০৩. দীনতারিণী নিরামিষ ঘরে

দীনতারিণী নিরামিষ ঘরে রান্না করছিলেন, সত্যবতী দাওয়ার নীচের ছাঁচতলায় এসে দাঁড়াল। উঁচু  পোতার ঘর। দাওয়ার কিনারাটা সত্যবতীর নাকের কাছাকাছি, পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর সমস্ত দেহভারটা দিয়ে ডিঙি মেরে গলা বাড়িয়ে সত্যবতী তার স্বভাবসিদ্ধ মাজাগলায় ডাক দিল, অ ঠাকুরমা, ঠাকুরমা!

নিরামিষ হেঁসেলের দাওয়ায় ওঠবার অধিকার সত্যবতীর কেন, বাড়ির মেটে দাওয়ার একপেশে কোণা থেকে খাজ কেটে সিঁড়ি বানানো হয়েছে, আর সে সিঁড়ি থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়া পথ হয়েছে একেবারে ঘাট বরাবর। দীনতারিণী, দীনতারিণীর সেজজা শিবজায়া, দীনতারিণীর দুই ননদ কাশীশ্বরী আর মোক্ষদা–মাত্র এঁরাই এই পথে পদক্ষেপের অধিকারিণী। ঘড়া নিয়ে ঘাটে যান এবং স্নান সেরে ঘাড়া ভরে ভিজে কাপড়ে পায়ে পায়ে এসে একেবারে ওই সিঁড়ি কটি দিয়ে স্বৰ্গে উঠে পড়েন। ওই রান্নাঘরের দেওয়ালেই তাদের কাঁচাকাপড় শুকোয়, কারণ রাত্রে তো আর এঘরে রান্নার পাট নেই। ঘর নিকোনোর কাজেও কিছু আর অছ্যুৎরা কেউ এসে ঢুকবে না। সে কাজ মোক্ষদার। এটোসিকড়ির ব্যাপারে মোক্ষদা বোধ করি স্বয়ং ভগবানকেও সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারেন না। কাজেই সে কাজ নিজের হাতে রাখেন। তা ছাড়া মোক্ষদাই বয়সে সব চেয়ে ছোট, অন্যান্যরা সকলেই তাঁর গুরুজন, অতএব সকলের খাওয়ার শেষে তারই ডিউটি।

রান্নার দায়িত্ব দীনতারিণীর, মোক্ষদার ওপর সে রান্নার বিশুদ্ধতা রক্ষার দায়িত্ব। বাকি দুজন যোগাড়ে। তা অবিশ্যি যোগাড়ের কাজটাও কম না। প্রয়োজনটা চারজনের হলেও আয়োজনটা অন্তত দশজনের মত হয়।

কিন্তু এসব কথা থাক।

আসলে ছেলে।পুলের এ উঠোনে পা দেবারও হুকুম নেই, কিন্তু সত্যবতীকে কেউ এঁটে উঠতে পারে না। ও যখন তখন দাওয়ার নিচে থেকে নাক বাড়িয়ে হাঁক পাড়ে, অ-ঠাকুরমা অথবা অ-পিসঠাকুরমা!

দীনতারিণী ওর গলা পেয়েই নিজের গলাটা বাড়িয়ে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বলেন, এই মলো যা, এ ছড়ি কি দস্যি গো! আবার এসেছিস? বেরো বেরো, ছোটঠাকুরঝি দেখতে পেলে আর রক্ষে রাখবে না!

সত্যবতী ঠোঁট উল্টে বলে, ছোটঠাকুরমার কথা বাদ দাও। তুমি শোন না একটু।

সত্যবতী দীনতারিণীর উপায়ী ছেলের মেয়ে, তাছাড়া সত্যর বিয়ে হয়ে গেছে, কাজেই খুব দূর-ছাইটা ওর কপালে জোটে না। তাই ওর আবদারে অগত্যাই দীনতারিণী একটু ডিঙি মেরে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালেন। ইশারায় বললেন, কি চাই?

সত্যবতী পিঠের দিকে গোটানো হাতটা ঘুরিয়ে একখানা ছোট মাপের কচি মানপাতা মেলে ধরে চুপি চুপি বলে একটা জিনিস দাও না!

এই মরেছে, এখন আবার জিনিস কি রে? এখন কি কিছু রান্না হয়েছে? আর হলেও তোর সেজঠাকুরমার গোপালের ভোগের আগ আগে দিয়েছি, টের পেলে কুরুক্ষেত্তর করবে না?

আগ চাই নি, আগ চাই নি, ভালমন্দ রোধে নিজেরাই খেয়ো বাবা, আমাকে একমুঠো পান্তাভাত দাও দিকি!

পান্তাভাত?

দীনতারিণী আকাশ থেকে পড়লেন। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন পাতাল ফুড়ে উঠলেন মোক্ষদা। রনে সপাসপে। ভিজে থান, কাখে ভরন্ত কলসী।

এইটা বোধ করি মোক্ষদার তৃতীয় দফা স্নান।

যে কোন কারণেই হোক, চাল ধুতে কি শাক ধুতে ঘাটে গেলেই মোক্ষদা একবার সবস্ত্ৰ স্নান সেরে নেন। দাওয়ার পৈঠে দিয়ে কখন যে উঠে এসেছেন, ঠাকুরমা নাতনী কারো চোখে পড়ে নি, চোখ পড়লো একেবারে সশরীরিণীর উপর।

দীনতারিণী অপ্ৰতিভের একশেষ, সত্যবতী বিরক্ত।

আর মোক্ষদা?

তিনি হাতেনাতে চোর ধরে ফেলা ডিটেকটিভের মতই উল্লসিত।

আবার তুই এখেনে! খনখনে গলায় প্রশ্ন করেন মোক্ষদা।

সত্যবতী ঈষৎ আমতা আমতা করে বলে, বাঃ রে, আমি কি তোমাদের দাওয়ায় উঠেছি?

দাওয়ায় উঠিস নি, বলি সকড়ি রাস্তা মাড়িয়ে এসে সেই পায়ে ওই উঠোনে তো পা দিয়েছিস! তুলসী গাছে জল দিতে উঠোনে নামতে হবে না। আমাদের?

সত্যবতী গোজ গোজ করে বলে, নামবার সময় তো দশঘড়া জল না ঢেলে নামো না, তবে আবার অত কি?

মুখে মুখে চোপা করিসনে সত্য, অব্যেস ভাল করা, মোক্ষদা ঘড়াটাকে দুম করে রান্নাঘরের চৌকাঠের ওপিঠে বসিয়ে আঁচল নিংড়ে নিংড়ে পায়ের কাদা ধুতে ধুতে বলেন, বাপের সোহাগে যে একেবারে ধিঙ্গী পদ পেয়ে বসে আছিস, বলি শ্বশুরঘর করতে হবে না? পরের বাড়ি যেতে হবে না? আর কদিন ধিঙ্গীনাচ নেচে বেড়াবি? মেরে কেটে আর দুটো-চারটে বছর, তাপর গলায় রসুড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাবে না? তখন করবি কি?

প্রতি কথায় এই পরের ঘরে যাওয়ার বিভীষিকা দেখিয়ে দেখিয়ে জব্দ করার চেষ্টাটা দু-চক্ষের বিষ সত্যবতীর। বরং তাকে ওরা ধরে দু-ঘা মারুক, সহ্য হবে। কিন্তু ওই পরের ঘরের খোঁটা সয় না। অথচ ওইটিই যেন এদের প্রধান ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ। সত্যবতী তাই বিরক্তভাবে বলে, করবো। আবার কি!

কি আর করবি? উঠতে বসতে শাউড়ীর ঠোনা খাবি। ওই পটলা ঘোষালের ভাইপো-বেঁটার মতন ঠোনা খেতে খেতে গালে কালসিটে পড়ে যাবে।

সত্যবতী বয়েস-ছাড়া ভঙ্গীতে ঝঙ্কার দিয়ে বলে ওঠে, ছিষ্টি সংসারের লোক তো আর পটলকাকার ভেজের মতন দজল নয়!

ওমা ওমা, শোন কথা মেয়ের, মোক্ষদা হত্তেলের রং নিটোল টাইট হাত দুখানা নেড়ে বললেন, তা বলবি বৈকি! বোর দোষ হলো না, দোষ হলো শাউড়ীর! অবাধ্য চোপাবাজ বৌকে কি করবে শুনি? টাটে বসিয়ে ফুল-চন্দন দিয়ে পূজো করবে?

আহা পূজো করা ছাড়া আর কথা নেই যেন! একটু ভাল চোখে চাইতে পারে না! দুটো মিষ্টি কথা বলতে পারে না!

ও মাগো! মোক্ষদা খনখনে গলায় হেসে উঠে বলেন, ভেতরে ভেতরে মেয়ে পাকার ধাড়ি হয়েছেন! দেখবো লো দেখবো, তোর শাউড়ী কি মধুঢালা কথা কইবে! কত সোনার চক্ষে দেখবে!… সে যাক, বলি পান্তাভাতের কথা কি বলছিলি?

এতক্ষণ চুপ ছিলেন, এবারে দীনতারিণী হাসেন।

হেসে ফেলে বলেন, ও আমার কাছে এসেছে পান্তাভাত চাইতে।

পান্তাভাত চাইতে এসেছে! মোক্ষদা সহসা যেন ফেটে পড়েন, আমাদের হেঁসেলে পান্তা চাইছে, আর তুমি সেই শুনে গা পাতলা করে হাসছ নতুন মেজবৌ? আর কত আহ্লাদ দেবে নাতনীকে? পরকাল যে ঝরঝরে হয়ে যাচ্ছে! বলি শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যদি বিধবার হেঁসেল থেকে দুটো পান্তা চেয়ে বসে, তারা বলবে কি? একথা ভাববে না যে, আমরা বুঝি গপগপ কয়ে বাসিহাঁড়ির ভাতগুলো গিলি! বলো বলবে কি না?

তাই কখনো কেউ বলে ছোটঠাকুরঝি! দীনতারিণী কথাটা হালকা করতে একটু কষ্টহাসি হেসে বলেন, ছেলে-বুদ্ধি অজ্ঞানে কি না বলে!

ছেলে-বুদ্ধি! ও মা লো! সোয়ামীর ঘর করতে পাঠালে ও এখন ছেলের মা হতে পারে, বুঝলে নতুন মেজবৌ! মোক্ষদা কাঁধ থেকে গামছাখানা নিয়ে জোরে জোরে ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, মেয়ের বাক্যি-বুলি শোন না তো কান দিয়ে? সোহাগেই অন্ধ! এই তোকে সাবধান করে দিচ্ছি সত্য, খবরদার পাঁচজনের সামনে এমনি বেফাঁস কথা বলে বসবি না! পাড়াপাড়শী উনুনমুখীরা তো মজা দেখতেই আছে, এমন কথাটা শুনলে ঠিক বলবে আমরা বাসি হাঁড়িতে খাই!

হঠাৎ হি-হি করে হেসে ওঠে সত্যবতী, হেসে বলে, লোকে বললেই বা! বললে কি তোমার গায়ে ফোস্কা পড়বে!

মোক্ষদা নেহাৎ মেয়েটাকে ছুতে পারবেন না, তাই নিজের গালেই একটা চড় মেরে বলেন, শুনলে নতুন মেজবৌ, তোমার নাতনীর আস্‌পদ্দার কথা? বলে কি না লোকে বললেই ব! ডাক শাস্তরের কথা, যাকে বললো ছি, তার রইলো কি? আর বলে কি না—

সেরেছে!

দীনতারিণী ভাবেন মোক্ষদা একবার মুখ ধরলে তো আর রক্ষে নেই! দুৰ্দান্ত স্বাস্থ্য মোক্ষদার, দুরন্ত ক্ষিদে-তেষ্টা, সেই ক্ষিদে-তেষ্টা চেপে রেখে তিন পহর বেলায় জল খায়, বেলা গড়িয়ে অপরাহ্ন বেলায় ভাত, সকালের দিকে শরীরের মধ্যে ওর খা খা বা ঝা করতে থাকে। তাই কথার চোটে থরহরি করে ছাড়ে সবাইকে।

প্ৰসঙ্গটা তাই তাড়াতাড়ি পরিবর্তন করেন দীনতারিণী, হ্যাঁ লা সত্য, সকালবেলা জলপান খাস নি? অসময়ে এখন পান্তাপাতের খোঁজ?

আহা কী বুদ্ধির ছিরি! সত্য ঝেজে ওঠে, আমি যেন খাবো! কেঁচো আর পান্তাভাত দিয়ে টোপ ফেলবো!

কি করবি? দীনতারিণীর আগেই মোক্ষদা দুই চোখ কপালে তোলেন, কি করবি?

টোপ ফেলবো, টোপা! মাছের টোপ! পেয়েছ। শুনতে? নেড় আমায় কঞ্চি চেঁচে খু-ব ভালো একটা ছিপ করে দিয়েছে, খিড়কির পুকুরে মাছ ধরবো।

সত্য! মোক্ষদা যেন ছিটাপিটিয়ে ওঠেন, ছিপ ফেলে মাছ ধরবি তুই? খুব নয় বোপসোহাগী আছিস, তাই বলে কি সাপের পাঁচপা দেখেছিস? মেয়ে ছিপ ফেলে মাছ ধরবি?

সত্য ঝাঁকড়া চুলে মাথা ঝাকিয়ে বলে, আহা! র কী বাক্যির ছিরি! মেয়েমানুষ মাছ ধরে না? রাঙা খুড়িমারা ধরে না? ও বাড়ির পিসিরা ধরে না?

আ মরণ মুখপোড়া মেয়ে! ওরা ছিপ ফেলে মাছ ধরে? ওরা তো গামছা ছাকা দিয়ে চুনোপুটি তোলে!

তাতে কি! সত্য হাতের মানপাতাখানা দাওয়ার গায়ে আছড়াতে বলে, গামছা দিয়ে ধরলে দোষ হয় না, ছিপ দিয়ে ধরলেই দোষ! চুনোপুটি ধরলে দোষ হয় না, বড় মাছ ধরলেই দোষ! তোমাদের এসব শাস্তর কে লিখেছে। গা?

সত্য! দীনতারিণী কড়াস্বরে বলেন, একফোঁটা মেয়ে, অত বাক্যি কেন লা? ঠিক বলেছে ছোটঠাকুরঝি, পরের ঘরে গিয়ে হাড়ির হাল হবে এর পর!

বাবা বাবা! দুটো পান্ত চাইতে এসে কী খোয়ার! যাচ্ছি। আমি আঁশ হেঁসেলের ওদের কাছে। যাবো কি? সেখানে তো আবার বড় জেঠি! গুলি ভাটার মতন চাউনি! খেঁদিদের বাড়ি থেকে নিলেই হত তার চেয়ে!

কি বললি! খেঁদিদের বাড়ি থেকে ভাত? কায়েত-বাড়ির ভাত নিয়ে ঘাঁটবি তুই?

ঘেঁটেছি নাকি? বাবাঃ বাবাঃ! ফি হাত তোমাদের খালি দোষ আর দোষ! আচ্ছা যাচ্ছি। আমি ও হেঁসেলেই। কিন্তু যখন ইয়াবড় মাছ ধরবো। তখন দেখো।

বলে সত্য আছড়ানোর চোটে চিরে চিরে যাওয়া মানপাতাটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যায় দাওয়ার কোণ-বরাবর ধরে ও মহলে।

সেখানে বিরাট এক কর্মকাণ্ড চলেছে অহরহ। দিনে দুবেলায় দুশো আড়াইশো পাত পরে।

সেখানেও এমনিই উঁচু পোতার রান্নাঘর, তবে দাওয়ায় উঠতে তেমন বাধা নেই। বেপরোয়া উঠে গেল। সত্য। আর এদিক ওদিক তাকিয়ে দাওয়ার কোণ থেকে একখানা খালি নারকেলের মালা কুড়িয়ে নিয়ে রন্ধনশালার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সাহসে ভর করে ডাকলো, বড় জেঠি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *