হুম্ হুম্ হুম্!
শুধু হাঁটু পর্যন্ত আটফাটা পা-গুলোর নয়, জিভে-মুখেও ধুলো বেতে যাচ্ছে বেহারাগুলোর। জ্যৈষ্ঠের দুপুর আর দুরন্ত মেঠো রাস্তা। খানিক খানিক পথ তো একেবারে ধু-ধু প্ৰান্তর, গাছ নেই ছায়া নেই। পথ সংক্ষেপের জন্য মাঝে মাঝে মোঠ ভাঙতে হচ্ছে বলেই লোকগুলো যেন আরও একেবারে জেরবার হয়ে যাচ্ছে। চারটে লোক পালা করে কাঁধ বদলে ছুটছে, তবু থেকে থেকে ঝিমিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু রামকালীরও তো আর এখন পালকি-বোহারাগুলোর ওপর দরদ দেখাবার উপায় নেই। আজ চার দিন গা ছাড়া, তো ধর মো ধর না হলেও হাতে কটা রুগী ছিল, কে জানে কেমন আছে সে কটা!
গিয়েছিলেন জীরেটের জমিদারবাড়িতে রুগী দেখতে। শুধু তো এক-আধখানা গাঁয়ে নয়, দশখানা গাঁ অবধি নামডাক বদ্যি চাটুয্যের।
রাজার আদরে রেখেছিল ওরা, আর পায়ে ধরে সাধছিল আরও দুটো দিন থেকে যাবার জন্যে। রাজী হন নি। রামকালী। বলে এসেছেন, প্রয়োজন নেই, যে ওষুধ দিয়ে গেলাম এতেই রুগী তিন দিনে উঠে বসবে। তবে পথ্যাপথ্যের যা ব্যবস্থা দিয়ে যাচ্ছি সেটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা চাই।
কবিরাজ মশাই পথে খাবেন বলে ওরা একঝুড়ি কলমের আম ওঁর পালকির মধ্যে তুলে দিয়েছে, আপওি শোনে নি। পা ছড়াতে অনবরত ঝুড়িটা পায়ে ঠেকছে আর বিরক্তি বোধ করছেন রামকালী। এই এক আপদ! পথে তিনি কিছু খান না, একথা ওরা মানতে চাইল না। স্বয়ং জমিদার মশাই দাঁড়িয়ে তুলিয়ে দিলেন। তবু মুখ কাটা ডাব গোটাচারেক পালকিতে তুলতে দেন নি। রামকালী, বলেছিলেন, ব্যায়রাগুলো তা হলে আপনার বাগানের এই ফলটলগুলোই বয়ে নিয়ে যাক রায়মশাই, আমি পদব্ৰজেই যাই!
সম্পূৰ্ণ তৈরী আম, জ্যৈষ্ঠের দুপুরের ঝলসানি হাওয়ায় একেবারে শেষ তৈরি হয়ে উঠে, থেকে থেকে মিষ্ট সুবাস ছড়াচ্ছিল। রামকালী বিরক্ত হচ্ছিলেন, আর বেহারাগুলো যেন অন্তর দিয়ে সেই সুবাসটুকুই লেহন করছিল। আর ভাবছিল ডাব চারটে পালকির বাঁকে বাঁকে নিলেই বা ক্ষতি কি ছিল? তবু তো কেষ্টর জীবের ভোগে লাগত।
অন্যমনস্ক হয়ে বোধ হয় ঝিমিয়ে এসেছিল তারা। হঠাৎ চমকে উঠল কর্তার হাঁকে।
পালকি থেকে মুখ বাড়িয়ে রামকালী হাঁকছেন, ওরে বাবা সকল, ঘুমিয়ে পড়িস নে, একটু পা চালা।
কথাটা শেষ করেই হঠাৎ সুর-ফের্তা ধরলেন। কবরেজ, এই দাঁড়া দাঁড়া, আস্তে কর, পেছনে হঠাৎ যেন আর একটা পালকির শব্দ পাচ্ছি।
চার বেহারিার আটখানা পা থমকে দাঁড়াল।
হ্যাঁ, শব্দ একটা আসছে বটে। পিছন থেকে। হঠাৎই আসছে। হুম, হুম আওয়াজটা ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রধান বেহারা গদাই ভূইমালী পালকির বাঁক থেকে ঘাড় সরিয়ে পিছন সড়কের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে ওঠে, আজ্ঞে কৰ্তামশাই, নিয্যস বলেছেন বটে! পালকিই একটা আসছে, মনে নিচ্ছে কোন বিয়ের বর আসছে!
বিয়ের বর!
রামকালী পালকি থেকে গলাটা আরও একটু বাড়িয়ে এবং সে গলার স্বরটাকে অনেকখানি বাড়িয়ে বলেন, বিয়ের বর এ খবরটা আবার চট করে কে দিয়ে গেল তোকে?
গদাই ভূইমালী মাথা চুলকে বলে, পালকির কপাটে হলুদ ছোগানো ন্যাকড়া ঝুলছে দেখতে পাচ্ছি কর্তা, ব্যায়রাগুলোর পরনে লালছোপ খেটে!
খেটোটা হচ্ছে ধুতির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। আরও অনেক শ্রমজীবীদের মত পালকি-বেহারাদের পুরো ধুতি পরা চলে না। জোটেই বা কই? ছালার মত মোটা সাতহাতি খেটেই তাদের জাতীয় পোশাক। লোকের বাড়ি কাজে-কর্মে বিয়ে-পৈতেয় লাল রঙে ছোপানো ওই ধুতি মাঝে মাঝে তাদের জোটে। এতে সুবিধেটা খুব। মাস তিন-চার ক্ষার না কোচে চালানো হয়।
লাল হলুদ রঙটাই শুধু নয়, ক্রমশ মানুষগুলোও স্পষ্ট হচ্ছে। গদাই আরও একটা উৎফুল্ল আবিষ্কার করে, পশ্চাতে গো-গাড়িও আসছে কত্তা, বলদের গলার ঘন্টি শুনতে পাচ্ছি। এ আর বরযাভীর না হয়ে যায় না। ইন্দিকেই কোথাও বে। উই পাশের গার সড়ক দিয়ে বেরিয়েছে।
পালকি নামা! গম্ভীর কণ্ঠে হুকুম করেন। রামকালী।
দেখা দরকার প্রকৃত ঘটনা গদাইয়ের আন্দাজ অনুযায়ী। কিনা। আর এও জানা দরকার যদি সত্যিই তাই হয়, কে এমন দুর্কিনীত আছে তার গ্রামে, যে ব্যক্তি মেয়ের বিয়ে দিতে বসেছে, অথচ রামকালীকে জানায় নি! আর এ গ্রামের যদি নাও হয়, খোঁজ নেওয়াও চাই, গ্রামের ওপর দিয়ে বারযাত্রী নিয়ে যাচ্ছে কোথায়!
রামকালীর মনে যাই থাক, বেহারাগুলো একটুখানির জন্যেও বাঁচল। একটা পাকুড় গাছতলায় পালকি নামিয়ে, খানিক তফাতে গিয়ে কাঁধের গামছা ঘুরিয়ে বাতাস খেতে লাগল।
কত্তামশায়ের চোখের সামনে তো আর বাতাস খাওয়া চলে না!
কিছুক্ষণ পরেই দূরবতী পালকি অদূরবতী এবং ক্রমশ নিকটবর্তী হল।
রামকালী বেরিয়ে পড়ে কাঁধের মটকার চাদরখানা গুছিয়ে কাঁধে ফেলে রাজ্যোচিত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে জলদগম্ভীর কণ্ঠে হাঁক দিলেন, কে যায়?
পালকি থামল। না থেমে এগিয়ে যাবার সাধ্য কার আছে, এই কণ্ঠকে উপেক্ষা করে?
পালকি থামল।
বর আর বরকর্তা এতে সমাসীন। বরকর্তার সঙ্গে সঙ্গে কিশোর বরটিও সভয়ে একটু মুখ বাডাল।
ওই দীর্ঘকায় গৌরকান্তি পুরুষ মাটিতে নেমে দাঁড়িয়ে, অতএব কে পালকি চড়ে বসে থাকতে পারে তার সামনে?
সে পালকি থেকেও নামলেন। বরকর্তা।
করজোড়ে বললেন, আপনি আজ্ঞে?
রামকালীর কিন্তু তখন ভুরু কুঁচকেছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির শরসন্ধান চলছে পালকির মধ্যে। অভ্যাবসশতই দুই হাত তুলে প্রতি-নমস্কারের ভঙ্গীতে বললেন, আমি রামকালী চাটুয্যে।
রামকালী চাটুয্যে!
ভদ্রসন্তান বিহ্বল হয়ে—না আত্মগত, না প্ৰশ্নসূচক, কেমন যেন আলগা ভাবে উচ্চারণ করলেন, কবরেজ!
হ্যাঁ। ছেলেটির কপালে চন্দন দেখলাম মনে হল, বিবাহ নাকি!
সে ভদ্রলোক রামকালীর চাইতে ছোট না হলেও বিনয়ে কীটানুকীটের মত ছোট হয়ে পায়ের ধুলো নিয়ে বলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। ওঃ, কী পরম ভাগ্য আমার যে এই শুভযাত্রায় আপনার দর্শন পেলাম।
আহাহা! আপনাকে চেনে না। এ তল্লাটে এমন অভাগা কে আছে? তবে নাকি চাক্ষ্মষ দর্শনের সৌভাগ্য ইতিপূর্বে হয় নি। রাজু, বেরিয়ে এসে পায়ের ধুলো নাও!
থাক থাক, বিয়ের বর! রামকালী স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, আপনার পুত্ৰ? আজ্ঞে না, ভ্রাতুষ্পপুত্র। পুত্র আমার কনিষ্ঠ সহোদরের। সে আছে পেছনে গো-যানে। আরও সব আত্মকুটুম্ব আসছেন তো!
হুঁ, কন্যাটি কোথাকার?
আজ্ঞে এই যে পাটমহলের। পাটমহলের লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের পৌত্রী—
লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়িয্যের পৌত্রী? রামকালী যেন সহসা সচেতন হলেন, তাই নাকি? আপনারা কোথাকার? আপনার ঠাকুরের নাম?
আমরা বলাগাড়ের। ঠাকুরে নাম ঈশ্বর গঙ্গাধর মুখোঁপাধ্যায়, পিতামহের নাম ঈশ্বর গুণধর মুখোঁপাধ্যায়, আমার নাম-
থাক, আপনার নামে প্রয়োজন নেই। তা হলে আপনারা মুখুটি কুলীন? তা হাবভাব এমন যজমেনে ভট্টচায্যের মতন কেন? কিন্তু সে যাক, দুটো কথা আছে আপনার সঙ্গে। বর নিয়ে বেরিয়েছেন কখন?
যজমেনে ভট্টচার্য শব্দটায় ঈষৎ ক্ষুব্ধ হয়ে পাত্রের জেঠা গভীরভাবে বলেন, আভ্যুদায়িক শ্ৰাদ্ধের পর।
সে তো বুঝলাম, কিন্তু সেটা কত বেলায়?
এই এক প্রহরটিাক আগে হবে।
হুঁ! পাত্রের কপালের ঐ চন্দন রেখা কি সেই তখনকারই নাকি?
চন্দন রেখা!
এ আবার কেমন প্রশ্ন!
পাত্রের জেঠা নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, কিন্তু পাত্রের কপালের চন্দনরেখাঙ্কনের কালনির্ণয়ের মত এমন অদ্ভুত প্রশ্নের জন্য নিশ্চয় প্রস্তুত ছিলেন না। তাই অবোধের মত বলেন, কি বলছেন?
বলছি, ছেলের কপালে এই যে চন্দন পরানো হয়েছে, ওটা কি সেই যাত্রাকালেই?
আজ্ঞে হ্যাঁ, তা তো নিশ্চয়ই। পাত্রের জেঠা সোৎসাহে বলেন, যাত্রাকালে মেয়েরা যেমন পরিয়ে দেয় তেমনি দেওয়া হয়েছে, আমাদের বাড়ির মেয়েদের বুঝলেন। কিনা এসন ব্যাপার খুব নামডাক আছে। পাড়া থেকে ডাকতে আসে পিঁড়ি আলপনা দিতে, শ্ৰী গড়তে, বর কনে সাজাতে—
রামকালী ওই পালকির দিকে তাকাতে তাকাতে আবার কেমন অন্যমনা হয়ে পড়েছিলেন, ইত্যবসরে পশ্চাৎবর্তী গোরুর গাড়ি দুখানা এসে পড়েছে। পালকি নামানো এবং অপর এক পালকির আরোহীর সঙ্গে বাক্যবিন্যাসের ব্যাপার দেখে ঈষৎ ঘাবড়ে গিয়ে বরের বাপিও নেমে এসে দাঁড়িয়েছেন।
অন্যমনা রামকালী একটা দীর্ঘঃনিশ্বাস ফেলে গাঢ় স্বরে বলেন, আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করছি মুখুজ্যে মশাই, আপনি যাত্ৰা স্থগিত করুন।
যাত্রা স্থগিত করুন!
বিবাহযাত্ৰা! হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন বরের জেঠা আর বরের বাপ। লোকটা পাগল না। শয়তান! না কনের বাড়ির সঙ্গে গভীরতম কোন শক্ৰতা আছে?
ওদিকে ঘুম ছুটে যাচ্ছে বেহারাদের, রোদুরটা অসহনীয় হয় উঠেছে। দু পালকির বেহারারা অদূরে দাঁড়িয়ে পরস্পর বাক্যবিনিময় করে ব্যাপারটা অনুধাবন করার চেষ্টা করতে ঘন ঘন এদিকে তাকাচ্ছে কখন পালকি তোলার ডাক পড়ে।
ব্যাপারটা যে একটা কিছু হচ্ছে, এ অনুমান করে ইত্যবসরে গরুর গাড়ি থেকে এক ব্যক্তি লাফিয়ে নেমে পড়েছেন, যিনি হচ্ছেন বরের পিসে; গাড়ির ছাঁইয়ের মধ্যে গলদঘর্ম হয়ে আসতে আসতে এমনিতেই মেজাজ তার চড়ে উঠেছিল, নেমেই যাত্ৰা স্থগিতের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, কে মশাই আপনি? ভাঙচি দেবার আর জায়গা খুঁজে পান নি? যাত্রা করে বর বেরিয়েছে, পথের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে ভাঙচি দিচ্ছেন?
মুখুজ্যে ভ্রাতৃদ্বয় ভগ্নীপতির এ হেন দুর্বিনয়ে বিচলিত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, আঃ গাঙ্গুলী মশাই, কাকে কি বলছেন? ইনি কে তা জানেন?
জানতে চাইনে মুখুয্যে, থামো তুমি। যে ব্যক্তি এ হেন অর্বাচীনের ন্যায় কথা কয়—
চোপরাও! হঠাৎ যেন ঘুমন্ত বাঘ জেগে উঠে গর্জে উঠল, চোপরাও বামুনের ঘরের কুষ্মাণ্ড!
মুখুজ্যে! চেঁচিয়ে উঠল বাঘের পর খেকশিয়াল, দাঁড়িয়ে অপমানিত হবার জন্যে তোমার ছেলের বিয়ের বরযাত্তর হয়ে আসিনি। ইটি বোধ হয় তোমার কোন বড় কুটুম্ব? তা একে নিয়েই ৰিয়ে দেওয়াও গে, আমি চললাম।
আহাহা, করেন কি গাঙ্গুলী মশাই! ইনি হচ্ছেন আমাদের সাতখানা গায়ের মাথা কবিরাজ চাটুয্যে মশাই। অবশ্যই অনিবাৰ্য কোন কারণে ইনি যাত্ৰা স্থগিতের আদেশ-
কবরেজ চাটুয্যে! অ্যাঁ!
গাঙ্গুলীর কাছার কাপড় আলগা হয়ে পড়ে, তিনি সহসা আধাবিঘৎটাক জিভ বার করে সে জিভে দাঁতে কেটে, দু হাতে দু কান মলে বয়সের মর্যাদা ভুলে প্ৰণাম করে বসেন।
রামকালী প্ৰণামরতের প্রতি দৃকপাত মাত্র না করে সমান স্থৈ্যুর্যের সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ, অনিবার্য কারণেই বলছি মুখুয্যে মশাই, যাত্রা স্থগিত রাখুন! নইলে অকারণ আপনাদের পুত্রের বিবাহযাত্রা স্থগিত রাখতে বলব, এমন অর্বাচীন সত্যিই আমি নই।
বড় মুখুয্যে দুহাত কচলে বলেন, আজ্ঞে তা আর বলতে! মানে ইয়ে লক্ষ্মীকান্তবাবুর বংশে কোন দোষ-
আঃ মুখুয্যে মশাই, অনুগ্রহ করে আমাকে অন্ত ইতর ভাববেন না। আমি বলছি পুত্রের বিয়ে দিতে গিয়ে আপনি বিপদে পড়বেন। আপনার পুত্ৰ অসুস্থ।
পুত্ৰ অসুস্থ! এ আবার কি প্যাঁচের কথা!
এ যে দেখছি সমুদ্রের দিক থেকে পাথর ছুটে আসা! এ পাথরের আশঙ্কা তো ছিল না! কন্যাপক্ষে কোন গোলমাল আছে, এবং ইনি অবশ্যই কন্যাপক্ষের কোন বিশেষ হিতৈষী, এইটাই ভাবছিলেন মুখুয্যেরা। যেটা স্বাভাবিক। তা নয়, পথের মাঝখানে আটকে এ কী উলটো চাপ।
পুত্ৰ অসুস্থ! বলেন কি কবিরাজ মশাই? এ যে একটা অসম্ভব কথা বলছেন। অমন সুস্থ সহজ পুত্র আমার। উপবাসে ও মধ্যাহ্নকালের উত্তাপে বোধ করি ঈষৎ শুষ্ক দেখাচ্ছে! ছোট মুখুয্যে কাতরভাবে বলেন।
না, শুষ্ক দেখাচ্ছে না। রামকালী জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, বরং বিপরীত। রীতিমত রসস্থই দেখাচ্ছে, লক্ষ্য করলেই টের পাবেন। আমি গোড়াতেই লক্ষ্য করেছিলাম,এবং আপনাকে নিবৃত্ত করবার সংকল্প নিয়েই আটকেছি। ছেলেটির চেহারায় আমি শিরঃশূলী-সান্নিপাতিকের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। বিবাহসভায় নিয়ে গিয়ে সঙ্কটে পড়বেন। বাড়ি ফিরে যান, কন্যার বাড়িতে সংবাদ দিন।
বরের পিসে পূর্ব বিনয় ভুলে গিয়ে রুখে ওঠেন, ভ্যালা ঝামেলা করলে তা দেখছি। আজ বিবাহ, রাত্রির প্রথম প্রহরে লগ্ন, এখন ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব, আর কন্যাপক্ষকে সংবাদ দেব পাত্ৰ অসুস্থ? এ কি ছেলের হাতের মোয়া নাকি? বুঝতে পারছি আপনি কন্যাপক্ষের একজন মস্ত হিতৈষী!
রামকালীর গৌর মুখ রোদের তাতে এমনিতেই লাল টকটকে হয়ে উঠেছিল, এবার আগুনের মত গানগনে দেখাল।
তবু উত্তেজিত হলেন না।
স-তাচ্ছিল্যে গাঙ্গুলির প্রতি একটা কটাক্ষপাত করে বললেন, হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, বিশেষ হিতৈষী। লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যে মশাই আমার মাতুলের সতীর্থ পিতৃতুল্য। তাঁর পৌত্রীটি যে বিবাহরাত্রেই বিধবা হয় এটা আমার অভিপ্রেত হতে পারে না।
নির্মল নির্মেঘ আকাশ থেকে যেন বজ্রপাত ঘটল।
এ কী সর্বনেশে অলক্ষণের কথা!
এ কী অভিশাপ, না অপ্রকৃতিস্থ মস্তিষ্কের প্রলাপ? মুখুয্যে গলার পৈতে হাতে জড়িয়ে হাঁ হাঁ করে উঠলেন।
রামকালী নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখা, —কঠিনহৃদয় বিচারক অপরাধীর প্রতি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েও যেমন স্থির থাকে, তেমনি অচল অটল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
অভিশাপ দেওয়া হল না, পৈতে হাত থেকে ছেড়ে মুখুয্যেরা কেঁদে উঠলেন, এ কী বলছেন কবরেজ মশাই?
কি করব বলুন, আমি মুখের উপর স্পষ্ট বলতে চাই নি, আপনারাই বললেন। শুনুন, যদি হিত চান, এখনও পুত্রকে তার জননীর কাছে নিয়ে যান। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি স্বয়ং কাল ওর শিয়রে দাঁড়িয়ে। আর বেশী বাক্যব্যয়ে সময়ের অপচয় করবেন না, তাছাড়া আপনারা উচাটন হলে পুত্ৰ বিহ্বল হবে।
কিন্তু মুখুয্যেরাও তো রক্তমাংসের মানুষ। ওদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস দিয়ে তৈরী মন। যে ছেলে পালকির মধ্যে দিব্যি বসে রয়েছে, মাঝ-মাঝে মুখ বাড়িয়ে দেখেও নিচ্ছে কী হচ্ছে এখানে, যার কপালে এখনও চন্দনের রেখা জ্বলজ্বল করছে, আর গলার মালা থেকে সুগন্ধ বিকীরণ করছে, সামান্য একটা মানুষের কথায় বিশ্বাস করে বসবেন যে সে ছেলের শিয়রে শমন দাঁড়িয়ে! আর সেই কথায় বিশ্বাস করে একটা নিরীহ ভদ্রলোককে মরণান্তক সর্বনাশের গহবরে নিক্ষেপ করে মূঢ়ের মত যাত্ৰা-করা বর নিয়ে ফিরে যাবেন! বাঁড়িয্যেদের হবে কি? কন্যা ভ্ৰষ্টালগ্ন হওয়া মৃত্যুর চাইতে কি কিছু কম?
না, এ অসম্ভব! নিশ্চয় এ কোন চক্রান্ত!
হয় এই চাটুয্যের সঙ্গে লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের ঘোরতর কোন শত্রুতা আছে, নচেৎ এই লোকটা আদৌ চাটুয্যেই নয়! কোন ক্ষ্যাপাটে বামুন! তবু এই ব্যক্তিত্বের প্রভাবের সামনে কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আর সন্তানের সম্পর্কে অত বড় অভিশাপ-সদৃশ্য বাণী!
ছোটমুখুয্যে একবার অদূরবতী পালকির দিকে তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাস-বক্ষে বলেন, আমি তো রোগের কোন লক্ষণ দেখছি না। কবরেজ মশাই!
রামকালী একটু বিষাদব্যঞ্জক হাসি হাসেন, তা দেখতে পেলে তো আমার সঙ্গে আপনার কোন প্রভেদ থাকত না মুখুজ্যে মশাই। আসুন, এদিকে সরে আসুন। দেখছেন তাকিয়ে ছেলের ললাটে ওই চন্দনরেখা দেখা? সদ্য চন্দনের মত আৰ্দ! অথচ বলছেন এক প্রহরকাল আগে চন্দন পরানো হয়েছে! তাহলে সে চন্দন এতক্ষণে শুকিয়ে খড়ি হয়ে যাবার কথা। হয় নি। কারণ চোরা সান্নিপাতিকে সর্বশরীর রসস্থ হয়ে উঠেছে—
এই কথা! হঠাৎ পাত্রের জেঠা হেসে ওঠেন, কবিরাজ মশাই, খুব সম্ভব পথশ্রমে আপনি কিছু অধিক ক্লান্ত, তাই লক্ষণ নির্ণয়ে ভুল করছেন। গ্ৰীষ্মকালে ঘাম-নিৰ্গমের দরুন চন্দন শুকিয়ে ওঠবার অবকাশ পায় নি, এই তো কথা! ওহে বেয়ারারা, চল চল। পালকি ওঠাও। শুভযাত্রায় এ কী বিপত্তি!
লক্ষণ নির্ণয়ে ভুল করেছেন রামকালী! রামকালীর নিজেরই মাথার শিরা ফেটে যাবে নাকি!
একবার নিজের পালকির দিকে অগ্রসর হতে উদ্যত হলেন রামকালী, কিন্তু আবার কি ভেবে থমকে দাঁড়িয়ে আরও ভারী গলায় বললেন, শুনুন মুখুয্যে মশাই, রামকালী চাটুয্যের লক্ষণ নির্ণয়ে ভুল হয়েছে, এ কথা যদি অন্য কোন ক্ষেত্রে উচ্চারণ করতেন, সে ঔদ্ধত্যের সমুচিত উত্তর পেতেন। কিন্তু এখন আপনার সঙ্কট সময়, ওদিকে বাঁড়ুয্যেরাও বিপন্ন, তাই মার্জনা পেয়ে গেলেন। লক্ষ্মীকান্ত লাড়ুয্যের বাড়ি এখনই সংবাদ দেওয়া প্রয়োজন, এবং সে কাজ আমাকেই করতে হবে। প্রয়োজন হলে পালকি ছেড়ে দিয়ে ঘোড়া নিতে হবে। তবে আপনাকে শেষ সাবধান কথা জানিয়ে যাচ্ছি, ছেলেটির মাথার শিরা ছিঁড়ে ভিতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে, চোখের শিরার রং এবং রাগের শিরার স্ফীতির দিকে লক্ষ্য করলে আপনিও ধরতে পারবেন। মনে হচ্ছে খানিক বাদেই বিকার শুরু হবে। জানানো আমার কর্তব্য বলেই জানিয়ে দিলাম। বলছিলেন না লক্ষণনির্ণয়ে ভুল! ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, রামকালী কবরেজের বিচারে যেন ভুলই হয়ে থাকে। রোদের ঘামকে কালঘাম ভাবার ভ্রান্তিই তার হয়েছে, এই যেন হয়। আর কি বলব! আচ্ছা নমস্কার। …ওরে গদাই, তোল পালকি। পা চালিয়ে একবার বসিরের ওখানে চল দিকি, ঘোড়াটাকে নিতে হবে।
পালকি চলতে শুরু করেছে। হঠাৎ ছুটে এলেন ছোট মুখুয্যে, প্রায় ড়ুকরে কেঁদে চীৎকার করে উঠলেন, কবরেজ মশাই, এত বড় সর্বনাশের কথা বললেন যদি তো একটু ওষুধ দিলেন না?
রামকালী গম্ভীর বিষণ্ণ ভাবে হাতটা একটু নেড়ে সে হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, দেবার হলে আপনাকে বলতে হত না, আমি নিজেই দিতাম। কিন্তু এখন আর স্বয়ং ধন্বন্তরীর বাবারও সাধ্য নেই।
ও পালকিতে তখন বড় মুখুয্যে উঠে পড়ে বিরক্তভাবে বলে ওঠেন, দুৰ্গা দুর্গা, যত সব বিঘ্ন! কালে কার মুখ দেখে বেরোনো হয়েছিল! কোথা থেকে এক উৎপাত জুটে, —এই রাজু, অমন ঢলছিল কেন? গরমে কষ্ট হচ্ছে?
রাজু রক্তবর্ণ দুটি চোখ মেলে বলে, না জেঠামশাই, শুধু বড্ড শীত করছে।