কথায় আছে মাটি বোবা।
কিন্তু কলকাতার মাটি বোধ করি কথা কয়। বোধ করি তার মূল বনেদে অনন্তকালেব সহস্ৰস্তরের ঐতিহ্য নেই বলেই প্রকৃতিতে তার উঠতি বয়সের মেয়ের চপলতা আর মুখরতা। সেই মুখরতার ঝাঁপটায় সে মূককে বাচাল করে তুলতে পারে। তাই কলকাতার বাসিন্দারা কিছু। না শিখেও পণ্ডিত, কিছু না বুঝেও বোদ্ধা।
সত্য বলে, এ নাকি শুধু কলকেতার হাওয়ারই নয়, কলের জলেরও গুণ।
তা হতেও পারে।
আদি অনন্তকাল তো লোকে পৃথিবীর গহ্বর থেকেই আঁজলা ভরে নিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করেছে, জীবনযাত্রার প্রয়োজন মিটিয়েছে। যেখানে সে গহ্বর আছে ভাল, যেখানে নেই সেখানে কোদাল চালিয়ে গহ্বর খুঁড়েছে। তার পর তার কাছে এসেছে ঘট নিয়ে কলসী নিয়ে, ভরে নিয়ে গেছে অসময়ের জন্যে। কে কবে মাটির নীচে নল চালিয়ে জলকে হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিয়ে তাকে হুকুমের চাকর বানিয়ে ফেলবার কল গড়তে শিখেছিল? শেখে নি!…. কলকাতা শিখে ফেলেছে। জল হেন দুর্লভ বস্তু, কল মোচড় দিয়েই তাকে আদায় করছে। এ কী কম তাজ্জব!
এ জলের বিশেষ গুণ শরীরে বর্তাবে বৈকি। আর কিছু না হোক, কলের জলটা সাহসের যোগানদার।
নইলে আর নবকুমারের সাহস হয় ভবতোষ মাস্টারকে মুখের ওপর বলতে, আমরা আপনাকে ত্যাগ করলাম মাস্টার মশাই। ভবিষ্যতে আপনি আর আমাদের বাড়িতে মাথা গলাতে আসবেন না।
বলেছে সে খবরটা নবকুমার নিজেই গিয়ে পৌঁছে দিল নিতাইকে। বলল, রেখে ঢেকে বললাম, বুঝলি? আচ্ছা করে শুনিয়ে দিলাম। যখন মান্যের ছিলেন তখন মান্য করেছি, এখন উনি যদি মান্যের মর্যাদা নিজে ঘুচিয়ে গালে মুখে চুনকালি লেপেন, মান্য রাখবার দায় আমার নয়। এই বুড়ো বয়সে উনি যদি ধর্ম খোয়াতে পারেন, মানুষের ছেদ্দা-ভক্তি-ভালবাসা সবই খোয়াতে হবে। ছি ছি, কি করে যে এ দুর্মতি হল মাস্টারের, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না। বিদেশবিভুঁই জায়গায় একটা অভিভাবকের মত ছিলেন সেটা ঘুচল।
নিতাই একটু পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বলে, সম্পর্ক আর রাখবি না তা হলে?
ক্ষেপেছিস! উনি তো ‘পতিত’! পতিতের সঙ্গে আবার সম্পর্ক কি?
না, নিতাইকে পতিত বলে ত্যাগ করে নি নবকুমার। প্রতিদিন ওর মেসে ধর্না দিয়ে যায়, আর হাতে পায়ে ধরে বলে, এবং শেষ অবধি ভবতোষ মাস্টারের পরামর্শমত সত্যকে দিয়ে বলিয়ে সুরাহার পথে এনেছে তাকে।
অবিশ্যি সেও হয়ে গেল অনেকদিন। নবকুমারের বড় ছেলে, যার ভাল নাম নাকি সাধনকুমার, সে তখন ফোর্থ ক্লাসে পড়ত, আর এখন সে এনট্রেন্স পাসের পড়া পড়ছে। সত্য বলেছে জলপানি নেওয়া চাই। বলেছে জলপানি নিয়ে পাস করতে না পারলে সত্যর জীবনের সাধনাই মিথ্যে।
গাঁয়ের ছেলেরা পাঁচ মাইল রাস্তা ভেঙে ইস্কুলে পড়ে পড়ে যেটুকু করছে, সত্যর সাধনকুমারও যদি এতখানি সুযোগ সুবিধে পেয়েও সেইটুকু করে, কি হল এই যুদ্ধ আর বলক্ষয়ে?
অবিশ্যি শুধু জলপানি পাওয়াটাই শেষ কথা নয়। মানুষের মত মানুষ হতে হবে সত্যর ছেলেদের। কিন্তু লেখাপড়ায় মুখোজ্জ্বলটা তো তার প্রথম সোপান।
তা ছেলেটা মুখ রাখবে বলে মনে হয়। অন্তত ওর মাস্টার তো তাই বলে, নগদ মাস মাস দশ দশটা টাকা দিয়ে যে মাস্টারকে পুষছে নবকুমার।
কিন্তু নবকুমারের মাস্টার যে এভাবে নবকুমারের মুখ পোড়াবেন, এ কথা কে কবে ভেবেছিল?
স্বস্তি জিনিসটা কি এতই দুর্লভ!
সেই কতদিন তো গেল নিতাইয়ের দুর্মতির গ্লানিতে। কত হাঁটাহাঁটি করতে হয়েছে তার মেসে, কত কাকুতিমিনতি করতে হয়েছে তার কাছে, হেসে উড়িয়েছে নিতাই। জ্বালাভরা তিক্ত হাসি। বলেছে, আমাদের মতন একটা অখদ্যে অবদ্যের জন্যে আবার ভাবনা! রইলাম কি উচ্ছন্ন গেলাম ত্রিভুবনের কার কি এসে গেল তাতে? বেশ আছি। খাচ্ছিদাচ্ছি রঙিন নেশা নিয়ে পড়ে আছি। তোমরা বাবা গুড বয়, দামী মাল, জগতে তোমাদের দরকার আছে, তোমরা ভাল হও গে।
কিন্তু এই এক জায়গায় নবকুমার হালছাড়া হয় নি, দৃঢ় থেকেছে। নিতাইকে সুপথে আনতেই হবে।
শেষ পর্যন্ত ভবতোষ মাস্টারের নির্দেশমত সত্যর কাছেই নিতাইকে টেনে এনে হাজির করেছিল নবকুমার। বলেছিল, নাও এবার মোকাবিলা কর দ্যাওরের সঙ্গে। বোঝাও সংসারে ওর দাম আছে কি নেই?
সত্যর তখন শঙ্করীর ব্যাপারে মনপ্রাণ ভাল নয়, তাই থমথমে মুখে বলেছিল, দাম আছে কি নেই সে কথা আমি বোঝাব?
নবকুমার মাথা চুলকে বলে, ও তো তাই বলছে। মানে, বলছে, ও উচ্ছন্ন গেলে কারুর কিছু এসে যাবে না।
হঠাৎ স্পষ্ট করে চোখ তুলে তাকিয়েছিল সত্য নিতাইয়ের দিকে, বলেছিল, কারুর কিছু এসে যাবে না, সেটা জেনে ফেলেছ? সবজান্তা তুমি?
নিতাই সেই দৃষ্টির সামনে মাথা নীচু করেছিল।
সত্য তীব্রস্বরে বলে উঠেছিল, আমি বলছি, আমার এসে যাবে। মানবে সে কথা?
নবকুমার এই তীব্রতার মানে খুঁজে পায় নি, ঘাবড়ে গিয়েছিল। ওর ধারণা ছিল সত্য কাকুতি মিনতি করবে, দিব্যিদিলেশা দেবে। কিন্তু কই! তেমন তো দেখা গেল না!
ধমকই কি দিল?
মনে হচ্ছে না তা, অথচ কথাটা যে জোরালো তাতে সন্দেহ নেই। আবার তেমনি জোরালো সুরেই বলে সত্য, আমি বলছি তোমায় ভালো হতে হবে, সভ্য-ভব্য ভদ্দরলোক হতে হবে। মানুষ যে বনের জন্তু-জানোয়ার নয় সেটা মনে রাখতে হবে। আপিসে ছুটি নাও দশ দিন, দেশে যাও, বৌ নিয়ে এস। আমি এখানে বাসার ব্যবস্থা করে রাখছি।
বৌ!
বাসা!
নিতাই আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।
সে অসম্ভব।
অসম্ভব! কেন, অসম্ভবটা কিসে?
বাড়িতে রাজী হবে না।
কে রাজী হবে না? তোমার বৌ? সত্যর স্বর তীব্র।
না, মানে একরকম তাই। নিতাই মলিন স্বরে বলে, মামা-মামী রাজী হবে না, কাজে কাজেই সেও
কাজে কাজেই সেও? এ তো দেখি আচ্ছা স্বার্থপর মেয়ে!
স্বার্থপর!
নিতাই আকাশ থেকে পড়ে।
যেখানে পরার্থপরতার চরম পরাকাষ্ঠা, সেখানে কিনা স্বার্থপরতার অপবাদ!
আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না বৌঠান।
সঙ্গে সঙ্গে নবকুমারও বলে, তাই তো! এ কথাটা তোমার আবোল-তাবোল হল বড় বৌ।
বুদ্ধি খরচ করলে বুঝতে আবোল-তাবোল নয়। বলি ওপরওয়ালাদের গোড়ে গোড় যে দেবে বৌ, সে কি ছেদ্দায়, না ভালবাসায়? বোঝাও তুমি আমায়। স্বামীর থেকে বেশী ভালবাসে তাদের? স্বামীর কাছে থেকে স্বামী বেঁধেবেড়ে খাইয়ে যত্ন করে যে পরিতৃপ্তি পাবে, তার থেকে বেশী পরিতৃপ্তি পাচ্ছে তেনাদের যত্ন করে? হক কথা বল?
প্রশ্নটা নিতাইকেই, তবে উত্তর দেয় নবকুমার।
বলে, আহা এটা আবার কথা নাকি? বাসায় আসতে চাইলে লোকনিন্দে নেই? পাঁচজনে মন্দ বলবে না? তোমার মতন–
হ্যাঁ, আমার মতন ডাকাত আর কে আছে! সে যাক, অনেক দিনের পুরনো কথা ওটা। বলি পাঁচজনে আমায় একটু মন্দ বলবে এই ভয়ে স্বামী হেন বস্তুকে ভাসিয়ে দেব, হোটেলের ভাতে ছেড়ে দিয়ে শরীর স্বাস্থ্য ঘোচাব তার, উচ্ছন্নতার পথে যেতে দেব তাকে, এটা স্বার্থপরতা নয়? পাঁচজনের মন্দ বললে কি আমার গায়ে ফোঁসকা পড়বে? কাজটা যে মন্দ নয়, সেটা আমার অন্তরাত্মা বুঝবে না? সে তো আবার বাজা মানুষ। কি নিয়ে আছে শুনি? উদয়াস্ত জগতের যাবতীয় ওঁচা কাজ নিয়ে পড়ে আছে, তার বিনিময়ে লোকে সুখ্যাতি করছে, এই কি একটা মনিয্যির জীবন? আমি তোমায় বলছি ঠাকুরপো, যদি নিজের হিত চাও, বৌকে নিজের কাছে এনে রাখ। বাসা আমি দেখছি।
হঠাৎ আরও একদিনের মত নিতাই একটা কাজ করে বসে। হেঁট হয়ে সত্যর দুই পায়ে হাত দিয়ে সে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলে, নিজের হিত অহিত আমি বুঝি না বৌঠান, বুঝি শুধু আপনাকে। আপনি যদি হুকুম করেন, তা হলেই
হ্যাঁ, হুকুমই করছি আমি। সত্য দৃঢ় স্বরে বলে, হুকুম করছি মানুষের মত ঘর-সংসার কর, অলীক স্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামিও না।
নিতাই চলে যায়।
সত্য চলে যায় নিজের কাজে। নবকুমার বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকে ফ্যালফেলিয়ে। প্রকৃত ঘটনা যে কি ঘটল, তা যেন অনুধাবন করতে পারছে না। অথচ ওর চোখের ওপরই এমন একটা কিছু ঘটল, যেটা ঠিক সচরাচরের নয় এ বোধ আসছে। সত্য আর নিতাই যেন উর্দু ফার্সি অন্য আর এক ভাষায় কথা বলল।
অথচ সত্যকে এখন জিজ্ঞেস করে ব্যস্ত করাও চলে না। শঙ্করীর কীর্তিতে সত্য নিতান্তই মনমরা এখন।
.
সত্যি, শঙ্করী যে সত্যর সঙ্গে এত বড় শক্রতা সাধবে, এ কি সত্য স্বপ্নেও ভেবেছিল? এ যেন পূর্বজন্মের শত্রুতার ঋণশোধ করে গেল শঙ্করী!
নইলে চিরদিনই হারিয়ে যাওয়া মানুষটা, একদিনের তরে মনের কোণেও যাকে আনে নি, সে হঠাৎ এমন আচমকা দেখাই বা দেবে কেন, চেনাই বা করবে কেন?
কত সুখে কাটাচ্ছিল সত্য, হঠাৎ যেন শঙ্করী তার সেই সুখের প্রাণে একটা ছুরির আঁচড় টেনে ক্ষত করে দিয়ে গেল।
সেই যে গল্প আছে কবর থেকে প্রেতাত্মা উঠে এসে মানুষকে যন্ত্রণা দেয়, সেই প্রেতাত্মার মতই করল শঙ্করী।
কী করেছিল সত্য তার কাছে যে এইভাবে দাগা দিয়ে গেল সত্যকে?
বাবাকে চিঠি লিখেছিল সত্য, শঙ্করীকে পাওয়ার খবর জানিয়ে, বাবা কি বলেন না বলেন জানতে। সে চিঠির জবাব আসার আগেই নতুন খবর ঘটাল শঙ্করী।
দু দিনও তর সইল না তার?
এ যেন সত্যিই সত্যকে ধরল আর ধারালো অস্তরখানা শানিয়ে তুলে বসিয়ে দিল সত্যর বুকের মাঝখানে!
এই দীর্ঘকাল ধরে শত লাঞ্ছনা আর শত ধিক্কারের ভাত খেয়ে খেয়ে যে প্রাণটাকে পুষে রেখেছিল শঙ্করী, একটা দিন সত্যর কাছে ভালবাসার ভাত খেয়ে হেলায় বিসর্জন দিলে সেই প্রাণটাকে?
এর চাইতে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতা আর কি আছে?
খবরটা শুনেই সত্য মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে সেই কথাই বলেছিল, জানি, জানতাম। চিরকেলে পাষাণ! মেয়েমানুষ এত বড় নিষ্ঠুর, উঃ!
তারপর ডাক ছেড়ে বলে উঠেছিল, ওগো বৌ, কুক্ষণে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তোমার, কুক্ষণে আমি বলেছিলাম তোমার মেয়েটার ভার নেব! কেন মরতে বললাম গো! না বললে তো তুমি এমনভাবে দায়মুক্ত হতে পারতে না!
তা কথাটা তো ভুল নয়, সুহাসের দায়েই তো এ যাবৎকাল অত বড় গ্লানির জীবন বয়ে বেড়াচ্ছিল শঙ্করী!
সে দায় থেকে মুক্ত হল বলেই তো
নাকি শুধু সাময়িক উত্তেজনার ফল? মেয়ে যখন মায়ের সঙ্গে কোদল করে বলে বসেছিল, আমি যখন এতই গলার পাথর তোমার, সে পাথর সরিয়ে দিয়ে যাব, তখন কি শঙ্করীর মুখে একটা ক্রুদ্ধ আক্রোশের তীব্র হাসি ফুটে উঠেছিল? ভেবেছিল কি, বটে! চিরকাল আমিই শুধু জব্দ হব তোমার কাছে? পাপের প্রাচিত্তির আর হচ্ছে না আমার? জন্মাবধি জব্দ করে রেখেছ তুমি আমাকে, আবার মরে জব্দ করতে চাও? আচ্ছা দেখ এবার কে কাকে জব্দ করে!
কে জানে কোন কথাটা সত্যি!
ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে দীর্ঘকালের পরিকল্পনাকে রূপ দিয়েছিল শঙ্করী, নাকি ক্ষণিক মুহর্তের অসতর্কতায় কূলে এসে ওঠা নৌকোখানাকে ডুবিয়ে বসেছিল?
না, প্রকৃত কথা কেউ জানে না।
আত্মহত্যা করবার আগে যে একটু লিখে রেখে যেতে হয়, আমার মরার জন্যে কেউ দায়ী নয়– সেটুকুও জানত না শঙ্করী। অথবা সে রেওয়াজ তখনও চালু হয়নি।
লিখতে ওরা শেখে নি বলেই হয়তো চালু হয় নি।
চালু হয় নি, তাই রাত পোয়াতেই দত্তদের বাড়ির অন্দরে হৈ-হৈ উঠল। রাতে রান্নাঘরের পাশের ঘরে আড়ায় দড়ি বেঁধে জুলে মরেছে পানসাজুনি বামুনদিদি
ওমা কেন গো!
কী দুঃখে!
এই যে কাল আহ্লাদের সাগরে ভাসছিল, দেশের লোকের সন্ধান খবর পেয়ে, তাঁদের কাছে আদরের ভাত খেয়ে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবই তো বলেছিল, বলেছিল, দেশের লোক, চিরকালের চেনা-জানা, ছাড়ছে না, মেয়েটার সুদ্ধ ভার নেবে বলেছে, এ সুযোগ ছাড়তে পারব না মা। অনেক দিন তো দাস্যবিত্তি করলাম।
কালীতলায় নাকি পরিচয় হয়েছিল।
কিন্তু মানুষটা আর কেউ না, দত্তদের সাত নম্বর বাড়ির সেই অহঙ্কারী ভাড়াটে।
তার কাছেই আশ্রয়ের আশ্বাস পেয়েছিল সে।
চলেই যেত।
তবে দিনক্ষণের ছুতো দেখিয়ে বলেছিল, চৈৎ পোষ ভাদ্দর এ তিনটে মাসে পোষা বিড়ালটাকেও বিদেয় দিতে নেই মা, দিলে গেরস্থর অকল্যাণ। এতদিন নেমক খেলাম, অকল্যাণ করব না তোমার। এ মাসটা আর যাব না।
হঠাৎ সবুদ্ধি কি করে বিনষ্ট হল শঙ্করীর? কি করে বিস্মৃত হল সে নিমকের ঋণ!
তাই অদিনে অক্ষণে গেরস্থর অকল্যাণ ঘটিয়ে চিরদিনের মত বিদেয় হয়ে গেল?
.
হৈ-হৈ হল।
তবে নাকি বড়মানুষের অন্দর, আর দীনদুঃখী চাকরানী বিধবার প্রাণ। তাই সে হৈ হৈ ফুটল আর মরল। থানা পুলিস তো দূরের কথা, বৈঠকখানার কর্তারাও সবাই টের পেলেন কি না পেলেন। অন্তত টের পেয়েছেন এ লক্ষণ প্রকাশ পেল না তাদের আচরণে।
গড়গড়ায় একটানা শব্দটার একবার হয়তো একটু ছন্দপতন হল, গলা থেকে একবার হয়তো একটু হুঙ্কার উঠল, তার বেশী নয়।
দত্তদের খিড়কির দরজা দিয়ে বার হয়ে গেল শঙ্করীর মৃতদেহ। নিজের দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সত্য। যখন চলে গেল, চোখছাড়া হয়ে গেল, হাত দুটো একবার তুলে নমস্কার করে মনে মনে বলল, এত পতনেও ভেতরে ভেতরে তুমি খাড়া তেজী ছিলে বৌ, বুঝতে পারছি। তাই ছোট ননদের করুণার আশ্রয়ে থাকতে আর রইলে না। সবাই শুধোচ্ছে কারণ, কারণ! হাড়ে হাড়ে বুঝেছি, আমিই কারণ। কি করব, আমার নিয়তি! ভগবান যাকে যার নিমিত্ত করেন!
ঠিক এই সময়ে ও-বাড়ি থেকে একজন দাসী ডাকতে এল সত্যকে, বড় গিন্নীমা ডাকতেছে।
সত্য দ্বিরুক্তি করল না।
হয়তো এই ডাকটির প্রতীক্ষাই করছিল।
অবশ্য ডেকে ওকে সন্দেশ খাওয়াবেন দত্তগিন্নী, এমন আশা করবারও হেতু ছিল না। তবে এটাও ভাবে নি সত্য। ভাবে নি ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করে গাল পাড়বেন তিনি তার সাত নম্বরের প্রজার বৌকে। একবার যেন পুলিসেরও ভয় দেখালেন, কারণ দশেধর্মে সাক্ষী দেবে, সত্যর পরামর্শতেই হঠাৎ সাদাসিধে ভালমানুষটা কেমন বিগড়ে গেছল।
তুমিই ওর মৃত্যুর কারণ। নইলে বেশ তো ছিল এযাবৎ! বললো দত্তগিন্নী।
সত্য মাথা নীচু করে সব অভিযোগ মেনে নিয়ে শুধু বলল, যা হবার তা তো হয়েই গেল, মেয়েটাকে আমায় দিন।
তোমায় দেব? মেয়েটাকে?
অমন একটা রূপবতী উঠতি বয়সের মেয়েকে অমনি এক কথায় বিলিয়ে দেবেন, এত বোকা নন দত্তগিনী! ও জিনিস হল হাতের একটা হাতিয়ার। ওকে দিয়ে সময়ে অসময়ে কত কাজ হাসিল হতে পারে, কত কাজে লাগতে পারে। তাই ভুরু কুঁচকে বলেন তিনি, তোমায় দেব মানে? তুমি কি ওর অছি? আমার সংসারেই থাকবে ও। যেমন ওর মা ছিল।
সত্য মুখ তুলে প্রশ্ন করে, পানসাজুনি চাকরানী হয়ে?
দত্তগিন্নী কালিমুখে কঠিন গলায় বলেন, তা চাকরানীর মেয়ে চাকরানী হবে না তো কি রাজরানী হবে? তবে কিনা আমাদের ঘরের পুরুষ বেটাছেলেদের দয়ার শরীর, নজরে পড়তে পারলে তাও হওয়া আশ্চয্যি নয়।
এই বিষাক্ত হুলটা যে দত্তগিন্নী জেনে বুঝে ইচ্ছে করে ফোঁটালেন, তাতে আর সন্দেহ কি! আসল কথা শঙ্করীর মরণটার জন্য আগাগোড়া সত্যকে দায়ী করে বসে আছেন তিনি, কি না জানি মন্তর কানে দিলে, আর জলজ্যান্ত ভাল ঝিটা তার কর্পূরের মত উপে গেল! এর ওপর আবার তার মেয়েটাকে দাবি করতে আসছে!
ওরে আমার কে রে!
তোমার অহঙ্কার ভাঙবার দিন এবার এসেছে আমার। বুঝেছি তোমার ভেতরের শাঁস। ওই সুহাসের মা তোমার দেশের লোক! কোন না আত্মীয়ই! তুমিও তবে সেই পদেরই লোক। মুখে অহঙ্কার দেখিয়ে আমার সঙ্গে টেক্কা?
সত্যবতী দত্তগিন্নীর মনের কথাটা বোধ করি মুখের ভাষা থেকেই আবিষ্কার করে ফেলে। তাই বিচলিত হব না প্রতিজ্ঞা করেই বলে, তা হলে তো সুবিধেই। আপনাদের ঘরের পুরুষদের যখন এত দয়ার শরীর, তখন আর ওর কী গতি হবে ভেবে কাতর হই কেন? সদ্গতিই হবে মনে হচ্ছে।
দত্তগিন্নী ভুরু কুঁচকে বলেন, কী বললে?
ওই তো বললাম!
সদগতির কথা কি বললে?
ওই তো বললাম, যদি বুঝতে না পেরে থাকেন, তবে বোঝাতে পারব না, পরে বুঝবেন। আচ্ছা তা হলে যেতে অনুমতি দিন।
দত্তগিন্নী আবার নিজমূর্তি ধলেন। বললেন, তোমায় আমি পুলিসে দিতে পারি জান? বলতে পারি, আমার লোক তোমার প্ররোচনায় মরেছে?
সত্য মৃদু হেসে বলে, তবে সেই চেষ্টাই করুন। কিন্তু আপাতত আপনাদের কোন দাসী কি ছোট ছেলেকে আমার সঙ্গে দিন, দেখিয়ে দেবে কোথায় আপনাদের বৈঠকখানা!
বৈঠকখানা দেখিয়ে দেবে? বৈঠকখানায় যাবে তুমি? তোমার মতলবখানা কি তাই বল তো?
দয়ার মানুষদের কাছে একটু ভিক্ষে চাইব। বামুনের মেয়ের তাতে দোষ নেই।
এ তো আচ্ছা জাহাবাজ মাগী! দত্তগিন্নী তেড়ে খাট থেকে উঠে দুম দুম করে মাটিতে নেমে আসেন, বলেন, তোমার রীতি-নীতি তো ভাল দেখছি না! বৈঠকখানা বাড়িতে গিয়ে পুরুষদের কাছে কী ছলা-কলা করতে যাবে শুনি? বলি একটু লাজ লাগবে না?
সত্যর মাথার কাপড়টা খসে পড়েছিল, সত্যর মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল, দুটোকেই সংবরণ করে সত্য শান্ত সুরে বলে, লজ্জার কি আছে? শুদ্দুর মাত্রেই ব্রাহ্মণকন্যার সন্তানতুল্য। সন্তানের কাছে মায়ের লজ্জার কথাটা উঠবে কেন?
তারপর কিসে কি হল দত্তগিন্নীর অজ্ঞাত!
তবে সুহাসিনীকে সত্যর সংসারেই ভর্তি করে দিতে হল তাঁকে।
মেজকর্তা অর্থাৎ মেজ দ্যাওর চটি ফটফটাতে ফটফটাতে অন্দরে ঢুকে এসে আদেশ দিলেন, ওই বামনী-মাগীর মেয়েটাকে সাত নম্বর বাড়িতে চালান করে দাও গে বড়বৌ, মেয়েটা নাকি ওদের দেশের লোক।
বৌ-মরা দ্যাওর, বলতে গেলে বড়গিন্নীর হাতের মুঠোর সম্পত্তি, তাই ভ্রূভঙ্গী করে প্রশ্ন করেন তিনি, কে কার দেশের লোক, সে খবর তোমার কানে আসে কোথা থেকে?
আসে কোথা থেকে! শোন কথা! কানে গিয়ে ঢেলে দিয়ে এলে আসবে না? ওই বাড়ূয্যের পরিবার তো নিজে গিয়ে বলল
বলল! তোমার সঙ্গে কথা কয়ে বলল!
আহা পষ্টাপষ্টি কথা কয়ে কি আর বলল? একটা চাকরানীকে দিয়ে বলল-
আর তুমি অমনি সোন্দর মুখ দেখে গলে গেলে! ধন্য বটে! এসব অন্দরমহলের কথায় তোমার থাকবার দরকার নেই মেজবাবু। পুরুষ-মজানি মেয়েমানুষকে কি করে শায়েস্তা করতে হয় আমার জানা আছে।
মেজবাবু বিচলিত হলেন।
আঃ, কী যা-তা বলছ? ভদ্রঘরের মেয়েছেলে, বলতে গেলে আমার মেয়ের বয়সী, এসব কী কথা! ছি ছি!
বড়গিন্নী চাপা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ইল্লি মারি গুরু গোঁসাই! কত ছলাই জানো! মেয়ের বয়সী মেয়েমানুষ আর কখনো দেখি নি আমি! যাও যাও, যেখানের মানুষ সেখানে যাও। সুহাসকে আমি কোথাও পাঠাব না, ব্যস।
মেজকর্তা নিরুপায় ভঙ্গীতে বলেন, কিন্তু আমি যে কথা দিয়েছি। আমার কথাটার একটা দাম আছে তো?
ওঃ! আর আমার কথার দাম নেই, কেমন?
কী মুশকিল! সে কথা কে বলছে-, মেজকর্তা কূট-কৌশল ধরেন, আমি বলছি ও তোমার যখন বিনি চেষ্টায় আপদ বিদেয় হচ্ছে হতে দাও! জানই তো গলায়-দড়ি-মড়ার সদ্গতি হয় না? আর পৃথিবীতে যার প্রতি বেশী টান ছিল, তার ধারে কাছে ঘুরে ঘুরে আসে। ওই মেয়েটা তো ওর একটাই সন্তান, অবিশ্যিই টান ছিল খুব।
বড়গিন্নী শিউরে রামনাম করে উঠলেন।
খুব!
খুব বললে আর কতটুকু বলা হয়? সন্তানে এত আকর্ষণ দত্তগিন্নী অন্তত দেখেন নি কখনো। যাক আর কাঠ-খড় পোড়াতে হল না, ওই এক মশালেই কার্যসিদ্ধি হয়ে গেল মেজবাবুর। সুহাসিনী শত অনিচ্ছে নিয়ে সত্যর সংসারে এসে উঠল।
.
অনিচ্ছে সকলেরই।
নবকুমারের তো মোল আনাই অনিচ্ছে, সত্যরও আগের সেই বেশ একটি মধুর কর্তব্যের আনন্দ রইল না আর। নেহাতই নীরস কর্তব্যের দায়ে ঘরে আনল তাকে। বাক্যদত্ত হয়েছিল শঙ্করীর কাছে তাই।
তা এসব তো সেই বছর চারেক আগের কথা।
এখন তো বেথুন স্কুলে তিন ক্লাস পড়া হয়ে গেল সুহাসিনীর।
স্কুলে সুবিধের জন্যেই হোক আর দত্তবাড়ির আওতা-মুক্ত হতেই হোক, মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটের সেই বাড়ি ছেড়ে বাগবাজারে উঠে এসেছিল সত্য। এ বাড়িতে ভাড়া বেশী, অসুবিধের ঢের, তবে পরম লাভ গঙ্গা খুব নিকটে। নিত্য গঙ্গাস্নানের পুণ্য অর্জন হয়।
আর?
আরও একটা আকর্ষণ আছে, যে খবর নবকুমারের অজ্ঞাত। নবকুমারের অজানিতেই দুপুবেলা একটা জায়গায় আনাগোনা শুরু করেছে সত্য।
যাক, সে তো নবকুমারের অজানিতেই, তার জন্যে নবকুমারের সুখ-দুঃখ নেই, মোটামুটি সুখেই তো থাকবার কথা তার। কারণ বাড়ির ভাড়া যেমন বেড়েছে, তেমনি অফিসের মাইনেও তার বেড়েছে অনেক। ছেলে দুটি প্রত্যেক বছর ফার্স্ট সেকেণ্ড হয়ে ক্লাসে উঠেছে, একজন পাস দিয়েছে। সত্যর অটুট স্বাস্থ্য আর অপরিসীম কর্মক্ষমতা সংসারটিকে একখানি নিটোল মুক্তোর মত করে রেখেছে।
দেশের বাড়িতে মা-বাপও আছেন ভাল।
নিতাইটারও মতিগতি ফিরেছে বলা চলে। আর কি চাইবার আছে?
ছিল না।
চাইবার আর কিছু ছিল না, কিন্তু হঠাৎ ভয়ানক লোকসান ঘটে গেল।
হ্যাঁ, হঠাৎই। আর যা হয়েছে তার চারা নেই।
বিনা মেঘে বজ্রাঘাত ঘটেছে নবকুমারের, ষোলো সুখে বিষাদ!
ভবতোষ মাস্টার ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছেন!
পতিত হয়েছেন।