দেশের বাড়িতে আর এক চেহারা ছিল ভাবিনীর। সারাদিন গাধার মত খাটুনি, সারারাত মোষের মত ঘুম। সাত চড়ে মুখে ‘রা’ নেই। মামাশ্বশুরবাড়ির তামন্ত প্রাণীকে যমের মত ভয়।
কলকাতার বাসায় আসার আগে, এতখানি বয়েস পর্যন্ত নিতাইয়ের সঙ্গে কটা কথা বলেছে তার বৌ, বোধ করি হাতে গুনে বলতে পারে নিতাই। শুধু সেই অনেকদিন আগে যখন একবার বাসায় আসার কথা উঠেছিল, তখনই যা বৌয়ের একটু স্পষ্ট গলা শুনতে পেয়েছিল নিতাই।
বৌ বলেছিল, গলায় দড়ি আমার! লোকলজ্জা ভাসিয়ে গালে মুখে চুনকালি মেখে বাসায় যাব তোমার সঙ্গে?
আশেপাশে কোনোখান থেকে যে ‘আড়িপাতা’র লীলা চলেছে, এ জ্ঞান টনটনে থাকার দরুনই বোধ হয় বৌয়ের এই উচ্চ কণ্ঠ।
শুনে নিতাইয়ের চুন মুখ আরো চুন হয়ে গিয়েছিল।
পরদিন মামী বলেছিল, কি রে নিতাই, পরিবারকে বাসায় নিয়ে যাবি নাকি, তোর ওই পেরাণের বন্ধুটার মতন?
নিতাই উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, কী যে বল! ক্ষেপেছ?
মামী বলেছিল, দ্যাখো বাপু, ভবিষ্যতে আমায় দুষো না। বৌমাকে আমি বলেছিলাম, মনের বাসনা চেপে এখেনে পড়ে থাকার দরকার নেই, যাবে তো যাও। তা আবাগীর বেটি বলে কি, তোমাদের পা আঁকড়ে পড়ে থাকব, দেখি আমায় কে নিয়ে যেতে পারে তোমাদের আচ্ছয় থেকে।
মামীর কণ্ঠে পরিতৃপ্তির সুর ঝরে পড়েছিল।
আর নিতাই তার ধর্মপত্নীর ধর্মজ্ঞানের পরিচয়ে পরিতৃপ্ত হয়েই কলকাতায় এসে নবকুমারের সংসারে ভর্তি হয়েছিল।
কিন্তু সে তো সেই গোড়ার দিকের কথা।
তারপর তো কত জল গড়াল, কত জল ঘোলাল। নিতাইয়ের দশ দশা ঘটল। এবং অবশেষে বন্ধুপত্নীর নির্দেশে অথবা আদেশে আবার সেই পুরনো প্রস্তাব নিয়ে দেশে গেল!
ভেবেছিল বেশ একটু লড়তে হবে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এবারে বিনাযুদ্ধেই রাজ্য দখল হয়ে গেল। ঈশ্বর জানেন কে কোথায় কি কলকাঠি নেড়েছিল, তবে নিতাইয়ের বলার আগেই মামী বললেন, কতকাল আর ‘মেছে’র ভাত খাবি, বৌমাকে এবার নিয়ে যা।
মামাও তাই বললেন।
এবং দেখা গেল বৌ বিনাবাক্যে সুড়সুড় করে নিতাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করল। তার গায়ে যে চুনকালি পড়েছে, এমন মনে হল না ভাবগতিক দেখে।
তাহলে ব্যাপারটা এই
নিতাইয়ের চরিত্র-চ্যুতির খবর দেশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কারণ নিন্দে আর মন্দ খবরের পাখা থাকে। আর সে পাখা অনেক ‘অশ্বশক্তি’ সম্বলিত।
শুনে অবধি বৌ ধরাশয্যা নিয়েছিল, আর অভিভাবকরা চিন্তান্বিত হয়ে স্থির করেছিলেন, ঘাঁটি আগলাতে সেনাপতি পাঠানো প্রয়োজন। আর ইতিমধ্যে তো গ্রামের বেশ কয়েকটা বৌ-ই গ্রাম ছেড়েছে। মামীর নিজের বাপের বাড়ির গ্রাম থেকেই চার-চারটে বৌ জামালপুরে চলে গেছে। এখানের একটা গেছে কাঁচড়াপাড়ায়, একটা সাহেবগঞ্জে। রেলের চাকরি হয়েই ছেঁড়াগুলো সাপের পাঁচ পা দেখছে, লজ্জাসমের মাথা খেয়ে বৌ নিয়ে বাসায় যাচ্ছে।
অতএব নিতাইয়ের বৌ যদি কলকাতায় যায়ই, জাতিপাত হবে না। তা ছাড়া নেহাৎ অগঙ্গার দেশও নয় যখন। বরং কালীঘাটের কালীমাতা বিদ্যমান।
জমি আপনিই প্রস্তুত হয়ে ছিল।
তবে নিতাই এত জানত না। নিতাই এক কথায় মত পেয়ে অবাক হয়েছিল।
কিন্তু সে আর কতটুকু?
এখন নিতাইকে মুহূর্তে মুহূর্তে অবাক করছে ভাবিনী।
সে যেন আর এক মূর্তি পরিগ্রহ করেছে।
নিতাই কি স্বপ্নেও ভেবেছিল ভাবিনীর এত মুখ আছে?
কিন্তু ভাবিনীকেও দোষ দেওয়া যায় না।
প্রথম কথা, সে এসেছে ঘাঁটি রক্ষা করতে, বরকে শায়েস্তা করার ব্রত নিয়ে। দ্বিতীয় কথা, এই এতদিনের বিবাহিত জীবনে ‘মুখ’কে অবিরত চুপ করিয়েই রেখে এসেছে ভাবিনী, তা সে ভয়েই হোক আর সুখ্যাতি কিনতেই হোক। সেই রাখার একটা প্রতিক্রিয়া তো দেখা দেবেই।
তৃতীয় কথা হচ্ছে, এখন আর সে মুখকে চুপ করিয়ে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। অতএব এই দীর্ঘকালের রুদ্ধ জল বাঁধ ভেঙে প্রবল কল্লোলে নিজেকে বিস্তার করতে শুরু করেছে।
উঠতে বসতে নিতাই বাক্যবাণে জরজর!
অথচ উল্টে চড়ে ওঠবার মুখ তার নেই, কোথায় যেন হার হয়েছে তার। বোঝা যায় না হারটা কোথায়, অথচ কী এক লজ্জা মাথা তুলতে দেয় না।
আবার সব থেকে মর্মান্তিক এই, যেখানে নিতাইয়ের পূজার বেদী হৃদয়ের নৈবেদ্য, ঠিক সেখানেই যেন ভাবিনীর যত আক্রোশ। সত্যবতীর নামে জ্বলে ওঠে সে। অথচ কেন এই অগ্নিদাহ, হৃদয়ঙ্গম হয় না নিতাইয়ের। মানুষ জাতটা কি এতই অকৃতজ্ঞ।
নিতাই ভাবে, কার দয়ায় বাসায় আসতে পেলি তুই? কে তোর জন্যে সংসার গুছিয়ে রেখেছিল? কে তোর স্বামীকে বিপথ থেকে সুপথে আনল? এত স্বাধীনতা এত বাবুয়ানা থাকতো কোথায় তোর যদি সত্যবতী না সুপারিশ করত? ধান সেদ্ধ করতে করতে, ক্ষার কাঁচতে কাঁচতে আর পেঁকিতে পাড় দিতে দিতেই তো জীবন কাটছিল, আর তাই কাটত।
তা তার জন্যে কৃতজ্ঞতার বালাই মাত্তর নেই! জানে না নাকি! নিতাই তো কলকাতার বাসায় পা দিয়েই বলেছিল, এই যে গিন্নেপনার স্বাধীনতাটি পেলে, এর কারণ স্বরূপ হচ্ছে সেই মানুষটি! বৌঠান না হুকুম করলে কোন শালা এত ঝামেলা পোহাতে যেত।
ভাবিনীর যে ‘মুখ’ বলে একটা বস্তু আছে, সেই দিনই যেন হঠাৎ একটু আভাস পেয়েছিল নিতাই। ঝপ করে বলে উঠেছিল ভাবিনী, সভ্য শহরে বাসা করলে বুঝি কথাবাত্রা এমন চোয়াড়ে হয়!
তা ইদানীং কথাবার্তা একটু অসভ্য হয়ে গিয়েছিল নিতাইয়ের। যে সঙ্গের যে ফল! যে বন্ধু তাকে উচ্ছন্নের পথ চেনাচ্ছিল, সে নিজে যে দরের, তার গতিবিধিও তেমনি দরের ঘরে। কাজেই কথাবার্তা চালচলনে একটু প্রভাব পড়বেই, না পড়ে যাবে কোথায়?
নিতাই ‘শালা’ শব্দটা উচ্চারণ করেই ঈষৎ লজ্জিত হয়েছিল, ভাবিনীর মন্তব্যে আরো দমে গিয়ে বলল, এ্যাই দেখো! বাসায় পা দিতে না দিতেই যে গিন্নীত্ব শুরু করলে!
সেদিন ওইটুকুর ওপর দিয়েই গিয়েছিল।
কিন্তু দিনে দিনে কলা চাঁদ বেড়ে যায়। এখন ষোল কলায় বিকশিত হয়ে উঠেছে ভাবিনী।
আজ সকালেই হয়ে গেল একচোট।
রাত থেকে মাথাটা টিপটিপ করে সর্দিজ্বর মত হয়েছিল নিতাইয়ের, বলেছিল ভাতও খাব না, অফিসও যাব না। শুনে একটু প্রসন্নই হয়েছিল ভাবিনী। বাজা মানুষ, সারাটা দিন একাই কাটে, এ তবু বাড়িতে থাকবে লোকটা। চোরের রাত্রিবাস, একটা দিন একটা দিনই! ছুটির দিনগুলো তো নিতাইয়ের কাটছে আজকাল এক নতুন নেশায়। ঠিক নতুনও নয়, পুরোনো নেশা ঝালানো। দেশে গ্রামে তো ওই ছিল একমাত্র আনন্দ। মাছধরা ধরেছে আজকাল নিতাই আর নবকুমার ফি রবিবার।
অফিসের সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেরই একটু এদিকে সেদিকে বাড়ি বাগান পুকুর আছে, তারা নেমন্তন্ন করে মাছ ধরতে। অতএব শনিবার দুপুর থেকেই ছিপ হুইল বঁড়শি চার’ নিয়ে ব্যস্ততা পড়ে যায় দু বাড়িতে।
সে যাক।
আজ রবিবার নয়, তাই খুশি হল ভাবিনী। আর শহরের বাসায় কম কাজ করে করে আয়েসী হয়ে যাওয়া মনে ভাবল, যাক, তাহলে আজ রাঁধবই না। ও যেমন ভাতের বদলে মুড়ি চিড়ে খেয়ে থাকবে, আমিও তাই থাকব। তবে আজ তিথিটা ভাল নয়, দশমী। এয়োৎ রক্ষে করতে একটু মাছ মুখে দেওয়া দরকার। তা রাতে সে লক্ষণটুকু পাললেই হবে। কলসীতে কৈ মাছ জিয়ানো আছে।
সেই মন নিয়েই খানিক বেলায় আধসেলাই কথাখানা আর ছুঁচসুতো পেড়ে নিয়ে বসেছিল ভাবিনী। নিতাই ঘরে শুয়ে পা নাচাচ্ছিল। হঠাৎ উঠে এসে বলল, এ কী, রান্না না চড়িয়ে কথা পেড়ে বসেছ যে?
ভাবিনী মুখ কুঁচকে বলে, তুমিই যখন খাচ্ছ না, তখন আর নিজের জন্যে কে আবার হাঁড়ি নাড়ে!
নিতাই অবাক হয়ে বলে, তার মানে? আমি খাব না বলে তুমিও হরি মটর? ছি ছি, এ আবার একটা কথা নাকি? খাবে কি?
ভাবিনী একটা উচ্চাঙ্গের দার্শনিক ভঙ্গী করে বলে, মেয়েমানুষের আবার খাওয়া ও তোমার সঙ্গে দুটো খই-মুড়ি খেলেই হবে।
এ্যাই দ্যাখো! চুলোই জ্বালবে না?
দরকার তো দেখছি না কিছু– নিতাই ইতস্তত করে বলে, তবে আর কথা কি! নইলে ভাবছিলাম
কি ভাবছিলে?
নাঃ থাক! ভাবিনী কাথা সরিয়ে রেখে বলে, থাকবেই বা কেন? বলই না?
নিতাই বলে, না, মানে বলছিলাম কি তেমন কিছু জ্বর তো হয় নি, আলুমরিচের দম দিয়ে দুখানা গরম গরম রুটি খেলে মন্দ হত না।
রুটি!
রুটি শুনেই ভাবিনীর মাথায় বজ্রাঘাত হয়। রুটি কথাটাই শুনেছে এ যাবৎ, হাতে করে গড়ে নি কখনো। তাদের গায়ে-ঘরে ও বস্তুর চলনই নেই। ভাত খাও ভাত, না খাও মুড়ি আছে চিড়ে আছে, খই বাতাসা ফুলুরি কলাইসিদ্ধ আছে, যেমন যার শরীরের অবস্থা বুঝে সেবা কর। রুটির কথা ওঠে না!
কলকাতায় এসে নিতাই এই চালটি শিখেছে। আর একদিন অমনি সন্ধ্যেবেলা ফিরে বলে বসেছিল, দেহটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে, দুখানা রুটি গড়ো না। আটা নিয়েই এসেছি একেবারে।
সেদিন একটু অনৃতভাষণ করতে হয়েছিল ভাবিনীকে। স্বামীর কাছে মিথ্যা বলার পাপের জন্য অলক্ষ্যে একবার নাকটা কানটা মলে নিয়ে বলেছিল, ও হরি! তা কি জানি ছাই! ভাত তো চড়িয়ে ফেলেছি!
নিতাই অবশ্য রান্নাঘর খানাতল্লাস করতে যায়নি, তবে থাক তবে থাক বলে আটার ঠোঙাটা নামিয়ে রেখেছিল। সেই ঠোঙাসুদ্ধ আটা মজুত আছে নিতাইয়ের জানা, কাজেই বাসনাটা প্রকাশ করে ফেলে, অন্য চিন্তায় পড়ে না।
কিন্তু ভাবিনীর মাথায় যে দুশ্চিন্তার পাহাড় চাপল।
রুটি গড়তে পারব না বলাটাও যেমন কঠিন, রুটি গড়তে জানি না বলাটাও তেমনি কঠিন।
তবু শেষ চেষ্টা করে সে।
বলে, দিনদুপুরে শুকনো রুটি আর কেন খাবে তবে? বরং একটু খিচুড়ি চড়িয়ে দিই, তাই গরম গরম
না না, খিচুড়ি না, নিতাই ভাবিনীর আশার মূলে কুঠারঘাত করে, অন্ন দ্রব্যটা থাক, ওতে শরীর রসস্থ হয়। রুটিটা নেয়াৎ শুকনো না কর, গাওয়া ঘি একটু মাখিও। মেলা করো না, ওই খান বারো-চোদ্দ। অল্পাহারই ওষুধ!
অগত্যাই আটার ঠোঙা নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে হয় ভাবিনীকে ভাগ্যকে ধিক্কার দিতে দিতে। কোথায় আজ কাঁথাখানা মিটিয়ে ফেলবে আশা করছিল, আশা করছিল উনুনের দায়ে ধরা পড়বে না, সে জায়গায় কিনা একেবারে মাথায় আকাশ!
বলা বাহুল্য রুটির ব্যাপারে ভাবিনীর প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হল না।
কারণ প্রথমেই প্রয়োজনাতিরিক্ত জল ঢেলে আটাটাকে প্রায় শির্ণীতে পরিণত করে ফেলেছিল সে। তার পর যদিও ছিঁড়েখুঁড়ে বহুঁকোণবিশিষ্ট খানকয়েক আটার চাকলা বানাল হিমসিম খেয়ে, তাদের উনুনে ফেলে তুলতে তুলতে পুড়ে উঠল প্রায় সবগুলোই। অথচ আবার গঠন-সৌকুমার্যে জায়গায় জায়গায় কাঁচাও বর্তমান।
ওদিকে দুপুর গড়িয়ে যায়।
নিতাই অনুমান করে, নিজের জন্যেও রুটি করছে ভাবিনী। আর সে রুটির সংখ্যা অনুমান করে মনে মনে একটু হেসে ধৈর্য ধরে বসে থাকে।
কিন্তু ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে। পেটের মধ্যে যে সাড়া উঠেছে।
বার বার সাড়া দিয়ে উসখুস করে অবশেষে রান্নাঘরের দরজাতেই এসে দাঁড়ায় নিতাই, কী এত নশো-পঞ্চাশ ব্যঞ্জন রাধ? বললাম যে শুধু দুখানা রুটি আর আলু মরিচের দম হলেই হবে।
ভাবিনী আজও মনে মনে নাক-কান মলে বলে, ওমা তাই কি আবার খেতে পারে মানুষ? একটু সোনামুগের ডাল চড়াচ্ছি
এ্যাই দ্যাখো! আবার ওই সব! তাই এত দেরি হচ্ছে! দরকার নেই দরকার নেই, ওই যা হয়েছে তাই দিয়ে দাও।
দিয়ে তো দেবে, কিন্তু আলু-মরিচের দম কই?
আলু তো এখনও ঝুড়িতে।
অগত্যাই হাটে হাঁড়ি ভাঙতে হয় ভাবিনীকে। সবটা নয়, হাঁড়ির কানাটা। বলতে হয়, একটু অপেক্ষা কর, দেরি আছে।
নিতাই ছটফট করে আর বলতে থাকে, ও না হয় পরেই হবে। শুধু গুড়-রুটিও মন্দ না।
অতএব শুধু গুড়-রুটিই ধরে দিতে হয় ভাবিনীকে স্বামীর পাতের গোড়ায়।
আর জোর ক্ষিদের মুখে সেই গুড়ের ডেলা এবং আটার পিণ্ডি দর্শনে নিতাইয়ের সমস্ত রক্তকণিকা মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিকণিকায় পরিণত হয়ে মার মার করে ওঠে।
থালাটা ধরে দিয়েই ছুতো করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছিল ভাবিনী। হঠাৎ থালা-আছড়ানোর ঝনঝন শব্দে চমকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। এতটা আশঙ্কা ছিল না তার। কিন্তু দেখল থালাটা অদূরে নিক্ষিপ্ত।
সব কখানা রুটি একসঙ্গে তাল করে হাতে চটকে নিতাই চেঁচাচ্ছে, কী হয়েছে কী এ? আমার ছেরাদ্দর পিণ্ডি! বলি দুখানা রুটি গড়বারও যদি ক্ষমতা না থাকে, বল নি কেন আগে? কোন শালা বেকুব খেতে চাইত তা হলে? আমার যেমন মুখ্যমি: বাজার থেকে দু আনার পুরী-তরকারি কিনে এনে খেলেই চুকে যেত। তা নয়, সাধ করে রুটি খেতে চাইলাম আমার কর্মিষ্ঠ পরিবারের কাছে। হুঁ! বোঝা উচিত ছিল এসব সভ্য কাজ সবাইয়ের জন্যে নয়। সেই যে বলে– বাপের জন্মে নেইকো চাষ, ধানকে বলে দুর্বোঘাস! এ হচ্ছে তাই। তা শহরে যখন এসেছ, সভ্য কাজ একটু শিখতে হবে বৈকি। তোমার ধান সেদ্ধ টেকি কোটার মহিমা তো চলবে না এইখানে। তাই পরামর্শ দিই– একবার আধবার বৌঠানের কাছে গিয়ে মানুষের মতন কাজকর্ম শিখে এসো দু-একখানা–
বড্ড বেশী খিদের মাথায় বড্ড বেশী আশাভঙ্গ হয়েই বোধ করি মেজাজের ওপর রাশ রাখতে পারে নি নিতাই। কিন্তু সকলেরই ধৈর্যের সীমা আছে।
বিশেষ অপ্রতিভ হয়ে গিয়েছিল বলেই এতগুলো কথা নীরবে শুনেছিল ভাবিনী, মানুষটার খিদের মাথায় উত্তর-প্রত্যুত্তর করবে নাই ভাবছিল, এবং মনে মনে আঁচ করছিল রাগটা একটু নরম হলে বরং তুতিয়ে পাতিয়ে চারটি খই দুধ
কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
শেষ টানটা আর সইতে পারল না যন্ত্রের তার। ছিঁড়ে পড়ল ঝনঝনিয়ে।
পড়বেই।
তোমার গায়ে আমার পায়ের আগাটা একটু ঠেকে গেছে বলে তুমি আমায় কষে লাথালে আমি সইব? তোমার গোয়ালে আমার তামাকের কাঠকয়লাখানা ছিটকে পড়েছে বলে আমার ঘরে তুমি আগুন দেবে আর আমি চুপ করে থাকব? তোমার বাগানে আমার ছাগলটা একবার মুখ লাগিয়েছে বলে গরুর পাল ঢুকিয়ে আমার তাবৎ বাগান তুমি মুড়োবে, আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকব?
ইয়ার্কি নাকি? মানুষ মানে পাথর নয়।
তাই শেষরক্ষে হল না। নিতাইয়ের কথাটা শেষ হবার আগেই ভাবিনীও “রে-রে” করে তেড়ে এল।
কী! কী বললে? আর একবার বল তো শুনি? তোমার পেয়ারের বৌঠানের কাছে আমি যাব রান্না শিখতে? বলি আর কত অপমান তুলে রেখেছ আমার জন্যে? যা রেখেছ একসঙ্গে বার কর। একেবারে বুকে ভরে নিয়ে মা-গঙ্গার কোলে আশ্রয় নিই গে!– রেখে এস, আজ আমায় রেখে এস বারুইপুরে। এত অপমান সয়ে থাকতে পারব না, এই বলে দিলাম সাদা বাংলা ওগো মাগো, এই সুখ করাতে তুমি আমায় শহরে এনেছিলে? ঝাড় মারি আমি অমন সুখের মাথায়! ভাবছিলাম দোষ হয়ে গেছে, ঘাট মানব, চুকে যাবে ন্যাটা, তার আর ডালপালা গজাবে না। ওমা এ যে দেখি থামেই না! শক্তের ভক্ত আর নরমের যম তুমি, কেমন? উঠতে বসতে নড়তে চড়তে খালি বৌঠান আর বৌঠান! বলি এতই যদি মন্তরপূত করে রেখেছিলো বৌঠান তো আমাকে আবার আনতে গেলে কেন? লোকের কাছে মুখ রাখতে? শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে? তোমার–
আবার শেষ ঘাটে ধাক্কা!
আবার কথার উপর হাতুড়ি!
নিতাই আসন থেকে দাঁড়িয়ে উঠে গলা ফাটিয়ে বলে, কী বললি?
অ্যাঁ! তুই! তুই বললে তুমি আমাকে হাড়ি-কাওরার মতন? এও বোধ হয় শহুরে সভ্যতা? ভাবিনী ধেই ধেই করে ওঠে, তোমায় আমি কড়ে আঙ্গুলের ছেদ্দা করি না, বুঝলে? কানা কড়ার না। দুশ্চরিত্র স্বামী আবার স্বামী?! আমি যাব সেই মায়াবিনী ডাকিনীর কাছে শিক্ষে করতে! গলায় দেবার দড়ি জুটবে না আমার? যাও তুমি যাও, দু-বেলা তার পাদোদক খাও গে
নিতাই সহসা গম্ভীর হয়ে যায়। হাত দুখানা আড়াআড়ি করে বুকের ওপর রেখে বার দুই পায়চারি করে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, পাদোদক যদি জোটে তো শুধু খাবো কেন, মাথায় মেখে বর্তাব! তবে এই তোমার মতন মেয়েমানুষেরও সেটা করা উচিত। বিশ বছর তার পায়ের কাছে বসে শিক্ষে করলে, আর দুবেলা পা-ধোয়া জল খেয়ে যদি তাঁর কড়ে আঙ্গুলের নখের যুগ্যিও হও!
নিতাই চরম অভিব্যক্তিতে তার হৃদয়ের শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু স্ত্রীর পক্ষে যে পরস্ত্রীর প্রতি এ শ্রদ্ধা প্রকাশ কাটাঘায়ে নুনের তুল্য তাতে তো আর সন্দেহ নেই। অতএব এর পর ভাবিনী যদি কোমরে কাপড় জড়ায়, তাকে দোষ দেওয়া যায় না। ভাবিনী জীবনাবধি যা দেখেছে তাই শিখেছে। দেখার ঊর্ধ্বে শেখবার মত অনুভূতি কটা মেয়েমানুষের থাকে?
তা ছাড়া যে মেয়েমানুষ যতই নীরেট হোক নির্বোধ হোক, স্বামী মন পেলাম কিনা বুঝতে বাধে না তার। আর সে মনের অধীশ্বরী যদি আর কেউ থাকে, তাকে চিনতেও দেরি হয় না। কলকাতার মাটিতে পা দিয়েই তাকে চিনেছে ভাবিনী। সেই জ্বালাকর সত্যটা বুঝে ফেলেছে।
এই ভয়ঙ্কর জ্বালা ভাবিনী মহান উদারতায় সহ্য করে যাবে, এ তো আর হয় না।
অতএব কোমরে কাপড় জড়িয়ে কী যেন একটা ছড়া আউড়ে ছিটকে কাছে সরে আসে ভাবিনী।
বটে! বটে! কড়ে আঙ্গুলের যুগ্যি! চরিত্রহীন পুরুষের উপযুক্ত কথাই বলেছ! পরের ইস্তিরীর সবই মিষ্টি যাদের! বলি তোমার প্রাণের নিধি বৌঠানের সব ‘খেলা’ জান? ও কথা তুলি না, তুলতে পিরবিত্তি হয় না তাই বলি না। তুললেই তো পুরুষের মুখ বুক সব খুলে যাবে। যা দেখবে তাই সুচক্ষে দেখবে। নইলে জেনেছি অনেকদিন। এইবার তোমায় জানাই স্বামীকে লুকিয়ে রোজ ভরদুপুরে বিবিটি সেজে কোথায় যান গিন্নী, জান সেকথা?
স্বামীকে লুকিয়ে মানে?
নিতাই যেন দুর্বল পক্ষ হয়ে পড়ে। অতএব সবল পক্ষ ভাবিনী কুটিল হেসে বলে, নুকিয়ে মানে নুকিয়ে! ঝি মাগীই বলেছে আমার ঝিকে, ছেলেদেরকে শেখানো আছে বলিস নে।
নিতাই বিশ্বাস করতে পারে না সত্যবতীর পক্ষে লুকোচুরি সম্ভব। তাই সগর্জনে বলে, বিশ্বাস করি না।
ওঃ, তাই নাকি? এইটুকুই বিশ্বাস কর না? আর শুনলে না জানি কি বলবে!… বলি তোমাদের ওই জাতধর্ম খোয়ানো মাস্টারটার সঙ্গে তলে তলে দহরম মহরম তা জান! তেনার সঙ্গে তো বেম্ভধর্মের আপিসে পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল। বলি নি এতদিন, ওর কথা তোমার কাছে কইতে ঘেন্না হয়, তাই বলি নি। আমি বলছি ও মেয়েমানুষ একদিন
খবরদার!
নিতাই তীব্র চীৎকারে এগিয়ে আসে, মিথ্যাবাদী! মিছিমিছি করে আর কিছু বলতে যাস তো জিভ খসে পড়বে! চুপ, একেবারে চুপ!
দিশেহারা দেখায় নিতাইকে।
একে তো দুটো অপবাদই ভয়ানক মারাত্মক, অথচ এমনই সর্বনেশে সত্যগন্ধী মত যে একেবারে উড়িয়ে দিতেও বুকে বল আসে না। তদুপরি আবার সেই ভবতোষ মাস্টার। মাস্টার জাতধর্ম খুইয়ে বেম্ভ হয়েছিল, নিতাইয়ের হাড়ে বাতাস লেগেছিল। ভেবেছিল অন্তত নবকুমারের বাড়িতে আসা-যাওয়ার পথে তার কাটা পড়ল!
কিন্তু এ কী কথা শোনা যায় মন্থরার মুখে? দিশেহারাই হয়ে যায় নিতাই।
এই সুযোগে ভাবিনী কোমরের আঁচলটা আর একটু শক্ত করে।
বলি গায়ের জোরে চুপ করিয়ে রাখলেই তো আর সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না? আমি এই তোমায় বলে রাখছি, ওই তোমার পেয়ারের বৌঠান বেম্ভ হবে হবে হবে। ওই যে একটা বুড়ো ধিঙ্গী মেয়ে পুষেছে, মিছে করে বলে ভাইঝি, ভগবান জানেন বেধবা না আইবুড়ি, বয়সের তো গাছপাথর নেই, সেটাকে তো আর হিদুর সংসারে গছাতে পারবে না? তাই বেম্ভ হয়ে তার–
তুমি চুপ করবে?
ভাবিনী মুখে একটা আঙ্গুল ঠেকিয়ে ভেঙিয়ে উঠে বলে, তবে এই করলাম! কিন্তু আমি চুপ করলেই তো আর জগৎ চুপ করে থাকবে না? জানতে সবাই পারবে।
চুপ সত্যিই তখন করেছিল ভাবিনী।
বোধ করি অস্নাত অভুক্ত স্বামীকে পরাজিত শত্রুপক্ষের মতই দেখতে লেগেছিল বলে অস্ত্র সংবরণ করেছিল।
কিন্তু নিতাই ছটফটিয়ে বেড়িয়েছিল পাগলের মত।
বৌঠানের দ্বারা এসব সম্ভব?
লুকোচুরি, অভিসার, ব্রাহ্মসমাজের যাতায়াত, ভবতোষের সঙ্গে চুপি চুপি মেলামেশা! ভাবিনীর অভিযোগ যদি সত্যিই হয়, তা হলে তো ধর্ম মিথ্যে, ভগবান মিথ্যে, জগতে যা কিছু বস্তু আছে সবই মিথ্যে!
অসুস্থ শরীর, না-স্নান, না-আহার আরও উদ্ভ্রান্তি আনছিল। ভাবিনী এক-সময় এসে পায়ে ধরে মাপ চেয়ে দুটো নারকেলনাড়ু আর একটি ঘটি জল নিয়ে সেধেছিল, গলা দিয়ে নামাতে পারে নি নিতাই, পরে হবে- বলে সরিয়ে রেখে বালিশে মাথা ঘষতে ঘষতে অবশেষে একসময় ঘুমিয়েও পড়েছিল।
ওবেলা ঘটেছিল এসব।
ঘুম ভাঙ্গল পড়ন্ত বেলায় নবকুমারের ডাকে।
নবকুমার ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঠেলা মেরে প্রশ্ন করছে, নিতাই নিতাই, তোদের বৌঠান এসেছে এ বাড়িতে?
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে নিতাই।
উপবাসক্লিষ্ট শরীরের মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে, প্রশ্নের কথাটা চট করে হৃদয়ঙ্গম হয় না। তাই উত্তরের বদলে নিজেই সে প্রশ্ন করে, কি? কে এসেছে?
আরে বাবা তোর বৌঠান ছাড়া আর কে? আর কাকে খুঁজে বেড়াব আমি? ভেতরে গিয়ে একবার খবর নিয়ে আয় দিকি, বৌমার কাছে বেড়াতে এসেছে কিনা?
নিতাই হতচকিত দৃষ্টি মেলে আস্তে মাথা নাড়ে।
কী মুশকিল! বসে বসে হাত গুনছিস কেন? তুই তো ঘুমোচ্ছিলি মদ্দারাম! ইত্যবসরে এসেছে কিনা
এতক্ষণে বড়সড় একটা কথা বলে নিতাই ভেবেচিন্তে, কেন, বাড়িতে নেই?
এই দেখ! থাকবে যদি তো আমি ছুটে এসে হামলা করছি কেন? ওঠ তুই একবার
অগত্যাই উঠতে হয় নিতাইকে।
এবং বাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি না থাকার অসুবিধেটা হঠাৎ এখন স্পষ্ট করে উপলব্ধি করে নিতাই।
ভিতরে গিয়ে ওই প্রশ্নটা এখন করতে হবে ভাবিনীকে! নিতাইয়ের মুখ থেকেই বার করতে হবে, বৌঠান এসেছেন?
উত্তরটা যা আসবে সে তো নিতাইয়ের জানাই। নেহাৎ নবকুমারের নির্দেশেই ওঠা। নইলে সত্যবতী এসেছে, আর নিতাই টের পায় নি? ঘুমিয়েছিল বৈ তো মরে ছিল না?
খানকয়েক বাড়ির ব্যবধানেই দুটো বাড়ি। আসা-যাওয়া তো আছেই। ভাবিনী আসার পর তার সুবিধে অসুবিধে দেখতে প্রথম প্রথম খুবই এসেছে সত্য, কিন্তু ভাবিনীর অনাগ্রহেই যাওয়াটা আসাটা কমিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু সে সব আসা বেশীর ভাগই নিতাইয়ের অনুপস্থিতিতে। উপস্থিতিতে দৈবাৎ। আজই কি আর হঠাৎ সেই সৌভাগ্য–
নবকুমারের অধীরতায় উঠে গেল নিতাই। ভিতরের গিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে চলে এসে মাথা নাড়ল।
মান খুইয়ে জিজ্ঞেস আর করতে হল না।
দেখল ভাবিনী একা বসে সন্ধ্যের অন্ধকার তুচ্ছ করে কথাখানাই সেলাই করছে। ভরসন্ধ্যেয় যে উঁচসুতো হাতে করতে নেই, এ শিক্ষাও যেন বিস্মৃত হয়ে গেছে ভাবিনী।
কী হবে নিতাই? নবকুমার প্রায় ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলে।
নিতাই শুষ্কমুখে বলে, আর কোথাও গেছেন হয়তো!
আর কোথায় যাবে? একা আর কোথা যাবে? নবকুমার কাতর ভাবে বলে, কপালক্রমে ঠিক এই সময় তুড়ু খোকা দুদিনের জন্যে ওদের ঠাকুমা-ঠাকুদ্দাকে দেখতে বারুইপুর গেছে–
একা গেছে? চমকে ওঠে নিতাই।
না না! আমাদের অবনী যাচ্ছিল দেশে- ভাবলাম ওদের তো ছুটি রয়েছে, যাক দুদিন। দেশভিটে কিছুই তো চিনলো না! কী করে জানব এই ফাঁকে এই বিপদ হবে!
নিতাই আরও শুষ্ককণ্ঠে বলে, তোমার সঙ্গে কোনও বচসা-টচসা হয় নি তো? মানে গঙ্গার দিকেটিকে
না না। সে সব কিছু নয় নিতাই। তবে আমাকে না জানিয়ে তো তুড়ুর মা কোথাও—
আবেগের মুখে এসেছিল নিতাইয়ের, তা তিনি যান। শুনেছি সে খবর
কিন্তু আবেগকে প্রশমিত করে। আস্তে আস্তে অন্য কথা বলে, সেই যে মেয়েটা মানে সুহাস আর কি– সে নেই?
সে তো ইস্কুল থেকে এসে পর্যন্ত না দেখে ভাবনা করছে। ঝিটাও কিছু জানে না। কী হবে নিতাই?
কী হবে, কী হচ্ছে, কী হতে চলেছে, তার কি কিছুই জানে নিতাই? তার শূন্য মস্তিষ্কে যেন সহস্র বোলতা শনশনিয়ে ওঠে। মাথার ভার ঘাড় বহন করতে রাজী হয় না। বালিশে ধপ করে মাথাটা ফেলে ভাঙা গলায় বলে ওঠে নিতাই, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
কিন্তু আর একজন তো সবই বুঝতে পেরে ফেলেছে।
নিতাইয়ের ওই একবার নিঃশব্দে অন্তঃপুরে পাক খেয়ে আসার পরমুহূর্তেই কাঁথা ফেলে উঠে এসেছে ভাবিনী।
দরজার ফাঁকে চোখ কান রেখে আড়ি পেতে এপিঠের কথাবার্তা শুনেছে, এবং শুনেই সমস্ত রহস্য হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছে।
একটা বদ বিচ্ছিরি মেয়েমানুষের জন্যে দু-দুটো দস্যিপুরুষ যে এরকম মচ্ছি হয়ে পড়বে, এও তো অসহ্য! চোখে দেখাই শক্ত!
ওই অসহ্য ব্যাপারটা আর বেশীক্ষণ বরদাস্ত করতে পারে না ভাবিনী, ঠনঠনিয়ে দরজার শেকলটা নেড়ে দেয়।
সেই ঠনঠনানির মধ্যে যেন কোনও রহস্যবার্তার ইশারা।
.
ছেলের বৌ যেমনই হোক, নাতি বড় জিনিস। বংশধর, সর্বেশ্বর, নাড়িতে নাড়িতে বাঁধন। ছেলে দুটো আসা অবধি এলোকেশী যেন উথলে বেড়াচ্ছেন। অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গে বৌয়ের নিন্দেরও বিরাম নেই। যে ছোটলোকের বেটী’ তাঁকে এই পরম বস্তু থেকে বঞ্ছিত করে রেখেছে, তার যে কখনো ভাল হবে না, এ বিষয়ে শেষ রায় দিয়ে এলোকেশী নাতিদের যত্নে তৎপর হয়ে বেড়াচ্ছেন। কারণ এবার ওরা একা এসেছে। কোন-কোনবার পূজোয় আসে, বাপের সঙ্গে তিন-চারটে দিন মাত্র থাকে, বিশেষ হাতে পান না। না, সত্য আর আসে নি। এলোকেশী আর তার মুখ দেখতে চান না, সেটা বড় গলায় জানিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের পৈতে দিয়ে গেছে ভিটেয় এসে, তাও নবকুমার একা। দুই ছেলের একসঙ্গে মাথা মুড়িয়ে দিয়েছে। কৃপণস্বভাব নীলাম্বরের বাড়িতে সমারোহময় কাজের ধরনও নেই। নবকুমার শেখে নি।
আর সত্য? তার যদি বা কোন সাধ থেকেও থাকে, এলোকেশীর কথা ভেবে সে তুলে রেখেছে। সমারোহ করতে গেলেই তো তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এ বরং কদিন ঝিকে রাত্তিরে থাকতে বললেই বেশ থাকতে পারবে সত্য। তাই থেকেছে।
ভারি তো মনিষ্যি সাধন সরল, তুড়ু খোকা ছাড়া পোশাকী নামে যাদের আজ পর্যন্ত কেউ ডাকে নি, বড় একেবারে খাইয়ে, তবু তাদের জন্যে পুকুরে জাল ফেলা হচ্ছে, টাটকা চিড়ে কোটানো হচ্ছে, পিঠে পায়েস, নাড়, পাটিসাপটা গোকুলপিঠে, ক্ষীরতক্তি ইত্যাদি করে যতরকম জানা আছে এলোকেশীর, একটু ভুল বলা হলে– যত রকম বানাতে জানা আছে সদুর, সব চলছে একধার থেকে।
নাকে নল ছেঁচে যাচ্ছে সদুর।
নীলাম্বর অবশ্য এক-আধবার বলছেন, ওরে তোদের পেট-টেট ভাল আছে তো? দেখিস, দিনকাল ভাল নয়। শেষে আবার কলকাতায় ফিরলে তোদের মা না বলে ঠাকুরমার কাছে আদর খেয়ে পেটের রোগ ধরিয়ে এনেছে!
কিন্তু এলোকেশী সে কথায় কর্ণপাত মাত্র করছেন না।
নাতিদের অসুখ এবং বৌয়ের কথা শোনানো সম্পর্কে তার মনে লেশমাত্রও ভয় আছে বলে মনে হচ্ছে না। বরং ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠেছেন, তুমি থাম তো! অসুখই বা হতে যাবে কেন? বালাই ষাট। আমি কি পচা পান্তো খাওয়াচ্ছি নাতিদের? অসুখ যদি হয় তো বলতে হবে যে ওদের গর্ভধারিণীর গুণেই হয়েছে। শহরে গিয়ে শহুরে চাল ধরেছেন, ছেলে দুটোকে আধপেটা খাইয়ে খাইয়ে পেট মেরে রেখেছেন। সারা দিনমানে একবার বৈ দুবার ভাত নয়।… আর নবুকে আমার আমি তিনবার করে ভাত দিতাম। সকালবেলা কী খাচ্ছে ছেলেরা, না গজা জিলিপি তিলকুট! দোকান থেকে কিনে আনিয়ে রাখে। কেনা খাবারে ছেলেপিলের পেট ভরে? কেন সকালে একবার দুটো ফেনাভাত দিতে হাতে পোকা পড়ে?… ইস্কুল থেকে এসে খাবার কি? না পরোটা! খিদের সময় ময়দা? দেখলে চোখ ফেটে জল আসে না ছেলেদের?… নবু আমার একদিন যদি ইস্কুল থেকে এসে মাছভাতের বদলে অন্য কিছু দেখেছে তো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কেঁদেছে!
সদু এক আধবার বলতে চেষ্টা করেছিল, তা নবুর ছেলেদেরও যে কান্না আসে, তা বলেছে ওরা তোমাকে?
এলোকেশী সে কথাও উড়িয়েছেন।
বলেছেন বলবে আর কোন সাহসে? যে খাণ্ডারনী মা, ভয়ে তার বিপক্সে কথা একটা বলতে পারে? বড়টাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যদিবা দু-একটা পেটের কথা টেনে বার করছি, ছোটটা একেবারে তুষোড় পাকা। জানে কথা প্রকাশ পেয়ে গেলে মা আর আমার কাছে পাঠাবে না, তাই
আহা প্রকাশেরই বা আছে কি? বৌ তো আর বাসায় গিয়ে চুরি ডাকাতি করছে না?
চুরি-ডাকাতি না করুক, অনেক কাণ্ডই তো করছে। কোথাকার একটা অখদ্যে-অবদ্যে ছুঁড়িকে তো পুষছে, তাকে পয়সা খরচ করে ইস্কুলে দিয়েছে, বই খাতা কিনে দিচ্ছে, সে তো গেল! নিজে নাকি রোজ দুপুরে কোথায় গিয়ে মেয়ে পড়াচ্ছে। বিদ্যেবতী লীলাবতী! বলি চুরি-ডাকাতির চেয়ে কমটাই বা কি হল তা হলে? বাবার জন্মে শুনেছিস কেউ এ কথা? ভদ্রঘরের বৌ যায় গুরুমশাইগিরি করতে হলে?
নীলাম্বরও অবশ্য এ সংবাদে ছিটকে উঠেছিলেন, গাল দিয়ে নবকুমারের পিতৃশ্রাদ্ধ ঘটিয়ে সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন, নিজে গিয়ে খড়ম পেটা করে ছেলে বৌকে গায়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন, পরে সে সংকল্প ত্যাগ করেছেন। বলেছেন, নাঃ, গায়ে এনে আর দরকার নেই! জাত যা যাবার তা। তো গেছেই, ও বৌয়ের হাতের ভাত তো আর খাচ্ছি না আমরা, মিথ্যে আর ধরা-বাঁধার দরকার কি? এ বরং বাইরে আছে, এখানে আনলেই তো পাড়া জানাজানি। ঘোমটা দিয়ে কোণে বসে থাকবার বৌ যখন নয়, তখন চোখের আড়ালে থাকাই মঙ্গল। বরং ছেলে দুটোকে যদি হাত করতে পার সেই চেষ্টা দেখ। আখেরে বুড়ো-বুড়ীকে দেখবার একটা তো চাই!
এলোকেশী গলা খাটো করে মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, সে চেষ্টার কসুর করছি মনে করছ? মায়ের ওপর মন বিষ করে তোলবার জন্যে, মায়ের যত গুণাগুণ সবই ব্যক্ত করছি। তবে মায়াবিনীর যে মহামন্তর জানা! ছেলেরা মাতৃভক্তিতে ডগমগ! মন্তর নইলে আমার নিজের পেটের ছেলেটা অমন পর হয়ে যায়?
সাধন সরল অবশ্য ভেতরের এত কথা জানে না, তারা প্রাণভরে ছুটির আনন্দ উপভোগ করছে। কলকাতার ধরা-বাঁধা জীবনের বাইরে এসে, শৈশবের লীলাভূমি ফিরে পেয়ে, মাঝে মাঝে সত্যিই মায়ের ওপর রাগ হচ্ছে তাদের। মার জেদের জন্যেই যে কলকাতায় বাস, সেটা সবিস্তারে এবং স নিয়ে শুনছে তো উঠতে বসতে।
তবে সদু ন্যায্য কথা কয়।
অবশ্য মামীর সামনে তত নয়, কারণ এলোকেশীর রণরঙ্গিণী মূর্তিকে সে বড় ডরায়। রাতের খাওয়ার সময় একলা পায় ভাইপোদের, এলোকেশী সন্ধ্যার মধ্যে বিছানা নেন। সদু ভাত বেড়ে দিয়ে কাছে বসে গল্প করে। বলে, ঠাকুরমার কথায় তোমাকে দুষছিস, বলি মা যাই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছল তাই না এই বয়সে এতটা পড়া করেছিস, ভাল ভাল করে পাস করছিস। এখানে থাকলে হত এসব? দেখছিস তো এখানে তোদের বইসী ছেলেদের। কেউ এরই মধ্যে পড়া ছেড়ে দিয়ে মাছ ধরছে আর তামাক খাচ্ছে, কেউবা একটা কেলাসে তিন-চার বছর ঘষটাচ্ছে। না সভ্যতা, না ভব্যতা। বামুনের ঘরের ছেলেটা আর চাষার ঘরের ছেলেটার তফাৎ বোঝবার উপায় নেই।
সাধন ঠাকুমার মুখের বচন ঝেড়ে বলে, তা এত এত দিন, এত এত যুগ ধরে লোকে তা দেশগায়েই থেকেছে? তারা কি আর মানুষ নয়? মায়ের বাবাও তো পাড়াগাঁয়ের ছেলে?
তোদের দাদামশাইয়ের কথা বলছিস? তার কথা বাদ দে। তিনি হলেন হাজারে একটা। তবে তিনি কি আর তোর এই ঠাকুদ্দার মতন বদ্ধজলা? তিনি হলেন নদীর মতন। শুধু পাড়াগাঁয়ে কেন? শহর-বাজারেই তার অনেকদিন পর্যন্ত কেটেছে। তা হ্যাঁ রে মামারবাড়ি যাস-টাস না?
না তো!
যাস না? আমি বলি, এখন তোর মা স্বাধীন হয়েছে, হয়তো।
হঠাৎ সরল ফট করে বলে বসে, মা আবার একলা একলা কি স্বাধীন হল? আমাদের দেশেরই কেউই তো স্বাধীন নয়, ভারতবর্ষটাই তো পরাধীন!
সদু কথাটা চট করে অনুধাবন করতে পারে না, বলে, ভারতবর্ষটা কি বললি?
পরাধীন, পরাধীন! গোরা সাহেবরা রাজা নয়?
সদু বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, ওমা? শোন কথা, ওদের রাজ্য ওরা রাজা হবে না?
বাঃ, ওদের রাজ্য কি করে হবে? ওরা কি আমাদের এ দেশের লোক?
তা ওরা তো রাজার জাত? তা ছাড়া ওরা সমুদ্রের ওপার থেকে এসে তোদের কত ভাল করছে।
ভাল করছে না হাতী! অনেক লোকসানই করেছে বরং। আর মা বলেন, যে যার নিজের দেশের মালিক হবে এই নিয়ম। যারা পরের দেশে এসে লোভ করে সেখানে শেকড় গেড়ে বসেছে, তাদের
সদু অবাক হয়ে বলে, এই সব কথা বলে তোদের মা? তা হলে তো দেখছি মামী যা বলে মিথ্যে নয়! মাথারই দোষ! কিন্তু ওসব কথা বলতে নেই রে থোকা, সাহেবরাই তোদের বাপের অন্নদাতা।
অন্নদাতা কথাটার সম্যক অর্থ বুঝতে না পেরেই বোধ করি সরল উত্তর দেয় অন্য পথে, মা তো সাহেবদের নিন্দে করেন না, শুধু বলেন, সব ছেলেরই মনে এই চিন্তা নিয়ে মানুষ হওয়া দরকার, পৃথিবীর মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। তা দেশটাই যাদের পরাধীন, তারা আর মাথা উঁচু করবে কি করে?
সদু হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলে, কি জানি বাবা, ওসব কথার মর্ম বুঝি না। তোর মায়ের চিরদিনই চোটপাট কথা, উদভুট্টে বিদঘুট্টে চিন্তা। এত দেশ থাকতে কিনা সাহেব বাঙালী নিয়ে মাথা ঘামানো, কে রাজা কে প্রজা তার ভাবনা! আজন্ম পরাধীনতায় কাটল, স্বাধীনতা কাকে বলে তাই জানলাম না। তার মর্ম বুঝবো কি ছাই! মানুষ পরাধীন হয় তাই জানি, দেশের আবার স্বাধীন পরাধীন? যাক গে মরুক গে ওসব কথা, তোর মা নাকি গুরুমশাইগিরি করতে যায় রে?
সাধন সরল দুই ভাই একবার মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে, তার পর সরলই সহসা সবেগে বলে ওঠে, তা বল না দাদা, ভয়টা কি? মা তো বলেছেন, লুকোচুরি মিথ্যে কথা, এর বাড়া পাপ নেই। তবে বাবাকে বলতে মানা, বাবা পাছে মাকে যেতে নিষেধ করেন। নিষেধ করলে তো মুশকিল। অথচ মাস্টার মশাই বলেছেন-।
সদু চোখ কুঁচকে বলে, মাস্টার মশাই কে?
বাঃ, মাস্টার মশাই কে জান না? ভবতোষবাবু! বাবাকে যিনি—
বুঝেছি বুঝেছি! তা সে না ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে গেছে?
সাধন ভয়ে ভয়ে মাথা কাত করে।
তার সঙ্গে বৌ কথা কয়?
সাধন ততোধিক নম্রতায় আর একবার মাথা কাত করে।
ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে যাবার পরও তোদের বাড়িতে আসে সে?
না, বাড়িতে আসে না, সরল গম্ভীরে ভাবে বলে, বাবা তো তার মান রাখেন নি, বাড়িতে ঢুকতে বারণ করেছেন। তাই মা বলেন, বেশ, আমিই তাঁর বাড়ি যাব। মাস্টারমশাই কত উপকারী।
সদু গালে হাত দিয়ে বলে, তোমার কথা শুনে আমি তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি তুড়ু ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে দেখে আসি তোদের মার আর দুখানা হাত-পা বেরিয়েছে কিনা। যা ত্রিভুবনে কেউ শোনে নি, সেই সব ঘটনা ঘটাচ্ছে সে? কিন্তু এও বলি, এক-কালে মাস্টার উপকার করেছে বলে এখন জাতধর্ম নষ্ট করার পরও কি দরকার তার কাছে যাবার?
যে কথা মনে আনাও পাপ, হঠাৎ তেমনি একটা সন্দেহ দংশন করে ওঠে সদুকে। তাই এই প্রশ্ন।
কিন্তু সাধন ততক্ষণে সদুত্তর দিয়েছে।
পাঠশালা তো মাস্টার মশাই-ই বানিয়েছে। বুড়ো বুড়ো গিন্নীরা অ আ ক খ শিখতে আসে। মাস্টার মশাই বলে, দিনভোর গালগল্প করে, তাস খেলে আর কোদল করে নয়তো বা ঘুমিয়ে নষ্ট করার চাইতে কত ভাল কাজ লেখাপড়া শেখা, তাই সর্বমঙ্গলা তলায় দুপুরবেলায় ওই পাঠশালা খুলে দিয়েছে। তোমাদের মতন বড়রাও পড়তে আসে।
সদু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, এজন্মে যদি কখনো মরি, তবে আবার তোদের ওই কলকাতায় জন্মাব, আর তোর মার ইস্কুলে পড়ব।
তা এখনই তো পড়তে পার?
পারব সেই একেবারে যখন চিতায় শোব! নে, ভাত কটা যে পাতে পড়েই আছে।
খাচ্ছি। বাবা, রাতদিন যা খাচ্ছি আর পেটে ধরছে না!
তবে থাক, জোর করে খাস নে।
সাধন সদুর সেই হঠাৎ স্থির হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে, পিসি, তুমি চল না আমাদের সঙ্গে
আমি? সদু হঠাৎ চড়ে উঠে বলে, আমি কলকাতায় যাই আর এই বুড়ো-বুড়ী দুটো না খেয়ে মরুক!
আহা চিরকাল কি? দু-একদিনের জন্যে বেড়াতে
থাক বাবা। তুই যেতে বললি এই ঢের, বেড়াতে আর এজন্যে কোথাও যাচ্ছি না, যাব তো চিরকালের মতন সেই যমরাজের বাড়িতে। তবে বড় হয়েছিস তুই, চুপি চুপি একটা যদি কাজ করতে পারিস। কাউকে কিন্তু বলতে পাবি না। যে বলবে সে আমার মরা মুখ দেখবে–
আহা কি কাজ তাই বল না?
বলছি– তোদের ওই বাগবাজারেই, তাই বলছি। ওখানের একটা বাসার ঠিকানায় একখানা চিঠি দেব, পৌঁছে দিতে পারবি?
সাধন মহোৎসাহে বলে, কেন পারব না, কত নম্বর বল?
লেখা আছে দেব। কিন্তু শোন কেউ যেন না জানতে পারে।
জানতে না পারে? কেন বল তো পিসি?
পরে বলব।