উপায়ে এই ভয়ঙ্কর আনন্দের বার্তাটা তার কানে পৌঁছে দেবে?
উপায় হচ্ছে না, অথচ এই অপরিসীম আনন্দের ভাবটা একা একা বহন করাও কঠিন মনে হচ্ছে।
দু’দিনেই দু বছর হয়ে ওঠে ভুবনেশ্বরীর।
তবু এ ইচ্ছেও হচ্ছে না, আর কেউ বলে ফেলুক। এই মধুর সুন্দর ভয়ঙ্কর রমণীয় খবরটি ধীরে ধীরে একটি উপহারের মত ধরে দেবে স্বামীকে, এই বাসনায় মর্মারিত হয়ে ওঠে ভুবনেশ্বরী।
কিন্তু নিজ কণ্ঠে সে উপহার দেওয়া আর ঘটে উঠল না তার। রামকালীর খেতে বসার সময় হঠাৎ মোক্ষদা দুম করে বলে বসলেন। বললেন, বললে তোমার মাথায় থাকবে কিনা জানি না, তবু বলা কর্তব্য তাই বলছি, দাদামশাই হতে চললে!
রামকালী চমকে তাকালেন।
কথাটা ঠিক বোধগম্য হল না।
মোক্ষদা এসব পছন্দ করেন না। অতএব তিনি আরও স্পষ্ট প্রখর ভাষায় বলে ফেলেন, বাংলা বৈ উর্দু ফার্সি বলছি না বাবা, বলছি সত্যর ছেলেপুলে হবে!
রামকালী সহসা বিষম খেলেন।
জলের গ্লাসটা মুখে ঠেকিয়ে নামিয়ে রাখলেন, তাপর ঘাড় নিচু করে যেন পাতের ভাতের মধ্যে কথাটার অর্থ খুঁজতে লাগলেন।
না, কথা তিনি এখন কইবেন না। আচমন করে বসেছেন। কালাশৌচের বছরটা রীতিমত বিধিনিষেধের মধ্যে থাকতে চান। এসবে বিশ্বাসী তিনি কোনদিনই নন, কিন্তু মানুষের মন যে কত জটিল জিনিস, দীনতারিণীর মৃত্যুতে তা আর একবার দেখা গেল– রামকালীর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আচারনিষ্ঠা দেখে।
কথা কইবেন না। অতএব উত্তরও মিলবে না।
তবু এই সময়টুকু ছাড়া রামকালীকে পাচ্ছে কে? কাজেই যাবতীয় জ্ঞাতব্য বিষয় এই সময়েই রামকালীর কর্ণকুহরে ঢালার পক্ষে প্রকৃষ্ট।
বিষম খাওয়া শেষ হলে মোক্ষদা আর একবার বলেন, আমি এই জানিয়ে দিলাম, এখন তোমার গুণবতী বেয়ানকে জানাবার কি ব্যবস্থা করবে তা দেখ! মাগীকে তো দিয়ে থুয়েও মন পাওয়া যায় না! এক ঝাক মণ্ডা আর এক জালা তেল দিয়ে পাঠাও কাউকে, তার সঙ্গে পাদ্য-অর্ঘ্য!
.
রামকালী খেয়ে চলেছেন, ওদিকে ভুবনেশ্বরীর চোখে জল। যে খবর শুনে রামকালীর আহ্লাদে প্রাণ উথলে ওঠার কথা, সেই খবর দেওয়া হল কিনা তার মৌনকালে। কেন খাবার সময় ছাড়া আর দেয়া যেত না?
তাছাড়া ভুবনেশ্বরীর আর আকাঙক্ষা আর উদ্বেগ আনন্দে কম্পমান হৃদয়টি তার দল মেলে বিকশিত হয়ে উঠতে পেল না।
অবিশ্যি এত সুচারু করে কি আর ভাবতে পারল ভুবনেশ্বরী?
তা নয়।
শুধু চোখের সেই জলের ধারাটা যেন অবিরল হয়ে উঠল নানা অনুভূতি আর অব্যক্ত বেদনার ধাক্কায়।….
মোক্ষদা শেষ অস্ত্রটি ত্যাগ করে, আর একটা কথা না বলে বাচছি না, মেয়ে তো তোমার এতদিন শ্বশুরঘর করেও কিছুমাত্তর বদলায় নি! যে ধিঙ্গী সেই ধিঙ্গী! সাঁঝ-সন্ধ্যের মানে না, ডিঙানো মাড়ানো গেরাহ্য করে না, আগান-বাগান, ঘাট, পুকুর, ছিষ্টি মাড়িয়ে বেড়াচ্ছে! আমি বারণ করতে গিয়ে শুধু হাস্যাস্পদ হয়েছি মাত্তর, এখন তুমি দেখ যদি শাসন করতে পারো!
রামকালীর কি আজ গলা দিয়ে ভাত নামছে না? তাই এত দেরি হচ্ছে খেয়ে উঠতে?
মোক্ষদার এত অবসর নেই বসে থাকবেন, বড়বৌমা দেখো শ্বশুর আর কিছু নেয় কিনা বলে চলে যান মোক্ষদা।
রাগ হয়েছে তাঁর। হলেই বা মৃত্যুশোক, তাই বলে এমন সুখবরে মুখটা প্রসন্ন করবে না? এত কী! যাক, সত্যর শ্বশুরবাড়ি খবর পাঠানোর ব্যবস্থা তাকেই করতে হবে। এ তিনি জানেন। এটা মেয়েলি কাজ।
সারদা অদূরে বসে আছে পাখা হাতে, তার ওপরই শ্বশুরকে দেখার নির্দেশ।
হ্যাঁ, সারদাই বসে একগলা ঘোমটা দিয়ে। এটা তার সর্বশ্রেষ্ঠ কর্তব্য। দীনতারিণী, মোক্ষদা, কাশীশ্বরী, শিবজায়া যে কেউই কাছে থাকুন, খাওয়ার তদারকি করুন, সারদা তফাৎ বাচিয়ে বসে পাখা নাড়বেই।
আর কে করবে?
ভুবনেশ্বরী তো আর এই একবাড়ি গিন্নীর সামনে লজ্জার মাথা খেয়ে স্বামীর খাওয়ার তদারক করতে আসবে না।
মোক্ষদা চলে যেতে রামকালী উঠলেন।
দাওয়ার ধারে চকচকে করে মাজা গাড় ও তার উপর পাট করা কাঁচা গামছা রক্ষিত আছে আঁচানোর জন্যে, তবু হঠাৎ কি ভেবে চলে গেলেন ঘাটে। হবিয্যের সময় ঘাটে মুখ প্রক্ষালন করাটা বিধি ছিল বটে, কিন্তু এখন কেন?
যে জন্যেই যান–
আজ ভুবনেশ্বরী ভয়ঙ্কর এক অসমসাহসিক কাজ করে বসল। দ্রুতপায়ে রান্নাঘরের পিছনে গলির বেড়ার দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে, মেয়েঘাটের আবরু স্বরূপ আড়াল করা যে ঝোঁপঝাড়গুলো আছে, তার পাশ দিয়ে এগিয়ে প্রায় পুরুষঘাটের কাছ-বরাবর দাঁড়িয়ে থাকল।
রামকালী হাতমুখ ধুয়ে ফেরার পথে চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলেন, এ কী, তুমি এখানে?
ভুবনেশ্বরী ঘোমটার মধ্যে থেকেই রুদ্ধকণ্ঠে বলে, তা কি করবো! চোরে কামারে তো দেখা নেই, একটা কথার দরকার থাকলে–
রামকালী প্রায় বিরক্ত স্বরে বললেন, তা এইটা কি কথার জায়গা?
ভুবনেশ্বরীর চোখে যে ধারাশ্রাবণ, তা ঘোমটার মধ্যে থেকেই ধরা যায়।
সেই শ্রাবণ-বর্ষণের মধ্যেই তার কথা শোনা যায়, কখন তোমায় পাচ্ছি?
রামকালী ঈষৎ শান্তস্বরে বলেন, তা কথাটা কি, বলে নাও চটপট! চারিদিকে লোকজন
বলছি–সত্যর কথা–
রামকালীর গলায় কেমন একটা বিরূপ গম্ভীর স্বর বাজে, হ্যাঁ শুনলাম। ওর দিকে একটু লক্ষ্য রাখবে। বেশী দৌড়ঝাঁপ না করে। যাও, বাড়ির মধ্যে যাও।
ভুবনেশ্বরীর শরীর একটা মূক অভিমানে কেঁপে ওঠে, আর কথা বলে না সে, আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে সরে আসে।
তার গতিভঙ্গীর দিকে তাকিয়ে রামকালীর একবার মনে হয়, আর একটু নরম করে কথা বললে ভাল হত। নির্বোধ মানুষটা মেয়ের এই সংবাদে ভয়ে সারা হচ্ছে। কিন্তু কি করবেন রামকালী, এটা তো আর স্ত্রীর সঙ্গে গালগল্পের জায়গা নয়!
ভাবেন কোনো এক সময় বলে দেবেন, ভয় পাবার কিছু নেই।
কিন্তু কোন সেই সময়?
রামকালী জানেন কি?
জানেন কি স্ত্রীর সঙ্গে গালগল্প করা কি বস্তু? স্নেহ প্রেম ভালবাসা এগুলো ব্যক্ত করার বস্তু নয়, এটাই জানেন রামকালী।
সত্যর শ্বশুরবাড়িতে খবর পাঠতে কাকে নির্বাচন করা যায়, তাই ভাবতে ভাবতে চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে বসেন রামকালী।
.
মোক্ষদা চলে আসেন।
এবং তোড়জোড় লাগিয়ে দেন সত্যর শ্বশুরবাড়িতে খবর দেবার।
গিরি তাঁতিনী যাবে।
গরুরগাড়ি নিয়ে রাখুও যাবে। গিরির জন্যে তসর শাড়ি আসে, রাখুর জন্যে হলুদে ছোপানো ধূতি-চাঁদর। মস্ত একটা পেতলের হাঁড়িতে একহাঁড়ি ঘানিভাঙা তেল, আর মস্ত একটা মটকিতে বোঝাই কাঁচাগোল্লা। এ দৃশ্য দেখলেই ঘটনাটা বুঝতে পারবে সত্যর শাশুড়ী, মুখ ফুটে বলতেও হবে না।
ওরা বেরোবার মুখে রামকালী হঠাৎ থামান। মোক্ষদাকে উদ্দেশ করে একগেঁজে টাকা বাড়িয়ে ধরে বলেন, সেখানে লোকজন সবাইকে যেন পরিতোষ করে আসে, দিয়ে দাও গিরির হাতে।
সংসারসুদ্ধ সবাই আহ্লাদে ভাসছে, দীনতারিণীর মৃত্যুশোক এ আহ্লাদকে পরাভূত করতে পারছে। শুধু রামকালীই যেন পরাভূত হয়ে যাচ্ছেন, চেষ্টা করেও তেমন আহ্লাদ আনতে পারছেন না।
যেন রামকালীর কী একটা লোকসানই ঘটেছে।
সত্য বড় হয়ে যাচ্ছে, সত্য বড় হয়ে গেছে!
গিয়েই তো ছিল। তবু যেন কোথায় একটু আশা ছিল। মাতৃশ্রাদ্ধের বিরাট কাজের মধ্যে দেখছিলেন সত্যর ছুটোছুটি আসা-যাওয়া গালগল্প। মনে করছিলেন যা ভাবছিলাম তা নয়, শুধু শ্বশুরবাড়ির চাপে পড়েই
ভাবছিলেন হাতের কাজটা হালকা হলেই সত্যকে ডেকে কাছে বসিয়ে কথা বলবেন।
কাজ না মিটতেই মোক্ষদা এলেন ভগ্নদূতের মূর্তিতে।
আর কাকে “কাছে” বসাবেন রামকালী?
অনেক দূরে চলে গেল যে সে।
নাঃ, কাছে আর কোনোদিন পাবেন না তাকে রামকালী।
এক নতুন চক্রের চক্রান্তে পড়ে অন্য আর এক রাজ্যের প্রজা হয়ে গেছে সত্য।
সে রাজ্য প্রমীলার রাজ্য, সে চক্রান্ত বিধাতার চক্রের।